উমর ফারুক (রা)-এর চরিত্র বৈশিষ্ট্য
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স) স্বীয় জীবনের অকৃত্রিম সাধনার ফলে এক পূর্ণাঙ্গ আদর্শবাদী ও উন্নত চরিত্রবিশিষ্ট সমাজ গঠন করিয়াছিলেন। তাঁহার গঠিত সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিই আদর্শবাদী ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়া ছিল পর্বত-শৃংগের মত উন্নত, অন্যায় ও বাতিলের সম্মুখে অনমনীয় এবং বিরুদ্ধবাদীদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত দুর্জয় ও দুর্ভেদ্য। প্রায় সকল সাহাবী সম্পর্কেই এই কথা পূর্ণ মাত্রায় সত্য ও প্রযোজ্য। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইহা অনস্বীকার্য যে কোমলতা, কঠোরতা, বিনয়,নম্রতা এবং সহিষ্ণুতার দিক দিয়া তাঁহাদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। এই পার্থক্য স্বভাবগত তারতম্যের কারণে এক বাস্তব সত্যরূপে স্বীকৃত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যখন হযরত উমর ফারুক (রা)-এর ব্যক্তি চরিত্র পর্যালোচনা করি, তখন আমাদের সম্মুখে এক অসাধারণ লৌহ-মানবের বিস্ময়কর ভাবমূর্তি সমুদ্ভাসিত হইয়া উঠে। বস্তুত হযরত উমর (রা) ইসলামী সমাজে এক অপরিসীম বীর্যবান, তেজোময়, নির্ভীক ও অনমনীয় ব্যক্তিত্তের অত্যুজ্জ্বল আদর্শ সংস্থাপন করিয়াছেন। ইসলামী খিলাফতের বিশাল আকাশে তিনি এক দেদীপ্যমান চন্দ্রের সমতুল্য। খিলাফতের ময়দানে তাঁহার ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সমুন্নত।
উমর চরিত্রের এই বলিষ্ঠতা তাঁহার জীবনের প্রথমকাল হইতেই পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম-পূর্ব যুগের সমাজে তিনি এক অসামান্য বীর-পুরুষ রুপেই পরিচিত ছিলেন। তিনি যখন সাতাইশ বৎসরের এক উদীয়মান বীর যুবক, ঠিক তখনি আরবের মরুবক্ষে ইসলাম-সূর্যের অভ্যুদয় ঘটে। মক্কার পর্বতচূড়া হইতে দিক প্রকম্পক তওহীদ বানী ধ্বনিত হয়। উমর ফারুকের নিকট এই ধ্বনি ছিল সম্পূর্ণ অভিনব ও অপরিচিত। তিনি ইহা শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠেন। ফলে যাহার সম্পর্কেই তিনি ইসলাম কবুল করার খবর পাইতেন, তিনি তাহারই প্রচণ্ড শত্রু হইয়া দাঁড়াইতেন। তাঁহার বংশেরই একটি ক্রীতদাসী ইসলাম কবুল করিলে তাহাকে তিনি অবিশ্বাস্য রকমে প্রহার করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত আর যাহার সম্পর্কেই তিনি ইসলাম কবুল করার সংবাদ পাইতেন, তাঁহাকেই তিনি নাস্তানাবুদ করার জন্য দৃপ্ত পদক্ষেপে অগ্রসর হইতেন। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এত আঘাত করিয়াও তিনি একটি মাত্র লোককেও ইসলাম ত্যাগে প্রস্তুত করিতে পারনে নাই। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বয়ং বিশ্বনবীকেই খতম করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। একদা তীক্ষ্ণ শানিত কৃপাণ স্কন্ধে ঝুলাইয়া দৃপ্ত পদক্ষেপে তিনি সেই উদ্দেশ্যেই যাত্রা করিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে যখনি তিনি শুনিতে পাইলেন যে, তাঁহারই আপন ভগ্নি ও ভগ্নিপতি ইসলাম কবুল করিয়াছেন, তখন তাঁহার উপর যেন বজ্রপাত হইল। তিনি তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া গিয়া ভগ্নী ও ভগ্নীপতিকে এতই প্রহার করেন যে, তাঁহাদের দেহ হইতে রক্তের অবরল ধারা প্রবাহিত হইতে শুরু করে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তাঁহাদের দিলে ইসলামের প্রতি ঈমানের একবিন্দু দুর্বলতা দেখা দেয় নাই। উপরন্তু তাঁহারা উমর ফারুককে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ “তোমার মনে যাহা আসে কর। কিন্তু আমাদের দিল হইতে ইসলামের প্রতি ঈমানের অত্যুজ্জ্বল দীপমশাল নির্বাপিত করা তোমার সাধ্যাতীত”।
নওমুসলিমদের এই অনমনীয়তা দর্শনে উমর ফারুক (রা) বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া পড়েন। কি কারণে ইহারা ইসলামের জন্য এতদূর আত্মহারা ও উৎসর্গীকৃতপ্রাণ হয় এবং কোন পরশপাথরের ছোঁয়ায় একজন অসভ্য নাফরমান লোক মানুষ পদবাচ্য হইয়া উঠে তাহা ভাবিয়া তিনি দিশাহারা হইয়া যান। শেষ পর্যন্ত তিনিও ইসলামের সুদৃঢ় নীতি-দর্শনের সম্মুখে মস্তক অবনত করিতে বাধ্য হন। তাঁহার ন্যায় একজন অসামান্য বীর-পুরুষের ইসলাম গ্রহণে তদানীন্তন আরবের দুই পরস্পর বিরোধ সমাজেই দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কাফির সমাজ যেমন আশ্চার্যািন্বত হয় তেমনি হয় হতাশাগ্রস্ত; পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র পরিসরের ইসলামী সমাজে উৎসাহ উদ্দীপনার এক যৌবন জোয়ার পরিলক্ষিত হয়, তখন মুসলমানরা ছিলেন অতিশয় দুর্বল, শক্তিহীন ও অসহায়। প্রকাশ্যভাবে ইসলামী জিন্দেগী যাপন ও জরুরী অনুষ্ঠানাদি পালন তো দূরের কথা, নিজদিগকে মুসলিমরূপে ব্যক্ত করাও তাঁহাদের পক্ষে কঠিন বিপদের কারণ হইয়া পড়িয়াছিল। বিশেষতঃতাহাদের পক্ষে আল্লাহ্র ঘরে আল্লাহ্র বন্দেগী করা তো ছিল একেবারে অসম্ভব। হযরত উমর (রা)-এর ন্যায় নির্ভীক বীর পুরুষের ইসলাম গ্রহণে সহসা অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তিনি নিজেই মুসলিম হওয়ার কথা রাষ্ট্র করিয়া দিলে কাফির সমাজ তাঁহার প্রতি অত্যন্ত বিরুপ ও ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে। তাঁহার মামা প্রভাবশালী কাফির নেতা আস বিন ওয়ায়েল তাঁহাকে আশ্রয় দিতে চাহিলে তিনি তাঁহার স্বভাবসুলভ তেজস্বীতা ও বীর্যবত্তার দরুণ তাহার আশ্রয় গ্রহন করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কেননা ইসলামের বিপ্লবী কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র উপর বিশ্বাস স্থাপনের পর কোন কাফির ব্যক্তি বা শক্তির আশ্রয় গ্রহন করা, কোন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে মোটেই শোভন ব্যাপার নহে। উপরন্তু তিনি মুসলিমদের সমভিব্যহারে কা’বা ঘরে গিয়াই নামায আদায় করেন। মূলত বীর উমরের সাহসিকতার বলেই এই কাজটি সম্ভব হইয়াছিল। এইজন্য নবুয়্যাতের দরবারে তিনি ফারুক (হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত হন।
হযরত উমর (রা) ইসলাম গ্রহণের পর হিজরাত পর্যন্ত মক্কা শরীফে প্রায় ছয়-সাত বৎসরকাল অবস্থান করেন। এই সময় কাফিরদের তরফ হইতে মুসলিমদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার ও জুলুম-নিষ্পেষণ সংগঠিত হয়, অন্যান্যদের সঙ্গে হযরত উমর (রা) ও তাহা অবলীলাক্রমে সহ্য করিয়াছেন। বস্তুত ইসলামের জন্য অতুলনীয় আত্মোৎসর্গিতা,অপূর্ব নৈতিক দৃঢ়তা ও চারিত্রিক অনমনীয়তা না থাকিলে কাফিরদের পৈশাচিক নির্যাতনের যাতাকলে নিষ্পিষ্ট হইয়াও ঈমানকে বাঁচাইয়া রাখা তদানীন্তন মুসলিমদের পক্ষে বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল।
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের ময়দানে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে হযরত উমর (রা)যে সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি,আত্মোৎসর্গী ভাবধারা ও অনমনীয় দৃঢ়তা প্রদর্শন করেন, ইসলামের ইতিহাসে তাহা উজ্জ্বল অক্ষরে লিখিত। ইসলামের জন্য তিনি অতি বড় নিকটাত্মীয়কেও একবিন্দু ক্ষমা করিতে প্রস্তুত হন নাই। যুদ্ধের ময়দানে তাঁহার মামা ‘আস তাঁহার নিজ তরবারীর আঘাতেই নিহত হয়। এই পরম আত্মীয়ের বক্ষে অস্ত্র বিদ্ধ করিতেও তিনি কিছু মাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন নাই। ইসলামের জন্য এই আত্মত্যাগ বস্তুতঃই তুলনাহীন।
বদর যুদ্ধে মুসলিমরা গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জন করে এবং ইহাতে কম-বেশী সত্তর জন কাফির সরদার মুসলিমদের হস্তে বন্দি হয়। ইহাদের সহিত কিরুপ ব্যবহার করা হইবে, তাহা লইয়া আলোচনা শুরু হইলে হযরত উমর ফারুক (রা) স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করিয়া বলিলেনঃ “ইহাদের হত্যা করাই বাঞ্ছনীয় এবং আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ আত্মীয়কে নিজ হস্তে যবেহ করা কর্তব্য”।
ষষ্ট হিজরী সনে চৌদ্দ শত মুসলিম সমভিব্যাহারে নবী করীম (স) হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রা করেন। যুলহুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছিয়া তিনি জানিতে পারেন যে, মক্কার কুরাইশগন এই বৎসর মুসলিমদিগকে কিছুতেই নগরীতে প্রবেশ করিতে দিবে না। এই পরিস্থিতিতে হযরত উসমান (রা) কে শহীদ করিয়া ফেলার সংবাদ ছড়াইয়া পড়ে। এই সময় নবী করীম (স) সাহাবীদের নিকট হইতে আত্মোৎসর্গের ‘বায়’আত’ গ্রহন করেন। হযরত উমর (রা) ইহাতে অগ্রবর্তী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কুরাইশদের সহিত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হইলে উহার একটি শর্ত উমর ফারুক (রা)-এর নিকট সুস্পষ্টরূপে অগ্রহণযোগ্য মনে হয় এবং তাঁহার প্রখর আত্মসম্মানবোধ সাহসিক প্রকৃতিতে প্রচণ্ড আঘাত হানে। তিনি অনতি-বিলম্বে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইয়া আরজ করিলেনঃ “আমরা যখন বাস্তবিকই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তখন বাতিলের সহিত এত নম্র ও নত হইয়া সন্ধি করার প্রয়োজন কি?”
মক্কা বিজয়ের বৎসরই হুনাইন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হযরত উমর (রা) এই যুদ্ধে অত্যন্ত দৃঢ়তা সহকারে লড়াই করেন। নবম হিজরীতে যখন রোমান সম্রাটের মদীনা আক্রমণের সংবাদ ছড়াইয়া পড়ে, তখন নবী করীম (স)-এর আবেদনক্রমে হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার মোট সম্পত্তির অর্ধেক আনিয়া রাসূলের খেদমতে পেশ করেন।
বিশ্বনবীর ইন্তেকালের সংবাদ পাইয়া গোটা মুসলিম সমাজ প্রচণ্ড মর্ম জ্বালায় ভাঙ্গিয়া পড়ার উপক্রম হয়। এদিকে কুটিল চরিত্রের মুনাফিকগন সুযোগ বুঝিয়া কোন মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য চেষ্টিত হইতে পারে মনে করিয়া হযরত উমর ফারুক (রা) মসজিদে নববীতে দাঁড়াইয়া ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করিতে শুরু করেনঃ “যে বলিবে বিশনবী ইন্তেকাল করিয়াছেন, তাঁহার গর্দান উড়াইয়া দেওয়া হইবে”। বস্তুত ইহা ছিল হযরত উমর (রা)-এর সহজাত তেজোবীর্যেরই বাস্তব অভিব্যাক্তি মাত্র।
হযরত উমর (রা)-এর চরিত্রে যে তেজস্বিনী ও অনমনীয় ভাবধারা পূর্বাপর পরিলক্ষিত হয় কোন কোন সাহাবার উপর ইহার কিছুটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যখন জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হইয়া পরবর্তী খলীফা নিয়োগের চিন্তায় অধীর হইয়া পড়েন, তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে হযরত উমর (রা)কে এই পদে অভিষিক্ত করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। তিনি তাঁহার জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে, তাঁহার অন্তর্ধানের পর উমর ফারুক (রা)-ই হইতেছেন খিলাফতের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা)-এর নিকট যখন তাহার এই মত প্রকাশ করিলেন, তখন তিনি বলিলেনঃ ‘উমর ফারুক সম্পর্কে আপনার যে মত, আল্লাহ্র শপথ তিনি তাহা হইতেও উত্তম। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই যে, তাঁহার প্রকৃতিতে তীব্রতা ও কঠোরতা অত্যন্ত বেশী’।(তাবারী) ইহার উত্তরে হযরত আবূ বকর (রা) বলিলেনঃ “ইহার কারণ এই যে, আমার মধ্যে ছিল অত্যধিক নম্রতা ও বিনয়। কিন্তু তাঁহার নিজের উপরই যখন দায়িত্ব অর্পিত হইবে, তখন তিনি তাঁহার অনেক অভ্যাস ও স্বভাবই পরিত্যাগ করিবেন। হে আবূ মুহাম্মাদ! আমার অভিজ্ঞতা এই যে, আমি কাহারো প্রতি ক্রুদ্ধ হইলে আমার ক্রোধাগ্নি নির্বাপিত করার জন্য উমরই চেষ্টিত হইতেন ও আমাকে নম্র ভাব অবলম্বনের পরামর্শ দিতেন’। (আল-ইসলাম অল-হিযারাতুল আরাবিয়া)।
হযরত উমর ফারুক (রা)-এর কঠোর প্রকৃতি সম্পর্কে হযরত আবূ বকর (রা)-কে জনগণের নিকটও জওয়াবদিহি করিতে হইয়াছে। তাঁহার পরবর্তী খলীফা সম্পর্কে তাঁহার মত যখন জনগণের মধ্যে প্রচারিত হইয়া পড়ে, তখন কিছু সংখ্যক লোক আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেঃ “উমরের মত কঠোর প্রকৃতির ব্যক্তিকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করিলে আল্লাহ্র নিকট পৌঁছিয়া আপনি কি জবাব দিবেন?” হযরত আবূ বকর (রা) তাহাদের ভুল মতের অত্যন্ত সূক্ষ্ম পন্থায় প্রতিবাদ করিয়া বলিলেনঃ “আমি আল্লাহ্র সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিব যে, পরবর্তী উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই আমি খলীফা হিসাবে পছন্দ করিয়াছি”।
বস্তুতঃনবী করীম (স)-এর দরবারে হযরত আবূ বকর (রা)-এর যে মর্যাদা ছিল, হযরত আবূ বকর (রা)-এর দরবারে অনুরূপ মর্যাদা ছিল হযরত উমর ফারুক (রা)-এর। (মুকদ্দমা ইবনে খালদুন ২০৬ পৃঃ) এইজন্য হযরত আবূ বকর (রা)-এর উপরোল্লিখিত উক্তি সম্পূর্ণ সত্য।
হযরত উমর (রা) খলীফা পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর সর্বপ্রথম যে বাণী তাঁহার কণ্ঠনিঃসৃত হইয়া মুসলিম জনগণের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে তাহা এইঃ ‘আরবগণ, রশি-বাঁধা উষ্ট্রের ন্যায় চালকের পশ্চাতে পশ্চাতে চলাই তোমাদের ধর্ম। কিন্তু চালক কোথায় কিভাবে লইয়া যায়, তাহাই লক্ষণীয়। তবে আমার সম্পর্কে বলিতে পারি-কা’বা ঘরের আল্লাহ্র কসম, আমি তোমাদিগকে অবশ্যই সঠিক পথে আনিয়া ছাড়িব’।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর দাফন কার্য সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পরই তিনি নিজ হস্ত হইতে মৃত্তিকা ঝাড়িয়া ফেলিয়া ভাষণ দানের জন্য দণ্ডায়মান হইলেন। সমবেত ইসলামী জনতাকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেনঃ
মুসলিম জনতা! আল্লাহ্ তোমাদিগকে ও আমাকে এক সাথে শামিল করিয়া দিয়াছেন। আর আমার প্রাক্তন দুই সঙ্গীর পর আমাকে জিন্দাহ ও অবশিষ্ট রাখিয়াছেন। আল্লাহ্ শপথ, আমার সম্মুখে যে সকল ব্যাপার উপস্থাপিত হইবে, তাহা সবই আমি মীমাংসা করিব। আর যাহা কিছু আমার অগোচরে থাকিয়া যাইবে, সেই বিষয়ে আমি পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞান ও আল্লাহপরস্তি সহকারে চেষ্টা করিব। বস্তুতঃলোকেরা যদি আমার প্রতি ইহসান ও কল্যাণের আচরণ গ্রহন করে, আমিও তাহাদের সহিত অনুরূপ ব্যবহারই করিব। কিন্তু যদি কেহ খারাপ ও অবাঞ্ছনীয় আচরণ অবলম্বন করে, তাহা হইলে আমিও তাহাকে কঠোর শাস্তি দান করিব’।
হযরত উমর (রা)-এর এই নীতি-নির্ধারণী ভাষণই ছিল তাঁহার খিলাফতের কার্যসম্পাদনের দিক-নির্দেশিকা। অভিজ্ঞ লোকদের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, তিনি আগা-গোড়া তাঁহার এই কথা অনুযায়ীই কাজ করিয়াছেন। ইহার এক বিন্দু কমও করেন নাই, বেশীও করেন নাই।
হযরত উমর (রা) নিজেই আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করিতেনঃ
********(আরবী)
হে আল্লাহ্, আমি স্বভাবতই কঠোর প্রকৃতির লোক, আমাকে নম্র ও আর্দ্র করিয়া দাও। আমি দুর্বল, আমাকে শক্তি দান কর। আমি কৃপণ, আমাকে দানশীল বানাইয়া দাও। (আল ইসলাম অল-হিযারাতুল আরাবিয়া)
হযরত উমর (রা) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর ইরাক অভিযানকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রেরণে উদ্যোগী হন। এই উদ্দেশ্য প্রকাশ্য জনসভায় উপর্যুপরি কয়েকদিন পর্যন্ত আবেদন করার পরও তিনি এক মর্মস্পর্শী ও উদ্দীপনাময় ভাষণ দান করে। উহার ফলে মুসলিম জনতা দলে দলে জিহাদে যোগদানের জন্য প্রস্তুত হয়। এই অব্যাহত সংগ্রামধারার শেষ পর্যায়ে ইরানের সঙ্গে মুসলমানদের প্রকাশ্য সংঘর্ষ ঘটে। কিন্তু মুসলিমগণ ইহাতে পরাজিত হন ও নয় সহস্র সৈনিকের মধ্যে মাত্র তিন সহস্র অবশিষ্ট থাকে। এই পরাজয়ের সংবাদ পাইয়া হযরত উমর ফারুক বেজায় অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হন। তখন তিনি ইসলামের জন্য আত্মদানের আহবান জানাইয়া যে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন, আরব গোত্রসমূহের মধ্যে তাহা অগ্নুৎগীরণের সৃষ্টি করে। এমন কি অসংখ্য খৃস্টান নাগরিকও এই যুদ্ধে মুসলিমদের সহিত সংগ্রাম ক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িতে প্রস্তুত হয়।
হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফতকালে ইসলামের অপূর্ব বিজয় সাধিত হয়। মিশর, সিরিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া, ইরান, ফিলিস্তিন, আজারবাইজান,আলজিরিয়া ও ত্রিপলিতে এই সময় ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়। বস্তুতঃইহার পূর্বে যেমন এরূপ দেশ জয়ের কোন দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় নাই, তেমনি ইহার পরেও নয়। তাঁহার নিক্ষিপ্ত কোন তীরই লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয় নাই। তাঁহার উন্নত করা কোন ঝাণ্ডাই কখনো অবনমিত হয় নাই।
মুসলিমদের জীবন ছিল তাঁহার নিকট সর্বাধিক প্রিয় বস্তু। তিনি এমন সব লোককে সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করিতেন, সমসাময়িক সমাজে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় যাঁহাদের বিশেষ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ‘নেহাওন্দ’ যুদ্ধে তিনি নু’মান বিন মাকরানকে লিখিয়াছিলেনঃ
আমি জানিতে পারিয়াছি যে, নেহাওন্দ শহরে অমুসলিম দুশমনগণ তোমাদের সহিত সংঘর্ষ বাধাইবার জন্য দলে দলে সমবেত হইতেছে। আমার এই চিঠি পাওয়া মাত্রই তোমার নিকটবর্তী মুসলিমগণকে লইয়া আল্লাহ্র আদেশ, সাহায্য ও রহমতের ছায়ায় যাত্রা করিবে। তাহাদিগকে বন্ধুর ও দুর্গম পথে লইয়া যাইবে না। কেননা উহাতে তাহাদের বিশেষ কষ্ট হইবে। তাহাদের সঙ্গত কোন অধিকারেই হস্তক্ষেপ করিবে না। অন্যথায় তাহারা অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ হইবে। তাহাদিগকে লইয়া নিবিড় অরণ্য পথেও প্রবেশ করিবে না। জানিয়া রাখিও,একজন মুসলিম ব্যক্তি এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা অপেক্ষাও আমার নিকট অধিকতর প্রিয় ও মূল্যবান।
তিনি এই অভূতপূর্ব দেশ জয়ের অভিযানে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য বিভিন্ন যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্য প্রেরণ করিয়াছেন; কিন্তু যুদ্ধে কোন সিপাহী কিংবা সিপাহসালারের শাহাদাতের সংবাদ পাইলে তাঁহার দুই চক্ষুকটোর হইতে অবিশ্রান্ত ধারায় মর্মব্যথার তপ্ত অশ্রু বিগলিত হইয়া দরদর বেগে প্রবাহিত হইত, এমন কি সেই সঙ্গে কোন বিরাট দেশ জয়ের শুভ সংবাদ শুনাইলেও তাহা বারণ মানিত না।
হযরত উমর (রা) তাঁহার পূর্ববর্তী দুই মহান ব্যক্তির (রাসূলে করীম ও আবূ বকর সিদ্দীক)-এর মতই ন্যায়পরায়ণতা ও সততার নিশানবরদার ছিলেন। তাঁহার কণ্ঠনিঃসৃত বানীও ছিল তাঁহাদেরই অনুরূপ। বিদ্রোহী কুর্দজাতিকে দমন করার উদ্দেশ্য তিনি মুসলিমা আশজায়ীকে যখন প্রেরণ করেন, তখন তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলেনঃ
আল্লাহ্র নাম লইয়া রওয়ানা হইয়া যাও এবং আল্লাহ্র পথে আল্লাহ্দ্রোহী লোকদের সহিত পূর্ণ শক্তিতে লড়াই কর। তোমাদের মুশরিক ভাইদের সহিত সম্মুখ-সমর সংঘটিত হইতে থাকিলে প্রথমে তাহাদের নিকট তিনটি প্রস্তাব পেশ কর। তাহাদিগকে ইসলাম কবুল করার দাওয়াত দাও। তাহারা ইসলাম কবুল করিলে ও অস্ত্রসংবরণ করিয়া নিজেদের ঘরে বসিয়া থাকিতে প্রস্তুত হইলে তাহাদের ধনসম্পদ হইতে যাকাত আদায় করা তোমাদের কর্তব্য। তাহারা তোমাদের সহিত মিলিত হইয়া কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করিতে প্রস্তুত হইলে তাহাদের ও তোমাদের অধিকার ও মর্যাদা সমান হইবে। কিন্তু তাহারা যদি ইসলাম কবুল করিতে অস্বীকার করে,তবে তাহাদের নিকট আনুগত্য ও খারাজ প্রদানের দাবি জানাও। কিন্তু তাহাদের শক্তি-সামর্থের অধিক কোন বোঝা তাহাদের উপর চাপাইয়া দিওনা। খারাজ দিতে প্রস্তুত না হইলে তাহাদের সহিত লড়াই কর। আল্লাহ্ তাহাদের বিরুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করিবেন।
হযরত উমর ফারুক (রা) প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও বিভিন্ন বিভাগীয় সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র আরামপ্রিয়তা, বিলাসিতা ও জাঁকজমক বরদাশত করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি শাসক ও শাসিতের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য ও সমতা রক্ষার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেন। অনারবদের বিলাসী সভ্যতা ও উচ্ছৃখল চরিত্র যেন তাহাদিগকে স্পর্শ করিতে না পারে, সেজন্য তাঁহার সংরক্ষণমূলক প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। শাসনকর্তা হযরত উৎবা বিন ফরকাদ (রা)- কে তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেনঃ বিলাসিতা, জাকঁজমক, সুখসম্ভোগ, মুশরিকী আচার ও রীতিনীতি এবং রেশমী বস্ত্র পরিহার করিয়া চলিবে।
নবনিযুক্ত শাসনকর্তাদের নিকট হইতে তিনি এই মর্মে প্রতিশ্রুতি গ্রহন করিতেন যে, তুর্কি ঘোড়ায় আরোহণ করিবে না, (কেননা ইহা তখনকার সময় চরম বিলাসিতারুপে বিবেচিত হইত), দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করিবে না, অভাবগ্রস্ত ও প্রয়োজনশীল লোকদের জন্য দ্বার সতত উন্মুক্ত ও অবাধ রাখিবে। কেহ ইহার বিরুদ্ধাচরণ করিলে তিনি অনতিবিলম্বে তাহাকে পদচ্যুত করিতেন।
হযরত সায়াদ কুফা নগরে এক বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। হযরত উমর (রা) উহাকে অগ্নি-সংযোগ করিয়া ভস্ম করিয়া ফেলেন। মিশরে হযরত খারেজা বিন হাজাফা এক বালাখানা তৈয়ার করেন। সংবাদ পাইয়া হযরত উমর (রা) উহাকে ধ্বংস করার নির্দেশ পাঠান। কেননা অন্যান্য অবৈধতা ছাড়াও উহার ফলে প্রতিবেশীর পর্দা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিয়াছিল।(কিতাবুল খারাজ)
হজ্জের সময় মক্কা শরীফে উপস্থিত হইয়া উমর ফারুক (রা)শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ থাকিলে তাহা সরাসরি তাঁহার নিকট পেশ করার আহবান জানাইয়া সাধারণ ঘোষণা প্রকাশ করিতেন। এক ব্যক্তি কোন শাসনকর্তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করিল যে, সে তাহাকে অকারণ একশত চাবুকের আঘাত দিয়াছে। উত্তরে তিনি বলিলেন, সংশ্লিষ্ট শাসনকর্তাকে তুমি একশত চাবুক মারিবে।বস্তুত ইহা যে কত বড় কঠিন ফয়সালা, তাহা সহজেই অনুমেয়। সংশ্লিষ্ট শাসনকর্তা ইহাতে শিহরিয়া উঠিল। সে দাঁড়াইয়া বলিলঃ ‘এইরূপ করিলে শাসনকর্তার মর্যাদা নষ্ট হইবে ও শাসনকার্য অচল হইয়া যাইবে’। হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ “তৎসত্ত্বেও এইরুপ সুবিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন অপরিহার্য কেননা স্বয়ং নবী করীম (স) এইরূপই করিয়াছেন’।
হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা) কোন জাতীয় ও সামগ্রিক প্রয়োজন ব্যতীতই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিয়াছেন জানিতে পারিয়া হযরত উমর (রা)তাঁহাকে পদচ্যুত করার ফরমান প্রেরণ করেন। তিনি বলেনঃ “খালিদ এই অর্থ নিজ হইতে ব্যয় করিলে নিঃসন্দেহে অর্থের অপচয় করিয়াছেন আর বায়তুলমালের অর্থ ব্যয় করিয়া থাকিলে অনধিকার চর্চা ও আমানতে খিয়ানত করিয়াছেন”।
হযরত উমর (রা) পূর্ববর্তী মহান ব্যক্তিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই খিলাফতের কার্য সম্পাদন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ “আমার দুই সাথী ইতিপূর্বে অতীত হইয়াছেন। একই পথ ও পন্থাই তাঁহারা অবলম্বন করিয়াছিলেন। আমি তাঁহাদের বিপরীত কাজ করিলে তো আমার পক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হইবে”। বস্তুতঃ ইহা বিশ্বনবীর এই কথারই প্রতিধ্বনি মনে হয়ঃ ‘আমার পর কেহ নবী হইলে উমরই হইতেন সেই নবী’।
উমর ফারুক (রা)-এর চরিত্রে যে কঠোরতা ও অনমনীয় ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়, স্বয়ং নবী করীম (স)-ই ইহার সঠিক ব্যাখ্যা দান করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ ‘আল্লাহ্র কার্যসমূহে উমর যত শক্ত ও কঠোর, আমার উম্মতের মধ্যে তত আর কেহ নয়’।
অপর একজন বলেন, ‘উমর সত্যের জন্য দানশীল; কিন্তু অন্যায় ও বাতিলের জন্য হাড়ে হাড়ে কৃপণ’।
বস্তুত হযরত উমর (রা) প্রকৃতির অন্ধ দাস ছিলনে না; তিনি কোন ব্যাপারে নিছক প্রকৃতিগত কঠোরতার দরুণই কঠোরতা অবলম্বন করিতেন, একথা কিছুমাত্র সত্য নহে; বরং কঠোরতা ও কোমলতা সম্পর্কে তাঁহার ধারণা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল, এ ব্যাপারে তাহার মন ও মগজ ছিল সর্বদা জাগ্রত। তাই তিনি নিজেই স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ
খিলাফতের কার্য যথাযথরূপে সম্পন্ন হইতে পারেনা যতক্ষণ না এমন কঠোরতা অবলম্বন করা হইবে, যাহা জুলুমের পর্যায় গিয়া পৌঁছায় না। এমন বিষয়েও নম্রতা অবলম্বিত হওয়া উচিত নহে, যাহার ভিত্তি দুর্বলতার উপর স্থাপিত। (কিতাবুল খারাজ)
আর এই কঠোরতাও ছিল সম্পূর্ণরূপে শরীয়াতের ব্যাপারে-আল্লাহ্র হক ও বান্দাহর হক-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাপারে হযরত উমর (রা) কোন দিনই এক বিন্দু কঠোরতা প্রদর্শন করেন নাই। বরং সে ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মোম অপেক্ষাও দ্রবীভূত ও কোমল। ঠিক এই কথাই জানা যায় উমর ফারুক (রা)-এর নিজের এক ভাষণ হইতে। তিনি প্রসঙ্গত বলিয়াছেনঃ
******(আরবী)
আল্লাহ্র শপথ, আমার দিল আল্লাহ্র ব্যাপারে যখন নরম হয়, তখন পানির ফেনা অপেক্ষাও অধিক নরম ও কোমল হইয়া যায়। আর আল্লাহ্র দ্বীন ও শরীয়াতের ব্যাপারেই (প্রয়োজন মুতাবিক) যখন শক্ত ও কঠোর হয়, তখন তাহা প্রস্তর অপেক্ষাও অধিক শক্ত ও দুর্ভেদ্য হইয়া পড়ে।
বস্তুত খিলাফতের দায়িত্ব সম্পাদনের ব্যপারে হযরত উমর ফারুক (রা) যে কঠোর নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহা রাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিতে ছিল একান্তই অপরিহার্য। হযরত খালিদ ইবনে অলীদকে পদচ্যুতকরণ, শাসনকর্তাদের সহিত কঠোরতা অবলম্বন, ইসলামী বিধান পালনে অত্যন্ত কড়াকড়ি অবলম্বন প্রভৃতি ক্ষেত্রে হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতেরই ন্যায় বিরাট দায়িত্ব পাওনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি যাহা কিছু করিয়াছেন, খলীফা পদের কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্যই করিয়াছেন। কেননা তাহা না করিলে খিলাফতের ন্যায় অতিশয় নাজুক ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কিছুমাত্র পালিত হইতে পারিত না। আর আল্লাহ্ না করুন, হযরত উমরও যদি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করিয়া ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তব নিদর্শন প্রতিষ্ঠা না করিতেন, তাহা হইলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিলুপ্তিই ছিল অবধারিত।
তবে খিলাফতের দায়িত্ব পালনে তাঁহার কঠোরতা, অনমনীয়তা ও ক্ষমাহীনতা উমর চরিত্রের একটি দিকমাত্র। উহারই অপর দিকে হইল দয়া, সহানুভূতি ও ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁহার দৃষ্টান্তহীন অবদান। তদানীন্তন সমাজে আল্লাহ্র বিবেক-সম্পন্ন সৃষ্টিকুলের মধ্যে ক্রীতদাসদের তুলনায় অধিক দয়া ও সহানুভূতি লাভের অধিকারী আর কেহই ছিল না। হযরত উমর ফারুক (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহন করার পরই সমস্ত আরব ক্রীতদাসদের সম্পূর্ণ মুক্ত করিয়া দেন। সেই সঙ্গে তিনি এই মর্মে একটি শাসনতান্ত্রিক বিধানও জারী করেনঃ ‘আরববাসী কখনো কাহারো দাস বা গোলাম হইতে পারে না’। তদানীন্তন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থানুযায়ী সমস্ত অনারব ক্রীতদাসকে মুক্ত করা বড়ই দুরূহ ব্যাপার ছিল। তা সত্ত্বেও তাহাদের পক্ষে কল্যাণকর বহু আইন-বিধান তিনি কার্যকর করেন। এমনকি মনিব-মালিকদের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের জন্যও তিনি সরকারী ভাতা বা বৃত্তি জারী করিয়া দেন।
হযরত উমর (রা) যিম্মী ও অমুসলিমদের সহিত এমন হৃদ্যতাপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণ গ্রহন করিয়াছিলেন, যাহা একালের মুসলমানরাও মুসলমানদের সহিত করেন না। এই ব্যাপারে তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশেষ সচেতন ছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি সাধারণভাবে ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রদর্শনও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করিতেন না।
দ্বিতীয় খলীফা সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজ কেবল সরকারী পর্যায়েই করিতেন, তাহা নয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও মানবতার কল্যাণে সর্বক্ষণ কর্মে নিরত থাকিতেন। জিহাদের ময়দানে গমনকারী মুজাহিদদের বাড়ি বাড়ি গিয়া তিনি তাঁহাদের পরিবারবর্গের খবরাখবর লইতেন। কাহারো কোন প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাহা পূরণের ব্যবস্থা করিয়া দিতেন। কোথাও ভূক্ত লোক দেখিতে পাইলে অনতিবিলম্বে তাহাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিতেন। উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত আমলে ধনী-দরিদ্র, নিঃস্ব ও ধনাঢ্যের মধ্যে পূর্ণ সমতা ও সাম্য স্থাপিত হইয়াছিল। জনগণের মধ্যে একবিন্দু বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শন না করার জন্য দায়িত্বশীল কর্মচারীদের প্রতি তিনি কঠোর নির্দেশ দিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি নিজে কোনরূপ তোষামোদ ও তারীফ-প্রশংসা পছন্দ করিতেন না। মদীনার বিচারালয়ে তিনি বিবাদী হিসাবে উপস্থিত হইলে বিচারপতি খলিফাতুল মুসলেমীনের সম্মানার্থে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ইহা দেখিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ বলিলেনঃ ‘এই মামলায় ইহাই তুমি প্রথম অবিচার করিলে’। খলীফার দাপট ও প্রতাপে তখন গোটা পৃথিবী কম্পমান ছিল; কিন্তু তাঁহার অবলম্বিত সাম্য নীতির ফলে বিদেশী রাষ্ট্রদূতগণ আমিরুল মুমিনীনকে সহসা চিনিয়া লইতে পারিতেন না। তিনি অত্যন্ত তীব্র সম্ভ্রম বোধসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। পর্দাসংক্রান্ত আয়াত নাজিল হওয়ার পূর্বে সাধারণ মুসলিম মহিলারা তো বটেই,নবী করীম (স)-এর বেগমগণও পর্দা পালন করিতেন না। কিন্তু এই পর্দাহীনতা ও মহিলাদের অবাধ চলাফিরাকে তিনি তখনও পছন্দ করিতে পারিতেন না।
ফারুকী চরিত্রের মৌল ভিত্তি
হযরত উমর ফারুক (রা)-এর সুমহান চারিত্রিক গুণাবলী অত্যন্ত মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। উন্নততম নৈতিক মান প্রতিষ্ঠাকারী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নিবিড় ও ঘনিষ্টতম সাহচর্য হইতেই তিনি এই ভিত্তি অর্জন করিয়াছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন মহৎ গুণাবলীতে বিভূষিত,নবী চরিত্রের বাস্তব প্রতিমূর্তি। তাঁহার চরিত্র-দর্পণে সর্বাধিক মাত্রায় প্রতিফলিত হইয়াছিল একনিষ্ঠতা, আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণ, বৈষয়িক স্বাদ আস্বাদনে অনীহা, জিহ্বা ও মনের সংযম, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যপরায়ণতা, বিনয় ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। এই মহৎ গুণাবলী তাঁহার চরিত্রে এতই দৃঢ় ছিল যে, কোন লোক তাঁহার সংস্পর্শে আসিলে, তাঁহার চরিত্রেও এই গুণাবলী গভীরভাবে রেখাপাত করিত। তাঁহার নিকট হইতে প্রকৃত তাকওয়া পরহেজগারী শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য বহু সাহাবীও অতীব উৎসাহে তাঁহার সংস্পর্শ লাভের জন্য চেষ্টিত হইতেন। স্বয়ং রাসূলে করীম (স) তাহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
*******(আরবী)
আল্লাহ্ ত’আলা উমরের মুখ ও দিলের উপর সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন। তিনি হইলেন হক্ক বাতিলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিধানকারী।
ফারুকী খিলাফত কালের সরকারী পদাধিকারীদের চরিত্রেও ইহার প্রভাব পুরামাত্রায় প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল।
আল্লাহ্ ভীতির তীব্রতা
উমর (রা)-এর চারিত্রিক দৃঢ়তার মূল উৎস ছিল আল্লাহ্র কুদরাত ও শক্তিমত্তার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়। তিনি নিতান্ত বিনয় ও ভীত-সন্ত্রস্ত হৃদয় লইয়া গভীর রাত্র পর্যন্ত নামাযে নিরত থাকিতেন। কুরআনের যে সব আয়াতে আল্লাহ্র মহানত্ত ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পাঠ করিয়া তিনি ভাবাবেগে অত্যন্ত আপ্লুত হইয়া যাইতেন এবং অদম্য কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়িতেন। তাঁহার হৃদয় এতই কোমল ও আর্দ্রতাপূর্ণ ছিল যে, একবার তিনি ফজরের নামাযে সূরা ইউসুফ পড়িতে শুরু করিলে তাঁহার হৃদয় উদ্বেলিত হইয়া উঠিত এবং কাঁদিতে কাঁদিতেই সমগ্র কুরআন শেষ করিয়া রুকূতে যাইতে বাধ্য হইলেন।
কিয়ামত দিবসের পাকড়াওকে তিনি খুব বেশী ভয় পাইতেন। তিনি প্রায়শঃ বলিতেন, কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আযাব হইতে কোনমতে রক্ষা পাইলেও নেকী-বদী সমান-সমান হইলেই আমি নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে করিব। একাবার একটি তৃণখণ্ড হাতে লইয়া তিনি দুঃখ-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেনঃ ‘হায়, আমি যদি এই তৃণখণ্ডের ন্যায় দায়িত্বমুক্ত হইতাম! হায়, আমি যদি ভূমিষ্ঠই না হইতাম! আল্লাহ্র ভয়ে তাঁহার হৃদয়-মন সব সময়ই ভীত-শঙ্কিত হইয়া থাকিত। এইজন্য তিনি প্রায়শঃবলিতেনঃঊর্ধ্বলোক হইতে যদি ঘোষিত হয় যে, দুনিয়ার একজন ছাড়া সমস্ত মানুষই জান্নাতী হইবে, তখনো আমার মনকে এই আশংকা কাতর ও আশংকাগ্রস্ত করিয়া রাখিবে যে, কি জানি, সেই হতভাগ্য ব্যক্তি আমিই না হইয়া পড়ি।
রাসূলের প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য
মন-মানসিকতার পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধি এবং উত্তম ও অকৃত্রিম চারিত্রিক গুন-বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য মহৎ চরিত্রের মৌল উৎস বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা ও তাঁহার সুন্নাত অনুসরণ করিয়া চলার অকৃত্রিম নিষ্ঠা অর্জন একান্তই অপরিহার্য। বস্তুতঃযে দিল রাসূলের প্রতি প্রেমময় নয় এবং যে পদক্ষেপ রাসূলে করীম (স)-এর উত্তম আদর্শানুসারী নয়, তাহা ইহ-পরকালের নিয়ামত লাভে ধন্য হইতে পারে না। হযরত উমর ফারুক (রা) ছিলেন রাসূলের সত্যিকার নিষ্ঠাবান প্রেমিক। তিনি নিজের জান-মাল ও সন্তান-স্বজন অপেক্ষাও অধিক ভালবাসিতেন রাসূলে করীম (স)-কে। এই কারণে তিনি নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের ব্যাপারটিকে সহসা ও সহজভাবে স্বীকার করিয়া নিতে সক্ষম হন নাই।
হযরত উমর (রা) চরিত্রের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল দিক হইল প্রতিপদে রাসূলে করীম (রা)-এর আক্ষরিক অনুসরণ। পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, উঠা-বসা,চলা-ফিরা,কথা-বার্তা প্রভৃতি সর্বকাজে তিনি নবী-আদর্শকে নিষ্ঠার সহিত অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন। রাসূলে করীম (স) অভাব-অনশন ও দারিদ্রের মধ্যে দিয়া জীবন অতিক্রম করিয়াছেন। এই জন্য হযরত উমর (রা) রোম ও পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হইয়াও নিতান্ত দরিদ্রের ন্যায় জীবন অতিবাহিত করিতেন। একবার তাঁহার কন্যা উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রা) বলিয়াছিলেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলা এখন তো স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্য দান করিয়াছেন। কাজেই উত্তম পরিচ্ছদ ও উৎকৃষ্ট খাদ্য গ্রহন হইতে এখন আপনার বিরত থাকা উচিত নয়। জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ ‘রাসূলে করীমের দুঃখ ও দারিদ্র-জর্জরিত জীবনের কথা কি তুমি ভুলিয়া গেলে? আল্লাহ্র শপথ, আমি তো আমার ‘নেতা’কে অনুসরণ করিয়াই চলিব। ………চলিব এই আশায় যে, পরকালে আল্লাহ্ আমাকে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য দান করিবেন’।
রাসূলে করীম (স)-কে তিনি যে কাজ যেভাবে করিতে দেখিয়াছেন, সেই কাজটি ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিতে সব সময়ই চেষ্টিত থাকিতেন। তাঁহার কাজের ধরণ দেখিয়া উহার কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি অকপটে বলিয়া ফেলিতেনঃ “আমি রাসূলে করীম (স)-কে এই কাজটি ঠিক এইভাবে করিতে দেখিয়াছি বলিয়াই আমি ইহা এইভাবে করিলাম”।
দায়িত্বের তীব্র অনুভূতি
হযরত উমর (রা) স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যপারে অত্যন্ত তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। জনগণের সব কিছুর জন্য তিনি নিজেকে দায়ী মনে করিতেন এবং সে দায়িত্ব পালনে যত কষ্টই হউক, তিনি তাহা অকাতরে বরদাশত করিতেন। মুসলিম জনগণ বা রাষ্ট্রের যে সব ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁহার উপর অর্পিত হইত, উহার জন্য তিনি চূড়ান্ত মাত্রায় কষ্ট ও শ্রম সহ্য করিতেন। বায়তুল মালের কোনরূপ ক্ষতি সাধিত হইলে তাহা পূরণ করিতেন এবং কোন কিছু হারাইয়া গেলে তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে যত শ্রমেরই প্রয়োজন হইত, ব্যক্তিগতভাবে তাহা স্বীকার করিতে তিনি একবিন্দু কণ্ঠিত হইতেন না।
হযরত আলী (রা) বলেন, একদা আমি হযরত উমর (রা)-কে উষ্ট্রে সওয়ার হইয়া দ্রুত চলিয়া যাইতে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলামঃ আমীরুল মু’মিনীন, আপনি কোথায় যাইতেছেন?’ জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ ‘যাকাত বাবদ আদায় করা একটি উষ্ট্র হারাইয়া গিয়াছে, উহার খোঁজ করিতে বাহির হইয়াছি’। আমি বলিলামঃ এইরূপ করিয়া আপনি তো আপনার পরবর্তী খলিফাদের জন্য দায়িত্ব পালন অত্যন্ত কঠিন করিয়া দিতেছেন, অর্থাৎ আপনি খিলাফতের দায়িত্ব পালনে এতখানি কষ্ট স্বীকার করিলে আপনার পরে যাহারা খলীফা হইবেন,তাহাদিগকেও অনুরূপ কষ্ট করিতে হইবে। এই শুনিয়া তিনি বলিলেনঃ
*******(আরবী)
হে হাসানের পিতা! আমাকে তিরস্কার করিও না। যে আল্লাহ্ মুহাম্মাদ (স)-কে নবুয়্যাত দান করিয়া পাঠাইয়াছেন, তাঁহার শপথ; ফোরাত নদীর তীরে একটি উষ্ট্রও যদি মরিয়া যায়, তাহা হইলেও কিয়ামতের দিন সেজন্য এই উমরকেই পাকড়াও করা হইবে।
বস্তুতঃ অপরিসীম দায়িত্ববোধ এবং কিয়ামতের জওয়াবদিহির প্রতি অকৃত্রিম ও অবিচল বিশ্বাস থাকিলেই এইরূপ কথা বলা যায় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার জন্য অনুরূপ চেষ্টা ও কষ্ট স্বীকার করা সম্ভব ইহাতে কোনই সন্দেহ নাই।
হযরত উমর (রা) জনগণের প্রকৃত অবস্থা জানিবার জন্য রাত্রিকাল লোকালয়ে চলাফিরা করিতেন। তিনি একই ঘরে পরাপর তিন রাত্রি পর্যন্ত কান্নার ধ্বনি শুনিতে পাইয়াছিলেন। পরে তিনি ঘরে লোকদের ডাকিয়া শিশুর কান্নার কারণ জানিতে চাহিলেন। শিশুর মা বলিলঃ ‘স্তন সেবন বন্ধ না করা পর্যন্ত বায়তুল মাল হইতে শিশুর জন্য বৃত্তি বরাদ্দ করা হইবে না বিধায় অবিলম্বে দুগ্ধপোষ্য শিশুর স্তন সেবন বন্ধ করিতে চেষ্টা করা হইতেছে। শিশুর ইহাই মূল কারণ’।
এই কথা জানিতে পারিয়া অবিলম্বে তিনি ঘোষণা করাইলেনঃ
********(আরবী)
তোমারা শিশুর স্তন পান বন্ধ করার জন্যে তাড়াহুড়া করিও না। অতঃপর আমরা প্রত্যেক মুসলিম সন্তানের জন্যই খাদ্য বরাদ্ধ করিতেছি।
সেই সঙ্গে সমগ্র ইসলামী রাজ্যে এই বিধান অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য তিনি স্পষ্ট নির্দেশ পাঠাইলেন।১ {দায়িত্ববোধের অনন্য দৃষ্টান্তঃএই প্রসঙ্গে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। একদা গভীর নিশিথে খলীফা উমর (রা) ইবনে আব্বাস(রা)-কে সঙ্গে লইয়া মদীনা হইতে দূরবর্তী এক পল্লী এলাকা পরিদর্শনে গেলেন। তাঁহারা একটি মহল্লার ভিতর দিয়া অতিক্রমের সময় পার্শ্ববর্তী জীর্ণ কুটিরের ভিতর হইতে শিশুদের ক্রন্দন-ধ্বনি শুনিতে পাইলেন। তাঁহারা কুটিরের ভিতর উঁকি মারিয়া দেখিলেনঃ এক বৃদ্ধা মহিলা উনুনে পানি ভর্তি হাঁড়ি বসাইয়া আগুন জ্বালাইতেছেন এবং উহার চারিপার্শ্বে বসিয়া শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় ক্রদন করিতেছে। মহিলা কিছুক্ষন থামিয়া থামিয়া শিশুদের প্রবোধ দিতেছেনঃ ‘তোমরা আরেকটু সবুর কর, এক্ষুণি খাবার তৈয়ার হইয়া যাইবে’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাবার আর তৈয়ার হইল না। অনেক্ষন ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ক্লান্ত হইয়া অবশেষে শিশুরা ঘুমাইয়া পড়িল। মহিলাটিও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া স্বগতোক্তি করিলঃ ‘যাক, আজিকার রাত্রের মত অন্ততঃ বাঁচা গেল’। এই মর্মান্তিক অবস্থা দেখিয়া খলীফা উমর (রা) এবং তাঁহার সহচর মহিলাটির মুখামুখি হইলেন তাঁহাদের প্রশ্নের জবাবে মহিলাটি, বলিলেনঃ ‘তাঁহার পরিবারে উপার্জনক্ষম কোন পুরুষ সদস্য নাই; তিনি নিজেও উপার্জন করিয়া শিশুদের মুখে অন্ন যোগাইতে পারিতেছেন না। তাই কয়েকদিন যাবত তিনি উনুনে শুধু পানিভর্তি হাঁড়ি বসাইয়া ক্ষুধার্ত শিশুদের এইভাবে প্রবোধ দিতেছেন’। তাঁহার প্রশ্ন করিয়া আরো জানিতে পারিলেন যে, রাষ্ট্রের বায়তুল মাল হইতে এ পর্যন্ত তাহাদের নিকট কোন খাদ্য-সাহায্য পৌঁছে নাই। এই মর্মভেদী কাহিনী শুনিয়া খলীফা এবং তাহার সহচর দ্রুত মদীনা পৌঁছিয়া বায়তুল মালের গুদামের দরজা খুলিলেন। অতঃপর তিনি নিজেই এক বস্তা ময়দা ও একবস্তা চিনি কাঁধে তুলিয়া দরিদ্র মহিলাটির উদ্দেশে রওয়ানা হইলেন। এই সময় ইবনে আব্বাস (রা) অন্ততঃএকটি বস্তা তাঁহার কাঁধে তুলিয়া দেওয়ার জন্য খলিফাকে অনুরোধ করিলেন। খলীফা উহা দ্বীর্থহীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেনঃ ‘ইবনে আব্বাস! আজ তুমি আমার বোঝা হাল্কা করিবার জন্য আগাইয়া আসিয়াছ;কিন্তু কিয়ামতের দিন যখন দায়িত্ব পালনের যখন দায়িত্ব পালনের এই ব্যর্থতার জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হইবে তখন তো তুমি আমার পাপের বোঝা হাল্কা করিতে আগাইয়া আসিবেনা’। দ্বিতীয় খলীফার দায়িত্ববোধ কত প্রখর ছিল, এই ঘটনা উহার জ্বলন্ত প্রমাণ।– সম্পাদক }
এই মানবিকতা, সহানুভূতি ও পরদুঃখ কাতরতা ইসলামী আদর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্র নায়কদের চরিত্রে প্রকট থাকাই বাঞ্ছনীয়।
হযরত উমর (রা) বস্তুতঃই সমাজের প্রতিটি দুর্বল ও ইয়াতীম ব্যক্তির জন্য স্নেহ-বাৎসল্যপূর্ণ পিতার সমতুল্য ছিলেন। সুবিচার ও ন্যাপরায়নতাই ছিল তাঁহার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতি সমান গুরুত্ত স্বীকার করিতেন। ১ {স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীনতাঃ মানুষের স্বাধীনতা তথা মৌল মানবাধিকার প্রশ্নে হযরত উমর (রা)-এর মনোভাব ছিল আপোষহীন। কোন যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসঙ্গত কারণ ব্যতীত কাহারো স্বাধীনতা এতটুকু ক্ষুণ্ণ করার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। এ ব্যাপারে শাসনকর্তাদের প্রতি ও ছিল তাঁহার কড়াকড়ি নির্দেশ। এতৎসত্ত্বেও একবার খলীফার নিকট মিশরের শাসনকর্তার বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ আসিল যে, তিনি (শাসনকর্তা) কোন যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসম্মত কারণ ছাড়াই নেহায়েত সন্দেহের বশে কতিপয় ব্যক্তিকে কারাগারে আটক করিয়া রাখিয়াছেন।খলীফা অবিলম্বে শাসনকর্তাকে ডাকাইয়া আনিয়া ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। শাসনকর্তা ইহার কোন সদুত্তর দিতে পারিলেন না। তখন খলীফা তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিলেনঃ ‘এই লোকগুলিকে তো ইহাদের মায়েরা স্বাধীনভাবেই প্রসব করিয়াছিল। তুমি ইহাদের পরাধীন করিয়া রাখার অধিকার কোথায় পাইলে?’ বস্তুতঃ জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি এই বলিষ্ঠ নীতিভঙ্গির উপরই খলীফা উমর (রা) অবিচল ছিলেন। ইহা হইতে কেহ তাঁহাকে একবিন্দু টলাইতে পারে নাই।–সম্পাদক}
সমাজের দুর্বল ও মিসকীনদের কাতারে দাঁড়াইয়া তিনি মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করিতেন। কেবল মুসলমানেরা প্রতিই তাঁহার এই নীতি কার্যকর ছিল না। ইসলামী রাজ্যের অনুগত অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিও তিনি বিন্দুমাত্র পার্থক্যবোধ রাখিতেন না। তিনি তাহাদের প্রতি সুবিচারপূর্ণ আচরণ ও ন্যায়নীতি অনুসরণ করার জন্য সকল পর্যায়ের প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশ জারী করিয়াছিলেন। তাহাদের প্রতি সকল প্রকার অন্যায় ও জুলুমমূলক আচরণ পরিহার করার জন্য তিনি তাকীদ করিতেন। এই পর্যায়ে তাঁহার নিজেরই একটি ঐতিহাসিক উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখ্য।তিনি বলিয়াছিলেনঃ
********(আরবী)
আল্লাহ্ তা’আলা আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছেন, তাহার কল্যাণ প্রধানতঃ তিনটি জিনিসের উপর নির্ভরশীল। তাহা হইলঃ আমানত বা বিশ্বস্ততা যথাযথভাবে রক্ষা করা, শক্তি সহকারে উহা ধারণ করা এবং আল্লাহ্র নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী শাসন ও বিচার কার্য সম্পাদন করা।
রাষ্ট্রীয় ধনমাল সম্পর্কে তিনি বলিয়াছিলেনঃ
*******(আরবী)
তোমরা জানিয়া রাখ, এই রাষ্ট্রীয় ধন-মালের কল্যাণ মাত্র তিন প্রকার ব্যবহারে নিহিতঃ উহা গ্রহণ করা হইবে হক্কভাবে- হক্ক অনুসারে, দেওয়া হইবে হক্কভাবে অর্থাৎ হক্ক আদায় স্বরূপ এবং বাতিল পন্থায় গ্রহন বা দান বন্ধ। দুর্বল ঈমানদার লোকের পক্ষে শাসন-বিচারে সুবিচার বাস্তবায়িতকরণই যথেষ্ট।
বিচার কার্যে তিনি সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রস্তুত হইতেন। দুই বিবদমান পক্ষ বিচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে তিনি দুই হাঁটু বিছাইয়া মহান আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করিতেন এই বলিয়াঃ
হে আল্লাহ্, তুমি এই কাজে আমাকে সাহায্য কর। কেননা পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকেই আমাকে আমার দ্বীন হইতে বিভ্রান্ত করিয়া দিতে পারে।–(যদি আমি ন্যায়বিচার না করি)।
ভোগ-বিলাসে অনীহা ও অল্পোতুষ্টি
বৈষয়িক স্বাদ-আস্বাদনের লোভ-লালসাই প্রকৃতপক্ষে অনৈতিকতা চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি সৃষ্টির মূল কারণ। এই জন্য হযরত উমর ফারুক (রা) স্বভাবতঃই উহা ঘৃণা করিতেন।তাঁহার সমসাময়িক লোকেরা একবাক্যে স্বীকার করিতেন যে, ভোগ-বিলাসে অনীহা ও অল্পে তুষ্টির ক্ষেত্রে তিনি সকলকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন। রাসূলে করীম (স) কোন সময় তাঁহাকে কিছু দিতে চাহিলে তিনি বলিতেনঃ “হে রাসূল! আমার চেয়ে অভাবগ্রস্ত লোক অনেক রহিয়াছে। তাহারাই ইহা পাইবার অধিক যোগ্য”। হযরত উমর (রা)-এর দেহ কখনও নরম মসৃণ পোশাক স্পর্শ করে নাই। খণ্ড খণ্ড তালিযুক্ত কোর্তা,জীর্ণ-দীর্ণ কাপড়ের পাগড়ী, এবং ছিন্ন-চূর্ণ জুতা-ইহাই ছিল তাঁহার আজীবনের ভূষণ। ইহা লইয়াই তিনি কাইজার ও কিসরার রাষ্ট্রদূতদের এবং দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিবর্গের সহিত সাক্ষাত করিতেন। তাঁহার নিকৃষ্ট মানের খাবার দেখিয়া লোকেরা স্তম্ভিত ও হতবাক হইয়া যাইত। তিনি বলিতেনঃ ‘তোমরা কি মনে কর আমি উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু খাবার গ্রহনে অক্ষম ও অনিচ্ছুক?আল্লাহ্র শপথ, কিয়ামতের দিবসের ভয় না হইলে আমিও তোমাদের ন্যায় ভোগ-বিলাস ও স্বাদ-আস্বাদনে নিমগ্ন হইতাম’। তিনি সরকারী দায়িত্তে নিযুক্ত কর্মচারীদিগকেও অনুরূপ ভোগ-বিলাস ও স্বাদ-আস্বাদন হইতে বিরত থাকার জন্য কড়া নির্দেশ দিতেন।
অল্পেতুষ্টি ছিল তাঁহার স্বভাবগত গুন। খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর ক্রমাগত কয়েক বৎসর পর্যন্ত তিনি বায়তুলমাল হইতে একটি মুদ্রাও গ্রহণ করেন নাই।অথচ অভাব-অনটন ও দারিদ্রের কষাঘাতে তাঁহার গোটা পরিবারই বিধ্বস্ত হইয়া যাইতেছিল। সাহাবায়ে কিরাম তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া অতি সাধারণ খাদ্য ও পোশাক সংগ্রহ হইতে পারে এমন পরিমাণ ভাতা বায়তুল মাল হইতে তাঁহাকে প্রদানের ব্যবস্থা করিয়া দেন। কিন্তু হযরত উমর (রা) উহা গ্রহণ করিতে সম্মত হইলেন এই শর্তে যে, ‘যতদিন প্রয়োজন ঠিক ততদিনই ভাতা গ্রহন করিতে থাকিব। আমার নিজের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উহা লওয়া বন্ধ করিয়া দিব’। তখন রুবাই ইবনে জিয়াদ হারেমী বলিলেনঃ ‘আমীরুল মু’মিনীন! আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে যে মর্যাদা দান করিয়াছেন, তাহাতে আপনি দুনিয়ার সকলের অপেক্ষা অধিক বিলাস-ব্যসন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ-স্ফূর্তির জীবন যাপনের অধিকারী’। হযরত উমর (রা)ক্রুদ্ধস্বরে বলিলেনঃ ‘আমি তো জনগণের আমানতদার মাত্র। আমানতের খিয়ানত করা কি কখনো জায়েয হইতে পারে?’ হযরত উৎবা(রা) একদিন তাঁহাকে নিকৃষ্ট মানের খাদ্য খাইতে দেখিয়া বলিলেনঃ আমীরুল মু’মিনীন! খাওয়া-পরার ব্যাপারে আপনি যদি কিছুটা বেশী পরিমাণ ব্যয় করেন, তাহাতে মুসলমানদের সম্পদ কম হইয়া যাইব না’। হযরত উমর (রা)বলিলেনঃ ‘বড়ই দুঃখের বিষয়, তুমি আমাকে বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাস-ব্যসনে প্রলোভিত করিতেছ’।
বস্তুত খিলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পর হযরত উমর (রা)জীবন যাত্রার ব্যাপারে অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করেন। কেননা এই সময় তাঁহার সামান্য ভুল-ত্রুটি প্রকাশ পাইলেও উহা সমগ্র মুসলিম জনতার চরিত্রে দুর্নীতি প্রশ্রয় পাওয়ার কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারিত।