হযরত আলী (রা)-এর জীবন ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য
প্রাথমিক জীবন
হযরত আলী (রা) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। নবী করীম (স)-এর নবুয়্যাত লাভের বৎসর হযরত আলীর বয়স হইয়াছিল মাত্র দশ বৎসর। তাঁহার পিতা আবূ তালিব বহু সংখ্যক সন্তানের পিতা ছিলেন। আর্থিক অনটন ও দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতির দরুণ দারিদ্রের দুর্বহভারে তিনি ন্যুব্জ হইয়া পরিয়াছিলেন। এই অবস্থা দেখিয়া নবী করীম (স) তাঁহার অপর চাচা হযরত আব্বাস (রা)-এর সঙ্গে আবূ তালিবের দৈন্যভার লাঘব করার উপায় সম্পর্কে পরামর্শ করেন। নবী করীম (স) তাঁহাকে বলিলেন, ‘চাচার দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্ট আমাদের সমভাগে ভাগ করিয়া লওয়া উচিত’। এই পরামর্শ অনুসারে হযরত আব্বাস (রা) আবূ তালিব পুত্র জাফরের এবং নবী করীম (স) স্বয়ং হযরত আলীর লালন-পালনের সমস্ত দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলিয়া লইলেন।
বস্তুত নবী করীম (স)-এর প্রতি আবূ তালিবের অবদান ছিল অনন্য। তিনি বনু হাশিমের সরদার ছিলেন এবং সমস্ত কুরাইশ গোত্রের উপর বনু হাশিমের প্রাধান্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অসামান্য। কা’বা ঘরের সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বনু হাশিমের উপর অর্পিত ছিল। এই কারণে তদানীন্তন আরব সমাজে আবূ তালিবের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব এক স্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমগ্র আরবের ধর্মীয় নেতৃত্ব এই পরিবারের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিল। নবী করীম (স) জন্মের পূর্বেই ইয়াতীম হইয়া গিয়াছিলেন। ফলে জন্মের অত্যল্পকাল পর হইতেই তিনি চাচা আবূ তালিবের স্নেহময় ক্রোড়ে লালিত-পালিত হইয়া যৌবনে পদার্পণ করেন। নবুয়্যাত লাভের পর তাহাঁরই প্রবল সমর্থনে ও আশ্রয়ে তিনি তওহীদের দাওয়াত প্রচারে ব্রতী হন। অতঃপর কুফরী শক্তির পক্ষ হইতে আসা অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতিটি আঘাতের সম্মুখে আবূ তালিব বুক পাতিয়া দেন এবং এইভাবেই কাফিরদের আক্রমণের মুকাবিলায় তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষা করেন। তাঁহার এই সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার দরুণ মুশরিক কুরাইশরা গোটা আবূ তালিব বংশের সহিত চরম শত্রুতায় মাতিয়া উঠে এবং যত উপায়ে সম্ভব তাহাদিগকে জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নে জর্জরিত করিয়া তোলে। তাহাদের জুলুম-অত্যাচারের এক চূড়ান্ত রূপ দেখা গিয়াছে তখন, যখন মক্কার সমস্ত মুশরিকরা সম্মিলিতভাবে এই পরিবারটির সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শেষাবধি এই পরিবারটি পর্বত-গুহায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হয়। কিন্তু সত্যের পৃষ্টপোষক এই পরিবারটির নেতা ও সরদার আবূ তালিব বিন্দুমাত্র দমিত না হইয়া সকল প্রকার বিরুদ্ধতা ও নির্যাতন নীরবে মাথা পাতিয়া নেন।
ইসলাম গ্রহণ
এই আবূ তালিবের পুত্র হযরত আলী (রা) বাল্যকাল হইতেই নবী করীম (স)-এর সঙ্গী-সাথী ও সহচর হিসাবে পরিচিত হইয়া উঠেন। এই কারণে নবুয়্যাত লাভের পর রাসূলে করীমের (স)-এর জীবনে পরিবর্তন সূচিত হওয়ার বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী তিনি নিজ চক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ লাভ করেন। এই পরিবর্তন সম্পর্কে হযরত আলী (রা)ই জিজ্ঞাসার জবাবে নবী করীম (স) যখন তাঁহার নিকট তওহীদী দ্বীনের ব্যাখ্যা করেন এবং ইহার প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানান, তখনি তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে ও উদ্দীপিত হৃদয়ে দ্বীন-ইসলামের প্রতি ঈমান আনেন।
রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি সর্বপ্রথম কে ঈমান আনিয়াছেন, এই পর্যায়ে বহু লোকের নাম হাদীসের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত হইয়াছে। মুসলিম মনীষীদের শেষ সিদ্ধান্ত এই যে, বালক বয়সের যে কয়জন লোক প্রথম ঈমান আনিয়াছিলেন, হযরত আলী (রা) তাঁহাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি।
ইসলাম কবুল করার পর হযরত আলী (রা)-র জীবনের তেরটি বৎসর মক্কা শরীফে রাসূলে করীম (স)-এর গভীর সান্নিধ্যে অতিবাহিত হইয়াছে। তিনি যেহেতু সর্বক্ষণ রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে থাকিতেন, এইজন্য পরামর্শ সভা, শিক্ষা-দীক্ষার মজলিস, কাফির মুশরিকদের সহিত বিতর্ক বৈঠক এবং এক আল্লাহ্র ইবাদাতের অনুষ্ঠানাদি-এক কথায় সর্ব ব্যাপারে তিনি রাসূলে করীম (স)-এর সহিত শরীক থাকিবার অফুরন্ত সুযোগ লাভ করেন। নবী করীম (স)নবুয়্যাতের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন অতীব গোপনে ও লকচক্ষুর অন্তরালে থাকিয়া এক আল্লাহ্র বন্দেগীতে নিমগ্ন হইতেন, হযরত আলী (রা) তাহাতেও উপস্থিত থাকিবার সুযোগ পাইতেন। এই গোপনীয়তা সত্ত্বেও আবূ তালিব একবার পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে বিশেষ ধরণের ইবাদতে মশগুল দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘তোমরা দুইজন কি করিতেছ? তখন নবী করীম (স) তওহীদী দ্বীন ও আল্লাহ্র ইবাদতের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। আবূ তালিব সবকিছু শুনিয়া বলিলেনঃ ‘ঠিক আছে, ইহাতে কোন দোষ নাই। তোমরা করিতে পার; কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হইবে না’।
নবুয়্যাত লাভের পর ক্রমাগত তিনটি বৎসর পর্যন্ত নবী করীম (স) দ্বীন-ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াত পেশ হইতে বিরত থাকেন। এই সময় দ্বীন প্রচারের সমস্ত কাজ তিনি বিশেষ গোপনীয়তা সহকারে চালাইতে থাকেন। তিনি বিশেষ লোকদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনী আদর্শানুযায়ী লোকদের মন-মানসিকতা ও চরিত্র গঠনের দায়িত্বও পালন করিতেন। চতুর্থ বৎসর তাঁহার প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অবতীর্ণ হইলঃ
******(আরবী)
তোমার বংশের নিকটবর্তী পূর্ণসংখ্যক লোকদিগকে (বেঈমানি ও শিরকের পরকালীন আযাব সম্পর্কে ) ভীত ও সাবধান করিয়া তোল।
নবী করীম (স) আল্লাহ্ তা’আলার এই নির্দেশ লাভ করিয়া নিকটবর্তী ‘সাফা’ পর্বতের চূড়ায় উঠিলেন এবং নিজ বংশের বিপুল জনতার সম্মুখে সর্বপ্রথম তওহীদী দ্বীনের আহবান উদাত্ত কণ্ঠে পেশ করিলেন। ইহার পরও নবী করীম (স) নিজের পরিবার ও বংশের লোকজনের নিকট সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত পেশের জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাইয়াছেন। এমন কি একবার এই উপলক্ষে একটি ভোজের আয়োজন করার জন্য তিনি হযরত আলী (রা)-কে নির্দেশ দেন।
দ্বীন প্রচারে সহযোগিতা
হযরত আলী (রা)র বয়স তখন খুব বেশী হইলেও চৌদ্দ পনের বৎসরের অধিক হইবে না। কিন্তু এই অল্প বয়স সত্ত্বেও তিনি বিশেস দক্ষতা সহকারে নিজ বংশ ও পরিবারের লোকদের জন্য এক বিরাট ভোজের আয়োজন করেন। সংশ্লিষ্ট সমস্ত লোকই ভোজসভায় উপস্থিত হয়। প্রায় চল্লিশজন লোক ইহাতে যোগদান করে। কুরাইশ বংশের প্রভাবশালী প্রায় সব কয়জন সরদারই এখানে সমবেত হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষ হইবার পর নবী করীম (স) দাঁড়াইয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণের মাধ্যমে উপস্থিত জনগণের দ্বীন-ইসলাম কবুল করার আহবান জানান। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার উপর দ্বীন প্রচারের যে বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছেন, সেই কাজে তাঁহার সহিত সহযোগিতা করিবার জন্য তিনি প্রসঙ্গত সকলেই উদ্ধুদ্ধ করিতে চেষ্টা করেন। নবী করীম (স)-এর ভাষণ শেষে সভাস্থলে সর্বপ্রথম হযরত আলী (রা)র কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইয়া উঠে। তিনি নির্ভীক কণ্ঠে বলিয়া উঠেনঃ ‘বয়সে আমি ছোট। দৈহিক অক্ষমতাও আমার অবর্ণনীয়। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও আমি এই মহান ব্রতে আপনার সঙ্গী, চির সহচর ও প্রান-পণ সাহায্যকারী থাকিব’। তাঁহার এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ ‘তুমিই আমার ভাই ও আমার উত্তরাধিকারী’।
নবুয়্যাতের প্রায় তেরটি বৎসর মক্কায় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা নবী করীম (স)-কে সমস্ত মুসলমান সমভিব্যাহারে মদীনায় হিজরাত করিয়া যাইবার জন্য নির্দেশ দেন। সে অনুসারে নবী করীম (স) মক্কার মুসলমানদিগকে একের পর এক মদীনায় চলিয়া যাইতে বলিলেন। ইহাতে মক্কা শহর মুসলমান-শূন্য হইয়া পড়ার আশংকা দেখা দিল। এই অবস্থা দেখিয়া কাফির মুশরিকগণ বিশেষভাবে শংকিত ও ভীত হইয়া পড়ে এই ভাবিয়া যে, মুসলমানরা বাহিরে কোথাও সংঘবদ্ধ ও বিপুল শক্তিতে বলীয়ান হইয়া আমাদের উপর আক্রমন করিয়া বসিতে পারে। এই আশংকায় তাহারা আগে-ভাগেই ‘শত্রু’ নিধনে কৃত-সংকল্প হইল। আল্লাহ্ তা’আলা অহীর মাধ্যমে নবী করীম (স)-কে এই বিষয়ে যথাসময়ে অবহিত করিলেন এবং অনতিবিলম্বে হিজরাত করার জন্য আদেশ দিলেন। তিনি হযরত আলী (রা)কে নিজের শয্যায় শায়িত রাখিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যান এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) সমভিব্যাহারে মদীনার দিকে রওয়ানা হন।
কাফির মুশরিকরা নবী করীম (স)-কে হত্যা করিয়া ইসলামের প্রোজ্জ্বল সূর্যের চির অস্তগমনের ব্যবস্থা করার জন্য সারা রাত্রব্যাপী তাঁহার বাসগৃহ অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত করিয়া রাখে। হযরত আলী (রা) তখন বাইশ-তেইশ বৎসরের এক যুবক মাত্র। তিনি কাফিরদের মারাত্মক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও অসীম সাহসিকতা সহকারে রাসূলের শয্যায় নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া থাকেন। সকাল বেলা শত্রুবাহিনী ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিতে পায়, রাসূলে করীম (স) অনুপস্থিত এবং তাহাঁরই জন্য প্রান-উৎসর্গকারী এক যুবক তাহাঁরই শয্যায় আত্মদানের দৃঢ় সঙ্কল্প লইয়া নিদ্রায় অচেতন হইয়া রহিয়াছে। তখন তাহারা নিজেদের এই সম্মিলিত অভিযানের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং রাসূলে করীম (স)-এর অবধারিত সাফল্য বুঝিতে পারিয়া মর্মাহত, লজ্জিত ও হতাশাগ্রস্ত হইয়া পড়ে।
মদীনায় কর্মময় জীবন
ইহার পর হযরত আলী (রা) দুই বা তিন দিন পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করেন। রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁহার নিকট রক্ষিত জনগণের আমানতসমূহ যথাযথভাবে প্রত্যার্পণের পর তিনিও মক্কা ত্যাগ করিয়া মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন।
মদীনায় উপস্থিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম মসজিদে নববীর নির্মাণে হযরত আলী (রা) প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী উহার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের সহিত একত্র হইয়া উহার নির্মাণ কার্য সুসম্পন্ন করিয়া তোলেন।
অতঃপর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর সুকঠিন কর্মময় জীবন শুরু হইলে হযরত আলী (রা) সেই ক্ষেত্রে ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও অদম্য সাহসিকতা সহকারে ছায়ার মতই তাঁহার সঙ্গী হইয়া থাকেন। নবী করীম (স)-এর প্রায় সব কয়টি যুদ্ধ-জিহাদেই তিনি পূর্ণ দায়িত্ব লইয়া অংশ গ্রহণ করেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি যে বীরত্বের পরিচয় দিয়াছেন, উহাতে তাঁহার সমকক্ষ আর কেহই হইতে পারে না। বদর যুদ্ধে নবী করীম (স) তিনশত তের জন জীবন-উৎসর্গকারী সাহাবী সমভিব্যাহারে মদীনা হইতে রওয়ানা হইলেন। কাফেলার সম্মুখভাবে কালো বর্ণের দুইটি পতাকা মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের নিদর্শন স্বরূপ পতপত করিয়া উড়িতেছিল। উহার একটি পতাকা হযরত আলী (রা)র হস্তে উড্ডীন হইতেছিল। বদর নামক স্থানে উপস্থিত হওয়ার পর নবী করীম (স) শত্রুপক্ষের গতি-বিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে হযরত আলী (রা)র নেতৃত্বে একটি দুঃসাহসী ঝটিকা বাহিনী প্রেরণ করেন। ওহোদ যুদ্ধে নবী করীম (স) আহত হইয়া একটি গর্তে পড়িয়া গেলে শত্রু বাহিনীর লোকেরা তাঁহার দিকে তীব্র গতিতে অগ্রসর হয়। এই সময় প্রথমে হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর (রা) তাহাদের সহিত লড়াই করিতে করিতে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁহার পরই হযরত আলী (রা) অগ্রসর হইয়া পতাকা ধারণ করেন এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়া যুদ্ধের মোড় ঘুরাইয়া দেন।
বনু কুরাইজা অভিযানেও হযরত আলী (রা)র হস্তেই পতাকা উড়িতেছিল এবং রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী ইয়াহুদীদের দুর্গ দখল করার পর উহার প্রাঙ্গনে তিনি আসরের নামায পড়েন। হুদাইবিয়ার হযরত উসমান (র)-এর শাহাদাতের সংবাদ পাওয়ার পর সাহাবীদের নিকট হইতে আত্মোৎসর্গ করার যে বায়’আত গ্রহণ করা হয়, হযরত আলী (রা)ও এই বায়’আতে শরীক ছিলেন। পরে মক্কার মুশরিকদের সহিত যে সন্ধি-চুক্তি লিখিত ও সাক্ষরিত হয়, নবী করীম (স) উহা লিখিবার জন্য তাঁহাকেই নির্দেশ দেন। খায়বর যুদ্ধে প্রথম দুইটি অভিযানে নেতৃত্ব দেন হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)। কিন্তু কোন অভিযানেই বিজয় সম্ভবপর হয় নাই। সর্বশেষে নবী করীম (স) হযরত আলী (রা)র স্কন্ধে খায়বরের দুর্ভেদ্য দুর্গসমূহ জয় করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করিয়া খায়বরের দুর্গসমূহের উপর ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। মক্কা বিজয়ের অভিযানেও তিনি অগ্রবর্তী বাহিনীর পতাকা লইয়া বিজয়ীর বেশে নগর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তাবুক যুদ্ধ হইতে প্রত্যাবর্তনের পর নবী করীম (স) সেই বৎসরের হজ্জে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-কে ‘আমীরে হজ্জে’ বানাইয়া মক্কায় প্রেরণ করেন। তাঁহার রওয়ানা হইয়া যাওয়ার পর সূরা ‘বারায়াত’(তওবা) নাযিল হয়। মদীনায় উপস্থিত সাহাবীগণ এই সূরাটি আদ্যোপান্ত শুনার পর মত প্রকাশ করেন যে, হজ্জের সময় সমবেত মুসলমানদের সম্মুখে এই সূরাটি পড়িয়া শুনানো হইলে খুবই ভালো হইবে। নবী করীম (স)ও ইহার গুরুত্ব অনুধাবন করিয়া হযরত আলী (রা)কে এই দায়িত্ব দিয়া মক্কা শরীফ পাঠাইয়া দিলেন।
ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে নবী করীম (স) যে কয়টি প্রতিনিধিদল বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন, ইয়েমেনে প্রতিনিধিদল প্রেরণ তন্মধ্যে বিশেষ গুরুত্তের অধিকারী। হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা) দীর্ঘ ছয় মাস যাবত নানাভাবে চেষ্টা চালাইয়াও সফলকাম হইতে ব্যর্থ হন সর্বশেষে হিজরী দশম বৎসরে নবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে এই দায়িত্ব দিয়া পাঠাইবার সিদ্ধান্ত নেন। হযরত আলী (রা) ইয়েমেন উপস্থিত হইতেই সেখানকার অবস্থার আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। তিনি সেখানকার লোকদের সম্মুখে ইসলামের তত্ত্ব,মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন এবং ইহার ফলে হাজার হাজার লোক ইসলাম দীক্ষিত হন।
একাদশ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে নবী করীম (স) পরলোক গমন করেন। এই মর্মান্তিক বেদনা সমস্ত মুসলিম জগতকে প্রচণ্ডভাবে ব্যথাতুর করিয়া ফেলে। নবী পরিবারের সদস্যগণ সর্বাধিক পরিমাণে কাতর ও বেদনা-বিধুর হইয়া পড়েন। প্রত্যেকেরই হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়, চক্ষুদ্বয় চিরকালের জন্য শ্রাবণের অস্রু নির্ঝরে পরিণত হয়। হযরত আলী (রা) নবী পরিবারের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কও ঘনিষ্ঠতার দিক দিয়া যেমন, পারিবারিক ও আত্মীয়তার দিক দিয়াও তেমনি এই বেদনা তাঁহার পক্ষে অসহনীয় হইয়াছিল। তদুপরি নবী-তনয়া হযরত ফাতিমা (রা)র ইয়াতীমী তাঁহা অন্তরে দুঃসহ আঘাত হানে। তিনি ভয়ানক রকম মুষড়িয়া পড়েন এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের সহিত সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া নিতান্তই ঘর-বাসী হইয়া থাকেন। এই সময় নিজের দুঃখ সামলানো, হযরত ফাতিমা (রা)-কে সান্তনা দান এবং কুরআন মজীদ সুসংবদ্ধকরণ ব্যতীত অন্য কোন কাজের প্রতি বিন্দুমাত্র উৎসাহ বা কৌতূহল প্রদর্শন করা তাঁহার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। কিছুদিন পর হযরত ফাতিমা (রা) ও যখন ইন্তেকাল করিয়া গেলেন তখন তিনি নিজেকে যেন নাড়া দিয়া উঠাইলেন এবং প্রথম খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার হস্তে খিলাফতের বায়’আত করেন।
হযরত আবূ বকর (রা)-এর পরে হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার খিলাফত আমলে সকল জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হযরত আলী (রা)-এর সহিত পরামর্শ করিতেন। হযরত আলী (রা)ও তখন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে প্রতিটি ব্যাপারে তাঁহাকে পরামর্শ দিতেন। নিহাওয়ান্দ অভিযানে তাঁহাকে সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তিনি তাহা গ্রহণ করিতে অসম্মত হন। পরে উমর (রা) যখন বায়তুল মাকদিস গমন করেন, রাজধানীতে হযরত আলী (রা)কে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত (Acting)করিয়া খিলাফতের সমস্ত দায়িত্ব তাঁহার নিকট অর্পণ করিয়া যান। হযরত উমর (রা)-এর পর হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতের শেষ দিকে সারা দেশে যখন অশান্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেয়, তখন তাহা দমন করার জন্য হযরত আলী (রা) বিশেষ ও কার্যকর পরামর্শ দান করেন এবং অশান্তির মূল কারণসমূহ নির্দেশ করিয়া তাহা সংশোধন ও বিদূরণের পন্থা দেখাইয়া দেন।