ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা
।।এক ।।
মৌলিক দৃষ্টিভংগী
ইসলামের ইহা এক বৈশিষ্ট যে, সে তাহার আইন কানুনের রহস্যাবলীর উপর নিজেই আলোকপাত করে। সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত করিার জন্য ইসলামের যে বিধান পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে ইসলামই আমাদিগকে বলিয়া দিয়াছে যে, সে বিধানের বুনিয়াদ কোন কোন জ্ঞানবিজ্ঞানের মুলনীতি ও কোন কোন প্রাকৃতিক রহস্যাবলীর উপরে প্রতিষ্ঠিত।
দাম্পত্য সম্পর্কের মুল মর্ম
এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম যে রহস্যের উর্দঘাটন করা হইয়াছে, তাহা হইতেছেঃ
****************************
প্রতিটি বস্তুকে আমি জোড়া জোড়া সৃষ্টি করিয়াছি। -সুরা যারিয়াতঃ ৪৯
এই আয়াতে দাম্পত্য বিধানে ।Law of Sex। এক ব্যাপক অর্থের দিকে ইংগিত করা হইয়াছে। বিশ্ব প্রকৃতির ইঞ্জিনিয়ার তাঁহার স্বীয় ইঞ্জিনিয়ারী কলা-কৌশল এইভাবে উদঘাটিত করিতেছেন যে, তিনি এই বিশ্বপ্রকৃতির যাবতীয় মেশিণ দাম্পত্য বিধান ।Law of Sex। অনুযায়ী নির্মাণ করিয়াছেন অর্থাৎ এই মেশিনের সমুদয় অংশকে জোড়া জোড়া নির্মাণ করিয়াছেন এবং এই সৃষ্টি জগতে যতই কারিগরী দেখা যায়, তৎসমুদয়ই এই জোড়া জোড়া নিয়ম-বিধানেরই এক বিস্ময়কর পরিণাম ফল!
এখন দাম্পত্য বিধান ।Law of Sex। বস্তুটি কি, তাহা বিবেচনা করা যাউক। দাম্পত্য বিধানের মুল কথা এই যে, ইহার একটিতে থাকিবে ক্রিয়া এবং অপরটিতে থাকিবে ক্রিয়া গ্রহণ করিবার প্রবণতা। একটিতে থাকিবে প্রভাব, অপরটিতে প্রভাবের স্বীকৃতি। একটিতে থাকিবে যুক্ত বিজড়িত করিবার ক্ষমতা, অপরটিতে যুক্ত বিজড়িত হওয়ার প্রবণতা। এই যুক্ত বিজড়িতকরণ ও তাহার সুযোগ দান করা, এই ক্রিয়া ও তাহা গ্রহণ করিবার প্রবণতা, এই প্রভাব ও তাহার স্বীকৃতি এবং এই কর্তৃত্ব ও কর্তৃত্ব গ্রহণ- এই সকল বিষয়ের সম্পর্ক হইতেছে দুইটি বস্তুর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক হইতেই সমুদয় নির্মাণকার্য সাধিত হয় এবং নির্মাণকার্য দ্বারা সমগ্র সৃষ্টিজগতের কারখানা চলে। সৃষ্টিজগতে যত কিছু আছে, তাহার সমুদয়ই আপন আপন শ্রেণীতে জোড়া জোড়া সৃজিত হইয়াছে। প্রত্যেক জোড়ার মধ্যে মৌলিক দিক দিয়া দাম্পত্যের যে সম্পর্ক দেখিতে পাওয়া যায় তাহা হইতেছে এই যে, ইহাদের একটি কর্তা এবং অপরটিতে তাহার ক্রিয়া গ্রহণকারী। অবশ্য সৃষ্টিজগতের এক এক শ্রেণীতে এই সম্পর্কের রূপ এক এক ধরনের, যথাঃ এক প্রকারের জোড়াবন্ধন পদার্থের মধ্যে, অন্য প্রকার বর্ধনশীল স্থুল পদার্থের মর্ধে দেখা যায়। আবার এক প্রকার জোড়া বন্ধন বা দম্পত্যবিধান প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। এই সমুদয় দাম্পত্যবিধান আপন আপন অবস্থা ও প্রাকৃতিক উদ্দেশ্যের দিক দিয়া বিভিন্ন ও পৃথক। কিন্তু এই সকলের মধ্যে দাম্পত্য বিধানের মুল কথা এক ও অভিন্ন, তাহা যে কোন প্রকার অথবা যে কোন শ্রেণীর হউক না কেন। প্রকৃতির আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ গঠনকার্য ও গঠনাকৃতি লাভের জন্য ইহা অপরিহার্য যে, জোড়ার মধ্যে একটিতে থাকিবে ক্রিয়ার শক্তি এবং অপরটিতে থাকিবে ক্রিয়া গ্রহণের শক্তি।
উপরে উল্লিখিত আয়াতের এই মর্ম অনুধাবন করিবার পর ইহা হইতে দাম্পত্য বিধানের তিনটি মুলনীতি প্রমাণিত হয়ঃ
১. আল্লাহ তায়ালা যে ফরমুলায় সমগ্র বিশ্বজগত সৃষ্টি করিয়াছেন এবং যে পদ্ধতিকে স্বীয় কারখানা পরিচালনার কারণ নিরূপণ করিয়াছেন, তাহা কখনও অপবিত্র ও হীন হইতে পারে না, বরং মুলের দিক দিয়া তাহা পবিত্র ও সম্মানজনক। সুতরাং তাহা হওয়াই বাঞ্জনীয়। কারখানার বিরোধীরা তাহাকে অপবিত্র ও ঘৃনার্হ মনে করিয়া তাহা হইতে দুরে সরিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু কারখানার নির্মাতা ও মালিক কোনদিনই এই ইচ্ছা পোষণ করিবে না যে, তাঁহার কারখানা বন্ধ হইয়া যাউক। তিনিও এই ইচ্ছাই পোষণ করিবেন যে, কারখানার মেশিনের অংগ-অংশগুলি চালু থাকুক এবং আপন কাজ করিতে থাকুক।
২. ক্রিয়া ও ক্রিয়া গ্রহণ উভয়ই এই কারখানা পরিচালনার জন্য সমভাবে প্রয়োজন। কর্তা ও তাহার ক্রিয়া গ্রহণকারী উভয়ের অস্তিত্ত্ব এই কারখানায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। না কর্তার কর্তার ক্রিয়ার বিশেষ কোন সম্মান আছে, না অপরের ক্রিয়া গ্রহণে কোন অসম্মান আছে। কর্তার সিদ্ধি এই যে, তাহার মধ্যে কর্মশক্তি এবং কর্তার গুণ পাওয়া যায়, যাহাতে সে দাম্পত্যের ক্রিয়ার দিক সুচারুরূপে সমাধা করিতে পারে। একটি সাধারণ মেশিনের অংশগুলি দ্বারা যদি কেহ উহাদের প্রকৃত কাজ না লইয়া এমন কাজে লাগায় যাহার জন্য উহাদিগকে তৈরি করা হয় নাই, তাহা হইলে সেই ব্যক্তিকে নির্বোধ ও অনভিজ্ঞ বলা হইবে। প্রথমত, এই চেষ্টা নিষ্ফল হইবে এবং বলপূর্বক লইতে গেলে মেশিন নষ্ট হইয়া যাইবে। এই সৃষ্টিজগতের বিরাট মেশিনেরও ঐ একই অবস্থা। যে নির্বোধ ও অনভিজ্ঞ, একমাত্র সেই কর্তাপক্ষকে তাহার ক্রিয়া গ্রহণকারীর স্থানে এবং ক্রিয়া গ্রহণকারীকে কর্তার স্থানে নিযুক্ত করিবার ধারণা করিতে পারে। অতপর সে এই চেষ্টা করিয়া এবং ইহাতে সাফল্যের আশা পোষণ করিয়া অধিকতর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু এই বিরাট মেসিনের সৃষ্টিকর্তা কখনও তাহা করিবেন না। তিনি কর্তাপক্ষকে ক্রিয়ার স্থানে রাখিয়া তাহাকে তদনরূপ শিক্ষাই দিবেন এবং ক্রিয়া গ্রহণকারী পক্ষকে গ্রহণের কাজে নিযুক্ত করিয়া তাহার মধ্যে ক্রিয়া গ্রহণের যোগ্যতা সৃষ্টির ব্যবস্থাই করিবেন।
৩. ক্রিয়া গ্রহণের উপর ক্রিয়ার এক প্রকার মর্যাদা আছে। এই অর্থে মর্যাদা নহে যে, ক্রিয়ার মধ্যে সম্মান আছে এবং পক্ষান্তরে ক্রিয়া গ্রহণে অমর্যাদা আছে, বরং মর্যাদা এই অর্থে যে, ক্রিয়ার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে থাকে শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তি ও প্রভাব। কোন বস্তু অপর কোন বস্তুর উপর ক্রিয়া করিলেতাহার কারণ এই যে, দ্বিতীয়টির তুলনায় প্রথমটি শ্রেষ্ঠ, শক্তিশালী ও প্রভাবান্বিত করিবার শক্তি রাখে। যে বস্তুটি ক্রিয়া গ্রহণ করে এবং ক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহার ক্রিয়া গ্রহণ ও প্রভাবিত হওয়ার কারণ এই যে, সে পরাভূত, দুর্বল ও প্রভাবিত হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন। ক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার জন্য যেমন কর্তা এবং ক্রিয়া গ্রহণকারী উভয়ের অস্তিত্ব সমান প্রয়োজন, তদ্রুপ কর্তার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রভাব বিস্তারের এবং ক্রিয়া গ্রহণকারীর মধ্যে প্রাধীন্য স্বীকার ও প্রভাব গ্রহণের শক্তি থাকা প্রয়োজন। কারণ শক্তিতে উভেয়ে যদি একরূপ হয় এবং কাহারও উপরে কাহারও প্রাধান্য না থাকে, তাহা হইলে ইহাদের মধ্যে কেহ কাহারও প্রভাব স্বীকার করিবে না এবং ক্রিয়া একেবারেই সংঘটিত হইবে না। সুঁচের মধ্যে যে কাঠিন্য আছে, তাহা যদি কাপড়ের মধ্যেও হয়, তাহা হইলে সেলাই ক্রিয়া সম্পন্ন হইতে পারে না। কোদাল ও হালের প্রাধান্য স্বীকার করিবার জন্য মাটির মধ্যে যদি কোমলতা না থাকে, তাহা হইলে কৃষি ও নির্মাণকার্য অসম্ভব হইয়া পড়িবে। মোট কথা, পৃথিবীতে যত কাজ অনুষ্ঠিত হয়, তাহার একটিও হইবেনা, যদি একটি কর্তার জন্য একটি ক্রিয়া গ্রহণকারী না হয় এবং তাহার মধ্যে কর্তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যোগ্যতা না থাকে। অতএব দম্পতির মধ্যে যে কর্তা হয়, তাহার প্রকৃতির চাহিদাই এই যে, তাহার মধ্যে থাকিবে শ্রেষ্ঠত্ব, দৃঢ়তা ও কর্তৃত্ব শক্তি, যাহাকে বলে পুরুষত্ব। কারণ কার্যকরী অংশ হিসাবে নিজের কর্তব্য সমাধা করিবার জন্য তাহার এইরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। পক্ষান্তরে ক্রিয়া গ্রহণকারীর প্রকৃতির দাবি এই যে, তাহার মধ্যে থাকিবে কোমলতা ও প্রভাব গ্রহণের প্রবণতা, যাহাকে বলা হয় নারীত্ব। কারণ দাম্পত্য ব্যবস্থার ক্রিয়া গ্রহণকার্যে এই গুণাবলীই তাকে সফলকাম করিতে পারে। যাহারা এই গূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবহিত নহে, তাহারা কর্তার ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বকে সম্মান মর্যাদার অর্থে ব্যবহার করত ত্রিয়া গ্রহণকারীকে হেয়, অবমানিত মনে করে অথবা শ্রেষ্ঠত্ব একেবারেই অস্বীকার করত ক্রিয়া গ্রহণকারিণীর মধ্যে এই এই সকল গুণ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, যে গুলি কর্তার মধ্যে থাকা উচিত। কিন্তু যে ইঞ্জিনিয়ার এই উভয় অংশ সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি তাহাদিগকে মেশিনের মধ্যে এমনভাবে লাগাইয়া দেন যে, সম্মানের দিক দিয়া উভয়ে এক রকম এবং শিক্ষা-দীক্ষা, লালন পালন ও অনুগ্রহ লাভের দিক দিয়া উভয়ে সমান হয়। কিন্তু ক্রিয়া ও ক্রিয়া গ্রহণের প্রকৃতি যে প্রভুত্ব ও পরাধীনতা দাবি করে, উহাদের মধ্যে তাহাই সৃষ্টি করিতে হইবে যেন দাম্পত্য ব্যবস্থার উদ্দেশ্য পূর্ণ হইতে পারে। পক্ষান্তরে উভয়েই যেন কঠিন পাথর হইয়া না পড়ে-যাহার ফল উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষই হইতে পারে, কিন্তু পরস্পরের কোন সম্মিলিত কর্মপন্থা এবং কোন পদ্ধতি গ্রহণ করিতে পারে না।
ইহা ঐ সকল মূলনীতি, যাহা দাম্পত্য ব্যবস্থার প্রাথমিক অর্থ হইতেই পাওয়া যায়। নিছক একটি জড় অস্থিত্ব হিসাবে নারী-পুরুষের জোড়া জোড়া হওয়াই এই বিষয়ের দাবি করে যে, তাহাদের সম্পর্কের মধ্যে এই মুলনীতি থাকিতে হইবে। সম্মুখে অগ্রসর হইলে জানিতে পারা যাইবে যে, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা যে সামাজিক বিধান তৈরি করিয়াছেন, তাহাতে উপরে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হইয়াছে।
মানুষের পশু স্বভাব ও তাহার আশংকা
এখন এক ধাপ সম্মুখে অগ্রসর হউন। নারী ও পুরুষের অস্তিত্ব শুধু একটি জড়-অস্তিত্ব নহে বরং ইহা একটি পশু-অস্তিত্বও বটে। এই দিক দিয়া তাহাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক হওয়ার পিছনে কোন্ বস্তুর দাবি রহিয়াছে?
কুরআন বলেঃ
********************
আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হইতেই জোড়া বানাইয়া দিয়াছেন। পশুদের মধ্যেও জোড়া বানাইয়া দিয়াছেন। এইভাবে তিনি তোমাদিগকে পৃথিবীর বুকে ছড়াইয়া দেন। -সূরা শুরাঃ ১১
*************************
তোমাদের নারী তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্রস্বরূপ।
-সূরা বাকারাঃ ২২৩
প্রথম আয়াতে মানুষ ও পশুর জোড়া জোড়া সৃষ্টি হওয়ার কথা একই সংগে বলা হইয়াছে। তাহার মিলিত উদ্দেশ্য এই বলা হইয়াছে যে, তাহাদের দাম্পত্য সম্পর্কের দ্বারা বংশ বৃদ্ধি করা হইবে।
দ্বিতীয় আয়াতটিতে মানুষকে সাধারষ পশু শ্রেণী হইতে পৃথক করিয়া ইহা প্রকাশ করা হইয়াছে যে, পশু শ্রেণীর মধ্য হইতে এই বিশেষ ধরনের দাম্পত্যের মধ্যে শস্যক্ষেত্র ও কৃষকের সম্পর্ক আছে। ইহা একটি জীব-বিজ্ঞানসম্মত সত্য। জীব-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নারী পুরুষের যে সুন্দর উপমা দেওয়া যাইতে পারে তাহা ইহাই।
এই দুইটি আয়াত হইতে আরও তিনটি মুলনীতি পাওয়া যায়। তাহা নিম্নরূপঃ
- আল্লাহ তাআলা অন্যান্য জীবের ন্যায় মানুষের জোড়াও এই উদ্দেশ্যে সৃষ্ট করিয়াছেন যেন তাহাদের যৌনসম্পর্ক দ্বারা বংশ বৃদ্ধি হইতে থাকে। ইহা মানুষের পশু প্রকৃতির দাবি এবং তাহা পুরণের সুযোগ দিতে হইবে। খোদ মানুষকে এইজন্য পয়দা করেন নাই যে, তাহাদের কিছু লোক পৃথিবীতে শুধু নিজেদেরই প্রতিপালন করিবে এবং মানব জাতিকে স্থায়ী রাখা এবং তিনি মানবের পশু-প্রকৃতিতে এমন এক যৌন-আকর্ষণ ঢালিয়া দিয়াছেন, যেন দম্পতি পরষ্পর মিলিত হইতে পারে ও আল্লাহর পৃথিবীকে চালু রাখিবার জন্য নিজেদের বংশ বৃদ্ধি করিতে থাকে। অতএব যে বিধান আল্লাহর পক্ষ হইতে হইবে, তাহা কখনও যৌন-আকর্ষণ দমিত করিতে ও মিটাইতে পারে না, বরং তাহার মধ্যে অবশ্য অবশ্য এমন বিষয়ের সুযোগ থাকিবে যাহাতে মানুষ তাহার সেই প্রাকৃতিক দাবী পূরণ করিতে পারে।
২. কৃষক ও শস্যক্ষেত্রের সংগে নারী ও পুরুষের উপমা দিবার পর বলা হইয়াছে যে, মানব দম্পতির সম্পর্ক অন্যান্য জীবের দাম্পত্য সম্পর্ক হইতে পৃথক। মানুষ হিসাবে বিচার করা ছাড়িয়া দিয়া পশু হিসাবে বিচার করিলেও দেখঅ যায় যে, এই দুইয়ের [নর-নারীর] শারীরিক গঠন এমনভাবে করা হইয়াছে যে একটি কৃষক ও তাহার শস্যক্ষেত্রের মধ্যে যে নম্পর্ক থাকে, তাহাদের মধ্যেও সেই দৃঢ় ও অটল সম্পর্ক বিদ্যমান থঅকা দরকার। কৃষকের কাজ শুধু তাহার ভূমিতে বীজ নিক্ষেপ করাই নহে, উহাতে পানি সেচন করা, বীজ ও শস্যের তদারক করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রয়োজনও তাহারই। ঠিক এইরুপ নারীও এমন একটি শস্যক্ষেত্র নহে যে, কোন এক জীব পথ চলিতে চলিতে তাহাতে কোন বীজ নিক্ষেপ করিয়া দিল এবং তাহার পর তাহা হইতে আপনা-আপনি বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়া গেল, বরং ব্যাপার এই যে, যখন সেই নারী গর্ভ ধারণ করে, তখন সে প্রকৃতপক্ষে কৃষকের মূখাপেক্ষী হইয়া পড়ে, যাহাতে সে তাহার প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে।
৩. মানব দম্পতির মধ্যে যে যৌন-আকর্ষণ আছে, জীব-বিজ্ঞান মতে তাহা ঠিক ঐরূপ, যাহা অন্য প্রাণিদের মধ্যেও আছে। এক শ্রেণীর প্রতিটি জীব তাহার বিপরীত লিংগের প্রতিটি জীবের প্রতি পাশবিক যৌণ-আকর্ষণ রাখে এবং বংশ বৃদ্ধির যে বিরাট আকাঙ্খা তাহাদের মধ্যে গচ্ছিত রাখা হইয়াছে তাহা উভয় শ্রেণীর ঐ সকলকে পরষ্পরে আকৃষ্ট করে যাহাদের মধ্যে বংশ বৃদ্ধির যোগ্যতা কার্যত বিদ্যমান থাকে। অতএব বিশ্বস্রষ্টার রচিত বিধান মান্যুষের পশু প্রকৃতির এই দুর্বল দিক উপেক্ষা করিতে পারে না। কেননা ইহার মধ্যে যৌন-শৃংখলতার [ Sexual anarchy] প্রতি এমন এক বিরাট প্রবণতা লুক্কায়িত আছে যাহা সংরক্ষরণের বিশেষ পদ্ধতি ব্যতিরেকে সংযত করা যায় না। যদি একবার উহা আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায় তাহা হইলে মানুষ পশুরও অর্ধম হইয়া পড়ে।
(আরবি******************************)
আমি তো সৃষ্টি করিয়াছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে, অত্পর আমি উহাকে হীনতাগ্রস্তদিগের হীনতমে পরিণত করি-কিন্তু তাহাদিগের জন্য নহে যাহারা মু,মিন সৎ কর্মপরায়ণ।-সূরা তীনঃ ৪-৬
মানব প্রকৃতি ও তাহার আকাঙ্খা
পূর্ব বর্ণনা করা হইয়াছে যে, মানব সৃষ্টির ভূমি ও ভিত্তি হিসাবে রহিয়াছে পাশবিক প্রকৃতি। এই ভূমির উপরই মনুষ্যত্বের অট্টলিকা গড়িয় তোলা হইয়াছে। মানুষের ব্যক্তিগত ও জাতিগত অস্তিত্ব অবশিষ্ট রাখিবার জন্য যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হয়, তাহার মধ্যে প্রত্যেকের আকাঙ্খা এবং প্রত্যেকের তাহা পূরণ করিবার যোগ্যতা আল্লাহ তায়ালা তাহার পাশবিক বিভাগেই রাখিয়া দিয়াছেন। এখন এই সকল আকাঙ্খার কোন একটি পূর্ণ হইতে না দেওয়া কিংবা ঐ সকল যোগ্যতার কোন একটি নষ্ট করিয়া দেওয়া মোটেই আল্লাহর ইচ্ছা নহে। কারণ এই সকল অবস্থাই প্রয়োজনীয় এবং ইহা ব্যতীত মানুষ ও মনুষ্য জাতি বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। অবশ্য প্রকৃতি চায় যে, মানুষ তাহার আকাঙ্খা পূরণে এবং সকল যোগ্যতার বাবহারে যেন নিছক পাশবিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে, বরং তাহার মানবিক বিভাগে যে সকল বিষয়ের আকাঙ্খা রাখে এবং তাহার মধ্যে যে সকল অতিপাশবিক বিষয়ের চাহিদা আছে, সে সকল দিক দিয়া তাহার পদ্ধতি মানবসুলভ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা শরীআতের সীমারেখা নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন, যাহাতে মানুষের কার্যাবলী একটা নিয়ম-শৃংখলার অধীন হয়। এতদসহ এইরূপ সাবধান বাণীও উচ্চারিত হইয়াছে যে, যদি সীমালংঘন অথবা ন্যুনতর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তাহা হইলে ধ্বংসে অনিবার্য হইবে।
(আরবি********************************)
যে আল্লাহর বিধান লংঘন করে সে নিজেরই উপর অত্যাচার করে-সূরা তালাকঃ ১
এখন লক্ষ্য করুন দাম্পত্য ব্যাপারে কুরআন মজিদে মানবীয় প্রকৃতির কোন কোন বৈশিষ্ট্য ও কোন কোন কামনা- বাসনার দিকে অংগুলী নির্দেশ করে।
উভয় শ্রেণীর [নর-নারী] ভিতর যে ধরনের সম্পর্ক মানবীয় প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রাখা হইয়াছে, তাহার ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ
(আরবি**************************)
এই তাঁহার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রহিয়াছে, তিনি [আল্লাহ তাআলা] তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হইতেই জোড়া বানাইয়া দিয়াছেন যাহাতে তোমরা শান্তি লাভ করিতে পার এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও করুণার সঞ্চার করিয়া দিয়াছেন।-সূরা রূমঃ ২১
(আরবি**********************)
তাহার তোমাদের ভূষণস্বরূপ এবং তোমরা তাদের ভূষণস্বরূপ।-সূরা বাকারঃ ১৮৭
ইহার পূর্বে যে আয়াতে মানুষ ও পশু উভয়ের জোড়া সৃষ্টি করার উল্লেখ করা হইয়াছে সেখানে জোড়া সৃষ্টির উদ্দেশ্য শুধু বংশ রক্ষা বলা হইয়াছে। এখানে পশু হইতে পৃথক করিয়া মানুষের এই বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হইয়াছে যে, জোড়া সৃষ্টির একটা উচ্চাতর উদ্দেশ্য আছে এবং তাহা এই যে, তাহাদের সম্পর্ক নিছক যৌনসুলভ হনে, সে সম্পর্ক প্রেম ও ভালবাসার। তাহার একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার। তাহাদের মধ্যে এমন সাহচর্য ও সংযোগ সংস্পর্শ হইবে-যেমন হয় শরীর ও পরিধেয় বস্ত্রের মধ্যে। উভয়ের মধ্যে এহেন সম্পর্ক মানবীয় তমদ্দুনের ভিত্তিপ্রস্তর-ইহা পূর্বেও বলা হইয়াছে। ইহার সহিত [আরবি] শব্দদ্বয় দ্বারা ইংগিত করা হইয়াছে যে, নারীর মধ্যে পুরুষের জন্য শান্তি ও আনন্দ-সম্পদ আছে এবং নারীর প্রকৃতিগত সেবাই এই যে, সে এই সংগ্রামশীল ও কর্মময় দুনিয়ার শান্তি ও আনন্দকণার সন্চার করিবে-ইহাই মানুশের পারিবারিক জীবন। পাশ্চাত্যবাসী অবশ্য বস্তুগত ও বৈষয়িক সুখ-সুবিধার জন্য এই পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব উপেক্ষা করিয়াছে। বস্তুত অন্যান্য বিভাগের যে গুরুত্ব তামাদ্দুনিক ও সমাজ-ব্যবস্থার বিভাগগুলিতে আছে, তদ্রুপ গুরুত্ব এই পারিবারিক বিভাগেরও এবং তামাদ্দুনিক জীবনের জন্য ইহাও ততখানি আবশ্যক, যতখানি আবশ্যক অন্যান্য বিভাগগুলি।
২.এই যৌন-সম্পর্ক শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসাই কামনা করে না, সেই সাথে ইহাও কামনা করে যে, এই সম্পর্ক দ্বারা যে সন্তান-সন্ততি জন্মলাভ করিবে, তাহাদের সংগেও একটা গভীর আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপিত হউক। ইহার জন্য বিশ্বস্রষ্টা মানুষের, বিশেষ করিয়া নারীর শারীরিক গঠন, গর্ভ ও স্থন্য দানের প্রকৃতিক অবস্থার মধ্যে এমন ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন যে, তাহার রক্ত-গোশত ও অণু-পরমাণুতে সন্তানের স্নেহ-মমতা জড়িত হইয়া যায়। কুরআন মজিদ বলেঃ(আরবি******************)
তাহার মা তাহাকে বহু কষ্টসহকারে পেটে ধারণ করিয়াছে। অতপর দুই বৎসর পর সে স্তন্য ত্যাগ করিয়াছে।
–সূরা লুকমানঃ ১৪
(আরবী********************************)
তাহার মা তাহাকে বহু কষ্টে পেটে ধারণ করিয়াছে, বহু কষ্টে প্রসব করিয়াছে এবং গর্ভ ধারণ হইতে স্তন্য ত্যাগ পর্যন্ত ত্রিশ মাস অতিবাহিত করিয়াছে। -সূরা আহকাফঃ ১৫
এইরূপ অবস্থা পুরুষেরও- যদিও সন্তানের ভালবাসার দিক দিয়া সে নারী অপেক্ষা কিছু নিম্নে।
(আরবী****************************)
আনন্দদায়ক জিনিসের ভালবাসা মানুষের মধ্যে বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। অতপর এই সম্পর্ক হইতে পরিবার, পরিবার হইতে গোত্র এবং গোত্র হইতে জাতির সৃষ্টি হয়। তারপর এই সকল সম্পর্ক হইতে তমদ্দুন গঠিত হয়।
(আরবী*******************************)
এবং তিনি আল্লাহ তায়ালা যিনি পানি হইতে মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন। অতপর তাহাদের মধ্যে বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন।–সূরা ফুরকানঃ ৫৪
(আরবী***************************)
হে মানব জাতি! আমি তোমাদিগকে একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক হইতে সৃষ্টি করিয়াছি। অতপর তোমাদিগকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করিয়াছি যাহাতে তোমরা একে অপরকে চিনিতে পার। –সূরা হুজুরাত
অতএব, ঔরসজাত, বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষে মানবীয় তমদ্দুনের প্রাথমিক ও প্রাকৃতিক ভিত্তিমূল। উক্ত তামাদ্দুনিক প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে এমন অবস্থার উপর যাহাতে সন্তান-সন্ততির পরিচিতি পিতা-মাতার হয় এবং তাহাদের বংশ নিরাপদ হয়।
৩. মানবীয় প্রাকৃতিক কামনা এই যে, যদি কেহ তাহার জীবনের শ্রমলক্ক কিছু কাহারও জন্য ছাড়িয়া যাইতে চায়, তাহা হইলে সে সন্তান-সন্ততি ও প্রিয়জনের জন্য ছাড়িয়া যাইতে চায়, তাহা হইলে সে সন্তান-সন্ততি ও প্রিয়জনের জন্য ছাড়িয়া যাইবে, যাহাদের সংগে সে সারা জীবন রক্তের সম্পর্কে আবদ্ব ছিল।
(আরবী******************************)
আল্লাহর কুরআনের বিধান অনুযায়ী আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে কেহ কাহারও উপর উত্তরাধিকারের দিক দিয়া বেশী হকদার।–আনফাল
(আরবী*******************************)
যাহাদিগকে তোমরা ধর্ম পুত্র করিয়াছ, আল্লাহ তায়ালা তাহাদিগকে তোমাদের পুত্র করিয়া লন নাই। –সূরা আহযাব
অতএব, উত্তরাধিকার বন্টনের জন্যও বংশীয় রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন।
৪. মানব-প্রকৃতির মধ্যে লজ্জা প্রবণতা এক অতি স্বাভাবিক প্রবণতা। তাহার শরীরের কতক অংশ এমন যে, তাহা ঢাকিয়া রাখিবার ইচ্ছা আল্লাহ তায়ালা তাহার শারীরিক উপাদানের মধ্যে সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন। এই শারীরিক সাংগঠনিক ইচ্ছাই মানুষকে আদিকাল হইতে কোন না কোন প্রকারের বন্ত্র পরিধান করিতে বাধ্য করিয়াছে। এই অধ্যায়ে কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আধুনিক মতবাদের খন্ডন করিয়াছে। কুরআন বলে যে, মানব শরীরের যে সকল অংশে নারী-পুরুষের জন্য যৌন-আকর্ষণ আছে, তাহা প্রকাশে লজ্জাবোধ করা এবং আচ্ছাদিত রাখিবার চেষ্টা করা মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক চাহিদা। অবশ্য শয়তানের ইচ্ছা যে, মানুষ এগুলিকে উন্মুক্ত রাখে।
(আরবী*******************************)
অতপর যখন তাহারা উভয়ে উক্ত বৃক্ষের ফল ভোগ করিল তখন তাহাদের শরীরের আবৃত অংশ প্রকাশ হইয়া পড়িল এবং তাহার উহা বেহেশতের পত্র-পল্লব দ্বারা আবৃত করিতে লাগিল।
-সূরা আরাফঃ
পুনরায় কুরআন বলে যে, আল্লাহ তায়ালা এইজন্য বস্ত্রের প্রচলন করিয়া দিয়াছেন যে, উহার দ্বারা একদিকে যেমন লজ্জা নিবারণ হয়, অপরদিকে ইহা শোভা বর্ধন করে। শুধু লজ্জা নিবারণই যথেষ্ট নহে, তাহার সংগে অন্তকরণে আল্লাহর ভয় থাকা বাঞ্ছনীয়।
(আরবি*********************)
তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকিবার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদিকে পরিচ্ছদ দিয়াছি এবং তকওয়ার পরিচ্ছই সর্বোৎকৃষ্ট।-সূরা আরাফাঃ ২৬
ইহা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক ধারণা। এই অন্তরে পোষণ করার পর এই সমাজ ব্যবস্থার বিস্তারিত রূপ অধ্যয়ন করুন, যাহা ধারণাকে ভিত্তি করিয়া রচিত করা হইয়াছে। ইহা অধ্যয়ন করিবার সময় আপনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সহকারে যাচাই করা উচিত যে, ইসলাম যে সকল মতবাদকে আপন আইন প্রণয়নের ভত্তি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে, তাহা অক্ষরে অক্ষরে কার্যকরী করিবার ব্যাপারে কতখানি নিষ্ঠা, উপযোগিতা, সংগতি ও যুক্তিযুক্ততা ঠিক রাখা হইয়াছে। মানব রচিত যত প্রকার বিধান আমরা দেখিয়াছি, তাহার সবগুলির এই স্পষ্ট দুর্বলতা আমরা লক্ষ্য করিয়াছি যে, তাহাদের মৌলিক মতবাদ ও প্রত্যক্ষ খুটিনাটির মধ্যে পূর্ণ সমঞ্জস্য ও সংগতি বজায় নাই। মূলনীতি ও তাহার শাখা-প্রশাখার মধ্যে বিরাট বৈষম্য দেখা যায়। মূলনীতি যাহা বর্ণনা করা হয়, তাহার রূপ এক প্রকার হয় এবং বাস্তব রূপ দান করিবার জন্য যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নির্ধারণ করা হয়, তাহা অন্য একরূপ ধারণ করে। চিন্ত, গবেষণা ও যুক্তির আকাশে আরোহণ করিয়া এক ধরনের মতবাদ পেশ করা হয়। কিন্তু উর্ধ্ব জগত হইতে অবতরণ করত বাস্তব কর্মক্ষেত্রে মানুষ যখন সমস্যাবলীর মধ্যে সে সব কিছু এমনভাবে হারাইয়া ফেলে যে, তাহার নিজের মতবাদ স্মরণ থাকে না। মানব-রচিত আইন-কানুনের চক্ষে দূরবীন লাগাইয়া বিশেষ সমালোচনার দৃষ্টিতে লক্ষ্য করুন যে,যে বিধান আরব মরুর একবালক দুনিয়ার সামনে পেশ করিয়াছিলেন, যাহা প্রণয়ন করিবার জন্য কোন আইন প্রণয়নকারী পরিষদ অথবা কোন সিলেকট কমিটির পরামর্শ লওয়া হয় নাই, তাহার মধ্যে কোথাও কোন প্রকারের অসংগদতি ও ক্রটি-বিচ্যুতির অবকাশ আছে কি না।
ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থা
দুই
মূলনীতি ও বাধ্যতামূলক ধারাগুলি
সমাজ গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যেমন অন্যত্র বর্ণিত হইয়াছে, যৌন প্রবণতাকে উচ্ছৃংখলতা হইতে রক্ষা করিয়া একটা নিয়ম- শৃংখলার অধীন করিয়া দেওয়া। কারণ ইহা ব্যতীত তমদ্দুনের শৃংখলা রক্ষিত হইতে পারে না। কখনও ইহার ব্যতিক্রম হইলে মানুষকে ভয়ানক নৈতিক ও মানসিক অধপতন হইতে রক্ষা করিবার উপায় থাকে না। এই উদ্দেশ্যে ইসলাম নারী-পুরুষের সম্পর্ক পৃথক সীমারেখার অধীন করিয়া এক কেন্দ্রের সহিত জুড়িয়া দিয়াছে।
নিষিদ্ধ নারী-পুরুষ
সর্বপ্রথম ইসলামী বিধান ঐ সকল পুরুষ ও নারীকে একে অপরের জন্য হারাম করিয়া দিয়াছে, যাহারা পরস্পর মিলিত হইয়া অথবা অতি নিকট সম্পর্ক স্থাপন করিয়া বসবাস করিতে বাধ্য। যথাঃ মাতা ও পুত্র, পিতা ও কন্যা, ভাই ও ভগ্নি, ফুফু ও ভ্রাতুষ্পত্র চাচা ও ভ্রাতুষ্পত্রী খালা ও ভাগিনেয়,মামা ও ভাগিনেয়ী, সৎ পিতা ও কন্যা, সৎ মাতা ও পুত্র, শ্বাশুড়ী ও জামাতা, শ্বশুর ও পুত্রবধু, শ্যালিকা ও ভগ্নিপতি [দুই ভগ্নি একত্রে] ও স্তন্যদুগ্ধ সম্পর্কের নারী-পুরুষ। এই সকল নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম করিয়া তাহাদিগকে যৌনবাসনা হইতে এত দূর পবিত্র কোন প্রকার যৌন আকর্ষণের ধারণাই করিতে পারে না। [ অবশ্য যদি এমন কোন পশু প্রবৃত্তির মানুষ হয় যাহারা কোন নৈতিক বন্ধনের অধীন নহে সে স্বতন্ত্র কথা]
ব্যভিচার নিষিদ্ধ করণ
এই সীমারেখা নির্ধারণের পর দ্বিতীয় বাধা-নিষেধ যাহা আরোপ করা হইয়াছে তাহা এই যে, অপরের সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ সকল নারী হারাম। এই সকল ব্যতীত যে সব নারী অবশিষ্ট রহিল, তাহাদের সংগে অবৈধ যৌনসম্পর্ক হারাম করা হইয়াছে।
(আরবি*********************************)
ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হইও না। কারণ উহা একদিকে যেমন অশ্লীলতা, অপরদিকে ইহা এক ভ্রান্ত পথ।
-সূরা বনি ইসরাঈলঃ ৩২
বিবাহ
এইভাবে নিয়ন্ত্রণ ও বাধা-নিষেধ প্রয়োগের দ্বারা যৌন-উচ্ছৃংখলতার সকল পথ রুদ্ধ করা হইয়াছে। কিন্তু মানুষের পাশাবিক বিভাগের চাহিদা-বাসনা এবং কুদরতের কারখানার নির্ধারিত নিয়ম-পদ্ধতি চালু রাখিবার জন্য একটি পথ উন্মুক্ত করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, ‘এই চাহিদা ও প্রয়োজন পুরণ কর, কিন্তু বিচ্ছিন্ন ও অনিয়মতান্ত্রিক সম্পর্ক দ্বারা নহে। লুকোচুরি করিয়াও নহে, প্রকাশ্য অশ্লীলতার পথেও নহে, বরং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রকাশ্য ঘোষণার দ্বারা যেন তোমার সমাজে এ কথা সকলের কাছে পরিজ্ঞাত ও প্রকাশিত হইয়া যায় যে, অমুক পুরুষ ও নারী একে অপরের হইয়া পড়িয়াছে।
(আরবি************************)
এইসব নারী ব্যতীত আর যাহারা আছে তাহাদিগকে তোমাদের জন্য হালাল করা হইল যাহাতে তোমরা নিজের মালের [মোহর] বিনিময়ে তাহাদের সংগে আইন-সংগত সম্পর্ক স্থাপন করিতে পার, স্বাধীন যৌন সম্পর্ক নহে।……….অতএব এই সকল নারীর অভিভাবকদের অনুমতি লইয়া তাহাদিগকে বিবাহ কর।…….এমনভাবে তাহারা যেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, প্রকাশ্যে অথবা গোপনে প্রণয়িনী সাজিবার জন্য নহে।-সূরা নিসাঃ-২৪-২৫
এইখানে ইসলামের ভারসাম্য লক্ষ্য করুন। যে যৌন-সম্পর্ক বিবাহ বন্ধনের বাহিরে হারাম ও ঘৃণার্হ ছিল, উহা বিবাহের গন্ডির মধ্যে আসিয়া শুধু জায়েযই হয় নাই ইহা এক উৎকৃষ্ট পুণ্য কাজে পরিণত হইয়াছে। ইহা গ্রহণ করিবার আদেশ দেওয়া হইতেছে এবং ইহা হইতে বিরত থাকাকে অপসন্দ করা হইতেছে। স্বামী-স্ত্রীর এহেন সম্পর্ক এক ইবাদত হইয়া পড়িতেছে। এমন কি স্ত্রী যদি স্বামীর সংগত ইচ্ছা পূরণ করা হইতে বাচিবার জন্য নফল রোযা রাখে অথবা নামায ও তিলাওয়াতে মগ্ন হয়, তাহা হইলে সে গুনাহগার হইবে। এই প্রসংগে নবী করীম (স)-এর কতিপয় মহান বাণী শ্রবণ করুনঃ
(আরবি******************************)
তোমাদের বিবাহ করা উচিত। কারণ চক্ষুদ্বয়কে কুদৃষ্টি হইতে রক্ষা করিতে এবং লজ্জাস্থানের রক্ষাণাবেক্ষণ করিতে বিবাহ এক উৎকৃষ্ট পন্থা। তোমাদের মধ্যে যাহাদের বিবাহ করার ক্ষমতা নাই, সে যেন রোযা রাখে। কারণ রোযা যৌন-বাসনা দমন করে। -তিরমিযী
(আরবী***************************************)
আল্লাহর কসম, আল্লাহকে ভয় করিবার এবং তাঁহার অসন্তোষ হইতে বাঁচিবার ব্যাপারে আমি তোমাদের সর্বাগ্রে। তথাপি আমি রোযা রাখি, ইফতার করি, নামায পড়ি, রাত্রিতে নিদ্রা যাই এবং বিবাহ করি। ইহা আমার সুন্নত এবং যে ব্যক্তি আমার সুন্নত হইতে বিরত থাকে তাহার সংগে আমার কোন সম্পর্ক নাই।-বুখারী
(আরবী*********************************)
স্ত্রী যেন তাহার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে রোযা [নফল] না রাখে।-বুখারী
(আরবী*****************************)
যে নারী তাহার স্বামী হইতে পৃথক হইয়া রাত্রি যাপন করে, ফেরেশতাগণ তাহার উপর অভিসম্পাত করিতে তাকে যতক্ষণ না সে স্বামীর নিকট প্রত্যাবর্তণ করে।-বুখারী
(আরবী*************************************)
যখন তোমাদের মধ্যে কেহ কোন নারীকে দেখিয়অ তাহার সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় তখন সে যেন তাহার স্ত্রীর নিকট গমণ করে। কারণ উক্ত নারীর নিকটে যাহা কিছু আছে, তাহা তাহার স্ত্রীর নিকটেও আছে। -তিরমিযী
এই সমুদয় নির্দেশের পশ্চাতে শরীআতের উদ্দেশ্য এই যে, যৌন অনাচারের সকল পথ বন্ধ করা হউক। যৌন-সম্পর্ক বিবাহ বন্ধনের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করা হউক। এই গন্ডির বাহিরে যতদূর সম্ভব কোন প্রকার যৌন উত্তেজনা না হউক। প্রকৃতির চাহিদা অনুযায়ী অথবা কোন ঘটনার দ্বারা যৌন-উত্তেজনা ঘটিলে তাহা চরিতার্থ করিবার জন্য একটি কেন্দ্র নির্ধারণ তরা হউক। সে কেন্দ্র হইতেছে স্বামীর জন্য স্ত্রী এবং স্ত্রীর জন্য স্বামী। এই সকল ব্যবস্থা এইজন্য করা হইয়াছে যাহাতে মানুষ তাহার যাবতীয় অপ্রাকৃতিক ও আপনসৃষ্ট উত্তেজনা ও বিশৃংখলা কার্যকলাপ হইতে নিজেকে বাঁচাইয়া একনিষ্ঠ শক্তি দ্বারা তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় আত্ননিয়োগ করিতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এই কারখানা পরিচালনার জন্য প্রত্যেক পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে যৌনপ্রেম ও আকর্ষণ ঢালিয়া দিয়াছেন, তাহার সবটুকুই যেন পরিবার গঠন ও তাহার স্থায়িত্বের জন্য ব্যয়িত হয়। বৈবাহিক সম্পর্ক সকল দিক দিয়াই পসন্দনীয়। কারণ ইহা মানব প্রকৃতি ও পশু প্রকৃতির ইচ্ছা এবং আল্লাহর বিধানের উদ্দেশ্য পূরণ করে। পক্ষান্তরে বিবাহ ব্যবস্থা পরিহার করা সকল দিক দিয়াই অপসন্দনীয়। কারণ ইহা দ্বারা দুইটি গর্হিত কার্যের যে কোন একটি অবশ্যই হইবেঃ হয় মানুষ প্রকৃতির বিধানের ইচ্ছা পূরণ করিবেই না এবং নিজ শক্তি প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতেই ব্যয় করিবে অথবা প্রকৃতির চাহিদায় বাধ্য হইয়া ভ্রান্ত ও অবৈধ পথে আপন কামনা চরিতার্থ করিবে।
পরিবার সংগঠন
যৌন-বাসনাকে পরিবার সৃষ্টি এবং তাহার স্থায়িত্ব বিধানের উপায় স্থির করিবার পর ইসলাম পরিবার সংগঠন করে। এখানেও সে পূর্ণ ভারসাম্যের সহিত প্রকৃতির বিধানের ঐ সকল দিকের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াছে যাহা পূর্বে আলোচিত হইয়াছে। নারী-পুরুষের অধিকার নির্ধারণে যে পরিমাণে সুবিচারের লক্ষ্য রাখা হইয়াছে তাহা আমি হাক্কুয-যওজাইন [স্বামী-স্ত্রীর অধিকার] শীর্ষক গ্রন্হ বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি। উহা অধ্যয়ন করিলে আপনি জানিতে পারিবেন যে, উভয় শ্রেণীর মধ্যে যে পরিমাণ সমতা কায়েম করা সম্ভব তাহা ইসলাম করিয়াছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিধানের পরিপন্থী কোন সমতা ইসলাম সমর্থন করে না। মানুষ হিসাবে যতখানি অধিকার পুরুষের আছে, ঠিক ততখানি নারীর ও আছে।
(আরবী**********************************)
কিন্তু কর্তা হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত মর্যাদা, স্বামীর সম্মানের অর্থে নহে, বরং প্রভাব-প্রতিপত্তির অর্থে। ইহা সুবিচার সহকারে পুরুষকে দান করা হইয়াছে।
(আরবী********************************)
এইভাবে নারী ও পুরুষের মধ্যে “গিয়ানী” ও “গিয়ান প্রদত্তে”র প্রাকৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করিয়া ইসলাম নিম্ন পদ্ধতিতে পারিবারিক সংগঠন করিয়াছেঃ
পুরুষের কর্তৃত্ব প্রভুত্ব
পরিবারের মধ্যে প্ররুষ কর্তা ও পরিচালকের মর্যাদা রাখে অর্থাৎ সে পরিবারের শাসক, রক্ষক, নৈতিক ও যাবতীয়া বিষয়ের অভিভাবক। তাহার আনুগত্য তাহার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জন্য ফরয [অবশ্য যদি সে আল্লাহ ও রাসূলের কোন নাফরমানীর আদেশ না করে]। পরিবারের জন্য জীবিকা অর্জন করা এবং জীবন যাপনের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা স্বামীর দায়িত্ব।
(আরবী************************************)
আল্লাহ তায়ালা এতদূভয়ের একজনকে যে অপরের উপরে মর্যাদাশীল করিয়াছেন তাহার ভিত্তিতে পুরুষ নারীর উপর প্রভুত্বশীল। এ কারণেও যে, পুরুষ মোহর ও ভরণ-পোষণের জন্য তাহার অর্থ ব্যয় করে।-সূরা নিসাঃ ৩৪
(আরবী********************************)
পুরুষ তাহার স্ত্রীপুত্র-পরিজনের শাসক এবং ইহার জন্য তাহাকে পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করিতে হইবে।-বুখারী
(আরবী*********************************)
পুণ্যবর্তী নারী স্বামীর অনুগত্য এবং আল্লাহর অনুগ্রহে স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাহার মযার্দা রক্ষাকারিণী।-সূরা নিসাঃ ৩৪
(আরবী************************************)
নবী (স) বলিয়াছেন, যখন কোন নারী তাহার স্বামীর বিনা অনুমতিতে গৃহ হইতে বাহির হয়, আকাশের প্রত্যেক ফেরেশতা তাহার প্রতি অভিসম্পাত করিতে থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সে প্রত্যাবর্তন না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে যে দিক দিয়া গমন করে, জ্বিন ও মানুষ ব্যতীত সকলেই তাহাকে ধিকৃত করে।
(আরবী***********************************)
তোমাদের যে সকল স্ত্রী হইতে অবাধ্যতার আশংকা হয়, তাহাদিগকে উপদেশ দান কর। যদি ইহাতে তাহারা বিরত না হয় তবে শয্যা পৃথক করিয়া দাও। ইহাতেও সংশোধন না হইলে প্রহার কর। অতপর যদি তোমার অনুগত হইয়া চলে, তবে বাড়াবাড়ি করিবার বাহানা খুঁজিও না।-সূরা নিসাঃ ৩৪
(আরবী********************************)
আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়াছি যেন পিতামাতার সংগে ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু যদি তাহারা তোমার উপরে পীড়াপীড়ি করে আমার সংগে এমন বিষয়ের শরীফ করিতে, যে সম্পর্কে তোমার নিকট প্রমাণ নাই, তাহা হইলে তাহাদের অনুগত হইও না।-সূরা আনকাবূতঃ ৮
(আরবী************************************)
এইরূপ পরিবারের সংগঠন এমনভাবে করা হইয়াছে যে, ইহার একজন কর্তা ও শাসক হইবে। যে ব্যক্তি এই নিয়ম-শৃংখলা নষ্ট করিবার চেষ্টা করিবে তাহাদের সম্পর্কে নবী (স) নিম্নের সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়াছেনঃ
(আরবী************************************)
যে ব্যক্তি স্বামী হইতে তাহার স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ করিবার চেষ্টা করিবে, তাহার সহিত আমার কোন সম্পর্ক নাই।
নারীর কর্মক্ষেত্র
এই সংগঠনে নারীকে গৃহের রাণী করা হইয়াছে। জীবিকার্জনের দায়িত্ব স্বামীর উপর এবং অর্জিত অর্থের দ্বারা গৃহের ব্যবস্থাপনা করা নারীর কাজ।
(আরবী********************************)
নারী স্বামীর গৃহের পরিচালিকা এবং এই শাসন পরিচালনার জন্য তাহাকে জবাবদিহি করিতে হইবে।-বুখারী
গৃহের বহির্ভূত কাজের দায়িত্ব হইতে তাহাকে মুক্ত করা হইয়াছে, যথাঃ জুমআর নামায তার উপর ওয়াজিব করা হয় নাই। তাহার উপর জিহাদও ফরয নহে, প্রয়োজনবোধে অবশ্য মুজাহিদীনের খিদমতের জন্য সে যাইতে পারে। পরে ইহার সুষ্ঠু আলোচনা করা হইবে। জানাযায় অংশ গ্রহণ করা তাহার প্রয়োজন নাই, বরং ইহা হইতে তাহাকে বিরত রাখা হইয়াছে।-বুখারী
তাহার উপর জামায়াতে নামায পড়ার এবং মসজিদে হাযির হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয় নাই। যদিও কিছু নিয়ন্ত্রণ সহকারে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু ইহা পসন্দ করা হয় নাই।
তাহাকে মুহরেম পুরুষের সংগে ব্যতীত ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয় নাই।-তিরমিযী
মোটকথা, সকল দিক দিয়া নারীর গৃহ হইতে বাহির হওয়া অপসন্দ করা হইয়াছে, এবং ইসলামী বিধান অনুযায়ী তাহার জন্য পসন্দনীয় কাজ এই যে, সে গৃহে থাকিবে। (আরবী******************) –[ইহার অর্থঃ গৃহের অভ্যন্তরে বসবাস কর। অনেকে বলে যে, এই আদেশ নির্দিষ্ট করিয়া নবী (স)-এর পত্নিগণের জন্য করা হইয়াছিল, কারণ “হে নবীপত্নিগণ”- বলিয়া আয়াত শুরু করা হইয়াছে। কিন্তু এই সমগ্র আয়াতটিতে যে নির্দেশাবলী দেওয়া হইয়াছে, তাহার কোনটি নবীপত্নীদের জন্য নির্দিষ্ট? বলা হইয়াছে, “যদি তোমরা পরগার হও তাহা হইলে কাহারও সংগে প্রেমালাপের ভংগীতে কথা বলিও না। কারণ তাহা হইলে যাহার অন্তরে খারাপ ধারণা আছে, সে তোমাদের সম্পর্কে কোন [খারাপ] আশা পোষণ করিতে পারে। যে কথা বলিবে তাহা সরলভাবে বলিবে। নিজের গৃহের মধ্যে অবন্থান কর। জাহিলিয়তের যুগের নারিদের ন্যায় ঠাট-ঠমক ও সজসজ্জা করিয়া বাহির হইও না। নামায পড়, যাকাত দাও, আল্লাহ রসূলের আনুগত্য কর। আল্লাহ চান যে, তিনি তোমাদিগকে অপবিত্রতা হইতে দূরে রাখেন”।
এই নির্দেশাবলী সম্পর্কে চিন্তা-বিবেচনা করুন। ইহার মধ্যে কোন নির্দেশটি এমন, যাহা সাধারণ নারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়? সাধারণ নারী সমাজ কি পরহেযগার হইবে না? তাহারা কি পর-পুরুষের সংগে প্রেমালাপের ভংগীতে কথা বলিবে? তাহারা কি নামায, যাকাত ও আল্লাহ-রাসূলের আনুগত্য হইতে বিরত থাকিবে? আল্লাহ তায়ালা কি তাহাদিগকে অপবিত্রতার মধ্যে রাখিতে চান? এই সকল নির্দেশ যদি সাধারণ নারী জাতির জন্য হয়, তাহা হইলে “তোমাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান কর” –এই কথাটিই কেন শুধু নবীপত্নিদের জন্য হইবে?
প্রকৃতপক্ষে এই সম্পর্কে ভূল ধারণা এইজন্য হইয়াছে যে, আয়াতের প্রারন্তে লোকে এই কথাগুলি দেখিতে পায়, “হে নবীপত্নিগণ! তোমরা কিন্তু সাধারণ নারীদের মত নও।“ কিন্তু বর্ণনাভংগী ঠিক এইরূপ, যেমন কোন সম্ভ্রাম্ভ সন্তানকে কলাহয়, “তোমরা তো সাধারণ লোকের সন্তানের মত নও যে, বাজারের রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইবে, অপকর্ম করিবে?
তোমাদের একটু সাবধান হইয়া চলাফেরা করা দরকার। এই কথা বলার অর্থ এই নহে যে অন্যান্য ছেলেমেয়ে হাটে বাজারে বেয়াড়ার মত ঘুরিয়া বেড়ান পসন্দনীয় এবং ভাল হওয়া তাহাদের জন্য বাঞ্চনীয় নহে বরং এইরূপ বলার দ্বারা সচ্চরিত্রের একটা মান নির্ধারণ করাই উদ্দেশ্য, যাহাতে প্রত্যেকটি বালক বালিকা সম্ভ্রান্ত সন্তানদের ন্যায় হইতেইচ্ছা করিলে যেন এই ধরনের মান [Standard]- এ পৌছিতে চেষ্টা করিতে পারে। কুরআনে নারীদের জন্য এইরূপ উপদেশের পন্থা এইজন্য অবলম্বন করা হইয়াছে যে আরব জাহিলিয়াতের যুগে নারীদের মধ্যে ঐরূপ স্বাধীনতা ছিল এখন যেমন ইউরোপে আছে। নবী পাক (স) এর মাধ্যমে ক্রমশ তাহাদিগকে ইসলামী সভ্যতার অনুসারী করা হইতেছিল এবং তাহাদের জন্য নৈতিক সীমারেখা ও সামাজিক নিয়ম শৃংখলার বন্ধন নির্ধারণ করিয়া দেওয়া হইতেছিল। এই অবস্থায় উম্মাহাতুল মুমিনীনের জীবনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিন করা হইয়াছে, যাহাতে তাঁহারা অন্য নারীদের জন্য আদর্শ হইতে পারেন ্ বেং সাধারণ মুসলমানের গৃহে তাহাদের জীবন পদ্ধতি অনুসৃত হইতে পারে। ঠিক সেইরূপ অতিমত আল্লামা আবু বকর হিসসাম তাহার আহকামুল কুরআন নামক গ্রস্থে প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি বলেন এই নির্দেশ যদিও নবী (স) ও তাহার পত্বিগণের জন্য অবতীর্ণ হইয়াছিল, তথাপি ইহার প্রয়োগ বিশ্বজনীন নবী ও সাধারণ মুসলমানের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কারণ আমরা নবীর অনুসরণের জন্য আদিষ্ট এবং যে সকল আদেশ নবীর উপর নাযিল হইয়াছে, তাহা আমাদের জন্যও। শুধু বিশেষ কয়েকটি আদেশ সম্পর্কে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে যে, তাহা শুধু নবীরই জন্য নির্দিষ্ট। উক্ত গ্রস্থ ৩য় খণ্ড]
আয়াতের স্পষ্ট মর্ম ইহাই। কিন্তু এ বিষয়ে এত বেশী কড়াকড়ি করা হয় নাই এইজন্য যে, কোন কোন অবস্থায় নারীদের বাড়ীর বাহিরে যাওয়া প্রয়োজন হইয়া পড়ে। হইতে পারে যে, কোন নারীর কোন অভিভাবক নাই। ইহাও হইতে পারে যে, পরিবারের কর্তার আর্থিক দৈন্য, বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা অথবা এইরূপ আরও বহু কারণে নারীকে বাড়ীর বাহিরে কাজ করিতে হয়। এইরূপ অবস্থায় আইনের মধ্যে যথেষ্ট অবকাশ রাখা হইয়াছে।
হাদীসে আছেঃ
(আরবী*****************************)
আল্লাহ তায়ালা তোমাদীগকে অনুমতি দিয়াছেন যে, তোমরা প্রয়োজন অনুসারে বাড়ীর বাহিরে যাইতে পার।
–বুখারী
কিন্তু নারীর কর্মক্ষেত্র যে তাহার গৃহ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার এই নিয়ম-পদ্ধতিতে পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের খাতিরে এই ধরনের অনুমতি কোন সংশোধনী আনয়ন করিতেছে না। ইহা নিছক একটি অবস্থা বিশেষে অনুমতি এবং ইহাকে এই অবস্থায়ই রাখা উচিত।
প্রয়োজনীয় বাধা-নিষেধ
সাবালক নারীকে তাহার নিজস্ব ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু একজন সাবালক পুরুষকে যে পরিমাণ স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে, ততখানি তাহাকে দেওয়া হয় নাই। যথাঃ
পুরুষ আপন ইচ্ছামত যেখানে সেখানে যাইতে পারে। কিন্তু নারী- সে কুমারী হউক, বিবাহিতা হউক অথবা বিধবা হউক, সকল অবস্থায় ইহা প্রয়োজন যে, ভ্রমণকালে তাহার সংগে একজন মুহরেম পুরুষ হইতে হইবে।
(আরবী************)
যে নারী আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তাহার জন্য ইহা জায়েয নহে যে, সে তিনদিন অথবা তাহার অধিক দিন ভ্রমণ করে অথচ তাহার সংগে তাহার পিতা অথবা ভ্রাতা, স্বামী অথবা পুত্র অথবা কোন মুহরেম পুরুষনাই।
(আরবী****************)
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত, নবী (স) বলিয়াছেন, নারী যেন এক দিন রাতের সফর না করে যতক্ষণ না তাহার সংগে কোন মুহরেম পুরুষ থাকে।
(আরবী*****************)
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে আরও বর্ণিত আছে, নবী (স) বলিয়াছেন, কোন মুসলমান নারীর জন্য হালাল নয় যে, সে কোন মুহরেম পুরুষ ব্যতীত এক রাত্রিও সফর করে। -আবু দাউদ
এই সকল বর্ণনায় সফরের সময়কাল লইয়া যে মতভেদ আছে, তাহাতে একদিন বা দুই দিন হওয়া এমন গুরুত্বপূর্ণ নহে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই যে, নারীকে একাকিনী ভ্রমণ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হয় নাই। কারণ ইহা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এইজন্য ন বী (স) সফরের সময়কাল নির্ধারণের ব্যাপারে তত গুরুত্ব দেন নাই। বিভিন্ন অবস্থা, সময় ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়কালের উল্লেখ করিয়াছেন।
আপন বিবাহের ব্যাপারে পুরুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে। মুসলমান অথবা আহলি কিতাব যে কোন নারীকে সে বিবাহ করিতে পারে এবং দাসীও রাখিতে পারে। কিন্তুনারী এ ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীন নহে। সে কোন অমুসলমানকে বিবাহ করিতে পারে না।
(আরবী************)
সে তাহাদের জন্য হালাল নহে এবং তাহারাও ইহার জন্য হালাল নহে। -সূরা মুমতাহানাঃ১০
সে গোলামের সংগেও সহবাস করিতে পারে না। দাসীর সংগে পুরুষের যেমন সহবাসের অনুমতি কুরআনে দেওয়া হইয়াছে, তেমন নারীকে দেওয়া হয় নাই। হযরত ওমর (রা)-এর কালে এক নারী কুরআনের কতর্থ করিয়া তাহার গোলামের সংগে সহবাস করে। হযরত ওমর (রা) তাহা জানিতে পারিয়া বিষয়টি আলোচনার জন্য সাহাবাগণের মজলিশে শূরায় পেশ করেন। সেখানে আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ঃ
(আরবী***********)
সে আল্লাহর কিতাবের কদর্থ করিয়াছে।
অপর একজন নারী হযরত ওমরের (র) নিকট ঐ ধরনের কার্যের অনুমতি চাহিলে তিনি তাহাকে গুরুতর শাস্তি দেন এবং বলেনঃ
(আরবী************)
যতক্ষণ আরব নারিগণ গর্হিত কর্ম হইতে নিরাপদ থাকিবে ততক্ষণই তাহাদের জন্য মংগল।
নারী গোলাম ও কাফির ব্যতীত স্বাধীন মুসলমান পুরুষের মধ্য হইতে যে কোন ব্যক্তিকে স্বামী নির্বাচন করিতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারেও তাহার পিতা, দাদা, ভাই ও অন্যান্য অভিভাবকের অনুমতি লওয়া আবশ্যক। অভিভাবকেরও এ অধিকার নাই যে, সে কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাকে কোথাও পাত্রস্থ করে। কেননা এ ব্যাপারে নবীর নির্দেশ আছেঃ
(আরবী***********)
স্বামী নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভিভাবক অপেক্ষা বালিকারই অধিকার বেশী।
(আরবী**********)
কুমারী বালিকার অনুমতি ব্যতি রেকে যেন তাহাকে পাত্রস্থ করা না হয়।
কিন্তু নারীর পক্ষেও ইহা সমীচীন নহে যে, সে পরিবারের দায়িত্বশীল পুরুষদের মতের বিরুদ্ধে যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে বিবাহ করে। এইজন্য কুরআন মজিদে যেখানেই পুরুষের বিবাহের উল্লেখ আছে সেখানে নিজে বিবাহ করার কথা বলা হইয়াছে। যথাঃ
(আরবী***********)
মুশরিক নারীকে বিবাহ করিও না।
(আরবী************)
তাহাদিগকে তাহাদের পরিবারস্থ লোকজনের অনুমতি লইয়া বিবাহ করে।
কিন্তু যেখানে নারীদের বিবাহের উল্লেখ আছে, সেখানে তাহাদিগকে বিবাহ দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে। যথাঃ
(আরবী**********)
বিধবা নারীদের বিবাহ দাও।
(আরবী**************)
মুশরিক পুরুষ ঈমান আনিবার পূর্বে তাহাদের সহিত তাহাদের সহিত তোমাদের নারীদের বিবাহ দিও না।
এই সবের অর্থ এই যে, বিবাহিতা নারী যেমন স্বামীর অধীন, ঠিক তেমনি অবিবাহিতা নারী পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তির অধীন। কিন্তু এই অধিনতার অর্থ এই নয় যে, তাহার ইচ্ছা ও কাজের কোন স্বাধীনতা নাই অথবা তাহার নিজের ব্যাপারে তাহার কোনই স্বাধীনতা নাই, ইহার প্রকৃত মর্ম এই যে, সামাজিক ব্যবস্থাকে ফাটল ও বিশৃংখলা হইতে রক্ষা করা এবং পরিবারের চরিত্র ও কার্যকলাপকে ভিতর ও বাহিরের বিপদ হইতে রক্ষা করার দাযিত্ব পুরুষের। এই শৃংখলা রক্ষার জন্যইনারীর অপরিহার্য কর্তব্য যে, এই শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব যাহার, সে তাহার আনুগত্য করিবে, সে তাহার স্বামী হউক, পিতা অথবা ভাউ হউক।
নারীর অধিকার
এইভাবে ইসলাম- (আরবী*************) – [আল্লাহ তায়ালা তাহাদের কাহারও উপরে কাহাকেও মর্যাদা দান করিয়াছেন। কে একটি প্রাকৃতিক সত্য হিসাবে স্বীকার করিবার সাথে সাথে (আরবী*********)-[তাহাদের (নারীদের) উপর পুরুষের কিছু মর্যাদা আছে] কেও সঠিকভাবে নির্ধারিত করিয়াছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে জীব-বিজ্ঞান এবং মনস্তত্বের দিক দিয়া যে পার্থক্য আছে তাহাকেও সে সঠিকরূপে স্বীকার করে। যতখানি পার্থক্য আছে তাহাকে হুবহু প্রতিষ্ঠিত রাখে এবং যেরূপ পার্থক্য আছে তদনুযায়ী তাহাদের মর্যাদা এবং ভাতা নির্ধারণ করে। ইহার পর যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তাহা হইতেছে নারীর অধিকার সম্পর্কে। এই অধিকার নির্ধারণে ইসলাম তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াছে।
প্রথমতঃ পুরুষকে যে নিছক পরিবারের শৃংখলা বজায় রাখিবার জন্য কর্তৃত্ব ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে, তাহার সুযোগ গ্রহণ করিয়া সে যেন অন্যায় করিতে না পারে এবং এমনও যেন না হয় যে, শাসক ও আনুগতের সম্পর্ক প্রভু ও দাসীর সম্পর্কে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়তঃ নারীকে এমন সব সুযোগ দান করিতে হইবে, যাহা দ্বারা সে সমাজ ব্যবস্থার গন্ডির মধ্যে স্বীয় স্বাভাবিক প্রতিভার পরিষ্ফুরণ করিতে পারে এবং তমদ্দুন গঠনে যথাসম্ভব ভালোভাবে অংশ গ্রহণ করিতে পারে।
তৃতীয়তঃ নারীর উন্নতি ও সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করা যেন সম্ভব হয়। কিন্তু তাহার উন্নতি ও সাফল্যে যাহা কিছুই হইবে তাহা নারী হিসাবেই হইবে। তাহার পুরুষ সাজিবার কোন অধিকার নাই এবং পুরুষোচিত জীবন যাপনের জন্য তাহাকে গড়িয়া তোলা-না হাতার জন্য, না তমদ্দুনের জন্য মংগলকর। আর পুরুষোচিত জীবন যাপনে সে সাফল্যে লাভও করিতে পারে না।
উপরে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখিয়া ইসলাম নারীকে যেরূপ ব্যাপক তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দিয়াছে, যে উচ্চ সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করিয়াছে, এই সকল অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণের জন্য নৈতিক ও আইনগত নির্দেশাবলীর মধ্যে যে ধরনের চিরস্থায়ী গ্যারান্টি দান করিয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর প্রাচীন ও আধূনিক কোন সমাজ ব্যবস্থায় খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
অর্থনৈতিক অধিকার
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়, যাহা দ্বারা সমাজে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যাহার দ্বারা সে তাহার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখিতে পারে তাহা হইতেছে তাহার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল আইন-কানুন নারীকে অর্থনৈতিক দিক দিয়া দুর্বল করিয়া রাখিয়াছে এবং সমাজে নারীর দাসত্বের প্রধান কারণই হইতেছে তাহার এই আর্থিক দুর্গতি। ইউরোপ এই অবস্থার অবসান চাহিল এবং তাহার জন্য নারীকে উপার্জনশীল বানাইল। ফলে ইহা আর এক বিরাট অমংগল ডাকিয়া আনিল। ইসলাম এই দুইয়ের মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করিল। ইহা নারীকে উত্তরাধিকারের বিরাট অধিকার দান করিল। পিতা, স্বামী, সন্তান ও অন্যান্য নিকট আত্নীয়ের উত্তরাধিকার [উত্তরাধিকার আইনে নারীকে পুরুষের অর্ধেক অংশ দেওয়া হইয়াছে। তাহার কারণ এই যে, নারী তাহার স্বামীর নিকট হইতে মোহর ও ভরণ-পোষণ পায়। পুরুষ এই সকল হইতে বঞ্চিত। নারীর ভরণ-পোষণ শুধু স্বামীর উপরে ওয়াজিব নহে, বরং স্বামী না থাকিলে পিতা, ভাই, সন্তান অথবা অন্যান্য আত্মীয়-মুরব্বী তাহার ভরণ-পোষণ করিতে বাধ্য। অতএব পুরুষের উপরে যে গুরু দায়িত্বি আছে তাহা যখন নারীকে দেওয়া হয় নাই, তখন উত্তরাধিকার যে অংশ পুরুষকে দেওয়া হইয়াছে তাহা নারীকে দেওয়া হয় নাই।] সে লাভ করে। উপরন্তু স্বামীর নিকট হইতে সে মোহর লাভ করে। এই সকল্য উপায়ে যে ধন-সম্পত্তি সে লাভ করে, তাহার উপর তাহার পূর্ণ মালিকানা ও স্বত্ব কয়ে হয় এবং তাহা ব্যয় করিবার পূর্ণ অধিকার তাহার পিতা, স্বামী অথবা অন্য কাহারও নাই। উপরন্তু কোন ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করিলে অথবা নিজ শ্রম দ্বারা অর্থ উপার্জন করিলে তাহারও সে মালিক হইবে। এতদসত্ত্বেও তাহার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বামীর। স্ত্রী যতই ধনশালিনী হউক না কেন, তাহার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব হইতে স্বামী মুক্ত হইতে পারে না। এইভাবে ইসলামে নারীর আর্থিক অবস্থাকে এত সুদৃঢ় করিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, অনেক সময় নারী পুরুষ অপেক্ষা অধিকতর ভাল অবস্থায় থাকে।
তামাদ্দুনিক অধিকার
স্বামী নির্বাচনে পূর্ণ অধিকার নারীকে দেওয়া হইয়াছে। তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেহ তাহাকে কোথাও বিবাহ করে, ইহাতে তাহাকে কেহ বাধা দিতে পারে না। অবশ্য যদি সে এমন লোককে স্বামী নির্বাচন করে, যে তাহার বংশের তুলনায় নিকৃষ্ট, এমতাবস্থায় তাহার অভিভাবকগণের ইহাতে আপত্তি করিবার অধিকার থাকিবে।
একজন অমনোপূত, অত্যাচারী অথবা অকর্মণ্য স্বামী হইতে বিবাহ বিচ্ছেদের পূর্ণ অধিকার নারীকে দেওয়া হইয়াছে। স্বামী উপরে স্বামীকে যে সকল অধিকার দেওয়া হইয়াছে, সদাচরণ ও দয়ার্দ্র ব্যবহারের সহিত তাহা প্রয়োগ করিতে ইসলাম নির্দেশ দিয়াছে। কুরআন বলেঃ
(আরবি**************************)
নারীদের সংগে সদ্ব্যবহার কর
(আরবি**************************)
পারস্পরিক সম্পর্ককে দয়ার্দ্র ও স্নেহশীল করিতে ভুলিও না।
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
(আরবি**************************)
তোমাদের মধ্যে তাহারাই উৎকৃষ্ট ব্যক্তি, যাহারা তাহাদের স্ত্রীর নিকটে উৎকৃষ্ট এবং যাহার আপন পরিবার-পরিজনের সহিত স্নেহশীল ব্যবহার করে।
ইহা শুধু নৈতিক উপদেশ নয়। যদি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উপর অধিকার প্রয়োগে অন্যায়-অত্যাচার করা হয়, তাহা হইলে আইনানুগ ব্যবস্থা অবলম্বন করিবার অধিকার স্ত্রীর থাকিবে।
৪. বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারী অথবা ঐ সকল নারী, যাহাদের বিবাহ আইন অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছে অথবা স্বামী হইতে যাহাদিগকে পৃথক করা হইয়াছ, তাহাদিগকে দ্বিতীয় বিবাহের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হইয়াছে এবং এই ব্যাপারে পরিষ্কার ভাষায় বলা হইয়াছে যে, পূর্ব স্বামী অথবা তাহার কোন আত্মীয়-স্বজনের কোন প্রকার অধিকার ঐ সকল নারীর উপরে নাই। এইরূপ অধিকার ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ রাষ্ট্রগুলিতে নারীকে দেওয়া হয় নাই।
৫. দেওয়ানী ও ফৌদারী আইনে নারী-পুরুষের মধ্যে পূর্ণ সাম্য কায়েমে করা হইয়াছে। ধন-প্রাণ ও মান- সম্মানের নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসলামে নারী- পুরুষের মধ্যে কোন প্রকারের পার্থক্য রাখা হয় নাই।
নারী শিক্ষা
দীনী ও পর্থিব শিক্ষা লাভ করিবার জন্য নারীকে শুধু অনুমতিই দেওয়া হয় নাই: বরং পুরুষের শিক্ষা-দীক্ষা যেমন প্রয়োজন মনে করা হইয়াছে, তাহাদের শিক্ষা-দীক্ষাও তদ্রুপ প্রয়োজন মনে করা হইয়াছে। নবী করীম (স) হইতে পুরুষগণ যেমন দীনী ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করিত, নারীগণও তদ্রুপ করিত। নারীদের জন্য সময় নির্ধারিত করা হইত এবং সেই সময়ে তাহার নবী করীম (স)-এর নিকট হইতে শিক্ষা লাভের জন্য উপস্থিত হইত। নবঅর সহধর্মিনিগণ, বিশেষে করিয়া হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও শিক্ষায়িত্রী ছিলেন এবং বড় বড় সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস, তফসীর ও ফিকাহ শিক্ষা করিতেন। সম্ভ্রান্ত লোকদের তো কথাই নাই, দাসীদিগকে পর্যন্ত দান করিবার জন্য নবী করীম (স) আদেশ করিয়াছেন। তিনি বলেনঃ
(আরবি********************************)
যাহার নিকট কোন দাসী আছে এবং সে তাহাকে ভালভাবে বিদ্যা শিক্ষা দান করে, ভদ্রতা ও শালীনতা শিক্ষা দেয়, অতপর তাহাকে স্বাধীন করিয়া বিবাহ করে, তাহার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান রহিয়াছেন।
বুখারী
অতএব মূল শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়া ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। অবশ্য শিক্ষার প্রকারে পার্থক্য আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত শিক্ষা এই যে, ইহা দ্বারা তাহাকে উৎকৃষ্ট স্ত্রী, উৎকৃষ্ট মাতা ও উৎকৃষ্ট গৃহিনীরূপে গড়িয়া তোলা হবে। যেহেতু তাহার কর্মক্ষেত্র গৃহ, সেহেতু তাহাকে এমন শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন যাহা এইক্ষেত্রে তাহাকে অধিকতর উপযোগী করিয়া তুলিতে পারে। উপরন্তু তাহার জন্য ঐ সকল জ্ঞান-বিদ্যারও প্রয়োজন, যাহা মানুষকে প্রকৃত মানুষরুপে গড়িয়া তুলিতে,তাহার চরিত্র গঠন করিতে ও দৃষ্টিভংগী প্রশস্ত করিতে পারে। এই ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা প্রত্যেক নারীর জন্য অপরিহার্য। অতপর যদি কোন নারী অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মানসিক যোগ্যতার অধিকারিণী হয় এবং এই সকল শিক্ষা-দীক্ষার পরও অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা লাভ করিতে চায়, তাহা হইলে ইসলাম তাহার পথে প্রতিবন্ধক হইবে না। কিন্তু শর্ত এই যে, সে যেন শরীআত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করে।
নারীর প্রকৃত মুক্তি [Emancipation]
এইসব শুধু অধিকারের কথা। কিন্তু ইসলাম নারীর উপর যে বিরাট অনুগ্রহ করিয়াছে, এই সব দ্বারা তাহা অনুমান করা যায় না। মনবীয় তমদ্দুনের গোটা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীতে নারী লাঞ্ছনা, লজ্জা ও পাপের প্রতিমূর্তি হিসাবে বিবেচিত হইত। পিতার জন্য কন্যার জন্মগ্রহণ বিরাট অপরাধ ও লজ্জ্র বিষয় ছিল। শ্বশুর-শাশুড়ীর সম্পর্ক লাঞ্ছনা হইতে বাঁচিবার জন্য কন্যা হত্যা করিবার প্রচলন হইয়াছিল। [কুরআন এই জাহিলী যুগের মানসিকতা ভাষায় বর্ণনা করিতেছেঃ
(আরবি********************************)
যখন তাহাদের কাহাকেও কন্যা প্রসব হওয়ার সংবাদ দেওয়া হইত, তখন তাহার মখমন্ডল মলিন হইয়া যাইত, যেন সে হলাহল পান করিল। এই সংবাদে সে এমন লজ্জিত হইত যে, তাহার জন্য মুখ সেখাইতে পারিত না। দেখাইতে পারিত না। সে এইরূপ চিন্তা করিত, ‘লাঞ্ছনা সহকার কন্যাকে গ্রহণ করিব, না তাহাকে মাটিতে প্রোথিত করিব?]
অজ্ঞ অশিক্ষিত দূরের কথা, শিক্ষিত সমাজ এ ধর্মীয় নেতাগণও বহুদিন যাবত এই দ্বন্ধের সম্মুখীন ছিলেন যে, নারী প্রকৃতই মানুষ কিনা, আল্লাহ তাহাদের মধ্যে কোন আত্না দিয়াছেন কি-না ইত্যাদি। হিন্দু ধর্মমতে বেদ নারীর জন্য নিষিদ্ধ। বৌদ্ধমতে নারীর সংগে সম্পর্ক স্থাপনকারীর জন্য নির্বানের কোন পন্থা নাই। খ্রীস্টান ও ইহুদী ধর্মমতে একমাত্র নারীই মানবীয় পাপের জন্য দায়ী। গ্রীসে গৃহিনীদের শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও তামাদ্দুনিক অধিকার ছিল না। রোম, ইরান, মিসর চীন ও অন্যান্য সভ্যতার কেন্দ্রে নারীর অবস্থা প্রায়ও অনুরূপ ছিল। শতাব্দীর দাসত্ব, অধীনতা ও বিশ্বজনীন ঘৃণা-লাঞ্ছনার ফলে নারীর মন হইতে আত্নসম্মানের অনুভূতি মিটিয়া গিয়াছিল। পৃথিবীতে সে কোন অধিকার লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং তাহার জন্য কোন সম্মানের স্থান আছে, এ কথা সে ভুলিয়া গিয়াছিল। পুরুষ তাহার উপর অন্যায়-অত্যাচার করাকে নিজের অধিকার মনে করিত এবং নারী এইসব উৎপীড়ন সহ্য করাকে তাহার কর্তব্য মনে করিত। তাহার মধ্যে দাসত্বের মনোভাব বদ্ধমূল করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, সে নিজের দাসত্বের মনোভাব এমনভাবে বদ্ধমূল করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, সে নিজের স্বামীর দাসী বলিতে গর্ব অনুভব করিত এবং পতি আরাধনা তাহার ধর্ম ছিল।
এইরূপ অবস্থায় শুধু আইনের দিক দিয়া নহে, বরং মানসিক দিক দিয়াও এক বিরাট বিপ্লব যে আনয়ন করিয়াছে , সে হইতেছে ইসলাম। একমাত্র ইসলামই নারী-পুরষে উপরিউক্ত মানসিকতার পরিবর্তন আনিয়াছে। আজকাল নারী অধিকার, নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের যে শ্লোগান আপনি শুনিতেছেন তাহা ঐ বিপ্লবী বাণীরই প্রতিধ্বনি, যাহা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মুখে উচ্চারিত হইয়াছিল। তিনি মানবীয় চিন্তাধারার গতি পরিবর্তন করিয়া দিয়াছিলেন এবং একমাত্র তিনিই বিশ্ববাসীকে এই কথা শুনাইয়া দিয়াছিলেন যে, নারী ঠিক এইরূপই একটি মানুষ, যেমন পুরুষ।
(আরবি***************************)
তোমাদের সকলকে আল্লাহ তায়ালা একটি মানুষ হইতেই সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তাহা হইতেই জোড়া সৃষ্টি করিয়াছেন। আল্লহার দৃষ্টিতে নারী পুরুষের মধ্যে কোনই পার্থক্য নাই।
সূরা নিসাঃ১
(আরবি***************************)
পুরুষ যেমন কার্য কারবে তেমন ফল পাইবে এবং নারী যেমন কার্য করিবে ঠিক তাহার ফল করিবে।
সূরা নিসাঃ ৩২
ঈমান ও ভাল আমলে সংগে আধ্যত্নিক উন্নতির জন্য যেরূপ মর্যাদা পুরুষ লাভ করিতে পারে, তদ্রুপ মর্যাদার পথ নারীর জন্যও উন্মুক্ত আছে। পুরুষ যদি ইব্রাহীম বিন-আদম হইতে পারে, তবে নারীর রাবেয়া বসরী হওয়ার পথে কেহ প্রতিবন্ধক হইতে পারে না।
(আরবি***************************)
তাহাদের প্রভু তাহাদের প্রার্থনার প্রত্যুত্তরে বলিলেন, আমি তোমাদের মধ্যে কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করিব না-সে আমলকারী পুরুষ হউক বা নারী হউক, তোমরা একজন অন্যজন হইতে হইয়াছে।
-আলে ইমরানঃ ১৯৫
(আরবি***************************)
এবং যে কেহই উৎকৃষ্ট করিবে-সে স্ত্রীলোক হউক অথবা পুরুষ হউক-কিন্তু যদি সে ঈমানদার হয়, তাহা হইলে এই ধরনের লোক বেহেশতে প্রবেশ করিবে এবং তাহাদের প্রতি তিল পরিমাণ অন্যায় করা হইবেনা।
_নিসাঃ ১২৪
আবার মুহাম্মদ (স)_ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পুরুষকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন যে, নারীর উপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, তদ্রুপ পুরুষের উপরও নারীর অধিকার আছে।
(আরবি***************************)
নারীর যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, তেমনই তাহার অধিকারও আছে।
উপরন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) নারীরকে লজ্জা, অপমান ও লাঞ্ছনা হইতে মুক্ত করত মান-মর্যাদায় ভূষিত করিয়াছেন। তিনি পিতাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, কন্যা তাহার জন্য লজ্জাকর নয়, বরং তাহার প্রতিপালন ও হক আদায় কারার দ্বারা তাহার বেহেশত লাভ হইতে পারে।
(আরবি***************************)
যদি কোন ব্যক্ত তাহার দুইটি কন্যাকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করে, তাহা হইলে সেই ব্যাক্তি ও আমি কিয়ামতে এমনভাবে একত্রে আগমন করিব যেমন আমার দুইটি অংগুলি একত্র আছে।
মুসলিম
(আরবি***************************)
যদি কাহারাও কন্যা-সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং সে তাহাদের প্রতিপালন করে তাহা হইলে তাহারা তাহার জন্য দোযখের প্রতিবদ্ধক হইবে।
-নাসয়ী
নবী করীম (স)-ই স্বামীকে বলিয়া দিয়াছেন যে, উত্তম স্ত্রী তাহার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় নিয়ামত।
(আরবি***************************)
দুনিয়ার নিয়ামতসমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নিয়ামত ভাল স্ত্রী
নাসায়ী
(আরবি***************************)
পৃথিবীতে বস্তুসমূহের মধ্যে নারী ও সুগন্ধি আমার নিকটে সর্বাপেক্ষা প্রিয় এবং নামায আমার চক্ষু শীতলকারী।
নাসায়ী
(আরবি***************************)
পৃথিবীর নিয়ামতসমূহের মধ্যে উৎকৃষ্ট স্ত্রী হইতে উৎকৃষ্টতর আর কিছুই নাই।
ইবনে মাজাহ
একমাত্র ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-ই কথা বলিয়াছেন যে, আল্লাহ ও রসূলের পরে সবচেয়ে অধিক সম্মান, মর্যাদা ও সদ্ব্যবহার পাইবার যোগ্য মাতা।
(আরবি***************************)
এক ব্যাক্তি বলিল, “হে আল্লাহর রসূল। আমার নিকট হইতে সদ্ব্যবহার পাইবার সবচাইতে বেশী অধিকার কাহার?” রসূল বলিলেন, “তোমার মাতার।“ সে বলিলঃ তাহার পর কাহার?” তিনি বলিলেন, “তোমার মাতার“ সে বলিল, অতপর কাহার?” তিনি বলিলেন, তোমার মাতার।“ সে বলিলঃ “তাহার পর কাহার?” তিনি বলিলেন, “তোমার পিতার।“
বুখারী।
(আরবি***************************)
মাতার অবাধ্যতা ও অধিকার হরণ আর্লঅহ তায়ালা তোমার জন্য হারাম করিয়া দিয়াছেন। -বুখারী
নবী করীম (স) মানুষকে এই মর্মকথাটিও বলিয়া দিয়াছেন যে, ভাবপ্রবণতার আধিক্য, ইন্দীয়ানুভূতির কমনীয়তা এবং চরম পন্থার দিকে ঝুঁকিয়া পড়া নারীর স্বভাব। এই স্বভাবের উপর আল্লাহ তাহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং ইহা নারীত্বের জন্য দূষণীয় নহে , বরং ইহাই তাহার সৌন্দর্য। মানুষ ইহা হইতে যতটুকুই সুবিধা ভোগ করিতে পারে, তাহা পারে তাহাকে উক্ত স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখিয়াই। তাহাকে পুরুষের ন্যায় সোজা ও কঠিন বানাইবার চেষ্টা করিলে সে ভাঙ্গিয়া যাইবে।
এইরূপ নবী করীম (স)-ই সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি নারী সম্পর্কে শুধু পুরুষের নয়, নারীরও মনোবৃত্তি পরিবর্তন করিয়া দিয়াছেন এবং জাহিলী যুগের মনোবৃত্তির পরিবর্তে এক সঠিক মনোবৃত্তি সৃষ্টি করিয়াছেন, যাহার ভিত্তি ভাবপ্রবণতার উপর নহে, বরং জ্ঞানবুদ্ধিরর উপরে প্রতিষ্ঠিত। অতপর তিনি শুধু আধ্যাত্নিক সংস্কার-সংশোধন করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, আইনের সাহায্যে নারীর অধিকার রক্ষা এবং পুরুষের অন্যায়-অত্যাচার প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা করিয়াছেন। উপরন্তু তিনি নারীদের মধ্যে এতখানি চেতনার সঞ্চার করিয়া দিয়াছেন, যাহাতে তাহারা নিজেদের ন্যায়সংগত অধিকার বুঝিতে পারে এবং তাহা সংরক্ষণের জন্য আইনের আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারে।
নারীদের জন্য নবী (স)-এর মধ্যে এতখানি দয়া ও স্নেহ-মমতা ছিল এবং তিনি তাহাদের এত বড় রক্ষক ছিলেন যে, তাহাদের প্রতি কণামাত্র অন্যায়- অবিচার হইলে তৎক্ষনাৎ তাহারা নবীর নিকটে নালিশ করিত। পুরুষেরাও ভীত-সন্ত্রস্ত থাকিত এই ভাবিয়া যে, হয়ত কখন বা স্ত্রীলোকেরা তাহাদের বিরুদ্ধে নবীর নিকট নালিশ করিয়া বসে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলিয়াছেনঃ
যতদিন নবী (স) জীবিত ছিলেন, আমরা আমাদের স্ত্রীদের বিষয়ে বড় সাবধান হইয়া চলিতাম, যেন আমাদের জন্য হঠাৎ কোন শাস্তিমূলক আদেশ অবতীর্ণ না হয়। নবী (স) –এর ইন্তেকালের পর আমরা তাহাদের সংগে প্রাণ খুলিয়া কথাবার্তা বলিতে লাগিলাম। -বুখারী
ইবনে মাজাহর বর্ণনায় জানা যায় যে, নবী (স) স্ত্রীর উপর হাত উঠাইতে নিষেধ করিয়াছেন। একবার হযরত ওমর (রা) অভিযোগ করিলেন যে, নারীরা বড় উদ্ধত হইয়া পড়িয়াছে। তাহাদিগকে অনুগত করিবার জন্য প্রহার করিবার অনুমতি থাকা উচিত। নবী (স) অনুমতি দিলেন। মানুষ যেন কতদিন হইতে প্রস্তুত হইয়ািই ছিল। অনুমতি পাইবার পর সেইদিনই সত্তরজন স্ত্রীলোক স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হইল। পরদিন নবীগৃহে অভিযোগকারিণীদের ভীড় জমিল। নবী (স) লোকদিগকে সমবেত করিয়া বলিলেনঃ
(আরবী************************************************)
আজ সত্তর জন নারী নবী মুহাম্মদ (স) –এর পরিবার-পরিজনকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। তাহাদের প্রত্যেকে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতেছিল। যাহারা এ ধরনের কাজ করিয়াছে, তাহারা তোমাদের মধ্যে ভাল লোক নহে।
এইরূপ নৈতিক ও আইনগত সংস্কারের ফল এই যে, ইসলামী সমাজে নারীকে এত উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে যে, পৃথিবীর অন্য কোন সমাজে তাহার দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। একজন মুসলমান নারী পার্থিব জীবনে ও দীনের ব্যাপারে বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক ও ভাল বুদ্ধির দিক দিয়া সম্মান ও উন্নতির এমন উচ্চতর শিখরে আরোহণ করিতে পারে, যেখানে পুরুষই কেবল আরোহণ করিতে পারে। তাহার নারী জীবন কোন দিক দিয়াই এ পথে প্রতিবন্ধক নয়। আজিকার এই বিংশতি শতাব্দীতে পৃথিবী ইসলাম হইতে বহু পশ্চাতে। ইসলাম যে চিন্তাধারার শিখরে উপনীত হইয়াছে, মানবীয় চিন্তাধারার উন্নতি তথায় উপনীত হইতে পারে নাই। পাশ্চাত্য দেশগুলি নারীকে যাহা কিছু দান করিয়াছে, তাহা নারী হিসাবে করে নাই, বরং নারীকে পুরুষ বানাইয়া তাহা করিয়াছে। নারী প্রকৃতপক্ষে আজও তাহাদের দৃষ্টিতে হেয়, যেরূপ জাহিলী যুগে ছিল। গৃহের রাণী, স্বামীর স্ত্রী, সন্তানের মাতা; মোটকথা, একটি প্রকৃত নারীর জন্য এখনও কোন মর্যাদা নাই। সম্মান-মর্যাদা যদি থাকে তবে ঐ ‘স্ত্রীলিংগ-পুরুষের’ অথবা পুরুষরূপী স্ত্রীলোকের –যে দৈহিক দিক দিয়া নারী কিন্তু মানসিকতার দিক দিয়া পুরুষ এবং তমদ্দুন ও সমাজে পুরুষের ন্যায় কাজ করে। অর্থাৎ ইহা নারীত্বের মর্যাদা নহে, পুরুষত্বেরই মর্যাদা! অতপর হীনমন্যতার [Inferiority Complex], মানসিক বৈকল্যের স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, পাশ্চাত্য নারী গর্ব সহকারে পুরুষের পোশাক পরিধান করে অথচ কোন পুরুষ নারীর পোশাক পরিধান করত জনসাধারণ্যে বাহির হইবার ধরণাও করিতে পারে না। স্ত্রী হওয়া পাশ্চাত্য নারীদের নিকটে অবমাননাকর। অথচ স্বামী হওয়া কোন পুরুষের নিকটে অবমাননাকর নহে। পুরুষোচিত কাজ করিতে নারী সম্মানবোধ করে। অথচ গৃহিনীপণা ও সন্তান প্রতিপালনের ন্যায় নারীর কাজে কোন পুরুষ সম্মান দান করে নাই। এইকাজ একমাত্র ইসলামই করিয়াছে যে, নারীকে তাহার স্বাভাবিক স্থানে রাখিয়া তমদ্দুন ও সমাজে তাহাকে উচ্চ মর্যাদা দান করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারীত্বের মর্যাদা সমুন্নত করিয়াছে। ইসলামী তমদ্দুন নারীকে নারী এবং পুরুষকে পুরুষ রাখিয়া উভয়ের নিকট হইতে পৃথক পৃথক ভাবে ঐ সকল কাজ লইয়া থাকে, যাহার জন্য প্রকৃতি তাহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছে। অতপর প্রত্যেককে তাহার নিজের স্থানে রাখিয়া সম্মান, উন্নতি ও সাফল্যের সমান সুযোগ দিয়াছে। তাহার দৃষ্টিতে নারীত্ব ও পুরুষত্ব উভয়ই মানবতার প্রয়োজনীয় অংশ। তমদ্দুন গঠনে উভয়ের গুরুত্ব সমান। উভয়ে নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে থাকিয়া যে সেবাকার্য করে, তাহা সমান মংগলকর ও সমান মর্যাদার অধিকারী। না পুরুষত্বে কোন আভিজাত্য আছে, না নারীত্বে কোন অপমান। পুরুষ থাকিয়া পুরুষোচিত কাজ করিলে পুরুষের যেমন সম্মান, উন্নতি ও সাফল্য লাভ হয়, ঠিক তেমনি নারী নারী থাকিয়া নারীসুলভ কাজ করিলে তাহাতেই তাহার সম্মান, উন্নতি ও সাফল্য লাভ হইবে। একটি সৎ তমদ্দুনের কাজ এই যে, সে নারীকে তাহার স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে রাখিয়া পরিপূর্ণ মানবীয় অধিকার দান করিবে, সম্মান ও শ্রদ্ধায় ভূষিত করিবে, শিক্ষা-দীক্ষার দ্বারা তাহার প্রছন্ন প্রতিভার বিকাশ করিবে এবং ঐ কর্মেক্ষত্র ও গণ্ডির মধ্যেই তাহার উন্নতি ও সাফল্যের পথ উন্মুক্ত করিয়া দিবে।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা
।।তিন।।
সংরক্ষণ
এই ছিল ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার পূর্ণ কাঠামো। এখন সম্মুখে অগ্রসর হইবার পূর্বে এই কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি আর একবার দেখিয়া লউন।
১. এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সমষ্গিত পরিবেশকে যথাসম্ভব যৌন উত্তেজনা ও যৌন আন্দোলন হইতে পবিত্র রাখা, যাহাতে মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তি একটা পবিত্র ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে স্ফুরিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং নিজের সংরক্ষিত ও সমবেত শক্তি দ্বারা তমদ্দুন গঠনে অংশ গ্রহণ করিতে পারে।
২. যৌন সম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে বৈবাহিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিতে হইবে এবং এই গণ্ডির বাহিরে শুধু কর্ম-বিশৃংখলাই রোধ করা হইবে না, বরং চিন্তা-বিশৃংখলারও সকল পথ যথাসম্ভব রোধ করা হইবে।
৩. নারীর কর্মক্ষেত্র পুরুষের কর্মক্ষেত্র হইতে পৃথক হইবে। উভয়ের স্বভাব-প্রকৃতি এবং মানসিক ও দৈহিক যোগ্যতার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া তমদ্দুনের পৃথক পৃথক কার্যভার তাহাদের উপর ন্যস্ত করা হইবে। তাহাদের সম্পর্ক সংগঠন এমনভাবে করা হইবে যে, বৈধ সীমারেখার ভিতরে একে অপরের সাহায্যকারী হইবে। কিন্তু সীমারেখা অতিক্রম করিয়া কেহ কাহারও কার্যে হস্তক্ষেপ করিবে না।
৪. পরিবারের নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে পুরুষ পরিচারকের মর্যাদা লাভ করিবে এবং গৃহের সকলেই গৃহস্বামীর অনুগত থাকিবে।
৫. নারী-পুরুষ উভয়ের মানবিক অধিকার থাকিবে এবং উভয়কে উন্নতির সুযোগ দিতে হইবে। কিন্তু সমাজে তাহাদের জন্য যে সীমারেখা নির্ধারিত আছে, তাহার তাহা লংঘন করিতে পারিবে না।
এই চিত্রের উপরে যে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করা হইয়াছে তাহার জন্য এমন কিছু সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন, যাহা দ্বারা উহার শৃংখলা যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসহ অক্ষুণ্ণ থাকিতে পারে। ইসলামের এই সংরক্ষণ ব্যবসথা তিন প্রকারেরঃ
ক) আধ্যাত্মিক সংস্কার,
খ) শাস্তি বিধায়ক আইন-কানুন,
গ) প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
সামাজিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের উপযোগিতার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া এই তিন প্রকার সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হইয়াছে এবং ইহা সম্মিলিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে।
আধ্যাত্মিক সংস্কারের দ্বারা মানুষকে এমনভাবে দীক্ষা দেওয়া হয় যে, সে আপনা-আপনি এই সামাজিক ব্যবস্থঅর আনুগত্যের জন্য অগ্রসহর হয়, বাহিরে এই আনুগত্যের জন্য তাহাকে বাধ্য করিবার কোন শক্তি থাকুক, আর নাই থাকুক।
শাস্তিমূলক আইনের দ্বারা এই ব্যবস্থায় ধ্বংসকারী সকল প্রকার অপরাধে পথ রুদ্ধ করা হয়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দ্বারা সামাজিক জীবনে এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হইয়াছে যাহা অস্বাভাবিক উত্তেজনা ও কৃত্রিম গতিবিধি হইতে সমাজের পরিবেশকে পবিত্র করিয়া দেয় এবং যৌন-উচ্ছৃংখলতার আশংকা একেবারে কমাইয়া দেয়। নৈতিক শিক্ষা দ্বারা যাহাদের আধ্যাত্মিক সংস্কার হয় নাই এবং শাস্তিমূলক আইনেরও ভয় যাহারা করে না, এই পদ্ধতি তাহাদের পথে এমন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে যে, যৌন-উচ্ছৃংখলতার প্রতি তাহাদের আগ্রহ-বাসনা থাকা সত্ত্বেও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা তাহাদের জন্য কঠিন হইয়া পড়ে। উপরন্তু ইহা এমন পদ্ধতি যে, ইহা নারী-পুরুষের ক্ষেত্র পৃথক করিয়া দেয়, পরিবারের শৃংখলা সত্যিকার ইসলামী পন্থায় কায়েম করে এবং ঐ সকল সীমারেখার রক্ষণাবেক্ষণ করে যাহা নারী-পুরুষের জীবনে পার্থক্য প্রতিষ্ঠিত রাখিবার জন্য ইসলাম নির্ধারিত করিয়া দিয়াছে।
আধ্যাত্মিক সংস্কার
ইসলামে আনুগত্যের ভিত্তি পরিপূর্ণরূপে ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁহার কিতাব ও রসূলের উপর ঈমান রাখে, শরীয়তের আদেশ-নিষেধ তাহারই জন্য। আদেশ মানিবার জন্য এবং নিষেধ হইতে বিরত থাকিবার জন্য তাহার এতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন যে, আল্লাহ অমুক বিষয়ের আদেশ করিয়াছেন এবং অমুক বিষয়ে নিষেধ করিয়াছেন। অতএব যখন কোম মু’মিন আল্লাহর কিতাব হইতে জানিতে পারে যে, আল্লাহ অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ নিষিদ্ধ করিয়াছেন, তখন তাহার ঈমান দাবী করে যে, সে উক্ত কাজ হইতে বিরত থাকুক এবং নিজের মনকেও ঐ সকল কাজে আকৃষ্ট করা হইতে বিরত রাখুক। এমনিভাবে একজন নারী যখন জানিতে পারে যে, আল্লাহ ও তদীয় রসূল সমাজের মধ্যে তাহার কি স্থান রাখিয়াছেন, তখন তাহার ঈমানের দাবিই এই হয় যে, সে নারী যেন সন্তুষ্ট চিত্তে ও আগ্রহ সহকারে সেই স্থান মানিয়া লয় ও নিজের সীমা লংঘন কা করে। এইভাবে জীবনের অন্যান্য বিভাগের ন্যায় নৈতিকতা ও সামাজিকতার গণ্ডিতেও ইসলামের সঠিক ও পরিপূর্ণ আনুগত্য নির্ভর করে ঈমানের উপরে। এই কারণেই নৈতিকতা এবং সামাজিকতা সম্পর্কে কোন নির্দেশ দিবার পূর্বে ইসলামে সর্বপ্রথম ঈমানের দিকে আহবান জানান হইয়াছে এবং উহা হৃদয়ে বদ্ধমূলক করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে।
ইহা আধ্যাত্মিক সংস্কারের এমন মৌলিক উপায়, যাহার সম্পর্কে শুধু নৈতিকতার সংগেই নহে, বরং পূর্ণ ইসলামী ব্যবস্থার সংগে রহিয়াছে। অতপর বিশেষ করিয়া চরিত্রের গণ্ডিতে ইসলাম শিক্ষা-দীক্ষার এমন এক বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করিয়াছে, যাহার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হইলঃ
লজ্জাঃ
পূর্বে বলা হইয়াছে যে, মানুস তাহার পশু-প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হইয়া ভ্যবিচচার, চুরি, মিথ্যা ও অন্যান্য অপরাধ করিয়া থাক্ এই সমুদয়ই মানব-প্রকৃতির পরিপন্থী। এই কার্যগুলিকে কুরআনের ভাষায় ‘মুনকার’ বল হইয়াছে। ‘মুনকার’ শব্দের অর্থ ‘অজ্ঞ’ বা ‘অপরিচিত’। এই সকল কার্যকে ‘মুনকার’ বলার অর্থ ইহা এমন কাজ যে, মানব-প্রকৃতি যখন এসব কার্যের সহিত পরিচিতি নহে এবং তাহার পশু-প্রকৃতি তাহাকে সকল কার্য করিতে বাধ্য করে, যাহা এই সকল ‘মুনকার’ বা অপরিচিত কার্য ঘৃণার চক্ষে দেখিবে। বিজ্ঞ শরীঅত প্রণেতা এই বস্তু বা উপাদানের দিকে অংগুলি নির্দেশ করিয়াছেন এবং তাহা হইতেছে ‘লজ্জা’।
‘মুনকার’ কার্যগুলির প্রতি আকৃষ্ট মানুষ স্বীয় প্রকৃতির নিকটে এবং আল্লাহর নিকটে যে লজ্জা অনুভব করে, তাহাকেই ইসলামী পরিভাষায় ‘হায়া’ বলা হইয়াছে। হায়া অর্থ লজ্জা। এই লজ্জা এমন এমন এক শক্তি, যাহা মানুষকে অশ্লীলতা ও অন্যান্য মুনকার বা গর্হিত কার্য হইতে বিরত রাখে। যদি কখনও সে পশু-প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হইয়া কোন মন্দ কাজ করিয়া ফেলে, তাহা হইলে এই বস্তুই [লজ্জা] তাহার অন্তকরণকে দংশন করে। ইসলামী নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার সংক্ষিপ্তসার এই যে, সে লজ্জার এই প্রচ্ছন্ন উপাদানকে মানব-প্রকৃতির তলদেশ হইতে বাহির করিয়া জ্ঞান, বোধশক্তি ও উপাদানকে মানব-প্রকৃতির তলদেশ হইতে বাহির করিয়া জ্ঞান, বোধশক্তি ও চেতনার পথ দ্বারা প্রতিপালিত করে এবং একটি সুদৃঢ় নৈতিক অনুভূতি সৃষ্টি করত তাহাকে মানুষের মনের মধ্যে এক প্রহরী হিসাবে নিযুক্ত করে। ইহা নিম্নোক্ত হাদীসেরই ব্যাখ্যাঃ
(আরবী************************************************************************)
প্রতিটি দীনের একটি চরিত্র আছে এবং ইসলামের চরিত্র লজ্জা।
অপর একটি হাদীসও ইহার উপর আলোকপাত করেঃ
(আরবী**********************************************)
তোমার যদি লজ্জাই না থাকে, তবে যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।
কারণ যখন লজ্জাই থাকিল না, তখন পশু-প্রকৃতির সূচনা প্রবৃত্তি মানুষের উপর জয়ী হয় এবং তখন তাহার নিকটে ‘মুনকার’ আর ‘মুনকার’ থাকে না।
মানবের প্রকৃতিগত লজ্জা একটা আকৃতিবিহীন উপাদানের ন্যায়, যাহা কোন আকৃতি অবলম্বন করে না। সমুদয় গর্তিত কার্যের প্রতি তাহার একটা স্বভাবসুলভ ঘৃণা থাকে, কিন্তু তাহার মধ্যে কোন বোধজ্ঞান থাকে না। এই কারণে কোন বিশেষ কাজে তাহার ঘৃণা কেন, তাহা সে জানে না-এই অজ্ঞতা ক্রমশ তাহার ঘৃণার অনুভূতিকে দুর্বল করিয়া ফেলে। অতপর পাশবিক প্রবৃত্তির চাপে মানুষ গর্হিত কাজ করিতে আরম্ভ করে এবং পুন পুন ইহা করিবার পর অবশেষে লজ্জার অনুভূতি নষ্ট হইয়া যায়। ইসলামী নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য এই অজ্ঞতা দূর করা। ইহা তাহাকে শুধু প্রকাশ্যে ‘মুনকার’ কার্যগুলি সম্পর্কে পরিজ্ঞাত করে না, বরং অন্তরের গোপন কোণে সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়া ধরে। এক একটি গর্হিত কাজের অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে তাহাকে সাবধান করিয়া দেয় যেন সে অন্তর্দৃষ্টি সহকারে তাহাকে ঘৃণা করে। অতপর নৈতিক শিক্ষা এই শিক্ষাপ্রাপ্ত লজ্জাকে এত দূর অনুভূতিশীল করিয়া তোলে যে, গর্হিত কাজের প্রতি সামান্যতম প্রবণতাও তাহার নিকটে গোপন থাকে না এবং ইচ্ছা-বাসনার সামান্য ত্রুটি সম্পর্কেও সে সাবধানবাণী উচ্চারণ না করিয়া ছাড়ে না।
ইসলামী নৈতিকতার মধ্যে লজ্জার পরিসীমা এত ব্যাপক যে, জীবনের কোন বিভাগ ইহার বহির্ভূত নহে। যেমন, তমদ্দুন ও সমাজের যে বিভাগটি মানবের যৌনজীবনের সংগে সংশ্লিষ্ট, ইসলাম তাহার মধ্যেও নৈতিক সংস্কারের জন্য ইহার সাহায্য গ্রহণ করিয়াছে। ইহা যৌন সংক্রান্ত ব্যপারে মানব মনের মৃদু মধুর গোপন কথাটি ধরাইয়া দিয়া লজ্জাকে সে সম্পর্কে সাবধান করিয়া দিয়া তাহার তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত করে। এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নাই। শুধু কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়াই ক্ষান্ত হইব।
মনের চোর
আইনের দৃষ্টিতে দৈহিক সংযোগ-সংমিলনে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। কিন্তু নৈতিকতার দৃষ্টিতে দাম্পত্য-গণ্ডির বাহিরে বিপরীত লিংগের প্রতি আসক্তি ইচ্ছা ও বাসনার দিক দিয়া ব্যভিচার। অপরিচিতের সৌন্দর্যে চক্ষু জুড়ানো, তাহার কণ্ঠ স্বরে কর্ণকূহরে আনন্দ উপভোগ, কথোপকথনে কমনীয় বাক-ভংগী, তাহার বাসস্থানের দিকে পুনপুনঃ পদক্ষেপ –এই সকলই ব্যভিচারের ভূমিকা এবং অর্থের দিক দিয়া ব্যভিচার। আইন এহেন ব্যভিচার ধরিতে পারে না। ইহা মনের চোর এবং একমাত্র মনের পুলিশই ইহাকে গ্রেফতার করিতে পারে। এই প্রসঙ্গে হাদীসে এইভাবে সাবধানবাণী উচ্চারিত হইয়াছেঃ
(আরবী************************************************************************)
চক্ষুদ্বয় ব্যভিচার করে, দৃষ্টি তাহাদের ব্যভিচার; হস্তদ্বয় ব্যভিচার করে, স্পর্শ তাহাদের ব্যভিচার; পদদ্বয় ব্যভিচার করে, এই পথে চলা তাহাদের ব্যভিচার; কথোপকথন জিহ্বার ব্যভিচার; কামনা-বাসনা মনের ব্যভিচার; অবশেষে যৌনাংগ এই সকেলর সত্যতা অথবা অসত্যতা প্রমাণ করে।
দৃষ্টির অনিষ্ট
মনের বড় চোর দৃষ্টি। এইজন্য কুরআন পাক ও হাদীস শরীফ সর্বপ্রথম ইহা ধরাইয়া দেয়। কুরআন বলেঃ
(আরবী*********************************************************)
হে নবী! মু’মিন পুরুষদিগকে বলিয়া দিন, তাহারা যেন অপর স্ত্রীলোক হইতে আপন দৃষ্টি ফিরাইয়া রাখে এবং স্বীয় লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইহা তাহাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা। তাহারা যাহা করে, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। এবং হে নবী! মু’মিন স্ত্রীলোকদিগকে বলিয়া দিন তাহারা যেন অপর পুরুষ হইতে তাহাদের দৃষ্টি ফিরাইয়া রাখে এবং লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে। -সূরা নূরঃ ৩০-৩১
হাদীসে আছেঃ
(আরবী***********************************************)
হে মানব সন্তান! তোমাদের প্রথম দৃষ্টি তো ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু সাবধান দ্বিতীয়বার যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ না কর। -জাসসাস
হযরত আলী (রা) –কে বলা হইয়াছিলঃ (আরবী*************************************************)
হে আলী! প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করিও না। প্রথমটি ক্ষমার যোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়।
হযরত জাবের (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হঠাৎ যদি দৃষ্টি পড়ে, তাহা হইলে কি করিব? নবী বলিলেন, ‘তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরাইয়া লইও”। -আবু দাউদ
সৌন্দর্য প্রদর্শনীর প্রবণতা
নারীহৃদয় সৌন্দর্য প্রদর্শনের বাসনাও দৃষ্টির কুফলের একটি হেতু। বাসনা সকল সময়ে সুস্পষ্টও হয় না। মনের যবনিকার আড়ালে কোথাও না কোথাও সৌন্দর্য প্রদর্শনের বাসনা লুক্কায়িত থাকে এবং তাহাই বেশভূষার সৌন্দর্যে, চুলের পরিপাটিতে, মিহি ও সৌখিত বস্ত্র নির্বাচনে এবং এইরূপ অন্যান্য ব্যাপারে প্রকাশিত হইয়া পড়ে। কুরআন এই সকলের জন্য ‘তাবার-রুজে জাহিলিয়াত’ নামে এক সার্বিক পরিভাষা ব্যবহার করিয়াছে। স্বামী ব্যতীত অপরের চক্ষু জুড়াইবার উদ্দেশ্যে যে সৌন্দর্য প্রদর্শন ও বেশভূষা করা হয় তাহাকেই বলে ‘তাবার-রুজে জাহেলিয়াত’। এই উদ্দেশ্যে যদি কোন সুন্দর হয় তাহাও ‘তাবার-রুজে জাহেলিয়াতে’ পরিগণিত হইবে। ইহার জন্য কোন আইন প্রণয়ন করা যায় না। ইহা নারীর বিবেকের উপর নির্ভরশীল। নিজের মনের হিসাব তাহাকে নিজেই লইতে হইবে এবং দেখিতে হইবে যে, তথায় কোন অপবিত্র বাসনা লুকাইয়া আছে কিনা। যদি থাকে তাহা হইলে তাহার জন্য আল্লাহর এই নির্দেশঃ
(আরবী********************************)
জাহিলিয়াতের যুগে যে ধরনের সাজ-সজ্জা ও ঠাট ঠমক করিয়া বেড়াইতে, এখন তাহা করিও না। -আহযাবঃ ৩৩
যে সাজ-সজ্জার পশ্চাতে কোন অপবিত্র ইচ্ছা-বাসনা নাই, তাহা ইসলামী সাজ-সজ্জা। যাহার মধ্যে তিলমাত্র খারাপ বাসনা আছে, তাহই জাহিলিয়াতের সাজ-সজ্জা।
জিহবার অনিষ্ট
মন-শয়তানের আর এক দালাল জিহবা। জিহবার দ্বারা অহরহ কত অনিষ্ট সাধিত হইতেছে এবং বিস্তার লাভ করিতেছে তাহার ইয়ত্তা নাই। নারী-পুরুষ কথোপকথন করিতেছে। কোন মন্দ বাসনা সুস্পষ্ট প্রকাশিত নহে কিন্তু মনের গোপন চোর কণ্ঠে মিষ্টতা, কথা বলার ভংগীতে একটা আকর্ষণ এবং কথাবার্তার একটা মোহাবেশ সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে। কুরান এই মনচোরকে ধরিয়া দিতেছেঃ
(আরবী********************************)
যদি তোমাদের মনে আল্লাহর ভয় থাকে, তাহা হইলে [অপরের সংগে] কমনীয় ভংগীতে কথা বলিও না। নতুবা যাহার মনে [খারাপ বাসনার] রোগ আছে, সে তোমাদের সম্পর্কে এক আশা পোষণ করিয়া বসিবে। কথা বলিতে হইলে সহজ সরলভাবে বল [যেমন একজন আর একজনের সংগে সাধারণভাবে বলিয়া থাকে]। -আহযাবঃ ৩২
মনের এই চোরই অপরের বৈধ অথবা অবৈধ যৌন-সম্পর্কের অবস্থা বর্ণনা করিতে এবং শুনিতে আনন্দ উপভোগ করে। এই আনন্দরস উপভোগ করিবার জন্য প্রেমপূর্ণ গান গাওয়া হয়, সত্য-মিথ্যা প্রেমের গল্প বলা হয় এবং সমাজে এ সবের প্রচার এমনভাবে হয় যেন মৃদু মৃদু আগুনের আঁচ।
কুরআন বলেঃ
(আরবী***********************************************************************)
যাহারা ইচ্ছা করে যে, মুসলমানদের মধ্যে নির্লজ্জতার প্রচার হউক, তাহাদের জন্য পৃথিবীতেও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং আখেরাতেও। নূরঃ ১৯
জিহার অনিষ্টকারিতার আরও অনেক বিভাগ আছে এবং প্রতিটি বিভাগে মনের একটি চোর নিযুক্ত আছে। ইসলাম এইসবের অনুসন্ধান করিয়া তৎসম্পর্কে সাবধান করিয়া দিয়াছে। কোন স্ত্রীলোককে অনুমতি দেওয়া হয় নাই যে, সে তাহার স্বামীর নিকটে অন্য কোন স্ত্রীলোকের অবস্থা বর্ণণা করে। হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
(আরবী*********************************************************)
নারী-পুরুষকে নিষেধ করা হইয়াছে যে, তাহারা যেন তাহাদের দাম্পত্য সম্পর্কিত গোপন অবস্থা অপরের নিকটে বর্ণনা না করে। কারণ ইহাতেও অশ্লীলতার প্রচার হয় এবং মনের মধ্যে প্রেমাসক্তির সঞ্চার হয়। -আবু দাউদ
জামায়াতের সহিত নামাযে ইমাম যদি ভুল করেন কিংবা কোন ব্যাপারে তাঁহাকে সাবধান করিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে পুরুষদিগকে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে, ‘সুবহানাল্লাহ’ বলিয়া সাবধান করিবে। কিন্তু নারীদিগকে বলা হইয়াছে যে, তাহারা মুখে কিছু না বলিয়া হাতের উপর হাতের আঘাত করিবে। -আবু দাউদ, বুখারী।
শব্দের অনিষ্ট
অনেক সময়ে জিহবা নীরব থাকে। কিন্তু অন্যান্য গতিবিধির দ্বারা শ্রবণশক্তি আকৃষ্ট করা হয়। ইহাও খারাপ নিয়্যতের সংগে সংশ্লিষ্ট এবং ইসলাম এই সম্পর্কে নিষেধবাণী উচ্চারণ করিয়াছেঃ
(আরবী******************************************************)
তাহারা যেন পায়ের দ্বারা মাটিতে আঘাত করিয়া না চলে। নতুবা যে সৌন্দর্য [অলংকারাদি] তাহারা গোপন রাখিয়াছে তাহার অবস্থা জানিতে পারিবে। -সূরা নূরঃ ৩১
সুগন্ধের অনিষ্ট
একটি দুষ্ট মন হইতে অপর দুষ্ট মনে সংবাদ পৌঁছাইবার জন্য যত সংবাদবাহক আছে, তাহার মধ্যে সুগন্ধি একটি। ইহা সংবাদ পরিবহনের এক অতি সূক্ষ্ম উপায়, যাহাকে লোকে সূক্ষ্মই মনে করে। কিন্তু ইসলামী লজ্জা এতই অনুভূতিশীল যে, তাহার নমনীয় প্রকৃতির কাছে এই সূক্ষ্ম আন্দোলনও কঠিন। সুবাস-স্নাত বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া পথ চলিতে অথবা সভাস্থলে গমন করিতে ইসলামী লজ্জা কোন মুসলিম নারীকে অনুমতি দেয় না। কেননা তাহার সৌন্দর্য ও ভূষণ অপ্রকাশ থাকিলেই বা লাভ কি? কারণ তাহার সুঘ্রাণ বাতাসে ছড়াইয়া উত্তেজনার সঞ্চার করিবে।
(আরবী*******************************************************************)
নবী (স) বলিয়াছেন, যে নারী আতর বা সুগন্ধি দ্রব্যাদি ব্যবহার করত লোকের মধ্যে গমন করে সে একটি ভ্রষ্টা নারী।
(আরবী****************************************************************)
তোমাদের মধ্যে কোন নারী মসজিদে গমন করিলে যেন দ্রব্যাদি ব্যবহার না করে।
(আরবী************************************************************)
পুরুষের জন্য বর্ণহীন খোশবুদার আতর এবং নারীদের জন্য উজ্জ্বল বর্ণের গন্ধহীন আতর উপযোগী।
নগ্নতার অনিষ্ট
সতরের-[ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নারী-পুরুষের শরীরের যে যে অংশ আবৃত রাখিবার আদেশ করা হইয়াছে তাহাকে সতর বলে।-অনুবাদক] অধ্যায়ে ইসলাম মানবীয় লজ্জা-সম্ভ্রমের যে সঠিক ব্যাখ্যা দান করিয়াছে, তাহা পৃথিবীর কোন সভ্যতা খণ্ডন করিতে পারে নাই। আজকাল পৃথিবীর সুসভ্য জাতিগুলোরও এই অবস্থা যে, শরীরের যে কোন অংশ অনাবৃত রাখিতে তাহাদের নারী-পুরুষের বাধে না। তাহাদের নিকটে বেশ ভূষা সৌন্দর্যের জন্য, সতরের জন্য নহে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিত সৌন্দর্য হইতে সতরের গুরুত্ব অধিক; ইসলাম নারী-পুরুষকে তাহাদের দেহের ঐ সকল অংশ আবৃত রাখিতে আদেশ করে যাহার মধ্যে একে অপরের জন্য যৌন-আকর্ষণ পাওয়া যায়। নগ্নতা এমন এক অশ্লীলতা, যাহা ইসলামী লজ্জা-সম্ভ্রম কিছুতেই বরদাশত করিতে পারে না। পর পুরুষের তো কথাই নাই, স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের সম্মুখে উলংগ হওয়াকেও ইসলাম পসন্দ করে না। -ইবনে মাজাহ
(আরবী*************************************************************)
তোমাদের মধ্যে কেহ স্ত্রীর নিকটে গমন করিরে তাহার উচিত সতরের প্রতি লক্ষ্য রাকা। গর্দভের ন্যায় উভয়ে যেন উলংগ হইয়া না পড়ে। -ইবনে মাজাহ
(আরবী*******************************************************************)
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ (স) –কে কোন দিন উলংগ অবস্থায় দেখেন নাই।
অধিকতর লজ্জা-সম্ভ্রম এই যে, একাকী উলংগ থাকাও ইসলাম পসন্দ করে না। ইহার কারণ এই যে, আল্লাহর সম্মুখে বেশী লজ্জা করা উচিত।
(আরবী*********************************************************************)
সাবধান! কভু উলংগ থাকিও না। কারণ তোমাদের সংগে আল্লাহর ফেরেশতাগণ থাকেন, তাঁহারা তোমাদের হইতে পৃথক হন না, শুধু ঐ সময় ব্যতীত, যখন তোমরা মলত্যাগ করিতে যাও কিংবা স্ত্রীর নিকটে গমন কর। অতএব তাঁহাদের জন্য লজ্জা করিও এবং তাঁহাদের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখিও।
যে পোশাক-পরিচ্ছদের ভিতর দিয়া শরীরের অংগ-অংশ দেখা যায় এবং সতর প্রকাশ হইয়া যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে তাহা কোন পোশাকই নহে।
(আরবী******************************************************************************)
রসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন, যে সকল নারী কাপড় পরিধান করিওয়াও উলংগ থাকে, অপরকে তুষ্ট করে এবং অপরের দ্বারা নিজে তুষ্ট হয়, বুখতি উটের ন্যায় গ্রীবা বক্র করত ঠাট-ঠমকে চলে, তাহারা কখনও বেহেশতে প্রবেশ করিবে না, এমন কি বেহেশতের ঘ্রাণও পাইবে না।
এখানে কতিপয় দৃষ্টান্ত এইজন্য দেওয়া হইল যে, ইহা হইতে ইসলামী চরিত্রের মান এবং তাহার চারিত্রিক প্রাণশক্তি (Spirit) অনুমান করা যাইবে। ইসলাম সামাজিক পরিবেশ ও তাহার আবহাওয়াকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কার্যাবলীর সকল প্ররোচক বিষয় হইতে মুক্ত ও পবিত্র রাখিতে চায়। এই সকল প্ররোচনার উৎস মানুষের অন্তর প্রদেশে। অশ্লীলতা ও গর্তিত কার্যাবলীর জীবাণু ঐ স্থানেই প্রতিপালিত হয় এবং সেখান হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দেলন বা প্ররোচণার সূচনা হয় যাহা পরবর্তীকালে উদ্বেগ ও ঝঞ্জাটের কারণ হইয়া পড়ে। অজ্ঞ লোক ইহাকে তুচ্ছ মনে করিয়া উপেক্ষা করে; কিন্তু বিজ্ঞের দৃষ্টিতে প্রকৃতপক্ষে উহাই চরিত্র, তমদ্দুন ও সমাজ ধ্বংসকারী মারাত্মক ব্যাধির মূল। অতএব ইসলামের নৈতিক শিক্ষা অন্তর প্রদেশেই লজ্জার এমন এক বিরাট অনুভূতি সৃষ্টি করিতে চায়, যেন মানুষ নিজের হিসাব নিজেই লইতে থাকে এবং মন্দ কাজের প্রতি সামান্যতম প্রবণতা দেখা দিলে, তাহা অনুভব করত স্বীয় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাহা অংকুরে বিনষ্ট করিতে পারে।
শাস্তি বিধায়ক আইন
ইসলামের শাস্তি বিধায়ক আইনের মূলের মূল এই যে, যতক্ষণ পর্যণ্ত মানুষ তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা ধ্বংস করিবার মত কোন অপরাধ না করিয়া ফেলে, ততক্ষণ তাহাকে রাজনীতির অকটোপাশে আবদ্ধ করা হইবে না। কিন্তু একবার উক্ত অপরাধ করিয়া বসিলে মৃদু শাস্তি দিয়া পাপ করিবার এবং শাস্তি ভোগ করিবার জন্য অভ্যস্ত করিয়া তোলা উচিত হইবে না। অপরাধ প্রমাণ করিবার শর্ত কঠিন রাখিতে হইবে।–[ইসলামী সাক্ষ্য-আইনে অপরাধ প্রমাণ করিবার শর্ত সাধারণত বড় কঠিন করা হইয়াছে। ব্যভিচার প্রমাণ করিবার শর্ত সবচাইতে বেশী কঠিন করা হইয়াছে। সাধারণভাবে সমগ্র ব্যাপারে ইসলামী আইন দুইজন সাক্ষী যথেষ্ট মনে করে। কিন্তু ব্যভিচার প্রমাণের ব্যাপারে অন্তত চারিজন সাক্ষী নির্ধারিত করা হইয়াছে।] যতদূর সম্ভব আইনের আওতায় আসা হইতে মানুষকে রক্ষা করিতে হইবে।–[নবী (স) বলেনঃ (আরবী*********************) মুসলমানদিগকে যথাসম্ভব শাস্তি হইতে রক্ষা কর। অপরাধীর জন্য পরিত্রাণের কোন উপায় থাকিলে ছাড়িয়া দাও। কারণ ইমামের পক্ষে শাস্তি দিতে ভুল করা হইতে মুক্তি দিতে ভুল করা শ্রেয়।–তিরমিযী] কিন্তু যখন কোন ব্যক্তি আইনের আওতায় আসিবে, তখন তাহাকে এমন গুরুতর শাস্তি প্রদান করিবে যেন সে কেবল পাপের পুনরাবৃত্তি হইতে দূরে থাকে না, বরং এই পাপের প্রতি অনুরক্ত অন্যান্য শত সহস্র লোক উক্ত গুরুতর শাস্তি দেখিয়া ভীত-শংকিত হইয়া পড়ে। কারণ আইনের উদ্দেশ্য সমাজকে অপরাধমুক্ত করা। ইহা নহে যে, মানুষ বারবার অপরাধ করুক এবং বারবার শাস্তি ভোগ করুক।
সামাজিক ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইসলামী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যে সকল কার্যকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে স্থির করিয়াছে তাহা দুইটি। একটি ব্যভিচার, দ্বিতীয়টি মিথ্যা অভিযোগ।
ব্যভিচারের শাস্তি
ব্যভিচার সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে যে, নৈতিকতার দিক দিয়া এই কার্য মানুষের চরম অধপতনের ফল।
যে ব্যক্তির দ্বারা এই কাজ হয়, সে প্রকৃতপক্সে এই কথার প্রমাণ দেয় যে, তাহার মনুষ্যত্ব পশুত্বের নিকট হার মানিয়াছে। ইহার পর সে মানব সমাজের একজন সৎ সদস্য হইয়া থাকিতে পারে না। যে সকল অপরাধ মানবীয় তমদ্দুনের মূলে কুঠারাঘাত করে, সমাজের দৃষ্টিতে ইহা সেই সকল বিরাট অপরাধের একটি। এই সকল কারণে ইসলাম ইহাকে একটি দণ্ডনীয় পাপ বলিয়া স্থির করিয়াছে, ইহার সহিত অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হউক আর নাই হউক। যথাঃ বলপূর্বক হউক অথবা অন্যের অধিকার হরণ হউক আর নাই হউক।
কুরআনের নির্দেশ এইঃ
(আরবী*************************************************************)
ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষের প্রত্যেককে এক শত করিয়া বেত্রাঘাত কর এবং আল্লাহর আইনের ব্যাপারে তাহাদের প্রতি কখনও অনুকম্পাশীল হওয়া চলিবে না, যদি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি তোমাদের বিশ্বাস থাকে এবং যখন তাহাদিগকে শাস্তি প্রদান করা হইবে,তখন মুসলমানদের একটি দল তাহাদের শাস্তি দেখিবার জন্য যেন উপস্থিত থাকে। -সূরা নূরঃ ২
এই অধ্যায়ে ইসলামী আইন ও পাশ্চাত্য আইনের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রহিয়াছে। পাশ্চাত্য আইনের দৃষ্টিতে শুধু ব্যভিচার কোন অপরাধ নহে। তাহাদের চক্ষে ব্যভিচার একমাত্র তখনই অপরাধ হিসাবে পরিগণিত হইবে, যখণ উহা বলপূর্বক করা হইবে অথবা এমন কোন নারীর সহিত-যাহার স্বামী রহিয়াছে। অন্য কথায় তাহাদের আইনে ব্যভিচারই একটি অপরাধ এবং বলপ্রয়োগ ও অপরের অধিকার হরণ অতিরিক্ত অপরাধ। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে শাস্তির বেলায়ও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। পাশ্চাত্য আইন বলপূর্বক ব্যভিচারের জন্য কারাদণ্ডই যথেষ্ট মনে করে এবং বিবাহিতা নারীর সহিত ব্যভিচার করিলে তাহার স্বামীকে ক্ষতি পূরণের অধিকার দেওয়া হয়। এই দণ্ড অপরাধ প্রতিরোধ করে না; বরং লোককে আরও নির্ভীক করিয়া দেয়। এইজন্য ঐ সমস্ত দেশে, যেখানে আইন প্রচলিত আছে, ব্যভিচারের মাত্রা বাড়িয়া চলিয়াছে। ইহার বিপরীত ইসলামী আইন ব্যভিচারের জন্য এই ধরনের অপরাধ ও অপরাধী হইতে মুক্ত রাখে। যে সকল দেশে ব্যভিচারের জন্য এই ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়, তথায় এই অপরাধ কখনও সার্বজনীন হয় না। একবার শরীঅতের বিধান মত শাস্তি হইলে দেশের সমগ্র অধিবাসীর মধ্যে এমন এক আতংকের সৃষ্টি হয় যে, কয়েক বৎসর পর্যন্ত এই ধরনের অপরাধ করিতে কাহারও সাহস হয় না। এই ধরনের অপরাধপ্রবণ লোকের মনে ইহা এক প্রকার মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন, যাহা দ্বারা তাহার মনে আপনা-আপনি সংস্কার হইয়া যায়।
পাশ্চাত্যে মন এক শত বেত্রাঘাত ঘৃণার চক্ষে দেখে। ইহার কারণ ইহা নহে যে, সে মানুষের দৈহিক শাস্তি পসন্দ করে না; বরং তাহার প্রকৃত কারণ এই যে, তাহার নৈতিক অনুভূতির পরিস্ফুরণ এখনও হয় নাই। সে প্রথমত ব্যভিচারকে একটা দোষ মনে করিত। এখন উহাকে একটা নিছক ক্রীড়া, একটা চিত্তবিনোদ মনে করে, যাহার দ্বারা দুইটি মানব-মানবী কিছুক্ষণের জন্য মনোরঞ্জন করিতে পারে। এইজন্য সে চায় যে, আইন এইকাজে উদারতা প্রদর্শন করুক এবং যে পর্যণ্ত ব্যভিচারী অপরের স্বাধীনতা বা আইনগত অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে, সে পর্যণ্ত কোন কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করা না হউক। অতপর অপরের স্বাধীনতা বা অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হইলে ইহাকে এমন অপরাধ মনে করা হয়, যাহা দ্বারা এক ব্যক্তির অধিকারই ক্ষুণ্ণ হয়। এই জন্য সে সাধারণ দণ্ড অথবা ক্ষতি পূরণ এই অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি মনে করে।
প্রকাশ থাকে যে, যে ব্যক্তি ব্যভিচার সম্পর্কে এইরূপ ধারণা রাখে, সে এই কাজের এক শত বেত্রাঘাতকে উৎপীড়নমূলক শাস্তিই মনে করিবে। কিন্তু যখন তাহার নৈতিক ও সামাজিক অনুভূতির উন্নতি হইবে এবং সে জানিতে পারিবে যে, ব্যভিচার স্বেচ্চায় হউক অথবা বলপূর্বক হউক, সকল অবস্থায়ই ইহা একটি সামাজিক অপরাধ এবং সমগ্র সমাজই ইহার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন শাস্তি সম্পর্কেও তাহার দৃষ্টিভংগীর আপনা-আপনি পরিবর্তন হইবে। তাহাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, এই অনিষ্ট হইতে সমাজকে রক্ষা করিতে হইবে এবং যেহেতু ব্যভিচারে প্ররোচিত করিবার উপাদান মানুষের পাশবিক প্রকৃতিতে বদ্ধমূল থাকে ও ইহার মূলোচ্ছেদ নিছক কারাদণ্ড ও ক্ষতি পূরণের দ্বারা সম্ভব নহে, সেইজন্য ইহার সকল পথ রুদ্ধ করিতে হইলে কঠিন ব্যবস্থা অবলম্বন করা ব্যতীত উপায় নাই। অপরাধীকে শাস্তির কষ্ট হইতে অব্যাহতি দিয়া গোটা জাতিকে এবং তাহার ভবিষ্যত নিরপরাধ বংশধরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা অপেক্ষা এক বা দুই ব্যক্তিকে কঠিন দৈহিক শাস্তি দান করত লক্ষ লক্ষ মানবকে অসংখ্য নৈতিক ও সামাজিক অনিষ্ট হইতে রক্ষা করা অধিকতর শ্রেয়।
এক মথ বেত্রাঘাতকে অত্যাচারমূক মনে করার অপর একটি কারণ আছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তিমূল সম্পর্কে চিন্তা করিলে তাহা সহজেই হৃদয়ংগম করা যায়। পূর্বেই বর্ণণা করিয়াছি যে, এই সভ্যতার সূচনাই হইয়াছে সমষ্টির বিরুদ্ধে ব্যষ্টিকে সমর্থন করার প্রবণতা হইতে এবং এই সভ্যতার গোটা ভিত্তিই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অধিকারের একটি অতিরিক্ত ধারণা হইতে প্রস্তুত করা হইয়াছে। এইজন্য ব্যক্তি সমষ্টির উপরে যতই অন্যায় করুক না কেন, পাশ্চাত্যবাসীর নিকট ইহা তেমন অসহনীয় হয় না, বরং অধিক ক্ষেত্রে তাহারা ইহাকে আনন্দ সহকারে বরণ করিয়া লয়। অবশ্য সমষ্টির অধিকার সংরক্ষণের জন্য যখন ব্যক্তির উপর হাত দেওয়া হয়, তখন তাহাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয় এবং তাহাদের সমস্ত সহানুভূতি সমষ্টির পরিবর্তে ব্যক্তির জন্য হইয়া থাকে। উপরন্তু সমগ্র জাহিলী যুগের অধিবাসীদের ন্যায় পাশ্চাত্য জাহিলিয়াতের উক্ত অনুরক্তদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এই যে, তাহারা যুক্তির পরিবর্তে ভাবপ্রবণতাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। একটি ব্যক্তির যে অনিষ্ট হয়, সেইজন্য উহা যেহেতু সীমিত আকারে অনুভূত হয়, সেইজন্য উহাকে তাহারা এক বিরাট বিষ মনে করে। পক্ষান্তরে গোটা সমাজ ও তাহার ভবিষ্যত বংশধরের যে ব্যাপক অনিষ্ট হয়, তাহারা তাহার গুরুত্ব অনুভব করিতে পারে না।
ব্যভিচারের ভিত্তিহীন অভিযোগের শরীঅতী বিধান
ব্যভিচারে যে অনিষ্ট হয়, প্রায় অনুরূপ অনিষ্ট ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগেও হয়। সম্ভ্রান্ত মহিলার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ করাতে শুধু তাহার একার কলংক হয় না, বরং ইহাতে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে শত্রুতা বাড়িয়া যায়, বংশাবলী সন্দেহভাজন হইয়া পড়ে, দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট হইয়া যায় এবং এক ব্যক্তি মাত্র একবার কিছু বাক্য উচ্চারণ করিয়া বহু লোককে বহু বৎসর যাবত শাস্তি দিতে থাকে। কুরআনে এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
কুরআন বলেঃ
(আরবী****************************************)
যাহারা পূর্ণপূত মহিলাদের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ করিবে, অতপর তাহার সপক্ষে চারিজন সাক্ষী উপস্থিত করিতে পারিবে না তাহাদিগকে আশি বেত্রাঘাত কর এবং ভবিষ্যতে কখনও তাহাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করিও না। এই ধরনের লোক নিজেরাই দুষ্কর্মকারী। -সূরা নূরঃ ৪
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
এইভাবে ইসলামের ফৌজদারী আইন আপন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা একদিকে অন্যায় কাজ বলপূর্বক রহিত করে এবং অপরদিকে সমাজের সম্ভ্রান্ত লোকদিগকে দুরভিসন্ধিকারী মানুষের অপবাদ হইতেও রক্ষা করে। ইসলামের নৈতিক শিক্ষা মানুষকে ভিতর হইতে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করিয়া দেয় যে, নৈতিক শিক্ষা ত্রুটিযুক্ত থাকিবার কারণে মনের মধ্যে খারাপ বাসনা সৃষ্টি হইলে এবং তাহা জোরপূর্বক কার্যে পরিণত করিলে তাহাকে আইনবলে রোধ করা হয়। এই উভয় পদ্ধতির মাঝখানে অতিরিক্ত পদ্ধতি এই কারণে অবলম্বন করা হইয়াছে যে, তাহার আধ্যাত্মিক সংস্কারে নৈতিক শিক্ষার সহায়ক হইবে। এই সকল পদ্ধতির দ্বারা সমাজ ব্যবস্থাকে এমনভাবে সংশোধিক করা হইয়াছে যে, নৈতিক শিক্ষার ত্রুটির কারণে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে সকল দুর্বলতা রহিয়া যায়, তাহা যেন বাড়িয়া না যায় এবং কার্যকরী না হয়; সমাজের মধ্যে যেন এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেখানে খারাপ বাসনা পরিস্ফুরণের সুযোগ না থাকে এবং তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা নষ্ট করিবার সম্ভাব্য সকল প্রকার পথ রুদ্ধ হয়।
এখন আমরা বিস্তারিত আলোচনার জন্য ঐ সকল পদ্দতির এক একটি বর্ণনা করিতেছি।
পোশাক ও সতরের আদেশ
সামাজিক নির্দেশাবলীর ব্যাপারে ইসলামের প্রথম কাজ এই যে, সে নগ্নতার মূলোচ্ছেদ করিয়াছে এবং নারী-পুরুষের জন্য সতরের সীমারেখা নির্ধারণ করিয়া দিয়াছে। এই ব্যাপারে আরব জাহিলিয়াতের যে অবস্থা ছিল, তাহা হইতে ভিন্ন নহে। তাহারা একে অপরের সম্মুখে বিনা দ্বিধায় উলংগ হইয়া পড়িত।–[হাদীসে আছেঃ হযরত মিসওয়ার বিন মাখরামা (রা) একটি প্রস্তর বহন করিয়া আনিতেছিলেন। পথিমধ্যে তাঁহার তহবন্দ খুলিয়া গেল এবং তিনি এই অবস্থায় প্রস্তর বহন করিয়া আনিতেছিলেন। নবী (স) দেখিয়া বলিলেন, ‘আপন শরীর আবৃত কর এবং উলংগ অবস্থায় চলিও না’। -মুসলিম] গোসল ও মলত্যাগের সময় পর্দা করা তাহারা নিষ্প্রয়োজন মনে করিত। সম্পূর্ণ উলংগ হইয়া কা’বাঘরের তাওয়াফ করা হইত এবং ইহাকে উৎকৃষ্ট ইবাত মনে করা হইত।–[ইবনে আব্বসা (রা), মুজাহিদ (র), তাউস (র) ও যুহরী (র) একমত হইয়া বলিয়াছেন যে, কা’বা ঘরের তাওয়াফ উলংগ অবস্থায় করা হইত।] নারীরাও তাওয়াফের সময় উলংগ হইয়া পড়িত।–[মুসলিম, কিতাতুল তফসীরে আরবের এই প্রথা বর্ণনা করিয়াছেন যে, একজন নারী উলংগ অবস্থায় তাওয়াফ করিত এবং সমবেত লোকদিগকে বলিত, ‘কে আমাকে একটি বস্ত্র দান করিবে যাহা দ্বারা আমি আমার শরীর আবৃত করিব?’ এইভাবে উক্ত নগ্ন নারীকে বস্ত্র দান করা বিরাট পূণ্য কাজ মনে করা হইত।] তাহাদের স্ত্রীলোকদের পোশাক এমন হইত যে, বুকের কিয়দাংশ অনাবৃত থাকিত এবং বাহু, কোমর ও হাঁটুর নীচে কিয়দাংশ অনাবৃত থাকিত। অবিকল এই অবস্থা বর্তমানে ইউরোপ,আমেরিকা ও জাপানে দেখা যায়। শরীরের কোন কোন অংশ অনাবৃত ও কোন কোন অংশ আবৃত থাকিবে ইহা নির্ধারণকারী কোন সমাজ ব্যবস্থা প্রাচ্যের দেশগুলির কোথাও নাই।
ইসলাম এই ব্যাপারে মানুষকে সভ্যতার প্রথম পাঠ শিক্ষা দিয়াছে।
(আরবী******************************************)
হে মানব সন্তান! আল্রাহ তায়ালা তোমাদের শররি আবৃত করিবার জন্য পোশাক অবতীর্ণ করিয়াছে এবং ইহা তোমাদের শোভাবর্ধক। -সূরা আরাফঃ ২৬
এই আয়াতের মর্মানুযায়ী শরীর আবৃত করা প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য ফরয করা হইয়াছে। নবী (সঃ) কড়া নির্দেশ দান করিয়াছেন যেন কেহ কাহারও সম্মুখে উলংগ না হয়।
(আরবী***********************************************)
যে আপন ভাইয়ের সতরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে অভিশপ্ত।
-জাসসাসঃ আহকামুল কুরআন
(আরবী***********************************************)
কোন পুরুষ কোন পুরুষকে এবং কোন নারী কোন নারীকে যেন উলংগ অবস্থায় না দেখে। -মুসলিম
(আরবী********************************************************)
আল্লাহর কসম, আমার আকাশ হইতে নিক্ষিপ্ত হওয়া এবং দ্বিখন্ডিত হইয়া যাওয়া অধিকতর শ্রেয় এমন অবস্থা হইতে যে, আমি কাহারও গুপ্তাংগ দেখি অথবা কেহ আমার গুপ্তাংগ দেখে। -মাবসূত
(আরবী*********************************************************)
সাবধান, কখনও উলংগ হইবে না। কারণ তোমাদের সংগে যাহারা আছে, তাহারা কখনও তোমাদের সংগ ত্যাগ করে না, মলত্যাগ ও সহবাসের সময় ব্যতীত। -তিরমিযী
(আরবী****************************************************)
যখন তোমাদের মধ্যে কেহ তাহার স্ত্রীর নিকটে গমন করে তখনও সে যেন তাহার সতর আবৃত রাখে এবং একেবারে গর্দভের ন্যায় উলংগ হইয়া না পড়ে। -ইবনে মাজাহ
একবার নবী (সঃ) যাকাতের উটের চারণভূমিতে গিয়ে দেখিতে পাইলেন যে, উষ্ট্র-রাখাল উলংগ হইয়া শুইয়া আছে। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাকে চাকুরী হইতে অপসারিত করিলেন এবং বলিলেনঃ
(আরবী*******************************)
যে নির্লজ্জ সে আমাদের কোন কাজের নয়।
পুরুষের জন্য সতরের সীমারেখা
এই সকল নির্দেশের সংগে নারী-পুরুষের শরীর ঢাকিবার সীমারেখাও পৃথক পৃথক নির্ধারিত করা হইয়োছে। শরীরের যে অংশ আবৃত রাখা ফরয করা হইয়েঅছে শরীআতের পরিভাষায় তাহাকে সতর বলে। পুরুষের নাভী ও হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশকে সতর বলা হইয়াছে এবং আদেশ করা হইয়াছে যে, উহা যেন অপরের সম্মুখে অনাবৃত করা না হয় এবং অপরেও যেন উহা না দেখে।
(আরবী****************************************************)
আবু আইয়ুব আনসারী হইতে বর্ণিত আছে, নবী (সঃ) বলেন, ‘হাটুর উপরে ও নাভীর নীচে যাহা আছে তাহা ঢাকিবার অংশ’। -দারু কুতনী
(আরবী*************************************************)
পুরুষের জন্য নাভী হইতে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকিবার অংশ। -মাবসূত
(আরবী************************************************************)
হযরত আলী (রাঃ) হইতে বর্ণিত, হুযুর (স) এরশাদ করেন, নিজের উরু কাহাকেও দেখাইও না এবং কোন জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তির উরুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিও না। -তাফসীরে কবীর
ইহা সার্বজনীন নির্দেশ। একমাত্র স্ত্রী ব্যতীত কেহ ইহার ব্যতিক্রম নহে।
(আরবী*******************************************************)
তোমাদের স্ত্রীর ও ক্রীতদাসী ব্যতীত অন্যান্যের নিকট হইতে তোমাদর সতর রক্ষা কর। -আহকামুল কুরআন
নারীর জন্য সতরের সীমারেখা
নারীদের জন্য সতরের সীমারেখা অধিকতর প্রশস্ত করা হইয়াছে। তাহাদিগকে আদেশ করা হইয়াছে যে, নিজেদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ব্যতীত সমস্ত শরীর আবৃত রাখিতে হইবে। পিতা, ভ্রাতা ও সমস্ত নিকট আত্মীয়গণ এই আদেশের শামিল এবং স্বামী ব্যতীত কোন পুরুষের বেলায় ইহার ব্যতিক্রম হইতে পারে না।
(আরবী********************************************************)
নবী (সঃ) বলিয়াছেন, যে নারী আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, তাহার জন্য ইহার বেশী হাত খুলিয়া রাখা জায়েয নহে’। এই বলিয়া তিনি তাঁহার হাতের কব্জীর মধ্যস্থলে হাত রাখিলেন। -ইবনে জরীর
(আরবী****************************************************************)
যখন কোন বালিকা সাবালিকা হয়, তখন তাহার শরীরের কোন অংশই দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত নয়। শুধু মুখমণ্ডল ও কব্জী পর্যন্ত হস্তদ্বয় দেখা যাইতে পারে। -আবু দাউদ
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমি একবার বেশভূষা করিয়া আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুল্লাহ বিন তোফায়েলের সম্মুখে আসিলে নবী (সঃ) ইহা অপসন্দ করিলেন। আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রসূল! সে তো আমার ভ্রাতুষ্পুত্র’। নবী (সঃ) তখন বলিলেনঃ
(আরবী************************************************)
যখন কোন বালিকা সাবালিকা হয় তখন মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ব্যতীত শরীরের কোন অংশ প্রকাশ করা তাহার জন্য জায়েয নয়’। এই বলিয়া তিনি তাঁহার কব্জীর উপরে এমনভাবে হাত রাখিলেন যে, কব্জীর মধ্যস্থল এবং তাঁহার হাত রাখিবার স্থানের মধ্যে মাত্র একমুষ্ঠি পরিমাণ অবশিষ্ট রহিল। -ইবনে জরীর
নবী করীম (সঃ) –এর শ্যালিকা হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) একবার মিহি কাপড় পরিধান করিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিলেন। কাপড়ের ভিতর দিয়া তাঁহার শরীরের অংগ-প্রত্যংগ দেখা যাইতেছিল। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ফিরাইয়া লইয়া নবী (সঃ) বলিলেনঃ
(আরবী*********************************************************)
‘হে আসমা! সাবলিকা হওয়ার পর ইহা ও উহা ব্যতীত শরীরের কোন অংশ অপরকে দেখান কোন স্ত্রীলোকের পক্ষে জায়েয হইবে না’। -এই বলিয়া নবী (সঃ) তাঁহার মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জীর দিকে ইংগিত করিলেন। -ফাতহুল কাদীর
হাফসা বিনতে আবদুর রহমান একদা সূক্ষ্ম দোপাট্টা পরিধান করিয়া হযরত আয়েশা (রাঃ) এর গৃহে হাযির হইলেন। তখন তিনি তাহা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া একটা মোটা চাদর দিয়া তাঁহাকে ঢাকিয়া দিলেন। -ইমাম মালিকঃ মুয়াত্তা
নবী (সঃ) বলিয়াছেনঃ
(আরবী**********************************************)
আল্লাহর অভিমাপ ঐ সকল নারীদের উপর, যাহারা কাপড় পরিধান করিয়াও উলংগ থাকে।
নারীদিগকে এমন আঁট-সাঁট কাপড় পরিধান করিতে দিও না যাহাতে শরীরের গঠন পরিস্ফুট হইয়া পড়ে।
এই সকল বর্ণনা হইতে জানিতে পারা যায় যে, মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জী ব্যতীত নারীর সমস্ত শরীর সতরের মধ্যে শামিল। বাড়ীর অতি আপন লোকের নিকটেও এই সতর ঢাকিয়া রাখিতে হইবে। একমাত্র স্বামী ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির নিকটে এই সতর খুলিতে পারা যাইবে না, সে পিতা, ভ্রাতা অথবা ভ্রাতুষ্পুত্র যেই হউক না কেন। যে সকল বস্ত্রের ভিতর দিয়া শরীরের অংগ-প্রত্যংগ দেখা যায়, তাহাও পরিধান করা যাইবে না।
এই অধ্যায়ে যত নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা সকলই যুবতী নারীর জন্য। সতর ঢাকিবার নির্দেশাবলী ঐ সময় প্রযোজ্য হয়, যখন কোন বালিকা সাবালিকা হয় এবং যতদিন পর্যন্ত তাহার মধ্যে যৌন আকর্ষণ অবশিষ্ট থাকে ততদিন পর্যন্ত ইহা বলবৎ থাকে। এই বয়স অতিক্রান্ত হইলে কিছুটা শিথিল করা হইয়াছে।
কুরআন পাক বলেঃ
(আরবী********************************************************************)
যে সকল অতি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক পুনরায় কোন বিবাহের আশা পোষণ করে না, তাহারা যদি দোপাট্টা খুলিয়া রাখে, তাহাতে কোন দোষ হইবে না। তবে শর্ত এই যে, বেশভূষা প্রদর্শন করা যেন তাহাদের উদ্দেশ্য না হয়। এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা তাহাদের জন্য মংগলকর। -সূরা নূরঃ ৬০
এখানে কড়াকড়ি হ্রাস করার কারণ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে। ‘বিবাহের আশা পোষণ করে না’ –কথার মর্ম এই যে, যৌনস্পৃহা ও যৌন আকর্ষণ না থাকা। উপরন্তু সাবধানতার জন্য এই শর্ত আরোপ করা হইয়াছে যে, বেশভূষা প্রদর্শন করা যেন উদ্দেশ্য না হয় অর্থাৎ যৌনস্পৃহার কণামাত্র স্ফুলিংগ যদি বুকের মধ্যে অবশিষ্ট থাকে, তাহা হইলে দোপাট্টা খুলিয়া রাখা জায়েয হইবে না। কেবল ঐ সকল বৃদ্ধাদের জন্য এই নিয়ম শিথিল করা হইয়াছে, যাহারা বার্ধক্যে উপনীত হইবার কারণে পোশাক সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ হইতে মুক্ত হইয়াছে এবং যাহাদের প্রতি শ্রদ্ধার দৃষ্টি ব্যতীত কোন কুদৃষ্টি পতিত হইবার আশংকা নাই। এই ধরনের স্ত্রীলোক দোপাট্টা অথবা চাদর ব্যতীত গৃহে অবস্থান করিতে পারে।
অনুমতি গ্রহণ
ইহার পরে দ্বিতীয় বাধা যাহা আরোপ করা হইয়াছে তাহা এই যে, গৃহের অধিবাসীদের বিনা অনুমতিতে গৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, যাহাতে গৃহের স্ত্রীলোকদিগকে কেহ এমন অবস্থায় দেখিতে না পায়, যে অবস্থায় তাহাদিগকে দেখা পুরুষের উচিত নহে।
(আরবী*******************************************************)
যখন তোমাদের পুত্রগণ সাবালক হইবে, তখন অনুমতি সহকারে গৃহে প্রবেশ করা তাহাদের উচিত, যেমন তাহাদের পূর্ববর্তীগণ অনুমতি সহকারে গৃহে প্রবেশ করিত। -সূরা নূরঃ ৫৯
এখানেও কারণ পরিস্কার করিয়া বলা হইয়াছে। অনুমতি গ্রহণের আদেশ শুধু তাহাদের জন্যই প্রযোজ্য, যাহাদের মধ্যে যৌন-অনুভূতির সঞ্চার হইয়াছে। এই অনুভূতির সঞ্চার হইবার পূর্বে অনুমতি গ্রহণ আবশ্যক নহে।
এতদসহ অপর লোকদিগকেও আদেশ করা হইয়াছে, যেন তাহারা বিনা অনুমতিতে কাহারও গৃহে প্রবেশ না করে।
(আরবী********************************************)
হে ঈমানদারগণ! গৃহস্বামীর অনুমতি ব্যতীত কাহারও গৃহে প্রবেশ করিও না এবং যখন প্রবেশ করিবে তখন গৃহের অধিবাসীদেরকে সালাম বলিবে। -সূরা নূরঃ ২৭
গৃহের ভিতরে ও বাহিরের মধ্যে একটা বাধা-নিষেধ স্থাপন করাই এখানে প্রকৃত উদ্দেশ্য, যেন পারিবারিক জীবনে নারী পর-পুরুষের দৃষিট্ হইতে নিরাপদ থাকিতে পারে। আরববাসিগণ প্রথমে এই সকল নির্দেশের কোন কারণ নির্ণয় করিতে পারে নাই। এইজন্য অনেক সময়ে তাহারা ঘরের বাহির হইতে ভিতরে উঁকি মারিত। স্বয়ং নবী করিম (সঃ)-এর সংগে একবার এইরূপ এক ঘটনা ঘটিয়াছিল। একদা তিনি তাঁহার হুজরায় অবস্থান করিতে ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি জানালা দিয়া উঁকি মারিল। তিনি বলিলেনঃ
যদি আমি জানিতাম যে, তুমি উঁকি মারিবে,তাহা হইলে তোমার চোখে আমি প্রবিষ্ট করাইতাম। অনুমতি গ্রহণের আদেশ তো দৃষ্টি হইতে রক্ষা করিবার জন্যই দেওয়া হইয়াছিল। -বুখারী
ইহার পর তিনি ঘোষণা করিলেনঃ
যদি কেহ অনুমতি ব্যতিরেকে অপরের গৃহের ভিতরে তাকাইয়া দেখে তাহা হইেল তাহার চক্ষু উৎপাটিত করিবার অধিকার গৃহের অধিবাসীর থাকিবে। -মুসলিম
অতপর অপরিচিত লোককে আদেশ করা হইয়াছিল যে, যদি অপরের গৃহ হইতে কিছু চাহিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে গৃহে প্রবেশ না করিয়া বাহিরে পর্দার অন্তরাল হইতে চাহিবে।
(আরবী***************************************)
তোমরা নারীদের নিকট হইতে যখন কিছু চাহিবে, তখন পর্দার অন্তরাল হইতে চাহিবে। ইহাতে তোমাদের এবং উহাদের মনের জন্য অধিকতর পবিত্রতা রহিয়াছে। -সূরা আহযাবঃ ৫৩
এখানেও বাধা-নিষেধের উদ্দেশ্যের উপর পূর্ণ আলোকপাত করা হইয়াছে। নারী-পুরুষকে যৌনস্পৃহা ও উত্তেজনা হইতে রক্ষা করাই প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং এই নির্দেশের দ্বারা নারী-পুরুষের স্বাধীন মেলামেশা বন্ধ করা হইয়াছে। ।
এই নির্দেশাবলী শুধু অপরিচিতের জন্য নহে, বরং গৃহের চাকরদের জন্যও বটে। বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত বিলাল (রাঃ) অথবা হযরত আনাস (রাঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর নিকট হইতে তাঁহার কোন এক সন্তান লইতে চাহিলেন। তখন তিনি পর্দার অন্তরাল হইতে সেই সন্তানকে দিলেন। -ফতহুল কাদির
অথচ উভয়েই নবী-পাক (সঃ)-এর বিশেষ ভৃত্য এবং আপন জনের মত ছিলেন।
নিভৃতে সাক্ষাত ও শরীর স্পর্শ
তৃতীয় বাধা-নিষেধ এই যে, স্বামী ব্যতীত অন্য কেহ কোন নারীর সংগে নিভৃতে থাকিতে এবং তাহার শরীর স্পর্শ করিতে পারিবেনা, সে যতই নিকটতম বন্ধু বা আত্মীয়ই হউক না কেন।
(আরবী***********************************)
উকবা বিন আমেন (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে যে, নবী(সঃ) বলিয়াছেন, ‘সাবধান, নিভৃতে নারীতর নিকটে যাইও না’। জনৈক আনসার বলিলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?’ নবী (সঃ) বলিলেন, সে তো মৃত্যুর ন্যায়!’ –বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী
(আরবী******************************)
স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোন নারীর নিকটে যাইও না। কারণ শয়তান তোমাদের যে কোন একজনের মধ্যে রক্তের ন্যায় প্রবাহিত হইবে। -তিরমিযী
(আরবী*******************************************)
আমর বিন আস বলেন, “স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোন নারীর নিকটে যাইতে নবী (সঃ) আমাদিগকে নিষেধ করিয়াছেন”। তিরমিযী
(আরবী***************************************)
আজ হইতে যেনকেহ স্বামীর অনপস্থিতিকে কোন নারীর নিকটে না যায়, যতক্ষণ তাহার নিকটে একজন অথবা দুইজন লোক না থাকে। -মুসলিম
স্পর্শ করার বিরুদ্ধেও এইরূপ নির্দেশ আছেঃ
(আরবী***************************************)
নবী (সঃ) বলেন, ‘যদি কেহ এমন কোন নারীর হস্ত স্পর্শ করে, যাহার সহিত তাহার কোন বৈধ সম্পর্ক নাই, তাহা হইলে পরকালে তাহার হাতের উপরে জ্বলন্ত অগ্নি রাখা হইবে’।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, নবী (সঃ) নারীদের নিকট হইতে শুধু মৌখিক বায়’আত গ্রহণ করিতেন। তাহাদের হাত নিজের হাতের মধ্যে লইতেন না। বিবাহিতা স্ত্রী ব্যতীত কো নারীর হস্ত স্পর্শ করেন নাই। -বুখারী
উসায়মা বিনতে রুকায়কা বলেন, ‘আমি কয়েকজন মহিলাকে সংগে লইয়া নবী (সঃ)-এর নিকটে বায়আত গ্রহণ করিতে গেলাম।শিরক, চুরি,ব্যাভিচার, মিথ্যাপবাদ ও নবীর নাফরমানী হইতে বিরত থাকার শপথ তিনি আমাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিলেন’। শপথ গ্রহণ শেষ হইলে আমরা বলিলাম, ‘আসুন, আমারা আপনার হাতে বায়’আত করি’। নবী বলিলেন, ‘আমি নারীদের হস্ত স্পর্শ করি না, শুধু মৌখিক শপথ গ্রহণ করি’। -নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ
এই নির্দেশগুলিও শুধু বয়স্ক নারীদের বেলায় প্রযোজ্য। বৃদ্ধা নারীর নিকটে নিভৃতে বসা এবং তাহার শরীর স্পর্শ করা জায়েয। হযরত আবু বকর (রাঃ) এক গোত্রের মধ্যে যাতায়াত করিতেন –যেখানে তিনি দুধ পান করিয়াছিলেন। ঐ গোত্রের বৃদ্ধা স্ত্রীলোকদের তিনি করমর্দন (মুসাফেহা) করিতেন। কথিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর এক বৃদ্ধার দ্বারা হাত পা দাবাইয়া লইতেন।
যুবতী ও বৃদ্ধা নারীর মধ্যে এই যে পার্থক্য রাখা হইয়াছে, তাহার দ্বারা ইহাই প্রমাণিত হয় যে, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করিতে হইবে। কারণ ইহা অনিষ্টের পথ উন্মুক্ত করিতে পারে।
মুহরেম ও গায়ের মুহরেমের মধ্যে পার্থক্য
স্বামী ব্যতীত মুহরেম ও গায়ের মুহরেম নির্বিশেষে সমস্ত পুরুষ উপরের নির্দেশাবলীর অধীন। ইহাদের মধ্যে কাহারও সম্মুখে নারী তাহার সতর অর্থাৎ মুখমণ্ডলও হস্তদ্বয় ব্যতীত শরীরের কোন অংশ খোলা রাখিতে পারে না, যেমন কোন পুরুষ কোন পুরুষের সম্মুখে তাহার সতর [নাভী ও হাটুর মধ্যবর্তী কোন অংশ] খুলিতে পারে না।
সমস্ত পুরুষকে অনুমতি সহকারে গৃহে প্রবেশ করা উচিত এবং তাহাদের মধ্যে কাহারও নির্জনে কোন নারীর নিকটে উপবেশন করা অথবা তাহার শরীর স্পর্শ করা জায়েয নহে।–[শরীর স্পর্শ করা বা শরীরে হাত লাগান সম্পর্কে মুহরেম ও গায়ের মুহরেম পুরুষের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। ভ্রাতা ভগ্নির হাত ধরিয়া কোন যানবাহরে উঠাইয়া দিতে অথবা তথা হইতে নামাইয়া লইতে পারে। প্রকাশ থাকে যে, ইহা কোন গায়ের মুহরেমের জন্য জায়েয নহে। নবী করীম (সঃ) সফর হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে কাছে টানিয়া মস্তক চুম্বন করিতেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ) এর মস্তক চুম্বন করিতেন।]