পর্দার নির্দেশাবলী
কুরআন পাকের যে সকল আয়াতে পর্দার আদেশ করা হইয়াছে, তাহা নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ
(আরবী**************************************************************************************************************)
[হে নবী! মু’মিন পুরুষগণকে বলিয়া দিন, তাহারা যেন তাহাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং যৌন পবিত্রতা রক্ষা করিয়া চলে। ইহাই তাহাদের তৎসম্পর্কে পরিজ্ঞাত। এবং মু’মিন নারিগণকে বলিয়া দিন, তাহারা যেন তাহাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং নিজেদের যৌন পবিত্রতা রক্ষা করিয়া চলে এবং স্বীয় সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে শুধু ঐ সৌন্দর্য ব্যতীত যাহা স্বতই প্রকাশিত হইয়া পড়ে। এবং যেন তাহারা স্বীয় বক্ষের উপরে উড়িবার চাদর টানিয়া দেয় এবং সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে [অন্য কাহারও নিকটে] এই সকল লোক ব্যতীত, যথাঃ স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, তৎপুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র, ভাগিনেয়, আপন স্ত্রীলোকগণ, স্বীয় দাস, নারীর প্রতি স্পৃহাহীন সেবক এবং ঐ সকল বালক, যাহারা নারীর গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয় নাই। [উপরন্তু তাহাদিগকে আদেশ করুন যে] তাহারা যেন পথ চলিবার সময় কোন পদধ্বনি না করে, যাহাতে তাহাদের অপ্রকাশিত সৌন্দর্য পদধ্বনিতে প্রকাশিত হইয়া পড়ে।
-সূরা নূরঃ ৩০-৩১
(আরবী**************************************************)
হে নবীর বিবিগণ! তোমরা তো সাধারণ নারীদের মত নহ। যদি পরহেযগারী অবলম্বন করার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে বিনাইয়া বিনাইয়া [দ্ব্যর্থবোধক] কথা বলিও না। কারণ ইহার ফলে যাহাদের অন্তরে খারাপ বাসনা আছে, তাহারা তোমাদের উপরে এক ধরনের আশা পোষণ করিয়া বসিবে। সহজ-সরলভাবে কথা বলিও। আপন ঘরে থাকিও এবং অতীত জাহিলিয়াতের ন্যায় রূপ-যৌবনের প্রদর্শনী করিয়া বেড়াইও না। -সূরা আহযাবঃ ৩২-৩৩
(আরবী**********************************************************)
হে নবী! আপন বিবি, কন্যা ও মু’মিন মহিলাদের বলিয়া দিন, তাহারা যেন তাহাদের শরীর ও মুখমণ্ডল চাদর দ্বারা আবৃত করিয়া রাখে। -সূরা আহযাবঃ ৫৯
এই সখল আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করিয়া দেখুন। পুরুষকে তো শুধু এতটুকু তাকীদ করা হইয়াছে যে, তাহারা যেন তাহাদের দৃষ্টি অবনমিত করিয়া রাখে এবং যৌন অশ্লীলতা হইতে আপন চরিত্রকে বাঁচাইয়া রাখে। কিন্তু নারীদিগের প্রতি উপরিউক্ত দুইটি আদেশ তো করা হইয়াছেই, উপরন্তু সামাজিকতা ও আচার-আচরণ সম্পর্কেও অতিরিক্ত নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহার পরিস্কার অর্থ এই যে, তাহাদের চরিত্র সংরক্ষণের জন্য শুধু দৃষ্টি সংযত করা এবং গুপ্তাংগের রক্ষণাবেক্ষণই যথেষ্ট নহে বরং আরও কতকগুলি রীতিনীতির প্রয়োজন। এখন আমাদিগকে দেখিতে হইবে যে, নবী করীম (সঃ) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এই নির্দেশগুলিকে কিভাবে ইসলামী সমাজে রূপায়িত করিয়াছিলেন। এই সকল নির্দেশের প্রকৃত মর্ম কি এবং কিভাবে এইগুলি কার্যখরী করা যায়, তাঁহাদের কথা ও কাজ এই সম্পর্কে কোন আলোকপাত করে কি-না, তাহাও আমাদিগকে দেখিতে হইবে।
দৃষ্টি সংযম
সর্বপ্রথম নারী ও পুরুষকে আদেশ করা হইয়াছে, ‘দৃষ্টি অবনমিত কর’। অর্থাৎ কাহারও মুখমণ্ডলের উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করিয়া তাহা নিম্নমুখী করিতে হএব। ইহাই কুরআনের ‘গদ্দে-বাসার’ শব্দের শাব্দিক অর্থ। কিন্তু ইহার দ্বারা পূর্ণ মর্ম পরিস্কার হয় না। আল্লাহ তাআলার আদেশের প্রকৃত উদ্দেশ্য ইহা নহে যে, মানুষ সকল সময় নীচের দিকে দেখিবে এবং উপরের দিকে কখনও তাকাইবে না, বরং প্রকৃত উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ ঐ বস্তু হইতে নিজেকে রক্ষা করুক যাহাকে হাদীসের পরিভাষায় চক্ষুর ব্যভিচার বলা হইয়াছে। অপরিচিত নারীর রূপ ও সৌন্দর্য-শোভা দর্শন করিয়া আনন্দ উপভোগ করা পুরুষের জন্য যেমন অনাচার সৃষ্টিকারী, তেমনই অপরিচিত পুরুষের প্রতি তাকাইয়া দেখাও নারীর জন্য অনাচার সৃষ্টিকারী। অনাচার বিপর্যয়ের সূচনা স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগতভাবে এইখানে হইতেই নয়। এইজন্য সর্বপ্রথম এই পথ বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং দৃষ্টিসংযম বা দৃষ্টি অবনমিত করণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ইহাই।
ইহা সত্য যে, চক্ষু খুলিয়া দুনিয়ায় বাস করিতে গেলে সব কিছুর উপরেই দৃষ্টি পতিত হইবে। ইহা তো সম্ভব নহে যে, কোন পুরুষ কোন নারীকে এবং কোন নারী কোন পুরুষকে কখনও দেখিবে না। এইজন্য শরীআতের ব্যবস্থা দানকারীর নির্দেশ এই যে, হঠাৎ কাহারও উপর দৃষ্টি পড়িলে এবং তাহার সৌন্দর্যের প্রতি কিছু আকর্ষণ অনুভূত হইলে দ্বিতীয়বার তাহার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা নিষিদ্ধ করা হইয়াছে।
হযরত জারীর (রাঃ) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘হঠাৎ যদি কাহারও উপরে নজর পড়িয়া যায়, তাহা হইলে কি করিব?’ উত্তরে তিনি বলিলেন, ‘দৃষ্টি ফিরাইয়া লও’। -আবু দাউদ
(আরবী********************************************************)
হযরত বারিদাহ (রাঃ) বলেন যে, নবী (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বলিলেন, ‘হে আলী! প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয়বার তাকাইও না। প্রথম দৃষ্টি ক্ষমা করা হইবে; কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকাইলে তাহা ক্ষমা করা হইবে না। -আবু দাউদ
(আরবী*********************************************)
নবী (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কোন অপরিচিত নারীর প্রতি যৌন লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কিয়ামতের দিনে তাহার চক্ষে উত্তপ্ত গলিত লৌহ ঢালিয়া দেওয়া হইবে। -ফাতহুল কাদীর
কিন্তু এমন অনেক অবস্থার সম্মুখীন হইতে হয়, যখন অপরিচিত নারীকে দেখা আবশ্যক হইয়া পড়ে। যথাঃ কোন নারী কোন চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন আছে কিংবা নারী কোন মোকদ্দমায় বিচারকের সম্মুখে সাক্ষী হইতেছে অথবা পানিতে ডুবিয়া যাইতেছে কিংবা কোন নারীর সতীত্ব ও সম্ভ্রম বিপন্ন হইয়াছে –এমতাবস্থায় তাহার মুখমণ্ডল দর্শন করা কেন, প্রয়োজন হইলে সতরও দেখা যাইতে পারে। তাহার শরীরও স্পর্শ করা যাইতে পারে, বরং অগ্নিতে দগ্ধীভূত হইতেছে বা পানিতে নিমগ্ন হইতেছে, এমন নারীকে কোলে তুলিয়া লইয়া আসা শুধু জায়েযই নহে, ফরয হইয়া পড়ে। শরীআত প্রণেতার নির্দেশ এই যে, এইরূপ অবস্থায় যথাসম্ভব নিয়্যত পবিত্র রাখিতে হইবে। কিন্তু মানবসুলভ চাহিদার কারণে যদি কণামাত্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তাহা হইলে তাহাতে কোন অপরাধ হইবে না। কারণ এইরূপ দৃষ্টি প্রয়োজনের তাকিদেই করা হইয়অছে এবং প্রাকৃতিক চাহিদা দমিত করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নহে।
অনুরূপভাবে অপরিচিহত নারীকে বিবাহের উদ্দেশ্যে দেখা এবং ভালভাবে দেখা শুধু জায়েযই নহে, বরং হাদীসে এই সম্পর্কে নির্দেশ আছে। স্বয়ং নবী করীম (সঃ) ও এই উদ্দেশ্যে নারী দর্শন করিয়াছেন।
(আরবী******************************************************)
মুগীরা বিন শো’বাহ হইতে বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি একটি নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। নবী (সঃ) তাঁহাকে বলিলেন, ‘তাহাকে দেখিয়া লও। কারণ ইহা তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও ঐক্য সৃষ্টি করিতে অধিকতর উপযোগী হইবে’। -তিরমিযী
(আরবী****************************************************)
সহর বিন সা’দ হইতে বর্ণিত আছে যে, একদা এক নারী নবী করীম (সঃ)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার সহিত বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হইবার জন্য আমি আমার নিজকে পেশ করিতেছি’। ইহাতে নবী (সঃ) তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া লইলেন। -বুখারী
(আরবী****************************************)
হযরত আবু হুরায়রা বলেন, ‘আমি নভী (সঃ)-এর নিকটে বসিয়াছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আসিয়া বলিল, ‘আমি একজন আনসার নারীকে বিবাহ করার মনস্থ করিয়াছি। নবী (সঃ) বলিলেন, ‘তুমি কি তাহাকে দেখিয়াছ?’ সে ব্যক্তি বলিল ‘না’। হুযুর (সঃ) বলিলেন, ‘তাহাকে দেখিয়া লও। কারণ সাধারণত আনসারদের চক্ষে কিছু না কিছু দোষ থাকে’। -মুসলিম
(আরবী******************************************************************)
জাবির বিন আবদুল্লাহ হইতে বর্ণিত আছে, নবী (সঃ) বলিয়াছেন, যদি তোমাদের মধ্যে কেহ কোন নারীকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব দেয়, তাহা হইলে যথাসম্ভব তাহাকে দেখা উচিত যে, তাহার মধ্যে এমন কিছু আছে কিনা, যাহা উক্ত পুরুষকে বিবাহের জন্য উদ্ধুদ্ধ করে। -আবু দাউদ
এই সকল ব্যক্তিক্রম সম্পর্কে চিন্তা করিলে বোঝা যায় যে, নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করাকে একেবারে বন্ধ করিয়া দেওয়া আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য নহে বরং প্রকৃতপক্ষে ফিতনা বা অনাচারের পথ বন্ধ করাই তাহার উদ্দেশ্য। যে দেখার কোন প্রয়োজন নাই, যাহা দ্বারা কোন তামাদ্দুনিক উপকারও নাই এবং যাহা দ্বারা যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হইবার কারণ থাকে, এইরূপ দর্শন করা নিষিদ্ধ হইয়াছে।
এই সকল নির্দেশ যেমন পুরুষের জন্য করা হইয়াছে ঠিক তেমনি নারীদের জন্যও করা হইয়াছে।
হাদীসে হযরত উম্মে সালমা হইতে বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি ও হযরত মায়মুনা হযরত নবী (সঃ) –এর নিকটে বসিয়াছিলেন। এমন সময় অন্ধ হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম তথায় আসিলেন। নবী (সঃ) বলিলেন, ‘তাহার জন্য পর্দা কর’। হযরত উম্মে সালমা বলিলেন, ‘ইনি কি অন্ধ নহেন? তিনি তো আমাদিগকে দেখিতেও পারিবেন না এবং চিনিতেও পারিবেন না’। নবী (সঃ) বলিলেন, ‘তোমরাও কি অন্ধ যে তাহাকে তোমরা দেখিতে পাইতেছ না?’
কিন্তু পুরুষের চোখে নারীকে দেখা এবং নারীর চোখে পুরুষকে দেখার মধ্যে মনস্তত্ত্বের দিক দিয়া সামান্য পার্থক্য আছে। পুরুষের প্রকৃতির অগ্রবর্তী হইয়া কাজ করার প্রবণতা আছে। সে কোন কিছু মনপুত হইবার পর তাহা অর্জন করিবার জন্য চেষ্টানুবর্তী হয়। কিন্তু নারীপ্রকৃতিতে আছে বাধা প্রদান প্রবণতা ও পলায়নপরতা। যে পর্যন্ত তাহার প্রকৃতি পরিবর্তিত না হইয়াছে, সে পর্যন্ত সে এতখানি নির্ভীক ও দুঃসাহসী হইতে পারে না যে, কেহ তাহার মনপুত হইবার পর তাহার দিকে ধাবিত হইবে। শরীআত প্রণেতা এই পার্থক্যর প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া নারীর জন্য পুরুষকে দেখার ব্যাপারে ততখানি কঠোরতা ঘোষণা করেন নাই, যতখানি করিয়াছেন পুরুষের পক্ষে নারীকে দেখার ব্যাপারে। যেহেতু হাদীস গ্রন্থগুলিতে হযরত আয়েশার (রাঃ)এই বর্ণনাটি প্রসদ্ধ যে, ‘হযরত নবী(স) তাঁহাকে ঈদ উপলক্ষে হাবশীদের খেলা দেখাইয়াছিলেন’।–[এই বর্ণনাটি বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ প্রভৃতিতে বিভিন্নরূপে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কেহ কেহ ইহার ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে, এই ঘটনা সম্ভবত ঐ সময়ে সংঘটিত হইয়াছিল যখন হযরত আয়েশা (রা) নাবালিকা ছিলেন এবং যখন পর্দার নির্দেশ অবতীর্ণ হয় নাই। কিন্তু ইবনে হুরানে বিস্তারিত আলোচনায় বলা হইয়াছে যে, ইহা ঐ সময়ের ঘটনা, যখন আবিসিনিয়া হইতে একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় আসিয়াছিল। ইতিহাস হইতে প্রমাণিত আছে যে, উক্ত প্রতিনিধি দল ৭ম হিজরীতে মদীনায় আসিয়াছিল। এই দিক দিয়া বিচার করিতে গেলে হযরত আয়েশা (রা) এর বয়স তখন পনর-ষোল বৎসর ছিল। উপরন্তু বুখারীর বর্ণনাতে বলা হইয়াছে যে, নবী(স) হযরত আয়েশা (রা)-কে চাদর দ্বার ঢাকিয়া রাখিয়াছিলেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, পর্দার নির্দেশাবলীও তখন অবতীর্ণ হইয়াছিল।] ইহা হইতে জানা যায় যে, নারীদের পক্ষে পুরুষকে দেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু একই সমাবেশে উভয়ের মিলিত হইয়া বসা এবং অপলক-নেত্রে দেখা নিষিদ্ধ। এমন দৃষ্টিও জায়েয নহে, যাহা দ্বারা কোন অনাচার অমংগল হইতে পারে। যে অন্ধ সাহাবী হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম হইতে পর্দা করিবার জন্য নবী (স) উম্মে সালমাকে আদেশ করিয়াছিলেন সেই সাহাবীর গৃহেই আবার ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা) কে ইদ্দত পালন করিবার জন্য নবী (স) আদেশ করিয়াছিলেন। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী তাঁহার আহকামুল কুরআনে ঘটনাটি এইভাবে বিবৃত করিয়াছেনঃ
তিনি বলেন যে, ফামিতা বিনতে কায়েস উম্মে শরীকের গৃহে ইদ্দত পালন করিতে চাহিয়াছিলেন। নবী(স) বলিলেনঃ এই বাড়ীতে লোক যাতায়াত করে। তুমি ইবনে উম্মে মাকতুমের বাড়ীতে থাক। কারণ সে একজন অন্ধ এবং সেখানে তুমি বেপর্দাও থাকিতে পার।
ইহা হইতে জানা যায় যে, উদ্দেশ্য অনাচার-অমঙ্গলের আশংকা লাঘব করা। যেখান অনাচারের আশংকা অধিক ছিল, সেখানে থাকিতে নিষেধ করা হইল এবং যেখানে আশংকা কম ছিল, সেখানেই থাকিতে বলা হইল। কারণ সে নারীকে কোথাও না কোথাও অবশ্যই থাকিতে হইত এবং যেখানে থাকার কোন আবশ্যকতা ছিল না, সেখানে নারীদিগকে একজন বেগানা পুরুষের সংগে একই স্থানে সমবেত হইতে এবং সামনাসামনি তাহার সংগে দেখা-সাক্ষাত করিতে নিষেধ করা হইল।
এই সকল মর্যাদা-বিচার-বুদ্ধিসম্মত ও শরীআতের মর্ম অনুধাবন করিবার যোগ্যতা যাঁহার আছে, তিনি সহজেই বুঝিতে পারেন যে, দৃষ্টি সংযমের নির্দেশাবলীর যুক্তিসংগত কারণগুলি কি এবং এই দিক দিয়া এই সকল নির্দেশের কঠোরতা বৃদ্ধি ও লাঘবের কারণ কি? শরীআত প্রণেতার প্রকৃত উদ্দেশ্য দৃষ্টির খেলা বন্ধ করা। নতুবা কাহারও চক্ষুর সংগে তাঁহার কোন শত্রুতা নাই। চক্ষুদ্ধয় প্রথমে নির্দোষ দৃষ্টি দিয়া দেখে। মনের শয়তান তাহার আস্বাদন এবং তাহা প্রকৃতিপ্রদত্ত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যান্য আনন্দ উপভোগ কর’। অতএব মানবীয় সৌন্দর্য একবার অবলোকন কর এবং তাহা হইতে এক আধ্যাত্মিক আনন্দ উপভোগ কর’। কিন্তু ভিতরে ভিতরে শয়তান আনন্দ-সম্ভোগ-স্বাদ বাড়াইয়া চলে। অবশেষে সৌন্দর্য স্বাদ মিলনাকাঙ্ক্ষা উন্নীত হয়। জগতে এই পর্যন্ত যত পাপাচার হইয়াছে এবং হইতেছে, এই চক্ষুর দৃষ্টিই যে তাহার প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ, তাহা অস্বীকার করিবার সাধ্য কাহারও আছে কি? কোন ব্যক্তি এ দাবী করিতে পারে যে, এতটি পুষ্প দর্শন করিয়া মনের যে অবস্থা হয়, কোন সুন্দর যুবক আর যুবতী দর্শনে ঠিক সেই অবস্থা হয়? যদি উভয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্য থাকে এবং একটির তুলনায় অপর অবস্থাটি যৌন-আবেদনমূলক হয়, তাহা হইলে কেমন করিয়া বলা যায় যে, একটি সৌন্দর্য আস্বাদনে যে স্বাধীনতা থাকিবে, অপরটির বেলায়ও তাহাই থাকিবে? শরীআত প্রণেতা কাহারও সৌন্দর্য-স্বাদ বন্ধ করিতে চাহেন না। তিনি তো বলেনঃ তুমি তোমার ইচ্ছামত জোড়া নির্বাচন করিয়া লও এবং উহাকেই কেন্দ্র করিয়া তোমার মধ্যে সৌন্দর্য-স্বাদের যতখানি বাসনা আছে তাহা মিটাইয়া লও। এই কেন্দ্র হইতে সরিয়া যদি অপরের রূপ-যৌবন দেখিয়া বেড়াও, তাহা হইলে অনাচার-অশ্লীলতায় লিপ্ত হইবে। আত্মসংযম ও অন্যান্য বাধা নিষেধের কারণে কার্যত লাম্পট্যে লিপ্ত না হইলেও, চিন্তারাজ্যের লাম্পট্য হইতে নিজকে রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার অনেক শক্তি অপচয়িত হইবে চক্ষুর উত্তেজনায়। অনেক অকৃত পাপাকাঙ্ক্ষায় তোমার মন কলুষিত হইবে। পুন পুন প্রেম-প্রতারণায় জর্জরিত হইবে এবং বহু রাত্রি জাগিয়া জাগিয়া স্বপ্ন দেখিয়া কাটাইবে। অনেক সুন্দর নাগ-নাগিনী তোমাকে দংশন করিবে। হৃৎপিন্ডের কম্পন ও রক্তের উত্তেজনায় তোমার জীবনী শক্তি ক্ষয়িত হইবে –এটা কি কম ক্ষতি? এইগুলি আয়ত্তে রাখ। বিনা কারণে দেখা এবং এমন দেখা, যাহার ফলে অনাচার-অমংগল সংঘটিত হইতে পারে –তাহা হইতে বিরত থাকা উচিত। যদি দেখার কোন প্রকৃত আবশ্যকতা এবং তাহার দ্বারা যদি কোন তামাদ্দুনিক মংগল হয়, তাহা হইলে তাহা ন্যায়নংগত হইবে।
সৌন্দর্য প্রকাশে বাধা-নিষেধ ও তাহার সীমারেখা
দৃষ্টি-সংযমের আদেশাবলী নারী-পুরুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। আবার কতক আদেশ নারীদের জন্য নির্দিষ্ট। তাহার মধ্যে প্রথম আদেশ এই যে, একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার বাহিরে আপন সৌন্দর্য প্রদর্শন করা চলিবে না।
এই আদেশের উদ্দেশ্য ও বিবরণ সম্পর্কে চিন্তা করিবার পূর্বে একবার ঐ সকল নির্দেশ স্মরণ করা দরকার, যাহা ইতিপূর্বে পোশাক ও সতরের অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে। মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় ব্যতীত নারীর সমগ্র দেহ (সতর) যাহা পিতা, চাচা, ভ্রাতা ও পুত্রের নিকটেও উন্মুক্ত জায়েয নহে। এমন কি কোন নারীর সতর অপর নারীর সম্মুখের উন্মুক্ত করাও মাকরূহ।–[কোন নারীর নাভী হইতে হাঁটুর মধ্যবর্তী অংগগুলি অন্য নারীর জন্য দেখা ঠিক ঐরূপ হারাম, যেমন কোন পুরুষের এই অংগগুলি অন্য পুরুষের জন্য দেখা হারাম। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অংগগুলি দেখা মাকরূহ, হারাম নহে।] এই সত্যকে সম্মুখে রাখিবার পর সৌন্দর্য প্রকাশের সীমারেখা আলোচনা করা দরকার।
১। নারীকে তাহার সৌন্দর্য স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, সৎ পুত্র, ভ্রাতা, ভাইপো ও ভাগিনেয়র সম্মুখে প্রকাশ করিবার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে।
২। তাহাকে আপন গোলামের সম্মুখে (অন্য কাহারও গোলামের সম্মুখে নহে) সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতিও দেওয়া হইয়াছে।
৩। সে এমন লোকের সম্মুখেও সৌন্দর্য শোভা সহকারে আসিতে পারে, যে তাহার অনুগত ও অধীন এবং নারীদের প্রতি যাহার কোন আগ্রহ বা আকাঙ্ক্ষা নাই।–[এই নির্দেশের তফসীর করিতে গিয়া হাফেয ইবনে কাসীর বলেনঃ (আরবী******************) ইহা দ্বারা ঐ সকল মজুর, চাকর ও অনুগত লোক বুঝায় যাহারা চালাকচতুর নহে, অত্যন্ত সরলচিত্ত এবং নারীদের প্রতি যাহাদের কোন যৌনবাসনা নাই। দুইটি অবস্থায় যৌনবাসনা না থাকিতে পারে। প্রথমত, তাহাদের মধ্যে মোটেই কোন যৌনবাসনা নাইঃ যথাঃ বৃদ্ধ, অবোধ অথবা জন্মগত নপুংসক। দ্বিতীয়ত, পুরুষোচিত শক্তি এবং নারীর প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহাকাঙ্ক্ষা আছে বটে, কিন্তু যে বাড়ীর অধীনে সে একজন অনুগত চাকর, অথবা যে বাড়ীতে সে একজন ভিখারী হিসাবে সাহায্য গ্রহন করিতে যায়, সে বাড়ীর নারীদের প্রতি সে কোন যৌনবাসনা পোষণ করিতে পারে না। কুরআনের উপরিউক্ত শব্দগুলি দ্বারা এই দুই শ্রেণীর লোককেই বুঝান হইয়াছে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, এই ধরনের যে সকল পুরুষের সামনে নারীদিগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে অবশ্যই দুইটি গুণ থাকিতে হইবে। প্রথমত, যে বাড়ীর মেয়েরা তাহাদের স্ত্রীলোকদের প্রতি কোন প্রকার যৌনবাসনা রাখিবার চিন্তাও তাহারা করিবে না। অতপর প্রতিটি বাড়ীর মলিকের এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার যে, যে সকল ভৃত্যকে বাড়ীর ভিতরে আসিতে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে, প্রথমত তাহাদের প্রতি যে ধারণা করা হইয়াছিল, তাহা প্রমাণিত হইয়াছে কিনা। অনুমতি দেওয়ার পর যদি তাহাদের প্রতি কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়, তাহা হইলে উহাদের বাড়ীর ভিতরে আসা বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। এই ব্যাপারে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ঐ নপুংসক ব্যক্তি, যাহাকে হযরত নবী (স) বাড়ীর মধ্যে আসিবার অনুমতি দিয়াছিলেন।
ঘটনাটি এই যে, মদীনাতে একজন নপুংসক ছিল। সে নবীর বিবিগণের সামনে যাতায়াত করিত। একদা সে হযরত উম্মে সালমা (রা)-এর নিকটে বসিয়া তাঁহার ভ্রাতা হযরত আবদুল্লাহ (রা)-এর সহিত আলাপ করিতেছিল। এমন সময় নবী(স) তথায় আগমন করিলেন এবং বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিবার সময় উক্ত নপুংসককে হযরত আবদুল্লাহর কাছে এই কথাগুলি বলিতে শুনিলেনঃ
আগামী কাল যদি তায়েফ বিজিত হয়, তাহা হইলে বাদিয়া বিনতে গায়লান সাকফীকে তোমাকে দেখাইব। তাহার অবস্থা এই যে, যখন সে সম্মুখ দিক হইতে আসে, তখন তাহার পেটে চারিটি ভাঁজ দেখা যায় এবং পশ্চাৎ ফিরিলে আটটি ভাঁজ। অতপর সে অশ্লীল ভাষায় তাহার গোপনীয় অংগের প্রশংসা করিল। নবী (স) ইহা শ্রবণ করিয়া বলিলেনঃ হে আল্লাহর দুশমন! তুমি তো তাহাকে খুব নিবিড়ভাবে দেখিয়াছ। অতপর তিনি তাঁহার সহধর্মিনিগণকে বলিলেনঃ আমি দেখিতেছি যে, এই ব্যক্তি নারীদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অতএব সে যেন তোমাদের নিকটে না আসিতে পারে।
নবী(স) ইহাতেই ক্ষান্ত হইলেন না। তিন তাহাকে মদীনা হইতে বহিস্কার করিয়া দিলেন। কারণ সে বিনতে গায়লানের গোপনীয় অংগের যে চিত্র অংকন করিল তাহাতে নবী(স) মনে করিলেন যে, তাহার মেয়েলী ধরন ও হাবভাব দেখিয়া মেয়েরা তাহার সংগে এমনভাবে দ্বিধাহীন চিত্তে মেলামেশা করে, যেমন করে আপন নারী জাতির সংগে। এই সুযোগে ঐ ব্যক্তি মেয়েদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা অবগত হইয়া পুরুষের নিকটে তাহাদের প্রশংসা করে। ইহার ফলে বিরাট অনিষ্ট-অনাচার হইতে পারে।]
৪। যে সকল বালকের মধ্যে এখনও যৌন অনুভূতির সঞ্চার হয় নাই, তাহাদের সম্মুখেওো সে সৌন্দর্য প্রদর্শন করিতে পারে। কুরআন পাকে আছেঃ
(আরবী*******************************************)
এমন বালক বা নারীদের গোপন কথা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয় নাই।
৫। সকল সময় মেলামেশা করা হয় এইরূপ মেয়েদের সামনে মেয়েদের সৌন্দর্য-শোভা প্রদর্শন করা জায়েয আছে। কুরআন পাকে ‘সাধারণ নারিগণ’ শব্দের পরিবর্তে ‘আপন নারীগণ’ ব্যবহার করা হইয়াছে। ইহা দ্বারা ‘সম্ভ্রান্ত মহিলাগণ’ অথবা ‘আপন মহিলা আত্মীয়-স্বজন’ অথাব ‘আপন শ্রেণীর মহিলাগণকেই’ বুঝানহইয়াছে। অজ্ঞ মুর্খ নারী, এমন নারী যাহাদের চালচলন সন্দেহযুক্ত অথবা যাহাদের চরিত্রে কলংক ও লাম্পট্যের ছাপ আছে, এই ধরনের সকল নারীর সম্মুখে আলোচ্য নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি নাই। কেননা ইহারাও অনাচার-অমংগলের কারণ হইতে পারে। শামদেশে মুসলমানগণ যাওয়ার পর মুসলমান মহিলাগণ, ইহুদী-খৃষ্টান মহিলাদের সহিত মেলামেশা আরম্ভ করিলে হযরত ওমর (রা) শামের শাসনকর্তা হযরত আবু ওবায়দাহ বিন জাবরাহ (রা) কে লিখিয়া জানাইলেন, যেন মুসলমান মহিলাগণকে আহলে-কিতাব মহিলাদের সহিত হাম্মামে (স্নানাগার) প্রবেশ করিতে নিষেধ করা হয়। -তাফসীরে ইবনে জারীর
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) ব্যাখ্যা করিয়া বলেন যে, মুসলমান মহিলাগণ কাফির ও যিম্মী নারীগের সামনে ততটুকুই প্রকাশ করিতে পারে, যতটুকু অপরিচিত পুরুষের সামনে করিতে পারে। -তাফসীর কবীর
কোন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা এ সবের উদ্দেশ্য ছিল না, বরং যে সকল নারীর স্বভাব-চরিত্র ও তাহযীব-তমদ্দুন জানা ছিল না, অথবা জানা থাকিলে তাহা ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক ছিল-এই ধরনের নারীর প্রভাব হইতে মুসলমান নারীদিগকে রক্ষা করাইইহার উদ্দেশ্য ছিল। এমন অমুসলমান নারীদের মধ্যে যাহারা সম্ভ্রান্ত ও লজ্জাশীলা, তাহারা কুরআনের (আরবী********) ‘আপন নারীগণের মধ্যেই শামিল’।
এই সকল সীমারেখা সম্পর্কে চিন্তা করিলে দুইটি জাতিনে পারা যায়ঃ
১। যে সৌন্দর্য প্রকাশের অনুমতি এই সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে দেওয়া হইয়াছে তাহা ‘সতরে-আওরাতের আওতাবহির্ভূত অংগাদির অর্থাৎ অলংকারাদি পরিধান করা, সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত হওয়া, সুরমা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা, কেশ বিন্যাস করা এবং অন্যান্য বেশভূষা, যাহা নারিগণ নারীসুলভ চাহিদা অনুযায়ী আপন গৃহে পরিধান করিতে অভ্যস্ত হয়।
২। এই ধরনের বেশভূষা ঐ সকল পুরুষের সম্মুখে প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে, যাহাদিগকে নারীদের জন্য চিরতরে হারাম করা হইয়াছে অথবা ঐ সকল পুরুষের সম্মুখে, যাহাদের মধ্যে যৌন-বাসনা নাই অথবা ঐ সকল লোকের সম্মুখে যাহারা কোন অনাচার-অমংগলের কারণ হইবে না। নারীদের বেলায় ‘আপন নারিগণ’ শর্ত আরোপ করা হইয়াছে, অধীনদের জন্য ‘যৌনবাসনাহীন’ এবং বালকদের জন্য ‘নারীদের গোপন বিষয় সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত’ শর্ত আরোপ করা হইয়াছে। ইহা দ্বারা জানিতে পারা গেল যে, শরীআত-প্রণেতার উদ্দেশ্য হইতেছে নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শন এমন গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা,যাহাতে তাহাদের সৌন্দর্য ও বেশভূষার দ্বারা কোন প্রকার অবৈধ উত্তেজনা সৃষ্টি এবং যৌন উচ্ছৃংখলতার আশংকা হইতে না পারে।
এই গণ্ডির বাহিরে যত পুরুষ আছে তাহাদের সম্পর্কে এই আদেশ করা হইয়াছে যে, তাহাদের সম্মুখে সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রদর্শন করা চলিবেনা, উপরন্তু পথ চলিবর সময় এমনভাবে পদক্ষেপ করা চলিবে না, যাহাতে গোপন সৌন্দর্য ও বেশভূষা পদধ্বনির দ্বারা প্রকাশিত হইয়া পড়ে। ফলে পুরুষের দৃষ্টি উক্ত নারীর প্রতি নিবদ্ধ হয়। এই আদেশ দ্বারা যে সৌন্দর্য পরপুরুষ হইতে গোপন করিতে বলা হইয়াছে, তাহা ঠিক উহাই, যাহা উপরে উল্লিখিত সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে প্রকাশ করিবার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। উদ্দেশ্য অতি সুস্পষ্ট। মহিলারা যদি বেশভূষা করিয়া এমন লোকের সম্মুখে আসে, যাহারা যৌন-লালসা রাখে এবং মুহরেম না হওয়ার কারণে যাহাদের মনের যৌন-লালসা পবিত্র-নিষ্পাপ ভাবধারায় পরিবর্তিত হয় নাই, তাহা হইলে কেহই বলে না যে, এই রূপ সৌন্দর্য প্রকাশের ফলে প্রত্যেক নারী চরিত্রহীনা হইবে এবং প্রত্যেক পুরুষ কার্যত পাপাচারী হইয়া পড়িবে। কিন্তু ইহাও কেহ অস্বীকার করিতে পারে না যে, সুন্দর বেশভূষা সহকারে নারীদের প্রকাশ্যে চলাফেলা এবং জনসমাবেশে অংশ গ্রহণ করার ফলে অসংখ্য প্রকাশ্য ও গোপন, মানসিক ও বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হইতেছে। আজকাল ইউরোপ-আমেরিকার নারী সমাজ নিজেদের ও স্বামীর উপার্জিত অধিকাংশ বেশভূষায় ব্যয় করিতেছে। তাহাদের এই ব্যয়ভার দৈনন্দিন এতই বাড়িয়া চলিয়াছে যে, ইহা বহন করিবার আর্থিক সংগতি তাহাদের নাই।–[সম্পত্রি কেমিক্যাল দ্রব্য নির্মাতাদের একটি প্রদর্শনী হইল। ইহতে বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায় জানা গেল যে, ইংলণ্ডের নারিগণ বৎসরে দুই কোটি পাউন্ড এবং আমেরিকার নারীমহল বৎসরে সাড়ে বারকোটি পাউন্ড ব্যয় করে। প্রায় শতকরা নব্বইজন নারী কোন না-কোন প্রকারের ‘মেক-আপ’ করতে অভিলাষী। (বি.দ্র.-ইহা চল্লিম বৎর পূর্বের কথা-যেমন এই প্রবন্ধ লিখিত হয়। বর্তমানে নারীদের বিলাসিতা উহা হইতে যে বহুগুণে বর্ধিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। -অনুবাদক।] যে সকল যৌন-লোলুপ দৃষ্টি বাজারে, অফিসাদিতে এবং জনসমাবেশে যোগদানকারী নারীদিগকে স্বাগতম জানায়, তাহাই কি এই উন্মাদনা সৃষ্টি করে নাই? পুনরায় চিন্তা করিয়া দেখুন, নারীদের মধ্যে সাজ-সজ্জার এত বড় প্রবল আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হওয়ার এবং তাহা দ্রুতবেগে বর্ধিত হওয়ার কি কারণ থাকিতে পারে? কারণ ইহাই কি নহে যে, তাহারা পুরুষের প্রশংসা লাভ করিতে এবং তাহাদের চক্ষে মানানসই সাজিতে ইচ্ছা করে? –[সুন্দরী সাজিবার উন্মাদনা মহিলাদের মধ্যে একটা বাড়িয়া গিয়াছে যে ইহার জন্য তাহারা জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতেছে। তাহাদের চরম প্রচেষ্টা এই হয়যে, তাহারা পাতলা ছিপছিপে হইয়া থাকিবে এবং শরীরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক পাউন্ড গোশত যেন না থাকে। সৌন্দর্যের জন্য বিশেষজ্ঞগণ পায়ের গোছা, উরু ও বক্ষের যে মাপ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, প্রত্যেকটি বালিকা নিজের দেহকে সেই পরিমাপের মধ্যে রাখিতে চায় যেন অপরের চোখে আনন্দদায়িনী সাজা ব্যতীত এই সকল হতভাগীদের জীবনের দ্বিতীয় কোন লক্ষ্যই নাই। লক্ষ্যে পৌঁছিবার জন্য হতভাগীরা অনাহারে কাটায়, শরীর পুষ্টকারী খাদ্য দ্রব্যাদি হইতে নিজেকে বঞ্চিত রাখে, লেবুর রস, তিক্ত কফি এবং এই ধরনের মৃদু পানাহারে দিন যাপন করে। চিকিৎসকের বিনা পরামর্শে, বরং পরামর্শের বিপরীত, এমন সব ঔষধাদি ব্যবহার করে, যাহা তাহাদিগকে ক্ষীণ ও দুর্বল করিয়া ফেলে। এই উন্মাদনার বশে অনেক নারী জীবন বিসর্জন দিয়াছে এবং দিতেছে। ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে বুদাপেষ্টের বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘জুসিলাবাস’ হঠাৎ হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ফলে মারা যায়। পরে তদন্তে জানা গেল যে, বিগত কয়েক বৎসর যাবত সে অর্ধভুক্ত অবস্থায় কাটাইতেছিল এবং শরীরের ওজন কমাইবার জন্য পেটেন্ট ঔষধ ব্যবহার করিতেছিল। অতপর হঠাৎ একদিন তাহার জীবনীমক্তি জবাব দিয়া ফেলিল। উহার পর শুধু বুদাপেষ্টেই পর পর আরও তিনটি ঘটনা সংঘটিত হয়। হাংগেরীর অতি প্রসিদ্ধ সুন্দরী ‘মাগদা বরসিলি’ হাল্কা সাজিবার জন্য জীবন দেয়। অতপর গায়িকা ‘লুইস জাবু’ এক রাত্রিতে মঞ্চের উপরে হাজার হাজার দর্শকের সামনে হঠাৎ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া মৃত্যুবরণ করে। তাহার দুৎখ এই ছিল যে, তাহার দেহ আধুনিক যুগের সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনুযায়ী ছিল না। এই দুঃখ দূর করিবার জন্য বেচারী কৃত্রিম পন্থা অবলম্বন করিয়াছিল এবং দুই মাসে ষাট পাউন্ড শরীরের ওজন কমাইল। ফল এই হইল যে, হৃৎপিণ্ড অতিমাত্রায় দুর্বল হইয়া পড়িল এবং একদিন সৌন্দর্যের গ্রাহকদের জন্য জীবন বিসর্জন করিল।
ইহার পর ‘ইমুলা’ নাম্মী একজন অভিনেত্রীর পালা আসিল। সে কৃত্রিম উপায়ে তাহার শরীর এত হাল্কা করিয়াছিল যে, অবশেষে এক স্থায়ী মস্তিষ্ক রোগে আক্রান্ত হয়। অতপর রংগমঞ্চের পরিবর্তে তাহাকে পাগলা গারদে যাইতে হয়। এই ধরনের খ্যাতনাম্নী লোকদের ঘটনা তো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কে জানে এই সৌন্দর্য এবং প্রেমিক সাজিবার উন্মাদনা, যাহা গৃহে গৃহে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, প্রতিদিন তাহা কত স্বাস্থ্য এবং কত জীবন ধ্বংস করিতেছে? কেহ কি বলিবে, ইহা নারী স্বাধীনতা, না নারীর দাসত্ব? এই তথাকথিত স্বাধীনতা তো তাহাদের উপর পুরুষের কামপ্রবৃত্তির প্রভূত্ব অধিকতর চাপাইয়া দিয়াছে। উহা তাহাদিগকে এমন দাস বানাইয়া দিয়াছে যে, পানাহার ও স্বাস্থ্য্ রক্ষার ব্যাপারেও স্বাধীনতা হইতে সে বঞ্চিত হইয়াছে। এই হতভাগিনীদের জীবন-মরণ এখন শুধু পুরুষদের জন্যই রহিয়া গিয়াছে।] ইহা কিসের জন্য? ইহা কি একেবারে নিষ্পাপ আকাঙ্খা? ইহার অভ্যন্তরে কি যৌন-বাসনা লুক্কায়িত নাই, যাহা স্বীয় স্বাভাবিক গণ্ডির বাহিরে বিস্তার করিতে চায় এবং যাহার দাবি পূরণ করিবার জন্য অপর প্রান্তেও অনুরূপ বাসনা রহিয়াছে? যদি আপনি ইহা অস্বীকার করেন তাহা হইলে হয়ত আগামীকাল আপনি এই দাবী করিতে দ্বিধা করিবেন না যে, আগ্নেয়গিরিতে যে ধুম্ররাশি দেখা যাইতেছে, তাহার অভ্যন্তর হইতে কোন লাভা বহির্ভূত হইতে উন্মুখ নহে।
আপনি আপনার কাজ করার স্বাধীনতা রাখেন এবং যাহা ইচ্ছা তাহা করুন। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করিবেন না। এ সত্য এখন আর গোপনও নাই। দিবালোকের ন্যায় ইহার ফলাফল প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে। এই ফলাফল আপনি জ্ঞাতসারে গ্রহণ করিতেছেন। কিন্তু যে স্থান হইতে উহার প্রকাশ সূচিত হয়, ইসলাম ঐ স্থানেই উহাকে বন্ধ করিয়া দিতে চায়। কারণ তাহার দৃষ্টি সৌন্দর্য প্রকাশের বাহ্যত আপাত নিষ্পাপ সূচনার উপরে নিবদ্ধ নহে, বরং যে ভয়ানক পরিণাম কিয়ামতের অন্ধকারের ন্যায় সমগ্র সমাজে ছড়াইয়া পড়ে, তাহারই উপর নিবদ্ধ রহিয়াছে।
হাদীসঃ
(আরবী*****************************************)
পর পুরুষের সম্মুখে সাজ-সজ্জা সহকারে বিচরণকারী নারী আলোক-বিহীন কিয়ামতের অন্ধকারের ন্যায়। -তিরমিযী
কুরআনে যে অপরিচিত পুরুষের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে সেখানে একটি ব্যতিক্রমও আছে। যথাঃ (আরবী***********) ইহার তাহাতে কোন দোষ নাই। লোকে এই ব্যতিক্রম হইতে কিছু সুবিধা লাভ করিবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু বিপদ এই যে, এই শব্দগুলি হইতে বেশী সুবিধা লাভের কোন অবকাশ নাই। শরীআত প্রণেতা এই কথা বলেন যে, স্বেচ্ছায় অপরের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ করিও না। কিন্তু যে বেশভূষা আপনা-আপনি প্রকাশ হইয়া পড়ে অথবা প্রকাশ হইতে বাধ্য, তাহার জন্য কেহ দায়ী হইবে না –ইহার অর্থ অতি সুস্পষ্ট। তোমার নিয়্যত যেন সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রকাশের না হয়। তোমার মধ্যে এই প্রেরণা, এই ইচ্ছা কিছুতেই হওয়া উচিত নহে যে, নিজের সাজ-সজ্জা অপরকে দেখাইবে কিংবা কিছু না হইলেও অন্তত অলংকারাদির লুপ্ত ঝংকার শুনাইয়া তোমার প্রতি অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে। তোমাকে তো আপন সৌন্দর্য-শোভা গোপন করিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে। ইহার পর যদি কোন কিছু অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে ইহার জন্য আল্লাহ তোমাকে দায়ী করিবেন না। তুমি যে বস্ত্র দ্বারা তোমার সৌন্দর্য ঢাকিয়া রাখিবে, তাহা তো প্রকাশ পাইবেই। তোমার দেহের গঠন ও উচ্চতা, শারীরিক সৌষ্ঠব ও আকার-আকৃতি তো উহাতে ধরা যাইবে। কাজ-কর্মের জন্য আবশ্যক মত তোমার হস্তদ্বয় ও মুখমণ্ডলের কিয়দাংশ তো উন্মুক্ত করিতে হইবে। এইরূপ হইলে কোন দোষ নাই। তোমার ইচ্ছা উহা প্রকাশ করা নহে; বরং তুমি তাহা করিতে বাধ্য। ইহাতে যদি কোন অসৎ ব্যক্তি আনন্দস্বাদ উপভোগ করে তো করুক। সে তাহার অসৎ অভিলাষেল শাস্তি ভোগ করিবে। তমদ্দুন ও নৈতিকতা যতখানি দায়িত্ব তোমার উপর অর্পণ করিয়াছিল, তাহা তুমি সাধ্যানুযায়ী পালন করিয়াছ।
উপরিউক্ত আয়াতের ইহাই প্রকৃত মর্ম। তাফসীরকারগণের মধ্যে এই আয়াতের মর্ম লইয়া যত প্রকার মতভেদ আছে, তাহা লইয়া চিন্তাগবেষণা করিলে জানিতে পারা যাইবে যে, যাবতীয় মতান্তর সত্ত্বেও তাঁহাদের উক্তির মর্ম উহাই দাঁড়াইবে, যাহা উপরে বর্ণিত হইল।
ইবনে মসউদ, ইব্রাহীম নখয়ী ও হাসান বসরীর মতে প্রকাশ্য সৌন্দর্যের অর্থ ঐ সকল বস্ত্র, যেইগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ঢাকিয়া রাখা যায়, যথাঃ বোরকা, চাদর ইত্যাদি।
ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, আতা, ইবনে ওমর, আনাস, জাহহাক, সাঈদ বিন জুবাইর, আওযায়ী ও হানাফী মতাবলম্বী ইমামগণের মতে ইহার অর্থ মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় এবং ইহাতে ব্যবহৃত সৌন্দর্য-উপাদানসমূহ –যথাঃ হাতের মেহেদী, আংটি, চোখের সুরমা প্রভৃতি।
সাঈদ বিন আল-মুসায়্যেরের মতে ব্যতিক্রম শুধু মুখমণ্ডল এবং অন্য এক বর্ণনামতে হাসান বসরীও এই মত সমর্থন করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রা) মুখমণ্ডল ঢাকিয়া রাখার পক্ষপাতী। তাঁহার মতে প্রকাশ্য সৌন্দর্যের অর্থ হস্তদ্বয়, হাতের চুড়ি, আংটি, কংকন ইত্যাদি।
মিসওয়ার বিন মাখরামা ও কাতাদাহ অলংকারাদিসহ হাত খুলিবার অনুমতি দেন এবং তাঁহার উক্তিতে মনে হয় যে, তিনি সমগ্র মুখমণ্ডলের পরিবর্তে শুধু চক্ষুদ্বয় খুলিয়া রাখা জায়েয রাখেন।–[ইবনে জারীর ও আহকামুল কুরআন।]
এই সকল মতভেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করিয়া দেখুন। এই সকল তফসীরকার (আরবী***********) হইতে ইহাই বুঝিয়ানে যে, আল্লাহ তাআলা এমন সৌন্দর্য প্রকাশের অনুমতি দেন, যাহা বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ হইয়া পড়ে অথবা যাহা প্রকাশ করা আবশ্যক হইয়া পড়ে। হস্তের প্রদর্শনী করা অথবা কাহারও দৃষ্টির বিষয়বস্তু করা ইহাদের কাহারও উদ্দেশ্য নহে।
প্রত্যেকে আপন আপন বোধশক্তি অনুযায়ী নারীদের প্রয়োজনকে সম্মুখে রাখিয়া ইহা বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, প্রয়োজন হইলে কোন অংগ বাধ্যতামূলকভাবে উন্মুক্ত করা যায় কিংবা স্বভাবতই উন্মুক্ত হয়। আমরা বলি যে, (আরবী**********) –কে উহার কোন একটিতেও সীমাবদ্ধ রাখিবেন না। যে মু’মিন নারী আল্লাহ ও রসূলের নির্দেশাবলীর অনুগত থাকিতে চায় এবং অনাচার-অমংগলে লিপ্ত হওয়া যাহার ইচ্ছা নহে, সে স্বয়ং নিজের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুারে সিদ্ধান্ত, করিতে পারে যে, মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় উন্মুক্ত করিবে,কি করিবে না। করিতে চাহিলে কোন সময়ে করিবে, কি পরিমাণে উন্মুক্ত করিবে এবং কি পরিমাণে আবৃত রাখিবে। এই ব্যাপারে শরীআত প্রণেতা কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন নাই। অবস্থার বিভিন্নতা এবং প্রয়োজন দেখিয়ে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ নির্ধারণ করিতে হইবে, ইহাও বাস্তব বিচার-বুদ্ধির চাহিদা নহে। যে নারী আপন প্রয়োজনে বাহিরে যাইতে এবং কাজকর্ম করিতে বাধ্য,তাহাকে কখনও হাত এবং কখনও মুখমণ্ডল খোলার প্রয়োজন হইবে। এইরূপ নারীর জন্য প্রয়োজন অনুসারে অনুমতি আছে। কিন্তু যে নারীর অবস্থা এইরূপ নহে, তাহার বিনা কারণে স্বেচ্ছায় হাত-মুখ অনাবৃত করা দুরস্ত নহে।
অতএব শরীআত প্রণেতার উদ্দেশ্য এই যে, যদি নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোন অংগ-অংশ অনাবৃত করা হয়, তাহা হইলে তাহাতে পাপ হইবে। অনিচ্চায় স্বতই কিছু প্রকাশিত হইয়া পড়িলে তাহাতে কোন পাপ হইবে না। প্রকৃত প্রয়োজন যদি অনাবৃত করিতে বাধ্য করে, তাহা হইলে তাহা জায়েয হইবে। এখন প্রশ্ন এই যে, অবস্থার বিভিন্নতা হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া শুধু মুখমণ্ডল সম্পর্কে কি নির্দেশ রহিয়াছে? শরীআত প্রণেতা উহাকে অনাবৃত রাখা পসন্দ করেন, না অপসন্দ করেন? শুধু প্রয়োজনের সময় উহাকে অনাবৃত করা যায় না, উহা অপরের দৃষ্টি হইতে লুকাইয়া রাখিবার বস্তুই নহে?
সুরায়ে আহযাবের আয়াতসমূহে এই প্রশ্নগুলির উপর আলোকপাত করা হইয়াছে।
মুখমণ্ডল সম্পর্কে নির্দেশ
উপরে সূরায়ে আহযাবের যে আয়াতসমূহের উল্লেখ করা হইল তাহা এইঃ
(আরবী*********************************************)
হে নবী! আপন বিবিগণ, কন্যাগণ ও মুসলমান নারীগণকে বলিয়া দিন, তাহারা যেন আপন চাদর দ্বারা নিজের ঘোমটা টানিয়া দেয়। এই ব্যবস্থার দ্বারা আশা করা যায় যে, তাহাদিগকে চিনিতে পারা যাইবে এবং অতপর তাহাদিগকে ত্যক্তবিরক্ত করা যাইবে না। -সূরা আহযাবঃ ৫৯
বিশেষ করিয়া মুখমণ্ডল আবৃত করিবার জন্য আয়াত নাযিল হইয়াছে (আরবী*********) শব্দের বহুবচন (আরবী*********) ইহার অর্থ চাদর। (আরবী*********) শব্দের অর্থ লটকান। (আরবী*****************) এর শাব্দিক অর্থ নিজের উপরে চাদরে খানিক অংশ যেন লটকাইয়া দেয়। ঘোমটা দেওয়ার অর্থও ইহাই। কিন্তু এই আয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধারণভাবে পরিচিত ‘ঘোমটা’ নহে, বরং ইহার উদ্দেশ্য মুখমণ্ডলকে আবৃকরণ। তাহা ঘোমটার দ্বারা হউক, পর্দা অথবা অন্য যে কোন উপায়ে হউক। ইহার উপকারিতা এই বর্ণনা করা হইয়াছে যে, যখন মুসলমান নারী এইভাবে আবৃত অবস্থায় গৃহের বাহির হইবে, তখন লোকে বুঝিতে পারবে যে, তাহারা সম্ভ্রান্ত মহিলা-নির্লজ্জ ও শ্লীলতাবর্জিত নহে। এই কারণে কেহ তাহার শ্লীলতার প্রতিবন্ধক হইবে না।
পবিত্র কুরআনের সকল তাফসীরকার এই আয়াতের এই মর্মই ব্যক্ত করিয়াছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) ইহার তফসীরে বলেনঃ
আল্লাহ তাআলা মুসলমান নারীদিগকে আদেশ করিয়াছেন যে, তাহারা যখন কোন প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে যাইবে, তখন যেন তাহারা মাথার উপর হইতে চাদরের অঞ্চল ঝুলাইয়া মুখমণ্ডল ঢাকিয়া দেয় –তাফসীরে ইবনে জারীর
ইমাম মুহাম্মদ বিন সিরীন হযরত ওবায়দা বিন-সুফিয়ান বিন আল হারিস আল-হাজরামীর নিকট জানিতে চাহিলেন, এই আদেশের কি প্রকারে আমল করা যায়। ইহার উত্তরে তিনি স্বয়ং উড়াইয়া দেখাইয়া দিলেন। কপাল, নাক ও একটি চক্ষু ঢাকিয়া ফেলিলেন এবং শুধু একটি চক্ষু খুলিয়া রাখিলেন। -তাফসীরে ইবনে জারীর
আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ
হে নবী! আপনার বিবিগণ, কন্যাগণ ও মুসলমান নারিগণকে বলিয়া দিন যে, যখন তাহারা কোন প্রয়োজনে আপন গৃহ হইতে বাহিরে গমন করে, তখন যেন তাহারা ক্রীতদাসীদের পোষাক পরিধান না করে, যাহাতে মাথা ও মুখমণ্ডল অনাবৃত থাকে, বরং তাহারা যেন নিজের উপরে চাদরের ঘোমটা টানিয়া দেয় যাহাতে ফাসিক লোকেরা তাহাদের শ্লীলতার অন্তরায় না হয় এবং জানিতে পারে ইহারা সম্ভ্রান্ত মহিলা। -তাফসীরে ইবনে জারীর
আল্লামা আবুবকর জাসসাস বলেনঃ
এই আয়াতের দ্বারা এই কথা প্রমাণিত হয় যে, যুবতী নারীকে পর-পুরুষ হইতে তাহার মুখমণ্ডল আবৃত রাখার আদেশ করা হইয়াছে এবং গৃহ হইতে বাহিরে যাইবার সময় পর্দা ও সম্ভ্রমশীলতা প্রদর্শন করা উচিত, যাহাতে অসৎ অভিপ্রায় পোষণকারী তাহার প্রতি প্রলুব্ধ হইতে না পারে। -আহকামুল কুরআন, তৃতীয় খণ্ড
আল্লামা নায়শাপুরী তাঁহার তাফসীর ‘গারায়েবুল কুরআন’-এ বলেনঃ
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মেয়েরা জাহিলিয়াতের যুগের ন্যায় কামিজ ও দোপাট্টা পরিধান করিয়া বাহিরে যাইত। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের পোশাকও নিম্নশ্রেণীর মেয়েদের হইতে পৃথক ছিল না। অতপর আদেশ হইল যে, তাহারা যেন চাদর উড়াইয়া তদ্বারা মুখমণ্ডল ঢাকিয়া ফেলে যাহাতে লোকে মনে করিতে পারে যে, তাহারা সম্ভ্রান্ত মহিলা, শ্লীলতাবাজিতা নহে।
ইমাম রাজী বলেনঃ
জাহিলিয়াতের যুগে সম্ভ্রান্ত মহিলাগণ ও ক্রীতদাসী, সকলেই বেপর্দা ঘুরিয়া বেড়াইত এবং অসৎ লোক তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিত। আল্লাহ তাআলা সম্ভ্রান্ত নারীদের প্রতি আদেশ করিলেন যেন তাহারা চাদর দ্বারা নিজদিগকে আবৃত করে। (আরবী********************) ইহার দুই প্রকার মর্ম হইতে পারে। প্রথমত, এই পোশাক হইতে চিনিতে পারা যাইবে যে, ইহার সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং তাহাদিগকে অনুসরণ করা হইবে না। দ্বিতীয়ত, ইহার দ্বারা বুঝিতে পারা যাইবে যে, ইহারা চরিত্রহীনা নহে। কারণ যে নারী তাহার মুখমণ্ডল আবৃত করিয়া রাখে [অথব মুখমণ্ডল ‘আওরাতের’-(শরীরের যে অংশ স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত অন্য সকলের নিকটে আবৃত রাখার নির্দেশ আছে তাহাকে কুরআনের পরিভাষায় ‘আওরাত’ বলে। পুরুষের নাভী হইতে হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশকেও এই অর্থে আওরাত বলা হয়।) মধ্যে গণ্য নহে যে তাহা আবৃত রাখা ফরয হইবে], তাহার নিকট কেহ এ আশা পোষণ করিতে পারে না যে, সে ‘আওরাত’ অনাবৃত করিতে রাজী হইবে। অতএব এই পোশাক ইহাই প্রমাণ করিবে যে, সে একজন পর্দানশীন নারী এবং তাহার দ্বারা কোন অসৎ কাজের আশা করা বৃথা হইবে। -তাফসীরে কবীর
কাযী বায়যাবী বলেনঃ
(আরবী******************************************)
ইহার অর্থ এই যে, যখন তারা আপন প্রয়োজনে বাহিরে যাইবে তখন চাদর দ্বারা শরীর ও মুখমণ্ডল ঢাকিয়া লইবে। এখানে (আরবী********) শব্দটি (আরবী*******) –এর জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে অর্থাৎ চাদরের উপর জড়াইতে হইবে। (আরবী*********************) ইহা দ্বারা সম্ভ্রান্ত নারী, ক্রীতদাসী এবং গায়িকাদের মধ্যে পার্থক্য করা হইয়াছে। (আরবী**********) অর্থাৎ সন্দেহভাজন লোক তাহাদের শ্লীলতাহানীর দুঃসাহস করিবে না। -তাফসীরে বায়যাবী
এই সকল উক্তি হইতে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) –এর পবিত্র যুগ হইতে আরম্ভ করিয়া অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত প্রতি যুগে উক্ত আয়াতের একই মর্ম করা হইয়াছে এবং সে মর্ম উহাই, যাহা আমরা উহার শব্দগুলি হইতে বুঝিতে পারিয়াছি। ইহার পর হাদীসগুলির প্রতি লক্ষ্য করিলে তাহা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর হইতে নবী করীম (স)-এর যুগে সাধারণভাবে মুসলমান নারিগণ মুখমণ্ডলের উপর আবরণ দেওয়া আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং উন্মুক্ত মুখমণ্ডল সহকারে চলাফেরার প্রচলন বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। আবু দাউদ, তিরমিযী, মুয়াত্তা ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থগুলিতে আছে যে, নবী (স) ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের মুখে আবরণ ও হাতে দস্তানা পরিধান করা নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, সেই পবিত্র যুগেই মুখমণ্ডল আবৃত করিবার জন্য আবরণ ও হস্তদ্বয় ঢাকিবার জন্য দস্তানা ব্যবহারের প্রচলন হইয়াছিল। শুধু ইহরামের অবস্থায় উহা ব্যবহার করিতে নিষেধ করা হইয়াছিল। কিন্তু হজ্জের সময় নারীর মুখমণ্ডল জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর করা ইহার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং ইহার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, ইহরামের দীনবেশে মুখের আবরণ যেন নারীদের পোশাকের কোন অংশবিশেষ না হইতে পারে, যাহা অন্য সময়ে সাধারণভাবে হইয়া থাকে। অন্যান্য হাদীসে বলা হইয়াছে যে, ইহাম অবস্থায়ও নবী-পত্মীগণ ও অন্যান্য সাধারণ মুসলমান মহিলা আবরণহীন মুখমণ্ডল অপরিচিত লোকের দৃষ্টিপথ হইতে লুকাইয়া রাখিতেন।
(আরবী************************************************)
হযরত আয়েমা (রা) বলেন, ‘যানবাহন আমাদের নিকট দিয়া যাইতেছিলেন এবং আমরা নবী (স) –এর সংগে ইহরাম অবস্থায় থাকিতাম। যখন লোক আমাদের সম্মুখে আসিত, তখন আমাদের চাদর মাথার উপর হইতে মুখের উপর টানিয়া দিতাম। তাহারা চলিয়া গেলে আবার মুখ খুলিয়া দিতাম’।
-আবু দাউদ
(আরবী***************************************************)
ফাতিমা বিনতে মানযার বলেন, ‘আমরা ইহরাম অবস্থায় কাপড় দিয়া মুখ ঢাকিয়া রাখিতাম। আমাদের সংগে হযরত আবু বকরের কন্যা হযরত আসমা (রা) ছিলেন। তিনি আমাদিগকে নিষেধ করেন নাই’। ইমাম মালিকঃ মুয়াত্তা
ফতহুল বারী,কিতাবুল হজ্জে হযরত আয়েশা (রাঃ –এর একটা বর্ণণা আছেঃ
(আরবী**********************************************_)
নারিগণ ইহরাম অবস্থায় নিজেদের চাদর যেন মস্তক হইতে মুখের উপর ঝুলাইয়া দেয়।
আবরণ
কুরআন পাকের শব্দগুলি ও জনসাধারণ্যে সেগুলির স্বীকৃতি, সর্বসম্মত তাফসীর ও নবী করীম (সা) –এর যুগে তাহার বাস্তবায়নের প্রতি যে ব্যক্তি লক্ষ্য করিবে, তাহার পক্ষে এই সত্যকে অস্বীকার করা সম্ভব হইবে না যে, ইসলামী শরীয়াতে অপরিচিতের সামনে নারীদের মুখমণ্ডল ঢাকিয়া রাখার নির্দেশ রহিয়াছে এবং নবী (সঃ) –এর যুগের এই আদেশ প্রতিপালিত হইতেছিল। ‘নিকাব’ বা আবরণ শব্দের দিক দিয়া না হইলেও অর্থ ও মর্মের দিক দিয়া পবিত্র কুরআনের প্রস্তাবিত বিষয়। যে পবিত্র সত্তার উপর কুরআন নাযিল হইয়াছিল, তাঁহার চোখের সামনে মুসলমান নারিগণ ইহাকে বহির্বাটিস্থ পোশাকের অংগ হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিল এবং সেকালেও ইহার নাম ছিল ‘নিকাব’ অর্থাৎ পর্দা বা আবরণ।
পরিতাপের বিষয়, ইহা সেই ‘নিকাব’ (veil), ইউরোপ যাহাকে অত্যন্ত অপসন্দনীয় ও ঘৃণিত বস্তু মনে করে। নিছক ইহার ধারণাও পাশ্চাত্য বিবেকের নিকটে অসহনীয়। তাহারা ইহাকে অত্যাচার, সংকীর্ণতা ও বর্বরতার পরিচায়ক মনে করে। ইহা এমন একটি বিষয় যে, যখন প্রাচ্যের জাতিগুলির অজ্ঞতা ও অনুন্নতির উল্লেখ করা হয়, তখন ইহারও নাম করা হয়। আবার যখন বলা হয় যে, কোন প্রাচ্য জাতি তাহযীব-তমদ্দুনে উন্নতি করিতেছে, তখন সর্বপ্রথম যে বিষয়টি বিশেষ ফলাও করিয়া বলা হয়, তাহা হইতেছে এই যে, এই জাতির মধ্য হইতে ‘নিকাব’ বিদায় গ্রহণ করিয়াছে। এখন লজ্জায় শির নত করুন যে, ইহা পরবর্তী যুগেদর আবিস্কৃত বস্তু নহে, বরং কুরআন পাকেরই ইহা আবিস্কৃত এবং নবী করীম (সঃ) ইহার প্রচলন করিয়াছিলেন। কিন্তু শুধু মস্তক অবনত করিলেই চলিবে না। উট পাখি শিকারীকে দেখিয়া বালুকার মধ্যে মস্তক লুকাইলে শিকারীর অস্তিত্ব লোপ পায় না। আপনিও তদ্রুপ মস্তক অবনত করিতে পারেন, কিন্তু ইহাতে কুরআনের আয়াত মিটিয়া যাইবে না এবং ইতিহাস প্রমাণিত ঘটনাগুলি বিলুপ্ত হইবে না। জটিল ব্যাখ্যার দ্বারা ইহার উপরে যবনিকাপাত করিলে এই ‘লজ্জার কালিমা’ অধিকতর পরিস্ফুট হইবে। পাশ্চাত্য ‘ঐশী বাণীর’ উপর ঈমান আনিয়া আপনি উহাকে ‘কলংক-কালিমা’ বলিয়াই যখন মানিয়া লইয়াছেন, তখন উহা দূর করিবার একটি মাত্র উপায়ই আছে। তাহা হইতেছে এই যে, যে ইসলাম ‘নিকাব’, অবগুণ্ঠন ও মুখাবরণের ন্যায় ‘ঘৃণিত বস্তুও’ আদেশ করে, সেই ইসলাম হইতে আপনার নিষ্কৃতি ঘোষণা করুন। আপনি ‘উন্নতি’ অভিলাষী, আপনার প্রয়োজন ‘সভ্যতা’। অতএব ঐ ধর্মটি কেমন করিয়া আপনার গ্রহণীয় হইতে পারে, যে নারিগণকে সভা-সমিতির আলোকবর্তিকা সাজিতে বাধা দান করে। লজ্জাশীলতা, পর্দা ও সম্ভ্রম-সতীত্বের শিক্ষা দান করে এবং গৃহবাসী ব্যতীত অন্যান্যদের চোখের আনন্দদায়িনী সাজিতে নিষেধ করে? এইরূপ ধর্মে ‘উন্নতি’ কোথায়? ‘সভ্যতা’র সংগে এইরূপ ধর্মের সম্পর্ক কি?? ‘উন্নতি’ ও ‘সভ্যতা’র জন্য তো প্রয়োজন এইযে, যে নারী-নারী নয় মেম সাহেবা-বাহিরে যাইবার পূর্বে দুই ঘন্টা পর্যন্ত সকল কাজকর্ম হইতে মুক্ত হইয়া শুধু সৌন্দর্যের পারিপাট্য ও সাজ-সজ্জায় লিপ্ত হইবে, সর্বশরীর সুগন্ধিতে ভরপুর করিবে, রং ও কাটিং এর দিক দিয়া অতীব চিত্তাকর্ষক বস্ত্রে ভূষিত হইবে, মুখাবয়ব ও বাহুদ্বয় রঞ্জিত করিবে, লিপস্টিকে ওষ্ঠদ্বয় রক্তোজ্জ্বল করিবে, ভ্রূ-ধনুকে সঠিক ও দৃষ্টিবান নিক্ষেপের জন্য চক্ষুদ্বয়কে সতেজ করিবে, এই সকল মনোহর ভংগিতে সজ্জিত হইয়া যখন সে গৃহ হএত বহির্গত হইবে, তখন অবস্থা এই হইবে যে, প্রতিটি ভংগিমা যেন হৃদ-মন আকর্ষন করিয়া বলিবে ‘প্রকৃত স্থান তো এইটি’। অতপর ইহাতেও আত্মালংকার প্রদর্শনীর বাসনা পরিতৃপ্ত না হয়, আয়না ও প্রসাধনের সরঞ্জাম সর্বদা সংগে থাকিবে,যাহাতে সাজ-সজ্জার কণামাত্র ত্রুটি হইলে অল্পক্ষণ পর পর তাহা সংশোধণ করা যাইতে পারে।
আমরা এ কথা পুন পুন বলিয়াছি যে, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার উদ্দেশ্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রহিয়াছে এবং যদি কেহ পাশ্চাত্যের দৃষ্টিকোণ হইতে ইসলামী নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যা করে, তাহা হইলে সে মারাত্মক ভুল করিবে। পাশ্চাত্যের বস্তুসমূহে মূল্য ও মর্যাদার যে মাপকাঠি আছে ইসলামের মাপকাঠি তাহা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। পাশ্চাত্য যে সকল বস্তুকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনের কাম্য মনে করে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাহার কোনই গুরুত্ব নাই। আবার ইসলাম যাহাকে গুরুত্ব দান করে, পাশ্চাত্যের নিকট তাহা মূল্যহীন। এখন যে ব্যক্তি পাশ্চাত্য মাপকাঠিতে বিশ্বাসী, তাহার নিকট তো ইসরামের প্রতিটি বস্তুই সংশোধনযোগ্য মনে হইবে। সে ইসলামী নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যা করিতে বসিলে তাহা পরিবর্তন করিয়াই ছাড়িবে এবং পরিবর্তনের পরেও তাহা নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করিতে পারিবে না। কারণ পদে পদে কোরআন-সুন্নাহের ব্যাখ্যা তাহার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে। এইরূপ লোকের আল্লাহর নির্দেশাবলী কার্যকরী করিবার খুঁটিনাটি পন্থার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার পূর্বে ভাবিয়া দেখা উচিত যে, কি উদ্দেশ্যে এই পন্থাগুলি অবলম্ন করা হইয়াছে বা কতখানি গ্রহণযোগ্য। যদি সে ঐ সকল উদ্দেশ্যের সহিতই একমত হইতে পারিল না, তাহা হইলে উদ্দেশ্য লাভের উপায়-পদ্ধতি সম্পর্কে বিতর্ক করা এবং উহাকে পরিবর্তন করার অহেতুক কষ্ট স্বীকার করিবে? যে ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সে ত্রুটিযুক্ত মনে করে, তাহাই সে পরিত্যাগ করে না কেন? কিন্তু যদি সে উহার উদ্দেশ্যাবলীর সহিত একমত হয়, তাহা হইলে বিতর্ক শুধু এই বিষয়ে রহিয়া যায় যে, এই সকল উদ্দেশ্য লাভ করিবার জন্য যে সকল কার্যকরী পন্থার প্রস্তাব করা হইয়াছে তাহা সংগত, না অসংগত। এই বিতর্কের সহজেই মীমাংসা হইতে পারে। কিন্তু শুধু সম্ভ্রান্ত লোকই এই পন্থা অবলম্বন করিতে পারেন। এখন রহিল মুনাফিকের দল। ইহারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিজীবের মধ্যে সব চাইতে নিকৃষ্ট। তাহাদের ইহাই শোভা পায় যে, তাহারা কোন কিছুর উপরে বিশ্বাস স্থাপনেরও দাবী করিবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস তাহাদের অন্য কিছুর উপরে।
‘নিকাব’ ও ‘বোরকা’ লইয়া যে পরিমাণে বিতর্ক চলিতেছে তাহা প্রকৃতপক্ষে ভন্ডামির ভিত্তিতেই হইতেছে। সর্বশক্তি দিয়া ইহাই প্রমাণিত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে যে, পর্দার এই ধরন ইসলামপূর্ব যুগের জাতিগের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং জাহিলিয়াতের এই উত্তরাধিকার নবীযুগের বহু পরে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন কর হইয়াছে। কুরআনের একটি সুস্পষ্ট আয়াত, নবী-যুগের প্রমাণিত কার্যধারা এবং সাহাবা-তাবেঈনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার বিপক্ষে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের জন্য এই মাথা ব্যথা কেন? শুধু এই করণে ঐ সকল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তাহাদের সম্মুখে ছিল এবং আছে, যাহা পাশ্চাত্যের জনসাধারণ্যে গৃহীত। ‘উন্নতি’ ও ‘সভ্যতা’র ঐ সকল ধারণা অন্তরে বদ্ধমূল হইয়ছে, যাহা পাশ্চাত্যবাসীর নিকট হইতে অনুকরণ করা হইয়াছে। যেহেতু বোরকা পরিধান করা ও মুখমণ্ডলে আবরণ দেওয়া ঐ সকল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী এবং ঐ সকল ধারণার সংগে সামঞ্জস্যশীল নহে, সেইজন্য ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের বলে ঐ সকল বিষয় মিটাইয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছে, যাহা ইসলাশী আইনশাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে। ইহা এক সুস্পষ্ট মুনাফিকী যাহা অন্যান্য সমস্যার ন্যায় এই সমস্যায়ও করা হইয়াছে। ইহার প্রকৃত কারণ সেই নীতিজ্ঞানহীনতা, বুদ্ধির স্বল্পতা ও নৈতিক সাহসের অভাব, যাহা উপরে বর্ণিত হইয়াছে। যদি ইহা না হইত, তাহা হইলে ইসলামের আনুগত্যের দাবী করা সত্ত্বেও কুরআনের ইতিহাস উপস্থাপিত করিবার চিন্তা মনে উদয় হইত না। হয় তাহার উদ্দেশ্যাবলী ইসলামের উদ্দেশ্যাবলীর সংগে এক করিয়া দিত [যদি সে মুসলমান হইয়া থাকিতে ইচ্ছা করিত] নতুবা প্রকাশ্যে এই ধর্ম হইতে পৃথক হইয়া যাইত, যাহাকে সে তাহার নিজস্ব উন্নতির মাপকাঠি অনুযায়ী উন্নতির প্রতিবন্ধক বলিয়া মনে করে।
যে ব্যক্তি ইসলামী আইনের উদ্দেশ্য হৃদয়ংগম করে এবং সে কিছু সাধারণ জ্ঞানও [Common Sense] রাখে, তাহার জন্য ইহা হৃদয়ংগম করা কঠিন নহে যে, নারীদিগকে উন্মুক্ত মুখমণ্ডলসহ বাহিরে চলাফেরার অনুমতি দান করা ঐ সকল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, ইসলাম যাহার প্রতি এতটা গুরুত্ব দান করে। কোন ব্যক্তিকে অপরের যে বস্তুটি সর্বাপেক্ষা অধিক আকৃষ্ট করে, তাহা হইতেছে তাহার মুখাবয়ব। মানবের সৃষ্টিগত সৌন্দর্য, অন্য কথায় মানবীয় সৌন্দর্যের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্যই তাহার মুখাবয়ব। ইহাই সর্বাপেক্ষা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইহাই আবেগ-অনুভূতিকে আলোড়িত করে। যৌন আবেগ ও উত্তেজনার সর্বশ্রেষ্ঠ এজেন্ট ইহাই। ইহা উপলব্ধি করিবার জন্য কোন গভীর মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানেরও প্রয়োজন নাই। আপনি নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করুন। আপন চক্ষুদ্বয়ের নিকটেই ফতোয়া তলব করুন। স্বীয় মানসিক পরীক্ষায় যাচাই-পর্যলোচনা করিয়া দেখুন। ভণ্ডামির কথা পৃথক। ভণ্ড-মুনাফিক যদি সূর্যের অস্তিত্ব স্বীকারকেও নিজরে স্বার্থের পরিপন্থী দেখে তাহা হইলে সে দিবালোকের সূর্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া বসিবে। যদি সত্যকে অবলম্বন করেন, তাহা হইলৈ স্বীকার করিতে হইবে যে, যৌন আবেগ-আবেদনের [Sex Appeal] বেলায় দেহের সমস্ত সৌন্দর্যের অধিকাংশই আল্লাহ তাআলা মুখমণ্ডলে দান করিয়াছেন। যদি কোন মেয়েকে আপনার বিবাহ করিতে হয়, আর যদি তাহাকে কি দেখিয়া সিদ্ধান্ত করিবেন? এক তো এই হইতে পারে যে, সে আপনার সম্মুখে মুখমন্ডল ব্যতীত তাহার সর্বাংগ ঢাকিয়া থাকিবে। দ্বিতীয়ত এই হইতে পারে যে, সে কোন বাতায়নের ফাঁকে তাহার মুখাবয়ব দেখাইয়া দিল। বলুন এখন এই উভয় প্রকারের মধ্যে কোনটিকে আপনি গ্রহণ করিবেন? সত্য করিয়া বলুন যে, সমগ্র দেহের তুলনায় মুখের সৌন্দর্য কি আপনার নিকট অধিক গুরুত্বর্পূণ নহে?
এই সত্যকে স্বীকার করিবার পর সম্মুখে অগ্রসর হউন। সমাজের যৌন উচ্ছৃংখলতা ও বিকেন্দ্রিক যৌন-উত্তেজনা বন্ধ করাই যদি কাম্য না হয় তাহা হইলে মুখমণ্ডল কেন, বক্ষ, বাহু, উরু ও পায়ের গোছা প্রভৃতি সকল কিছুই উন্মুক্ত রাখিবার স্বাধীনতা থাকা উচিত, যেমন পাশ্চাত্য সভ্যতায় আছে। এমতাবস্থায় ঐ সকল সীমারেখা ও বাধা-নিষেধের কোনই প্রয়োজন নাই, যাহা ইসলামী পর্দাপ্রথা সম্পর্কে উপরে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু যৌন-উত্তেজনার ঝটিকা রোধ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে ইহা অপেক্ষা সুষ্ঠু বিচার-বিরুদ্ধ অবৈজ্ঞানিক কথা আর কি হইতে পারে যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বারে শিকল লাগান হইবে, কিন্তু বৃহৎ দ্বারা একেবারে উন্মুক্ত রাখা হইবে।
এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে, অবস্থা যদি এই হয়, তাহা হইলে অপরিহার্য প্রয়োজনে ইসলাম মুখমণ্ডল খুলিবার অনুমতি কেন দিল? তাহার উত্তর এই যে, ইসলামী আইন ভারসাম্যহীন ও একদেশদর্শী নহে। উহা একদিকে যেমন নৈতিক পরিণামদর্শিতার দিকে লক্ষ্য রাখে, ঠিক অন্যদিকে আবার মানবের প্রকৃত প্রয়োজনকে সম্মুখে রাখিয়া বিচার করে এবং উভয়ের মধ্যে সে অতিমাত্রায় সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য বজায় রাখিয়াছে। সে নৈতিক অনাচারের পথ রুদ্ধ করিতে চায় এবং তৎসহ কোন মানুষের প্রতি এমন কোন বাধা-নিষেধও আরোপ করিতে চায় না, যদ্বারা আপন প্রকৃত প্রয়োজন মিটাইতে পারে না। ইহাই একমাত্র কারণ যে, সতর ঢাকিবার ও সৌন্দর্য প্রকাশের ব্যাপারে যেরূপ সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওা হইয়াছে মুখমণ্ডল ও হস্তের ব্যাপারে সেইরূপ দেওয়া হই নই। কারণ সতর ও সৌন্দর্য লুকাইয়া রাখিরে জীবনের প্রয়োজন পূরণ কোনই অসুবিধা হয় না। কিন্তু হস্তদ্বয় ও মুখমণ্ডল সর্বদা আবৃত রাখিলে নারীদের প্রয়োজন পূরণে বিরাট অসুবিধার সৃষি।ট হয়। অতএব নারীদের জন্য সাধারণভাবে এই ব্যবস্থা করা হইয়াছে যে, তাহারা মুখের উপর অবগুণ্ঠন ও আবরণ দিয়অ রাখিবে এবং (আরবী**********) –এর নীতি অনুযায়ী এই সুবিধা দান করা হইয়াছে যে, প্রকৃতই যদি মুখ খুলিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে তাহা খোলা যাইতে পারে। তবে শর্ত এই যে, সৌন্দর্য প্রদর্শন উদ্দেশ্য হইবে না বরং প্রয়োজন পূরণই হইবে প্রকৃত উদ্দেশ্য। অতপর অপরপক্ষ হইতে যে অনাচার-অমংগলের আশংকা ছিল, পুরুষকে দৃষ্টি সংযত করার নির্দেশ দিয়া তাহারও পথ রুদ্ধ করা হইয়াছে। যদি কোন সম্ভ্রমশীলা রমণী নিজের প্রয়োজনে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করে তাহা হইলে পুরুষ তাহার দৃষ্টি অবনমিত করিবে এবং উহার অন্যান্য ব্যবহার হইতে বিরত থাকিবে।
পর্দা পালনের এই নির্দেশাবলী সম্পর্কে চিন্তা করিলে জানা যায় যে, ইসলামী পর্দা কোন জাহিলী প্রথা নহে, বরং একটি জ্ঞান-বুদ্ধিসম্মত আইন।। জাহিলী প্রথা স্থবির, অপরিবর্তনশীল। যে প্রথা যেভাবে প্রচলিত রহিয়াছে, কোন অবস্থাতেই তাহার মধ্যে কোন পরিবর্তন করা যায় না। যাহা গোপন হইয়অছে, তাহা চিরদের জন্য গোপন রহিয়া যায়। মরিয়া গেলেও তাহা প্রকাশ করা সম্ভব নহে। পক্ষান্তরে বুদ্ধি-বিবেকসম্মত আইনে থাকে নমনীয়তা। অবস্থা অনুযায়ী ইহার মধ্যে কঠোরতা ও লাঘবের অবকাশ থাকে। অবস্থা অনুযায়ী ইহার নিয়ম-নীতির মধ্যে ব্যতিক্রমের পন্থাও রাখা হয়। এই দরনের আইন অন্ধের ন্যঅয় মানিয়া চলা যায় না। ইহার জন্য বোধশক্তি ও বিচার-বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। বিবেকসম্পন্ন আইন-মান্যকারী ব্যক্তি নিজেই সিদ্ধান্ত করিতে পারে, কোন সময় সাধারণ নিয়ম-নীতি পালন করা উচিত এবং কোন সময় আইনের দৃষ্টিকোণ হইতে প্রকৃত প্রয়োজন হয়, যাহার জন্য ব্যতিক্রমের সুযোগ গ্রহণ করা যাইতে পারে। অতপর সে নিজেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারে যে, কোন অবস্থায় অনুমতি দ্বারা কতখানি উপকার লাভ করিতে পারে এবং উপকার লাভকরিতে যাইয়া আইনের উদ্দেশ্যকে কিভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। এই সকল কাজে প্রকৃতপক্ষে একটা পবিত্র নিয়্যত বা বাসনাই মু’মিনের মনকে সত্যিখার মুফতী বানাইতে পারে। নবী (স) বলিয়াছেনঃ
(আরবী*************************************))
নিজের মনের নিকট ফতোয়া চাও এবং মনের মধ্যে যে বিষয় সম্পর্কে খটকা বা সন্দেহের উদ্রেক হয়, তাহা পরিত্যাগ কর।
এই কারণেই অজ্ঞতাসহকারে এবং না বুঝিয়ে ইসলামের আনুগত্য সম্ভব নহে। ইহা একটি বিবেক-বুদ্ধিসম্মত আইন এবং ইহা মানিয়া চলিতে হইলে পদে পদে অনুভূতি এবং বোধশক্তির প্রয়োজন হয়।