প্রাকৃতিক বিধান
প্রকৃতি অন্য সকল প্রাণীর ন্যায় মানুষকেও নর ও নারী- এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া সৃষ্টি করিয়াছে এবং ইহাদের উভয়ের প্রতি পারস্পরিক স্বাভাবিক আকর্ষণবোধ আছে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী সম্পর্কে গবেষণা করিয়া জানা যায় যে, তাহাদের নারীপুরুষে বিভক্ত হওয়া এবং তাহাদের মধ্যে স্বাভাবিক আকর্ষণবোধের উদ্দেশ্য নিছক তাহাদের জাতীয় স্থায়িত্ব বিধান। এই জন্যই তাহাদের মধ্যে আকর্ষণবোধ-অন্য কথায় যৌনবোধ শুধু সেই পরিমাণেই দেওয়া হইয়াছে, যে পরিমান অবশ্যক তাহাদের বংশ বৃদ্ধি – তথা জাতীয় স্থায়িত্ব বিধানের জন্য। তাহাদের স্বভাবের মধ্যে এমন এক নিয়ন্ত্রণ শক্তি আছে যে, তাহা যৌন সম্পর্কিত ব্যপারে নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করিতে দেয় না। পক্ষান্তরে মানবের মধ্যে যৌনবোধ সীমাহীন অপ্রতিহত এবং অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা মাত্রায় অত্তি অধিক। তাহার যৌনক্রিয়ায় সময়ের অথবা ঋতুর কোন বাধা নিষেধ নাই। তাহার স্বভাবের মধ্যে এমন কোন শক্তি নাই যে, তাহাকে কোন এক বিশেষ সীমারেখায় আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে। নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে এক চিরন্তন পারস্পরিক যৌনবোধ বিদ্যমান থাকে। তাহাদের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও যৌনবোধের অফুরন্ত উপাদান আছে। তাহাদের অন্তকরণে কাম ও প্রেমের এক বিরাট আকাঙ্ক্ষা আছে। তাহাদের শারীরিক গঠন, দেহসৌষ্ঠব, লাবন্য, স্পর্শ-ইন্দ্রিয় এবং প্রতি অংগপ্রত্যংগের মধ্যে বিপরিত্ত লিঙ্গের জন্য এক আকাঙ্ক্ষাবোধ সৃষ্টি করিয়াছে। তাহাদের স্বর, চলনভঙ্গী, অঙ্গসৌষ্ঠব, কমনীয় ভঙ্গী প্রভৃতির মধ্যেই আকর্ষণ শক্তি পূর্ণমাত্রায় আছে। এতদ্ব্যতীত তাহাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ প্রকৃতিরাজ্যকে এমন অগণিত উপাদানে পরিপূর্ণ রাখা হইয়াছে যে, তাহা তাহাদের যৌন-আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপ্ত করত একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত করিয়া দেয়। মলয় হিল্লোল, নদীর কলতান, স্থলোপরি মনোহর শ্যামলিমা, ফুলের সুরভি, পাখির কূজন, মেঘের ঘনঘটা, চাঁদনী রাতের সৌন্দর্য শোভা- মোটকথা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতিটি দৃশ্য এবং সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৌন্দর্য দিপ্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের যৌনবাসনা উদ্দীপ্ত করে।
অতপর মানবের শারীরিক শৃঙ্খলার যাচাই-পর্যালোচনা করিলে জানিতে পারা যায় যে, ইহার মধ্যে যে শক্তির বিরাট আকর আছে, তাহা জীবনী শক্তি, কর্মশক্তি ও যৌনশক্তির একত্র সমাবেশ। দেহের মধ্যে কতিপয় নিরণালী গ্রন্থি আছে, যাহা অঙ্গ-প্রতংগবিশেষকে জীবন রস [Hormone] সিঞ্চনে উত্তেজিত ও উদ্দীপিত করে।* উক্ত নিরণালী গ্রন্থিসমূহ মানবের মধ্যে কর্মক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি সৃষ্টি করে। উপরন্তু এই সকল গ্রন্থি তাহার মধ্যে যৌনবোধ জাগ্রত করে, যৌনক্ষমতা উদ্দীপ্ত করিবার আবেগানুভুতির স্ফুরণ আনয়ন করে। এই সকল আবেগ অনুভূতির স্ফুরণের জন্য সৌন্দর্য, লাবন্য, ঠাকঠমক, সাজসজ্জার বিবিধ সরঞ্জাম সংগ্রহ করিয়া দেয়। অতঃপর এই সমস্ত সাজ-সরঞ্জামের প্রতি আকৃষ্ট হইবার যোগ্যতা তাহার চক্ষু, কর্ণ, ঘ্রাণেন্দ্রিয়, স্পর্শেন্দ্রিয় ও কল্পনা শক্তির মধ্যেও সৃষ্টি করিয়া দেয়।
*মানব দেহের অভ্যন্তরে কতগুলি নিরণালী অন্তস্রাবী গ্রন্থি আছে। এই সকল নিরণালী গ্রন্থি হইতে যে রস নির্গত হয় তাহাকে Hormone বলে। হরমোন দেহের বিশেষ বিশেষ অংগ-প্রত্যংগকে উত্তেজিত ও উদ্দীপিত করে। নারী পুরুষের মধ্যে নিম্নরূপ নয়টি অন্তস্রাবী নিরণালী গ্রন্থি আছেঃ
Pineal, Pituitary, Thyroid & Parathyroid, Thymus, Pancreas, Adrenal, Ovary, Placenta.
নারীদেহে উপরের সবগুলিই আছে এবং পুরুষের মধ্যে কয়েকটি মাত্র আছে। -অনুবাদক
প্রকৃতির এবম্বিধ কার্যকুশলতা মানবের মানসিক শক্তিনিচয়ের মধ্যেও দেখা যায়। তাহার মনের মধ্যে যে সকল উদ্দীপক শক্তি আছে, তাহার দুইটি বিরাট আকাংক্ষা থাকে। প্রথম আকাঙ্ক্ষাটি স্বীয় অস্তিত্তের নিরাপত্তা বিধানে এবং আপন সেবায় উদ্বুদ্ধ করে। দ্বিতীয়টি তাহাকে বিপরিত লিঙ্গের সহিত সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করে। যৌবনে যখন মানুষের কর্মক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে, তখন এই দ্বিতীয় আকাঙ্ক্ষাটি এত প্রবল হয় যে, অনেক সময় সে প্রথম আকাংক্ষাকে দমিত করিয়া রাখে। ইহার প্রভাবে মানুশ এতখানি প্রভাবিত হইয়া পড়ে যে, স্বীয় জীবন বিসর্জন দিতে এবং স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে নিজেকে ধ্বংসের মুখে থেলিয়া দিতেও কোন দ্বিধাবোধ করে না।
তমদ্দুন গঠনে যৌন আকর্ষণের প্রভাব
এতসব কিসের জন্য? ইহা কি শুধু জাতীয় অস্তিত্বের স্থায়িত্ব বিধান- তথা বংশ বৃদ্ধির জন্য? কখনই নহে। কারণ, মানব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য তত পরিমান বংশ বৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না, যত পরিমাণ প্রয়োজন হয় মৎস্য, ছাগল ও অন্যান্য প্রাণীর। তাহা হইলে প্রকৃতি যে যাবতীয় প্রাণী অপেক্ষা মানুষের মধ্যে অধিকতর পরিমানে যৌনবোধ ও যৌন-আকর্ষণ সৃষ্টি করিয়াছে এবং ইহার জন্য উদ্দীপক উপাদানসমুহ সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে সৃষ্টি করিয়াছে তাহারই বা কারণ কি হইতে পারে? তবে এত সব কি নিছক মানবের ভোগ বিলাসের জন্য? তাহাও নহে। প্রক্রিতিকন ক্ষেত্রেই ভোগবিলাসকে একমাত্র জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে উপস্থাপিত করে নাই। সে কোন এক মহান উদ্দেশ্য সাধনকল্পে মানুষ ও অন্যান্য জীবকে কার্যে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য ভোগ বিলাস তথা যৌনসম্ভোগকে একটা রসাস্বাদস্বরূপ উপস্থাপিত করিয়াছে, যেন তাহার উক্ত কার্যকে নিজের মনে করিয়াই করিতে পারে। এখন চিন্তা করিয়া দেখুন যে, এই ব্যাপারে প্রকৃতির সম্মুখে কোন মহান উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই বিষয়ে যতই চিন্তা-গবেষণা করা যাউক না কেন, ইহা ব্যতীত অন্য কোন কারণ নির্ণয় করিতা পারা যায় না যে, প্রকৃতি অন্যান্য প্রাণীকে বাদ দিয়া শুধু মানুষ জাতিকে লইয়া একটা তমদ্দুন রচনা করিতে চায়।
এইজন্য মানুষের মনে কাম ও প্রেমের এমন এক বাসনা সৃষ্টি করিয়া দেয়া হইয়াছে যে, তাহা নিছক দৈহিক মিলন ও বংশ বৃদ্ধির দাবিই করে না, বরং এক চিরন্তন সংগ লাভ, আন্তরিক সংযোগ ও আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের দাবি জানায়।
এইজন্য মানুষের মধ্যে সংগম ক্ষমতা অপেক্ষা যৌনবোধ অধিক পরিমাণে দেওয়া হইয়াছে। তাহার মধ্যে যৌনস্পৃহা ও যৌন আকর্ষণ যে পরিমাণে রহিয়াছে, তাহার এক দশমাংশও সন্তানোৎপাদনের কার্যে ব্যবহৃত হয়, তাহা হইলে তাহার স্বাস্থ্য বিনষ্ট হইয়া যাইবে। স্বাভাবিক বয়স লাভ করিবার পূর্বেই তাহার দৈহিক শক্তি নিঃশেষিত হইয়া যাইবে। মানুষের মধ্যে যৌন আকর্ষণের যে আধিক্য রহিয়াছে, তাহার উদ্দেশ্য ইহা নহে যে, মানুষ যাবতীয় পশুপক্ষী অপেক্ষা অধিকতর যৌনক্রিয়া সম্পাদন করিবে, বরং নারী ও পুরুষ একত্রে সংযোগ করা এবং তাহাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থায়ী ও সুদৃঢ় করাই ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য।
এই কারণেই নারী-স্বভাবের মধ্যে আকর্ষণ ও বাসনার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা-সম্ভ্রম, যৌনক্রিয়ায় কৃত্রিম অনিচ্ছা, একটা পলায়নের মনোভাব এবং বাধাদানের স্বাভাবিক বৃত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। ইহা কম বেশী প্রত্যেক নারীর মধ্যেই আছে। এই পলায়নের মনোভাব ও কৃত্রিম অনিচ্ছা পশু স্ত্রীজাতিতেও দেকা যায়। কিন্তু মানব নারীর মধ্যে ইহার শক্তি ও পরিমাণ বেশী মাত্রায় আছে। ইহাকে লজ্জা-সম্ভ্রমের ভাবাবেগ দ্বারা অধিকতর কঠোর করা হইয়াছে। ইহার দ্বারা জানিতে পারা যায় যে, মানুষের মধ্যে যৌন চুম্বকের উদ্দেশ্য একটা চিরন্তন মিলন ব্যতীত কিছুই নহে। ইহা নহে যে, প্রতিটি যৌন বাসনা শুধু যৌনক্রিয়াতেই পর্যবসিত হইবে।
এই কারনে মানব সন্তানকে যাবতীয় পশু সন্তান অপেক্ষা অধিকতর দুর্বল ও অসহায় করিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে। পশুদের তুলনায় মানব-সন্তান কয়েক বৎসর যাবত পিতামাতা কর্তৃক নিরাপত্তা ও প্রতিপালনের মুখাপেক্ষী হয়। নিজের পায়ে দাঁড়াইবার ও স্বাবলম্বি হওয়ার যোগ্যতা সে বহু বিলম্বে লাভ করে। ইহারও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এই যে, নারী পুরুষের সম্পর্ক নিছক যৌনসম্পরকে সীমাবদ্ধ নহে বরং এই সম্পর্কের পরিণামস্বরূপ তাহাদিগকে সংযোগ সহযোগিতায় বাধ্য করা।
মানুষের অন্তকরণে সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতা অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা অধিক পরিমাণে ঢালিয়া দেয়া হইয়াছে। পশু-পক্ষী অতি অল্পকাল পর্যন্ত স্বীয় শাবকদের প্রতিপালন করত তাহাদিগকে পরিত্যাগ করে। অতপর তাহাদের মধ্যে আর কোন সম্পর্কই বাকী থাকে না। এমনকি তাহারা একে অপরকে চিনিতেও পারে না। পক্ষান্তরে মানুষ স্বীয় সন্তানাদির প্রাথমিক প্রতিপালনকাল অতীত হইবার পরও তাহাদের স্নেহ-মমতায় আকৃষ্ট থাকে। এই স্নেহবাৎসল্য পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে চলিতে থাকে। মানুষের স্বার্থপর পশুস্বভাব এই স্নেহ-বাৎসল্য ও প্রেম-ভালবাসায় এতই প্রভাবিত হইয়া পড়ে যে, সে নিজের জন্য যাহা কামনা করে, তদাপেক্ষা অধিক কামনা সে সন্তানাদির জন্য করিয়া থাকে। তাহার অন্তরে এইরূপ উচ্চাশার উদ্রেক হয় যে, সে সন্তানাদির জন্য যথাসম্ভব সচ্ছলতর জীবন যাপনের ব্যবস্থা করিয়া থাকে। তাহার নিজের শ্রম-মেহনতের ফল তাহাদের জন্য রাখিয়া যাইবে। এই প্রবল প্রেমানুরাগ সৃষ্টির দ্বারা নর-নারীর যৌনসম্পর্ককে একটা চিরন্তন মিলনে রূপান্তরিত করাই প্রকৃতির উদ্দেশ্য হইতে পারে। এই চিরন্তন মিলন-সংযোগকে পরিবার গঠনের সহায়ক করা হয়। অতপর জাতিসুলভ প্রেমপরম্পরা অন্য বহু পরিবারকে বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ করে। ফলে প্রেম ও প্রেমাস্পদের সমন্বয়ে তাহাদের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা ও আদানপ্রদানের সংগঠন স্থাপিত হয়। এইভাবে একটা সামাজিক ও তামাদ্দুনিক সম্পর্ক অস্তিত্ব লাভ করে।
তমদ্দুনের মৌলিক সমস্যা
এতদ্বারা জানিতে পারা গেল যে, মানব দেহের অনু-পরমাণু ও অন্তরাত্মার মধ্যে যে যৌনবাসনা ঢালিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং যাহার যথার্থ সাহায্যার্থে সৃষ্টিরাজ্যের স্তরে স্তরে উপাদানসমুহ উদ্দীপক বস্তুনিচয় ব্যাপকভাবে সংগৃহীত করা হইয়াছে, মানবকে ব্যষ্টি হইতে সমষ্টির দিকে আকৃষ্ট করাই তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য। প্রকৃতি মানব সভ্যতার প্রকৃত উদ্দীপক শক্তি হিসেবেই এই বাসনা করিয়াছে। এই যৌনবাসনা ও আকর্ষণের ফলে মানব জাতির উভয় লিংগের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি হয় এবং এই সংযোগ-সম্পর্ক সামাজিক জীবনের সূত্রপাত করে।
যাচাই-পর্যালোচনার পর ইহা স্বতই স্পষ্ট প্রতীয়মান হইল যে, নর-নারীর সম্পর্কের যে সমস্যা, তাহা প্রকৃতপক্ষে তমদ্দুনেরই মৌলিক সমস্যা। ইহারই সমাধানের উপরে তমদ্দুনের কল্যাণ ও অনাচার, উন্নতি ও অবনতি, দৃঢ়তা ও দুর্বলতা নির্ভর করে। মানস জাতির এই ইভই অংশের মধ্যে একটা পাশবিক সম্পর্ক আছে, যাহাকে অন্য কথায় নিছক যৌন ও সরাসরি সকাম বলা হয়। জাতির অস্তিত্ব সংরক্ষণ বা বংশবৃদ্ধি ব্যতীত ইহার অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই। দ্বিতীয় সম্পর্কটি মানবীয়। উভয়ের সম্মিলিত শক্তিতে এক অভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আপন আপন সাধ্যানুযায়ী ও স্বাভাবিক যোগ্যতানুসারে একে অপরের সাহায্য সহযোগিতা করাই ইহার উদ্দেশ্য। এই সাহায্যের জন্য তাহাদের যৌনপ্রেম সংযোগ –সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে কার্য করে। এই সকল পাশবিক ও মানবিক উপাদান একত্রে একই সময়ে তাহার দ্বারা তামাদ্দুনিক কার্যকলাপ চালাইয়া লয় এবং এই সকল কার্যকলাপ অব্যাহত রাখিবার জন্য অতিরিক্ত ব্যক্তিবর্গ সংগ্রহ করিয়া লয়। উভয়বিধ উপাদানগুলির সংমিশ্রণে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য রক্ষিত হওয়া না হওয়ার উপরেই তামাদ্দুনিক কল্যাণ ও অকল্যাণ নির্ভর করে।
পুত পবিত্র তমদ্দুন গঠনে অপরিহার্য বিষয়সমুহ
এখন এই সমস্যাটির যাচাই পর্যালোচনা করিয়া আমাদের অবগত হওয়া দরকার যে একটি পূণ্যপূত তমদ্দুনের জন্য নারীপুরুষের পাশবিক ও মানবিক সম্পর্কের সুনামঞ্জস্য ও প্রকৃতিগত সংমিশ্রণ কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে? উপরন্তু ইহাও অবগত হওয়া দরকার যে, এই সংমিশ্রণে সামঞ্জস্য বিধানের কোন কোন ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য তমদ্দুন তমদ্দুন বিশৃঙ্খল হইয়া পড়ে।
১. যৌনবাসনায় মিতাচার
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাগ্রগণ্য প্রশ্ন এই যে, এই যৌন বাসনা ও আকর্ষণ কিভাবে সংযত রাখা যায়। উপরে বর্ণিত হইয়াছে যে, মানবের মধ্যে এই বাসনা অন্যান্য জীবজন্তু হইতে অধিক পরিমাণে রহিয়াছে। শুধু যে মানবদেহের অভ্যন্তরেই যৌন উদ্দীপক শক্তি প্রবল রহিয়াছে, তাহা নহে, বরং বিশাল বহির্জগতেরও চতুর্দিকে অফুরন্ত যৌন উত্তেজক উপাদানসমুহ ছড়াইয়া আছে। স্বয়ং প্রকৃতি সে সকল উপাদান এত অধিক পরিমাণে সংগৃহীত রাখিয়াছে, উহাকে যদি মানুষ মনোযোগ সহকারে তার উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারা বর্ধিত ও উন্নত করিবার উপায় অবলম্বন করে এবং এমন এক তমদ্দুন গ্রহণ করে, যাহাতে তাহার যৌন তৃষ্ণা উত্তরোত্তর বর্ধিত হইতে থাকে ও তৎপর সেই তৃষ্ণা মিটাইবার সহজ পন্থা নির্ণয় করিতে থাকে, তাহা হইলে এমতাবস্থায় উহা অবশ্যম্ভাবীরূপে বাঞ্চিত সীমারেখা অতিক্রম করিয়া যাইবে। মানবের পাশবিক উপাদান মানবিক উপাদানের উপর জয়ী হইবে এবং এই পাশবিক দানব তাহার মানবতা ও তমদ্দুন উভইকেই ভক্ষন করিয়া ফেলিবে।
যৌন সম্পর্ক তাহার সূচনা ও উত্তেজক বিষয়সমুহের প্রতিটিকেই প্রকৃতি মধুর করিয়া সৃষ্টি করিয়াছে। কিন্তু পূর্বেই ইংগিত করা হইয়াছে যে, প্রকৃতি এবম্প্রকার মধুরতর আস্বাদনকে নিছক স্বীয় উদ্দেশ্য অর্থাৎ তমদ্দুন গঠনের জন্যই ব্যবহার করিয়াছে। এই আস্বাদ সীমাতিরিক্তহইলে এবং মানুষ তাহার প্রতি বিভোর হইয়া পড়িলে তাহা শুধু তমদ্দুনই ধ্বংস করিবে না, বরং তাহা মানুষেরও ধবংসের কারণ হইতে পারে, হইতেছে এবং অতীতেও বহুবার হইয়াছে।
যে সকল জাতি ধ্বংস হইয়াছে, তাহাদের নির্দেশাবলী ও ইতিহাস আলচনা করিয়া দেখুন। যৌন উন্মাদনা তাহাদের মধ্যে সীমা অতিক্রম করিয়াছিল। তাহাদের সাহিত্য এই ধরনের উত্তেজনামূলক প্রবন্ধাতিতে পরিপূর্ণ ছিল। তাহাদের ভাবধারা, গল্পকাহিনী, কবিতাবলী, চিত্রাদি, প্রতিমূর্তি, উপাসনালয়, গৃহাদি প্রভৃতি সকল কিছুই ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যে সকল জাতি বর্তমানে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হইতেছে, তাহাদের অবস্থাও অবলোকন করুন। তাহারা তাহাদের যৌন উন্মাদনাকে শিল্প, রস-সাহিত্য, সৌন্দর্যস্বাদ প্রভৃতি যে কোন সুন্দর ও নির্দোষ নামে অভিহিত করুক না কেন, ব্যাখ্যার হের ফের দ্বারা প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। ইহার অর্থ কি এই নয় যে, সমাজে নারী, নারী অপেক্ষা পুরুষের সংগ লাভ এবং পুরুষ অপেক্ষা নারীর সংগ লাভের জন্য উদগ্রীব? নারী-পুরুষের মধ্যে সৌন্দর্য চর্চা ও সাজসজ্জার স্পৃহা বারিয়া চলিয়াছে কেন? ইহার কি কারণ হইতে পারে যে, নারী পুরুষের মিশ্র সমাজে নারীর দেহ বস্ত্রহীন হইয়া পরিয়াছে? ইহা কোন বস্তু, যাহার জন্য নারী তাহার দেহের প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ উন্মুক্ত করিয়া জনসম্মুখে তুলিয়া ধরিতেছে এবং পুরুষ পক্ষ হইতে ‘আরও চাই, আরও চাই’ দাবি উত্থিত হইতেছে? ইহার কি তাৎপর্য যে, নগ্নচিত্র, নগ্ন প্রতিমূর্তি, নগ্ন নৃত্য সর্বাপেক্ষা অধিক সমাদৃত হইতেছে? ইহারই কি কারণ যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সিনেমায় প্রেম-প্রণয়ের রসাস্বাদ পাওয়া না যায় এবং তাহার মধ্যে বচন ও ক্রিয়ার যৌন-সম্পর্কের সুত্রপাত না হয়, ততক্ষণ তাহাতে কোন আনন্দই পাওয়া যায় না? এই সকল এবং অনুরূপ আরও বহুবিধ দৃশ্যাবলী যৌন উন্মাদনার জন্য নহে তো কিসের জন্য? যে তমদ্দুনে এইরূপ অসমঞ্জস যৌন উত্তেজক পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাহার পরিণাম ফল ধ্বংস ব্যতীত আর কি হইতে পারে?
এইরূপ পরিবেশে যৌন বাসনার প্রাবল্য, উপর্যুপরি উত্তেজনা ও প্রতিনিয়ত যৌনক্রিয়ার ফলে অবশ্যম্ভাবী রূপে বংশধরগণ দুর্বল হইয়া পড়ে এবং তাহাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির বৈকল্য ঘটে, চিন্তাশক্তি বিক্ষিপ্ত ও বিস্রস্ত হইয়া পড়ে, অশ্লীলতা বাড়িয়া চলে, যৌনব্যাধির বিস্তার লাভ ঘটে, গর্ভনিরোধ, গর্ভপাত, ভ্রূণ ও প্রসূত হত্যার আন্দোলন শুরু হয়।*
নারী-পুরুষ পশুর ন্যায় যৌনসংমিলনে লিপ্ত হইতে থাকে। প্রকৃতি তাহাদিগকে অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা যে অধিকতর যৌনবাসনা দান করিয়াছে, তাহারা তাহাকে প্রকৃতির অভীপ্সিত উদ্দেশ্যের পরিপন্থী কার্যে ব্যবহার করে এবং তাহাদের পশুত্ব যাবতীয় জীবজন্তুকে অতিক্রম করিয়া যায়। এমনকি বানর ও নরছাগ তাহাদের নিকত হার মানে। এই ধরনের প্রবল পশু প্রবৃত্তি মানবীয় তাহযীব-তমদ্দুন, এমনকি গোটা মানবকে ধবংস করিয়া দিবে সন্দেহ নাই। যাহারা ইহাতে নিমগ্ন হইয়া পড়িবে, তাহাদের নৈতিক অধপতন তাহাদিগকে এতখানি নিম্নগামী করিয়া দিবে যে, উহা হইতে আর উত্থানের কোন আশাই থাকিবে না।
১.জনৈক ডাক্তার বলেন, “সাবালকত্বের প্রারম্ভকাল বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে। মন ও দেহের ক্রিয়াকলাপে সেই সময়ে এক বিপ্লবী অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং সকল দিক দিয়া তাহা বিকশিত ও পরিস্ফুটিত হয়। সেই সময়ে এই সকল পরিবর্তন সহ্য করিবার জন্য এবং সে সকল বিকাশ ও পরিস্ফুটন লাভ করিতে সর্বশক্তির প্রয়োজন হয়। এইজন্য তখন মানুষের মধ্যে রোগের প্রতিরোধ শক্তি অতি অল্প থাকে। সাধারণ দৈহিক বিকাশ ও পরিস্ফুটন, অংগ-প্রত্যঙ্গের উন্নতি ও বর্ধন এবং মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনসমুহের জন্য যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, যাহার পর মানুষ শৈশব হইতে যৌবনে পদার্পণ করে, তাহা মানবদেহে ক্লান্তি আনয়ন করে। কারণ এই সময়ে মানবদেহ চরম চেষ্টা চরিত্রে নিমগ্ন থাকে। এই অবস্থায় তাহার উপর অস্বাভাবিক বোঝা চাপান সংগত হইবে না, বিশেষ করিয়া যৌনক্রিয়া এবং যৌন উত্তেজনা তাহার জন্য মারাত্মক হইবে।”
অপর একজন বিখ্যাত জার্মান মনস্তত্ত্বত্বিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ বলেন, “যৌন অংগসমুহ একটা চরম সুখ-তৃপ্তি ও আবেগ উত্তেজনার অসাধারণ অনুভূতির সঞ্চার করে বলিয়া ইহারা আমাদের মানসিক শক্তিরও একটা বিরাট অংশের ক্ষতি সাধনে সর্বদা প্রস্তুত হয়। তাহারা প্রাধান্য লাভ করিতে পারিলে মানুষকে তামাদ্দুনিক সেবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত সুখ-সম্ভোগে বিভোর করিয়া রাখিবে। সামান্য অসাবধানতার জন্য মানুষের যৌনজীবনকে ভারসাম্যহীন করত মংগলদায়ক করার পরিবর্তে ক্ষতিকারক করিয়া দিবে। এই বিপদের প্রতিরোধ করাই শিক্ষার মহান উদ্দেশ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
অনুরুপভাবে যে তমদ্দুনে স্বাভাবিক প্রয়োজনের পরিবর্তে চরম ন্যূনতা অবলম্বন করা হইবে, সেখানেও একই পরিণতি ঘটিবে। যৌনবাসনা চরিতার্থ করিতে গিয়া সীমা অতিক্রম করা যেমন ক্ষতিকর, তদ্রুপ উহাকে অতিমাত্রায় দমিত করাও ক্ষতিকর। যে তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা মানুষকে ব্রক্ষচারী ও সংসারত্যাগী বানাইতে চায়, তাহা প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। কিন্তু প্রকৃতি কখনও তাহার প্রতিপক্ষের দ্বারা পরাজিত হয় না, বরং তাহাকে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দেয়। ইহা অতি সত্য যে, প্রকৃত সন্ন্যাস ধর্মের ভিত্তিতে কোন তমদ্দুন গঠিত হইতে পারে না। কারণ প্রকৃতপক্ষে ইহা তাহযীব-তামাদ্দুন গঠনের পরিপন্থী। অবশ্য সন্ন্যাস মতবাদকে মনের মধ্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত করিয়া তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় এমন এক নিস্কাম পরিবেশ অবশ্যই সৃষ্টি করা যাইতে পারে যেখানে যৌন সম্পর্ককে একটি গর্হিত, ঘৃণা ও কুরুচিকর বস্তু মনে করা হইবে। ইহা হইতে নিবৃত্ত হওয়াই চারিত্রিক মান মনে করা হইবে। কিন্তু যৌন বাসনা দমিত করার অর্থ মানবতাকে দমিত করা। উহা একাকী দমিত হইবে না, বরং মানবের প্রতিভা, কর্মশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, উদ্যম ও সাহস,ল সংকল্প ও বিরত্ব সকল কিছু সংগে করিয়াই দমিত হইবে। উহা দমিত হওয়ার ফলে মানবের সমগ্র শক্তি অবশ হইয়া পড়িবে। তাহার রক্তকণা শীতল ও জমাট হইয়া যাইবে, যাহা উদ্দীপিত করিবার কোন ক্ষমতাই তাহার মধ্যে থাকিবে না। কারণ এই যৌনশক্তিই মানুষের শ্রেষ্ঠতম উদ্দীপিত শক্তি।
অতএব যৌনবাসনাকে সীমাতিক্রম ও চরম ন্যুনতা হইতে রক্ষা করিয়া এক মধ্যবর্তী সুসামঞ্জস্য অবস্থার মধ্যে আনয়ন করা এবং তাহাকে উপযোগী নিয়ম-নীতির দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত করাই একটি সৎ সাধু তমদ্দুনের প্রাথমিক কর্তব্য হইবে। সামাজিক জীবন যাপনের ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যে, একদিকে মানুষ তাহার বাসনা ও সম্ভোগ-পরায়ণতার দ্বারা যে সকল অস্বাভাবিক উত্তেজনা-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তাহার সকলই বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। অপর দিকে স্বাভাবিক উত্তেজনা প্রশমিত ও পরিতৃপ্ত করিবার জন্য প্রকৃতির অভীপ্সিত সকল পন্থা উন্মুক্ত রাখিতে হইবে।
২. পারিবারিক ভিত্তি স্থাপন
এখন স্বতই এই প্রশ্ন মনের কোণে উদিত হয় যে, প্রকৃতির ইচ্ছা কি? এই ব্যাপারে কি আমাদিগকে অন্ধকারে নিমজ্জিত্রাখা হইয়াছে যে, চক্ষু বন্ধ করত ইচ্ছামত কার্য করিব এবং তাহাকেই প্রকৃতির বাসনা বলিয়া উল্লেখ করিব? বরং প্রকৃতির নিদর্শনাবলী সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করিলে আমরা কি তাহার অভিপ্রায় জানিতে পারিব না? সম্ভবত অনেকেই প্রথমোক্ত মতই পোষণ করে। এইজন্যই প্রকৃতির নিদর্শনাবলীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করিয়াই যখন উহা ঘটিয়া যায়, তাহাকে ইচ্ছামত প্রকৃতির অভিপ্রায় বলিয়া উক্তি করিয়া থাকে। কিন্তু একজন তথ্যানুসন্ধিতসু যখন তথ্যের সন্ধ্যানে বাহির হয়, তখন কয়েক পদ অগ্রসর পরই তাহার মনে হয় যেন প্রকৃতি তাহার অভিপ্রায়ের দিকে স্পষ্ট অঙ্গুলী নির্দেশ করিতেছে।
ইহা জানা কথা যে, অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় মানুষকে স্ত্রী-পুরুষ রূপে সৃষ্টি করত উভয়ের মধ্যে যৌন আকর্ষণ ঢালিয়া দেওয়ার পশ্চাতে প্রকৃতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হইতেছে বংশ বৃদ্ধি করা। কিন্তু মানুষের নিকট প্রকৃতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হইতেছে বংশ বৃদ্ধি করা। কিন্তু মানুষের নিকট প্রকৃতির শুধু ইহাই একমাত্র দাবি নহে; বরং প্রকৃতি মানুষের নিকটে ইহা ব্যতীত আরও কিছু প্রত্যাশা করে। সামান্য চিন্তা-গবেষণা করিলে আমরা জানিতে পারি যে, সে দাবি কি এবং তাহা কোন ধরনের।
সর্বপ্রথম যাহা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহা এই যে, যাবতীয় জীবজন্তু ব্যতীত একমাত্র মানব সন্তানই রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিপালনের জন্য অধিক সময়, শ্রম ও মনোযোগ দাবি করে। যদি তাহাকে একটি স্বতন্ত্র প্রাণী হিসাবেই ধরা যায়, তবুও আমরা দেখিতে পাই যে, নিজের জৈবিক চাহিদা মিটাইবার জন্য অর্থাৎ আহারের সংস্থান ও আত্মরক্ষা করিবার যোগ্যতা অর্জন করিতে কয়েক বৎসর অতীত হইয়া যায়। প্রথম দুই-তিন বৎসর তো সে এত অসহায় থাকে যে, মাতার প্রতিনিয়ত লালন-পালন ব্যতীত সে বাঁচিয়াই থাকিতে পারে না।
প্রকাশ থাকে যে, মানুষ বর্বরতার যে কোন প্রাথমিক পর্যায়ে থাকুক না কেন, সে নিছক পশু নহে। কোন না কোন স্তরের সভ্যতা তাহার জীবনের জন্য অনিবার্য হইয়া পড়ে। অতপর এই সভ্যতার কারণে সন্তানাদির প্রতিপালনের স্বাভাবিক দাবির সংগে আরও দুটি দাবি সংযোজিত হয়। প্রথমত, যতটুকু তামাদ্দুনিক উপায়-উপাদান প্রতিপালনকারী লাভ করিতে পারে তাহার সমুদয়ই সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে নিয়োজিত করিবে। দ্বিতীয়ত, সন্তানকে এমনভাবে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে যেন, যে তামাদ্দুনিক পরিবেশে সে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তথাকার কার্য পরিচালনা করিবার এবং পূর্ববর্তীগণের স্থলাভিষিক্ত হইবার জন্য সে প্রস্তুত হইতে পারে। অতপর তমদ্দুন যতই উন্নতি লাভ করিতে থাকিবে, এই উভয় দাবি ততই গুরুতর বোঝাস্বরূপ হইতে থাকিবে। এক দিকে সন্তান প্রতিপালনের আবশ্যকীয় উপায়-উপাদান ও অনিবার্য দ্রব্যাদির চাহিদা বাড়িতে থাকিবে, অপরদিকে তমদ্দুন শুধু যে তাহার অস্তিত্বের জন্য স্বীয় মর্যাদা অনুযায়ী শিক্ষিত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত উপযুক্ত কর্মী দাবি করে তাহাই নহে, বরং তাহার বিকাশ ও ক্রমোন্নতির জন্য ইহাও কামনা করে যে, বর্তমান বংশধর হইতে যেন ভবিষ্যৎ বংশধর উৎকৃষ্টত হইতে পারে অর্থাৎ অন্য কথায় প্রত্যেক শিশুর প্রতিপালক শিশুকে আপন হইতে উৎকৃষ্টতর করিয়া গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করে। ইহা এক চরম ত্যাগ, যাহা মানুষকে তাহার আত্মস্বার্থ বলিদান করিতে উদ্বুদ্ধ করে।
এইসব হইতেছে মানব প্রকৃতির দাবি। এই দাবিসমুহের প্রথম মুখপাত্র নারী। পুরুষ কিয়ৎকালের জন্য নারীর সঙ্গলাভের পর তাহার দায়িত্ব হইতে চিরদিনের জন্য মুক্ত হইতে পারে। কিন্তু এই সংগ লাভের স্বাভাবিক পরিণাম নারী বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া এমন কি আজীবন ভোগ করিতে থাকে। গর্ভসঞ্চারের পর হইতে অন্তত পাঁচ বৎসর কাল যাবত উক্ত সংগ লাভের পরিণাম ফল তাহাকে ভোগ করিতে হয়। কিন্তু যদি তমদ্দুনের পরিপূর্ণ দাবি মানিয়া চলিয়ে হয়, তাহা হইলে তাহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, মুহূর্তকালের জন্য যে নারী পুরুষের সংগ লাভের দ্বারা আনন্দ উপভগ করিয়াছিল, তাহাকে তাহার গুরু দায়িত্ব সুদীর্ঘ পনর বৎসর যাবত বহন করিতে হইবে। এখন প্রশ্ন এই যে, একটি যৌথ দায়িত্ব গ্রহণে শুধু একপক্ষ কেমন করিয়া অগ্রসর হইতে পারে? যতক্ষণ নারী তাহার অংশীদারের বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা হইতে মুক্ত না হইয়াছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে স্বীয় সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না হইয়াছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাহাকে স্বীয় জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা হইতে অব্যাহতি দেওয়া না হইয়াছে, সে কেমন করিয়া এত গুরু দায়িত্ব বহন করতে প্রস্তুত হইবে? যে নারীর কোন অভিবাবক বা রক্ষক নাই, তাহার জন্য গর্ভসঞ্চার একটি দুর্ঘটনা, একটি বিপদ-একটি অতি সাংঘাতিক বিপদ ব্যতীত আর কিছুই নহে। ইহা হইতে অব্যাহতি লাভ করার বাসনা তাহার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। নতুবা এহেন গর্ভসঞ্চারকে সে কেমন করিয়া স্বাগতম জানাইতে পারে?
যদি মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষা এবং তমদ্দুনের প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির প্রয়োজনীয়তা বোধ করা হয়, তাহা হইলে ইহা অনিবার্য যে, পুরুষ নারীর উপরে কোন গুরুভার চাপাইয়া দিলে সেই ভার বহন করিবার জন্য পুরুষও নারীর অংশীদার হইবে। কিন্তু এই অংশ গ্রহণে পুরুষকে কেমন করিয়া সম্মত করা যাইতে পারে? জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রকৃতির যে অনিবার্য নির্দেশ, সে বিষয়ে চিন্তা করিলে দেখা যায় যে, এ ব্যাপারে পুরুষের যাহা করণীয় তাহা সে রতিগমন করত মুহূর্তের মধ্যেই সমাধা করে। অতপর সে গুরুভার একাকী নারীর উপরেই রহিয়া যায় এবং তাহা কিছুতেই পুরুষের উপর প্রযোজ্য হয় না। যৌন আকর্ষণের দিক দিয়া চিন্তা করিলেও দেখা যায় যে, ইহা পুরুষকে সেই নারীর সহিত মিলিত হইয়া থাকিতে বাধ্য করে না। পুরুশ ইচ্ছা করিলে এক নারীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য নারীর সহিত সম্পর্ক স্থাপন করিতে পারে। এইভাবে সে প্রতি ভূমিতে বীজ নিক্ষেপ করিয়া যাইতে পারে। অতএব যদি এ সকল কার্য তাহার ইচ্ছার উপরেই ছাড়িয়া দেয়া হয়, তাহা হইলে সে যে সেচ্ছায় পরবর্তী গুরুভার বহন করিতে প্রস্তুত থাকবে, তাহার কোনই কারণ থাকিতে পারে না। এমতাবস্থায় এমন কোন বস্তু আছে যে, তাহাকে তাহার শ্রম ও উপার্জন সেই নারী ও তাহার গর্ভস্থ সন্তানের জন্য ব্যয় করিতে বাধ্য করিবে? অন্য একটি সুন্দরী কুমারীর পরিবর্তে কেনই বা এই স্ফীতগর্ভ রমণীর প্রতি তাহার অনুরাগ থাকিবে? অযথা একটি অপদার্থ গোশতপিন্ড কেন সে আপন ব্যায়ে প্রতিপালন করিবে? অতপর নবজাত শিশুর ক্রন্দনচীৎকারে কেন সে তাহার নিদ্রা হারাম করিয়া দিবে? এই ক্ষুদ্র শয়তানটি যে তাহার প্রতিটি বস্তু ভাঙিয়া চুরমার করে, সারা বাড়ী নোংরা করিয়া ফেলে এবং কাহারও কোন বাধা নিষেধই মানিতে চাহে না-কেন তাহাকে ক্ষতিগ্রস্থ করিবে?
এই সমস্যার কিয়দংশ সমাধান প্রকৃতি স্বয়ং দান করিয়াছে। সে নারীর মধ্যে সৌন্দর্য, মাধুর্য, মনভুলানো শক্তি ও প্রেমানুরাগের জন্য ত্যাগ ও উৎসর্গ করিবার যোগ্যতা সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে। এইসব অস্ত্র প্রয়োগে সে পুরুষের স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা জয় করিয়া তাহাকে বশীভূত করিয়া লইতে পারে। উপরন্তু প্রকৃতি মানব শিশুর মধ্যেও এমন এক বিস্ময়কর বশীকরণ শক্তি সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে যে, সে তাহার কষ্টদায়ক ধ্বংসাত্মক ও দুষ্টামিপূর্ণ স্বভাব-চরিত্র সত্ত্বেও পিতামাতাকে স্নেহবাৎসল্যের বন্ধনে আবদ্ধ করিয়া রাখে। নৈতিক, তামাদ্দুনিক কর্তব্য সম্পাদনের জন্য বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া ক্ষয়ক্ষতি, দুঃখ-কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করিতে মানুষকে বাধ্য করিবার জন্য শুধু এই সকলই যথেষ্ট নহে। মনে রাখিতে হইবে যে, মানুষের সঙ্গে তাহার চিরদুশমন শয়তান লাগিয়াই আছে। সে মানুষকে স্বাভাবিক পথ হইতে বিচ্যুত করিবার চেষ্টা সর্বদা করিয়াই থাকে। প্রত্যেক যুগের প্রতিটি জাতির লোককে পথ ভ্রষ্ট করিবার জন্য তাহার প্রতারণার ঝুলিতে অফুরন্ত যুক্তি-প্রমাণাদি ও প্ররোচনা আছে।
ইহা ধর্মের এক মৌলিক শক্তি যে, ইহা নরনারীকে জাতি ও তমদ্দুনের জন্য ত্যাগ ও উৎসর্গে অনুপ্রাণিত করে। ইহা মানবরূপী স্বার্থান্ধ পশুকে ত্যাগের জন্য প্রস্তুত করে। একমাত্র আল্লাহর প্রেরিত নবীগণই প্রকৃতির ইচ্ছা সঠিক অবগত হইয়া নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন-সম্পর্ক এবং তামাদ্দুনিক সহযোগিতার সঠিক পন্থা বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছেন। তাঁহাদেরই শিক্ষা ও পথনির্দেশেই পৃথিবীর সর্বত্র সকল জাতির মধ্যে বিবাহের প্রচলন হইয়াছে। তাঁহাদেরই প্রচারিত নৈতিক ভিত্তির উপরেই মানুষের মধ্যে এমন আধ্যাত্মিক কর্মকুশলতার সৃষ্টি হইয়াছে যে, সে ইহার জন্য দুঃখ কষ্ট ও ক্ষয়-ক্ষতি সহ্য করিতে পারে। নতুবা প্রকৃত ব্যাপারে এই যে, পিতামাতা অপেক্ষা সন্তানের বৃহত্তম শত্রু কে হইতে পারে? নবীগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়ম-কানুনের দ্বারা পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছে, যাহার সুদৃঢ় হস্তমুষ্ঠি বালক-বালিকাকে এহেন দায়িত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও এই প্রকার যৌথ কার্যের জন্য বাধ্য করে। নতুবা যৌবনের পাশবিক দাবি এত প্রবল হয় যে, কোন বাহ্যিক অনুশাসন ব্যতিরেকে শুধুমাত্র নৈতিক দায়িত্ববোধ তাহাকে যৌন স্বেচ্ছাচারিতা হইতে নিরস্ত করিতে পারে না। যৌন অনুরাগ স্বতই সামাজিক বিরোধী [anti-social]। ইহা স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অরাজকতার অনুরাগ জন্মায়। ইহার মধ্যে স্থিতিশীলতা নাই, দায়িত্বানুভূতি নাই। ইহা শুধু সাময়িক সুখ-সম্ভোগের জন্য উদ্দীপনার সঞ্চার করে। এই দানবকে বশীভূত করিয়া তাহার এমন এক সমাজ-জীবনের সেবা গ্রহণ সহজসাধ্য নহে যাহা ধৈর্য, সহনশীলতা, শ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দায়িত্ববোধ ও পারিবারিক ব্যবস্থাই এই দানবকে ক্ষুদ্র বোতলে প্রবিষ্ট করাইয়া তাহার নিকত হইতে পাপিষ্ঠতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার দালালি [agency] কাড়িয়া লয়। অতপর জীবন গথনের জন্য অপরিহার্য নারী-পুরুষের এহেন অবিরাম সহযোগিতা ও যৌথকার্যের এজেন্ট নিযুক্ত করে। ইহা না হইলে মানুষের তামাদ্দুনিক জীবন শেষ হইয়া যাইবে; মানুষ পশুর মত জীবন যাপন করিবে এবং অবশেষে মানব জাতি ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে।
অতএব যৌনবাসনাকে স্বেচ্ছাচার ও অমিতাচার হইতে মুক্ত করত তাহার প্রাকৃতিক দাবি পূরণকল্পে স্বয়ং প্রকৃতি যে পন্থা উন্মুক্ত দেখিতে চায়, তাহা শুধু এই যে, নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে চিরন্তন মিলন হউক এবং এই মিলনের দ্বারা পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হউক। তমদ্দুনের ন্যায় একটা বিরাট ও ব্যাপক কারখানা চালাইবার জন্য যে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, তাহা পরিবারের এই ক্ষুদ্র ওয়ার্কশপে [কারখানা] তৈরী করা হয়। বালক-বালিকা যৌবনে পদার্পণ করিবার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ার্কশপের পরিচালকগণ তাহাদের যথাসম্ভব সুষ্ঠু দাম্পত্য ব্যবস্থার চিন্তা করেন যেন তাহাদের দাম্পত্য মিলনের ফলে উৎকৃষ্টতর বংশধর জন্মলাভ করিতে পারে। অতপর তাহাদের পরে যে বংশধর ভূমিষ্ঠ হইবে, এই ওয়ার্কশপের প্রত্যেক কর্মী পূর্ণ আন্তরিকতার সহিত তাহাদিগকে যথাসম্ভব উৎকৃষ্টতর করিয়া গড়িবার চেষ্টা করিবে। পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে জীবনের প্রথম মুহূর্ত শুরু করিবার সংগে সংগেই নবপ্রসূত সন্তান পারিবারিক সীমানার মধ্যে প্রেম, যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষাদীক্ষার এমন এক পরিবেশের মধ্যে প্রবেশ করে যেন স্বীয় বিকাশ লাভের জন্য সে ‘আবে-হায়াত’ [সঞ্জীবনী সুধা] লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে একমাত্র পরিবারের মধ্যেই সন্তান এমন দুই ব্যক্তির সাহচর্য লাভ করে যাহারা শুধু তাহাকে ভালই বাসে না, বরং অন্তরে এই অনুরাগ পোষণ করে যে, যেরূপ মর্যাদায় সন্তান জন্মলাভ করিয়াছে, তাহা অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদা সে লাভ করুক। পৃথিবীতে একমাত্র পিতামাতার সন্তানকে সর্বদিক দিয়া উন্নতর ও অধিকতর সুখী ও সমৃদ্ধ দেখুক। এইভাবে তাহারা অনিচ্ছায় ও অজ্ঞাতে ভবিষ্যৎ বংশধরকে বর্তমান বংশধর হইতে উন্নততর করিতে চেষ্টা করে। তাহাদের এই চেষ্টার মধ্যে স্বার্থপরতার লেশমাত্র নাই। তাহারা নিজের জন্য কিছুই কামনা করে না, আপন সন্তানাদিরই কল্যাণ কামনা করে এবং তাহাদের জীবন সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত দেখার মধ্যেই স্বীয় শ্রমের পারিতোষিক লাভ করে। পরিবারের এই কারখানায় এমন একনিষ্ঠ শ্রমিক ও নিঃস্বার্থ কর্মী কোথায় পাওয়া যাইবে যাহারা মানব জাতির কল্যানহেতু শুধু অবৈতনিক শ্রমই করে না, বরং তাহাদের সময়, শান্তি, শক্তি, যোগ্যতা ও শ্রমলব্ধ সকল কিছু তাহাদেরই সেবার জন্য ব্যয় করিতে পারে? এমন আর কে আছে যে এই কাজের জন্য তাহার প্রতিটি মূল্যবান বস্তু উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত হয়, অথচ তাহার ফলভোগ অপরে করে? যে অপরের জন্য উৎকৃষ্ট কর্মী ও খাদেম তৈরী লওয়ার মধ্যে আপন শ্রমের পারিতোষিক লাভ করে? ইহা অপেক্ষা মানবতার পবিত্রতর ও মহত্তর আকাঙ্ক্ষা আর কিছু হইতে পারে কি?
প্রতি বৎসর মানব জাতির অস্তিত্ব অ মানবীয় তমদ্দুনের সংযোগ-পরম্পরা ও উন্নতির জন্য এইরূপ লক্ষ কোটি দম্পতির প্রয়োজন, যাহারা স্বেচ্ছায় ও সানন্দে এই মহৎ সেবার দায়িত্বে আপনাকে উৎসর্গ করিতে পারে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া এই ধরনের কর্মক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করিতে পারে। পৃথিবীতে যে বিরাট কারখানা চলিতেছে, তাহা একমাত্র এইভাবে চলিতে পারে, যদি এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবক উপর্যুপরি গঠিত হয় এবং এই কারখানা চালাইবার জন্য তাহারা লোক সংগ্রহ করিয়া দেয়। যদি নুতন লোক ভর্তি না হয় এবং এই স্বাভাবিক কারণে পুরাতন কর্মী কাজের অনুপযোগী হইয়া পড়ে তাহা হইলে কাজের লোক ক্রমশ হ্রাস পাইতে থাকিবে। একদা এই গঠনকারী সত্তা বিকল অবস্থায় পরিয়া রহিবে। তমদ্দুনের এই মেশিনকে যাহারা পরিচালিত করিতেছে তাহাদের কর্তব্য শুধু ইহাই নহে যে, তাহারা নিজেদের জীবনেই ইহা চালাইতে থাকিবে, বরং ইহাও তাহাদের কর্তব্য যে, তাহাদের স্থলাভিষিক্ত করিবার লোকও তাহারা সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিবে।
এইদিক দিয়া দেখিতে গেলে বিবাহ যে শুধু যৌন-অনুরাগ প্রশমিত করিবার একটি বৈধ পন্থামাত্র তাহা নহে, বরং ইহা একটি সামাজিক অপরিহার্য কর্তব্য, ব্যক্তির উপর সমাজের স্বাভাবিক অধিকার আছে এবং ব্যক্তিকে এ অধিকার কখনও দেওয়া যাইতে পারে না যে, সে বিবাহ করা না করার সিদ্ধান্ত নিজের জন্য সংরক্ষিত রাখিবে। যাহারা যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাতিরেকে বিবাহ করিতে অস্বীকার করিবে, তাহারা সমাজের শুধু পরাংগপুষ্ট জীবই নহে, বরং বিশ্বাসঘাতক ও লুন্টনকারীও বটে। জগতে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার জীবনের প্রথম শ্বাস গ্রহন করিবার পর হইতে যৌবনে পদার্পণ করিবার সময় পর্যন্ত ঐ সকল অফুরন্ত সম্পদ ভোগ করিতে থাকে, যাহা পূর্ববর্তীগণ সংগ্রহ করিয়া রাখে। তাহাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলির বদৌলতেই সে জীবন ধারণ করার, প্রতিপালিত ও পরিবর্ধিত হওয়ার এবং মানবতার বিকাশ লাভ করার সুযোগ পায়। এই সময়ের মধ্যে সে শুধু গ্রহণই করিতে থাকে, কিছু দান করে না। সমাজ তাহার অপূর্ণ শক্তিকে পূর্ণতা দান করিবার জন্যই তাহার সম্পদ ও সময় ব্যয় করিয়া থাকে, এই আশায় যে, যখন সে স্বয়ং কিছু দান করিবার যোগ্যতা অর্জন করিবে তখন নিশ্চয় তাহা করিবে। এখন যদি সে বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া নিজের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার দাবি করিয়া বলে যে, সে শুধু তাহার আপন প্রবৃত্তিই চরিতার্থ করিবে, কিন্তু এই প্রবৃত্তি সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করিবে না, তাহা হইলে সে সমাজের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণাই করে। তাহার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অন্যায় ও অবিচারই বলিতে হইবে। সমাজের মধ্যে যদি কণামাত্রও চেতনাবোধ থাকে, তাহা হইলে এই অপরাধীকে ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা অথবা সম্মানিত ব্যক্তি মনে করিবার পরিবর্তে একটি চোর, দস্যু ও প্রতারকই মনে করিবে। আমরা ইচ্ছায়ই হউক অথবা অনিচ্ছায় হউক, ঐ সমস্ত ধন-সম্পদের অধিকারী হইয়াছি, যাহা আমাদের পূর্ববর্তীগণ আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন। এখন আমাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা কেমন করিয়া হইতে পারে যে, যে প্রাকৃতিক নিয়মে আমরা এই উত্তরাধিকার লাভ করিয়াছি, তাহার ইচ্ছা আমরা পূর্ণ করিতে পারি অথবা নাও পারি? মানব জাতির এহেন সম্পদের উত্তরাধিকারী কোন ভবিষ্যৎ বংশধর তৈরি করি বা না করি? আমাদিগকে যেভাবে গঠন করা হইয়াছে, সেইভাবে এই সকল সম্পদ সামলাইবার জন্য দ্বিতীয় একটি দল গঠন করি বা না করি?
৩. যৌন লাম্পট্যের মূলোৎপাটন
বিবাহ ও পারিবারিক ভিত্তি স্থাপনের সংগে সংগে ইহারও প্রয়োজন যে, বৈবাহিক দুর্গ-প্রাচীরের বহির্ভাগের যৌন বাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য সকল পথ রুদ্ধ করিয়া দিতে হইবে। কারণ ইহা না করিলে প্রকৃতির ইচ্ছা পূর্ণ হইতে পারে না, যাহার জন্য সে বিবাহ ও পারিবারিক ভিত্তি স্থাপনের দাবি করে।
প্রাচীন জাহেলিয়াতের ন্যায়, বর্তমান জাহেলিয়াতের যুগেও অধিকাংশ লোক ব্যভিচারকে একটি প্রাকৃতিক কর্ম মনে করিয়া থাকে। তাহাদের মতে বিবাহ তমদ্দুন কর্তৃক আবিষ্কৃত নিছক একটি কৃত্রিম ও অতিরিক্ত বস্তু মাত্র। তাহাদের এই ধারণা এই যে, প্রকৃতি যেমন প্রতিটি ছাগীর জন্য ছাগ এবং প্রতিটি কুকুরীর জন্য কুকুর সৃষ্টি করিয়াছে, তেমনি প্রত্যেক নারীর জন্য পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছে। অতএব প্রকৃতির নিয়ম এই যে, যখন ইচ্ছা ও সুযোগ হইবে এবং যখন নারী-পুরুষ পরস্পর সম্মত হইবে, তখন পশুদের মধ্যে যেমন যৌনক্রিয়া সম্পন্ন হইয়ে থাকে, তেমনি তাহাদের মধ্যেও হইবে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা মানবীয় প্রকৃতির নিতান্তই ভুল ব্যাখ্যা। তাহারা মানুষকে নিছক পশুই মনে করিয়াছে। অতএব যখনই তাহারা ‘প্রকৃতি’ শব্দ ব্যবহার করে, তখন তাহার দ্বারা মানবীয় প্রকৃতির পরিবর্তে পাশবিক প্রকৃতিই বুঝায়। যে ব্যাপক যৌন সম্পর্ককে তাহারা ‘প্রাকৃতিক’ বলে, তাহা পশুদের জন্য কখনই হইলেও মানবের জন্য প্রাকৃতিক নহে! ইহা শুধু মানব-প্রকৃতির পরিপন্থী নহে, বরং শেষ পরিণতির দিক দিয়া বিচার করিলে যে পাশবিক প্রকৃতি মানুষের মধ্যে নিহিত রহিয়াছে, তাহারও পরিপন্থী। ইহার কারণ এই যে, মানবের মধ্যে মানবত্ব ও পশুত্ব দুইটি স্বতন্ত্র বস্তু নহে। প্রকৃতপক্ষে একই সত্তার ভিতরে উভয়ের সমন্বয়ে একই ব্যক্তিত্ব গঠন করে এবং উভয়ের প্রয়োজনাবলী পরস্পর এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, একটি উপেক্ষিত হইলে অপরটি আপনা-আপনিই বিনষ্ট হইয়া যায়।
বাহ্যত ইহা মনে করা যাইতে পারে যে, ব্যভিচারের দ্বারা পাশবিক প্রকৃতির প্রয়োজন তো পূরণ হয়। কারণ বংশ বৃদ্ধি ও মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যও একমাত্র যৌনক্রিয়ার দ্বারাই পূর্ণ হয়, তাহা বিবাহের মাধ্যমেই হউক কিংবা তাহা ব্যতিরেকেই হউক। কিন্তু ইতিপূর্বে আমরা যাহা বর্ণনা করিয়াছি, তাহার প্রতি একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে জানিতে পারা যাইবে যে, এই কার্য যেমন মানবীয় প্রকৃতির উদ্দেশ্য ব্যহত করে, তেমনই পাশবিক প্রকৃতির উদ্দেশ্যও ব্যাহত করিয়া দেয়। মানব প্রকৃতি দাবি করে যে, যৌন সম্পর্ক সুদৃঢ় ও স্থায়ী হউক যাহাতে পিতামাতা মিলিতভাবে সন্তান প্রতিপালন করিতে পারে এবং পরিমিত কাল পর্যন্ত পুরুষ শুধু সন্তানের নহে, সন্তানের মাতারও পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারে। যদি পুরুষের এই বিশ্বাস না জন্মে যে, সন্তান তাহার ঔরসজাত, তাহা হইলে তাহা প্রতিপালনের জন্য সে ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার আদৌ করিবে না এবং উক্ত সন্তান তাহার উত্তরাধিকারী হইবে, ইহাও সে মানিয়া লইবে না। এইরূপ যদি নারীরও এই বিশ্বাস না জন্মে যে, যে পুরুষ তাহার গর্ভসঞ্চার করিতেছে সে তাহার ও তাহার সন্তানের প্রতিপালনের দ্বায়িত্ব গ্রহনে অসম্মত তাহা হইলে সে নারীও গর্ভ ধারণের বিপদ ঘাড়ে লইতে সম্মত হইবে না। সন্তান প্রতিপালন ব্যাপারে যদি পিতামাতা সহযোগিতা না করে, তাহা হইলে তাহার শিক্ষা-দীক্ষা, নৈতিক, মানশিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিবে না যাহা দ্বারা সে মানবীয় তমদ্দুনের কোন উপযোগী কর্মী হইতে পারে। এই সবই হইতেছে মানব-প্রকৃতির চাহিদা। এই সকল চাহিদা পদদলিত করিয়া যখন নারী-পুরুষ নিছক পশুর ন্যায় সাময়িক সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন সে পশু প্রকৃতির চাহিদা বা প্রয়োজনকেও [অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন ও বংশ বৃদ্ধি] অবহেলা করে। কারণ সে সময়ে সন্তান উৎপাদন ও বংশ বৃদ্ধির দিকে তাহার কোন লক্ষ্য থাকে না এবং থাকিতেও পারে না। সেই সময়ে তাহাদের মধ্যে যৌন-আস্বাদের বাসনার জন্যই হইয়া থাকে। ইহার প্রকৃতির ইচ্ছার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আধুনিক জাহেলিয়াত যুগের ধ্বজাধারিগণের নিজেদেরই এ দুর্বলতা আছে। এইজন্য তাহারা আর একটি যুক্তির অবতারণা করিয়া বলে যে, যদি সমাজের দুইটি লোক মিলিত হইয়া কয়েক মুহূর্ত আনন্দ-সম্ভোগে কাটাইয়া দেয়, তাহা হইলে ইহাতে সমাজের কি ক্ষতি করা হয় যে, সে ইহাতে হস্তক্ষেপ করে? যদি এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর বলপ্রয়োগ করে অথবা প্রতারণা প্রবঞ্চনা করে কিংবা সামাজিক কোন বিপদ-বিসম্বাদের কারণ ঘটায়, তাহা হইলে সেক্ষেত্রে অবশ্য সমাজের হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে ইহার কোনটাই সংঘটিত হয় না এবং কেবল দুই ব্যক্তির আনন্দ উপভোগেরই বিষয় হয়, তখন তাহাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করিবার কি অধিকার সমাজের আছে? এইভাবে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে [Private affairs] যদি হস্তক্ষেপ করা হয়, তাহা হইলে ব্যাক্তি স্বাধীনতা অর্থহীন হইয়া পড়ে।
ব্যক্তি স্বাধীনতার এই ধারণা অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর এক অজ্ঞতা বিশেষ, যাহা জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের প্রথম কিরণ প্রতিভাত হওয়ার সংগে সংগে বিদূরিত হয়। সামান্য চিন্তা-গবেষণার পরই লোকে ইহা অনুধাবন করিতে পারে যে, ব্যক্তির জন্য যে ধরনের স্বাধীনতার দাবি করা হইতেছে, সমাজ-জীবনে তাহার কোন স্থান নাই। এইরূপ স্বাধীনতা যাহারা কামনা করে, বনে-জংগলে গমন করত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করাই তাহাদের শ্রেয়। মানব সমাজ প্রকৃতপক্ষে ভালবাসা ও সম্বন্ধ-সম্পর্কের এমন এক জাল, যাহার সহিত প্রত্যেক মানুষের জীবন অন্যান্য অসংখ্যা মানবের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রত্যেকেই অন্যান্যের উপর যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তেমনই অন্যান্যের দ্বারাও প্রভাবান্বিত হয়। এইরূপ পারস্পরিক সম্বন্ধ সম্পর্ক যেখানে বিদ্যমান, সেখানে কোন কার্যকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং একক বলা যায় না। সামগ্রিকভাবে সমাজের উপরে কোন প্রভাব বিস্তার করে না, এমন কোন ব্যক্তিগত কার্যের ধারণাই করা যাইতে পারে না। অংগ-প্রত্যাংগের ক্রিয়া তো দুরের কথা, মনের কোণে লুক্কায়িত এমন কোন বাসনাও নাই, যাহা আমাদের অস্তিত্বের উপরে এবং অতঃপর প্রতিবিম্বিত হইয়া অন্যান্যের উপরে ক্রিয়াশীল না হয়। আমাদের মন ও দেহের এক একটি ক্রিয়ার পরিণাম ফল আমাদের নিকত হইতে স্থানান্তরিত হইয়া এত দূর-দূরান্তে গিয়া পৌঁছে যে, তাহা আমাদের জ্ঞানের বহির্ভূত। এমতাবস্থায় ইহা কি প্রকারে বলা যাইতে পারে, কোন ব্যক্তি বিশেষের আপন শক্তির ব্যবহার সে ব্যতিরেকে অন্য কাহারও উপর প্রভাব বিস্তার করে না? অতএব, ইহাতে কি অন্য কাহারো কিছুই করিবার নাই এবং এই ব্যাপারে উক্ত ব্যক্তির পুরন স্বাধীনতা থাকাই কি উচিত? যদি আমার এমন স্বাধীনতা না থাকে যে, আমার হাতের কাষ্ঠখন্ড যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে ঘুরাইতে থাকিব, আমার পা দুইটিতে ইচ্ছামত পরিচালিত করিয়া যথা ইচ্ছা তথা গমন করিব, আপন শকটকে যথেচ্ছ চালাইব এবং আপন গৃহে ইচ্ছামত আবর্জনা স্তূপীকৃত করিব এবং যদি এ ধরনের অন্যান্য অগণিত ব্যক্তিগত কার্যকলাপ সামাজিক নিয়ম-কানুনের অধীন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তাহা হইলে শুধু আমার রতিক্রিয়া এমন কোন মর্যাদার অধিকারী হইল যে, তাহাকে কোন সামাজিক নিয়ম-পদ্ধতির অধীন করা হইবে না এবং আমাকে এমন পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হইবে যে, আমার ইচ্ছামত তাহাকে নিয়োজিত করিব?
একজন পুরুষ ও একজন নারী নিভৃত স্থানে সকলের অগোচরে যে যৌনসম্ভোগ করে, সমাজ-জীবনে তাহার কোন ক্রিয়া হয় না এমন কোন কথা শিশুসুলভতা [Childish talks] মাত্র। প্রকৃতপক্ষে যে সমাজের সহিত কোন ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে, তাহার কার্যকলাপের ক্রিয়া শুধু সেই সমাজের উপরই হয় না, বরং সমগ্র মানবতার উপরই হয়। শুধু বর্তমানকালের লোকদের উপর হয় না, বরং ভবিষ্যত বংশধরগণও ইহার পরিণাম ভোগ করে। যে সামাজিক ও সমাজতাত্ত্বিক রীতি-নীতির বন্ধনে সমগ্র মানবতা আবদ্ধ, তাহা হইত্য কোন একক ব্যক্তি কোন অবস্থাতেও কোন সুরক্ষিত স্থানে পৃথকভাবে থাকিতে পারে না। সে যেমন মুক্ত মাঠে, হাটে-ঘাটে অথবা সভাসমিতিতে থাকিয়া সামাজিক জিবনের সহিত জড়িত থাকে, তেমনি আবদ্ধ কক্ষে ও প্রাচীর অভ্যন্তরে সুরক্ষিত থাকিয়াও সামাজিক জীবনের সহিত জড়িত থাকে। যে সময়ে নিভৃতে সে স্বীয় সন্তানোৎপাদন একটি সাময়িক ও অপরিণামদর্শী ও আনন্দ সম্ভোগে বিনষ্ট করে, সে সময়ে সে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়াইতে, জাতির অধিকার ক্ষুন্ন করিতে এবং সমাজের অসংখ্য নৈতিক, বৈষয়িক ও তামাদ্দুনিক ক্ষতি সাধনে লিপ্ত থাকে। সে আপন স্বার্থে ঐ সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আঘাত করে যাহা দ্বারা সে সমাজের অংগঅংশ হিসাবে উপক্রিত হইয়াছে, তাহার প্রতিষ্ঠার স্থায়িত্বের জন্য সে স্বীয় দ্বায়িত্ব পালনে অস্বিকার করিয়া বসিয়াছে। সমাজ মিউনিসিপ্যালিটি হইতে রাষ্ট্রক্ষেত্র পর্যন্ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে সৈন্য বিভাগ পর্যন্ত, কল-কারখানা হইতে জ্ঞান বিজ্ঞানের গবেষণাগার পর্যন্ত যতগুলি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত করিয়া রাখিয়াছে, তাহা একমাত্র এই বিশ্বাসে যে, ইহার দ্বারা উপকৃত প্রত্যেক ব্যক্তি ইহার প্রতিষ্ঠা ও জন্য আপন অনিবার্য করণীয় অংশ গ্রহণ করিবে। কিন্তু যখন সেই বে-ঈমান স্বীয় কামশক্তি এমন ভাবে ব্যয় করিল যে, সন্তানোৎপাদন, বংশ বৃদ্ধি ও সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণের কোন ইচ্ছাই তাহার রহিল না, তখন সে এক আঘাতে এই সমগ্র ব্যবস্থার মুলচ্ছেদ করিয়া ফেলিল। যে সামাজিক চুক্তির সহিত সে মানুষ হিসাবে জড়িত ছিল, তাহা ভংগ করিয়া ফেলিল। সে আপন দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে তাহা অপরের স্কন্ধে চাপাইয়া দিল। সে কোন সম্ভ্রান্ত লোক হইতে পারে না-সে একজন চোর, প্রতারক ও পরস্বপহারী। তাহার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করার অর্থ সমগ্র মানবতার প্রতি যুলুম করা।
সামাজিক জীবনে এক ব্যক্তির মর্যাদা উপলব্ধি করিবার পর নিসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, আমাদের মন ও দেহে যে এক প্রকারের শক্তি প্রদত্ত হইয়াছে তাহা ব্যক্তি বিশেষের জন্য নহে, বরং সমগ্র মানবতার জন্য আমাদের নিকট আমানতস্বরূপ গচ্ছিত আছে। আমাদিগকে প্রতিটি শক্তির জন্য সমগ্র মানবতার নিকতে জবাবদিহি করিতে হইবে। যদি আমরা নিজের জীবনের অথবা শক্তিগুলির মধ্যে কোনটির অপচয় করি অথবা আপন অপকর্মের জন্য নিজের ক্ষতি সাধন করি, তাহা হইলে আমাদের এই কার্যের প্রকৃত ফল ইহা হইবে না যে, আমাদের যাহা ছিল তাহা অপচয় অথবা ক্ষতি করিয়াছি। প্রকৃতপক্ষে ইহা এইরূপ বিবেচিত হইবে যে, সমগ্র মানব জগতের জন্য আমাদের নিকটে যাহা আমানতস্বরূপ গচ্ছিত ছিল, তাহা আমরা আত্মসাত করিয়াছি এবং ইহা দ্বরা মানবতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছি। পৃথিবীতে আমাদের সত্তা সাক্ষ্য দেয় যে, অপরের দুঃখকষ্ট ভোগ ও দ্বায়িত্বভার বহন করিয়া জীবনের জ্যোতিধারা আমাদের দিকে বিচ্ছুরিত করিয়া দিয়াছে বলিয়াই আমাদের জগতে পদার্পণ করা সম্ভব হইয়াছে। অতপর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করিয়াছে। স্বাস্থ্য রক্ষা বিভাগ আমাদের স্বাস্থ্য সংরক্ষণে রত রহিয়াছে। লক্ষ কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন যাপনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংস্থান হইয়াছে। যাবতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি মিলিয়া আমাদের শক্তি-সামর্থ্য যোগাইয়াছে, শিক্ষা দানের চেষ্টা করিয়াছে এবং আমাদিগকে বর্তমান মর্যাদায় উন্নীত করিয়াছে। এসবের কি এই প্রতিদান হইবে? এই কি সুবিচার হইবে যে, যে জীবন ও শক্তি-সামর্থ্যের সৃষ্টি, স্থায়িত্ব ও পরিস্ফুটনের জন্য অপরে এতখানি অংশগ্রহন করিয়াছে, তাহাকে আমরা অযথা বিনষ্ট করিয়া ফেলি অথবা মঙ্গলকর করিবার পরিবর্তে ক্ষতিকর করি? এই কারনেই আত্মহত্যা নিষিদ্ধ হইয়াছে। এই কারনেই জগতের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞ ও দার্শনিক [নবী সঃ] হস্তমৈথুনকারীকে অভিশপ্ত বলিয়া উক্তি করিয়াছেন। (*********) হস্তমৈথুনকারী অভিসপ্ত হাদীস। এইজন্যই সমমৈথুন অর্থাৎ লুত সম্প্রদায়ের কুকার্যকে গর্হিত অপরাধ বলা হইয়াছে। এই কারনেই ব্যভিচার, ব্যক্তিগত চিত্তবিনোদনও একটা সুবর্ণ মুহূর্ত নহে, বরং সমগ্র জাতির প্রতি অবিচারবিশেষ।
গভীরভাবে চিন্তা করিলে দেখা যাইবে যে, ব্যাভিচার ক্রিয়ার সহিত কত সামাজিক অনাচার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমনঃ
১. সর্বপ্রথম ব্যভিচারীর যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হইবার আশংকা থাকে। এইভাবে জনকল্যাণকর কার্যের জন্য সে শুধু তাহার দৈনিক শক্তিরই ক্ষতি সাধন করে না, বরং সমাজ ও বংশধরকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে। প্রমেহ রোগ সম্পর্কে প্রত্যেক চিকিৎসকই একমত যে, ইহা দ্বারা মুত্রদ্বারে যে ক্ষত হয়, তাহা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুরারোগ্য হয়। জনৈক চিকিৎসক মন্তব্য করিয়াছেন যে, একবার প্রমেহ রোগ হইলে তাহা আর নিরাময় হয় না। ইহার ফলে যকৃত, মুত্রথলি, মল-মূত্রদ্বার প্রভৃতি অংগগুলি অধিকাংশ সময়ে আক্রান্ত হইয়া পড়ে। ইহা গেঁটে বাত ও অন্যান্য রোগসমূহেরও কারণ হইয়া পড়ে। ইহাতে চিরদিনের জন্য বন্ধ্যা রোগেরও আশংকা থাকে। ইহা অপরের জন্যও সংক্রামক হইয়া পড়ে। অতপর ইহার আর এক মারাত্মক পরিণাম সিফিলিস বা গর্মি ঘা সম্পর্কে চিন্তা করিয়া দেখুন। ইহা সর্বজনবিদিত যে, সমগ্র শারীরিক সংগঠন ইহার দ্বারা বিষাক্ত হইয়া পড়ে। আপাদমস্তক প্রতিটি অংগ প্রত্যংগে ইহার বিষক্রিয়া সংক্রমিত হইয়া পড়ে। ইহা শুধু রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দৈহিক শক্তিই বিনষ্ট করিয়া ফেলে না, বরং এক ব্যক্তি হইতে বিভিন্ন উপায়ে অসংখ্য অসংখ্য অগণিত ব্যক্তির মধ্যে এই রোগের জীবাণু সংক্রমিত হইয়া পড়ে। রোগীর নিরপরাধ সন্তান সন্তুতি বংশানুক্রমে ইহার পরিণাম ফল ভোগ করিতে থাকে। দুরাচারী পিতা কয়েক মুহূর্তের যৌন সম্ভোগকে যে তাহার জীবনের একান্ত কামনীয় বস্তু মনে করিয়াছিল, তাহারই স্বাভাবিক পরিণাম স্বরূপ সন্তান অন্ধ, বোবা, বধির অথবা উন্মাদ হইয়া জন্মগ্রহণ করে।
২. প্রত্যেক ব্যভিচারী যৌনব্যধিতে আক্রান্ত নাও হইতে পারে। কিন্তু এই ব্যভিচার ক্রিয়ার সহিত নিশ্চিতরূপে সংশ্লিষ্ট নৈতিক দুর্বলতা হইতে রক্ষা পাওয়া তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। নির্লজ্জতা, প্রতারণা, মিথ্যা দুরভিসন্ধি, স্বার্থপরতা, প্রবৃত্তির দাসত্ব, কুপ্রবৃত্তির দমনে অক্ষমতা, অসৎ চিন্তাধারা, যৌনক্রিয়ার মজা লুটিয়ার মনোবৃত্তি, অস্থিরমতিত্ব, অবিশ্বাস প্রভৃতি ব্যভিচারের এমন সব নৈতিক কুফল যাহা ব্যভিচারীর মনের উপর দৃঢ় প্রতিফলিত হয়। এই সকল দোষ যে ব্যক্তি পোষণ করে, তাহার দুর্বলতার কুফল যে শুধু যৌনক্রিয়ায় সিমাবদ্ধ-তাহা নহে, বরং তাহার নিকট হইতে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে সমাজের মধ্যে ইহা বিস্তার লাভ করে। সমাজের অধিকাংশ লোকের মধ্যে যদি এই দোষগুলি বিস্তার লাভ করে। সমাজের অধিকাংশ লোকের মধ্যে যদি এই দোষগুলি বিস্তার লাভ করে তাহা হইলে তাহা দ্বারা শিল্পকলা, সাহিত্য, আমোদ-প্রমোদ, খেলাধুলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ব্যবসায়-বানিজ্য, সামাজিকতা, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচারালয়, সামরিক পরিচর্যা, দেশ পরিচালনা প্রভৃতি সকল কিছুই বিপন্ন ও অচল হইয়া পড়িবে। বিশেষ করিয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থামতে ব্যক্তিবর্গের এক একটি নৈতিক বৈশিষ্ট্য তো সমগ্র জাতির জীবনে প্রতিফলিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে জাতির অধিক সংখ্যক লোকের মধ্যে কোন স্থিরতা ও দৃঢ়তা নাই এবং যে জাতির অধিকাংশ লোক বিশ্বস্ততা, ত্যাগ, আত্মসংযম প্রভৃতি গুণাবলী হইতে বঞ্চিত থাকে, তাহাদের রাজনীতিতেই বা স্থিতিশীলতা আসিবে কোথা হইতে?
৩. ব্যভিচারকে বৈধ বলিয়া স্থান দেওয়ার সংগে সংগে সমাজের ব্যভিচারবৃত্তি প্রচলিত রাখাও আবশ্যক হইয়া পড়ে। যে ব্যক্তি বলে যে, একজন যুবকের চিত্ত বিনোদনের অধিকার আছে, সে সংগে সংগে ইহাও স্বীকার করিয়া লয় যে, সমাজে বেশ কিছু সংখ্যক এমন নারীর প্রয়োজন আছে, যাহারা সর্বদিক হইতে অতীব নীচ ও হীন জীবন যাপন করিবে। এখন প্রশ্ন হইতেছে যে, এই সকল নারী কোথা হইতে আসিবে? ইহারা অবশ্য অবশ্য সমাজেরই লোক হইবে। ইহারা সমাজের কোন না কোন ব্যক্তির কন্যা অথবা ভগ্নিই হইবে। যাহারা এক-একটি গৃহের অভিনেত্রী, এক-একটি পরিবারের প্রতিষ্ঠাত্রী এবং কত শিশু সন্তানের অভিভাবক হইতে পারিত, এমন লক্ষ লক্ষ নারীকে সমাজচ্যুত করিয়া হাটে-বাজারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিতে হইবে যেন সেগুলি মিউনিসিপ্যালিটির প্রস্রাবখানার ন্যায় লম্পট প্রকৃতির পুরুষদের মলত্যাগের মহলরূপে গড়িয়া উঠিতে পারে। ইহার দ্বারা যেন নারীদের যাবতীয় সম্ভ্রমসুলভ বৈশিষ্ট্য হরণ করা যাইতে পারে এবং তাহাদিগকে রূপ-যৌবন বিক্রয়ের শিক্ষা দেওয়া যাইতে পারে। উপরন্তু তাহাদিগকে যেন এমনভাবে প্রস্তুত করা যায়, যাহাতে স্বীয় প্রেম, দেহ-মন, আপন সৌন্দর্য ও কমনীয়ভংগী প্রতি মূহুর্তে নুতন নুতন ক্রেতার নিকটে বিক্রয় করিতে পারে এবং কোন ফলপ্রসু সেবার পরিবর্তে আজীবন অপরের কাম-লালসা চরিতার্থকরণের জন্য ক্রীড়ানক হইয়া পড়ে।
৪. ব্যভিচারকে বৈধ বলিয়া গ্রহণ করিলে বিবাহের তামাদ্দুনিক রীতিনীতি নষ্ট হইয়া যায়। পরিণামে বিবাহের পরিবর্তে সমাজের সর্বত্র শুধু ব্যভিচারই রহিয়া যায়। এই সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, ব্যভিচার-মনা নারী-পুরুষের মধ্যে সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন যাপনের যোগ্যতা খুব কমই থাকে। কারণ দূরভিসন্ধি, হীনমন্যতা, সম্ভোগ-লালসা ও উচ্ছৃংখল প্রকৃতি এই পদ্ধতিতে সৃষ্টি হয় এবং এই ধরণের লোকের মধ্যে কামনা-বাসনার অস্থিরতা এবং কুপ্রবৃত্তির দমণের দুর্বলতা জন্মে। ইহা ঐ সকল গুনাবলীকে সমূলে বিনষ্ট করিয়া দেয় যাহা একটি সার্থক দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রয়োজন হয়। তাহারা যদি দাম্পত্যবন্ধনে আবদ্ধও হয়, তাহা হইলে তাহাদের মধ্যে সেই মধুর ব্যবহার, সংযোগ, পারস্পরিক বিশ্বাস, স্নেহ-হৃদ্যতার সম্পর্ক কখনই সুদৃঢ় হইবে না- যাহার ফলে সুসন্তান লাভ হইতে পারে এবং একটা আনন্দমুখর পরিবার গড়িয়া উঠিতে পারে। আবার যেখানে ব্যভিচারের পথ সুগম হয়, সেখানে বিবাহের তামাদ্দুনিক নীতি বলবৎ থাকা কার্যত মোটেই সম্ভব নহে। কারণ দায়িত্ব গ্রহণের পরিবর্তে কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার সুযোগ যাহাদের হইবে, তাহাদের এমন কি প্রয়োজন আছে যে, তাহারা আপন স্কন্ধে গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করিবে?
৫. ইহা প্রমাণ করা হইয়াছে যে, ব্যভিচারের বৈধতা ও প্রচলন দ্বারা শুধু তমদ্দুনের মূলোৎপাটনই হয় না; বরং মানব বংশেরই মূলচ্ছেদ করা হয়। অবাধ যৌনসম্পর্কের ফলে নারী-পুরুষ কাহারও মধ্যে এই ইচ্ছা হয় না এবং হইতেও পারে না যে, সে মানব জাতির স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তার জন্য কিছু করে।
৬. ব্যভিচারের দ্বারা সমাজ ও মানব জাতির জন্য সন্তান লাভ হইলে তাহা অবৈধ সন্তানই হয়। বংশের মধ্যে বৈধ-অবৈধ সন্তানের পার্থক্যকরণ নিছক ভাবপ্রবণতাপ্রসূত নহে- যদিও কিছু সংখ্যক নির্বোধ তাহাই মনে করে- প্রকৃতপক্ষে অনেক দিক দিয়া অবৈধ সন্তান উৎপাদন করা স্বয়ং সেই সন্তানের এবং সমগ্র মানবীয় সভ্যতার প্রতি নির্মম অবিচার করা হয়। প্রথমত পিতামাতা যখন একটা পাশবিক প্রবৃত্তিতে মত্ত হয়, তখনই সন্তান গর্ভস্থ হয়। একটি বিবাহিত দম্পতির মধ্যে যৌনক্রিয়ার সময়ে যে পবিত্র মানবীয় ভাবের উদয় হয়, তাহা অবৈধ যৌনসংমিলনকালে কখনই সম্ভব হয় না। একটা নিছক পাশবিক যৌন-উন্মত্ততাই উভয়কে সংমিলিত করে এবং সেই সময়ে যাবতীয় মানবিক বৈশিষ্ট্য উভয়কে সংমিলিত করে এবং সেই সময়ে যাবতীয় মানবিক বৈশিষ্ট হইতে তাহারা দূরে থাকে। এইরূপ অবৈধ সন্তানকে ‘স্বাগতম’ জানাইবার জন্য না তাহার মাতা, না তাহার পিতা প্রস্তুত থাকে। সে একটি ইপ্সিত বস্তু নহে; বরং পিতা-মাতার নিকটে গলগ্রহ অথবা অবাঞ্চিত বিপদ স্বরূপ। পিতার স্নেহ-বাৎসল্য ও সাহায্য-সহানুভূতি হইতে সে বঞ্চিত হয়। শুধুমাত্র মায়ের এক তরফা প্রতিপালনই তাহার ভাগ্যে জোটে এবং তাহাও অসন্তোষ ও আন্তরিকতাবিহীন উচ্ছ্বাস-উদ্যমের সহিত। দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা, মামা এবং পরিবারের অন্যান্য পরময়াত্মীয়ের আদর প্রতিপালন হইতে সে হয় বঞ্চিত। এইরূপ সন্তান স্বভাবতই সর্ববিধ অবস্থাতেই ত্রুটিযুক্ত ও অপূর্ণ মানবরূপেই গড়িয়া উঠে। না ইহার কোন সঠিক চরিত্র গঠন হইতে পারে, না পারে ইহার কোন প্রতিভার বিকাশ হইতে। সে উন্নতি ও কার্যকুশলতার উপায়-উপাদান পাইতে পারে না। সে স্বয়ং অপূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত, উপকরণহীন, বন্ধুহীন, সহায়-সম্বলহীন ও মযলুম হইবে এবং সে বৈধ সন্তান হিসাবে তমদ্দুন গঠনে যতখানি উপযোগী হইতে পারিত, এমতাবস্থায় ততখানি কখনই হইতে পারিবে না।
অবৈধ যৌনক্রিয়ার সমর্থকরা বলে যে, সন্তানগণের প্রতিপালন ও শিক্ষার জন্য একটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হওয়া উচিত। সন্তানের পিতা-মাতা তাহাকে অবাধ যৌনসম্পর্ক দ্বারা জন্মদান করিবে এবং তামাদ্দুনিক সেবার উপযোগী করিয়া লালন-পালনের জন্য তাহাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ছাড়িয়া দিবে। তাহাদের এই ধরনের প্রস্তাব করিবার উদ্দেশ্য এই যে, ইহার দ্বারা নারী-পুরুষের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র সংরক্ষিত হইবে। উপরন্তু যৌন প্রবৃত্তির পশ্চাতে সন্তানের জন্মদান ও তাহার প্রতিপালনের যে বাসনা রহিয়াছে, তাহাও বিবাহ ব্যতিরেকেই চরিতার্থ হইবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বর্তমান বংশধরদের জন্য এমন একজাতীয় শিক্ষা ও সরকারী প্রতিপালন ব্যবস্থার প্রস্তাব করিতেছে যে, তাহার ফলে স্বাতন্ত্রের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের উন্নতি সাধনের কোনই উপায় নাই। যে পদ্ধতিতে একই সংগে লক্ষ লক্ষ সন্তানকে একই আদর্শে, একই নিয়মে এবং একই ঢঙে গঠন করা হইবে, সেখানে সন্তানদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের ষ্ফূরণ কখনই সম্ভব নহে। এখানে তো তাহাদের মধ্যে বড় জোর কৃত্রিম সমতা সৃষ্টি করত তাহাদিগকে একই রকম করিয়া গড়িয়া তোলা হইবে। এই কারখানা হইতে সন্তানগণ একই ধরনের ব্যক্তিত্বসহ বাহির হইবে, যেমন কোন বিরাট ফ্যাক্টরী হইতে লৌহখন্ডগুলি একই ছাঁচে তৈরী হইয়া আসে। চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয় যে, মানুষ সম্পর্কে এই সকল নির্বোধ লোকদের ধারণা কত নীচ ও জঘন্য! ইহারা মানব সন্তানকে বাটা কোম্পানীর জুতার ন্যায় গড়িতে চায়। ইহা তাহাদের নিকট অজ্ঞাত যে, সন্তানের ব্যক্তিত্ব গড়িয়া তোলা একটি অতি সূক্ষশিল্প (art) বিশেষ। এই শিল্প একটি ক্ষুদ্র চিত্রালয়েই সম্পাদিত হইতে পারে-যেখানে প্রত্যেক চিত্রকরের দৃষ্টি একটি চিত্রের প্রতি নিবদ্ধ থাকে। একটি কারখানায়, যেখানে ভাড়াটিয়া মজুর এক ধরনের লক্ষ লক্ষ চিত্র তৈরী করে, সেখানে সন্তান প্রতিপালনের মত সূক্ষ শিল্পের বিকাশ সাধনের পরিবর্তে তাহার ধ্বংসই হইবে।
অতপর জাতীয় শিক্ষার ব্যাপারে এমন কর্মীবৃন্দের প্রয়োজন হইবে, যাহারা সমাজের পক্ষ হইতে সন্তানদের প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করিবে। প্রকাশ থাকে যে, এই কার্যের জন্য ঐ কর্মীই উপযোগী হইতে পারে, যাহারা স্বীয় ভাবপ্রবণতা ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করিতে পারে এবং যাহাদের মধ্যে নৈতিক সংযম-সংবরণ দেখিতে পাওয়া যায়। নতুবা তাহারা সন্তানদের মধ্যে সংযম-সংবরণ সৃষ্টি করিবে কেমন করিয়া? এখন প্রশ্ন এই যে, এই ধরনের লোক কোথা হইতে আমদানী করা হইবে? তাহারা তো জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এই জন্যই কায়েম করিতে চাহে যে, নারী-পুরুষকে তাহাদের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য বল্গাহীন করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইবে। এইভাবে যখন সমাজ হইতে সংযম-সংবরণ প্রবৃত্তি দমনের শক্তিই অংকুরে বিনষ্ট করা হইল, তখন অন্ধের পল্লীতে চক্ষুষ্মান কোথায় পাওয়া যাইবে, যে নূতন বংশধরকে পথে দেখিয়া চলিতে শিক্ষা দিবে?
৭. স্বার্থান্ধ পুরুষ ব্যভিচারের দ্বারা যে নারীকে সন্তানের মাতা করিয়া দেয়, সে নারীর জীবন চিরদিনের জন্য ধ্বংস হইয়া যায়। জনগণের পক্ষ হইতে লাঞ্ছনা ও ঘৃণা এবং বিপদের পাহাড় তাহার উপরে এমনভাবে ভাঙ্গিয়া পড়ে যে, সমগ্র জীবনব্যাপী সে ইহার দ্বরা নিষ্পেষিত হইতে থাকে। আধুনিক নৈতিক আদর্শ এইরূপ সমাধান পেশ করিতেছে যে, সকল প্রকার মাতৃত্বকে একসমান দেখিতে হইবে। সে মাতৃত্ব বিবাহের মাধ্যমে হউক অথবা অন্য উপায়ে হউক। বলা হয় যে, সকল অবস্থাতেই মাতৃত্ব শ্রদ্ধার পাত্র। আরও বলা হয় যে, সরলতার কারণে অথবা অসাবধানতাবসত যে নারী মাতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে, তাহাকে অভিশপ্ত ও কলংকিত করা সমাজের পক্ষ হইতে তাহার প্রতি এক বিরাট অবিচার। কিন্তু এই সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, ইহার দ্বারা ব্যভিচারী নারীর যতই সুবিধা হউক না কেন, সমাজের জন্য সামগ্রিকভাবে ইহা এক বিরাট বিপর্যয়। সমাজ একটি অবৈধ সন্তানকে স্বভাবতই যে ঘৃণা ও লাঞ্ছনার চক্ষে দেখে, তাহা একদিকে নর-নারীর পাপ ও দুষ্কর্মের বিরাট প্রতিবন্ধক স্বরূপ এবং অপরদিকে ইহা সমাজের মধ্যে নৈতিক অনুভূতির জাগ্রত রাখিবার নিদর্শন বিশেষ। যদি বৈধ এবং অবৈধ সন্তানের মাতাকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়, তাহা হইলে তাহার অর্থ এই হইবে যে, সমাজ হইতে মংগল-অমংগল, ভাল-মন্দ ও পাপ-পূণ্যের তারতম্য দূরীভূত হইয়াছে। দ্বিতীয় কথা এই যে, যদি তাহাই হয়, [অর্থাৎ বৈধ-অবৈধ সন্তানের মাতাকে সমান মর্যাদায় ভূষিত করা হয়] তবুও অবৈধ সন্তানের মাতাকে যে সকল অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হইবে তাহার কি সমাধান ইহার দ্বারা হইবে? নূতন দৃষ্টিভংগীর বাহকগণ উভয় মাতাকে সমান মনে করিলেও প্রকৃতি ইহাদিগকে কখনঅ সমান মনে করিবে না এবং প্রকৃতপক্ষে উভয়েই কোন দিনও সমান মর্যাদা লাভ করিতে পারে না। ইহাদের সাম্য, বুদ্ধি-বিবেক, যুক্তি, ন্যায় ও সত্যের বিপরীত। যে নির্বোধ নারী যৌন-আবেগের সাময়িক উত্তেজনায় বশীভূত হইয়া নিজের দেহকে এমন এক স্বার্থান্ধ পুরুষের অধীন করিয়া দিল যে, তাহার এবং সন্তানের প্রতিপালনের কোন দ্বায়িত্বই সে গ্রহণ করিতে রাজী নহে, সে নারী ঐ বুদ্ধিমতী নারীর সমান কেমন করিয়া হইতে পারে, যে একজন সম্ভ্রান্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে স্বামীরূপে না পাওয়া পর্যন্ত তাহার যৌবনের আবেগ-অনুভূতিকে সংযত রাখিয়াছে? কোন বুদ্ধি-বিবেক এই উভয় নারীকে এক সমান মনে করিবে? উভয়েই সমান করিবার এক প্রদর্শনী করা যাইতে পারে কিন্তু যে ভরণ-পোষণ, সংরক্ষণ, সহানুভূতিসম্পন্ন আচরণ, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসার দৃষ্টি, শুভাকাংখা, শান্ত ও স্থৈর্য একটি বিবাহিতা নারী লাভ করে, তাহা ঐ নির্বোধ ব্যভিচারিণী কোথা হইতে লাভ করিবে? তাহার অবৈধ সন্তানের জন্য পিতার স্নেহ এবং পৈত্রিকগোষ্ঠীর স্নেহ-ভালবাসা কোন বাজার হইতে আমদানী করা যাইবে? বড় জোর আইনের বলে তাহাকে আর্থিক সাহায্য করা যাইতে পারে! কিন্তু পৃথিবীতে একটি মাতা ও সন্তানের শুধু কি অর্থেরই প্রয়োজন হয়? অতএব ইহা সত্য যে, বৈধ ও অবৈধ মাতৃত্বকে সমান অধিকার দিলে পাপাচারীদের বাহ্যিক সান্ত্বনা যতই হউক না কেন, ইহা তাহাদিগকে তাহাদের নির্বুদ্ধিতার বিষময় পরিণাম হইতে এবং অবৈধ সন্তানদিগকে জন্মগত স্বাভাবিক ক্ষতি হইতে রক্ষা করিতে পারে না।
উপরিউক্ত কারণে সামাজিক জীবনের প্রতিষ্ঠা ও তাহার পরিষ্ফুরণের জন্য ইহা একান্ত অপরিহার্য যে, সমাজে যৌনকার্যের প্রসার একেবারে বন্ধ করিয়া দিতে হইবে এবং যৌবনাবেগ প্রশমিত ও চরিতার্থ করিবার একটি মাত্র পথ উন্মুক্ত রাখিতে হইবে। তাহা হইতেছে দাম্পত্য জীবনের পথ। নর-নরীকে ব্যভিচারের স্বাধীনতা দেওয়ার অর্থ তাহাদিগকে অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়া এবং সমাজের প্রতি শুধু অবিচার করাই নহে, উহাকে হত্যা করা। যে সমাজ এই বিষয়টিকে তুচ্ছ মনে করে ও ব্যভিচারকে নিছক একটি আনন্দ মুহুর্ত (Having a good time) মনে করিয়া উপেক্ষা করিয়া চলিতে চায় এবং অবাধ বীজ বপনের (Sowing wild oats) প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করিতে চায়, তাহা প্রকৃতপক্ষে একটি অজ্ঞ সমাজ। সে স্বীয় অধিকার সম্পর্কে সচেতন নহে। সে নিজেই শত্রুতা সাধন করে। যদি সে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং অনুধাবন করিতে পারে যে, যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে সামাজিক স্বার্থের উপরে ব্যক্তি স্বাধীনতার কি বিষময় প্রতিক্রিয়া হয়, তাহা হইলে সে চুরি, ডাকাতি, হত্যা প্রভৃতিকে যেমন মনে করে, ইহাকেও তেমন মনে করিবে; বরং চুরি-ডাকাতি হইতে অধিকতর মারাত্মক মনে করিবে। চোর, ডাকাত এবং হত্যাকারী বড় জোর এক ব্যক্তি অথবা কতিপয় ব্যক্তির ক্ষতি করে কিন্তু ব্যভিচারী গোটা সমাজ এবং ভবিষ্যত বংশধরগণের উপরে ডাকাতি করে। একই সময়ে সে লক্ষ-কোটি মানবের ধন অপহরণ করে। তাহার অপরাধের পরিমাণ অন্যান্য অপরাধ হইতে অধিকতর সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। ইহা যখন সর্বজনস্বীকৃত যে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেহ কাহারও উপরে হস্তক্ষেপ করিলে তাহার বিরুদ্ধে সমাজের সাহায্যের জন্য আইনের বলপ্রয়োগ সমীচীন হয় এবং যখন ইহার ভিত্তিতে চুরি, হত্যা, লুন্ঠন, প্রবঞ্চনা ও পরস্বপহরণের অন্যান্য উপায়গুলিকে অপরাধ মনে করিয়া শাস্তি বিধানের দ্বারা তাহার পথ রুদ্ধ করা হয়, তখন দেশের আইন সমাজের রক্ষক হইয়া ব্যভিচারকে শাস্তিমূলক অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করিবে না-ইহার কোনই কারণ নাই।
আদর্শের দিক দিয়াও ইহা সুস্পষ্ট যে, বিবাহ এবং ব্যভিচার একই সময়ে একটি সামাজিক ব্যবস্থার অংশ হইতে পারে না। যদি এক ব্যক্তির জন্য বিবাহ ব্যতিরেকে যৌনপ্রবৃত্তি প্রশমিত করা বৈধ করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই একই কার্যের জন্য আবার অপরের জন্য বিবাহ বিধির প্রচলন অর্থহীন। ইহার দৃষ্টান্ত ঠিক এইরূপ যে, রেলগাড়ীতে বিনা টিকেটে ভ্রমণ করা বৈধ ঘোষণা করিয়া সংগে সংগে টিকিট বিক্রয়ের ব্যবস্থাও চালু রাখা হইয়াছে। কোন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি এই উভয় ব্যবস্থাকে একই সংগে গ্রহণ করিতে পারে না। যুক্তিসংগত ব্যবস্থা এই যে, টিকেট বিক্রয়ের প্রথা একেবারে রহিত করিতে হইবে। কিন্তু যদি ইহা চালু রাখিতে হয়, তাহা হইলে বিনা টিকিটে ভ্রমণ অপরাধজনক ঘোষণা করিতে হইবে। তদ্রুপ বিবাহ এবং ব্যভিচার সম্পর্কেও উভয়ের প্রয়োগ এক অন্যায় ও অসংগত ব্যাপার। যদি তমদ্দুনের জন্য বিবাহ ব্যবস্থা আবশ্যক মনে করা হয়-যেমন ইতিপূর্বে ইহা যুক্তিদ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে-তাহা হইলে ব্যভিচারকে অপরাধ বলিয়া ঘোষণা করা একান্ত আবশ্যক হইবে।*
অজ্ঞতার ইহা এহ সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য যে, যে সকল বিষয়ের পরিণাম অতি সীমাবদ্ধ হয় এবং অল্পকাল মধ্যে প্রকাশ হইয়া পড়ে, শুধু তাহাই উপলব্ধি করা হয়। কিন্তু যাহার পরিণাম ব্যাপক ও সুদূঢ় প্রসারী হওয়ার কারণে অনুভব করা যায় না এবং বলম্বে ফল প্রকাশিত হয়, তাহার কোন গুরুত্বই দেওয়া হয় না-ইহার প্রতি কোন মনোযোগই দেওয়া হয় না। চুরি, ডাকাতি, হত্যা প্রভৃতির ব্যাপারে গুরুত্বদান এবং ব্যভিচারের ব্যাপারে কোন গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ ইহাই। যে ব্যক্তি তাহার গৃহে প্লেগের ইঁদুর জমা করিয়া রাখে অথবা সংক্রামক ব্যাধি ছড়ায়, বর্বর সমাজও তাহাকে ক্ষমার পাত্র মনে করে না। কারণ তাহার কার্য প্রকাশ্যভাবে ক্ষতিকারক দেখায়। কিন্তু যে ব্যভিচারী তাহার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তমদ্দুনের মূল কর্তন করে, সে অজ্ঞ বর্বরদের নিকটে সকল প্রশ্রয় লাভ করে। কারণ তাহার দ্বারা যে ক্ষতি হয়, তাহা যুক্তি সংগত হইলেও অনুভূত হয় না। অতএব অজ্ঞদের মস্তিস্কে ইহা প্রবেশই করে না যে, ব্যভিচারের মধ্যে অপরাধজনক কার্য কি হইতে পারে। যদি তামাদ্দুনিক ভিত্তি বর্বরতার পরিবর্তে বিবেক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহা হইলে এই পদ্ধতি কখনই গৃহীত হইবে না।
৪. অশ্লীলতার প্রতিরোধ পদ্ধতি
তমদ্দুনের জন্য ক্ষতিকারক বিষয়কে বন্ধ করিবার জন্য তাহাকে আইনত অপরাধ ঘোষণা করত তাহার জন্য একটা শাস্তির ব্যবস্থাই যথেষ্ট হইবে না; বরং এতদসহ চারিপ্রকার পদ্ধতি অবলম্বন করিতে হইবে। যেমনঃ
ক) শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে মানুষের এতখানি মানসিকতার সংস্কার সাধন করিতে হইবে যেন সে স্বয়ং উক্ত কার্যকে ঘৃণার চক্ষে দেখে, ইহাকে পাপকার্য মনে করে; তাহার নৈতিক চেতনা তাহাকে যেন উক্ত পাপকার্য হইতে বিরত রাখে।
খ) এই পাপকার্যের বিরুদ্ধে সামাজিক চরিত্র ও জনমত এমনভাবে গঠন করিতে হইবে যেন জনসাধারণ
১.একটি সাধারণ বিকৃত ধারণা রহিয়াছে যে, বিবাহের পূর্বে একটি যুবকের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার কোন না কোন সুযোগ থাকা উচিত। কারণ যৌবনে কামভাব দমন করা কঠিন এবং দমন করিলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। কিন্তু যে সকল সূত্র হইতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে তাহা সকলই ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে কামপ্রবৃত্তির আবেগ দমন করা যায় না,তাহা এক অস্বাভাবিক ব্যাপার [abnormal] এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি এই কারণে হয় যে, একটা ভ্রান্ত তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা জোর করিয়া তাহাকে উত্তেজিত করে। আমাদের সিনেমা, সাহিত্য, চিত্রকলা, নৃত্য-সংগীত এবং নারী-পুরুষের এই মিশ্র সমাজে সাজ-সজ্জায় ভূষিতা নারীদের অবাধ সংস্পর্শলাভই স্বাভাবিক মানুষকে অস্বাভাবিক যৌনপ্রবণ করিয়া তুলিবার কারণ। নতুবা একটা শান্ত ও পূণ্যপূত আবহাওয়ায় সাধারণ নারী-পুরুষের মধ্যে এমন এক যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি হইতেই পারে না যাহা মানসিকতা ও নৈতিক শিক্ষার ফলে দমন করা যায় না। যৌবনে যৌনক্রিয়া না করিলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, অতএব স্বাস্থ্যের জন্য ব্যভিচার বিধেয়-এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতা, উভয়ের সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন যে, সমাজের যে সব ভ্রান্ত ব্যবস্থা এবং বিলাসবহুল জীবনের যে সব ভ্রান্ত মানের কারণে বিবাহ কঠিন এবং ব্যভিচার সহজ হইয়া পড়িয়াছে, তাহার পরিবর্তন করিতে হইবে।
উহাকে অপরাধ ও লজ্জাজনক কাজ মনে করে এবং উহাকে এমন ঘৃণার চক্ষে দেখে যেন জনমত ও ঐ সকল লোককেও উক্ত পাপকাজ হইতে বিরত রাখিতে পারে-যাহাদের শিক্ষা অসম্পুর্ণ রহিয়াছে অথবা যাহাদের নৈতিক চেতনা দুর্বল রহিয়াছে।
গ) যে সকল উপায়-উপাদান মানুষকে এই পাপকার্যে প্ররোচিত ও প্রলুব্ধ করে, তামাদ্দুনিক ব্যবস্থার মধ্যে সে সমুদয়ের পথ করিয়া দিতে হইবে। এতদসহ যে সকল উপায়-উপাদান মানুষকে পাপকার্য করিতে বাধ্য করে, যথাসম্ভব তাহারও মূলোৎপাটন করিতে হইবে।
ঘ) তামাদ্দুনিক জীবনে এই পাপকার্যের বিরুদ্ধে এমন কতকগুলি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করিতে হইবে যে, কোন ব্যক্তি উক্ত পাপকার্য করিতে ইচ্ছা করিলেও যেন তাহা সহজে করিতে না পারে।
বিবেক উপরিউক্ত চারিটি পদ্ধতির সত্যতা ও আবশ্যকতার সাক্ষ্য দেয় এবং প্রকৃতিই ইহাই দাবী করে। কার্যত সমগ্র দুনিয়ার কার্যপদ্ধতিও ইহাই যে, সামাজিক আইন যে সকল বিষয়কে অপরাধরূপে গণ্য করিয়াছে, তাহা বন্ধ করিবার জন্য শাস্তির ব্যবস্থার সংগে সংগে এই চারি প্রকারের ব্যবস্থাও অবলম্বন করা হইয়া থাকে। এখন যদি ইহা স্বীকৃত হয় যে, যৌন সম্পর্কের প্রসার তমদ্দুন ধ্বংস করে এবং সমাজের পরিপন্থী একটা বিরাট অপরাধ সংগঠিত করে, তাহা হইলে অবশ্যম্ভাবীরূপে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, ব্যভিচারের পথ রুদ্ধ করিতে শাস্তি বিধানের সংগে সংগে উপরে বর্ণিত সকল প্রকার সংস্কারমূলক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। ইহার জন্য জনগণের শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। জনগণকে বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন করিয়া তুলিতে হইবে। যে সকল বিষয় মানুষের মধ্যে যৌন-উত্তেজনা সৃষ্টি করা তাহাও তামাদ্দুনিক সীমারেখা হইতে দূরীভূত করিতে হইবে। বিবাহের ব্যপারে যে সকল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, সামাজিক ব্যবস্থা হইতে তাহাও দূর করিয়া দিতে হইবে। নারী-পুরুষের পারস্পরিক মেলামেশার উপরেও এতখানি বাধা-নিষেধ আরোপ করিতে হইবে যে, যদি কেহ বৈবাহিক সম্পর্ক ব্যতিরেকে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করিতে চায়, তাহা হইলে সে পথ যেন রুদ্ধ করা হয়। ব্যভিচারকে পাপ এবং অপরাধ স্বীকার করার পর কোন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি এই সকল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করিতে পারিবে না।
যে সকল নৈতিক ও সামাজিক মূলনীতিকে ভিত্তি করিয়া ব্যভিচারকে পাপ বলিয়া গণ্য করা হইয়াছে, তাহা একদল স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁহাদের হঠকারিতা এই যে, ব্যভিচারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ও প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থাদির পরিবর্তে শুধু সংস্কারমূলক ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করা উচিত। তাঁহারা বলেন, “শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এমন আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগ্রত করিয়া দাও, তাহাদের মনের দাবী ও নৈতিক চেতনাকে এতখানি জোরদার করিয়া দাও, যেন ইহা আপ্না-আপনি বন্ধ হইয়া যায়। নতুবা আধ্যাত্মিক সংস্কার-সংশোধনের পরিবর্তে শাস্তিমূলক ও প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করার অর্থ এই হইবে যে, তোমরা মানুষের সংগে শুধু শিশুসূলভ আচরণই করিতেছনা; বরং মানবতার অপমান করিতেছ।”
আমরাও এতখানি স্বীকার করি যে, মানবতার সংস্কার-সংশোধনের পথ ইহাই। প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার শেষ প্রান্ত ইহাই যে, মানবের অন্তরে এমন এক শক্তির সৃষ্টি হয়, যাহার দ্বারা সে নিজে নিজেই সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার সম্মান করিতে থাকে এবং তাহার মন তাহাকে নৈতিক বন্ধন ছিন্ন করা হইতে বিরত রাখে। এই উদ্দেশ্যেই মানুষের শিক্ষার জন্য সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, আমাদের সভ্যতা কি প্রকৃতপক্ষে সেই প্রান্তে উপনীত হইয়াছে? সাধারণ ও নৈতিক শিক্ষার দ্বারা মানবকুলকে কি এতখানি পরিমার্জিত করা হইয়াছে যে, তাহার আধ্যাত্মিকতার উপরে নির্ভর করা যাইতে পারে এবং সামাজিক ব্যবস্থার সংরক্ষণকল্পে প্রকাশ্য কোন শাস্তিমূলক ও প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থার আবশ্যকতা নাই? অতীত যুগের কতা ছাড়িয়া দিন। ইহা তো তাঁহাদের ভাষায় ‘অন্ধযুগ’। এই বিংশ শতাব্দী-এই ‘জ্যোতির্ময় যুগ’ সম্মুখে বর্তমান রহিয়াছে। এই যুগে ইউরোপ এবং আমেরিকার মত সভ্য দেশগুলির দিকে দৃস্টিপাত করুন। তাহাদের প্রত্যেকেই শিক্ষিত। নাগরিকগণ উচ্চশিক্ষায় গর্বিত। কিন্তু সেখানে কি শিক্ষা ও আধ্যাত্নিক সংস্কার অপরাধ ও আইনভংগ বন্ধ করিয়া দিয়াছে? সেখানে কি চুরি-ডাকাতি হয় না? ধোকা, প্রবঞ্চনা, অত্যাচার-আনাচারের ঘটনা কি সংটিত হয় না? সেখানে কি পুলিশ, বিচারালয়, কারাগার, সাংস্কৃতিক খতিয়ান ও হিসাব-নিকাশের কোন প্রয়োজন হয় না? সেখানে কি জনগণের মধ্যে এমন নৈতিক দায়িত্বানুভূতি সৃস্টি হইয়াছে যে, এখন আর তাহাদের সংগে ‘শিশু সুলভ’ আচরণ করা হয় না? যদি ঘটনা তাহা না হয়, যদি এই সভ্যযুগেও সমাজের আইন-শৃংখলাকে শুধুমাত্র জনগণের নৈতিক চেতনার উপর ছাড়িয়া দেওয়া না যায়, যদি এখনও প্রত্যেক স্থানেই অপরাধ বন্ধ করিবার জন্য শাস্তিমূলক ও প্রতিরোধমূলক উভয় প্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন দ্বারা ‘মানবতার অপমান’ করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহার কি কারণ হইতে পারে যে, শুধু যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে ‘মানবতার অপমান’ অসহ্য হইয়া পড়িয়াছে? শুধু এই একটি ব্যাপারে ‘মানবতার অপমান’ অসহ্য হইয়া পড়িয়াছে? শুধু এই একটি ব্যাপারে এই সকল ‘শিশুদের’ সহিত ‘বয়োজ্যেষ্ঠদের’ ন্যায় ব্যবহার করিবার জন্য এত হঠকারিতা চলিতেছে কেন? একটু গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখুন, ইহাদের মনের কোণে কোন ধরনের চোর লুকাইয়া আছে।
বলা হয় যে, যে সকল বিষয়কে যৌন-উত্তেজক মনে করিয়া তমদ্দুনের সীমাবহির্ভুত করা হইতেছে তাহা তো শিল্প এবং সৌন্দর্যস্বাদের প্রাণস্বরূপ এই সকল পরিহার করিলে তো মানব-জীবনের সৌন্দর্য- উৎসই শুস্ক হইয়া যাইবে। অতএব তমদ্দুনের সংরক্ষণ এবং সামাজিক সংস্কারের জন্য কিছু করিতে চাহিলে তাহা এমনভাবে করা উচিত যাহাতে চারুশিল্প এবং সৌন্দর্য সম্ভোগে কোন আঘাত না লাগে। আমরাও এই ভদ্রলোকদের সহিত এতটুকু একমত যে, শিল্প এবং সৌন্দর্য সম্ভোগ প্রকৃ্তই মূল্যবান বস্তু।ইহার সংক্ষণ ও উন্নয়ন বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সামাজিক জীবন এবং সামাজিক কল্যাণ সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। কোন শিল্প ও সম্ভোগের জন্য ইহা উৎসর্গ করা যাইতে পারে না। শিল্প ও সৌন্দর্যসম্ভোগের বিকাশ ও পরিস্ফুটন করিতে হইলে তাহার জন্য এমন পন্থা অবিস্কার করিতে হইবে যাহা সামাজিক জীবন ও তাহার কল্যাণের সমন্বয় সাধন করিতে পারে। যে শিল্প ও সৌন্দর্যসম্ভোগ জীবনের পরিবর্তে ধ্বংস এবং কল্যাণের পরিবর্তে বিপর্যয় আনয়ন করে, তাহাকে সামাজিক গন্ডির মধ্যে পরিস্ফুট হওয়ার সুযোগ কিছুতেই দেওয়া যাইতে পারে না। ইহা আমাদের কোন ব্যক্তিগত অথবা ঘরোয়া দৃষ্টিভংগী নহে;বরং ইহাই বিবেক ও প্রকৃ্তির দাবী।সমগ্র জগত ইহাকে নীতিগতভাবে স্বীকার করে এবং সর্বত্র ইহাকে কার্যকারী করা হয়। যে সকল বিষয়কে জগতে সামাজিক জীবনের জন্য ধ্বংসকারক ও বিপর্যয় সৃস্টিকারী মনে করা হয়, তাহাকে শিল্প ও সৌন্দর্যসম্ভোগের নাম করিয়া কোথাও প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। কোন সাহিত্য ভাঙন, দ্বন্দ্ব-কলহ, হত্যা-লুন্ঠন প্রভৃতির প্ররোচনা দিলে তাহাকে যেমন শুধু সাহিত্যের খাতিরে বরদাশ্ত করা হয় না, তেমনি কোন সাহিত্যের মাধ্যমে প্লেগ,কলেরা প্রভৃতি মারাত্মক ব্যাধি ছড়াইবার জন্য প্ররোচিত করিলে তাহাও কুত্রাপি সহ্য করা হয় না। যে সকল সিনেমা –থিয়েটার শান্তিভংগ ও বিদ্রোহের জন্য উত্তেজনা ছড়ায়, তাহাকে জগতের কোন গভর্নমেন্টই জনাসাধারণ্যে অভিনীত হওয়ার অনুমতি দেয় না। যে সকল চিত্রের মধ্যে অত্যাচার, দ্বন্দ্ব-কলহ ও অনাচারের আবেগ প্রকাশিত হয় কিংবা যাহার দ্বারা নৈতিকতার সর্বজন স্বীকৃ্ত আর্দশ ভংগ করা হয়, তাহা যতই শিল্প নৈপুণ্যের বাহক হউক না কেন, কোন আইন এবং কোন সমাজের বিবেক উহাকে সম্মানের চক্ষে দেখিতে প্রস্তুত নহে। পকেটমারা বিদ্যা যদিও একটি অতি সূক্ষ কৌশল বিশেষ এবং হাত সাফাইয়ের কলা-কৌশল চরমভাবে বিবেচিত হইলেও কোন মানুষই ইহার বিকাশ সাধন পসন্দ করে না। নোট, চেক ও দলিল-দস্তাবেজ জাল করিতে অসাধারণ মস্তিষ্ক শক্তি ও ণৈপুণ্যের প্রয়োজন হয় কিন্তু এই কলা-কৌশলকে কেহই বৈধ মনে করে না। প্রতারণা,জুয়াচুরি বিদ্যায় মানব মস্তিষ্ক স্বীয় উদ্ভাবনী শক্তির কত ধরনে কৃ্তিত্ব প্রদর্শন করিয়াছে। কিন্তু কোন সভ্যসমাজ এই সকল কৃ্তিত্বের সম্মান করিতে ভালবাসে না। ইহা এক স্বীকৃ্ত সত্য যে, সমাজ জীবন, উহার শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নতি ও মংগল যে কোন চারুশিল্প এবং সৌন্দর্যসম্ভোগ হইতে অধিকতর মূল্যবান। অতএব, কোন শিল্পের জন্য ইহাকে উৎসর্গ করা যায় না। অবশ্য এ বিষয়ে একমাত্র মতানৈক্যের বিষয় শুধু এই যে, যাহাকে আমরা সমাজ জীবন ও উহার মংগলের পরিপন্থী মনে করি, অপরে তাহা করে না। যদি তাহাদের দৃষ্টিভংগী আমাদের ন্যায় হইত তাহা হইলে তাহারাও আমাদের ন্যায় শিল্প ও সৌন্দর্যসম্ভোগকে নিয়ন্ত্রিত করার আবশ্যকতা অনুভব করিত।
ইহাও বলা হয় যে, অবৈধ যৌনসম্পর্ক বন্ধ করিবার জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা করা এবং সমাজে স্বাধীনভাবে চলাফেরা বন্ধ কর প্রকৃ্ত পক্ষে তাহাদের চরিত্রের উপর সন্দেহ সংশয় পোষণ করা। ইহার দ্বারা বুঝা যায় যেন সকল মানুষকেই চরিত্রহীন মনে করা হইল এবং তাহারা নারী-পুরুষের চরিত্র সম্পর্কে মোটেই আস্থাশীল নহে। ইহা বড়ই যুক্তিযুক্ত কথা। এই যুক্তিপদ্ধতিটি আর একটু প্রসারিত করুন। গৃহদ্বারে ব্যবহৃ তালা যেন ইহাই ঘোষণা করে যে,গৃহস্বামী পৃ্থিবীর সকল মানুষকেই চোর মনে করিয়াছে। পুলিশের অস্তিত্ব ইহাই সাক্ষ্য দিতেছে যে,গভর্নমেন্ট দেশের সকলকেই অসাধু মনে করন। টাকার আদান-প্রদানে যে চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়,তাহারও কারণ এই যে, একপক্ষ অপর পক্ষকে আত্মসাৎকারী মনে করে। অপরাধ বন্ধ করিবার জন্য যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, উহার দ্বারা যাহারাই প্রভাবিত হয়, তাহাদের সকলকেই সম্ভাব্য অপরাধী মনে করা হইয়াছে। এই যুক্তিপদ্ধতির দ্বারা তো আপ্নাকেও প্রতি মুহূর্তে চোর-বদমায়েশ,পরস্বপহারী এবং সন্ধিগ্ধ চরিত্র মনে করা হয়। কিন্তু ইহার দ্বারা তো আপনার আত্মসম্মানে এতটুকু আঁচও লাগে না। তবে ঐ একটি মাত্র ব্যাপারে আপনার অনুভূতি এত দুর্বল কেন?
উপরে যে বিষয়ের প্রতি ইংগিত করা হইয়াছে, আসলে ব্যাপার তাহাই। যাহাদের মনে প্রাচীন নৈতিক ধারণার জীর্ণপ্রভাব বিদ্যমান আছে, তাহারা ব্যভিচার এবং যৌন-অনাচারকে গর্হিত মনে করে। তবে এতখানি গর্হিত মনে করে না যে, উহা একেবারে নির্মূল করিতে হইবে। এই কারণে সংস্কার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের ব্যাপারে তাহাদের ও আমাদের দৃষ্টিভংগী পৃথক। যদি প্রাকৃতিক তথ্যাবলি তাহাদের নিকটে উদ্ঘটিত হয় এবং তাহারা এই ব্যাপারে সঠিক অবস্থা হৃদয়ংগম করিতে পারে, তাহা হইলে তাহারা আমাদের সহিত একমত হইবে যে, মানুষ যতক্ষণ মানুষ রহিয়াছে এবং যতক্ষণ উহার মধ্যে মনুষত্বের উপাদান বর্তমান আছে, ততক্ষণ সে তমদ্দুন মানবের কুপ্রবৃত্তি ও তাহার আনন্দসম্ভোগ অপেক্ষা সমাজ-জীবনের উন্নতি অধিকতর প্রিয় মনে করিবে, সে এই সকল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি উদাসীন হইতে পারে না।
৫।দাম্পত্য সম্পর্কের সঠিক অবস্থা
পারিবারিক ভিত্তিস্থাপন ও যৌন-উচ্ছৃংখলতার পথ রুদ্ধ করিবার পর একটি সৎ তমদ্দুনের জন্য যাহা অত্যাবশ্যক তাহা এইযে, সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সম্পর্কের সঠিক রুপ নির্ধারণ করিতে হইবে। ন্যায়পরায়ণতার সহিত তাহাদের অধিকার নিরুপিত করিতে হইবে। তাহাদের মধ্যে যথার্থভাবে দায়িত্ব ভাগ করিয়া দিতে হইবে। পরিবারের মধ্যে তাহাদের পদমর্যাদা এবং ভাতা এমনভাবে নির্ধারিত করিতে হইবে যেন মিতাচার ও সমতার মধ্যে কোন ব্যবধান না থাকে।তমদ্দুনের যাবতীয় সমস্যার মধ্যে এই সমস্যাটি বড় কঠিন। কিন্তু মানুষ ইহার সমাধান অধিকাংশ সময়ে ব্যর্থ হইয়াছে।
এমন কতক জাতি আছে যাহারা নারীকে পুরুষের উপর কর্তৃত্ব দিয়াছে। কিন্তু আমরা এমন একটি দৃষ্টান্তও দেখিতে পাই যে, এই সকল জাতির কোন একটি জাতি তাহযীব ও তমদ্দুনের কোন উন্নত শিখরে আরোহণ করিয়াছে। অন্ততপক্ষে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তো এমন কোন জাতির নামগন্ধ পাওয়া যায় না যাহারা নারীকে পুরুষের শাসক বানাইয়া পৃথিবীকে কোন শক্তি ও পদমর্যাদা লাভ করিয়াছে অথবা কোন উল্লেখযোগ্য কাজ করিয়াছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ জাতীই পুরুষকে নারীর উপর প্রাধান্য দিয়াছে। কিন্তু এই প্রাধান্য অধিকক্ষেত্রে অত্যাচারের রুপ ধারণ করিয়াছে, নারীকে দাসীতে পরিণত করিয়াছে। তাহাকে অপমানিত ও পদদলিত করা হইয়াছে। তাহাকে কোন প্রকার অর্থিক ও তামাদ্দুনিক অধিকার দেওয়া হয় নাই। তাহাকে পরিবারের একটা নগণ্য পরিচারিকারুপে এবং পুরুষের কামরিপু চরিতার্থের ক্রীড়নকরুপে ব্যবহার করা হইয়াছে। পরিবার বহির্ভূত একদল নারীকে কিছু পরিমাণ শিক্ষা ও সভ্যতার অলংকারে ভূষিত করা হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা একমাত্র এই জন্য যে, তাহারা যেন পুরুষের যৌন চাহিদা অধিকতর
হৃদয়গ্রাহী করিয়া পূর্ণ করিতে পারে। যেমন তাহারা স্বীয় সংগীত-কলার দ্বারা কর্ণস্বাদ, নৃত্য ও দেহভংগীর দ্বারা চক্ষুস্বাদ এবং পরম ও চরম যৌন-আবেদনের দ্বারা দৈহিকস্বাদে পরিণত হইতে পারে। ইহাই ছিল পুরুষের কুপ্রবৃত্তি কর্তৃক আবিষ্কৃত নারীত্বের অপমান ও লাঞ্ছার অতীব লজ্জাকর পন্থা। যে জাতি এই পন্থা অবলম্বন করিয়াছে, সে ধ্বংস রক্ষা পায় নাই।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা তৃতীয় এক পন্থা অবলম্বন করিয়াছে। তাহা হইতেছে এই যে, নারী-পুরুষের সমতা ও সমানাধিকার থাকিতে হইবে। উভয়ের দায়িত্ব অনুরুপ এবং প্রায় একই হইবে। উভয়ে একই কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করিবে, উভয়ে আপন আপন জীবিকা অর্জন করিবে এবং স্বাবলম্বী হইবে। সামাজিক ব্যবস্থার এই পদ্ধতি এখনও পূর্ণতা লাভ করিতে পারে নাই। কারণ এখনও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব সুস্পষ্ট। জীবনের কোন বিভাগে এখনও নারী-পুরুষ সমান হইতে পারে নাই। পরিপূর্ণ সাম্যের আকারে যে সমস্ত তাহার লাভ করা উচিত ছিল, তাহা সে এখনও লাভ করিতে পারে নাই। কিন্তু যতটুকু পরিমাণে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে, তাহার দ্বারা সে তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় একটা বিপর্যয়ই সৃষ্টি করিয়াছে। ইতিপূর্বে ইহার ফলাফল আমরা বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি। অতএব এখানে নূতন করিয়া কিছু মন্তব্য করা প্রয়োজন মনে করি না। এই বর্ণিত ত্রিবিধ প্রকারের তমদ্দুনই ন্যায়, মিতাচার ও সংগতি হইতে বঞ্চিত। কারণ তাহারা প্রকৃতির নির্দেশ হৃদয়ংগম করিতে এবং যথাযথভাবে তদনুযায়ী পন্থা অবলম্বন করিতে অবহেলা করিয়াছে। বিবেক-বুদ্ধি সহকারে গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিলে জানিতে পারা যাইবে যে, প্রকৃতি স্বয়ং এই সকলের সুষ্ঠু সমাধান দিয়াছে। বরং ইহাও প্রকৃতির একটা বিরাট শক্তি, যাহার প্রভাব নারী না ততখানি নীচতায় নামিয়া আসিতে পারে, যতখানি তাহাকে নামাইবার চেষ্টা করা হইয়াছে এবং না ততখানি উপরে উঠিতে পারে, যতখানি সে উঠিতে চাহিয়াছে অথবা পুরুষ তাহাকে তুলিবার চেষ্টা করিয়াছে। মানুষ তাহার ভ্রমান্ধ বিবেক ও আত্মপ্রবঞ্চনার দ্বারা পরিচালিত হইয়া দুই বিপরীত চরমপন্থা অবলম্ব করিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতি ন্যায়, মধ্যমপন্থা ও মিতাচার অবলম্বন করিতে ইচ্ছা করে এবং স্বয়ং ইহার পন্থা বলিয়া দেয়।
মানুষ হিসাবে নারী ও পুরুষ যে সমান, এ কথা কেহই অস্বীকার করিতে পারে না। নারী-পুরুষ মানবজাতির দুইটি অংশ।তমদ্দুন গঠনে, সভ্যতার ভিত্তিস্থাপন ও রূপায়ণে এবং মানবতার সেবায় উভয়ে সমান অংশীদার। মন-মস্তিষ্ক, বিবেক, অনুভূতি, প্রবৃত্তি ও মানবিক প্রয়োজন উভয়েরই আছে। তামাদ্দুনিক সংস্কার ও উন্নতিবিধানের জন্য উভয়ের মানসিক উন্নতি, মস্তিষ্কচর্চা, বিবেক ও চিন্তাশক্তির বিকাশ সমভাবে প্রয়োজন, যাহাতে তামাদ্দুনিক সেবায় প্রত্যেকে আপন আপন ভূমিকা পূর্ণরুপে গ্রহণ করিতে পারে। এই দিক দিয়া সমতার দাবী সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। পুরুষের ন্যায় নারীকেও তাহার স্বাভাবিক শক্তি ও যোগ্যতানুসারে যতদূর সম্ভব উন্নতি সাধন করিতে সুযোগ দেওয়াও একটা সৎ তমদ্দুনের একান্ত দাবী। জ্ঞানার্জন ও উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগ তাহাকে দিতে হইবে। পুরুষের ন্যায় তাহাকেও তামাদ্দুনিক ও আর্থিক অধিকার দিতে হইবে। সমাজে তাহাকে এমন মর্যাদা দান করিতে হইবে যেন তাহার মধ্যে আত্মসম্মানের অনুভূতির উদ্রেক হয় এবং ঐ সকল মানবীয় গুণের সঞ্চার হয় যাহা শুধু আত্মসম্মানের অনুভূতির দ্বারাই হইতে পারে। যে সকল জাতি এই ধরনের সমতা অস্বীকার করিয়াছে, যাহারা নিজেদের নারী সমাজকে অজ্ঞ, অশিক্ষিত, লাঞ্ছিত ও সামাজিক অধিকারসমূহ হইতে বঞ্চিত রাখিয়াছে, তাহার স্বয়ং অধপতনের গহবরে পতিত হইয়াছে। কারণ মানবজাতির অর্ধাংশকে অধপতিত করার অর্থ মানবতাকে অধপতিত করা। হীনা, লাঞ্ছিতা মাতার গর্ভ হইতে সম্মানী, অশিক্ষিতা মাতার ক্রোড় হইতে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং অধপতিতা মাতার লালনাগার হইতে উন্নতচিন্তার মানুষ আশা করা বৃথা।
কিন্তু সমতার একটা দ্বিতীয় দিক আছে। তাহা এ যে, নারী-পুরুষ উভয়ের কর্মক্ষেত্র এক হইবে, উভয় একই ধরনের কাজ করিবে। উভয়ের উপরে জীবনের সকল বিভাগের গুরুদায়িত্ব সমানভাবে উর্পিত হইবে এবং তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় উভয়ের স্থান একই প্রকারের হইবে। ইহার সমর্থনে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের প্রমাণ উপস্থাপিত করিয়া বলা হয় যে, নারী-পুরুষ শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যের দিক দিয়া এক (Equipotential)। উভয়ের মধ্যে এই ধরনের সমতা দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার জন্য এতটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে না যে, প্রকৃতির উদ্দেশ্যও উভয়ের দ্বারা একই প্রকারের কাজ লওয়া। উক্তরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কখনই যুক্তিযুক্ত হইবে না-যতক্ষণ না প্রমাণ করা হইয়াছে যে, উভয়ের শারীরিক গঠনও একই রূপ, প্রকৃতি উভয়ের উপরে একই ধরনের দায়িত্ব অর্পন করিয়াছে এবং উভয়ের মানসিক অবস্থাও অভিন্ন। আজ পর্যন্ত মানুষ যত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছে তাহার দ্বারা ইহার বিপরীত উত্তরই পাওয়া যায়।
জীব বিজ্ঞানে নারীর প্রকৃতি বিন্যাস
জীব বিজ্ঞানের (Biology)তত্বানুসন্ধানে প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, নারী স্বীয় আকৃতি, অবয়ব এবং (Protein molecules of tissue cells)পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাপারে পুরুষ হইতে পৃথক। যখন গর্ভে সন্তানের মধ্যে (sex Formation) [গঠন-আকৃতি] হয়, সেই সময় হইতে উভয় শ্রেণীর শারীরিক গঠন ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিকাশ লাভ করিতে থাকে। নারীর শারীরিক গঠন এমনভাবে করা হয়, যেন সে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের যোগ্য হইতে পার। প্রাথমিক (Womb Formation) হইতে আরম্ভ করিয়া সাবালকত্ব পর্যন্ত তাহার শরীরের পূর্ণ বিকাশ এই যোগ্যতার পরিপূর্ণতার জন্যই হইয়া থাকে এবং ইহাই তাহার ভবিষ্যত জীবনের পথ নির্ধারণ করিয়া দেয়।
সাবালক হইবার পর মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়। ইহার দ্বারা তাহার যাবতীয় অংগ-প্রত্যাংগের কর্মক্ষমতা প্রভাবাম্বিত হয়। শরীরতত্ববিদগণের পর্যবেক্ষণের দ্বারা জানিতে পারা যায় যে, মাসিক ঋতুকালে নারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত পরিবর্ত্ন ঘটিতে দেখা যায়ঃ
১। শরীরে তাপ-সংরক্ষণ শক্তি কমিয়া যায়। ফলে অধিক মাত্রায় শারীরিক তাপ নির্গত হইয়া তাপমাত্রা কমিয়া যায়।
২। নাড়ি ক্ষীণ হইয়া পড়ে, রক্তের চাপ কমিয়া যায়, শ্বাস গ্রহণে পার্থক্য দেখা যায়।
৩। Endocrines,Tonsils এবং Lymphatic Glands-এ পরিবর্তন দেখা যায়।
৪। Protein Metabolism কমিয়া যায়।
৫। Phosphates এবং Chlorides কম পরিমাণে নির্গত হয় এবং Gaseous Metabolism-এর অবনতি হয়।
৬। হজমশক্তি ব্যাহত হয়। খাদ্যবস্তুর প্রোটিন ও চর্বির ভাগ শরীর গঠনে অপর্যাপ্ত হয়।
৭। শ্বাস গ্রহণের শক্তি হ্রাস পায় এবং বাকশক্তির যন্ত্রাদিতে পরিবর্তন সূচিত হয়।
৮। স্নায়ূমন্ডলী অবসন্ন ও অনুভূতিশক্তি শিথিল হয়।
৯। স্মরণশক্তি কমিয়া যায় এবং কোন বিষয়ে একাগ্রতা থাকে না।
এই সকল পরিবর্তন একটি সুস্থ নারীকে রুগ্নতার এত নিকটবর্তী করিয়া দেয় যে, সুস্থতা এবং রুগ্নতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা দুষ্কর হইয়া পড়ে। শতকরা এমন ত্রিশজন নারী পাওয়াও দুষ্কর, যাহাদের ঋতুকালে কোন বেদনা বা কষ্ট হয় না। একবার এক হাজার ষাটজন নারীকে পরীক্ষা করিয়া জানা যায় যে, ইহাদের মধ্যে শতকরা ৮৪ জন ঋতুকালে কোন প্রকারের বেদনা অথবা কষ্ট ভোগ করিয়াছে। শরীর বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এলিম নুডিক বলেনঃ
ঋতুমতী স্ত্রীলোকদের মধ্যে সাধারণত যে পরিবর্তন দেখা যায়, তাহা নিম্নরূপঃ
মাথাব্যথা, অবসাদ, অংগ-প্রত্যংগে বেদনা, স্নায়বিক দৌর্বল্য, স্বভাবে রুক্ষতা, মূত্রনালীতে যন্ত্রণা, হজমশক্তি হ্রাস পাওয়া, কোন কোন অবস্থায় কোষ্ট কাঠিন্য, সময় সময় বমির ভাব এবং বমন হওয়া। বেশ কিছু সংখ্যক নারীর বক্ষে মৃদু বেদনা বোধ হয় এবং কোন সময় তাহা অতিমাত্রায় বাড়িয়া যায়। কোন কোন নারীর এই সময়ে কন্ঠস্বর ভারী হইয়া পড়ে। আবার কখনও হজমশক্তি বিনষ্ট হইয়া যায়, শ্বাস গ্রহণে কষ্ট হয়।
ডাক্তার ক্রেগার যত নারীকে পরীক্ষা করিয়াছেন তাহাদের মধ্যে অর্ধেক এমন ছিল যাহাদের ঋতুকালে হজমশক্তির ব্যাঘাত জন্মিয়াছে এবং শেষের দিকে কোষ্ঠকাঠিন্য হইয়াছে।
ডাক্তার গীব হার্ড বলেনঃ
এমন নারী খুব কমই পাওয়া গিয়াছে যাহাদের মাসিক ঋতুকালে কোন কষ্ট হয় নাই। অধিকাংশ এমন পাওয়া গিয়াছে যাহাদের মাথা বেদনা, নাভীর নিম্নভাগে বেদনা হইয়াছে এবং কন্ঠ শুষ্ক হইয়াছে। এই সময়ে তাহাদের মেজাজ খিটখিটে হয় এবং কাঁদিতে ইচ্ছা করে।
এই অবস্থায় ইহা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, মাসিক ঋতুকালে একটি নারী প্রকৃতই রুগ্ন হইয়া পড়ে। ইহা এক প্রকার ব্যারাম, যাহা প্রতি মাসেই একটি স্ত্রীলোককে আক্রান্ত করে।১
এই সকল শারীরিক পরিবর্তন নারীর মানসিক শক্তি ও অংগ-প্রত্যংগাদির উপর অবশ্যম্ভবীরূপে ক্রিয়া করে। ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে (Dr. Voicechevsky) গভীর পর্যবেক্ষণের পর মন্তব্য করিয়াছেন যে, ঐ সময়ে নারীর একাগ্রতাশক্তি ও মানসিক শ্রমশক্তি হ্রাস পায়। অধ্যাপক (Krschi Skevsky) মনস্তাত্বিক পর্যবেক্ষণ করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, ঐ সময় নারীদের স্নায়ূমন্ডলী উত্তেজিত হইয়া পড়ে। অনুভূতি শক্তি শিথিল ও সামঞ্জস্যহীন হইয়া যায়। সুবিন্যস্ত চিন্তা-প্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা হ্রাস পায় এবং অনেক সময়ে নষ্ট হইয়া যায়। এমনকি পূর্ব হইতে মনের কোণে প্রভিফলিত স্থির-সিদ্ধান্তেও বিচলতার সৃষ্টি হয়। ইহার ফলে তাহার দৈনন্দিন জীবনে যে সকল কার্যকলাপে সে অভ্যস্ত এই সময়ে তাহাও ঠিক থাকে না। এই সময়ে ট্রামের মহিলা কন্ডাকটর টিকেট দিতে এবং রেজকী গণনা করিতে ভুল করিবে। মোটর চালিকা ভয়ে ভয়ে ও ধীরে ধীরে মোটর চালনা করিবে এবং প্রতিটি মোড়ে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িবে। একজন মহিলা টাইপিস্ট ভুল টাইপ করিবে, টাইপ করিতে বিলম্ব করিবে, চেষ্টা সত্ত্বেও শব্দ ছুটিয়া যাইবে, ভুল বাক্য টাইপ করিবে এবং এক অক্ষরে আঙ্গুলের আঘাত করিতে যাইয়া অন্য অক্ষরের উপর আঙ্গুল পড়িবে। মহিলা ব্যারিষ্টার সঠিকভাবে মামলা প্রমাণ করিতে পারিবে না। মামলা পেশ করিতেও যুক্তি প্রদর্শনে ভুল করিবে। মহিলা ম্যাজিষ্টেটের বোধশক্তি হ্রাস পাইবে এবং সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করিবে। একজন দন্ত চিকিৎসিকা দন্ত উৎপাটনের যন্ত্রপাতি কাজের সময়ে সহজে হাতের কাছে পাইবে না। একজন গায়িকা তাহার সূর ও তালমান হারাইয়া ফেলিবে। এমন কি একজন কন্ঠবিশারদ স্বর শুনিয়াই বলিয়া দিতে পারিব যে, গায়িকা ঋতুমতী। মোটকথা, ঋতুকালে নারীর মন-মস্তিষ্ক এবং স্নায়বিক যন্ত্র দুর্বল ও বিশৃংখল হইয়া পড়ে। তাহার ইচ্ছানুযায়ী অংগ-প্রত্যংগাদি কার্য করিতে পারে না; বরং আভ্যন্তরীণ একটা প্রভাবশীল শক্তি তাহার ইচ্ছাশক্তি ও বিবেচনা শক্তিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। তাহার দ্বারা অনিচ্ছাকৃত কার্য হইতে থাকে। এই অবস্থায় তাহার কর্ম-স্বাধীনতা আর থাকে না এবং দায়িত্বপূর্ণ কার্য করিবার যোগ্যতা সে হারাইয়া ফেলে।
অধ্যাপক লাপিনিস্কি [Lapinsky] তাহার The Development of Personality in Women নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, মাসিক ঋতুকালে নারীদের কর্মস্বাধীনতা নষ্ট হইয়া যায়। একটা প্রভাবশীল শক্তি তাহাকে বাধ্যানুগত করিয়া ফেলে। স্বেচ্ছায় কোন কাজ করা না করার ক্ষমতা প্রায় নষ্ট হইয়া যায়।
এই সকল পরিবর্তন একজন স্বাস্থবতী নারীর মধ্যে সংঘটিত হয় এবং ইহা ক্রমশ রোগে পরিণত হয়। এইরূপ বহু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে যে, এই অবস্থায় নারী পাগলিনীর ন্যায় হইয়া পড়ে। সামন্য উত্তেজনায় অতিমাত্রায় রাগান্বিত হওয়া, পশু ও নির্বোধের ন্যায় কোন কিছু করিয়া ফেলা, এমন কি আত্মহত্যা পর্যন্ত করা অসম্ভব নহে। ডাক্তার ক্রাকট এবিং [Kraft Ebing] বলেন, দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে সকল নারীকে বিনয়ী, ভদ্র এবং প্রফূল্লচিত্ত দেখতে পাই, মাসিক ঋতুকালে তাহাদের মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন আসিয়া যায়। এই সময়টি তাহাদের নিকটে যেন একটা ‘ঝড়ের’ ন্যায় আসিয়া উপস্থিত হয় এবং তাহারা রুক্ষ, ঝগড়াটে এবং অসহিষ্ণু হইয়া পড়ে। বাড়ীর চাকর-বাকর, ছেলে-মেয়ে এবং স্বামী পর্যন্ত তাহার প্রতি বিরূপ হইয়া পড়ে। এমন কি অপরিচিত লোকের প্রতিও তাহারা ভাল ব্যবহার করে না।কোন কোন বিশেষজ্ঞ গভীর অনুসন্ধানের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, নারীদের অধিকাংশ অপরাধমূলক কার্য ঋতুকালে সংঘটিত হইয়া থাকে। কারণ এই সময়ে তাহারা নিজেকে সংযত রাখিতে পারে না। এমন সময়ে একজন অতি সৎ নারীও চুরি করিয়া বসে এবং পরে অনুতপ্ত হয়। ওয়েনবার্গ [Weinberg] গভীর পর্যবেক্ষণের পর মন্তব্য করিয়াছেনঃ
আত্মহত্যাকারী নারীদের শতকরা ৫০ জন ঋতুকালেই এই কাজ করিয়া থাকে। ইহার ভিত্তিতে ডাক্তার ক্রাফট এবিং এই মন্তব্য করিয়াছেন যে, অপরাধী সাবালিকা নারীর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা চলাকালে কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান করা উচিত যে, এই অপরাধ তাহার ঋতুকালে সংঘটিত হইয়াছিল কি না।
মাসিক ঋতু অপেক্ষা গর্ভাবস্থা অধিকতর কঠিনকান। ডাঃ রিপ্রেভ [Reprev] বলেন যে, নারীর অতিরিক্ত দৈহিক উপাদানগুলি ক্ষুধার্ত অবস্থায় যত পরিমাণে নির্গত হয়, গর্ভাবস্থায় তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে নির্গত হয়। নারীর স্বাভাবিক অবস্থায় শারীরিক ও মানসিক শ্রম করিবার যে মক্তি থাকে, গর্ভাবস্থায় বিশৃংখলা দেখা দেয়। মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট হইয়া যায়। তাহার যাবতীয় মানসিক উপাদানগুলি একটা একটানা বিশৃংখলায় পতিত হয়। সে রোগ ও সুস্থতার মধ্যে দোদুল্যমান থাকে। অতপর তুচ্ছ কারণে সে রুগ্নতার সীমায় উপনীত হয়। ডাক্তার ফিশার বলেন যে, একজন সুস্থ নারী গর্ভধারণকালে কঠিন মানসিক চাঞ্চল্যে ভোগে। তাহার মধ্যে অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা দেখা যায়। স্মৃতিশক্তি বিশ্রস্ত হইয়া পড়ে এবং অনুভূতি, চিন্তা-গবেষণা ও বোধশক্তি কমিয়া যায়। হিউলাক, ইলিয়াস, এলবার্ট মোল এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সর্ববাদিসম্মত অভিমত এই যে, গর্ভকালীন শেষ মাসটি এমন অবস্থায় কাটে যে, এই সময়ে নারীর কোন প্রকার দৈহিক ও মানসিক শ্রম করিবার যোগ্যতাই থাকে না।
সন্তান প্রসবের পর বিভিন্ন প্রকারের রোগে আক্রান্ত হইবার আশংকা থাকে। প্রসূতির সেপটিক রোগে ভুগিবারও আশংকা থাকে। গর্ভকালের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়া যাইবার জন্য অংগ-প্রতংগে একটা আলোড়ন-সঞ্চালনের সৃষ্টি হয়, যাহার কারণে সমস্ত শারীরিক ব্যবস্থা বিশৃংখল হইয়া পড়ে। কোনরূপ আশাংকা না থাকিলেও, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিতে তাহার কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগিয়া যায়। এইভাবে গর্ভ সঞ্চারের পর হইতে পূর্ণ এক বৎসর পর্যন্ত নারী প্রকৃত পক্ষে রুগ্না অথবা অর্ধরুগ্না থাকে। ফলে তাহার কর্মশক্তি স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় অর্ধেক অথবা তদপেক্ষা কম হইয়া পড়ে।
অতপর স্তন্যদানের কালটা এমন যে, এই সময়ে সে নিজের জন্য জীবন ধারণ করে না; বরং প্রকৃতি তাহার নিকটে যে আমানত গচ্ছিত রাখিয়াছে তাহা পূরণের জন্যই সে জীবন ধারণ করে। এই সময়ে তাহার শরীরে মূল্যবান পদার্থসমূহ তাহার সন্তানের জন্য স্তন্যদুগ্ধে পরিণত হয়। আহার্য বস্তু হইতে যতটুকু পরিমাণে তাহার জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন, ততটুকুই তাহার দেহে সন্নিবেশিত হয় এবং অবশিষ্ট স্তন্যদুগ্ধে পরিণত হয়। ইহার পরে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সন্তানের লালন-পালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শিক্ষা-দীক্ষার জন্য তাহার সকল দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতে হয়।
বর্তমান যুগে স্তন্যদান সমস্যার এইরূপ সমাধান করা হইয়াছে যে, শিশুদিগকে বাহির হইতে আহার্য যোগাইতে হইবে। কিন্তু ইহা কোন সুষ্ঠ সমাধান নহে। কারণ প্রকৃতি মাতৃস্তন্যে শিশু প্রতিপালনের যে সামগ্রী সংরক্ষিত করিয়া রাখিয়াছে, তাহার উপযোগী বিকল্প আর কিছুই হইতে পারে না। ইহা হইতে শিশুকে বঞ্চিত করা বিরাট অন্যায় ও স্বার্থপরতা বৈ আর কিছুই নহে। এই বিষয়ে সকল বিশেষজ্ঞ একমত যে শিশুর সত্যিকার বিকাশ সাধনের জন্য মাতৃস্তন্য অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর খাদ্য আর কিছু নহে।
মাতা যাহাতে তাহার শিশু সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া নিশ্চিত মনে বহির্বাটীর কাজে আত্মনিয়োগ করিতে পারে, তাহার জন্য শিশুর শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে ‘নার্সিং-হোম’ বা ‘শিশু-সদনের’ প্রস্তাব উত্থাপিত হইয়াছে। কিন্তু ‘নার্সিং হোম বা শিশু-সদনে, অকৃত্রিম মাতৃস্নেহ সরবরাহ করা সম্ভব নহে। শৈশবের প্রাথমিক অবস্থায় যে স্নেহ-ভালবাসা, যে দরদ ও শুভাকাঙ্খার প্রয়োজন হয়, তাহা ভাড়াটিয়া প্রতিপালিকার হৃদয়ে কোথা হইতে আসিবে? শিশু প্রতিপালনের এই নূতন পদ্ধতি এখনও পরীক্ষিত হয় নাই। শিশু প্রতিপালনের এই নূতন পদ্ধতি এখনও পরীক্ষিত হয় নাই। শিশু সদনের নূতন কারখানার তৈরি বংশধর এখনও ফল দান করে নাই। এখন পর্যন্তও তাহাদের স্বভাব-চরিত্র, আচার আচারণ এবং র্কীতি-কলাপ দৃষ্টিগোচর হয় নাই। অতএব এই পরীক্কাকার্যের সাফল্য ও অসাফল্য সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই মন্তব্য করা সমীচীন হইবে না যে, জগত মাতৃক্রোড়ের সুষ্ঠু বিকল্প ব্যবস্থা আবিষ্কার করিয়াছে। শিশুর প্রাকৃতিক লালনাগার ও শিক্ষাগার যে মাতৃক্রোড়ে, এই সত্য এখনও সর্বজন স্বীকৃত।
এখন ইহা একজন সামান্য বিবেকসম্পন্ন লোকেরও বোধগম্য যে, নারী-পুরুষের শারীরিক ও মানাসিক শক্তি এবং যোগ্যতা যদি সমানও হয়, তথাপি প্রকৃতি উভয়ের উপর সমান দায়িত্ব অর্পন করে নাই। বংশীয় স্থায়িত্বের জন্য বীজ বপন ব্যতীত পুরুষের উপর কোন কাজ চাপান হয় নাই। ইহার পর সে সম্পূর্ণ স্বাধীণ। জীবনের অন্য যে কোন কাজ সে করিতে পারে। পক্ষান্তরে বংশীয় স্থায়িত্ব বিধানে কাজ করিবার সকল দায়িত্ব নারীর উপরে অর্পিত হইয়াছে। যখন সে মাতৃগর্ভে একটা ভ্রুণাগারে অবস্থান করিত; তখন হইতেই তাহাকে এই দায়িত্ব সামলাইবার যোগ্য করিয়া পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত করা হয়। তাহার শরীরের যাবতীয় যন্ত্রাদি ইহারই উপযোগী করিয়া গড়িয়া তোলা হয়। ইহারই জন্য তাহার সমগ্র যৌবনে মাসিক ঋতুর বিবর্তন ঘটিয়া থাকে। এই সময় প্রতিমাসে তিন হইতে দশদিন পর্যন্ত সে কোন অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পালনে এবং কোনরূপ কঠিন শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করিতে অপারগ হয়। ইহারই জন্য তাহাকে গর্ভ ও গর্ভোত্তরকালীন পূর্ণ একটি বৎসর ভীষণ কষ্ট ভোগ করিতে হয়। এই সময়ে সে প্রকৃতপক্ষে অর্ধজীবিত অবস্থায় থাকে। ইহারই জন্য স্তন্যদানের দুইটি বৎসর তাহার এমনভাবে কাটে যে, সে স্বীয় রক্তদ্বারা মানবতার ক্ষেত্রে জলসেচন করে এবং বুকের স্রোতধারায় উহাকে সুজলা-সুফলা করিয়া তোলে। ইহারই জন্য শিশুর প্রাথমিক পরিচর্যা প্রতিপালনের কয়েকটি বৎসর এমন শ্রম ও কষ্টের মধ্যে তাহার অতিবাহিত হয় যে, এই সময়ে রাতের নিদ্রা এবং দিনের বিশ্রাম তাহার জন্য হারাম হইয়া যায়। এইভাবে সে স্বীয় সুখ-শান্তি, আনন্দ-উপভোগ, প্রকৃতির বাসনা সকল কিছুই ভবিষ্যত বংশধরের জন্য বিসর্জন দেয়।
প্রকৃত ব্যাপারে এই হইলে চিন্তা করিয়া দেখুন সুবিচার কোনটি। ইহাই কি সুবিচার যে, নারী প্রকৃতিপ্রদত্ত সকল দায়িত্ব একাই পালন করিবে এবং উপরন্তু সকল তামাদ্দুনিক দায়িত্বের বোঝাও তাহার স্কন্ধে চাপান হইবে যাহা পালন করিবার জন্য পুরুষকে প্রকৃতি প্রদত্ত সকল দায়িত্ব হইতে মুক্ত রাখা হইয়াছে? তাহাকে কি এ কথা বলা হইবে? ‘হে নারী! যে সকল দুঃখ-কষ্টের বোঝা প্রকৃতি তোমার উপরে চাপাইয়াছে, তাহাও বহন কর এবং তদুপরি আমাদের সহিত যোগদান করত জীবিকা অর্জনের জন্য পরিশ্রম কর। দেশ-শাসন, বিচার, শিল্প, ব্যবসায়, কৃষি, দেশে শান্তি স্থাপন, দেশরক্ষা প্রভৃতি কাজে আমাদের সাথে সমানভাবে অংশগ্রহণ কর। আমাদের সমাজে প্রবেশ করিয়া আমাদের চিত্তবিনোদন কর। আমাদের বিলাস-বাসন, আনন্দ-উল্লাস ও সুখ-সম্ভোগের উপাদান সংগ্রহ কর’।
ইহা সুবিচার নহে-অবিচার, সাম্য নহে-স্পষ্ট অসাম্য। সুবিচার তো ইহাই হওয়া উচিত যে, প্রকৃতি যাহার উপরে অনেক বেশী দায়িত্ব চাপাইয়া দিয়াছে, তাহাকে সমাজের লঘু ও সহজ কাজ করিতে দেওয়া হইবে। পক্ষান্তরে প্রকৃতি যাহার উপরে কোনই দায়ত্ব অর্পণ করে নাই, তাহাকেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক শ্রমসাপেক্ষ কার্য করিতে হইবে। ইহা ব্যতীত তাহাকে পরিবারের ভরণ-পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও গ্রহণ করিতে হইবে।
নারীর উপরে বহির্বাটির কাজ চাপান শুধূ অবিচারই নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে উপরে উল্লেখিত পুরুষোচিত কার্য সমাধা করিবার পূর্ণ যোগ্যতাও তাহার নাই। যাহার কর্মশক্তি অটল, যে ধারাবাহিকভবে এবং সর্বদা স্বীয় কর্তব্য এইরূপ যোগ্যতার সহিত সমাধা করিতে পারে এবং যাহার দৈহিক ও মানসিক শক্তির উপর আস্থাশীল হওয়া যায়, একমাত্র সেই ব্যক্তিই এই সকল কার্য করার যোগ্য হইতে পারে। কিন্তু যে সকল কর্মী প্রতি মাসে পর্যাপ্তকাল অযোগ্য অথবা স্বল্পযোগ্য হইয়া পড়ে এবং যাহাদের কর্মশক্তি বারংবার বাঞ্ছিত মান হইতে নিম্নগামী হয়, তাহারা কেমন করিয়া এই সকল দায়িত্বের বোঝা বহন করিবে? নারীগঠিত একটি সেনাবাহিনীর অথবা নৌ-বাহিনীর কথা চিন্তা করিয়া দেখুন,যাহার মধ্যে ঠিক যুদ্ধের সময় কিছু সংখ্যক সুতিকাগৃহে শয্যাগ্রহণ করিয়াছে এবং একটা বিশ্বস্তদল গর্ভধারণ করিয়া কাজের অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছে? সেনাবাহিনীর উদাহরণ দিলে আপনি বলিবেন যে, ইহা তো বড় কঠিন কাজ। কিন্তু পুলিশ, বিচার বিভাগ, দৌত্যকার্য, রেলওয়ে এবং শিল্পবাণিজ্যের কথাই বলুন। ইহার মধ্যে কোনটার দায়িত্ব বা এমন; যাহার জন্য সদানির্ভরশীল যোগ্য কর্মশক্তি প্রয়োজন হয় না? তাহা হইলে যাহারা নারীর দ্বারা পুরুষের কাজ লইতে চায়, তাহাদের উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে, সমগ্র নারী জাতিকে পুরুষ বানইয়া মানব বংশ ধ্বংস করিতে হইবে অথবা শতকরা কিছু সংখ্যক নারীকে বাধ্যতামূলকভাবে পুরুষ সাজাইয়া শাস্তি ভোগের জন্য নির্বাচিত করিতে হইবে অথবা সমাজের সকল প্রকার কাজে যোগ্যতার মান অবনত করা হইবে।
কিন্তু আপনি উপরিউক্ত পন্থাগুলির যে কোনটিই অবলম্বন করুন না কেন, নারীকে পুরুষের কাজের জন্য প্রস্তুত করা প্রকৃতির দাবি ও রীতির সম্পুর্ণ পরিপন্থী! ইহা মানত ও নারী সমাজ কাহাও জন্য মংলজনক নয়। যেহেতু শরীর-বিজ্ঞান অনুযায়ী নারীকে সন্তান প্রসব ও তাহার প্রতিপালনের জন্যই সৃষ্টি করা হইয়াছে, সেইজন্য মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়াও তাহার মধ্যে প্রেম-ভালবাসা, সহানুভূতি, স্নেহ বাৎসল্য, হৃদয়ের কোমলতা, তীক্ষ্ণ অনুভূত, নমনীয় আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রভৃতি গুণাবলী গচ্ছিত রাখা হইয়াছে-যাহা প্রকৃতিপ্রদত্ত দৈনন্দিন কার্যের সম্পূর্ণ উপযোগী।
দাম্পত্য জীবনে পুরুষকে ক্রিয়ার এবং নারীকে ক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে। এইওজন্য নারীর মধ্যে এমন সব গুণের সৃষ্টি করা হইয়াছে যাহা তাহাকে শুধু প্রভাবিত হওয়ার দিকে কাজ করিবার জন্য প্রস্তুত করে। তাহার মধ্যে কঠোরতার পরিবর্তে নম্রতা, কোমলতা ও নমনীয়তা আছে। প্রভাব বিস্তারের পরিবর্তে প্রভাব গ্রহণের উপাদান আছে। ক্রিয়ার পরিবর্তে ক্রিয়া গ্রহণের ক্ষমতা আছে। দৃড়তা ও অটলতার পরিবর্তে নতি-স্বীকার ও বিনয়-নম্রতার প্রবণতা আছে। ঔদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিবর্তে অস্বীকৃতি, পলায়নের মনোভাব ও বাধাদান আছে। যে সকল কর্যে এবং জীবনের যে সকল বিভাগে কঠোরতা , প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, প্রতিবন্ধকতা ও উপেক্ষা-অবহেলার প্রয়োজন হয়, যাহাতে ক্ষীণ আবেগ ইচ্ছার পরিবর্তে দৃঢ়-সংকল্প ও অভিমতের প্রয়োজন হয়, সেখানে নারী কিরূপে সাফল্য অর্জন করিতে পারে? সমাজের এই সকল বিভাগে নারীকে টানিয়া আনার অর্থ নারীত্বকে ধ্বংস করা এবং সকল বিভাগকেও ধ্বংস করা।
ইহার দ্বারা নারীর উন্নতির পরিবর্তে অবনতিই হয়। কোন ব্যক্তির স্বাভাবিক প্রতিভা দমিত করিয়া তাহার মধ্যে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কৃত্রিম যোগ্যতা সৃষ্টি করাকে উন্নতি বলে না, বরং পুরুষ সবল ও ষ্ফুরণ এবং তাহার কাজের সুযোগ সৃষ্টি করিয়া দেওয়াকেই প্রকৃত উন্নতি বলে।
ইহাতে নারীত্বের কোন সাফল্য নাই, বরং অসাফল্যই রহিয়াছে। জীবনের কোন দিকে নারী দুর্বল এবং পুরুষ সবল অগ্রসর। আবার কোন দিকেপ পুরুষ দুর্বল, নারী অগ্রগামিনী। পুরুষের সহিত প্রতিযোগিতায় জীবনের এমন দিকে হতভাগ্য নারীকে দাঁড় করান হইতেছে, যেদিকে সে দুর্বল। ইহার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম এই হইবে যে, নারী সর্বদা পুরুষ হইতে নিকৃষ্ট প্রমাণিত হইবে। যত প্রকার পন্থাই অবলম্বন করা হউক না কেন, নারী জাতির মধ্য হইতে এরিস্টটল, ইবনে সীনা, কান্ট, হেগেল,ওমর খাইয়াম,শেক্সপীয়ার, আলেকজাণ্ডার, নেপোলিয়ন, সালাহউদ্দীন, নিযাম-উল-মুল্ক তুসী, বিস্মার্ক পৃথিবীর পুরুষ জাতি মিলিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করিলেও তাহাদের মধ্যে হইতে একটি সাধারণ শ্রেণীর মাতাও প্রস্তুত করিতে পারিবে না।
ইহাতে তমদ্দুনের মংগল না হইয়া অমংগলই হয়। মানবীয় জীবন ও সভ্যতার জন্য যেমন কঠোরতা-নির্মমতার প্রয়োজন আছে, তেমন প্রয়োজন আছে কোমলতা ও নমনীয়তার। যতখানি প্রয়োজন আছে দক্ষ সেনাপতির, বিচক্ষণ পরামর্শদাতার ও উৎকৃষ্ট শাসকের ততখানি প্রয়োজন আছে উৎকৃষ্ট মাতার, উৎকৃষ্ট সহধর্মিনী ও পরিবার পরিজনের। উভয় শ্রেণীর মধ্যে যাহাকেই বাদ দেওয়া হউক না কেন, তমদ্দুন ক্ষতিগ্রস্ত হইবেই।
ইহা এমনই এক কর্মবন্টন (Division of work)যাহা প্রকৃতি উভয় শ্রেণীর মধ্যে করিয়া দিয়াছে। জীব-বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও সমাজ-বিজ্ঞান প্রভৃতি যাবতীয় বিজ্ঞানশাস্ত্র এই কর্ম বন্টনের দিকেই ইংগিত করিতেছে। সন্তান প্রসব ও পালনের দায়িত্ব নারীর উপর অর্পিত হওয়া একটি সিদ্ধান্তকর সত্য। ইহা মানবীয় তমদ্দুনে তাহার জন্য একটি সীমারেখা নিদির্ষ্ট করিয়া দেয়। কোন কৃত্রিম ব্যবস্থাই এই সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করিতে পারে না। একটি সৎ তমদ্দুন ইহাই হইতে পারে যে, এই সিদ্ধান্তকে হুবহু মানিয়া লইবে। অতপর নারীকে তাহার সঠিক স্থানে রাখিয়া তাহার সামাজিক সম্ভ্রম দান করিবে। তাহার ন্যায়সংগত তামাদ্দুনিক ও আর্থিক অধিকারসমূহ মানিয়া লইবে। শুধু গৃহের দায়িত্বই তাহার উপর ন্যস্ত করিবে এবং বহির্বাটির দায়িত্ব ও পরিবারের অভিভাবকত্ব পুরুষের উপর ন্যস্ত করিবে। যে তমদ্দুন এই কর্মবন্টনকে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিবে, সে সাময়িকভাবে বৈষয়িক উন্নতি ও জাঁকজমকের মহড়া প্রদর্শন করিতে পারে, কিন্তু পরিণামে তমদ্দুনের ধ্বংস সুনিশ্চিত। কারণ পুরুষের সমান আর্থিক ও তমদ্দুনিক দায়িত্ব যখন নারীর উপর ন্যস্ত করা হইবে, তখন সে নিজের উপর ন্যস্ত প্রাকৃতিক দায়িত্বের বোঝা দুরে নিক্ষেপ করিবে। ফলে ইহা দ্বারা শুধু তমদ্দুনই ধ্বংস হইবে না, মানবতাও ধ্বংস হইয়া যাইবে। নারী যদি তাহার স্বভাব ও প্রাকৃতিক গঠনের পরিপস্থী কোন চেষ্টা করে, তাহা হইলে কিছু না কিছু পরিমাণে ত পুরুষের কাজ সামলাইয়া লইবে, কিন্তু পুরুষ কিছুতেই সন্তান প্রসব ও প্রতিপালনের যোগ্য হইতে পারিবে না।
প্রকৃতির এই কর্ম বন্টনের সম্মুখে রাখিয়া যে পরিবারিক ব্যবস্থা হইবে এবং নারী-পুরুষের যে ভাতা নির্দৃষ্ট করা হইবে, তাহার অনিবার্য শর্তগুলি নিম্মে প্রদত্ত হইলঃ
১। পরিবারের জন্য উপার্জন করা, উহার সাহায্য ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, তমদ্দুনে শ্রমজনিত কাজ করা পুরুষের কাজ হইবে। ইহার শিক্ষা-দীক্ষা এমন হইতে হইবে যেন তাহা এই সকল উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অধিক পরিমাণে উপযোগী হই।
২। সন্তান প্রতিপালন, গৃহাভ্যন্তরীণ কাজকর্ম, পারিবারিক জীবনকে স্বর্গীয় মধুর করিয়া গড়িয়া তুলিবার কাজ নারীর হইবে। তাহাকে যথোপযুক্ত শিক্ষা দান করিয়া এই উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে।
৩। পারিবারিক শৃংখলা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য এবং ইহাকে যত মাথা তত নেতার হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য এক ব্যক্তিকে আইনানুগ কর্তৃত্ব দান করিতে হইবে, যেন পরিবার একটি মস্তকবিহীন সেনাবাহিনীতে পরিণত না হয়। মনে রাখিতে হইবে,এমন ব্যক্তি একমাত্র পুরুষই হইতে পারে। কারণ বারংবার মাসিক ঋতুকালে ও গর্ভাবস্থায় পরিবারের যে সদস্যটির মন-মস্তিষ্কের অবনতি ঘটে, সে কোন অবস্থাতেই এই ক্ষমতা ব্যবহারের যোগ্য হইতে পারে না।
তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় এই কর্ম বন্টন, শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে, যাহাতে কোন নির্বোধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নির্বুদ্ধিতাবশত নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে এক করিয়া সেই তামাদ্দুনিক ব্যবস্থাকে বানচাল করিয়া না দেয়।