সিদ্ধান্তকর প্রশ্ন
আমাদের দেশে ও অন্য দেশগুলিতে যাহারা পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করে, তাহাদের সম্মুখে প্রকৃতপক্ষে জীবনের ঐরূপ চিত্রই পরিস্ফুট রহিয়াছে। এইরূপ জীবনের উজ্জ্বল দৃশ্যগুলি তাহাদের ইন্দ্রিয়নিচয়কে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। এইসব দৃষ্টিভঙ্গী, এইরূপ নৈতিক মূলনীতি এবং এইরূপ বৈষয়িক ও দৈহিক আনন্দ-সম্ভোগের উজ্জ্বল দিক তাহাদের মন-মস্তিস্ককে প্রভাবান্বিত করিয়াছে। পর্দার প্রতি তাহাদের ঘৃণা এই জন্য যে, পাশ্চাত্যের যে নৈতিক দর্শনের প্রতি তাহারা ইমান আনিয়াছে, তাহা পর্দা সম্পর্কিত নৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং যে সমস্ত বৈষয়িক লাভ ও সুখ-সম্ভোগ তাহাদের কাম্য বস্তু, পর্দা তাহার প্রতিবন্ধক। এখন প্রশ্ন এই যে, এই জীবন-চরিত্রের অন্ধকার দিকটি অর্থাৎ ইহার বিষময় পরিণাম ফল মানিয়া লইতে ইহারা সম্মত কি-না। এই বিষয়ে ইহারা সকলে কিন্তু একমত নহে।
একদল এমন আছে, যাহারা এই সকল পরিনাম-ফল স্বীকার করিয়া লইতে প্রস্তুত আছে। প্রকৃতপক্ষে তাহাদের মতে ইহাও পাশ্চাত্য জীবন-দর্শনের উজ্জ্বল দিক-অন্ধকার দিক নহে।
দ্বিতীয় দল ইহাকে চিত্রের অন্ধকার দিকই মনে করে এবং ইহার পরিণাম-ফল স্বীকার করিয়া লইতে রাজী নহে। কিন্তু ঐরূপ জীবন যাপনের সহিত যে সকল উপভোগের সামগ্রী রহিয়াছে, তাহার প্রতি ইহারা মোহাবিষ্ট হইয়া পড়িয়াছে।
তৃতীয় একটি দল আছে, যাহাদের না এই সব দৃষ্টিভংগী বুঝিবার জ্ঞান আছে, না ইহার পরিনাম-ফল সম্পর্কে তাহাদের কোন অনুভূতি আছে। এই সকল দৃষ্টিভংগী ও পরিণাম-ফলের মধ্য কি কার্যকরণ সম্পর্ক আছে, সে সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করিয়া শ্রম স্বীকার করিতেও ইহারা প্রস্তুত নহে। তাহাদের কর্তব্য এই যে, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ঢালিয়া দিয়া যুগের অন্ধ অনুকরণ করিয়া যাইতে হইবে।
এই তিনটি দল এমনভাবে সংমিশ্রিত রহিয়াছে যে, আলাপ-আলোচনায় ইহা নির্ণয় করা কঠিন হইয়া পড়ে যে, আলোচনায় অংশ গ্রহণকারী কোন দলভুক্ত। এইরূপ সংমিশ্রণের ফলে সাধারণত আলোচ্য বিষয়বস্তু এক কঠিন জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়। এইজন্য প্রতিটি দল বাছিয়া পৃথক করা প্রয়োজন বোধ করি এবং অতঃপর প্রত্যেকের বিষয়ে তদানুযায়ী আলোচনা করা উচিত।
পাশ্চাত্য সভ্যতার মন্ত্রে দীক্ষিত দল
প্রথম দল জানিয়া শুনিয়া ঐ সকল মতবাদ ও সাংস্কৃতিক মুলনীতির উপর ঈমান আনিয়াছে, যাহাকে ভিত্তি করিয়া পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে। নব্য ইউরোপের সমাজ-শিল্পিগণ যে মনমস্তিষ্ক দ্বারা চিন্তা করে এবং যে দৃষ্টিতে জীবনের সমস্যাবলী দেখে, ইহারা অবিকল তাহাই করে। ইহারা আপন আপন দেশের সাংস্কৃতিক জীবনকেও সেই পাশ্চাত্য রঙে রঞ্জিত করিতে চায়। নারী শিক্ষার চরম লক্ষ্য তাহাদের এই যে, নারীরা যেন জীবিকার্জনের যোগ্যতা লাভ করিতে পারে এবং তৎসহ পর-পুরুষের মন জয় করিবার কলা কৌশলও হস্তগত করিতে পারে। তাহাদের মতে পরিবারের মধ্যে নারীর স্থান এই যে, সে-ও পুরুষের ন্যায় পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হইবে এবং সম্মিলিত বাজেটে সে তাহার অংশ পূরণ করিবে। তাহাদের মতে সমাজে নারীর অবস্থান এই যে, সে তাহার সৌন্দর্য, সাজ-সজ্জা এবং কমনীয় ভঙ্গী দ্বারা সমাজ জীবনে এক রসের উপাদান যোগাইবে। তাহার কোকিল কণ্ঠে মনের মধ্যে এক আনন্দ শিহরণ সঞ্চারিত করিবে। তাহার সংগীত কলায় কর্ণকুহর জুড়াইয়া দিবে। তাহার লাস্যময়ী নৃত্যে প্রাণে এক সঞ্জীবনী ধারা প্রবাহিত করিবে। তাহার ‘চলিতে ছলকি পড়িছে কাঁকাল, যৌবন থর থর তনু’ ভঙ্গীমায় আদম-সন্তানদের চিত্তবিনোদন করিবে। দর্শক নয়ন ভরিয়া তাহা উপভোগ করিবে এবং তাহার শীতল রক্তকণায় তড়িৎ প্রবাহ ছুটিতে থাকিবে। সে সমাজসেবা করিয়া বেড়াইবে, মিউনিসিপ্যালিটি ও কাউন্সিলের সভ্য হইবে, সম্মেলন ও সভা-সমিতিতে অংশ গ্রহণ করিবে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে আপন সময় ও মস্তিষ্ক ব্যয় করিবে। ক্রীড়া-কৌতুক ও খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করিবে। সন্তরণ, দৌড়, লম্ফ-ঝম্ফ, আকাশ পথে বিচরণ প্রভৃতিতে রেকর্ড ভংগ করিবে। তাহাদের মতে জাতীয় জীবনে নারীর করণীয় ইহা ব্যতীত আর কিছুই নাই। মোট কথা, যাহা গৃহের বাহিরের, তাহাই সে করিবে এবং যাহা গৃহাভ্যন্তরের, তাহার ত্রিসীমানায় সে যাইবে না। এইরূপ জীবনকেই তাহারা আদর্শ জীবন মনে করে। তাহাদের বিশ্বাস, পার্থিব উন্নতির ইহাই একমাত্র পথ এবং যে সব প্রাচীন নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী এই পথের প্রতিবন্ধক হয়, তাহা সবই অর্থহীন ও ভ্রান্ত। ইউরোপ যেমন প্রাচীন নৈতিক মূল্যমানকে নূতন মূল্যমানের দ্বারা পরিবর্তিত করিয়াছে, ইহারাও তাহাই করিয়াছে। বৈষয়িক উন্নতি ও দৈহিক ভোগ-বিলাসই তাহাদের নিকট একমাত্র মূল্যবান কাম্য বস্তু। লজ্জা, সতীত্ব ও পবিত্রতা, নৈতিক চরিত্র, দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব ও বিশ্বাসভাজনতা, বংশরক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি তাহাদের নিকটে মূল্যহীনই নহে, বরং বর্বরোচিত ও কুসংস্কারজনিত প্রতারণামাত্র। এই সবের মূলোচ্ছেদ ব্যতীত উন্নতির পদক্ষেপ সম্ভব নহে।
ইহারা প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য দীনের খাঁটি মু’মিন। যে সমস্ত পন্থা অবলম্বনে ইউরোপ তাহার মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রচার করিয়াছে, ইহারাও সেই মতবাদে ঈমান আনিয়া সেই পন্থায় তাহা প্রাচ্যের দেশগুলিতে ব্যাপক প্রচারের চেষ্টা করিতেছে।
নূতন সাহিত্য
সর্বপ্রথম তাহাদের সাহিত্যের দিকে লক্ষ্য করুন, যাহা মন-মস্তিষ্ক গঠনে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি বিশেষ। এই তথাকথিত সাহিত্যের (?) [প্রকৃতপক্ষে অপসাহিত্য] দ্বারা পূর্ণ শক্তিতে এই চেষ্টা করা হয়, যাহাতে ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকটে নূতন চরিত্র দর্শন উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়া ধরা যায় এবং প্রাচীন নৈতিক মূল্যমানকে মন ও মস্তিষ্কের অণু-পরমাণু হইতে টানিয়া বাহির করিয়া দুরে নিক্ষেপ করা যায়। আমি এখানে উর্দু সাহিত্য হইতে ইহার কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করিব।
এই দেশে সাহিত্য ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ একটি মাসিক পত্রিকায় ‘শিরীনের পাঠ’ শীর্ষক একটি গল্প প্রকাশিত হইয়াছিল। গল্পলেখক উচ্চ শিক্ষিত, সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রখ্যাত এবং একটি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। গল্পের সারাংশ এই যে, একটি তরুণী তাহার শিক্ষকের নিকটে পড়িতে বসিয়াছে। পড়িবার কালে সে তাহার এক তরুণ প্রেমিকের প্রেমপত্র আলোচনার উদ্দেশ্যে শিক্ষকের নিকটে উপস্থাপিত করে। একটি টি পার্টিতে সেই প্রেমিক বন্ধুটির সংগে তাহার প্রথম পরিচয় ঘটে। তথায় জনৈক মহিলা তাহাদের পরিচয় করাইয়া দেয়। সেইদিন হইতেই তাহাদের মেলামেশা ও পত্রের আদান-প্রদান শুরু হয়। তরুণীর ইচ্ছা যে, তাহার শিক্ষক উক্ত প্রেমপত্রের একটা জবাব লিখিয়া দিবেন। শিক্ষক তাহাকে এই সমস্ত বাজে বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া পাঠের দিকে আকৃষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তরুণী ও শিক্ষকের মধ্যে এতদ্বিষয়ে নিম্নরূপ কথোপকথন চলেঃ
তরুণীঃপড়তে তো চাই আমি। কিন্তু এমন পড়া পড়তে চাই, যা আমাকে জাগ্রত স্বপ্নের আশা পূরণে সাহায্য করে। এমন পড়া পড়তে চাই না, যা আমাকে এখন থেকে আইবুড়ো করে রাখে।
শিক্ষকঃ আচ্ছা, এ মহাত্মা ছাড়াও কি তোমার অন্য কোন যুবক বন্ধু আছে?
তরুণীঃ হাঁ, কয়েকজন আছে। তবে এই যুবকটির বৈশিষ্ট্য এই যে, সে বড় মিষ্টি স্বরে ধমক দেয়।
শিক্ষকঃ আচ্ছা, তোমার পিতা এ পত্রের বিষয় জানতে পারলে কি হবে বলতো?
তরুণীঃ বা-রে! পিতা কি তার যৌবনকালে এ ধরনের প্রেমপত্র লিখেন নি? তিনি তো বেশ ফিটফাট বাবু ছিলেন। এখনও লিখে থাকলেই বা আশ্চর্যের কি আছে? এখনও তো তিনি বুড়ো হন নি!
শিক্ষকঃ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এ ধারণা করাই সম্ভব ছিল না যে, কেউ কোন সম্ভ্রান্ত বংশের বালিকার নিকটে এ ধরনের প্রেমপত্র লিখবে।
তরুণীঃ তবে কি সে কালের লোকেরা শুধু ইতরশ্রেণীর লোকের সাথেই প্রেম করতো? বাঃ তবে তো সেকালে ইতর শ্রেণীর লোক বেশ আরামেই ছিল এবং সম্ভ্রান্তশ্রেণীরা ছিল বেশ দুষ্ট।
শিরীনের শেষ উক্তিগুলির মধ্যে গল্পলেখকের সাহিত্য দর্শনের সুর ঝংকৃত হয়।
শিরীন বলেঃ আমাদের মতো নব্য যুবতীদের দ্বিগুন দায়িত্ব রয়েছে। যে সব আনন্দ-উল্লাস আমাদের গুরুজন হারিয়ে ফেলেছেন, তা পুনরুদ্ধার করা এবং যে সব ক্রোধ ও মিথ্যার অভ্যাস বিদ্যমান আছে, তা দূর করা আমাদের কর্তব্য।
আর একটি খ্যাতনামা সাহিত্য পত্রিকায় আজ হইতে কয়েক বৎসর পূর্বে ‘অনুতাপ’ শীর্ষক একটি নাতিদীর্ঘ গল্প প্রকাশিত হইয়াছিল। সহজ সরল ভাষায় তাহার সারাংশ এইঃ
সম্ভ্রান্ত বংশের একটি কুমারী বালিকা এক যুবকের প্রেমে পড়িয়া যায়। পিতামাতার অজ্ঞাতে সে তাহাকে আপন কক্ষে ডাকিয়া লয়। অতপর অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপনের ফলে তাহার গর্ভ সঞ্চার হয়। অতপর সে তাহার এহেন গর্হিত অপবিত্র কার্যকে ন্যায়সংগত প্রমাণ করিবার জন্য আপন মনে বিড় বিড় করিয়া বলিতেছেঃ
আমি এত চিন্তিতা কেন? আমার দুরু দুরু হিয়াই বা কেন?… আমার বিবেক কি আমাকে দংশন করে? আমার দুর্বলতার জন্য আমি কি লজ্জিতা? কিন্তু সেই সুন্দর চাঁদনী রাতের ঘটনা আমার জীবন গ্রন্থে সোনালী অক্ষরে লিখিত হইয়াছে। যৌবনের সেই মদমত্ত মুহূর্তগুলির স্মরণ আমি আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ মনে করি। সেই মুহূর্তগুলি ফিরে পাবার জন্যে কি আমি সর্বস্ব ত্যাগ করিতে প্রস্তুত নই?….
তবে কেন আমার হিয়া কাঁপছে? একি পাপের জন্যে? আমি কি কোন পাপ করেছি? না, কোন পাপ আমি করিনি। আমি কার কাছে পাপ করেছি? আমার পাপের জন্যে কার ক্ষতি হয়েছে? আমি তো উৎসর্গ করেছি। তারই জন্যে উৎসর্গ করেছি। হায়রে, তার জন্যে যদি আরও উৎসর্গ করতে পারতাম! পাপের ভয় আমি করি না। কিন্তু হাঁ, আমি এই সমাজ ডাইনীকে ভয় করি। তার কেমন অর্থবোধক সন্দিগ্ধ দৃষ্টি আমার উপরে নিপতিত হচ্ছে।….
আমি তার জন্যেই বা কেন ভীতা হবো? তবে কি আপন পাপের জন্যে? কিন্তু আমার পাপই বা কি? আমি যা করেছি, সমাজের আর কোন মেয়ে তা তা করে নাকি? আহা, সেই মধুর রাত্রি আমার অধরে তার অধরামৃতের পরশ! নিবিড় বাহুবন্ধন! আর সুরভিত মধুময় বক্ষে কেমন এক অব্যক্ত আনন্দ আবেশে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং তাতে কি হয়েছে? অন্যেই বা কি করতো? অন্য নারী কি সেই মুহূর্তে তাকে প্রত্যাখান করতো?
পাপ? পাপ আমি কখনই করি নি। অনুতপ্ত আমি কখনই নই। পুনরায় তা করবার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি।.. সতীত্ব? সতীত্ব আবার কোন বস্তু? সাধু কুমারিত্ব, না মনের পবিত্রতা? আমি আর কুমারী নেই। আমি কি সতীত্ব হারিয়ে ফেলেছি?
অশান্তিপ্রিয় ডাইনী সমাজ যা খুশি তা করুক। সে আমার কি করতে পারে? কিছুই না। তার প্রগলভতাপূর্ণ বিদ্রুপের জন্যে আমি কেন ভয় করবো? তার কানাঘুষার জন্যেই বা কেন ভীতা হবো? আমার মুখমণ্ডলই বা বিবর্ণ করি কেন? তার ব্যংগ-পরিহাসের জন্যেই বা কেন মুখ লুকাবো? আমার মন বলছে যে, আমি ঠিকই করেছি। তা হলে আমি কেন চোর হবো? তবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কেনই বা একথা বলবো না যে, আমি এরূপ করেছি এবং বেশ করেছি।
নব্য সাহিত্যিকগণ এইরূপ যুক্তি-প্রমাণাদির অবতারণায় ভৎগিমা এবং চিন্তাপদ্ধতি আধুনিক যুগের প্রত্যেক মেয়েকে-সম্ভবত তাহাদের আপন ভগ্নি ও কন্যাগণকেও-শিক্ষা দিতে চায়। তাহাদের শিক্ষা এই যে, চাঁদনী রাত্রিতে যদি কোন যুবতী নারীর পক্ষে কোন পর-পুরুষের আলিঙ্গন লাভ সম্ভব হয়, তাহা হইলে তাহার উত্তপ্ত বক্ষে নিজেকে বিলীন করিয়া দিতে হইবে। কারণ এমন অবস্থায় একমাত্র এইরূপ করাই সম্ভবপর। কোন নারী এইরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হইলে ইহা ব্যতীত অন্য কিছুই করিতে পারে না। ইহা পাপ কার্য নহে, বরং ত্যাগ ও উৎসর্গ। ইহার দ্বারা সতীত্বের মর্যাদাও ক্ষুন্ন হয় না। মনের পবিত্রতা সহকারে কুমারিত্বকে বিসর্জন দিলে সতীত্বের কি আসে যায়? একটি নারীর জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকে। তাহার চেষ্টা-চরিত্রও এইরূপ হওয়া উচিত যাহাতে তাহার সমগ্র জীবন-গ্রন্থ এইরূপ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়।
এখন রহিল সমাজ। তাই সমাজ যদি এইরূপ স্বতীসাধ্বী নারীর প্রতি দোষারোপ করে, তাহা হইলে তাহাকে অশান্তি স্থাপনকারিণী ও ডাইনীই বলিতে হইবে। এইরূপ উৎসর্গকারিণী বালিকাদের প্রতি যাহারা দোষারোপ করে তাহারা দোষী, না ঐ সকল সম্ভ্রান্ত বংশীয়া কুমারী, যাহারা সুন্দর চাঁদনী রাতে উন্মুক্ত বক্ষের মধুর আলিঙ্গনকে উপেক্ষা করিতে পারে না, তাহারা দোষী? যে অত্যাচারী সমাজ এহেন সুন্দর কাজকে কদর্য বলে, তাহার এমন কোন অধিকার থাকিতে পারে না যাহার জন্য মানুষ তাহাকে সমিহ করিয়া চলিবে এবং এমন সুন্দর কাজ করিয়া তাহার ভয়ে মুখ লুকাইতে হইবে। প্রত্যেকটি মেয়েকে প্রকাশ্যে ও নির্ভীক চিত্তে এই নৈতিক মহত্ব প্রদর্শন করিতে হইবে এবং নিজে লজ্জিতা না হইয়া সমাজকেই লজ্জিত করিতে হইবে।
এইরূপ স্পর্ধা ও দুসাহস কোনদিন ব্যবসায়ী বারাঙ্গনাদেরও হয় নাই। কারণ পাপকে পুন্য, পুণ্যকে পাপে করিবার কোন নৈতিক দর্শন এই সকল হতভাগিনীদের ছিল না। সেকালের বেশ্যাগণ আপন সতীত্ব নষ্ট করিত বতে, কিন্তু নিজেকে হেয় ও পাপীয়সী মনে করিত। কিন্তু এখন নূতন সাহিত্য প্রতি পরিবারের কন্যা ও পুত্রবধুকে সেকালের বেশ্যা হইতে দোষ ধাপ সম্মুখে আগাইয়া দিতে চায়। কারণ কুকার্য ও অশ্লীলতা ঢাকিবার জন্য সে নতুন দর্শন আবিস্কার করিতেছে।
আর একটি পত্রিকা আছে, যাহা আমাদের দেশের সাহিত্যিক মহলে যথেষ্ট সমাদর লাভ করিতেছে। এই পত্রিকায় ‘দেবর’ শীর্ষক একটি গল্প প্রকাশিত হয়। গল্প লেখকের পিতা নারীদের জন্য উন্নত ধরনের নৈতিক সাহিত্য রচনা করিয়া সমাজের প্রভূত শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এই মহান কাজের জন্য তিনি নারী সমাজের নিকটও সমাদৃত হন। কিন্তু তাহারই পুত্র উক্ত গল্পে এমন একটি বালিকার চরিত্র সুন্দররূপে অংকিত করিয়া তাহার ভগ্নিদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিতেছেন যে, বিবাহের পূর্বে স্বীয় কল্পিত দেবরের পূর্ণ যৌবন এবং যৌনোচ্ছ্বাসের কল্পনায় আপন দেহ-মনে এক অব্যক্ত পুলক শিহরণ অনুভব করিতেছে। কুমারী জীবনেই তাহার দৃষ্টিভঙ্গী এমন ছিল যে, সে এইরূপ ধারণা করিত ‘যে যৌবন নীরব ও শান্ত থাকিয়া ফুরাইয়া যায়, তাহা অকর্মণ্যতারই পরিচায়ক। আমার মতে যৌবনে চাঞ্চল্য ও উচ্ছ্বাস অবশ্যম্ভাবী এবং সৌন্দর্য ও প্রেমের আকর্ষণ-বিকর্ষণই তাহার উৎসর্গ। এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গী এবং ধারণা লইয়া সেই বালিকা যখন বিবাহ বাসরে স্বামীর শশ্রু শোভিত মুখ দর্শন করিল, তখন তাহার সুকুমার বৃত্তিসমুহ কুয়াশাবৃত্ত হইয়া পড়িল। তখন সে পূর্ব কল্পিত বাসনানুযায়ীন স্থির করিয়া ফেলিল যে, স্বামীর সহোদর ভ্রাতার প্রেমপাশেই সে আবদ্ধ হইবে। ইহার সুযোগও শীঘ্রই ঘটিল। তাহার স্বামী শিক্ষা লাভের জন্য বিলাত গমন করিলে দেবর-ভাবীতে প্রাণ ভরিয়া মজা লুটিল এবং উভয়ে ভ্রাতা ও স্বামীর প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করিল। গল্প লেখক এই কুকীর্তি স্বয়ং ব্যাভিচারিণী বালিকার লিখনীতেই প্রকাশ করিতেছে। সে তাহার অবিবাহিতা বান্ধবীর নিকট যাবতীয় কার্যকলাপ পত্রাকারে লিখিয়া পাঠাইতেছে। যাবতীয় প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করিয়া কিরূপে দেবর ও ভাবীর প্রেম চরম পরিণতি লাভ করিল, সে তাহার বিস্তারিত বিবরণ লিখিয়া জানাইতেছে। নিবিড় বাহুবন্ধন ও যৌনমিলনের সময় দেহমনের যে আনন্দমন্ডতা ঘটে, তাহার কোন কিছুই পত্রে অপ্রকাশ রাখা হয় নাই। শুধু যৌন-ক্রিয়ার চিত্রাংকটুকুই অবশিষ্ট রহিয়াছে। সম্ভবত এইরূপ ধারণা লইয়াই এই ত্রুটি-বিচ্যুতিটুকু রাখা হইয়াছে যে পাঠকপাঠিকা স্বয়ং কল্পনার তুলিতে সে অভাবটুকু পূরণ করিবে।
ফরাসী দেশের যে দৃষ্টান্ত পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার সহিত যদি নূতন সাহিত্যের তুলনা করা যায়, তাহা হইলে স্পস্ততই প্রতীয়মান হইবে যে, এই শেষোক্ত অভিযাত্রীদল একই পথ ধরিয়া একই গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিয়াছে। সেই জীবন ব্যবস্থার জন্যই দৃষ্টিভঙ্গী ও নৈতিকতার দিক দিয়া মন-মস্তিস্ক তৈরী করা হইতেছে, বিশেষ করিয়া নারীদের প্রতিই তাহাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়া আছে, যাহাতে তাহাদের মধ্যে লজ্জা-সম্ভ্রমের শেষ লেশটুকুও অবশিষ্ট না থাকে।
নূতন সংস্কৃতি
বাস্তবক্ষেত্রে যে শুধু এই নৈতিক দর্শন ও জীবন পদ্ধতি পাওয়া যায় তাহা নহে, ইহার সংগে পুঁজিপতিসুলভ সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক মূলনীতিও কার্যকরী হইয়াছে। পাশ্চাত্য জীবনের যে চিত্র নির্মিত হইয়াছে, এই ত্রিবিধ শক্তি সম্মিলিত উপায়ে তাহাই করিতেছে। যৌন-বিজ্ঞান সম্পর্কে নিকৃষ্টতম অশ্লীল সাহিত্য রচনা করিয়া তাহা স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়ান হইতেছে। নগ্ন চিত্র ও চরিত্রহীনা নারীর ছবি প্রতিটি সংবাদপত্র, পুস্তিকা, গৃহ ও দোকান ঘরের শোভা বর্ধন করিতেছে। গৃ্ষক গৃহে ও হাটে-বাজারে অতীব অশ্লীল অরুচিকর গ্রামোফোন রেকর্ড বাজান হইতেছে। সিনেমার যাবতীয় কার্যকলাপ যৌন উত্তেজনাই বাড়াইতেছে। শুভ্র উজ্জ্বল পর্দায় উহা প্রতি সন্ধ্যায় অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতাকে এমন চিত্তাকর্ষক করিয়া ফুটাইয়া তুলিতেছে যে, প্রত্যেক বালক-বালিকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবনকে উৎকৃষ্ট আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করিতেছে। এইরূপ কামনা-বাসনা উদ্দীপক অভিনয় দর্শন করত যুবক-যুবতিগণ যখন রঙ্গমঞ্চের বাহিরে পদার্পণ করে, তখন তাহারা অধীর উদ্যমে চতুর্দিকে প্রেম-ফাদ বিস্তারের সুযোগ খুজিতে থাকে। এই সব কিছুই ধনতান্ত্রিক সুযোগসুবিধার বিভিন্ন রূপ। এই ধনতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার কৃপায় বড় বড় শহরে দ্রুত গতিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হইতেছে যে, তথায় নারীদের পক্ষে স্বয়ং জীবিকান্বেষণ অপরিহার্য হইয়া পড়ে। এই উৎপীড়কমূলক ব্যবস্থার সাহায্যেই ঔষধ পত্রাদি ও যন্ত্রপাতিসহ প্রচারণা শুরু হইয়াছে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আশীর্বাদ প্রধানত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাধ্যমেই প্রাচ্যের দেশগুলিতে পৌছিয়াছে। ইহা প্রধারনত নারীদের জন্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতার পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে।
দ্বিতীয়ত ইহা এমন কতকগুলি সংস্থা স্থাপিত করিয়াছে, যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা অপরিহার্য হইয়া পড়ে। তৃতীয়ত; ইহা আইনের বন্ধনকে এমন শিথিল করিয়া দিয়াছে যে, অশ্লীলতার ইচ্ছা প্রকাশই শুধু নহে, বরং উহাকে কার্যে পরিণত করিলেও তাহা অধিকাংশ সময়ে মোটেই অপরাধজনক বলিয়া বিবেচিত হয় না।
এমতাবস্থায় যাহারা পূর্ণ আত্মপ্রত্যয় সহকারে জীবনের এই পথে চলিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছে, তাহাদের নৈতিকতা ও সামাজিকতায় প্রায় পূর্ণ বিপ্লবই ঘটিয়াছে। এখন তাহাদের মহিলাগণ এমন বেশভূষায় বাহির হউ যে, তাহাদিগকে দেখিলে ফিল্ম অভিনেত্রী বলিয়া ভ্রম হয়। ইহাদের ঔদ্ধত্য ঈমন চরমে পৌছিয়াছে যে, ইহাদের বস্ত্রের নগ্নতা, রূপসৌন্দর্যের নির্লজ্জ অভিব্যক্তি, সাজ-সজ্জার অতি আয়োজন এবং প্রতিটি কমনীয় ভঙ্গী দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যৌন-চুম্বক সাজা ব্যতীত এই সকল নারীর অন্য কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই নাই। ইহাদের লজ্জাহীনতা এমন চরমে পৌছিয়াছে যে, স্নানের পোশাক পরিধান করিয়া পুরুষের সহিত স্নান করা এবং সেই অবস্থায় ফটো তুলিয়া তাহা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা এই শ্রেণীর কোন সম্ভ্রান্ত মহিলার জন্য লজ্জাকর বিবেচিত হয় না। এমন কি লজ্জার কোন প্রশ্নই সেখানে উঠে না। আধুনিক নৈতিক মতবাদ অনুযায়ী মানব-দেহের সকল অংশই সমান। যদি হাতের তালু এবং পায়ের তলা উন্মুক্ত রাখা চলে, তাহা হইলে নিতম্ভ প্রদেশ ও কৃচাগ্রভাগ উন্মুক্ত রাখিলে দোষ কি? জীবনের আনন্দ সম্ভোগ যাহার বহিঃপ্রকাশকে সামগ্রিকভাবে আর্ট বা শিল্পকলা বলা হয় – ইহাদের নিকট তাহা যাবতীয় নৈতিকতার ঊর্ধ্বে। এমন কি ইহারা তাহাদের চারিত্রিক কষ্টিপাথর। ইহাকে ভিত্তি করিয়া পিতা এবং ভ্রাতার আনন্দ ও গর্বে বুক ফুলিয়া যায়, যখন তাহারা দেখে যে, তাহাদের সম্মুখে কন্যাভগ্নি রঙ্গমঞ্চের উপরে নৃত্য-গীত ও প্রেমপূর্ণ কমনীয় ভঙ্গিমা দ্বারা শত শত উন্মুখ শ্রোতা ও দর্শকের প্রশংসাধ্বনি লাভ করিতেছে। বৈষয়িক সাফল্য-যাহার দ্বিতীয় নাম জীবনের উদ্দেশ্য… তাহাদের মতে ঐ সকল বস্তু হইতে অধিকতর মূল্যবান যাহাকে বিসর্জন দিয়া ইহা লাভ করা যায় যে, নারী বাঞ্ছিত মুল পদার্থ এবং সমাজের জনপ্রিয়তা লাভের যোগ্যতা অর্জন করিল, সে সতীত্ব হারাইয়া ফেলিলেও কিছুই হারাইল না, বরং সব কিছুই লাভ করিল। এই কারণে ইহা তাহারা কিছুতেই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে না যে, কোন বালিকার বালকের সংগে কলেজে সহ-অধ্যায়ন অথবা ভরা যৌবনে শিক্ষার উদ্দেশ্যে একাকিনী ইউরোপ গমন কেনই বা দূষণীয় হইবে?
পাশ্চাত্যের দাসানুদাসগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে
ইহারাই ঐ সকল ব্যক্তি, যাহারা পর্দা প্রথার অধিকতর সমালোচনা করিয়া থাকে। তাহাদের মতে পর্দা এমন তুচ্ছ ও প্রকট মিথ্যা বস্তু যে, তাহা রহিতকরণের জন্য বিদ্রুপ ও কৌতুক পরিহাসই যথেষ্ট। কিন্তু এই ধারণা অবিকল এরূপ লোকের ন্যায়, যে তাহার মুখমণ্ডলের উপরে নাকের কোন আবশ্যকতাই বোধ করে না এবং এই জন্য সে যাহারই নাক দেখিতে পায় তাহাকেই বিদ্রুপ করিতে থাকে। এইরূপ নির্বোধ যুক্তির দ্বারা একমাত্র নির্বোধেরাই পরাভূত হইতে পারে। তাহাদের মধ্যে যদি কণামাত্র যৌক্তিকতার লেশ থাকিত তাহা হইলে তাহারা অবশ্যই বুঝিতে পারিত যে, তাহাদের ও আমাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যমানের মৌলিক পার্থক্য রহিয়াছে। যাহাকে আমরা মূল্যবান মনে করি, তাহা তাহাদের নিকট মূল্যহীন। অতএব নিজেদের মূল্যমানের নিরিখ অনুযায়ী যে কাজকে আমরা আবশ্যক মনে করি তাহা অবশ্যম্ভাবীরূপে তাহাদের দৃষ্টিতে শুধু অনাবশ্যক নহে, অর্থহীনও বিবেচিত হয়। কিন্তু এইরূপ মৌলিক মতভেদের স্থলে একমাত্র স্বল্পজ্ঞানী ব্যক্তিই মতভেদের প্রকৃত মুল বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করার পরিবর্তে উহার শাখা-প্রশাখা লইয়া কলহ করিতে পারে। মানবীয় মুল্যমান নির্ণয়ে একমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মকেই মানিয়া চলিতে হইবে। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী মানুষের শারীরিক গঠন প্রকৃতি যে বিষয়ের দাবি করে এবং যাহাতে মানুষের কল্যাণ ও সুখ-শান্তি হইতে পারে, তাহাই প্রকৃতপক্ষে মুল্যমান নিরুপনের যোগ্য।
অতএব, তাই এই কষ্টিপাথর দ্বারা যাচাই-পরীক্ষা করিয়া দেখি মূল্যমানের মতবিরোধে আমরা সঠিক পথে আছি, না তোমরা আছ। জ্ঞানবিজ্ঞানের যুক্তি-প্রমাণ তোমাদের যাহা আছে, তাহা লইয়া আইস, যাহা আমাদের আছে তাহা আমরা উপস্থিত করিতেছি। অতপর ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানবান লোকের ন্যায় লক্ষ্য করিয়া দেখ, গুরুত্ব কোন দিকে। এই পন্থায় যদি আমরা মূল্যমানের নিরিখ প্রমাণ করিয়া দেই, তাহা হইলে তোমরা বিশুদ্ধ জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মূল্যমানকে ইচ্ছা করিলে গ্রহণও করিতে পার কিংবা নিছক প্রবৃত্তির অনুরাগে গৃহীত মূল্যমানেরও অনুসরন করিতে পার। কিন্তু স্মরণ রাখিও এই দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করিলে তোমাদের অবস্থা এমন শোচনীয় হইয়া পড়িবে যে, আমাদের কর্মপদ্ধতির প্রতি উপহাস করার পরিবর্তে তোমরা নিজেরাই হাস্যম্পদ হইয়া পড়িবে।
দ্বিতীয় দল
ইহাদের পরে আর একটি দল আছে। প্রথম দলে অমুসলমান ও নামেমাত্র মুসলমান উভয়েই আছে। কিন্তু দ্বিতীয় দলটি সামগ্রিকভাবে মুসলমান দ্বারাই পরিপূর্ণ। ইহাদের মধ্যে আজকাল আধা-পর্দা এবং আধা প্রগতির এক বিচিত্র সংমিশ্রণ দেখা যায়। ইহারা এদিকেও নয়, অদিকেও নয়; এমন দোদুল্যমান দলের ন্যায়। একদিকে তাহারা ইসলামী ঝোঁক প্রবণতা পোষণ করে, চরিত্র, সভ্যতা, আভিজাত্য ও সুন্দর স্বভাবের ইসলাম কর্তৃক উপস্থাপিত কষ্টিপাথর মানিয়া চলে, আপন নারীদিগকে সম্ভ্রম সতীত্বের ভূষণে অলংকৃত করিতে এবং আপন গৃহগুলিকে নৈতিক অপবিত্রতা হইতে রক্ষা করিতে অভিলাষী হয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সামাজিকতার মৌলিক নীতি অনুসারে যে সকল পরিণাম ফল পরিস্ফুট হওয়া স্বাভাবিক, তাহা মানিয়া লইতেও ইহারা রাজী নহে। কিন্তু অপরদিকে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মূলনীতি ও আইনকানুনকে চূর্ণ করত কিছুটা নিজেকে সংযত রাখিয়া এবং কিছুটা কিছুটা সঙ্কচ করিয়া নিজেদের স্ত্রী-ভগ্নি-কন্যাদিগকে পাশ্চাত্য সভ্যতার পথেই লইয়া চলিয়াছে। ইহারা ভ্রমাত্মক ধারণা লইয়া আছে যে, তাহারা অর্ধ পাশ্চাত্য ও অর্ধ ইসলামী পন্থা একত্র করিয়া উভয় সভ্যতার সুযোগ-সুবিধাগুলি ভোগ করিবে অর্থাৎ তাহাদের গৃহে ইসলামী চরিত্রও অক্ষুন্ন থাকিবে, পারিবারিক জীবনের শৃঙ্খলাও ঠিক থাকিবে। তৎসহ তাহাদের সামাজিকতার মধ্যে পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার শুধু কুফলসমুহই নহে, বরং উহার আত্মপ্রবঞ্চনা, ভোগবিলাস ও বৈষয়িক সুযোগসুবিধাগুলিও সন্নিবেশিত থাকিবে। কিন্তু প্রথম কথা এই যে, ভিন্ন আদর্শ ও ভিন্ন লক্ষ্যসহ দুইটি বিপরীতমুখী সভ্যতার অর্ধাংশদ্বয়কে একত্রে গ্রথিত করাই ন্যায়সংগত হইবে না। কারণ এইরূপ অসামঞ্জস্য একত্র করণের ফলে উভয়ের গুনাবলীর পরিবর্তে দোষগুলিই একত্র হওয়ার আশংকা বেশি থাকে।
দ্বিতীয়ত ইহাও অযৌক্তিক ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ যে, একবার ইসলামের সুদৃঢ় নৈতিক ব্যবস্থার বন্ধন শিথিল করিবার পর এবং মানুষ আইন ভংগ কার্যে আনন্দ লাভ করিতে থাকিবার পর উহাকে এমন এক সীমারেখায় আবদ্ধ রাখা সম্ভব হইবে, যাহার দ্বারা কোন ক্ষতির আশংকা থাকিবে না। এই অর্ধ নগ্ন পরিচ্ছদের পরিবর্তন, এই সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার লালসা, এই বন্ধুবান্ধবের বৈঠকাদিকে নির্ভীক নির্লজ্জতার প্রাথমিক শিক্ষা, এই সিনেমা, নগ্ন চিত্রাদি এবং প্রেমপূর্ণ গল্প ও নাটকাদির প্রতি বর্ধনশীল অনুরাগ, এই পাশ্চাত্য ধরনে মেয়েদের শিক্ষা হয়ত তাহাদের পূর্ণ ক্রিয়া বিস্তার করিতে পারিবে না, হয়ত বর্তমান বংশধরও ইহার কুফল হইতে নিরাপদ থাকিবে। কিন্তু তাই বলিয়া ভবিষ্যৎ বংশধরও ইহার কুফল হইতে নিরাপদ থাকিবে, এইরূপ চিন্তা করা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হইবে। সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে তুচ্ছ বিষয় হইতেই ভুলের সুত্রপাত হইয়া থাকে। কিন্তু উক্ত তুচ্ছ ভ্রমটিই বংশানুক্রমে বর্ধিত হইয়া এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ইউরোপ ও আমেরিকায় যে সমস্ত ভ্রান্ত মৌলিক ভিত্তির উপর সমাজ ব্যবস্থার আধুনিক রূপ দেওয়া হইয়াছিল তাহার পরিণাম ফল সংগে সংগেই পরিস্ফুট হয় নাই বরং তাহার পূর্ণ পরিণাম ফল সম্প্রতি তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষে আসিয়া পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে। অতএব, এই পাশ্চাত্য ও ইসলামী ব্যবস্থার সংমিশ্রণ এবং এই অর্ধ প্রগতি প্রকৃতপক্ষে কোন চিরস্থায়ী ও অটল বস্তু নহে, বরং ইহার স্বাভাবিক অনুরাগ পাশ্চাত্যবাদের দিকেই রহিয়াছে। যাহারা এই পথে চলিতেছে, তাহাদের জানিয়া রাখা উচিত যে, তাহারা যে যাত্রা শুরু করিয়াছে গন্তব্য স্থলে তাহারা নিজেরা পৌছাইতে না পারিলেও তাহাদের পুত্র-পৌত্রাদি নিশ্চয় তথায় পৌছিয়া ক্ষান্ত হইবে।
সিদ্ধান্তকর প্রশ্ন
এমতাবস্থায় সম্মুখে অগ্রসর হইবার পূর্বে সকল লোককে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করিয়া নিম্নের মৌলিক প্রশ্নের সমধান করিয়া লইতে হইবে। তাহা এইঃ
তোমরা কি পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার ঐ সকল পরিণাম ফল ভোগ করিতে প্রস্তুত আছ, যাহা ইউরোপ-আমেরিকায় প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে এবং যাহা উক্ত সমাজ ব্যবস্থারই স্বাভাবিক পরিণতি? তোমরা কি ইহাই চাও যে, তোমাদের সমাজেও ঐরূপ উত্তেজনামূলক ও যৌন উন্মাদনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হইক? তোমাদের জাতির মধ্যে ঐরূপ নির্লজ্জতা, সতীত্বহীনতা ও অশ্লীলতার প্লাবন হউক? রতিজ দুষ্টব্যাধি মহামারী আকারে ছড়াইয়া পড়ুক? পারিবারিক ও গৃহের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হউক? তালাক অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ ও পৃথকীকরণের ব্যাপক প্রচলন হউক? যুবক-যুবতী স্বাধীন যৌনক্রিয়ায় অভ্যস্ত হইয়া পড়ুক? জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত, ভ্রূণহত্যা, প্রসুত হত্যা প্রভৃতির দ্বারা বংশ বৃদ্ধি বন্ধ করা হউক? যুবক-যুবতী সীমাতিরিক্ত যৌন উন্মত্ততায় নিজেদের বৃহত্তম কার্যকরী শক্তি ও স্বাস্থ্য নষ্ট করুক? এমন কি অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকদের মধ্যে অসময়ে যৌন প্রবণতার উন্মেষ হইতে থাকুক এবং তাহার ফলে মানসিক ও শারীরিক স্ফুরণে প্রথম হইতেই বিকল্পতা বদ্ধমুল হইয়া পড়ুক?
যদি বৈষয়িক লাভ ও ইন্দ্রিয় লালসার জন্য তোমরা এই সকল মানিয়া লইতে প্রস্তুত হও, তাহা হইলে দ্বিধাহীন চিত্তে পাশ্চাত্য সভ্যতার পথে চল এবং তখন আর ইসলামের নাম মুখে লইও না। ঐ পথে চলিবার পূর্বে ইসলামের সহিত তোমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করিবার কথা ঘোষণাও করিতে হইবে, যেন পরে তোমরা ইসলামের নামে কাহাকেও প্রতারিত করিতে না পার এবং তোমাদের এই লাঞ্ছিত অবস্থা যেন ইসলাম ও মুসলমানের জন্য কোন লজ্জা বা দোষের কারণ হইয়া না পড়ে।
কিন্তু তোমরা যদি এই সকল পরিণাম ফল মানিয়া লইতে প্রস্তুত না থাক, যদি তোমরা এমন এক মহান ও পবিত্র সংস্কৃতির আবশ্যকতা উপলব্ধি কর যেখানে পুত চরিত্র ও সম্ভ্রমশীল অধিকার প্রতিপালিত হইতে পারে, যেখানে মানুষ তাহার মানসিক, আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উন্নতির জন্য শান্ত পরিবেশ লাভ করিতে পারে, যেখানে নারীপুরুষ পারস্পরিক উত্তেজনার ত্রুটিবিচ্যুতি হইতে নিরাপদ থাকিয়া নিজেদের সর্বোত্তম যোগ্যতা অনুযায়ী আপন সাংস্কৃতিক কর্তব্য পালন করিতে পারে, যেখানে সংস্কৃতির ভিত্তিপ্রস্তর অর্থাৎ পরিবার সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে, যেখানে বংশধর নিরাপদ হয় এবং জাতির সংমিশ্রণের আশংকাও থাকে না, যেখানে মানুষের পারিবারিক জীবন আনন্দ ও শান্তির নিকেতন হইয়া পড়ে, সন্তান-সন্ততির জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ শিক্ষার পাদপীঠ হইয়া পড়ে এবং পরিবারের সমুদয় লোক সম্মিলিতভাবে পারস্পরিক সহানুভুতির সহিত কার্য সম্পাদন করিতে পারে? তাহা হইলে এই সকল মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তোমাদিগকে পাশ্চাত্যমুখী হওয়া চলিবে না। কারণ পাশ্চাত্য এক সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে যাত্রা করিয়াছে এবং পশ্চিমে যাত্রা করিয়া পূর্বে উপনীত হওয়া যুক্তির দিক দিয়াও অসম্ভব। যদি সত্যই তোমাদের বাসনা এই হয়, তাহা হইলে তোমাদিগকে ইসলামের পথই অবলম্বন করিতে হইবে।
কিন্তু এই পথে পদক্ষেপ করিবার পূর্বে তোমাদিগকে ঐ সকল বৈষয়িক লাভ ও ইন্দ্রিয় ভগ-বিলাসের আকাঙ্ক্ষা মন হইতে বিদূরিত করিতে হইবে, যাহা পাশ্চাত্যের আত্মপ্রবঞ্চনামুলক বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী ও ভাবধারাকেও মন-মস্তিস্ক হইতে মুছিয়া ফেলিতে হইবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা হইতে গৃহীত যাবতীয় মূলনীতিও বর্জন করিতে হইবে। ইসলামের নিজস্ব মৌলিক নীতি ও উদ্দেশ্য আছে। তাহার নিজস্ব শাশ্বত সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীয়ও আছে। সে তাহার মৌলিক নীতি, উদ্দেশ্য ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী তদনুরূপই এক সামাজিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করিয়াছে। অতপর সে এই সামাজিক ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ এক বিশেষ অনুশাসন নিয়ম নিষ্ঠার মাধ্যমে করিয়া থাকে। এই সকল নিয়ম-নীতি ও অনুশাসন [Discipline] প্রতিষ্ঠা করিতে চরম নিপুণতা ও মানবীয় মনস্তত্ত্বের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হইয়াছে। কারণ ইহার অভাবে এই সামাজিক ব্যবস্থা ত্রুটিবিচ্যুতি ও বিশৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইতে পারে না। ইহা প্লেটোর গনতন্ত্রের ন্যায় কোন কাল্পনিক ব্যবস্থা অথবা Sir Thomas More – এর কল্পিত সুখরাজ্য [Utopia] বা রামরাজ্য নহে, বরং ইহা চৌদ্দ শত বৎসরের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ব্যবস্থা। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে কোন দেশ ও জাতির মধ্যে ইহার প্রভাবে ঐ সকল কুফলের এক-দশমাংশও পরিস্ফুটিত হইতে দেখা যায় নাই, যাহা পাশ্চাত্য সভ্যতায় এক শতাব্দীর মধ্যেই প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে। এই সুদৃঢ় ও সুপরিকল্পিত সামাজিক ব্যবস্থার দ্বারা যদি তোমরা লাভবান হইতে চাও, তাহা হইলে তাহার অনুশাসন ও নিয়ম নীতি পরিপূর্ণরূপে মানিয়া চলিতে হইবে। অতপর এই সামাজিক ব্যবস্থার প্রকৃতিবিরুদ্ধ অন্য কোন স্বকল্পিত অথবা অপরের নিকট হইতে শিক্ষাপ্রাপ্ত অচল ও ধিকৃত পন্থা ইহার মধ্যে সন্নিবেশিত করার কোন অধিকারই তোমাদের থাকিবে না।
তৃতীয় দলটি যেহেতু কতগুলি নির্বোধ বিবেক-বিবেচনাহীন লোক লইয়া গঠিত, যাহাদের কোন বিচার করিয়া সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা নাই, সেইজন্য তাহারা উপেক্ষার পাত্র। অতএব ইহাদের সম্পর্কে আলোচনা না করিয়া সম্মুখে অগ্রসর হওয়াই বাঞ্ছনীয়।