নব্য যুগের মুসলমান
দুইটি বিপরীত চরম সীমাতিক্রমের গোলক ধাঁধায় বিভ্রান্ত জগতকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে সক্ষম ছিল একমাত্র মুসলমানই । কারণ একমাত্র তাহারই নিকটে ছিল সামাজিক জীবনের যাবতীয় জটিল সমস্যার সঠিক সমাধান। কিন্তু পৃথিবীর ভাগ্যের ইহা এক বিস্ময়কর ও মর্মন্তুদ পরিহাস যে, এই অমানিশার অন্ধকারে যাহার হস্তে আলোকবর্তিকা ছিল, সেই হতভগ্যই রাত্রান্ধ হইয়া পড়িল। অপরকে পথ-প্রদর্শন করা তো দূরের কথা, বরং সে নিজেই অন্ধের ন্যায় পথভ্রষ্ট হইয়া পড়িল এবং এক একটি পথভ্রষ্টের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া চলিল।
যে সমস্ত শরীয়তের নির্দেশের সমষ্টিগত রুপকে বুঝাইবার জন্য পর্দা শব্দটি শীর্ষনাম হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহা প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সমাজ বিধানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশাবলীর অন্তর্ভুক্ত।এই সমাজ বিধানের মানদণ্ডে উক্ত নির্দেশাবলীকে যথাযথভাবে স্থাপন করিলে যে কোন স্বাভাবিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিই এইরূপ স্বীকারোক্তি না করিয়া পারিবে না যে, সমাজ ব্যবস্থায় ইহা ব্যতীত মিতাচার এবং মধ্যপন্থার অন্য কোন উপায়ই থাকিতে পারে না। যদি এই বিধি-বিধানকে সত্যিকারভাবে প্রত্যক্ষ জীবনে রূপায়িত করা যায়, তাহা হইলে দুঃখ বেদনাক্লিষ্ট পৃথিবী বিনা প্রতিবাদে শান্তির এই উৎসের দিকে দ্রুত ধাবিত হইবে এবং তাহা নিঃসন্দেহে সামাজিক ব্যাধির মহৌষধ লাভ করিবে। কিন্তু এই কার্য কাহার দ্বারা সম্পাদিত হইবে? ইহা সম্পাদন করিবার ক্ষমতা যাহার ছিল সে-ই যে দীর্ঘকাল যাবত পীড়িত হইয়া আছ। সুতরাং সম্মুখে অগ্রসর হইবার পূর্বে তাহার ব্যাধিটিও কিঞ্চিৎ পরীক্ষা করিয়া দেখা আবশ্যক।
ঐতিহাসিক পটভূমি
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালে পাশ্চাত্য জাতিসমূহের দেশ জয়ের প্লাবন প্রচণ্ড ঝঞ্জাবেগে মুসলিম দেশগুলিকে নিমজ্জিত করিয়া ফেলেছিল। এই সময়ে মুসলমানগণ অর্ধনিদ্রিত ও অর্ধজাগ্রত অবস্থায় ছিল এবং দেখিতে দেখিতে এই ঝঞ্জা-প্লাবন প্রাচ্য হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতীচ্যের সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করিয়া ফেলিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে উপনীত হইতে না হইতেই অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র ইউরোপের গোলাম হইয়া পড়িল এবং অপরাপর দেশগুলি গোলাম না হইলেও পরাভূত ও প্রভাবিত হইয়া পড়িল। এই সর্বধ্বংসী বিপ্লব পূর্ণ দানা বাঁধিয়া উঠিবার পর মুসলমানদের চক্ষু উন্মিলিত হইতে লাগিল। দিগ্বিজয় ও রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে উন্নতিশীল মুসলমানদের যে জাতীয় গৌরব সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা অপ্রত্যাশিতরূপে ধূলিস্মাৎ হইয়া গেল। অতঃপর ক্ষমতাবান শত্রুর উপর্যুপরি আঘাতে মাদকতামুক্ত মদ্যপায়ীর ন্যায় তাহারা স্বীয় পরাজয় এবং ইউরোপীয়দের জয় লাভের কারণ সম্পর্কে গবেষণা করিতে লাগিল। কিন্তু তখনও মস্তিষ্ক প্রকৃতিস্থ হয় নাই। মাদকতা যদিও কাটিয়া গিয়াছে, কিন্তু মানসিক ভারসাম্য তখনও বিকল রহিয়াছে। একদিকে অপমান-অসম্মানের তীব্র অনুভূতি তাহাদের এতাদৃশ হীনাবস্থার পরিবর্তন সাধনের জন্যও চাপ দিতেছিল এবং অপরদিকে বহু শতাব্দীর বিলাস প্রিয় শ্রমবিমুখ জীবন পদ্ধতি অবস্থা পরিবর্তনের সহজতম ও নিকটতম পন্থা অনুসন্ধান করিতেছিল। উপরন্তু তাহারা জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা-বিবেচনার জীর্ণ শক্তিগুলিকে কার্যে নিয়োজিত করিতে অনভ্যস্থ হইয়া পড়িয়াছিল। এতদ্ব্যতীত পরাভূত গোলাম জাতির মধ্যে অপ্রত্যাশিতরূপে যে সন্ত্রস্ততা ও ভয়-বিহবলতার সৃষ্টি হয়, তাহাও তাহাদের মধ্যে সঞ্চারিত হইয়াছিল। এহেন বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণের ফলে সংস্কারপ্রিয় মুসলমানগণ নানাবিধ কল্পনাত্মক ও ব্যবহারিক পাপাচারে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। তাহাদের অধিকাংশই নিজেদের হীনতা, দুর্নীতি ও ইউরোপের উন্নতি বিধানের প্রকৃত হেতুই অনুধাবন করিতে পারিল না। আবার যাহারা অনুধাবন করিল, তাহাদের মধ্যে এতটুকু সৎ সাহস, সহনশীলতা এবং সংগ্রামী মনোভাব ছিল না যে, উন্নতির দুর্গম পথ অতিক্রম করে। এই উভয় দলের মধ্যেই দুর্বলতা ও ভয়বিহ্বলতা সমানভাবে বিদ্যমান ছিল। এইরূপ বিভ্রান্ত মানসিকতায় তাহাদের উন্নতির সহজতর পন্থা এই ছিল যে, পাশ্চাত্য তাহযীব-তমদ্দুনের বাহ্যদৃশ্যাবলী তাহারা তাহাদের জীবনে প্রতিফলিত করে এবং স্বয়ং এমন দর্পণ হইয়া যায় যাহার অভ্যন্তরে সুরম্য উদ্যান ও বসন্ত কান্তিরাজির মনোহর দৃশ্যপট প্রতিবিম্বিত হয়, অথচ প্রকৃত উদ্যান ও তাহার সৌন্দর্য শোভার কোন অস্তিত্বই থাকে না।
মানসিক দাসত্ব
ব্যাধির এই চরম পর্যায়ে পাশ্চাত্য বেশভূষা, সমাজ ব্যবস্থা, সাহিত্য-কলা, আচার-আচরণ, চাল-চলন প্রভৃতি অনুকৃত হইতে লাগিল। এমন কি বাকভঙ্গিমাতেও পাশ্চাত্য অনুকরণ প্রকট হইয়া পড়িল। মুসলমান সমাজকে পাশ্চাত্য আদর্শে ঢালিয়া সাজাইবার প্রচেষ্টা চলিতে লাগিল। খোদাদ্রোহিতা, নাস্তিকতা ও জড়বাদিত্ব অন্ধের ন্যায় ‘ফ্যাশান’ হিসাবে গৃহীত হইল। পাশ্চাত্যের আমদানীকৃত স্পষ্ট অথবা অস্পষ্ট চিন্তাধারা ও মতবাদের প্রতি অন্ধের ন্যায় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বৈঠকাদিতে উহাকে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে উপস্থাপিত করা পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারার পরিচায়ক মনে করা হইল। মদ্যপান, জুয়া, লটারি, ঘোড়দৌড়, থিয়েটার, নৃত্যগীত ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতপ্রসূত অন্যান্য বিষয়ও তৎসঙ্গে গৃহীত হইল। শ্লীলতা, নৈতিকতা, সামাজিক আদানপ্রদান, জীবিকার্জন, রাজনীতি, আইন-কানুন এমন কি ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানাদি বিষয়ক যত প্রকার দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্ম পদ্ধতি ছিল তাহা সবই বিনা প্রতিবাদ ও চিন্তা-গবেষণায় আকাশ হইতে অবতীর্ণ ওহীর ন্যায় –‘শ্রবণ করিলাম ও মানিয়া লইলাম’-বলিয়া গৃহীত হইল। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, ইসলামী শরীয়তের নির্দেশাবলী ও কুরআন-হাদীসের বর্ণনাগুলির প্রতি অতীতের ইসলামবৈরিগণ যেরূপ ঘৃণা পোষণ ও প্রতিবাদ করিয়াছে, এই যুগের মুসলমানগণও তদ্রুপ ইহার জন্য লজ্জাবোধ করিতা লাগিল এবং তাহারা এই কলংক মোচনে সচেষ্ট হইয়া উঠিল।
পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ প্রভুগণ ইসলামী জিহাদের তীব্র সমালোচনা করিল। ইহারাও (মুসলমানগণ) প্রভুদের চরণে কৃতাঞ্জলি নিবেদন করিয়া বলিল, ‘হুযুর। কোথায় আমরা আর কোথায় জিহাদ!’ তাহারা দাস প্রথার সমালোচনা করিল। ইহারা বলিল, ‘ইহা তো ইসলামে একেবারেই নিষিদ্ধ।‘ তাহারা বহু বিবাহের সমালোচনা করিলে তৎক্ষণাৎ কুরআনের একটি আয়াত বা নির্দেশকে রহিত করিয়া দিল। তাহারা বলিল, ‘নারী ও পুরুষের মধ্যে পূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ ইহারা বলিল, ‘ইহাই তো আমাদের ধর্মের মূল কথা।’ তাহারা বিবাহ-তালাকের সমালোচনা করিলে ইহারা তৎসমূহের সংশোধনীর জন্য তৎপর হইয়া পড়িল। তাহারা বলিল, ‘ইসলাম তো শিল্পকলার শত্রু।’ ইহারা তদুত্তরে বলিল, ‘হুযুর! ইসলাম তো চিরকালই নৃত্য-গীত, চিত্রাংকন ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া আসিয়াছে।’
পর্দা প্রসঙ্গে সূচনা
মুসলমানদের জাতীয় ইতিহাসে ইহাই সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় ও লজ্জাকর যুগ। যেহেতু এই যুগেই পর্দাপ্রথা লইয়া বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তর্কের বিষয়বস্তু যদি এই হইত যে, ইসলাম নারী স্বাধীনতার কি সীমা নির্ধারণ করিয়াছে, তাহা হইলে ইহার জওয়াব মোটেই কঠিন হইত না। কারণ এই ব্যাপারে যতটুকু মতানৈক্য পরিদৃষ্ট হয় তাহা এই পর্যন্ত যে, নারী তাহার মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় অনাবৃত রাখিতে পারে কিনা; ইহা কোন গুরুত্বপূর্ণ মতভেদ নহে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এইস্থলে অন্যরূপ। মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন এইজন্য উত্থিত হইয়াছে যে, ইউরোপ ‘হেরেম’ পর্দা ও নারীর বহিরাবরণকে ঘৃণার চোখে দেখিয়াছে। ইউরোপীয়গণ তাহাদের সাহিত্যে ইহার ঘৃণাব্যঞ্জক ও বিদ্রুপাত্মক চিত্র অংকিত করিয়াছে, ইসলামের দোষত্রুটির তালিকায় নারীদের ‘অবরোধ’কে (পর্দা) বিশিষ্ট স্থান দিয়াছে। ইউরোপ যখন পর্দাকে ঘৃণার্হ বলিয়া পরিত্যাগ করিয়াছে তখন তাহাদেরই মানসিক দাসানুদাস মুসলমানদের পক্ষে কেমন করিয়া ইহা সম্ভব যে, ইহার জন্য তাহারা স্বভাবতই লজ্জা বোধ করিবে না? তাহারা জিহাদ, দাসপ্রথা, বহুবিবাহ ও এবম্বিধ অন্যান্য ব্যাপারে যে ব্যাবস্থাবলম্বন করিয়াছে, এই বিষয়েও তাহাই করিল। তাহারা কুরআন, হাদীস এবং ফিকাহতত্ববিদ ইমামগণের গভীর গবেষণাপ্রসূত গ্রন্থাবলীর পৃষ্ঠা উলটাইতে লাগিল। উদ্দেশ্য এই ছিল যে, সেই কুৎসিত কলংক কালিমা অপনোদনের জন্য কোন উপায়-উপাদান তাহার মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় কি-না। জানিতে পারা গেল যে, কোন কোন ইমাম হস্ত ও মুখমণ্ডল অনাবৃত রাখিবার অনুমতি দিয়াছেন। ইহাও জানা গেল যে, নারী তাহার আবশ্যক কার্যের জন্য গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে পারে। উপরন্তু আরও জানিতে পারা গেল, নারী যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের পানি পান করাইতে এবং আহতদের সেবা করিতে পারে। নামাযের জন্য মসজিদে ও শিক্ষা গ্রহন ও শিক্ষা দানের জন্য অন্যত্র গমন করিতে পারে। ব্যস, এতটুকুই তাহাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। অতঃপর তাহারা ঘোষণা করিল, ‘ইসলাম নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করিয়াছে। পর্দা নিছক অন্ধ বর্বর যুগের একটি প্রাচীন প্রথা মাত্র। ইসলামের প্রাথমিক যুগের (খিলাফতে রাশেদার) বহু পরে সংকীর্ণমনা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানগণ ইহার প্রচলন করিয়াছে। কুরআন-হাদীসে পর্দার কোন নির্দেশ নাই। ইহার মধ্যে লজ্জা-সম্ভ্রম সম্পর্কে নৈতিক শিক্ষা দান করা হইয়াছে মাত্র। এমন কোন নীতি নির্ধারিত হয় নাই, যাহার দ্বারা নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হইতা পারে।’
গোড়ার কথা
মানুষের ইহা একটি স্বাভাবিক দুর্বলতা যে, বাস্তব কর্মজীবনে যখন সে কোন পথ অবলম্বন করে, তখন সেই পথ নির্বাচনে সাধারণত ধীর ও স্থির মস্তিস্কে যুক্তি ও বিবেক-বুদ্ধির সাহায্য না লইয়া সে একটি ভাবপ্রবণতার দ্বারা পরিচালিত হয়। অতপর সেই ভাবপ্রবণতাপ্রসূত সিদ্ধান্তকে সে নির্ভুল প্রমাণিত করিবার জন্য যুক্তি-প্রমাণের সাহায্য গ্রহণ করে। পর্দার ব্যাপারেও সেই অবস্থারই সৃষ্টি হইয়াছে। এতদসম্পর্কে যে বিতর্কের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার জন্য কোন যুক্তিসংগত অথবা শরীয়ত সম্পর্কিত আবশ্যকতা অনুভূত হয় নাই। বিজয়ী জাতির বাহ্যিক চাকচিক্যময় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত এবং ইসলামী তমদ্দুনের বিরুদ্ধে উক্ত জাতির তীব্র প্রচারণার দ্বারা বিহবল হওয়ার ফলে যে অনুরাগ, অনুভূতি ও ভাবপ্রবনতার সৃষ্টি হইয়াছিল, পর্দা সম্পর্কিত বিতর্কের সূচনা শুধু তাহারই কারণে হইয়াছিল।
আমাদের সংস্কারপ্রিয় শিক্ষিত সমাজ যখন বিস্ময় বিস্ফোরিত নেত্রে ইউরোপীয় ললনাদের সৌন্দর্য, বিলাস-ভূষণ, যত্রতত্র স্বাধীন বল্গাহীন যাতায়াত এবং আপন সমাজে তাহাদের কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করিল, তখন অনিবার্যরূপে তাহাদের মনে এই বাসনার সঞ্চার হইল যে, তাহাদের রমণীগণও যেন সেইভাবে চলিতে পারে এবং তাহাদের তমদ্দুনও যেন ইউরোপীয় সংস্কৃতির সমকক্ষতা লাভ করিতে পারে। নারী স্বাধীনতা, স্ত্রীশিক্ষা এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্যের নূতন দৃষ্টিভঙ্গী শক্তিশালী প্রামানিক ভাষার চটকদার ছাপার অক্ষরে যখন তাহাদের মধ্যে অবিরল বারি বর্ষণের ন্যায় বর্ষিত হইতেছিল, তখন তাহারা উহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িল। এই সকল সাহিত্যের শক্তিশালী প্রভাবে তাহাদের ভালো-মন্দের বিচার শক্তি লোপ পাইয়াছিল। তাহাদের মনের মধ্যে এই ধারণাই বদ্ধমূল হইয়াছিল যে, সত্যিকার প্রগতিশীল হইতে হইলে প্রাচীনত্ব ও জীর্ণতার কলংক কালিমা হইতে মুক্ত হইতে হইলে ঐ সমস্ত ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন করত লিখনী ও বক্তৃতার সাহায্যে তাহার প্রচারণা চালাইতে হইবে এবং সাহসিকতার সহিত তাহাকে বাস্তব জীবনে রূপায়িত করিতে হইবে। অবগুণ্ঠনসহ শ্বেতবস্ত্রাবৃত রমণীদিগকে সচল তাঁবুর ন্যায় বা কাফনপরিহিত জানাযার পোশাকে আচ্ছাদিত দেখিলে এই সকল আত্মপ্রবঞ্চিত হতভাগ্যের দল ব্রীড়াহত হইয়া ভূলুণ্ঠিত হয়। কতকাল আর ইহা সহ্য করা যায়? অবশেষে বাধ্য হইয়া অথবা মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া তাহারা এই লজ্জার কলঙ্ক অপনোদনে প্রস্তুত হইল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে নারী স্বাধীনতার যে আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়াছিল, তাহার মূলে ছিল উপরোক্ত আবেগ, অনুভূতি ও ভাবপ্রবণতা। এই সকল আবেগ, অনুভূতি আবার কাহারো কাহারো সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির অন্তরালে লুক্কায়িত ছিল। তাহারা নিজেরাই এই বিষয়ে অবহিত ছিল না যে, এই আন্দোলন তাহাদিগকে কোথায় লইয়া যাইতেছে। তাহারা ছিল আত্মপ্রবঞ্চিত। পক্ষান্তরে কেহ কেহ আবার এই সকল আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে অবহিতও ছিল। কিন্তু প্রকৃত ভাবাবেগ অপরের সম্মুখে প্রকাশ করিতে তাহারা কুণ্ঠাবোধ করিত। ইহারা যদিও আত্মপ্রবঞ্চিত ছিল না, কিন্তু বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করিয়া বহির্জগতকে প্রতারিত করিবার চেষ্টা করিল। যাহা হউক, উভয় দলই একই লক্ষ্যে শর নিক্ষেপ করিতেছিল এবং তাহা এই যে, স্বীয় আন্দোলনের মূল প্রেরণাকে গোপন করিয়া একটি ভাবাবেগ পরিচালিত আন্দোলনের পরিবর্তে একটি যুক্তিসংগত আন্দোলন পরিচালনার প্রয়াস পাইল। নারীদের স্বাস্থ্য, জ্ঞানার্জন ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাহাদের উৎকর্ষ সাধন, তাহাদের স্বাভাবিক ও জন্মগত অধিকার সংরক্ষণ, জীবিকার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা, পুরুষের অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা হইতে পরিত্রাণ লাভ, জাতির অর্ধাংশ হিসাবে তাহাদের উন্নতির উপর তামাদ্দুনিক উন্নতির নির্ভরশীলতা এবং ইউরোপ হইতে সরাসরি আমদানীকৃত অন্যান্য কলাকৌশল এই আন্দোলন পরিচালনায় এমনভাবে প্রয়োগ করা হইল যেন মুসলমান জনসাধারণ প্রতারিত হয়। এই আন্দোলন পরিচালনায় এমন এক কৌশলও অবলম্বিত হইল যে, মুসলমান নারীগণকে ইউরোপীয় নারীদের আচরণ পদ্ধতি এবং ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থা অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করাই যে এই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য, তাহার গূঢ় রহস্য যেন মুসলমান জনসাধারণের নিকট উদ্ঘাটিত না হয়।
বিরাট প্রবঞ্চনা
এই বিষয়ে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক প্রবঞ্চনা এই ছিল যে, কুরআন- হাদীস হইতে যুক্তির অবতারণা করত এই আন্দোলনকে ইসলামের অনুকূলে সপ্রমাণ করিবার জন্য প্রয়াস চলিয়াছে। অথচ ইসলামী ও পাশ্চাত্য তাহযীবের উদ্দেশ্য ও সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক নীতির মধ্যে আকাশ- পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান। ইসলামী তাহযীবের অন্তর্নিহিত উদ্দশ্যে এই যে, মানবের যৌন শক্তিকে (Sex Energy) নৈতিক নিয়মতান্ত্রিকতার মাধ্যমে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে, যাহাতে তাহা লাম্পট্য ও কামোত্তেজনার বশে নিঃশেষিত না হইয়া একটা পূত-পবিত্র ও সৎ তমদ্দুন গঠনে নিয়োজিত হয়। পক্ষান্তরে জীবনের কার্যকলাপে এবং দায়িত্ব পালনে নারী পুরুষকে সমানভাবে নিযুক্ত করিয়া বৈষয়িক উন্নতির গতি প্রবাহকে দ্রুততর করাই পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির উদ্দেশ্য। এতদসহ ইহা যৌনোত্তেজনাকে এমন কার্যে ব্যবহৃত করে যাহাতে জীবন সংগ্রামের তিক্ততা মধুর সুখ সম্ভোগে পরিণত হয়। উদ্দেশ্যের এই বৈষম্য অবশ্যম্ভাবীরূপে ইহাই দাবী করে যে, জীবন যাপনের পদ্ধতিতেও ইসলাম ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মধ্যে মৌলিক বৈষম্য থাকিবে না। ইসলাম এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা দাবী করে, যেখানে নারী পুরুষের কর্মক্ষেত্র পৃথক হইবে। উভয়ের স্বাধীন একত্র মিলনকে নিষিদ্ধ করা হইয়াছে ও এই শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী সকল উপায়-উপাদানের মূলোৎপাটন করা হইয়াছে। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির লক্ষ্য এবং দাবি এই যে, নারী পুরুষ উভয় শ্রেণীকে জীবনের একই ক্ষেত্রে টানিয়া আনিবার, উভয়ের অসংযত বল্গাহীন পারস্পরিক মিলন ও কার্য পরিচালনার পথে সকল বাধা-বিঘ্নকে অপসারিত করা হইয়াছে। উপরন্তু তাহাদিগকে পারস্পরিক সৌন্দর্য ও যৌন সম্ভোগের সীমাহীন সুযোগও দেওয়া হইয়াছে।
এখন যে কোন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি অনুমান করিতে পারেন যে, যাহারা একাধারে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণ করিতে ইচ্ছা করে এবং ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম-নীতিকে তাহার স্বপক্ষে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপিত করে, তাহারা কতখানি আপনাদিগকে ও অপরকে প্রতারিত করিতেছে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নারী স্বাধীনতার শেষ সীমারেখা এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে যে, সে তাহার হস্তদ্বয় ও মুখমণ্ডল অনাবৃত রাখিতে পারিবে এবং আবশ্যকবোধে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্তও হইতে পারিবে। কিন্তু ইহারা (পাশ্চাত্যের অনুসারীগণ) ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত শেষ সীমারেখাকেই তাহাদের যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে। ইসলামের যাত্রা যেখানে শেষ হইয়াছে, ইহারা তাহা হইতে আরম্ভ করে এবং এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, লজ্জা, সম্ভ্রম ও শ্লীলতাকে পরিহার করে। শুধু হস্ত ও মুখমণ্ডল নহে, বরং সুষম সীমান্তসহ কেশরাজিশোভিত নগ্ন মস্তক, স্কন্ধদেশে আস্তীন, বেণী ও অর্ধনগ্ন উন্নত বক্ষ দর্শকের নয়নগোচর করা হয়। কমনীয় দেহকান্তির যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাও এমন সুক্ষ বস্ত্রে আবৃত করা হয় যে, তন্মধ্য হইতে এমন অংগসমূহ দৃষ্টিগোচর হয় যাহার দ্বারা পুরুষের কামপিপাশা চরিতার্থ করা যায়। অতঃপর এহেন বেশভূষা ও সাজসজ্জাসহ স্ত্রী, কন্যা ও ভগ্নিকে ‘মুহরেম’(ইসলামী আইনানুযায়ী যাহাদের সহিত বিবাহ নিষিদ্ধ হইয়াছে।) পুরুষগণের সম্মুখে নহে, বরং বন্ধুদের সম্মুখে আনয়ন করা হয় এবং পর পুরুষের সহিত এমনভাবে হাসি-ঠাট্টা, কথাবার্তা ও ক্রীড়া-কৌতুক করিবার স্বাধীনতা দেয়া হয়, যাহা কোন মুসলমান রমণী তাহার বৈমাত্রেয় অথবা বৈপিত্রেয় ভ্রাতার সহিতও লাভ করিতে পারে না। কেবল আবশ্যক কার্যোপলক্ষে শরীয়তসম্মত পরিপূর্ণ দেহাবরণসহ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার স্বাধীনতাকে চিত্তাকর্ষক শাড়ী, অর্ধনগ্ন ব্লাউজ ও অসংযত নয়নবানসহ প্রকাশ্য রাজপথে ভ্রমনে, প্রমোদ কাননে বিচরণে, ক্লাব-হোটেলাদিতে চিত্তবিনোদনে এবং ছায়াচিত্র দর্শনে প্রযুক্ত করা হয়। গৃহাভ্যন্তরীণ কাজকর্ম ব্যতীত বিশেষ শর্তাধীনে অন্য কাজকর্মের যে স্বাধীনতা ইসলাম নারীকে দান করিয়াছে তাহাকে এইরূপ যুক্তিস্বরূপ উপস্থাপিত করা হইতেছে যে, মুসলমান নারীও ইউরোপীয় নারীর ন্যায় গার্হস্থ্য জীবন ও পরিবারিক দায়িত্ব পরিত্যাগ পূর্বক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষিপ্রকারিতায় যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়াইবে এবং কর্মক্ষেত্রে পুরুষের কণ্ঠসংলগ্ন হইয়া কঠোর পরিশ্রম করিবে।
ভারত উপমহাদেশের অবস্থা মোটামুটি এই পর্যায়ে দাঁড়াইয়াছে। মিসর, তুরস্ক ও ইরানের রাজনৈতিক স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মানসিক দাসগণ ইহা অপেক্ষা দশ ধাপ অগ্রসর হইয়াছে। এই সকল দেশের মুসলিম নারীগণ ইউরোপীয় নারীদের অনুরূপ পোশাক পরিধান করে। এতদ্বারা তাহারা আসল ও নকলের পার্থক্য মিটাইতে চাহে। তুরস্ক এই ব্যাপারে এতখানি অগ্রসর হইয়াছে যে, তুর্কী নারীদের আলোকচিত্রে তাহাদিগকে সমুদ্রতীরে স্নানের পোশাকসহ দেখা যায়। এতদৃশ পরিচ্ছদ পরিহিত নারীদের দেহের তিন-চতুর্থাংশ অনাবৃত থাকে। দেহের অবশিষ্টাংশ এমনভাবে সূক্ষ্ম বস্ত্রাচ্ছাদিত থাকে যে, দেহের স্ফীত ও অনুন্নত অংগসমূহ তৎসংশ্লিষ্ট বস্ত্রের উপর পরিস্ফুট ও বিকশিত হইয়া পড়ে।
কুরআন ও হাদীসে কুত্রাপিও এমন জীবন পদ্ধতি সমর্থনের কোন সূত্র খুঁজিয়া পাওয়া যায় কি? কেহ যদি এই পথ অবলম্বন করিতে চাহে, তবে তাহার স্পষ্ট ঘোষণা করা উচিত যে, ইসলাম ও ইসলামের আইন-কানূনের সে প্রকাশ্য বিরোধী। যে সমাজ ব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতির মৌলিক নীতি, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থার প্রতিটি বিষয়কে কুরআন নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে, তাহাকে শুধু প্রকাশ্যে ও সজ্ঞানে অবলম্বন করা নহে, উপরন্তু এই পথের প্রথম পদক্ষেপ কুরআনের নামেই করা হইতেছে। ইহার উদ্দেশ্য এই যে, জগতকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করিয়া কুরআনের নামে এই পথেই পরবর্তী পদক্ষেপ করা হইবে। ইহা কত বড় ভণ্ডামি, নীচতা ও শঠতা!
আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয়
নব্যযুগের মুসলমানদের অবস্থা উপরে বর্ণিত হইল। এখন আমাদের সম্মুখে আলোচনার দুইটি দিক রহিয়াছে। এই গ্রন্থে এই উভয় দিকের আলোচনায় মনোনিবেশ করিতে হইবে।
প্রথমত, মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র মানব জাতির সমক্ষে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ব্যাখ্যা করিতে হইবে এবং ইহাও বলিয়া দিতে হইবে যে, এই ব্যবস্থায় পর্দার নির্দেশাবলী কেন প্রদত্ত হইয়াছে।
দ্বিতীয়ত, এই নব্যযুগের মুসলমানদের সম্মুখে একদিকে কুরআন-হাদীসের নির্দেশাবলী ও অন্যদিকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সামাজিকতার দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাহার পরিণাম ফল তুলনামূলকভাবে উপস্থাপিত করিতে হইবে, যাহাতে তাহাদের দ্বিমুখী কার্যপদ্ধতির অবসান ঘটে এবং দুইটি পথের যে কোন একটিকে অবলম্বন করিতে পারে। যদি তাহারা প্রকৃত মুসলমান হিসাবে বসবাস করিতে চাহে, তাহা হইলে ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ আনুগত্য করিয়া চলিতে হইবে নতুবা যে লজ্জাকর ও ভয়াবহ পরিণামের দিকে পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থা তাহাদিগকে আকৃষ্ট করিতেছে, ইসলামী সংশ্রব বর্জন করত তাহাকেই অবলম্বন করিতে হইবে।