মানব সমাজের মৌলিক সমস্যা
সমস্যার ধরন-প্রকৃতি
মানব সভ্যতার প্রধানতম ও জটিলতম সমস্যা দুইটি। এই দুইটি সমস্যার সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানের উপর মানব জাতির কল্যাণ ও অগ্রগতি নির্ভরশীল। এইজন্যই ইহার সমাধানের জন্য আবহমানকাল হইতে দুনিয়ার বিদগ্ধ সমাজ বিব্রত ও চিন্তান্বিত রহিয়াছেন।
প্রথম সমস্যাটি এই যে, সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের সম্পর্ক কিরুপে স্থাপিত হইতে পারে। কারণ ইহাই প্রকৃতপক্ষে তমদ্দুনের ভিত্তি-প্রস্তর এবং ইহাতে তিলমাত্র বক্রতার অবকাশ থাকিলে তাহাকে অবলম্বন করিয়া যে ইমারত গরিয়া উঠিবে, তাহাও অবশ্যই বক্র হইবে।
দ্বিতীয় সমস্যা হইতেছে মানব জাতির ব্যষ্টি ও সমষ্টিগত সম্পর্ক। ইহারও সামঞ্জস্য বিধানে যদি সামান্যতমও অসংগতি থাকিয়া যায়, তাহা হইলে যুগযুগান্ত কাল ধরিয়া মানব জাতিকে ইহার তিক্ত ফল ভোগ করিতে হইবে।
একদিকে যেমন সমস্যা দুইটির গুরুত্ব এইরূপ, অপরদিকে ইহার জটিলতাও এত বর্ধনশীল যে, মানবপ্রকৃতির যাবতীয় তথ্যের পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ না করিয়া কেহ ইহার সমাধানে সমর্থ হইবে না। সত্য সত্যই এইরূপ মন্তব্য যথার্থ হইয়াছে যে, মানব একটি ক্ষুদ্রতম জগত; ইহার শারীরিক গঠন, প্রকৃতিবিন্যাস, ক্ষমতা-যোগ্যতা, বাসনা, অনুপ্রেরণা-অনুভূতি এবং আপন সত্তাবহির্ভূত অসংখ্য সৃষ্টিনিচয়ের সহিত ইহার বাস্তব সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়সমূহ একটি বিশ্বজগতের ন্যায় মানবের অভ্যন্তরে বিরাজমান। এহেন জগতের প্রতি প্রান্তে সুস্পষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ না করিলে মানবের প্রকৃত পরিচয় লাভ সম্ভব নহে এবং পূর্ণ ও প্রকৃত পরিচয় ব্যতীত তাহার মৌলিক সমস্যাবলির সমাধানও অসম্ভব।
আবার বিষয়টি এতই জটিল যে, আদিকাল হইতে অদ্যাবধি ইহা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার লীলাভূমি হইয়া রহিয়াছে। প্রথম কথা এই যে, আজ পর্যন্ত জগতের সমুদয় তথ্য মানুব সম্মুখে উদ্ঘাটিত হয় নাই। আজ পর্যন্ত কোন মানবীয় জ্ঞানই চরম পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে নাই অর্থাৎ কোন মানুষই এমন দাবী করিতে পারে না যে, উক্ত জ্ঞানের সহিত সংশ্লিষ্ট তথ্যাবলীর সমুদয়ই তাহার আয়ত্তাধীন রহিয়াছে। উপরন্তু যে সমস্ত তথ্যের উপর এ-যাবত আলোকপাত করা হইয়াছে, তাহার বিস্তৃতি ও সূক্ষ্মতা আবার এত অধিক যে, ব্যক্তি বিশেষ তো দূরের কথা, দল বিশেষেরও সতর্ক দৃষ্টি উহার উপরে একই সময়ে নিপতিত হয় না। উহার একদিক যদি জ্ঞান-চক্ষে ধরা পড়ে তো অপরদিক তমসাবৃত থাকিয়া যায়। কোথাও দৃষ্টি সংকীর্ণ হইয়া পড়ে, আবার কোথাও ব্যক্তিগত ভাব-প্রবণতা দৃষ্টি-পথকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। এবম্বিধ দ্বিগুণিত দুর্বলতা সহকারে মানব স্বীয় জীবনের এই সকল সমস্যা সমাধানের সকল প্রকার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অকৃতকার্য থাকিয়া যায় এবং পরিণামে তাহার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিই প্রকট হইয়া পড়ে। সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন তৎসংশ্লিষ্ট সমুদয় তথ্য সম্পর্কে সমদর্শিতা লাভ হয়। আবার যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত তথ্য না হইলেও অন্তত আবিষ্কৃত তথ্যাবলীর সমগ্র দিক এক সংগে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত না হইবে, ততক্ষণ সমদর্শিতা লাভ হইবে না। কিন্তু আবার যে দৃশ্যপটের বিস্তৃতি স্বভাবতই এত অধিক হয় যে, উহার সমগ্রখানি দৃষ্টিপথে পতিত হয় না এবং এতদ্সহ প্রকৃতির বাসনা, আগ্রহ ও ঘৃণার অভীপ্সা এত প্রবল হয় যে, যাহাও স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয় তাহা হইতেও দৃষ্টি কুঞ্চিত করা হয়। এমন অবস্থা সমদৃষ্টিশক্তি লাভ কি কখনও সম্ভব হইতে পারে? এমতাবস্থায় যে সমাধান গ্রহণ করা হইবে, তাহাতে অবশ্যম্ভাবীরূপে হয়ত অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি অথবা সংগত সীমা লংঘিত হইবে নতুবা অপ্রাচুর্য ও ন্যূন্যতা ঘটিবে।
উপরে বর্ণিত প্রধানতম সমস্যা দুইটির মধ্যে প্রথমটিই এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়। আমরা এতদ্বিষয়ে অতীত ইতহাস আলোচনা করিলে শুধু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং চরম ন্যূনতার এক বিস্ময়কর টানা-হেঁচড়া দেখিতে পাই। আমরা একদিকে দেখিতে পাই যে, নারী মাতারূপে সন্তানাদির অন্ন দান করিয়াছে এবং অর্ধাঙ্গিনী সাজিয়া জীবনের উত্থান-পতনে পুরুষের সাহায্য করিয়াছে। অপরদিকে সেই নারীকেই আবার সেবিকা অথবা দাসীর কার্যে নিযুক্ত করা হইয়াছে। তাহাকে গরু-ছাগলের ন্যায় ক্রয়-বিক্রয় করা হইয়াছে। মালিকানা ও উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা হইয়াছে। তাহাকে পাপ-পংকিলতা ও লাঞ্ছনার প্রতিমূর্তি করিয়া রাখা হইয়াছে। তাহার ব্যক্তিত্বের পরিস্ফুটন অথবা ক্রমবিকাশের কোন সুযোগই তাহাকে দেয়া হয় নাই। আবার কোন সময়ে নারীকে উন্নীত ও পরিষ্ফুট করা হইলেও সংগে সংগে চরিত্রহীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতায় তাহাকে নিমজ্জিত করা হইয়াছে। তাহাকে পাশবিক প্রবৃত্তির ক্রীড়নকে পরিণত করা হইয়াছে। আবার কখনও তাহাকে ‘শয়তানের এজেন্ট’ আখ্যায়িত করিয়া রাখা হইয়াছে এবং তাহার তথাকথিত পরিস্ফুটন ও উন্নতির সংগে সংগে মানবতারও অধপতন শুরু হইয়াছে।
এতদৃশ চরম সীমাদ্বয়কে আমরা শুধু দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়া সংগত সীমালঙ্ঘন এবং চরম ন্যূনতার নামেই অভিহিত করিতেছি না, বরং অভিজ্ঞতার দ্বারা যখন ইহার বিষময় পরিণাম আমরা দেখতে পাই, তখনই নৈতিক পরিভাষায় ইহার একটিকে সংগত সীমালঙ্ঘন এবং অপরটিকে চরম অপ্রাচুর্য বা ন্যূনতা বলিয়া থাকি। উপরোল্লিখিত ইতিহাসের পটভূমি আমাদিগকে ইহাই শিক্ষা দান করে যে, যখন কোন জাতি বন্য জীবন যাপনের যুগ অতিক্রম করিয়া সভ্যতা ও বসতি স্থাপনের দিকে অগ্রসর হয় তখন তাহাদের নারী দাসী ও সেবিকার ন্যায় পুরুষদের সংগে বসবাস করিতে থাকে। প্রথম প্রথম কুখ্যাত শক্তিগুলি তাহাদিগকে ক্রমোন্নতির দিকে লইয়া যায়। কিন্তু তামাদ্দুনিক উন্নতি যখন বিশিষ্ট পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন তাহারা অনুধাবন করে যে, তাহাদের অর্ধাঙ্গিনীদিগকে অনুন্নত রাখিয়া তাহারা উন্নতির পথে পদক্ষেপ করিতা পারে না। তখন নিজেদের উন্নতির পথ রুদ্ধ মনে করে এবং প্রয়োজনানুসারে জাতীয় অর্ধাংশকে (নারী) প্রথমাংশের (পুরুষ) সহিত অগ্রসর হইবার যোগ্য করিয়া তোলে। এইভাবে তাহারা ক্ষতিপূরণ করিতে থাকে এবং তখন শুধু ক্ষতিপূরণেই তুষ্ট না হইয়া ক্রমাগত সম্মুখে অগ্রসর হইতে থাকে। অবশেষে বংশীয় শৃঙ্খলা-যাহাকে তামাদ্দুনিক ভিত্তিপ্রস্তর বলা হয়-নারী স্বাধীনতার দ্বারা ধ্বংস ও লুপ্ত হইয়া যায়। নৈতিক অবনুতির সংগে সংগে মানসিক, শারীরিক ও বৈষয়িক শক্তি নিচয়ের অবনতিও অবশ্যম্ভাবীরূপে পরিষ্ফুট হয়। ইহার শেষ পরিণতি ধবংস ব্যতীত আর কি হইতে পারে?
ইতিহাস হইতে বিস্তৃতভাবে দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করিতে গেলে সন্দর্ভের কলেবর বর্ধিত হইবে বলিয়া আমরা এখানে মাত্র দুই-চারিটির উল্লেখ সমীচীন মনে করিতেছি।
গ্রীস
প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্যে গ্রীস সভ্যতাই সরবাপেক্ষা গৌরবময়। এই জাতির প্রাথমিক যুগে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, আইন সম্পর্কিত অধিকার, সামাজিক আচার প্রভৃতির দিক হইতে নারীর মর্যাদা নিতান্ত অধপতিত ছিল। গ্রীস পুরাণে নারী ‘পান্ডোরাকে’ মানবের দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসাবে বর্ণনা করা হইয়াছে, যেইরূপ হযরত হাওয়া (আ)-কে ইহুদী পুরানে উক্ত বিষয়ের জন্যে দায়ী করা হইয়াছে। হযরত হাওয়া (আ) সম্পর্কিত কল্পিত মিথ্যা কাহিনী ইহুদী ও খ্রীস্টীয় সম্প্রদায়ের রীতি নীতি, আইন-কানুন, সামাজিক ক্ষেত্রে, নৈতিক চরিত্র প্রভৃতিকেও যে প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করিয়াছে, তাহা কাহারও অজ্ঞাত নহে। ‘পান্ডোরা’ সম্পর্কে গ্রীকগণ যে ধারণা পোষণ করিত, তাহাও তাহাদের মানসিকতাকে সমভাবে প্রভাবান্বিত করিয়াছিল। তাহাদের দৃষ্টিতে নারী এক নিকৃষ্ট জীব ছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর কোনই মর্যাদা ছিল না এবং সম্মানিত মর্যাদা একমাত্র পুরুষের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে কিয়ৎ সংশোধনীসহ এই ব্যবস্থাই বলবৎ রহিল। সভ্যতা ও জ্ঞানালোকের এতটুকু প্রভাব পরিলক্ষিত হইল যে, নারীর আইন সম্পর্কিত অধিকার পূর্ববতই রহিল, তবে সামাজিক ক্ষেত্রে তাহাকে উন্নত মর্যাদা দান করা হইল। সে গ্রীকদের গৃহরাণী হইল। তাহার কর্তব্যকর্ম গৃহাভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ রহিল। এই সীমারেখার মধ্যে তাহার পূর্ণ কর্তৃত্বও ছিল। তাহার সতীত্ব অতীব মূল্যবান ছিল এবং ইহার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হইত। সম্ভ্রান্ত গ্রীক পরিবারে পর্দা প্রথার প্রচলন ছিল। তাহাদের গৃহাভ্যন্তরে নারী-পুরুষের প্রকোষ্ঠ পৃথক ছিল। তাহাদের রমণিগণ নারী-পুরুষের মিলিত বৈঠকে যোগদান করিত না। জনসাধারণের প্রেক্ষাগৃহে তাহারা দৃষ্টিগোচর হইত না। বিবাহের মাধমে পুরুষের সংগে সম্পর্ক স্থাপন করাকেই তাহারা সম্মানজনক মনে করিত। বীরাঙ্গনায় জীবন যাপন অত্যন্ত ঘৃণিত ও অভিশপ্ত ছিল। ইহা তৎকালীন অবস্থা ছিল, যখন গ্রীক জাতি অতীব শক্তিশালী ও দ্রুত উন্নতির উচ্চ সোপানে অধিষ্ঠিত ছিল। এই সময়ে নৈতিক পাপাচার বিদ্যমান থাকিলেও তাহা ছিল সীমাবদ্ধ। গ্রীক রমণীগণ পবিত্রতা, শ্লীলতা ও সতীত্বের দাবী করিতে পারিত এবং পুরুষগণ তাহার বিপরীত ছিল। তাহারা এতাদৃশ গুণাবলীর প্রত্যাশী ছিল না এবং তাহারা যে পবিত্র জীবন যাপন করিবে এমন আশাও করা যাইত না। বেশ্যা সম্প্রদায় গ্রীক সমাজের একটি অভিন্ন অংশ ছিল। এই সম্প্রদায়ের সহিত সম্পর্ক স্থাপন পুরুষের জন্য কোনক্রমেই দূষণীয় ছিল না।
গ্রীকদের মধ্যে ক্রমশ প্রবৃত্তি পূজা ও কামোদ্দীপনার প্রভাব বিস্তার লাভ করিতে লাগিল এবং এই যুগে বেশ্যা-সম্প্রদায় এতখানি উন্নত মর্যাদা লাভ করিল যে, ইতিহাসে তাহার দৃষ্টান্ত বিরল। বেশ্যালয় গ্রীক সমাজের আপামর-সাধারণের কেন্দ্র ও আড্ডাখানায় পরিণত হইল। দার্শনিক, কবি, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও বিশেষজ্ঞ প্রভৃতি নক্ষত্ররাজি উক্ত চন্দ্রকে পরিবেষ্টিত করিয়া রাখিত। বেশ্যাগণ কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্মেলনে সভানেত্রীর আসনই গ্রহণ করিত না; বরং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনাও তাহাদের সমক্ষে সম্পাদিত হইত। যেই সমস্ত সমস্যার সহিত জাতির জীবন-মরণ প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট ছিল, সেই সকল ব্যাপারেও বেশ্যাদের মতামতকে চূড়ান্ত মনে করা হইত। অথচ তাহাদের বিচার-বিবেচনায় কোন ব্যক্তির উপর কস্মিনকালেও সুবিচার করা হইত না। সৌন্দর্যপূজা গ্রীকদের মধ্যে কামাগ্নি প্রবলাকারে প্রজ্বলিত করিয়া দিল। যেই প্রতিমূর্তি অথবা শিল্পের নগ্ন আদর্শের প্রতি তাহারা সৌন্দর্য লালসা প্রকাশ করিত; তাহাই তাহাদের কামাগ্নির ইন্ধন যোগাইতে লাগিল। অবশেষে তাহাদের মানসিকতা এত বিকৃত হইল যে, কামাগ্নি পুজাকে তাহারা নৈতিকতার দিক দিয়া কোনরূপ দূষণীয়ই মনে করিত না। তাহাদের নৈতিক মাপকাঠি এতখানি পরিবর্তিত হইয়াছিল যে, বড় বড় দার্শনিক ও নীতিবিদ ব্যভিচার ও অশ্লীলতাকে কদর্য ও দূষণীয় মনে করিত না। সাধারনভাবে গ্রীকগণ বিবাহকে একটা অনাবশ্যক প্রথা মনে করিত এবং বিবাহ ব্যতীত নারী-পুরুষের প্রকাশ্য সংমিলন যুক্তিযুক্ত মনে করিত। অবশেষে তাহাদের ধর্মও তাহাদের পাশবিক প্রবৃত্তির কাছে নতি স্বীকার করিল। কামদেবীর (Aphrodite) পূজা সমগ্র গ্রীসে বিস্তৃতি লাভ করিল। গ্রীক পুরাণে কামদেবী সম্পর্কে এইরূপ বর্ণিত আছে যে, সে জনৈক দেবতার পত্নী হইয়া অপরাপর তিনজন দেবতা ও একজন মানবের সংগে প্রেমপূর্ণ দৈহিক সম্পর্ক সংস্থাপন করিয়াছিল। ইহাদের যৌনমিলনের ফলে যে সন্তান লাভ হইল, উত্তরকালে সেই কামদেব (কিউপিড) নামে অভিহিত হয়। এই কামদেব গ্রীকদের উপাস্য বা মা’বুদ ছিল। ইহা অনুমান করা কঠিন নহে যে, যেই জাতি এইরূপ জঘন্য চরিত্রকে শুধু তাহাদের আদর্শ নহে, উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিল, তাহাদের নৈতিক মানদণ্ড কত নিম্নস্তরের ছিল। এবম্বিধ নৈতিক অধপতনের পরে কোন জাতির পুনরুত্থান সম্ভব নহে। এই নৈতিক অধপতনের যুগেই ভারতে ‘বামমার্গীয়’ এবং ইরানে ‘মজদকীয়’ মতবাদ প্রচারিত হইয়াছিল। এইরূপ পরিস্থিতিতেই বেবিলনে বেশ্যাবৃত্তি ধর্মীয় শূচিতার মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। ইহার পরিণামে পরবর্তীকালে বেবিলন শুধু অতীত কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হইয়া রহিল এবং জগতে তাহার অস্তিত্ব চিরতরে বিলীন হইয়া গেল।
গ্রীসে যখন কামদেবীর পূজা আরম্ভ হইল, তখন গণিকালয়গুলি উপাসনা মন্দিরে পরিণত হইল। নির্লজ্জ বেশ্যা নারী দেবযানী বা দেবীতে পরিণত হইল এবং ব্যভিচার কার্য ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের মর্যাদায় উন্নীত হইল।
এইরূপ কামপূজার দ্বিতীয় সুস্পষ্ট পরিণাম এই হইয়াছিল যে, গ্রীক জাতির মধ্যে ‘লুত’ সম্প্রদায়ের দুস্কার্যাবলী মহামারীর ন্যায় সংক্রমিত হইয়া পড়িল এবং তাহা ধর্মীয় ও নৈতিক সমর্থন লাভ করিল। ‘হোমার’ ও ‘হিসিউড’ – এর শাসনকালে এই সমস্ত কার্যকলাপের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু সাংস্কৃতিক উন্নতি যখন সৌন্দর্যবিজ্ঞান ও রসবিজ্ঞানের নামে (Aesthetics) নগ্নতা ও যৌনসম্ভোগের পূজার প্রবর্তন করিয়া দিল, তখন কামাগ্নির লেলিহান শিখা এমন পর্যায়ে পৌঁছুল যে, গ্রীক জাতিকে স্বাভাবিক পথ হইতে বিচ্যুত করিয়া এক প্রকৃতিবিরুদ্ধ পথে পরিচালিত করিল। শিল্প বিশেষজ্ঞগণ ইহাকে দুই ব্যক্তির মধ্যে ‘বন্ধুত্বের দৃঢ় সম্পর্ক’ নামে অভিহিত করিল। গ্রীকদেশীয় ‘হারমেডিয়াস’ ও ‘এরস্টগীন’ – ই সর্বপ্রথম এতদূর মর্যাদা লাভ করিয়াছিল যে, তাহাদের স্মরণার্থে আপন মাতৃভূমিতে তাহাদের প্রতিমূর্তি নির্মিত হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে পারস্পরিক অবৈধ ও অস্বাভাবিক প্রেম-সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই যুগের পর গ্রীকদের জাতীয় জীবনে আর কোন নবযুগের সূত্রপাত হয় নাই।
রোম
গ্রীক জাতির পরে জগতে রোমক উন্নতির সুযোগ আসিয়াছিল। এখানেও আমরা পূর্বের ন্যায় উত্থান-পতনের চিত্র দেখিতে পাই। রোমকগণ যখন বর্বরতা অন্ধকার হইতে বাহির হইয়া ইতিহাসের উজ্জ্বল দৃশ্যপটে উদিত হয়, তখন তাহাদের সামাজিক শৃঙ্খলার চিত্র এইরূপ দেখা যায় যে, পুরুষ তাহার পরিবারের প্রধান কর্মকর্তা হইয়াছে; স্ত্রী ও সন্তানাদির উপর তাহার পূর্ণ প্রভুত্ব রহিয়াছে। এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে সে তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিতেও ক্ষমতাবান হইয়াছে।
বর্বরতা যখন কিয়ৎ পরিমাণে হ্রাস পাইল এবং তাহযীব-তমদ্দুনের ক্ষেত্রে রোমকগণ অগ্রসর হইতে লাগিল, তখন প্রাচীন পারিবারিক রীতিনীতি বজায় থাকিলেও তাহার কঠোরতার লাঘব এবং অবস্থা কিঞ্চিৎ পরিমিত হইল। রোমান সাধারণতন্ত্রের উন্নতিকালে গ্রীকদের ন্যায় পর্দা-প্রথার প্রচলন হয় নাই। কিন্তু নারী ও যুবক- যুবতিগণকে পারিবারিক শৃঙ্খলায় সম্ভ্রমশীল করিয়া রাখা হইয়াছিল। সতীত্ব, সাধুতা, বিশেষ করিয়া নারীদের ক্ষেত্রে এক অমুল্য রত্ন ছিল এবং ইহাই ছিল সম্ভ্রমশীলতার কষ্টিপাথর। নৈতিক কষ্টিপাথরও ছিল উচ্চমানের। একবার রোমান সিনেটের জনৈক সদস্য আপন কন্যার সম্মুখে তাহার স্ত্রীকে চুম্বন করিয়াছিল। ইহার দ্বারা জাতীয় চরিত্রের প্রতি কঠোর অবমাননা করা হইয়াছে বলিয়া মনে করা হয় এবং সিনেট গৃহে তাহার বিরুদ্ধে ভরৎসনাসূচক ভোট প্রদত্ত হয়। তৎকালে একমাত্র বিবাহ প্রথাই ছিল স্ত্রী-পুরুষের মিলনের বৈধ ও সম্মানিত পন্থা। নারীর সম্মান নির্ভর করিত তাহার মাতৃত্বে। বেশ্যাশ্রেণী যদিও বিদ্যমান ছিল এবং একটি সীমারেখা পর্যন্ত তাহাদের সংগে মেলামেশার অধিকারও পুরুষদের ছিল, তথাপি রোমদেশীয় জনসাধারণ ইহাকে অত্যন্ত হেয় মনে করিত এবং তাহাদের সহিত সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষদিগকে অবজ্ঞার চক্ষেই দেখা হইত।
তাহযীব-তমদ্দুনের উন্নতির সংগে সংগে নারীদের সম্পর্কে রোমকদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হইতে লাগিল। ক্রমশ বিবাহ-তালাকে বিধি-ব্যবস্থার এবং পারিবারিক রীতিনীতিরও এমন পরিবর্তন সংঘটিত হয় যে,অবস্থা অতীত অবস্থার বিপরীত হইয়া গেলো। বিবাহ শুধু একটা আইনগত চুক্তিনামায় (Civil Contract) পরিণত হইল-যাহার স্থায়িত্ব ও বিচ্ছেদ স্বামী-স্ত্রীর উপর নির্ভর করিত । দাম্পত্য সম্পর্কের দায়িত্ব গুরুত্বহীন হইয়া পড়িল। নারীকে উত্তরাধিকার ও ধন-সম্পত্তির মালিকানার পূর্ণ অধিকার দেওয়া হইল। রোমান আইন তাহাকে পিতা ও স্বামীর কর্তৃত্ব হইতে স্বাধীন করিয়া দিল। রোমান নারীগণ সামাজিক ক্ষেত্রেই শুধু স্বাধীনতা লাভ করিল না, জাতীয় ধন-সম্পদের একটা বিরাট অংশও ক্রমশ তাহাদের কর্তৃত্বাধীন হইয়া পড়িল। তাহারা স্বামী দিগকে উচ্চহারের সুদে টাকা কর্য দিতে লাগিল। ফলে স্বামী ধনাঢ্য স্ত্রীর দাসে পরিণত হইল। তালাক এত সহজ বস্তু হইয়া পড়িল যে, কথায় কথায় দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হইতে লাগিল। বিখ্যাত রোমান দার্শনিক ও পণ্ডিত স্নীকা (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ – খ্রিস্টপূর্ব ৪) তালাকের আধিক্যের জন্যে অনুতাপ করিয়া বলেন, ‘আজকাল রোমে তালাক কোন লজ্জার ব্যাপার নহে। নারী তাহার স্বামী সংখ্যার দ্বারাই নিজের বয়স গণনা করে।’
এই যুগে নারী পরস্পর বহু স্বামী গ্রহণ করিতে থাকে। মার্শাল (খ্রী. ৪৩-১০৪) একটি নারীর উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে, সে দশজন স্বামী গ্রহণ করা হইয়াছিল। জুদনিয়েল (খ্রী. ৬০-১৪০) একটি নারী সম্পর্কে মন্তব্য করিয়াছেন, সে পাঁচ বৎসরে আটজন স্বামী গ্রহণ করিয়াছে। সেন্ট জুরুম (খ্রী. ৩৪০-৪২০) এমন এক নারীর বর্ণনা করিয়াছেন, যে তাহার জীবনে বত্রিশ জন স্বামী গ্রহণ করিয়াছে এবং সে তাহার স্বামীর একবিংশ পত্নী ছিল।
বিবাহ ব্যতীত নারী-পুরুষের যৌনমিলন যে দূষণীয়, এমন ধারনাও এ যুগে মানুষের মন হইতে দূরীভূত হইতে লাগিল। বড় বড় নীতিবিদগণও ব্যভিচারকে একটি সাধারণ কার্য মনে করিত। খ্রী. পূর্ব ১৮৪ সনে কাটো (Cato)রোমে নীতিপরিদর্শক ও নীতিতত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। তিনিও যৌনসুলভ লাম্পট্যকে সংগত বলিয়াছেন। সিসেরো নব্য-যুবতীদের জন্য নৈতিক বন্ধনকে শিথিল করার পরামর্শ দিয়াছেন। জিতেন্দ্রিয়তা, নিস্পৃহতা, ঔদাসিন্য, তিতিক্ষা, নিঃসঙ্গতা প্রভৃতি দার্শনিক মূলনীতির (Stoics) পূর্ণ অনুসারী (Epictetus) তাঁহার শিষ্যমন্ডলীকে নিম্নরূপ উপদেশ দান করিতেনঃ
যতদুর সম্ভব বিবাহের পূর্বে নারীদের সংস্পর্শ হইতে বিরত থাকিবে। কিন্তু যদি কেহ এ বিষয়ে সংযমী হইতে না পারে, তাহাকে ভর্ৎসনা করিও না।
অবশেষে নৈতিক চরিত্র ও সামাজিকতার বন্ধন এত শিথিল হইয়া পড়িল যে, কামপ্রবণতা, নগ্নতা ও অশ্লীলতার প্লাবনে রোম সাম্রাজ্য নিমজ্জিত হইয়া গেল। রঙ্গালয়ে নির্লজ্জতা ও নগ্নতার অভিনয় শুরু হইল। নগ্ন, কামোদ্দীপক ও অশ্লীল চিত্র দ্বারা গৃহের শোভা বর্ধন আবশ্যক বোধ করা হইল। বেশ্যাবৃত্তি এত প্রসার লাভ করিল যে, রোম সম্রাট ‘টাইবেরিসের’ (খ্রী. ১৪-৩৭) শাসনকালে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদিগকে বেশ্যা-নর্তকীয় কার্য হইতে নিরস্ত করিবার জন্য আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছিল। ফ্লোরা (Flora) নামে একটি ক্রীড়া সেইকালে বেশ জনপ্রিয় হইয়াছিল। কারণ ইহাতে উলঙ্গ নারীদের দৌড় প্রতিযোগিতা হইত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের একত্রে স্নানাবগাহন প্রথা প্রচলিত ছিল। রোমীয় সাহিত্যে অশ্লীল নগ্ন চিত্রসম্বলিত প্রবন্ধাদি দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ করা হইত এবং এইরূপ সাহিত্যই আপামরসাধারণের সুখপাঠ্য ও সমাদৃত ছিল। সাহিত্যের মান এত নিম্নস্তরের ছিল যে, এই সমস্ত অশ্রাব্য কুশ্রাব্য প্রবন্ধ রচনায় রূপাত্মক অথবা শ্লেষাত্মক বাক্য যোজনারও আবশ্যক অনুভূত হইত না।
পাশবিক প্রবৃত্তির দ্বারা বশীভূত হইবার পর রোম সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল অট্টালিকা এমনভাবে ধূলিসাৎ হইয়া পড়িল যে, তাহার শেষ ইষ্টকটিরও অস্তিত্ব রহিল না।
খ্রীস্টীয় ইউরোপ
পাশ্চাত্য জগতের এবম্বিধ নৈতিক অধপতনের প্রতিবিধানের জন্য ঈসায়ী ধর্মের আবির্ভাব হয়। ইহাতে প্রথম প্রথম বেশ সুফল পরিলক্ষিত হইল। অশ্লীলতার দ্বার রুদ্ধ হইল, জীবনের প্রতিক্ষেত্র হইতে নগ্নতা দূরীভূত হইল, বেশ্যাবৃত্তি রহিতকরণের ব্যবস্থালম্বন করা হইল; বেশ্যা, গায়িকা ও নর্তকীদিগকে পাপাচার হইতে নিবৃত্ত করা হইল এবং মানুষের মধ্যে পূত-পুণ্য চরিত্রের ধারণা অন্তর্নিবিষ্ট করা হইল। কিন্তু নারী ও যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে খ্রিষ্টীয় ধর্ম-যাজকদের যে ধারণা ছিল তাহা চরম সীমা অতিক্রম করিল। ফলে ইহা দ্বারা মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষিত হইল।
তাহাদের প্রাথমিক ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, নারীই পাপের মূল উৎস। পুরুষের জন্য নারী পাপ আন্দোলনের উৎস এবং নরকের দ্বার স্বরূপ। মানবের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা নারী হইতেই হইয়াছে। নারীরূপে জন্মলাভ করা এক লজ্জাস্কর ব্যাপার। তাহার রূপ-সৌন্দর্যের জন্য তাহার লজ্জাবোধ করা উচিত। কারণ উহাই শয়তানের মারণ-যন্ত্র। যেহেতু সে জগত ও জগতবাসীর জন্য অভিশাপ আনয়ন করিয়াছে, সেইজন্য তাহাকে চিরদিন প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।
Tertullian নামক খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের প্রাথমিক যুগের ধর্মগুরু নারী সম্পর্কে নিম্নরূপ মন্তব্য করিয়াছেনঃ
সে শয়তানের আগমনের দ্বারস্বরূপ, সে নিষিদ্ধ বৃক্ষের দিকে আকর্ষণকারিণী, খোদার আইন ভংগকারিণী ও পুরুষের ধ্বংসকারিণী।
খ্রীস্টীয় তাপসশ্রেষ্ঠ (Chrysostum) নারী সম্বন্ধে এইরূপ বলিয়াছেনঃ
-একটি অনিবার্য পাপ, একটি জন্মগত দুষ্ট প্ররোচনা, একটি আনন্দদায়ক বিপদ, পারিবারিক আশংকা, ধ্বংসাত্মক প্রেমদায়িনী, একটি সজ্জিত বিঘ্ন।
তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক বিবাহের মাধ্যমে হইলেও উহা মূলত একটি অপবিত্র কার্য এবং ইহা হইতে নিবৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। নৈতিক চরিত্রের এতাদৃশ বৈরাগ্যসুলভ ধারণা কামগন্ধহীন দর্শনের (Neo Platonism)প্রভাব সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য বিস্তার লাভ করিতেছিল। খ্রীস্টীয় মতবাদ তাহাকে চরমে পৌঁছাইয়া দিল। এখন কৌমার্য ও কুমারীত্ব নৈতিক চরিত্রের কষ্টিপাথর হইয়া পড়িল। দাম্পত্য জীবনকে নৈতিক চরিত্রের দিক হইতে ঘৃণিত ও অধপতিত মনে করা হইল। লোকে বিবাহ হইতে বিরত থাকাকে পুণ্যের কাজ ও উন্নত চরিত্রের পরিচায়ক মনে করিতে লাগিল। পবিত্র জীবন যাপনের পন্থা এই হইল যে, কেহ একেবারে বিবাহই করিবে না অথবা বিবাহ করিলেও নারী-পুরুষ তাহাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করিবে। বিভিন্ন ধর্মীয় সভা-সমিতিতে এইরূপ আইন প্রণীত হইল যে, গীর্জার কর্মচারীগণ নির্জনে তাহাদের স্ত্রীর সঙ্গে সম্মিলিত হইতে পারিবে না, এমন কি দেখা-সাক্ষাত করিতে হইলেও উন্মুক্ত স্থানে অন্তত দুইজন পুরুষের উপস্থিতিতে করিতে হইবে। বৈবাহিক সম্পর্ক যে অপবিত্র, এই ধারণা নানা প্রকারের খ্রীস্টানদের মধ্যে বদ্ধমূল হইতা লাগিল। এখানে প্রচলিত একটি রীতির দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। যেদিন গীর্জায় কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হইত, পূর্বরাত্রে একত্র বসবাসকারী স্বামী-স্ত্রীকে তাহাতে যোগদান করিতে দেওয়া হইত না। কারণ যৌন সম্মিলনের দ্বারা তাহারা পাতকী হইয়াছে এবং এইরূপ অবস্থায় তাহাদিগকে কোন পবিত্র স্থানে গমন করিবার অনুমতি দেওয়া যাইতে পারে না। এইরূপ বৈরাগ্যসূলভ মনোভাব সমগ্র পারিবারিক সম্পর্ক, এমনকি মাতা-পুত্রের সম্পর্কও তিক্ততর করিয়া তুলিয়াছিল এবং বিবাহের ফলে যে সম্পর্ক দানা বাঁধিয়া উঠিত, তাহাকে অপবিত্র ও পাপজনক মনে করা হইত।
উপরিউক্ত উভয় প্রকারের দৃষ্টিভঙ্গী শুধুমাত্র নৈতিক ও সামাজিক দিক হইতে নারীর মর্যাদাকে অতিমাত্রায় হেয় করে নাই বরং কৃষ্টিগত আইন-কানুনকে এতখানি প্রভাবান্বিত করিয়াছে যে, একদিকে বৈবাহিক জীবন নারী-পুরুষের জন্য বিপজ্জনক হইয়া পড়িয়াছে এবং অপরদিকে সমাজে নারীর মর্যাদা সকল দিক দিয়ে হেয় ও অবজ্ঞেয় হইয়া পড়িয়াছে। খ্রীস্টধর্মীয় বিধি-বিধান অনুযায়ী যত প্রকার আইন পাশ্চাত্য জগতে প্রচলিত হইয়াছে, উহার বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপঃ
১। জীবিকার্জন ক্ষেত্রে নারীকে সম্পূর্ণ অসহায় করিয়া পুরুষের অধীন করিয়া রাখা হইয়াছিল। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে তাহার অধিকার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল এবং বিষয়-সম্পত্তির উপর অধিকার অধিকতর সীমাবদ্ধ ছিল। এমন কি স্বোপার্জিত অর্থের উপরও তাহার কর্তৃত্ব ছিল না। সকল বিষয়ের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল স্বামীর।
২। ‘তালাক’ ও ‘খোলার’ অনুমতি দেওয়া হইত না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যতই মনোমালিন্য হউক না কেন, পারস্পরিক তিক্ত সম্পর্কের জন্য সংসার নরকতুল্য হউক না কেন, তথাপি ধর্ম ও আইন উভয়ই স্বামী-স্ত্রীকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকিতে বাধ্য করিত। অবস্থা অত্যন্ত বেগতিক হইলে উভয়কে এই শর্তে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হইত যে, তাহারা কেহই দ্বিতীয়বার অন্যত্র বিবাহ করিতে পারিবে না। ইহা প্রথমোক্ত নীতি হইতে কঠোরতর ছিল। কারণ এমতাবস্থায় বিচ্ছিন্ন নারী-পুরুষের জন্য সারা জীবন বৈরাগ্য পালন অথবা যৌন পাপাচারে লিপ্ত হওয়া ব্যতীত অন্য কোন পন্থা থাকে না।
৩। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর ও স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীর পুনরায় বিবাহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও পাপজনক ছিল। খ্রীস্টীয় পাদ্রীগণ বলিতেন যে, ইহা শুধু পাশবিক প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং ভোগ লালসা ব্যতীত আর কিছু নহে। তাঁহারা ইহাকে ‘মার্জিত ব্যভিচার’ নামে অভিহিত করিতেন। গির্জার কর্মচারীগণের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ অপরাধজনক ছিল। দেশের সাধারণ আইনানুযায়ী কোন কোন স্থানে ইহার অনুমতিই দেওয়া হইত না। কোথাও আবার আইনগত বাধা না থাকিলেও ধর্মীয় ভাবাপন্ন জনসাধারণ ইহাকে বৈধ মনে করিত না।
আধুনিক ইউরোপ
খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের দার্শনিক ও সাহিত্যিকগণ যখন ব্যক্তিগত অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করিলেন, তখন তাহাদের সম্মুখে সেই ভ্রান্তিপূর্ণ তামাদ্দুনিক রীতিনীতি বিদ্যমান ছিল-যাহা খ্রীস্টীয় নৈতিক শাসন, জীবন দর্শন ও সামন্ততন্ত্রের জঘন্য সমন্বয়েই গঠিত হইয়াছিল। ইহা মানবীয় আত্মাকে অপ্রাকৃতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া উন্নতির সকল দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছিল। এই প্রচলিত রীতি-নীতিকে চূর্ণ করিয়া তদস্থলে এই নূতন রীতি-শৃঙ্খলা প্রবর্তনের জন্য নব্য-ইউরোপের প্রতিষ্ঠাতাগণ যে দৃষ্টিভঙ্গী উপস্থিত করিলেন তাহার ফলে ফরাসী বিপ্লব জন্মলাভ করিল। তাহার পর পাশ্চাত্য তাহযীব-তমদ্দুনের উন্নতির পদক্ষেপ এমন পথে পরিচালিত হইল, যাহার শেষ পরিণতি বর্তমান পর্যায়ে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
নবযুগের প্রারম্ভে নারী জাতিকে তাঁহাদের অধপতন হইতে উন্নীত করিবার জন্য যাহা কিছু করা হইয়াছিল, তাহার সুফল সামাজিক জীবনেই প্রতিফলিত হইল। বিবাহ ও তালাকের পূর্বতন কড়াকড়ি হ্রাস করা হইল। নারীদের জীবিকার্জনের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হইল। যে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে নারীকে হেয় ও অবহেলিত করিয়া রাখা হইয়াছিল, তাহার সংশোধন করা হইল। যেই সমস্ত সামাজিক মূলনীতির কারণে নারী দাসীর ন্যায় জীবন যাপন করিত, তাহাও সংশোধন করা হইল। পুরুষের ন্যায় নারীর জন্য উচ্চশিক্ষার পথ উন্মুক্ত হইল। ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক রীতিনীতি ও অন্ধকার যুগের নৈতিক ধারণাসমূহের চাপে নারীদের নিষ্পেষিত যোগ্যতা ও প্রতিভা এইরূপ নানাবিধ সুব্যবস্থার ফলে ক্রমশ উদ্বেলিত হইয়া উঠিত। তাহারা গৃহ সামলাইল, সমাজে পবিত্রতা আনয়ন করিল এবং জনগনের মঙ্গল সাধন করিল। স্বাস্থ্যের উন্নতি, সন্তানাদি প্রতিপালন, রোগীর পরিচর্যা, গার্হস্থ্য ও বিজ্ঞানের উন্নতি প্রভৃতি যে সব গুণ নূতন তাহযীবের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের মধ্যে পরিস্ফুট হইয়াছিল, তাহা ঐ আন্দোলনেরই প্রাথমিক ফল ছিল। কিন্তু যে সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গীর গর্ভ হইতে এই আন্দোলন জন্মলাভ করিল, প্রথম হইতেই উহার মধ্যে সংগত সীমালংঘনের অভীপ্সা বিদ্যমান ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর এই অভীপ্সা অনুযায়ী কার্যকলাপ বেশ অগ্রসর হইয়া ছিল এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ইউরোপীয় সমাজ অসংযম ও অমিতাচারের দ্বিতীয় প্রান্ত সীমায় উপনীত হইল ।
যেই সকল দৃষ্টিভংগীর উপর নুতন পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করা হইল , তাহা নিম্নরূপ তিনটি শিরোনামায় ব্যক্ত করা যায়ঃ
ক) নারী – পুরুষের মধ্যে সাম্য বিধান,
খ) নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও
গ) নারী –পুরুষের অবাধ মেলামেশা ।
এই তিনটি মৌলিক ভিত্তির উপর সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাব্য পরিণাম ফল হইতে পারে, তাহাই অবশেষে প্রকট হইয়া পড়িল।
প্রথমত, সাম্যের এইরূপ সংজ্ঞা বর্ণনা করা হইল যে, নারী ও পুরুষ নৈতিক মর্যাদা ও মানবীয় অধিকারের দিক দিয়াই শুধু সমান নহে বরং তামাদ্দুনিক জীবনে পুরুষ যে সব কার্য করে, তাহারাও তাহাই করিবে এবং নৈতিক বন্ধন পুরুষের জন্য যেমন শিথিল করা হইয়াছে, নারীদের জন্যও অনুরুপ শিথিল করা হইবে। সাম্যের এই ভ্রান্ত ধারণার জন্য নারী তাহার দৈনন্দিন কার্যাবলীর প্রতি উদাসীন ও বিদ্রোহী হইয়া পড়িল। বস্তুত এই সমস্ত প্রকৃতিগত দৈনন্দিন কার্য সমাধার উপর তমদ্দুন ও মানব জাতির স্থায়িত্ব নির্ভরশীল । অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দলীয় প্রবণতা তাহার ব্যক্তিত্বকে আত্মকেন্দ্রিক করিয়া তুলিল। নির্বাচনী অভিযানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অফিস ও কলকারখানায় চাকুরি গ্রহণ, স্বাধীন ব্যবসায় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে পুরুষের সংগে প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা, ক্রীড়া, ব্যায়ামাদি ও সমাজের চিত্তবিনোদনকারী কার্যকলাপে অংশ গ্রহণ, ক্লাব, রংগমঞ্চ, নৃত্যগীত প্রভৃতি ও অনুষ্ঠানে সময় ক্ষেপণ এবং এবম্বিধ বহু প্রকার অকরণীয় ও অবক্তব্য কার্যকলাপ তাহাদের মন ও মস্তিস্ককে এমনভাবে প্রভাবান্বিত করিল যে, দাম্পত্য জীবনের গুরু দায়িত্ব, সন্তান প্রতিপালন, পারিবারিক সেবা-শুশ্রুষা, গৃহের সুব্যবস্থা প্রভৃতি যাবতীয় করণীয় বিষয়গুলি তাহার কর্মসূচী-বহির্ভূত হইয়া পড়িল। উপরন্তু তাহাদের প্রকৃতিগত ক্রিয়াকলাপের প্রতি তাহাদের আন্তরিক ঘৃণা জন্মিল। এখানে পাশ্চত্য পারিবারিক শৃঙ্খলা-যাহাকে তামাদ্দুনিক ভিত্তি-প্রস্তর বলা হয়-কদর্যভাবে প্রসার লাভ করিতে লাগিল। যেই গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-শান্তির উপর মানবের কার্যক্ষমতা পরিস্ফুটন নির্ভরশীল , তাহা প্রকৃতপক্ষে শেষ হইয়া আসিতে লাগিল। তামাদ্দুনিক পরিচর্যায় নারী-পুরুষের পারস্পরিক সুষ্ঠু পন্থাই বৈবাহিক সম্পর্ক-উহা এখন মাকড়সার জাল অপেক্ষা ক্ষীণতর হইয়া পড়িল। জন্ম নিয়ন্ত্রন, গর্ভপাত ও প্রসূত হত্যার দ্বারা বংশ বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হইতে লাগিল। নৈতিক সাম্যের ভ্রান্ত ধারণা নারী-পুরুষের মধ্যে চরিত্রহীনতার সাম্য আনয়ন করিল। যেই নির্লজ্জতা পুরুষের জন্যও লজ্জাজনক ছিল, তাহা আর নারীর জন্য লজ্জাকর রহিল না।
দ্বিতীয়ত, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তাহাকে পুরুষ হইতে বেপরোয়া করিয়া দিল। পূর্বতন রীতিনীতি অনুযায়ী পুরুষ উপার্জন করিত এবং নারী গৃহ রক্ষা করিত। এখন তাহার পরিবর্তন ঘটিল। এখন নারী পুরুষ উভয়েই উপার্জন করিবে এবং গৃহ-শৃঙ্খলার ভার বহিরাগত তৃতীয় ব্যক্তির উপর অর্পিত হইবে বলিয়া স্থির হইল। এখন একমাত্র যৌন সম্পর্ক ব্যতীত নারী-পুরুষের মধ্যে এমন কোন সম্পর্ক রহিল না, যাহার জন্য একে অপরের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিতে বাধ্য হয়। কামরিপু চরিতার্থ করিবার জন্য নারী-পুরুষকে অবশ্যম্ভাবীরূপে চিরন্তন পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ থাকিয়া কোন এক গৃহে যৌথ জীবন যাপন করিতা হইবে-ইহার কি প্রয়োজন আছে? যেই নারী স্বীয় জীবিকা অর্জন করিতে পারে, যাবতীয় আবশ্যক মিটাইতে সক্ষম এবং অপরের নিরাপত্তা ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী নহে, সে শুধু যৌন সম্ভোগের জন্য কেন একটি পুরুষের অধীনতা স্বীকার করিবে? কেনই-বা সে নৈতিক ও আইনগত বাধা-নিষেধ আপন স্কন্ধে স্থাপন করিবে? এবং কেনই-বা একটি পরিবারের গুরুদায়িত্ব বহন করিবে? বিশেষ করিয়া যখন নৈতিক সাম্যের ধারণা তাহার যৌন সম্ভোগের পথ নিষ্কণ্টক করিয়া দিয়াছে, তখন সে অভিলাষ চরিতার্থের এমন সহজ-সুন্দর সুরুচিসম্মত পন্থা পরিত্যাগ করিয়া ত্যাগ ও দায়িত্বসম্পন্ন প্রাচীন পন্থা অবলম্বন করিবে কেন? ধর্মের সংগে পাপ-ভয়ও দূরীভূত হইয়াছে। সমাজ তাহাকে আর অশ্লীলতার জন্য তিরস্কার করিবে না বলিয়া তাহার অন্তর হইতা সমাজ ভীতিও দূর হইয়াছে। তাহার একমাত্র ভয় ছিল অবৈধ সন্তানের। কিন্তু তাহা হইতে পরিত্রাণ লাভ করিবার জন্য গর্ভনিরোধেরও ব্যবস্থা আছে। ইহা সত্ত্বেও যদি গর্ভ সঞ্চার হ্য়, তবে গর্ভ-নিপাতেও ক্ষতির কোন কারণ নাই। ইহাতেও বিফল মনোরথ হইলে, প্রসূতকে গোপনে হত্যা করা যাইতে পারে। কিন্তু একান্তই যদি হতভাগ্য মাতৃত্বের অভিলাষ (যাহা দুর্ভাগ্যবশত এখনও বিলুপ্ত হয় নাই) প্রসূতকে হত্যা করিতে বাধা দান করে, তাহাতেই-বা ক্ষতি কি? কারণ বর্তমানে ‘কুমারী মাতা’ এবং জারজ সন্তানের স্বপক্ষে এত আন্দোলন হইতেছে যে, যেই ব্যক্তি তাহাদিগকে ঘৃণার চক্ষে দেখিবার সৎ সাহস করিবে তাহাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলিয়া অভিযুক্ত করা হইবে।
ইহাই পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করিয়াছে। আজকাল প্রতিটি দেশে লক্ষ লক্ষ যুবতী নারী চিরকুমারীত্ব বরণ করিয়া কামাসক্ত জীবন যাপন করিতেছে। আবার বহু সংখ্যক নারী আকস্মিক প্রেম-ফাঁদে পড়িয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু একমাত্র যৌন সম্পর্ক ব্যতীত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অন্য কোনরূপ আবশ্যকীয় যোগসূত্র থাকে না-যাহা তাহাদিগকে চিরমিলনের সূত্রে আবদ্ধ রাখিতে পারে। এইজন্য বর্তমানে বৈবাহিক সম্পর্কে কোন স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তার অবকাশ নাই। স্বামী-স্ত্রী কেহ কাহার পরোয়া করে না বলিয়া তাহাদের দাম্পত্য সম্পর্ক লইয়া কোন প্রকার বিচার-বিবেচনা অথবা সমঝোতার জন্যও তাহারা প্রস্তুত নহে। নিছক যৌন প্রেমানুরাগ অবিলম্বেই মন্দীভূত হইয়া পড়ে; ইহার ফলে তুচ্ছ মতদ্বৈধতা, এমন কি অধিকাংশ সময়ে শুধু ঔদাসিন্য তাহাদের বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দেয়। একমাত্র এই কারণেই অধিকাংশ বিবাহই তালাক অথবা আইনসম্মত পৃথকীকরণে পর্যবসিত হইয়া থাকে। গর্ভনিরোধ, গর্ভনিপাত, ভ্রূণ ও প্রসূতহত্যা, জন্মহারের ন্যূনতা এবং জারজ সন্তানের সংখ্যা বৃদ্ধি বহুলাংশে উপরিউক্ত কারণসমূহেরই শেষ পরিনতি। কুকার্য, নির্লজ্জতা ও রতিজ দুষ্ট ব্যাধির প্রাদুর্ভাবও উপরিউক্ত কারণেই হইয়া থাকে।
তৃতীয়ত, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নারীদের মধ্যে সৌন্দর্য প্রদর্শন, নগ্নতা ও অশ্লীলতা স্পৃহাকে অতিমাত্রায় বর্ধিত করিয়াছে। প্রকৃতিগতভাবে যৌন আকর্ষণ নর-নারীর মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান থাকে এবং উভয়ের অবাধ মেলামেশার ফলে উক্ত যৌন আকর্ষণ অতিরিক্ত বর্ধিত হয়। আবার এতাদৃশ মিশ্র সমাজে স্বাভাবিকভাবে নর-নারী উভয়ের মধ্যে এই অদম্য স্পৃহা জন্মে যে, তাহাদিগকে বিপরীত লিঙ্গের লোকের জন্য চিত্তাকর্ষক সাজিতে হইবে। যেহেতু নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের ফলে এইরূপ কার্য নিন্দনীয় বিবেচিত হয় না, বরং প্রকাশই প্রেম নিবেদন প্রশংসার্হ মনে করা হয়, সেইজন্য রূপ-লাবণ্যের আড়ম্বর ক্রমশ সকল সীমা লঙ্ঘন করিয়া চলে। অবশেষে ইহা নগ্নতার চরম সীমায় উপনীত হয়। পাশ্চাত্য তাহযীবের বর্তমান পরিস্থিতি ইহাই। আজকাল বিপরীত লিঙ্গের জন্য চৌম্বক সাজিবার স্পৃহা নারীদের মধ্যে এত প্রবল যে, চাকচিক্যময় মনোহর সাজ-পোশাক ও লিপস্টিক, রুজ প্রভৃতি প্রসাধন দ্রব্যাদি সুশোভিত রূপসজ্জায় তাহাদের মনের সাধ মিটে না। অবশেষে হতভাগিনীর দল বিবস্ত্র হইয়া পড়ে। এদিকে পুরুষদের পক্ষ থেকে অধিকতর নগ্নতার দাবী উত্থিত হয়। কারণ কামলিপ্সার প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা নগ্ন সৌন্দর্যের দ্বারা নির্বাপিত না হইয়া অধিকতর লেলিহান হইয়া উঠে এবং অধিকতর নগ্নতার দাবী করে। মরু সাইমুম তাড়িত পিপাসারত পথিকের এক চুমুক পানি যেমন তৃষ্ণা বৃদ্ধিই করে, তেমনি এই হতভাগাদের যৌন পিপাসা এক চরম তৃষ্ণায় পরিণত হইয়াছে। সীমাহীন যৌন-তৃষ্ণায় অতৃপ্ত হইয়া এই সকল কামলিপ্সুর দল সর্বদা সকল সম্ভাব্য উপায়ে পরস্পরের যৌন তৃপ্তি বিধানের উপাদান সরবরাহ করিয়া থাকে। নগ্নচিত্র, যৌনোদ্দীপক সাহিত্য, প্রেমপূর্ণ গল্প, নগ্ন বলনৃত্য এবং যৌনানুরাগ পরিপূর্ণ ছায়াচিত্র কিসের জন্য? সমস্তই উক্ত অগ্নি নির্বাপিত করিবার-প্রকৃতপ্রস্তাবে অধিকতর প্রজ্বলিত করিবার উদাহরণস্বরূপ যাহা এই ভ্রান্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যেকের কণ্ঠ সংলগ্ন করিয়া রাখিয়াছে এবং স্বীয় দুর্বলতাকে ঢাকিবার জন্য ইহার নাম দিয়াছে ‘আর্ট’।
এক্ষণে ঘূণেধরা পাশ্চাত্য জাতিসমূহের জীবনীশক্তি নিঃশেষিত হইয়া আসিতেছে। বস্তুত আজ পর্যন্ত ঘূণেধরা কোন জাতিই বাঁচিয়া থাকে নাই। যেই সমস্ত শারীরিক ও মানসিক শক্তি আল্লাহ তায়ালা মানুষকে জীবন ধারণ ও উন্নতি বিধানের জন্য দান করিয়াছেন, তাহা এইরূপ ঘূণেই বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। বস্তুত যাহারা চতুর্দিক হইতে কামোদ্দীপনার পীড়নে নিপীড়িত হইয়া জীবনযাপন করে, প্রতি মুহূর্তে যাহাদের আবেগ-অনুভূতিকে নব নব প্ররোচণা ও নব নব উত্তেজনার সম্মুখীন হইতে হয়, একটি উত্তেজনাব্যঞ্জক পরিবেশ যাহাদিগকে প্রভাবান্বিত করিয়া রাখিয়াছে, নগ্ন চিত্র, অশ্লীল সাহিত্য, চিত্তাকর্ষক সংগীত, কামোদ্দীপক নৃত্য, প্রেম-প্রণয়পূর্ণ চলচিত্র, চিত্তহরণকারী জীবন্ত দৃশ্য ও চলার পথে বিপরীত লিঙ্গের সহিত নিত্যনৈমিত্যিক সাক্ষাতকারের সুযোগ-সুবিধা যাহাদের রক্তকণাকে উত্তপ্ত ও উত্তেজিত করিয়া রাখিয়াছে, তাহারা কেমন করিয়া সেই নিরাপত্তা, শান্তি ও চিত্তের প্রসন্নতা আনয়ন করিবে যাহা গঠনমূলক ও সৃজনশীল কার্যে একান্ত অপরিহার্য? এইরূপ উত্তেজনার মধ্যে তাহাদের তরুণ বংশধরগণের জন্য সেই শান্ত সুশীতল ক্ষেত্র কোথায়, যেখানে তাহাদের মানসিক ও নৈতিক শক্তির বিকাশ সম্ভবপর হইতে পারে? সংগ লাভ করিবার সংগে সংগেই তো পাশবিক প্রবৃত্তির দৈত্য তাহাদিগকে গ্রাস করিয়া ফেলে। এহেন দৈত্যের নখর কবলিত হওয়ার পর তাহাদের উন্নতির সম্ভাবনা কোথায়?
মানবীয় চিন্তাধারায় বেদনাদায়ক নৈরাশ্য
তিন সহস্র বৎসরের ঐতিহাসিক উত্থান-পতনের কাহিনী পরস্পর এমন একটি বিশাল ভূখণ্ডের সহিত সংশ্লিষ্ট রহিয়াছে, যাহা অতীতেও দুইটি বিরাট সভ্যতার লালন-পালন ক্ষেত্র ছিল এবং যাহার সভ্যতার বিজয়-ডঙ্কা বর্তমানকালেও জগতের বুকে নিনাদিত হইতেছে। এইরূপ কাহিনী মিসর, বেবিলন, ইরান এবং অন্যান্য দেশেরও আছে। প্রাচীন ভারত উপমহাদেশেও শত শত বৎসর যাবত সংগত সীমা লঙ্ঘন ও চরম নূন্যতার অভিশাপ নামিয়া আসিয়াছে। একদিকে নারীকে দাসীরূপে পরিগণিত করা হইয়াছে; পুরুষ তাহার স্বামী, পতিদেব ও উপাস্য মা’বুদ হইয়াছে- তাহাকে শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বৈধব্যাবস্থায় পুত্রের অধীন হইয়া থাকিতে হইয়াছে। স্বামীর চিতায় সে সহমরণ বরণ করিয়াছে। তাহাকে কর্তৃত্ব ও উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা হইয়াছে। বিবাহ ব্যাপারে তাহার উপর এমন নিষ্ঠুর আইন প্রয়োগ করা হইয়াছে যা, তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাকে একজন পুরুষের হস্তে সম্প্রদান করা হইয়াছে ও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাহার কর্তৃত্ব ও অধীনতার নাগপাশ হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে পারে নাই। ইহুদী এবং গ্রীকদের ন্যায় তাহাকে পাপ এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অধপতনের প্রতিমূর্তি মনে করা হইয়াছে। তাহার চিরন্তন ব্যক্তিত্বকে মানিয়া লইতে অস্বীকার করা হইয়াছে।
অপরদিকে যখন তাহার প্রতি করুণা প্রদর্শন করা হইয়াছে, তখন তাহাকে পাশবিক প্রবৃত্তির ক্রীড়নকে পরিণত করা হইয়াছে। সে এমন নিবিড়ভাবে পুরুষের দেহ-সঙ্গিনী হইয়াছে যে, পরিণামে সে তাহার জাতিসহ ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। এই যে লিংগ ও যোনীপূজা, উপাসনালয়ে নগ্ন যুগল মূর্তি, ধর্মীয় বারাঙ্গনা, হোলির প্রেম-লীলা এবং নদ-নদীতে অর্ধনগ্নস্নান-এই সকল কিসের স্মৃতিবাহক? প্রাচীন ভারতের বামমার্গীয় আন্দোলনের পরে পাপাচার-ব্যভিচারই শেষ পরিণাম ফল হইয়া রহিল-যাহা ইরান, বেবিলন, গ্রীস ও রোমের ন্যায় ভারতেরও তাহযীব-তমদ্দুনের ক্রমোন্নতির পর সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়াইয়া পড়িল এবং হিন্দু জাতিকে কয়েক শতাব্দীর জন্য গ্লানি ও অধপতনের অতলগর্ভে নিমজ্জিত করিয়া দিল।
এই ইতিবৃত্তের প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে পরিজ্ঞাত হওয়া যায় যে, নারী সম্পর্কে সাম্য-সুবিচার জ্ঞান লাভ করা, উহা অনুধাবন করা এবং উহার প্রতি অবিচল থাকা মানবের পক্ষে কত দুষ্কর প্রমাণিত হইয়াছে। সাম্য সুবিচারের অর্থ এই হইতে পারে যে, একদিকে নারীকে তাহার ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা প্রদর্শনের এতখানি সুযোগ দান করা, যাহাতে সে উন্নত কর্মদক্ষতার সহিত মানবীয় তাহযীব-তমদ্দুনের উৎকর্ষ সাধনে অংশ গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তূ অপরদিকে আবার এমন সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে, যেন সে নৈতিক অধপতন ও মানবতার ধ্বংসের কারণ হইয়া না পড়ে । উপরন্তু পুরুষের কার্যে তাহার সাহায্য–সহযোগিতা এমন পন্থা নির্ণয় করিয়া দিতে হইবে, যাহাতে উভয়ের মিলিত কার্যক্রম তমদ্দুনের জন্য মংগলকর হয়। শত সহস্র বৎসর হইতে জগত এই সাম্য –সুবিচারের প্রতীক্ষায় দিন গণনা করিতেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তাহা সম্ভব হয় নাই। কখনও সে এক চরম প্রান্তসীমায় উপনীত হইতেছে এবং মানবতার একাংশকে অকর্মণ্য করিয়া রাখিয়াছে। আবার কখনও অপর প্রান্তসীমায় উপনীত হইয়া মানবতার উভয় অংশকে একত্রে মিলিত করিয়া ধ্বংসের অতলগর্ভে নিমজ্জিত করিতেছে।
তথাপি সাম্য – সুবিচার অবর্তমান নহে, ইহার অস্তিত্ব বিদ্যমান । কিন্তু শতসহস্র বৎসরের সংগত সীমা লংঘন ও চরম শূন্যতার মধ্যে বিবর্তিত হইবার ফলে মানুষের এতখানি মতিভ্রম হইয়াছে যে, স্বচক্ষে দর্শন করিয়াও চিনিতে পারে না যে, ইহাই তাহার চির ঈপ্সিত বস্তু –যাহার সন্ধান সে যুগে যুগ ধরিয়া করিয়া আসিতেছে । এই চির –অভীস্পতকে দেখিয়া সে ভ্রমবশত নাসিকা কুঞ্চিত করে –বিদ্রূপ করে । যে ব্যক্তির মধ্যে ইহা দেখিতে পাওয়া যায়,তাহাকে হাস্যস্পদ করিবার চেষ্টা করা হয়। ইহার দৃষ্টান্ত এমন একটি শিশুর ন্যায়, যে একটি কয়লা খনির গর্ভে ভূমিষ্ট হইয়াছে এবং তথায় প্রতিপালিত ও বর্ধিত হইয়াছে। সেই কয়লা অধ্যুষিত জলবায়ু ও তমসাবৃত স্থানই যে তাহার নিকটে স্বাভাবিক মনে হইবে, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। অতঃপর অন্ধকার কয়লাখনির অভ্যন্তর হইতে ভূপৃষ্ঠে তাহাকে আনয়ন করিলে প্রাকৃতিক জগতের সূর্য-করোজ্জ্বল নির্মল প্রান্তরের প্রতিটি বস্তু দর্শনে প্রথমত সে অবশ্য নাসিকা কুঞ্চিত করিবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তো মানুষ বটে। কয়লার ছাদ ও তারকা-শোভিত আকাশের পার্থক্য নির্ণয় করিতে তাহার কত সময় লাগিবে? দূষিত ও নির্মল বায়ুর পার্থক্য নির্ণয় করিয়া সে কতদিন কাটাইবে?