যৌনোন্মাদনা ও অশ্লীলতার সংক্রামক ব্যাধি
যৌন ব্যাধি
যৌন প্রবণতার প্রজ্জ্বলিত অগ্নির স্বাভাবিক পরিণামস্বরূপ লজ্জাহীনতা ও ব্যভিচার যে ব্যপক আকারে জনস্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল তাহার মূলে ছিল ঐ সকল সাহিত্য, বিজ্ঞাপন, ছায়াচিত্র, নাট্যাভিনয়, নৃত্যগীত, নগ্নতা ও অশ্লীলতা।
স্বার্থান্বেষী পুঁজিপতিদের একটি বাহিনী সকল সম্ভাব্য উপায়ে যৌনতৃষ্ণায় ইন্ধন যোগাইবার কার্যে লিপ্ত থাকে এবং এই উপায়ে নিজেদের ব্যবসায় প্রসার করে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাগুলি চরম অশ্লীলতাপূর্ণ প্রবন্ধাদি ও চিত্রাদি প্রকাশ করে। কারণ, তাহাদের পত্রিকার বহুল প্রচারের ইহা অধিকতর কার্যকরী অস্ত্র বিশেষ। এই কাজে উন্নত ধরনের প্রতিভা, কৌশল ও মনস্তাত্ত্বিক নিপুণতার প্রয়োগ করা হয়, যাহাতে শিকার কোনক্রমেই আত্মরক্ষা করিতে না পারে। এতদ্ব্যতীত যৌনসমস্যা সম্পর্কিত চরম অশুচি সাহিত্য ও প্রচারপত্র পুস্তাকাকারে প্রকাশিত হয়। এই সকল এত অধিক পরিমাণে প্রচারিত হয় যে, এক এক সংস্করণে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার পর্যন্ত ছাপান হয়। অনেক সময় এই সকল সাহিত্যের সষ্টিতম সংস্করণ পর্যন্ত প্রকাশিত হইতে দেখা যায়। কোন কোন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুধু এই কাজের জন্যই নির্দিষ্ট থাকে। এমন অনেক লেখক ও সাহিত্যিক আছে, যাহারা এইরূপ কাজ করিয়াই খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করিয়া থাকে। কোন অশ্লীল গ্রন্থ প্রনয়ণ এখন আর মোটেই অসম্মানজনক নহে, বরং ইহা জনসাধারণ্যে গৃহীত হইলে গ্রন্থকার ফরাসী একাডেমীর সদস্যপদ কিংবা অন্ততপক্ষে Croix D’honnenr লাভের যোগ্য হয়।
সরকার এই সকল নির্লজ্জতা ও কাম প্ররোচনা নীরবে উপেক্ষা করিয়া থাকে। যদি কখনো চরম লজ্জাকর কিছু প্রকাশিত হয়, তবে পুলিশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও অপরাধীকে চালান দেয়। তদুপরি মহানুভব বিচারালয় রহিয়াছে। তথাকার ন্যায়বিচারের আসন হইতে অপরাধকে মাত্র সাবধান করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয়। কারণ বিচারালয়ের আসন যাহারা অলংকৃত করিয়া থাকে, তাহারাও এবম্বিধ সাহিত্য হইতে রসাস্বাদন করিয়া থাকে। কোন কোন বিচারকের লেখনী আবার অশ্লীল যৌন সাহিত্য প্রণয়নে লিপ্ত থাকে। যদি কখনো ঘটনাক্রমে কোন বিচারক প্রাচীনপন্থী প্রতিপন্ন হয় এবং তাহার দ্বারা কোন অনুচিত রায় দানের আশঙ্কা হয়, তাহা হইলে বড় বড় সাহিত্যিক ও খ্যাতনামা লেখক সম্মিলিতভাবে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিতে থাকে এবং সংবাদপত্রে এই বলিয়া ইহার তীব্র সমালোচনা করা হয় যে, সাহিত্য ও শিল্পকলার উন্নতির জন্য স্বাধীন ক্ষেত্রের প্রয়োজন আছে। অন্ধ যুগের মনোভাব দ্বারা নৈতিক বন্ধন প্রয়োগ করার অর্থ রসবিজ্ঞানের কণ্ঠরোধ করা। এই রসবিজ্ঞানের উন্নতি কি কি উপায়ে হয়? নগ্নচিত্র ও চলচ্চিত্র এই ব্যাপারে বিশেষ কার্যকরী হয়। ইহার লক্ষ লক্ষ এলবাম তৈরী করিয়া ইহাকে শুধু বাজার, হোটেল ও চা-খানায়ই রাখা হয়। অশ্লীলতা বিরোধী সংঘের দ্বিতীয় অধিবেশনে এমিল পুরেসি যে রিপোর্ট পেশ করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি বলেনঃ
এই সকল অশুচি ইতর তৈলচিত্রগুলি মানবীয় ইন্দ্রিয়নিচয়ে একটা উত্তেজনা ও পরম তৃষ্ণার সঞ্চার করে। ইহা হতভাগ্য ক্রেতাদিগকে এমন পাপকার্যে উদ্বুদ্ধ করে যে, তাহা চিন্তা করিলেও শরীর রোমাঞ্চিত হয়। বালক-বালিকাদের উপর ইহার সর্বনাশা প্রভাব বর্ণনাতীত। নৈতিক ও শারীরিক দিক দিয়া বহু স্কুল-কলেজ এইসবের জন্য ধ্বংস হইয়া গিয়াছে, বিশেষ করিয়া বালিকাদের জন্য ইহা অপেক্ষা অধিকতর ক্ষতিকর আর কিছুই হইতে পারে না।
নাট্যশালা, প্রেক্ষাগৃহ, সঙ্গীতালয় ও কফিখানায় চিত্তবিনোদনের দ্বারা এই রস-বিজ্ঞানের চর্চা করা হয়। যে সকল নাট্যাভিনয় ফরাসী সমাজের অভিজাতশ্রেণী আনন্দ সহকারে দর্শন করে এবং যে নাট্যকার ও কৃতি অভিনেত্রীদের উপর প্রশংসাসূচক করতালিসহ পুষ্প বর্ষণ করা হয় তাহার প্রতিটিই কামোন্নাদনাপূর্ণ হয়। বৈশিষ্ট্যই এই যে, নৈতিকতার দিক দিয়া যে চরিত্রটি অত্যন্ত জঘন্য হয়, তাহাকে সর্বোৎকৃষ্ট ও উচ্চাঙ্গের আদর্শ হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়। পল ব্যুরোর ভাষায়ঃ
ত্রিশ চল্লিশ বৎসর হইতে আমাদের নাট্যকারগণ জীবনের যে চিত্র পরিষ্ফুট করিতেছে, তাহা দর্শন করিয়া যদি কেহ আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা করিতে চায়, তাহা হইলে সে এতটুকু হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে যে, আমাদের সমাজে যত বিবাহিত দম্পতি আছে, তাহারা সকলেই কৃতঘ্ন এবং দাম্পত্য জীবনে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসী। হয়ত স্বামী নির্বোধ কিংবা তাহার স্ত্রী পরম শত্রু। স্ত্রীর যদি কোন মহৎ গুণ থাকে, তাহা হইলে তাহা এই যে,সর্বদা স্বামীর প্রতি বিরাগভাজন হইবে এবং অন্যত্র প্রেম নিবেদনের জন্য প্রস্তুত থাকিবে।
অভিজাত সম্প্রদায়ের নাট্যাভিনয়ের যদি এই অবস্থা হয়, তাহা হইলে জনসাধারণের নাট্যশালা ও চিত্তবিনোদনের স্থানগুলির কি স্বরূপ হইতে পারে, তাহা সহজেই অনুমেয়! যৌন ক্রীড়ামোদীগণ যে ভাষা, কমনীয় ভঙ্গী ও নগ্নতার আনন্দ উপভোগ করে, তাহা নির্লজ্জভাবে রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়। পূর্বাহ্ণে জনসাধারণকে জানাইয়া দেওয়া হয় যে, তাহাদের যৌনতৃষ্ণা মিটাইবার সকল উপাদান পাওয়া যাইবে। আরও বলা হয়ঃ আমাদের রংমঞ্চ লৌকিকতা বর্জিত ও স্বভাবসংগত (Realistic)।
এমিল পুরেসি তাঁহার রিপোর্টে বহু দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি বিভিন্ন চিত্তবিনোদনের স্থানগুলিতে গমন করত এই সকল দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করিয়াছেন এবং উহা বুঝাইবার জন্য তিনি নামের পরিবর্তে অক্ষর ব্যবহার করিয়াছেন।
ব. ‘এখানে অভিনেত্রীদের গীত.স্বগতোক্তি (Monologues) এবং অঙ্গ-ভঙ্গিমা চরম অশ্লীলতাপূর্ণ ছিল। পটের উপর যে দৃশ্য উন্মোচন করা হইয়াছিল, তাহা যৌন সম্মিলনে শেষ পর্যায়ে উপনীত হইতে হইতে রহিয়া গেল। সহস্রাধিক দর্শক তথায় সমবেত হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও ছিল। সকলে তন্ময় হইয়া প্রশংসাসূচক ধ্বনি করিতেছিল।’
ন. ‘এখানে সংক্ষিপ্ত গীত ও তাহার মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত কথন, অঙ্গ-ভঙ্গিমা এবং নীরবতা নির্লজ্জতায় চরম সীমায় পৌঁছাইয়াছিল। শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণগণও পিতামাতার সহিত বসিয়া এই রঙ্গ-রস উপভোগ করিতেছিল এবং প্রত্যেক বালক অশ্লীল অভিনয় দর্শনে পূর্ণোদ্যমে করতালি দিতেছিল।’
ল. ‘এখানে দর্শকবৃন্দ পাঁচবার কোলাহল করিয়া অভিনেত্রীকে পুনঃপুনঃ এমন একটি অভিনয়ের জন্য বাধ্য করিল যে, তাহার অভিনয় চরম অশ্লীল গীত দ্বারা সমাপ্ত করিতে হইয়াছিল।’
র. ‘এখানে দর্শকবৃন্দ একজন অভিনেত্রীকে পুনঃপুনঃ একটি অতীব অশ্লীল অভিনয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছিল।’
অবশেষে সেই অভিনেত্রী বিরক্তি সহকারে বলিয়া উঠিল, “তোমরা কি এতই নির্লজ্জ? দেখিতেছ না যে, এখানে কতকগুলি শিশুও আছে?” এই বলিয়া সে অভিনয় সমাপ্ত না করিয়াই চলিয়া গেল। ইহা এমন অশ্লীল ছিল যে, অত্যন্ত পাপীয়সীও ইহার পুনরাভিনয় সহ্য করিতে পারিত না।
জ. ‘অভিনয় শেষে অভিনেত্রীদের লটারী করা হইল। তাহারা এক একটি টিকেট দশ শান্তিম মূল্যে (এক শান্তিম প্রায় দুই আনার সমতুল্য) বিক্রয় করিতে লাগিল। যে ব্যক্তির ভাগ্যে যে অভিনেত্রীর নাম উঠিল, সে-ই রাত্রির জন্য তাঁহার হইল।’
পল ব্যুরো বলেন যে, ‘অধিকাংশ সময়ে রঙ্গমঞ্চে এমন এক নারীকে আনয়ন করা হয়, যাহার দেহে বস্ত্রের লেশ মাত্র থাকে না। অ্যাডলফ বায়াসন (Adlophe Biason) একবার ফরাসীর বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘তানে’ (Tamps) এই সকল বিষয়ের প্রতিবাদ করে লেখেন, এখন মঞ্চোপরি শুধু যৌনক্রিয়া সম্পাদনই অবশিষ্ট রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে তখনই আর্টের পরিপূর্ণতা লাভ হইবে।’
গর্ভনিরোধ আন্দোলন ও যৌনবিজ্ঞানের তথাকথিত জ্ঞানগর্ভ ও ভৈষজ্যশাস্ত্র সম্পৃক্ত সাহিত্যাবলী নির্লজ্জতা প্রচার এবং মানুষের নৈতিক চরিত্র ধ্বংসের ব্যাপারে বিশিষ্ট অংশ গ্রহণ করিয়াছে। জনসভায় বক্তৃতা, ভৌতিক আলোকচিত্র ও পুস্তকাদিতে চিত্র ও তাঁহার বিশ্লেষণের দ্বারা গর্ভ, তৎসম্পর্কিত বিষয়াদি এবং গর্ভনিরোধের সরঞ্জামাদির ব্যবহার বিধির এমন বিশ্লেষণ করা হয় যে, তাহার পর আর কোন কিছু প্রকাশ করিবার প্রয়োজন হয় না। এইরূপ যৌনবিজ্ঞানের পুস্তকাদিতে শরীর বিশ্লেষণ হইতে আরম্ভ করিয়া যৌন-ক্রিয়ার কোনোদিকই অপ্রকাশ রাখা হয় না। বাহ্যত এই সকল বিষয়ের উপরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবরণ দেওয়া হইয়াছে, যেন ইহার প্রতিবাদের কোন পথ না থাকে। উপরন্তু ইহার এতখানি উন্নতি হইয়াছে যে, ইহাকে সমাজসেবা নামে অভিহিত করা হয়। কারণস্বরূপ বলা হয় যে, তাহারা যৌনক্রিয়া সম্পর্কে অপরকে ভুল্ভ্রান্ত্রি হইতে রক্ষা করিতে চায়। কিন্তু প্রকৃত ব্যপার এই যে, এই সমস্ত সাহিত্য ও শিক্ষা প্রচার দ্বারা নারী-পুরুষ ও অল্পবয়স্ক তরুন-তরুণীদের মধ্যে জঘন্য নির্লজ্জতা সৃষ্টি করা হয়। এই সবের কৃপায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে যে, অপ্রাপ্তবয়স্কা কচি বালিকা পাঠাগারে বিদ্যাভ্যাস করিতে আসিয়া যৌন সম্পর্কিত এমন জ্ঞান লাভ করে, যাহা বিবাহিতা নারীগণও করিতে পারে না। কচি বালকদেরও এই একই অবস্থা। অসময়ে ইহাদের যৌন প্রবণতা সজাগ হইয়া পড়ে। ফলে তাহাদের মনে যৌনমৈথুন পরীক্ষা করিয়া দেখিবার আগ্রহ জন্মে। পূর্ণ যৌবন লাভ করিবার পূর্বেই তাহারা কাম প্রবৃত্তির নখর কবলিত হইয়া পড়ে। বিবাহের জন্য তো বয়সের সীমা নির্ধারিত আছে, কিন্তু যৌনক্রিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য বয়সের কোন সীমা নির্ধারিত করা নাই। কাজেই বার-তের বৎসর হইতেই এই সকল কার্য চলিতে থাকে।
জাতীয় অধঃপতনের পূর্বাভাস
যেখানে পবিত্রহীনতা, প্রবৃত্তি পূজা ও দৈহিক ভোগ-সম্ভোগের দাসত্ব চরমে উপনীত হয়, যেখানে নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই ভোগবিলাসে লিপ্ত হয় এবং যেখানে উন্মাদনার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি মানুষকে তাহার আয়ত্তের বাহিরে লইয়া যায়, যেখানে জাতীয় অধপতনের যাবতীয় কারণ প্রকাশিত হওয়া এক অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ এই প্রকার ধ্বংসোন্মুখ জাতিকে উচ্চ শিখরে দেখিয়া এই সিদ্ধান্ত করে যে, তাহাদের ভোগবিলাস উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক নহে বরং সহায়ক। তাহারা অধিকন্তু বলিয়া থাকে যে, কোন জাতির চরম উন্নতি একমাত্র তখনই হয় যখন সে ভোগবিলাসের চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। কিন্তু এইরূপ সিদ্ধান্ত একেবারেই ভ্রান্ত। যেখানে সৃষ্টি ও ধ্বংসের শক্তিগুলি মিলিতভাবে কার্য করে এবং সামগ্রিকভাবে গঠনমূলক কার্যাবলীই স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়, সেখানে বিধ্বংসী শক্তিগুলিকেও সৃষ্টির কারণসমূহের মধ্যে গণ্য করা একমাত্র সেই ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যাহার জ্ঞানবুদ্ধি বিকল হইয়া পড়িয়াছে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ যদি কোন সতর্ক ব্যবসায়ী জ্ঞান-বুদ্ধি, শ্রম ও অভিজ্ঞতার দ্বারা অজস্র অর্থ উপার্জন করে এবং তৎসহ মদ্যপান, জুয়া এবং ভোগ বিলাসেও লিপ্ত হয়, এমতাবস্থায় তাঁহার জীবনের উভয় দিককেই যদি স্বাচ্ছন্দ্য ও উন্নতির কারণ হিসাবে গণ্য করা হয়, তাহা হইলে ইহা অপেক্ষা অধিক নির্বুদ্ধিতা আর কি হইতে পারে? প্রকৃতপক্ষে তাহার উন্নতির কারণ এবং শেষোক্ত দোষগুলির সমষ্টি তাহার ধ্বংস সাধনে লাগিয়া থাকে। প্রথমোক্ত গুণাবলীর শক্তিতে অট্টালিকায় প্রতিষ্ঠিত থাকার অর্থ ইহা নহে যে, ধ্বংসকারী শক্তিগুলি তাহার উপর প্রভাব বিস্তার করিতেছে না। একটু সূক্ষদৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে প্রতীয়মান হইবে যে, এইসব ধ্বংসকারী শক্তি তাহার মস্তিস্ক ও শরীরের শক্তি ক্রমাগত ভক্ষন করিয়াই চলিয়াছে। তাহার শ্রমোপার্জিত অর্থ লুণ্ঠন করিতেছে। এই শক্তিগুলি তাহাকে ধ্বংস করিবার সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা এমন সুযোগের প্রতিক্ষায় থাকে যে, একটি সিদ্ধান্তকারী আক্রমনের দ্বারা প্রথম আঘাতেই তাহাকে শেষ করিয়া দিবে। জুয়ার শয়তান এক অশুভ মুহূর্তে তাহার সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থ নিমেষেই ধ্বংস করিয়া দিতে পারে এবং সে সেই মুহূর্তেরই প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। মদ্য পানের শয়তান সময় মত তাহার সংজ্ঞাহীনতার সুযোগে তাহার দ্বারা এমন এক মারাত্মক ভুল করাইতে পারে, যাহার ফলে সে মুহূর্তের মধ্যে দেউলিয়া হইতে পারে। সেও সেই সুযোগের সন্ধানে আছে। দুষ্কৃতির শয়তানও সেই মুহূর্তের প্রতীক্ষায় আছে, যখন সে তাহাকে হত্যা, আত্মহত্যা অথবা হঠাৎ ধ্বংসের মধ্যে লিপ্ত করিয়া দিতে পারে। ধারণাই করা যাইতে পারা যায় না যে, যদি সেই ব্যক্তি এই শয়তানগুলির কবলে না পড়িত, তাহা হইলে তাহার উন্নতির কি অবস্থা হইত!
একটি জাতির বেলায়ও এই একই অবস্থা। সে গঠনমুখী শক্তি বলে উন্নতি সাধন করে। কিন্তু সঠিক পরিচালনা শক্তির অভাবে উন্নতির পথে কয়েক ধাপ অগ্রসর হইবার পর স্বীয় ধ্বংসের কারণ সৃষ্টি করিতে থাকে। কিছুকাল পর্যন্ত সৃষ্টিমুলক শক্তিগুলি তাহাকে সম্মুখের দিকে পরিচালিত করিতে থাকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসকারী শক্তিগুলি তাহার জীবনী-শক্তি ঘূনের ন্যায় ভিতর হইতে ভক্ষণ করিতে থাকে। অবশেষে এমন শুন্যগর্ভ করিয়া ফেলে যে, হঠাৎ একটি আঘাতেই তাহার গৌরব সৌধ ধূলিসাৎ করিয়া দেয়। ফরাসী জাতির ভ্রান্ত সমাজ ব্যবস্থা তাহাদের জন্য যে ধ্বংস টানিয়া আনিয়াছে, তাহার সুস্পষ্ট বিরাট কারণগুলি এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করিব।
শারীরিক শক্তি নাশ
যৌন কামনার একচ্ছত্র শাসনের প্রাথমিক কুফল এই হইয়াছিল যে, ফরাসী দেশবাসীর শারীরিক শক্তি ক্রমশ লোপ পাইতে লাগিল। কামনার দাসত্ব তাহাদের মধ্যে সংযম ও ধৈর্য শক্তি নিঃশেষ করিয়া দিয়াছিল। রতিজ দুষ্ট ব্যাধির আধিক্য তাহাদের স্বাস্থ্যের উপর সর্বনাশা ক্রিয়া করিয়াছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতে এই অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছিল যে, সামরিক কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হইয়া কয়েক বৎসর পর পর নূতন ভাবে সৈন্য সংগ্রহের (New Reqruits) জন্য শারীরিক যোগ্যতার মান কমাইয়া দিতে হয়। কারণ প্রথমে যোগ্যতার যে মান নির্ণীত ছিল, সেই মানের অতি অল্প সংখ্যক যুবকই পরবর্তী সময়ে পাওয়া যাইত। ইহা একটি নির্ভরযোগ্য যন্ত্র, যাহা তাপ নির্ণয় যন্ত্রের (Thermometre) ন্যায় প্রায়ই নিশ্চয়তার সহিত বলিয়া দেয় যে, ফরাসী জাতির শারীরিক শক্তি ক্রমশ কত দ্রুতবেগে কমিয়া যাইতেছে। এই অধপতনের কারণগুলির মধ্যে রতিজ দুষ্ট ব্যাধি একটি বিশেষ কারণ ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের প্রথম দুই বৎসর যে সমস্ত সৈনিককে সিফিলিস ব্যাধির জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়, তাহাদের সংখ্যা ছিল পঁচাত্তর হাজার। মাত্র একটি মধ্যম শ্রেণীর সামরিক ছাউনিতে একই সময়ে ২৪২ জন সৈনিক এই রোগে আক্রান্ত হয়। একদিকে সেই সংকটসংকুল অবস্থার দিকে লক্ষ্য করুন, যখন ফরাসী জাতি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দোদুল্যমান ছিল, গোটা জাতির অস্তিত্ত্বের জন্য প্রতিটি সৈনিকের প্রাণপণ চেষ্টার প্রয়োজন ছিল, একটি ফ্রাঙ্ক অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। সময়, শক্তি, যাবতীয় উপায়-উপাদান ও প্রত্যেক বস্তু অত্যধিক পরিমাণে দেশরক্ষার কাজে ব্যয়িত হওয়ার প্রয়োজন ছিল; অন্য দিকে এই জাতির যুবকদের প্রতি লক্ষ্য করুন, তাহাদের মধ্যে হাজার হাজার যুবক যৌন বিলাসে কারণে শুধু দীর্ঘকাল ধরিয়া কাজের অযোগ্যই হইয়া পড়িল না বরং এই সংকট মুহূর্তে জাতির অর্থ ও উপায়-উপাদান চিকিৎসার জন্য ব্যয় করিয়া ফেলিল।
একজন ফরাসী বিশেষজ্ঞ ডাঃ ল্যারেড (Dr. Laredde) বলেন যে, ফ্রান্সে প্রতি বৎসর শুধু সিফিলিস এবং তজ্জনিত ব্যাধিতে ত্রিশ হাজার লোক প্রাণত্যাগ করে। জ্বর রোগের পর ইহাই মৃত্যুর সর্ববৃহৎ কারণ। একটি রতিজ ব্যাধির এই অবস্থা! ইহা ব্যতীত এ ধরনের আরও অনেক ব্যাধি আছে।
পারিবারিক শৃঙ্খলার বিলোপ সাধন
এই বল্গাহীন যৌন উন্মাদনা ও লাম্পট্যপ্রিয়তার সার্বজনীন প্রচলন ফরাসী সভ্যতার যে দ্বিতীয় বিরাট আপদ ডাকিয়া আনিয়াছিল, তাহা হইল পারিবারিক শৃঙ্খলার বিলোপ সাধন। নারী-পুরুষের যে স্থায়ী ও সুদৃঢ় সম্পর্কের দ্বারা পারিবারিক শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়, তাহার নাম বিবাহ। এই সম্পর্কের দ্বারাই মানব জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, স্থৈর্য ও স্থায়িত্ব স্থাপিত হয়। এই বস্তুই তাহার ব্যক্তিগত জীবনকে সামাজিক জীবনে পরিবর্তিত করিয়া দেয়। ইহাই বিশৃঙ্খলার অভিসম্পাতকে দমন করিতে তাহাদিগকে সভ্যতার দাস বানাইয়া দেয়। এই শৃঙ্খলার সীমারেখার মধ্যে প্রেম, শান্তি এবং ত্যাগের এমন শান্ত ও সুমহান আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়, যাহাতে নূতন বংশধর সঠিক চরিত্র, নির্ভুল শিক্ষা ও নির্মল চরিত্র গঠনের সঙ্গে প্রতিপালিত ও পরিবর্ধিত হইতে পারে। কিন্তু যেখানে নারী-পুরুষের অন্তর হইতে বিবাহ ও তাহার মহান উদ্দেশ্যের ধারণা একেবারে বিদূরিত হইয়াছে, যেখানে কামরিপু চরিতার্থ করা ব্যতীত যৌন সম্পর্কের অপর কোন উদ্দেশ্যই মনে স্থান পায় না এবং যেখানে কামপিপাসু ও কামপিপাসিনীর দল ভ্রমরের ন্যায় পুষ্পে পুষ্পে মধু পান করিয়া বেড়ায়, সেখানে এই শৃঙ্খলা স্থাপিত হইতে পারে না এবং থাকিতে পারে না। যেখানে নারী-পুরুষের এই যোগ্যতাই থাকে যে, তাহারা দাম্পত্য জীবনের গুরু দায়িত্ব, তাহার অধিকার, কর্তব্য ও নৈতিক নিয়মনীতির গুরুভার বহন করিবে, তাহাদের মানসিক ও নৈতিক অবস্থার ফল এই হয় যে, প্রত্যেক বংশধরের শিক্ষা পূর্বতন বংশ হইতে নিকৃষ্টতর হইয়া পড়ে। লোকের মধ্যে স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এত বাড়িয়া যায় যে, সভ্যতার বন্ধন ছিন্ন হইতে থাকে। লোকের মধ্যে রূপ পরিবর্তন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইতস্ততকরণ এত বাড়িয়া যায় যে, জাতীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন স্থিরতা বিদ্যমান থাকে না। পারিবারিক শান্তি না থাকার কারণে তাহাদের জীবন তিক্ত হইতে তিক্ততর হইতে থাকে এবং একটি চিরন্তন দুর্ভাবনা তাহাদিগকে মুহূর্তের জন্যও শান্তি দান করিতে পারে না। ইহাই ইহলৌকিক জাহান্নাম, যাহা লোকে নির্বুদ্ধিতাসুলভ ভোগলালসার উন্মাদনায় ক্রয় করিয়া লয়।
ফ্রান্সে প্রতি বৎসর হাজারে সাতআটজন নারী পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই অনুপাত এত নগণ্য যে, ইহার দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়, ফরাসী অধিবাসিদের কেমন একটা বিরাট অংশ অবিবাহিত রহিয়া যায়।
আবার যে নগণ্য সংখ্যক লোক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহাদের মধ্যেও অতি অল্প এমন পাওয়া যায়, যাহারা সৎ ও পবিত্র জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে বিবাহ করে। এই একটি উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যও তো তাহাদের থাকে। এমন কি যে নারী অবৈধ সন্তান প্রসব করিয়াছে, তাহাকে বিবাহ করত তাহার সন্তানকে বৈধ ঘোষণা করা জনসমাজে প্রচলিত এক কাম্য বস্তু ছিল। পল ব্যুরো বলেনঃ
ফ্রান্সের শ্রমিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহা সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল যে, বিবাহের পূর্বে বিবাহেচ্ছু নারী তাহার ভাবী স্বামীর নিকট হইতে এই প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে যে, সে তাহার অবৈধ সন্তানকে নিজের বৈধ সন্তান বলিয়া স্বীকার করিয়া লইবে।
১৯১৭ খৃস্টাব্দে সীনের (Saine) দেওয়ানী আদালতে জনৈকা নারী নিম্নোক্ত বিবৃতি দান করেঃ
আমি বিবাহের পূর্বেই আমার স্বামীকে এ বিষয়ে সাবধান করিয়া দিয়াছিলাম, আমার বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, অবিবাহিতা অবস্থায় আমি যে সন্তান প্রসব করিয়াছিলাম, তাহাকে বৈধ বলিয়া ঘোষণা করিতে হইবে। এখন প্রশ্ন এই যে, আমি তাহার সঙ্গে আর স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করিব কি না। এইরূপ ইচ্ছা আমার তখনও ছিল না, এখনও নাই। এইজন্যই যেদিন আমাদের বিবাহ হয় সেইদিনই সাড়ে পাঁচ ঘটিকায় আমি আমার স্বামীর সহিত বিবাহ বিচ্ছেদ করি। আজ পর্যন্ত তাহার সঙ্গে মিলিত হই নাই। কারণ দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব পালনের কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না।
-পল ব্যুরোর পূর্ব বর্ণিত গ্রন্থ, পৃঃ ৫৫
প্যারিসের একটি বিশিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষ পল ব্যুরোর নিকট এই বলিয়া মন্তব্য করেন যে, সাধারণত নব্য যুবকদের বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য আপন গৃহেও একটি রক্ষিতার সেবা গ্রহণ করা। দশ বার বৎসর তাহারা চতুর্দিকে স্বাধীনভাবে রসাস্বাদন করিয়া বেড়ায়। তারপর এমন এক সময় আসে, যখন তাহারা এইরূপ উচ্ছৃঙ্খলতা ও লাম্পত্যে ক্লান্ত শ্রান্ত হইয়া একটি নারীকে বিবাহ করিয়া বসে, যেন গৃহের শান্তিও কিয়দংশ লাভ করা যায় এবং স্বাধীন আনন্দ সুখবিলাসীর ন্যায় আনন্দ সম্ভোগও করিতে পারে। -উক্ত গ্রন্থ দ্র.
ফ্রান্সে বিবাহিত লোকের ব্যভিচার করা মোটেই দূষণীয় এবং নিন্দার্হ নহে। কেহ স্ত্রী ব্যতীত গৃহে কোন রক্ষিতা রাখিলে তাহা গোপন রাখিবার প্রয়োজন হয় না। সমাজও ইহাকে এক সাধারণ সম্ভাব্য বিষয় মনে করে।
-উক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৭৬-৭৭
এইরূপ অবস্থায় বৈবাহিক সম্পর্ক এত ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে যে, কথায় কথায় তাহা ছিন্ন হইয়া পড়ে। অনেক সময় এই সকল হতভাগ্যের দাম্পত্য জীবন কয়েক ঘন্তার বেশি তিকিয়া থাকে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ফ্রান্সের এক সম্মানিত ব্যক্তি যিনি কয়েকবার মন্ত্রিত্বের আসনও অলংকৃত করিয়াছেন, তিনি বিবাহের মাত্র পাঁচ ঘণ্টা পরে আপন স্ত্রীর সহিত বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। এমন সব তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপারে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘতিয়া থাকে যে, তাহা শ্রবণ করিলে হাসি পায়। যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেহ শয়নকালে ঘুমের ঘোরে নাক ডাকিলে অথবা একে অপরের কুকুরকে ভাল না বাসিলে বিচ্ছেদ অনিবার্য হইয়া পড়ে। সীনের দেওয়ানী আদালতে একবার একই দিবসে দুইশত চুরানব্বইটি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৮৪৪ খৃস্টাব্দে যখন বিবাহের নূতন আইন পাশ হয়, তখন চারি সহস্র তালাক সম্পাদিত হয়। ১৯০০ খৃস্টাব্দে এই সংখ্যা সাড়ে সাত সহস্রে, ১৯১৩ খৃস্টাব্দে ষোল সহস্রে ও ১৯৩১ খৃস্টাব্দে একুশ সহস্রে পৌঁছে।
বংশ হত্যা
সন্তান প্রতিপালন একটি উন্নত ধরনের নৈতিক কার্য। যাহার জন্য প্রয়োজন হয় প্রবৃত্তির সংযম, লালসা-বাসনার জলাঞ্জলী, দুঃখকষ্ট ও শ্রম স্বীকার এবং ধন প্রাণের উৎসর্গীকরণ। স্বার্থপর ও প্রবৃত্তির দাস যাহারা, তাহারা এই মহান কার্যের জন্য মোটেই প্রস্তুত নহে। কারণ একাকিত্ব বা সংশ্রবহীনতা ও পশুত্ব তাহাদিগকে পাইয়া বসে।
প্রায় শতাব্দীকাল হইতে ফরাসী দেশে গর্ভনিরোধ আন্দোলন চলিয়া আসিতেছে। এই আন্দোলনের ফলে ফরাসী দেশের প্রত্যেক নরনারী এমন কৌশল শিক্ষা করিয়াছে যাহাতে তাহারা মদানন্দ উপভোগ করিয়াও তাহার স্বাভাবিক পরিণতি গর্ভসঞ্চার, সন্তান প্রসব ও বংশ বৃদ্ধি হইতে রক্ষা পাইতে পারে। এমন কোন নগর, উপনগর বা গ্রাম নাই, যেখানে গর্ভনিরোধের ঔষধাবলী ও সরঞ্জমাদি প্রকাশ্যে বিক্রয় করা হয়না। ফলে এই সবের ব্যবহার শুধু উচ্ছৃঙ্খল যৌনামোদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং বিবাহিত নরনারীও ইহা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করে এবং ইহাই কামনা করে যে, সন্তান ভূমিষ্ট হইয়া যেন তাহাদের সুখ সম্ভোগে কোন প্রকার বাধার সৃষ্টি করিতে না পারে। ফরাসী দেশের জন্মহার যে পরিমাণে হ্রাস পাইতেছে তাহা লক্ষ্য করিয়া বিশেষজ্ঞগণ অনুমান করিয়াছেন যে, গর্ভনিরোধের এই ব্যাপক মহামারী প্রতি বৎসর অন্ততপক্ষে ছয় লক্ষ সন্তানের জন্ম গ্রহণে বাধা দান করে। এই সকল কৌশল সত্ত্বেও যে সকল গর্ভসঞ্চার হয়, গর্ভনিপাত করিয়া তাহা নষ্ট করা হয়। এইরূপে আরও তিন চারি লক্ষ্য মানব সন্তানের পৃথিবীতে আগমন বন্ধ হইয়া যায়।গর্ভনিপাত শুধু অবিবাহিত নারীই করেনা, , বরং বিবাহিতা নারীও এই ব্যপারে তাহাদের সমতুল্য। নৈতিকতার দিক দিয়া এই কার্যকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে এবং নারীর অধিকার মনে করা হয়। মনে হয় দেশের আইন এই বিষয়ে চক্ষু বন্ধ করিয়া আছে। যদিও আইন গ্রন্থে ইহা এখনও অপরাধজনক বলিয়া লিপিবদ্ধ আছে,তথাপিও ব্যাপার এই যে, তিন শত জনের মধ্যে কোনক্রমে একজনকে এই অপরাধে চালান দেয়া হয়। যাহাদের চালান দেওয়া হয়, তাহাদের মধ্যেও শতকরা পঁচাত্তর জন কোর্ট হইতে মুক্তি লাভ করে।গর্ভনিপাতের ডাক্তারি কৌশল এত সহজ ও সর্বজনপরিচিত যে,অধিকাংশ নারী নিজেই গর্ভনিপাত করিতে পারে। যাহারা ইহা করিতে পারে না,তাহাদের ডাক্তারের সাহায্য লাভে বেগ পাইতে হয়না। ভ্রুণ হত্যা বা গর্ভস্থ সন্তান হত্যা করা তাহাদের নিকট যন্ত্রণাদায়ক দন্ত উৎপাটনের ন্যায় এক সাধারণ ব্যাপার হইয়া পড়িয়াছে ।
এইরূপ মানসিকতা মাতৃ-প্রকৃতিকে করিয়া দিয়াছে যে,যাহারা প্রেম ও স্নেহবাৎসল্যকে জগতে চিরকালেই পরম ও চরম বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে সেই মাতা স্বীয় সন্তানাদির প্রতি শুধু বিরাগভাজন ও বিষণ্ণই নহে, বরং তাহাদের শত্রু হইয়া পড়িয়াছে।গর্ভনিরোধ নিপাতের নিষ্ফল চেষ্টার পরও যে সকল সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তাহাদের প্রতি নির্মম আচরণ করা হয়। পল ব্যুরো এই বেদনাদায়ক তথ্যটি নিম্নরূপ ভাষায় প্রকাশ করিতেছেনঃ
প্রতিদিন সংবাদ-পত্রাদিতে ঐ সকল সন্তানের দুর্দশা প্রকাশিত হয়, যাহাদের প্রতি তাহাদের মাতাপিতা নির্মম অমানুষিক আচরণ করিয়াছে। সংবাদপত্রেও কেবল অসাধারণ ঘটনাগুলির উল্লেখ করা হয়, কিন্তু লোকে ইহা ভালভাবেই জানে যে, সাধারণত এই সকল হতভাগ্য অনভিপ্রেত অতিথির প্রতি তাহাদের পিতামাতা কিরূপ নির্মম ব্যবহার করে। তাহাদের জনক-জননী তাহাদের প্রতি এইজন্য বিষণ্ণ ও উদাসীন যে, এই হতভাগ্যের দল তাহাদের জীবনের সুখ-সম্ভোগ একেবারে বিনষ্ট করিয়া দিয়াছে। সাহসিকতার স্বল্পতা অনেক ক্ষেত্রে গর্ভনিপাতে বাধা দান করে এবং এই সুযোগে নিরপরাধ শিশু জগতের বুকে পদার্পণ করে। কিন্তু তাহার আগমনের পরেই তাহাকে পরিপূর্ণ শাস্তি ভোগ করিতে হয়। -উক্ত গ্রন্থ, পৃ.৭৪
সন্তানের প্রতি এতোদৃশ বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা এমন চরমে পৌছিয়াছে যে, একদা একটি নারীর ছয় মাসের শিশুর মৃত্যু হইলে সে তাহার মৃত সন্তানের শবদেহ সম্মুখে রাখিয়া নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান করিল এবং প্রতিবেশীদের সম্মুখে বলিতে লাগিলঃ
এখন আমরা দ্বিতীয় সন্তান হইতে দিব না। এই সন্তানটির মৃত্যুতে আমি ও আমার স্বামী পরম শান্তি লাভ করিয়াছি। চিন্তা করিয়া দেখ তো, সন্তান কোন বস্তু? সে সর্বদা ঘ্যানর ঘ্যানর করিয়া কাঁদে, নোংরামি সৃষ্টি করে এবং ইহা হইতে কি বাঁচিবার উপায় আছে? -উক্ত গ্রন্থ, পৃ.৭৫
ইহা অপেক্ষা অধিকতর বেদনাদায়ক ব্যাপার এই যে, প্রসূত হত্যা এক সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় বিস্তার লাভ করিতেছে। ফরাসী সরকার ও তথাকার বিচারালয়গুলি গর্ভনিপাতের ন্যায় এই মারাত্মক অপরাধকেও উপেক্ষা করিয়া চলিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ১৯১৮ খৃস্টাব্দে ‘Loir’ আদালতে দুইজন নারীকে শিশু হত্যার অপরাধে হাযির করা হয় এবং উভয়কেই পরে মুক্তি দেওয়া হয়। তাহাদের একজন তাহার শিশু সন্তানকে পানিতে ডুবাইয়া মারিয়াছে। তাহার প্রথম সন্তান এক আত্মিয়ের দ্বারা প্রতিপালিত হইতেছে এবং সে দ্বিতীয় সন্তান প্রতিপালনেরও ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু মাতা সিদ্ধান্ত করে যে, এমন শত্রুর সে নিপাত করিয়াই ছাড়িবে। আদালতে তাহার অপরাধ ক্ষমার যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয়। দ্বিতীয় নারী তাহার সন্তানকে প্রথমত গলা টিপিয়া মারে। ইহাতে তাহার জীবনবায়ু একেবারে নিঃশেষিত হয় নাই মনে করিয়া সে তাহাকে দেওয়ালে নিক্ষেপ করিয়া মস্তক চূর্ণ করিয়া দেয়। জজ ও জুরীদের মতে সে মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় নাই। এই বৎসরেই সীনের আদালতে একটি নর্তকীকে অনুরূপ অপরাধের জন্য হাযির করা হয়। সে তাহার সন্তানের জিহ্ববা টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করে অতপর তাহার মস্তক চূর্ণ করিয়া এবং গলা কাটিয়া দিয়া তাহাকে হত্যা করে। এই নারীকেও নিরপরাধ বলিয়া জজ ও জুরীগণ রায় দান করে।
যে জাতি স্বীয় বংশধরের শত্রুতা সাধনে এমন চরমে উপনীত হইতে পারে, পৃথিবীর কোন সুব্যবস্থাই তাহাদিগকে ধ্বংসের কবল হইতে রক্ষা করিতে পারে না। নতুন বংশধরের জন্মলাভ একটি জাতির স্থিতিপরস্পরা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য অনিবার্য। যে জাতি আপন বংশধরের শত্রু হয়, সে প্রকৃতপক্ষে নিজেরই শত্রু হইয়া পড়ে। সে আত্মহত্যা করিতে থাকে এবং তাহার কোন বহিশত্রু না থাকিলেও সে নিজেই নিজের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করিতে থাকে। পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে যে, বিগত ষাট বৎসর হইতে ফরাসীর জন্মহার ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। কোন বৎসর মৃত্যুহার জন্মহারকে অতিক্রম করে। কোন কোন বৎসর উভয়ই সমান থাকে। আবার কোন সময়ে জন্মহার মৃত্যুহারের তুলনায় অতি কষ্টে হাজারকরা একজনের অনুপাতে বাড়িয়া যায়। অপর দিকে ফরাসী দেশে বিজাতীয় বহিরাগতের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়াই চলিতেছে। ১৯৩১ খৃস্টাব্দে ফরাসী দেশের মোট চারি কোটি আঠার লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে আটাশ লক্ষ নব্বই হাজার বহিরাগত বিজাতীয় ছিল। এই অবস্থা যদি চলিতে থাকে তাহা হইলে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসী জাতি যে স্বীয় মাতৃভূমিতেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হইবে, তাহাতে আশ্চর্যের কিছুই নাই।
ইহাই ঐ সকল মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিণাম ফল, যাহাকে ভিত্তি করিয়া উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালে নারী অধিকারের আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছিল।