সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
ইসলাম কোন একপেশে ব্যবস্থা নয়। যৌন দাবি দাওয়া একটা প্রচন্ড ঝঞ্ঝা বিশেষ। তা কোন্ মুহুর্তে সব ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে, তা আগে থেকে বলে দেয়া যায় না। এই জন্যে ইসলামী শরীয়াত এক্ষেত্রে বিশেষ কিছু জরুরী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার ফলে পাপ ও নাফরমানীর পথ স্বভাবতঃই সঙ্কীর্ণতর হয়ে গেছে। কাজেই সে ব্যবস্থা পালন করে মানুষ যৌন পঙ্কিলতা থেকে সহজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের একটি আয়াত বিশেষভাবে স্মরণীয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ۖ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا [١٧:٣٢]
‘এবং তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও যেওনা। কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জতা ও পাপ-পঙ্কিল ও অত্যন্ত খারাপ পন্থা।’ (বনী ইসরাঈল, ৩২)।
ব্যভিচার পরিহার করে চলার এই নির্দেশটি অতীব জ্ঞানগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ নির্দেশে মানুষের মস্তিষ্কের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ফলে ‘ব্যভিচারের কাছেও যেওনা’ কথাটি শোনামাত্রই এমন সব দিক শ্রোতার মানসপটে ভেসে ওঠে, যার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের কারণে বর্তমান সভ্যতা ব্যভিচারকে অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। বস্তুতঃ কুরআন লোকদেরকে কেবল ব্যভিচার করতেই নিষেধ করে নি কার্যত ব্যভিচার ঘটায়-ঘটতে সহজ করে দেয় যেসব ব্যাপার, তাও পরিহার করে চলার নির্দেশ দিয়েছে। এসব ব্যাপারকে সাধারণত দোষণীয় মনে করা হয় না বটে; কিন্তু একটু চিন্তা করলেই নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যায় যে, সেই ব্যাপারগুলো পরিহার করে চললে ব্যভিচারের মত একটা চরম পাপ কিছুতেই সংঘটিত হতে পারে না। কোন মানুষই হঠাৎ করে বড় ধার্মিক হয়ে যায় না, হঠাৎ করে ধর্মত্যাগীও হয়ে যায় না কেউ। উভয় ক্ষেত্রেই একটা ক্রমিক গতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। প্রতিটি ব্যাপারের পশ্চাতেই থাকে ঘটনা পরম্পরার ধারাবাহিকতা, যার পরিণামে কেউ ধার্মিক হয়ে যায় আবার কেউ ধর্ম ত্যাগ করে চরম নাফরমান হয়ে পড়ে। ব্যভিচারের ব্যাপারটিও তদ্রুপ। তা একেবারে হঠাৎ ঘটে না। তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি ও ক্রমিক আনুকুল্য অবশ্যম্ভাবী। তাই ইসলাম সে পূর্ব প্রস্তুতি ও ক্রমিক আনুকুল্যের পর্বকে মূলোৎপাটিত করতে চায়। অন্যথায় ব্যভিচার অতীব সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে; তা বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভব হবেনা। সে কারণে ধ্বংসের মুখটি বন্ধ করে দেয়া ও সে মুখের পাশ দিয়ে যাতে কেউ পথ না মাড়ায়, তার জন্যে আগে থেকে মানুষকে সতর্ক করে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কুরআনের পূর্বোদ্ধৃত কথাটি এই পর্যায়েরই।
নবী করীম (সা) এর একটি হাদীসের মর্ম হচ্ছেঃ
‘মানুষ নানাভাবে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। চক্ষের ব্যভিচার, চলাচলের ব্যভিচার, মনোবৃত্তির ব্যভিচার এবং কামনা বাসনার ব্যভিচার। সর্বশেষে যৌন অঙ্গ তাকে সত্যে পরিণত করে কিংবা মিথ্যা করে দেয়।–আবু দাউদ।
তার অর্থ, মূল ব্যভিচার কাজের পূর্বে এসবের মাধ্যমে তার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। কাজেই ইসলাম ব্যভিচারকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব পূর্বাহ্নিক কার্যক্রমকেও ব্যভিচার পর্যায়ের কাজ বলে ঘোষণা করেছে এবং এসকেও হারাম করে দিয়েছে।
দৃষ্টি নত রাখার নির্দেশ
এই পর্যায়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে দৃষ্টি নত রাখার নির্দেশ। চোখে কাউকে ভাল লাগলে তার প্রতি যৌন আকর্ষণ তীব্র হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক।
এই কারণে কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছেঃ
قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ [٢٤:٣٠] وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَفُرُوجَهُنَّ
‘হে নবী! মুমিন লোকদের বলে দাও, তারা যেন নিজেদের চক্ষুকে নত রাখে। তা করে তারা যেন নিজেদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে। তাদের চরিত্রকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখার জন্য এই ব্যবস্থা অতীব কার্যকর। তারা যা কিছু করে, সে বিষয়ে আল্লাহ পূর্ণ অবহিত। আর ঈমানদার মহিলাদেরও বলে দাও, তারা যেন নিজেদের চক্ষুকে নত রাখে ও নিজেদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে।’- (সূরা নূর ৩০-৩১)।
আয়াতের বাচন ভঙ্গি হতে স্পষ্ট বোঝা যায়, নারী ও পুরুষ উভয়েরই গায়র মুহাররাম স্ত্রী পুরুষদের প্রতি চোখ তুলে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে এজন্যে যে, তা না করলে তাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। লজ্জাস্থানের পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এই দেখা বা দৃষ্টিপাত। নবী করীম (সা) এর একটি হাদীসে এ আয়াতের নির্দেশটির সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। হযরত আলী (রা) কে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেনঃ
আরবী (**********)
‘হে আলী! তুমি একবার তাকিয়ে দ্বিতীয়বার তাকাবে না। তোমার প্রথম দৃষ্টিপাত ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু দ্বিতীয়বার নয়।’- আবু দাউদ।
অর্থাৎ প্রথম দৃষ্টিপাত আকস্মিক, অনিচ্ছামূলক। কিন্তু তারপর আবার চোখ তুলে তাকানোর অর্থ হলো, বিপরীত লিঙ্গ তার মনকে আকৃষ্ট করছে। তাই একবার যদি চোখ পড়েই যায়, তাহলে দ্বিতীয়বার আর না তাকাতে ও চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
গান-বাজনা শ্রবণ নিষিদ্ধ
চোখের দৃষ্টি যেমন মানুষকে বিপরীত লিঙ্গের দিকে আকৃষ্ট করে, তেমনি করে গানের সুর। মধুর কণ্ঠস্বর মানুষকে মোহাবিষ্ট করে; ফলে ন্যয়- অন্যায় ও ভাল মন্দের পার্থক্যবোধ সে হারিয়ে ফেলে। এই কারণে ইসলামে গান বাজনার কোন স্থান নেই। বিশেষ করে সুন্দরী যুবতীর সুমিষ্ট কণ্ঠের গান পুরুষদের জন্যে এবং অনুরূপ পুরুষ কণ্ঠের গান মেয়েদের জন্য খুবই মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। বস্তুতঃ গান বাজনা যে মানুষের মধ্যে যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি করে, অনস্বীকার্য। এই কারণে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেনঃ
আরবী (*********)
‘এই জন্যই বলা হয়েছে, গান মানুষকে ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে গান ও ব্যভিচারের মধ্যে এক প্রকারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তা এভাবে যে, গান মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে আর ব্যভিচার মানুষের কুপ্রবৃত্তি বা দৈহিক দাবিকে চরিতার্থ করে। আর এ কারণেই হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘গান মানুষকে ব্যভিচারের জন্য যাদুর ন্যায় প্ররোচিত করে।’- আল্লামা ইবনুল জাওযী।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে নারী
পূর্বোক্ত আলোচনার দৃষ্টিতে একথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে, বর্তমান সময়ে প্রচলিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান নরনারী বিশেষ করে যুবতী নারী সমাজের জন্য খুবই মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টির কারণ হতে পারে। সুস্থ ও অনাবিল দৃষ্টিতে দেখলেই স্পষ্টভাবে দেখা যাবে যে, সংস্কৃতির সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা করে এখনকার যুবক যুবতীদের এক সাংঘাতিক গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে নেয়া হচ্ছে। বস্তুতঃ ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহার করে মানুষের মনে এক প্রকারের মোহমুগ্ধতা ও আবিলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ শব্দটি শ্রুতিগোচর হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুসজ্জিত, বর্ণাঢ্য ও আলোকমন্ডিত সুউচ্চ মঞ্চে আকর্ষণীয় সাজে সজ্জিত যৌন চেতনা উদ্দীপক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রদর্শনকারী সুন্দর সুশ্রী যুবক যুবতীর যুগ্ম ও একক নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান। এ সব অনুষ্ঠান শুধু যুবক যুবতীদের অবাধ মেলা মেশারই শুধু সুযোগ করে দেয় না, সমস্ত দর্শকবৃন্দকেও যৌন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে প্রবলভাবে সাহায্য করে। কোন ঈমানদার নারীর পক্ষে এধরনের অনুষ্ঠানে নর্তকী বা গায়িকা হিসেবে অংশগ্রহণ করাতো দূরের কথা, দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার কথাও কল্পনা করা যায় না। কেননা সংস্কৃতি তো মানুষের মন ও মগজকে পরিশুদ্ধ করে আর চরিত্রকে করে পবিত্র ও নিষ্কলুষ। নাটক ও ছায়াছবির প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি এর চেয়েও শতগুণ বেশি মারাত্মক। অবিবাহিত যুবতী কন্যাকে তাতে ভিন পুরুষের প্রেমিকা বা স্ত্রী সেজে তদুপযোগী রসালো কথোপকথন ও আচার আচরণ করতে হয়। ফলে এ দুয়ের মাঝে কলুষতার আবর্ত সৃষ্টি কে রোধ করতে পারে? এর ফলে নৈতিকতার চেতনা ও চরিত্রের বাঁধন যে সম্পূর্ণ শিথিল হয়ে যায় এবং পরস্পর অবাধ ও অবৈধ যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয় তা কি খুব যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বোঝাতে হবে?
মুসলিম নারীর যে মর্যাদা ও দায়িত্ব মহান সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তাতে উপরোক্ত ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি তথা থিয়েটার ও ছায়াছবিতে নায়িকা সাজার কোন অবকাশই থাকতে পারে না। এসবের মাধ্যমে নারী জাতির চরম অপমানই করা হচেছ। নারীর রূপ, কণ্ঠমাধূর্য ও যৌবনদীপ্ত দেহচ্ছটা খোলা বাজারে অতি সামান্য মূল্যে যার তার হাতে সাধারণ ও গুরুত্বহীন পণ্য দ্রব্যের ন্যায় বিক্রী করা হচ্ছে। আমাদের নারী সমাজের কি আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছুই নেই? এই পর্যায়ে পবিত্র কুরআনের এ কথাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়ঃ
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ [٢٤:١٩]
‘যারা ঈমানদার লোকদের মধ্যে নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা, এবং জঘন্য কামুকতা ও যৌনতার ব্যাপক প্রচার ও বিস্তৃতি পছন্দ করবে ও ভালবাসবে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে পীড়াদায়ক আযাব নির্দিষ্ট হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে কোনটা নির্লজ্জতা তা তোমরা জান না, আল্লাহই জানেন। ’- (সূরা নূর, ১৯)।
পোশাকের গুরুত্ব
নগ্নতা ও উলঙ্গতা একালের একটা অতিবড় ফিতনা। তা মানুষের মনে কামনা বাসনার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। নারীদেহের নগ্নতা যে মানুষকে যৌনতার দিকে কতটা বেশী আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ইসলাম নগ্নতা ও উলঙ্গতার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। নারী ও পুরুষের সতর (অবশ্যই আবৃত্ত করে রাখার স্থানসমূহ) নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং কোন অবস্থায়ই যেন তা অনাবৃত না হয়, সেজন্যে প্রবলভাবে তাকীদ করেছে। ইসলাম এমন পোশাক পরিধান করতেও নিষেধ করেছে, যা লজ্জাস্থানসমূহ আবৃত করার পরিবর্তে আরও অধিক উলঙ্গ ও অধিক আকর্ষণীয় করে তোলে।
গায়র মুহাররাম নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা
নারী পুরুষের চারিত্রিক পবিত্রতার রক্ষার জন্য ইসলাম গায়র মুহাররাম নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও যত্রতত্র বা যখন তখন দেখা সাক্ষাতকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে নীরবে নিভৃতে এই মেলামেশা ও দেখা সাক্ষাত সহজেই তাদেরকে চরিত্রহীনতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত করতে পারে। তাই নবী করীম (সা) কঠোর ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেনঃ
আরবী (*********)
‘যে সব নারীর নিকট তাদের মুহাররাম পুরুষ উপস্থিত নেই, তাদের নিকটেও যাবে না। কেননা শয়তান মানুষের মধ্যে রক্তের ধারার মতই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।
মোটকথা, ব্যক্তিচরিত্র সংরক্ষণ ও তা সুষ্ঠুরূপে গড়ে তোলার জন্য ইসলাম যে বিধি-বিধান ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তা পালন করা ঈমানদার নারী ও পুরুষের অবশ্য কর্তব্য।
সামাজিক সংস্কার ব্যবস্থা
ব্যক্তিদের সমন্বয়েই সমাজ গঠিত হয়। সমাজকে কোন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন ব্যক্তিদেরকে সেই আদর্শে বিশ্বাসী ও তাতে উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত করে তোলা। এই কারণে ইসলাম তার আদর্শানুযায়ী সমাজ গড়ার জন্য ব্যক্তি গঠনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করছে। কিন্তু নিছক ব্যক্তি গঠন কখনই আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ব্যক্তি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ গঠনের উপর ইসলাম সমান গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রতিটি সমাজেরই একটা নিজস্ব সামষ্টিক আদর্শ থাকে এবং সমাজ অবশ্যই চায় তার ব্যক্তিদের সেই আদর্শের বাস্তব প্রতিমূর্তি রূপে গড়ে তুলতে। ইসলামী সমাজও তার ব্যক্তিদের ইসলামী আদর্শানুযায়ী গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট কথা বলা হয়েছে। নিম্নোদ্ধৃত আয়াত এ পর্যায়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণঃ
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ ۙ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٦٠:١٢]
‘হে নবী! ঈমানদার মেয়েলোকেরা তোমার নিকট এই বিষয়ে বায়আত করার জন্য যদি আসে যে, তারা আল্লাহর পথে একবিন্দু শিরক করবে না, তারা চুরি করবে না-ব্যভিচার করবে না-তাদের সন্তানদের হত্যা করবে না (গর্ভপাত বা গর্ভসঞ্চার বন্ধ করবে না) সামনা সামনি কারুর উপর মিথ্যা দোষারোপ করবে না এবং ন্যায়সঙ্গত কাজে তোমার নাফরমানী করবে না, তাহলে তুমি তাদের এই বায়আত গ্রহণ কর। আর তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও। কেননা আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, দয়াবান।’ (সূরা মুমতাহিনা, ১২)।
ইসলাম এমন চিন্তা বিশ্বাস ও মতাদর্শ পেশ করে, যা মানুষের উপর সর্বাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তাকে প্রতি মুহুর্তে নিয়ন্ত্রিত করে। যে লোক এই চিন্তা বিশ্বাসকে স্বীয় মন মগজ দিয়ে গ্রহণ করে, সে কি গোপনে কি প্রকাশ্যে, দিনে বা রাতে, লোকদের সম্মুখে বা নিতান্ত নিভৃতে ও একাকীত্বে-কখনই পাপকার্যের প্রতি পা বাড়াতে সাহসী হয় না। কেননা তার মনে প্রতি মুহুর্তে এই ভয় জাগরুক থাকে যে, কেউ না দেখতে পেলেও এবং পুলিশের হাতে ধরা না পড়লেও এমন এক মহান সত্তা তা অবশ্যই দেখতে পাচ্ছেন, যার নিকট বিন্দু পরিমাণ ব্যাপারও গোপন নেই এবং যিনি এজন্য কঠিন শাস্তি দিবেন।
নৈতিকতার মূল্য ও গুরুত্ব
বস্তুত যে সমাজের ভিত্তিই হবে এ্ই মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান, সে সমাজ যে পবিত্র সমাজ হবে এবং তাতে নৈতিক চরিত্রে মূল্য ও মর্যাদা যে অনেক বেশি ও সবচাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে, তাতে কোনরূপ সন্দেহ থাকতে পারে না। এহেন সমাজে নৈতিকতা কেবল একটা মৌখিক ওয়াজ নসীহতের ব্যাপার হয়েই থাকবে না, তাতে আেইন ও রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা অনিবার্য হয়ে দেখা দিবে। প্রতিটি ব্যক্তিই এসব নৈতিক সৌন্দর্য্ ও বৈশিষ্ট্যকে স্বীয় মান মর্যাদার অমূল্য সম্পদ বলে মনে করবে। সমাজে সকলের নিকট সম্মানিত ও মর্যাদার অমূল্য সম্পদ বলে মনে করবে। সমাজে সকলের নিকট সম্মানিত ও মর্যাদাবান হয়ে থাকার জন্য নিজের জান প্রাণ ও ধন মালের মতই সে সবের সংরক্ষণ করবে। কেউ যদি তাকে চরিত্রহীনতার পথে টেনে নিয়ে যেতে চায়, তবে সে পূর্ণশক্তিতে তার প্রতিরোধ করবে। এবং সে জন্য যদি এই অপচেষ্টাকারীকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায়ই না থাকে, তাহলে সে তাও করতে দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু কোন অবস্থায়ই সে তার নৈতিক মূল্যমানকে ধ্বংস হতে দিবে না।
পাশ্চাত্য সভ্যতায় নৈতিক চরিত্রের আদৌ কোন গুরুত্ব স্বীকৃত নয়। এই কারণে যে যত বড় চরিত্রহীন, সে ততই বড় মর্যাদার অধিকারী। ফলে সে সভ্যতায় চরিত্রহীনতার প্রেরণাই লাভ করে প্রতিটি ব্যক্তি। কিন্তু ইসলাম এমন সমাজ গঠন করে যেখানে চরিত্রহীন ব্যক্তি কোন সম্মানই পাবে না। বরং সেখানে সেই ব্যক্তি তত বেশি ঘৃণ্য ও লাঞ্ছিত, যার চরিত্র যত হীন ও পন্কিল।ইসলামী সমাজের পরিবারসমূহের কর্তব্য কেবল এটুকুই নয় যে তা পরিবারের সব লোকের শুধু খাওয়া পরা থাকারই ব্যবস্থা করবে, বরং সেই সঙ্গে সকলের চরিত্র রক্ষার-কেউ চরিত্রহীনতার দিকে এগুতে চাইলে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে চরিত্রবান রাখার জন্য চেষ্টা করাও ঐকান্তিক কর্তব্য। এই কারণে ছেলে বা মেয়ে-বিয়ের বয়স হলেই তার বিয়ের ব্যবস্থা করা কর্তব্য বলে ঘোষিত হয়েছে। এখানে কোন বিবাহক্ষম নারী বা পুরুষের পক্ষে কুমার বা কুমারী হয়ে থাকার একবিন্দু অবকাশ নেই। কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছেঃ
وَأَنكِحُوا الْأَيَامَىٰ مِنكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ ۚ
‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর-চরিত্রবান দাস দাসীদেরও।’ (সূরা নূর-৩২)।
অন্য কথায়, ইসলামে নারী বা পুরুষ কারুরই অবিবাহিত থেকে জীবন যাপন সম্ভব নয়। যদি কারুর পক্ষে বিয়ে করা নিজ হতে সম্ভব না হয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা করার জন্য দায়ী হবে। কেননা নবী করীম (সা) ইসলামী সমাজের নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই বলেছেনঃ
আরবী (***********)
‘যার কোন অভিভাবক নেই, রাষ্ট্র সরকারই তার অভিভাবক।’-তিরমিযী।
চারজন স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি
বয়সের একটা পর্যায় পর্যন্ত পুরুষের মধ্যে যৌনশক্তি ও আবেগ পূর্ণমাত্রায় থাকে। কিন্তু স্ত্রী লোক স্বভাবতই বারবার এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়, যার দরুণ তার এই যৌন আবেগ নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। এই কারণে অনেক স্ত্রীই বেশি দিন স্বামীর যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সামর্থ্য রাখে না। আবার অনেক স্ত্রী নানা কারণে সন্তান ধারণ করতে পারেন। এই সব কারণে ইসলামী সমাজে পুরুষকে একই সময় একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু তাও সীমাহীন বা নিঃশর্ত নয়। একই সময়ে মাত্র চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি রয়েছে, তার অধিক নয়। পুরুষের যৌন প্রয়োজন পূরণ এবং তার সন্তান লাভের জন্য ব্যক্তি বিশেষে এই অনুমতির গুরুত্ব কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। তবে যে পুরুষই একই সময়ে একাধিক স্ত্রী্র স্বামী হবে, স্ত্রীগণের মধ্যে সর্ববিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতা ও সুষ্ঠু সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা তার অবশ্য কর্তব্য বলে নির্দিষ্ট হয়েছে।
কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছেঃ
فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً
‘অতএব তোমরা পুরুষরা পছন্দমত দুই তিন চার-যে কজন স্ত্রী গ্রহণ ইচ্ছা তা করবে। আর যদি স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না বলে ভয় কর, তাহলে মাত্র একজন স্ত্রী গ্রহণ করবে।’ –সূরা নিসা, আয়াত ৩।
অর্থাৎ একসাথে একাধিক স্ত্রী (চারজন পর্য্ন্ত ) গ্রহণের অনুমতি এই শর্তে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের মধ্যে পূর্ণ সাম্য ও সুবিচার নিশি।চত করতে হবে। তা করতে পারবে না বলে ভয় বা আশঙ্কা হলে একজনই বিধেয়, একাধিক নয়।
স্ত্রী লোকদের পূর্ণবার বিয়ে করার অনুমতি
দৈহিক সামর্থ্য ও যৌন কামনা স্পৃহার দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। পুরুষের সন্তান ধারনের দিক দিয়েও স্ত্রীলোকের সীমাবদ্ধতা সর্বজনবিদিত। এই কারণে পুরুষের জন্য একই সময়ে একাধিক স্ত্রী রাখার অধিকার দেয়া হলেও একজন স্ত্রীকে একই সময়ে একাধিক স্বামী গ্রহণের অধিকার দেয়া হয় নি। কিন্তু কোন স্ত্রীলোক যদি কোন কারণে (তালাক বা মৃত্যু) স্বামীহীনা হয়ে পড়ে, তবে তাকে দ্বিতীয়বার স্বামী গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বামীহীনা স্ত্রীর পুনর্বার বিবাহিতা হওয়ার উপর বিশেষ তাকীদ ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলামী সমাজে এই বিবাহ খুবই উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে সম্পন্ন হয়ে থাকে-যেন যৌন চেতনাসম্পন্ন কোন নারীই তার স্বাভাবিক স্পৃহার চরিতার্থতা থেকে বঞ্চিত না থাকে।