নারীদের কর্মক্ষমতা
এ পর্যন্তকার আলোচনা হতে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, শরীয়াতের দৃষ্টিতে জীবনের সমস্যাবলী দুই ধরনের। এমন অনেক ব্যাপারই রয়েছে, যাতে নারীদের বিচার বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা চলে। পক্ষান্তরে অনেক ব্যাপার এমনও রয়েছে, যাতে নারীদের বিবেচনা শক্তি বা স্মরণ শক্তি ভুল করে বসতে পারে, তার আশঙ্কা পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। বাস্তব কর্মক্ষেত্রে ও শরীয়াত এই নীতিই গ্রহণ করেছে। শরীয়াত একদিকে নেতৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন হতে নারীদের অব্যাহতি দিয়েছে। কেননা প্রকৃতপক্ষে সমাজ সমষ্টির নেতৃত্বের জন্য যে বিশেষ গুণাবলী ও যোগ্যতা কর্মক্ষমতা একান্তই অপরিহার্য, তা নারীদের জন্য অনুপস্থিত। অপর দিকে রাসূলে করীম (সা) বলিষ্ঠ কন্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ
আরবী (*********)
‘নারী তার স্বামীর ঘরের লোকদের ও তার সন্তানদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সে তাদের প্রতি কর্তব্য কতটা পালন করেছে, তাদের অধিকার কতটা আদায় করেছে, সে বিষয়ে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’
কিন্তু নারীকে শুধু ঘরের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির জন্য দায়িত্বশীল বানানো হল কেন? হাফেজ ইবনুল হাজার এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ
আরবী (********)
‘কেবলমাত্র ঘরের ভিতরে নারীদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কেননা ঘরের অভ্যন্তর ছাড়া অন্য কোন স্থানে তাদের নির্বাধে পৌছা সম্ভব নয়। তবে বিশেষ অনুমতি বা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোন সুযোগ লাভ করলে সে কথা স্বতন্ত্র।’
অর্থাৎ মেয়েদের আসল স্থান ও অবস্থান কেন্দ্র তাদের ঘর। ঘরের সমস্যাবলী নিয়েই তাদের দিন রাত ব্যস্ত থাকতে হয়। এ কারণে ঘরের বাইরে কোন কিছুর জন্য তাদের দায়িত্বশীল বানানোর প্রশ্নই উঠে না কোন এবং তা নিতান্তই তাৎপর্যহীন।
এক্ষণে দেখতে হবে, ঘরের মধ্যেই স্ত্রীলোকদের সংরক্ষণ, পরিচালন ও দায়িত্ব পালনের প্রকৃত তাৎপর্য কি?
এর তাৎপর্য্ এই যে, ঘরের আভ্যন্তরীণ যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও কার্য্ সম্পাদনের দায়িত্ব নারীর। ঘরের লোকেরা তার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাধীন। তাদের সকলের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা তারই কর্তব্য। শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী তাদের নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত করা, ঘরের পরিবেশ শরীয়াতের আলোকে গড়ে তোলা এবং ঘরোয়া অনুষ্ঠানাদি শরীয়াত মোতাবিক পালন করা তারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। তদ্রুপ অন্যায় আচার আচরণ ও অনুষ্ঠানাদি থেকে তাদের বিরত রাখা, ভাল-মন্দ ও লাভ-লোকসান সম্পর্কে তাদের অবহিত করা-ঠিক যেমন রাখাল তার পরিচালিত প্রাণীগুলোর দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে-নারীর একান্ত কর্তব্য। এখানই নারীর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। স্বামী ঘরের খরচাদি চালাবার ও পারিবারিক কাজকর্ম আঞ্জাম দেয়ার জন্য যে অর্থ সম্পদ তার হাতে তুলে দেয়, তার যথাযথ ব্যয় ব্যবহার করাও তারই কর্তব্য। কারণ সে-ই তার সংরক্ষক ও আমানতদার। তাই সদাচারী স্ত্রীর গুণ বর্ণনা পর্যায়ে রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (*********)
‘স্বামী যদি স্ত্রীর নিকট থেকে বাইরে বা দূরে চলে যায়, তাহলে সেই নিজের পবিত্রতা এবং তার (স্বামীর) ধন-মালের ব্যাপারে কল্যাণকামী হবে।’
ঘরের আভ্যন্তরীণ দায়িত্ব কর্তব্যও স্ত্রীরই অধিকারে সঁপে দেওয়া হয়েছে। রাসূলে করীম (সা) হযরত ফাতিমা (রা) ও হযরত আলী (রা) এর মধ্যে পারিবারিক ও গার্হস্থ্য কাজ কর্মকে স্পষ্টতঃ ভাগ করে দিয়েছিলেন। হযরত ফাতিমা (রা) কে দায়িত্বশীল বানিয়েছিলেন ঘরের আভ্যন্তরীণ যাবতীয় কাজ কর্মের এবং হযরত আলী (রা) এর উপর অর্পিত ছিল বাইরের সব কাজের দায়িত্ব। -যা’দুল মায়াদ।
ইসলামে স্ত্রীকে ঘরের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি। এই দায়্তিব ও কর্তব্য নিজের বিবেক বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা অনুযায়ী সুষ্ঠু রূপে সম্পন্ন করার জন্য যে স্বাধীনতা অপরিহার্য, ইসলাম তাও তাকে দিয়েছে পুরোপুরিভাবে। এমন কি, ঘরের কাজকর্ম সম্পাদন, বিশেষভাবে সন্তান লালন পালন পর্যায়ের প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বামীর অজ্ঞাতসারেই যদি তার ধন সম্পদ ব্যয় করতে হয়, তবু তা করার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে। একটা বিশেষ সীমা পর্যন্ত স্বামীর ধন সম্পদ থেকে দান খয়রাত করারও অধিকার রয়েছে স্ত্রীর।–বুখারী।
বস্তুতঃ পারিবারিক জীবনে নারীর যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতার ওপর ইসলাম বিরাট আস্থা ও নির্ভরতা পোষণ করে। তার বড় প্রমাণ এই যে, সন্তানরা পূর্ণ বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাদের লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনে ইসলাম পুরুষদের তুলনায় স্ত্রীলোকদেরকেই অধিক উপযুক্ত বলে মনে করেছে। বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তানদের লালন পালনের অধিকার নিয়ে পিতা মাতার মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হলে পিতার পরিবর্তে মায়ের ওপরই এই দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে খোদ রাসূলে করীম (স) এর বিচারে। ইতিহাসে বা হাদীসে এ ধরনের অনেক ঘটনারই উল্লেখ রয়েছে। তার কারণ স্বরূপ ফিকাহবিদগণ বলেছেনঃ
আরবী (***********)
‘সন্তান পালনের সর্বাধিক অধিকার স্ত্রীদের। কেননা তারা পুরুষদের তুলনায় দয়ার্দ্র হৃদয়, কোমলমতি ও অনুগ্রহশীল হয়ে থাকে। ছোট ছোট শিশুদের লালন পালন ও প্রশিক্ষণের যোগ্যতা ও উদ্যম প্রেরণা তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বেশি।
মহিলাদের স্বতন্ত্র সংগঠন
শিশু সন্তানের লালন পালনের ব্যাপারে নারীদের যোগ্যতা যখন পুরুষের তুলনায় বেশি এবং এ কারণে পুরুষদের ওপর তাদের অগ্রাধিকারও দেয়া হয়েছে, তখন সমাজের যেসব ক্ষেত্রে তাদের সেবামূলক কর্মক্ষমতা অধিক অবদান রাখতে সক্ষম এবং যে সব ক্ষেত্রে এই নারীসূলভ সেবা শুশ্রুষামূলক কার্যাবালী অপরিহার্য বিবেচিত হবে, সেই সব ক্ষেত্রে তাদেরকেই অগ্রসর করা হবে, এ-ই তো স্বাভাবিক। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, এই উদ্দেশ্যে তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সামষিটক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানোর অনুমতি তাদের জন্য থাকতে হবে। ইসলামী শরীয়াত এজন্য কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। এই কারণে নবী করীম (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে মহিলাদের কোন স্বতন্ত্র সংগঠন ছিল কিনা, এ প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর। কেননা সামাজিক সংগঠন সংস্থা গড়বার কারণ থাকলেই তা গড়ে ওঠে। সেকালে এ ধরনের কোন হয়ত দেখা দেয়নি বলেই তা হয় নি। শুধু নারীদের সংগঠনই নয়, একালের মত কোন প্রকার সামাজিক সংগঠন সংস্থা তখন আদৌ ছিল কিনা, তাও অনুসন্ধান সাপেক্ষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য্ , বিভিন্ন দ্বীনি ও সামাজিক প্রয়োজনে স্ত্রীলোকেরা সমবেত হয়েছেন। অনেক সময় তাঁরা মিলিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেছেন এবং নিজেদের ধ্যান ধারণা ও বাস্তব সমস্যাগুলো রাসূলে করীম (সা) এর সমীপে পেশ করেছেন। তিনিও সেসব বিষয়ের সমাধান তাদের বলে দিয়েছেন। এইসব ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে যে, বহুসংখ্যক মহিলা একত্রিত হয়ে সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে রাসূলে করীম (সা) এর সমীপে উপস্থিত হলেও তাঁরা সকলেই একসঙ্গে কথা বলেন নি; নিজেদের মধ্য হতে একজনকে নেত্রী পদে বাছাই করে তার মাধ্যমেই কথা বলেছেন। সেই মহিলা নেত্রী যা কিছু বলেছেন, তাতে তিনি নিশ্চয়ই সকলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যেমন বর্তমানের কোন সংগঠন-সংস্থার নেতা সাধারণত করে থাকেন। এক বারের ঘটনায় হযরত জায়েদ (রা) এর কন্যা হযরত আসমা (রা) নেত্রী হিসেবে রাসূলে করীম (সা) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ
আরবী (***********)
‘আমার পশ্চাতে মুসলিম মহিলাদের যে দল রয়েছে, আমি তাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হয়েছি। তাঁদের সকলেই আমার কথা বলেছেন এবং আমি যে মত পোষণ করি, তাঁরাও সেই মতই পোষণ করেন।’
দ্বীন ইসলামের নীতি ও আদর্শের দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে, মহিলাদের স্বতন্ত্র সংগঠন-সংস্থা গড়ে তোলা কিছুমাত্র অন্যায় নয়। নারীরা পুরুষের থেকে আলাদাভাবে জামা‘আতের সাথে নামায পড়তে পারে। উম্মে আরাক্বা নাম্নী মহিলা সাহাবীকে নবী করীম (স) নিজেই নির্দেশ দিয়েছিলেন ঘরের লোকদের নিয়ে একত্রে নামায পড়তে ও তাতে ইমামতি করতে। নবী করীম (স) এর পরে মহিলা সাহাবীগণ এই রীতিকে চালু রেখেছিলেন। তাঁরা ফরয ও নফল সর্বপ্রকার নামাযই জামা‘আতের সাথে পড়েছেন এবং তাতে তাঁরাই ইমামতি করেছেন। রীতা হানফীয়া নাম্নী তাবেয়ী মহিলা বর্ণনা করেছেনঃ
আরবী (**********)
হযরত আয়েশা (রা) আমাদের মহিলাদের ইমামতি করেছিলেন ফরয নামাযে। অবশ্য তিনি মহিলাদের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিলেন। (পুরুষের ন্যায় কাতারের সম্মুখে দাঁড়ান নি)।
তাইমা বিনতে সালমা বলেছেনঃ হযরত আয়েশা (রা) মাগরিবের ফরয নামাযের ইমামতি করেছেন। তিনি মহিলাদের সঙ্গে কাতারে দাঁড়িয়েছেন এবং উচ্চস্বরে কেরাআত পাঠ করেছেন। -আল মুহাল্লা, ইবনে হাজম।
‘মুস্তাদরাকে –হাকেম’ হাদীস গ্রন্থে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছেঃ
আরবী (**********)
‘হযরত আয়েশা (রা) নামাযের আযান দিতেন, ইকামত বলতেন, মহিলাদের ইমামতি করতেন এবং তিনি তাদের মাঝখানে দাঁড়াতেন।’
বস্তুতঃ মেয়েদের আলাদা জামা‘আতে নামায পড়া ও তাতে একজন মহিলার ইমামতি করা সম্পূর্ণ জায়েয। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এই মত প্রকাশ করেছেন।
জামা‘আতের সাথে নামায মুসলিম উম্মতের সংগঠন-সংস্থার একটা ক্ষুদ্র নমুনা। এই কারণে নামাযের ইমামতিকে ‘ক্ষুদ্র পরিসর নেতৃত্ব’ বলা হয়। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, মহিলাদের ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, ও শিক্ষা সংস্কৃতি বিষয়ক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলা শুধু যে জায়েয তাই নয়, একান্ত জরুরীও। এইসব সংগঠন সংস্থাকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সামষ্টিক পর্যায়ের কার্যাবলী সমাধান করার পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা দেয়া যেতে পারে। এসব সংগঠন সংস্থা মেয়েদের শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজ সুসম্পন্ন করবে। মহিলাদের নিজেদের মামলা মোকদ্দমার মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে নিজস্ব আদালত গঠন করা এবং বিচারক ও আইন প্রয়োগ পর্যায়ের অধিকারও তারা ভোগ করতে পারেন কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা ব্যতীতই।
নারী ও নেত্রীপদ
এই পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ইসলাম নারীকে জাতীয় নেতৃত্ব ও পথ প্রদর্শক হওয়ার মত কোন পদের দায়িত্ব অর্পণ করে না। এটা এজন্যে নয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী পুরুষের তুলনায় হীন বা দীন। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে, জাতীয় নেতৃত্ব দানের জন্য যেসব যোগ্যতা একান্তই জরুরী, তা নারীদের মধ্যে স্বভাবতঃই নেই। আর ইসলাম যেহেতু যার মধ্যে যে কাজের যোগ্যতা নেই, তাকে সেই কাজের দায়িত্ব দেয় না। এ কারণেই জাতীয় নেত্রী পদের দায়িত্ব কেবলমাত্র পুরুষের উপরই ন্যস্ত করতে ইচ্ছুক, নারীদের উপর নয়। যেসব ক্ষেত্রে কাজ করার যোগ্যতা নারীদের দেয়া হয় নি, সেসব ক্ষেত্রে তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ নিতান্তই অযৌক্তিক কাজ হবে। আর এই অযৌক্তিক কাজ করা হলে জাতীয় জীবনে বিপর্যয়, অচলাবস্থা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া ছাড়া তার আর কোন পরিণতি হতে পারে না। এ কারণেই নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (*******)
‘পুরুষরা যখন নারীদের আনুগত্য শুরু করে, তখন তার পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছু হয় না’।
আরও অধিক সুস্পষ্ট ভাষায় রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ
আরবী (********)
‘যে জাতি তাদের জাতীয় ও সামষ্টিক বিষয়াদি সমর্পণ করে তাদের নারীদের ওপর, সে জাতি কখনও কল্যাণ লাভ করতে পারে না’।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
‘এই হাদীস হতে জানা গেল যে, নারী জাতীয় নেতৃত্ব ও সরকারী দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয়। নারীকে কোন জাতির নেত্রী বানানো জায়েয নয়। কেননা অকল্যাণ ও ক্ষতি হয় যে কাজে, তা অবশ্যই পরিহার্য।’-নাইলুল আওতার।
ইসলামে এ ব্যাপারে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই। কোন মুসলমানই এ বিষয়ে কোন ভিন্নমত গ্রহণ করতে পারে না। আল্লামা ইবনে হাজাম এই পর্যায়ের যাবতীয় হাদীসের ভিত্তিতে বলেছেনঃ
‘মুসলমানদের মধ্যে যত দল উপদলই থাকুক না কেন, তাদের কেউই নারী নেতৃত্বের যথার্থতা্য় বিশ্বাসী নয়।’
বস্তুতঃ নারীদের স্বাভাবিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাই জাতীয় নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার এবং এই পদের জন্য অনুপযোগী বিবেচিত হওয়ার আসল কারণ। ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের নেতা হওয়ার যোগ্য েএমন ব্যক্তি, দ্বীন ইসলামের মৌলিক এবং খুঁটিনাটি বিষয়ে যার ইজতিহাদী যোগ্যতা ও প্রতিভা রয়েছে, এবং যিনি সমস্ত জাতীয় ও সামষ্টিক বিষয়াদি সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার বিবেচনা, যুদ্ধ ও সন্ধি সংক্রান্ত জটিল বিষয়াদিতে বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি প্রয়োগ এবং অতীব বীরত্ব ও সাহসিকতা সহকারে সম্মুখবর্তী যাবতীয় সমস্যার মুকাবিলা করার যোগ্যতার অধিকারী। আর এই পর্যায়ের জরুরী ও অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলী যে আল্লাহ তা‘আলা কেবলমাত্র পুরুষদেরই দিয়েছেন-নারীদের দেননি, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। তবে এই যোগ্যতা নির্বিশেষে সব পুরুষের মধ্যেই রয়েছে, এমন কথা ইসলাম কখনও বলে নি।
জাতীয় নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কার্যকরভাবে চালাবার জন্য যে সব স্থানে গতিবিধি ও যাতায়াত জরুরী, সেসব স্থানে নারীর যাতায়াতই ইসলামে নিষিদ্ধ। যদি কেউ মনে করেন, নারীর মধ্যে স্বতঃই এই যোগ্যতা না থাকলে ও তাকে এই পদে অভিষিক্ত করা হলে সে অনায়াসেই যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষদের সহযোগিতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলে তার সে ধারণা যে নিতান্তই অবিবেচনাপ্রসূত, একটু সূক্ষ্মভাবে বিচার করলেই তা বোঝা যাবে। বস্তুতঃ যার নিজের মধ্যে কোন কাজের মৌল যোগ্যতা নেই, সে অন্য লোকদের দ্বারা সেই কাজ যথার্থভাবে সুসম্পন্নও করাতে পারে না। কেননা যাদের দ্বারা এই কাজ সমাধা করানো হবে, মূল দায়িত্ব তাদের নয় বলে তারা দায়িত্বানুভূতি সহকারে সে কাজ করবে না। তার কর্তব্যনিষ্ঠা সহকারে যে কাজ করা হয় না, তা যথার্থভাবে সুসম্পন্নও হতে পারে না। উপরন্তু অন্য যোগ্য কর্মীদের দ্বারা সে কাজ করানো হলে কার্যতঃ সে কাজের দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তানো বাঞ্ছনীয়। অযথা একজন নারীকে শিখন্ডীরূপে দাঁড় করিয়ে কোন সুফল বা কল্যাণ লাভের আশা করা একান্তই হাস্যকর।
দুনিয়ার যে সব দেশে নারী নেতৃত্ব ও নারীর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব দেশ ও জাতি যে কিছুমাত্র কল্যাণ লাভ করতে পারে নি; বরং চরম বিপর্যয়ের মধ্যে হাবুডুবু খেয়েছে, তা দুনিয়ার এ ধরনের যে কোন দেশ ও জাতির ইতিহাসই অকাট্যভাবে প্রমাণ করবে। আমাদের নিকটবর্তী দু’-একটি দেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।
এখানে স্মর্তব্য, নারীর মধ্যে জাতীয় নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের যোগ্যতা না থাকলেও তারা যে কোন রকমেরই সামষ্টিক কাজের যোগ্য নয়, ইসলাম কিন্তু একথা কখনও বলে নি। নারীদের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রের বাইরে এমন বহু সামাজিক ও সামষ্টিক কাজ রয়েছে, যে সবের দায়িত্ব নারীদের ওপর সহজেই অর্পণ করা যেতে পারে। আল্লামা ইবনুল হুম্মাম লিখেছেনঃ শরীয়াতে শুধু এতটুকুই বলা হয়েছে যে, নারীদের বিচার বুদ্ধি কিছুটা কম। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার আদৌ কোন যোগ্যতা নেই। তোমরা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে –ওয়াকফ বিভাগের কার্যাবলী চালানোর দায়িত্বশীলতা, ইয়াতিমখানা পরিচালনা করার যোগ্যতা ইত্যাদি তাদের মধ্যে রয়েছে। -ফতহুল কাদীর।
এ দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, নারী সামাজিক খেদমত বা সেবামূলক কর্মকান্ড চালাবার যোগ্যতার অধিকারী। এভাবে অনেক প্রকার কাজের দায়িত্বই তাদের ওপর অর্পণ করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, নারী স্বভাবতই যে কাজ করতে অসমর্থ, সেই ধরনের কোন কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর কখনোই চাপানো উচিত নয়। তাতে একদিকে যেমন সেই কাজের ক্ষতি হবে, তেমনি নারীর জীবনেও আসবে চরম অশান্তি ও ব্যাপক বিপর্যয়।
নারীদের ওপর সমাজ সমষ্টির কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে কয়েকটি মৌলনীতি দৃঢ়তা সহকারে অবশ্যই পালন করতে হবে। কেননা শরীয়াতের দৃষ্টিতে নারীর ব্যক্তিসত্তার নিরাপত্তা ও বিকাশ এবং সমাজের সাফল্য ও কল্যাণ এই নীতিসমূহের প্রতিপালনের ওপর নির্ভরশীল।
(১) এই পর্যায়ের প্রথম মূলনীতি হচ্ছে, নারীকে সর্বদা নিজের আসল অবস্থান কেন্দ্রের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। আসলে নারী প্রকৃতিগতভাবেই সাংসারিক জীবনের নির্মাতা এবং তার ভাল মন্দের জন্য দায়ী। তার এই মর্যাদা (পজিশন) বিনষ্ট করে তার ওপর কোন কাজের দায়িত্ব দেয়ার অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্র কারুরই নেই। তার নিজেরও অধিকার নেই এই মৌল দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে এর পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজের ভার নিজের মাথায় তুলে নেয়ার। পারিবারিক ও সামাজিক জীবন বিনাশ করে সমাজ সমষ্টির কাজে নিজের যোগ্যতা প্রতিভা ব্যয় করা শুধু তার নিজের পক্ষেই মারাত্মক নয়, সমাজ সমষ্টির পক্ষেও তা নিরশয় ক্ষতিকর। অফিস পরিচালনে নারীর সময় ব্যয়িত হতে গিয়ে যদি সংসার চালাতে এবং সন্তান ধারণ ও শিশু পালনের কাজ ব্যাহত হয়, তাহলে তা হবে বিশ্বমানবতার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা।
(২) দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে স্বামীর আনুগত্য ও অধীনতা। ইসলাম যে সমাজ পরিকল্পনা উপস্থাপনা করেছে, তাতে পরিবার হচ্ছে প্রথম ইউনিট। শৃংখলার প্রয়োজনে এই পরিবার ইউনিটের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পিত হয়েছে স্বামীর ওপর।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
আরবী (**********)
‘পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বসম্পন্ন’।
কাজেই স্বামী স্ত্রীকে যে সব সীমার মধ্যে রাখতে চাইবে তা যদি শরীয়াতের পরিপন্থী না হয়, তবে তা রাখার তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং সে অধিকার মেনে নেয়া স্ত্রীর কর্তব্য। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
আরবী (**********)
‘স্বামী তাঁকে যে কাজের আদেশ করবে, সে তা পালন করবে। ’
রাসূলে করীম (সা) আরো বলেনঃ ‘যে স্ত্রী স্বামীর অবাধ্যতা করে-আদেশ অমান্য করে, তার নামায আল্লাহর নিকট কবুল হয় না।’ বস্তুত পারিবারিক জীবনে স্ত্রীই হচ্ছে স্বামীর বড় সহায়। এই সহায়তা বাস্তবায়িত হতে পারে যদি স্ত্রী স্বামীর নিয়ন্ত্রণে জীবন যাপন করে। স্ত্রীর ঘরের বাইরে যাওয়া যদি স্বামী সমর্থন না করে, তাহলে তার পক্ষে বাইরে যাওয়া সমীচীন নয়। স্ত্রীলোকদের পক্ষে মসজিদে গিয়ে জামা‘আতের সাথে নামায পড়া অসঙ্গত নয়; কিন্তু তারা যেতে পারেন যদি তাদের স্বামীগণ অনুমিত দেন। এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (সা) সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, কারও স্ত্রী যদি মসজিদে গিয়ে নামায পড়ার অনুমতি চায়, তবে তার অনুমতি দেয়া উচিত, নিষেধ করা উচিত নয়। (মুসলিম)। এর অর্থ, স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে পারে না, তা মসজিদে নামায পড়ার জন্য হলেও। এমনকি কোন স্ত্রীর ওপর হ্জ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও তার স্বামীর অনুমতি না পেলে কোন মুহাররাম পুরুষ সঙ্গী ছাড়া সে হজ্জ করতেও যেতে পারবে না। (বায়হাকী)। তবে কতকগুলো ব্যাপারে স্বামীর অনুমতি ছাড়াই স্ত্রী ঘরের বাইরে যেতে পারে। যেমনঃ শরীয়াতের কোন মাসয়ালা জানবার জন্য কোন বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হলে, কোন মুহাররাম পুরুষের সঙ্গে ফরয হজ্জ পালনে যেতে হলে, পিতা মাতার বা মুহাররাম নিকটাত্মীয়কে দেখবার জন্য যেতে হলে স্ত্রী স্বামীর অনুমতির মুখাপেক্ষী হবে না।
স্বামীর অনুমতি ব্যতীত স্ত্রী কামাই রোজগার পর্যায়ের কোন কাজে বাইরে যেতে পারে না। কেননা কামাই রোজগার তার কর্তব্য নয়। মূলতঃ ভরণ পোষণের সমস্ত দায়িত্ব স্বামীর। তবে স্বামী যদি ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন না করে বা করতে অক্ষম হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে যেতে ও চেষ্টা শ্রম করতে পারে। ঘরের খরচ পত্রের বাড়তি প্রয়োজন পূরণের জন্য স্ত্রী যদি ঘরে বসেই কোন কাজ করে, তাহলে তাও সে অনায়াসে করতে পারে। এ পর্যায়ে মৌলিক কথা হলঃ
‘যে সব কাজে স্বামীর অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা অধিকার সঙ্কুচিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, সেসব কাজ করার কিংবা সে ধরনের কাজে ঘরের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে স্বামী স্ত্রীকে বাধা দিতে পারে। কিন্তু যে সব কাজে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, সেসব কাজে বাধা দেয়ার কোন কারণ নেই।’-দুররুল মুখতার।
এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, স্ত্রী স্বামীর অধিকার যথাযথ ও পুরোপুরি আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে বিভিন্ন তৎপরতায় নির্বাধে অংশ নিতে পারবে কি না? আমাদের মতে এই প্রশ্ন অযৌক্তিক। শরীয়াতের দৃষ্টিতে ঘর হল স্ত্রীর প্রধান কর্ম-কেন্দ্র এবং তার দ্বীন ও নৈতিকতার আশ্রয় স্থল। ঘরের বাইরের তৎপরতায় নির্বাধে অংশগ্রহণে এই সব দিক দিয়ে তার বিপন্ন হওয়া অসম্ভব নয়। এই কারণেই নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
আরবী (*********)
‘নারী গোপন করে রাখার যোগ্য। সে যখন বাইরে যায়, তখন শয়তান তার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।’
হযরত উমর ফারূক (রা) বলেছেনঃ ‘নারী প্রচ্ছন্ন রাখার বস্তু। তাকে তোমরা লুকিয়েই রাখবে।’-উয়ূনুল আখবার।
এ সব কথার পশ্চাতে একটা মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। ইসলাম দাম্পত্য জীবনকে দৃঢ়বদ্ধ দেখতে চায়। কিন্তু এই বন্ধন এতই নাজুক ও ঠুনকো যে, যে কোন ধাক্কায় তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এই বন্ধনের নিরাপত্তার খাতিরেই কোন সচেতন ও বুদ্ধিমান স্বামী তার যথেচ্ছ বিচরণ ও যখন তখন বাইরে যাতায়াত বরদাশত করতে পারে না। কেননা তাতে স্ত্রীর পক্ষে নানা প্রকার বিপদে আপদে ও জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। স্ত্রী যদি যুবতী হয় এবং দেখতে শুনতে হয় সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া, উপরন্তু স্বামী হয় ভদ্র চরিত্রসম্পন্ন, তাহলে তো কথাই নেই। -ফতহুল কাদির।
(৩) তৃতীয় মূলনীতি হচ্ছে, পর-পুরুষের সাথে নারীদের অবাধ মেলামেশা ও সংমিশ্রণ পরিহার করতে হবে। পূর্ববর্তী আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, স্বামীর অনুমতিক্রমে ঘরের বাইরে শিক্ষাগত, দ্বীনি ও সামাজিক কার্যাবলী আঞ্জাম দেয়া স্ত্রীর জন্য সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু ইসলামী শরীয়ত তাকে পরপুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশার একটুও অনুমতি দেয় নি; বরং তাদের ও ভিন পুরুষদের মাঝে নৈতিকতা এবং আইনের একটা প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নারীদের বাইরে চলাফেরা করার ব্যাপারে ইসলামের এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থার একটা বড় কারণ এই যে, পর-পুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশার ফলে তাদের নৈতিক চরিত্র কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোন নারী খোদার কায়েম করা এই প্রাচীর চূর্ণ বা লংঘন করে বাইরে চলাফেরা করলে সে পদে পদে খোদাদ্রোহিতা ও নাফরমানীতে নিমজ্জিত হবে। আর এটা নারী ও সমাজ উভয়ের জন্যই অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে। এই কারণে শিক্ষা প্রশিক্ষণ, সভ্যতা সংস্কৃতি কিংবা রাজনীতি, দেশরক্ষা-প্রতিটি ক্ষেত্রে গায়র-মুহাররাম নারী-পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণ পূর্ণ শক্তিতে প্রতিরোধ করা দরকার। ইসলামে পুরুষ দর্শকদের সম্মুখে মেয়েদের নাচ গান করার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি একই শ্রেণীকক্ষে পাশা পাশি বা সামনা সামনি বসে লেখাপড়া করার, শিক্ষকের লেকচার শোনার ব্যবস্থা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অচল। কোন মুসলিম নারী ভিন পুরুষের সাথে একত্রে না সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে, না কোন মিশ্র তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করতে পারে।
নবী করীম (সা) এর সময় তাঁর ভাষণ শুনবার জন্য মহিলারাও উপস্থিত হতেন। কিন্তু তারা একত্রিত হয়ে পাশাপাশি বসতেন না কখনও। তাদের বসার স্থান পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হত। এখনকার মত তখন মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা ছিল না বলে রাসূলে করীম (সা) পুরুষদের সামনে একবার ভাষণ দিতেন, পরে আবার ভাষণ দিতেন মহিলাদের সামনে। নবী করীম (সা) দায়েরকৃত মামলায় বিচারের জন্য মহিলা আসামীকে বিচারস্থানেও উপস্থিত করতেন না। বিচারালয় হতে মেয়েদের স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে এই কারণে।
নবী করীম (সা) এর সময়ে নারীদের যথারীতি সামরিক শিক্ষা দেয়া না হলেও তখনকার নারীরা বিশেষ পরিবেশ ও সংগ্রামী জীবন ধারার প্রভাবে সব সময়ই সামরিক কার্যাদি সুসম্পন্ন করার প্রস্তুত হয়েছিলেন। একালেও প্রয়োজনবোধে ইসলামী রাষ্ট্র নারীদের সামরিক ট্রেনিং দিয়ে তাদের যোগ্যতা প্রতিভা কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু তাতে এ শর্ত অবশ্যই থাকতে হবে যে, পুরুষদের সাথে তাদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ দেয়া চলবে না। খোদ নবী করীম (সা) তাঁর বেগম হযরত আয়েশা (রা) কে যুদ্ধের ময়দানে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন এবং তিনি নিজেই তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে তিনি অপর পুরুষদের সাথে কোনরূপ অবাধ মেলামেশার সুযোগ ঘটতে দেন নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মেয়েদের সামরিক বিভাগে নিযুক্ত করা হলে তাদেরকে পুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশা থেকে দূরে রাখতেই হবে, শরীয়াতে কি তার খুব বেশী তাকীদ রয়েছে? রাসূলের যুগেও যখন নারীরা পুরুষদের সাথে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করেছে, তখন নারী পুরুষের মেলামেশা নিশ্চয়ই ততটা নিষিদ্ধ নয়?
এর জবাব এই যে, বিচ্ছিন্ন দু একটা ঘটনাকে কখনও নীতি বলা চলে না। সাধারণ নিয়মই হচ্ছে নীতি। বিশেষ কোন সময়ে কোন অসাধারণ সমস্যার কারণে কোন কাজ করা হয়ে থাকলে তা কখনই সাধারণ নিয়ম হতে পারে না। বিশেষ সময়ে বিশেষ অবস্থার কারণে বা প্রয়োজনে কোন কাজ করা হলে তার ভিত্তিতে স্থায়ী নিয়ম তৈরি হতে পারে না। কেননা, বিশেষ ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণের অনুমতি শরীয়তে থাকতে পারে। সাধারণ অবস্থায় সে অনুমতি সম্পূর্ণ রূপে অচল বলে মনে করতে হবে।
যুদ্ধ ভয়ঙ্কর ধরনের একটা আপতিক ঘটনা। তাতে কোন ব্যক্তিকে নয়, গোটা জাতিকেই মরণ পণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়াতে হয়। তখন সাধারণ ও শান্তিকালীন স্থায়ী নীতি নিয়ম যথাযথভাবে পালন করা কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া যুদ্ধ বিগ্রহ নিতান্তই জরুরী পরিস্থিতি আর জরুরী পরিস্থিতিকে সাধারণ শান্তিকালীন অবস্থার সাথে তুলনা করা চলে না। নবী করীম (সা) এর যুগে মুসলিম মহিলাদেরও গায়র মুহাররাম পুরুষদের পাশে থেকে একত্রে ময়দানে লড়াই করতে হয়েছে, তা ইতিহাসের কথা; কিন্তু তা কখনই সাধারণ অবস্থায় অনুসৃত নীতি ছিল না।
তাছাড়া যুদ্ধ স্বতইঃ সাধারণ অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। অনেক সময় তা এতই ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও ভয়াবহ রূপে দেখা দেয় যে, তখন প্রতিটি মানুষ তাতে বিচলিত হয়ে পড়ে। নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারও তখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দেখা দেয়।
রাসূলে করীম (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) কে তখন যুদ্ধ সংগ্রামে অনুরূপ পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখনও মুসলমানদের জাতীয় স্থিতি ও রাষ্ট্রীয় সংহতি সুদৃঢ়ভাবে গড়ে উঠতে পারে নি। এ সত্ত্বেও তাঁদের যুদ্ধ সংগ্রামের এক অসহ ও অশেষ পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। সামরিক সাজ সরঞ্জাম বলতে তাদের কিছুই ছিল না; সেই সঙ্গে জনশক্তিও ছিল এতই অল্প ও সামান্য যে, এ নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এই কারণে তখন আপন স্ত্রী কন্যা বোন-দেরকে যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায়ই ছিল না। এইকারণে সেকালের সেই সঙ্কটময় সময়ে মুসলিম নারীদেরও যুদ্ধে যেতে হয়েছে এবং যার দ্বারা যতটুকু সামরিক কাজ সম্ভব ছিল, তা করানো হয়েছে। প্রয়োজনে প্রান্তিক সীমার বাইরে তাকে যেতে দেয়া হয়নি কখনো। নারীদের যুদ্ধে যোগদানের আগে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হত সর্বাগ্রে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাস্তবিকই প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেই একজন নারীকে যুদ্ধে যোগদানের অনুমতি দিতেন রাসূল (সা)। এক যুদ্ধে কতিপয় মহিলা তাদেরই ঘরের পুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উপস্থিত হলে নবী করীম (স) খুবই অপ্রসন্ন হয়ে বললেনঃ
আরবী (**********)
‘তোমরা কাদের সঙ্গে বের হয়ে এসেছ এবং কার অনুমতি নিয়ে তোমরা ঘর হতে বের হলে?’
এক কথায় বলা যায়, যে নারীই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করতেন, নিজেদের অতি আপনজনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যোগ দিতেন এবং সর্বোপরি রাসূলে করীম (সা) এর নিকট হতে ব্যক্তিগতভাবে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কোন নারী যুদ্ধে যোগদান করতে পারতেন না।
ইমাম নববী এই পর্যায়ে লিখেছেনঃ
আরবী (*********)
‘নারীদের এই সেবা শুশ্রুষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি ছিল তাদের মুহাররাম আত্মীয় স্বজন ও স্বামীদের জন্য এবং তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর তাদের ছাড়া অন্যদের সেবা শুশ্রুষা ও চিকিৎসার কাজ যা কিছু হত, তাতে সাধারণত দৈহিক স্পর্শ হত না-অবশ্য নিতান্ত প্রয়োজন দেখা দিলে সে নির্দিষ্ট স্থান স্পর্শ করা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা।’
এই পর্যায়ে একটি জরুরী কথা এই যে, মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে পাশ্চাত্য সমাজ দর্শনের অনুসরণে নারীদের কোনরূপ অশ্লীল, উচ্ছৃঙ্খল ও নগ্ন তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া কিংবা তাদের ঘর হতে টেনে বের করে এনে পুরুষদের মধ্যে একাকার করে দিয়ে এক নির্লজ্জ পরিবেশের সৃষ্টি করা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। পাশ্চাত্য দর্শন খোদাদ্রোহীতা আর ইসলামী সমাজ খোদাভীরুতার উপর প্রতিষ্টিত। এ দুয়ের মাঝে সমতা সৃষ্টির চেষ্টা ইসলামের প্রতি চরম শত্রুতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। পাশ্চাত্য সমাজ নারীদের যে স্বাধীনতা দিয়েছে, তার সাথে ইসলামের দেয়া স্বাধীনতার কোন তুলনা হতে পারে না। পাশ্চাত্য দর্শনে নারী হচ্ছে বারবণিতা, নাচ ঘরের নর্তকী, কারখানার শ্রমিক ও পুরুষদের লালসা চরিতার্থের উপকরণ মাত্র। ইসলাম নারীদের জন্যে যে কর্ম বিধি র্নিধারণ করেছে তাদের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য , পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে তাতে নাকি নারীর অপমান!
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নবী করীম (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীন এর যুগে মুসলিম সমাজ বহু সামরিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। এ সবের সমাধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কখনও কোন নারীর উপর অর্পণ করা হয় নি। কতই না যুদ্ধ সংঘটিত হল, কিন্তু কোন যুদ্ধের সেনাধ্যক্ষ হয় নি কোন নারী। কোন সুশিক্ষিতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন নারী সাহাবীকেও কোন এলাকার গভর্নর বা প্রসাশক নিয়োগ করা হয় নি। অর্থ বিভাগ বা বিচারকার্য পরিচালনার জন্যও নিযুক্ত করা হয় নি কোন নারী। রাসূলে করীম (সা) এর ইন্তিকালের পর কোন নারী সাহাবীকে খলীফাও বানানো হয় নি।
বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজে নারীদের শুধু ঘর হতেই টেনে বের করা হয় নি, নারী পুরুষের মাঝে ঠিক জীব জন্তুর ন্যায় অবাধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তার ফলে মানব সমাজে যে সর্বাত্মক বিপর্য্য় দেখা দিয়েছে, তা এ কালের মানব জাতির পক্ষে সাংঘাতিকভাবে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ অনতিবিলম্বে সাবধান না হলে অবশিষ্ট মূল্যবোধটুকুও খড়কুটোর মত ভেসে যাবে, তাতে একবিন্দু সন্দেহ নেই।