بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
স্বভাবসম্মত নারী জীবন
নারী অর্ধেক মানবতা। পুরুষ মানবতার মাত্র একাংশের প্রতিনিধি। অপর অংশের প্রতিনিধিত্ব করে নারী। তাই নারী সমাজকে বাদ দিয়ে মানব জাতির যে পরিকল্পনাই রচিত হবে, তা অনিবার্যভাবে হবে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। কেবল পুরুষ সমন্বয়ে গঠিত কোন মানব সমাজের-যেখানে নারীর প্রয়োজনই নেই-কল্পনাও করা যায় না। কেননা নর ও নারী পরস্পর সম্পূরক, পরস্পর নির্ভরশীল। না নারী পুরুষ ছাড়া চলতে পারে, না পুরুষ পারে নারীবিহীন হয়ে থাকতে। এই মুখাপেক্ষিতা ও নির্ভরতা সামাজিক, জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক সর্বদিক দিয়ে। সামষ্টিক জীবনের দাবি হল, নারী পুরুষ পায়ে পা মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে। অপরদিকে স্বভাবগত যৌনস্পৃহার চাহিদা হচ্ছে, নারী ও পুরুষ পরস্পরের নিকট হতে শান্তি, স্বস্তি, তৃপ্তি ও সার্থকতা লাভ করবে।
বস্তুতঃ সামষ্টিক জীবনের সুষ্ঠতা ও উন্নতি একান্তভাবে নির্ভর করে নারী পুরুষের মাঝে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক যথার্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌন সম্পর্কও যথার্থ ও পবিত্র হওয়ার ওপর। নারীর চেষ্টা সাধনায় যে ত্রুটি ও অপূর্ণতা থেকে যাবে, পুরুষ তা কানায় কানায় পূর্ণ করে দেবে। পক্ষান্তরে যে ত্রুটি বিচ্যূতি ও অপূর্ণতা থাকবে পুরুষের দায়িত্ব পালনে, তার পরিপূরণে এগিয়ে আসবে নারী। নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক তার স্বভাবসম্মত সীমার মধ্যে সীমিত থাকবে এবং নিছক স্বাদ-আস্বাদন ও লালসা চরিতার্থকরণের উপায় হিসেবেই তা গ্রহণ করা যাবে না। এটাই সর্বতোভাবে যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত।
নারী পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক যদি ভারসাম্যহীন হয় এবং তাদের পারস্পরিক যৌন সম্পর্ক উচ্ছৃঙ্খলতায় আকীর্ণ হয়ে উঠে, তাহলে গোটা মানব সমাজই সর্বাত্মক ভাঙন ও বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াবে। কেননা, এই ভারসাম্যহীনতার পরিণামে সামষ্টিক জীবনের অনেকগুলি দিক শূণ্য থেকে যাবে আর অনেকগুলো দিকের ওপর অস্বাভাবিক ও অপ্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপিত হবে। এই দুটো অবস্থাই সুষ্ঠু সমাজ জীবনের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনুরূপভাবে যৌন সম্পর্ক শৃঙ্খলাহীন হয়ে গেলে সমাজ-সংস্থা ভাঙন ও বিপর্যয়ের শিকার হবে অথবা যৌন সম্পর্ক সম্পূর্ণ পরিহার করার প্রবণতা সমাজে সাধারণভাবে প্রবল হয়ে দেখা দেবে। যে-সব জাতির জীবনে, যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ব্যাপক ও মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়, সে সব জাতি বেশী দিন পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারে না। পক্ষান্তরে যৌন বিমুখতা মানব সভ্যতা গড়ে তোলার পথে বিরাট অন্তরায়। মানুষের ইতিহাস এ কথার যথার্থতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে।
আধুনিক সভ্যতা নারী ও পুরুষের মাঝে স্বভাবসম্মত সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর যৌন সমস্যার সমাধান করাতো তার সাধ্যেরও অতীত। কেননা আধুনিক সভ্যতা নারীর জন্য তার আসল ও স্বভাবসম্মত স্থান নির্ধারণ করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে; বরং তার আসল ও স্বভাবসম্মত স্থান হতে তাকে টেনে নিয়ে পুরুষদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ফলে নারী আজ পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট বিশাল কর্মক্ষেত্রে সদা তৎপর; অথচ তার সৃষ্টি হয়েছে যে কাজের জন্য, সেখানে সে অনুপস্থিত। আধুনিক সভ্যতা যৌন ভাবাবেগকে এতটা প্রবল, সুতীব্র ও উচ্ছসিত করে তুলেছে যে, মানুষের মন ও মগজের ওপর তার সর্বাত্মক আধিপত্য সংস্থাপিত হয়ে গেছে। ফলে মানুষ আসল করণীয় বিষয়কে উপেক্ষা করে চলেছে এবং চারদিকে যৌন স্বাদ আস্বাদনের এক প্রচন্ড বন্যা বইছে।
এ কথায় কোনোই সন্দেহ নেই যে, নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভুল ও ভ্রান্ত কাঠামোর ওপর গড়ে উঠেছে বলে বর্তমান সভ্যতা এক কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এক্ষণে মানুষ এমন এক স্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার অশেষ উপায় উপকরণ থাকা সত্ত্বেও মানুষ তা হতে বঞ্চিত। তার এ বঞ্চনা কিছুমাত্র ঘুচবে, তাও সুদূরপরাহত বলে মনে হয়।
আধুনিক সভ্যতা ও সামাজিক অবস্থা যারা অনাবিল, অনাসক্ত ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করছেন, তাঁরা আমাদের উপরোক্ত কথার সত্যতা অবশ্যই স্বীকার করবেন। এ কথায়ও তাঁদের কোন সন্দেহ থাকবে না যে, সামান্য ও নগণ্য ধরনের সংশোধন চেষ্টা-প্রচেষ্টা দ্বারা এই সমাজকে রক্ষা করা যাবে না, তাকে নিরোগ ও সমস্যামুক্ত করাও এই উপায়ে সম্ভব হবে না। এক্ষনে নারী ও পুরুষ সমন্বয়ে সুষ্ঠু সমাজ সংস্থা গড়ে তোলার জন্য সম্পূর্ণ নতুনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেজন্যে বর্তমান ঘুনে ধরা সমাজ কাঠামোকে ভেঙে ফেলে তাকে নতুনভাবে সুদৃঢ় করে সংস্থাপন করতে হবে। এই প্রেক্ষিতেই আমরা অত্র আলোচনার অবতারণা করছি।
আমাদের বিশ্বাস ইসলামী আদর্শই নারী-পুরুষের সামাজিক ও যৌন জীবনের জন্য নির্ভুল ভিত্তি উপস্থাপন করছে। এই ভিত্তির ওপর যে সম্পর্ক কাঠামো গড়ে উঠবে, তা সর্বপ্রকার ভাঙন, বিপর্যয় ও উচ্ছৃঙ্খলতার কবল হতে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে সর্বোতভাবে সাফল্যমন্ডিত হবে। পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্থাপিত কাঠামো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে নবতর সমাজ কাঠামো গড়ে তোলা ছাড়া আধুনিক মানুষের অন্য কোন উপায় নেই। একথা আমরা বলিষ্ঠ কন্ঠেই বলতে চাই।
এ পর্যায়ে আমরা এখানে যে আলোচনার অবতারণা করেছি, তাকে মোটামুটিভাবে দু’ভাগে ভাগ করে নিচ্ছি। প্রথমভাগে আমরা দেখাব, নারী সম্পর্কে পাশ্চাত্য মনীষীদের আধুনিক চিন্তাধারা ও মতাদর্শ এবং দ্বিতীয়ভাবে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো, ইসলাম নারীকে কি মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে এবং স্বভাবসম্মত নারী জীবনের জন্য কি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে।
নারী ও আধুনিক চিন্তাধারা
জুলুমের পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। নারী সুদীর্ঘকাল হতেই নানাভাবে নিপীড়িত ও নির্যাতিত। এ অবস্থা যখন চরম পর্যায়ে পৌছে গেল, তখনই তার ভয়াবহ পরিণতির প্রকাশ ঘটতে শুরু করল। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের পর জীবনের প্রায় সব কটি ক্ষেত্রেই বিপ্লব এসেছে। ফলে নারীর সামাজিক মর্যাদাও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই সেদিনও নারীকে অত্যন্ত হীন ও নীচু মনে করা হত কিন্তু আজ সেই নারীই ইজ্জত ও সম্মানের দাবীদার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে এমন একটা সময় ছিল যখন পুরুষ নারীকে তার যথার্থ ও ন্যায্য মর্যাদা দিতেও প্রস্তুত ছিল না। ফলে সে যখন সুযোগ পেয়ে গেল, তখন স্বীয় মর্যাদা ও অধিকার আদায় করতে গিয়ে স্বাভাবিক সীমালঙ্ঘন করে সমূখে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেল। তার সীমালংঘনমূলক সে অগ্রগতি আজও চলছে; মুহুর্তের তরেও তা থেমে যায় নি। অতীতে নারী জীবনে এমন একটা সময় এসেছিল, যখন সে তার ঘরের ক্ষুদ্রায়তন পরিবেষ্টনীর মধ্যেও কিছুমাত্র স্বাধীন ছিল না। কিন্তু আজ অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের নারীকে রুখতে পারে, এমন শক্তি না ঘরের ভিতর আছে, না ঘরের বাইরে আছে।
আজকের পাশ্চাত্য নারী স্বাধীনতার সুউচ্চ পর্যায়ে উপনীত। ঐতিহাসিক কার্যকারণ এই ব্যাপারে তার পক্ষে খুব বেশী সহায়ক হয়েছে। ঠিক যে সময় নারীরা পুরুষের নির্যাতন-নিষ্পেশনের অক্টোপাশ থেকে মুক্তিলাভের জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টারত, ঠিক সে সময়েই পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটে। এই বিপ্লবই নারীর মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌছিয়ে দেয়। পূর্বে যে ঘর ছিল তার কর্মক্ষেত্র, তার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চেয়েছিল; কিন্তু ঘরের বাইরে সে কোথায় যাবে, কি করবে, জীবনের কোন্ নীল নকশাকে সে অবলম্বন করবে, সে বিষয়ে তার কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু শিল্প বিপ্লব তাকে শুধু পথ নয়-উদার, উন্মুক্ত ও লোভনীয় রাজপথ দেখিয়ে দিল। এই বিপ্লব নারীর সম্মুখে জীবনের যে নীল নক্সা উজ্জ্বল ও স্পষ্ট করে তুলে ধরল, তা ঘরোয়া জীবন হতে অনেক লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বলে প্রতীয়মান হল। তার একথা বুঝে নিতে দেরী হল না যে, সে এই নীল নক্সা অবলম্বন করে গোলামীর জিঞ্জিরকে ছিন্ন করতে পারে। নারী তার পিতা-মাতা ও স্বামীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে বলে অতীতে কখনো কল্পনাও করা যায় নি। কিন্তু এই নীল নক্সাই তাকে বিদ্রোহ ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করল। কেননা, এক্ষেত্রে সে কারোই মুখাপেক্ষী থাকলো না, থাকল না কারুর ওপর নির্ভরশীল। তার প্রয়োজন পূরণ ও লালসার ইন্ধন যোগানোর বিপুল আয়োজন সমারোহ চতুর্দিকে স্তূপীকৃত। সুযোগ সুবিধার সমস্ত দুয়ার তার সম্মুখে উন্মুক্ত-অবারিত। তাই খুব সহজেই সে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারল।
নারী সমাজের এই বিদ্রোহের মূলে নিজেদের অবস্থার সংশোধন ও উন্নয়ন ইচ্ছা যতটা কার্যকর ছিল, তার চাইতে অধিক প্রভাবশালী ছিল পুরুষদের বন্ধন হতে মুক্তি এবং প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা। এই কারণে যে সমাজ ব্যবস্থা তাদেরকে পুরুষদের অধীন করে রেখেছিল, তার শৃঙ্খলা তারা সর্বপ্রথম ছিন্ন করল। অথচ প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানযোগ্য ছিল না। তাতে কিছু দোষ-ত্রুটির অনু্প্রবেশ অবশ্যই ঘটেছিল-কিন্তু তা সত্ত্বেও তাতে নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই অশেষ কল্যাণ নিহিত ছিল। তাই এই ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়ার নয়, সংশোধনযোগ্য ছিল। কিন্তু কোন বিশেষ ব্যবস্থা ও আদর্শের বিরুদ্ধে একবার কোনরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে তা চরম পরিণতি না দেখিয়ে ছাড়ে না, এ এক স্বতঃসিদ্ধ কথা। তাই দেখতে পাই, পুরুষদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীমনে যে ক্রোধ-হিংসা, বিদ্বেষ বহ্নি জেগে উঠেছিল, তার পরিণতিতে নারী মুক্তি আন্দোলন তার স্বাভাবিক স্বীমাকেও অতিক্রম করে গেল। তা নারীকে এমন এক স্থানে পৌছে দিল, যা নারীকে ঠিক নারী থাকতে পারল না; সে হয়ে গেল অনেকাংশে পুরুষের প্রতিরূপ। কিন্তু নারীর পুরুষরূপ কোনক্রমেই বাস্তবরূপ হতে পারে না- তা নিতান্তই কৃত্রিম ও অন্তঃসারশূণ্য। কেননা প্রকৃতপক্ষে নারীর পুরুষ হয়ে যাওয়া কখনো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। পুরুষও কখনো পারে না নারী হয়ে যেতে। উভয়ই সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দেহাবয়ব, আকার আকৃতি ও শক্তি সামর্থ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। একই স্থান ও কাল, একই আবহাওয়া ও পরিবেশ ও একই পিতামাতার সন্তান হয়ে এবং একই ঘরে লালিত পালিত হওয়া সত্ত্বেও নারী ও পুরুষ স্বভাব প্রকৃতি ও মনস্তাত্ত্বিকতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথক ও ভিন্ন ভিন্ন সত্তার অধিকারী। এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য এতই বেশি যে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের একই প্রজাতীয় দুই ব্যক্তির মাঝেও অতটা পার্থক্য হতে পারে না, যতটা এ দুয়ের মাঝে বিদ্যমান। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বর্ণ, বংশ, আবহাওয়া, পরিবেশ, ভৌগলিক অবস্থান ও ভাষার পার্থক্য কিছুমাত্র মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী নয়। কেননা, সেক্স বা লিঙ্গের পার্থক্য অতীব মৌলিক-অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতালব্ধ অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে, লিঙ্গের পার্থক্য খুব নগন্য বা সামান্য ব্যাপার নয়। শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের প্রভাব দ্বারা এই পার্থক্য অতিক্রম করা কখনই সম্ভবপর হতে পারে না। কেননা মানব-সত্তায় জন্মগতভাবেই যে যোগ্যতা বিদ্যমান, মানুষ কেবল তারই লালন ও বিকাশ সাধন করতে পারে। যে শক্তি বা যোগ্যতা আসলেই তার মধ্যে নেই, তার উন্নতি বা বিকাশ সাধনের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। নারী বা পুরুষ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও চেষ্টা সাধনার সাহায্যে খোদাপ্রদত্ত শক্তি ও যোগ্যতারই প্রবৃদ্ধি সাধন করতে পারে, নবতর কোন যোগ্যতা মৌলিকভাবে ও নতুন করে সৃষ্টি করার সাধ্য কারুর নেই।
মানব জাতির গোটা ইতিহাস থেকেই এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আজ পর্যন্ত লব্ধ কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই এই কথাকে অসত্য প্রমাণিত করতে পারে নি। Man the Unknown গ্রন্থের গ্রন্থকার নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত ফরাসী চিন্তাবিদ আলেক্সিম ক্যারেলি লিখেছেনঃ
পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা মৌলিক পর্যায়ের। তাদের দেহের রগ রেশা স্নায়ু সংগঠন ভিন্নতর বলেই তাদের মধ্যকার এই পার্থক্য। নারীর ডিম্বকোষ হতে যে রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, তার প্রভাব নারীদেহের প্রতিটি অঙ্গে প্রতিফলিত হয়। নারী-পুরুষের স্বভাবগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্নতার কারণও এই।
বস্তুত নারী ও পুরুষ কেবলমাত্র দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, আকার আকৃতি, অস্থিমজ্জা, গঠন-প্রকৃতি ও স্নায়ু সংগঠনের দিক দিয়েই ভিন্ন নয়, এদিক দিয়েও তারা ভিন্নতর যে, তারা সমান পরিমাণের বায়ু ও খাদ্য গ্রহণ করে না। তাদের রোগ-ব্যাধিও হয় বিভিন্ন প্রকারের, বিভিন্ন রূপের ও বিভিন্ন প্রকৃতির। তাদের মানসিক ঝোঁক প্রবণতা ও নৈতিকতাবোধও একই রকমের নয়। এক্ষেত্রে পুরোপুরি বৈচিত্র অবশ্যই লক্ষণীয়।
আজ হতে প্রায় এক শতাব্দীকাল পূর্বে যখন নারী স্বাধীনতার আন্দোলন এতটা ব্যাপকতা লাভ করেনি, তখনও এই ধরনের মত ও চিন্তাধারা বিদগ্ধ মহলে প্রকাশ করা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের বিশ্বকোষে লিখিত হয়েছিলঃ
পুরুষ ও নারীর যৌন অঙ্গের সংগঠন ও আকৃতির বিভিন্নতা যদিও খুব বড় বিভিন্নতা বলেই মনে হয়; কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে বিভিন্নতা কেবল এ দিক দিয়েই নয়; নারীর পা হতে মাথা পর্যন্ত সব কটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পুরুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে অনেকটা ভিন্নতর। এমনকি, যে সব অঙ্গ বাহ্যতঃ পুরুষদের সদৃশ মনে হয়, তা-ও।
নারী ও পুরুষের এই জন্মগত ও স্বভাবগত পার্থক্য এর কারণে প্রত্যেকের কাছ হতে তার শক্তি, সামর্থ্য ও কর্মক্ষমতা অনুপাতেই কাজ গ্রহণ করা এবং তাকে সে ধরনের কাজে নিযুক্ত করাই স্বাভাবিকতার দাবি। জীবনের অনেকগুলি ক্ষেত্রে ঠিক তাই করা হচ্ছে আবহমান কাল হতে। সাধারণতঃ কোন প্রকৌশলীকে কৃষিকাজে নিযুক্ত করা হয় না। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞকে লাগানো হয় না জাহাজ নির্মাণের কাজে। একই লিঙ্গের দুই ব্যক্তির মাঝে যোগ্যতা-প্রতিভা, ঝোঁক প্রবণতা, রুচিশীলতা ও আনুপাতিকতার দৃষ্টিতে অবশ্যই পার্থক্য করা হয়। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, নারী ও পুরুষের মাঝেও এইরূপ মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। মানুষ হিসেবে তারা অভিন্ন; কিন্তু উভয়ের দৈহিক ও আঙ্গিক সংগঠন, মনস্তত্ত্ব ও মানসিকতা হতে মৃত্যু পর্যন্ত তাদের ওপর আবর্তিত বিভিন্ন অবস্থায় উভয়ের প্রতিক্রিয়া, আবেগ-উচ্ছ্বাস ও অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে পরস্পর বিভিন্ন। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ঊভয়ের সৃষ্টিই হয়েছে আলাদা ধরনের প্রকৃতিতে ও সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। প্রকৃতি উভয়ের দ্বারা একই ধরনের ও একই রকমের কাজ নিতে ইচ্ছুক নয়; সে চায় ভিন্ন ভিন্ন কাজ নিতে। তার আঙ্গিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্নতার মূলে এই কারণটিই তীব্রভাবে নিহিত।
কিন্তু আধুনিক কালের নব্যচিন্তা ও দৃষ্টিকোণ নারী-পুরুষকে একই ক্ষেত্রে টেনে এনেছে এবং উভয়কে ঠিক পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর একই ক্ষেত্রে উন্নতি-অগ্রগতি লাভের সুযোগ-সুবিধাও উভয়কে একই রকমের দেয়া হচ্ছে। নারী ও পুরুষের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা যে এক ও অভিন্ন নয়, সে কথা একবারও চিন্তা ও বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে না। অথচ এ পর্যায়ে পেশ করার মত স্বভাবগত ও মনস্তাত্ত্বিক কোন প্রমাণই তাদের হাতে নেই। যে সব কাজ পুরুষরা করতে পারে, সেই সব কাজ যে মেয়েরাও সাধারণত করতে পারে, এমন অকাট্য প্রমাণ আজ পর্যন্ত পেশ করা সম্ভবপর হয় নি।
অ্যালেক্সিস ক্যারেল পুরুষ ও নারীর মধ্যকার স্বভাবগত ও গুণগত পার্থক্য ও বিভিন্নতা পর্যায়ে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
“নারী ও পুরুষের মধ্যকার স্বভাবগত পার্থক্য প্রমাণকারী মৌলিক সত্যকে অস্বীকার করার কারণে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলনকারীরা দাবি করেছে যে, নারী ও পুরুষের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন ও সমান হতে হবে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, এই দুইয়ের মাঝে সীমাহীন পার্থক্য বিদ্যমান। নারীদেহের প্রতিটি কোষের ওপর তার নারীত্বের চিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কেও এ কথাই সত্য-বিশেষ করে তার স্নায়ুমন্ডলী সম্পর্কে। নারীদের কর্তব্য তাদের স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ী নিজেদের ঝোঁক-প্রবণতার রূপায়ণ। পুরুষদের অনুকরণ করা তাদের উচিত নয়। সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতিতে নারীদের তুলনায় পুরুষদের অবদান অনেকও বেশি। এ কারণে তাদের নিজেদের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের ব্যাপারে কোনরূপ উন্মাসিকতা প্রকাশ সম্পূর্ণরূপে-অনুচিত।”
বস্তুতঃ নারী পুরুষের মাঝে স্বভাবগত ও জন্মগত পার্থক্য ও বিভিন্নতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই তাদের সামাজিক অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করা কর্তব্য। উভয়ের মধ্যে স্বভাবগত পার্থক্য আধুনিক পাশ্চাত্য মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে নি; পারেনি এ পার্থক্যকে দূর করে উভয়কে সর্বতোভাবে একাকার ও অভিন্ন করে তুলতে। ফলে নারী পুরুষের সাম্যের যে দাবি আধুনিক পাশ্চাত্য হতে জোরদার হয়ে উঠেছে, তা সর্বৈব মিথ্যা ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে মনে করা হয়েছে যে, এরূপ করতে পারলেই নারীদের করুণ ও মর্মান্তিক অবস্থা দূর করা ও তা হতে তাদের মুক্তিসাধন সম্ভবপর হবে। মনে করা হয়েছে যে, সমাজে পুরুষদের প্রাধান্য রয়েছে বলেই নারী উপেক্ষিত ও পদদলিত। নারী সমাজ নিজেদের জান-মাল সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা ও অধিকার হতে এ কারণেই বঞ্চিত। এ কারণে পাশ্চাত্যের মত নারীদেরও পুরুষদের মতই অধিকার দিতে হবে। উপরন্তু সমাজে কেবল পুরুষদেরই প্রাধান্য দেয়া চলবে না। এই প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব যে সব কারণ ও উপায় উপকরণের দরুণ অর্জিতে হয়ে থাকে, তা বিশেষ এক লিঙ্গের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট করে না দিয়ে উভয়ের জন্য তার দ্বার সমানভাবে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। নারীদেরও সমাজ ও রাষ্ট্রের উচ্চতর পদে নিয়োগ করতে হবে। তা না হলে এক লিঙ্গের লোকেরাই সর্বত্র অগ্রগতি লাভ করবে এবং অপর লিঙ্গের লোকেরা থাকবে পশ্চাদপদ হয়ে। তার ফলে গোটা সমাজ ভারসাম্যপূর্ণ উন্নতি লাভ করতে পারবে না। কেননা সমাজের যে অংশ বা শ্রেণী অনুন্নত ও পশ্চাদপদ থেকে যাবে, তারা অপর অংশ বা শ্রেণী কর্তৃক শোষিত ও নিষ্পেষিত হবে। ক্ষমতাশালী লোকেরাই যে জুলুম করে এবং তাদের সে জুলুম প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারুর থাকে না, এতো সর্ববাদী সম্মত কথা!
এ হল নারী ও পুরুষের সামাজিক অধিকার ও দায়িত্বকে অভিন্ন মনে করার দৃষ্টিকোণ। অথচ প্রকৃতপক্ষে এ দুটি শ্রেণী অভিন্ন নয়। এ দুয়ের মাঝে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। কারুর প্রতি সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যের আচরণ গ্রহণ এক কথা আর তাকে কোন নির্দিষ্ট সামাজিক কাজে নিয়োগ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এই দুটি বিষয়কে এক ও অভিন্ন মনে করা একটা মারাত্মক ধরনের ভুল। কেননা তার ফল এই দাঁড়াবে যে, কেউ কোন বিশেষ ধরনের কাজ করতে অক্ষম হলে তাকে সামাজিক অধিকার হতেও বঞ্চিত হতে হবে।
নারীদের ওপর জুলুম ও অবিচার সংঘটিত হয়ে থাকলে এবং তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকলে মনে করতে হবে, রাষ্ট্র ও সমাজ তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম রয়েছে বলেই এমন হয়েছে। নাগরিকদের, বিশেষত নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাগুলি তাদের জন্য সহজলভ্য করে দেয়া তো রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। যে রাষ্ট্র তার এই কর্তব্য পালন করে না, তার অস্তিত্ব জনগণের জন্যে একেবারেই অর্থহীন। বিশেষ কোন নাগরিককে তার অধিকার হতে বঞ্চিত রাখা বা বঞ্চিত থাকতে দেয়ার কোন অধিকারই থাকতে পারে না কোন রাষ্ট্রের। সেই সঙ্গে জনগণের বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর প্রতি বিভেদমূলক আচরণ গ্রহণ করাও কোন রাষ্ট্রের পক্ষে শোভন হতে পারে না। কোন রাষ্ট্রে সেরূপ হতে থাকলে সে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দেয়া উচিত। কেননা এটা একটা গুরুতর অপরাধ, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
কিন্তু কোন রাষ্ট্রের নাগরিক হলেই যে তাকে নির্বিশেষে সর্বপ্রকারের দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করতে হবে, এমন কোন কথা হতে পারে না। কেননা দায়িত্ব পালনের জন্য দরকার যোগ্যতা। আর সবরকমের লোকেরই যে সব ধরনের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থাকবে, এমন কথা যুক্তিসঙ্গত নয়। সুতরাং নারীদের যে সব কাজ করার সত্যিই যোগ্যতা আছে, তাদের কেবল সেসব কাজের দায়িত্বই দেয়া উচিত। যে সব কাজের যোগ্যতা স্বভাবতঃই তাদের নেই, সেই সব কাজের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলে তার মত জুলুম ও অমানুষিক কাজ আর কিছু হতে পারে না।
পাশ্চাত্য ভাবধারাপূর্ণ আধুনিক সমাজ এই যুক্তিপূর্ণ কথাটিই অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করে চলেছে। এ সমাজের লোকেরা কয়েক ধরনের বিশেষ কাজ তথা পেশা ও শিল্পকেই উন্নতি, অগ্রগতি ও সম্মানে প্রতীক মনে করে নিয়েছে। বস্তুত মান সম্মান ও অপমান লাঞ্ছনার এ এক মনগড়া মানদন্ড। এই মানদন্ড রচনা করা হয়েছে পুরুষদের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাকে সামনে রেখে। নারীদের মেজাজ প্রকৃতি অনুসারে এই মানদন্ড রচিত হয় নি। তা সত্ত্বেও এই মানদন্ডের ভিত্তিতেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নারীদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। এটা যে কত বড় অবিচার, তা বলে শেষ করা যায় না। বস্তুত প্রকৃতি যার মধ্যে যে যোগ্যতা রেখেছে, সে ধরনের কাজকেই তার সাফল্যের মানদন্ড রূপে নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়। কেবল তা হলেই প্রত্যেক লিঙ্গের লোকেরা নির্দিষ্ট মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে। মেয়েদের স্বাভাবিক যোগ্যতার মানদন্ডে পুরুষদের উত্তীর্ণ হতে বলা যেমন হাস্যকর, এ-ও তেমনি। এরূপ হলে প্রত্যেকেরই আপন স্বভাব প্রকৃতির সাথে দ্বান্ধিক ভূমিকা পালন করতে হবে। আর স্বভাব প্রকৃতির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার মত মারাত্মক ব্যাপার কল্পনাও করা যায় না।
বলা হয়, বর্তমানে নারীর যা প্রকৃতি- তা কৃত্রিম, তা তার আসল প্রকৃতি নয়। পুরুষদের ক্রমাগত ও দীর্ঘকালীন নিপীড়ন ও শোষন নির্যাতনের শিকার হতে থাকার ফলেই নাকি বর্তমান নারী-প্রকৃতি পুরুষদের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার চিন্তা-চেতনা ও কর্মশক্তি অনুন্নত ও অনগ্রসর হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন পর্যন্ত। তাকে আপন মেধা ও প্রতিভাকে চর্চা করার সুযোগ দেয়া হয়নি বলেই তার এই অবস্থা। যদি তা না হত, পুরুষদের মত সুযোগ সুবিধা তারাও লাভ করতো, তাহলে আজ তাদের স্বভাব প্রকৃতি নাকি পুরুষদের মতই হত এমনকি তারা স্বাভাবিক যোগ্যতা, প্রতিভা ও কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে নাকি পুরুষদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারত।
কিন্তু যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এই যুক্তি মোটেও ধোপে টিকে না। স্বাধানীতা ও সুযোগ সুবিধা পেলে নারী সর্ব দিক দিয়ে পুরুষের সমান হতে পারত-এ সম্ভাবনা মেনে নিলে, সেরূপ না হতে পারার সম্ভাবনাকেও স্বীকার করতে হবে। কেননা এ দুটি সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে সমান মাত্রার। এ দৃষ্টিতে বলা যায়, নারীদের মধ্যেও যে পুরুষালী দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা রয়েছে বলে যে দাবি করা হয়, তার কোন ভিত্তি নেই। বিশেষতঃ নারীর বর্তমান মনস্তত্ত্ব ও যোগ্যতা-কর্মক্ষমতাই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, জীবন সংগ্রামে তার ক্ষেত্র পুরুষদের ক্ষেত্র হতে সর্বতোভাবে ভিন্নতর। আর পুরুষদের স্বভাবগত যোগ্যতা, কর্মক্ষমতাও নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, তাদের কর্মক্ষেত্র নারীদের হতে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া একান্তই আবশ্যক।
পুরুষদের অবিচার ও নিষ্পেষণই নারীকে তার অন্তর্নিহিত প্রতিভা ও যোগ্যতার বিকাশ ও প্রকাশ সাধন করতে দেয় নি এবং তার পথে প্রবল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তাও বহুলাংশে বাস্তবতার পরিপন্থী। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদগণ স্পষ্ট কন্ঠে বলেছেন, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী অবাধ ও উদার সুযোগ সুবিধা পেয়েও নিজের বিশেষ কর্মক্ষেত্রের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোন কীর্তি স্থাপন করতে পারে নি। নারীর উপর অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব অর্পিত হওয়া সত্ত্বেও সে তা স্বাধীনভাবে পালন করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বস্তুতঃ নারী স্বভাবতই অন্যের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য উদগ্র হয়ে থাকে। তার মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার বাসনা ও প্রেরণা পুরুষদের ন্যায় প্রবল নয়। এ কোন মনগড়া বা বিদ্বেষমূলক কথা নয়, এ সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক সত্য। মানবেতিহাসে এমন কোন কীর্তিমান নারীর নাম পাওয়া যায় না, যে পুরুষদের সাথে নিঃসম্পর্ক হয়ে স্বতন্ত্র ও নিজস্বভাবে মানবজাতির জন্য কোন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। মাদাম কুরি তাঁর স্বামী মি. কুরীর সঙ্গে থেকে বিজ্ঞানে, মিসেস ব্রাউনিং তাঁর জীবনসঙ্গী মি. ব্রাউনিং এর সঙ্গে থেকে কাব্যে এবং জর্জ ইলিয়ট মি. লউসের সঙ্গে থেকে উপন্যাস রচনায় যে অবদান রেখেছেন তা নিতান্তই সহযোগিতানির্ভর এবং এ সহযোগিতা এসেছে পুরুষদের নিকট হতে। ইতিহাসে একটা কালস্রোত এমনও অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন নারী পুরুষেরই সমান চেষ্টা সাধনার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকৃতি নারী ও পুরুষের মাঝে যে পার্থক্য রেখেছে, তা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। (আজকের পাশ্চাত্য জগতের দিকে তাকালেও এর একটা অকাট্য প্রমাণ চোখে পড়বে। সেখানে শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য, রাষ্ট্র-প্রশাসন ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই নারীর অবাধ পদচারণা; কিন্তু পুরুষের তুলনায় তার সাফল্য মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় ধরনের সমাজের বেলায়ই একথা প্রযোজ্য)।
এ কালেও এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বহু আলোক বঞ্ছিত সমাজে নারীরা বিশেষ কোন ক্ষেত্রে বন্দী হয়ে না থেকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করা সত্ত্বেও পুরুষদের সমান যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয় নি। বলা বাহুল্য, কোনদিন তা হতেও পারবে না।
বর্তমান সভ্য যুগটার কথাই একবার বিচার করা যাক। এ যুগে নারীরা পুরুষদের সমান স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা অন্ততঃ পাশ্চাত্য দেশসমূহে পেয়েছে বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এই স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা কি নারীদের দৈহিক সংগঠন ও প্রকৃতিতে কোন মৌলিক পরিবর্তন এনে দিতে পেরেছে? শারীরবৃত্ত (Physiology) অনুসারে নারী ও পুরুষের দৈহিক ও মগজ সংস্থানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। এই ব্যবধান যেমন প্যারিসের মত একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের লীলাভূমির অধিবাসীদের নিকট প্রকট, তেমনি প্রকট আমেরিকার জংলী অসভ্য জাতিগুলোর মাঝেও। বরং সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই স্বভাবগত পার্থক্যও তীব্র হয়ে উঠে। শ্বেতাঙ্গ নারী পুরুষদের মাঝে যেমন এই পার্থক্য, তেমনি কৃষ্ঞাঙ্গ নারী পুরুষের মাঝেও এই পার্থক্য নিঃসন্দেহে লক্ষ্যণীয়।
নারীকে যদি সামাজিক ও সামষ্টিক-সাংস্কৃতিক কাজ কর্ম হতে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, তাহলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গতি স্তিমিত হয়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস প্রচেষ্টার সাহায্যে সভ্যতা সংস্কৃতির যেসব পর্যায় ৫০ বছরে অতিক্রম করা সম্ভব, নারীদের বাদ দেয়া হলে সে সব পর্যায় একশ বছরেও অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। এ কথার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, নারী তাঁর স্বভাবজাত কার্যাবলীতে ব্যস্ত থেকে যেন সভ্যতা সংস্কৃতির কোন কল্যাণই সাধন করছে না। কিন্তু এ কথার কোন অকাট্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। কেননা সমাজ কোন প্রকৌশলগত প্রতিষ্ঠান নয়। বিশেষ এক ধরনের কাজে সকলে মিলে আত্মনিয়োগ না করলে সমাজের কোন উন্নতিই হবে না-এমন কথা কেবল অর্বাচীনরাই বলতে পারে। মানব জীবনের বিভিন্ন বিভাগের ভারসাম্যপূর্ণ সংযোজন ও সমন্বয়েরই নাম সমাজ। এ সমাজেরই বহু সংখ্যক বিভাগের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিভাগে ও বহু সংখ্যক ক্ষেত্রের মধ্যে বিশেষ একটি ক্ষেত্রে তৎপর রয়েছে আমাদের নারীকূল। এ ক্ষেত্রটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ ক্ষেত্র সে ত্যাগ করে চলে গেলে গোটা সমাজ প্রাসাদই সহসা ধ্বসে পড়বে।
সামাজিক উন্নতি ঘটে সমাজের সব কয়টা বিভাগের ভারসাম্যপূর্ণ ও সমন্বিত উন্নতি লাভে। চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা উন্নতি লাভ করে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পেশাগত আনুকূল্য সৃষ্টিতে। শ্রমিকদের উন্নতি ঘটে শ্রমকাজের সুযোগ-সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভে। একইভাবে সাংবাদিকদের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও ব্যবসায়ীর ব্যবসায়ে মুনাফা লাভে যেমন সামাজিক উন্নতি নিহিত, তেমনি নারীকে তার নিজস্ব ক্ষেত্র ও পরিবেষ্টনীতে সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হলেই তাদের উন্নতি লাভ সম্ভব। আর কেবল তখনই সামষ্টিক মান হতে পারে সমুন্নত।
সমাজের উন্নতির দোহাই দিয়ে শিল্প শ্রমিকদের চাষাবাদের কাজে, সাংবাদিকদের শিক্ষকতার পেশায় এবং ব্যবসায়ীদের প্রশাসন যন্ত্র চালাবার কাজে লাগান হলে যেমন কোন অগ্রগতির আশা করা যায় না, অনুরূপভাবে নারীকে পুরুষের কাজে নিয়োজিত করা হলেও আশা করা যায় না কিছুমাত্র কল্যাণের। তেমন করা হলে তাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলবে, এমন নির্বোধ এই পৃথিবীতে কেউ আছে বলে মনে করার এখনও কোন কারণ ঘটে নি।
পেশা পরিবর্তনের স্বাধীনতা অবশ্যই যে কারোই থাকতে পারে। এক পেশার লোক সেই পেশা ত্যাগ করে অন্য কোন কাজে লাগলে সে নিশ্চয়ই এমন কাজে লাগবে, যা করার তার প্রকৃতই যোগ্যতা রয়েছে। যে কাজ করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা আসলেই নেই, সেই কাজে অংশগ্রহণ করে যে কাজের যোগ্যতা আছে সে কাজটিকেও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার যুক্তি খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
বস্তুতঃ নারীর স্বভাবতই যে কাজের যোগ্যতা রয়েছে, তার জন্যে কেবল সেই কাজের পরিকল্পনাই নেয়া যেতে পারে। সে কাজ যদি হীণ ও নীচ ধরনের বলে মনে করা হয়, তাহলে নারীর স্রষ্টাকেই প্রশ্ন করা উচিত, তিনি তাকে নারী করে সৃষ্টি করলেন কেন? অথবা নারীর জন্য প্রথমে ইচ্ছামত একটা পরিকল্পনা তৈরি করে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আনবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া আর কি উপায় থাকতে পারে?
প্রশ্ন উঠতে পারে, নারী যে বিশেষ একটি ক্ষেত্রেই কাজ করতে পারে, এ মতটি কি একালে বদলে গেছে? না, যায় নি। বদলে যাওয়ার কোন কারণও ঘটে নি। সভ্যতার বর্তমান উন্নতি-অগ্রগতির মূলে নারীদের সর্বক্ষেত্রেই পুরুষদের সমান অবদান রয়েছে বলে দাবি করা হলে ইতিহাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী কথাই বলা হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও অগ্রগতিতে নারীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। এ ক্ষেত্রে নারী সমাজ উল্লেখযোগ্য কোন অবদানই রাখতে পারে নি। দর্শন ও বিজ্ঞানের কোন একটি বিভাগেও নারীর একক কোন মহান কীর্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তার কারণও রয়েছে। এসব কাজের ক্ষেত্র নারীর স্বভাব উপযোগী নয়। এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের কিছু করার যোগ্যতাও তার নেই। সে যদি এক্ষেত্রে পা রেখেও থাকে, তবে সে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক সত্তা। এক্ষেত্রে কাজ করার যত সুযোগ সুবিধা বা স্বাধীনতাই তাকে দেয়া হোক, পুরুষের কর্মক্ষমতা ও কাজের গতির সাথে তাল রেখে চলা তার পক্ষে সম্ভবই নয়। একালের পাশ্চাত্য চিন্তাবিদরাই এ সত্য অকপটে স্বীকার করেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে একজন স্বল্পশিক্ষিত পুরুষ ও এক উচ্চশিক্ষিতা নারীর তুলনায় অনেক বেশি অবদান রাখতে সক্ষম। কেননা নারী পুরুষ উপযোগী কাজ করতে গেলে তার নারীত্বই সে কাজের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলতে হয়, এ কালে নারীদের যে দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের স্বভাবগত প্রবণতাই সেদিকে চলতে অস্বীকার করেছে। ফলে নারীর সত্যিকার কোন কল্যাণ করা হচ্ছে না, বরং তার সাথে করা হচ্ছে মহাশত্রুতা। একালের নারীদের একান্তভাবে ঘর-গৃহস্থালীর কাজ করতে না দিয়ে ব্যাপকভাবে তাদের অফিস বিপণী ও সিনেমা নাটকের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে পুরুষরা কেবল বাইরের কাজ করে অবসর পেলেও নারীকে ঘর ও বাইর উভয় ক্ষেত্রেই কলুর বলদের মত খেটে যেতে হচ্ছে। এহেন মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে সৃষ্টিলোকের অন্য কোন প্রাণীকেই আজ পর্যন্ত পড়তে হয়নি। প্রখ্যাত মনীষী আর্নল্ড টয়েনবী বলেছেনঃ দুনিয়ার পতন যুগ সাধারণভাবে তখনই সূচিত হয়েছে, যখন নারী ঘরের চার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে বাইরে পা রেখেছে।
প্রাচীনকালের ইতিহাসেও এর বহু প্রকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর গ্রীস উন্নতির উত্তুঙ্গ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু তখন নারী ছিল ঘরের সৌন্দর্য। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর পর নগর কেন্দ্রিক রাষ্ট্রসমূহের পতনকালে বর্তমানকালের ন্যায়ই এক নারীমুক্তি আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনই গ্রীসের সামাজিক পতন ও বিপর্যয়ের সূচনা করেছিল। টয়েনবীর বিশ্লেষণ থেকে একথা স্পষ্টভাবে জানা গেছে।
বস্তুতঃ নারীর আসল স্থান তার ঘর। এই ঘর ছেড়ে দিলে যে পতন ও বিপর্য্য় সূচিত হয়, তার দুটি কারণ হতে পারেঃ একটি এই যে, এর ফলে সমাজের মৌল উৎস-কেন্দ্রই অচলাবস্থার সম্মুখীন হয় এবং বহু সমস্যাই নিষ্পত্তিহীন ও অসম্পাদিত অবস্থায় থেকে যায়। কেননা যে নারীর নিপুণ হস্ত এই সমস্যার সমাধান করবে, তাই সেখানে অনুপস্থিত। এ কাজ নারীর পরিবর্তে পুরুষদের দ্বারা কখনোই সম্পাদিত হতে পারে না। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে, এর ফলে নারী ও পুরুষ-উভয়ের তৎপরতা ও কর্মব্যবস্থা এমন একটা দিকে চলতে থাকে, ইতিহাসের সিদ্ধান্ত অনুসারে যেদিকে চলে কেউ কোনদিন সাফল্য বা কিছুমাত্র কল্যাণ লাভ করতে পারে নি।
এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, সমাজে নারী ও পুরুষদের সঠিক স্থান কি এবং এ দুয়ের মাঝে সম্পর্কের সঠিক রূপ কি-তা নির্ধারণ করতে প্রাচীনকালের মতবাদগুলো যেমন অসমর্থ হয়েছে, তেমনি করুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে একালের নব্য মতবাদগুলো ও। কাজেই সমাজে নারী ও পুরুষের সঠিক স্থান এবং এ দুয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের স্বভাবগত ও যথার্থ রূপ নির্ধারণের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ ও অনাসক্ত চিন্তা বিবেচনার প্রয়োজন বর্তমানে অত্যন্ত তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই চিন্তা-বিবেচনার প্রসঙ্গে কয়েকটি মৌলিক বিষয় চোখের সামনে চির উদ্ভাসিত রাখা আবশ্যক। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, মানুষকে যে দুই লিঙ্গে বিভক্ত করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা কিছুমাত্র নিরর্থক বা উদ্দেশ্যহীন নয়। এই দুই লিঙ্গের পারস্পরিক ও সম্মিলিত সহযোগিতায়ই মানব বংশের ধারা শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে অব্যাহতভাবে চালু রাখা সম্ভবপর হয়েছে। ফলে যে লিঙ্গের লোককে স্বভাবতইঃ যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তার দ্বারা ঠিক সেই কাজই গ্রহণ করা হলে কোন অসুবিধা বা বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকতে পারে না। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেকের স্বভাবগত যোগ্যতা সৃষ্টি-উদ্দেশ্যের পূর্ণতা বিধানে নিয়োজিত হলেই স্বাভাবিক নিয়মের সাথে সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলা সম্ভবপর হতে পারে।
আর এজন্য পুরুষ ও নারীর কর্মক্ষেত্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হওয়া আবশ্যক। কিন্তু তাই বলে বিশেষ এক লিঙ্গের লোকদের মধ্যে বিশেষ ধরনের যোগ্যতা থাকার কারণেই তাদের অপর লিঙ্গের লোকদের ওপর অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছনীয় ধরনের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দিতে হবে, এমন কোন কথা নেই; বরং সামাজিক ব্যবস্থা এমন হতে হবে, যার ফলে দুই লিঙ্গের কোন লোকই যেন নিজের জন্য নির্দিষ্ট কাজকে কোনরূপ গর্ব-অহংকার কিংবা লজ্জা অপমান লাঞ্ছনা ও হীনতা-নীচতার কারণ বলে মনে করতে না পারে। প্রত্যেকেই যাতে স্বীয় স্বভাবজাত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে সম্মান ও মর্যাদা লাভের অধিকারী হতে পারে, তার সুযোগ থাকতে হবে। পক্ষান্তরে নর-নারীর স্বভাব প্রকৃতি বিরোধী কর্মকান্ড ও চেষ্টা-সাধনাকে কোনক্রমেই চলতে দেয়া উচিত হবে না। এইরূপ ব্যবস্থার ফলে প্রত্যেক লিঙ্গের লোকেরাই নিজেদের বিশেষ ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি লাভের অধিকারী হবে। আর তার বাইরে তাদের তৎপরতা যতদূর সম্ভব কম করে দিতে হবে।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, এইরূপ ব্যবস্থা হলেই কি পুরুষ অবলা নারীদের সাথে মমতাভিত্তিক আচরণ গ্রহণ করবে এবং অধিকার ও মর্যাদা প্রশ্নে তাদের প্রতি সুবিচার করবে? নারীদের দুর্বল মনে করেইতো আবহমানকাল হতে পুরুষরা তাদের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে এসেছে, নিজেদের দাসত্ব নিগড়ে বন্দী করে রেখেছে। দুর্বলদেরকে দুর্বল করে রাখতেই যে তারা তৎপর হবে এবং কোনক্রমেই মাথা তুলে মানুষের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে দিবে না, অভিজ্ঞতার আলোকে এ আশংকাই তো প্রবল হয়ে দেখা দেয়। তাহলে প্রস্তাবিত স্বভাবসম্মত ব্যবস্থা সমস্যার কতটা সমাধান দিতে পারবে?
এ প্রশ্নের জবাবে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে, উপরে যে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে তাতে এরূপ আশঙ্কার সম্ভাবনা আদৌ থাকবে না। কেননা নারীদের প্রতি পুরুষদের যে অমানুষিক আচরণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা নিতান্তই অস্বাভাবিক কর্মকান্ডের পরিণতি। নারী ও পুরুষ নিজ নিজ স্বভাবসম্মত কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করে যে অস্বাভাবিকতার আশ্রয় নিয়েছে ও স্বাভাবিকতার সীমা লংঘন করেছে, তারই ফলে এরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া সম্ভবপর হয়েছে। সেখানে উভয়ের আচরণে যদি স্বাভাবিকতাকে ভিত্তি করা হত, তাহলে এই অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারত না। কাজেই স্বাভাবিক অবস্থায় অস্বাভাবিকতা যে আপন আপনি বিদূরিত হবে, তা খুবই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, সমাজের স্বাভাবিক অবস্থা রক্ষার জন্য অনুকূল আইন বিধানের বলিষ্ঠ সক্রিয়তা অপরিহার্য। স্বাভাবিক অবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য উভয় লিঙ্গের সুষ্ঠ সঠিক শিক্ষণ প্রশিক্ষণের ব্যাপক ব্যবস্থা থাকার সঙ্গে সঙ্গে যদি কঠোর নিশ্চিত জবাবদিহি ও শাসন প্রশাসনের ভয় প্রকটভাবে কার্যকর থাকে এবং প্রশাসন ব্যবস্থাও থাকে অতীব সবল, তাহলে কোন পক্ষ হতেই উল্লেখিত ধরনের অবাঞ্ছিত আচরণের আদৌ কোন আশংকা থাকতে পারে না। এই ব্যবস্থায় নারী অবস্থান হবে সুদূঢ়। তার স্বভাবগত দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তাকে মজলুম ও দারিদ্র প্রপীড়িত করে রাখা সম্ভবপর হবে না। বলা ও লেখনী চালনার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য সমাজের সম্মুখে তুলে ধরার পূর্ণ অধিকার থাকবে নারীর। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ব্যবহারের সমান অধিকার থাকবে তাদের। তাদের ওপর কোনরূপ অবিচার করার ক্ষমতাও থাকবে না কারো। তাদের জান-মাল ও ইজ্জত আব্রু হবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। পিতা-মাতা, স্বামী, প্রশাসক কেউই তাদের ওপর কোনো বেআইনী কাজের চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। আইনের এই কঠোরতা সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের মধ্যে নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ এবং স্নেহ ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা হবে।
এ যদি বাস্তবিকই করা যায়, তাহলে নারী পুরুষের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন করে দিলে এবং প্রত্যেককে তার স্বভাবগত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করার এবং উন্নতি অগ্রগতি লাভের সুযোগ দেয়া হলে কোন সমস্যাই থাকবে না। বস্তুতঃ এইরূপ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মুখে নিপতিত বর্তমান বিশ্ব-মানবতাকে রক্ষা করা সম্ভব। শুধু রক্ষাই নয়, তাকে উত্তরোত্তর প্রকৃত কল্যাণের অধিকারী বানানোও এ পন্থায়ই সম্ভব হবে, একথা দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়।
বলা বাহুল্য, এইরূপ স্বভাবসম্মত ব্যবস্থা দুনিয়ার বুকে উপস্থাপন করেছে কেবলমাত্র আল্লাহর প্রদত্ত দ্বীন ইসলাম। ইসলামই যে মানবতার জন্য স্বভাবসম্মত দ্বীন-জীবন ব্যবস্থা-তাতে কোনই সন্দেহ নেই।