নর নারীর যৌন সম্পর্ক
মৌলিক প্রশ্ন
নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক মানব জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরতিশয় জটিল ব্যাপার। এই সম্পর্কে স্বরূপ কি কি হওয়া বাঞ্ছনীয়, তা এক প্রাচীনতম প্রশ্ন। এই প্রশ্নের মধ্যে কেবলমাত্র যৌন লালসা ও প্রবৃত্তির চরিতার্থতারই ব্যাপার জড়িত নয়, বংশ রক্ষার ব্যাপারটিও গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কেননা যৌন সম্পর্ক ছাড়া এই দুটি সমস্যার সমাধানের স্বভাবসম্মত পন্থা আর কিছু হতে পারে না। প্রাচীন কালের লোকেরা যৌন কামনা সম্পর্কে নানাবিধ ভুল ধারণার মধ্যে ছিল। অনেকে মনে করত, এই কামনা একটি অদৃশ্য শক্তি এবং মানুষের জীবন মরণ এর উপর নির্ভরশীল। এককালের মানুষ যৌনশক্তি ও প্রবৃত্তির তাড়নাকে এক দৈবশক্তির প্রভাব বলে বিশ্বাস করে এই শক্তির প্রতিমূর্তি বানিয়ে পূজা উপাসনা করত। অনেকে যৌন অঙ্গের আকার আকৃতি বানিয়ে তারই পূজা করত। দুনিয়ার কোন কোন ধর্মে যৌনপ্রবৃত্তির পূজা একটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান রূপেই গণ্য হত।
এই সবের মূলে লোকদের বংশরক্ষার বাসনাটাই প্রবলভাবে কাজ করেছে। এই পর্যায়ে নানা জটিল প্রশ্ন তাদের মনে উদয় হত। ভূমিষ্ট সব শিশুকেই তারা রক্ষা করবে, না কেবলমাত্র কাজে আসতে পারে এমন সন্তানদের বাঁচাবে ও লালন করবে, এটা ছিল তাদের কাছে এক জটিল প্রশ্ন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, ভূমিষ্ট শিশুদের লালন পালনের দায়িত্ব কে নেবে? এ দায়িত্ব কেবল নারীর অর্থাৎ মায়ের? কিংবা পুরুষদের? অথবা নারী পুরুষ উভয়ের?
তাছাড়া জীবন জীবিকা, ধন মাল ও দ্রব্য সামগ্রী বিলি বন্টনের ব্যাপারটিও তাদের জন্য বিশেষ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। এসব প্রশ্নই অধিকতর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি লাভ করে অবশেষে গোত্র, জাতি ও রাষ্ট্রের রূপ নেয়। আর এভাবেই প্রাচীন লোকদের সামাজিক সংস্থা গড়ে উঠত। তাদের গোত্রীয় জীবন কখনও কখনও মাকে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয়েছে। তখন পিতা শ্রম মেহনত করে জীবিকা উপার্জন করলেও মা পূর্ণ মালিকানা ও কর্তৃত্ব নিয়ে সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য লোকজনদের জন্য তা ব্যয় করত। সন্তানরা তখন মায়ের নামেই পরিচিত হত। আবার কোথাও পিতাই হত পরিবারের সর্বেসর্বা-একচ্ছত্র কর্তা।
এভাবে পারিবারিক সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন রূপের সঙ্গে সঙ্গে যৌন সম্পর্কের রূপও পরিবর্তিত হত। কোথাও এই সম্পর্ক সাময়িক, কোথাও তা স্থায়ী বন্ধন হয়ে থাকত। কোথাও তা নারী পুরুষের ইচ্ছা ও সম্মতির ওপর নির্ভরশীল হত। আবার একক বিয়ের প্রচলনও ছিল কোথাও কোথাও অর্থাৎ এক স্বামী, এক স্ত্রী। কোথাও একজন স্ত্রীর সাথে পরিবারের সব পুরুষেরই যৌন সম্পর্ক স্থাপনের নিয়ম ছিল। আবার কোথাও এক স্বামী বহু স্ত্রী গ্রহণ করত। মোটকথা, মানব ইতিহাসে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ এমনও অতিবাহিত হয়েছে, যখন বিয়ে ও পারিবারিক নিয়মের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম কার্য্কর ছিল না।
পারিবারিক জীবন সংস্থার এই বৈচিত্র্যের মূলে কোন অর্থনৈতিক কার্য্যকারণ ছিল না। যৌন কামনা চরিতার্থতার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে মাত্র। যৌন কামনাই বরং সামাজিক দাবির ওপর বিজয়ী হয়েছে অনেক সময়। ফলে সমাজকে কঠিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। মানুষের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। বিশৃঙ্খলা, মারামারি, কাটাকাটি ও যুদ্ধ বিগ্রহ প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। এক কথায় বলা যায়, যৌন লালসা নিবৃত্তির আবেগে মানুষের সামাজিক ও তামাদ্দুনিক জীবন দুঃসহ বিপর্য্য্যের মধ্যে পড়েছে।
বৈরাগ্যবাদ
এইরূপ অবস্থায়ই দেখা দিয়েছে বৈরাগ্যবাদ। চারদিকে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার সয়লাব লক্ষ্য করে এক শ্রেণীর মানুষ বিবাহ ও পরিবার জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। নারী পুরুষ একে অন্যের সাথে যৌন সম্পর্ক একে সম্পূর্ণ বর্জন করে চলবার প্রবণতাও ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ নয় বরং তাকে কঠোরভাবে দমন করতে দুঃসহ কৃচ্ছ্রসাধানায় লিপ্ত হয় মানুষ। গোটা খৃস্টধর্ম উত্তরকালে এই বৈরাগ্যবাদী নীতির ওপর সংস্থাপিত হয়। পুঁতিগন্ধময় আবর্জনা পরিহার করার মতই ধর্মে বিশ্বাসী লোকেরা যৌন সম্পর্ককে সম্পূর্ণ বর্জন করে চলতে শুরু করে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিদ্বেষ, বিতৃষ্ঞা ও অনাশক্তি তখন এতই প্রবল হয়ে দেখা দেয় যে, খৃস্টধর্মে দীক্ষিত লোকেরা নিজেদের গর্ভধারিনী মা এবং সহোদরা বোনদের সাথেও সাক্ষাত করতে চাইতো না। গোটা মানবতাকে যেন বৈরাগ্যবাদের এই ব্যাধি অক্টোপাশের মত আকড়ে ধরেছিল। কেবল খৃস্ট ধর্মই নয়, অন্যান্য অনেক ধর্মমতই এই বৈরাগ্যনীতিকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ সব ধর্মে যৌন কামনা বাসনার চরিতার্থের কোন ভারসাম্যপূর্ণ বিধান নেই। যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা রোধ করার কোন সুষ্ঠু নীতি বা আদর্শই দিতে পারেনি এসব ধর্ম; বরং তাতে যৌন প্রবৃত্তি ও যৌন সম্পর্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শিক্ষা রয়েছে। অথচ যৌন প্রবৃত্তি অবদমিত করে রাখা সম্ভব নয়। যৌন সম্পর্ক পরিহার করা মানব স্বভাব ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ ধর্মগুলো তা-ই করতে চেয়েছে বলেই উত্তরকালে এসব ধর্মে বিশ্বাসী লোকদের মধ্যে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছে স্বাভাবিকভাবে। বস্তুতঃ স্বাভাবিক যৌন প্রবৃতি ও সম্পর্কের পথে যেখানেই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে, সেখানেই তার তীব্র প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অবৈধ পন্থায় এর চরিতার্থতার প্রবণতা ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছে। খৃস্ট ধর্মের অন্যতম প্রধান দিকপাল গ্রেট পোপ জন পর্যন্ত নিজের সহোদরা বোনের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। কাটার বারির পুরোহিত ১১৭১ সনে কেবল একটি মাত্র স্থানেই ১৭টি অবৈধ সন্তানের পিতারূপে চিহ্নিত হয়েছে। স্পেনের একজন খৃস্টান পুরোহিত ১৯৩০ সনে ৭০ জন মেয়ে দাসীকে নিজের যৌন দাসী রূপে ব্যবহার করেছে। তৃতীয় হেনরীর পাদ্রী ১২৭৪ সনে ৬০টি অবৈধ সন্তানের জন্মদাতা ছিল। এভাবে খৃস্টান পাদ্রীদের উপাসনাগুলো খোদার উপাসনার পরিবর্তে ব্যভিচারের লীলাকেন্দ্রে পরিণত হয়। ব্যভিচার প্রবণতা তাদের এতই সীমালংঘন করে যে, তাতে আপন পর, রক্ত সম্পর্ক এবং মুহাররাম ও গায়র মুহাররামের কোন পার্থক্যও তারা রক্ষা করেনি। এ কারণে খৃস্ট ধর্মে পাদ্রীদের জন্য বারবার এই বিধান জারি করতে হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের মা ও বোনদের কাছেও না যায়। বস্তুতঃ খৃস্ট ধর্মের প্রচারকরাই এইসব অপকর্মে অধিক পটু ও পারদর্শী বলে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বাদশ শতকে একজন পাদ্রী ইংল্যান্ডে ধর্ম প্রচারে গমন করে। দীর্ঘক্ষণ ওয়াজ নসীহত করার কয়েক ঘন্টা পরই তাকে একটি বেশ্যার ওপর যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জঘন্য কাজে লিপ্ত দেখা যায়। আসলে এ হচ্ছে বৈরাগ্যবাদের প্রতিক্রিয়া। পাদ্রীদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ হওয়ার বিষাক্ত ফল।
বস্তুতঃ মানুষের মধ্যে যৌন কামনা চরিতার্থ করার যে স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে, কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমেই তার নির্বিঘ্ন, শান্তিপূর্ণ ও বৈধ চরিতার্থতা সম্ভব। কিন্তু এই বিবাহ যদি বর্জিত হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কেবল ব্যক্তি জীবনকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় না, গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেও বিদীর্ণ করে তোলে। অনেক সময় বিবাহ বর্জনকারী পুরুষ বা নারী মানসিক সুস্থতা হারিয়ে সোজা পাগল হয়ে যায়। ১৯৫৭ সালে একদল বৃটিশ বিশেষজ্ঞ বহু সংখ্যক মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত লোককে এই বলে পরামর্শ দিয়েছিল যে, তোমরা যদি নানাবিধ মানসিক রোগ ব্যাধি হতে রক্ষা পেতে চাও, তাহলে অবিলম্বে বিয়ে কর। জীব বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও বিয়ে নারী পুরুষ উভয়ের সুস্থ জীবন যাপনের জন্য একান্ত জরুরী। কিছুকাল আগে জাতিসংঘের ব্যবস্থায় দুনিয়ার সতেরটি দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ মিলিতভাবে গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এসব দেশের বিবাহিত নারী পুরুষের বয়সের গড় ৫৭ বছর আর অবিবাহিত নারী পুরুষের বয়সের গড় মাত্র ৩৯ বছর। বিবাহিতা নারীরা সকলের তুলনায় অনেক বেশী বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
বৈরাগ্যবাদী জীবন যাত্রা যৌন সম্পর্ক পরিহার করার মারাত্মক ক্ষতি কেবল ব্যক্তি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখে না, সামাজিক জীবকেও তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। লোকদের অপকর্ম ও চরিত্রহীন কার্যকলাপের পরিণামে যদি মহৎ ও পবিত্র সামাজিক সম্পর্কও কলঙ্কিত ও পঙ্কিল হয়ে যায়, তা হলে সব রকমের সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কও বিনষ্ট ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
বস্তুত যৌন স্পৃহা ও প্রবৃত্তিকে যদি কৃত্রিমভাবে বা কৃচ্ছ্র সাধনার পন্থায় অবদমিত করা হয়, তা হলে তার পরিণামে গোটা মানব সভ্যতাই দারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে এক অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য পরিণতিরূপে। সামাজিক জীবন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাওয়াও নিতান্তই অবধারিত।
অবিবাহিত জীবন যাপন যেমন স্বভাব-বিরুদ্ধ, তেমনি তা মানবতারও শত্রু। নারী ও পুরুষের মাঝে পারস্পরিক যে যৌন আকর্ষণ স্বভাবতঃই বিদ্যমান, তার চরম লক্ষ্য মানব বংশের ধারা অব্যাহত রাখা। অবিবাহিত জীবন এই লক্ষের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ আকর্ষণ স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করে যে, এখানে যারা বর্তমানে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকার অধিকার কেবল তাদেরই নয়, তাদের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরও মানবতার ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। আর মানব বংশ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যেই নারী পুরুষের মধ্যে যৌন আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবে রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু অবিবাহিত জীবন ধারা এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি এই প্রকৃতিগত দাবীর জবাবে যেন বলে দেয় যে, এই জমিনের উপর আমার একার বোঝাই দুর্বহ। এই দাবি পূরণ করতে গিয়ে আমার আত্মাকে কেন অপবিত্র করব? মানবতার এই বাগান যদি উজাড়ও হয়ে যায় , তাতে আমার কি? আমিতো নিজেকে দুনিয়ার কাঁটায় জর্জরিত করতে পারি না।
অবাধ যৌন চর্চা
এই বৈরাগ্যবাদী নীতির পাশাপাশি আর একটি ভাবধারা আদিকাল হতে চলে আসছে। তা হল অবাধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের নীতি। এই নীতির সার কথা হল, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের দাবি যখন একটা স্বাভাবিক দাবি, তখন অপরাপর স্বাভাবিক দাবির ন্যায় এই দাবি পূরণেরও অবাধ ও উন্মুক্ত ব্যবস্থা ও সুযোগ সুবিধা থাকা আবশ্যক। তাতে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য বা হালাল-হারামের কোন প্র্রশ্ন উঠতে পারে না। সেরূপ প্রশ্ন উঠলে তা হবে তাদের এই স্বাভাবিক দাবির প্রতিবন্ধক। অতএব যখন, যেখানে এবং যেভাবেই ইচ্ছা ও সম্ভব হবে, তখন সেভাবেই তার পরিপূরণের অধিকার থাকতে হবে।
বস্তুত বৈরাগ্যবাদ হচ্ছে যৌন পরিতৃপ্তি ও তার ধ্বংসকারিতার বিরুদ্ধে একটা পলায়নী মানসিকতা। আর অবাধ যৌন সম্পর্ক হচ্ছে মানবতার সংকল্প ও সাহসিকতার পরাজয় এবং দুষ্প্রবৃত্তির মোকাবিলায় সুপ্রবৃত্তির চূড়ান্ত নৈরাশ্যের ঘোষণা। প্রথমটি স্বভাবসিদ্ধ ভাবধারার একদিকের সীমালংঘন। আর দ্বিতীয়টি সেই স্বভাবসিদ্ধ ভাবধারার আর এক সীমান্ত অতিক্রমন। এই দুটিই স্বভাব ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়োগের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। প্রথম ভাবধারাটি মা ও বোন প্রভৃতি অতি আপনজনের সংস্পর্শও পরিহার্য করে তোলে। আর দ্বিতীয় ভাবধারাটি কাউকেই নিষ্কৃতি দিতে প্রস্তুত নয়। এটি চায় সর্বপ্রকার লালসা ও ভোগ উপভোগের অবাধ অধিকার। এ মত অনুযায়ী যে কোন নারী পুরুষ যেখানে এবং যখনই ইচ্ছা হবে, যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে পারবে। তাতে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ও ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবাঞ্ছনীয়। দুনিয়ায় বেশ্যা প্রথা চালু হওয়ার মূলে এই ভাবধারাই কাজ করেছে। এজন্যে বহু সমাজে বেশ্যাবৃত্তিকে বিশেষভাবে উৎসাহদান করা হয়েছে, যেন পূর্ণ স্বাধীনতা ও নির্ভীকতা সহকারে অবাধে যৌন লালসা মেটানো সম্ভব হয়।
বস্তুত একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ও অবাধ যৌন স্বাদ আস্বাদনের প্রাবল্য মানবেতিহাসের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। কখনও এই ব্যবস্থাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন বলে প্রচার করা হয়েছে, আবার কখনও এটাই প্রকৃতির দাবি বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করা হয়েছে এবং কোথাও একে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে মানুষের যৌন লালসার অবাধ নিবৃত্তি স্পৃহাই যে প্রধানত কাজ করেছে, তা অবশ্যই স্বীকার্য।
ইসলামের আগমনের পূর্বে সমগ্র আরব দেশে প্রায় এই ভাবধারারই ব্যাপক প্রভাব ও প্রসার ছিল। তখন সাধারণত চারটি পন্থায় যৌন বাসনা চরিতার্থ করা হত। প্রথম, যথারীতি বিবাহ ব্যবস্থা। বিয়ে করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে, প্রথমতঃ তার অভিভাবকদের নিকট প্রস্তাব পেশ করত। এই প্রস্তাব গৃহীত হলে নিয়মিত ‘মহরানা’ দিয়ে বিয়ের কাজ সমাধা করে দেয়া হত। দ্বিতীয়, প্রখ্যাত ও অভিজাত বংশীয় কোন ব্যক্তির ঔরসজাত সন্তান লাভ করার উদ্দেশ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে সে ব্যক্তির নিকট রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিত এবং যতদিন গর্ভলক্ষণ প্রকাশ না পেত, ততদিন সে নিজে স্ত্রী মিলন হতে বিরত থাকত। তৃতীয় পন্থা িএই ছিল যে, দশজনের কমসংখ্যক পুরুষ একজন রমনীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত। এর ফলে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে স্ত্রীলোকটি নিজে সেই সন্তানের পিতা নির্দিষ্ট করে দিত। তখন এই স্ত্রীলোকটিও তারই হয়ে যেত। আর চতুর্থ পন্থা এই ছিল যে, আরব দেশে রীতিমত বেশ্যারা দেহ ব্যবসা চালাত। তারা নিজেদের ঘরের দরজায় ঝান্ডা উঁচিয়ে রাখত। তাদের নিকট যাওয়ার ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার অবাধ অনুমতি ছিল সকলের জন্য। এর ফলে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করত, গণকের সাহায্যে সেই সন্তানের পিতাকে সনাক্ত করে নেয়া হত। তাকে এই সন্তানের পিতৃত্ব অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হত।
তখন এই উপমহাদেশে নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের দু/একটি নয়, আটটি পদ্ধতি চালু ছিল। আর বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এই আটটি পদ্ধতিই সমাজ কর্তৃক বৈধ ও পবিত্ররূপে স্বীকৃত ছিল। বন্ধ্যা নারীরা সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে পূজারীদের সাথে রাত্রি যাপন করত। আর তা সমাজের নিকট কিছুমাত্র দোষণীয় ছিল না। মদীনায় জনৈক ইয়াহুদী রাজা একটা অদ্ভূত আইন জারী করে রেখেছিল। সে আইন বলে যে মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হত, তাকে স্বামীর সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বে সেই ইয়াহুদী রাজার সাথে অন্ততঃ একটি রাত্র যাপন করতে হত। অন্যথায় তাকে কঠোর দন্ডে দন্ডিত করা হত।
বস্তুতঃ নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের নিয়ম ও পদ্ধতি সারা দুনিয়ায় কোন দিনই অভিন্ন ছিল না। যৌন উচ্ছৃংখলতা ছিল প্রায় সব যুগে, মানব সভ্যতার প্রায় প্রতিটি স্তরে ও পর্যায়ে এবং প্রতিটি সমাজে ও স্থানে। কিন্তু সে সঙ্গে একথাও সত্য যে, তাকে কোন দিনই স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয় বলে মনে করা হয় নি। শত-সহস্র রকমের চরিত্রহীন কর্মকান্ড সত্ত্বেও চারিত্রিক পবিত্রতা ও তাকওয়া পরহেজগারীই মানবতার উন্নতমানের নৈতিক আদর্শরূপে সর্বকালেই স্বীকৃত ছিল। জীব জন্তুর ন্যায় যথেচ্ছ যৌন লালসা চরিতার্থ করার অবাধ সুযোগ সুবিধা ও তার সপক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি বিশ্লেষণ নিতান্ত একালের একটা বিশেষ বিশেষত্ব এবং একটা বিশেষ অবদান। কেননা একালে ধরে নেয়া হয়েছে যে, ‘মানুষ বিশেষ কোন উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি নয়’, সে নিতান্তই জীব জন্তুর বংশধর ও জীব জন্তু ছাড়া আর কিছু নয়। এটা ঊনবিংশ শতকেরই একটা দার্শনিক চিন্তা মাত্র। জীব জন্তু তার ইচ্ছা বাসনা পূরণে কোন পন্থা অবলম্বন করেছে, এ বিষয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা যায় না, তেমনি মানুষ সম্পর্কেও এই ধরনের প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর। কিন্তু মানুষ নিজেকে জন্তু বলে মেনে নিতে কোনদিনই রাজী হতে পারে না। মানুষকে যে একালে ভুল বুঝানো হয়েছে, সে ভ্রান্তির জাল এক্ষনে বহুলাংশে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। ফলে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট চারিত্রিক পাশবিকতার ধারণা একালেই ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। একালের সজ্ঞাসম্পন্ন ও সচেতন বিবেকবান মানুষ এই দর্শনের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু মানুষকে পশু বানাবার ও পশু চরিত্রে ভূষিত করার ষড়যন্ত্রে যেসব প্রক্রিয়া উদ্ভাবন ও সাজ সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা এখনও বিশ্ব মানবতাকে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরে আছে। নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নাচ গানের আসর, বিচিত্রানুষ্ঠান, থিয়েটার ও সিনেমা এবং বেশ্যা প্রথা মানুষকে চরিত্রহীন পশু বানাবার উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। একালের রেডিও টেলিভিশন এর সামগ্রিক ভূমিকাও ভিন্নতর কিছু নয়। একালের সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা, উপন্যাস ও নাটক এ একই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রয়েছে। দেশব্যাপী যৌন অপরাধ, বলাৎকার, নারী হরণ, নারী লাভের প্রতিদ্বন্ধিতায় হত্যাকান্ড, যৌনরোগ এবং মারামারি, কাটাকাটি ইত্যাদির বড় কারণই হল এসব উপায় উপকরণ। এসবকে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত ও সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত করা না হলে এমন একটা সময় উপস্থিত হওয়া একান্তই অবধারিত, যখন সমগ্র দেশ গুন্ডা-বদমাঈশ, চোর-ডাকাত, লুন্ঠনকারী, ছিনতাইকারী, ব্যভিচারী ও নারী হরণকারীদের লীলাভূমিতে পরিণত হবে। ইতিমধ্যেই পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। এখনতো ছিনতাইকারীরাই আমাদের যুব সমাজের নিকট হিরো রূপে সম্মানার্হ। নারী হরণও একালে বীর জনোচিত কর্ম বলে গৃহীত। যু্বক বয়সের ছেলে মেয়েরা বাপ মাকে না জানিয়েই পরস্পরকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয় অবলীলাক্রমে। সমাজের নৈতিক অধঃপতন বর্তমানে কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এ থেকেই তা খানিকটা অনুমান করা চলে।
অশ্লীল বইপত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এখনকার সাহিত্যের বাজারে। আবহমান কাল ধরে লালিত নৈতিক মূল্যবোধকে বিনাশ করে চলছে এসব নোংরা বইপত্র। মাদক দ্রব্যের ব্যবহার বর্তমানে কোন বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নারী পুরুষ ও শিক্ষিত অশিক্ষিতদের মধ্যে এদিক দিয়ে কোনই পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না।
প্রতিক্রিয়া
বস্তুতঃ যৌন আকাঙ্খা মানব জীবনে সর্বাধিক আকর্ষণীয়, মোহময় ও আবেগপূর্ণ এক প্রবৃত্তি। মানুষকে মাতাল, দিশেহারা-েএমনকি কান্ডজ্ঞানশূণ্যও করে দেয় তা। এই দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে একমাত্র পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষার ধারণা। কিন্তু বর্তমানকালে এই ধারণাকে ‘সেকেলে’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে মুল্যহীন ও গুরুত্বশূণ্য করে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবন্ধক ছিল অবৈধ গর্ভসঞ্চারের ভয়। কিন্তু বর্তমানে গর্ভ-নিরোধক উপকরণ এবং ‘ভেসেক্টমী’ ও ‘লাইগেশন’ ব্যবস্থা এই ভয়কে সম্পূর্ণরূপে অমূলক ও ভিত্তিহীন বানিয়ে দিয়েছে। ফলে মানুষ এখন ঠিক জীব-জন্তুর মতই নির্ভীকভাবে ‘পাশবিক জীবন’ যাপনের ‘সৌভাগ্য’ (!) অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
এভাবে আধুনিক সমাজ মানুষের নৈতিক চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দিয়েছে। নারী ও পুরুষের দায়িত্বজ্ঞানকেও করেছে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সত্যিকার অর্থে আজকের মানুষ একেবারে নিঃস্ব, সর্বহারা। মানব সভ্যতার স্তম্ভসমূহ বিধ্বস্ত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে। মানুষ যেন নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে প্রস্তুত নয়। বিশেষ করে যৌন ব্যাপারে কোন রকমের নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ম নীতি পালনের বাধ্য বাধকতাকেও সে বরদাশত করতে রাজী নয়।
এ ধরনের লালসা পন্কিল মন মানসিকতার লোকেরা সর্বক্ষেত্রে নিতান্ত স্বার্থপর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা নিজেদের যৌন প্রবৃতির চরিতার্থতার জন্য যে অসহায় ও দুর্বল নারীকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তার কঠিন বিপদের দিনেও তার প্রতি একবিন্দু সহানুভূতি ও সহৃদয়তা পোষণ করে না, বরং নিজ বাসনা পরিপূরণের পরই তারা পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তারা না স্বীকৃত হয় কোন ধর্ষিতা নারীর স্বামীত্ব গ্রহণ করতে, না প্রস্তুত হয় সেই নারীর গর্ভে সাময়িক দুর্বলতার সুযোগে সঞ্চারিত সন্তানের পিতৃত্বের দায়িত্ব নিজের মাথায় তুলে নিতে।
এরূপ মানসিকতার ফল সমাজ জীবনে অত্যন্ত মর্মান্তিক হয়ে দেখা দিয়েছে। এ কারণে নারী পুরুষের যৌন জীবনে কোন স্থিতি বা দৃঢ়তা গড়ে উঠতে পারে নি। অথচ এই সম্পর্কের ব্যাপারে দৃঢ়তা স্থিতিশীলতা ও ঐকান্তিকতা ছিল নরনারীর আদিম ও শ্বাশ্বত ধারণা। পারস্পরিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সম্মত হওয়ার অর্থই ছিল-তারা চিরন্তন দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। অতঃপর পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসা, সম্প্রীতি ও ঐকান্তিকতার পরিবেশে চিরকাল তারা একে অপরজনের হয়ে থাকবে। তারা হবে পরস্পরের প্রতি গভীর অনুভূতিসম্পন্ন। একজন অপরজনকে কস্মিনকালেও ত্যাগ করা চলে যাবে না। একজনের বিপদে অপরজন বিপন্ন বোধ করবে। একজনের সুখে অপরজন অকৃত্রিমভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে-এই ছিল তাদের পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি। এক কথায়, তারা শুধু কাম-প্রবৃত্তির চরিতার্থতাই লিপ্ত হবে না, তারা হবে অচ্ছেদ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। সে কালে নারী পুরুষের যৌন জীবন কেবলমাত্র এভাবেই সম্ভব বলে মনে করা হত। কিন্তু নব্য চিন্তায় এ ধারণা কর্পূরের মত উবে গেল। অতঃপর যৌন সম্পর্ক সাময়িক কামনা চরিতার্থতায় পরিণত হল। আর শুধু কামনা প্রবৃত্তির চরিতার্থতাই যখন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল, তখন চিরন্তন বন্ধন হল নিতান্তই অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের ব্যাপার। অতেএব, একজন অপরজনকে চিরদিনের জন্য কেন সহ্য করবে।
কালক্রমে বিবাহবন্ধন এতই হাস্যাস্পদ হল যে, রাতে বিলম্ব করে ঘরে ফেরার অপরাধে স্ত্রী স্বামীকে অভিযুক্ত করল এবং বিচ্ছেদের দাবি জানাল। স্বামী জামা জুতা পরিধান করেনা বলেও স্ত্রী তার হয়ে থাকতে অস্বীকৃতি জানাল। স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করল যে, সে ঘরে ফিরার পূর্বেই স্ত্রী তার জন্য্ অপেক্ষা না করে রাতের খাবার একাকী খেয়ে নিল। শতবার সাবধান করা সত্ত্বেও স্ত্রী তার এই কাজ হতে বিরত হয় নি। অতএব তাকে আর স্ত্রী হিসেবে রাখা সম্ভব নয়।
বিবাহবন্ধন শুধু যে উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছে কিংবা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, তা-ই নয়, যৌন বৈচিত্র্যের প্রবৃত্তি নৈতিকতা ও মানবিকতার সমস্ত মূল্যমান চুরমার করে ফেলেছে। মানুষকে তা নিতান্ত জীব জন্তুর পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে। স্বামীকে একঘেয়ে লাগছে বলে স্ত্রী তাকে হত্যা করছে এবং ঘরের যুবক চাকর, বয়ফ্রেন্ড বা স্বামীর যুবক বন্ধুর সাথে পরম আনন্দে দিন কাটাতে শুরু করছে। আবার বহু স্বামী তাদের একান্ত নিবেদিত স্ত্রীকে হত্যা করছে এ কারণে যে, তার উপস্থিতিতে সে অন্য যুবতীর সাথে রাত যাপনের সুযোগ পাচ্ছে না।
বস্তত যে সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও প্রেম-প্রণয় চর্চা অতীব সাধারণ ব্যাপার, সেখানে কোন পুরুষের পক্ষে বহুসংখ্যক নারীর প্রেমিক হওয়া এবং একজন সুন্দরী যুবতীর পক্ষে বহুসংখ্যক পুরুষের মক্ষীরাণী হওয়া কোন বিচিত্র ব্যাপার নয়। আর তার ফলে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে জয় করবার জন্য লোকদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতার সৃষ্টি হওয়া এবং সেই প্রতিদ্বন্ধিতার ফলে হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এরই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শক্তির অবক্ষয়, মানব বংশের প্রতি ঘৃণা ও উপেক্ষা, ধৈর্য ও সহনশীলতার অভাব, হৃদয়াবেগের প্রচন্ডতা, ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিবর্তে স্বার্থপরতা ও শোষণ লুন্ঠনের প্রবণতা, সংহতি, সহৃদয়তা ও সম্প্রীতির পরিসমাপ্তি এবং মতবিরোধ, দ্বন্ধ কলহ ও রক্তারক্তি। যৌনবাদের এই হচ্ছে স্বাভাবিক পরিণতি। বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজ ও পাশ্চাত্য প্রভাবিত এদেশীয় সমাজে আজ আমরা এই কলঙ্কিত অবস্থাই প্রত্যক্ষ করছি। এ ধরনের জাতিই বিশ্ব নেতৃত্বের উচ্চ আসনে আসীন হয়ে মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করছে! চিন্তা-গবেষণা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্কার উদ্ভাবনীর ক্ষেত্রে এ জাতি আজও অগ্রসর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এটা কি করে সম্ভব হচ্ছে?
আসল ব্যাপার হল, বর্তমানে যারা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে সমাসীন, তারা শুরুতে অধঃপতিত ছিল না। যে সময় তাদের ওপর উন্নতি ও অগ্রগতি লাভের আবেগ কর্মমুখর হয়েছিল, তখন যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার প্রবণতা তাদের উপর এতটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারে নি। তারা নিজেদের শক্তি সামর্থ্য ও প্রতিভাকে গঠনমূলক কাজে লাগাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল। কামনা বাসনা লালসার চরিতার্থতা তখন তাদের নিকট মুখ্য ছিল না। তাই বলে তারা সর্বপ্রকার নৈতিক ত্রুটি-বিচ্যূতিমুক্ত ছিল, এমন কথাও নয়। তবে ব্যক্তি ও জাতি গঠনমূলক প্রবণতা বিশ্বের অপরাপর সমাজ ও জাতির তুলনায় তাদের অধিক প্রবল ছিল, এতে সন্দেহ নেই। এখনও এই প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করাও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। তবে পতনের লক্ষ্য যে সর্বাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে, তা অনস্বীকার্য।
তাই এটা দ্বিধাহীনচিত্তে বলা যায় যে, বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা অতি দ্রুত গতিতে চূড়ান্ত পতন ও সর্বাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ছুটে চলছে। এর অভ্যন্তরে ধ্বংসের যে জীবাণু প্রবিষ্ট হয়েছে, তা িএকে চূড়ান্ত বিনাশের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কোনই সন্দেহের অবকাশ নেই।
ইসলামের দৃষ্টিতে যৌন সমস্যার সমাধান
পূর্বেই বলেছি, যৌন সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের প্রশ্নে দুনিয়ার বড় বড় চিন্তাবিদরা নিজেদের চরমভাবে ব্যর্থ ও নিরুপায় প্রমাণ করেছেন। এক্ষেত্রে কোনরূপ ভারসাম্য রক্ষা করাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। একসময় তারা নৈতিক চরিত্র রক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে চরম বৈরাগ্যবাদের পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। আবার এক সময় যৌন কামনা বাসনার দাবি রক্ষা করতে গিয়ে মানুষের নৈতিক চরিত্র ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছেন। মানবীয় চিন্তা ও গবেষণার এই চরম ব্যর্থতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে যে, মানবীয় সমস্যাবলীর কোন একটিরও সমাধান নিতান্ত মানবীয় চিন্তা গবেষণা ও বিবেক বুদ্ধির দৌলতে হওয়া সম্ভবপর নয়; তা সম্ভব কেবলমাত্র মানবস্রষ্টা মহান আল্লাহ তা‘আলার প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের ভিত্তিতে।
বৈরাগ্যবাদ ও নৈতিক বিপর্যয় এই দুটি প্রান্তিক অবস্থার মধ্যে পুরোপুরি ভারসাম্য রক্ষা করা কেবলমাত্র দ্বীন ইসলামের পক্ষেই সম্ভব। ইসলাম একদিকে যৌন সমস্যার অতীব স্বভাবসম্মত সমাধান পেশ করেছে, অপরদিকে নৈতিক মূল্যমানকে সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ন রেখেছে। সে কামনা বাসনা তথা প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে যেমন মানুষকে রক্ষা করছে, তেমনি এসবের পূর্ণ পরিতৃপ্তির ব্যবস্থাও সঠিক ভারসাম্য সহকারে উপস্থাপন করেছে। এ পর্যায়ের বিস্তারিত আলোচনাকে আমরা এখানে পাঁচ ভাগে পেশ করছি।
ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ
খৃস্টধর্মের প্রখ্যাত হিরো সেন্টপলের চিন্তাধারা হচ্ছে, অবিবাহিত পুরুষ সবসময় খোদার চিন্তায় আত্মনিমগ্ন থাকে, সে কেবল খোদাকেই সন্তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট। পক্ষান্তরে বিবাহিত ব্যক্তি সর্বদা বৈষয়িক চিন্তা ধান্ধায় ব্যাপৃত থাকে। সে কেবল নিজের স্ত্রী ও পরিবার পরিজনের চিন্তায়ই মশগুল। বিবাহিতা স্ত্রী ও অবিবাহিতা রমণীর মধ্যেও অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান। অবিবাহিতা যুবতী সবসময় খোদাকে সন্তুষ্ট রাখতে ব্যস্ত। পক্ষান্তরে বিবাহিত মহিলা স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখার চিন্তায়ই বিভোর হয়ে থাকে।
কিন্তু এই চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য দাম্পত্য জীবনের প্রতি অনীহা পোষণের কোনই প্রয়োজন নেই। কেননা দাম্পত্য জীবন মূলতঃই খোদানুগত্যের ব্যাপারে কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক নয়।
তা-ই যদি হত, তাহলে মানুষ স্বীয় প্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য যৌন সম্পর্ক স্থাপনে যেমন বাধ্য হত না, তেমনি কেবলমাত্র এই সম্পর্ক স্থাপনের উপরেই মানব বংশের ধারা রক্ষা নির্ভরশীল হত না। সেক্ষেত্রে এমন সব উপায়ও তাদের করায়ত্ব থাকত, যা অবলম্বন করে মানুষ এসব উদ্দেশ্য লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করার ব্যবস্থা করতে পারত।
বিশেষতঃ আল্লাহর যেসব নবী রাসূল আল্লাহকে সন্তুষ্ট দেখাবার পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় এসেছিলেন, তাঁরা নিজেরাও অবিবাহিত জীবন যাপন করতেন না এবং কাউকে এই জীবন ধারণের উপদেশও দিতেন না। তাঁদের সম্পর্কেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّن قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً ۚ
‘ আর আমরা (হে নবী) তোমার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি এবং তাদের জন্য স্ত্রী ও সন্তান সন্তুতি বানিয়ে দিয়েছি’। (সূরা, রাদঃ ৩৮)
স্বয়ং নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘বিবাহ নবীগণের সুন্নাত’।
বৈরাগ্যবাদকে কুরআন মজীদ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় বলে মনে করে না। মূলত এ মতটি সম্পূর্ণভাবে মানুষের মনগড়া। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
আরবী (*********)
‘বৈরাগ্যবাদ লোকদের নিজেদের উদ্ভাবিত। আমি তাদের জন্য এই বিধান দিই নি’।
রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ আরবী (*********)
‘ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোন স্থান নেই’।
হাদীস শরীফে উদ্বৃত হয়েছেঃ
আরবী (********)
‘নবী করীম (সা) বিবাহ না করা ও দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে লোকদের নিষেধ করেছেন।’
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) অপর একজন অবিবাহিত লোককে সম্বোধন করে বলেছেনঃ ‘বিয়ে কর। বিয়ে না করাটা ধার্মিকতা বা খোদাভীতির লক্ষণ নয়।’
ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ ইসলামী জীবনের পন্থা ব্যাখ্যা করে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
আরবী (*********)
‘আল্লাহর শপথ, তোমরা আমার নীতিটাই দেখ। আমি তোমাদের তুলনায় অধিক আল্লাহভীরু, একথা তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার কর। অথচ দেখ, আমি নফল রোযা রাখি আবার ভাঙ্গিও। আমি রাত্র জাগরণ করে নফল নামায আদায় করি, ঘুমাইও। সেই সঙ্গে বিবাহিত নারীসঙ্গও লাভ করি।’
বস্তুতঃ খোদানুপাত জীবন যাপনের জন্য যৌন জীবন পরিহার করার প্রয়োজন যারা মনে করেন, তারা ইসলাম প্রদত্ত খোদানুপাত জীবন সম্পর্কে কোন জ্ঞানই রাখে না। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী জিন্দেগীটাই খোদানুপাত জীবন এবং এ জীবনে বিবাহিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।