বিয়ের গুরুত্ব
পারিবারিক দায়িত্ব পালন মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। দান খয়রাত করা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই সাওয়াবের কাজ। কিন্তু পরিবারবর্গের জন্য অর্থব্যয় সর্বাধিক সাওয়াব পাওয়ার অধিকারী।
বস্তুত আল্লাহর প্রতি উপেক্ষা যেমন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ, ঠিক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হচ্ছে পারিবারিক দায়িত্ব পালনে অনীহা। স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক রক্ষা করাও সুস্থ সবল মানুষের অতি বড় দায়িত্ব। বিশেষজ্ঞদের ঘোষিত মত হচ্ছে, বিবাহিত জীবন অবলম্বন না করে কেবল ইবাদত বন্দেগীর কাজে লিপ্ত হওয়া কোনক্রমেই কল্যাণকর ও মঙ্গলময় নয়। নারী জাতির প্রতি ঘৃণাপোষণ ও তাদের সম্পূর্ণ বর্জন করে চলার প্রবণতা মানব সভ্যতার পক্ষে মারাত্মক। এ কারণেই নবী করীম (সা) অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (**********)
‘যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, সে যদি বিয়ে না করে তাহলে সে আমার পথের অনুসারী নয়-আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।’-দায়েমী।
নবী করীম (সা) যুব সমাজকে সম্বোধন করে ভাষনদান প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
‘হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা যৌন সম্পর্ক রক্ষায় সক্ষম, তারা যেন অবশ্যই বিয়ে করে। কেননা এটা দৃষ্টিকে নত রাখে, যৌন অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে।’-বুখারী।
বিয়ের এই গুরুত্ব বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম কঠোর ভাষায় অবৈধ পন্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে নিষেধ করেছে। একমাত্র বিয়েই হচ্ছে নারী পুরুষের মাঝে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বৈধ উপায়। এছাড়া আর যত উপায় ও পন্থাই সম্ভব, ইসলামের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ হারাম।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
আরবী (*********)
‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও ঘেঁষবে না। কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জতার কাজ ও অতীব খারাপ পথ।’
পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর নেক বান্দাদের পরিচয় দান প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ ۚ
‘যারা এক আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে না, আল্লাহর হারাম করে দেয়া প্রাণী হত্যা করেনা, তবে আইন সম্মত হত্যার কথা ভিন্ন-আর যারা ব্যভিচার করে না-তারাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা।’(আল ফুরকান, ৬৮)।
এ পর্যায়ে ইসলামী বিধানের প্রকৃতি হচ্ছে, কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনই মূলত হারাম। তবে শরীয়াত এজন্য যে নিয়মকে বৈধ ঘোষণা করেছে, শুধু সে পন্থায়ই তা বৈধ বলে গণ্য হবে। তার বাইরে কোন বৈধ পথই থাকতে পারে না।–যাদুল মায়াদ।
ফিকাহর প্রামান্য গ্রন্থে লেখা হয়েছেঃ পুরুষদের বাধ্য করা হয়েছে কেবল সে সব স্ত্রী লোকদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে, যাদেরকে তাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে স্ত্রীলোকদেরও যৌন আবেদন পূরণের জন্য কেবলমাত্র তাদের স্বামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য করা হয়ছে।
ব্যভিচার অবৈধ ঘোষণা করে তার কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে যে তত্ত্ব পরিবেশন করা হয়েছে, তা হচ্ছেঃ নিয়ম শৃঙ্খলা বিবর্জিত স্বাধীন ও অবাধ যৌন সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে স্বীয় যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাই হচ্ছে আল্লাহর সেসব নেক বান্দাহর নীতি ও চরিত্র, যাদের উপর আল্লাহর রহমত সব সময়ই বর্ষিত হতে থাকে। বস্তুতঃ এসব লোকই মানবতার কিশতীকে আবেগ-উচ্ছাস ও কামনা লালসার উত্তাল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বুক হতে উদ্ধার করে সুস্থ জ্ঞান ও বিবেক বুদ্ধির বেলাভূমে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরাই মানবতার সঠিক ও নির্ভুল মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। মানবতার ব্যর্থতার কারণ তাঁরাই বুঝতে পেরেছেন; সাফল্যের পথ তাঁরাই দেখাতে পেরেছেন। তাঁদের একান্ত চেষ্টা প্রচেষ্টার ফলেই মানুষের মধ্যে সুস্থ বিবেক বুদ্ধিকে সতেজ ও সক্রিয় করে তোলা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের শিক্ষণ প্রশিক্ষণের ফলে দুনিয়ার আবেগ বিহবল লোকগুলোকে সেরা বুদ্ধিমানে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের চরিত্র ও নৈতিকতা ছিল সম্পূর্ণ ও সর্বতোভাবে কলঙ্কমুক্ত। তাঁদের উন্নত ও পবিত্র নৈতিকতার কোন তুলনাই জগতে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়তঃ যে জাতিই যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় নিমজ্জিত হয়েছে, সে জাতিই মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সে জাতি নিতান্ত অন্ধের মতই ধ্বংসের মহাগহবরে তলিয়ে গেছে। তাদের হাত ধরে তুলবারও নেই কেউ কোথাও। তারা পাশব বৃত্তির অন্ধ অনুসারী। তাদের চোখ থাকতেও নেই সেই চোখে এতটুকু দৃষ্টিশক্তি। তাই তাদের পতন ঘটেছে অনিবার্য্ভাবে। এটাই ইতিহাসের সিদ্ধান্ত আর ইতিহাসের সিদ্ধান্তের কখনও ব্যতিক্রম দেখা যায় না।
তৃতীয়তঃ এই বিধানের মাধ্যমে কুরআন চায়, মানুষ হৃদয়াবেগের অন্ধ দাসত্ব পরিহার করে একান্তভাবে আল্লাহর অনুগত হয়ে থাকুক, তাহলে তাদের পক্ষেই আল্লাহর রহমত লাভ করা সম্ভব হবে। তারা এমন জীবন লাভ করতে পারবে, যা পরম শান্তি, স্বস্তি ও নিরুদ্বেগে ভরপুর। কিন্তু প্রবৃত্তির দাসানুদাসেরা চায়, সারা দুনিয়ার মানুষ তাদেরই মত লালসার দাস হয়ে থাকুক।
চতুর্থ এই যে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দেন নি। তিনি শুধু এর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন। তাই বৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তির পথও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এসব পথও যদি রুদ্ধ থাকত, তাহলে লালসার প্রবল সয়লাব স্রোতে মনুষ্যত্বের সমস্ত মহান মূল্যবোধ একেবারে ভেসে যেত। কেননা মানুষ স্বভাবতই দুর্বল প্রকৃতির। হৃদয়াবেগ ও যৌন প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ দমন করে রাখা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাই মানুষের এই স্বাভাবিক দুর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বৈধতার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
পঞ্চম ও সর্বশেষ তত্ত্ব হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা, তাকওয়া পরহেজগারী অবলম্বন করা এবং পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতার নীতি অনুসরণ করা মানব প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ন। এ হচ্ছে মানব প্রকৃতির অভ্যন্তর থেকে উত্থিত এক স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদ, তাই সতীত্ব, নৈতিকতা ও পবিত্রতার ধারণার সাথে মানব প্রকৃতির কোন বৈরিতা বা দ্বন্ধ নেই; বরং তা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে প্রকৃতির তাগিদকে সাদর সম্বর্ধনা জানায়। তদনুযায়ী আমল করার ফলে এমন এক আলোকবর্তিকা তার করায়ত্ত হয়, যার সাহায্যে মানুষের চরম সাফল্যের পথে এগিয়ে চলা সম্ভব।
বস্তুত ইসলাম যৌন সম্পর্ক পর্যায়ে একটা সুস্পষ্ট ধারণা উপস্থাপন করেছে। সেই ধারণার ভিত্তিতে ইসলাম ব্যক্তির প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ সংস্কারের কাজও সুসম্পন্ন করে। কেননা ইসলাম উপস্থাপিত সে ধারণার সাফল্য এ দু’টি কাজের উপরেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
ব্যক্তির প্রশিক্ষণ
ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত। আর সামাজিক আদর্শের বাস্তবায়ন ও সাফল্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার অনুসরণের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। জনগণ যদি সামাজিক আদর্শকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে তার বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভবপর হতে পারে না। এজন্যে জনগণকে ঐকান্তিকতা সহকারে প্রস্তুত হতে হবে নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনতে। এই কারণে প্রতিটি সমাজই তার নিজ আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তিদের গঠন করার জন্য সদা চেষ্টা চালাতে থাকে। ইসলামী জীবনাদর্শও অন্যান্য সব কাজের চাইতে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে ব্যক্তিদের জীবনকে স্ব-আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার উপর; তবে এদিক দিয়েও দুনিয়ার অন্যান্য মতাদর্শের উপর ইসলামের বিশেষত্ব রয়েছে। ইসলাম মানবতার প্রতি কোনরূপ নৈরাশ্য পোষণ করে না; বরং তার শোধন প্রয়াস চলে মানবতার প্রতি পরম আশাবাদের ভিত্তিতে। মানুষ সম্পর্কে ইসলামের ধারণা অতীব উচ্চ ও মহান। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধী ও পাপপ্রবণ নয়। তার প্রকৃতি মালাকুতী মহিমায় সমৃদ্ধ ও সুষমামন্ডিত। মূলত ভুল চিন্তা বিশ্বাস ও বিপর্যয়কারী শিক্ষা প্রশিক্ষণই মানবতাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বিজয়ী সভ্যতা মানুষ সম্পর্কে অত্যন্ত নৈরাশ্যবাদী। তার দৃষ্টিতে মানব প্রকৃতিতেই পাপ ও দুষ্কৃতি নিহিত। যৌন প্রবৃত্তির চরিতার্থতার ব্যাপারেও বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার অবাধ ও উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনবিদিত। তার ধারণা, মানুষ যেমন মল-মূত্র ত্যাগ করার জন্য প্রকৃতির ডাকে তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে বাধ্য, যৌন তাড়না চরিতার্থ করাও তার জন্যে তেমনি অপরিহার্য। অতএব এক্ষেত্রে কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ বা বিধি নিষেধ আরোপ করতে বর্তমান সভ্যতা প্রস্তুত নয়।
পক্ষান্তরে ইসলাম ঘোষণা করেছে, নিয়ন্ত্রণমুক্ত যৌন চর্চা ও কামনা লালসা চরিতার্থ করা ব্যভিচার ছাড়া কিছুই নয় এবং ব্যভিচার একটা মহা পাপ বিশেষ। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানব প্রকৃতির সাথে ব্যভিচারের কোন সঙ্গতি বা সাযুজ্য নেই। পূণ্য ও পবিত্রতাই মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাপকার্যে মানবতার কোন মহত্ব নেই। শুভ, পূণ্য ও ন্যায় আচরণেই মানুষের মহিমা নিহিত। অকল্যাণে কারুরই একবিন্দু মঙ্গল নেই। কল্যাণেই সার্বিক মঙ্গল নিহিত। তা যদি না হত, মানুষই কেন অন্যায় কাজ করলে মানসিক দংশনে ছটফট করতে থাকে? পাপকাজে তার নিজের প্রকৃতিই কেন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে? তার কারণ হল, মানব প্রকৃতি পাপপ্রবণ নয়। তার আত্মমর্যাদার মহিমা সর্বপ্রকার ন্যায়, পবিত্র ও মহত্তর আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট। উত্তম, পবিত্র ও নিষ্কলুষ কার্যাবলীতেই মানুষের অহম প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করতে পারে। এই কারণে নিতান্ত অসাধু ব্যক্তিকেও জনগণের সামনে সম্পূর্ণ সাধুতার বেশ ধরে আসতে হয়। কেননা মানুষ অসাধুতা পছন্দ করে না, বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়, এটা সর্বজনবিদিত।
কুরআন মজীদ মানুষের মাঝে এই চেতনাটিকেই তীব্রভাবে জাগ্রত করতে চায়। সে ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বারবার বলেছে, আত্মপ্রতারণায় আর কতকাল নিমজ্জিত থাকবে? তোমাদের মান সম্মান সম্ভ্রম যদি বাস্তবিকই রক্ষা করতে চাও, তা হলে এসব মহৎ গুণাবলী অর্জনের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করে দাও।
আগের কালের লোকেরা অন্যায় ও পাপকার্যের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলতো, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের েএসব কাজই করতে দেখেছি। আর আল্লাহই যখন আমাদের দ্বারা এসব করাচ্ছেন, তখন কার কি বলবার থাকতে পারে? আজকের যুগের পাপীষ্টরাও নির্লজ্জভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুক্তি প্রদর্শন করছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, আল্লাহ নিজে কারুর দ্বারা কোন পাপ কাজ করান না, বাপ দাদারা পাপ করে থাকলেও পাপ কার্যের যৌক্তিকতা প্রমাণ হয় না। আর নির্ভুল জ্ঞান-বিজ্ঞান যে কখনই কোন পাপ কাজের অনুমতি দেয় না, তা পাপীষ্টরা বুঝতেই চায় না। বুঝলেও তা মুখে কখনও স্বীকার করবে না।
মানুষ স্বভাবতই কল্যাণপ্রবণ। এই কারণে মানুষ ভুলক্রমে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়লেও চিরকাল তার মধ্যে লিপ্ত থাকতে পারে না। একদিন না একদিন তার হৃদয় মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মানুষের এই সুস্থ মন মানসিকতাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। এই মনই মানুষকে অন্যায় কাজের জন্য তিরস্কার করে এবং শুভ কাজের জন্য সুখানুভূতি জাগায়। মনের এই ডাকই সর্বপ্রকার অন্যায় কাজের পথে প্রধান অন্তরায়। তবে মিথ্যা প্রচারণা ও প্ররোচণায় মানব মন সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এ কারণেই ইসলাম মানুষের হৃদয় মনকে মহত্তর আদর্শ শিক্ষার সাহায্যে সব সময় সজাগ, সক্রিয় ও বলিষ্ট করে রাখতে সচেষ্ট। জনৈক সাহাবীর এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (**********)
‘উত্তম চরিত্রই হচ্ছে পূণ্য কাজ। আর যে কাজ তোমার মনে কুন্ঠা জাগায় এবং লোকেরা তা জানুক তা তুমি পছন্দ কর না, তাই হচ্ছে পাপের কাজ।’-তিরমিযী।
বস্তুতঃ পাপ কাজ মানুষকে সবসময় কুণ্ঠিত করে রাখে। তাতে মানুষ নিজেকে বিব্রত বোধ করে। তা সব সময় মানুষের মনে কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে। পক্ষান্তরে উত্তম চরিত্র মানুষকে কল্যাণময় করে রাখে। মূলত ঈমানই মানুষের মধ্যে এই গুণের সৃষ্টি করে। নবী করীম (সা) এই কথা বোঝাবার জন্যই বলেছেনঃ
আরবী (***********)
‘তোমার ভাল কাজ যখন তোমাকে সন্তুষ্ট করবে এবং তোমার মন্দ কাজ তোমার খুবই খারাপ লাগবে, তখনই বুঝবে তুমি একজন ঈমানদার লোক।’- মুসনাদে আহমদ।
মানুষ যখন নিজের স্থান ও মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন হয়, অনুভূতি তীব্রভাবে জেগে উঠে, তখন মর্যাদাহানিকর কোন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। লজ্জা তাকে সকল প্রকার পাপ কাজ হতে বিরত রাখে। এই লজ্জাও মানুষের চরিত্র রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরী। রাসূলে করীম (সা) এর ভাষায়-‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’। এই অঙ্গটিও যদি লোপ পেয়ে যায়, তখন মানুষ যা ইচ্ছা তা-ই করে বসে। আবহমান কাল হতে নবী রাসূলগণ মানুষকে এই শিক্ষাই দিয়ে এসেছেন। এই কারণে নির্লজ্জতা ও নগ্নতা-উলঙ্গতা চিরকালই ঘৃনার্হ বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা এই লজ্জার ধনটি হারিয়ে ফেলেছে। তাই যারা এখনও নির্লজ্জতা গ্রহণ করেনি, তাদেরও চরম নির্লজ্জ বানাবার জন্য আধুনিক সভ্যতা সর্বপ্রকার আয়োজন করে চলছে।
পরকালীন জবাবদিহির অনুভূতি
বস্তুত লজ্জা চরিত্রবান মানুষের ভূষণ, তার অলঙ্কার। কিন্তু লজ্জার স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নির্ভর করে পরকাল বিশ্বাসের অনুভূতির উপর। কারো মনে যদি এই প্রত্যয় থাকে যে, আজ যদি আমি কোন নাফরমানীর কাজ করি, তাহলে কাল কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে আমি আল্লাহর সামনে কিভাবে দাঁড়াব? কেমন করে তাঁকে মুখ দেখাব? –তাহলে সে কোন পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না। পক্ষান্তরে এই দুনিয়াই যদি চূড়ান্ত হয়, তাহলে পাপ-পূণ্য, ন্যায় অন্যায় ও লজ্জা শরমের কোন বালাই থাকতে পারে না; কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারতো তা নয়। পরকালে আল্লাহর সামনে যে দাঁড়াতে হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশই নেই। তাই লজ্জানুভূতির ভিত্তি হচ্ছে পরকাল বিশ্বাস।
তাই যাদের বাস্তবিকই চক্ষু লজ্জা বলতে কিছু আছে, তারা হয়তো লোকলজ্জার কারণে পাপ কাজ এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই লজ্জাবোধটা খুবই ঠুনকো ভিত্তির উপর স্থাপিত। লোকদের মনে যদি এই বিশ্বাস থাকে যে, হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষের কাতারে তাকে এই পাপ কাজের জন্য অপদস্ত হতে হবে, কেবল তাহলেই তার পক্ষে কোন পাপ কাজের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা সম্ভব নয়। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে এই চিত্রই অঙ্কিত হয়েছেঃ
لِّلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ ۖ وَلَا يَرْهَقُ وُجُوهَهُمْ قَتَرٌ وَلَا ذِلَّةٌ ۚ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ [١٠:٢٦]وَالَّذِينَ كَسَبُوا السَّيِّئَاتِ جَزَاءُ سَيِّئَةٍ بِمِثْلِهَا وَتَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ ۖ مَّا لَهُم مِّنَ اللَّهِ مِنْ عَاصِمٍ ۖ كَأَنَّمَا أُغْشِيَتْ وُجُوهُهُمْ قِطَعًا مِّنَ اللَّيْلِ مُظْلِمًا ۚ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ[١٠:٢٧]
-‘যে সব লোক এই দুনিয়ায় উত্তম নীতির অনুসরণ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিফল। তার চাইতেও বেশি দেওয়া হবে তাদের। তাদের মুখমন্ডল তিমিরাচ্ছন্ন হবে না; তারা কোনরূপ অপদস্থতারও সম্মুখীন হবে না। তারা জান্নাতবাসী হবে এবং সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। পক্ষান্তরে যারা পাপ কাজ করেছে, তাদের প্রতিটি পাপ কার্যের অনুরূপ শাস্তি তারা ভোগ করবে। অপমান লাঞ্ছনা তাদের মুখমন্ডলকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। আল্লাহর আযাব হতে তাদের কেউই বাঁচাতে পারবে না। তাদের মুখমন্ডল এতটাই মসিলিপ্ত হবে যে, মনে হবে, অন্ধকারাচ্ছান্ন রাত্রির একটা অংশ তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তারা হবে দোজখবাসী এবং সেখানে তারা চিরকালই থাকবে।’-সূরা ইউনূস।
মহান লা শরীক আল্লাহর প্রতি ও পরকালে জবাবদিহির প্রতি দৃঢ় প্রত্যায় ঈমানের ভিত্তি। ব্যক্তির সমস্ত কাজ কর্ম এই ঈমান ও প্রত্যয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। অতঃপর কোনরূপ পাপ ও নাফরমানীর কাজ কল্পনাও করা যায় না। হযরত ইউসুফ (আ) এর কুরআনে বর্ণিত কাহিনী হতে একথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। বস্তুতঃ এই ঈমান ও প্রত্যয় যাদের হৃদয়-মনে দৃঢ়মূল হয়ে বসে, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লাবণ্য ও যৌবন সৌন্দর্য্ ও তাদের বিচলিত করতে পারে না। মিসরের সেরা সুন্দরী যুবতীরা হযরত ইউসূফ (আ) কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি আল্লাহর ভয়ে কম্পমান ছিলেন। তিনি েএই পদস্খলনের পরিবর্তে বৈষয়িক যে কোন কষ্ট স্বীকার করতেও অকাতরে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি কাতর কন্ঠে আল্লাহকে ডেকে বলেছিলেনঃ
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ [١٢:٣٣]
‘হে খোদা! এরা আমাকে যে দিকে ডাকছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকট প্রিয়তর। হে খোদা! তুমিই যদি ওদের ষড়যন্ত্র ফিরিয়ে না দাও আমার দিক হতে, তাহলে আমি যে ওদের কুহজালে জড়িয়ে পড়ব। আর তাহলে তো আমি অজ্ঞ মূর্খদের মধ্যে গণ্য হয়ে পড়ব।’-সূরা ইউসুফ-৩৩।
হযরত মরিয়ম ছিলেন আল্লাহর প্রতি অতিবড় ঈমানদার ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী। তিনি সহসা এক সুশ্রী সুকান্ত যুবককে নিভৃতে একাকী দেখতে পেয়ে আল্লাহর ভয়ে কেঁপে ওঠেন। তিনি বলে ওঠেনঃ
আরবী (**********)
‘আমি তোমার নিকট হতে খোদার নিকট আশ্রয় চাই-যদি তোমার খোদার ভয়সম্পন্ন লোক হও——-’।
এই প্রেক্ষিতেই মহানবী ইরশাদ করেছেনঃ
‘আরবী (***********)
‘সাতজন লোককে আল্লাহ তায়ালা ছায়া দিবেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হল সেই যুবক যে আল্লাহর বন্দেগীর মধ্যেই বর্ধিত হয়েছে। আর একজন সেই পুরুষ, যাকে কোন মর্যাদাসম্পন্ন সুন্দরী নারী ব্যভিচারে প্ররোচিত করে আর সে বলে ওঠেঃ না, আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর তৃতীয় সেই লোক, যে নীরবে নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণ করে ও নিজের কার্যাবলী স্মরণ হওয়ায় তার দুই চোখের পানি প্রবাহিত হতে থাকে।’- বুখারী, মুসলিম।
আল্লাহর ভয়ে ভীত ব্যক্তিদের এই হচ্ছে আদর্শ ভূমিকা। ইসলাম এই ধরনের আদর্শ চরিত্রবান ব্যক্তি তৈরি করে এবং তৈরী লোকদের কাছ হতে এইরূপ চারিত্রিক দৃঢ়তাই আশা করে।
ইসলাম মানব মনে গুনাহর প্রতি কেবল ঘৃণাই জাগায় না, পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণাও জাগিয়ে তোলে। ইসলাম জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য যেমন বিধান দিয়েছে, তেমনি নারী পুরুষ সম্পর্কের ব্যাপারেও সুস্পষ্ট ও অকাট্য কথা বলে দিয়েছে। সে জানিয়ে দিয়েছে, কোন্ কোন্ পন্থা ও পদ্ধতি আল্লাহর পছন্দ এবং কোন কোনটি নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে যৌন আকর্ষণ হচ্ছে, এই পরীক্ষা সঙ্কুল বিশ্ব জীবনে আল্লাহর বান্দাদের জন্য কঠিন পরীক্ষার বিষয়। নারী পুরুষের পারস্পরিক দুর্দমনীয় আকর্ষণ মানুষকে এক নাজুক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেখানে তাকে অনড়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় যে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ গ্রহণ করবে, না লালসা পন্কিল পথ অবলম্বন করে আল্লাহর গযবে পড়তে প্রস্তুত হবে। নবী করীম (সা) এই দিকেই ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ
আরবী (******)
‘আমার পর পুরুষদের জন্য নারীদের তুলনায় অধিক বিপদের কারণ আর কিছুই রেখে যাইনি আমি।’-বুখারী।
অপর এক হাদীস মতে প্রতিটি সকাল বেলা দুজন ফেরেশতা ঘোষণা করেঃ পুরুষদের জন্য নারীরা ক্ষতিকর এবং নারীদের জন্য পুরুষরা।
নারী ও পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণের প্রেক্ষিতে রাসূলে করীম (সা) এর এসব সাবধান বাণীর তাৎপর্য সহজেই বুঝতে পারা যায়। নারী পুরুষের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক যে কোন মুহুর্তে সংস্থাপিত হতে পারে। কিন্তু তা হতে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি?
এর জবাব নির্ভর করে এই প্রশ্নটির উপর-মানুষ কে ব্যভিচার করবে? মানুষের মধ্যে স্বভাবতই যে যৌন লালসা তীব্রভাবে বিদ্যমান। কিন্তু তার নিরসনের পথ কি উন্মুক্ত নেই? যদি থাকে, তাহলে সে পথেই কেন যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা হবে না? আর যদি না-ই থাকে, তাহলে সে পথ অবাধ ও উন্মুক্ত হবে না কেন?
ইসলাম মানুষের সামনে তাদের স্বাভাবিক যৌন চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য বৈধ পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আর তা হচ্ছে বিবাহিত জীবন। এই জীবনে যেমন পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি অর্জন সম্ভব, তেমনি এই পরিতৃপ্তি লাভের অনিবার্য পরিণতি গ্রহণেরও সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিহিত। তাই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
আরবী (*******)
‘বিবাহিত পুরুষের জীবন……..ব্যভিচারীর জীবন নয়।’
আরবী (**********)
‘বিবাহিত নারীর জীবন………..ব্যভিচারীণীর জীবন নয়’।
কুরআনের ভাষায় বিবাহিত জীবন দুর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরে যাপিত ভয়ন্কামুক্ত জীবন তুল্য। আর অবিবাহিত যৌন জীবন শন্কাময় ব্যভিচারী জীবন। উচ্ছৃঙ্খল, প্রকারবিহীন জীবন। অবিবাহিত যৌন জীবন যেন বাঁধাহীন জলস্রোত। তা শুধু ব্যক্তিকেই ডোবায় না, গোটা জনপদকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
ইসলাম ব্যভিচারকে হারাম করেছে এবং বিবাহকে বৈধ পথ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য লাভ সম্ভব। একটি হচ্ছে, যৌন লালসা পরিতৃপ্তির ক্ষেত্রে সংযম অবলম্বন করা এবং কোনরূপ উচ্ছৃঙ্খলতাকে বরদাশত না করা, অর্থাৎ একে একটা সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, এই নিয়ন্ত্রণ হবে মানবিক মূল্যবোধ তথা নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষার সহায়ক। বস্তুতঃ বিবাহরে মাধ্যমেই যৌন অনাচার প্রতিরোধ ও নৈতিক শুচিতা রক্ষা করা সম্ভব। রাসূলে করীম (সা) তাই বলেছেনঃ
আরবী (**********)
‘কোন নারী যদি কোন পুরুষকে আকর্ষণ করে এবং তার দিল আকৃষ্ট হয়ে পড়ে (অনুরূপভাবে কোন পুরুষ যদি কোন নারীকে আকর্ষণ করে ও তার মন আকৃষ্ট হয়ে পড়ে) তাহলে তার নিজের স্ত্রী (বা স্বামীর) নিকট চলে যাওয়া উচিত এবং তারই কাছে স্বীয় চাহিদা পূর্ণ করে নেয়া কর্তব্য। মনে জেগে ওঠা লালসা বা আকর্ষণের প্রকৃত পরিতৃপ্তি এমনিভাবেই সম্ভব।’
এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্বামী স্ত্রীকে পারস্পরিক ইচ্ছা বাসনার প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। স্ত্রীকে যেমন স্বামীর দাবি পূরণে প্রস্তুত থাকতে হবে, তেমনি স্বামীকেও প্রস্তুত থাকতে হবে স্ত্রী যেন অতৃপ্ত থেকে না যায়। এ কারণেই নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ‘স্বামী যখন স্বীয় স্ত্রীকে কামনা পূরণের আহবান জানাবে, স্ত্রী তার ডাকে অবশ্যই সাড়া দিবে-যদি সে জরুরী কোন কাজে ব্যস্ত থাকে, তবুও।’( অবশ্য এ নির্দেশ শুধু স্বাভাবিক অবস্থায়ই প্রযোজ্য। স্ত্রী যদি বাস্তবিকই শারীরিকভাবে অসমর্থ হয় কিংবা অসুস্থ থাকে তাহলে এ নির্দেশ প্রযোজ্য নয়)। অনুরূপ নির্দেশ স্বামীদের প্রতিও রয়েছে তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে। হযরত উমর (রা) তাঁর এক ভাষণ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
আরবী (***********)
‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের যৌন-অঙ্গের পবিত্রতা অবশ্যই রক্ষা করবে।’
উদ্দেশ্যের সহায়ক ব্যবস্থাসমূহ
এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীদের যৌন কামনা বাসনা পূর্ণমাত্রায় চরিতার্থ করা স্বামীদের কর্তব্য। অন্যথায় যৌন অতৃপ্তি স্ত্রীদের অপর পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। আরব জাহেলিয়াতের যুগে স্ত্রীদের যৌন কামনা বাসনা অতৃপ্ত রেখে তাদের শাস্তি দান কিংবা ভিন পুরুষের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠতে বাধ্য করা হত। ইসলাম এই কাজকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কেননা এরূপ অবস্থায় স্ত্রীরা বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অবিবাহিতাদের ন্যায় অতৃপ্ত থাকতে বাধ্য হয়। বস্তুতঃ ইসলাম নারী পুরুষের যৌন চাহিদার পরিতৃপ্তির জন্য বিবাহকে যে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে দিয়েছে, তা এসব বিবেচনায় সহজেই বুঝতে পারা যায়। এই পর্যায়ে কয়েকটি কথা স্মরণীয়ঃ
১। প্রেম-ভালবাসা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রাণস্বরূপ। প্রেম ভালবাসার বদৌলতেই নারী পুরুষের যৌন জীবন সুন্দর ও মোহময় হয়ে ওঠে। এরূপ জীবনেই নারী ও পুরুষ পরম শান্তি, স্বস্তি, তৃপিত্ ও নিরাপত্তা লাভে সক্ষম হয়।
২। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য বেশি হওয়া উচিত নয়। কেননা বয়সের পার্থক্য বেশি হলে উভয়ের কেউই অপরের নিকট হতে সে তৃপ্তি, সুখ ও আনন্দ লাভ করতে পারবে না, যা সুখী দাম্পত্য জীবনের স্থায়ীত্বের জন্য অপরিহার্য্। কোন যুবক সাহাবী একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করলে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘তুমি একটা কুমারী মেয়ে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তুমি তাকে নিয়ে আনন্দে খেলা করতে, হাসি খুশিতে তোমার মন ভরে ওঠত। আর সেও আনন্দ ও সুখ লাভে ধন্য হত।
একথার তাৎপর্য্য এই যে, যুবক বয়সের পুরুষ বেশী বয়সের অকুমারী মেয়ের নিকট সাধারণত সেই সুখ ও আনন্দ লাভ করতে পারে না, যা তার জন্য একান্তই জরুরী। হযরত আবু বকর ও হযরত উমার (রা) উভয়ই নবী দুহিতা হযরত ফাতিমা (রা) কে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে নবী করীম (সা) উভয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেনঃ ‘তোমাদের দুজনেরই বয়সের তুলনায় সে অতি অল্প বয়সের মেয়ে।’ অথচ যুবক হযরত আলী (রা) র সাথে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়েই ফাতিমার বিয়ে দিলেন।
৩। এই উদ্দেশ্যে বিয়ের পূর্বে বর ও কনের পরস্পরকে দেখার ব্যবস্থা ইসলামী শরীয়াতে বৈধ রাখা হয়েছে, যেন চিরস্থায়ী জীবনসঙ্গী বাছাই ও গ্রহণের পূর্বে তারা উভয়ই এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত মনে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নবী করীম (সা) বিয়ের প্রস্তাবদাতা একজন পুরুষকে বলেছিলেনঃ
আরবী (*********)
‘তুমি আগে কনেকে দেখ। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টির জন্য এই দেখা সাক্ষাত সহায়ক হবে।’- তিরমিযী।
এই কথাটি হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে গভীর প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হওয়াই ইসলামের কাম্য। দাম্পত্য জীবনে যে কোনরূপ মনোমালিন্য ও অপ্রীতিকর অবস্থাই বিবাহিত জীবনের লক্ষ্য বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কেননা এরূপ অবস্থা দেখা দিলেই সতীত্ব, নৈতিকতা ও পবিত্রতার বৈরীশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার এবং শয়তানী অসঅসা দিয়ে স্বামী বা স্ত্রীর পদস্খলন ঘটাবার সুযোগ পায়। এই কারণে নবী করীম (সা) এমন অনেক বিয়েই ভেঙ্গে দিয়েছেন, যেখানে স্ত্রী স্বামীর খারাপ মন মেজাজের জন্য তার সঙ্গে থাকতে অসম্মতি জানিয়েছে কিংবা স্ত্রীর এ ধরনের দোষে স্বামীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
৪। দাম্পত্য জীবনে মাধূর্য সৃষ্টি এবং স্বামীকে স্ত্রীর প্রতি অধিক আকৃষ্ট করে রাখার জন্য স্ত্রীর সাজ সজ্জা ও চাকচিক্যময় মনোহর পোশাক অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে থাকাকে ইসলাম খুবই পছন্দ করেছে। অথচ এরূপ অবস্থায় গায়র মুহাররাম পুরুষের সামনে বের হওয়াকে আদৌ সমর্থন করা হয় নি; কিন্তু স্বামীর জন্য এসব করাকে দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্বের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে স্বামীর মন স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ঞ হয়ে ওঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
আরবী (**********)
‘স্বামীদের জন্য স্ত্রীদের নানাবিধ অলঙ্কার ভূষণে ভূষিতা হওয়াকে খুবই উত্তম মনে করা হয়েছে।’
বিদেশাগত স্বামীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন পূর্বাহ্নে আগমনের খবর না দিয়েই হঠাৎ করে ঘরে প্রবেশ না করে । কেননা স্বামীদের অনুপস্থিতির কারণে স্ত্রীরা হয়তো কোনরূপ সাজসজ্জা না করে অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় জবু থবু হয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় স্ত্রীকে দেখলে স্বামীর মনে বিরক্তির ভাব জাগতে পারে। আর তা দাম্পত্য জীবনের স্থায়ীত্বের জন্য কিছুমাত্র সহায়ক নয়। তাই দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরতে থাকলে স্বামীদের কর্তব্য পূর্বাহ্নে খবর দেয়া, যেন স্ত্রীরা তাদেরকে গ্রহণ করার জন্য রীতিমত প্রস্তুত হয়ে প্রতীক্ষমান হয়ে থাকতে পারে। রাসূলে করীম (সা) এর নির্দেশনার ভাষাটি এইঃ
আরবী (************)
‘একটু অপেক্ষা কর-এখনই বাড়িতে প্রবেশ করো না, দেরী করে রাত্রিকালে ঘরে যাবে। এই অবসরে স্ত্রীরা তাদের মাথার বিস্তৃত চুলগুলো আচড়ে নেবে আর তারা গোসল করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে তৈরী থাকবে।’- বুখারী, মুসলিম।
৫। ইসলাম যেমন স্বামীর হৃদায়াবেগের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে স্ত্রীর মন মানসিকতার প্রতি সম্মান দেখানোর ওপর বিশেষ জোর। কেননা স্ত্রী তো নিছক লালসার বহ্নি নির্বাপিত করার একটা হাতিয়ার মাত্র নয়-নয় হৃদয়াবেগশূণ্য পাথরের মানবী দেহ। তার হৃদয় মনে সূক্ষ্ম অনুভূতি তীব্রভাবে বর্তমান। তাই সে অনুরূপ হৃদয়াবেগ দেখতে চায় প্রতিপক্ষের মধ্যেও। স্ত্রীর ঠুনকো মনের কাঁচে একবিন্দু আঘাতে তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।
৬। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক গভীরতর এবং মাধূর্যময় করে তোলার জন্য উত্তম নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। তারও প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, পারস্পরিক মত বিরোধ ও বিরাগ বিকর্ষণ যেন দাম্পত্য জীবনের একাত্মতাকে বিনষ্ট করে না দেয়। খোদ নবী করীম (সা) তাঁর স্ত্রীদের সাথে এমন সব ব্যাপারে একাত্ম হয়েছেন, যা তাকওয়া-পরহেজগারীর প্রচলিত ধারণার বিপরীত মনে হতে পারে। কিন্তু তাও তিনি করেছেন-করা কিছুমাত্র অসঙ্গত মনে করেন নি শুধু এই জন্যে যে, নারীরাও মানুষ-পাথর নয়। এসবের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের মাধূর্য বৃদ্ধিই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ ‘আমি রাসূলের সঙ্গে একত্রে খাবার খেতে বসতাম। খাওয়ার সময় গোশত ভরা হাড় খানিকটা চিবিয়ে আমি তাঁর পাতে ফেলে দিতাম। তিনি সেটি সেখান থেকেই খেতে শুরু করতেন, যেখান থেকে আমি চিবিয়েছিলাম।’ বস্তুতঃ দাম্পত্য জীবনে মাধূর্য সৃষ্টির জন্য এই ধরনের কার্যকলাপ কিছুমাত্র কম সহায়ক নয়। এক কথায় বলা যায়, দাম্পত্য জীবনকে ইসলাম নিছক কতিপয় ধরাবাঁধা রীতিনীতির মধ্যে সীমিত করতে চায় নি। তাতে নানাভাবে সৌন্দর্য, মাধুর্য্ ও আকর্ষণীয় পরিবেশ গড়ে তোলার উপকরণও দিয়েছে।