বৈবাহিক আইন
বস্তুত কুরআন মজীদের দাবি হল, আইনের বইতে, নৈতিকতার বিধানে এবং অধিকারসমূহের তালিকায় নারী ও পুরুষকে অভিন্ন মর্যাদা দিতে হবে। উভয়ের সম্মান-অসম্মানের মানদন্ড একই হতে হবে। উভয়ের জন্য উন্নতি, প্রগতি ও সাফল্য লাভের সুযোগ সুবিধা সম্পূর্ণ সমান থাকতে হবে। উভয়ের জান-মাল ও সম্মান সম্ভ্রম সমান গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কেন?
দুনিয়ার আধুনিক সাহিত্যে কুরআন মজীদই সর্বপ্রথম এর দার্শনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জবাব দিয়েছে এবং দৃঢ়ভাবে ও অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে বিশ্ব মানবের সামনে তা পেশ করেছে। বিশ্ব চিন্তা শত সহস্র পর্যায় অতিক্রম করার পরও নারী পুরুষের সাম্য ও অভিন্নতার ব্যাখ্যা এর চাইতে উত্তম ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পেশ করতে সক্ষম হয় নি।
ইসলাম সর্বপ্রথম বিশ্ব-দর্শন পর্যায়ে বলেছে, এই বিশ্বলোক একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর প্রতিটি দিক, প্রতিটি বস্তু ও কণা পরম সুসঙ্গতি, নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সুসমঞ্জস্যভাবে প্রতি মুহুর্তে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে সহস্র কোটি বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও এই বিশাল রঙ্গমঞ্চের নিত্য পরিবর্তনশীল সৌন্দর্যে ও মনোহারিতায় বিন্দুমাত্র পার্থক্যও আসেনি। কালের আবর্তন অব্যাহত গতিতে অগ্রসরমান। এর বৈচিত্র্য ও বিস্ময় যথাযথই রয়ে গেছে। কোন মহাশক্তি এই বিশ্বলোককে চরম ধ্বংস ও বিলুপ্তির কবল হতে রক্ষা করছে? কোন নিয়ম বিধান এখানকার মুহুর্ত ও বিন্দুসমূহকে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হতেও দীর্ঘতর ও বিলম্বিত করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? এর সদুত্তর একমাত্র কুরআনই দিয়েছে। সে বলেছে, বস্তুলোকে বৈবাহিক নিয়মের কার্যকর অবস্থিতিই তার মূল উৎস। প্রতিটি বস্তুর মধ্যে তার স্বজাতির স্থিতি ও টিকে থাকার স্বভাবজাত প্রবণতা প্রকটভাবে বর্তমান। আর এই প্রবণতার পরিতৃপ্তি ও চরিতার্থতার জন্য তার স্ব-প্রজাতির মধ্য থেকেই বিপরীত লিঙ্গের সৃষ্টি করা হয়েছে। এই বিপরীত লিঙ্গ তার মধ্যে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও সংবেদনশীলতা সক্রিয় রেখে তাকেও সক্রিয় করে তুলেছে এবং তাকে স্বকীয় অস্তিত্ব বহাল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করেছে। ঠিক এ কারণেই বস্তুলোকে প্রজাতীয় অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন ও অব্যাহত থাকা সম্ভবপর হচ্ছে। কুরআন মজীদ ঘোষণা করেছেঃ
আরবী (*********)
-“মহান পবিত্র সেই সত্তা, যিনি সব ধরনের জোড়া সৃষ্টি করেছেন জমীনের উদ্ভিদগুলির মধ্যেও, এমন বহুসংখ্যক জিনিসের মধ্যেও যাদের তারা জানে না। ”
আরবী (********)
-“প্রতিটি জিনিসই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি আমরা, যেন তোমরা (সৃষ্টি রহস্য ও সৃষ্টি নিয়ম) অনুধাবন করতে পার।”
বস্তুতঃ বৈবাহিক ও দুই বিপরীত সেক্সের মিলন-রীতি সমগ্র সৃষ্টিলোকে পরিব্যাপ্ত। মানুষ বা অন্য কিছুই এই নিয়মের বাইরে নয়। মানুষের জৈবিক কামনা বাসনা বিপরীত লিঙ্গের সাথে পূর্ণ মিলন ব্যতীত কোনক্রমেই চরিতার্থ হতে পারে না। পুরুষের জীবনের বহু দিক এমন, যার বিকাশ ও সার্থকতা কেবল নারীর দ্বারাই সম্ভব। নারী হচ্ছে পুরুষের প্রকৃতিগত দাবি ও স্বভাবগত প্রশ্নাবলীর জবাব। এ কারণে নারীকে বলা হয় পুরুষের হৃদয় বীনার ঝংকার। নারীর জন্য পুরুষও অনুরূপ অপরিহার্য। তার হৃদয়াবেগের উথাল পাথাল ও অন্তরের অস্থিরতার চরম প্রশান্তি পুরুষের দ্বারাই সম্ভব। মহান স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়মই এইরূপ যে, এর একটি অপরটির জন্য পরিপূরক। বিবাহ ব্যবস্থা তারই জন্য এক পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক ব্যবস্থা। বস্তুতঃ নারীও পুরুষ উভয়ে স্বীয় যোগ্যতা-কর্মক্ষমতা ও প্রজাতীয় বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্বের প্রকাশ ও বিকাশের জন্যে একটি ক্ষেত্রের মুখাপেক্ষী। বিপরীত লিঙ্গই হচ্ছে সেই ক্ষেত্র। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে জীবন যাপন শুরু করলেই নারী ও পুরুষ উভয়ে নিজ নিজ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রটি খুঁজে পেতে পারে। এই প্রয়োজনীয়তা ও পরিপূরকতা নারী পুরুষে সম্পূর্ণ সমান। কোন পার্থক্যই নেই এখানে। উভয়ই পারস্পরিক নির্ভরতা ও মুখাপেক্ষীতায় আবদ্ধ। কেউই কাউকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। এতে কারুর বিশেষ কোন প্রাধান্য নেই-নেই কারুর বিশেষ কোন শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশেষত্ব। কুরআন মজীদ নানাভাবে এই সত্যটি প্রকট করে তুলেছে। একটি ঘোষণায় বলা হয়েছেঃ
-আরবী (*******)
-“স্ত্রীলোকেরা-হে পুরুষ-তোমাদের জন্য ভূষণ স্বরূপ এবং তোমরা পুরুষরাও ভূষণ তাদের জন্য”।
কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে, পুরুষদের বহু ক্ষুধা তৃষ্ঞা নারীর দ্বারা নিভৃত হওয়া সম্ভব এবং স্বয়ং নারীর বহু অপূর্ণতাই পুরুষ দ্বারাই পূর্ণতা পেতে পারে। নারী ও পুরুষের এই বৈবাহিক সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুতা ভালবাসা ও প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক। পারস্পরিক শত্রুতা বা হিংসা বিদ্বেষের কোন অবকাশ নেই এখানে। কুরআন মজীদ ঘোষণা করেছেঃ
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ [٣٠:٢١]
-“আল্লাহর অস্তিত্বের একটা বড় নিদর্শন হচ্ছে, তিনি তোমাদের স্বজাতির মধ্য হতে জোড়া সৃষ্টি করেছেন তোমাদের প্রত্যেকের জন্য, যেন তোমরা সেই জুড়ির নিকট মনের প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তিনিই তোমাদের এই জুড়িগুলির মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ এর মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের জন্য চিন্তা ও গবেষণার বহু নিদর্শন রয়েছে”।
এই ভিত্তিগত তত্ত্বগুলোর ওপরই ইসলামী সমাজে নারীর মর্যাদা নির্ণিত ও নির্ধারিত। এ সব ভিত্তিকে বাদ দিয়ে ইসলামী সমাজের কথা চিন্তাও করা যায় না।
নারীর আসল কর্মক্ষেত্র
ইসলামী সমাজে নারীর ভূমিকা কি? তার চেষ্টা-সাধনা কোন দিকে ও কোন পথে চলবে? কুরআন মজীদ নবী করীম (স) এর বেগমদের সম্বোধন করে এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ
-“তোমরা নিজেদের বাসগৃহে শক্তভাবে আসন গ্রহণ করে থাক। পূর্ববর্তী জাহেলী সমাজে স্ত্রীলোকেরা যেরূপ নিজেদের রূপ ও সৌন্দর্য প্রকাশ্যভাবে দেখিয়ে বেড়াত, তোমরা তা কস্মিনকালেও করবে না”।
আয়াতটি পটভূমি স্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) যখন মদীনায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তখন দ্বীন ইসলামের দুশমনরা বিকাশমান মুসলিম সমাজ ব্যবস্থাকে শক্তিহীন করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাতে লাগল। ইসলাম একদিকে নৈতিক পবিত্রতা-পরিশুদ্ধি ও খোদার প্রতি ঐকান্তিকতা একাগ্রতার আহবান জানাচ্ছিল। আর কাফির শক্তি সমাজে নানারূপ বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে চেষ্টা পাচ্ছিল। এই সময় মুসলিম শক্তিও কাফির শক্তির মধ্যে যে প্রচন্ড দ্বন্ধ সংঘর্ষের উদ্ভব হয়েছিল, তাতে ইসলাম তার সমাজ সংস্থাকে সুষ্ঠভাবে গড়ে তোলার ও মুসলিম ব্যুহকে সুদৃঢ় রাখার জন্য সমাজের লোকদের পুর্নবিন্যাস করার তীব্র প্রয়োজন বোধ করে; দেশ ও সমাজের সংরক্ষণে নবতর আইন বিধান উপস্থাপন করে। তাতে পুরুষ লোকদেরকে সকল প্রকার প্রতি-আক্রমণ ও ফিতনা ফাসাদের মোকাবিলা করার জন্য সারিবদ্ধ করা হল এবং নারীদের নির্দেশ দেয়া হল গৃহ ক্ষেত্রে শক্ত হয়ে সর্বপ্রকার ভাঙন এবং বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। কেননা সমাজের গৃহ-দুর্গই গোটা সমাজের স্থিতির মূল কেন্দ্র। বাইরের মুকাবিলায় পরাজিত হলেও মানুষ গৃহদুর্গে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। কিন্তু যে সংগ্রামীদের গৃহ দুর্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তাতে শত্রু পক্ষের অনুপ্রবেশ ঘটে, সেই সংগ্রামীদের আশ্রয় নেয়ার আর কোন স্থানই অবশিষ্ট থাকে না। এই গৃহ-দুর্গের শক্তিমান রক্ষী হতে পারে মহিলারা। তারা এই গৃহ দুর্গে নিজেদের মান সম্ভ্রম ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রেখে গোটা সংগ্রামী বাহিনীকে বিরাট সাহায্য দানের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করতে পারে।
এই প্রেক্ষিতে দ্বিধা-সংকোচ মুক্ত হয়ে বলা যেতে পারে যে, ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজ সংরক্ষণের দায়িত্ব নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপরই অর্পণ করেছে বটে, কিন্তু কার্যত এ দুইলিঙ্গের সংগ্রাম ক্ষেত্র এক ও অভিন্ন রাখেনি। ইসলাম পুরুষদের চালিত করতে চায় অগ্রবর্তী বাহিনীরূপে আর মহিলাদের জন্য প্রকৃত সংগ্রাম ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাদের গৃহকোণ। উভয়েই নিজ নিজ ক্ষেত্রে পূর্ণ শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তা সহকারে দাঁড়িয়ে থেকে কুফরী আদর্শ ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাবে। আর সংগ্রাম ক্ষেত্রে প্রতিটি বাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট ফ্রন্টে অবিচল হয়ে থাকার উপরই নির্ভর করে সংগ্রামে বিজয় লাভের সম্ভাবনা। একটি বাহিনীও যদি নিজের নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ত্যাগ করে, তা হলে পরাজয় অবধারিত। এই দৃষ্টিতে উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করলে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, আল্লাহ তায়ালা চান, মহিলা সমাজ তাদের গৃহকোণকেই নিজেদের স্থায়ী কর্মক্ষেত্ররূপে গ্রহণ করুক। এবং এই ক্ষেত্রটি ত্যাগ করে অপর কোন ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ভুল যেন তারা কখনোই না করে। অন্যথায় সংগ্রামে শুধু পরাজয়ই বরণ করতে হবে না, চরমভাবে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে যাবে ইসলামের গোটা সমাজ-প্রাসাদ।
আল্লামা আবু বকর আল-জাসসাস উপরোক্ত আয়াতের আইনগত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ ‘নারী সমাজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের ঘরে স্থিতি গ্রহণের জন্য এবং ঘর ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে পড়তে তাদের নিষেধ করা হয়েছে”।
বস্তুতঃ ইসলামী সমাজে নারীর আসল স্থান-প্রকৃত কর্মক্ষেত্র তার ঘর। বৃহত্তর জীবন সাধনার কোন একটি ব্যাপারেও নারীর এই ক্ষেত্র নির্দেশে বিন্দুমাত্র ভুল করা হয় নি। ইবাদতের অনুষ্ঠান, সামাজিক সামষ্টিক কার্যাবলী, পরিবারসংস্থা, অর্থনৈতিক কর্ম তৎপরতা বা রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যস্ততা-কোন একটি কাজের জন্যও নারীকে তার ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে বলা হয় নি।
ইসলামী ইবাদতসমূহের মধ্যে নামাজের স্থান সর্বোচ্চ এবং তার গুরুত্ব সর্বাধিক। নামায পড়া ব্যক্তির জন্য ফরজ; কিন্তু তা আদায় করার নিয়ম জামা’আতের সাথে। জামা’আতের সাথে নামায পড়া ইসলামরে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কিন্তু নারী সমাজকে এই বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে। নারীদের প্রতিও পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে, কিন্তু জামা’আতের সাথে পড়া জরুরী ঘোষণা করা হয় নি। রাসূল করীম(স) ঘোষণা করেছেনঃ আরবী (*******)
“গৃহের নিভৃততম কোণই নারীর জন্য উত্তম মজলিশ”।
জুম’আর নামায মুসলমানদের সাপ্তাহিক ইবাদত। এই নামায মুসলিম সংহতির বাহ্য রূপ। ব্যক্তিগত সপ্তাহের এই একটি দিন ব্যাপক ও বিপুল সংখ্যায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় লুটায়। নিজেদের সামষ্টিক বিষয়াদি নিয়ে পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা করে; রাষ্ট্রীয় নির্দেশাদি লাভ করে এই জুম’আর নামাযের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে। ইসলামী সমাজ বিধানের দৃষ্টিতে এই নামাযের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। কিন্তু তা সত্ত্বেও নারীদের ওপর এই নামায ফরয করা হয় নি, জুমু’আর জামা‘আতে শামিল হওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় নি।
জানাজার নামায পড়া ও লাশ দাফনের জন্য কবরস্থান পর্যন্ত অনুগমন ইসলামী সমাজে সর্বসাধারণের দায়-দায়িত্বের ব্যাপার। কিন্তু সমাজের মহিলাগণকে এই কাজে শরীক হতে বারণ করা হয়েছে।
ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রকে খতম করার উদ্দেশ্যে কুফরী শক্তি যখন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন মুসলমানদের কর্তব্য হয় সর্বশক্তি দিয়ে তার মুকাবিলা করা। যুদ্ধ করে শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করা। কিন্তু ইসলাম এই দায়িত্ব প্রধানতঃ পুরুষদের ওপরই অর্পণ করেছে, নারীদের ওপর নয়। রাসূলে করীম (স) হযরত আয়েশা (রা) কে লক্ষ্য করে বললেনঃ
আরবী (************)
-“তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে ঘরে দৃঢ় ও স্থিতিশীল হয়ে বসে থাকা। এ-ই তোমাদের জিহাদ”।
জিহাদে শরীক হয়ে পুরুষরা বিজয়ী হলে তারা বিপুল গণীমতের মাল পায়। আর শহীদ হয়ে গেলে আল্লাহর নিকট পায় মহা সম্মান ও মর্যাদা। কিন্তু মেয়েরা এই কাজে শরীক হতে না পেরে পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে থাকে কি না?
প্রশ্নটি খুবই যুক্তিসঙ্গত এবং এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। রাসূলে করীম এর (স) জীবদ্দশায়ই এই প্রশ্ন উঠেছিল এবং তিনিই এর সুস্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন,স্ত্রীলোকেরাও অনুরূপ সাওয়াব ও মর্যাদা লাভ করতে পারে-
আরবী (********)
-“তাদের স্বামীদের আনুগত্য ও তাদের নিজেদের অধিকার জানতে পারলেই”।
কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের জন্য শ্রম, কষ্ট স্বীকার ও ত্যাগ তিতিক্ষা বরণের আবেগ উদ্যম নারীদের মনেও জাগতে পারে। ঈমানদার মহিলাদের ব্যাপারে এটা খুবই স্বাভাবিক। ইসলাম এই আবেগ উদ্যমকে বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা করেছে বটে; কিন্তু শ্রম-সাধনা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ক্ষেত্র পরিবর্তন করে গিয়েছে। নারীরাও কষ্ট স্বীকার করতে পারবে, ঘরের বাইরেও যেতে পারবে; কিন্তু জাতির ভাগ্যের ফায়সালা বা সামাজিক সামষ্টিক সমস্যার সমাধানের জন্য নয়, তা করবে আল্লাহর বন্দেগী কবুল করার ব্যাপারটিকে অধিকতর দৃঢ় করে তোলার উদ্দেশ্যে। রাসূলে কারীম (সা) বলেছেনঃ আরবী (*********)
-“হ্যাঁ, মেয়েলোকদের পক্ষেও জিহাদ করা ফরয, কিন্তু, তা এমন জিহাদ যাতে অস্ত্র চালনা বা রক্তপাত ও মারামারি নাই। তা হল হজ্জ ও উমরা করা।”
নামাযের জামায়াতে বা জুম’আর নামাযে শরীক হওয়া নারীদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম করে দেওয়া হয় নি। তবে একাজ পছন্দ করা হয় নি। এজন্য ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে বটে; কিন্তু ব্যবস্থা এমন করা হয়েছে, যাতে করে প্রতি পদে ও প্রতি মুহুর্তে তাদের মনে জাগ্রত থাকে যে, তাদের আসল ক্ষেত্র ঘর-বাইর নয়। মসজিদে নামাযের জামা‘আতে মেয়েদের শামিল হওয়ার জন্য তাদের সারিকে সম্পূর্ণ পিছনে ও ভিন্নতর রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও পুরুষদের সর্বশেষ সারি ও স্ত্রীলোকের সর্বপ্রথম সারি-নারী পুরুষদের নৈকট্যের কারণে বিপজ্জনক উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে পুরুষদের প্রথম দিকে কাতার ও স্ত্রীলোকদের সর্বশেষ কাতার-নারী পুরুষদের দুরত্বের কারণে উত্তম বলা হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, নারী তার আসল কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করে অন্য কোন কাজে লেগে যাবে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) তা আদৌ পছন্দ করেন নি। নারীর জন্য যে কর্মক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই সে কর্মতৎপর হয়ে থাক, নারীর প্রতি এটাই কাম্য।
সমাজ একটি একক
সমাজ যদি কোন ব্যক্তিকে তার কোন একটি বিশেষ বিভাগের বা কাজের দায়িত্ব অর্পণ করে, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়ায়না যে, সে ব্যক্তি সমাজের অন্যান্য বিভাগ হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে; সে অন্যান্য ব্যাপারে কোন কৌতুহল –কোন ঔৎসুক্য পর্যন্ত রাখবে না বা কঠিন প্রয়োজনেও তাতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ বা অধিকার পাবে না। এভাবে বিশেষ একটি কাজে বা বিশেষ একটি বিভাগের সাথে কাউকে জড়িত করার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সে তার বেশিরভাগ সময়, শক্তি ও মনোনিবেশ প্রধানতঃ সেই একটি ব্যাপারেই নিয়োজিত করবে। কেননা সমাজে বিভিন্ন বিভাগ বা কাজ বাহ্যতঃ যতই বিভিন্ন দেখা যাক না কেন, আসলে ও মূলগতভাবে এগুলো আদৌ বিভিন্ন ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। এগুলো একই সমাজ সংস্থার বিভিন্ন অংশ মাত্র। এগুলোর সমন্বয়েই সমাজ সংস্থা গড়ে ওঠে। এগুলোর কোন একটি অংশকে বাদ দিলে সমাজ সংস্থাই তার পূর্ণাঙ্গতা হারিয়ে ফেলবে। এই বিভাগগুলোর কোন একটি নিয়েই সমষ্টি নয়, কোন একটি সমষ্টির সার্বিক চাহিদা পূরণের জন্য তা কোনক্রমেই যথেষ্ট হতে পারে না। সমাজ-সংস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য এই সবগুলোর নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকা একান্ত জরুরী। এ কথার সত্যতা কোন সমাজতত্ত্ববিদই অস্বীকার করতে পারে না।
ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একথা সত্য। কোন ব্যক্তিই জীবনের অসংখ্য জরুরী কাজের মধ্যে কেবল একটি কাজ নিয়ে থাকতে পারে না; থাকলে তার গোটা জীবনটাই অচল হয়ে যাবে। কেননা ব্যক্তির সামাজিক প্রয়োজন সমাজের বিশাল ক্ষেত্রে বিস্তীর্ণ হয়ে আছে। সমাজের কৃষক, কামার, কুমোর, শিক্ষক-ছাত্র, সরকারী কর্মচারী, রাষ্ট্রের পরিচালক-বিচারপতি, পুলিশ, সৈনিক সকলের ব্যাপারেই এ কথা সত্য। এই দৃষ্টিতেই বলতে হয়, ইসলাম নারীকে ঘরের কাজে নিযুক্ত করেছে বলে তাকে কেবল ঘরের মাঝেই বন্দী হয়ে থাকতে হবে-ঘরের বাইরে কোন কাজে কিছুমাত্র ঔৎসুক্যও দেখাতে পারবে না, কঠিন প্রয়োজনের সময়ও তাতে কিছুমাত্র অংশগ্রহণ করতে পারবে না, ইসলামী সমাজ বিধানে এমন কথা বলা হয় নি।
সমাজে ব্যক্তির সাফল্যের শর্তাবলী
ব্যক্তিদের নিয়েই সমাজ। তাই বলে সমাজ সংস্থায় ও সমাজ জীবনে ব্যক্তি সত্তা কখনো তুচ্ছ বা বিলীন হয়ে যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে, সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা কোন অংশেই কম গুরুত্বহীন নয়; বরং তাকে সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করতে হয়।
সমাজে ব্যক্তির সফল ভূমিকা পালনের জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত হল, ব্যক্তির নির্ভুল চিন্তা-চেতনা তথা ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও পার্থক্যবোধ। কেবল ব্যক্তিসত্তার বিকাশের জন্যই নয়, সমাজের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্যও ব্যক্তি সত্তায় এই গুণের অবস্থিতি অপরিহার্য। এ না হলে ব্যক্তি ও সমষ্টির মাঝে পূর্ণমাত্রার সংহতি ও একাত্মতা গড়ে উঠতে পারে না। সমাজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ব্যক্তির সুস্পষ্ট ধারণা ও জ্ঞান না থাকলে সে কোন দিনই সমাজের কল্যাণে কোন বিশেষ অবদান রাখতে পারে না।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ও কল্যাণ কামনার ভিত্তিতে সমাজের জন্য কাজ করবার অবাধ সুযোগ থাকতে হবে। ব্যক্তি যে পথেই অগ্রসর হতে চাইবে, সার্বিকভাবে সমাজের জন্য অকল্যাণকর না হলে সে পথে তার অগ্রসর হওয়ার অধিকার থাকা আবশ্যক। কেউ যদি তার এপথে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে , তাহলে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার মত শক্তি থাকতে হবে সমাজের। নতুবা ব্যক্তির পক্ষে কোন ভূমিকা পালন করাই সম্ভবপর হবে না।
আর তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, সমাজ যদি ব্যক্তির নিকট দাবি জানায় সমাজের জন্য কাজ করার, তাহলে সমাজের কল্যাণে নির্ভুল পন্থায় কাজ করার অধিকার ব্যক্তিকে অবশ্যই দিতে হবে। সমাজস্বার্থের পরিপন্থী কাজ করার অনুমতি না থাকলেও তার কল্যাণে কাজ করার স্বাধীনতা থাকা ব্যক্তি ও সমষ্টি সকলেরই জন্য জরুরী।
এ তিনটি শর্তের পরিপূরণ সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। প্রচলিত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতেও এ শর্তসমূহের অপরিহার্যতা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এই শর্তগুলো পূরণ হলেই ব্যক্তির পক্ষে সমষ্টির জন্য কল্যাণকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব হতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই শর্ত তিনটির বিস্তারিত আলোচনার জন্য তিনটি শিরোনাম দেওয়া যায়। তা হলঃ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কর্মের সুযোগ ও সামাজিক পুনর্গঠন-সংশোধন প্রচেষ্টার স্বাধীনতা।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা নারী সমাজের ক্ষেত্রে এই তিনটি শর্ত কতটা পূর্ণ করতে সমর্থ, তা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। অতঃপর সেই আলোচনাই শুরু করতে চাই।
ইসলামের আগমনের পূর্বে তৎকালীন আরব জনগণ সামাজিক বন্ধন ও নিয়ম শৃঙ্খলামুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করত। সুস্পষ্ট জীবনবোধ বলতে কিছু ছিল না তাদের, কোন নৈতিক বিধি বিধান তারা মানত না। এ পর্যায়ে কোন আলোচনা বা বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেও রাজী ছিল না তারা। এ দুনিয়ার জীবনে দৈহিক সুখ সুবিধা এবং আনন্দ স্ফূর্তি লাভ করাই ছিল তাদের সর্বপ্রকার চেষ্টা সাধনার একমাত্র লক্ষ্য। এই বৈষয়িক জীবনের অন্তরালে অপর কোন জগত এবং এই বস্তুজীবনের পর কোন বস্তু-উর্ধ্ব জীবনের কল্পনা করাও ছিল তাদের সাধ্যাতীত। এই অবস্থায় ইসলাম তাদের সামনে আধ্যাত্মিক ও আদর্শভিত্তিক জীবনের এক সুস্পষ্ট চিত্র ও পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা উপস্থিত করে। এতে ছিল একটা পূ্র্ণাঙ্গ নৈতিক বিধি-বিধান। তাতে হালাল ও হারামের একটা তালিকাও ছিল। সওয়াব ও আযাব এবং জান্নাতও জাহান্নামের কথাও বলা হয়েছিল সুস্পষ্ট ভাষায়। আর এই সবের ভিত্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছিল আল্লাহর একত্ব, রাসূলের নব্যুয়ত রিসালাত ও পরকালের বিশ্বাস স্থাপনের হৃদয়স্পর্শী আহবান। আরবের লোকেরা যখন ধীরে ধীরে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে শুরু করে, তখন ইসলামের ভিত্তিতে একটা সমাজ গড়ে উঠে। এই সময় কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত ঘোষণাটি নাজিল হয়। এই ঘোষণার বক্তব্য ছিলঃ কোন নারী যদি ইসলামী সমাজ সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছা করে , তাহলে তাকে কতকগুলো বিষয়ে স্পষ্ট ভাষায় অঙ্গীকার বা শপথ করতে হবে। ঘোষণাটি এইঃ
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ ۙ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٦٠:١٢]
- হে নবী! মুমিন স্ত্রীলোকেরা যখন তোমার নিকট বায়আত গ্রহণের জন্য আসে এসব বিষয়ে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে একবিন্দু শিরক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না. তাদের সন্তান হত্যা করবে না, জেনে-শুনে কারুর ওপর মিথ্যা দোষারোপ করবে না, ভাল কাজে তোমার অবাধ্যতা করবে না, তখন তুমি তাদের বায়‘আত গ্রহণ কর এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট মাগফিরাত চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সূরা মুমতাহিনাঃ ১২)।
এ আয়াতে দ্বীনের যে কটি মৌলিক বিষয়ের শপথ নেয়ার জন্য রাসূলে করীম (স) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা কেবল নারীদেরই ব্যাপার নয়; তা পুরোপুরি পুরুষদের জন্যও প্রযোজ্য। কেননা পারিবারিক বিষয়াদির সাথে তাদের যা সম্পর্ক, তার চাইতে অনেক বেশি সম্পর্ক বাইরের জীবনের বিষয়াদির সাথে। এ-ও জানা গেল যে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি পরিপূরণের দায়িত্ব যতটা পুরুষের, স্ত্রীলোকদের দায়িত্ব তার চাইতে কিছুমাত্র কম নয়। জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে কার কি দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা যেমন পুরুষদের জন্য জানা দরকার, তেমনি স্ত্রীলোকদেরও। “কোন ভাল ও মঙ্গলজনক কাজেই রাসূলের অবাধ্যতা বা নাফরমানী করা হবে না” কথাটি ছোট্ট হলেও সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলার বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঙ্গীকার মানুষকে দায়িত্বশীল বানিয়ে রাখে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে রাসূলের প্রবর্তিত আদর্শের পরিপন্থী যে কোন কাজের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য এটি মানুষকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও কৃতসংকল্প বানিয়ে দেয়। ফলে নারী সমাজকেও দ্বীনের সংরক্ষণ ও দ্বীন ভিত্তিক সমাজ শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সংগ্রামী করে তোলে। রাসূলে করীম (সা) এর জীবদ্দশায়ই এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল। দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ বিধান সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান লাভের জন্য তখন মহিলা সাহাবীরা অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেছেনঃ “মেয়েরা দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞানার্জনের জন্য এতই তৎপর হয়ে উঠেছিল যে, এ পথে তারা কোনরূপ লাজ-লজ্জারও পরোয়া করতো না।” (মুসলিম)। হযরত আয়েশা (রা) এও বলেছেন, “নবী করীম (সা) এর সময়ে কোন আয়াত নাজিল হলে তাতে বর্ণিত হালাল হারাম ও আদেশ নিশেধসমূহ সঙ্গে সঙ্গেই আমরা আয়ত্ব করে নিতাম, তার কেবল শব্দগুলো মুখস্ত করে ক্ষান্ত হতাম না।” (আল ইকদুল ফরীদ)।
জুমু’আ ও ঈদের নামাযে শরীক হওয়ার জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসা স্ত্রীলোকদের জন্য জরুরী করা হয়নি বটে; কিন্তু তাতে যে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেয়া হয়, তা শ্রবণ ও তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সুযোগ গ্রহণ নারীদেরও কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।–বুখারী।
রাসূলে করীম (সা) এর সময়ে জ্ঞান চর্চার যেসব মজলিশ অনুষ্ঠিত হত, মহিলারা সেসবের অদূরে পর্দার অন্তরালে উপস্থিত থেকে তা থেকে যথেষ্ট উপকার লাভ করতেন। তাঁরা রাসূল (সা) এর ভাষণ শুনবার জন্য স্বতন্ত্রভাবে একত্রিত হতেন। শুধু চিত্তবিনোদনের জন্য নয়, ইসলাম সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্জনই ছিল এসব শিক্ষা সবাবেশে তাঁদের উপস্থিতির মুখ্য উদ্দেশ্য। অনেক মহিলা এমনও ছিলেন, যারা রাসূলের মুখে কুরআন পাঠ শুনেই তা মুখস্ত করে ফেলতেন। রাসূলে করীম (সা) নিজেও মহিলাদের দ্বীন ইসলাম শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ চিন্তা ভাবনা করতেন ও সেজন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। কোন সময় যদি তিনি মনে করতেন যে, মহিলারা তাঁর কোন কথা ঠিকমত শুনতে পারে নি, তাহলে তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে সেকথার পুনরাবৃত্তি করতেন। বস্তুতঃ সমাজের পুরুষদের ন্যায় মহিলাদেরও যে দ্বীন সম্পর্কে সুশিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা করা সমাজ প্রধানের দায়িত্ব, তাতে সামান্যতম সন্দেহ নেই। তাই সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা মহিলাদের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট মনে না হলে রাসূলে করীম (স) তাদের জন্য অনেক সময় স্বতন্ত্র ব্যবস্থাও গ্রহণ করতেন। মহিলারাই একবার রাসূলে করীম (সা) এর নিকট উপস্থিত হয়ে দাবি জানালেন এই বলে যে, “আপনার দরবারে সব সময় কেবল পুরুষদের ভিড় জমে থাকে, আমরা আপনার নিকট হতে শিক্ষা গ্রহণের কোন সুযোগ পাই না। কাজেই আমাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভিন্নতর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।” তাদের দাবি অনুযায়ী তিনি তাই করেছিলেন। মদীনার আনসরা গোত্রের মহিলাদেরকে একটি ঘরে একত্রিত করে তাদের দ্বীন শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে সেখানে তিনি হযরত উমর ফারুক (রা) কে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মহিলাদেরকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিয়েছিলেন।
অন্য কথায়, মহিলাদের জন্যও শিক্ষা অপরিহার্য ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এই শিক্ষার জন্য নারীদের শালীনতা বিরোধী কোন পরিবেশ বা পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়া কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু ও পাঠ্য পুস্তকেও নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য হওয়া আবশ্যক। সে ক্ষেত্রেও নারী পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণ সম্পূর্ণ পরিহার্য।
স্ত্রীলোকদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ লাভের সঠিক ও উপযুক্ত ক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর-পারিবারিক পরিবেশ। এই কারণে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব প্রধানত পিতা মাতা ও স্বামীর উপর অর্পণ করা হয়েছে। রাসূলে করীম (সা) এর এই পর্যায়ের একটি নির্দেশের ভাষা এইঃ আরবী (************)
“তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের নিকট চলে যাও, তাদের মধ্যে বসবাস কর, তাদের জ্ঞান শিক্ষা দাও এবং তদনুযায়ী আমল করার জন্য তাদের আদেশ কর।”
কুরআনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষ করে ঘরের মহিলাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী করীম (সা) পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামী সমাজে মহিলারা দ্বীন সম্পর্কে জরুরী জ্ঞান লাভ করুক, রাসূলে করীম (স) এর এই ছিল বাসনা এবং চেষ্টা। কেবল নীতিগত জ্ঞান শিক্ষা দেয়াই লক্ষ্য ছিল না, সেই সঙ্গে বিভিন্ন কারিগরী জ্ঞান শিক্ষা দেয়াও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এজন্য কেবল উপদেশ দিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেন নি, আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন। পিতা-মাতা বা স্বামী যদি পারিবারিক পরিবেশে জরুরী দ্বীনি শিক্ষা দানের ব্যবস্থা না করে, তাহলে ঘরের বাইরে গিয়েও সেই জ্ঞান লাভ করার সুযোগ মহিলাদেরকে দিতে হবে। এই হচ্ছে ইসলামী আইনের বিধান। দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের জন্য নারীকে সুযোগ সুবিধা দিতে গোটা সমাজই দায়িত্বশীল। এই পথে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা দূর করতে হবে সমাজকেই। শুধু কিতাবী বিদ্যাই নারীদের জন্য যথেষ্ট নয়, তাদের চিন্তা শক্তির উৎকর্ষ সাধন এবং অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে নব নব সত্য ও তত্ত্ব উদঘাটনের জন্য তাদের মানসিক শক্তির বিকাশ সাধনের ব্যবস্থা করাও ইসলামী সমাজের কর্তব্য।