দ্বীনের প্রতিরক্ষায় উৎসাহ দান
দ্বীন ইসলামের প্রতিরক্ষা কাজে মুসলিম মহিলাগণ একদিকে যেমন তীর ও তরবারির সাহায্যে কাজ করেছেন, তেমনি এই উদ্দেশ্যে তাঁরা সাহিত্য ও বাকশক্তিরও পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। এভাবে সত্য দ্বীনের ক্রমশঃ শক্তি বৃদ্ধিতে তাঁদের বস্তুগত শক্তি ও সাংস্কৃতিক শক্তির পূর্ণ সদ্বব্যবহার সাধিত হয়েছে। এই মহিলাদের উৎসাহব্যঞ্জক বক্তৃতা-ভাষণে বহুসংখ্যক লোক আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনের জন্য তাঁরই পথে জান-মাল ও যথাসর্বস্ব লুটিয়ে দিতে উৎসাহিত হয়েছেন। ইবনে আবদুল বার নবী করীম (স) এর ফুফু ও আবদুল মুত্তালিব দুহিতা আরওয়া সম্পর্কে লিখেছেনঃ
আরবী (*********)
“ঈমান গ্রহণের পর তিনি সর্বশক্তি দিয়ে নবী করীম (স) এর সাহায্য সহযোগিতা করতেন এবং তাঁর পুত্রকে নবী করীম (স) এর সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়া ও তাঁর লক্ষ্যকে নিজের জীবন লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য বারবার উৎসাহিত করছিলেন।”
তাঁর পুত্র তুলাইব (রা) মক্কা শরীফের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন। রাসূলে করীম (স) একদিন গোপনে কয়েকজন সাহাবী সমভিব্যাহারে নামায পড়ছিলেন। কয়েকজন কাফির সরদার এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে নামাযীদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। সাহাবীগণ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের মুকাবিলা করেন। এই সময় হঠাৎ তারা তুলাইবকে ধরে বেঁধে ফেলে ও অমানুষিকভাবে মারধর করে। কিছুসংখ্যক কাফির তুলাইবের জননীকে এই সংবাদ দিয়ে বিদ্রুপ করে বলেঃ তুলাইব মুহাম্মাদের ধোঁকায় (?) পড়ে কি রকম মারধর খাচ্ছে, একবার দেখো গিয়ে। তুলাইবের জননী এই কথা শুনে গিয়ে বললেনঃ
আরবী (********)
“তুলাইব যেদিন তাঁর মামাতো ভাইয়ের সমর্থনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যাবে, সেই দিনটিই হবে তার সবচাইবে শুভ ও কল্যাণময় দিন। কেননা তার মামার এই ছেলেটি আল্লাহর নিকট হতে প্রকৃত সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা) ওহোদের যুদ্ধে আহত হলে তাঁর জননী তাঁর সেবা-শুশ্রুষা করলেন এবং বললেনঃ
“হে পুত্র! উঠো এবং তরবারি নিয়ে এই মুশরিক জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়”।
আবু সুফিযানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম শহীদদের বিরুদ্ধে কবিতা পাঠ করে কুৎসা রটাতে শুরু করলে হযরত আসমা (রা)-র কন্যা হিন্দ কবিতার ভাষায়ই তার কঠোর জবাব দেন।–ইবনে হিশাম।
হযরত খানসা (রা) তাঁর চারটি সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাদেসিয়ার যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের রাত্রে তিনি তাঁর পুত্র চতুষ্টয়কে একত্রিত করে যে নসীহত করেছিলেন, তা এক ঈমানদার ও মুজাহিদ জননীর মুজাহিদ সন্তানের জন্য নসীহত হিসেবে ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। তিনি বলেছিলেনঃ
“আমার প্রাণ-প্রিয় পুত্ররা! তোমরা নিজেদেরই আগ্রহ উৎসাহে ঈমান গ্রহণ করেছ, কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ ব্যতীতই তোমরা হিজরত করে মদীনায় এসেছ। খোদার শপথ, তোমাদের মা এক, পিতাও তোমাদের এক। তোমাদের মা তোমাদের পিতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। তোমাদের নানার বংশমর্যাদাকেও ক্ষুণ্ন বা কলঙ্কিত করেন নি একবিন্দু। তোমাদের বংশধারাকে কিছুমাত্র কালিমালিপ্ত করেন নি। বস্তুতঃ তোমরা এক অত্যন্ত শরীফ ও পবিত্রা নারীর গর্ভজাত সন্তান। এই কারণে তোমাদের কাজকর্ম ও চরিত্র ভদ্রজনমন্ডলীর মতই উত্তম ও উন্নতমানের হওয়া উচিত।
তোমরা জানো, কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করার বদলে আল্লাহ তা‘আলা বিপুল ও বিরাট সাওয়াব রেখেছেন। সজাগ অন্তর্দৃষ্টি সহকারে খোদার সাহায্য চাওয়া ও পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। যুদ্ধ ভয়াবহ হলে ও যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলে তোমরা নির্ভীক চিত্তে ও অকুন্ঠ মনে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কাফির শত্রুবাহিনী যখন প্রবল বিক্রমে ও অন্ধ আবেগে যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তখন তাদের সেনাধ্যক্ষই হবে তোমাদের আক্রমণের লক্ষ্যবিন্দু। এইভাবে যুদ্ধ করে তোমরা ইহকালে বিজয় ও পরকালে জান্নাত লাভের ধন্য হওয়ার অধিকার নিয়ে ফিরে আসবে।
মহিয়সী জননীর নিকট হতে সন্তানরা এইরূপ আবেগময়ী উপদেশ পেয়ে সকাল বেলায় তরবারী হাতে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে গেলেন। অতঃপর তাদের দেখা গিয়েছিল রক্ত মাটি মিশ্রিত দেহাবয়ব সমন্বিত। “- আল ইস্তিয়াব।
সত্য প্রচার ও প্রয়োগ
স্বর্ণযুগে মুসলিম নারী সমাজ কেবল নিজেদের নিয়েই এবং দ্বীনের ওপর নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাখার কাজেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতেন না এবং সেই থাকাকেই তাঁরা নিজেদের জন্য যথেষ্টও মনে করতেন না। বরং সমাজ জীবনের যেখানে, যে দিকেই তাঁরা কোনরূপ বিপর্যয় , বিশৃঙ্খলা বা অসংলগ্নতা দেখতে পেতেন, তা দূর করে গোটা সমাজকে সুস্থ, সুশৃঙ্খল ও কল্যাণমুখী গড়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করে দিতেন। ঐতিহাসিক ইবনে আবদুল বার লিখেছেনঃ
“মহিলা সাহাবী সামুরা বিনতে নুহাইক (রা) হাটে বাজারে ঘুরে ফিরে ভাল ও কল্যাণময় কাজের আদেশ করতেন এবং খারাপ ও পাপ কাজ হতে লোকদের বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। তাঁর হাতে একটা চাবুক থাকত। কাউকে কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখলেই তিনি তা দিয়ে তাকে প্রহার করতেন। ”- আল ইস্তিয়াব।
এই ব্যাপারে মুসলিম মহিলাগণ না জনসাধারণকে কোন খাতির করেছেন, না শাসকশ্রেণীর লোকদের কোন পরোয়া করেছেন। তাঁদের ঈমানী আবেগ যেমন দ্বীনের প্রকাশ্য দুশমনদের প্রতিরোধ করেছে, তেমনি দ্বীনের নামধারী লোকদের চিন্তা বিশ্বাস ও কাজ কর্মের কোথাও একবিন্দু ব্যতিক্রম বা বিপর্যয় গোচরীভূত হলে তাও তারা বরদাশত করতেন না। সত্য দ্বীনের কথা প্রকাশ ও প্রচার করার ব্যাপারে না বড় বড় শক্তিধরকে তাঁদের কাজের পথে প্রতিবন্ধক হতে দিয়েছেন, না প্রবল স্বৈরাচারী শাসকদের বাড়াবাড়িকে তাঁরা কিছুমাত্র মেনে নিতে প্রস্তুত হয়েছেন।
ইতিহাস প্রখ্যাত স্বৈরাচারী হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) কে শূলে চড়িয়ে শহীদ করে দেয়ার পর তাঁর জননী হযরত আসমা (রা) এর নিকট গিয়ে বল যে, আপনার পুত্র আল্লাহর ঘরে বে-দ্বীনি ও নাস্তিকতার প্রচার করেছিলেন বলেই আল্লাহ তাঁকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে হযরত আসমা (রা) তাকে ভৎসর্না করে বলে উঠলেনঃ
আরবী (******)
“তুমি মিথ্যা বলছো। আবদুল্লাহ আদৌ বেদ্বীন ছিলনা। সে তাঁর পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার ও আচরণকারী ছিল, রোযাদার ও তাহাজ্জুদগুজারী ছিল। আসলে তুমিই তাঁর ওপর অমানুষিক জুলুম করেছ। রাসূলে করীম(সা) আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, সকীফ গোত্রের দুজন মিথ্যাবাদী আত্মপ্রকাশ করবে। দ্বিতীয়জন প্রথম জনের তুলনায় অধিক নিকৃষ্ট হবে। কেননা, সে-ই অধিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। (এই গোত্রের প্রথম মিথ্যাবাদী হল মুসাইলামা আর দ্বিতীয়জন হলে তুমি।)।”
শাসক শ্রেণীর প্রতি উপদেশ–নসীহত
মুসলিম বিদুষী মহিলারা শাসক শ্রেণীর লোকদের প্রতি প্রয়োজনীয় উপদেশ নসীহত করতেও কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না। উপদেশ নসীহত হোক কিংবা সমালোচনা, দোষ ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া – তার মূলে নিঃস্বার্থপরতা ও আন্তরিকতা একান্তই অপরিহার্য। অন্যথায় এর কোন সুফল পাওয়ার আশা করা যায় না। উপরন্তু আন্তরিকতাহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপদেশ-নসীহত বা সমালোচনা প্রতিপক্ষের মনে বিদ্বেষের সষ্টি করে থাকে অনেক সময়। এই পর্যায়ে মুসলিম মহিলাদের উজ্জ্বল কীর্তিকলাপের কথা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।
তাঁদের সামনে যখনই দ্বীনের পক্ষে কল্যাণকর কোন কাজ করার বা কোন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ এসেছে, তখনই তাঁরা পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিঃস্বার্থভাবে সে কাজ করেছেন। সাধারণ মুসলিম জনতাতো বটেই, রাষ্ট্রের প্রশাসকরাও তাঁদের সমালোচনাকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন এবং সে উপদেশ নসীহত শুনে তারা নিজেদের ভুল ত্রুটি সংশোধন করে নিয়েছেন।
একবার হযরত মুয়াবিয়া (রা) হযরত আয়েশা (রা) এর নিকট লিখে পাঠালেনঃ আমাকে এমন একটি সংক্ষিপ্ত উপদেশ দিন যা আমি চিরদিন সামনে রেখে চলব। তখন হযরত আয়েশা (রা) তাঁকে নবী করীম (সা) এর একটি বাণী লিখে পাঠালেনঃ
আরবী (**********)
“যে ব্যক্তি লোকজনকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চায়, লোকেরা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তাকে লোকদের অনিষ্টকারিতা হতে রক্ষা করেন। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট ক্রুদ্ধ করে লোকদের সন্তুষ্ট করতে চায়, আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সেই জনতার হাতে সঁপে দেন। (আর তারা যেমন ইচ্ছা সেই ব্যক্তির ওপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব চালায়।)।”
খাওলা বিনতে সা’লাবা নাম্নী এক মহিলা সাহাবী আমিরুল মু‘মিনীন হযরত উমর ফারুক (রা) কে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে নসীহত করতে লাগলেন। তিনি বললেনঃ
“ হে উমর! তোমাকে আমি উকাজের মেলায় দেখেছি, তুমি ডান্ডা দিয়ে ছোট বয়সের ছেলে পেলেদের ভয় দেখিয়ে বেড়াতে। তখন তুমি ছোট ছিলে। সে সময় লোকেরা তোমাকে ‘উমাইর’ বলে ডাকত। পরে তুমি যখন যুবক হলে, তখন থেকেই লোকেরা তোমাকে উমর বলে ডাকতে শুরু করল। তারপর খুব বেশিদিন অতিবাহিত হতে না হতেই তুমি আমিরুল মু‘মিনীন হয়ে গেলে। আল্লাহ তোমাকে কোথা হতে কোন্ উচ্চতর পর্যায়ে পৌছে দিয়েছেন, তা তোমার ভেবে দেখা উচিত। জনগণের ওপর তোমার স্বভাব সুলভ কঠোরতা কখনোই প্রয়োগ করবে না, বরং তাদের ব্যাপারে তোমার উচিত খোদাকে ভয় করা। তোমার মনে রাখা উচিত, যে লোক খোদার আযাবকে ভয় করে, সে কিয়ামতকে কখনও বহু দুরবর্তী ব্যাপার মনে করতে পারে না আর যে ব্যক্তি প্রতি মুহুর্তে মৃত্যু হতে পারে বলে বিশ্বাস করে, সে কখনও নিঃশন্ক, বেপরোয়া জীবন যাপন করতে পারে না। সে তো এমনভাবে সদাসতর্ক থাকবে, যেন নেক আমল ও জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পন্ন না করে কখনই থাকতে পারেনা। ”
হযরত উমর ফারূক (রা) এর সঙ্গী সাথীরা বললেনঃ ‘খাওলা, তুমি আমিরুল মুমিনীন এর প্রতি অকারণ উপদেশ দানে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ।’ সঙ্গে সঙ্গে হযরত উমর (রা) তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেনঃ ‘তোমরা জাননা, ইনি হচ্ছেন হযরত খাওলা বিনতে সা’লাবা (রা)।’
খলীফা উমর ফারুক (রা) একসময়ে মোহরানার পরিমাণ যথাসম্ভব কম করতে বললে সঙ্গে সঙ্গে একজন মহিলা তার প্রতিবাদ করে উঠলেন। বললেন, কুরআনে তো বলা হয়েছেঃ ‘তোমরা যদি তোমাদের স্ত্রীদের একস্তূপ পরিমাণ সম্পদও দাও, তাহলেও তোমরা তার একবিন্দু ফিরিয়ে নিবে না। এর বিপরীত কথা বলার বা আইন জারি করার কোন অধিকারই আপনার নেই।’
খলীফা এ সমালোচনায় বিন্দুমাত্র অপমানবোধ করলেন না, মহিলাটিকেও কোন ধমক দিলেন না; বরং তিনি সহজভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে বললেন, ‘একজন স্ত্রীলোক উমরের সঙ্গে বিতর্ক করল এবং বিজয়ী হল’।
দায়িত্বশীল সরকারী কর্মচারীদের সামান্যতম জুলুমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করতে তেজস্বী মুসলিম মহিলারা কখনও সঙ্কোচ বা দ্বিধাবোধ করেন নি। এক মহিলা হযরত উমর ফারুক (রা) এর নিকট এমনিই এক জুলুমের অভিযোগ করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই কর্মচারীকে বরখাস্ত করার ফরমান পাঠিয়ে দিলেন।
মুসলিম মহিলাদের এই বীরত্বপূর্ণ কাজ কর্ম করার মূলে যে কারণ নিহিত রয়েছে, তা হলো, যে দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের অবিচল ঈমান ছিল , যে জীবন দর্শনকে তাঁরা একমাত্র সত্য জীবন দর্শন বলে বিশ্বাস করেছিলেন, যে নির্মম আলোর সাহায্যে সত্য মিথ্যা ও ন্যায় অন্যায়ের মাঝে তাঁরা পার্থক্য করতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেই দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থাই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষকে এই কাজ করার অধিকার দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই কাজ করা যে অপরিহার্য কর্তব্য, অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তার ঘোষণাও দিয়েছে।
মত প্রকাশ ও পরামর্শ দানের অধিকার
উপরোক্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামী সমাজের ভাল মন্দ ও লাভ ক্ষতির ব্যাপারে মুসলিম মহিলারা কখনও নিঃসম্পর্ক বা নীরব নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। কেননা সমাজের ভাঙ্গাগড়া, উন্নতি অবনিত ও কল্যাণ অকল্যাণের সাথে নারী পুরুষ সকলেরই নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজের কোন ক্ষতি সাধিত হলে তা থেকে নারীরা বেঁচে থাকতে পারে না। আবার সমাজের কল্যাণ সাধিত হলে তার সুফল নারী সমাজও সমানভাগে ভোগ করে। এমতাবস্থায় নারীরা সমাজের কল্যাণ সাধনের কাজ হতে কিছুতেই দূরে সরে থাকতে পারে না। আর সে পর্যায়ে তাদের যদি কোন কাজ করতেই হয়, তাহলে সমাজকে অকল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধতা ও শত্রুতারও সম্মুখীন হতে হবে তাদের। কল্যাণময় কাজের সমর্থন ও সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলে সর্বপ্রকার অন্যায়, অসত্য ও অকল্যাণের প্রতিবাদ ও বিরুদ্ধতাও করতে হবে তাদের। এসব কাজে আত্মনিয়োগ করার তাদের স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। ইসলামী শরীয়ত তাদের এই অধিকার যেমন দিয়েছে, তেমনি এর দায়িত্বও তাদের ওপর অর্পণ করেছে। কাজেই সমাজ সমষ্টিকেও তাদের এই অধিকার বাস্তবভাবে মেনে নিতে হবে। সমাজ জীবনের বিভিন্ন ব্যাপার-তা ব্যক্তিগত হোক বা সামাজিক সমষ্টিরই হোক-নিজেদের মতামত ও হৃদয়াবেগ প্রকাশের অবাধ অধিকার সর্বতোভাবে স্বীকৃত। মৌখিকভাবে প্রকাশ, লেখনী চালানো ইত্যাকার যে কোন উপায়ে হোক, নির্দিষ্ট সীমার মধ্য থেকে এই মত প্রকাশের অধিকার তারা অনায়াসে ভোগ করবে। এই অধিকার হতে কে উই তাদের বঞ্চিত রাখতে পারে না।
নারীদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপারে-বিয়ে, খোলা তালাক গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, অন্য কেউ নিজের সিদ্ধান্ত তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে না। এ পর্যায়ে যা কিছু করা হবে, তা করতে হবে তাদের মতের ভিত্তিতে। রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (*************)
“স্ত্রীলোকদের সাথে তাদের কন্যাদের ব্যাপারে পরামর্শ কর।”
বস্তুতঃ জীবনের যে সব ব্যাপারে স্ত্রীলোকেরা অন্যদের তুলনায় অধিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী, তুলনামূলকভাবে ভাল ও বেশি জানে, সেসব ব্যাপারে তাদের সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে সমাজকে উপকৃত হতে হবে। নারী সমাজের সাথেও পরামর্শ করা এবং তাদের মতামত জানা ছিল রাসূলে করীম (সা) এর একটি স্থায়ী রীতি। হযরত হাসান বসরী বলেছেনঃ নবী করীম (সা) প্রায়শঃই পরামর্শ করতেন, এমনকি স্ত্রীলোকদের সাথেও। তাদের পরামর্শও তিনি গ্রহণ করতেন। -ঊয়ুনুল আখবার।
এই পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে কোন বিষয় নির্দিষ্ট ছিলনা। জীবনের যাবতীয় ব্যাপারেই তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হত। তাতে কোন একটা দিকও বাদ পড়ত না।
হুদায়বিয়ার সন্ধির একটা শর্ত ছিল, এই বছর মুসলমানরা উমরা পালন না করেই ফিরে যাবে। তাই রাসূলে করীম (সা) সাহাবায়ে কিরাম (রা) কে হুদায়বিয়াতেই ইহরাম খুলে ফেলা এবং সঙ্গে করে নিয়ে আসা পশুগুলো জবাই করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাহাবাগণ যখন এই সন্ধি ও সন্ধির শর্তসমূহ দেখে বিশেষভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন, সে কারণে তাঁরা কেউই রাসূলে করীম (সা) এর এই নির্দেশ পালনে কোন তৎপরতাই দেখালেন না। এইরূপ অবস্থা দেখে রাসূলে করীম (সা) হযরত উম্মে সালামা (রা) এর নিকট দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি সাহাবাদের মনস্তত্ত্ব লক্ষ্য করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সহকারে পরামর্শ দিলেনঃ ‘আপনি এরপর আর কাউকেই কিছু না বলে যা কিছুই করার আপনি নিজেই অগ্রসর হয়ে করে ফেলুন। দেখবেন, সকলেই আপনার দেখাদেখি সব কাজই করবেন। তখন আর কে উ আপনার আদেশ পালনে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিতও হবেনা।’ রাসূলে করীম (সা) এই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং যখনই তিনি করণীয় সব কাজ করলেন, সাহাবায়ে কিরাম (রা)ও তাঁর অনুসরণ শুরু করে দিলেন। এভাবে হযরত উম্মে সালামা (রা)-র যথার্থ ও সুচিন্তিত পরামর্শ উপস্থিত অচলাবস্থা দূর করতে সক্ষম হল এবং বাস্তবভাবে প্রমাণ করে দিল যে, মহিলাদেরও যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি আছে এবং তাদের পরামর্শ জাতীয় জীবনের অনেক সমস্যারই সমাধান করতে সক্ষম। -বুখারী।
রাসূলে করীম (সা) এর খুলাফায়ে রাশেদীনও তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহিলাদের দেয়া পরামর্শ গ্রহণ করতেন। একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ
আরবী (***********)
-হযরত উমর (রা) অগ্রবর্তী সামষ্টিক বিষয়াদিতে মত দিতে সক্ষম লোকদের সাথে পরামর্শ করতেন। এমন কি এই ধরনের ব্যাপারে বিবেক বুদ্ধির অধিকারী কোন মহিলা হলেও তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। তাঁর দেয়া পরামর্শে কল্যাণের কোন দিক দেখতে পেলে কিংবা কোন ভাল পছন্দনীয় জিনিস পেলে তা তিনি নির্দ্ধিধায় গ্রহণ করতেন।
হযরত শিফা (রা) হিজরতের পূর্বেই ঈমান এনেছিলেন। তিনি নবী করীম (সা) এর নিকট বায়‘আতও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বুদ্ধি বিবেচনায় খুবই মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। জীবনীকার ইবনে আবদুল বার লিখেছেনঃ
আরবী (********)
-হযরত উমর (রা) পরামর্শদান ও মত প্রকাশে তাঁকে অগ্রবর্তী স্থান দিতেন। তিনি (কথাবার্তায়) তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতেন এবং তাঁকে অন্যদের ওপর বিশেষ মর্যাদা দিতেন।
হযরত উসমান (রা) ও হযরত আলী (রা) সম্পর্কেও একই ধরনের নীতি অনুসরণ সংক্রান্ত বিবরণ গ্রন্থাবলীতে উদ্বৃত হয়েছে। খলীফা নির্বাচনে পুরুষদের ন্যায় মহিলাদের মতামতও গ্রহণ করা হয়েছে।
বাস্তব কর্মে সহযোগিতা
মোটকথা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যাপারে মহিলাদের বিবেক বুদ্ধিপ্রসূত পরামর্শ গ্রহণ করে ইসলামী সমাজ বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। ইসলামী সমাজ গঠনেও তাদের যোগ্যতা প্রতিভাকে বাস্তবভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। নারীদের ওপর প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণের দায়িত্ব না থাকলেও তাঁরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সব বিরাট বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, তা এই পর্যায়ে বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রয়োজনের সময় ইসলামী রাষ্ট্র সরকারও তাঁদের থেকে এ ধরনের কাজ নেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) রাসূলে করীম (স) এর মহিলা নীতির ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
আরবী (********)
‘রাসূলে করীম (স) মহিলাদের যুদ্ধ-জিহাদে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাঁরা সেখানে আহত ও রোগাক্রান্ত লোকদের চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষার কাজ আঞ্জাম দিতেন।’
হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেনঃ
আরবী (**********)
রাসূলে করীম (সা) উম্মে সুলাইম (রা) ও আনসার বংশের মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। তাঁরা সেখানে পানি পান করাতেন ও আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করাতেন।
তাছাড়া অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় কাজেও তাদের নিয়োগ করা হত। উম্মে অরাকা বিনতে আব্দুল্লাহ (রা) বলেছেনঃ ‘রাসূলে করীম (স) তাঁদের ঘরে যাতায়াত করতেন। তিনি তাঁদের জন্য একজন মুয়াযযিনও নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন; তিনি নামাযের আযান দিতেন এবং তাদের ইমামতিও করতেন।’
হযরত শিফা (রা) সম্পর্কে আল-ইস্তীয়াব গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
আরবী (*********)
‘হযরত উমর (রা) বাজারের কোন কোন দায়িত্ব অনেক সময় তাঁর ওপর ন্যস্ত করতেন।’
এ সব ঘটনা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামী সমাজে মুসলিম মহিলাদের ওপর বহু প্রকারের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায় দায়িত্বও সঁপে দেওয়া হত। আর এই মুসলিম মহিলাগণ নিজেদের পারিবারিক ও ঘর-গৃহস্থালীর দায়িত্ব পালন সহ এই সব সামাজিক দায়িত্ব ও পালন করতেন।
সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ পদে নারী
ইসলামী সমাজে নারীর অবদান ও দায়িত্বপালন পর্যায়ে এ পর্যন্ত যা কিছু বলা হল, তার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীদের কি কেবলমাত্র এই ধরনের কয়েকটি দায়িত্বেই নিয়োগ করা যেতে পারে কিংবা এছাড়া অন্যান্য সামাজিক সামষ্টিক দায়িত্বও তাদের উপর অর্পণ করা সমীচীন বিবেচিত হতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সর্বপ্রথম চিন্তাশক্তি ও বাস্তব কর্মের যোগ্যতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোণ ও অভিমত জানতে হবে। জানতে হবে ইসলাম মহিলাদের উপর কতটা নির্ভর ও আস্থা স্থাপন করতে বলে বা তা করার অনুমতি দেয়। নারীরা প্রকৃতপক্ষে কোন ধরনের কাজের যোগ্যতার অধিকারী এবং ইসলামী সমাজ কি রকম দায়িত্বপূর্ণ কাজ তাঁদের উপর অর্পণ করা যায় আর কোন সব দায়িত্ব নয়, তা তারপরই জানা যাবে।
মানব সমাজের কাজ বহুমুখী, এর ধারা বহুরকমের আর প্রকৃতিও বিচিত্রগামী। এই কাজের সংখ্যা গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। এ কাজ ছোট ছোট যেমন, তেমনি বড় বড়ও। সহজ সরল কাজও যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অত্যন্ত জটিল ও বহু কষ্টাসাধ্য কাজ। যদি বকোন কাজের সুফল পেতে হয়, তাহলে সে কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করার মত যোগ্যতার অধিকারী লোকদেরই যে তাতে নিয়োগ করতে হবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আর কেবলমাত্র ইসলামী সমাজেই নয়, সাধারণভাবে ও নির্বিশেষে সব মানবীয় সমাজেরই এই নীতি। কাজেই এ কথাটি একান্ত শ্বাশত ও সাধারণ সত্য। সেই সঙ্গে এই কথাও সত্য যে, সব মানুষেরই সব কাজ করার যোগ্যতা থাকে না, নেইও। কারও যদি এক ধরনের কাজের স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকে, তবে সে যেমন অন্য বহু ধরনের কাজেরই যোগ্যতা হতে বঞ্চিত, তেমনি সমাজেরই অপর বহু লোক হয়ত সেই কাজেরই যোগ্যতা রাখে। কেউ একে কাজের উপযোগী, কেউ অপর কাজের যোগ্য। কেউ বৈজ্ঞানিক চিন্তা গবেষণা শক্তির যোগ্যতা রাখে, কউ রাখে সামিরক সংগঠন গড়ে তোলার যোগ্যতা। কেউ সঙ্গীত বা কবিতা লিখতে পারে আর কে উ উচ্চ মানের সাহিত্য রচনার যোগ্যতা রাখে। কেউ হস্তশিল্পে পারদর্শী আর কউ খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পে। কেউ কউ গণ উদ্বোধক বক্তৃতা ভাষণে পারঙ্গম হলেও গ্রন্থ রচনায় অক্ষম। আবার কেউ বড় বড় বই লিখতে সক্ষম হলেও বক্তৃতা দিয়ে পারে না জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে। কেউ চিন্তাশক্তিতে গরীয়ান, কউ দৈহিক শক্তিতে বলীয়ান। কেউ কউ চিন্তা গবেষণা দ্বারা যেমন মানব সমাজকে উপকৃত করতে পারে, তেমনি কেউ তার স্বাভাবিক সাহস হিম্মতের সাহায্যে জাতির অনেক দুঃসাধ্য কাজ সমাধা করে জাতিকে পারে ধন্য করতে। শক্তি ক্ষমতা ও যোগ্যতা প্রতিভার এই সীমাহীন বৈচিত্র্যই মানব জাতির বৈশিষ্ট্য। এই বৈচিত্র্য মানব সমাজ ছাড়া সৃষ্টিলোকের অন্যত্র বিরল ও দুর্লভ। যোগ্যতা প্রতিভার এই পার্থক্য প্রতি দু’জন লোকের মধ্যে এমনকি একই পিতামাতার সন্তানদের মধ্যে ও সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। অনুরূপভাবে এই পার্থক্য পুরুষ ও নারীর মধ্যেও অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীরভাবে বর্তমান। এই বৈচিত্র্য ও পার্থক্য অনিবার্য। একই ধরনের যোগ্যতা প্রতিভা সব মানুষের মধ্যে থাকলে সমাজের বহু জরুরী কাজই অসম্পন্ন হয়ে থাকত, অনেক প্রয়োজনই থাকত অসম্পূর্ণ হয়ে। তার ফলে মানুষের জীবনই অচল হয়ে যেত। অতএব একথা বলতেই হবে যে, এই বৈচিত্র্য ও পার্থক্য মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কুশলতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাভাবিক ও জন্মগতভাবেই এই বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের সৃষ্টি। এই বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিলোক যে যতটা প্রতিভা এবং যে কাজের যোগ্যতার অধিকারী, তা কেউ নিজে সৃষ্টি করে নি, কেউ নিজের জন্য চেয়েও আনে নি।
নারীর স্বভাবগত দুর্বলতা
নারী ও পুরুষের মাঝে যে স্বভাবগত পার্থক্য ও ক্ষমতা যোগ্যতার যে বৈচিত্যের কথা এইমাত্র বলা হল, ইসলামী শরীয়ত তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে স্বীকৃতি দিয়েছে। বস্তুতঃ চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি এই উভয় দিক দিয়েই এই পার্খক্য স্বীকৃত। নবী করীম (সা) নারীদের বলেছেন-
আরবী (**********)
‘বিচার বুদ্ধি ও দ্বীন পালনের দায়িত্বের দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ।’
এর অর্থঃ নারীর চিন্তা শক্তি ও দৈহিক শক্তি এই দুইদিক দিয়েই পুরুষের তুলনায় কম যোগ্যতার অধিকারী। শারীরিক দিয়েও নারীরা পুরুষের তুলনায় দুর্বল। এই কারণে ইসলামী ফিকহবিদগণ বলেছেনঃ
আরবী (**********)
‘যোগ্যতা ক্ষমতার দিক দিয়ে পুরুষ নারীদের তুলনায় অগ্রসর’।
ইসলামী শরীয়ত নারীদের এই দুর্বলতার কথা স্বীকার করেই ক্ষান্ত হয় নি, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার প্রতি লক্ষ্য রেখে দায়িত্বও বন্টন করেছে। সে দুর্বলতাসমূহ সংক্ষেপে এইরূপঃ
(১) নিয়মিত মাসিক ঋতুস্রাব নারীদেহের একটি বিশেষ সমস্যা। পুরুষেরা তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই সময়ে নারীদের দৈহিক পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতাই শুধু বিলুপ্ত হয়ে যায় না, তাদের দেহ মনেও দেখা দেয় এক ধরনের অসুস্থতা ও অক্ষমতা, যার দরুণ অধিক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করা এই সময় তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই কারণে এ সময়ে নামায পড়ার দায়িত্বও তাদের ওপর হতে নেমে যায়। দ্বীনের দিক দিয়ে নারীদের যে অসম্পূর্ণতার কথা রাসূলে করীম (সা) বলেছেন, এটা তার একটা প্রমাণ।
(২) স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্ভোগের ফল প্রায় দশ মাস দশ দিন ধরে কেবলমাত্র স্ত্রীকেই বহন করতে হয়-পুরুষদের বহন করতে হয় না। উপরন্তু সন্তান প্রসবকালীন প্রাণান্তকর যাতনা কেবল স্ত্রীকেই বহন (ভোগ) করতে হয়, স্বামী (পুরুষ) এ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রসবকালীন এই কষ্টের দরুণই সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের নামায পড়তে হয় না। এমন কি, এ সময়ের না পড়া নামায কাযাও করতে হয় না তাদের।
(৩) ঋতুস্রাব ও সন্তান প্রসবকালীন অশুচির সময় নারীকে ফরয রোযাও কাযা করতে হয় না। পরে সে রোযা কাযা করার নিয়ম করা হয়েছে যখন সে সুস্থ থাকে। এমনকি সন্তানের স্তন্যপানকালে রোযার মাস এলে সে রোযা তখন পালন না করে পরে অন্য সময়ে পালন করতে পারে।
(৪) যুদ্ধ-জিহাদের কঠিন ও দুঃসহ দায়িত্ব হতেও নারী সমাজকে মুক্ত রাখা হয়েছে। বৃদ্ধ ও বালকদের মত তাদেরও নেই এ দায়িত্ব।
(৫) হজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালনের ক্ষেত্রেও পুরুষ হতে নারী হজ্জযাত্রীকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
নারীদের শারীরিক দুর্বলতার কারণেই শরীয়াতের এই বিশেষ ব্যবস্থা।
নারীদের মানসিক যোগ্যতা
নারীদের মানসিক দুর্বলতা সম্পর্কে নবী করীম (স) এর কথা উপরে উদ্ধৃত হয়েছে। এই মন্তব্যের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়ঃ
মানুষের মানসিক শক্তিকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম হল শুধু বুদ্ধি বিবেচনার যোগ্যতা। তা নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে, খুঁটিনাটি ব্যাপারে ইন্দ্রিয়শক্তি প্রয়োগলব্ধ জ্ঞান। যেমন চোখে দেখে বর্ণ ও আস্বাদন করে স্বাদ নির্ধারণ। অতঃপর সে সম্পর্কে বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগ চিন্তা গবেষণার সাহায্যে নির্ভেজাল চিন্তাগত তত্ত্ব ও তথ্য অর্জন। এই যোগ্যতাটুকু থাকলেই শরীয়তের বিধান পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে প্রাথমিক ও বাহ্যিক সত্যগুলো হতে কোনপ্রকার শ্রম ও সময় ক্ষেপন ব্যতীতই মতাদর্শ আয়ত্ত করা আর চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে, এসব মতাদর্শ মনের পর্দায় সর্বক্ষণ এমনভাবে জাগ্রত ও ভাস্বর রাখা, যেন তা চোখের সম্মুখে উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান।
শরীয়াতের সাধারণ প্রয়োগ নির্ভর করে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান তথা বিচার উপস্থিতির উপর। নারীদের মধ্যেও এ পর্যায়ের জ্ঞান বুদ্ধি রয়েছে। কেননা তারাও খুঁটিনাটি ব্যাপারে ইন্দ্রিয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সুস্পষ্ট জ্ঞানসমূহ লাভ করতে সক্ষম। তারা কোন ভুলে যাওয়া কথা স্মরণ করিয়ে দিলে পুণরায় তা স্মৃতিপটে জাগরুক করতে পারে। এরূপ ক্ষমতাও যদি নারীদের না থাকত, তাহলে শরীয়তের হুকুম আহকাম পুরুষ হতে নারীদের জন্য ভিন্ন রকমের হত। অথচ তা করা হয় নি; বরং উভয়ের উপর সমান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ থেকে জানা গেল যে, নবী করীম (সা) নারীদের যে বিচার বুদ্ধির ন্যূনতার কথা বলেছেন, তা তৃতীয় পর্যায়ের জ্ঞানের যোগ্যতা। নারীরা সাধারণত এ থেকে বঞ্চিত।–আল ইনায়া।
মোটকথা, শরীয়তের দৃষ্টিতে নারীর তুলনায় পুরুষদের বিচার-বুদ্ধি অধিক নির্ভরযোগ্য। নারীদের সাক্ষ্যদানের ব্যাপারটি এ পর্যায়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
নবী করীম (সা) বলেছেনঃ আরবী (*******)
‘নারীদের সাক্ষ্য পুরুষদের সাক্ষ্যের অর্ধেক’।
কুরআন মজীদে লেনদেনের ব্যাপারে দুজন পুরুষ সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে প্রথমে। পরে বলা হয়েছে, দুজন পুরুষ একসাথে পাওয়া না গেলে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলাকে সাক্ষী বানানো যাবে। এই দুজন মহিলা একজন পুরুষের বিকল্প। -সূরা আল বাকারা।
তবে বিশেষভাবে নারী সংক্রান্ত বিষয়াদিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য শুধুমাত্র নারীদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। কেননা পুরুষরা এ সব বিষয়ে কিছুই জানে না বললেই চলে। যেমন সন্তান প্রসব ও নারী দেহের গোপন অঙ্গের ত্রুটির ব্যাপারে কেবল নারীরাই সাক্ষ্য দিতে পারে। তাই ইমাম জুহরী লিখেছেন-আরবী (******)
‘যে সব বিষয়ে নারী ছাড়া অন্যদের জানার সুযোগ নেই, সেসব বিষয়ে কেবলমাত্র নারীদের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করা জায়েয-পূর্ব হতেই এ রীতি চলে এসেছে।’
যেসব ব্যাপারে নারীদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য এবং শেষ পর্যন্ত নারীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে-সেই সব ব্যাপার পর্যন্ত নারীদের মানসিক যোগ্যতাও স্বীকৃত। কেননা নিছক সাদামাটা সংবাদ দেয়াকেই সাক্ষ্যদান বলা যায় না। ঘটনাকে তার আসলরূপে অধ্যয়ন করা ও তার যথার্থ ব্যাখ্যা দানকে বলা হয় সাক্ষ্য। এটা সহজ ব্যাপার নয়। এর জন্যে প্রয়োজন বাইরের জীবন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। এইরূপ সাক্ষ্য দেয়ার অর্থই হল নিজের কাঁধে এক বিরাট গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে নেয়া। সাক্ষী এ দায়িত্ব বহন করলেই বিচারক তার ভিত্তিতে মূল্যবান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হন। এইরূপ সাক্ষ্য পাওয়ার পরও যদি বিচারক তদনুরূপ রায় না দেন, তাহলে তিনি অতিবড় গুনাহের অপরাধে অপরাধী হবেন। এরূপ অবস্থায় বিচারক পদচ্যূতও হয়ে যেতে পারেন। এই মতের ভিত্তিতে ইসলামী আইনবিদরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেনঃ
আরবী (*******)
‘সাক্ষ্যদানের যোগ্যতা থাকলে বিচারক হওয়ার যোগ্যতাও আছে বলে মনে করতে হবে।
এর অর্থ হচ্ছে যে, যদি কেউ কোন বিষয়ে সাক্ষ্যদানের যোগ্যতার অধিকারী হয়ে থাকে, তাহলে সে বিষয়ে সে বিচার করার যোগ্যতারও অধিকারী, একথা মানতে হবে।
এই দৃষ্টিতে মর্যাদায় সমান না হলেও জীবনের সর্বব্যাপারেই নারীর সাক্ষ্য গ্রহণীয় বলে ফিকাহবিদগণ মত দিয়েছেন। আর কোন কোন ক্ষেত্রে কেবল মাত্র নারীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিরোধীয় ব্যাপারসমূহে রায় দান করতেও কোন আপত্তি নেই।
এই কারণে জীবনের সর্ববিষয়ে নারী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপনে কারুর মনে এক বিন্দু সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। নারী ও পুরুষের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে শুধু যে কোনরূপ পার্থক্য করা হয় নি তাই নয়, বরং উভয় ধরনের হাদীসকেই সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয়েছে। এই পর্যায়ের বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) এর ভগিনী ফারিয়া (রা) এর স্বামীর কয়েকটি উট পালিয়ে যায়। উটের মালিক উটগুলোর খোঁজে বের হয়ে যান এবং সেগুলো পেয়েও যান। কিন্তু সহসা উটগুলো খেপে গিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে তিনি নিহত হন। ফারীয়া (রা) রাসূল (সা) এর নিকট উক্ত ঘটনা বিবৃত করেন। বলেনঃ আমার স্বামীর মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তিনি আমার জন্য জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছুই রেখে যান নি। এমনকি, তাঁর সন্তানদের নিয়ে বসবাস করার জন্য একটুখানি জায়গাও রেখে যান নি। এই কারণে আমি আমার ভাইদের সঙ্গে বসবাস করতে চাই। এ বিষয়ে আপনার নির্দেশ কি? জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘ঠিক যে বাড়িতে থাকা অবস্থায় তুমি তোমার স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছ, সেই ঘরে থেকেই তোমাকে ইদ্দত পালন করতে হবে ‘। উত্তরকালে হযরত উসমান (রা)ও অনুরূপ পরিস্থিতিতে ঠিক একইরূপ নির্দেশই দিয়েছিলেন। ফলে ফারীয়া নাম্নী একজন মাত্র মহিলার একটি বর্ণনা আইনের ভিত্তি হওয়ার মর্যাদা পেল। এমন বহু হাদীসই মুসলমান সমাজে প্রচলিত রয়েছে, যার বর্ণনাসূত্রে পর পর চার জন মহিলা রয়েছেন।–মুসলিম, কিতাবুল ফিতান। বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁদের বর্ণিত এ সকল হাদীস নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু জীবনের প্রতিটি বিভাগে মহিলাদের বর্ণিত হাদীস গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও জীবনের সর্বক্ষেত্রে মহিলাদের সাক্ষ্যকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়নি শুধু মনস্তাত্ত্বিক কারণে। সাধারণতঃ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবী বা তাবেয়ী মহিলাগণ যতটা দায়িত্ব সচেতন থাকেন, নিত্য নৈমেত্তিক ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে তাদের থেকে ততটা সতর্কতার আশা করা যায় না। সাক্ষ্যদান ও হাদীস বর্ণনা গ্রহণের ব্যাপারে এ কারণেই পার্থক্য করা হয়েছে।