রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইসলামী প্রেক্ষিত
আবদুল রশিদ মতিন
অনুবাদ
এ কে এম সালেহউদ্দীন
সম্পাদনা
এম আবদুল আযিয
বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট (বিআইআইটি)
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
প্রকাশকের কথা
সাধারণভাবে সমাজবিজ্ঞানীদের. উদ্দেশ্য হলো মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ। তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান জাগতিক মতাদর্শ নিয়ে জাগতিক প্রয়োজনে রচিত হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের রচিত সে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নৈতিক মূল্যবোধের কোন প্রতিফলন না থাকায় মানবজাতির পারলৌকিক কল্যাণ দূরের কথা, ইহজগতের সার্বিক কল্যাণেও ব্যর্থ হচ্ছে প্রচলিত রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষেল সার্বিক কল্যাণে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান শাস্ত্র’ আসলেই কীরূপ হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে নতুন নির্দেশনা আমাদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন নন্দিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবদুল রশিদ মতিন।
তিনি সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের গতিধারাকে উপলব্ধি করার জন্যে এ গ্রন্থে ইসলামী সভ্যতার তাৎপর্য তুলে ধরার পাশাপাশি উপনিবেশবাদীতার স্বরূপও যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি ‘ইসলাম ও রাজনীতি’র অবিচ্ছেদ্ধ সম্পর্কটিকেও যুক্তিযুক্তভাবে বর্ণনা করেছেন। সর্বোপরি তিনি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রায়োগিকতাকে সফলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই বইটি যে কোন সচেতন নাগরিক, রাজনীতিবিদ সহ সর্বশ্রেণীর পাঠকের জন্য একটি উপযোগী গ্রন্থ। এছাড়া বইটি দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, গবেষকদের জন্য রেফারেন্স হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য।
বিআইআইটি কর্তৃপক্ষ বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে সত্যিই আনন্দিত। বইটি প্রকাশের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এম জহুরুল ইসলাম
নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট
ঢাকা
মুখবন্ধ
ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ চলছিল, তখন ইসলামী সভ্যতা চরম শিখরে পৌঁছেছিল। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে পশ্চিম আফ্রিকা হতে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত মুসলিম জাহান দখল করে নেয়ার পর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপরীত ধারা সূচিত হয়। ইউরোপীয় উপনিবেশিক শাসন মুসলিম সংস্কৃতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে এবং মুসলিম উম্মাহকে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রে খণ্ড-বিখণ্ড করে দেয়। স্বাধীনতা লাভের পর এসব মুসলিম দেশের শাসনভার পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক চক্রের হাতে পড়ে হয়।
মুসলমান দীর্ঘদিন যাবত এই দুঃসহ অবস্থাটি ভাঙ্গার চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যেতে থাকে যাতে তারা সামষ্টিক জীবনের নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করে ইসলামী অতীতের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র রচনা করতে পারে। কেউ পাশ্চাত্যের মত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করে, কেউ শরীয়াহর ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণের এবং কেউ কেউ ইসলাম, জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও পাশ্চাত্য দর্শনের সমন্বয়ে রাষ্ট্রের গোড়া পত্তনের প্রস্তাব করেন। এর প্রতিটি ধারণার উপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তক প্রকাশিত হয়। এগুলো ছিল একপেশে ও একদেশদর্শী; এসব লেখকগণ ‘প্রাচ্যীবদ’ নামে অভিহিত। আপোষকামী কিছু পণ্ডিত মুসলিম সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে ভিত্তিহীন অভিযোগ সমূরেহ জবাব প্রদান করেন এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও উম্মাহর আশা-আকাংখার ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। অনেক ধর্মতাত্ত্বিক উলেমাবৃন্দ তাদের জড়বুদ্ধি ও গোঁড়ামীর কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথা ইজতিহাদের মাধ্যমে যুগ সমস্যার সমাধান করে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে একমত অন্যকথায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত ও অভিনিবেশী ছাত্ররা বিষয়টি সুচারু বিচার বিশ্লেষণে দীর্ঘদিন ধরে দৃষ্টিদানে বিরত থাকেন।
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে ইসলামী পুনর্জাগরণের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিশেষ মহল কর্তৃক ইসলামের নানা অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে; এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামকে স্বচ্ছ, সঠিক ও প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপনের এক বিরল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ইসলাম সম্পর্কে যে বিকৃত ধারণ দেয়ার অপচেষ্টা চলছে তার প্রেক্ষাপটে বর্তমান বিশ্বে ইসলামী ব্যবস্থার বাস্তবতার প্রয়োজনে এবং বিশ্বে বিভিন্ন বৈরী শক্তি ও স্বাভাবিক শক্তিসমূহের মধ্যে বর্তমানে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের সঠিক বিচার বিশ্লেষণের সময় এসেছে। কাজটি করতে হবে ইসলামীদের নিজেদের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও প্রাজ্ঞ জ্ঞান দ্বারা এবং ইসলামের মর্মবাণী, নীতিমালা, জীবন, সংস্কৃতি ও এবং সুবিন্যস্ত কাঠামোর সঠিকভাবে উপস্থাপনার মাধ্যমে। Political Science: An Islamic Perspective গ্রন্থটি সে উদ্দেশ্যে প্রণীত।
ইসলামী চিন্তাবিদদের ধারণা-দর্শনের উপর আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা না করে এ গ্রন্থে ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উপস্থাপন করা হয়েছে। বুদ্ধিভিত্তিক ও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলাম ও রাজনীতির সম্পর্কসূত্র, ইসলামের প্রয়োগ পদ্ধতির উপকরণ সমূহ, ইসলামী আইনের ধরণ ও প্রকার, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার স্বরূপ, ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা, এবং বর্তমান বিশ্বে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন সমূহের কৌশল ও পদ্ধতি সমূহ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি অনুযায়ী এ গ্রন্থের গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচন করা হয়েছে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়াবলীর মৌলিক বিষয়ের উপর ধারণা-দর্শন সঠিকভাবে উপলব্ধির জন্য বিচার বিশ্লেষণে দু’টি মুখ্য উৎসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছেঃ
প্রথমটি আল্লাহর বাণী সম্বলিত ঐশী গ্রন্থ আল কোরআন; দ্বিতীয়টি নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী, কার্যাবলী, আচরণ ও সাহাবীদের কার্যে সমর্থন বা মৌনতা অবলম্বনের ঘটনা সমষ্টি- যা সুন্নাহ নামে অভিহিত।
দ্বিতীয়ত শুরু হতে ঐতিহাসিক ধারাক্রমে পর্যালোচনা ও বিশ্লেণ করে আল কুরআন ও সুন্নাহর অনুশাসনের কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কতটুকু বিচ্যুতি ঘটেছে তাও এ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। এ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের অন্তর্বৈশিষ্ট্য তথা তাদের মূল্যবোধ, ধারণা, বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক মূল্যমান ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। মুসলমানগণ যেহেতু নবী করীম (সাঃ)-এর লৌকিক উত্তরসূরী চারজন খলীফাকে সঠিক পথে পরিচারিত বলে মনে করা হয় তাই জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় বিষয় আলোচনার সময় খোলাফায়ে রাশেদার যুগকে আদর্শ যুগ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে।
তৃতীয়ত আব্বাসীয় আমল থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ইসলামী রাজনৈতিক ও আইনশাস্ত্রীয় যে সব লিখা, আলাপ আলোচনা আবর্তিত হয়েছে তা ঐতিহাসিক ধারাক্রম ও ব্যাখাসহ তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিসর ব্যাপক, তাই অনুসন্ধান ও গবেষণার ক্ষেত্রমে ক্লাসিক্যাল ও সমকালিন যুগের প্রখ্যাত সুন্নী তাত্ত্বিকদের আলোচনার মদ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে। যে সব চিন্তাবিদের বক্তব্য আলোচিত হয়েছে তা কিছুটা বর্তমান গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত পছন্দ, কিছুটা অন্যান্য ইসলামী পণ্ডিতবর্গের লিখার উপর নির্ভর করেছে।
সর্বশেষ বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনার সময় পাশ্চাত্যের সমধর্মী ধারণাসমূহকে চিহ্নিত করা হয়েছে, ইসলামী ধারণার সাথে তাদের তুলনা করা হয়েছে এবং পরিশেষে ইসলাম প্রকৃত প্রস্তাবে কি বোঝাতে চায় ও বাস্তবায়ন করতে চায় তার চিত্র অংকন করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে মুসলিম বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার উপর সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিভিন্ন প্রকার ও মুসলিম সমাজে তার প্রভাব বর্ণিত হয়েছে।
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধারণা দর্শন প্রধান উপকরণ হিসাবে সমগ্র আলোচনায় স্থান পেয়েছে এবং মুসলিম সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর পাশ্চাত্যের অবক্ষয়ী প্রভাব গুরুত্তব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে স্বার্থবাদী দেশী মহলের যোগসাজস কিভাবে রচিত হয়েছিল; কেন ও কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল এবং এই ধর্মনিরপেক্ষ আদিপত্যবাদ মুসলিম সমাজের ক্ষতিসাধন করেছিল।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাধানরার প্রকৃত স্বরূপ উৎঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি উপলব্ধি করতে হলে ঐ ঐক্যসূত্রটি বুঝতে হবে যে, ইসলাম ও রাজনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান যা জীবনের সকল বিষয়কে পরিব্যাপ্ত করে আছে কেবলমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামী জীবনদর্শন ও জীবন ব্যবস্থাকে বাস্তবে রূপদান করা যায়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও ইসলামী রাজনীতি যে অবিভাজ্য তা ইসলামের কতিপয় আনুষ্ঠানিক আচার পদ্ধতির আর্থ-সামাজিক তাৎপর্যের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে; যথা সিয়াম, সালাত, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি।
অতঃপর এ অধ্যায়ে নবী করিম (সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদার সময় যে সব মহান পবিত্র ও কল্যাণকর বিষয়গুলো বিদ্যমান ছিল তা আলোচনা করা হয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম চিন্তাবিদ ইবনে খালদুনের সাথে একমত যে, উমাইয়া খিলাফতের সময় ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছিল যাতে ইসলামের সু-শাসনের অমোঘ ও পবিত্র নীতিমালা হতে শাসন ব্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটে। যোগসূত্রের নেতিবাচক পরিবর্তন সত্ত্বেও শাসকবর্গ কখনো ইসলামের সাথে রাজনীতির অমিলের কথা জনসম্মুখে ঘোষণা করার সাহস পায়নি, যারা চেষ্টা করেছে তারা তাদের ধ্বংসই ডেকে এনেছিল।
তৃতীয় অনুচ্ছেদ পাশ্চাত্য রাজনীতির সাথে ইসলামী রাজনীতির বৈসাদৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এখানে দেখা যায় যে, পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রয়োগ পদ্ধতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক সূত্রাবলির ভিত্তিকে রচিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের নিজস্ব ধরন ও আদলে পাশ্চাত্য রাজনীতির আদর্শগত মানচিত্র প্রণীত হয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলামে রাজনীতির ভিত্তি হিসাবে ঐশী প্রত্যাদেশ ও যুক্তিবোধকে দ্বৈত উৎস হিসাবে নেয়া হয়েছে। এভাবে এ অধ্যায়ে দেখান হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্টবিজ্ঞানের প্রয়োগ পদ্ধতি কুরআনের কতিপয় মৌল ধারণার সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত- যথা তাওহীদ, রিসালাত, খিলাফত ইবাদত, আদল ইত্যাদি। এ অনুসিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যাদেশের জ্ঞানের সীমারেখার মধ্যে ইসলাম বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা, যুক্তিতর্ক ইত্যাদির পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়। ইসলামী মূল্যবোধের সার্বজনীনতা দ্বারা ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোর মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ও নিজস্ব ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান রচনা করা সম্ভব ইসলামে।
চতুর্থ অধ্যায়ে ইসলামের আইনগত রূপ শরীয়াহ, যা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোদী, বিষয়ের আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট। এ আলোচনায় শরীয়াহকে পশ্চিমা মূল্যবোধ বিবর্জিত আইন হতে ভিন্ন আদর্শিক আদলে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া ইসলামী আইন বা ফিকাহ এবং শরীয়াহও যে পশ্চিমা মূল্যবোধের সম অর্থ বহন করে না তা ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। শরীয়াহ যে প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম আইন তাও আলোচনায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শরীয়ার সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, এর বিকাশ ও সমাজের উপর এর উপর প্রভাব বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ অধ্যায়ে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, স্বাধীন চিন্তা চর্চার স্বাধীনতা না থাকলে ইজতিহাদ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজকে পুনর্গঠন ও পরিবর্তন করা যায় না। ইজতিহাদ বা গবেষণাকে সঠিক মর্যাদা দানের জন্য সমাজের নৈতিক ও বস্তুগত সংস্কার সাধন করতে হবে।
পঞ্চম অধ্যায়ে ‘উম্মাহঃ ইসলামী সমাজব্যবস্থা’ চতুর্থ অধ্যায়ের বর্ধিতাংশ। সামাজিক অনুমোদন ছাড়া আইন কল্পনা করা যায়, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। পাশ্চাত্যে সমাজ বলতে কি বোঝায় এবং ইসলামের সাথে এ সমাজ ব্যবস্থার কোন মিল রয়েছে কিনা? কুরআন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, মুসলিম চিন্তাবিদ ও আইন শাস্ত্রবিদগণ এটাকে কিভাবে দেখেছেন এবং মহানবীর (সাঃ)-এর সময় ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে বিকাশ লাভ করেছিল? বিশ্বব্যবস্থায় উম্মাহর রাজনৈতিক ভূমিকা কি এবং ইসলামী সমাজের অন্তর্গঠনশৈলী কিরূপ এর উপর-এ অধ্যায়ের আলোক সম্পাত করা হয়েছে। সর্বশেষ উম্মাহর ধারণার সাথে জাতীয়তাবাদের ধারণার তুলনা করা হয়েছে এবং এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়েছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিকোন থেকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে ও মুসলিম বিশ্বে এ রাষ্ট্র ধারণা প্রয়োগের অবকাশ অথবা সামঞ্জস্যশীলতা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ইসলাশী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ধারণ দর্শনের বিষয়টি এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ধরনের ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার একত্ব বা বহুত্ব রয়েছে কিনা, আইনের প্রকৃতি কিরূপ, ক্ষমতার উৎস কি এ অধ্যায়ে এসব প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি গণতান্ত্রিক হতে পারে, হলে কিরূপ? পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণার সাথে ইসলামী গণতন্ত্রের ধারণার কি মিল রয়েছে?
এ অধ্যায়ে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিমূল আলোচনা করা হয়েছে; আল্লাহর একত্ব, ন্যায়বিচার, সমতা ও স্বাধীনতা এবং পারস্পরিক আলোচনা বা শূরা প্রভৃতির আলোকে একে চিহ্নিত করে এর গঠন ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়েছে।
সপ্তম অধ্যায়ে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিবেচনার স্বাভাবিক ধারাকাহিকতা হিসাবে ইসলামে শাসকের জবাবদিহিতার প্রশ্নটি পর্যালোচনা করেছে; এটি জনগণের অধিকার সংরক্ষণ এবং নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতার সীমারেখা অংকন করে দিয়েছে। সরকার গঠনের আবশ্যকতা ও অপরিহার্যতা,শাসকের আইনের অনুবর্তী হওয়া, জনসাধারণের শাসকের অবৈধ আদেশ প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এ বিষয়ে এ পর্যন্ত সব লেখকের বক্তব্য সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে শাসকের এদেশের বৈধতার নীতিমালা, শাসকের শরিয়াহর নীতির প্রতি আনুগত্য ও সংহতি, বড় ধরনের অবহেলা ও অসদাচরণের ক্ষেত্রে শাসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পদ্ধতিমালা আলোচনা করা হয়েছে।
অষ্টম অধ্যায়ে মুসলিম বিশ্বের পুনর্জাগরণ ও চলমান ইসলামী আন্দোলন সমূহের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন সমূহ কি বিরাজমান বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, নাকি এটি স্বতঃ উৎসারিত বিষয়? দেখা যায় সমস্ত আন্দোলন সমূহের মধ্যে মৌলিক কতগুলি বিষয়ের মিল রয়েছে, তবুও বিশেষ কোন আন্দোলনের স্বাতন্ত্রিক সমৃদ্ধি তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, ভারতে জন্ম নেয়া তাবলীগ জামাত আন্দোলন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব কৌশল ও পদ্ধতি হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে। এসব আন্দোলন সমূহ বহুত্বের মাঝে একত্বকে নির্দেশ করে এবং ঐশী একত্বের পতাকাকে সমুন্নত করে তুলে ধরে।
এ গ্রন্থটি ব্যাপক অর্থে কোন বিস্তারিত পাঠ্যপুস্তক নয়। ইহা ইসলামী রাজনৈতিক সমীক্ষা ও ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ও আগ্রহী অভিজ্ঞ বিজ্ঞজন, ছাত্র, শিক্ষক ও সর্বশ্রেণীর সুধীমহলের আগ্রহকে উদ্দীপ্ত করার জন্য সাধারণভাবে কতিপয় মৌল বিষয়ে উপর গ্রন্থটিতে আলোকপাত করা হয়েছে। আলোচিত বিষয়সমূহ যুগপৎ ঐতিহাসিক ও সমকালীন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গ্রন্থটি পাশ্চাত্য রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে ইসলাশী রাজনীতির সাংঘর্ষিক সম্পর্ক, বর্তমান মুসলিক বিশ্বব্যবস্থা এবং চলমান ইসলামী আন্দোলক সমূহের মূল চেতনা ও পদ্ধতি অনুধাবনে সহায়ক হবে বলে আশা করি।
আবদুল রশিদ মতিন
ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া