ইসলামে রাজনীতি
ডোনাল্ড ই. স্মীথের মতে সামাজিক, সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে মুসলিম সমাজ একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা। এরূপ সমাজে ধর্ম স্বাতন্ত্রিক স্বায়ত্ত্বশাসিত কোন এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্ম প্রবিষ্ট হয়।–[ ডোনাল্ড ইউজীন স্মীথ, ‘Religion and Political Developmen, (বোস্টন, লিটল ব্রাউন, ১৯৭০) পৃঃ ৫৯] কিন্তু মুসলিম অঞ্চল হতে উপনিবেশিক শক্তিসমূহের বিদায়ের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর যে সব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তা হতে দেখা যায় যে, এসব দেশে বাস্তবে মানুষের বস্তুগত জীবন ও আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে অথবা এ ধরনের বিভাজনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রকাশিত সমীক্ষাসমূহে ইসলাম ও রাজনীতির মধ্যে কি সম্পর্ক বিদ্যমান তার গুরুত্ব উৎঘাটন করে কি ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে এবং কি অপরিবর্তিত রয়েছে তা নির্ণয়ের উপর জোর দেয়া হয়েছে। তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতির অর্থ, ধরন, প্রকৃতি কি রূপ তা অনুধাবন করা প্রয়োজন।
রাজনীতির সংজ্ঞা
‘পরিটিক্স’ বা রাজনীতি শব্দটি গ্রীক শব্দ ‘পলিসি’ হতে এসেছে, যার অর্থ নগর। রাজনীতির উপর আলোচনা রাষ্ট্রের উপর বিধায় এর নানা অর্থ ও তাৎপর্য সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে “শুন্যতাকে ঘিরে পাহাড় প্রমাণ উপাত্ত” বলে অভিহিত করতে ই. ই. সাটস্নেউডার প্ররোচিত হয়েছেন।–[ E.E. Schattschneider Two Hundred Million Americans in Search of a Government’, (নিউইয়র্ক; হোল্ট, রাইনহার্ট এবং উইনস্টন, ১৯৬৯, পৃঃ ৮] অনেকে রাজনীতির সংজ্ঞা নির্ণয়ের উপযোগীতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, কেননা রাজনীতির সংজ্ঞা এর প্রাসঙ্গিতকার মধ্যেই নিহিত আছে। তাদের মতে রাজনীতি হচ্ছে রাজনীতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যা বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে বার্নার্ড ক্রীকস-এর প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য হচ্ছে ‘রাজনীতি হচ্ছে রাজনীতি’-[ বার্ণার্ড ক্রীক, ‘In Defence of Politics’ (লন্ডন: পেলিকান বুকস, ১৯৬৪), পৃঃ ১৬] সংজ্ঞার বিষয়ে এই অনীহার ঐতিহ্য সত্ত্বেও অনেকে অনেক সংজ্ঞা দিয়েছেন,যা রাষ্টবিজ্ঞানীর আওতাভুক্ত মৌল বিষয়ের উপর আলোচনা করেছে।
নীতি নির্ধারকগণের যে নৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার দরকার মূলতঃ সে দৃষ্টিকোণ থেকে প্লেটো ও এরিস্টটল রাজনীতিকে দেখেছেন। তাদের মতে রাজনীতর উদ্দেশ্য হলো প্লেটো ও এরিস্টটল রাজনীতিকে দেখেছেন। তাদের মতে রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো সাধারণ কল্যাণ, সামাজিক শুভবোধ ও নৈতিক পূর্ণতা সাধন। এরিস্টটলের মতে ‘রাষ্টবিজ্ঞানের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন।–[ এরিস্টটল, The Ethics; অনুবাদ: জে.এ.কে. থমসন (ইংল্যান্ড পেনগুইন বুকস, ১৯৫৩) পৃঃ ৪৪] রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক লক্ষ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করলেও, এরিস্টটল রাজনীতিক সংগঠন পদ্ধতির গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজ কর্মচারীদের কিভাবে নির্বাচিত করা হয়,কিভাবে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নির্ধারিত হয়, কর্মচারীদের উদ্দেশ্যের প্রকৃতির স্বরূপ ইত্যাদি বিষয়ে এরিস্টটল সবিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন।–[ আর্নেষ্ট বার্কার The Politics of Aristotle’ (নিউইয়র্ক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৮) পৃঃ ১৯৫৪-৬।] সাম্প্রতিক সময়ে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রের নৈতিক উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। তারা সুন্দর জীবন কি এ নিয়ে যে মতবিরোধ তাকে ‘রাজনীতির মৌলকেন্দ্র’ রূপে অভিহিত করেছেন।–[ Julius Gould and Willum L. Koll সম্পাদিত ‘A Dictionary of Social Science’ (নিউ ইয়র্ক, ফ্রী প্রেস, ১৯৬৫) পৃঃ ৪।] যদিও সুন্দর জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণার স্বাধীনতা ভোগ থেকে স্বাধীনতা ও শুভবোধের সমন্বয়-এর মধ্যে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়-[ William T. Bluhm, ‘Theories of the Political System’ (ঈগরউড ক্লিফস, এন.জে প্রেনটিস হল, ১৯৭০) পৃঃ ৬।], এর পরও তারা রাজনীতিকে একাথে কাজ করা ও বাঁচার কৌশল হিসাবে অভিহিত করেছেন।
রবার্ট-এ ডাহল রাজনীতি সম্পর্কে এরিস্টটলের সংজ্ঞাকে খুব সংকীর্ণ মনে করেছেন, কেননা এতে রাজনীতিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তিনি রাজনীতির সংজ্ঞা পুননির্মাণ করে বলেছেন যে, ‘ইহা একধরনের অনঢ় মানবিক সম্পর্কের প্রকৃতি যা উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষমতা, শাসন বা কর্তৃত্বের সাথে সংযুক্ত থাকে।–[ Robert A. Dahl ‘Modern Political Analysis’, (ঈগরউড ক্লিফস, এন.জে প্রেনটিস হল, ১৯৭০) পৃঃ ৬।] কল্যাণকর জীবন যাপনে রাষ্ট্রযন্ত্রই যথেষ্ট, এরিস্টটলের এই মতবাদকে ডাহল সমালোচনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন জাতিসত্তার সহঅবস্থঅনকে অন্তর্ভুক্ত করে রাজনীতির সম্পর্কের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করেছেন। তিনি জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘পদ’ বা ‘ভূমিকা’র সংজ্ঞা নির্মানে এরিস্টটলকে অনুসরণ করেননি।
ডাহলের বক্তব্যকে ডেভিড ইস্টন আরো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘রাজনৈতিক কর্ম সমাজে কর্তৃত্বের সাথে মূল্যবোধ সৃষ্টি করে’ মর্মে তার অভিমত অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে ‘গতানুতিক মতবাদে’ পরিণত করেছে।–[ ডেভিড ইস্টন, The Political System, ‘নিউইয়র্ক, আলফ্রেড এ, নফ, ১৯৫৩), পৃঃ ১৩৪।] ডাহলের ন্যায় তিনি রাজনীতিকে মানবিক সম্পর্কের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখেছেন, তবে তিনি একে সমগ্র সমাজের মাঝে ‘কর্তৃত্বশীলতার বন্টনের’ মাঝে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। উপরন্তু ইস্টন সমাজের সীমিত সম্পদের বন্টননীতির পরিবর্তন আনয়নের মদ্যে নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং তিনি অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের উপরও দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। এলান সি আইজ্যাকের মতে এ বক্তব্যটি ‘একটি আপোষমূলক অবস্থান, যা অতিসংকীর্ণও নয় আবার অতি বিস্তৃতও নয়’।–[ এলান সি আইজ্যাক, ‘Scope and Methods of Political Science; An Introduction to the Methodology of Political Inquiry’ (হোমউড, ইলিনয়েস,দি ডরসি প্রেস), পৃঃ ২১।]
বন্টনপদ্ধতি এবং তার উপর গুরুত্বারোপ হ্যারল্ড স্যাসওয়েলের লেখাতেও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মতে রাজনীতির সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘কে কি পাচ্ছে, কখন পাচ্ছে এবং কিভাবে পাচ্ছে’।–[ হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল, ‘Politics: Who Gets What, When, How’ (ক্লীভল্যান্ড, ওয়াল্ড পাবলিশিং কোম্পানী, ১৯৫৮।] লেসওয়েলের সংজ্ঞাটি পরিধির দিক থেকে ব্যাপক, যা একজন পর্যবেক্ষককে রাষ্ট্রযন্ত্রসহ সমাজ বিন্যাসের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে রাজনীতিকে অবলোকন করার সুযোগ করে দেয়। এ সংজ্ঞা যুগপৎ কর্তৃত্বশীলতার সম্পর্ক এবং বন্টনপদ্ধতিতে ক্ষমতা ও দ্বন্দের প্রভাবকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ইস্টন ও ল্যাসওয়েলের ধারণার পার্থক্য মূলতঃ তুলনামূলক গুরুত্বারোপের উপরঃ প্রথমজন সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর দৃষ্টিপাত করেছেন। সুতরাং এটা মোটেই আশ্চর্যজনক নয় যে ল্যাসওয়েল সাধারণভাবে রাজনীতিকে ‘ক্ষমতার আকার ও নির্ধারণ ও তার অংশীদারীত্ব বন্টন’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
স্পষ্টতই বিষয়বস্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামো হতে সীমিত সম্পদ বন্টনের বাঞ্ছনীয় ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত মানুষের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তিত বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অধিকন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতাবাদী ঐতিহ্য ক্লাসিক্যাল বা মধ্যযুগীয় ভালো সমাজ ও তৎসম্পর্কিত আচরণ বিধির-ধারণাকে অপসারিত করে দেয়। বর্তমানে ক্লাসিক্যাল বা আধুনিক রাজনীতির সংজ্ঞার ক্ষমতা ও দ্বন্দের ধারণাও বদলে গেছে। ক্ষমতার নৈতিক ও আদর্শিক ধারণাটি বর্জিত হয়েছে এবং সে স্থান দখল করে নিয়েছে- বিজয়ী বস্তুবাদ ও বস্তুগত আচরণবিধি।
‘যেকোন মূল্যের বিনিময়ে ক্ষমতাধারীর আনুগত্যের কাছে অন্য সবাইকে নতিস্বীকার করান’-এই সংজ্ঞা অনুযায়ী সর্বগ্রাসী ও সর্বশক্তিমান হয়ে উঠেছে।–[ এলান বুলক ও অলিভার স্টেলিব্রাস সম্পাদিত The Harper Dictionary of Modern Thought’ (নিউইয়র্ক, হার্পার এন্ড রো, ১৯৭৭), পৃঃ ৪৯০] এই ধরনের ক্ষমতার মানবীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতার সাথে সহঅবস্থান সম্ভব নয়। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এমন নজীরবিহীনভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় যে তা মানুষের অধিকার, চিন্তা, সংস্কৃতিকে দলিত করে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বাধীণ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে।–[ ব্রার্ট্রান্ড দ্য জুভিনাল, ‘Power: The NaturalHistory of Its’ Growth; অনুবাদ :জে.এফ. হান্টিংটন (লন্ডন, হাচিনসন, ১৯৪৮)] আইজ্যাক ডি ইসরাইলীর ভাষায় রাজনীতি তাই ‘প্রতারণার মাধ্যমে মানব জাতিকে শাসন করার কৌশলে’ পরিণত হয়েছে।–[ বার্নার্ড ক্রীক, ‘In Defence of Politics, পৃঃ ১৬]
ইসলামে রাজনীতি
পশ্চিমা রাজনীতির সাথে ইসলামী রাজনীতির কোন সামঞ্জস্য বা মিল নেই। তবে রাজনীতির অর্থ যদি হয় কল্যাণময় জীবন-যাপন এবং একমাত্র আল্লাহ পাকের আরাধনা ও সন্তুষ্টি বিধানের জন্য জীবনচর্চা তবে সে রাজনীতি ইসলামের মূল বিষয়। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে চারটি স্তম্ভ যথা নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্জ্ব ‘ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ ও ঐক্যবোধ সৃষ্টি করে’।–[ হামিদ এনায়েত, Modern Islamic Political Thought, (লন্ডন, ম্যাকমিলান, ১৯৮২) পৃঃ ২] ইসলামের এ স্তম্ভগুলোর উদ্দেশ্য শুধু ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সাধন নয় বরং এর আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক তাৎপর্য রয়েছে। এ সব স্তম্ভসমূহ মানুষের আচরণ ও কার্যকলাপের সাথে ঘনিষ্টভাবে সংযুক্ত। নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্বাসীদের জন্য যে নামাজ ফরজ করা হয়েছে (৪:১০৩), জামায়াতের সাথে যা আদায় করা বিধেয়, সে নামাজের মাধ্যমে একজন ঈমানদার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে যাতে রয়েছে চিন্তন, আবেগগত অনুপ্রেরণা ও শারীরিক সঞ্চালন। নামাজে বিশ্বাসী মানুষেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়, নামাজ আদায়ের জন্য একজনকে ইমাম নির্বাচিত করা হয়, মহান আল্লাহর মহিমা ঘোষণা; করে নামাজীরা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে প্রার্থনা করে, ‘হে প্রভু, আমাদের সরল সঠিক পথ দেখাও’। নামাজের প্রার্থনার মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে কল্যাণময় জীবনের নীতিমালা, সামাজিক সমতা ও ঐক্য, নেতৃত্ব ও আনুগত্য, দায়িত্ববোধ ও দায়িত্ব সচেতনতা এবং বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব। একই ধরনের গুণাবলী সম্বলিত নিয়মাবলী ইসলামের অন্যান্য স্তম্ভগুলির পরিচর্চা এক ধরনের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক প্রশিক্ষণ। সাইয়েদ আ’লা মওদুদীর ভাষায়, ‘যত নিয়মানুবর্তিতার সাথে আমরা এই প্রশিক্ষণ অনুসরণ করব, তত ভালোভাবে আমরাআদর্শের সাথে বাস্তব জীবনের মিলন ঘটাতে পারব।–[ আবুল আলা মওদুদী, Towards Understanding Islam’, অনুবাদ, খুরশীদ আহমদ (লন্ডন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮০), পৃঃ ৮৮]
রাজনীতিতে যদি সরকার পরিচালনার সীমাবদ্ধ সংজ্ঞায় ধরা হয় তবে রাজনীতি ইসলামের অন্যতম প্রধান বিষয়। ‘সৎ কাজের আদেশ কর এবং মন্দ কাজ নিষেধ কর’ কুরআনের এ আহবান; ন্যায়বিচার ও অন্যান্য ঐশী গুণাবলী ও নির্দেশনা প্রভৃতি সমুন্নত রাখার জন্য সমাজের প্রত্যেক মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। কুরআনে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলাকে নিন্দা করেছে (২:২০৫) এবং রাসূলুল্লাহ (সা) সমাজে সংগঠন ও কর্তৃত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সম্ভব নয় মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং আরে মন্তব্য করেছেন যে আনুগত্য ছাড়া নেতা নির্বাচিত হওয়া যায় না।–[ ইউসুফ ইবনে আবদ আল বার আল কুরতুবী, ‘জামি বায়ান আল ইলম ওয়া ফাডলুহ’,(মদিনা : আল মাকতাবাহ আল ইলমিয়াহ) ভলিউম-১; পৃঃ ৬২] খোলাফায়ে রাশেদা ও তাঁদের সাথীগণ এই মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে আল্লাহ পাকের ইচ্ছা বাস্তবায়নের যে ঐশী দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার দায়ভার যুগপৎ ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে সম্পাদন করতে হবে। জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় শুভবোধ দ্বারা এমনভাবে জড়িত হিসাবে দেখতেন। হযরত কাব এর সূত্রে ইবনে কুতায়বা বলেনঃ ‘ইসলাম, সরকার ও জনগণ হচ্ছে তাবু, দণ্ড, রজ্জুও পেরেকের মত। ইসলাম হচ্ছে তাবু, সরকার হচ্ছে তাবু ধারণকারী দণ্ড, আর জনগণ হচ্ছে রজ্জু ও পেরেক। একটি ছাড়া অন্যটির কোন কার্যকারিতা নেই।–[ ইবনে কুতারবাহ, ‘ইউয়ুন আল আকবার’ ভলিউম-১; বার্নার্ড লুইস কর্তৃক সম্পাদিত ‘Islam From the Prophet Muhammad to the Capture of Constantipole’ (লন্ডন, দি ম্যাকমিলান প্রেস লিঃ, ১৯৭৬), ভলিউম-১; পৃঃ ১৮৪]
ক্ষমতার জন্য সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে রাজনীতি ইসলামের আরো মৌলিক বিষয়। কেননা আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে তৌহিদ ঘোষণার জন্য প্রয়োজন সমস্ত তাগুতী শক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়া অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত অধিকার ও ক্ষমতা দখল করতে হবে যাতে পৃথিবী থেকে সকল জুলুম, অন্যায়, অবিচার অপসারণ করা যায়। ইসলামে কাংখিত তৌহিদী সমাজে কোন আপোষ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবকাশ নেই। সকল মিথ্যা দেবতাদের মিথ্যা পূর্জাঅর্চানকে বিতাড়ন করে দেয়ার জন্য ইসলাম উদাত্ত আহবান জানিয়েছে, এসব মিথ্যা দেবতাদের ধারক বাহকদের সকল ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ন্যায়পরায়ন ধর্মানুরাগী ব্যক্তিবর্গের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে এবং ভালোর উপর মন্দকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। কুরআনের নির্দেশেই নবী মোহাম্মদ (সা) নির্জনতা হতে বেরিয়ে এসে রিসালত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁর মদীনায় হিজরতের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঐশী ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। একইভাবে সকল পূর্ববর্তী নবীগণও ঐশী বাণী প্রচার করেছেন এবং সকল বিশ্বাসীদের তাগুতী শক্তি নস্যাৎ করে দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। (১৬:৩৬)
ইসলাম তাই ক্ষমতার সাথে কক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত, যে ক্ষমতার সাহায্যে সমগ্র মানবতার কল্যাণের জন্য ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালা অনুযায়ী জগতকে রূপান্তর করা যায়। ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ (আল্লাহর রাহে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা) তাই ঐশী ইচ্ছা বাস্তবায়ন প্রচেষ্টার অন্য নাম। ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক ক্ষমতা দখলকে কুরআনে এক বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কুরআন জিহাদকে ঈমানের কষ্টিপাথর হিসেবে অভিহিত করেছে।
ব্যক্তিগত সামষ্টিক স্বার্থ হাছিলের জন্য ক্ষমতা দখল ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। ইসলাম ক্ষমতাকে একটি নৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে স্থাপন করেছে। এ ক্ষমতা দখল আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য পূরণের মাধ্যম মাত্র, যাতে চির শান্তিময় অনন্ত জীবন লাভ করা যায় এবং মানবতার জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার উৎস হিসাবে যাতে এই রাজনৈতিক ক্ষমতার ধর্ম, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের রূপরেখাও তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাল্টে দেয়।
উপরের আলোচনা হতে সুস্পষ্টভঅবে প্রতীয়মান হয় যে রাজনীতি হচ্ছে ইসলামের নির্দেশনা এবং একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। স্রষ্টাও সীজারের মধ্যে একজনকে বেছে নেবারও অবকাশ ইসলামে নেই। ইসলামে সীজারের কোন অস্তিত্ব নেই, আছে শুধু মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্তিত্ব। শরীয়াহ (ইসলামী আইন) বস্তুগত জীবনের সাথে আধ্যাত্মিক জীবনের সামঞ্জস্য বিধান করেছে। ইসলামী নৈতিক মূল্যবোধ রাজনীতির নির্দেশনা ও গতিপথ নির্ধারণ করে দেয় এবং রাজনৈতিক আচরণ বিধি ইসলামের আদর্শিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ হতে উৎসারিত। তাই রাজনীতির মুখ্য বিষয়সমূহ তথা রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা, ন্যায়পরায়নদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ, মন্দের শিকড় উৎপাটন করে কল্যাণকর জীবন প্রতিষ্ঠা-এসব কিছুই ইসলামের প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং ইসলাম এবস কিছুকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। এ সমস্ত কর্মকাণ্ডকে ইসলাম কেন্দ্রীয় মর্যাদা প্রদান করে, তবে পার্থক্য এটুকু যে, এ সমস্ত কিছু তথা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ইসলামের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের মূল ও বিস্তৃত কাঠামোর ভিতরে সংঘটিত হতে হবে। ধর্ম ও রাজনীতি তাই ‘একই ইসলামী মুদ্রার দু’পিঠ’-নয়।–[ জি.এইচ জ্যানসেন, ‘Militant Islam’ (লন্ডন, প্যান বুকস, ১৯৭৯), পৃঃ ১৭] তাদেরকে এমনভঅবে বিন্যস্ত করা যায় না যে, একটি স্বাধীন সত্তা এবং একটি অন্যীটর উপর নির্ভরশীল। ইকবালের ভাষায় প্রকৃত সত্য এই যে ‘ইসলাম হচ্ছে দ্ব্যর্থহীনভাবে একক বাস্তব সত্যত, যা সুস্পষ্টভাবে এক ও অভিন্ন, যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন’।–[ স্যার মোহাম্মদ ইকবাল, The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ (লাহোর, শেখ মোহাম্মদ আশরাফ, ১৯৭১), পৃঃ ১৫৪]
ইসলাম ও রাজনীতিঃ একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত
ধর্ম ও রাজনীতির সবচেয়ে আদর্শিক সম্পৃক্ততার উদাহরণ হচ্ছে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা), যাকে কুরআন সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে (উসওয়াহ হাসানা ৩৩ : ২১)। অন্যান্য বিষয়াবলীর মধ্যে তাঁর মদীনায় হিজরতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ক্ষমতা-সম্পর্কের পুনর্গঠন করে ঐশী ইচ্ছার অনুবর্তী করা। এখানেই ইসলামের প্রথম রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, যার বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক প্রধান ছিলেন মহানবী মোহাম্মদ (সা)।
তিনি নামাজের ইমামতি করতেন, সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতেন, বিচারক হিসাবে কাজ করতেন এবং জননীতি নির্ধারণ করতেন। সঠিক পথে পরিচালিক খোলাফায়ে রাশেদা তাঁদের শাসনকালে মহানবী (সা) কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করেছিলেন। উম্মাহর নেতা হিসানে তিনি শরীয়াহ বাস্তবায়ন করতেন, ধর্মীয় আদর্শ পূর্ণভাবে সংরক্ষণ ও সমুন্নত এবং এর বিশুদ্ধতা বজায় রাখতেন। তৃতীয় খলিফা উসমানের সময় ইসলামী সভ্যতা ‘প্রাচ্য হতে পশ্চিমের আটলান্টিক মহাসাগরের তীর’ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।–[ Marshall Hodgson, The venture of Islam Conscience and History in A World of Civilization’ (শিকাগো, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ১৯৭৪), ভলিউম-১।]
পন্ডিতদের মদ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে যে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামীরাজনৈতিক ব্যবস্থা সকল মুসলমান সমাজের গ্রহণ ও অনুসরণের জন্য আদর্শ স্বরূপ। উমাইয়া খিলাফতের আর্বিভাবের সাথে মুসলিম ইতিহাসে বংশানুক্রমিক শাসনের এক নতুন ধারা যুক্ত হলো, যা কখনো কখনো বল্গাহীন রাজতন্ত্রে পরিণত হতো।–[ আদর্শ খিলাফত হতে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র বিবর্তনের বিস্তৃত বিবরণের জন্য দেখুন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, “খিলাফত ওয়া মুলুকিয়াত” (লাহোর, তারজুমান আল কুরআন, ১৯৭৫)] জাগতিক কর্মনাল্ডে তাদের শাসনব্যবস্থা ছিল স্বেচ্ছাচারী। তবও তাদের ইসলামী বিশ্বাসের প্রতিরক্ষাকারী, ইসলামের সম্মানের সংরক্ষক, ইসলামের বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধা হিসাবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তারা দন্ডমুক্তভাবে শরীয়াহকে অবজ্ঞা করার কোন ক্ষমতা বা সাহস রাখত না।
যে আন্দোলনের মাধ্যমে খিলাফতের ক্ষমতা উমাইয়াদের হাত হতে আব্বাসীদের হাতে সস্তান্তরিত হয় ঐ আন্দোলনের সাথে মহানবী (সা) এর আদর্শ মোতাবেক শাসন পরিচালনার অঙ্গীকার ব্যখ্ত করলেন, যা তাদের শাসনক্ষমতাকে শক্তিশালী বৈধতা দান করে। তাঁরা খিলাফতের ধর্মীয় দিকগুলিকে উচ্চাসন প্রদান করল এবং সামনে শরীয়াহর পূর্ণ আনুগত্যের অঙ্গিকার ব্যক্ত করল।
ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রমাণ হিসাবে অধিকাংশ আব্বাসীয় শাসকগণ নামের শেষে আল্লাহ বা ‘দ্বীন’ (ধর্ম, জীবন বিধান) শব্দ ব্যবহার করতেন যথা আল-মুনতাসীর বি-আল্লাহ, আল –কাহির বি-আল্লাহ, সালাহ আল-দ্বীন, মুহয়ী আল-দ্বীন ইত্যাদি। যদিও পরবর্তী খলীফাগণ শরীয়াহর সাথে সম্পর্কহীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করত, রাজনীতি ও ইসলামকে পৃথক করে রেখেছিল, তবু তারা লাগামহীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারত না এবং অন্ততঃ প্রকাশ্যে ঈমান ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্কের কথা স্বীকার করতেন। যাহোক মুসলিম শাসম শ্রেণী কর্তৃক রাজনীতি ও শরীয়াহর কার্যত পৃথকীকরণ এ যুক্তি দাঁড় করাতে পারে না যে ইসলামী এ পৃথকীকরণকে অনুমোদন করে। ইসলামের অবস্থান মূল্যায়ন করতে হবে এর মূলনীতির সাহায্যে, শাসকবৃন্দের বিচ্যুতি দ্বারা নয়। দরবেশের মত সাধারণ জীবন যাপনকারী ও শরীয়াহ অনুযায়ী শাসনকারী উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজীজ ব্যতীত মুসলিম ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জনগণের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐশী ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনা করা হতো না। এ পরিস্তিতি মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে তিনটি ধারার জন্ম দিল। সুফী শ্রেণীর লোকজন (অতিন্দ্রীয়াবাদী) জনজীবন হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে নির্জনবাস শুরু করলেন। হানাফী আইনশাস্ত্রবিদ আবু লয়দ আল-সমরকন্দী আনাসকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘উলামা বা ইসলামী পণ্ডিতগণ হচ্ছেন মহানবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের উত্তরাধিকার, কিন্তু তারা যখন শাসক শ্রেণীর নিটক যান এবং পার্থিব বিষয়ে অংশগ্রহণ করে তখন তারা মহানবী (সা) এর আদর্শ ভুলে যান’।–[ S.D.B Gotein; ‘Studies in Islamic Religious and Political Institutions’, লেউডেন: ই.জে.ব্রীল, ১৯৬৮) পৃঃ ২০৫-৬।] জাগতিক সকল বিষয় হতে সুফীদের নিজেদেরকে প্রত্যাহার বস্তুত আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটিয়েছিল। হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে কিছু সুফী তরিকা জন্ম নেয় যা অদ্যাবধি বর্তমান আছে। তাদের বিশ্বাস, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তবে এগুলোর মধ্যে কিছু অনৈসলামিক উপাদানও ঢুকেছে। এগুলো তরিকাসমূহের মধ্যে বিভ্রান্তির জটালজাল বিস্তার করে। এতদসত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে সুফীগণ ইসলামের মূল্যবোধসমূঞ সংরক্ষণ ও বৈরী শক্তির প্রভাব হতে ঈমান আকিদা রক্ষায় মহান অবদান রেখেছেন।
দ্বিতীয় ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন ঐসব চিন্তাবিদ ও আইনজ্ঞগণ যারা উম্মতের ঐক্য, সংহতি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে কার্যতঃ মেনে নিয়ে সমর্থন করেন। স্ববিরোধী হলেও তাঁরা ক্ষমতার কেন্দ্র হতে নিজেদের দূরে রেখেছেন, শাসন কর্তৃত্বের কোন পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, বলপূর্বক আনুগত্য গ্রহণের রীতিকে অনুমোদন করেননি, এবং যে সব বিদ্রোহী শাসন কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছে তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ফিকাহ শাস্ত্রের চারটি ধারার প্রবর্তকগণ (মাজহাব) শাসকশ্রেণীর সাথে সম্পর্ক রাখতেন, কিন্তু সে সম্পর্ক সৌহার্দমূলক ছিল না। ম্যানফ্রেড হলপার্ন তাঁদের এ নীতিকে ‘প্রতিবাদী সহযোগিতা’ বলে অভিহিত করেছেন;-[ Manfred Halpern, ‘The Politics and Social Change in the Middle East and North Africa’ (প্রিন্সটন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৩) পৃঃ ১১] যে ভূমিকার জন্য তারা নানা ধরনের নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁদের অন্যতম ইমাম আল-শাফীঈ প্রায় মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এসব মুসলিম চিন্তাবিদগণ স্থিতাবস্থা সমর্থন করেছিলেন এই জন্য নয় যে এই শাসকবর্গ ইসলামী আদর্শের প্রতীক ছিলেন বরং তারা নৈরাজ্য ও বিশৃংখল অবস্থা হতে উম্মতকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। তাই তারা শাসকবর্গকে মান্য করার পরামর্শ যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা জনগণকে পাপাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য না করে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কার্যত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে মেনে নেবার শামিল এবং এর ফলে বিশ্বাসীদের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন, কিন্তু বাস্তববোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে তাঁরা উম্মতের দুঃখদুর্দশা ও শান্তিপূর্ণ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শাসকদের অবস্থা মেনে নিয়েছিলেন।
তৃতীয় ধারাটির প্রতিনিধিত্ব করেন ‘উলেমাবৃন্দ’ যারা ‘রাষ্ট্রীয় অসহযোগীতা ও সামাজিক অস্থিরতার মাঝে ইসলামের পতাকা বহনের’ গুরুদায়িত্ব স্কন্ধে ধারণ করেন।–[ ডব্লিউ. সি. স্মীথ, ‘On Understanding Islam; Selected Studies’ (দি হেগ, মুটন, ১৯৮১) পৃঃ ২০২।] তারা জনগণের চরিত্র সংশোধনে নিয়োজিত থাকেন এই আশায় যে এ প্রচেষ্টা এক সময় ইসলামের আলোকে সমাজ বিবর্তন ঘটাবে। তাদের কর্ম প্রচেষ্টার বৃহদাংশ নিয়োজিত থাকে কুরান-সুন্নাহ অনুযায়ী ঈমান আকীদার বিশুদ্ধতাবজায় রাখা ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনে। তাঁরা সত্যনিষ্ঠ, আন্তরিকতা, সত্যবাদিতা, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ব, পিতা-মাতার প্রতি সম্মান, সহনশীলতা ও ধৈর্য ইত্যাদি আত্মিক গুণাবলী প্রচার করেন। এটা স্বীকৃত যে খোলাফায়ে রাশেদার সামনে মুসলিম সমাজের ক্রমবর্ধমান জটিলতার প্রেক্ষিতে রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকাও জটিল হয়ে পড়ে। আইন শাস্ত্রবিদ, সুফী ও উলেমাগণ যে সমাজে কাজ করেছেন সে সমাজ ব্যবস্থারও বিপুল পরিবর্তন ঘটে। বস্তুগত জগত ও আধ্যাত্ম জগতের মধ্যে দৃশ্যত যে বিভাজন পরিদৃশ্যমান হয় তার অর্থ এই নয় যে দু’টি ধারা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। যদিও কতিপয় সুফী প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন, প্রখ্যাত কয়েকজন তাদের আধ্যাত্মিক জীবন ও বাস্তব কর্মমান্ডের মাঝে সম্মিলন ঘটিয়েছেন। তাঁরা বৈরাগ্যপূর্ণ জীবন যাপন করলেও রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হতেন, শাসকবর্গের সাথে তাদের সংঘাত হতো বেং শেষতক তাঁদের প্রচেষ্টা শক্তিশালী সমাজ, রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। হিজরী ৬ষ্ঠ শতকে ইমাম গাজ্জালীর দার্শনিক শিষ্য মুহাম্মদ ইব তুমারত তার উদাহরণ।–[ ই.আই.জে রোজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’ (ক্যামব্রীজ, ক্যামব্রীজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮) পৃঃ ১৮১] তাঁর প্রচারিত তত্ত্ব ও দর্শনের ভিত্তিতে মুওয়াহিদ সাম্রাজ্যের পুরো পশ্চিমাঞ্চল দখল করে ‘প্রায় দু’ প্রজন্ম যাবত শান্তি ও সমৃদ্ধির ধারা বজায় রাখে, যা রোমানদের সময়ের পর আর দেখা যায়নি।–[ জে.জে সন্ডারসন, ‘A History of Medieval Islam’ (লন্ডন: রুলেজ এন্ড কেগান পল, ১৯৮০), পৃঃ ১৭১।] ধর্মযোদ্ধাদের প্রার্থনা ও বাসগৃহ হিসাবে পরিচিত ‘রিবাত’ ধর্মগৃহে বসবাসকারী মুওয়াহিদের পূর্বসূরী ‘আল মুরাবিতুন’রা সফল জিহাদ পরিচালনা পূর্বক ‘আল মুরাবিত’ সাম্রাজ্য (হিজরী ৪৪৮-৫৪১ সন/১০৫৬-১১৪৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সেনেগাম্বিয়া হতে আলজেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।–[ জামিল এ আবু নসর, ‘A History of the Maghreb’, (লন্ডন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৫), পৃঃ ৯২-১০৩; সি.সি. বসওয়ার্থ, The Islamic Dynastics (এডিনবার্গ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৪), পৃঃ ৪০৪-২৪।] সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ হচ্ছে তুর্কিস্থানের নকসবন্দীয়া আন্দোলন, সুদানের মাহদিয়া আন্দোলন এবং আরো অন্যান্য।
একইভাবে ‘উলেমা’ সম্প্রদায়ের যারা স্থিতিবস্থা মেনে নিয়েছিলেন, তারা একে কখনো ইসলামী মনে করেননি। তারা বাস্তবজীবন ও আধ্যাত্মিক জীবনের ঐক্যকে ইমাম গাজ্জালীর ভাষায় ‘ধর্ম ও বস্তু জীবন হচ্ছে যমজ’ এ ভাবে মনে করতেন। গাজ্জালীর মতে রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে, ‘মানুষের ইহকালীন ও পরকারীন জীবনের কল্যঅণ সাধন করা’।–[ রজেনথাল, ‘Politics Thought in Medieval Islam’, পৃঃ ৩৯।] ইসলামী আইনজ্ঞ (যথা আল মাওয়া’র্দী ও আল-গাজ্জালী), দার্শনিক (যথা নসর আল দ্বীন আল ফারাবী ও ফখর আল-দ্বীন আল-রাজী) ও গ্রন্থের লিখক (যথা নিযাম আল-মুলক ও হুসাইন ওয়াইজ কাশফী)-[ ‘Islamic Political Thought’ গ্রন্থে এ.কে.এম ল্যাম্বটন মুসলিম চিন্তাবিদগণকে তিনভাবে বিভক্ত করেছেন। Joseph Schacht এবং C.E. Bosworth সম্পাদিত ‘The Legacy of Islam’ (লন্ডন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৪) পৃঃ ৪০৪-২৪।] দের মতে আদর্শ রাষ্ট্র হচ্ছে যেখানে কল্যাণময় জীবন যাপনের জন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা রয়েছে –আল্লাহপাক নির্দেশিত আধ্যাত্মিক সাধনা ও শরীয়া’র বিধান মান্য করে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয়, নৈতিক ও বস্তুগত জীবন পরিচালনার মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের জন্য নিজেদের যেখানে গড়ে তুলতে পারবে।–[এইচ.এ.আর.গীব, Constitutional Organization; মজীদ খাদ্দুরী এবং এইচ জে লীবসনে সম্পাদিত Law in the Middle East: Original and Development of Islamic Law (ওয়াশিংটন ডিসি, The middle East institute, ১৯৫৬) পৃঃ ১২-১৩।] এমনকি ইবনে খালদুন প্রাচ্যবিদরা যাকে ধর্মনিরপেক্ষ ধরনের পর্যালোচনার জন্য ঊর্ধ্বে স্থান প্রদান করেন, তিনিও আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পৃক্তকরণের উপর সর্বশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আল মাওয়ার্দীর মত তিনিও ধর্মরক্ষণ ও শাসন কার্য পরিচালনার জন্য খলিফার ভূমিকাকে ‘মহানবী মোহাম্মদ (সা) এর উত্তরাধিকারী বা বিকল্প হিসাবে ‘বর্ণনা করেছেন।–[ ইবনে খালদুন, ‘The Muqaddimah, An introduction to History; অনুবাদ: এফ রজেনথাল, সম্পাদনা: এন.জে.দাউদ (প্রিন্সটন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮১) পৃঃ ১৫৫।]
সুতরাং দেখা যাচ্ছে নীতিগতভাবে চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনীতিতে কোন বিচ্ছেদ ঘটেনি। বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সর্বক্ষেত্র পরিব্যপ্তকারী ধর্ম হিসাবে ইসলাম কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে এর পরিসীমার বাইরে রাখতে পারে না। তবু যেসব ধারা উপরে আলোচিত হয়েছে তা হতে ক্ষমতা ও সামাজিক রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসাবে স্ববিরোধী ধারণার জন্ম হয়েছিল। মুসলিম অঞ্চল সমূহের উপর উপনিবেশবাদী শাসন এ অবস্থানে আরে দুর্বিষহ করে তুলে।
পাশ্চাত্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মুসলিম রাজনীতি
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের সাথে ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিজেদের সভ্যতা সম্পর্কে মুসলমানদের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়। ইতিহাতের প্রত্যাবর্তণ সম্পর্কে তাদের বিশ্লেষণ এবং সংশোধনের জন্য প্রস্তাবিত ব্যবস্থাপত্র তিনটি ধারার জন্ম দেয়, খুরশীদ আহমেদ এগুলোকে আধুনিকপন্থী, সনাতনপন্থী ও তাজদীদপন্থী রূপে অভিহিত করেছেন।–[খুরশীদ আহমদ, The Nature of Islamic Resurgence; জন.এল. এসপোসিটো সম্পাদিত ‘Voice of Resurgent Islam’ (নিউইয়র্ক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৩) পৃঃ ২১৯-২০। ‘তাজদীদ’ অর্থ পুনজ্জীবন; কোরান ও সুন্নাহর মূলচেতনায় ফিরে যাওয়া] এ তিনটি ধারাকে ভন হাদ্দাদ সংস্কৃতায়নবাদী, আদর্শবাদী ও নব্য আদর্শরূপে আখ্যায়িত করেছেন।–[সংস্কৃতিকরণ ক্যাটাগরী আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও পশ্চিমা এই তিন ভাগে বিভক্ত। Yvonne Yazbeek Haddad ও ‘Contemporary Islam and the Challenge of History (এলবানী State University of New York Press, ১৯৮২), পৃঃ ৭-১১।]
ক্যান্টওয়েল স্মীথের মতে আধুনিকপন্থীরা হচ্ছে পাশ্চাত্যপন্থী মুসলিম, তারা বিজাতীয় মূল্যবোধকে বৈধতা দানের জন্য ঐসব মূল্যবোধ দ্বারা ইসলামকে অসার জাকজমক দ্বারা আবৃত করতে চেয়েছে অথবা ঐসব মুসলিম ব্যক্তি যারা ইসলামের ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্যমূল্যবোধ আমদানী করে সংমিশ্রণ করতে চেয়েছে।–[ ডাব্লিউ সি. স্মীথ ‘Islam in Modern History’ (প্রিন্সটন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৭), পৃঃ ৬০।] এ চিন্তাধারার প্রতিনিধিরা হচ্ছেন স্যার সাইয়েদ আহমদ খান (হিজরী ১২৫৪-১৩১৫ সন/১৮৪৫-১৯০৫ খ্রি.) এবং অন্যান্যরা। তারা তকলীদকে (অন্ধভাবে পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য অনুসরণ) অগ্রাহ্য করেন, পশ্চিমা জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণের আহবান জানান, এবং ইসলামী চিন্তাধারার মূলকেন্দ্রে যুক্তিবাদকে স্থাপন করতে চান। ঐতিহ্যবাদী ইসলামী ধারণার যুক্তিবাদ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, তবে মননশীলতা হতে ভিন্ন।–[ সাইয়েদ হুসেইন নসর, ‘Ideals and Realities of Islam’ (বোস্টন, বেকন প্রেস, ১৯৭২)।] মূলতঃ কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবী মহলে আধুনিকতাবাদ ধর্মনিরপেক্ষতার উৎসকেন্দ্র হিসাবে কাজ করতে থাকে।
মুসলমানদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সবচেয়ে সরব মুখ্য প্রবক্তা হচ্ছেন শেখ আলী আবদ আল রাজিক (হিজরী ১৩০৪-১৩৮৪ হিজরী/১৮৮৮-১৯৬৬ খ্রী.); তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন এবং কিছুদিন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও অর্থনীতির উপর পড়াশুনা করেছিলেন। ই.আই.জে রজেনআলের মতে আল-রাজিক প্রণীত গ্রন্থ ‘আল ইসলাম-ওয়া উসুল আল-হুকম’ (ইসলাম ও সরকারের নীতি) রাষ্ট্রের জাগতিক কর্মকাণ্ড হতে… ধর্মকে চূড়ান্তভাবে পৃথক করার তাত্ত্বিক ভিত রচনা করে।–[ ই.আই.জে রজেনথাল. ‘Islam in the Modern National State (ক্যামব্রিজ; ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৫) পৃঃ ৮৯] আবদ আল রাজিক রাজনীতিও রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন সবকিছু বর্জন করে ইসলামকে শুধুমাত্র একটি ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করেন। তিনি যুক্তি উত্থাপন করেন যে, নবী করিম (সা) ছিলেন একন রাসূল প্রত্যাদেশ বাহক, যার শাসন করার বা রাষ্ট্র গঠনের কোন উদ্দেশ্য ছিল না।–[ আলী আবদ আল রাযীক, ‘আল ইসলাম ওয়া উসুল আল হুকম’(বৈরুত, আল হায়াত লাইব্রেরী, ১৯৬৬) পৃঃ ৮৩] ইসলাম সমগ্র মানবতার জন্য একটি বিশ্বজনীন ধর্ম এবং মোহাম্মদ (সা) ছিলেন অবিসংবাদিত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা, যাঁর ‘রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংহতিকরণ’ ছিল নিছক ঘটনাটক্র মাত্র এবং এর সাথে তাঁর নবুয়তী মিশনের কোন সম্পর্ক ছিল না।–[ আলী আবদ আল রাযীক, ‘আল ইসলাম ওয়া উসুল আল হুকম’(বৈরুত, আল হায়াত লাইব্রেরী, ১৯৬৬) পৃঃ ১১৮] কুরআন বার বার রাসূলুল্লাহ (সা) কে সতর্ক করে দিয়েছেন যাতে তিনি কারো প্রতিনিধি (উকিল), অভিভাবক (হাফিজ) বা মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব (মুসেয়তীর) না করেন, কেননা তাঁকে শুধু সতর্কবাণী উচ্চারণ, প্রজ্ঞা, সুন্দর ভাষণ ও যুক্তিযুক্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে উপেদেশ প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছৈ।–[ আলী আবদ আল রাযীক, ‘আল ইসলাম ওয়া উসুল আল হুকম’(বৈরুত, আল হায়াত লাইব্রেরী, ১৯৬৬) পৃঃ ১৪৩] সংক্ষেপে ইসলাম ও রাজনীতির মধ্যে রয়েছে যোজনব্যাপী ব্যবধান এবং উভয়কে অবশ্যই পৃথক রাখতে হবে।
উপর্যুক্ত মতামত অনুযায়ী কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা (মুসলমানদের ঐক্যমত) অনুসারে খিলাফতের কোন ধর্মীয় বৈধতা থাকেনা এবং ‘ক্রুরশক্তির’ ভিত্তিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং নির্যাতনের মাধ্যমে তা বহাল রাখা হয়। খলিফারা ‘ধর্মের নামে’ মুসলমানদের ‘রাষ্ট্র বিজ্ঞানের চর্চা’ করার অধিকার হরণ করেন….. এই ভয়ে যে তাতে তাদের ক্ষমতার ভিত ধ্বংসে পড়বে।–[ আলী আবদ আল রাযীক, ‘আল ইসলাম ওয়া উসুল আল হুকম’(বৈরুত, আল হায়াত লাইব্রেরী, ১৯৬৬) পৃঃ ১২-১৭] আবদ আল রাজিক জনগণের কল্যাণ ও ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি মনে করেন। কিন্তু তিনি মনে করেন ধর্মে কোন বিশেষ ধরনের সরকারের কথা বলা হয়নি, ইহা ‘যে কোন ধরনের’ হতে পারে- স্বৈতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক বা বলশেভিকীয়।–[ আলী আবদ আল রাযীক, ‘আল ইসলাম ওয়া উসুল আল হুকম’(বৈরুত, আল হায়াত লাইব্রেরী, ১৯৬৬) পৃঃ ৮২] সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হবে বিচার বিবেচনা মোতাকেব, যুক্তি ও রাজনৈতিক নীতিমালা অনুযায়ী।–[ আলী আবদ আল রাযীক, ‘আল ইসলাম ওয়া উসুল আল হুকম’(বৈরুত, আল হায়াত লাইব্রেরী, ১৯৬৬) পৃঃ ২০১] মুসলমানদের অবশ্যই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বাধুনিক তত্ত্বানুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
আল রাজিতের গ্রন্থ ‘আল ইসলাম ওয়া আল হুকস’ প্রবল প্রতিবাদের সৃষ্টি করে এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাণ্ড কাউন্সিল এ গ্রন্থের তীব্র নিন্দা করে। গ্রান্ড কাউন্সিল গ্রন্থকারের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ডিপ্লোমা বাতিল করে এবং তার বিচারক পদ প্রত্যাহার করে নেয়। আলী আবদ আল রাজিককে যে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু এতে কোন ভুল নেই যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবে নবুয়তী মিশন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ঘোষণা করেছিলেন, যে মিশনের লক্ষ্য শুধুমাত্র একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনই নয় বরং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনও ছিল। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চিন্তার ভিত্তি যুক্তিবাদ। আধুনিক আচরণবাদ ও বিজ্ঞানপন্থীরা ইসলামী বিশ্বাস ও মতাদর্শের মৌলিক স্তম্ভগুলিকে যে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে তা উপর্যুক্ত আলোচনা হতে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
বর্তমান ধারা
আধুনিকতাবাদ ধর্মীয় কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে আর এর উপাঙ্গ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সমাজ ও রাজনৈতিক জীবন হতে ধর্মের প্রভাবকে নির্বাসিত করতে চেয়েছে। পশ্চিমা মূল্যবোধভিত্তিক সামগ্রিক সংস্কৃতিয়ায়ন পরিকল্পনা এবং তার সাথে সম্পৃক্ত সবকিছু ইসলামের প্রতি বেরী ভাবাপন্ন। নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই নয়া উদ্ভাবন (বি’দাত) কে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা উলেমাদের দৃষ্টিতে ধর্মদ্রোহীতার সামিল। নিন্দা প্রতিরোধ এবং উলেমাদের প্রতিবাদের মুখে জনসমর্থনহীন হয়ে এক পশ্চিমা সংস্কৃতিকরণের প্রচেষ্টা মুসলিম সমাজে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়।
আবদ আল রাজিকের ইসলাম কেবল মাত্র ধর্মীয় চরিত্রের উপর গুরোত্বারোপ করে হামিদ এনায়েত দুঃখ করে বলেন যে, বিষয়টি ‘মুক্ত ও সত্যাশ্রয়ী বিতর্কের’ সুযোগ হতে বঞ্চিত হয়েছে। তাছাড়া নৈতিক মূল্যবোধের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছাড়াও অন্য উপাদানের প্রয়োজন আছে কিনা সে মতবাদের বিষয়ে যে বিশ্লেষণ ও বিচার বিবেচনার প্রয়োজন ছিল তে সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেছে।–[ এনায়েত, ‘Modern in Modern National State’, পৃঃ ৬৮] তিনি আধুনিকপন্থীদের ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ও অসহনশীল মানসিতকাকে’ দোষারূপ করেন যা ‘সনাতনপন্থীদের এই অভিযোগকে সত্যতা প্রদান করে আধুনিকপন্থীরা যে শুধুমাত্র ধমীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চায়না, বরং তারা ইসলামের সার্বিক নৈতিক, সামাজিক নীতিমালার বিনাশ সাধন চায়।–[ এনায়েত, ‘Modern in Modern National State’, পৃঃ ৬৮]
আদর্শবাদী ‘উলেমাবৃন্দ’ বিদেশী সংস্কৃতিকরণ উদ্যোগকে তাদের চিন্তাধারা ও প্রতিষ্ঠারেন বিরুদ্ধে বৈরীতামূলহ হিসাবেই দেখেননি উপরন্তু তারা সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে দুঃখজনকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতেও ব্যর্থ হন। প্রখ্যাত মুসলিম প্রাচ্যবাদী পণ্ডিতদের তুলনায় শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ও অন্যান্যদের চিন্তাধারার দৈন্যদশা ছিল জাজ্বল্যমান। ইসলামের সামাজিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিষয়ে তাদের জ্ঞান ও ধারণা ছিল ভাসাভাসা। আবদ আল রাজিকের সমীক্ষার প্রশংসা করলেও খান তাঁর চিন্তাধারার অসামঞ্জস্য ও বৈসাদৃশ্য অবলোকন করেন এবং লক্ষ্য করেন যে, ‘বিশেষ করে আল ফারাবি, ইবনে সীনা, ইবনে রুশদ এবং সাধারণভাবে অন্যান্য ‘ফালাসিকাহ’ বা মুসলিম দার্শনিকদের রাজনৈতিক অভিসন্দর্ভ সমূহ সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন।–[ রজেনথাল, ‘Islam in Modern National State’, পৃঃ ১০০।]
বিদেশী সাংস্কৃতিক বোধ দ্বারা যারা ইসলামী মূল্যবোধকে অভিষিক্ত করতে চেয়েছে সেসব আধুনিকপন্থীদের সম্পর্কে ম্যালকম ক্যার’ এর মন্তব্য দ্ব্যর্থহীনঃ ‘নতুন তাত্ত্বিকভিত নির্মাণের জন্য তাদের যথোপযুক্ত ও যথেষ্ট আদর্শিক জ্ঞান ছিল না, ছিল শুধুমাত্র পশ্চিমা মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিসম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান’।–[ Malcolm Kerr, Islamic Reform অক্সফোর্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৬), পৃঃ ২০৮] পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় তারা কোন সঠিক ইসলামী কাঠামোগত তত্ত্ব দাঁড় করাতে পারেননি, এমনকি নিজেদের সংস্কৃতির মধ্যে যে সব জটিলতা বিদ্যমান তাও তারা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।
পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মোকাবেলায় যে উন্নত ও সমৃদ্ধ চিন্তাধারা উপস্থাপন করা প্রয়োজন ছিল তা ইসলামে আছে এবং এ কারণে পাশ্চাত্য ভাবধারা ও মূল্যবোধ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজন হচ্ছে এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা, যে দায়িত্ব নব্য আদর্শবাদীরা স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন এবং যারা নতুন উদ্দীপনার সাথে আধুনিক মানুষের জন্য ইসলামকে ব্যাখ্যা করেন। যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাহিত্য তারা উপস্থাপন করেছেন তাতে পাশ্চাত্যের সমন্বয় ও বিশ্লেষণী পদ্ধতি গ্রহণ করা হলেও মূল বিষয়টি হচ্ছে ইসলামের মৌলিক আদর্শিক বাণী, সেই একই মহান বাণী যা শুরুতে প্রদান করা হয়েছিল এবং যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আধুনিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বিশ্বাসের বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন বিন্যাস, নয়া কোন ইসলাম নয়।–[হাদ্দাদ, ‘Contemporary Islam and the Challenge of History’ পৃঃ ১১। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের নব্য আদর্শবাদী বলে অভিহিত করেছেন। এতে যুক্ত করেছেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ও জমাতে ইসলামের সদস্যদের। ইসমাইল আর আল ফারুকী, সাইয়েদ হুসাইন নসর, খুরশীদ আহমদ, নওয়াব হায়দার নকবীও এই শ্রেণীভুক্ত।]
ফজলুর রহমান তাঁদেরকে নব্য মৌলবাদী অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। আধুনিক জগতের সাথে ঐশী প্রত্যাদেশ ও শরীয়াহকে সামঞ্জস্যশীলভাবে সম্পৃক্ত ও সমন্বয় না করতে পারার অভিযোগ তিনি নব্য মৌলবাদীদের সমালোচনা করেন। তবে তিনি নব্য মৌলবাদীদের চিত্ত ও চিন্তনের তীক্ষ্মতা অনুভব করতে পেরেছিলেন : ‘এটা প্রাণসঞ্জীবনীর ন্যায় জীবন্ত, ক্রোধ ও উৎসাহে স্পন্দিত এটি প্রাণবন্তভাবে সমৃদ্ধ এবং সত্যাশ্রয়ী ক্রোধে পরিপূর্ণ। এর নৈতিক গতিশীলতা প্রমাণিত এবং এস সংহতি ও ঐকতা উল্লেখযোগ্য’।–[ফজলুর রহমান, ‘Roots of Islamic Neo-Fundamentalism’, ফিলিপ এইচ. স্টোডার্ড, ডেভিস সি কাহেল এবং মার্গারেট সুলিভান সম্পাদিত ‘Change and the Muslim World’ (সাইরাকিউজ; সাইরাকিউজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮১) পৃঃ ৩৫] মুসলিম বিশ্বে চলমান ইসলামী আন্দোলনে তারা প্রথম কাতারে আছেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (হিজরী ১৩২২-১৩৯৯ সন/১৯০৩-১৯৭৯ খ্রি.), সাইয়েদ কুতুব (হিজরী ১৩২৪-১৩৪৬ সন/১৯০৬-১৯৬৬ খ্রিঃ) এবং আরো অনেক সমকালীন পণ্ডিত ইসলামের বিশ্বজনীনতা উপস্থাপন করেছেন।
সাইয়েদ মওদুদীর মতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ আবর্তে আবদ্ধ করে মানুষকে পার্শ্ব প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে উদ্ধুদ্ধ করে এবং একে অন্যের উপর জুলুম ও পাপাচার চালায়। সাইয়েদ কুতুবের মতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অজ্ঞ (জাহিলী) সংস্কৃতির নিদর্শণ, যাকে গতিশীল ও সমন্বিত ইসলামী ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে। তাঁদের মুখ্য বিষয় হচ্ছে তাওহীদ আল্লাহ পাকের একত্ব ও তাঁর একক সার্বভৌমত্ব, রিসালাত –নবী করীম (সা) এর প্রত্যাদেশের বাণী বহন, খিলাফত –আল্লাহ পাকের প্রতিনিধিত্ব। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়ে তারা আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত জীবনের ঐক্যতার মূলসুর ও ধারা হতে তাদের তাত্ত্বিক দর্শন ব্যবস্থাপনার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত’। একটিকে অস্বীকার অন্যটিকে অস্বীকার করার সামিল।–[ মুহাম্মদ ইকবাল, ‘Presidential Address’. এস.এ. ওয়াহিদ সম্পাদিত ‘Thoughts and Reflections of Iqbal’ (লাহোর আশরাফ, ১৯৬৪), পৃঃ ১৬৭] ‘এ সমগ্র পৃথিবী একটি মসজিদ স্বরূপ’। এ হাদীসের ভিত্তিতে ইকবাল ইসলাম সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘যা কিছু ইসলামে গুরুত্ব অন্তর্চেতনার বিনির্মাণে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়’।–[ মুহাম্মদ ইকবাল, ‘Presidential Address’. এস.এ. ওয়াহিদ সম্পাদিত ‘Thoughts and Reflections of Iqbal’ (লাহোর আশরাফ, ১৯৬৪), পৃঃ ১৫৪]
স্রষ্টার ক্ষেত্র ও সিজারের ক্ষেত্র আলাদা আলাদা মর্মে পাশ্চাত্যে যে তাত্ত্বিক ধারণা রয়েছে ইসলামে তার কোন স্থান নেই। ইসলামে সীজারের কোন অস্তিত্ব নেই, আছে শুধুমাত্র আল্লাহর সর্বপ্লাবী অস্তিত্ব, যিনি মহাবিশ্বের প্রভু, স্রষ্টা ও পালনকর্তা। ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করে ঐক্যের উপর- আল্লাহর অবিভাজ্য ঐক্য, বিশ্বাসীদের সম্প্রদায়গত ঐক্য, সামগ্রিক চেতনায় মানবজীবনের ঐক্য এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক জীবনের মিলন-জাত স্থাপিত। এটাই হচ্ছে মুখ্য ও বেগবান আদর্শিক ধারা প্রবাহ। এটাই ইজমা মুসলিম উম্মার ঐকমত্য।
উপসংহার
প্রচলিত ধারণার ইসলামকে যেরূপ মনে করা হয়, ইসলাম আসলে সে ধরনের কোন ধর্ম নয় –ভ্রান্তিমূলকভাবে ইসলাম ধর্মকে মনে করা হয় নিছক আচার অনুষ্ঠান, ভাবাবেগ ও কিছু বিশ্বাসের সমষ্টি। বরং ইসলাম হচ্ছে একটি জীবন্ত জীবন বিধান, জীবনের সকল অস্তিত্ব ও সমস্ত কর্মপরসর ঘিরে এ আবর্তন। সমগ্র মানবতার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক নির্দেশনার জন্য ইসলাম একটি সুসমন্বিত ব্যবস্থা, সামঞ্জস্যশীল একক সমগ্রতা, বিশ্বজনীন নীতিমালার একটি পূর্ণাঙ্গ ধারাপাত ও একটি সামগ্রিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর ভাষায় কুরআন শিক্ষা প্রদান করে যে, ‘ইসলাম শুধু প্রচারের জন্য নয়, বরং অনুশীলন করে তা বাস্তবায়নের জন্য, সঠিকভাবে একে উপস্থাপন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য’। রাজনীতির সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, এটা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ইসলাম ও রাজনীতি এ দু’য়ে মিলে হয় এক অবিভাজ্য সত্তা।
বস্তুত এটাই কারণ যে, ‘ঐতিহ্যগতভাবে মুসলমানরা কখনো বিচ্ছিন্নভাবে রাজনীতিকে অন্যান্য জ্ঞানের শাখার সাথে অসম্পর্কিতভাবে অধ্যয়ন করে না। রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সরকারের প্রকারভেদ, শাসকের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও শাসিতের অধিকার প্রভৃতি সমস্যাকে আদর্শবাদ ও আইনশাস্ত্রের সামগ্রিক নিরিখে আলোচনা করা হয়- সকলই অনাক্রমণসাধ্য ও সুরক্ষিত শরীয়াহ দেয়ালের মধ্যে সম্পাদিত হয়’।–[ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political’ Thought, পৃঃ ৩]
আধ্যাত্মজীবনের সাথে বস্তুজীবনের এ যে ওৎপ্রোতভাবে সম্পৃক্তিকরণ তা মহানবী (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদার জীবনে মূর্তভাবে প্রদর্শিত হয়েছে।
সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিখুঁত ইসলামী রাজনীতির নীতিমালা মদীনা মডেলে উজ্জ্বলভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। ঐতিহাসিক ক্রম বিবর্তন ও পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ইবনে খালদুন মন্তব্য করেছেনযে, কুরআন ও মহানবী (সা) উপস্থাপিত যে সত্যাশ্রয়ী ইসলামী শাসন পদ্ধতি ছিল, তা হতে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা বহুদূরে সরে গিয়েছে। উমাইয়া আমলে মুসলিম ইতিহাসের সকল শাসক তাদের শাসনব্যবস্থায় শুধুমাত্র ইসলামের কতিপয় নীতিমালা বিধিবদ্ধ করেছিল। তবুও এসব বংশানুক্রমিক শাসক প্রকাশ্যে শরীয়তের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে এবং ইসলামের নামে তাদের শাসন ক্ষমতাকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা নিতে হয়েছে। এই অস্থির সময়ের মুসলিম চিন্তানায়কগণ বিশ্বাসীদের মন ও হৃদয়ে ইসলামের সত্যাশ্রয়ী মর্মবাণী জাগরুক রাখা এবং শরীয়ার অনুশাসন সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ প্রয়োগের গুরুদায়িত্ব স্কন্ধে বহন করেছিলেন। কার্যকরী সমাজের রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রম ও আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড এ দু’য়ের পরস্পর নির্ভরশীল সমৃদ্ধ সম্মিলনে তাদের জীবন অতিবাহিত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকে ইসলাম এক গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হয়। মুসলিম বিশ্ব সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টবাদের নিকট পরাজিত হয় এবং বিজয়ী পাশ্চাত্য শক্তি মুসলিম ইতিহাসের মর্মমূলে আঘান হানা শুরু করে। পরিত্রাণের উপায় হিসাবে আদর্শবাদপন্থী নামে পরিচিত দল ইসলামী ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে থাকা ও পাশ্চাত্যকরণ ও প্রক্রিয়া হতে দূরে সরে থাকার পক্ষে অবস্থাণ গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিকপন্থীরা ইসলামকে সুরক্ষার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইসলামী বিষয়ে গভীর জ্ঞান না থাকার কারণে বিকলাঙ্গ ও বিকৃত এক ইসলামী তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। উপরে বর্ণিত দু’ধারার মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে নব্য আদর্শবাদ পন্থীদের হাতে ইসলামের এক জীবন্দ স্পন্দিত ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়। নব্য আদর্শবাদপন্থীরা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মোকাবেলায় বিকল্প পন্থা হিসাবে ঐশ্বরিক ইসলামের পূর্ণাঙ্গ সমগ্রতাকে বিলষ্ঠভাবে উত্থাপন করেন।
ইসলামের মূল বাণীর দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান, বর্তমান পরিস্থিতির সাথে ইসলামী প্রাসঙ্গিকতার শিকড় আবিষ্কার, বর্তমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করে তাকে ইসলামী বৈশিষ্ট্য নীতিমালার আদলে ঢালাই করার প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়, বরং ইসলামের সমগ্র ইতিহাস জুড়ে এ মৌলিক আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ইসলামী আন্দোলন সমূহের নতুন বৈশিষ্ট্য হলো এর ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং মুসলিম বিশ্বের সকল অঞ্চলে কর্মমুখর, সজীব ও সামঞ্জস্যশীলভাবে ইসলামকে বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন। মুসলিম বিশ্বের সকল অঞ্চলে এই প্রাণবন্ত ইসলামী আন্দোলন পরস্পর গ্রথিত শিকলের মত সচলভাবে চালু রয়েছে। পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী, মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য সমকালীন ইসলামী আন্দোলন সমূহের আহবান হচ্ছে রাজনীতি, ধর্মসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সামগ্রিক সংস্কার আনয়ন। ধর্মের বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতার চাপে কিছুদিন সুস্থ ছিল, তা মুসলিম সমাজ ও রাজনীতিতে পুর্ণশক্তিতে পুনর্জীবিত হয়ে উঠল।
এ আন্দোলন এতই উদ্দীপ্ত ও শক্তিমান ছিল যে, সকল নেতা সারাজীবন ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতার প্রবক্তা ছিল তাদের অন্যতম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোকেও পশ্চাদপসরণ করতে হয়েছিল এবং বাধ্য হয়ে ইসলামী সমাজকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জনপ্রিয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবির প্রতি মৌখিক সমর্থন জানাতে হয়েছিল।
জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার শক্তি এতই প্রবল ছিল যে, ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভী, পাকিস্তানের জেড এ ভূট্টোর ক্ষমতার ভিত নড়ে যায় এবং তারা ক্ষমতাচ্যুত ও অপসারত হয়। পরবর্তীতে আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও জেনারেল জিয়াউল হকের ক্ষমতার যে বৈধনা আসে তা ইসলাম হতে উৎসারিত। জিয়ার অধীন পাকিস্তান ইরানের পরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ইসলামী ভাবাপন্ন রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ব্রুনাই নিজকে সুলতানাত অব ব্রুনাই দারুস সালাম নামে ঘোষণা করে এবং এভাবে দেশটি নিজকে সরকারীভাবে ইসলাম উম্মাহ হিসাবে উপস্থাপন করে। একমন কি তুরস্ক, যে দেশটি ১৯২৪ সালে মুসলিম বিশ্বের সাথে সকল আধ্যাত্মিক বন্ধন ছিন্ন করে, সেখানেও মুসলিম পুনর্জাগরণের সূচনা হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামকে সাংবিধানিকভাবে কতটুকু গ্রহণ করা হয়েছে এবং কুরআন সুন্নায় বিধৃত মূল্যবোধ ও নীতিমালার কতটুকু মুসলিম সমাজসমূহে গৃহীথ হয়েছে তার তারতম্য রয়েছে। তবে শরীয়াহ অনুযায়ী শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করলেই রাতারাতি কিছু ঘটে যাবে না- এর জন্য প্রয়োজন সমগ্র সমাজের সংস্কার ও পুনর্গঠন। বিষয়টি রাজনীতিকে ধর্মের আওতায় আনার দাবি করে, যাতে মানুষের রাজনৈতিক জীবন তাদের বৃহত্তর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের কাঠামোর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়। এভাবেই ইমাম গাজ্জালীর ভাষায় রাজনীতি তরান্বিত করতে পারে ‘মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি’।–[ রজেনথাল, Political Thought in Medieval Islam, পৃঃ ৩৯]
রাজনীতি পরিভাষাটি যা কিছু অর্থ বহন করে সে বিষয়ে সব কিছু সম্যকভাবে জানতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আমাদের সেই ধ্যানধারণা, জ্ঞান প্রদান করে থাকে। সে জ্ঞানটি হচ্ছে সুশৃঙ্খল ও পদ্ধতিগতভাবে ধ্যান ধারণা, আচরণ, নীতিমালা এবং সকল পর্যায় ও প্রেক্ষিতে সকল আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ণভাবে জ্ঞাত হওয়া। বিশ্ব মানবিক ও ইসলামী ব্যবস্থা নির্মাণ দাবী করে যে, শরীয়ার কাঠামোর মধ্যে থেকে রাজনীতিতে একনিষ্ঠভাবে অধ্যয়ন ও অনুশীলন করতে হবে, যার চরম লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর রেজামন্দি ও সন্তুষ্টি অর্জন।