নাহদাহঃ ইসলামী পুনর্জাগরণ
ইসলামী আন্দোলন
ইসলাম একই সাথে একটি ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহর চিরন্তন নীতিমালা অনুযয়ী সরকার গঠন ও পরিচালনা করে। যেহেতু ইসলাম মানেই প্রায়োগিক আচরণ ও ব্যবহার, তাই ইসলাম জাগতিক কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী মানুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দাবি করে, বস্তুগত সকল বিষয়ে বিশ্বাসী মানুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দাবি করে, বস্তুগত সকল বিষয়ে বিশ্বাসী মানুষের ধার্মিক ও সৎচরিত্রের উৎঘাটন চায়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায়নিষ্ঠ নৈতিক আচরণের সর্বোচ্চ অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হতে বলে। ফলশ্রুতিতে সমগ্র ইসলামী ইতিহাসে মুসলিম সমাজ দেহ হতে বিজাতীয় চিহ্নাবলী অপসারণ, একটি কার্যকর সভ্যতা নির্মাণ ও শরীয়ার ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চলছে।
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান যেসব ইসলামী আন্দোলন চলছে তার গভীর শিকড় রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময়কালের মধ্যে নিহিত। ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকগণ এসব আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক অর্থে মৌলবাদ বলে অভিহিত করেছে এবং আদি আন্দোলনের পুনর্জাগরণের ব্যাখ্যা না পেয়ে তারা হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ‘মুসলমানদের নিজেদের ধারণা ও ভূমিকার আলোকে এসব ইসলামী আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করা হবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।–[ খুরশীদ আহমদ ‘The Nature of Islamic Resurgence’; জন এল. এল. এসপোসিটো সম্পাদিত ‘Voice of Rasurgent Islam’ (নিউইয়র্ক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৩), পৃ: ২২২] এসব ইসলামী আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্বদৃষ্টি ও দৃষ্টিকোণকে অস্বীকার করার ফলে এসব আন্দোলনের ভুল নামকরণ হয়েছে এবং একই সাথে এসব আন্দোলনের ভিন্ন ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় চরিত্র বুঝতেও অক্ষমতার সৃষ্টি হয়েছে। এ অধ্যায়ে মৌলবাদ অভিধাটি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং বর্তমান ইসলামী আন্দোলন সমূহকে মৌলবাদ অভিধাটি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং বর্তমান ইসলামী আন্দোলন সমূহকে মৌলবাদ আখ্যা দেয়ার উপযোগীতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এসব আন্দোলনের অভ্যুদয়ের বিকল্প ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান করা হয়েছে এবং পরিশেষে বিভিন্ন আন্দোলনসমূহ হলো মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াসের (হিজরী ১৩০৩-১৩৬৩সন/১৮৮৫-১৯৪৭ খ্রি.) তবলীগ জামাত আন্দোলন, পাকিস্তানে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর নেতৃত্বের জামাত-ই-ইসলামী আন্দোলন এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর (হিজরী ১৩২১-১৪০৯ সন/ ১৯০২-১৯৮৯ খ্রি.) নেতৃত্বে ইরানের বিপ্লব।
মাওলানা বনাম নাহদাহ বা পুনর্জাগরণী আন্দোলন
মৌলবাদ পরিভাষাটি ঐসব আন্দোলন সম্পর্কে প্রয়োগ করা হয়েছে যারা এমন ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে শরীয়াহকে জনসাধারণের সামনে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং আইনসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা।–[ এল বাইন্ডার কর্তৃক ‘Fundamentalism’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ‘The Ideological Revolution in the Middle East’ (নিউইয়র্ক, উইলী, ১৯৬৪)] শব্দটির উৎপত্তিস্থল আমেরিকা এবং মার্কিণ প্রটেস্ট্যান্টবাদ সম্পর্কে অভিধাটি ব্যবহৃত হয়েছিল, যে প্রটেস্ট্যান্টবাদের লক্ষ্য ছিল ‘আধুনিক ও উদারনৈতিক’ মতবাদ সমূহকে প্রতিরোধ করা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শব্দটির উৎপত্তি হয় এবং এই প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ ঐশীবাণীর অভ্রান্ততা, কুমারী মাতার গর্ভে যীশুর জন্ম, পরিবর্তক প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা, যীশুখ্রিষ্টের শারীরিক পুরুত্থান, এবং অলৌকিক ঘটনার সত্যতা।–[ George Marshden, ‘Fundamentalism and American Culture’ (অক্সফোর্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২) পৃ: ১১৭] ১৯২০ দশকের আমেরিকান মৌলবাদীরা এক ধরনের অপশক্তির মত কাজ করে, যখন তারা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও ডারউইনের বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারণা শুরু করে। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা এবং সাংস্কৃতিক উপ-সম্প্রদায়ে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে ‘মরাল মেজরিটি’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।–[ উইলিয়াম শেফার্ড, ‘Fundamentalism: Christian and Islamic’, Relogion, ভলিউম ১৭ (১৯৮৭) পৃ: ৩৫৬]
উৎসের দিক থেকে প্রটেস্ট্যাস্ট খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া সত্ত্বেও মৌলবাদ শব্দটি মৌলিক ইসলামী আন্দোলন যা অন্যকোণ অমুসলিমদের অনুরূপ আন্দোলন সম্পর্কে ব্যবহৃত হতে থাকে।–[দ্রষ্টব্য হামিদ এনায়েত, Model Islamic Political Thought (লন্ডন, ম্যাকমিলান প্রেস, ১৯৮২); ফজলুর রহমান, ‘Roots of Islamic NeopFundamentalism’, ফিলিপ এইচ স্টোয়ার্ড ও ডেভিড সি. ক্যাথেল সম্পাদিত ‘Change and the Islamic World’; ব্রুস বি লরেন্স, ‘Defenders of God: The Fundamentalist Revolt Against Model Age. (সান ফ্রান্সিসকো, ১৯৮৯)।] ব্রুস লরেন্স প্রদত্ত নতুন সংজ্ঞা অনুসারে ‘মৌলবাদ হচ্ছে এমন এক ধরনের আদর্শবাদী সংগঠন বা আন্দোলন যা আধুনিকতার পরিপন্থী এবং তার সমস্ত শক্তি আধুনিকতার সকল লক্ষ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধুনিকতা পরিপন্থি ও বিরুদ্ধবাদী। সে হিসাবে সমস্ত আধুনিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী।–[ ব্রুস বি লরেন্স, ‘Muslim Fundamentalist Movenemt Reflections Towards a new Approace’; বারবারা ফ্রেয়ার সম্পাদিত, ‘The Ismic Impulse (লন্ডন, ক্রুস হেম, ১৯৮৭), পৃ: ৩১, ৩২]
জন ও ভল ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন যে, এটা ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ শাব্দিক ও আবিধানিক অর্থে এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে এবং কঠোরভাবে ইসলাম ধর্মের সামাজিক-নৈতিক পুনর্গঠনের জন্য কাজ করে।–[ John O. Voll, ‘Fundamentalism in the Sunni Arab World: Egypt and the Sudan’; Mratine E. Marty এবং R. Scott Appleby সম্পাদিত (শিকাগো, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ১৯৯১), পৃ: ৩৪৭]
এ দৃষ্টিভঙ্গি হতে সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানই ‘মৌলবাদী’ কেননা সকল ধর্মপরায়ণ মুসলমানই আল্লাহর সার্বভৌম একত্বে বিশ্বাস করে, কুরআনকে ঐশীবাণী রূপে বিশ্বাস করে, কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে কতিপয় দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্য করণীয় হিসাবে পালন করে। মুসলমানগণ ইসলাম ধর্মকে একটি সার্বিক সামাজিক ব্যবস্থঅ হিসাবে মনে করে, যা ইহজীবন ও পরজীবনের সকল জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারে। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে, তারা ইজতিহাদের মাধ্যমে নতুন যুগ সমস্যার সমাধান মেনে নেয়া বা প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের বিরোধী। তাই মুসলমান বা মুসলমানদের কোন দল নিজেদের মৌলবাদী মনে করে না। এই পরিভাষাটি আরবীতে কোন প্রতিশব্দ নেই কিংবা কোন মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাষাতেও শব্দটি নেই। যারা ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত তারা নিজেদেরকে শুধু মুসলমান মনে করে, তারা ইসলাম নিয়ে কথা বলে এবং পাশ্চাত্য মূল্যবোধ আমদানীকে ঘৃণা করে। লক্ষ্য করা উচিত, যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অহরহ মৌলবাদী হিসাবে অভিহিত করা হয় তারা সহিংস পদ্ধতি বা রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না বরং শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে তা করতে চায়। পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল, গোঁড়ামী ও মধ্যযুগীয় মানসিকতাকে অহরহই মৌলবাদ হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়- এ অপ-মানসিকতার মধ্যদিয়ে প্রচারণাকারীদের আসল চরিত্রই ধরা পড়ে।
অনেক বিজ্ঞ পণ্ডিতের বিবেচনায়, মৌলবাদ শব্দটি যা খ্রিষ্টান জগতে ঘটনাচক্রে জন্মলাভ করেছে, তা ইসলামের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। ইসমাইল আল ফারুকী মৌলবাদের পরিবর্তে ‘নাহদাহ’ বা পুনর্জীবন শব্দটি যা খ্রিষ্টান জগতে ঘটনাচক্রে জন্মলাভ করেছে, তা ইসলামের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। ইসমাইল আল ফারুকী মৌলবাদের পরিবর্তে ‘নাহদাহ’ বা পুনর্জীবন শব্দটি ব্যবহার করেছেন যা বাস্তব অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।–[ ইসমাইল আল ফারুকী, ‘Islamic Renaissance in Contemporary Society’ আল ইত্তেহাদ, ১৫(৪), অক্টোবর, ১৯৭৮), পৃ: ১৫] আরভী বিশেষ অর্থ একটি শিশুর মাঝে সে সম্ভাবনা সুপ্ত থাকে তাকে জাগ্রত করা। এটা সমাজের জন্যও প্রযোজ্য।–[ ইসমাইল আল ফারুকী, ‘Islamic Renaissance in Contemporary Society’ আল ইত্তেহাদ, ১৫(৪), অক্টোবর, ১৯৭৮), পৃ: ১৫ পৃ: ১৬] তাই এ কথা সঙ্গত যে মুসলিম বিশ্ব ‘নাহদাহ’ এর মধ্যদিয়ে বিবর্তিত হচ্ছে (অর্থাৎ মুসলিম সম্ভাবনার অংকুর সজীব বৃক্ষের রূপ নিচ্ছে)। আসলে ইসলাম সবসবয়ের জন্যই অপরিবর্তিত থাকছে। এর ক্ষমতা ও সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মুসলিম জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ফলে তারা তাদের যুগসমস্যার প্রেক্ষিতে ইসলামকে প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হয়েছে।
নাহদাহ বা ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং ইসলামী বিশ্বদৃষ্টি
গঠন, প্রকৃতি, লক্ষ্য, বিষয়বস্তু নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলন পশ্চিমাদের অনেক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। পশ্চিমা দেশসমূহের জন্য তৈল উৎপাদনকারী আরবদেশ সমূহের গুরুত্ব, ১৯৭৯ সালে ইরানে সফল বিপ্লব, সোভিয়েত দখলদারীত্বের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে প্রতিরোধ আন্দোলনের পররাষ্ট্র বিষয়ক গুরুত্ব এবং অনুরূপ অনেক ঘটনা পশ্চিমে উদ্বেগ ও সতর্ক মনোভাব তৈরীর ক্ষেত্র তৈরীর ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। আধুনিক তাত্ত্বিকদের অনেকেই মুসলিম নাহদাহ আন্দোলন সম্পর্কে প্রকৃত উপলব্ধি পেতে ব্যর্থ হয় এবং তাই সমাজের দ্বৈত বা সংকর চরিত্র লক্ষণের উপর বেশ জোর প্রদান করে।–[আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতের জন্য দেখুরন, ডেনিয়েল লার্নার ‘The Passing of Traditional Society: Modernising the Middle East (গ্লেনকো, ফ্রি প্রেস, ১৯৫৮); Manfred Halpern, ‘The Politics of Social Change in the Middle East nad North Africa’ (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৩); Karl Deutsch, ‘Social Mobilization and Political Development’, American Political Science Review, এল.ভি (৩) সেপ্টেম্বর, ১৯৬১। পরবর্তী ধারণার জন্য দ্রষ্টব্য ফুয়াদ আজামী, ‘The Arab Predicament: Arab Political Thought and Practice Since 1967 (নিউইয়র্ক, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮১; মাইকেল কার্টিস সম্পাদিত ‘Religion and Politics in the Middle East’ (বোল্ডার, ওয়েস্টভিউ প্রেস, ১৯৮১)।] শেষের মতবাদটি দু’টি আকর্ষণ বিন্দু তত্ত্বের উপস্থাপন করে; একটি হচ্ছে পশ্চিমের প্রভাব, যা মুসলমানদের জন্য বৈরী ও চ্যালেঞ্জমুখী। যার সাথে মুসলমানদের মুখোমুখি হতে হবে, সমঝোতা আসতে হবে এবং এ অবস্থাকে অতিক্রম করে যেতে হবে। অন্যকথায় পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক বা মার্ক্সবাদী মহল মুসলমানদের ব্যাপার যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ঐসব ভাবনাচিন্তা বিভিন্ন সমীক্ষার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানগণ শুধু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে কিন্তু কোন ইতিবাচক বা পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে পারেনি।
বিশ্বের সামনে আন্দোলন ও মূলনীতির উপস্থাপন ও মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার অনুপ্রবেশের বিষয়ে সাধারণ আলোচনা হলেও ইসলামের সাথে ইসলামী আন্দোলনগুলির সম্পর্কের প্রাসঙ্গিকতা তেমন আলোচিত হয়নি। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলন সমূহ প্যালেস্টাইনের পক্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে জোরালো সমর্থন যোগালেও এই সমর্থন সামগ্রিকভাবে একই প্ল্যাটফর্ম হতে ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে পারেনি। প্যালেস্টাইনের ধর্মীয় গুরুত্ব এবং ইসলামী সহমর্মিতার কারণে প্যালেস্টাইনের ধর্মীয় গুরুত্ব এবং ইসলামী সহমর্মিতার কারণে প্যালেস্টাইনের সপক্ষে মুসলিম দলগুলি সমর্থন ও সহযোগীতা দিয়েছিল এ কথাও সমানভাবে সত্য। একইভাবে ইরানী বিপ্লবকে পাশ্চাত্য সভ্যতা (পাশ্চাত্যের সামরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি) ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা… যেতে পারে। ইমাম খোমেনীর ভাষায় বলা যায়, ‘যদি ইরানের শাহের বিরুদ্ধে ইরানী জনগণ বিদ্রোহ করে থাকে, তবে তা তারা ইসলামী কর্তব্য হিসাবে করেছে।–[ খোমেনী, ‘Islam and Revolution: Writtings and Declarations of Imam Khomeini’ সম্পাদনা: হামিদ আলগার (বার্কলী, মিজান প্রেস, ১৯৮১), পৃ: ৩২৭]
চলমান নাহদাহ আন্দোলন তথা পুনর্জাগরণী আন্দোলন সমূহের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে মনে রাখতে হবে যে, মুসলমানরা এমন একটি বিশ্বে বাস করে যেখানে ধর্ম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে কাজ করে। ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার নাম। খ্রিষ্টধর্মের মত ইসলাম সীজারের অংশ সিজারকে, আল্লাহর অংশ আল্লাহকে দাও এমন দর্শনে বিশ্বাস করে না। ইসলাম এমন একটি সার্বিক জীবন বিধান যা ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছুকে সম্পৃক্ত করে নেয়। ইসলামে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পদ্রান করে তাওহীদে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌম একত্ব, বিশ্বাসীদের. ঐক্য এবং জীবনের সামগ্রিকতার ঐক্য এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক জীবনের ঐক্যকে। মুসলিশ বিশ্বাস অনুযায়ী মানব জীবনের প্রত্যেক বিষয়ে যথাযথ ঐশী নির্দেশনা দেয়া আছে।
এটা সত্য যে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে পাশ্চাত্য শিক্ষিত নাগরিক ও ধনিক শ্রেণী শিথিলতা প্রদর্শন করেছে। পক্ষান্তরে গরীব, অশিক্ষিত ও গ্রামীণ লোকেরা সরলভাবে আল্লাহর রহমত, বরকত ও সার্বভৌম ঐশ্বরিক ক্ষমতার গভীর বিশ্বাস স্থাপন করে জীবন যাপন করে। এ পার্থক্য সত্ত্বেও ধর্মে বিশ্বাস ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে একই প্ল্যাটফর্মে আনয়ন করে একই সামাজিক আদর্শে আবদ্ধ করে। এ সচেতনতা হয়ত অপরিণত ও অস্পষ্ট হতে পারে, কিন্তু এ সচেতনতার যথার্থতা ও বাস্তবতার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কুরআনের বাণী, রাসূলুল্লাহ (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদার সময় সাহাবীদের অভিজ্ঞতা ও জীবনাচরণ থেকে জানা যায় যে জীবন যাপন করত তাকে তারা সত্য হিসাবে জানত এবং তাতে গর্ববোধ করত।
প্রথম যুগের মানুষেরা যে সভ্যতা লাভ করেছিল তাতে তারা দুনিয়াবী সকল সাফল্যের সাথে পরকালীন মুক্তিরও নিশ্চয়তা লাভ করেছিল। ক্ষমতা ও মর্যাদা ছাড়াও তারা বস্তুগত সমৃদ্ধি উচ্চতম সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা লাভ করেছিল। এসব কিছুর উপলব্ধি সমকালীন মুসলমানদের তাদের জীবনের বড় মিশনের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। অতীতের গৌরব গাঁথা মুসলমানদের ভাগ্য সম্পর্কে আশাবাদে অভিসিক্ত করে, যার ফলে তারা আল্লাহর রাহে জিহাদে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে। সাইয়েদ মওদুদী মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তারা যদি মহানবী (সা) প্রদর্শিত পথে ইসলাম প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে ‘একই ফলাফল পুনঃপ্রাপ্তি ঘটবে’।–[ আবদুল রশীদ মোতেন, ‘Pure and Practical Ideology The Thought of Mawlana Mawdudi’, ইসলামিক কোয়ার্টালী, ১৮ (১৯৮৪) পৃ: ২১৮] এই আশাবাদ মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগরণ ও প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। জেহাদের ধারণা ও তার ফলে সৃষ্ট আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদ মুসলমানদের মধ্যে চালিকা শক্তি হিসাবে নাহদাহ ইসলামী পুনর্জাগরণের চলমান প্রক্রিয়ায় শামিল রেখেছে। ইসলামের মধ্যেই গতিশীল নাহদাহ এর বীজ সুপ্ত আছে, যা এ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে, ‘প্রত্যেক শতাব্দীর প্রথম ভাগে একজন মুজাহিদ আবির্ভূত হবেন, যিনি ইসলামের পুনজীবনের জন্য লোকদের আহবান করবেন’।–[ আবদুল রশীদ মোতেন, ‘Pure and Practical Ideology The Thought of Mawlana Mawdudi’, ইসলামিক কোয়ার্টালী, ১৮ (১৯৮৪) পৃ: ২১৮]
এ দৃষ্টিকোণ থেকে সারা মুসলিম বিশ্বে নাহদাহ আন্দোলন আধুনিক কোন ঘটনাও নয়, নতুন কোন আন্দোলনও নয়। এ আন্দোলন শুধু পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়া নয় বরং এ হচ্ছে ক্রটিপূর্ণ পৃথিবীর নবুয়তী কার্যের অনুসরণে মুসলিম সমাজকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা।
সালাফিয়াহ আন্দোলন
মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল ওয়াহহাব (হিজরী ১১১৫-১২০৭ সন/১৭০৩-১৭৯২খ্রি.) এর সালাফিয়া আন্দোলন এই ধারায় একটি উজ্জল উদাহরণ। ইসলামের আদি বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী আবদ আল ওয়াহহাব শাসকবর্গ ও জনসাধারণের ভোগবিলাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি কুরআন সুন্নাহর ও ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর সুন্নী ফিকাহের দিকে জনগণকে ফিরে আসার আহবান জানান। আর সবকিছুকে তিনিও তার সহকর্মীরা বিদাত বলে ঘোষণা করেন। পীরপূজাকে ধ্বংস সাধনের জন্য চিহ্নিত করলেন, যা কিছু শির্ক (মূর্তিপূজা) এর পর্যায়ের তাকে বাতিল ঘোষণা করলেন এবং সুফীবাদকে প্রবলভাবে আক্রমণ করলেন। ইবনে আবদ আল ওয়াহহাব আরবের দিরিয়স্থ (বর্তমান রিয়াদ) স্থানীয় নেতা মোহাম্মদ ইবনে সউদ (মৃত্যু হিজরী ১১৭৯/১৭৬৫ খ্রি.) সাথে সংঘবদ্ধ হলেন এবং তার হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ করলেন। এর ফলে সৌদি রাজকীয় পরিবার ও ওয়াহহাবী ধর্মীয় সংঘেল মধ্যে গভীল সম্প্রীতি জন্ম নেয়, যা অদ্যাবধি সৌদি আরবে বহাল আছে।–[ জন এল এসপোসিটো, Islam and Politics’ (নিউইয়র্ক, Syracuse University Pres, ১৯৮৪) পৃ: ১০২-৩]
সেকোতো জিহাদ
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্তমান নাইজেরিয়ায় ইসলামী বিশ্বাস ও আচার শুদ্ধিকরণের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এখানে অনৈসলামিক প্রথা সমাজকে দুষিত করে তুলেছিল। এ আন্দোলন উপজাতি হাউসল্যান্ডের নেতা ও তাদের সহকর্মীদের অবিশ্বাস হিসাবে চিহ্নিত করে।
তারা গাছের পূজা করত, প্রসাদ বিতরণ করত ও ময়দা দিয়ে রং মাখাত। তারা ছিল অবিশ্বাসী।–[বি.জি মার্টিন, ‘Muslim Brotherhoods in Nineteenth Century Africa (ক্যামব্রিজ; ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৬), পৃ: ২৮। আরো দ্রষ্টব্য এ. রশিদ মোতেন, ‘Political Dynamism of Islam in Nigeria’ ইসলামিক স্টাডিজ, ২৬ (২), ১৯৮৭]
এ জিহাদের পিছনে ছিলেন শেখ উসমান ইবনে মুহাম্মদ ফুদি (হিজরী ১১৬৮-১২৩৩ সন/১৭৫৪-১৮১৭ খ্রি.) তিনি শেহু (আরবী ভাষায় শেখ) উসমান দান ফোদিও নামে পরিচিতি ছিলেন। তার প্রদত্ত মেনিফেস্টো অনুযায়ী সেহু’র জিহাদের লক্ষ্য ছিল কলুষমুক্ত সত্য ইসলাম প্রচার করা এবং শরীয়াহর ভিত্তিতে সরকার গঠন করা। ফুলানী ও হাউসা কৃষকদের সহায়তায় তিনি একটি ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্তঅ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন যার শীর্ষে ছিলেন মুজুলসী বা আমিরুল মোমেনীন (বিশ্বাসীদের নেতা)। এ জিহাদের মাধ্যমে যে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করে তা সোকোটো খিলাফত হিসাবে পরিচিত। সে ব্যবস্থায় শরীয়াহ ও ইসলামী সংস্কৃতি ছিল বাধ্যতামূলক। রাজনৈতিক ব্যবহারের আইনগত ভিত্তি ছিল শরীয়ার অনুশাসন।
মাহদীয়াহ আন্দোলন
মোহাম্মদ আহমাদ আবদ আল্লাহ (হিজরী ১২৫০-১৩০৩ সন/১৮৩৪-১৮৮৫ খ্রি.) নেতৃত্বে মাহদিয়াহ আন্দোলন আল্লাহ ও বিচার দিবসের শত্রু ও ভুয়া মহিসের (আল দাজ্জাল) আগমন ও যুদ্ধের পূর্বে বিশ্বজনীন সুবিচার ও সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। মাহদী ও তার অনুসারীদের অটোম্যান মিশরীয় শাসকদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা ছিল, তারা ‘আল্লাহর রাসূল ও নবীদের আদেশ অমান্য করেছিল,… মোহাম্মদ (সা) এর শরীয়া পরির্তন করেছিল, আল্লাহর প্রতি ধর্মদ্রোহীতা প্রদর্শন করেছিল।–[ জন ও. ভল ‘The Sudanese Mahdi; Frontier Fundamentalist’ ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মিডল ইস্ট স্টাডিজ, ১০ (১৯৭৯), পৃ: ১৫৯] বেশ্যাবৃত্তি, জুয়া, মদ্যপান ও গানবাদ্য ইত্যাদির সাহায্যে সুদানী সমাজের দুর্বৃত্তায়নে তারা ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। সালাফিয়া আন্দোলনের মত মাহাদী পন্থীরা ইসলামী বিশ্বাস ও আচরণে পরিশুদ্ধতা আনতে চেয়েছেন, ধর্মদ্রোহী ও দুর্নীতিপরায়ণ সরকার উৎখাত করে মদীনা মডেলের অনুকরণে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চেয়েছেন। মাহদীপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ১৪ বৎসর স্থায়ী ছিল। কিন্তু ১৮৯৯ সালে ইন্দো-মিশরীয় শক্তির হাতে তারা পরাজয় বরণ করেন।
মোহাম্মদ ইবনে আবদ আল ওয়াহহাবের সালাফীয়াহ আন্দোলন বা পশ্চিম আফ্রিকার শেখ উসমান দাউ ফদিও-এর নেতৃত্বে সকোতো জেহাদ স্বদেশে ইসলামী ব্যবস্থার বিকৃতি ও দুর্নীতির বিষয়ে অধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। পাশ্চাত্য প্রভাবে ইসলমী শক্তির অবক্ষয় হয়েছে এ দৃষ্টিকোণটি তারা তাদের আন্দোলনী মনোভাব বা কার্যপরিধিতে আনতে পারেননি। একইভাবে ইসলামী সমাজের অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে সুদানে মাহাদীপন্থী রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জ হয়ত এ আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করেছিল, কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ হতে এ আন্দোলন সৃষ্টি হয়নি। আরব বিশ্বের ইখওয়ানুল মুসলিমুন, দক্ষিণ এশিয়ার তাবলীগ জামাত আন্দোলন ও জামাত-ই-ইসলামী, অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন এবং একই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে মুসলিম নাহদাহ তথা পুনর্জাগরণ আন্দোলন ধারাবাহিক আত্মপ্রকাশ বলে পরিগণিত হয়েছে।
উপরের বিবরণ যদি আজকের মুসলিম নাহদাহ আন্দোলন সমূহের উৎপত্তি, লক্ষ্য, উৎসের কারণ হয়, তবে যে সমস্যা ও প্রয়োজনীয়তার কথা এ আন্দোলন সমূহ উপস্থাপন করেছে তা হচ্ছে বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন। এর আহবান রয়েছে কুরআনে ‘তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর এবং নিষেধ কাজ প্রতিরোধ কর’।
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় ইসলাম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে- এ হতে ইসলামের মৌলিক ধারা তথা পুনর্জাগরণী নাহদাহ আন্দোলন সমূহের স্বরূপকে খাটো করে দেখা বা অবমূল্যায়নেরকোন অবকাশ নেই। পাশ্চাত্যের প্রভাব এ নাহদাহ আন্দোলনগুলোর একটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা খুঁজে নেবার অন্বেষাকে বেগবান করেছে।
মুসলিম নাহদাহ’র বিভিন্ন প্রকার রূপ
মূলধারার নাহদাহ আন্দোলনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: প্রথমভাগে যে আন্দোলন তার কেন্দ্রীয় সুর শুধু ধর্মীয় এবং দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে ঐ আন্দোলন যার সমাজ-রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রথমভাগে ফেলা যায় মাওলানা ইলিয়াসের তাবলীগ জামাত আন্দোলকে এবং দ্বিতীয় ভাগে পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী আন্দোলন ও ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এ সবগুলো আন্দোলনই প্রথমে বিশুদ্ধ ইসলামে ফিরে যাবার সংকল্প নিয়ে শুরু হয়েছে। প্রথমত: তারা কেউই ইসলামকে অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম হিসাবে দেখেনি বরং একটি জীবন বিধান হিসাবে অবলোকন করেছে, দ্বিতীয়ত আন্দোলনগুলো ইসলামে বিশ্বজনীনতায় বিশ্বাস করে এবং জাতি, বর্ণ, সীমান্ত রেখার প্রাচীর ভেঙ্গে সমস্ত মুসলমানদের এক জাতি বা উম্মাহ হিসাবে গণ্য করে। তৃতীয়ত: তারা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদকে মানব রচিত বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করে এবং বিশ্বাস করে এগুলো মানুষের সুখ সমৃদ্ধির বিধান করতে পারবে না। মুসলিম সমাজের দুর্দশার কারণ হিসাবে তারা ধর্মকে অবহেলা করে পাশ্চাত্য বস্তুবাদের পেছনে ছুটাকে দায়ী করেছে। চতুর্থত: তারা অন্ধ অনুসরণ ও আনুগত্য তথা (তাকলীদ)কে প্রত্যাখ্যান করে এবং সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক ইজতিহাদের উপরসবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। চতুর্থত: তারা সবাই একটি ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন চেষ্টায় বিশ্বাস করে। যদিও সমকালীন সকল নাহদাহ আন্দোলন মুসলমানদের একটি আদর্শ ব্যবস্থা অর্জনের প্রত্যাশার ধারাবাহিকতা, তবুও নতুন নাহদাহ আন্দোলন যে সব নতুন উপাদান সংযুক্ত হয়েছে তা চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রথমত: বর্তমান নাহদাহ আন্দোলণ ভৌগোলিকভাবে পূর্বের চেয়ে অনেক স্থানে চলছে। আন্দোলনসমূহ কোন বিশেষ ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ না থেকে স্ব স্ব চরিত্র ও সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে জড়িত করেছে। দ্বিতীয়ত অতীতের আন্দোলনসমূহ যেরূপ ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা চালিত হতো, বর্তমানে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম এমন সব অন্যান্য বিভিন্ন পেশার লোকও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠিত ছাত্র, শ্রমিক, সেনাবাহিনী ইত্যাদির মধ্যে বর্তমান নাহদাহ আন্দোলন প্রভাব বলয় বিস্তার করে আন্দোলনের গণভিত্তি রচনা করেছে, যাতে বাইরের ও ভিতরের বৈরী চাপ মোকাবেলা করা যায়। তৃতীয়ত- অধিকাংশ মুসলিম দেশ এসব আন্দোলনের চাপের মুখে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে ইসলামী আদর্শ সংযোজন করে চলেছে। ৫২টি মুসলিম দেশের মধ্যে ২৬টি দেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ধরনের অভিধা প্রতীকি হলেও, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে এর নানা প্রভাব রয়েছে। সর্বশেষে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত হয়েছে ইরানী বিপ্লব যা, ‘সাম্প্রতিক সামগ্রিক ইসলামী ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্যসাধারণ ঘটনা’।–[ হামিদ আলগার, ‘The Roots of the Islamic Revolution’ (লন্ডন:দি অপেন প্রেস, ১৯৮৩), পৃ: ৯] শাহের স্বৈরাচারী শাসনের সকল চিহ্ন মুছে দেবার জন্য গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে উলেমা সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দুর্বলতা ও গতিশীলতা এবং পরবর্তীতে একটি ইসলামী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। বিশ্বের সকল পরাশক্তি ও তাদের ক্রীড়নকদের প্রবল বাধার মুখে ইরানী বিপ্লবের সফলতা ইসলামে অন্তর্নিহিত শক্তির প্রমাণ এবং কুফরের শক্তির জন্য একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা।
তাবলীগ জামাত
১৯২০-এর দশকে ভারতের দিল্লী ও এর আশে পাশে ‘ঈমানী আন্দোলন’ নামে পরিচিত তাবলীগ জামাত আন্দোলন জন্মলাভ করে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত মেওয়াত নামক স্থানের মুসলিম অধিবাসীদের অবক্ষয়িত নৈতিক ও ধর্মীয় আচরণ সংশোধনের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ দ্বীনি নেতা মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস এ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।–[ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, ‘Hadrat Mawlana Mohammad Ilyas awr Unki Dini Da’wat’ (লখনো, তানভীর প্রেস, ১৯৬০); এম.এ হক ‘The Faith Movement of Mawlana Muhammad Ilyas’ (লন্ডন, জর্জ এলেন এন্ড আনউইন, ১৯৭২)] তাবলীগ জামাত ইসলামের জন্য নিবেদিত সম্ভবত: এটিই সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক দল। জ্যানসেনের ভাষায় ‘এ আন্দোলনের লক্ষ্য নৈতিক সসস্ত্রীকরণ’।–[ গডফ্রে জ্যানসেন, ‘Islam in Asia Towards an Ismamic Society’, The Economist, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮২, পৃ: ৫৪] উম্মতের ভিতর থেকে দূরে থেকে নিয়তের বিশুদ্ধতা, ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি, শুদ্ধভাবে এবাদ বন্দেগী তথা প্রার্থনা করা, জ্ঞান অর্জন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে শরীয়াহ পালনের মাধ্যমে ইসলামের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছে। সার্বিক লক্ষ্য হচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রকে শরীয়াহ আওতাধীনে আনা। তাবলীগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার মতে, ‘নৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক সম্পর্ক শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিষয়েও শুদ্ধতা আসবে’।–[ নদভী, ‘Hadrat Mawlana Ilyas পৃ: ২৬৯]
এ আন্দোলনের কোন স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো নেই বা স্থায়ী সদস্যপদও নেই। স্বেচ্ছামূলকভাবে নিজ খরচে জামাতে অংশগ্রহণকারীদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে ঈমান আকিদা শিক্ষা ও প্রচারের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। স্থানীয় মসজিদকে অস্থায়ী আবাসস্থল করে তারা দেশের দূরবর্তী কোণায় ছড়িয়ে পড়ে। তারা দুয়ারে, জনে জনে মানুষকে মসজিদে এসে আল্লাহ ও রাসূলের কথা শোনার দাওয়াত দেয়, ছয় উসূল বা দফার মাধ্যমে তারা তাদের ইসলামী দাওয়াতের বাণী উপস্থাপন করে:
১. কলেমা শাহাদাত বা আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয়া, তার শুদ্ধ উচ্চারণ এবং তার অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করা, ২. সালাত বা আল্লাহর আনুগত্য হিসাবে দৈনিক ৫ বার নামাজ আদায় করা। ৩. জিকির বা ধর্মভীরুতা অর্জনের জন্য সর্বসময় আল্লাহকে স্মরণ করা, ৪. ইকরামুল মুসলেমীন ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে ও দাওয়াতের কৌশল হিসাবে মুসলমানদের সম্মান বা সেবা করা, ৫. দাওয়াত বা নিজের বাসগৃহের বাইরে দলবদ্ধ অবস্থায় আল্লাহ-রাসূলের বাণী প্রচার করা, ৬. ইখলাস বা শুদ্ধ নিয়ত তথা ধর্মীয় কাজে নিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাবলীগের কাজ করা।–[ মুহাম্মদ আইয়ুব কাদরী, ‘Tablighi Jama’at Ka Tarikhi Jalizah’ (করাচী, Maktaba Muawiyah, ১৯৭১) পৃ: ৯২-৬] তাবলীগ জামাত আন্দোলন সংবাদ প্রচারণা মাধ্যমকে পরিহার করে এবং সংবাদ মিডিয়ায় তাদের কোন প্রচারণা প্রেরণ করে না; এতদত্বেও এটা মুসলমানদের জন্য একটি শক্তিশালী নাহদাহ আন্দোলনের প্ল্যাটফরম। এ আন্দোলন প্রমাণ করে যে ইসলামী পুনর্জাগরণের বীজ ইসলামের ভিতরই অন্তর্নিহিত আছে।
তাবলীগ জামাত নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিহার করার উপর বিশেষ জোর দেন এবং সমাজ-রাষ্ট্রীক গুরুত্বপূর্ণ কোন রাজনৈতিক কাজে নিজেদের সংশ্লিষ্ট ও সংযুক্ত করে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁরা অবশ্য ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, তবে মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম রাজনীতিকে অগ্রাধিকার হিসাবে স্বীকার করেন না। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা শুদ্ধরূপ ইসলামকে বিকৃত করবে এবং জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবে বলে তারা মনে করেন।–[ মাওলানা ওয়াহিদ উদ্দীন খান, ‘Din Kya Hai? (দিল্লী, মাকতাবাহ আল রিসালাহ) পৃ: ২৬] তাদের দৃষ্টিতে ইসলামী আকিদার দুর্বলতার কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই ‘রাজনীতি পরিহার’? ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রথম পদক্ষেপ বা ভিত্তি বলে তারা মনে করেন। ইসলামের বৈরী শক্তির মোকাবেলা, তাদের মতে, ইসলামী বিশুদ্ধ তাবলীগের বাণী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে, ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের বাস্তব জীবনে অনুশীলন করতে হবে, আল্লাহর সাথে ভয় ও ভালোবাসায় নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং শেষ পদক্ষেপ হিসাবে হিজরত ও জিহাদের পন্থা অবলম্বন করতে হবে।–[ মাওলানা ওয়াহিদ উদ্দিন খান, ‘Aqliat-e-Islam’, (দিল্লী মাকতাবাহ আল রিসালাহ); পৃ: ৪-৫]
তাবলীগ জামাত আন্দোলনের সফলতার পরিমাণগত মান নির্ণয় দুরূহকর্ম। পৃথিবীর ২৪টি দেশে তাবলীগ জামাত আন্দোলনের কাজ চলছে। বিভিন্ন দেশে তাবলীগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলনে সর্বস্তরের লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। এ আন্দোলন বহু বুদ্ধিজীবীকেও তাবলীগ জামাতে সামিল করতে পেরেছে। বৎসরে একবার সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ তবলিগ জামাতের আমল আকিদায় বিশ্বাসী মুসলমানগণ বাংলাদেশে একত্রিত হন যাকে বলা হয় ‘বিশ্ব ইসতেমা’। এ সম্মেলন তিনদিন চলে।
জামাত-ই-ইসলামী
১৯৪১ সালে পাকিস্তানের লাহোর সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী জামাত-ই-ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটা রাজনৈতিক দল হিসাবে নয় বরং একটি আদর্শিক আন্দোলন হিসাবে জন্মলাভ করে। ইসলামের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিকের উপর সাইয়েদ মওদুদীর বিস্তৃত ও সুগভীর জ্ঞান ও দখল রয়েছে বলে পাকিস্তানে তার ব্যাপক স্বীকৃতি রয়েছে। জামাতে ইসলামী নামে গঠিত দলটির একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে এবং এ দলের একনিষ্ঠ মনোযোগ ও অঙ্গিকার রয়েছে এবং এ দল একনিষ্ঠ মনোযোগ ও অঙ্গিকারের সাথে সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে’।–[ রজেনথাল, Islam in the Modern National State (ক্যামব্রিজ, ক্যামব্রীজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৫), পৃ: ২৪৭] মওদুদীর মতে ইসলাম হচ্ছে একটি সর্বাত্মক বিশ্বজনীন জীবন বিধান, এটা একটি সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা, জীবনের সকল প্রশ্নের উত্তর এতে রয়েছে। এর মৌলিক কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আল্লাহর সর্বপ্লাবী সার্বভৌমত্বের ঐক্য। ইসলামের জীবন ব্যবস্থা শরীয়াহ নামে অভিহিত, যা গভীর ঈমানের উপর সংস্থাপিত। এ ভিত্তির উপরই ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
মওদুদীর মতে আদর্শ ইসলামী ব্যবস্থা গঠিত হতে পারে একমাত্র এমন লোক সমষ্টির সাহায্যে যারা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সকল কিছুর আনুগত্য হতে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছে; এরূপ সমাজ-রাষ্ট্র হবে ধর্মীয়গণতান্ত্রিক এবং এর নাগরিকগণ হবে চিরুনীর ফলার মত সমান। মুসলমানদের পরিচয় হচ্ছে ‘উম্মাহ ওয়াসাহ’ (ন্যায়ানুগ ও ভারসাম্যমূলক সমাজ) এবং তাই তারা ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা’ দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাঁর মতে কুরআন শুধুমাত্র খানকাহ, মঠ ও বিদ্যালয়ে চর্চার জন্য কোন তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় হেয়ালীপূর্ণ পুস্তক নয় বরং এটি হচ্ছে সক্রিয় আন্দোলনের নির্দেশনা সম্বলিত কিতাব।–[ এ. এ. মওদুদী, ‘তাফহীমুল কুরআন, (লাহোর, ইদারা তারজুমানুল কুরআন, ১৯৭৩), ভলিউম-১, পৃ: ৩৩] ফলে ইসলাম হচ্ছে বিপ্লবী সংগ্রাম ও সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার (জিহাদ) ধর্ম, সংজ্ঞা নির্ণয়ে মওদুদী রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তনের কথা বলেছেন, যে রাষ্ট্রযন্ত্র- মিথ্যা ভাবমূর্তি, বিকৃত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও অভিজান শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে।
এ উদ্দেশ্যে সাইয়েদ মওদুদী জামাত-ই-ইসলামী গঠন করেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) কর্মপদ্ধীত দলের মৌলিক নীতিমালা ও কৌশল হিসাবে গ্রহণ করেন। প্রথমেই আল্লাহর আপোষহীন সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে সর্বাত্মক বিপ্লবী কাজে ঝাপিয়ে পড়তে হবে এবং সঠিক আঙ্গিকে ইসলামী আকিদা বিশ্বাস ও অনুশাসন শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত যারা এ আহবানে সাড়া দেবেন তাদের এক প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত করে তাদের নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নের জন্য একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রোগ্রাম রচনা করতে হবে। তৃতীয়ত মুসলিম সম্প্রদায়ের সামষ্টিক জীবনকে ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে পুর্জীবিত করার জন্য একটি সর্বপ্লাবী আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। সর্বশেষে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এই বিপ্লবী আন্দোলনের মত শাসন ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা ছাড়া কোন বিকল্প পন্থা নেই, কেন না রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়া যে ধর্মপরায়ণ ব্যবস্থার কথা ইসলামে বর্ণিত রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত হয় আল্লাহর ঐশী নির্দেশনা মোতাবেক। তাই প্রকাশ্যে ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে, আইন ও সংবিধানের কাঠামোর মধ্য থেকে এ আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে।
‘যে সব আইনের বিরুদ্ধে আমি সারা জীবন লড়াই করেছি সে সব আইনও আমি কখনো ভঙ্গ করিনি। আমি আইনসঙ্গত ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে তা পরিবর্তন করতে চেয়েছি এবং কখনো আইন অমান্যের পন্থা অবলম্বন করিনি।(মাওলানা মওদুদী)–[ মরিয়ম জামিলাহ, ‘Islam in Theory and Practice’ (লাহোর, মোহাম্মদ ইউসুফ খান), পৃ: ৩৩৪]
স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হতে জামাত সদস্য সংগ্রহ করে। ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে জামাত নতুন এক বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টি করেছে। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ জন সদস্য নিয়ে শুরুকরে ১৯৭৮ সালে জামাতের রোকন বা সক্রিয় সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩,৫০০ জন, যার সাথে রয়েছে পাকিস্তানের প্রায় ৫ লক্ষ সহযোগী সদস্য। চারটি দেশে এর সহযোগী সংগঠন রয়েছে। জামাত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে যেখান হতে ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ সংগঠন ৩০০ এর অধিক পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছে এবং ১৯৫৫-৫৬ সাল নাগাদ ৫০টি স্থায়ী হাসপাতাল ও ১১টি অস্থায়ী ক্লিনিক স্থাপন করেছে। মৃত্যুর পূর্বে সাইয়েদ মওদুদী লক্ষ লক্ষ মানুষের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছেন, যাদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক অন্যতম। জিয়াউল হক সরকার জামাতের বহু শীর্ষ নেতার পরামর্শ ও সাহায্যে অনেক ইসলামী নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং মৃত্যুর সময় পর্যন্ত আরো কিছু ইসলামী নীতিমালা নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন।
ইরানী বিপ্লব
কেবলমাত্র ইরানী ইতিহাসের গভীর শিকড় অনুসন্ধান ও ইসলামের ভিতর ইতিহাসের মর্মবাণীর উপলব্ধির মাধ্যমেই ইরানী বিপ্লবকে অনুধাবন করা সম্ভব। এ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়।–[ ইরান সম্পর্কে সার্বিকভাবে জানার জন্য দেখুন, Nikkei keddie, Roots of Revolition: An Interpretive History of Modern Iran’ (নিউ হ্যাভেন, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮১)] ইরানী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ সুমাভী খোমেনী। তিনি আধ্যাত্মিকবাদী শিক্ষক হিসাবে প্রথমে খ্যাতি লাভ করেন। আলগার সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন যে ‘ইমাম খোমেনীর জীবন নির্দেশ করে যে ইসলামী বিপ্লব আবশ্যিকভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণ হতে সংঘটিত হয়।–[ ইমাম খোমেনী, ‘Islam and Revolition…., পৃ: ১৪] ইমাম খোমেনীর মতে ইসলাম সকলকাজের নির্দেশনা ও মূল্যবোধ ঠিক করে দিয়েছে। ইসলামী আইন হচ্ছে বিশ্বজনীন, অপরিবর্তনীয় এবং তাকে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেহেতু ইমামগণ ঐশী ইচ্ছা অনুযায়ী নবী করিম (সা) কর্তৃক নিযুক্ত হন,তাই ইমামদের অনুসারীদের জন্য ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক।–[ ইমাম খোমেনী, ‘Islam and Revolition…., পৃ: ৩৭] শেষ ইমামের গায়েরে থাকা অবস্থায় (গায়েবাহ), ঐশী বিধান অনুযায়ী ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণ শাসনকার্য পরিচালনা করবেন; ‘ফকিহরাই হচ্ছেন প্রকৃত শাসক’।–[ ইমাম খোমেনী, ‘Islam and Revolition…., ৬০]
খোমেনী খোলাফায়ে রাশেদার সময়কার মদীনার যুগ বিশেস করে রাসূলুল্লাহর জামাতা আলীর খিলাফতের প্রতি গভীর অনুরাগ ব্যক্ত করেন। পরবর্তীতে শির্ক (বহুত্ববাদ) অর্থনৈতিক দমন ও শোষনের মাধ্যমে সমাজে প্রবেশ করে। ইরানে আলীপন্থী ধর্মানুসারীর সাফায়ী শাসনকর্তাদের বিরোধিতা করেন, যে শাসকবৃন্দ ধর্মকে কলুষিত করেছিল, ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করত এবং সামাজিক বৈষম্যকে বৈধতা দান করত। শাহের রাজতন্ত্রের যে সমালোচনা খোমেনী করেন তা ছিল প্রধানত ইরানে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন্দ্রিক। তিনি জনগণকে পবিত্র জিহাদে অবতীর্ণ হতে আহবান জানান:
ইসলাম সাহসী ব্যক্তি সমষ্টির ধর্ম যারা সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। ইহা তাদের ধর্ম যারা মুক্তি ও স্বাধীনতাপ্রিয়। এটা তাদের ধর্ম যারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী।–[ ইমাম খোমেনী, ‘Islam and Revolition…., ২৮] জিহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ন্যায়পরায়ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা’ করা এমন বৈষম্যহীন সমাজ যেখানে প্রত্যেক মানুষের পরিশীলিত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির সুযোগ রয়েছে। জিহাদের জন্য ইমাম খোমেনী যে পথ, পন্থা ও পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা হলো: ১. পাহলবী রাজতন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আপোষহীন বিরোধীতা, ২. তিনি শাহের সরকারকে যুক্তরাষ্ট ও ইসরাইলের ক্রীড়নক হিসাবে চিহ্নিত করেন। ৩. তিনি খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন সংস্কার ধর্মী পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে তিনি ধর্মীয় ফরমান ও ভাষণের মাধ্যমে জনগণকে শাহের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত করেন, এসব বক্তৃতার অনেকগুলো ছিল তাঁর নির্বাসিত জীবন কালের ও ক্যাসেট ধারণকৃত, যা- ‘ক্যাসেক বিপ্লক’ শিরোনামটির জন্ম দেয়। তিনি জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করে বলেন, ‘ইসলামী আইনের চলিষ্ণুতার বিষয়ে লিখুন ও পুস্তক প্রকাশ করুন, যাতে ইসলামের কল্যাণমুখী দিকগুলি জনগণ জানতে পারে। আপনাদের প্রচারণার ধরন ও পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আরো সমৃদ্ধশালী ও উন্নতকরণ… নিজেদের প্রতি গভীর বিশ্বাস রাখুন এবং জেনে রাখুন এ পবিত্র কাজটি আপনারা অবশ্যই সম্পাদত করতে পারবেন’।–[ ইমাম খোমেনী, ‘Islam and Revolition…., ৩৭]
রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে খোমেনীর বাণী সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করে। তিনি দেশ-বিদেশের সকল নির্যাতিত মানুষ, শ্রমিক, বিত্তহীন ও সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা সোচ্চারভাবে ব্যক্ত করেন। যেখাকে ইরানের শাহের পতন ঘটান সম্ভব হয়েছিল তা ইসলামের অন্তর্নিহিত বিপ্লবী শক্তির পরিচয়বাহী। পাহলবী রাজতন্ত্র ইমামের নেতৃত্বে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধারা প্রতিস্থাপিত হয়। তিনি ‘বেলায়েতে ফকীহ’ ধারণা ও পদবী উপস্থাপন করেন, যার মর্যাদা ও ক্ষমতা সরকারের ঊর্ধে। ইমাম খোমেনীকে ইরান জাতি এ পদবীতে ভূষিত করে। ইমাম খোমেনীর মতে ‘বেলায়েতে ফকীহ’ কে ইরানী হতে হবে এমন শর্ত নেই, যদি তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কর্তৃক গৃহীত হন। জাতীয়তার উর্ধ্বে ইসলামী চেতনাকে স্থান দান ইরানী সংবিধানের একটি অনন্য ধারার সংযোজন, যার তুলনা অন্যকোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পাওয়া যাবেনা। ইরানে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণীর জন্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। বহুবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ইরানী ইসলামী রিপাবলিকান রাষ্ট্র একটি অনন্য সাধারণ উদাহরণ, যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ইরানের সীমারেখার বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত।–[ Nikki R. Keddie, ‘Iranian Revolution and Islamic Republic’ যুক্তরাষ্ট্র উইড্রো উইলসন সেন্টার, ১৯৮২), পৃ: ১৩]
একটি তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিত
ইরানের নাহদাহ আন্দোলনের প্রক্রিয়া ও বিজয়ের সাথে তুলনা করলে জামাত-ই-ইসলামী ও তাবলীগ আন্দোলনের অর্জন তাৎপর্যহীনতায় ম্লান হয়ে যায়। কারণগুলি সুস্পষ্ট। বিপ্লবের পথ রচনার জন্য সাইয়েদ মওদূদীর সামনে তেমন কো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ভাবমূর্তি ছিল না। পক্ষান্তরে ইমাম খোমেনী উত্তরাধিকার সূত্রে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারকদের ভাবধারা ও অস্ত্রসমূহ প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তার সাথে নিজের জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বকে সংযুক্ত করতে পেরেছিলেন। অধিকন্তু সুন্নী মতবাদের বিপরীতে শিয়া মতবাদে একটি শক্তিশালী বিপ্লবী ভাবধারা অন্তর্নিহিত রয়েছে। শিয়ারা ইমামবৃন্দ এবং তাদের মনোনীতদের কর্তৃত্বের সঠিক অধিকারী বলে মনে করেন। অন্যরা সবাই অবৈধ এবং তাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে বলে মনে করতেন। এখানেই মূল বিষয়টি নিহিত: ‘সুন্নী দেশসমূহের মুসলমানরা শাসকদের মান্য করায় বিশ্বাস করে, পক্ষান্তরে শিয়ারা সব সময় বিদ্রোহ-বিপ্লবে বিশ্বাস করে-কখনো কখনো তারা বিদ্রোহ করতে পেরেছে আবার কখনো অবস্থার চাপে তারা নীরব থেকেছে’।–[ খোমেনী, ‘Islam and Revolution… পৃ: ৩২৭] পরিশেষে সাইয়েদ মওদুদীর প্রচেষ্টা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতদের ইসলামের পরিধির মধ্যে টেনে আনতে পেরেছিলেন। ইরানে ডঃ আলী শরীয়তী এ কাজটি সফলতার সাথে সম্পাদন করেছিলেন। উলেমা সম্প্রাদায়ের অর্থপূর্ণ অবদানের অনুপস্থিতির কারণে পাকিস্তানে সাধারণ জনগণের মধ্যে কোন জাগরণ সৃষ্টি হয়নি এবং এমতাবস্থায় জাতীয় নির্বাচনে জামাত জনসমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়। ইরানের ক্ষেত্রে উলেমাবৃন্দ ইমাম খোমেনীর চারপাশে জনগণকে সমবেত করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন; তাছাড়া ইমাম খোমেনীও ছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন আলেম। এভাবে কোন সংযোগহীনতা না থাকায়, ইরানে বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হয়।
উপসংহার
বিশ্বব্যাপী মুসলিম পুনর্জাগরণেল যে ধারাক্রম চলছে তাকে মৌলবাদ, ইসলামী পুনরুত্তান, রেনেসাঁ ও অন্যান্য নানা নামে অভিহিত করা হচ্ছে। পশ্চিমে এই শব্দও পরিভাষার উদ্ভব বিধায়, এগুলি একদেশদর্শীতা, ভয় ও আবেগের জন্ম দিচ্ছে এবং এ শব্দগুলি অপপ্রয়োগ মাত্র। মুসলিম পুনর্জাগরণের এই ধারাকে আরবী শব্দে বা ইসলামী নাহদাহ পুনর্জাগরণ নামে অভিহিত করা অধিক যুক্তিসঙ্গত, কেননা বাস্তবতার নীরিখে মুসলিম অভিজ্ঞতা একে বাস্তব যৌক্তিকতা প্রদান করেছে (নাহদাহ অর্থ শিশুর মাঝে সুপ্ত সম্ভাবনা)।
ইসলামী প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে নাহাদাত আন্দোলনের স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য কি এ প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। উল্লেখ্য জনসাধারণের উপর ইসলামের প্রভাব বিপুল। মুসলমনাগণ নিজেদেরকে ন্যায়পরায়ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজের সদস্য হিসাবে মনে করে। ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষ এরূপ দু’টি পৃথক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব ইসলাম স্বীকার করে না। চার্চের সাথে রাষ্ট্রের বিভেদকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের ভূমিকা রয়েছে বলে মুসলমানরা মনে করে। আল্লাহ কর্তৃক মানবজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ঘোষিত মুসলমানরা যেখানেই শাসন ক্ষমতা পাবে সেখানেই তারা অর্পিত দায়িত্ব হিসাবে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করবে। মহানবী (সা) ও তাঁর সাহাবীরা এ জিহাদ পরিচালনা করে গৌরবময় মুসলিম সভ্যতার পত্তন করেছিলেন। মুসলিমরা সে সভ্যতার জন্য সব সময়ে গর্বিত। জিহাদ, আশাবাদ ও সাফল্য হচ্ছে নাহদাহের চলমান প্রক্রিয়ার চারিকা শক্তি। এই উপাদান এবং প্রতি শতাব্দীর প্রথম ভাগে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারকের আগমণ সম্পর্কে নবী করিম (সা) এর ভবিষ্যৎবাণী মুসলমানদের বিশুদ্ধ ইসলামের উত্থানের জন্য সংগ্রাম করতে উদ্ধুদ্ধ করে আসছে। নাহদাহ আন্দোলনকে তাই শুধুমাত্র ইসলামের কাঠামোর ভিতর থেকেই বোঝা সম্ভব। বিশেষ ধরনের সামাজিক অবস্থা ও বিশেষ রাজনৈতিক চাপ অতিরিক্ত উপাদান হিসাবে এই আন্দোলনকে গতিশীল ও জোরদার করেছে।
নাহদাহ আন্দোলনের নানা প্রকরণ রয়েছে। কিছু আন্দোলন শুধু নৈতিক সংস্কারের সাথে জড়িত, কিছু আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রীক লক্ষ্য রয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপের ভিতর আবার শ্রেণী বিভাজনমূলক ধারা রয়েছে, যেগুলোর স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যসমূঞ উপলব্ধি করতে হবে। এ সবগুলো আন্দোলনের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন, যা হচ্ছে একটি সুস্থ মানবিক ফলাফলের দিক থেকে তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। ইরানী অভিজ্ঞতা হতে বলা যায় সাফল্য আসে বহু ত্যাগ, রক্তপাত, ঘাম, সংকল্প ও আল্লাহর উপর গভীর আস্থা থেকে। এটি রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতিকর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বুদ্ধিজীবী ও গণমানুষের শক্তির মনোগত সফল ঐক্য এবং একটি মনোভঙ্গি ও মনস্তত্ব যা প্রতিরোধ ও শাহাদাত বরণকে উচ্চতম মর্যাদা প্রদান করে।