উম্মাহঃ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা
উম্মাহ বা ইসলামী জাতি হচ্ছে সমস্ত মানব জাতির জন্য সত্যের সাক্ষ্যবাহী (২:১৪৩)। ইতিহাসের স্থান-কালের প্রেক্ষাপটে ঐশী ইচ্ছা বাস্তবায়নের গতিশীল বাহন উম্মাহ। এ সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে শরীয়াহ আলোচনার অধিকাংশই নিয়োজিত করেছে ইসলামী সমাজব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে; আনুষ্ঠানিকতা ও ব্যক্তিগত নৈতিকতা বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে অল্প অংশে। একইভাবে ইসলামী ঐতিহ্য উম্মাহর ধারণার উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে। মুসলমান হওয়ার জন্য অপরিহার্য প্রয়োজন উম্মহার অংশ হওয়া। ইসলামী সময়কাল মহানবী (সা)-এর জন্ম বা মৃত্যু দিবসের সাথে সম্পর্কিত নয় বা প্রতম কুরআন নাজিলের সাথেও সম্পর্কিন নয়, বরং মহানবী তাঁর সাহাবীদের নিয়ে মদিনায় হিজরতের সময় হতে এর সূচনা। এটা সে সন্ধিক্ষণ যখন মক্কার মুসলমানগণ রক্তের সম্পর্কের উর্ধ্বে আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে স্থান দিয়েছিল। সুসামঞ্জস্যশীল উম্মাহর অংশে পরিণত হওয়ার মধ্যে মুসলমানের জীবনের তাৎপর্য এবং তার পরকালীন মুক্তি নিহিত। এ ধারণা ব্যাখ্যা করে উম্মাহর ধারণাটি কেন ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে। উম্মাহ আসলে কি? কুরআন ও সুন্নায় এ বিষয়ে কি ধারণা দেয়া হয়েছে? ইতিহাসে এ ধারণার জন্ম হল কিভাবে? পরিশেষে জাতীয়তাবাদের ধারণার সাথে কিভাবে এর তুলনা করা যায়?
পারিভাষিক বিভ্রান্তি
উম্মাহ একটি অনন্য সাধারণ পরিভাষা। পাশ্চাত্য ভাষায় এর কোন প্রতিশব্দ নেই। প্রথম দিকে পশ্চিমে উম্মাহ শব্দের সাথে জাতি বা জাতি রাষ্ট্রের ব্যবহার সমার্থক হিসাবে গণ্য হতো। সম্প্রতি পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উম্মাহ শব্দ সম্প্রদায় অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতি বা জাতি রাষ্ট্রের ধারণাটি সাম্প্রতিক এবং পশ্চিম থেকে ধার করা। দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা তাদের পাশ্চাত্য গুরুদের অনুকরণে উম্মাহ শব্দটি প্রতিশব্দ হিসাবে জাতি শব্দটি ব্যবহার করেছে। সম্পদায় অর্থে উম্মাহর ব্যবহারও সমভাবে ভুল।–[কুরআনে সম্প্রদায় বুঝাতে ‘শাব’ ও ‘কওম’ শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে ‘শা’ব’ শব্দটি মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা’ও বহুবচন ‘শুয়াব’ রূপে। ‘কওম’ শব্দটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, কতিপয় লোকের দল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।] এ দু’য়ের মধ্যে সাদৃশ্য কৃত্রিম।
সম্প্রদায় শব্দটি একই ধরনের জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত লোকসমষ্টিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং এমতাবস্থায় শব্দটি ‘স্থানীয় দল’, ‘কোন অঞ্চলের সামাজিক জীবন’ যথা গ্রাম, শহর বা দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।–[ R.M Maclver ‘Community: A Sociological study (লন্ডন, ১৯৩৬), পৃঃ ২২-২৩; ৭৩] এর মধ্যে একটি ‘জটিল সামাজিক ব্যবস্থা আর আঙ্গিক কাঠামো এবং সমাজ-মনস্তাত্বিক ঐক্য’ রয়েছে।–[ ম্যাবেল এ. ইলিয়ট ও ফ্রানসিস ই. মেরিল ‘Social Disorganisation’ (নিউইয়র্ক, দি ফ্রি প্রেস, ১৯৬০), পৃ. ৪৫৭] সহজভাবে বলতে গেলে, সম্প্রদায় হচ্ছে –একটি জনগোষ্ঠী যারা কোন বিশেষ অঞ্চলে বাস করে এবং যাদের মধ্যে বিশেষ ধরনের ঐক্যের বন্ধন রয়েছে। এই সাম্পদায়িক ঐক্য রক্ত, আত্মীয়তা, একই সংস্কৃতি, একই ভূখণ্ড হতে উদ্ভুত হতে পারে অথবা এগুলি উপাদানের কতিপয়কে নিয়ে এ ঐক্য হতে পারে। সম্প্রদায়ের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে তার সাথে উম্মাহ শব্দটির অর্থগত কোন মিল নেই। উম্মাহ গঠনের নির্ধারণী ভিত্তি জাতি, ভাষা, ইতিহাস বা এদের কতিপয়ের সমন্বয় নয়। কোন ভৌগোলিক অঞ্চরের মাঝে উম্মাহ সীমাবদ্ধ নয়। জাতি, ভাষা ও ভুখণ্ড দ্বারা উম্মাহ শব্দটিকে আবদ্ধ করা যায় না। উম্মাহ সীমাবদ্ধ নয়। জাতি, ভাষা ও ভূখণ্ড দ্বারা উম্মাহ শব্দটিকে আবদ্ধ করা যায় না। উম্মাহ হচ্ছে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যত মুসলমান বাস করে তাদের সমন্বয়ে এবং ইসলামী দর্শন ও চেতনার ঐখ্য বন্ধনে গঠিত একটি সামগ্রিক ধারণা। স্থানকালের পরিসীমা অতিক্রম করে ঐশী ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের সামগ্রিক মানবগোষ্ঠী হচ্ছে উম্মাহ, যার লক্ষ্য ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি।
কুরআন ও সুন্নায় উম্মাহ
আল কুরেআনে উম্মাহ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর নানা অর্থ করা হয়েছে।–[উম্মাহ শব্দটি কুরআনে ৬৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে, ৫৩ বার মক্কী আয়াতে, বাকী মদীনার আয়াতে। মোহাম্মদ ফুয়াদ আবদ আল বাকী, ‘al-Mu’jam al-Mufharas li-Alfaz al-Quran al-Karim’ (তুরস্ক, আল মাকতাবাহ আল ইসলামিয়া, ১৯৮৪), পৃ. ৮০] কতিপয় আয়াতে উম্মাহ বলতে ‘লোক সমষ্টি’, ‘জাতি’, বোঝাতে ‘কওম’ বা ‘শা’ব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যারা শুধুমাত্র –আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ (৪০:৫; ৪৯:১৩)।
কোন কোন আয়াতে উম্মাহ বলতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে একদল লোকে বোঝান হয়েছে (৭:১৫৯) অথবা বোঝান হয়েছে এমন দল ‘যারা পানির মত প্রবাহিত’ (২৮:২৩)।
কোন কোন আয়াতে উম্মাহ বলতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে একদল লোককে বোঝান হয়েছে (৭:১৫৯) অথবা বোঝান হয়েছে এমন দল ‘যারা পানির মত প্রবাহিত’ (২৮:২৩)।
১০:১৯ আয়াতে সমগ্র মানব জাতিকে একক জাতি বা ‘উম্মাহ ওয়াহিদাহ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বৃহৎ মানব গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই ধরনের কঠোর দৃষ্টিকোণ থেকে, উম্মাহ বলতে একই ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণ দ্বারা আবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে বোঝায় (৭:১৫৯)।
উম্মাহ বলতে একজন নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী একদল লোককেও বোঝান হয়েছে। (১০:৪৭), যারা একমাত্র আল্লাহ পাকের আনুগত্য করার শপথ নিয়েছে। এই বিশেষ অর্থেই কুরআন নবী করিম মোহাম্মদ (সা) এর অনুসারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘তোমরা মানবজাতির মধ্যে উম্মাহ, যারা সৎকাজের আদেশ করবে, অসৎকাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে (৩:১১০)।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে উম্মাহ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্বাসীদের (মুমেনুন) বুঝানো হয়েছে এবং বিপরীত পক্ষে রয়েছে অবিশ্বাসীরা (কুফর), ইহুদী ও বহুত্ববাদীরা (মুশরিকুন)। এভাবে আমরা তাদের পৃথিবীর বুকে উমুম (উম্মাহ’র বহুবচন) হিসাবে বিভক্ত করে দিলান, যাদের কিছু অংশ ন্যায়পরায়ণ আর বাকী অংশ বিপরীতধর্মী (৭:১৬৮)।
ইসলামে শাহাদাত শুধু আল্লাহপাকের একত্ব ও মোহাম্মদ (সা) এর নবুয়তে বিশ্বাসই নয় বরং ‘উম্মাহ মুসলিমাহ’ এর অংশ হবার আনুগত্যের শপথও। এ উম্মাহ বলতে সমগ্র মানবজাতিকে বোঝায় কেননা শেষ নবীর আহবান বাণী ছিল সর্বত্র মানব জাতির জন্য। ‘হে মানব মণ্ডলী’ আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর বাণী বাহক হিসাবে এসেছি, আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু যার অধীণ এবং তিনি ছাড়া আর কেউ উপাসনার যোগ্য নয়’ (৭:১৫৮)।
উম্মাহ শব্দটি নবী করিম (সা) এর অনেক হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি তার অনুসারীদের উম্মাহ বলে অভিহিত করেছেন এবং এই নব সমাজের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। হামিদুল্লাহ’র মতে উম্মাহর ধারণাটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব লাভ করে মদীনার লিখিত সংবিধানে এ শব্দটির ব্যবহার বা উল্লেখের মাধ্যমে।–[ মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ, ‘The First Written Constitution in the world’ (লাহোর: আশরাফ, ১৯৭৫)] সবচেয়ে সমালোচনাকারী মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিও এ দলিলের সত্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করেনি।–[ S.D.B Hoitein, ‘Studies in Islamic History and Institution’ ই. জে. ব্রীল, ১৯৬৮) পৃ. ১২৮] এই মৌলিক দলিলের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মদিনার দলিল হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ ও আহল-আল কিতাবী তথা কিতাবধারীদের মধ্যকার প্রথম চুক্তি, এখানে কিতাবধারী বলতে ইহুদীদের বোঝান হয়েছে।
‘পরম করুণাময় আল্লাহ’র নামে শুরু করছি’ এ শব্দগুচ্ছ দ্বারা আরম্ভ করে চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বিশ্বাসীগণ তথা কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মুসলমানগণ, আর তাদের সাথে যারা যোগ দিয়েছে ও অনুসরণ করছে এরা সবাই মানবজাতির মধ্যে আলাদা একটি উম্মাহ।–[ আর্টিকেল ১ এবং ২ দ্রষ্টব্য, হামিদুল্লাহ ‘The First Written Constitution in the World’ পৃ. ৫৫] তারা একে অন্যের সাওয়ালী বন্ধু, অভিভাবক, সহযাত্রী।–[ আর্টিকেল 15 দ্রষ্টব্য, হামিদুল্লাহ ‘The First Written Constitution in the World’ পৃ. ৫৫ পৃ. ৫৮] সমন্বিত দেহের মত একযোগে কাজ করে এবং অবিশ্বাসী (কুফর), ইহুদী ও বহুত্ববাদীদের (মুশরিকুন) সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।–[ আর্টিকেল ২০ (খ) দ্রষ্টব্য, হামিদুল্লাহ ‘The First Written Constitution in the World’ পৃ. ৫৫, পৃ: ৫৯] মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ইহুদীদের জীবনযাত্রা ইহুদী ধর্ম অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
এ ধরনের সুস্পষ্ট ঘোষণা সত্ত্বেও ‘মদীনার সংবিধানে ঘোষিত উম্মাহর ‘ভূখণ্ডগত পরিচয় রয়েছে’ মর্মে মতামত প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে।–[ ডব্লিউ মন্টোগোমারী ওয়াট, ‘Muhammad at Medina (অক্সফোর্ড, ক্লেরেনডন প্রেস, ১৯৫৬); পৃ: ২২৩, ২২৬] রোজেনথাল ও মন্টোগোমারী ওয়াট মনে করেন যে, উম্মাহ শব্দটি ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা মুসলিম, ইহুদী ও দেবদেবী পূজারীদের দায়িত্ব কর্তব্য ও অধিকার বন্টন করে দিয়েছে।–[ ই. আই. জে রজেনথাল ‘Political Thought in Medieval Islam An Introductory Outline (লন্ডন, ক্যামব্রীজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮); পৃ. ২৫] এ ধরনের ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে সংবিধানের এ ধারা হতে ‘ইন্না ইয়াহুদ বনি আউফ উম্মাতুন মা আল মুসলিমীন’ যার অর্থ মদিনাতে মুসলিম ও ইহুদীরা মিলে একটি উম্মাহ গঠন করেছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা কতিপয় কারণে অগ্রহণযোগ্য। প্রথম এটা কুরআনে বিধৃত উম্মতের ধারণার বিপরীতপন্থী দ্বিতীয়ত: এটা সংবিধানের প্রথম ধারার সাথে সাংঘর্ষিক যেখানে মুসলমানদেরকে বিশ্বাসী ও অনুসারীদের একটি দল বা উম্মত বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের বিপরীত দল হিসাবে ইহুদীও দেবদেবী পূজারীদের ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষ, সমস্ত সংবিধান জুড়ে ইহুদীদের মুসলমানদের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে, কখনো ইহুদীদের মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে উল্লেখ করা হয়নি। যখন উভয় দলকে একইসাথে উল্লেখ করা প্রয়োজন হয়েছে, তখন মদীনা সংবিধান ‘আহল হাদিহী আল সাহিফাহ (চুক্তির লোকসমষ্টি) শব্দটি ব্যবহার করেছে। তাই বনি আউফ সম্প্রদায়ের ইহুদীদের মুসলমানদের পাশাপাশি আলাদা উম্মাহ হিসাবে বুঝতে হবে। আল ফারুকীর মতে মুসলিম উম্মাহ’র সংজ্ঞা হচ্ছে:
‘একটি সংগঠিত লোকসমষ্টি; যারা ভূখণ্ড, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়; তারা সামগ্রিকভাবে সার্বজনীন, এবং সামষ্টিক জীবনের অঙ্গীকারে দায়বদ্ধ এবং এ উম্মাহ ধারণার সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের ইহকালীন জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দের বিধান এবং স্থান কালের পরিসীমায় ঐশী ইচ্ছার বাস্তব রূপায়ন স্বরূপ অভিহিত করা হয়েছে’।–[ ইসমাইল রাজী আল ফারুকী, ‘Tawhid: Its Implications for Thought and Culture’ (হারনডন, International Institution of Islamic Thought, 1982) পৃ. ১২০-২১]
উম্মাহর অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্যসমূহ
সংজ্ঞার দিক থেকে একটি জনসমষ্টি, যাদের কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে এবং যারা কতিপয় শর্ত মানতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা, রক্ষক, পালনকারী ও প্রভু ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে উম্মাহর মুসলিম সদস্যবৃন্দ –অন্য সবার চেয়ে আলাদা ও ভিন্ন। বিশ্বাসীরা নিজেদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় ঐখ্য গড়ে তোলে অবিশ্বাসীদের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান জ্ঞাপন করবে। তাঁরা আল্লাহর সার্বভৌম একত্ব ও মোহাম্মদ (সা)-এর শেষ নবুয়তে বিশ্বাসী। তারা আল্লাহ প্রেরিত কুরআনকে প্রত্যাদিষ্ট বাণী হিসাবে গ্রহণ করে, শরীয়াহ অনুসরণ করে এবং নির্দিষ্ট আনুষ্ঠাতিক ধর্ম পালন করে। দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে, শরীয়াহ অনুসরণ করে এবং নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করে। দ্বীন ইসলাম হচ্ছে উম্মতের জন্য নির্যাস স্বরূপ, যা উম্মতের সকল সদস্যকে একটি সমগ্রতার বাঁধনে আবদ্ধ করে এবং মানব জাতির অন্য অংশ থেকে নিজেদের আলাদাভাবে উপস্থাপন করে। মদীনা সনসে ইহুদীদের আলাদা উম্মাহ হিসাবে ঘোষণা করাহয়েছে, কারণ তারা পৃথক ধর্মে বিশ্বাসী এবং ভিন্ন আদর্শ পালন করে থাকে।
দ্বিতীয়ত: ইসলাম উম্মাহকে স্বাতন্ত্রিক পরিচয় প্রদান করেছে, যার স্বরূপ সার্বজনীন। কুরআন মুক্ত ও সমুন্নত কন্ঠে ঘোষণা করেছে যে, সকল মানুষ একই আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়া হতে এসেছে; অতঃপর বিভিন্ন গোত্র ও জাতিকে বিভক্ত হয়েছৈ, যাতে পরস্পরের সাথে সৌহার্দ রচনা করে সমৃদ্ধ হতে পরে (৪৯:১৩)।
প্রথম হতেই কুরআন ও মহানবী (সা) সমগ্র মানব জাতিকে আহবান করেছেন। ইসলামের সার্বজনীন ভিত্তিরউপর সংস্থাপিত মুসলিম উম্মাহর চরিত্র সার্বজনীন হতে বাধ্য। মুসলিম উম্মাহ কোন সম্প্রদায়, শ্রেণী বা বর্ণে বিভক্ত নয়। পক্ষান্তরে সমগ্র মুসলমানকে এর আওতাভুক্ত করার অবিরাম প্রয়াস রয়েছে। কুরআন ঘোষণা করে ‘তোমার এ উম্মত হচ্ছে একটি উম্মাহ’ (২১:৯২; ২৩:৫৩) এবং ফলে এ উম্মাহকে ঐশী ইচ্ছার বাস্তবরূপ প্রদান করতে হবে। উম্মতের বিশ্বজনীনতা ঘোষণা করার অর্থ অবশ্য এ নয় যে মানুষেল স্বাভাবিক গোত্র বা সম্প্রদায় থাকতে পারবেনা বা প্রশাসনিক সুবিধা ও দক্ষতার জন্য ভূখণ্ডগত বিভক্তি বা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে পারবে না। অবশ্য এ ধরনের সম্পদায়গত পার্থক্য বা প্রশাসনিক বিভক্তি চূড়ান্ত কিছু নয়, বরং শরীয়াহর নির্দেশ সবার জন্য প্রযোজ্য এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের উদ্যোগই চূড়ান্ত শরীয়াহর নির্দেশ সবার জন্য প্রযোজ্য এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের উদ্যোগই চূড়ান্ত লক্ষ্য। মুসলিম উম্মাহ জীবতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক বা ভাষাগত ঐক্যের বা অনৈক্যের কোন বিষয় নয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিসত্তামূলক যে আপাত দৃশ্যমান অনৈক্য দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে তার তলদেশে ইসলামী সভ্যতার মৌলিক ঐক্যসূত্র বিরাজ করে, যা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে একটি ঐক্যবদ্ধ সুসংহত রূপ প্রদান করেছে। মুসলিমগণ বিভিন্ন ভূখণ্ডে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে পারে, তবে কলেমা শাহাদাতের উচ্চারণ ও শরীয়াহ পালন সমস্ত ভিন্নতাকে বিলীন করে দিয়ে প্রত্যেক মুসলিমকে উম্মাহর একইরূপ সদস্যে পরিণত করেছে।
তৃতীয়ত: মুসলিম উম্মাহ বিশ্বজনীনতার সাথে সাথে একটি সুসংবদ্ধ সামগ্রিকতা, যার প্রতি অংশ অন্য অংশের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়ে একটি সমন্বিতরূপ ধারণ করেছে। বিশ্বাসী নরনারীগণ একে অন্যের ‘আওলিয়া’ (৯:৭১)। তারা একে অন্যের জন্য ‘আনমার’ (সহায়তাকারী) ও ‘আওয়ান’ (সাহায্যকারী)।–[ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর আল তারাবী ‘Jami al Bayan fi Tafsir al-Quran’ (বৈরুত, দার আল মারিফাহ, ১৯৭২) ভলিউম: ৯-১০; পার্ট ১০, পৃ: ১২৩] তাদের হৃদয় বন্ধুভাবাপন্ন যে একে-অন্যকে পরস্পর ভালবাসে।–[ আবু আবদ আল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবী, ‘Al-Jami li Ahkam al-Quran’ (বৈরুত, Dar lhya al Tutath al Arabi, (১৯৫৯) ভলিউম-৪, পার্ট-৮, পৃ: ২০৩]
‘এ ওয়ালা’ শব্দটি আরো গাঢ়ভাবে সুসংবদ্ধ হয়েছে ‘উখুওয়াই’ (ভ্রাতৃত্ব) শব্দটি দ্বারা। ‘বিশ্বাসীরা একে অন্যের ভাই এবং আল্লাহকে কেন্দ্র করে তাদের হৃদয়সমূহে একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রবাহিত (৪৯:১০; ৪৮:২৯)। এ ভ্রাতৃত্ব, ধর্ম (দ্বীন) ও পবিত্রতা (হুরমাহ) এবং পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সহযোগীতার দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।–[ আবু আবদ আল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবী, ‘Al-Jami li Ahkam al-Quran’ (বৈরুত, Dar lhya al Tutath al Arabi, (১৯৫৯), ভলিউম-৮; পার্ট ১৬; পৃ: ৩২২-৩]
ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রকাশ পায় জামাতবদ্ধভাবে নামাজ আদায়, এক মুসলমান ভাই অন্য মুসলমান ভাইয়ের দাওয়াত গ্রহণ ও পরলোকগত মুসলমানের মৃতদেহ বহনের মাধ্যমে। অন্য কথায় মুসলমান সমাজের প্রত্যেক সদস্য একে অন্যের উপর নির্ভরশীল এবং সবাই মিলে একক ঐক্য গঠন করেছে। মুসলমান উম্মাহর সামগ্রিক ঐক্য ও সংহতি দুনিয়ার বুকে আল্লাহর সাক্ষ্য হিসাবে বিদ্যমান। এর অর্থ নিহিত নবী করিম (সা) এর এ হাদীসে, যেখানে তিনি উম্মাহকে একটি মানবদেহের সাথে তুলনা করেছেন। এটা সে তুলনার সাথেও সাদৃশ্যমান যেখানে উম্মাহকে একটি প্রাসাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে,যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে তোলে।–[ আবু মূসা’র সূত্রে আল বোখারী ও মুসলিম শরীফের এই হাদীসটি মোহাম্মদ আসাদ কর্তৃক উদ্ধৃত হয়েছে ‘The Principles of State and Government in Islam’ (জিব্রালটার, দারআল আন্দালুস, ১৯৮০) পৃ: ৩১] নবী করিম (সা) কে ঘিরে সমস্ত উম্মত আঙ্গুরের মত সমবেত হয়ে হস্তে রূপান্তরিত হয়েছে। মহানবী এ বিষয়ের গুরুত্বের উপর বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যতক্ষণ তোমরা ঈমান না আন, ততক্ষণ তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা; আর যতক্ষণ তোমরা পরস্পরকে ভালো না বাস, ততক্ষণ তোমরা ঈমান অর্জন করতে পারবেনা’।–[‘The Principles of State and Government in Islam’ (জিব্রালটার, দারআল আন্দালুস, ১৯৮০) জারীর ইবনে আবদ আল্লাহ’র সূত্রে বোখারী মুসলিম শরীফের হাদীস, পৃ: ৮৯] মহানবী (সা) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, কেউ কারো ক্ষতি করে না বা একে অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।–[‘The Principles of State and Government in Islam’ (জিব্রালটার, দারআল আন্দালুস, ১৯৮০) আবদ আল্লাহ ইবনে উমর এর সূত্রে বোখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস, পৃ: ৩১]
চতুর্থত: উম্মতের সামগ্রিক প্রকৃতির উপর জোর প্রদান করতে গিয়ে ইসলাম সংঘবদ্ধ তথাকথিত ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব উপস্থাপন করেনি, অথবা ব্যক্তিগত বাড়াবাড়িকে স্থান দেয়নি। বরং ইসলাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা ও সামষ্টিকতাবাদের মধ্যে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় স্থাপন করেছে। শরীয়াহ ‘ফরজে আইন’ ও ‘ফরজে কেফায়া’ ধরনের কার্যাবলরি বিভক্তিকরণের মাধ্যমে সামষ্টিক প্রচেষ্টা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। উম্মাহর শেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তার বিকাশ, তবে এ বিকাশ পাশ্চাত্য অর্থে সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের বিকাশ নয়। বরং আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য উম্মাহর রাজণৈতকি ঐক্যবদ্ধতা। ইসলামে রাজনীতি অর্থ আল্লাহর রাজনীতি, বিশ্বাসীরা হচ্ছে আল্লাহর দল (হিযবুল্লাহ), যাকে কোরানে উম্মাহর সামষ্টিক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত করা হয়েছে (৫:৫৬)। রাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ, আনুগত্য একমামত্র আল্লাহর প্রাপ্য, যিনি একমাত্র সার্বভৌম শক্তি। ইসলামে রাজনীতি শরীয়ার বিধি বিধানের অধীন। উম্মতের সাধারণ বিষয়গুলি পারস্পরিক আলোচনার (শুরা) মাধ্যমে নির্ধারণ ও নিষ্পত্তি করা হয়। ইজমার মাধ্যমে ঐকমত্য স্থাপিত হয়। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসমূহ শুরা ও ইজমার মাধ্যমে শরীয়াহকে বাস্তবায়ন করে। এ অর্থে উম্মাহ হচ্ছে এমন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থঅপনা, যা খিলাফত নামে অভিহিত।–[আল ফারুকী, ‘Tawhid’, পৃ: ১৭২।
উম্মাহ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পার্থক্য ভালোভাবে বুঝা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে উম্মাহ’র রাজনৈতকি পরিপ্রেক্ষিত এবং দুটি বিষয়ের অভিন্ন ভূখণ্ডগত সীমারেখা না’ও থাকতে পারে।] এ প্রতিষ্ঠান ঐশী সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সমস্ত উম্মতের জন্য এ ছিল ঐক্যসূত্র।
উম্মাহর কার্যাবলী
উম্মাহর একত্বকে নির্দেশ করার জন্য কুরআন কাবা শরীফকে কিবলা ঘোষণা করেছে, এর প্রতীকি ব্যাঞ্জনা হিসাবে হজ্বের বিধান দিয়েছে ও জিহাদের মাধ্যমে উম্মতের উদ্দেশ্য চরিতার্থের কথা বলেছে। এ তিনিটি শব্দ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং উম্মাহ প্রসংগে কুরআনে এ তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে (২:১৪৩;১৪৫; ২২: ৭৭=৭৮)। যেহেতু উম্মাহর গঠন ও জীবনের উপর কুরআনের বক্তব্য রয়েছে তাই এর কার্যাবলী সম্পর্কে কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
সাইয়েদ মওদুদীর ভাষায়, উম্মাহ যে জন্য হয়েছে তার মূল কারণ হচ্ছে সমগ্র মানবসমাজের সামনে মুসলিম উম্মাহর আল্লাহর প্রদত্ত নির্দেশনা মোতাবেক সত্যের সাক্ষ্য হিসাবে দণ্ডায়মান হওয়া।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘Witness Unto Mankind; The Purpose and Duty of the Muslim Ummah, অনুবাদ ও সম্পাদনা খুররম মুরাদ (লেইসেসটার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৬) পৃ: ২৭।] কুরআন ঘোষণা করে:
‘এবং আমরা তাই মধ্যপন্থী (ওয়াসাত) উম্মত হিসাবে তোমাদের গঠন করেছি, যাতে তোমরা সমগ্র মানবজাতির সামনে সত্যের সাক্ষ্যবাহী হতে পার এবং রাসূল তোমাদের সাক্ষ্য হতে পারেন (২:১৪৩)’।
শাহাদাতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে। এ ইসলামী ঘোষণা করে যে আল্লাহ ছাড়া এবাদতের যোগ্য কোন মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ (সা) তার প্রেরিত রাসূল। শাহাদাতের মাধ্যমে সমগ্র সত্য বিঘোষিত হয় এবং মানবজীবনসহ সমগ্র কিছু আল্লাহর ঐশ্বরিকতার সামনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। সাইয়েদ মওদুদীর ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে:
মানুষকে সঠিক জীবন শিক্ষা দেয়া, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য সঠিক আচরণ বিধি পালন করা, তাদের যে সব কাজ করা উচিৎ এবং যেসব কাজ পরিহার করা উচিৎ ও তাদের যে সব কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে সে বিষয়ে শিক্ষা ও সাক্ষ্য দেয়া।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘Witness Unto Mankind; The Purpose and Duty of the Muslim Ummah, অনুবাদ ও সম্পাদনা খুররম মুরাদ (লেইসেসটার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৬) পৃ: ২৯।] সত্যের সাক্ষ্য কথা ও কাজে প্রমাণ করতে হবে। প্রথমটি করতে হবে বক্তব্য, লিখনী, যুক্তিপূর্ণ উপস্থাপনা, বিশ্বাসযোগ্যথা, সাক্ষ্য তথা শিক্ষা, গণসংযোগ ও প্রচারণার মাধ্যমে। কার্য দ্বারা সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে নিজের বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ব্যক্তিজীবন ও সামষ্টিক জীবনকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে তা ইসলামের জীবন্ত প্রতিবিম্বে পরিণত হয়। সক্রিয়ভাবে জিহাদে অবতীর্ণ হতে হবে যাতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সকল কিছুর ঊর্ধ্বে ঐশী নির্দেশ স্থান পায় ও বাস্তবায়িত হয়।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘Witness Unto Mankind; The Purpose and Duty of the Muslim Ummah, অনুবাদ ও সম্পাদনা খুররম মুরাদ (লেইসেসটার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৬) পৃ: ৩১-২।]
সূরা ২ এর আয়াত ১৪৩-এ তাফষীরকারকগণের মতে ‘ওয়াসাত’ শব্দটিকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অর্থে দাঁড়িপাল্লার সমান দুই দিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর অর্থ ইহুদীদের মত কঠিন অনড়তা এবং খ্রিষ্টানদের মত সবকিছুতে আপোষকামিতা নয় বরং ইসলামে এসব পরিহার করা হয়েছে। মুসলমানরা নবী করিম (সা) এর নিকট নাজিলকৃত ‘সরল সঠিক পথ’ (সিরাতুল মুস্তাকীম) অনুসরণ করে।–[ আল তাবারী, ‘Jami al-Bayan fi Tafsir al-Quran’ ভলিউম-২, পার্ট-১; পৃ: ৬] জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে মুসলমানদের সুবিচারের সাথে বাড়াবাড়ি চিহ্নিত করে তা পরিহার করে সরল সহজ পথে চলতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে রোগ চিহ্নিত করণের মত এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে কার্যক্ষেত্রে ঔষধ প্রয়োগ তথা সরল পন্থা অনুসরণ করা।
সূরা ২২ এর আয়াত ৪১ এ ব্যক্ত হয়েছে ‘তাদের (মুসলমানগণ) যখন আমরা ক্ষমতা প্রদান করি তখন তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, পূণ্যকাজ করে ও পাপকাজ পরিহার করে। পরিশেষে সকল কিছুর ফায়সালা আল্লাহর নিকট’
উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী এ দুনিয়ার বুকে উম্মতের কাজ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে এমন সমাজ-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যাতে কার্যকরভাবে পাপকে প্রতিহত করা যায় এবং পুণ্যকে লালন করা যায়। এখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই বর্ণিত হয়েছে।
এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একে অন্যের উপর কোনরূপ শাসন জুলুম করবেনা, বহিঃশত্রুকে মোকাবেলা করবে, কুরআন ও সুন্নার উল্লেখিত সুসমন্বিত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কায়েম করবে।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’, অনুবাদ ও সম্পাদনা : খুরশীদ আহমদ (লাহোর, ইসলামিক ফাবলিকেশন্স, ১৯৭৫) পৃ: ১৫১] সূরা ৩ এর আয়াত ১০৪-এ মর্মে বলা হয়েছে যে, তোমরা পরিণত হও সে উম্মতে, যারা ভালোর দিকে আহবান করবে, পূণ্যকে উৎসাহিত করবে এবং পাপকে প্রতিরোধ করবে। এ কাজের জন্য তোমরা সুনির্বাচিত (এবং এর জন্য রয়েছে পরকালীন সুখ)’। ইউসুফ আলীর মতে উক্ত আয়াতে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের কথা ব্যক্ত হয়েছে।
এর তাৎপর্য হচ্ছে ১. ঈমান আনয়ন করা ২. সঠিক ও ন্যায় কাজ করা, অন্যের জন্য সৎকাজ করার উদাহরণে পরিণত হওয়া, সে ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাতে সৎ কাজ বিরাজ করে ৩. পাপ কাজকে প্রতিহত করা এবং অন্যের জন্য অসৎকাজ প্রতিহত করার উদাহরণে পরিণত হওয়া এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাতে অন্যায় ও অবিচার পরাজিত হয়।–[ এ. ইউসুফ আলী ‘The Holy Quran Text, Translation and Commentary (লেইসেসটার, দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৭৫): পৃ: ১৫১]
উপরের উদ্ধৃতি ও তাফসীরকারদের ব্যাখ্যা হতে এটা সুস্পষ্ট যে, ন্যায়ভিত্তিক আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন ও মানুষের জন্য তা সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপন করা পরস্পর নির্ভরশীল এবং একটি ব্যতিরেকে অন্যটি সম্ভব নয়।
সাক্ষ্য হিসাবে নিজকে উপস্থাপন সমগ্র উম্মতের জন্য প্রযোজ্য। তবে শব্দ সমষ্টি ‘তোমরা সেই উম্মায় পরিণত হও’ যা দ্বারা সমগ্র উম্মতকে বোঝাতে পারে অথবা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ হিসাবে একটি দলকে বোঝাতে পারে, যারা শরীয়াহর দিকে মানুষকে আহবান করার দায়িত্বভার বহন করবে এবং বাড়াবাড়ি পরিহার করে জীবনকে সুসমন্বিত করবে। আল তাবারী ও আল কুরতবী দ্বিতীয় ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন এবং ইবনে তাইমিয়া ইবনে খালদুন ও সমকালীন তফছীরকারগণ প্রথম ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। করো কারো মতে কুরআনের আয়াত ১২২ অনুযায়ী আল কুরআন মুসলমানদের মধ্যে একটি দল গঠন করার আহবান করেছে, যারা ঈমান আকিদা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জণ করবে এবং প্রচারের মাধ্যমে লোক শিক্ষা প্রদান করবে। কিন্তু একটি দল কর্তৃক ঈমান ও আকিদা সম্পর্খে জ্ঞান অর্জন প্র প্রচার দ্বারা সমগ্র উম্মতের সাক্ষ্য হওয়া হয়ে উঠে না। পক্ষান্তরে কুরআন সত্যের সাক্ষ্য প্রদানের জন্য বিশেষ দল গঠনের ধারণাকে পরিহার করেছে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে, বিশ্বাসী নরনারীগণ একে অন্যের বন্ধু ও সহধর্মী; তারা সত্যের পতাকাকে সমুন্নত করে এবং পার কর্মকে প্রতিহত করে, সালাম কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও তার রাসূলকে মান্য করে- তাদের উপর আল্লাহ তার অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন, কেননা আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ’।
এ ধরনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার প্রেক্ষিতে ইমাম ইবনে তাইমিয়া অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা দান হচ্ছে সকল সরকারের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ কার্যে সকল সক্ষম মুসলমানের জন্য ফরজ। সামগ্রিকভাবে সমস্ত উম্মতের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত এবং উম্মত কর্তৃক নির্বাচিত দল এ কাজের আনজাম দিতে পারে। এই কাজ না করা হলে প্রত্যেক মুসলমান নরনারী ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবে।–[ কমরুদ্দীন খান, ‘The Plitical Thought of Ibn Taymiyyah’ (লাহোর ইসলামিক বুক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৩), পৃ: ১২৩-২৪]
সমগ্র উম্মতের সাক্ষ্যদানের বিষয়টির নানা তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত এটা বুদ্ধিজীবী অভিজাত শ্রেণী তৈরীর ধারণাকে বাতিল করে। এ ধারণাটি কুরআনের দৃষ্টিতে এতই গর্হিত যে কুরআন সুস্পষ্টভাবে ‘বিশ্বাসী নরনারী’ শব্দের ব্যবহার দ্বারা সবার সাক্ষ্য দান বুঝিয়েছে। এ দায়িত্বশীলতা প্রশ্নটি কুরআনে উল্লেখিত উম্মাহ শব্দের সাথে সঙ্গতিশীল; কেননা তৌহিদী উম্মাহ হচ্ছে বিশ্বজনীন, সদৃচ্ছা, সহযোগীতা ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সামগ্রিক ও বৈষম্যহীন। পরিশেষে সমগ্র ইতিহাসব্যাপী উম্মাহ কর্তৃক এই দায়িত্বভার গ্রহণ মুসলিম জাহানে বিপ্লব ও পরিবর্তনের চাকাকে সচল রেখেছে।
মুসলিম উম্মাহঃ একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মুসলিম উম্মতের উৎস সূদুর অতীতে সমাধিস্থ নয় অথবা এর জন্য কোন দার্শনিক তত্ত্ব নির্মাণের প্রয়োজন নেই। নবী করীম (সা) এর জীবন হতে এ উম্মত ধীরে ধীরে জন্মলাভ করেছে। তাঁর একনিষ্ঠ সংগ্রাম ও তাঁর সাহাবীদের জীবন গাঁথায় উম্মতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদার সময়কাল
নবী করিম (সা) এর আহবানে যে ক্ষুদ্র দলটি প্রথমে সাড়া দিয়েছিল তাদের নিয়ে উম্মতের সূত্রপান হয়। নবী সমধর্মিনী খাদিজা,তাঁর চাচাত ভাই আল ইবনে আবু তালিব, তাঁর বন্ধু আবু বকর এবং তাঁম মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস জায়েদ ইবনে হারিছাহ উম্মতের প্রথম ক্ষুদ্র দলটি গঠন করে, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা)। ৬১০-৬২২ খ্রি. এ অন্যান্য অনেকে তাদের সাথে যোগ দেন। তারা কালোম-শাহাদান উচ্চারণ করে ‘আল্লাহ নির্ধারিত পন্থায়’ জীবনকে গঠন করেন (২:১৮৭)।
পৌত্তলিক মক্কার বণিক সমাজে মুসলিম উম্মাহ একটি সংকীর্ণ আবর্তে ছিল। মক্কার শীর্ষস্থানীয় গোত্র কোরাইশ নতুন উম্মতের সদস্যদের উপর কঠোর অত্যাচার-নির্যাতন চালনা করে, মক্কানগরী থেকে অনেককে বহিষ্কার করে এবং অবশেষে নবী করিম (সা) কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহর নির্দেশে নবী করিম (সা) তার সাহাবাদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে মদীনায় হিজরত করেন এবং এভাবে ইসলামী সভ্যতার উন্মেষ ঘটে।–[মদীনায় রসূলুল্লাহ (সা) হিজরতের পূর্বে দু’বার শপথ বা ‘বায়াহ আল আকাবাহ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমবার রাসূলুল্লাহ (সা) ১২ জন লোকের সাথে মিলিত হয়েছিলেন যারা তৌহিদ বিশ্বাসে শপথ গ্রহণ করে। এক বৎসর পরে দ্বিতীয় ‘বায়াত’ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী উপস্থিত ছিলেন। এই শপথ ছিল তৌহিদে বিশ্বাস স্থাপন, নৈতিকতা মেনে চলা, রাসূলুল্লাহ (সা) এর অনুগত থাকা, উভয় পক্ষের পরস্পর সাহায্য ও সহযোগীতা এবং সত্যের প্রকাশে পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ। উল্লেখ্য, দুটি বায়াতের পূর্বে ৬ জন লোকের সাথে আর একটি ‘বায়াত’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্রষ্টব্য আবদ আল মালিক ইবনে হিসান (বৈরুত, আল খায়াত, ১৯৬৭), পৃ: ৬৩-৬৪] এ হিজরতের মাধ্যমে মুসলিমগণ এক ভূখণ্ড ভিত্তি লাভ করে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করে এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতার ইসলামী মূল্যবোধ দ্বারা আরবীয় জটিল গোত্রীয় প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ ও বিবর্তিত করে।–[ জাকারিয়া বশীর, ‘Hijra : Story and Significance’ (লেইসেসটার, দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৩), পৃ. ১০১-১০৩] সংক্ষেপে হিজরতের সাথে সাথে একটি নতুন জীবনধারা, নতুন জনগোষ্ঠী ও নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা জন্মলাভ করে –যার ভিত্তিতে ছিল তওহীদী উম্মতের বিশ্বজনীনতা।
মদীনায় আগমনের পর নবী করিম (সা)-এর অন্যতম প্রধান কাজ হলো মুসলমানদের মধ্যে জোড়ায় জোড়ায় ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক (মুয়াকাত) রচনা করা, যে সম্পর্ক ছিল রক্তের সম্পর্কের চেয়েও ঘনিষ্ঠ। নবী করিম (সা) আলীকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করে উদাহরণ স্থাপন করলেন। রাসূলুল্লাহর চাচা হামজার ভাই হলেন রাসূলুল্লাহ মুক্ত দাস জায়েদ ইবনে হারিসা। অন্যেরা এই উদাহরণ অনুসরণ করল (ছক ৫:১)
ছক ৫.১ নবী করিম (সা) কর্তৃক স্থাপিত জোড় ভ্রাতৃত্ব
আবু বকরের সাথে খারিজা ইবনে জুবাইর-
উমরের সাথে ইতরান বিন মালিক-
আবু উবাইদা আমির ইবনে আবদুল্লাহ-এর সাথে সাদ ইবনে মুয়াব ইবনে আল নুমান আবদুর রহমান ইবনে আউফের সাথে সাদ আল রাবি
আল জুবাইর ইবনে আওয়ামের সাথে সালামা ইবনে সালামা ইবনে ওয়াক্কাস
উসমান ইবনে আফফান এর সাথে আউস ইবনে সাবিত ইবনে আল মুনধীর
তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ এর সাথে কাব ইবনে মালিক
সাদ ইবনে জায়ীদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল এর সাথে উবাই ইবনে কা’ব
মাসুদ ইবনে উমরের সাথে আবু আইয়ুব খালিদ ইবনে জায়িদ
আবু হুজাইফা ইবনে উতবা এর সাথে আব্বাস ইবনে বিশর ইবনে ওয়াক্কাস
আম্মার ইবনে ইয়াসীন (বনি মাখজুম এর মিত্র) এর সাথে হুজায়ফা ইবনে ইয়ামান
আবু দার বুরাইর ইবনে জুনাদা আল গিফারী এর সাথে আল মুনধির ইবনে আমর
হাতিব ইবনে আমি বালতা (বনি আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জার মিত্র) এর সাথে উওয়াইম
ইবনে হাতিব ইবনে সাদিয়াব (বতি আমর ইবনে আউফের ভ্রাতা)।
সালমান ফারসী এর সাথে আবু দারদা/বিলাল (হযরত আবু বকর কর্তৃক মুক্ত মানব) এর সাথে আবু রুয়াইয়া আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ রাহমান আল খাতাবী।
(সূত্র: ইবনে ইসহাক; The life ofMohammad’/Alfred Guillaume কর্তৃক ইবনে ইসহাকের সীরাতে রাসূলুল্লাহ গ্রন্থের অনুবাদ (লন্ডন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৬৭, পৃঃ ২৩৪-৫)
এর পরেই প্রবর্তিত হয় হজ্ব, জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দেস হতে মক্কার কাবার দিকে কেবলা পরিবর্তন (২:১৪৪)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মদীনার সংবিধান প্রণয়ন ও স্বাক্ষর। এ দলিল সম্পাদনের সাথে দু’টি পৃথক সত্তা সৃষ্টি হলো:
দারুল ইসলাম (শান্তির স্থান) দারুল হরব (যুদ্ধের স্থান)।–[ হেনরী সীগম্যান, ‘The State and the Individual in Sunni Islam’, ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড, ভলিউম-৫৪ (জানুয়ারী, ১৯৬৪)।] মুসলিম উম্মাহর মৌলনীতি সমূহ বিদায় হজ্জের ভালষে বিধৃত যা নিম্নে উদ্ধৃত করা এখানে প্রাসঙ্গিক।–[ মোহাম্মদ হোসেইন হায়কল, ‘The Life of Mohammad’, অনুবাদ: ইসমাইল রাজী আল ফারুকী (কুয়ালালামপুর ইসলামিক বুক ট্রাষ্ট, ১৯৯৩), পৃ: ৪৮৬-৭]ৱ
“হে লোকসকল, আমার কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো, কেননা ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন উপলক্ষ্যে তোমাদের সাথে আমার আর সাক্ষাৎ হবে কিনা আমি জানি না। হে মানব মণ্ডলী, আজ হতে তোমাদের জীবন ও তোমাদের সম্পত্তি স্রষ্টার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত অলংঘিত ঘোষিত হইল। এ দিবস এবং এ মাস যেমন পবিত্র তেমনি তোমাদের জীবন ও তোমাদের সম্পত্তি তদরূপ পবিত্র ঘোষিত হল। স্মরণ রেখো, তোমরা অবশ্যই তোমাদের প্রভৃত সাথে মিলিত হবে এবং তোমাদের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। এ বিষয়ে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিতেছি। যদি তোমরা কারো কাছ থেকে কিছু আমানত প্রাপ্ত হও, তবে প্রকৃত মালিককে সেই আমানত ফিরিয়ে দেবে। সুদ প্রথা অদ্য হতে রহিত করা হল। তবে তোমাদের আসল বজায় থাকবে। তোমরা কেউ বৈষম্য করবেনা, বা বৈষম্যের শিকার হইওনা। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে আজ হতে সুদ অবৈধ এবং আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিব যা কিছু সুদ পেতেন তা প্রত্যাহার করা হলো। প্রাক ইসলামী যুগে হত্যার বদলে বদলা নেওয়ার প্রথা বাতিল করা হলো। এ ধরনের প্রথম যে বদলা আমি বাতিল করছি তা হলো রাবিয়াহ ইবনে আল হারিস ইবনে আবদুল মোত্তালিব এর হত্যার বদলা। হে লোকমণ্ডলী, শয়তান এ ভূখণ্ডে আর কোনদিন কোন উপাসনা পূজা অর্চনা পাওয়ার আশা বিসর্জন দিয়েছে; তদসত্বেও সে তোমাদের কাজকর্মকে লঘু বা হালকা করে দেবার চেষ্টা করবে। তোমাদের ধর্মের খাতিরে তার ষিয়ে সতর্ক হও। হে মানবসমাজ, মাস সমূহের মধ্যে বিভ্রাট সৃষ্টি করা গুরুতর অবিশ্বাসের কাজ এবং এটা অবিশ্বাসীদের বিপথগামী হওয়াকে নিশ্চিত করে। কোন বৎসর তারা একটি কাজ করে। আবার অন্য বৎসর তা করা হতে বিরত থাকে; তারা এরূপ করে আল্লাহ যা অনুমোদন করেছেন তা বাতিল করার জন্য, আর যা বাতিল করেছেন তাকে অনুমতি দেয়ার জন্য। সে ভাবে সময় গণনা করা হয়, তা সব সময় একই রকম। আল্লা মাসকে বারো সংখ্যায় নির্ধারণ করেছেন। চারটি মাস পবিত্র। তিনটি মাস পরস্পর সন্নিহিত এবং অন্য মানটি জুমাদা ও শাবান মাসের মধ্যে। হে লোক মণ্ডলী, স্বামীর নিকট স্ত্রীর অধিকার আছে, স্ত্রীর নিকটও স্বামীর অধিকার আছে। যাদের তোমরা অনুমোদন করোনা তাদের সাথে তারা (স্ত্রীগণ) দেখা সাক্ষাৎ করবেনা এবং তোমরা কখনো জিনায় লিপ্ত হয়োনা। যদি তারা সীমা লংঘন করে তবে তোমরা তাদের শয্যা আলাদা করে দাও, নিষ্ঠুরতা ছাড়া তাদের ভৎসনা করো। যদি তারা তোমাদের অধিকার রক্ষা করে, তবে সহৃদয়তার সাথে তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করো। তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সমাচরণ করো, তাদের প্রতি সদয় থেকো, কেননা তারা তোমদের সহধর্মিনী ও সাহায্যকারী। মতে রেখো তোমরা তাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছো এবং আল্লাহর আমানত হিসাবে ও তার অনুমতিতে তাদের সাথে মিলিত হচ্ছ। আমি তোমাদের যা বলছি তা ভালোভাবে চিন্তা করে দেখো। আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা তা অনুসরণ করো তবে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। হে মানব মণ্ডলী, আমার কথা ভালোভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করো। জেনে রেখো, একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই এবং সকল মুসলমান মিলে একটি ভ্রাকৃসমাজ। কোন মুসলমানের কোন দ্রব্য কোন অন্য মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না যতক্ষণ না সে স্বেচ্ছায় তা প্রদান করে।তাই নিজের নফসের প্রতি জুলুম করোনা। হে আমার প্রভু আল্লাহ? আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিতে পেরেছি?”
বিদায় হজ্বের ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ :
১। ইহা আনুগত্, পরিচয় ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রক্তের বন্ধনকে বাতিল ঘোষণা করে;
২। ইহা সুদ এবং সুদ সম্পৃক্ত সকল ব্যবসাকে অবৈধ ঘোষণা করে;
৩। ইহা পারিবারিক সম্পর্ককে ভালোবাসা, সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার উপর স্থাপন করে;
৪। ইহা জীবন, সম্পত্তি ও পরিবারকে আল্লাহর আমানত হিসাবে ঘোষণা করে,যার পবিত্রতা অলংঘনীয়।
৫। ইহা মুক্তির জন্য মুসলমানদের শরীয়াহ অনুসরণের নির্দেশ দেয়। মহানবী কর্তৃক এই ভাষনের সকল বক্তব্য আল্লাহকে সাক্ষী রেখে প্রদান করা হয়।
মুসলিম পণ্ডিতগণের ঐকমত্য এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর শরিয়তী কর্তৃত্ব খোলাফায়ে রাশেদার উপর অর্পিত হয়েছে, যারা নিজেরা আইন প্রণয়নের কোন ঐশী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না অথবা তা ঘোষণা করারও কো নবুয়তী কর্তৃত্ব রাখতেন না।–[ Albert, Hourani, ‘Arabic Thought in Liberal Age (লন্ডন: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭০)। পৃ. ৫] ঈমান আকিদার সংরক্ষণ ও দুনিয়াবী শাসক হিসাবে তাদের দায়িত্ব ছিল রাসূলের ঐতিহ্যকে বজায় রাখা ও শরীয়ার মাধ্যমে ধর্ম, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও উম্মাহকে পরিচালনা করা। এই সীমাবদ্ধ অর্থে তাঁরা ছিলেন নবীদের উত্তরসূরী এবং উম্মতের উপর তারা এভাবে নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতেন। খলিফাগণ উম্মতের ঐক্যের সূত্র হিসাবে রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক ছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী সময়ে উম্মাহ
নবী করিম (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদার ঈমান, ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠার স্বর্ণযুগে উম্মাহ মুসলেমীন এক রাজনৈতিক ঐক্যের ছত্রছায়ায় একতাবদ্ধ ছিল। সময়ের বিবর্তনে মুসলমানদের সহজ সরল জীবন ও গভীর ধর্মপরায়ণতার স্থান দখল করে নেয় শান শওকত, বিলাসিতা ও শরীয়াহ পালনে শিথিলতায়। বিশ্বভ্রাতৃত্বের ইসলামী মূল্যবোধ ও গোত্রীয় প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব। উমাইয়ারা ক্রমান্বয়ে খারেজী, শিয়া, আইন শাস্ত্রবিদ ও অনারবদের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। উমাইয়া শাসনের আর্থ-সামাজীক ও রাষ্ট্রীক অবক্ষয় ও পতনের সাথে তারা মদীনার স্বর্ণযুগের তুলনা করে গভীর সমালোচনায় লিপ্ত হয়। শেষের দিকে উমাইয়ারা আরব ও অনারবদের সম্মিলিত করে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিশ্বজনীনতার দিকে ফিরে যাবার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু এ পদক্ষেপ মাওয়ারী ও অনারব মুসলমানদের সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত করতে অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা আব্বাসীয়দের সাথে মিলিত হয়ে হিজরী ১৩২ সনে (৭৫০খ্রি.) উমাইয়া শাসনের পতন ঘটানো হয়। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন লাভ করে আব্বাসীয়রা ধর্মপরায়ণতাকে তাদের শাসনের ভিত হিসাবে ঘোসণা করল এবং গোত্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ধর্মকে রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করল। সাইয়েদ আমীর আলীর মতে সামাজীক সাম্যতার নীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে আব্বাসীয় যুগকে পাঁচ শতাব্দী ব্যাপী প্রলম্বিত করল অতঃপর বর্বর আক্রমণের মুখে তার পতন ঘটল।–[ সাইয়েদ আমীর আলী, ‘A Short History of The Saracens (লন্ডন, ১৯৩৪); পৃ. ৪০৩
] অবশ্য আমীর আলীর বিশ্লেষণটি ভ্রান্তিমূলক। প্রথম সাতজন খলিফার শাসনামলে (হিজরী ১৩২-২১৮ সন/ ৭৪৯-৮২৮ খ্রি.) আব্বাসীয় খিলাফত শীর্ষ শিখরে আরোহন করল, যার অত্যুত্তরে নজীর হচ্ছে বিখ্যাত খলিফা হারুন-আল রশীদের রাজত্বকাল হিজরী ১৭০-১৯৪/৭৮৬-৮০৯খ্রি.)।
অতঃপর ধীরে ধীরে গোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বীতা, রাজনৈতিক সংঘাত, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হলো ও খিলাফতের কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে লাগল। হিজরী ৩৯০ সন. ১০০০ খ্রি. এর দিকে আব্বাসীয় রাজত্ব ফাতিমী, হামদানী, বুওয়েহিদ, সামানীফ ও গজনভী সুলতানাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন শাসকদের কাজ ও উদ্দেশ্যে কোন ঐক্য ছিলনা, এবং তাদের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রতি আনুগত্যও ছিল না। প্রকৃতপক্ষে হিজরী ১৩২ সন/৭৫০ খ্রি: হতে শুরু করে হিজরী ১৩৪৩ সন/১৯২৪ খ্রি. সনে অটোম্যান খিলাফতের অবসান পর্যন্ত মুসলমানদের ইতিহাস ছিল দারুল ইসলামের রাজনৈতিক বিভক্তি এবং অবশেষে খিলাফত ব্যবস্থার অবসান। খিলাফত ব্যবস্থার অবসানের ফলে উম্মাহ ধ্বংস হয়ে গেছে বলা চলে না। ইবনে তাইমিয়ার মতে একক ও বিশ্বজনীন খিলাফত প্রতিষ্ঠার আর কোন ঐক্যসূত্র বজায় ছিল না। তাই মুসলমানদেরউতিচ স্ব স্ব অঞ্চলে শরিয়ার অনুসরণের স্বাধীন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব গঠন করা। তারপর কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে উম্মতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করা।–[ কমরুদ্দিন খান, ‘The Political Thought of Ibn Taymiyah, পৃ: ১৩০]
সমকালীন পণ্ডিতগণ খিলাফতের আদর্শ তত্ত্ব থেকে স্খলনের জন্য অতীতের অধিকাংশ মুসলিম আইশাস্ত্রবিদগণের তাত্ত্বিক আলোচনার সমালোচনা করেছেন। সমকারীন পণ্ডিতগণ শরীয়াহর অনুশাসনের প্রয়োগের গুরুত্বের উপর অধিক জোর প্রদান করেছেন, যা উম্মাহর মঙ্গল সাধন করতে পারত। এমনকি যদি বল প্রয়োগের মাধ্যমেও শরীয়ার অনুশাসন জারী করে উম্মতের ঐক্য বজায় রাখা হতো তাও বৈধ। ইবনে তাইমিয়া অবশ্য খলিফার পদবীর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে শরীয়াহর অনুশাসন অনুযায়ী উম্মতের আর্থ-রাজনৈতিক জীবন পরিচালনার উপর জোর দেন। খিলাফতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে শরীয়াহর প্রকৃত অনুবর্তীতার দিকে গুরুত্ব স্থানান্তরিত হয়েছে মর্মে রোজেনথাল যে মত ব্যক্ত করেছিলেন তা সঠিন ছিলনা।–[ ই.আই.জে রজেনথাগাল ‘Studia Semitica’, (ক্যাম্ব্রীজ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭১), ভলিউম: ২ পৃ: ২০৯] বরং গুরুত্ব স্থানান্তরিত হয়েছিল বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসাবে খিলাফতের পরিবর্তে শুধুমাত্র শরীয়াহর মাধ্যমে উম্মতের ঐক্য স্থাপনের দিকে।
একক খিলাফতের পরিবর্তে ইসলামী আইন ও অনুশাসন প্রয়োগের মাধ্যমে উম্মতের ঐক্য রচনাকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। শরীয়াহই যদি মুসলমানদের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতার দিকনির্দেশক এবং ঐক্য সংহতির শক্তিশালী মাধ্যম হয়, তবে ইসমাইল আল ফারুকীর মতে ‘শরীয়াহ যা ইসলামী আইনই বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজের পুরোভাগ ও মেরুদণ্ড উভয় হিসাবে’ পরিগণিত হবে।–[ আল ফারুকী, ‘Tawhid’, পৃ: ১৪৩] ঐক্যের এই অনুভূতি নৈতিক ও সামাজিক সাম্যের পরিব্যাপ্ততা দ্বারা আরো শক্তিশালীভাবে প্রসারিত হয়। মার্শাল হডজশন বলেন, ইসলাম যেখানেই গিয়েছে:
‘সেখানে সকল মুসলমানদের উপর এই আদর্শিক মানদণ্ড গ্রহণের চাপ সৃষ্টি হেছ, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একই ধরনের জীবন যাপন পদ্ধতি চালু হয়েছে,… সর্বত্রই বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি ঐক্য অনুভুতির সচেতনতা লক্ষ্য করা গিয়েছে,… চরম বৈষম্যমূলক ভৌগোলিক অবস্থঅনে বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকচিহ্ন সমূঞ সুস্পষ্টভাবে পরিদৃশ্যমান ছিল… এমনকি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিরাজ করছিল।–[ M.G.S Hodgson, ‘The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization, (শিকাগো, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ১৯৭৪) ভলিউম-১, পৃঃ ৭৫-৮]
মুসলিম বিশ্বের উপর ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্য বিস্তারের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র দারুল ইসলামে বস্তুগত ও উচ্চতর সাংস্কৃতিক একক বিশ্বদৃষ্টি ও ঈমানের একক ঐক্যসূত্র বজায় ছিল।
সমকালীন উম্মাহর অবস্থা
উপনিবেশিক ও সামগ্রিক পাশ্চাত্য আধিপত্যের অবমাননাকর পরিস্থিতিতে, মুসলিম উম্মাহর উপর শুধু রাজনৈতিক দুর্ভাগ্যই নিপতিত হয়নি, তাদের স্বাতন্ত্রের চিহ্ন আদর্শিক ভিত্তিও ক্ষয়ে গিয়েছিল। উপনিবেশিকবাদীরা জাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি বাতিল করে দেয়। শরীয়ার সবকিছু কর্তন করে অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে মুসলিশ পারিবারিক আইনকে যেন তেন প্রকারের অব্যাহত রাখা হয়। শরীয়ার সব কিছুকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়। মুসলিম উম্মাহর আশা-আকাঙ্ক্ষা বিনষ্ট করে তাদের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও হানাহানি বীব বপন করা হয়।
বর্তমানে ৫২টি দেশ রয়েছে যাদেরকে মুসলিম উম্মাহর পরিসরের মধ্যে ধরা যায়। এসব দেশের সংবিধানে বিভিন্ন মাত্রায় ইসলামকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এসব দেশের সমাজদেহে শরীয়াহ ও ইসলামী মূল্যবোধের সম্পৃক্তির মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায় সুদানে শরীয়াহর সামগ্রিক ব্যবস্থাকে দেমের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অপরদিকের বিপরীত উদাহরণ হিসাবে তুরস্ক ১৯২০ সালে ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করা হয়। তাছাড়া বিশ্বের মুসলমানদের এক তৃতীয়াংশ অমুসলিম দেশসমূহে সংখ্যালঘু হিসাবে বসবাস করছে।
জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ফেলা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের বাহক হিসাবে জাতি-রাষ্ট্র ধারণাকে দেশজ নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করে নেন এবং রাজনৈতিক অগ্রগতি ও স্বনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য এ মাধ্যমকে গ্রহণ করেন। বিষয়টি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আদর্শগত বিতর্কের জন্ম দেয়। জাতীয়তাবাদের ও উম্মাহর ধারণার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। জাতীয়তার রয়েছে এলাকাভিত্তিক কতিপয় বৈশিষ্ট্য আর উম্মাহর রয়েছে বিশ্বজনীন মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ধারণা।–[হামিদ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’, (লন্ডন, ম্যাকমিলান প্রেস, ১৯৯২), ছ. ১১২;আরো দ্রষ্টব্য আবদুল্লাহ আল আহসান, ‘Ummah or Nation: Indentity Crisis in contemporary Muslim Society’ (লেইসেসটার: দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯২)]
জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম
চরিত্রের দিক থেকে অস্পষ্ট ও রহস্যময়, জাতীয়তাবাদের ধারণাটি কোন একক সংজ্ঞা নেই। কার্লটন হইয়েছ এর মতে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ‘আধুনিক দু’টি অনুভূতির সম্পৃক্তি-দেশপ্রেম ও জাতীয়তা’; শেফারের মতে এটি হচ্ছে, পৌরাণিক ও বাস্তবতার ভিত্তিতে বিশ্বাস ও অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন সংমিশ্রণ; এবং ম্যানস কোহনের মতে, ‘এটি হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা, একটি সচেতন কর্ম, ব্যক্তি মানুষের ‘আমরা একটি দল’ এ অনুভূতির সাথে একাত্মতা, যা জাতিরাষ্ট্র ধারণার উপজাত’।–[Carlton I. Hayes The Historical Evolution of Nationalism’, (লন্ডন, ম্যাকমিলান, ১৯৩১), পৃ: ৩৭; বয়েড সি শেফার, ‘Nationalism: Its Meaning and History (নিউইয়র্ক, ম্যাকমিলান, ১৯৫৫।, ১; হ্যানস কোহন, ‘Nationalism : Its Meaning and History (প্রিন্সটন: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৫); পৃ: ৩৪] যাহোক এই জাতীয়তাবাদী ‘আমরা’ ধারণাটি বিজাতীয় ‘তাহারা’ ধারণা হতে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। এটা ‘মূলত: একটি বিরুদ্ধ মনোভাব- যা ঘৃণা ও ক্রোধের ভিত্তিতে পরিপুষ্টি লাভ করে এবং কোন প্রতিযোগী দলের বিরুদ্ধে চালিত হয়’।–[জওহর লাল নেহেরু, ‘Toward Freedom’ (নিউইয়র্ক, জন ডে, ১৯৪১)।] জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ এবং এর মৌলবোধ থেকে অন্যান্য আদর্শ বিশেষ করে ধর্মীয়বোধ বিবর্জিত।–[Carlton J. Hoyes, ‘Nationalism A religion’ (নিউইয়র্ক, ম্যাকমিলান, ১৯৬০)।]
‘ইসলামী ঐক্যকে টুকরো টুকরো করে দেয়ার জন্য’ উপনিবেশবাদীরা জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে।–[Shamloo সম্পাদিত ‘Speeches and Statements ofIqbal’ (লাহোর মোহাম্মদ আশরাফ, ১৯৪৮), পৃ: ২২৪] উপনিবেশবাদের শেষের দিকে এ ধারণার গোড়াপত্তন হয় এবং পাশ্চাত্য শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতা লাভের হিসাবে এর ব্যবহার শুরু করে। জাতীয়তাবাদী ধারণা ‘কখনো মুসলিম মূলধারার গণমানসে স্থান লাভ করেনি।–[হামিদ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’ পৃ: ১১৬] জাতীয়তাবাদী ধারণা বিশ্বের মুসলমান অঞ্চরের উপর পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদ অব্যাহত রাখার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
জাতীয়তাবাদী ধারণা ইসলামী ধারণার সমান্তরালে চলে এসেছে। চেতনা ও লক্ষ্যের দিক থেকে তারা পরস্পর বিরোধী। জাতীয়তাবাদের ধারণা বিভিন্নভাবে উম্মাহর ধারণার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রথমত: জাতীয়তাবাদ হচ্ছে এক ধরনের সপ্রশংসিত গোষ্ঠীপ্রীতি, যে ধারণা নবী করিম (সা) প্রত্যাখ্যান করেছেন; সে আমাদের দল ভুক্ত নয় যে নিজকে কোন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মনে করে এবং সেভাবে মৃত্যুবরণ করে’।–[মোহাম্মদ আসাদ কর্তৃক আবু দাউদ-কে উদ্ধৃত, ‘The Principles of State and Government in Islam’ পৃ: ৩২] অন্য একটি হাদীস অনুযায়ী :
‘মানুষ দু’ধরনের: প্রথমত: যারা স্বজ্ঞানে বিশ্বাসী, আর দ্বিতীয়ভাগে সীমালংঘনকারী ও বিপথগামী ছিল। তোমরা সবাই আদমের সন্তান এবং আদম মাটি হতে সৃষ্ট। জাতীয়তাবোধের গর্ব মানুষের পরিত্যাগ করা উচিৎ কেননা এ বোধ হচ্ছে জাহান্নামের কয়লা স্বরূপ। যদি তারা এই বোধ ধারণা পরিত্যাগ না করে তবে আল্লাহ তাদের নীচ কীট হিসাবে গণ্য করে পুতিগন্ধময় পুরিষে প্রবিষ্ট করাবেন’।–[আবুদল্লাহ ইবনে ইয়াজীন আল কাজইউনী ইবনে মাজাহ, ‘Sunan ibn Majah’, মোহাম্মদ ফুয়াদ আবদ আল বাকী কর্তৃক গবেষণাকৃত (বৈরুত দারুল যিকর ওয়াল নসর)]
দ্বিতীয়ত জাতীয়তাবাদ ভাষাগত, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিসত্তাগত ও অন্যান্য সবধরনের ভিত্তির উপর সংস্থাটিত, যা কুরআনে বর্ণিথ উম্মাহর ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। উম্মাহ মুসলিমাহ ভূখণ্ড, ভাষা, জাতি বা ইতিহাস দ্বারা আবদ্ধ নয় এবং এর একমাত্র ভিত্তি তাওহীদ। কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে, তোমাদের এ উম্মাহ একক ও ঐক্যবদ্ধ এবং আমি তোমাদের প্রভু এবং আমার আনুগত্য কর’ (২১:৯২)।
তৃতীয়ত: জাতীয়তাবাদ জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে শুধু নিজের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এমনকি অন্যের ক্ষতির বিনিময়েও। অপরদিকে কুরআন দাবী করে যে, উম্মাহ ভালো ও পুণ্যের উদ্বোধন ঘটাবে ও মন্দকে প্রতিহত করবে, ‘ধর্মভীরুতা অর্জনের জন্য ভালো কাজে’ সহযোগীতা করবে; পাপ, অপরাধ ও আক্রমণকে পরাভূত করার জন্য বিরোধীদের বাধা দিবে (৫:৩)। চতুর্থত: জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের মাঝে সামাজিক বিরোধ ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের দুয়ার উন্মোচন করে হানাহানি বৃদ্ধি করে। জাতীয়তাবাদ মুসলমানদের মূল ঐক্যসূত্র ও বৈশিষ্ট্য উম্মাহর ধারণার ভিত্তি প্রস্তরকে ক্ষয় করে। পক্ষান্তরে উম্মাহ হচ্ছে একটি বৈশিষ্ট্য ব্যবস্থা, যার রয়েছে শক্তিশালী ও ব্যাপক আদর্শ, বিশ্ব সরকার এবং তা বাস্তবায়নের বিশ্বসেনা বাহিনী।–[আল ফারুকী, ‘Tawhid’, পৃ: ২২।]
ছক : ৫.২ জাতীয়তাবাদ ও উম্মাহর তুলনা
জাতীয়তাবাদ উম্মাহ
জাতির প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করে উম্মাহর প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করে
জাতি ও তার প্রতিষ্ঠানসমূহকে সার্বভৌম শরীয়াহকে বৈধনার চূড়ান্ত উৎস মনে করে
ও বৈধতার উৎস মনে করে
জাতিগোষ্ঠী, ভাষা, জাতিসত্তা ও অন্যান্য আল্লাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের
বিবেচনার ভিত্তিতে গঠিত ধারণা তাওহীদের ভিত্তিতে গঠিত
কৃত্রিম ভূখণ্ডগত সীমান্তরেখা তৈরী করে সকল কৃত্রিম ভূখণ্ডগত সীমান্ত বিলুপ্ত করে
মানুষের মধ্যকার ঐক্যসূত্রকে বিনষ্ট করে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে
উম্মাহকে জাতিরাষ্ট্র সমূহে বিভক্ত করে সমস্ত বিশ্ব মুসলিমকে একই উম্মাহয় পরিণত
করে।
যে সব যুক্তি উপরে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ছক ৫.২-এ সন্নিবেশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে সাইয়েদ মওদুদী, হাসান-আল বান্না (হিজরী ১৩২৪-১৩৬৯ সন/১৯০৬-১৯৪৯ খ্রি.সাইয়েদ কুতুব ও অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতবর্গ সকল ধরনের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের মতে, মওদুদীর ভাষায়, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে- ‘বর্তমান বিশ্বে মানবতা যে সব বিপর্যয় ও বিপদ আপদে নিপতিত তার মূল কারণ’।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘Process of Islamic Revolution’ (দিল্লী, মাকতান জামাতে ইসলামী, ১৯৭০) পৃ: ২২] এমনটি তারা বিদেশী আধিপত্য প্রতিহত করতে ও জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার বিরোধী।–[ হামিদ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’ পৃ: ১১৫] জনগণের ভোটাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সংকীর্ণ চেতনা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সাথে শরীয়াহ ভিত্তিক ইসলামী বিশ্বজনীনতার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘তাজদিদ ইসলাহ’ বা ইসলামী পুনর্গঠন আন্দোলন শক্তিশালী হবার পর ১৯৭০ দশক হতে জাতীয়তাবাদী ধারণার শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে জাতীয়তাবাদী ধারণা অপসৃত হয়েছে অথবা মুসলিম মানসিকতা হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আরব জাতীয়তাবাদ বনাম উম্মাহ
সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যে সব যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছৈ তা সমানভাবে আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও প্রযোজ্য। আরব জাতীয়তাবাদ, আবদ আল রাহমান আল-বাজ্জাজ এর মতে, ‘ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মবাদ ও জীবনের মৌলিক বোধের ভিত্তিতে স্থাপিত’ এবং ইসলাম, ‘মূলত এবং অপরিহার্যভাবে আরবদের জন্য নাজিল হয়েছে’।–[ আবদ আল রাহমান আল-বাজ্জাজ, ‘Min Wahy al-Urubah’ (কায়রো); পৃ: ১৯৯; প্রাত্তক্তে উদ্ধৃত: ১১৩] আরব জাতীয়তাবাদের আধ্যাত্মিক জনক সাতি-আল হুসরী ‘আদ দ্বীন- লিল্লাহ ওয়া ওয়াতান লিযামী’ তথা ‘ধর্ম হচ্ছে আল্লাহর জন্য এবং জন্মভূমি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন।–[ সাতি আল হুসরী, ‘Ma Hiya al-Quwamiyah’, (বৈরুত: Dar al-Ilm lib Malayin, পৃ: ১৯৫; আরো দ্রষ্টব্য বাসাম তিবী, ‘Arab Nationalism: A Critical Enquiry (নিউইয়র্ক, সেইন্ট মার্টিন প্রেস, ১৯৮১)] এ জাতীয়তাবাদী তত্ত্বে এ বাণী নিহিত রয়েছে যে, আরবরা জাতিগতভাবে অন্যান্য মুসলিম জনগণ হতে পৃথক। এ কথা সত্য যে, ইসলামী বিশ্বজনীনতা সকল প্রকার জাতীয় ও গোষ্ঠীগত বিভিন্নতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও, ইসলামের আরবী ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে বিশেষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে নৈতিক আদর্শ হিসাবে ইসলাম আরব গোষ্ঠী প্রীতি তথা আরব জাতীয়তাকে অহংকার হিসাবে গ্রহণ করাকে জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা বলে বর্ণনা করেছে। এটা সত্য যে, কুরআন আরবী ভাষায় নাজেল হয়েছে, কতিপয় প্রাক-ইসলামিক সংস্কৃতি ইসলামী সংস্কৃতিতে স্থান পেয়েছে এবং স্বয়ং নবী করিত (সা) একজন আরব ছিলেন। তবে একথাও সমভাবে সত্য (যা উক্ত আরব জাতীয়তাবাদের ভুল ধারণার অনুসারীরা স্বীকার করেনি) যে, কুরআন আরবী ভাষায় নাজিল হওয়ার কারণ আরব জনগণের বোধগম্যতার জন্য এবং তাদের অনুভূতিকে নাড়া দেবার জন্য। আরবদের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে আরব গোত্রীয় সংস্কৃতি বিশ্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের নৈতিকতাবোধ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে, ইসলামী ঐশী প্রত্যাদেশ আরবী ভাষার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে এবং ‘ভাষাশৈলীর অনন্য উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে।–[ ইসমাইল আর আল ফারুকী ‘Islam as Culture and Civilization’; মালেক আজ্জাম সম্পাদিত ‘Islam and contemporary Society (লন্ডন) লংম্যান, ১৯৮২) পৃ: ১৪৩-৬] কুরআন নাজেল হওয়ার পর আরবী ভাষা কোন বিশেষ লোক সমষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সমগ্র উম্মতের জন্য ঐশী ভাষা হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে, যেমন করে নবী করিম (সা) সমস্ত মানবজাতির জন্য রহমত স্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছে।
‘আরবী জাতীয়তাবাদকে কুরআনের সাথে সমার্থক হিসাবে গণ্য করে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টার চেয়ে ক্ষতিক আর কিছু হতে পারে না। ইসলামের পশ্চিমা শত্রুরা এটা করেছে এবং ‘উরুবাই’ শব্দটি আমদানী করেছে যার জাতিবিদ্বেষী অর্থ হচ্ছে- আরব মুসলমানদেরকে তাদের অনারব মুসলমান ভাইদের থেকে পৃথক করে ফেলা।
এ তথাকথিত আরব জাতীয়তাবাদ বা ‘সুবিয়াহ’ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে দ্বিধা বিভক্ত করে একে অন্যের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে ও যুদ্ধে লিপ্ত করে দেয়া’।–[ ইসমাইল আর আল ফারুকী ‘Islam as Culture and Civilization’; মালেক আজ্জাম সম্পাদিত ‘Islam and contemporary Society (লন্ডন) লংম্যান, ১৯৮২) পৃ: ১৪৬]
ইসলাম সচেতন আরবরা তাই আরব জাতীয়তাবাদকে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন অর্থে গ্রহণ করেন না। মিশরের আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় আলেমবৃন্দ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ও কর্মীগণ আরব জাতীয়তাবাদী ধারণার নিন্দা করেছেন এবং সমগ্র আরব জাহানকে একমাত্র ইমানের ভিত্তিতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হবার আহবান জানান। ধারণাগতভাবে আরব জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ফেলার জন্য ইহুদী খ্রিষ্টানদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। যে সব বুদ্ধিজীবী ইসলাম সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা রয়েছে, তারাও বিভ্রান্তিমূলকভাবে এ আরব জাতীয়তাবাদী ধারনার শিকারে পরিণত হয়েছেন। আল আজহারের উলেমাদের সাম্প্রতিক আরব জাহানের ঐক্যের আহবান রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত মাত্র এবং ইসরাইলী আগ্রাসনের মোকাবেলার জন্য।–[ হামিদ এনায়েত, Modern Islamic Political Thought, পৃ: ১১৭-২০] অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিতই এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, জাতীয়তাবাদের ধারণাটি বিজাতীয় এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট করা।
উপসংহার
তৌহিদের ভিত্তিতে সংস্থাপিত মুসলিম উম্মাহ সার্বজনীন, সর্বব্যাপ্ত ও সুসংগঠিতভাবে সমন্বিত। মুসলিম উম্মাহর সদস্যঘণ সমষ্টিগত ও এককভাবে ভালো কাজের উদ্বোধন ও মন্দ কাজের প্রতিহত করার জন্য দায়বদ্ধ এবং এ সত্যের সাক্ষ্যবাহী যে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ (সা) তার প্রেরিত রাসূল’।
অটোম্যান খিলাফতের পতন, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির অনুপ্রবেশ ও আধিপত্য এবং সারাবিশ্বে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির অনুপ্রবেশ ও আধিপত্য এবং সারাবিশ্বে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ইউরোপীয় শক্তির প্রাধান্য শরীয়াহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট করে। এতদসত্ত্বেও রাজনৈতিক বিভেদ ছাপিয়ে এক এবং ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর ধারণা মুসলিম মানসে জাগ্রত ও জীবন্ত স্থান দখল করে আছে। এ ঐক্যবোধ শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নয় বরং একটি সামগ্রিক ঐক্যতা স্থাপনের আধ্যাত্মিক স্পৃহার বিস্তৃত হয়ে আছে এমনভাবে যে মুসলিম বিশ্বের কোথায় কোন আঘাত আসলে অন্যস্থানে সে আঘাতের ব্যথা অনুভূত হয়। সমস্ত সীমান্তপ্রাচীর ভেঙ্গে এক মুসলিম উম্মাহর এ চেতনা ও ধারণাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তব রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে এবং অব্যাহত রয়েছে। এসব সমন্বিত প্রচেষ্টা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে।