শরীয়াহ : ইসলামী আইনব্যবস্থা
শরীয়াহ হচ্ছে ইসলামের মূল শিকড়, মানুষের জন্য বিধাতার প্রদত্ত জীবন বিধান। এটি হচ্ছে ইসলামের সমাজ-রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণের হাতিয়ার। ঐশী উৎসমূল হতে উৎসারিত শরীয়াহ হচ্ছে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব স্বরূপ, যা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুমোদন ও ভিত্তিমূল হিসাবে কাজ করে। ইহা মুসলমানদের নিজেদের অভিষ্ট লক্ষ্যের ও মনজিলে মকসুদের দিকে সতত ধাবিত করে।–[ খুররম মুরাদ, ‘Shariah The way to God’ (লেইসেসটার, দি ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ১৯৮১) পৃঃ ৩]
তবে শরীয়াহ’র ধারণাকে এমনভাবে ভুল ব্যাখ্যা, ভ্রান্তির শিকার ও অপব্যাখ্যা করা হয়েছে যে শুধুমাত্র ইসলাম বিদ্বেষীদের মধ্যেই নয় বরং পাশ্চাত্যকৃত মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজেও এ সম্পর্কে ভীতি, বিদ্বেষ ও বিদ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কাছে শরীয়াহ হচ্ছে সেকেলে ও মধ্যযুগীয়, যাতে অতীত যুগের ধ্যান-ধারণা ও তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে এবং বর্তমান যুগের বাস্তবতার সাথে এর কোন সামঞ্জস্য নেই; তাই একে বাতিল, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে নতুন আইন ও বিধি রচনা করতে হবে যা বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাবে। পাশ্চাত্য মানসে ক্রসেডের সময় হতে উদ্ভুত তিক্ত অভিজ্ঞতা, পশ্চিমা মননে শরীয়া বিষয়ে নানা ভুল ধারণা, শরীয়া সম্পর্কে বিরাজিত বিরুদ্ধতা ও বিদ্বেষের জন্য অংশত দায়ী। মুসলিম সমাজে বিদ্যমান অন্ধ গোঁড়ামী ও অপসংস্কারমূলক রক্ষণশীলতা যেমন একদিকে এর জন্য দায়ী, অন্যদিকে মুসলিম ঈশ্বরতান্ত্রিক শাসকবর্গ কর্তৃক নিজেদের হীনস্বার্থে শরীয়ার অপব্যবহারও এর জন্য সমভাবে দায়ী। তাই সময়ের প্রয়োজন ও দাবী হচ্ছে ইসলামের এই মৌল ভিত্তির ধারণাগত বৈশিষ্ট্য, উৎসমূল, মৌলিক উদ্দেশ্যাবলী ও চারিত্রিক লক্ষণসমূহকে গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা।
প্রধানত: আইন, শরীয়াহ, ফিহাক ও ইসলামী অনুশাসনের ক্ষেত্রে অর্থ ও তাৎপর্যের দিক থেকে এসব পরিভাষার মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান, সে বিষয়ে এবং বিভ্রান্তিমূলকভাবে এসব পরিভাষাকে সমার্থক ও পরস্পরে বদলিযোগ্য হিসাবে যেভাবে গণ্য করা হয় সে সম্পর্কে বিরূপ ব্যাখ্যা উপস্থাপন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শরীয়াহ ও আইন
শরীয়াহকে প্রায়শই মুসলিম-অমুসলিম নির্বেশেষে সবাই চিরকালীন মহাপবিত্র ইসলামী আইন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্যমণ্ডলে ‘আইন’কে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, তার সাথে ‘শরীয়াহ’র ধারণাকে জড়িয়ে ফেলা বিভ্রান্তিমূলক। অনেক তত্ত্বের মধ্যে আইন সম্পর্কিত কতিপয় তাত্ত্বিক তত্ত্ব আর উৎস থমাস হবস এবং পরবর্তীতে আরো শক্তিশালীভাবে জন অষ্টিন ও ক্যালমেন কর্তৃক উপস্থাপিত হয়ে পাশ্চাত্যে বহুলভাবে পরিচিত ও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তারা আইনকে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম শক্তির আদেশ ও অনুশাসন হিসেবে দেখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এহরলিচ এর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় এই ধারনাকে আরো প্রসারিত করে এর মধ্যে শুধুমাত্র রাষ্ট্র যা কিছু প্রণয়ন করেছে তাই নয় বরং রাষ্ট্রকর্তৃক অনুমোদিত ও বলবৎ সামাজিক নিয়মনীতি, আচার পদ্ধতিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আইন প্রণয়ন, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ইত্যাদির মাধ্যমে প্রয়োজনের জন্য পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নতা সত্ত্বেও আইনকে ‘আচরণ বিধি’ হিসাবে দেখা হয়। পাশ্চাত্যের মতে নৈতিকতার সাথে আইনের কোন সম্পর্ক নেই আইন কি রূপ হওয়া উচিৎ সেভাবে নয়, বরং কি রূপে এটা রয়েছে সে নিরিখেই তাকে দেখে থাকে। আইনের এই সংজ্ঞা শরিয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য নয়। কেননা শরীয়ায় আইনগত দিকের চেয়ে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকই বেশী প্রাধান্য দেয় হয়।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আইন হচ্ছে স্রষ্টার ঐশী ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য একটি সামগ্রিক নৈতিক ও সামাজিক নির্দেশনা। মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে এটি পরিব্যপ্ত এবং তা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাসহ সামাজিক ও অপরাধমূলক ব্যাপারেও প্রযোজ্য। ইসলামে আইনের মর্মবস্তু হচ্ছে মান নির্ধারক চরিত্রের এবং নৈতিক শিক্ষা ও আইনগত প্রয়োগ হচ্ছে এর লক্ষ। মুসলিম পণ্ডিত ও আইনজ্ঞরা একে ‘আইন’ বলে অভিহিত করেন কারণ তাঁরা ঐশী প্রত্যাদেশকে স্রষ্টার আদেশ বলে ধারণা পোষণ করেন, আল্লাহর খলিফা হিসাবে আল্লাহর আদেশের প্রতি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করেন। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে এ জগতের কার্যাবলীর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব (আমানাহ) পালনের ক্ষমতা মানুষকে প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সে তার ঐশীসত্ত্বাকে পূর্ণতা দান করে এবং পরজগতে তার ভাগ্যকে নির্মাণ করে। অন্যকথায় বিশ্বাসভাজন বা আমানতদার হিসানে মানুষের আচরণ বিচার দিবসে ঐশী বিচারের নিক্তিতে নির্ণয় করা হবে এবং মানবজীবনের কার্যকলাপের জন্য পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করা হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের প্রত্যেকটি কাজের ‘আইনগত’ ফলাফল এবং দায়িত্বশীলতা রয়েছে, যা শরীয়ার ‘আইনসঙ্গতার’ পর্যাপ্ত যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে।
উপরের আলোচনা হতে আইন সম্পর্কে পশ্চিমা ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঐশী ইচ্ছার প্রতিফলন হিসাবে শরীয়াহ আইনের রূপ পরিগ্রহ করেছে, অন্যদিকে পশ্চিমা আইন মানব-মননের সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত পশ্চিমা আইন ও পদ্ধতি সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে জন্মলাভ করেছে এবং সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে আইনেরও পরিবর্তন ঘটে। ইসলামী আইন, যা সমাজ ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটের ঊর্ধ্বে, তা ঐশী নির্দেশনা অনুযায়ী সমাজকে পরবর্তন ও বিন্যস্ত করে। তৃতীয়থ পশ্চিমা আইন মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু ইসলামী আইন অধিকন্তু স্রষ্টার সাথে মানুষের এবং নিজের বিবেকের সাথে সম্পর্ককে অন্তর্ভুক্ত করে। সর্বশেষে, সামাজিক আচরণের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পশ্চিমা আইনের ভূমিকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্র, ধর্ম, নৈতিকতা, শিক্ষা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে এবং এদের দ্বারা সীমাবদ্ধ। পশ্চিমা আইন তাই কার্যত মানব চরিত্র গঠন ও মানুষের সম্ভাবনার বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। ব্যক্তি মানুষকে সমাজের গ্রহণযোগ্য সদস্য হিসাবে পরিণত করতে এবং তাকে সফল মানুষে রূপান্তরের সহায়তাদানে পশ্চিমা আইনের ভূমিকা সীমাবদ্ধ।–[ আয়ারডেল জেনকিনস, ‘Social Order and Limits of Law: A Theoretical Essay’ (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮০) পৃঃ ৩৫]
পক্ষান্তরে সমাজের উপর ইসলামী আইনের সুদূরপ্রসারী ও সর্বব্যাপ্ত প্রভাব রয়েছে কেননা এটি হচ্ছে আইনগত ও নৈতিকতা সম্পন্ন একটি সার্বিক ব্যবস্থা। শরীয়াহ মানুষের অন্তর্চেতনা দ্বারা চালিত এবং এটি মানুষের বিবেকবোধের উপর কাজ করে।–[ আনোয়ার আহমেদ কাদরী, ‘Islamic Jurisprudence in the Modern World’. (দিল্লী, তাজ কোম্পানী, ১৯৮৬), পৃঃ ৩২।] শরীয়ার কিছু অংশের কার্যকারিতার জন্য রাজনৈতিক কর্তৃত্বে অনুমোদন প্রয়োজন হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা মানুষের নৈতিক বিবেকবোধ দ্বারা চালিত। কার্যকর ও প্রয়োগ করার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ না থাকলেও বিশ্বাসী মানুষ শরীয়ার নৈতিক চালিকাশক্তি দ্বারা চালিত হয়।
শরীয়াহ ও ফিকাহ
‘শরীয়াহ’কে প্রায়শই ‘ফিকাহ’ এর সমার্থক হিসাবে ভুল করা হয়। শব্দ দু’টি যদিও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও একই সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবুও ধারণা দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।–[ আবদ আল করিম জাইদান, ‘আল মাদখাল-লি-দিরাসাত আল শরীয়াহ আল ইসলামিয়া, (বৈরুত, মুয়াসসাসাহ রিসালাহ, ১৯৮৫) পৃঃ ৬২-৯] উৎসের দিক থেকে শরীয়াহ হলো ঐশী তথা আল্লাহর নির্দেশ আর ফিকাহ হলো কুরআন সুন্নাহের ভিত্তিতে মানুষের রচিত বিধি বিধান: যা ব্যক্তি মানুষ ও সমাজের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনগত বিচার বিশ্লেষণ, অবরোহ অনুমান, ক্লাসিকেল আইন শাস্ত্রের (উসুল) অন্যান্য নীতিমালা ও পদ্ধতির মাধ্যমে প্রণীত হয়ে থাকে। অধিক যুক্তিযুক্তভাবে ফিকাহহে প্রায়োগিক শরীয়াহ বলা যায় যেহেতু ঐশী ইচ্ছার বাস্তবায়নের জন্য বিস্তারিত ও প্রায়োগিকভাবে ফিকাহ প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। কুরআন ও সুন্নাহর ঐশী নির্দেশনাকে সাধারনভাবে প্রয়োগের জন্য ফিকাহ হচ্ছে মানব রচিত বিধি বিধান বা কোন বিশেষ ঐশী নির্দেশনার প্রেক্ষিতে প্রায়োগিক ব্যাখ্যা। দেখা যায় আইনজ্ঞদের প্রণীত অনেক বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপেডিয়াতে শরীয়াহ ও ফিকাহ একই বন্ধনীতে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং সুম্পষ্টিকরণের জন্য যে গুরুত্বারোপের প্রয়োজন, তা হলো ফিকাহ শরীয়াহ হতে বাইরের কিছু নয়, তবে শরীয়াহ ও ফিকাহ অভিন্নও নয়। কুরআন সুন্নায় বিধৃত নীতিমালা, ধারণা ও আইনের সমন্বিত সমাহার ‘শরীয়াহ’ হচ্ছে অপরিবর্তনীয়, মহা পবিত্র ও চিরন্তন। মুসলিম আইনজ্ঞ ও পণ্ডিতগণ শরীয়ার উপলব্ধির ভিত্তিতে রচিত ‘ফিকাহ’ যুগের সাথে পরিবর্তনশীল এবং এর কোন চিরন্তন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
এতদসত্ত্বেও ফিকাহ হচ্ছে আইনগত প্রাজ্ঞ বিধি বিধান রচনার ক্ষেত্রে একটি বিশাল অর্জন যা সব সময় ইজতিহাদের ক্ষেত্রে উৎসাহ উদ্দীপনা ও জ্ঞানালোক প্রাপ্তির উৎস হয়ে থাকবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী আইনের দু’টি মৌলিক উপাদান রয়েছেঃ
ঐশ্বরিক উৎস যা আল্লাহ ও রাসূল (সা) কর্তৃক দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষিত হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ) এবং তা শব্দের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্যে ‘শরীয়াহ’ হিসাবে বর্ণিত; আর শরীয়াহর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হিসাবে মানব রচিত বিধিবিধান, যা ‘ফিকাহ’ বা প্রায়োগিক শরীয়াহ হিসাবে আখ্যায়িত।–[ হাম্মুদাহ আবদ আল আলী, ‘The Family Structure in Islam’, (লেগোস, ইসলামিক পাবলিকেসন্স ব্যুরো, ১৯৮২) পৃঃ ১৪।]
এভাবে শরীয়াহ হচ্ছে ঐশ্বরিক, আর ফিকাহ হচ্ছে মানব রচিত; প্রথমটি চিরন্তন এবং শেষোক্তটি পরিবর্তনশীল। ঐশী শরীয়াহ হচ্ছে অপরিবর্তনীয়, আর মানব রচিত ফিকাহ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনযোগ্য। এটি শরীয়াহ’র অভ্যন্তরীণ গতিশীলতাকে প্রতিনিধিত্ব করে।
শরীয়ার সংজ্ঞা
শরীয়াহ হচ্ছে একটি আরবী শব্দ যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পানির আধার বা জলাশয়ের দিকে যাবার পথ বা সড়ক। ঐশী বিধান ব্যবস্থার আঙ্গিকে এর অর্থ ‘জীবনের উৎসের দিকে যাবার পথ’। বস্তুত ইসলামে এর অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক আল্লাহর রাহের বর্ণনা। এর ধাতুগত শব্দটি হচ্ছে ‘শারা’ যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে “রাস্তা নির্মাণ”, তবে ধারণাগতভাবে এটা আইন প্রণয়ন বা একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা বোঝায়। ফলে এর বিভিন্ন ব্যুৎপন্ন শব্দসমূহ যথা ‘আ শরীয়াহ’, ‘তাসরী’, ‘শারী’ ইত্যাদি অর্থের দিক থেকে প্রণীত আইন, বিধি-প্রবিধি এবং আইন দাতা ইত্যাদি বোঝায়।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘Thafhim al Quran’ (লাহোর: ইদারাহ তারজুমান আল কুরান, ১৯৭৪); ভলিউম-৪, পৃঃ ৪৮৬-৭।]
মুসলিম পণ্ডিতবর্গ দু’টি ভিন্ন, কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিথ অর্থে সাধারণ শরীয়াহর ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। বৃহত্তর অর্থে, শরীয়াহ বলতে আল্লাহ হতে প্রেরিত সকল প্রত্যাদেশ যা সৃজনকারী আল্লাহর সাথে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক, ব্যক্তির নিজের সাথে মানুষের নিজের সম্পর্ক, অন্যান্য মানুষের সাথে সম্পর্ক এবং মানুষের চারপাশের সবকিছু যথা সকল সম্পদ, সমৃদ্ধি ও আশীর্বাদ যা কিছু মানুষের আয়ত্বে প্রদান করা হয়েছে- সামগ্রিকভাবে এসব কিছুর পরিচালনার নিয়মনীতি বোঝায়।–[ মাহমুদ সালাতুত, ‘al-Islam wa al-Duwaliyah fi al-Salam wa al Harb’ (কায়রো, আল জামিয়াহ আল আজহার, ১৯৫১) পৃঃ ৫]
এটা হচ্ছে মহানবী (সা) এর নিকট নাজিলকৃত ঐশী ইচ্ছা অনুযায়ী বিশ্বাস মানুষের চিন্তাধারা, কর্ম ও সামগ্রিক জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রদত্ত আইনগত ব্যবস্থা। এটি মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ রেখাচিত্র এবং সকল কিছুকে পরিবেষ্টনকারী সামাজিক ব্যবস্থা যেথায় কোন বাহুল্য বা অপূর্ণাঙ্গতা বলে কিছু নেই।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘The Islamic Law Constitution’ অনুবাদ ও সম্পাদনা: খুরশীদ আহমদ (লাহোর: ইসলামিক পাবলিকেসন্স লি: ১৯৬৭) পৃঃ ৫৩]
এ হচ্ছে এমন এক ‘পদ্ধতি পথ’ যা মানব জীবনকে সামগ্রিকভাবে বেষ্টন করে আছে। এ অর্থে কুরআন মহানবী (সা) কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেঃ অতঃপর আমরা তোমাকে (হে মোহাম্মদ) সকল বিষয়ে (তোমার দ্বীন) পথ (শরীয়াহ) প্রদর্শন করেছি; এই প্রথা অনুসরণ কর এবং যারা অজ্ঞ তাদের পছন্দ-অপছন্দকে অনুসরণ করোনা।
আল কুরতুবী’র মতে কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে শরীয়াহ শব্দটি দ্বারা ‘তাওহীদ’, ‘ইবাদত’, ‘মুয়ামালাত’ বা লেনদেন বিধি ও অন্যান্য সকল পূন্যময় কার্যাবলী সম্বলিত মানব জীবনের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে বোঝান হয়েছে।–[ আল কুরতুবী, ‘al-Jamili-Ahkam al Quran’ (বৈরুত: Dar Jhya a;-Turath al Arabi, ১৯৫৯) ভলিউম ১৬, পৃঃ ১৬৩-৪]
শরীয়াহ তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বাসী মানুষদের জীবন নিয়ন্ত্রণকারী ঐশী প্রত্যাদেশের সমাহার; যা তার ইহকালীন জীবনের কল্যাণ ও পরকালীন জীবনের মুক্তি নিশ্চিত করে। ইহা ব্যক্তি মানুষের প্রার্থনা-আরাধনার পদ্ধতি প্রদান করেছে এবং ব্যক্তিগত কার্যকলাপ ও নৈতিকতার বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। মানুষের সামষ্টিক জীবন যাতে রয়েছে পরিবার সম্পর্ক, আর্থ-সামাজিক বিষয়, নাগরিকের কর্তব্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি, যুদ্ধ ও শান্তির নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মত বিষয়াদি গ্রহণের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি, যুদ্ধ ও শান্তির নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মত বিষয়াদী যেসব বিষয়ে শরীয়াহ নির্দেশনা প্রদান করেছে।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ পৃ. ৫৩] এটা হচ্ছে সুবিন্যস্ত একটি ব্যবস্থা, একটি সামঞ্জস্যশীল সামগ্রিকতা –যা মানব জীবনের সকল দিককে বেষ্টন করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করা যায় যে, ‘দ্বীন’ ও ‘ইসলাম’ শব্দদ্বয়ের সাথে শরীয়াহকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা যায়।দ্বীনের অর্থ আল্লাহপাকের কাছে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য; আল্লাহর আদেশ মনে-প্রাণে গ্রহণ করে মুখে উচ্চারণ করা এবং আল্লাহ পাকের আদেশ নিষেধ পূর্ণভাবে মেনে চলা।–[ আল কুরতুবী, ‘al-Jami li-Ahkam al-Quran’ ভলিউম-2, পার্ট-4, পৃঃ 43; আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারির আল তাবারী ‘Jami al-Bayan fi Tafsir-al-Quran (বৈরুত, দার আল মারিয়াহ, ১৯৭২) ভলিউম-৩-৪, পার্ট-৩; পৃ: ১৪১-২।] আভিধানিকভাবে শরীয়াহ’র অর্থ ‘জীবন বিধান’ যা বিশ্বাসী মানুষ কেবলমাত্র আল্লাহ পাককে সকল ক্ষমতা ও পরক্রমশীলতার অধিকারী মনে করে তাঁর কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং জীবনের সকল প্রকার আচরণ ও কার্যকলাপের জন্য তার কাছে জবাবদিহিতার আবদ্ধ থাকে।–[ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, ‘Four Basic Quranic Terms’; অনুবাদ: আবু আসাদ (লাহোর, ইসলামী পাবলিকেসন্স, ১৯৮২) পৃঃ ৯৩-১০৩।] ইসলাম হচ্ছে বর্ণিত এই দ্বীনের নাম, আর শরীয়াহ হচ্ছে ঐ ঐশী জীবন বিধান যার মাধ্যমে কেবলমাত্র আল্লাহপাকের আরাধনা করা হয়। ফজলুর রহমান শরীয়াহকে ‘ঐশ্বরিকভাবে স্থিরকৃত পথ’ হিসাবে ভাষান্তর করেছেন –এ আলোকে যে শরীয়াহ ঐশ্বরিক উৎস থেকে আগত এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দিক ও উদ্দেশ্য। বস্তুত কুরআনে ‘শরীয়াহ শব্দের ‘দ্বীন’ ও ‘ইসলাম’ শব্দদ্বয় অনেক বেশীবার উল্লেখিত হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে শরীয়াহ শব্দটির প্রচলন হয়েছে।–[ফজলুর রহমান, ‘Islam’ (শিকাগো: ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ১৯৭৯) পৃঃ ১১৭। শরীয়াহ শব্দটি বিভিন্ন আকারে কুরআনে পাঁচ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছৈ, যথা, ৫:৪৮; ৭:১৬৩; ৪২:১৩; ৪২:২১ এবং ৪৫: ১৮, দ্বীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৬৩ বার, ইসলাম শব্দটি ইহার কোনরূপ প্রতিশব্দ ব্যতিরেকে ব্যবহৃত হয়েছে ৫ বার।] এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক কেননা প্রারম্ভিক সময়ে শরীয়াহ বোঝাতে ইসলাম ও দ্বীন শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হত।
শরীয়াহ অনেক সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; যার আওতাধীন বিষয়াদী হচ্ছে ধর্মীয় মতাদর্শ ও আনুষ্ঠানিকতা, সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়াদি, অপরাধ ও শাক্তি এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও ব্যবসায়িক আদান-প্রদান সম্পর্কিত নির্দেশাবলী ও আচরণবিধি। আল তাবারীর মতে শরীয়াহ সম্পত্তির উত্তারাধিকার, ‘হাদ’ শাস্তি, আদেশ ও নিষেধাত্মক নির্দেশনার সমন্বয়ে গঠিত।–[ এইচ, এ, আর গীব ও জে, ক্রোমারস সম্পাদিত ‘Shorter Encyclopaedia of Islam’ (ইথাকা, নিউইয়র্ক, কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৩), পৃঃ ৫৪২।] এসব আইন ও বিধি সংক্রান্ত কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহকে ‘আয়াত আহকাম’ বলা হয়। আধুনিক পরিভাষার আলোকে শরীয়াহর অংশে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ফৌজদারী ও দেওয়ানী আইন, শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক আইন, আন্তর্জাতিক আইন ইত্যাদি। এগুলো প্রয়োগের জন্য রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে। কুরআনুল করীমে এ ধরনের আয়াতের সংখ্যা খুব কম। যার সংখ্যা ৫০০ আয়াতের বেশী হবে না। আবদ আল ওয়াহহাব খালআফ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, কুরআনে পারিবারিক বিষয়ে ৭০টি আয়াত, দেওয়ানী বিষয়ে ৭০টি আয়াত, ফৌজদারী বিষয়ে ৩০টি আয়াত এবং অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিষয়ে ১০টি আয়াত রয়েছে।–[ আবদ আল ওয়াহহাব আল খাল্লাফ ‘Islam Usul al-Fiqh (কুয়েত, Dar-al-kuwaitiyyah, ১৯৭৮) পৃঃ ৩৪-৩৫] এ ধরনের সংখ্যা নির্ধারণকে আনুমানিক ধরে নিতে হবে কেননা আল কুরআনের কতিপয় নির্দেশনাবলীর আইনগত তাৎপর্য তর্কসাপেক্ষ ও দ্ব্যর্থবোধক এবং এমন অনেক আদেশ রয়েছৈ যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।–[ সাঈদ রামাদান, ‘Islam Law: Its Scope and Equity’ (কুয়ালালামপুর, মুসলিম ইয়থ মুভমেন্ট অব মালয়েশিয়া, ১৯৭৮) পৃ: ৪৩]
অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মুসলিম-ফিকাহবিদ বা আইনবিশারদগণ এসব ‘আহকাম’এর বিষয়ে গুরুত্ব প্রদানের সময় শরীয়াহর মৌলিক প্রকৃতিকে বিবেচনায় রেখেছেন। অন্য কথায় এসব আহকামের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন কোন অস্তিত্ব নেই এবং সামগ্রিক ইসলামী জীবন বিধানের প্রেক্ষিতে বহির্ভূতভাবে এসবের মর্ম বোঝা যাবে না বা প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। উপরোক্ত ব্যাখ্যাটি এজন্যই যুক্তিযুক্ত যে চুরির জন্য হাত কাটার কানুনী শাস্তি, ব্যভিচারের জন্য প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি নির্দেশাবলী বিশেষ শর্তাধীণ। জি.এইচ. জেনসেন মন্তব্য করেছেন যে, এসব ‘শর্তাবলীকে ‘অজুহাত’ হিসাবে মনে করার কোন কারণ নেই।–[ জি.এইচ. জ্যানসেন, ;Militant ilm’ (নিউইয়র্ক, হারপার এন্ড রো, (১৯৭৯), পৃ: ২৯] বরং এসব শর্ত শরীয়াহর ঐ মর্মবস্তুকে উৎঘাটিত করে যে চরম লক্ষ্য হচ্ছে উচুঁমানের সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণকে মিথ্যা বা সাক্ষ্যপ্রমাণহীন অসমর্থিত অভিযোগ আনয়ণ থেকে বিরত রাখা।
সংক্ষেপে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, শরীয়াহ মানুষের সর্বাধিক আচরণ ও চিন্তাকে পরিবেষ্টন করে আছে। এর আওতাভুক্ত রয়েছে সকল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিষয়াবলী এবং প্রথ্যেক কাজের পশ্চাতে মানুষের নিয়ত। আল কুরআনের আয়াত ১৬:৮৯ এ বর্ণিত হয়েছে যে:
‘আমরা কিতাব নাজিল করেছি যাতে তোমরা সকল বিষয় সম্যকভাবে বুঝতে পার এবং যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তাদের জন্য ইহা দিক নির্দেশনা, দয়া, ক্ষমা এবং সুসংবাদ।
শরীয়াহ’র উৎস
শরীয়াহ ও ফিকাহ-এর ভিন্নতার পেক্ষিতে ইসলামী আইনের উৎসসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: মুখ্য ও গৌণ।
মুখ্য উৎসসমূঞ
কোরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে শরীয়ার মূখ্য উৎস। এ দু’টি শরীয়ার ভিত্তি ও নির্যাস। বিদায় হজ্বের ভাষণে মহানবী (সা) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি; তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না যতক্ষণ তোমরা এ দুটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাক: তা হলো আল্লাহ’র কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’।–[ A.Dol, “Shariah: The Islamic Law” (লন্ডন: তা হা পাবলিসার্স, ১৯৮৪), পৃ: ৭]
কুরআন হচ্ছে শরীয়াহর প্রধান উৎস। কোরআন শাব্দিকভাবে আল্লাহ পাকের কথা, মহাপবিত্র, অতুলনীয় ও অননুকরণীয়। কুরআন খণ্ড খণ্ডভাবে নাজিল হয়েছে, যাতে এর অর্থ পূর্ণভাবে অনুধাবন এবং যাতে ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে এর বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়।–[ জালাল আল দ্বীন আবদ আল রাহমান সায়ূতী
Al-Itqan fi Ulum al Quran’ (কায়রো আল হালাবী প্রেস, ১৯৫১) ভলিউম-১; পৃঃ ৩৯-৪৪] প্রত্যাদিষ্ট এই কিতাব আদি আকৃতিতে এর প্রতিশব্দ অবিকল ও পূর্ণাঙ্গভাবে সর্বকালের দিক নির্দেশনার উৎস হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। চিরন্তন ও বিশেষ আহবান ও আদেশ যা সন্দেহাতীতভাবে সুস্পষ্ট (মুবীন) ও মহিমান্বিত (আ’লী) ও পবিত্র। এসবের সমন্বয়ে শরীয়াহ ইসলামের তাত্ত্বিক কাঠামো প্রদান করেছে। ঐশ্বরিক বিধায় বিশ্বাসীদের জন্য শরীয়াহ চিরন্তন, মহাপবিত্র, শর্তহীনভাবে বাধ্য বাধকতামূলক এবং অপরিবর্তনীয়।
‘যে আমার নির্দেশ মেনে চলে সে কখনো বিপথগামী হবে না, সে সমৃদ্ধিহীনও হবেনা। আর যে আমার স্মরণ হতে পরান্মুখ হবে, সে এক সংকীর্ণ জীবন প্রাপ্ত হবে এবং শেষ বিচারের দিন তাকে আমরা অন্ধ হিসাবে উত্থিত করব’।(২০:১২৩-২৪)
কুরআনে তিন ধরনের নির্দেশ রয়েছে। ঈমানের বিষয়াবলী, নৈতিক ও আইনগত অনুশাসন এবং সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিধিবিধান। পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, কুরআনের বিষয়াবলীর বৃহদাংশই নৈতিকতা এ আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত বিধিবিধান। পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, কুরআনে বিষয়াবলীর বৃহদাংশই নৈতিকতা এ আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত। আইনগত বিষয়াবলী সমগ্র কুরআনের ১০ ভাগ মাত্র। ফলশ্রুতিতে এভাবে মানবজাতি ‘ইজতিহাদ’ ‘শুরা’ ও ‘ইজমা’র মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি নিষ্পন্নের বৃহত্তর সুযোগ লাভ করেছে।–[ মুহাম্মদ রশীদ রিদা, ‘al-wahy al-Muhammadi (কায়রো, Matba’a al-Manar, ১৯৩১) পৃ: ২৫৫] মহানবী (সা) এর জীবনের সকল কর্ম, উক্তি, তাঁর মৌন সম্মতির নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সমন্বয়ে সুন্নাহ গঠিত। প্রথম দিকে সুন্নাহ ও হাদীস ভিন্ন বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত। সুন্নাহ বলতে মহানবী (সা) এর কৃত কার্যকলাপ ও আচরণ বোঝাতে আর হাদীস বলতে তাঁর নিকট সাহাবীদের শোনা উক্তি বোঝাত। তবে ক্রমান্বয়ে সমগ্র সুন্নাহ এমন বিস্তৃতভাবে হাদীস রূপে বর্ণিত হলো যে, হিজরী পাঁচ শতকে উভয় শব্দ সম্পূর্ণ সমার্থকে পরিণত হল।–[ Zaydan. Al-Madkhal li-Dirasat al-Shariah al-Islamiah’ পৃ: ১০৮-১৮] ছয়টি ‘সিয়াহ’ (নির্ভরযোগ্য) এর মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে সুন্নাহ শরীয়াহর দ্বিতীয় মৌলিক উৎসে পরিণত হল।
ইবনে কাইয়িম আল জাযিয়াহ সুন্নাহ কেন আল কোরআনের তুলনায় গৌণ তার ব্যাখা দিয়েছেন যে:
“কুরআন হচ্ছে চূড়ান্ত ও পরম সামগ্রিক ও বিস্তারিতভাবে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বধারী; কিন্তু বিস্তারিত বিশ্লেষণে সুন্নাহ কুরআনের মত চূড়ান্ত, পুংখানুপুংখ সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল নয় একে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে অবলোকন করতে হবে। কুরআনের সাথে সুন্নাহর তিনটি সম্ভাব্য সম্পর্ক রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে, সুন্নাহ বিশেষ প্রসঙ্গে হুবহু কুরআনের অনুসরণ করে এবং পরস্পর সমার্থকভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এবং তৃতীয়ত সুন্নাহ এমন সব বিষয়ে বিধান প্রদান করে যেখানে কুরআনের বিশেষ কিছু উল্লেখ নেই। কুরআনের পরিপন্থি হবার কোন সুযোগ সুন্নায় নেই’।–[ ইবনে কাইয়িম আল জওজিয়াহকে উদ্ধৃত করেছেন ইসমাইল আর আল-ফারুকী ‘The Great Asian Religions An Anthology’ (নিউইয়র্ক, ম্যাকমিলান, ১৯৫৯) পৃ: ৩৩৭-৮]
সুন্নাহর কর্তৃত্ব উৎসারিত কুরআরেন উৎস হতে যে আল কুরআন মহানবী (সা)কে প্রত্যাদিষ্ট রাসূল (সা) রপে আখ্যায়িত করেছে (৬৩:৩-৪)। তাঁর উপর মহা দায়িত্বপূর্ণ ভার পবিত্র গ্রন্থ (কুরআন) ও বাণী (ইসলাম) অর্পিত হয়েছে। কুরআন তাকেঁ কুরআন মজিদের ব্যাখ্যাকারী ও হিতোপদেশ প্রদানকারী শিক্ষক (১৬:৪৪); মহান গুরু ও পথ প্রদর্শক (৩:৪৮); শাসনকর্তা, আইনপ্রণেতা ও বিচারক (৪৪:৫৯) এবং বিশ্বাসীদের জন্যে অনুসরণযোগ্য ‘মহা আদর্শিক নমুনা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। সুন্নাহ তাওহীদের বাস্তব প্রতিফলন এবং এর ভিত্তি হচ্ছে কুরআনের চিরন্তন বানী। তজ্জন্যই কুরআন ঘোষণা করেছে,” যে রাসূল (সা)কে মান্য করেছে, সে আল্লাহ মান্য করেছে”। (৪:৮০) এবং নবী (সা) তা নিশ্চিত করে বলেছেন, যে আমাকে অনুসরণ করেছে সে আল্লাহকে অনুসরণ করেছে আর যে আমাকে অমান্য করেছে সে আল্লাহকে অমান্য করেছে’।–[ মওদুদী, ‘Islamic Law and Constitution’ পৃ; ১৯১]
স্পষ্টতই, আল্লাহর আদেশ নির্দেশনা সমূহ মানবজাতির কাছে দু’ভাবে এসেছে: কুরআন ও সুন্নাহ (মহানবী (সা) এর আদর্শ জীবনাচরণ)। সুন্নাহকে ‘অন্য’ উৎস হিসাবে দেখা ঠিক নয়, বরং তা আল কুরআনের বিধৃত রাসূল (সা) এর নীতিমালার কথা ও কাজের মাধ্যমে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বৃত্তান্ত। কুরআন হচ্ছে আত্মা আর সুন্নাহ তার দেহ; প্রথমটি দিয়েছে নীতিনির্দেশনা আর শেষোক্তটি প্রথমোক্তটির ব্যাখ্যা ও জীবন যাত্রার বাস্তবায়ন। দু’টি মিলে গঠিত হয়েছে সার্বভৌম আল্লাহর সর্বোচ্চ আইন ও বিধান, যাকে ইসলাশী পরিভাষায় শরীয়াহ বলা হয়।
গৌণ উৎসসমূহ
কুরআন ও সুন্নাহয় বিধৃত ঐশী ইচ্ছা অনুধাবন ও কার্যকর করণের জন্য মুসলিম আইনবিদগণ যে সব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া ব্যবহার ও অনুসরণ করেছেন তা শরীয়াহর গৌন উৎস। সমকালীন মুসলিম পণ্ডিতগণ এ সমষ্টিকে ‘ইজতিহাদ’ অভিধায় অভিহিত করেছেন।
‘ইজতিহাদের আভিধানিক অর্থ ‘প্রচেষ্টা, উদ্যোগ বা প্রয়োগ’, কিন্তু তাৎপর্যের দিক হতে এর অর্থ হচ্ছে সাধারণ নীতিমালা (কাওয়াইদ) এবং আইনগত সাক্ষ্য প্রমাণের (আদিল্লাহ) সহায়থা ইসলামের অনুশাসন ও মর্মবাণী অনুধাবনের চূড়ান্ত সাক্ষ্য প্রমাণের (আদিল্লাহ) সহায়তায় ইসলামের অনুশাসন ও মর্মবাণী অনুধাবনের চূড়ান্ত চেষ্টা। মোহাম্মদ ইকবাল ইজতিহাদকে একজন বিশেষজ্ঞের ‘একটি আইনগত বিষয়ের উপর স্বাধীন বিচারিক নায় প্রদানের’ ব্যক্তিগত চূড়ান্ত পচেষ্টা মর্মে অভিহিত করেছেন।–[ মুহাম্মদ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ (লাহোর: আশরাফ, ১৯৭১); পৃ. ১৪৮] ইজতিহাদের মাধ্যমে উপনীত সিদ্ধান্ত কখনো শরীয়াহর পরিপন্থী হতে পারবে না বা শরীয়াহর স্পষ্টতাকে ঘোলাটে করতে পারবে না এবং কেবলমাত্র যখন কোন প্রাসঙ্গিক বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কুরআন ও সুন্নায় কোন নির্দেশনা পাওয়া যাবেনা, কেবল তখনই ইজতিহাদ প্রয়োগ করা যাবে। যুক্তিশাস্ত্রের পদ্ধতি অনুযায়ী ইজতিহাদে অবরোহ ও আরোহ পদ্ধতির বিদ্যমান জ্ঞান (অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহ) এবং বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিবাদ উভয় শাস্ত্রই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইজতিহাদী প্রক্রিয়ায় ঐশী প্রত্যাদেশকে যুক্তিবাদের উপরে স্থান দেয়া হয় এবং তার ভিত্তিতেই ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সুসংবদ্ধ নিয়ম নীতি ছাড়া ইজতিহাদ পরিচালনা করা হলে নানা ধরনের মতামত সৃষ্টি হতে পারে। মুসলিম আইন শাস্ত্রবিধগণ তাই ইজতিহাদ পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপের লক্ষে ‘কিয়াস’ (সাদৃশ্যমূলক যুক্তিবাদ) নামক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। ‘কিয়াস’ হচ্ছে ঐশী উৎসে বর্ণিত সমরূপ কোন উদ্ধৃতির আলোকে বিবেচ্য অনুরূপ বিষয়ের উপর আলোক সম্পাত করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা ও পদ্ধতি।
যখন কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইজতিহাদ পণ্ডিতবর্গ (উলেমা) অথবা মুসলিম উম্মাহর সাধারণ সম্মতি বা ঐকমত্য অর্জন করে, তখন তা যে মর্যাদা লাভ করে তাকে ‘ইজমা’ বলে। ইজমা হচ্ছে শরীয়াহর শিক্ষার মনোপলব্ধি, ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ, যা উম্মাহর সাধারণ ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ণিত হয়। এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিশেষভাবে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তের সাথে উম্মাহর সাধারণ ঐকমত্যের সংযোগ সাধন করে। ইজমার দ্বিবিধ তাৎপর্য রয়েছে: প্রথমত: এটা ব্যক্তি মানুষের লাগাম ছাড়া গবেষণার রেশ টেনে ধরে, দ্বিতীয় সৃজনশীল ব্যক্তি গবেষণার মাধ্যমে সমস্যার গ্রন্থিমোচনে উম্মাহর সাধারণ স্বীকৃতি এনে দেয়।
খুররম মুরাদের মতে যে কোন ঐকমত্য ‘যা চার খলিফা ও সাহাবাদের সময় হতে ঐতিহাসিক ক্রম বিবর্তনতায় চলে আসছে, তা মান্য করা বাধ্যতামূলক বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে।–[ খুররম মুরাদ, ‘Shariah: The Way to God’ পৃ: ১১]
খোলাফায়ে রাশেদার ধর্মপরায়ণতা, রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে তাদের নৈকট্য, শরীয়াহ সম্পর্কে তাদের গভীর জ্ঞান, কঠোর মোত্তাকী (ধর্মানুসারী) প্রথম চার খলিফার নেতৃত্ব, শরীয়াহ সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞান অনুসরণের কারণে ঐ সময়ে যে সব ঐকমত্য স্থাপিত হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য ও কর্তৃত্বপূর্ণ। খোলাফায়ে রাশেদার যুগের অবসানের পর ঐক্যমত স্থাপনের জন্য শুরা’র কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার ভাঙ্গনের ফলে কোন বিষয়ে ইজমা অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এসব হলো জোরালো নজীর এবং সমাজ ও মানবিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে এগুলি পুনঃপরীক্ষার আওতায় আসে। লক্ষণীয় যে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার কতিপয় বিষয়ের উপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলিম উম্মাহর কোন মৌলিক বিষয়ের উপর এখন আর কোন চূড়ান্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন অনেক বিষয়ের উপরও ‘আইনশাস্ত্রের বিভিন্ন মতাদর্শের বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে’।–[আবদুল হামিদ আবু সুলায়মান ‘The Islamic Theoru of International Relations: New Directions for Islamic Methodology and Thought’ (জার্নডন, ‘International Institute of Islamic Thought, ১৯৮৭), পৃ: ৭৫। ইমামা ইবনে আল মুনযীর ৭৫৬টি বিষয় সনাক্ত করেছেন যেখানে ‘ইজমা’ রয়েছে। দ্রষ্টব্য, ইমাম ইবনে আল মুনযীর, ‘al-ijma’ (বৈরুত, দারুল কিতাব আল ইলমিয়া, ১৯৮৫)।] বিভিন্ন মতাদর্শপন্থী আইনশাস্ত্রবিদগণ নতুন আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা উদ্ভাবন করেছেন। এ সবের উদাহরণ হচ্ছে মূলগ্রন্থে কোন বিষয়ে কোন নির্দেশনামূলক ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
ক. ইসতিহসান (আইনগত অগ্রাধিকার): আইনজ্ঞ কর্তৃক এমন পদ্ধতির অনুসরণ যাকে তিনি সাদৃশ্যমূলক নজীর (কিয়াস) হতে উত্তম বিবেচনা করেন।
খ. ইসতিসলাহ (জনকল্যাণ) বা এমন একটি পথের অনুসরণ যা জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ আনয়ন করবে।
গ. ইসতিসহাব (চলমানতা বা কার্যকারিতা) পূর্বে প্রচলিত একটি আইনগত বিষয়ের ধারাবাহিকতা, যতক্ষণ না প্রমাণিত হয় যে এর বর্তমানে কোন প্রযোজ্যতা বা কার্যকারিতা নেই, নতুনভাবে তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
উরফ (প্রথা বা প্রচলন): কোন সমাজের প্রচলিত প্রথা যা শরীয়াহর সাথে সামঞ্জস্যশীল। উপরোক্ত আলেচনা হতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কোরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে শরীয়াহর মুখ্য উৎস। কিয়াস ও ইজমা শরীয়াহ’র দ্বিতীয় উৎস হিসাবে স্বীকৃত। সমকালীন মুসলিম পণ্ডিতবর্গ দ্বিতীয় উৎস হিসাবে স্বীকৃত। সমকালীন মুসলিম পণ্ডিতবর্গ দ্বিতীয় উৎস ও অন্যান্য পন্থাকে ইজতিহাদের শ্রেণীভুক্ত করেছেন। দ্বিতীয় উৎস হতে উৎসারিত আইনসমূহও বৈধ কেননা চূড়ান্ত বিশ্লেষণ উদ্ভূত এসব আইনের শিকড় মুখ্য উৎসে তথা কোরান ও সুন্নায় প্রোথিত।
ইজতিহাদের উত্থান ও পতন
ইকবালের মতে ‘ইজতিহাদ হচ্ছে ইসলামের গঠনশৈলীতে অগ্রসরতার নীতি।–[ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ পৃ. ১৪৮] ইহা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামী বিধানকে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে এবং শরীয়ার সীমারেখার মধ্যে যুগের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যহত রাখে। বস্তুত ইহা শরীয়াহর গতিশীলতার অন্যতম মৌলিক উপাদান।
ইজতিহাদের নীতির উৎস হচ্ছে –কুরআনের বহু পরিচিতি এ আয়াত, ‘এবং যারা চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে, তাদের আমরা পথ প্রদর্শন করি’। (১৯:৬১)। মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) সম্পর্কিত হাদীসটি সুপ্রসিদ্ধ। এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) যে বিষয়ে কোরআন-হাদীসে কোন দিকনির্দেশনা নেই সে বিষয়ে মুয়ায ইবনে জাবালের ইজতিহাদ প্রয়োগের ইচ্ছাকে অনুমোদন করেছিলেন।
ইসলামের সীমানা বৃদ্ধির সাথে সাথে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাহাবী এবং পরবর্তীতে সাহাবীদের শিষ্যরা নতুন নতুন পরিস্থিতি এবং সমাজ-রাষ্টীয় নানা নতুন জটিলতা নিরসনের জন্য ব্যাপকভাবে ইজতিহাদ প্রয়োগ করেছিলেন। ইজতিহাদের নীতি জীবরেন প্রগতিশীল পরিস্থিতিকে অপরিহার্য মর্মে উপলব্ধি করে ইসলামী আইনজ্ঞগণ বাস্তবজীবনের নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে ইজতিহাদ প্রয়োগ করেন। ইজতিহাদের বিষয়টি একটি হাদীসে সবিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। এখানে বলা হয়েছে কেউ যদি ভাল সহীহ নিয়তে ইজতিহাদের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং তাতে ভুলও করে তবুও আল্লাহ খুশী হন; আর যদি সফল হয়, তবে আল্লাহ দ্বিগুণ খুশী হন।
মহান ইসলামী আইনবিশারদ আবু হানিফাহ (হিজরী ৮০-১৫০ সন/৬৯৯-৭৬৭ খ্রি.); মালিক ইবনে আনাস (হিজরী ৯৭-১৭৯ সন.৭১৬-৮০১); মোহাম্মদ ইবনে ইদরীস আল সাফিঈ (হিজরী ১৫০-২০৪/৭৬৭-৮২০ খ্রি.) আহমাদ ইবনে হানবাল (হিজরী ১৬৪-২৪১/৭৮০-৮৫৫ খ্রি.) প্রমুখ ইজতিহাদের মাধ্যমে যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাসে তা অতুলনীয়। বিদ্যমান পরিস্থিতি ও উপস্থিত জ্ঞানের আলোকে উম্মতের সমস্যার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারা এমন রায় প্রদান করেছিলেন যার লক্ষ্য ছিল সত্যের সমীপে উপনীত হওয়া। তারা বার বার এ কথার উপর জোন দিয়েছিলেন যে তারা সাধ্যমত সঠিকভাবে বিষয়টি পরীক্ষঅ নিরীক্ষা করে তার উপর তাদের ব্যক্তিগত গবেষণালব্ধ মতামত প্রদান করেছেন, কিন্তু ‘এ রায় কোন মুসলমানের মান্য করা বাধ্যতামূলক নয়’।–[ সায়ীদ রামাদান, ‘Islamic Law: Its Scope and Equity’ পৃ: ৮৭]
সময়ের বিবর্তনের এই সব রায় একধরনের চিরন্তনতা লাভ করে যা ফিকাহশাস্ত্রের বিভিন্ন মাজহাবের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে আন্ত:মাজবাহ বিতর্ক স্ব স্ব স্থানে অনড় অবস্থানের সৃষ্টি করে। সপ্তম হিজরীর মধ্যভাগ বাগদাদের পতন এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা মুসলিম অঞ্চলগুলির দখল এ বিতর্ক অগ্নিতে আরো ইন্ধন যুক্ত করে। নিজ নিজ অবস্থানকে সংরক্ষণের এই অনুভূতি, ইকবালের ভাষায় ‘আইনগত ধারণায় খণ্ড খণ্ড কঠোরতার জন্ম দেয়, যা শরীয়াহ বিষয়ে অন্যান্য ইজতিহাদী মতবাদকে অস্বীকার করে বসল’।–[ ইকবাল, ‘The Reconstruction ofReligious Thought in Islam’ পৃ: ১৪৯-৫২] ফলে অধিকাংশ মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অন্ধ অনুকরণের (তাকলীদ আল আইমাহ) শিকারে পরিণত হল, যা ইসলামী অনুশাসনের শাব্দিক অনুসরণ ও অতীত ইজতেহাদী সিদ্ধান্তের অন্ধ আনুগত্যে পরিণত হল।–[ ইসমাইল আর. আল ফারুকী, ‘Historical Atlas of The Religions of the world’ (নিউইয়র্ক, ম্যাকমিলান, ১৯৭৪), পৃ: ২৬] এ ধরনের অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণের অত্যধিক বাড়াবাড়ি সৃজনশীলতার উদ্যমকে দারুণভাবে ব্যাহত করে। আইন কানুনকে কংকালে পরিণত এবং মর্মবস্তুকে বাদ দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্বতাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ফলে শরীয়াহ ইসলামের সোনালী যুগে যে প্রাণবন্ত ও গতিশীল সভ্যতা সৃজন করেছিল তার ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হল। ইসলামের পতনের কারণ হচ্ছে ইজতিহাদের স্বচ্ছন্দ প্রবাহের গতিরোধ ও অবক্ষয় এবং মর্মবস্তুকে বাদ দিয়ে ধর্মের বাহ্যিক খোলস ও খুটিনাটি বিষয় নিয়ে অনাবশ্যকভাবে লিপ্ত থাকা। উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ হতে প্রতীয়মান হয় যে, যদি সমাজের নৈতিক সংস্কার সংরক্ষণ করতে হয়, তবে ইজতিহাদকে তার সঠিক মর্যাদা প্রদান করতে হবে।
ইজতিহাদ শুধুমাত্র ঐসব প্রাজ্ঞবিজ্ঞ ইসলামী পণ্ডিতবর্গই পরিচালনা করতে পারেন যাদের কুরআন হাদীসের বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে এবং যারা অতীত ইসলামী আইনবিশারদদের ইজতেহাদী অবদান ও সমকালীন সমস্যার বিষয়ে সমকভাবে অবহিত আছেন।–[ মওদুদী, Islamic Law and Construction, পৃ: ৮০-৮১] যেহেতু এসব শর্তাবলী পূরণ “একজন ব্যক্তি মানুষের দ্বারা প্রায় অসম্ভব” তাই ইকবাল বিকল্প পন্থা হিসানে ইজতিহাদী প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন।–[ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’, পৃ: ১৪৯] সাংবিধানিকভাবে এরূপ প্রতিষ্ঠানকে ইজতিহাদের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের জন্য ক্ষমতা অর্পন করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সক্ষমতার ভিত্তিতে এমন সব মুজতাহিদদের (ইজতেহাদকারী) নির্বাচিত করা যায়। ইকবালের মতে, কেবলমাত্র এভাবে আইনগত বিষয়ে আমরা জীবনীশক্তি সঞ্চালিত করতে পারি এবং একে একটি বিবর্তনশীল রূপদান করতে পারি”।–[ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’, পৃ: ১৭৩-৪]
শরীয়ার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
উপরের আলোচনা হতে শরীয়াহর প্রকৃতি ও উৎসসমূহের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূঞ চিহ্নিত করা যেতে পারে। ইতিপূর্বে প্রদত্ত বিভিন্ন চিন্তাধারা শরীয়ার তাৎপর্য সুস্পষ্টভাবে উপলদ্ধির যৌক্তিকতা প্রদান করে।
প্রথমত শরীয়াহ হচ্ছে ঐশ্বরিক। ইহা ইসলামের শেষ নবী (সা) এর নিকট আল্লাহর প্রত্যাদিস্ট পবিত্র বাণী। মূলত ইহা ঐশী উৎস কুরআন ও সুন্নাহর উপর সংস্থাপিত। অন্যভাবে বলতে গেলে, শরীয়াহর উৎস হচ্ছে আল্লাহ ‘যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন… অবশ্যই সমগ্র সৃষ্টি ও সার্বভৌমত্বের মালিকাতা তাঁর’। (৭:৫৪)
প্রভৃ ও মালিক হিসাবে একমাত্র আল্লাহর নিকট মানুষেকে তার আত্মসমর্পণ করতে হবে। সেহেতু আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ, মানুষের কার্যাবলীকে তার নিয়ত দ্বারা বিচার করা হবে। সেহেতু এ বিশ্বাস শরীয়ার গুরত্বপূর্ণ দিক, তাই ইসলামে বিশ্বাসীদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার সাথে তা পালন করতে হবে। ইবরাহীম সুলায়মানের মতে তাই ইসলামে আইনের অর্থ ‘বিশ্বাসীদের আইন’ কেননা এ আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা এতে বিশ্বাস করে।–[ ইব্রাহীম সুলাইমান, ‘Islamic Law and law for Reform in Nigeria’ (৭-১০ এপ্রিল, ১৯৮১ নাইজেরিয়ার আহমাদু বেল্লো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইন শিক্ষকদের ১৯তম বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত নিবন্ধ)] তাই শরীয়াহ’র ভিত্তি হচ্ছে গভীর বিশ্বাস বা ঈমান। ঐশ্বরিক বিধায় শরীয়াহ চিরন্তন, ন্যায়ানুগ এবং সর্বদেশ ও সর্বসময়ের জন্য প্রযোজ্য।
দ্বিতীয়ত শরীয়া নির্দেশাত্মক নয় বরং আদর্শাত্মক। শরীয়াহ আচরণ বিধির উচ্চমান নির্দেশিকা হিসেবে এমন চরিত্র গঠন করে যা মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকে। সভ্য সমাজের মৌলিক লক্ষ্যসমূহ তথা ভালোমন্দ পার্থক্য করার মত মানসিক গঠন; দুর্বল, দুস্থ ও বঞ্চিতদের প্রতি সহানুভূতি; বাণিজ্যিক আদান-প্রদানে সততা; সকল প্রকার বঞ্চনা ও শোষণ হতে নারীসমাজকে রক্ষা করা; বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত রাখা; পারস্পরিক আলোচনা ও পবিত্র গ্রন্থের মাধ্যমে শাসন কার্য পরিচালনা করার কর্তব্যভার মানুষের উপর অর্পিত হয়েছে।–[ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’, পৃ: ১৪-১৯] মাদকাসক্তি, রিবা (সুদ), জুয়া ইত্যাদি ধরনের কার্যাবলী নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য শরীয়তের লক্ষ্য হচ্ছে জীবনের অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি (জরুরীয়াত), সুবিধাজনক দ্রব্যাদি (হাজিয়াত) এবং বিলাসিতা বা উৎকর্ষতামূলক দ্রব্যাদি (তাহসিনিয়াত) সরবরাহ করা। শরীয়াহ ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনকে পূণ্য বা ‘মারুফাত’ এর ভিত্তিতে গঠন করতে এবং পাপ পঙ্কিলতা বা ‘মুনকিরাত’ হতে মুক্ত করতে চায় (৩:১০৪)।–[ কুরআনের ‘মারুফাত’ শব্দটি ‘আদল’’, ‘ইহসান’ ও ‘ইতা দ্বী আল কুরবা (নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের দান করা) এর সহিত জড়িত। ‘মুনকার’ শব্দটি ‘ফাহেসা’ (নিন্দনীয় কাজ) এর সহিত জড়িত।] এভাবে সকল কর্মকে হালাল ও হারাম দু’ভাগে ভাগ করা যায় এবং প্রত্যেকটির রয়েছে বিভিন্ন স্তর। বস্তুত শরীয়াহ আচরণবিধিকে নৈতিকতার মাপকাঠিতে পাঁচভাগে ভাগ করেছে: বাধ্যতামূলক (ফরজ ও ওয়াজিব) ও সুপারিশমূলক। কিন্তু অবশ্য পালনীয় নয় (মানদুব), নিরপেক্ষ তথা পালনযোগ্য (মুবাহ), দূষণীয় কিন্তু সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয় (মাকরূহ) এবং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (হারাম)।–[ খাল্লাফ, ‘Ilm Usul al-Fiqh’, পৃ: ৮৪] মানুষের কার্যাবলীর বিভিন্ন মাত্রার নৈতিক দাবি অনুযায়ী এসব মূল্যবোধ ও বিধি সমাজকে এমনভাবে গঠনে সহায়তা করে যে তা মানুষের সকল কার্যাবলীতে সততা ও ন্যায় পরায়নতা বিস্তার করে। যেহেতু শরীয়াহ মূল্যবোধ ও নীতির সাথে সম্পৃক্ত, তাই এর নির্দেশনা ব্যক্তিমানুষকে সমাজের অসংখ্য ক্ষেত্রে সুনিপুণতা ও স্থিতাবস্থার সাথে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত শরীয়াহ হচ্ছে ব্যাপক। ব্যক্তি জীবনে মানুষের ব্যক্তিত্বের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নন্দনতাত্ত্বিক ও জৈবিক সকল দিক শরীয়াহর আওতাভুক্ত। সামষ্টিক জীবনে শরীয়াহর নির্দেশনা সামাজিক জীবনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য সকল ধরনের সামাজিক আচরণ ও কার্যাবলী আওতাভুক্ত করে। ইহজীবনে মানবজীবনের সমৃদ্ধি ও পরকালীন মুক্তির জন্য শরীয়াহ মাবন জীবনের সকল দিক ও অভিজ্ঞতা নিয়ন্ত্রণ করে।
এ প্রসঙ্গে এস. পারভেজ মঞ্জুর বলেন যে, অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা ও বাহ্যিক আইন, গুপ্ত ইচ্ছা ও প্রকাশিক কার্য, বাস্তব বিশ্বাস ও কার্যাবলীর মধ্যে যা কিছু বৈপরীত্য আছে তা শরীয়াহর সর্বপ্লাবী গতিশীলতার মাধ্যমে তার সমাধান হয়। একই সাথে ইহা আদর্শ ও চলার পথ। ঐশী ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ এবং সে ইচ্ছঅর বাহক হবার জন্য মানুষের সংকল্প ধর্ম, নৈতিকতা, আইন, সমাজতত্ত্ব এমনকি রাজনীতি এসব হচ্ছে ইসলামের ধর্মীয় ঐশ্বরিক দিকের অনন্য সাধারণ অবদান।–[ এস. পারভেজ মনজুর, ‘Quest for the Shariah’s Past and Future’, Inquiry: Magazine of Events and Ideas, ৩(১), জানুয়ারী, ১৯৮৭, পৃ: ৩৫।]
শরীয়ার অনুশাসনসমূহ শুধুমাত্র মানুষের বাহ্যিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের অন্তরের অন্ত:স্থলের অনুভূতি, অভিপ্রায় ও নিয়ত পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। শরীয়তের কিছু ব্যক্তিগত, কিছু সামাজিক, কিছু রাজনৈতিক এবং অন্যান্যগুলি নৈতিক পর্যায়ের। শরীয়তের সাধারণ ও বিশেষ, নৈতিক ও রাজনৈতিক সবগুলো অনুশাসনের সমন্বয়ই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে যা তাকে অন্যান্য আইন ব্যবস্থা থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করে।
চতুর্থত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শরীয়াহ হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে এমন একটি সামগ্রিকতা যার বিভিন্ন দিক ও ধারা তাওহীদ ও রিসালাতের একই নীতি হতে যৌক্তিক ও অপরিহার্যভাবে প্রবাহিত। শরীয়াহর ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয় বরং একই সুসমন্বিত ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ ও এক অংশ অপর অংশ হতে শক্তি সংগ্রহ করে। ইহা মুসলিম উম্মাহর দেহস্বরূপ, যে বিষয়ে রাসূল (সা) বলেছেন:
বিশ্বাসীগণ একে অন্যে মিলে একটি সুদৃঢ় অট্টালিকা স্বরূপ, যেন একটি জীবন্ত দেহ যেখানে একজন আঘাত প্রাপ্ত হলে অন্য সবাই একই ব্যথা প্রাপ্ত হয়।–[ ৩৯। মোনা আবুল ফদল, ‘Community,Justice, Jihad Elements of The Muslim Historical Consciousness’, American Journal of Islamic Social Sciences, ৪(১), ১৯৮৭, পৃ: ১৭।]
শরীয়াহ ধর্ম ও রাজনীতিসহ জীবনের কোন অংশের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করে না। জীবনের এমন কোন অঙ্গন নেই যেখানে শরীয়াহ কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি। এই নির্দেশনা দ্ব্যর্থহীন অথবা দ্ব্যর্থবোধক হতে পারে? কোথাও কঠোর যেমন ‘ফারাইদ’ ও ‘মুহররামাত’ এ ক্ষেত্রে, অথবা নমনীয় যেমন ‘মানদুব’, ‘মাকরুহ’ ও ‘মুবিহ’ এর ক্ষেত্রে। কিন্তু জীবনের কোন কিছুই শরীয়ার নির্দেশনার বাইরে নেই। শরীয়াহর দৃষ্টিকোন থেকে জীবন একটি অখণ্ড সমগ্রত। একটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে যাবন করতে হবে। শরীয়ার বিভিন্ন অংশকে আলাদা আলাদা করে দেখার অবকাশ নেই। শরীয়াহ তখনই সুচারু ও দক্ষভাবে কার্যকর হয়, যখন প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জীবনযাত্রা পরিচালনা করা হয়। তাই সাইয়েদ মওদুদীর মতানুসারে চুরির দায়ে হাত কাটার শুধুমাত্র পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত ইসলামী রাষ্ট্রে প্রযোজ্য যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিককে জীবিকার পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক সুযোগ প্রদান করা হয়েছে এবং যেখানে পাপাচার ও অবৈধ কাজ নিরোধ ও পূণ্য কাজকে উৎসাহিত করা হয়। এ বিধান ঐ সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয় যেখানে বৈষম্য, শ্রেণী সংঘাত ও দুর্বিষহ অর্থনৈতিক বিভেদ বিরাজমান। একইভাবে যে নোংরা সমাজে যৌনতা উদ্দীপক বস্তুর ছড়াছড়ি; নগ্ন ছবি, পুস্তক ও গান বিনোদনের মাধ্যমে সে সমাজে ব্যভিচারের জন্য শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি প্রযোজ্য নয়।–[ মওদুদী, ‘Islamic Law and Constitution’, পৃ: ৫৬।]
সর্বশেষ শরীয়াহ স্থায়ীত্ব (স্থিতিশীলতা) ও পরিবর্তন (স্থিতিস্থাপকতা) এর মধ্যে একটি সুষম সামঞ্জস্যশীলতা বিধান করেছে। এ বিষয়ে কুরআনের আয়াত ৫:৪৮-এ বর্ণিত হয়েছে, প্রত্যেক জাতির নিকট আমরা ঐশী কিতাব নাজিল করেছি এবং পথ প্রদর্শন করেছি। এভাবে আইনদাতা মহান আল্লাহ শুধু আইনই প্রদান করেননি, বরং শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যে থেকে স্থান, কাল অনুযায়ী নানাবিধ পার্থিব সমস্যার সমাথানের জন্য পথ খুঁজে নেবার আইন রচনার অনুমতি দান করেছেন।
যে সব বিষয় ‘ওয়াজিবাত’ ও ‘হারাম’ এর অন্তর্ভুক্ত শরীয়াহ বিশ্বাসীদের তা সুদৃঢ়ভাবে মানার নির্দেশ প্রদান করেছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বৃহদাংশ কর্মকান্ড মুবাহ শ্রেণীভুক্ত। যা ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতক পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে মানুষকে ব্যক্তিগত পছন্দ, স্বাধীনতা ও প্রবণতা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ প্রদান করেছে। শরীয়াহর এই অংশটুকু নমনীয় যা মানুষকে প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির প্রচুর সুযোগ ও সুবিধা দিয়েছে। মুসলিম আইনজ্ঞগণ নানা বিধি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করে দিছেছেন যাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এই পদ্ধতিসমূহের অধিকাংমই ‘ইজতিহাদ’এর ধারণার অন্তর্ভুক্ত, যা কুরআন ও সুন্নারহ পরিসীমার মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।
মুসলিম জাহাদের শরীয়াহ
শরীয়াহ ইসলামের মূলকেন্দ্র। সকল মূল্যবোধ, কার্য, নীতিমালার মূল মধ্যস্থতাকারী হচ্ছে শরীয়াহ এবং ইহা ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা নির্ধারণকারী উপকরণ। এতদসত্ত্বেও খোলাফায়ে রাশেদার পর দীর্ঘ দিন মুসলিম জাহানে শরীয়াহকে বিস্মৃত বা অবহেলা করা হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদার সময় শরীয়াহ সব কিছুর শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করত। ইসলাশী আইন বিশ্বস্ততার সাথে প্রয়োগ ও পালিত হচ্ছে কিতান সে বিষয়ে খলিফাগণ সবিশেষ লক্ষ্য রাখেতেন। অতঃপর অনেক শতাব্দী পর্যন্ত এই উচ্চমত আদর্শের সাথে সরকার সমূহের বাস্তব কর্মকান্ডের খুব কমই সাদৃশ্য ছিল। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাগণ এই শূণ্যস্থান পূরণের জন্য তাদের ইসলামী বৈধতার প্রতীকসমূহের সাথে নিজেদের জড়িত করত এবং নিজেদের ভাবমূর্তি ও সম্মান বৃদ্ধির জন্য ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও সেবার কাজে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করত। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের মুসলিম আইনজ্ঞগণ কর্তৃক ঘটনা উত্তর অনুমোদন এবং পরবর্তীতে প্রয়োজনীয়তার তত্ত্ব দ্বারা তাকে যুক্তিযুক্তকরণ –এ হতে প্রতীয়মান হয় যে শরীয়াহর আওতা হতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ক্রমেই দূরে সরে গিয়েছিল। শরীয়াহ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের এই বিভাজনের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ শরীয়াহকে গুরুত্বহীন ক্ষেত্রে ছুঁড়ে ফেলতে এবং প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে নিজেদের রচিত আইন প্রয়োগ করতে পেরেছিল।
অস্টিনের তত্ত্বের নীতিমালা অনুযায়ী, ইউরোপীয়ান সিভিল আইনসমূহ আইন, কার্যবিধি ও বিচার বিভাগীয় বিষয়াদিতে প্রতিস্থাপন করা হয। ফরাসী উপনিবেশসমূহে ‘নেপোলিয়ান কোড’ এবং ইংরেজ উপনিবেশসমূহে ‘কমন ল’ প্রচলন করা হয় এবং তা মুসলমাদের জন্য প্রযোজন্য হয়। প্রত্যেক মুসলিম অঞ্চলে একটি নতুন জাতীয় আইন ব্যাখ্যা গড়ে তোলা হয়; তবে মুসলমানদের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার বিষয় বিবেচনা করে মুসলিম পারিবারিক আইনসমূঞ অক্ষুণ্ণ রাখা হয়।–[ আনোয়ার আহমাদ কাদরী, ‘Islamic Jurisprudence in the Modern World, পৃ: ৮১-২।]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মুসলিম জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব অবস্থার উন্নতি ঘটাইনি। আইন ব্যবস্থার পাশ্চাত্যকরণ ছিল প্রতিষ্ঠিত প্রবণতা এবং শরীয়াহকে ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হল, তাছাড়া সেক্ষেত্রেও প্রভুত সংস্কার ও পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। তুরস্কে শরীয়াহকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে অনৈসলামিক আইন ব্যবস্থা প্রবর্তণ করা হয়। অন্যান্য মুসলিম দেশে পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে বিকৃত শরীয়াহর আইন জারি রেখে ফৌজদারী ও সাধারণ আইনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় মডেলের আইন বহাল করা হয়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরাদের মত দেশসমূহ শরীয়াহকে দেশের আইন স্বীকার করে নিলেও ইসলামী অনুশাসনের পরিপন্থী প্রথঅ ও আচরণও অনুমোদন করে। ইসলামী পণ্ডিতবর্গের সুদৃঢ় রায় হচ্ছে, আমীরাত ও অনুরূম মুসলিম দেশসমূহে শরীয়াহ’র দাবী অনুযায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত নেই। মরহুম আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে শরীয়াহর সার্বিক আঙ্কিকে সাধারণ আইককে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বৈরী বৈদেশিক শক্তি দক্ষ জনশক্তির অভার শরীয়াহ কার্যকরকরণের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করেছে।
তাই বর্তমানে এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দেখা যায়না, যাকে ইসলামী শাসন পদ্ধতির দাবী অনুযায়ী ইসলামী সরকারের নমুনা বা মডেল হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মুসলিম বিশ্বব্যাপি ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নের দাবীর প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান একটি অর্জন হচ্ছে -২৬টি মুসলিম দেশের শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত এবং এ মর্মে শাসনতান্ত্রিক ঘোষণা যে শরীয়াহ হবে সকল আইনের ‘উৎস’।
লক্ষ্যণীয় যে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হবে এবং শরীয়াহ সকল আইনের উৎস হবে এ মর্মে ঘোষণা দেবার কোন অবকাশ নেই। একটি ইসলামী শাসনতন্ত্রে স্বতই: শরীয়াহ ও ইসলামের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে; তাই এরূপ ঘোষণা অর্থহীন পুনরাবৃত্তি এবং অবাঞ্ছিত। রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটি একটি ইউরোপিয় ফর্মূলা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে আবরণ দেবার জন্য এটি মুসলিম দেশসমূহে আমদানি করা হয়েছে। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা বা না করা দ্বারা ইসলাম সমাজকে কিভাবে পরিবর্তন করবে তার উপর কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার করে না। এ ধরনের নামকরণের বাস্তব তাৎপর্যের চেয়ে প্রতীকি অর্থই অধিক এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে পশ্চিমা শিক্ষিতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সমালোচনাকারী ইসলামী ভাবধারায় সিক্ত ব্যক্তিবর্গকে তুষ্ট বা আশ্বস্ত করা।
শরীয়াহ বাস্তবায়নের অর্থ বর্তমানে বিরাজিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কার এবং বহিরঙ্গে প্রসাধনী পলেপ দেয়া নয়। এর অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিশীল করে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনগত চিন্তা ও পদ্ধতিকে পুনর্গঠিত করে তোলা। শরীয়াহর আহবান হচ্ছে বিজাতীয় চিন্তা ও জীবন পদ্ধতি অপসারণ করার জন্য সমস্ত সমাজকে জাগিয়ে তোলা; রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিবপত্যবাদের অবসাব ঘটান এবং ইসলামী সমাজ রাষ্ট্রী ব্যবস্থার পত্তনের জন্য ইসলামী মূল্যবোধের চর্চার প্রবাহিত করা।
উপসংহার
শরীয়াহ পরিভাষাটি প্রায়শই ভ্রান্তি বা ভুল বোঝাবুঝির শিকার এবং পাশ্চাত্য আইন সম্পর্কে যে ধারণা প্রচালিত তার সাথে ভ্রান্তিজনকভাবে শরীয়াহকে সমার্থক বলে গণ্য করা হয়। শরীয়াহকে ফিহাক বা আইনশাস্ত্রের সাথেও সমথক মনে করা হয়ে থাকে। তবে এ দু’টি পরিভাষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও অভিন্ন নয়। শরীয়াহ হচ্ছে উৎসের দিক থেকে ঐশ্বরিক, আর ফিকাহ মানব রচিত –আল্লাহ পাকের ঐশী ইচ্ছাকে উপলব্ধি, ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের মানবীয় প্রচেষ্টার ফল হচ্ছে ফিকাহ।
কোরান ও সুন্নাহর উদ্দেশ্য ঐশী ইচ্ছঅকে সংজ্ঞায়িত বা ব্যক্ত করা; আর ফিকাহ সেই ঐশী ইচ্ছাকে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করে এবং ব্যক্তিও সামগ্রিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিধিবিধান উদ্ভাবন করে। যাহোক, উভয়ই শরীয়র অংশ।
শরীয়াহ হচ্ছে মহাবিশ্বের স্রষ্টা, রক্ষক ও আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। উৎসের দিক থেকে ঐশী বিধায় প্রকৃতিগতভাবে শরীয়াহ অনেকাংশে নির্দেশাত্মক, সুসমন্বিত এবং সাংগঠনিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শরীয়াহ আল্লাহ সাথে মানুষের সম্পর্ক ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও দায়িত্ব, নিজের প্রতি ও অন্যান্য মানুষ ও প্রাণীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ন্ত্রন করে। সংকীর্ণ অর্থে একে ‘করণীয়’ ও ‘নিষেধ’ এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। জীবনের সকল অঙ্গনকে বেষ্টনকারী ঐশী জীবন বিধানের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এসব নির্দেশমালাকে অবলোকন করতে হবে। ইসলামী আইন নামে এখন যা দেখা যায় অথবা ইসলামীকরণ পরিকল্পনার অধীনে যা রচিত হচ্ছে, তা একটি বিশাল সমগ্রতার ক্ষুদ্র অংশবিমেষ করে যার কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই এবং সামগ্রিকতা বহির্ভূতভাবে বিচ্ছিন্নভাবে এর প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব নয়।
শরীয়াহ নিম্নবর্ণিত নীতির উপর সংস্থাপিত ১. সকল কিছুর আল্লাহ কেন্দ্রীকতা (তাওহীদ); ২. মুহাম্মদ (সা) এর নবুয়ত (রিসালাত); ৩. পৃথিবীতে মানুষের আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব (খিলাফাহ), এবং ৪. সৎসাকের আদেশ দান ও অসৎ কাজে নিষেধ করা (আমর বি আল মারুফ ওয়া আল নাহইয়ান আল মুনকার)। তাওহীদের ঘোষণা এবং মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র ক্ষমতা আল্লাহর। সেই জন্যই কুরআন নাজিল হয়েছে, প্রত্যাদিষ্ট নবী প্রেরণ তাই অত্যাবশ্যক, যাতে তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা, বিশ্বাসীদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ, বক্তব্য ও অনুমোদন (যা এক সাথে সুন্নাহ নামে অভিহিত) দ্বারা পরিচালিত করতে পারেন। কুরআন ও সুন্নাহ হতে ইতিবাচক বিধি আহরণ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার প্রয়োগ করাকে সামগ্রিকভাবে ‘ইজতিহাদ’ বলা যায়, বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত হয়ে তা নিম্নরূপ শব্দ রূপে প্রকাশিত হয়েছে যথা ‘ইজমা’, ‘ইসতিসলাহ’, ‘ইসতিহসান’, ‘ইসতিহসাব’ ও ‘উরফ’।
মুসলিম সমাজের মুখ্য নৈতিক ও আইনগত বিধান শরীয়াহ মুসলমানদের সামাজিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি এমনভাবে প্রসারিত করেছিল যে বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চল নিয়ে একটি সমৃদ্ধ ইসলামী সভ্যতা গড়ে উঠে। শরীয়াহ’র গতিশীলতা ও স্থিতিস্থাপকতায় ইজতিহাদের ভূমিকা বহুলাংশে প্রধান। এটা সুবিদিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা)এর সাহাবীগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের অধিকাংশ পণ্ডিতব্যক্তি এবং আইনশাস্ত্রের ধারা প্রবর্তক প্রণেতারা (মাজাহিব) নিজেরা ইজতিহাদ চর্চা করেছেন এবং অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতদের ইজতিহাদ চর্চা করতে আহবান জানিয়েছেন ও উৎসাহিত করেছেন। যে ইজতিহাদী সজ্ঞীবনী শক্তি মুসলমানদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনকুশলতা সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল এবং মুসলিম সমাজের প্রবৃদ্ধির শিকড়ে রস সিঞ্চন করেছিল, তা এক পর্যায়ে এসে অবস্থাচক্রে স্বীয় ভূমিকা পালনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তার স্থান দখল করে নেয় ‘তাকলীদ’ বা পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুকরণ।
‘তাকলীদ’ এর ফলশ্রুতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয় ও সামাজিক ক্ষয়িষ্ণুতা সৃষ্টি হয়েছে এবং ফলত পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে মুসলমানদের মৌন আত্মসমর্পণ ঘটেছে –সমকালীন এ উপলব্ধি ইজতিহাদের দুয়ার পুনঃ উন্মোচনের আহবান সৃষ্টি করেছে যাতে ইসলামের গতিশীল ও জীবন্ত সভ্যতার সৌধ পুনঃ বিনির্মাণ করা যায়।