মুহাসাবাহঃ ইসলামে জবাবদিহিতা
ইসলামে জবাবদিহিতা
প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুসলিম চিন্তাবিদগণ সংশ্লিষ্ট ইসলামী সাহিত্যসমূহ অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করে আদি হতে যে বর্ণাঢ্য মুসলিম সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থঅ চলে আসছে তাতে নাগরিকদের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা ও সরকারের নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা প্রণয়ন করে এসেছেন। সমাজের অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষায় সরকারের বিশেষ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দিয় তারা শরীয়াহর বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তারা শাসক শ্রেণীকে আইনের শাসন মেনে চলা এবং নাগরিক শ্রেণীকে অবৈধ আদেশ লংঘন করার নির্দেশনা দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। যে বিষয়ে লেখাসমূহ পরিলক্ষিত হয়নি তা হচ্ছে- ক. শাসক ও শাসকের আদেশের আইনগত বৈধনা নির্ণয়ের নীতিমালা খ. অবহেলা ও অসদাচরণের দোষে দোষী শাসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের যে বৈধতা প্রয়োজন তার প্রয়োগ পদ্ধতি নিরূপন। ইসলামের আর্থ-সামাজিক বাস্তবায়নের যে আন্দোলন আজকে বিশ্বব্যবাপী চলছে তার প্রেক্ষিতে এ ইস্যু দু’টি ভালোভাবে পরীক্ষঅ নিরীক্ষা করে শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যে এর সাংবিধানিক সমাধান খুঁজে বের করা বিশেষভাবে প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যে সরকার ও সরকারী কর্মচারীদের আইন ও জনগণের নিকট জবাবদিহিতার মুখোমুখি থাকার জন্য কি কাঠামো ও উপদেশমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে।
আইনসভাঃ প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা
সরকারের যে অঙ্গকে অনুসন্ধানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তা হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা বা আইনসভা। প্রদত্ত অনুসন্ধানের এ ক্ষমতাটি একটি অপরিহার্য ক্ষমতা এবং আইনসভার আইন প্রণয়নের পাশাপাশি একটি ক্ষমতা। হ্যারল্ড লাস্কির মতে, এই অনুসন্ধানের ক্ষমতা, ‘সরকারের অসততা বা অদক্ষতা প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধমূলক ক্ষমতা।–[ হ্যারল্ড জে.লাস্কী,’The American Democracy: A Commentary and an Interpretation’ (নিউইয়র্ক, দি ভাইকিং প্রেস, ১৯৪৩), পৃ: ৮৯]। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে:
‘আইনসভার প্রকৃত কাজ হচ্ছে সরকারকে অবলোকন করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা- এবং যদি সরকারের অধীনস্থ লোকেরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে, অথবা এমনভাবে কাজটি করে যা ন্যায়পরায়ণতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবে তাদেরকে তাদের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।–[ R.B. McCallum সম্পাদিত, ‘On Liberty and Consideration on Representative Government (অক্সফোর্ড, বাসিল ব্ল্যাকওয়েল, ১৯৪৮) পৃ: ১৭২] আইনসভা যদি নির্বাহী বিভাগের কাউকে অপসারণ করতে চায় তা অভিশংসনের মাধ্যমে করতে হবে।
অভিশংসন মানে চার্জ বা অভিযোগ আনয়ন।–[ Raoul Berger, Impeachment The Constitutional Problems (ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩), পৃ: ৩] এটা গ্রান্ড জুরি কর্তৃক অভিযুক্তকরণের সমতুল্য। মার্কিন ইতিহাসের বৃহদাংশ জুড়ে নিম্নপদস্থ বিচারকদের’ তাদের ‘নোংরা অসদাচরণের জন্য’ অপমানের নিমিত্তে অভিশংসন প্রথা ব্যবহৃত হয়েছে।–[ Raoul Berger, Impeachment The Constitutional Problems (ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩), পৃ: ৯১, ১১৮] যাহোক প্রকৃত প্রস্তাবে অভিশংসন প্রথাটি রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক বা ফৌজদারী অপরাধের জন্য অপসারণার্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১ নং আর্টিকেল-এর রাষ্ট্রপতিকে তার পদ হতে বিশ্বাসঘাতকতা, ঘুষ অথবা অন্যকোন বড় অপরাধ ও অসদাচরণের জন্য অপসারণের বিধান রাখা হয়েছে। সংবিধান আইনসভাকে অভিশংসরেন ক্ষমতা দিয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের জন্য বিচার হবে কিনা তার ক্ষমতা দিয়েছে। আইনসভার অধিকারং সদস্য অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিলে বিষয়টি সিনেটে প্রেরিত হয়। সিনেটের সব সদস্য মিলে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে অভিশংসন বিচারালয় সংগঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগতভাবে হাজিরা দিতে পারেন অথবা অনুরোধপূর্বক হাজির হওয়া হতে অব্যাহতি পেতে পারেন। উভয় পক্ষের শুনানীর পর, সিনেট ভোট প্রদান করে। অভিশংসনের প্রতদফার অপরাধ সাব্যস্ত হবার জন্য দুই তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। এ পর্যন্ত একজন রাষ্ট্রপতি এন্ড্রু জনসনকে সিনেটের সামনে হাজির হতে হয়েছে, কিন্তু এক ভোটের জন্য তিনি অভিশংসন হতে রক্ষা পান। আরেক জন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন নিশ্চিতভাবে অবিশংসনে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি পদ হতে অপসারিত হন এবং ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সম্মানজনক ও বিশ্বাসের পদে আসীন হতে পারেন না। যে কোন ক্ষমতার ন্যায়, অনুসন্ধানের ক্ষমতাও দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে। অভিশংসনের বিধান কোন অজনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে অপসারণের জন্য রচিত হয়নি, যদিও এ উদ্দেশ্যেই ১৮৬৮ সালে রাষ্ট্রপতি এন্ড্রু জনজনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের ক্ষমতাটি ব্যবহৃত হয়েছিল। অভিশংসন পদ্ধতির অপব্যবহার হতে প্রতীয়মান হয় যে প্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতা প্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থে অভিশংসন প্রথার ব্যবহার হতে পারে।
শাসন কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য কুরআন ও সুন্নাহ
শাসকের কর্তৃত্ব এবং শাসিতের দায়িত্ব সম্পর্কে কুরআনের সূরা ৪ এর আয়াত ৫৯-এর বিশ্বাসীদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে যে ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল তাঁদেরকেও (ওয়া উলি আল-আমর মিনকুম)’।–[কুরআন দু’বার ‘উলু আল আমর’ এর উল্লেখ রয়েছে (৪:৫৯; এবং ৪:৮৩)। ইবনে মনজুরের মতে শব্দটি দ্বারা প্রধান কর্মকর্তাবৃন্দ ও জ্ঞানী লোকদের বুঝিয়েছেন। দ্রষ্টব্য ইবনে মনজুর, ‘Lisan al-Arab’ (কায়রো, ১৯৬৫), আল আরব, ভলিউম-৪, পৃ: ৩১। আল তাবারী, আল কুরতুবী, ইবনে কাহির প্রমুখ একমত পোষণ করেন যে এই শব্দটি দ্বারা শাসক, আইনশাস্ত্রবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গকে বুঝান হয়েছে। তবে আল কুরতুবী ‘আল উমারা’ শব্দ দ্বারা জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গকে বুঝিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে উলামা’দের সাথে আলোচনা করা এবং প্রদত্ত পরামর্শ মান্য করা বাধ্যতামূলক।দ্রষ্টব্য আবদ আল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল কুরতুবী, ‘al-Jami-li-Ahkam al-Quran’ (বৈরুত: Dar Ihya al-Turath al-Arabi, ১৯৫৯) ভলিউম-৩, পার্ট-৫, পৃ: ২৬০।] কর্তৃত্বশীলদের পূর্বে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ক্রিয়াপদ ‘মান্য করা’ উহ্য রেখে বা বাদ দিয়ে শাসকের প্রতি আনুগত্যকে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) প্রতি আনুগত্যের শর্তাধীন করা হয়েছে। এ শর্তটি ‘সঠিক ঈমান’ এবং রীতিনীতি যথাযত মান্য করা। অধিকন্তু শাসকের বা কর্তৃত্বশীলদের অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে এবং একবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর তা প্রয়োগ করতে হবে (৩:১৫৯)। সরকারকে আমানত হিসাবে ঘোষণা করে, কুরআন শাসকদের ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন করতে (৪:৫৮) ও নির্দয়তা পরিহার করতে (৩:১৫৯), জনকল্যাণমূলক কাজ করতে, অভাবী লোকদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে এবং ধনীদের স্বার্থে সমাজের ক্ষতি না করতে (৫৯:৭) আহবান জানিয়েছে।
জামাখসারী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী আদেশ জানী করার দ্বারা শাসকশ্রেণী জনগণের আনুগত্য পাওয়ার অধিকার হারায়।–[ আবু আল কাশিক মাহমুদ ইবনে উমর জামাখসারী, ‘al-Kashshaf’ (বৈরুত; দার আল মারিফাত) ভলিউম-১, পৃ: ২৯০।] কুরআনে বেশ কিছুসংখ্যক আয়াত রয়েছে যেখানে সুস্পষ্টভাবে তাদের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে যারা ‘নিজেদের খেয়ালখুশী মতে নির্দেশ জারী করে (১৮:২৮)’ এবং ‘যারা আল্লাহ প্রদত্ত সীমারেখা লংঘন করে (২৬:১৫)’। বস্তুত কুরআন বিশ্বাসীদের উপর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাধ্যতামূলক করেছে, যখন জুলুম আসে তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা রচনা করতে (১৩:৩৯) এবং ‘আল্লাহর পথে এবং সহায়হীন নর, নারী ও শিশু, যারা নির্যাতিত তাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে (৪:৭৫)’, আহবান জানিয়েছে।
উপরোক্ত কুরআনের দ্ব্যর্থহীন আহবান কতিপয় হাদীস দ্বারাও শক্তিশালী হয়েছে, যেখানে মুসলমানদের শাসনকর্তৃত্বকে মান্য করতে বলা হয়েছে শুধু তাদের ছাড়া যারা ‘পাপ কাজ করতে আদেশ করে’।–[ সহীহ মুসলিম, অনুবাদ: আবদুল হামিদ সিদ্দিকী, (বৈরুত, দার আল আরাবী, ১৯৭১), ভলিউম-৩, সংখ্যাঃ ৪৫৩৩, পৃ: ১০২২।]
এ ধরনের ক্ষেত্রে আনুগত্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে লুপ্ত হয়ে যায়, কেননা, ‘স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে, এ ধরনের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জীবের প্রতি কোন আনুগত্য নেই’।–[‘Mishkat al-Masabih’ উদ্ধৃত করেছেন মওদুদী, ‘Islami Law and Constitution’ অনুবাদ ও সম্পাদনা: খুরশীদ আহমদ (লাহোর: ইসলামী পাবলিকেসন্স, ১৯৬৭; পৃ.২৫৭; মওদুদী উদ্ধৃত আরেকটি হাদীস হচ্ছে, ‘যারা আল্লাহকে অমান্য করে তাদের প্রতি কোন আনুগত্য নেই’, ভলিউম-৩, সংখ্যাঃ ৪৫৩৩, পৃ: ১০২২।] আনুগত্য ‘শুধুমাত্র পুণ্য কাজে বাধ্যতামূলক’।–[ সহীহ মুসলিম, ভলিউম-৩, নং ৪৬৩৪, পৃ: ১০২২] বস্তুত নবী করিম (সা) বিভ্রান্ত ও দুষ্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না তোলা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন:
‘আল্লাহর শপথ! তোমরা অবশ্যই সত্যকে তুলে ধরবে এবং অন্যায়কে রোধ করবে এবং তোমরা দুষ্কৃতিকারীর হাত প্রতিহত করবে, যে হাতকে মুচড়ে সত্যের (আল-হাক্ক) অনুবর্তী করতে এবং ন্যায় কাজ করতে তাকে বাধ্য করবে- সংখ্যায় আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে একে অন্যের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করবেন’।–[ মোহাম্মদ আসাদ, ‘The Principles of State and Government in Islam’ (জিব্রালটার, দার আল আন্দালুস, ১৯৮১), পৃ: ৮১-২]
অধিকন্তু নবী করিম (সা) এর সমগ্রাজীবন ছিল নির্যাতন, নিগ্রহ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত যুদ্ধ স্বরূপ। তার সমগ্র জীবন ছিল সত্যের মূর্তপ্রতীক (উসওয়াহ হাসানাহ) যা মুসলমানজের জন্য সতত অনুসরণযোগ্য।
খোলাফায়ে রাশেদীন
সুন্নী মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদ ও চিন্তাবিদগণের মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে যে খোলাফায়ে রাশেদা কুরআন সুন্নায় বিধৃত আদর্শ মানদণ্ড কঠোরভাবে মেনে চলেছেন। ‘ন্যায়পরায়ণতা উজ্জ্বলতায় পূর্ণ’ এ যুগ ছিল আদর্শ বিচার ও বৈধতা দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
কেউ, বংশানুক্রমিক রাজত্বের গোড়াপত্তন করেননি বা কেউ বলপ্রয়োগপূর্বক বা ছলনা দ্বারা ক্ষমতা দখল করেননি।–[ আবুল আলা মওদুদী, ‘Political Thought in Early Islam’ এম এম. শরীফ সম্পাদিত ‘A History of Muslim Philosophy’ (ওয়েসবেভেন, অটো হারামোউইটজ, ১৯৬৩), ভলিউম- ১, পৃ: ৬৫৯] তাঁরা আইনসঙ্গত পদ্ধতিতে তথা নির্বাচনের মাধ্যমে খিলাফতের আসনে আসীন হয়েছিলেন এবং তারা শরীয়াহ অনুসারে ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। আনুগত্যকে যে শর্তাধীন করা হয়েছে তা উজ্জ্বলভাবে প্রথম খলিফা আবু বকরের উদ্বোধনী ভাষণে বিবৃত হয়েছিল:
‘হে লোকসকল, আমাকে আপনাদের বিষয়ে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যদিও আমি আপনাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট নই। যতি আমি ভালো কাজ করি তবে আমাকে সাহায্য করুন আর আমি যদি বিপথগামী হই তবে আমাকে শুধরে নিদ সঠিক পথে পরিচালনা করুন… আমাকে ততক্ণ মান্য করুন যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মান্য করি। যদি আমি আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুশাসন ভঙ্গ করি, তবে আমি আপনাদের আনুগত্যের দাবীদার হতে পারি না। আপনাদের পছন্দমত যোগ্য নেতা নির্বাচিত করতে পারবেন’।–[ আবু মোহাম্মদ আবদ আল মালিক ইবনে হিশাম ‘al-Sirah al-Nabawiyah’; সম্পাদনায়: এম.আল সাক্কা, আল আহইয়ারী ও হাফিজ সালাবী (কায়রো: মুস্তাফা আল বাবী আল হালাবী হিজরী ১৩৫৭/১৯৫৫ খ্রী:, ভলিউম ২, পৃ: ৬৬১]
একইভাবে তার উত্তরসূরী ওমর ঘোষণা করেছিলেন:
‘অবশ্যই আমি আপনাদের একজন, আমি চাইনা যে আপনারা আমার খেয়ালখুশীকে অনুসরণ করবেন’-[ ইয়াকুব ইবনে আবু ইউসুফ, ‘Al-Tabaqat al-Kurba’ (কায়রো, সালফিয়া প্রেস, হিজরী ১৩৫২) পৃ: ১৪] তৃতীয় খলিফা ওসমান শুধু কোরান সুন্নাহকে অনুসরণ করেননি, বরং মুসলমানগণ তাঁকে তাঁর দু’যোগ্য পূর্বসূরীর পথ অনুসরণে বাধ্য করেছিল। তিনি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালানায় বিশ্বাস করতেন এবং শরীয়াহকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। এটা সত্য যে তিনি বিদ্রোহীদের দ্বারা তার পদত্যাগের দাবীকে মেনে নেননি। এর কারণ হচ্ছে এ পদত্যাগের দাবী ‘আহল আল শুরা’ হতে আসেনি, বরং এসেছিল বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে যারা তলোয়ারের মুখে পদত্যাগ দাবী করেছিল। বস্তুত ‘শুরা’র একজন সদস্য মুয়াধ ইবনে জাবাল খলিফাকে পদত্যাগ করনে নিষেধ করেন যাতে তা তার উত্তরসূরীর জন্য নজীর সৃষ্টি না করে।–[ মোহাম্মদ ইবনে সাদ, ‘Al-Tabaqat al-Kurba’ (বৈরুত, দার আল তাবাহ, ১৯৫৭); ভলিউম ২, পৃ: ৬৬ এবং ভলিউম ৩, পৃ: ৬৮] চতুর্থ খলিফা আলী গোপনে অথবা জনগণের অনুমোদন ব্যতিরেকে খলিফার পদ গ্রহণে অস্বীকার করেন। খোলাফায়ে রাশেদার কেউ সম্রাটের ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন না এবং শর্তহীনভাবে জনগণের আনুগত্য দাবী করতেন না।
খিলাফতের আদর্শ ব্যবস্থার বিশুদ্ধরূপ ও জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য দীর্ঘদিন বজায় রাখতে পারেননি। নির্বাচিত খিলাফত ব্যবস্থঅ সহসা উমাইয়া খলিফাদের হাতে একনায়কতন্ত্রে পরিবর্তিত হল এবং আব্বাসীয় খিলাফতের হাতে পরবর্তিতে আরো বেশী দুর্নীতিপরায়ণগ্রস্ত হ পড়ল। খিলঅফত ব্যবস্থঅর এ অবস্থার মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদদের খিলাফত কাঠামোর বিষয়ে ভাবনাচিন্তা ও গবেষণায় নিমগ্ন করতে উদ্ধুদ্ধ করল।
মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদ ও চিন্তাবিদ
খোলাফারে রাশেদার সময়কাল ছিল এক অত্যুজ্জল আদর্শে চিহ্নিত উৎসস্থল, যাকে ভিত্তি ও অনুসরণ করে মুসলিম চিন্তাবিদগণ একটি আদর্শ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার নকসা প্রণয়ন করেন। মাওয়ার্দী থেকে মওদুদী পর্যন্ত সমস্ত মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদ ও চিন্তাবিদগণের লিখনীতে এ রূপরেখা পাওয়া যায়। সময়ের বিবর্তনে খিলাফত অর্থহীন সম্মানসূচক এক খোলাসে পরিণত হল; স্থানীয় শাসকরা বলপূর্বক ঐ সকল অঞ্চল শাসন করতে থাকে; অন্যান্যরা খলিফা দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত ছিলেন না। এ ধরনের একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মুসলিম সমাজের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলল। আল মাওয়ার্দী এ ধরনের পরিস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ শর্তে যে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী স্থানীয় শাসকদের শরীয়াহর নির্দেশনা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে।–[ কমরুদ্দিন খান, ‘আল মাওয়ার্দী’, সংকলিত এম এম শরীফ সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘A History of Muslim Philosophy’, পৃ: ৭২৯] আল গাজ্জালী উপলব্ধি করলেন যে, সমকালীন সরকার বস্তুত সামরিক শক্তিতে পরিচালিত শরকার’; তাইতিনি নামেমাত্র খলিফা ও প্রকৃত শাসন ‘সুলতানদের’ মধ্যে সহযোগীতার ভিত্তিতে এক নতুন সম্পর্ক বিন্যস্ত করতে চাইলেন।–[ ই.আই.জে রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam: An Intoductory Outline’ (ক্যামব্রিজ, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮), পৃ: ৩৮-৪৩] ইবনে জামাহ তাঁর ‘কাহর ওয়া খালবাহ (শক্তি ও বিজয়)’ তত্ত্বে সামরিক শক্তিকে শাসনকর্তৃত্বের অপরিহার্য উপাদান হিসাবে গ্রহণ করেন।–[ই.আই.জে রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam: An Intoductory Outline’ (ক্যামব্রিজ, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮), পৃ: ৩৮-৪৩ পৃ: ৪৩-৫১; আরো দ্রষ্টব্য এইচ.এ. আর গীব ‘Constotutional Organization’; মজিদ খাদ্দুরী ও এইচ.জে লেইবেসনী সম্পাদিত ‘Law in the Middle East’ (ওয়াশিংটন ডি.সি, The Middle East Instotute, 1955) ভলিউম- ১; পৃ: ৪৫] এই ধরনের ধারণা ও লিখনী সমূহ খলিফাকে এমনকি শরীয়াহ লংঘনকারী শাসককেও অমান্য করার নীতির সুর গরম করে তোলে।
প্রচলিত পরিস্থিতির আলোকে আইন শাস্ত্রবিদগণের চিন্তাধারা নতুনভাবে বিনির্মাণের প্রচেষ্টাকে বিভিন্নভাবে দেখা হল- যুক্তি প্রদর্শন করা হল যে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ খলিফাদের প্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন।–[ হামিদ এনায়েত, Modern Islamic PoliticalThought’ (লন্ডন, ম্যাকমিলান প্রেস, ১৯৮২) পৃ: ১১; রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’ পৃ: ২৭] পক্ষান্তরে ক্ষমতা দখলকারীদের বাস্তব শাসন ক্ষমতা ও খলিফার নীতিগত ক্ষমতা উভয়কে সামঞ্জস্য বিধান করার পক্ষাপতি আইনশাস্ত্রবিদগণ এমন শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতত্ত্ব উপস্থাপন করেন যেখানে বাস্তব ক্ষমতাভোগকারী শাসনকর্তাদের শরীয়াহ অনুবর্তী থাকা ও সমাজের স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ণ রাখার উপর জোর প্রদান করা হয়। খিলাফতের প্রতিষ্ঠানটিকে তারা শরীয়াহর সার্বভৌম প্রতীক হিসাবে গণ্য করে উম্মাহর অবিভাজ্যতা কামনা করেন। যদিও খিলাফত ক্ষমতাশূণ্য হয়ে পড়েছে, তবুও এটা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন যাতে খিলাফতের নামে আদালত কর্তৃক আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয় এবং রাষ্ট্রের ভিতর আর্থিক লেনদেনের আইনগত ভিত্তি থাকে। বর্তমান স্থিতাবস্থঅ মেনে নেয়া মানে একে আইনগত বৈধতা প্রদান করা নয় বরং স্বৈরতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তণ করে বৈধ সরকার না আসা পর্যন্ত একটি সাময়িক অবস্থা হিসাবে মেনে নেয়া মাত্র। আল গাজ্জালীও স্বীকার করে নেন যে এ ধরনের অনভিপ্রেত অবস্থঅ মেনে নেয়া পরিস্থিতির শিকার হওয়া মাত্র। তিনি একে বাধ্য হয়ে মৃতপশুর মাংস ভক্ষণের সমান হিসাবে তুলনা করেছেন।–[ আল গাজ্জালী, ‘al-Iqtisad fi al I’itiqad’, যা রুবেন লেভী কর্তৃক উদ্ধৃত ‘The Social Structure of Islam’ ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৭) পৃ: ২৯১] তার পূর্বে আল মাওয়ার্দীও স্বীকার করেছেন যে অবৈধ আমীরকে স্বীকৃতি প্রদান আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, তবে জনশৃংখলা বিনষ্ট হতে পারে এ আশংকায় এ ব্যবস্থা মেনে নেয়া ছাড়া অত্যন্তর নেই।–[ গীব, ‘Constitutional Organization’, পৃ: ১৯] কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে বর্তমান স্বৈরশাসনের চেয়েও আরো বেশী জনগণের দুঃখ দুর্দশা বাড়িয়ে তুলবে। তাই এসব আইনশাস্ত্রবিদগণ ‘দু’টি মন্দের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম মন্দ’কে গ্রহণের নীতি গ্রহণ করলেন। কেননা, বিদ্রোহের দ্বারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভাঙ্গন জনগণের জন্য অধিকতর অমঙ্গল ও দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনবে। তবে এমন একজন আইনশাস্ত্রবিদও পাওয়া যাবেনা যিনি এমন ফতওয়া বা মতামত প্রদান করেছেন যে ইসলাম সকল অবস্থাতে সকল শাসকের আনুগত্য করতে মুসলমানদেরকে কোনরূপ বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। উল্লেখযোগ্য যে, পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে স্বৈরশাসনকে মেনে নিলেও, আইনশাস্ত্রবিদগণ শাসন ক্ষমতার অপরিহার্য অংশ হিসাবে ন্যায়পরায়ণতা, অবিচার ও অন্যায়ের ধ্বংসাত্মক পরিণতি, আল্লাহর রাহে কাজ করা ও জনগণের কল্যাণার্থে সর্ববিধ কার করার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান থেকে বিরত থাকেনি। আল গাজ্জালী, নিজাম-ইল-মূলক (মৃত্যু হিজরী ৪৮৫ সন/১১৯২ খ্রি.) ও শাসকদের আচরণ ও কার্যবিধি বিষয়ে লিপিবদ্ধকারী প্রখ্যাত পণ্ডিতগণ উপরোক্ত মর্মে প্রচুর সারগর্ভ গ্রন্থ-নিবদ্ধ রচনা করেছেন। আল মাওয়ার্দী এমনকি প্রয়োজনের চাপেও খলিফার গুণাবলী হ্রাসে সম্মত ছিলেন না এবং শর্তহীন আনুগত্যের দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইমাম আবু হানিফা অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে শরীয়ার বিধান লংঘনকারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুধুমাত্র ‘প্রাণ ও শক্তি ক্ষয়ের’ মাধ্যমে বিলীন হয়ে যাওয়া উচিৎ নয়।–[ মওদুদী, ‘আবু হানিফা এবং আবু ইউসুফ’, উদ্ধৃত এম.এস. শরীফ সম্পাদিত ‘A History of Muslim Philosophy, ভলিউম ১,পৃ: ৬৮৮]
শাসানীয়ান সাম্রাজ্যের শাসকদের প্রতি ইমাম আবু ইউসুফ কর্তৃক খোলাফায়ে রাশেদার পদাংক অনুসরণের আহবান কার্যত তাদের শাসনপ্রণালীর সমালোচনা হিসাবে গণ্য।–[ আবু ইউসুফ, ‘Kitab al-Kharaj’, ভূমিকা] ইবনে জামাহ বল প্রয়োগপূর্বক ক্ষমতা দখলকারীদের স্বীকৃতি প্রদান করলেও, ঐসব শাসকবর্গকে ধর্মের মর্মবাণী রক্ষা, আইনগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, শরিয়াহ নির্ধারিত পন্থায় কর আদায় ইত্যাদি ইসলামী বিধি বিধান পালন যে বাধ্যতামূলক তা উল্লেখ করেছেন।–[ আলবার্ট হাওরানী কর্তৃক ইবনে জামাহ উদ্ধৃত ‘Arabic Thought in the Liberal Age, 1798-1939’ (লন্ডন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭০), পৃ: ১৫] আবু আলী ইবনে সীনা (হিজরী ৩৭৯-৪২৮ সন/৯৮০-১০৩৭ খ্রি.) জবর দখলের নিন্দা করেছেন এবং অযোগ্য খলিফার বিরুদ্ধে যোগ্য বিদ্রোহী’ কে সমর্থনের আহবান জানিয়েছেন।–[ রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’, পৃ: ১৫৩]
এ বিষয়ের উপর ইমাম ইবনে তাইমিয়া আরে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তিনি ইবনে জামেয়ার মতামতের জন্য তার নিন্দা করেন এবং শাসকশ্রেণীর উপর তাদের নীতিবিচ্যুতির জন্য এমন সুদৃঢ় আক্রমণ পরিচালনা করেন যে প্রায়শঃই তাকে কারাবরণ করে হত। তিনি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের অংশ গ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। বিশ্বাসীদের তাদের নিজেদের বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে কুরআন সুন্নাহ বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে মর্মে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।–[ তাকী আল দ্বীন ইবনে তাইমিয়া, ‘Al-Siyasah al-Shariyah fi islam al-ra’ya wa al-ra’yah (মিশর, দারুল কিতাব আল আরাবী) পৃ: ৮-৯] তিনি আরে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সরকার হচ্ছে একটি আমানত এবং শাসক ও শাসিত উভয়ে মিলিতভাবে ব্যবস্থা ব্যক্তিগত ইচ্ছামাফিক শাসন পদ্ধতি পরিচালনার বিরোধী এবং এ ব্যবস্থা শরীয়াহ নির্দেশিত সমতার ভিত্তিতে রচিত শাসন ব্যবস্থঅ; শাসকের প্রতি আনুগত্য শাসক কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ বৈধ ও আইনসঙ্গত কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার উপর নির্ভরশীল; স্বৈরশাসক ‘যারা শরীয়াকে পরিত্যাগ করেছে যদিও তারা কলেমা শাহাদাতের দু’টি সাক্ষ্য প্রদান করেছে’ তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং এভাবে শাসককে অমান্য করা ধর্মীয় কর্তব্য।–[ তাকী আল দ্বীন ইবনে তাইমিয়া, ‘Al-Siyasah al-Shariyah fi islam al-ra’ya wa al-ra’yah (মিশর, দারুল কিতাব আল আরাবী) পৃ: ১২৭] ইবনে তাইমিয়ার এ বলিষ্ঠ ও শরীয়াভিত্তিক উপস্থাপন ও তত্ত্ব পরবর্তীতে ইবনে খালদুন, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল (হিজরী ১২৯০-১৩৫৭ সন/১৮৭৩-১৯৩৮ খ্রি.) সাইয়েদ কুতুব, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ও অন্যান্যদের লিখনীতে বলিষ্ঠতরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁদের সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী লিখা কুরআন ও সুন্নাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিংশ শতাব্দীর ইসলামী আন্দোলন সমূহকে প্রেরণা শক্তি জুগিয়েছে।
অভিশংসনের ভিত্তিভূমি
সরকার ও শাসন কর্তৃত্বের উপর আল মাওয়ার্দী হতে আজ পর্যন্ত সকল প্রখ্যাত লেখকদের লিখনী পাঠ করলে আশ্চর্য হতে হয় যে তারা কতিপয় বিষয়ের উপর আপোহীনভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন এবং এতে কোন ছাড় দেননি, যদিও তারা ভালোভাবেই জানেন যে, কেবলমাত্র খোলাফায়ে রাশেদার সময়েই এসব নীতিগত বিষয় বাস্তবে রূপায়িত হয়েছিল। সরকারের নির্বাহী বিভাগের সাথে জড়িত এসব নীতিমালা সমূহ ‘আইনসঙ্গত’ ও ‘বৈধতা’ এই দুটি ভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। এই দুটি নীতির যেকোন একটির লংঘন অধিষ্ঠিত শাসনকর্তার অপসারণের ভিত্তিভূমি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
বৈধতা
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা শাসনকর্তা সম্পর্কে মুসলিম পণ্ডিতগণ বিশাল অভিসন্ধর্ভ রচনা করেছেন, তাতে এপদের নির্বাচনী প্রকৃতির উপর সবচেয়ে বেশী জোর প্রদান করা হয়েছে। তারা ‘গণমানুষের উপর ঐশী নির্দেশনা এবং ইজমার অভ্রান্ততার উপর অনমনীয়ভাবে নির্ভর করেছেন।–[ এইচ. এ. আ. গীব, ‘Al-Mawardi’s theory of the Khilafa’ ইসলামিক কালচার, ভলিউম ২ (জুলাই, ১৯৩৭), পৃ: ২৯৪।] আল মাওয়ার্দী খলিফা নির্বাচনে নির্বাচনী পদ্ধতির পক্ষে যু্ক্তি প্রদর্শন করেছেন; সাইয়েদ কুতুবের মতে যিনি (খলিফা) একটি উৎস শরীয়াহ ও শাসিত মানুষের ইচ্ছা আশা আকাঙ্ক্ষা হতে সকল অধিকার ও কর্তৃত্ব প্রাপ্ত হন।–[ সাইয়েদ কুতুব, ‘Ma’rakat al-Islam Wa al-Ra’smaliyah (বৈরুত, দার আল শুরুক, ১৯৭৫) পৃ: ৭৩] আল্লামা মওদুধীর মতে কেবলমাত্র তিনটি নীতি প্রতিফলিত হলে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে:
১. প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তার নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে সাধারণ জনগণের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে, কারো নিজকে বলপূর্বক শাসক হিসাবে চাপিয়ে দেবার ক্ষমতা বা অধিকার থাকবে না।
২. কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণীর শাসনকর্তৃত্বের উপর একচেটিয়া ক্ষমতা বা অধিকার থাকবেনা;
৩. নির্বাচন সকল প্রকার চাপ বা প্রভাবমুক্ত হবে।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ পৃ: ২৫২]
সরকারের এইসব উচ্চতম আদর্শের মানদণ্ড ঐশী গ্রন্থে বিধৃত ‘শুরা’র উচ্চতম আদর্শ এবং ভালো কাজকে উৎসাহিত ও মন্দ কাজকে রোধ করার অনুশাসন হতে আহরণ করা হয়েছে এবং বস্তুত পক্ষে প্রথম চারজন মহৎ খলিফার স্বর্ণযুগে তা স্বতঃস্ফুর্তভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল। মধ্যযুগের খলিফাদের সময় ঐ সব নীতিমালার বাস্তবায়ন কল্পনাতীত ছিল, তাই আইনশাস্ত্রবিদগণ তখন প্রত্যেক ব্যক্তির খলিফা নির্বাচনে অংগ্রহণের অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রদান করেননি। তারা অবশ্য কখনো বংশানুক্রমিক শাসন পদ্দতিকে সমর্থন করেন নি, যদিও তা তথাকথিত প্রচলিত বায়াত প্রথার সামষ্টিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন; এ নির্বাচন পদ্ধতি তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হতে হবে যারা জনগণতান্ত্রিকতার আলকেল্লায় আবৃত করা হতো। তারা নির্বাচনকে একটি সামষ্টিক দায়িথ্ব বলে মনে করতেন; এ নির্বাচন পদ্ধতি তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হতে হবে যারা খলিফা পদের জন্য কারা সবচেয়ে বেশী যোগ্য তা বিচার বিশ্লেসণ করা যোগ্যতা রাখেন। এটা লক্ষ্য রাখতে হবে যে ইসলাম কোন বিশেষ ধরনের নির্বাচনকে নির্দিষ্ট করে দেয়নি। নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য আরো অনেক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে। প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তার পদে নির্বাচন বিশেষ কোন পদ্ধতিকে যাজন সম্প্রদায়ের তথাকথিত বাহ্যিক পবিত্রতা দ্বারা মণ্ডিত করারও প্রয়োজন নেই।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নির্বাচনের আপাত সহজ যে পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে তা হতে অনুমান করা সঙ্গ হবে না যে নির্বাচন প্রার্থীর যোগ্যতার কোনরূপ ন্যূনতা বা কমতি থাকতে পারবে। মুসলিম পণ্ডিত ও সকল ধর্মতাত্ত্বিক মাজহাবের প্রধানগণ সামান্য তারতম্য সত্ত্বেও এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে নেতৃত্বের দাবীদারকে অবশ্যই একন মুসলিম, পুরুষ, প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি হতে হবে।–[পণ্ডিতদের মধ্যে ঐকমত্য বিরাজ করে যে প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তা হবেন একজন রক্ষম ও অভিক্ষ পুরুষ। সম্প্রতি কয়েকজন মুসলিম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় জনগুরুত্ব পদে মহিলাদের নির্বাচনে উপযোগীতার বিষয়ে প্রাণবন্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।] ইসলামী সমাজের প্রধান হবার জন্য এসব হচ্ছে নূন্যতম প্রয়োজনীয়তা; আরো গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী হচ্ছে:
ক. ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার ও আনুগত্যশীলতা বা ‘ওয়ারা’;
খ. ইসলামী ব্যবস্থার দাবী সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি জ্ঞান বা ইলম;
গ. প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন করার দক্ষতা ও যোগ্যতা বা কাফা’আহ এবং
ঘ. ন্যায়পরায়ণতা সমুন্নত রাখার সুদৃঢ় মনোভাব’ অঙ্গীকার বা আদালাহ।
এইসব গুণাবলী আলোচনা ও বিশ্লেষনের প্রশ্নে, সমকালীন চিন্তাবিদগণ আল মাওয়ার্দী, আল গাজ্জালীসহ অন্যান্য পূর্ববর্তী পণ্ডিতগণের চিন্তাধারার উপর নির্ভর করেছেন।
প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তা নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচক মণ্ডলী প্রার্থীর যোগ্যতাসমূহ সবিশেষ বিবেচনা করবেন মর্মে তাঁরা গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইবনে সীনা এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, ‘নির্বাচকমণ্ডলী অবিশ্বাসীতে পরিনত হবেন (ফা-কাদ কাফারু বি আল্লাহ)
যদি তারা নেতা নির্বাচনের ভুল করেন।–[ রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’, পৃ: ১৫৩] এ মতামত পূর্ণাঙ্গভাবে যুক্তিযুক্ত না হলেও ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার নেতা নির্বাচন যে কত গুরুতর বিষয় তা নির্দেশ করে। যাহোক, ইসলামী ব্যবস্থার নেতা নির্বাচিত হয় কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী ও শর্তসাপেক্ষে এবং মুসলমানদের ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক। নেতা যদি এসব গুণাবলী বা শর্তের কোনটি লংঘন করেন অথবা কোনপ্রকার চাতুরীর আশ্রয় নেন বা বল প্রয়ো৯গ করেন তবে তাকে অব্যাহতি দেবার বা ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার উম্মাহ সংরক্ষণ করে।
আইনসঙ্গতা
যদি ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্তঅর প্রকৃত হয় নির্বাচনমূলক তবে ‘আইনসঙ্গতা’ দাবী করে যে এ ব্যবস্থার জনগণের অনুমোদনের সাথে শরীয়াহর সার্বভৌমত্ব ও সর্বউর্ধে থাকবে।–[সমগ্র গ্রন্থে Caliphate, Political order, Political System সমঅর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আমি State বা Islamic State শব্দ ব্যবহার এড়িয়ে গেছি। এ প্রসঙ্গে আল ফারুকীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
‘যখন আমরা ‘খিলাফত’ শব্দটি ব্যবহার করি তখন আমরা তৎদ্বারা ‘রাষ্ট্র’ বুঝাই। পাশ্চাত্য অর্থে ‘রাষ্ট্র এবং ‘উম্মাহ’ শব্দদ্বয়ের অর্থের মধ্যে বিশাল যে ব্যবধান রয়েছে তা আমাদের মনে রাখতে হবে। উম্মাহর আল্লাহ পাকের তরফ থেকে প্রতিনিধিত্ব বলতে খিলাফত বুঝায়। উম্মাহর সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসমাইল রাজী আল ফারুকী, ‘Tawhid Its Implications for Thought and life’ (হারনডন, International Institute of Islamic Thought, ১৯৮২), পৃ: ১৭২] প্রথম থেকেই ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বলা হয়েছে সরকারী ব্যবস্থার ভিত্তি হবে আলাপ আলোচনামূলক। এ প্রসঙ্গে কুরআন ঘোষণা করেছে যে, ‘মুসলমানরা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিষয় নিষ্পত্তি করবে (১২:৩৮) এবং ‘যখন তোমরা কোন সিদ্ধান্ত নেবে, তখন আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হবে (৩:১৫৯)’।
সমগ্র মুসলিম চিন্তাধারায় এমন কোন নিবন্ধ পাওয়া যাবে না যেখানে উপর্যুক্ত আয়াত দু’টি একসাথে উদ্ধৃত হয়নি। আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি হতে হবে মর্মে মনে করতেন, অন্যরা সকল মুসলমান যারা ইসলামী আইনের বিষয়ে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় মতামত ব্যক্ত করতে সক্ষম তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন। অধিকাংশ চিন্তাবিদদের মতে সর্বসম্মত ঐকমত্যের অর্থ এই নয় যে, প্রত্যেক মতামত প্রদানকারী এক ও অভিন্ন মত প্রদান করবেন। বরং এর অর্থ অধিকাংশ নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক যে রায় প্রদত্ত হয়েছে। মতামত প্রদানের পদ্ধতিটি জনগণ নির্ধারণ করবেন। তবে এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে পারস্পরিক আলোচনার নির্দেশকে অগ্রাহ্য করা যাবে না অথবা এমন কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা যাবে না যা পারস্পরিক আলোচনার উদ্দেশ্যকে অকার্যকর ও ব্যর্থ করে দেয়। উমর বিন খাত্তাব ঘোষণা করেছেন যে, ‘পারস্পরিক আলোচনা ব্যতিরেকে খিলাফন হতে পারে না’।–[ ড: এস.এ.কিউ হুসাইনী, ‘Arab Administration’ (লাহোর, আশরাফ, ১৯৭০), পৃ: ৩৭] এক্যমত্যের বৈধতা নির্ভর করে এটা শরীয়াহর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে নিকা তার উপর। আইনের কারণেই রাজনীতি বেঁচে থাকে, বিপরীত পন্থায় নয়। শরীয়াহ সকল প্রজন্মের মুসলমানদের মন মানসিকতা দখল করেছিল এবং এ শরীয়াহ হচ্ছে সত্যিকার ইসলামী চেতনার প্রতিবিম্ব, ইসলামী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ এবং ইসলামের সার নির্যাস।–[ ডব্লিউ সি. স্মীথ ‘The Concept of Shariyah’ ‘Among some Mutakallimun’. গীব প্রণীত ও জর্জ মাকদীসি সম্পাদিত, ‘Arabic and Islamic Studies’ (ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস ১৯৬৫), পৃ: ৫৮১] ইসলামী চিন্তাবিদগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য যে শরীয়াহ হচ্ছে দেশের আইন, এটা এতো সার্বিক যে এতে আপোষের কোন স্থান নেই। খলিফা বা আমির নিজ ইচ্ছায় নয় বরং এই শরীয়াহর কার্যনির্বাহক হিসাবে কাজ করেন; তিনি শরীয়াহ ও জনগণের নির্দেশিকা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কার্যসম্পাদন করবেন। শরীয়াহ আইনের প্রতিষ্ঠা, তার পবিত্রতা সংরক্ষণ এবং এর আওতাধীন সকল কিছুর পরিচালনার জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ তাকে শরীয়াহর আইনের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দানের জন্য সমর্থন বা ভোট প্রদান করেছে। জনগণ তাকে অপসারিত করে অন্য একজনকে নির্বাচিত করবে যদি তিনি এমন কাজ করেন বা তার অপসারণ দাবী করে।–[ আল বাকিলানী, ‘Al-Radd’; ইবিস ইউসুফ সম্পাদিত ‘Nusus al-Fikr al-Siyasi al Islami (বৈরুত, হায়াত প্রেস, ১৯৬৫), পৃ: ৫৮১]
খিলাফত বা ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা কোন অধিকার নয় বরং জনগণের পক্ষে সম্পাদনের জন্য একটি পবিত্র দায়িত্ব। শরীয়াহ ক্ষমতা জবরদখল করাকে বা রাজনৈতিক বৈধতা লাভের উদ্দেশ্যে বংশানুক্রমিক শাসনকে প্রত্যাখান করে। ইহা ব্যক্তিগত কর্তৃত্বকে ঘৃণা করে এবং ইকবালের ভাষায় ইহা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের বিরোধী।–[জামিলুদ্দিন আহমেদ, ‘Iqbal’s Concept of Islamic Polity’, পাকিস্তান পাবলিকেসন্স), পৃ: ২১] আমীর শাসন করার ক্ষমতা হারায় যদি তাঁর নৈতিক মর্যাদার কোন বিচ্যুতি ঘটে, যদি তিনি ব্যভিচার করেন, আমরা তাকে বেত্রঘাত করব, তিনি নিজকে আমাদের নিকট হতে গোপন বা লুক্কায়িত রাখবেন না, তিনি প্রতারণা ধর্মীও হবেন না… তিনি আমাদের সমপর্যায়েরই একজন মানুষ।–[ আহমাদ হাসান, ‘The Political Role of Ijma ইসলামিক স্ট্যাডিজ, ভলিউম ৮, নং ২ (১৯৬৯), পৃ: ১৩৮]
অভিশংসনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম
উপরের আলোচনা হতে সুস্পষ্ট যে আইনসম্মত নয় এমন নির্বাহী কর্মকর্তা শাসন করার অধিকার হারান এবং তাকে তার পদ হতে অপসারণ করা যায়। তবে এটা পরিস্কার নয় যে কিভাবে বা কোন পদ্ধতিতে তাকে তার পদ হতে অপসারিত করা হবে, কেননা কোন ট্রাইবুনাল বা পদ্ধতির কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, যার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ইসলাম অনেক অনিষ্পন্ন প্রাতিষ্টানিক ও সাংবিধানিক বিষয় কুরআন হাদীসের আলোকে মানুষের বিচারবুদ্ধি দ্বারা নিষ্পন্নের জন্য রেখে দিয়েছে। প্রথম যুগের আইনজ্ঞগণ সরাসরি বিদ্রোহের কথা বলেছেন যেহেতু একজন বিপথগামী আমীরকে অপসারণের জন্য কোন পথ খোলা ছিল না। স্বৈরতন্ত্রের মাত্রা হ্রাস পাওয়ায় ও একজন নির্বাহীকে শান্তিপূর্ণ পন্থায় অপসারণের সম্ভাবনা দেখা যাওয়ায়, সাংবিধানিক পন্থায় সীমারেখার মধ্যে থেকে প্রধান নির্বাহীকে অপসারণের পন্থা নিরূপণের চেষ্টা করা হয়। অভিশংসনের জন্য তিনটি প্রাতিষ্টানিক পন্থা প্রস্তাব করা হয়েছে; বিচার বিভাগ, উলেমা বা নেতৃত্বপরিষদ এবং শুরা পরিষদ :
বিচার বিভাগ
যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্তঅ ঐশীসূত্রে প্রাপ্ত শরীয়াহ বা ইসলামী আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত; তাই শুধু এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। শরীয়াহ প্রয়োগের জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু এর জন্য নতুন কোন আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা নেই। শরীয়াহর বিধান অনুযায়ী সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগের উপর বিচার বিভাগ স্থান পায়।
ইসলামী সরকারের আমীর ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ যতক্ষণ তিনি পরিপূর্ণভাবে শরীয়াহ প্রয়োগ করে থাকেন। পূর্ব নির্ধারিত অপরিবর্তনীয় বিধি বিধানের সীমারেখার মধ্য থেকে আমীর তার কার্যসম্পাদন করেন। আমীরের কার্যকলাপ সার্বক্ষণিক নজরে রাখা প্রয়োজন; এ জন্য যোগ্যতম ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন ইসলামী বিচারকবৃন্দ যাদের শরীয়াহ বিষয়ে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ও গভীর জ্ঞঅনের জন্য তাদের বিচারক হিসাবে নিয়োজিত করা হয়।–[ আবদুল রহমান আবদুল কাদির কুর্দী, ‘The Islamic State: A Study Based in the Islamic Holy Constitution’ (লন্ডন, ম্যানসেল, ১৯৮৪), পৃ: ৮৬,৮৯।] ফলশ্রুতিতে কুর্দী ও অন্যান্যরা বিচারকবৃন্দকে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করেছেন তথা সরকার প্রধানসহ নির্বাহী ও আইন বিভাগের যে কোন কর্মচারীকে অব্যাহতি প্রদান, রিট ইস্যুকরণ, অভিশংসন অথবা করাদণ্ড প্রদান।–[ আবদুল রহমান আবদুল কাদির কুর্দী, ‘The Islamic State: A Study Based in the Islamic Holy Constitution’ (লন্ডন, ম্যানসেল, ১৯৮৪), পৃ: ৮৭]
ঐতিহাসিকভাবে যে সংস্থাটি প্রশাসনের কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান ও বিচার বিভাগীয় কার্য সম্পাদন করে তা ‘দিওয়ান আল নাযর ফি আল মাজালিম’ নামে অভিহিত। শাসকশ্রেণী কর্তৃক নিপীড়নমূলক ও অন্যায় কার্য প্রতিরোধের জন্য ‘দিওয়ান’ মামলা বা আপীল রুজুর আদালত হিসাবে কাজ করত। ‘দিওয়ান’ এর উৎস নবী করিম (সা) এর জামানা হলেও চতুর্থ খলিফা আলী ব্যক্তিগতভাবে শাসক ব্যক্তির অবৈধ কার্যকলাপ ও তার ফলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশার বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন। আবদ আল মালিক ইবনে মারওয়ান (হিজরী ৬৮৫-৭০৫ সন/১২৮৬-১৩০৫ খ্রি.) হতে উমাইয়া খলিফাগণ প্রত্যেক সপ্তাহের সুনির্দিষ্ট দিনে ব্যক্তিগতভাবে এসব বিষয়ের শুনানী গ্রহণ করতেন।–[ আলী এ. মানসুর, ‘Nuzum al-Hukm wa al-Idarah fi Shariat al Isamiyah wa al-qawanin al-wadiyah’ (বৈরুত, Dar al-Fath li al-Yaba’ah wa al-Nashr, হিজরী ১৩৯১/১৯৭১ খ্রী:), পৃ: ৩৭৯।]
‘দিওয়ান আল মাজালিম’ প্রধান শাসককর্তাসহ সকল কর্মচারীদের কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দাবি করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কেউই, এমনকি খলিফাও কোন প্রাধিকারমূলক সুবিধা ভোগ করতেন না। অসংখ্য নজীর রয়েছৈ যেখানে ক্ষমতাসীন খলিফাকে সাধারণ আসামীর মত আদালতে কাজীর সামনে হাজির হতে হয়েছিল। তবে আদালন খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল না। আল মাওয়ার্দী সম্ভবতঃ প্রথম মুসলিম চিন্তাবিদ যিনি সুবিন্যস্তভাবে ‘দিওয়ানের’ গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি ‘দিওয়ান আল মুজালিম’ এর বিস্তারিত কার্যাবলী, কোন ধরনের বিষয়সমূহ বিচারের আওতাধীণ হবে, কোন ধরনের কর্মচারীদের বিচারের আওতায় আনা যাবে ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তবে তিনি প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তাকে তদন্তের অধীনে এনে দিওয়ানের মাধ্যমে তাঁকে অভিশংসনের কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে যেহেতু ‘দিওয়ান’ খলিফার কার্যালয়ের একটি বিভাগ হিসাবে কাজ করত, ফলে দিওয়ানের পক্ষে খলিফাকে অপসারণ করার সম্ভাবনা তিরোহিত ছিল।
ঐতিহাসিকভাবেও এমন কোন উদাহরণ নেই যে বিচার বিভাগ কর্তৃক কোন খলিফা অপসারিত হয়েছেন। এথমত খলিফাকে অভিশংসনের কোন বিধানই ছিলনা। যদি এ ধরনের অভিশংসনের ক্ষমতার অস্তিত্ব স্বীকারও করে নেয়া হয়, তবুও তা কার্যকর করার কোন উপায় বা কার্যকর পদ্ধতি ছিলনা। অপসারণ ও ক্ষমতারোহন তলোয়ারের শক্তির দ্বারাই নির্ধারিত হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ করে আব্বাসীয় আমলে করা হতো। আদালতের বিচারককে শুধু এই অপসারণ কাজটি সত্যায়নের জন্য ডেকে আনা হতো। অতঃপর পদত্যাগকারী খলিফা জনগণের সামনে তার পদত্যাগের ঘোষণা প্রদান করতেন।
ফলে দেখা যায় কাজীর (বিচারক) কাজ ছিল শুধু পদত্যাগের বিষয়টি সত্যায়ন করা, খলিফাকে অপসারণ করা নয়। আব্বাসীয় আমলে কাজীদের এরূপ ক্ষমতা ও কার্যপরিধি সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত ছিল। বিষয়টি আব্বাসীয় খলিফা আল কাহির বি আল্লাহ (হিজরী ৯৩২-৯৩৪ সন/১৫২৫-১৫২৭ খ্রি.) এর পদত্যাগের ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। খলিফা পদত্যাগে অস্বীকার করলে এবং কাজীকে ডেকে আনা হলে কাজী প্রশ্ন করেন, ‘আমাকে কেন ডেকে আনা হয়েছে যখন খলিফা নিজে পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেছেন?’ এতে আলী ইবনে ইছা মন্তব্য করেন যে, তাঁর আচরণ দুষ্কৃতিমূলক এবং তাই তাকে অপসারণ করা উচিত’। কাজী এর উত্তরে বলেন, রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা আমাদের কাজ নয়, তলোয়ারের শক্তিধারী ব্যক্তিবর্গই এ কাজটি সম্পাদন করেন থাকেন। আমরা শুধু পদত্যাগ করারপর তা সত্যায়ন করি।–[ আহমেদ ইবনে মোহাম্মদ মিসকাওয়াহ, ‘Tajarib al-Umam’, সম্পাদনা এইচ.এফ এমিড্রজ (বাগদাদ, আল সুথান্না লাইব্রেরী, ১৯৪১), ভলিউম ২, পৃ: ২৯০-১] সুতরাং দেখা যায় যে যারা সরকার প্রধানকে অপসারণে বিচার বিভাগের ক্ষমতা রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তাদের সমর্থনে তেমন কোন দালিলিক প্রমাণ বা সমর্থন নেই।
অভিভাবক পরিষদ
‘মুজালিম’ আদালত যে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন ঐ সকল ক্ষমতা ইরানী সংবিধানে ‘সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’ কে অর্পণ করা হয়। এই সংবিধান ভোটদাতাদের ৯৮.২% দ্বারা অনুমোদিত হয় এবং ১৯৭৯ সালে এ সংবিধান বলবৎ হয়। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের কোন ধারা লংঘন করলে তা বিবেচনা করার ক্ষমতা ‘সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’কে প্রদান করা হলেও, রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করার ক্ষমতা এ কাউন্সিলকে প্রদান করা হয়নি।–[ দ্রষ্টব্য ‘Constitution of the Islamic Republic of Iran’ (তেহরান, Ministry of Islamic Guidance, ১৯৮৫)।] এ ক্ষমতাটি বেলায়েতে ফকীহ’কে প্রদান করা হয়েছে, যিনি হচ্ছেন সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রধান। ১৯৭৯ সালের ইরানী সংবিধানের ৫ ধারা, যা শিয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিবৃত করেছে, তাতে বলা হয়েছে,
‘ওয়ালী আল আসর’ এর গুপ্ত থাকার সময় (আল্লাহ তার আগমনকে ত্বরান্বিত করুন) ওয়ালিয়াহ ও উম্মতের নেতৃত্ব ন্যস্ত হয় ন্যায়পরায়ণ (আদিল) ও ধর্মপরায়ণ (মুত্তাকী) ফকিহ-এর উপর যিনি তার যুগের পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল; সাহসী প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং প্রশাসন পরিচালনায় ক্ষমতাসম্পন্ন; জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দ্বারা নেতা হিসাবে স্বীকৃত ও গৃহীথ; আর যদি সর্বজনগ্রাহ্য এমন কোন ফকিহ বিদ্যমান না থাকেন তবে অভিভাকমণ্ডলী, যারা ফকিহদের দ্বারা গঠিত ও উপরোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন তাদের উপর সংবিধানের ১০৭ ধারা অনুযায়ী এ দায়িত্ব অর্পিত হয়’।
সংবিধানের ১০৯ ধারা অনুযায়ী নেতা বা অভিভাবকমণ্ডলীর সদস্যদের বিশেষ গুণাবলী হবে নিম্নরূপ:
ক. ‘মুফতী’ ও ‘মারজী’র কার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পাণ্ডিত্য ও ধর্মপরায়ণতা;
খ. রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বচ্ছ জ্ঞান, সাহস, শক্তি ও নেতৃত্ব প্রদানের প্রশাসনিক ক্ষমতা।
সংবিধানের আর্টিকেল ১১০ বেলায়েত ফকীহ’কে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রদান করেছে, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও পার্লামেন্টকে ‘ফকিহ’ এর কর্তৃত্বের অধীন করেছে। রাষ্ট্রপতি প্রসঙ্গে ‘অভিভাবক পরিষদের’ কাজ হল অন্যান্যদের মধ্যে নিম্নরূপ:
ক. রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি ফরমান স্মারক করা;
খ. দেশের স্বার্থে এবং সুপ্রীম কোর্ট যদি রাষ্ট্রপতিকে সাংবিধানিক দায়িত্ব লংঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে তবে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করা অথবা যদি আইন পরিষদ তার অযোগ্যতার প্রশ্নে ভোট দেয় সেক্ষেত্রেও তাকে অপসারণ করা যেতে পারে (আর্টিকেল ১১০; সেকশন ৪ এবং ৫)। এসব ধারা যে কোন অন্তসারশূণ্য বক্তব্য নয় তা যথাযথভাবে আয়াতুল্লাহ খোমেনী (হিজরী ১৩২০-১৪১০ সন/১৯০২-১৯৮৯ খ্রি.) প্রদর্শন করেছেন। ১৯৮১ সালে প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ডঃ আবু হাসান বনি সদর অভিশংসিত হন, তার পদ থেকে অপসৃত হন এবং তার স্থলে ইসলামী রিপাবলিকান পার্টির অন্য একজন নেতাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়।
ইরানী সংবিধান ইসলামী রাষ্ট্রের শিয়া ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে, যার ভিত্তি হচ্ছে নবী করিম (সা) এর জামাতা ও চাচাত ভাই আলী ইবনে আবি তালিব এর ইমামত এবং তাঁর সূত্রে তাঁর ১১ জন অধঃস্তন পুরুষের ইমামত। যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে মহানবী (সা) এর তিরোধানের পর মুসলমানদের পরিচালনার গুরুদায়িত্ব ইমামদের উপর অর্পিত ঐশী গুণাবলী সম্পন্ন উলামা ও মুজতাহিদগণকে গ্রহণ করতে হবে।–[ হামিদ এনায়েত, Modern Islamic Political Thought’, পৃ: ৫] এভাবে ইরানী সংবিধান বেলায়েতে ফকীহ’কে সরকারের সকল কাজ তত্ত্বাবধান, ইসলামী আদর্শের সাথে সরকারের কাজের সামঞ্জস্য বিধানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পন করে। শিয়া ঐতিহ্যের যে রাজনৈতকি ধারাভাষ্য তা শিয়া জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ইরানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী জনগণের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা বাস্তব কারণেই কায়েম করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সুন্নী উলেমারা শিয়া উলেমাদের মত তেমন উচ্চ কর্তৃত্ব ও প্রাধিকার সুবিধা ভোগ করেন না। সুন্নী উলেমারা কেন্দ্রীয়ভাবে সংঘবদ্ধ নন; তারা মাঠ পর্যায়েও জনগণের শর্তহীন আনুগত্য লাভ করেন না এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাদের কোন স্বাধীন সত্ত্বা নেই।–[ দ্রষ্টব্য লিওনার্দ বাইন্ডার, ‘The Proops of Islam: Religion and Politics in Iran’, in Arabic and Islamic Studies in Honour of Hamilton A.R Gibb (লন্ডন; ই.জে.ব্রীল, ১৯৬৫), পৃ: ১২১] তারা জনজীবনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং অটোম্যান খিলাফতের সময়ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে এবং কাজী হিসাবে বিচারালয়ে বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রই প্রকৃতপক্ষে সকল ক্ষমতার অধিকারী ছিল। হডজসন মন্তব্য করেছেন যে, সরকার ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উলেমারা কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতেন, তবে সে চাপ কখনো চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করতে পারেনি।–[ Marshal G. Hodgson,’The Venture of Islam: Conscience and History in a world Civilisation’, (শিকাগো, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ১৯৭৪) ভলিউম-১, পৃ: ২৩৮]
শুরা পরিষদ
সরকার সম্পর্কে সুন্নী মতামত হচ্ছে রাজনৈতিক শক্তির উৎস দু’টি: ঐশী আইন শরীয়াহ ও বিশ্বাসী জনগণের সমন্বয়ে গঠিত উম্মাহ। আলীর বংশধরদের ইমামতের ধারণার সাথে সুন্নী মতামতের এভাবে পার্থক্য সূচিত হয়েছে। সুন্নী মতামত অনুযায়ী খিলাফত খলিফার নিজস্ব কোন অধিকার নয়, বরং জনগণের পক্ষ থেকে তিনি কার্যনির্বাহক মাত্র। সকল বিশ্বাসীদের ক্ষমতা, ভ্রাতৃত্ব এবং উম্মতের সম্মিলিত দায়িত্ব ‘সর্বজ্ঞানী’ শাসকের ধারণাকে বাতিল করে দেয় অথবা এমন একশ্রেণীর ‘বিশেষজ্ঞ উলেমাদের’ ধারণাকেও বাতিল ঘোষণা করে যারা জনগণের সাথে পরাসর্ম ব্যতিরেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এভাবে সুন্নীমতে শুরা বা আলাপ আলোচনার মাধ্যবে ব্যবস্থা গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, যার রয়েছৈ কার্যকর তত্ত্বাবধান ও নৈতিক পরিদর্শন যেখানে সৎকাজকে উৎসাহিতকরণ ও মন্দ কাজকে নিরোধ করা হয়েছে।
শুরা ব্যবস্থা নবী করিম (সা) এর সময় চালু ছিল, খোলাফায়ে রাশেদা তা অনুসরণ করেছেন এবং ইসলামী ব্যবস্তঅর প্রত্যেক নেতার জন্য তা বাধ্যতামূলক। আমীর শুধু নিজকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত ও জ্ঞাতকরণের জন্য শুরাপদ্ধতি তথা আলাপ আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না, বরং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তও তিনি বাস্তবায়িত করবেন।–[ মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ শফী, ‘Islam me Mushawarah Ki Ahmiyat’ (লাহোর, ইদারাহ ইসলামিয়াত, ১৯৭৬) পৃ: ১২৮-৩০] মুসলিম আইন শাস্ত্রবিদ ও চিন্তাবিদগণ এই ধারণা পোষণ করেন যে উম্মাহর বিষয়াবলী নিষ্পন্ন করার জন্য যার উপরই দায়িত্ব অর্পিত হোক না কেন, তিনি ‘আহল আল শুরা’ এর সাথে পরামর্শক্রমে তার দায়িত্ব পালন করবেন।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ পৃ: ২৩৫] সাইয়েদ রশীদ রিদা (হিজরী ১২৮২-১৩৫৪ সন/১৮৬৫-১৯৩৫ খ্রি.) বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থঅপন করেছেন যে ‘আহল আল হাল ওয়অ আল আকদ (মজলিসে শুরা) এর ভিত্তিতে অতীতের জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞজনেরা অন্যায় ও অত্যাচার প্রতিরোধ করেছিলেন এবং এসব পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গই খলিফার আচরণ বিধির ন্যায়সঙ্গতা সম্পর্কে অভিমত প্রদানে সক্ষম ছিলেন এবং শরীয়াহ ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে খলিফার অপসারণের পক্ষে মত দিতে পারতেন।–[ মুহাম্মদ রশিদ রিদা, ‘al-Khalafah Al-Imamah al-Uzma (কায়রো, আল জাহরা আল ইসলাম আল আরাবী, ১৯৮৮) পৃ: ১১-১৩; ১২৪-৫]
‘আহল আল শুরা’ কর্তৃক অভিশংসনের ক্ষমতা প্রয়োগের ঐতিহাসিক নজীর খোঁজা অর্থহীন। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে তলোয়ারের অগ্রভাবে খলিফাদের অপসারণ করা হয়েছিল। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময় ৫১ জন খলিফার মধ্যে ৪২ জন নিহত হয়েছিলেন বা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, ৫ জন স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, ৩ জনকে অন্ধ করে অযোগ্য করে দেয়া হয়েছিল এবং ১জনকে অভিশংসিত করা হয়েছিল। খলিফা রশিদ বি আল্লাহ (হিজরী ৫২৯-৩০ সন/১১৩৫-৩৬ খ্রি.) একমাত্র খলিফা যাকে ‘আহল আল শুরা’র সাথে পরামর্শের পর অভিশংসিত করা হয়েছিল। সুলতান যাকে ‘আহল আল শুরা’র সাথে পরামর্শের পর অভিশংসিত করা হয়েছিল। সুলতান মাসুদ কর্তৃক আহুত এই শুরা কাউন্সিলে কাজী, পণ্ডিতবর্গ ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। তারা লিখিত আবেদন পত্রটি পরীক্ষা করে দেখেন যাতে খলিফা রশিদের অন্যায় অত্যাচার, নিপীড়ন, সম্পত্তি জবরদখল, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, মদ্যপান ইত্যাদির সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরীক্ষান্তে তারা খলিফাকে অভিশংসিত করেন। আবু আবদুল্লাহ এম আল মুকতাকী লি আমর আল্লাহ (হিজরী ৫৩০-৫৫৫ সন/১১৩৬-৬০ খ্রি.) নতুন খলিফা হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।–[ জালাল আল দ্বীন আবদ আল রাহমান আল সায়ূতী Tharikh al-Khulafa’ (মিশর, দার আল মাকতাবাহ, ১৯৬৯) পৃ: ৪৩৬; স্যার উইলিয়াম মুর, ‘The Caliphate: Its Rise,Decline and Fall’ (নিউইয়র্ক, এ এম এস প্রেস, ১৯৭৫) পৃ: ৫৮৫]
পশ্চিম আফ্রিকার সতোতো সাম্রাজ্যের সুলতান আলী ইউ বাব্বা’র (হিজরী ১২৫৮-১২৯৬ সন/১৮৪২-১৮৫৯ খ্রি.) বিরুদ্ধে অভিশংসনের চেষ্টা নেয়া হয়েছিল। শুরা’র ৬ জন অগ্রগণ্য সদস্য সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে,
প্রথমত: তিনি শরীয়ার বিধান অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে বন্টন না করে সকল রাজস্ব ধনসম্পদ কুক্ষিগত করেন। দ্বিতীয়ত: তিনি সকোতো খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা নির্মিত মসজিত শেহু ও মসজিদ সকোতোর দেয়াল নষ্ট হলে পুনির্মাণে হাত দেন নি। তৃতীয়ত: তিনি কোন জিহাদে অংশগ্রহণ করেন নি। এবং এরূপ কোন আহবানও জানান নি।–[কায়ারী তিজ্জানী ‘The Force of Religion in the Conduct of Political Affairs and Interpersonal Relations in Borno and Sokoti’, in Studies in the History of Sokoto Caliphate; The Sokoto Seminar Papers (জারিয়া,আহমাদু বেল্লো ইউনিভার্সিটি, ১৯৭৯) পৃ: ২৭১]
তারা সুলতান হতে তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করেন এবং সম্ভাব্য বিকল্প খলিফা হিসেবে দু’জন যোগ্য ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেন। সুলতান বাব্বা দ্রুত রাজধানীতে ফিরে আসেন, শুরার সদস্যদের সামনে হাজির হন এবং নিজের স্বপক্ষে শুনানী প্রদান করেন। ‘খলিফা অভিযোগ সমূহ হতে মুক্ত হয়েছেন’ এই মর্মে রায় দিয়ে শুরার সদস্যগণ আবার খলিফার আনুগত্য স্বীকার করেন।–[কায়ারী তিজ্জানী ‘The Force of Religion in the Conduct of Political Affairs and Interpersonal Relations in Borno and Sokoti’, in Studies in the History of Sokoto Caliphate; The Sokoto Seminar Papers (জারিয়া,আহমাদু বেল্লো ইউনিভার্সিটি, ১৯৭৯) পৃ: ২৭১।] অতঃপর খলিফা তাঁর কার্যকলাপে উন্নতি বিধান করেন এবং জিহাদের আহবান জানান।
শাসন কর্তৃত্বের দায়িত্বে নিয়োজিতদের জবাবদিহিতা কিভাবে শরীয়াহন নির্দেশনা মোতাবেক নিশ্চিত করা হত তার প্রয়োগ পদ্ধতির কতিপয় উদাহরণ উপরে উল্লেক করা হয়েছে।
রশিদ রিদা ও অন্যান্য সমকালীন চিন্তাবিদগণ আধুনিক সময়ের শুরা ব্যবস্থাকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত আইনসভা দ্বারা প্রতিস্থাপনের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।–[ রিদা, Al-khilafah wa Al-Imamah al-Uzma, পৃ: ২১] সাইয়েদ মওদুদী বলেন, ফিকাহ শাস্ত্রে যাকে ‘আহলে আল হাল ওয়া আল আকদ’ (মজলিসে শুরা) বলা হয়েছে তা বর্তশান পরিভাষায় আইনসভা নামে অভিহিত।–[ মওদুদী, The Islamic Law and Constitution পৃ: ২৫৫] এসব চিন্তাবিদ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগের অনুবর্তীতার কথা বলেন। আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদ ফজলুর রহমান তাদের সমর্থনে বলেন যে, ‘জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড় ধরনের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে সরকার প্রধানকে অপসারণ করা যেতে পারে।–[ফজলুর রহমান, ‘Implementation of the Islamic Concept of State in Pakistan Miliea ইসলামিক স্ট্যাডিজ, ভলিউম ৬, সংখ্যা ৩ *(সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭) পৃ: ২১৩] জুলাই, ১৯৮৩ সালে পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতান্ত্রিক সরকার গঠন পরীক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক যে কমিশন গঠন করেছিলেন তাতেও এর শক্তিশালী সমর্থন পাওয়া যায়।
২২ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিন কমিশনে (১৬ জন সদস্য, ৩ জন সহযোগী সদস্য ও ৩ জন সম্মানসূচক সদস্য) ছিলেন শীর্ষস্থানীয় উলামাবৃন্দ, বর্তমান ও ভূতপূর্ব বিচারপতিবৃন্দ, শিক্ষাবিদ ও ফেডারেল কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা জাফর আহমদ আনসারী কমিশনের সভাপতিত্ব করেন।কমিশন অভিমত প্রদান করে যে প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তা মজলিসে শুরা’র (পরামর্শ সভা)সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য থাকবেন, শরীয়া লংঘন, আইন অমান্য, গুরুতর অসদাচরণ, যে সব গুণাবলীর জন্য তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন সেগুলি পরিত্যাগ করলে শুরা তাকে অভিশংসিত করতে পারবে। মজলিসের যে কোন সদস্য আইন সভার এক তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে অভিশংসন অভিযোগ আনয়ন করতে পারবেন। অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবার ১০ দিনের মধ্যে আনীত অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত সপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য প্রদান করবেন। যদি আইন সভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তার বিরুদ্ধে ভোট দেয় তবে তিনি ক্ষমতা হতে অপসারিত হবেন।–[‘Nizam-e-Hukumat Ke Bare Ansari Kamishan Ki Report (ইসলামাবাদ, প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব পাকিস্তান, ৪ আগষ্ট, ১৯৮৩) পৃ: ১৮-২০; ৭৩-৫।]
ডিসেম্বর, ১৯৮৩ সালে ইসলামিক কাউন্সিল অব ইউরোপ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তি হিসাবে সাংবিধানিক কাঠামোর গুরুত্ব অনুধাবন করে ‘A Model of an Islamic Constitution’ রচনা করেন। কাউন্সিলের সেক্রেটারী জেনারেল মডেলটি ‘প্রখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত, আইনশাস্ত্রবিদ, রাষ্ট্রনায়কবৃন্দ ও ইসলামী আন্দোলন সমূহের নেতৃবৃন্দের দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমের ফসল হিসাবে অভিহিত করেন।–[ ইসলামিক কাউন্সিল, ‘A Model of An Islamic Contitution (লন্ডন, ইসলামিক কাউন্সিল, ১৯৮৩), ভূমিকা, পৃ: ৪।] মডেল সংবিধানের আর্টিকেল ২৬-এ বর্ণিত হয়েছেযে ‘ইমাম সকলের আনুগত্য পাবেন এমনটি যদি তাদের মতামত ইমামের মতামত হতে ভিন্নও হয়। তবে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) অনুশাসন লংঘন করেন তবে তিনি আনুগত্যের হকদার হতে পারেন না। আর্টিকেল ৩১ এর উদ্ধৃতি নিম্নরূপঃ
ইমাম মজলিসে শুরা কর্তৃক প্রণীত আইন মান্য করবেন এবং যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করবেন। মজলিসের কোন আইনকে ভোটে দেয়ার তার কোন ক্ষমাত থাকবে না…।
আর্টিকেল ৩৩ এ আছে-
ক. ইমাম যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সংবিধানের কোন ধারা লংঘন করেন, শরীয়ার গুরুত্ব বিধান ভঙ্গ করেন, তবে মজলিসে শুরার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে তাকে অভিশংসিত করে অপসারণ করা যাবে;
খ. ইমামের অভিশংসন ও তার অপসারণের পদ্ধতি আইনের অধীন বিধি বিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে;
আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি রিসার্চ একাডেমী নিয়োজিত একটি কমিটি যে খসড়া ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন করেছে তাতে বর্ণিত হয়েছে যে, যারা ইমামকে নির্বাচিত করবেন তাদের আইনের অধীনে বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী ইমামকে অপসারিত করারও ক্ষমতা থাকবে (আর্টিকেল ৫০)। আর্টিকেল-৮৩ নির্বাহী বিভাগের কার্যকলাপ তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা আইনভা বা মজলিসে শুরার হাতে অর্পণ করেছে (পরিশিষ্ট ‘ক’ দ্রষ্টব্য)।
ইমামের অভিশংসনের পূর্বে মজলিসের জন্য সমীচীন হবে দক্ষ আইনশাস্ত্রবিদ ও বিচারপতিদের সমন্বয়ে একটি ট্রাইবুনাল গঠন করা, যে ট্রাইবুনাল বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের সুপারিশ করবে।
উপসংহার
বিশ্বাসীদের আল্লাহ ও তার রাসূলকে মান্য করা এবং কর্তৃত্বশীলদেরকেও অনুসরণ করা মর্মে কুরআনের বিখ্যাত আয়াত শুধুমাত্র ইসলামের রাজনৈতিক কর্তব্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেনি বরং সংগঠিত কর্তৃত্বকে কি প্রেক্ষিতে ও কি পরিসরে মান্য করতে হবে তার সীমারেখাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইহা সরকার প্রধানের প্রতি আইনের আনুগত্য করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং শানিতদের অবৈধ আদেশ অমান্য করার নির্দেশ প্রদান করেছে। কুরআন ও সুন্নাহ সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং খোলাফায়ে রাশেদার সময়কার বাস্তব কর্মকাণ্ড তার জ্বলত্ব সাক্ষ্যবাহী।
আদর্শ খিলাফত ব্যবস্তার পতন ও অবক্ষয়ের পর মুসলিম চিন্তাবিদ ও আইনশাস্ত্রবিদগণ শাসকদের বলপূর্বক ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টিকে উম্মাহর দুর্দশা লাঘবের প্রয়োজনীয়তার তাগিদে আপাততঃ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তবে তারা কখনো এ ধরনের অবৈধ স্থিতাবস্থার পক্ষে বৈধতা প্রদান করেননি এবং কখনো তারা সর্বাবস্থায় আনুগত্য করে যেতেই হবে মর্মে রায় প্রদান করেননি। তারা একমত ছিলেন যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের আস্থাশীল হতে হবে; শাসক ও শাসিত উভয়কেই শরীয়াহকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও প্রাধান্য প্রদান করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে শাসকের ব্যর্থতা তার অপসারণ দাবি করে এবং চরম ক্ষেত্রে সরাসরি বিদ্রোহের মাধ্যমে তা করতে হবে।
অদক্ষতা ও অযোগ্যতার জন্য সরকার প্রধানকে অপসারণরে অনুমোদন প্রদান করলেও মুসলিম পণ্ডিতগণ অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু আলোচনা করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন আল মাওয়ার্দী যিনি অপসারণের পদ্ধতি কি হবে সে বিষয়ে তিনি সুস্পষ্টভাবে কিচু উল্লেখ করেননি। পণ্ডিত ও আইন শাস্ত্রবিদগণের অপ্রতুল লিখনী এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুশাসন হতে সরকার প্রধানকে অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণের দু’টি মৌলিক ভিত্তির উল্লেক পাওয়া যায়: ‘বৈধতা’ ও ‘আইনসঙ্গতা’। প্রথমটি তথা বৈধতার বিষয়টি খলিফা নির্বাচনের জন্য তার প্রয়োজনীয় গুণাবলী ও নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কিত। সরকার প্রধানকে অবশ্যই মুসলমান, পুরুষ, প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের তথা ওয়ারা, ইলম, কাফা’য়াহ ও আদালাহ ইত্যাদি গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে। জনগণ কর্তৃক মুক্ত ও অবাধ ভোটের মাধ্যমে খলিফা নির্বাচিত হবেন। দ্বিতীয়ত: তথা ‘আইনসঙ্গতা’র বিষয়টি হচ্ছে ইমামকে শরীয়ার কাঠামোর ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুসারে শাসন কার্য পরিচালনা করতে হবে। একজন অবৈধ ও বেআইনী শাসক শাসন করার অধিকার হারান এবং তিনি অপসারণযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হন।
সরকার প্রধানের অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণের পদ্ধতির বিষয়ে কুরআন হাদীসে কোন উল্লেখ পাওয়া যায়না। ‘বৈধতা’ ও ‘আইনসঙ্গতার’ নীতিমালার উপর ভিত্তি করে মুসলিম চিন্তাবিদগণ উলেমা কাউন্সিল, বিচার বিভাগ ও আইন সভার সমন্বয়ের মাধ্যমে অভিশংসন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি প্রয়োগ করার প্রস্তাবনা প্রদান করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী মতামত হচ্ছে একজন অযোগ্য ও অদক্ষ সরকার প্রধানকে অপসারণ করার দায়িত্বভার ‘আহল আল শুরা’র উপর অর্পণ করা উচিৎ। মুসলিম শুরা কর্তৃক এ ধরনের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রয়োগের উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে। এ অভিমত পাকিস্তানের আনসারী কমিশনের সদস্যদের সর্বসম্মত সমর্থন লাভ করেছে। ইসলামী কাউন্সিল অব ইউরোপ ও আল আজহার কমিটি মজলিসে শুরা’কে একটি মাসনতান্ত্রিক কাঠামো অব ইউরোপ ও আল আজহার কমিটি মজলিসে শুরা’কে একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রূপরেখা প্রদানের প্রস্তাব করে, যাতে পারস্পরিক আলোচনা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে বিষয়টি কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তির গোড়াপত্তন করা যায়।
পরিশেষে ইসলাম শাসকের প্রতি শর্তহীন আনুগত্যকে প্রত্যাখ্যান পূর্বক যে সকল নেতা ঐশী নির্দেশনা লংঘন করে তাদেরকে অমান্য ও বিরোধীতা করার জন্য উম্মতের উপর বাধ্যতামূলক নির্দেশ প্রদান করেছে। কুরআন যারা কর্তৃত্বশীল পদে রয়েছে তাদেরকে মান্য করার নির্দেশ দিয়েছে। একই কুরআন নেতৃবৃন্দকে শরীয়ার অনুশাসন মেনে চলার এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করার আদেশ প্রদান করেছে। এসব বিষয়াবলী হতে শাসকের বিচ্যুতি তার অপসারণ দাবি করে। আইনসভা বা মজলিসে শুরা অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করার সময় একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিষয়টি ন্যায় ও নিরপেক্ষভাবে তদন্তপূর্বক পরামর্শ গ্রহণের পদ্ধতি গ্রহণ করবে।