রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইসলামী প্রয়োগ প্রণালী
ইসলামী সভ্যতা ও সমাজে এক সময় ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞান জীবন ও গতি সঞ্চার করেছিল। এখন এটা প্রাচীন মাদ্রাসা ও সনাতন খানকা সমূহের চার দেয়ালে বন্দী হয়ে আছে। পাশ্চাত্যের নতুন সমাজ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক চিন্তাধারা আয়ত্ব করে কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবী নিছক অনুষ্ঠান ও আচার সর্বস্ব প্রথা, পদ্ধতি ও সংস্কারের যে প্রাচীন ইসলামী ফসিল রয়েছে তা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্ব দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এ পরিস্থিতিতে ইসলামী সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি যুগোপযোগী প্রয়োগ পদ্ধতি নির্মাণের আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, সমকালীন ইসলামী আন্দোলন সমূহের প্রাগ্রসরতা এর প্রয়োজনীয়তাকে আরো বেশী অপরিহার্য করে তুলেছে।
এই অধ্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইসলামী প্রয়োগ প্রণালী ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত যে সব মৌলিক ধারণাসমূহ ব্যবহৃত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় তার দুর্বলতাসমূহ এ অধ্যায়ে চিহ্নিত করা হয়। এটা করার প্রয়োজনীতা হচ্ছে পাশ্চাত্যের ধারণা সমূহ হতে মুসলিম মানসকে মুক্ত করা, যাতে মহানবী মদীনায় যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন সেদিকে মুসলমানগণ ধাবিত হতে পারে।
প্রায়োগিক সমাজবিজ্ঞানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
পশ্চিমা প্রায়োগিক সমাজ এই ধারণার উপর স্থাপিত। পদার্থ বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক সূত্রের সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার মত সমাজ বিজ্ঞানেও মানুষের আচরণের সামঞ্জস্যশীলতা ও ঐক্যের সাধারণ সূত্র বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব।–[এস.জে. এলডার্সভেলড, ‘Research in Political Behaviour’; এস. সিডনী সম্পাদিত ‘Introductory Reading in Political Behaviour’ (শিকাগো, ব্যান্ড ম্যাকনেলী-এন্ড কোং, ১৯৬১); R.A. Dahl ‘The Behaviourial Approach in Political Science Epitaph for a Monument to a Successful Protest’, American Political Science Review 55 (ডিসেম্বর, ১৯৬১); ডেভিড ইস্টন, The Current Meaning of Behaviouralism’, জে.সে. চার্লসওয়ার্থ সম্পাদিত ‘Contemporary Political Analysis (নিউইয়র্ক: ফ্রি প্রেস, ১৯৬৭); অষ্টিন রেনী সম্পাদিত Essays on the Behaviorial Study of Politics (অবতারণা, ইলিনয়েস, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েস প্রেস, ১৯৬২)।] শত বছরের পুরনো ধারণার পরজীবী শিকড়ের?-[ Neil Reimer, ‘The Revival of Democratic Theory’ (নিউইয়র্ক: এপলিটন সেঞ্চুরি-ক্রফটস, ১৯৬১), পৃঃ ১] উপর বেঁচে থাকা সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরনো ধারণাসমূহ বাতিল করে দিয়ে নতুন সমাজ বিজ্ঞানের জীবনের অনুসন্ধানের প্রতি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রযোজ্যতার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।–[ডেভিট ইস্টন, ‘The Decline of Modern Political Theory’; James A Gould এবং Vincents V. Thursby ও ভিনসেন্ট ভি. মার্সবী সম্পাদিত ‘Contemporary Political Thought’ (নিউইয়র্ক; হোল্ট, রেইনহার্ট ও উইনসটন, ১৯৬৯), পৃঃ ৭৬৬।] মানুষের আধ্যাত্মিক ও আন্তঃমনন অস্তিত্ব ও অভিজ্ঞতাকে প্রচলিত পশ্চিমা সমাজ বিজ্ঞান জ্ঞানের ভিত্তি হিসাবে স্বীকার করে না। নতুন এই বিজ্ঞানে ভাষাগত দর্শনের সাথে ইতিবাচক যুক্তিবাদকে সমার্থক হিসাবে ধরে নিয়েছে। পরবর্তীতে একটি আন্দোলন জন্ম নিয়েছে যা ‘উপাত্তগত বাস্তবতা’ এবং ‘মূল্যবোধ’ এর মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে একে সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে।
‘বিংশশতাব্দীর প্রথমভাগে সমাজবিজ্ঞানী ওয়েবারের দর্শন ধারণার প্রভাবে সমাজ বিজ্ঞানীরা প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিয়েছে যে প্রায়োগিক ও বাস্তব গবেষণার ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক মূল্যবোধ’কে অন্তর্ভূক্ত করা যাবে, না করা সঠিক হবেনা’।–[ডেভিট ইস্টন, ‘The Decline of Modern Political Theory’; James A Gould এবং Vincents V. Thursby ও ভিনসেন্ট ভি. মার্সবী সম্পাদিত ‘Contemporary Political Thought’ (নিউইয়র্ক; হোল্ট, রেইনহার্ট ও উইনসটন, ১৯৬৯), পৃঃ ৭৬৬।]
এ ধরনের গবেষণাধর্মী বিজ্ঞান সকল সমীক্ষা হতে ধর্মীয় আবরণের প্রভাবকে মুক্ত করতে চেয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর ঐশ্বরিক তথা চার্চের অনুমোদন প্রথা বাতিল ঘোষণা করে। সকল জ্ঞানগত সমীক্ষা ও গবেষণাকে সম্পূর্ণভাবে যুক্তি নির্ভর করার উদ্যোগ নেয়। যার ফলে মানুষ ‘যুক্তিপূর্ণভাবে বিনস্থ’ বিশ্বের উন্নয়নের নিয়ম কানুনসমূহ জানতে পারে। এসব বিজ্ঞান নৈতিক বা আধ্যাত্মিক প্রশ্নগুলিকে বাতিল করে এবং সকল বিষয় বিজ্ঞানকে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ করে যাতে মানুষের দৃশ্যমান সকল আচরণ দ্বারা সমস্ত কিছুকে ব্যাখ্যা করা যায়।–[ Dahl, ‘The Behaviourial Approach in Political Science’ পৃঃ ৭৬৬।] এভাবে এ বিজ্ঞান প্রয়োগ প্রণালী, পর্যবেক্ষণ, শ্রেণীকরণ ও পরিমাপের উপর নিজকে সীমাবদ্ধ করে। অংকশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিজ্ঞান হতে গবেষণা কৌশলগুলি আনয়ন বা ধার করা হয়।
এক ধরনের ইতিবাচক বিজ্ঞান বলে অভিহিত শাস্ত্র প্রথমে এর উৎগাতাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম দিলেও এটা পরে ভুল ও ক্ষণস্থায়ী বলে প্রমাণিত হয়। উত্তর বিশ্ব ও দক্ষিণ বিশ্বের মধ্যে কাঠামোগত বিপুল বৈষম্য, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি; লেবানন, গাজা, কাশ্মীর ও পারস্য অঞ্চলের অমানবিক দমননীতি এরূপ নতুন নৈর্ব্যত্তিক সমাজবিজ্ঞানের ভিত নাড়িয়ে দেয়।–[ যারা রাজনীতিতে পূর্বে ব্যবহারিক পদ্ধতির প্রবক্তা ছিলেন তারাও পরে বিষয়টি উপলব্ধি করেন। Machael Hass এবং Henry S. Kariel সম্পাদিত ‘Approaches to Political Science’ (ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান্ডলার, ১৯৭০)।]
তাই সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত আচরণ পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও তাগিত অনুভূত হয়। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, ইসলাম একটি সামগ্রিক সভ্যতা হিসাবে মানব জীবনকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে পর্যবেক্ষণ করে এবং মানুষের সমস্যা ও তার সমাধানকে কোরান ও সুন্নায় বিধৃত নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক আদর্শের নিরিখেদেখে। তাই ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মকেন্দ্রীক না হয়ে পারে না। এ দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত, কেননা ইসলামে ব্যক্তি মানুষের প্রকৃতি ও আচরণ ও তার প্রতিক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করা হয়।
যুক্তি ও প্রত্যাদেশ
এম.এইচ নসরের মতে প্রকৃতির দিক থেকে পাশ্চাত্য সমাজ বিজ্ঞান নৃতাত্ত্বিকমূলক যা উচ্চতর সকল আদর্শ ও নীতিকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বকে বাস্তবতার মাপকাঠি মনে করে। পশ্চিমা সমাজ বিজ্ঞান শুধুমাত্র প্রত্যাদেশ ও যুক্তিকে পৃথকই করে না বরং প্রত্যাদেশকে জ্ঞানের মাধ্যম হিসাবে অস্বীকারও করে।–[ এস.এইচ. নসর, ‘Islam and Plight of Modern Man’ (লন্ডন: লংম্যান, ১৯৭৫), ‘Science and Civilization in Islam’ (ক্যামব্রীজ মাস, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮)।] গ্রীক-রোমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও যুক্তিবাদী দর্শন অনুসারে সমাজ বিজ্ঞান যা কিছু মানববুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারে না তাকে অস্বীকার করে। এ মানদণ্ডে যা মানুষকে সর্বোচ্চ বস্তুগত কল্যাণ দান করে তাকে নৈতিক বলে মনে করে।–[ এ.এইচ.এ, নদভী, Religion and Civilization’ লখনৌ, Academy of Islamic Research, ১৯৭০) পৃঃ ৬২-৭০।]
পক্ষান্তরে ইসলামী সভ্যতার শিকড় ঐশী প্রত্যাদেশের মধ্যে প্রোথিত। যেহেতু প্রত্যাদেশ ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানের প্রয়োগনীতির অন্যতম ভিত্তি তাই এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে প্রত্যাদেশের সত্যতা যুক্তির মানদণ্ডে বিচার করা যায় এবং তা সবসময় করা হয়ে আসছে। প্রথম থেকে সকল ধর্মতাত্মিক ও দার্শনিক বিতর্কে প্রত্যাদেশের সাথে যুক্তির সম্পর্ক কেন্দ্রীয় গুরুত্ব লাভ করে আসছে। আল আশারী (হিজর ২৭০-৩৩০ সন/৮৭৩-৯৪১ খ্রিঃ) কালাম শাস্ত্র বা যুক্তিবাদের ভিত্তি গুড়িয়ে দেন, তিনিও যে কোন তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে যুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এটা সর্বজনবিদিত যে ইমাম আবু হানিফা, তার বিখ্যাত শিষ্য আলতাহায়ী, আল মানুরিদি এবং একনকি ইমাম গাজ্জালী জ্ঞান লাভের জন্য যুক্তির নীতি ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।–[ মুসলিম দর্শনে তাদের অবদানের জন্য দেখুন এম.এম. শরীফ সম্পাদিত, A History of Muslim Philosophy (ওয়েসব্যাডেন: অটো হ্যাসারোউইটজ, ১৯৬৩)]
কুরআন সঠিক পথের জন্য সকল কিছুকে যুক্তির মানদণ্ডে বিচার করে দেখার আহবান জানিয়েছে (কুরআন ৫৯:২, ৭:৮৬)। প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী রজেন থালের মতে ঐশী আইন ও মানবীয় যুক্তি পরস্পর বিরোধী নয়, বরং পরস্পর পরস্পরে পরিপূরক।–[ এরউইন আই. জে. রজেনথাল, Political Thought in Medieval Islam: An Introductory Outline’ (ক্যামব্রিজ, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬২), পৃঃ ১৬] যুক্তি না থাকলে প্রত্যাদেশ কখনো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতো না এবং ঐশী প্রত্যাদেশ বলেই এটা সাদারণ স্বীকৃতি লাভ করত না। কুরআনের কমপক্ষে ৭৫০ আয়াতে মানব ইতিহাস, সমাজ ও মানব প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা, গবেষণা, উপলব্ধি, যুক্তি প্রয়োগ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে আল মাতুরিদি মন্তব্য করেছেন যে, মানুষের ইন্দ্রিয় ও যুক্তির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কখনো মানবীয় চিন্তার অস্বচ্ছতার কারণেও নানা অস্তঃ ও বহিঃ শক্তির প্রভাবে জ্ঞান লাভে ব্যর্থ হয়।–[ আল মাতুরিদি, এম এম শরীফ সম্পাদিত, ‘A History of Muslim Philosophy, পৃঃ ২৬৩]
ঐশী প্রত্যাদেশ মানুষকে পরকালীন চিরস্থায়ী জগত এবং একই সাথে এই ইহকালীন জীবনের যাবতীয় কার্যাবলীর বিষয়ে দিক-নির্দেশনা, বৃহত্তর পরিসরের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ঐশী প্রত্যাদেশ এমন উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার আলোকচ্ছটা যে অজ্ঞতা, অপর্যাপ্ত জ্ঞান স্থবির সংস্কৃতি ও আচার পদ্ধতির কুয়াশা বিদীর্ণ হয়ে যায়। ইমাম গাজ্জালী ও ইবনে খালদুনের লিখনী হতে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলমানগণ প্রত্যাদেশের জ্ঞানের সাথে যুক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম শিখরে আরেহন করেছিল। ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে জোয়ার বর্তমানে প্রবাহিত হচ্ছে তার শিখা আরবের ইসলাশী জগত প্রজ্জ্বলিত করেছিল। আধুনিক বিজ্ঞান ইসলামী সভ্যতার অনন্য অবদান।–[‘Robert Griffault, The Making of Humanity’. মোহাম্মদ ইকবালের,The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ এ উদ্ধৃত (লাহোর মোহাম্মদ আশরাফ, ১৯৭১) পৃঃ ১২৯-৩০]
সমাজ বিজ্ঞান বনাম প্রাকৃতিক বিজ্ঞান
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সূত্রাবলী ও তথ্যাবলী সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগের বিভ্রান্তি ও অবিমৃশ্যকারী ফলাফল হচ্ছে, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রায়োগিকতাকে অনেক সময় সম্পূর্ণভাবে আদর্শগত ও নৈতিক বিষয়ের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক শ্রদ্ধা অর্জন ও বৈজ্ঞানিক নিপুনতা প্রমাণের জন্য অনেক সময় আবশ্যকভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্ধভাবে অনুকরণ করা হয়েছে।–[ মার্শাল বি. ক্লিনার্ড ‘The Socialogists Quest for Respectability’, The Socialogical Quaterly 7 (১৯৬৬), পৃঃ ৩৯৯-৪১২] ব্যবহারিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চাকারীরা এটি করতে গিয়ে কৃত্রিকমার সৃষ্টি করেছেন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সূত্রাবলীর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষের অনিশ্চিত আচরণ ও ব্যবহারকে দুমড়ে-মুচড়ে অনেক বিকৃত করা হয়েছে।
“আমরা সামঞ্জস্যশীলতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি অথচ লক্ষ্য করছি না আমাদের আচরণ বিধি সামঞ্জস্যশীল কিনা অথবা আমরা সামঞ্জস্যশীলভাবে সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছি কিনা। এর ফলালফ এমন হতে পারে যে আমরা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে একটি ভুল পথ অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছি”।–[ Irwin Deutscher, ‘World and deeds Social Science and Social Policy’ Social Problems 13 (১৯৬৬), পৃঃ ৩৯৯-২৪১]
সুতরাং উপসংহার এই যে, সমাজবিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় সূত্রাবলীর ও ফলাফলের দিক থেকে নিঁখুত হতে হবে এ ভুল মনোভাব ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা বাদ দিয়েই সামগ্রিকভাবে সমাজ বিজ্ঞানমূলক জ্ঞান লাভের চেষ্টা করতে হবে।
প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজ বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন হবার কথা, এবং তা হলো মহান স্রষ্টার সৃষ্টি কৌশল ও মানবীয় চরিত্রের মৌলিক প্রবণতাকে উৎঘাটন করা। আল কোরআনের আলোকে জ্ঞান তিন প্রকারঃ অদৃশ্যলোকের সর্বোচ্চ ঐশী জ্ঞান (হাক্কুল ইয়াকীন); সাক্ষ্য প্রমাণ ও যুক্তি নির্ভর জ্ঞান (ইলম-উল-ইয়াকীন) এবং জীবন অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক বিবরণ নির্ভর জ্ঞান (আইনুল ইয়াকীন)।–[ এ.ইউসুফ আলী, The Holy Qur’an: Text, Translation, Commentary (লেইসেসটার, দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৭৫), পৃঃ ১৬০৩]
অতএব দেখা যায় ইসলামে জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা, অনুসন্ধান, বুদ্ধিবৃত্তি, যুক্তি সব কিছুকেই স্থান প্রদান করা হয়েছে। এটা বাঞ্ছনীয় যে জ্ঞানের একটি শাখা হতে জ্ঞানের অন্য শাখা তথ্য আহরণ করে সমৃদ্ধ হবে। তবে মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে গবেষণা ও কৌশল পদ্ধতি অনুযায়ী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার স্বাতন্ত্রিক অস্তিত্ব রয়েছে।
রাজনীতির যান্ত্রিক ধারণা
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনুকরণের ফলে প্রায়োগিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের অনুসন্ধাদের ক্ষেত্রকে দৃশ্যমান বাহ্যিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। রাজনীতির সংজ্ঞা ‘কে কি পেল, কখন পেলো এবং কিভাবে পেলো’ (ল্যাস ওয়েল) এবং ‘মূল্যবোধের কর্তৃত্বমূলক বিতরণ’ (ইষ্টন) এর সংজ্ঞায় পর্যবসিত হলো। একইভাবে রাষ্ট্রের ধারণাও কতগুলো সাধারণ যৌক্তিকতা তথা জাতীয় আয়, বস্তুগত ও সেবাগত পরিমাণ, উপযোগীতা প্রভৃতি নির্ণায়কের দাড়িপাল্লায় নিরূপিত হলো।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনীতির যান্ত্রিক ধারণাটি বিশ্বজনীন নয়, বরং বিশেষ সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। পাশ্চাত্যে রাজনীতির যান্ত্রিক ধারণার জন্ম বিধায় শুধু মাত্র সেই সমাজের জন্যই তা প্রযোজ্য হতে পারে। এ কারণে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানী বিপ্লব, আফগানিস্তানে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন, কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যৌক্তিক বলে বিবেচিত হচ্ছে না, কেননা এখানে জাতীয় আয় বৃদ্ধি ধরনের কোন উপাদান কাজ করছে না। নীতি বিবর্জিত পাশ্চাত্য রাজনীতি তাই ‘নোংরা খেলায়’ পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতা লিপ্সুরা স্বার্থবাদী নানা অনৈতিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে একে অন্যকে হারিয়ে ক্ষমতার আসন দখল করে।–[ উদাহরণ স্বরূপ দেখুন বার্নার্ড ক্রিক, In Defence of politics (লন্ডন: পেলিকান বুকস, ১৯৬৪); পৃঃ ১৬] কোন মহৎ উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু ক্ষমতা দখলই যখন রাজনীতির লক্ষ্য হয়, তখন রাজনীতি একটি উন্মক্ত, নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়।
রাজনীতির যান্ত্রিক ধারণার সাথে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মিল নেই, কেননা ইসলাম একটি উদ্দেশ্যমুখী ও লক্ষ্যভিসারী জীবন বিধান। ইসলাম তাই এই সব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের উপর গুরুত্বারোপ করে। কুরআন বিশৃঙ্খলা ও কর্তৃত্বের উপর জোর দিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে ইসলামী পণ্ডিতগণ উল্লেখিত বিষয়ের উপর জোর দিয়ে আসছেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের মতে একজন নেতা বা ইমামকে মান্য করা ব্যতীত সংগঠিত সমাজ গঠিত হতে পারে না। ইমাম ইবনে হাম্বল এর সাথে একমত পোষণ করে বলেন ইমামের অনুপস্থিতিতে সমাজ নিশ্চিতভাবে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।–[ ইউসুফ ইবনে আবদ আল বারিয়াল কুরতুবী, ‘জামী বায়ান আল ইলম ওয়া ফাদলিহ’ মেদিনা; আল মাকতাবাহ আল-ইলমিয়া) পৃঃ ৬২] শীর্ষস্থানীয় মুসলিম চিন্তাবিদ আল মাওয়ার্দী আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন জ্ঞান অর্জন ও সত্যপথে চলার জন্য একজন ইমাম থাকা অত্যাবশ্যক।–[ আলী ইবনে মোহাম্মদ আল মাওয়ার্দী, ‘আল আহকাম আল-সুলতানিয়াহ’ (কায়রো: ইছা আল বাবী আল হালাবী, ১৯৬০); পৃঃ ৫]
সংগঠিত কর্তৃত্বের উপর এরূপ অত্যাধিক গুরুত্বারোপের কারণ হিসাবে ফখল আল দ্বীন আল রাজী (হিজরী ৫৪৩-৬০৬ সন ৫৪৩-৬০৬ খ্রিঃ) বলেছেন যে, রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া মানুষ তার কাংখিত লক্ষ্যে অভিষ্ট ভাগ্যে উপণীত হতে পারে না।–[ রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’ পৃঃ ১৪] ইবনে তাইমিয়ার (হিজরী ৬৬১-৭২৮ সন। ১২৬২-১৩২৮ খ্রিঃ) মতে রাজনৈতিক সংগঠন ব্যতিরেকে ধর্মও টিকে থাকতে পারে না।–[ কমরুদ্দিন খান, ‘The Political Thought of ibn Taymiyyah (লাহোর ইসলামিক বুক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৩) পৃ: ২৯]
এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সংগঠিত কর্তৃত্বের হাতে কত প্রকার সম্পদ রয়েছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের দ্বারা ইসলামের সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, The Islamic Law and Constitution’ অনুবাদ: খুরশীদ আহমদ (লাহোর: ইসলামিক পাবলিকেশন্স, ১৯৬৭), পৃঃ ২৪৮] ইসলাশী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে আদর্শ ভিত্তিক, এর পদ্ধতি হচ্ছে সার্বিক ও সার্বজনীন এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে ঐশী নির্দেশনা অনুযায়ী ন্যায়বিচার ও ভালো কর্মের প্রতিষ্ঠা। সংক্ষেপে, ইসলামে রাজনীতি হচ্ছে রাজনৈতিক মানব সংগঠনের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা প্রবিষ্ট করে দেয়া।–[ এম. ইকবাল ‘The Recognition of Religious Thought in Islam’ পৃঃ ১৫৫] তাই দেখা যায় ইসলামে রাজনীতি কোন লক্ষ্য নয়, বরং ইসলামী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রাজনীতি। এরূপ একটা সুদৃঢ় ধারণা রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে পার্থক্যের কোন অবকাশ রাখে না। বরং এ ধারণা উল্লেখিত উপাদান দু’টিকে সংমিশ্রিত করে, প্রত্যাদেশের আলোকে রাজনীতিকে পরিচালিত করে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ঐশী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে মানুষকে পুণ্যবান করার জন্য তাদের ‘সত্য, ও ভালের দিকে আহবান ও মন্দ থেকে বিরত থাকার আহবান করে? (কুরআন ৩:১০৪; ৫:৩।)
এটাই সে আদর্শ যা প্যালেস্টাইন ও কাশ্মীরে স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত রেখেছে। ইসলামী রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন ইসলামী আদর্শের বাইরের কিছু নয়। বরং এর কেন্দ্র রয়েছে ইসলামের সাংস্কৃতিক ধর্মীয় ধারণা এবং ঐশী আলোকে ব্যক্তি মানুষ সমষ্টির জন্য যে ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়া আছে তদানুযায়ী জাতির ভাগ্য নির্মাণ করা। পশ্চিমকে এই মুসলিম রাজনৈতিক মানসিকতা বুঝতে হবে, যাতে তারা মুসলমানদের প্রকৃত আশা আকাংখাকে উপলব্ধি করতে পারে।
ইসলামী বিশ্লেষণ কাঠামো
রাজনীতি সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির উপরের আলোচনা হতে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম কৃত্রিম ও খামখেয়ালীপূর্ণভাবে সামগ্রিক জীবনকে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ এমন দুই ভাগে বিভক্ত করে না। ইসলামে রাজনীতি ও ধর্ম সমন্বিত হয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক একটি সমগ্রতা নির্মিত হয়। আল ফারুকী মন্তব্য করেছেন যে,
‘উম্মাহ হচ্ছে একটি দেহ স্বরূপ যার এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের উপর নির্ভরশীল এবং সব অঙ্গ পরস্পর নির্ভরশীল। কোন এক অঙ্গ যখন কাজ করে তখন তা দেহের অন্যান্য অঙ্গের কার্যাদিও সম্পন্ন করে এবং সমগ্র দেহের কাজের প্রভাব আবার প্রত্যেক অঙ্গের উপর পতিত হয়’।–[ ইসমাইল রাজী আল ফারুকি, Tawhid: Its Implications fot Thought and Life’ (হার্নডন, InternationalInstitute ofIslamic Thought, ১৯৮২) পৃঃ ১৫৩]
নবী করিম (সা) উম্মতকে, ‘একটি সুনির্মিথ সৌধের সাথে তুলনা করেছেন, যার একটি অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে’ এবং আরো তুলনা করেছেন ‘একটি দেহের সাথে যার অন্য অংশ ব্যথা পোলে অন্য অংশেও ব্যথা অনুভূত হয়’।–[ ইসমাইল রাজী আল ফারুকি, Tawhid: Its Implications fot Thought and Life’ (হার্নডন, InternationalInstitute ofIslamic Thought, ১৯৮২) পৃঃ ১৫৩]
ইসলামী রাজনীতি যেহেতু একটি সামগ্রিক বিষয়, তাই ব্যক্তি মানুষকে শুধু মাত্র তার ব্যক্তি পরিমন্ডল দিয়ে ভোলা যাবে না। ব্যক্তি পরিবারের সহিত সম্পর্কিত উদ্দেশ্য ও কার্যের দিক থেকে, আবার সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবারের বিশেষ গুরুত্বের কারণ কুরআন পরিবার সম্পর্কিত বিষয়ের উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে; পরিবার একদিকে সামাজিক বিন্যাসের একটি একক, আবার অন্যদিকে ব্যক্তিমানুষের সমষ্টিও বটে। বস্তুত অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ পরিবার ও সমাজকে সমার্থক মনে করেছেন যেহেতু ইসলামী কাঠামো বিন্যাসে একটিকে ছাড়া অন্যটি কল্পনা করা যায় না।
সমকালীন রাজনীতি বোঝার সুবিধার জন্য শতাব্দী ব্যাপী আমাদের ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতীক পরিবার প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তির ভূমিকা, এবং এর উপর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে পশ্চিমা ধারণার প্রভাবে ব্যক্তির ভূমিকা হ্রাস, পিতামাতার ভূমিকার প্রান্তিকীকরণ ও পরিবার ব্যবস্থার বিপর্যয় এবং তার নতুন বিন্যাসের সমকালীন প্রেক্ষাপট সমূহকে উপলব্ধি করতে হবে। পরিবারে ব্যক্তি কর্তৃত্ব হ্রাসের সংকট উম্মতের মধ্যে ব্যক্তি মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্বের ক্ষেক্রে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যার প্রভাব সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপরও পড়তে বাধ্য। ফলে রাজনীতির মহলে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস, হতাশা সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈধতার প্রশ্নটি উঠে এসেছে, যা দ্বারা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে বলিষ্ঠভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ইসলামী সমাজ গঠন কাঠামোর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুরু হয় ইসলামী উম্মতের অঙ্গ সংগঠনের সামগ্রিক ধারণার উপর নির্ভর করে যাতে প্রত্যেক অংশ তথা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিন্যাস সব কিছু একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
প্রস্তাবিত সামগ্রিক মডেলটি যুক্তিসঙ্গত কারণে শৃঙ্খলামূলক জ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিসীমা ও পরিধি বৃদ্ধি করে। প্রথমতঃ প্রত্যেক অংশ সামগ্রিক বিষয়ের একটি সম্পর্কিত দিক, যার ফলে পারস্পরিক শৃঙ্খলা, সমন্বয় ও সম্পর্কীকরণ সহজতর হয়। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেকটি অংশকে আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা করা যায় যা সমীক্ষার বিনির্মাণে সহায়তা করে। তৃতীয়তঃ প্রত্যেকটি অংশকে বৃহত্তর সামগ্রিকতার পরিমণ্ডলে স্থাপন করার দ্বারা পরীক্ষণ ও সমীক্ষা সহজ হয় ও জ্ঞানের প্রত্যেক অংশের মধ্যে সমীক্ষা ও কার্য করিধি সীমাবদ্ধ রাখা ইসলাম সমর্থন করে না, কেননা অন্যান্য অংশ মনযোগ না পাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
বাহ্যিক ঘটনা ও মূল্যবোধ
উপরের আলোচনার অন্যতক তাৎপর্য হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনার উপর নির্ভর করে অধ্যয়ন করা যায় না, কেননা মানুষের আচরণ মৃত কিছু নয় বরং এটি একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া। বাহ্যিক ঘটনা তখনই অর্থ ও তাৎপর্য লাভ করে যখন একে সামগ্রিকতার কাঠামোর মধ্যে ফেলে ব্যাখ্যা করা হয়। শুধুমাত্র ঘটনা লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড করার মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায় না কেননা সামগ্রিক ব্যাখ্যা হতে বিচ্ছিন্নভাবে এ হতে কিছু নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেগিন ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত অথবা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী রবিন ও প্যালেষ্টাইনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে –এ তথ্য কোন তাৎপর্যপূর্ণ কিছুই বোঝায় না অথবা যা বোঝায় তা নির্ভর করছে কোন সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছে তার উপর। ব্যক্তি সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনা আপেক্ষিক, কেননা মানুষের আচরণ তার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল এবং এ ইচ্ছা তার বিশ্বাস ও নৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত। একটি ঘটনা নিজেই নিজকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত। একটি ঘটনা নিজেই নিজকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। গাণিতিক পিয়সে সমীকরণের মত ঘটনা সংঘটিত হয় না। ঘটনার তাৎপর্য নির্ণয় করেন ঐ পর্যবেক্ষক যিনি তা অবলোকন করেন এবং তিনি তা নির্ণয় করেন বিশ্বাস পরিস্তিতি এবং যে অবস্থার প্রেক্ষিতে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। কোন ঘটনার ব্যাখ্যা তাই মূল্যবোধের গুরুত্ব দাবী করে। থমাস কুইন, সাইয়েদ এইছ, নসর, নকীব আল-আত্তাস ও আমেরিকাত রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মূল্যবোধ নিরপেক্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণাকে চূড়ান্তভাবে নাকচ করে দিয়েছেন।–[ ডেবিড ইস্টন, ‘the New Revolution in Political Science’, The American Political Science Review, 63 (ডিসেম্বর ১৯৬৯) পৃঃ ১০৫১-৬১] এ ধরনের ডান করা আত্মপ্রতারণার সামিল। মূল্যবোধ নিরপেক্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা বস্তুত রূপকথা কেননা মূল্যবোধই নির্ধারণ করে দেয় কি বিষয় ও কি পদ্ধতিতে বিষয়াবলী অধ্যয়ন ও নিরীক্ষা করা হবে। তাই কোন বিষয়ে যদি সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হয়, তবে অবশ্যই মূল্যবোধকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে।
প্রকৃত প্রস্তাবে পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়। কঠোর মূল্যবোধ নিরপেক্ষতার আবরণে বস্তুত অধিকাংশ পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উদার নৈতিক গণতন্ত্রের সপক্ষে পক্ষপাত করে থাকেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে মুনাঠা ও মুনাফার অংক বৃদ্ধি। সহজভাবে বলতে গেলে, তারা প্রচলিত গণতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠার আবরণে চালিয়ে দিয়েছেন।–[ খ্রীষ্টীয়ান বে, ‘Politics and Pseudopolitics A critical Evaluation of some Behavioural Literature’, হেইনজ ইউলাউ সম্পাদিত Behaviouralism in Political Science (নিউইয়র্ক: এমারর্টন প্রেস, ১৯৬৯), পৃঃ ১১৭] ফলে তাদের সৃষ্ট বিষয়গত জ্ঞান নিরপেক্ষ নয় বরং পশ্চিমা সভ্যতার ধ্যান-ধারণার সাথে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সংমিশ্রিত; ফলে সবাই বিষয়টি বুঝতে না পেরে নিরপেক্ষ জ্ঞান মর্মে ভ্রমে পতিত হয়।–[ এস.এম নকীব আল আত্তাস, Islam and Secularism (কুয়ালালামপুর, মুসলিম ইয়থ মুভমেন্ট অব মালয়েশিয়া, ১৯৭৮), পৃঃ ১২৭-১২৮।]
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কোন না কোন মূল্যবোধ বা আদর্শিক বিবেচনা দ্বারা চালিত হয় এবং সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই কিছু ধ্যান-ধারণার বেলায় মানবিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আদর্শগত ধ্যানধারণা ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়ার কোন বাস্তব পরিস্থিতির সুযোগ নেই।
ইসলামী মূল্যবোধ কাঠামো
পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আদর্শগত মূল্যবোধ ও বিবেচনাকে গোপন করে বা বিভ্রান্তমূলক ধারণা সৃষ্ট করলেও, ইসলাম মূল্যবোধের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে। ‘জ্ঞান ও মূল্যবোধ’ এর উপর ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত স্টকহোম সম্মেলন ১০টি প্রত্যয়কে চিহ্নিত করে বা ইসলামী সংস্কৃতির মৌলিক মূল্যবোধঃ তাওহীদ, খিলাফত, ইবাদত, ইলম, হালাল ও হারাম, আদল, জুলুম, ইসতিসলাহ, জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও দা’য়া বা অপচয়। ইসলামের অপরিহার্য ও প্রথম ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তি একেশ্বরবাদ। তাঁর কোন শরীক নেই, তিনি ছাড়া আর কেউ এবাদতের যোগ্য নয়। তাওহীদ সমস্ত সৃষ্টিলোকের জন্য প্রযোজ্য, ফলে এর তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহ পাকের একত্ব, ঈমানদারদের একত্ব, জীবনের সামগ্রিকতার একত্ব এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক জীবনের একত্ব। তাওহীদ একটি মাত্র দিক নির্দেশ করে এবং অনুসারীদের জন্য একক চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে এবং মানবজাতিকে প্রজ্ঞা দ্বারা বিভূষিত ও সমৃদ্ধ করে। তাওহীদের অনুসঙ্গ হচ্ছে খিলাফত, যার অর্থ পৃথিবীতে মানুষের আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব। আল্লাহর পতিনিধি হিসাবে মানুষ মুক্ত তবে দায়িত্বসচেতনতা ও আল্লাহ পাকের কাছে জবাবদিহিতা দ্বারা আবদ্ধ। আল্লাহ মানুষ ও জ্বীনকে তার এবাদত ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য সৃষ্টি করেননি (কুরআন ৫১:৫৬)। খিলাফতের তাৎপর্য হচ্ছে মানুষ নিজের প্রতি ও অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি ঐশী ইচ্ছা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। এই উচ্চ দায়িত্ব সার্বিকভাবে পালন করার মধ্যে ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্য নিহিত।
ইসলামে ইবাদতের ধারণা বেশ ব্যাপক। ‘এবাদত’ অর্থ কোন সুনির্দিষ্ট প্রার্থনা বা কিছু আনুষ্ঠানিতকা নয় বরং সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহর নির্দেশনার স্মরণ ও আনুগত্য। এবাদত জীবনের সব কর্মকাণ্ড তথা আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সকল কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে, এগুলো আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং তাঁর প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী সম্পাদনা করা হয়।–[ জিয়া উদ্দিন সরদার সম্পাদিত ‘The Touch ofMidas’ (ম্যানচেস্টার, ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৪)] আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের কার্যাবলী দু’ভাগে বিভক্তঃ হককুল্লাহ তথা আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও আনুগত্য পালন এবং হক্কুল এবাদ আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রতি, অন্য মানুষের প্রতি ও অন্যান্য সৃষ্টি জীবের প্রতি কর্তব্য পালন করা।
কার্যকরভাবে ‘ইবাদত’ করার জন্য প্রয়োজন ইলম বা জ্ঞান। সামগ্রিক দৃষ্টিতে জ্ঞানের ধারণা ও পরিধি বিশাল। এর অর্থ ও তাৎপর্য সুফী দৃষ্টিভঙ্গিতে মারিফাত (আত্মপরিচয়) হতে ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘Towards Understanding Islam’, অনুবাদ খুরশীদ আহমদ (লন্ডন: দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮০) পৃঃ ৮৮] ইলম বা জ্ঞানকে সাধারণ ভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যায়; ‘প্রত্যাদিষ্ট ঐশী জ্ঞান, যা আল কুরআন ও সুন্নায় বিধৃত আছে এবং ‘বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞান’ যা পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে লাভ করা যায়। প্রথম শ্রেণীর জ্ঞান আবার দু’ভাগে বিভক্তঃ ‘ফরজে আইন’ যা সবার জন্য অবশ্যকরণীয় এবং ‘ফরজে কেফায়া’ যা সমগ্র সমাজের মধ্য থেকে কতিপয় ব্যক্তি সম্পাদন করলে সবার পক্ষ হতে কর্তব্য সমাধা হয়ে যায়।–[ এফ. রোজেনথাল, Knowledge Triumphant (লেইডেন, ই.জে.ব্রীল, ১৯৭০)। এই গ্রন্থটি ইসলামী প্রেক্ষিতে লিখিত হয়েছে এবং এ’তে ইসলামী জ্ঞানের বিষয়ে প্রভূত তথ্য রয়েছে; মুসলিম পণ্ডিতদের ৮৭টি সংজ্ঞার তালিকা রয়েছে।]
ইলম বা জ্ঞানের কথা কুরআনে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন ৩০:৫৬ আয়াতে ঈমান বা বিশ্বাস এবং ৩:৭১ আয়াতে জ্ঞান যুক্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। জ্ঞান বা ইলম অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীন পর্যন্ত ভ্রমণ করো মর্মে হাদীস রয়েছে। তবে জ্ঞান চর্চা বা অর্জন তখনি এবাদত যখন তা ইসলামের সীমারেখার মধ্যে করা হয়। পাশ্চাত্যের ‘জ্ঞানার্জনের জন্য জ্ঞানার্জন’ বা ‘সকল জ্ঞানই মঙ্গলকর’ এ ধারণার সাথে ইসলাম একমত নয়। বরং জ্ঞান তখনই কল্যানকর যখন তা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর হয় ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্জন করা হয়।
জ্ঞান মূল্যবোধ ভিত্তিক হতে হবে এবং অবশ্যই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে জ্ঞানের জন্য জ্ঞান নয় বরং মুক্তি লাভের জন্য জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং সকল জ্ঞান দ্বারা এ উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। মুসলিম পণ্ডিতগণ ইসলামের অনুমোদিত সকল জ্ঞান দ্বারা এ উদ্দেশ্য সাধিন হবে না। মুসলিম পণ্ডিতগণ ইসলামের অনুমোদিত জ্ঞানের অন্বেষণ ও চর্চায় জীবন ব্যয় করেছেন। জ্ঞানকে হালাল ও হারাম দু’টি ভাগ করা হয়েছে। হালাল ঐসব জ্ঞান ও কার্যাবলী যা ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের জন্য কল্যাণকর। যে জ্ঞান ও কার্য হালাল তা আদল, সামাজিক ইনসাফ, ইসতিসলাহ বা জনকল্যাণ সাধন করে। আদল তার সর্ব পরিপ্রেক্ষিতে এবং ইসতিসলাহ তার সকল ব্যপ্তিসহ ঐ জ্ঞানকে উৎসাহিত ও নিশ্চিত করে যা ক্ষমতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক মর্যাদা তথা মুসলমানদের সমাজ ও সংস্কৃতি কল্যাণ সাধন করে।
হারাম বা নিষিদ্ধ গবেষণা হচ্ছে যা শারীরিক, বুদ্ধিবৃদ্ধিক ও আধ্যাত্মিকভাবে মানুষ ও পরিবেশের জন্য ধ্বংসাত্মক। যে গবেষণা বিচ্ছিন্নতা, অমানবিকতা ও পরিবেশগত ধ্বংস সাধন করে তা গর্হিত তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্জনীয়। এ কার্যাবলীসমূহ নিপীড়নমূলক এগুলো অপচয় মূলক। এ শ্রেণীভুক্ত হচ্ছে হস্তরেখা বিদ্যা, যা রাসূলুল্লাহ (সা) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, এতে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের ভাগই বেশী। মানুষ হচ্ছে আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যাকে বিবেকশক্তি, প্রজ্ঞা ও বিবেচনা বোধ প্রদান করা হয়েছে এবং তাকে দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে ভালো কাজ করার জন্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর উপর নির্ভরতার জন্য (কুরআন ২:১৪৮, ১৯৩)
উপরে জ্ঞান ও মূল্যবোধের যতগুলির ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা পরস্পর পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে ইসলামের সামগ্রিক চরিত্র গঠন করেছে। এ সব মূল্যবোধের অনুসরণে যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচালিত তা সমাজের জন্য যা প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর তা নিশ্চিত করতে পারে। এ ধরনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানব জীবনের অন্যান্য জ্ঞানবিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় আনয়ন করে, এবং যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তার উপর আলোকপাত করে। এভাবে ইসলামী মূল্যবোধ ভিত্তিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক, তাৎপর্যপূর্ণ ও তাৎপর্যহীনতা, পুণ্যময় ও পংকিলতাপূর্ণ এর মধ্যে পার্থক্য করে। মূল্যবোধ বর্জিত কতিপয় ঘটনা ও তথ্য সম্বলিত পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ ধরনের জীবনবাদী জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে পারে না।
আদর্শ হিসাবে মদীনার মডেল
মূল্যবোধ ব্যবস্থা হিসাবে, ইসলামী প্রয়োগপ্রণালী শুধু তথ্যনির্ভর নয় বরং মূল্যবোধ ভিত্তিক। ‘কোন কিছু কিরূপ’ এই ধারণা পৃথক করা যায় না। তাই ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধারণাটি ‘আদর্শ ব্যবস্থা’ এর সমার্থক হওয়ার কথা কেননা দ্বিতীয়টির মানদণ্ড প্রয়োগ ছাড়া প্রথম ধারণাটির তাৎপর্য ফুটে উঠে না। পাশ্চাত্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানও এধরনের একটি ‘আদর্শ ব্যবস্থার’ প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেনি এবং সে উপলব্ধি হতে সেন্ট-সাইমন, বরার্ট ওয়েন, চার্লস ফুরিয়ার প্রমুখ তত্ত্ব নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এ ধারায় কার্লমার্ক্স ও ফ্রেডেরিক এনগেলষ –এর ‘শ্রেণীহীন সমাজের’ ধারণাটি প্রণিধানযোগ্য।
মুসলমানদের জন্য পাশ্চাত্যের ইউটোনীয় ধরনের তত্ত্বের সাহায্য নেয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। মুসলমানদের মধ্যে এ ঐকমত্য রয়েছে যে নবী করিম (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদা মদীনায় যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা পৃথিবীর বুকে নজীর বিহীন ও আদর্ম স্থানীয় এবং তা মুসলমানদের সর্বযুগের জন্য দিক নির্দেশন প্রদান করেছে। সাইয়েদ কুতুবের ভাষায়ঃ এ যুগটি ছিল অনন্য সাধারণ যুগ, পরিশীলিত শীর্ষ যুগ, অসাধারণ গুণাবলীসম্পন্ন মানুষের সমষ্টি ও সমস্যা, একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। এটা ছিল মহান আল্লাহ প্রদত্ত ঐশী ব্যবস্থাপনা, যাতে মানুষের বাস্তবজীবন পরিসীমায় তা বাস্তবায়ন করা যায় এবং মানুষের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে ভবিষ্যতে এ মডেল পুনঃ পুনঃ স্থাপন করা যায়।–[ সাইয়েদ কুতুব, ‘This Religion of Islam’ (গ্যারী, ইন্ডিয়ানা International Islamic Federation of Student Organisations) পৃঃ ৬৫।]
সকল যুগের সকল পরিস্থিতিতে মদীনার মডেলটি আদর্শ স্থানীয় এবং প্রচলিত অবস্থঅ ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে মদীনার মডেলটির দাড়িপাল্লায় ওজন করে এর সঠিকতা নিরূপণ করা যায়। ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান হচ্ছে সর্বোচ্চ আদর্শ মানব হিসাবে মহানবী (সা) এবং আদর্শ মডেল হিসাবে মদীনার ব্যবস্থাকে অনুসরণের নিরন্ত প্রচেষ্টা। এই মডেলের স্বর্গীয় স্পর্শে যেকোন রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা জীবন্তভাবে স্পন্দিত হয়ে উঠে। এটা সর্বজনবিধিত যে মুসলিম পণ্ডিতগণ ইসলামী সীমারেখার মধ্যে থেকে জ্ঞানের সকল শাখা ও ক্ষেত্রে বিচার করেছিলেন। আদি যুগে ‘ফুকাহা’ বা শাস্ত্রবিদগণ ছিলেন জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার, তারা জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে তথা সাহিত্য হতে চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি সমস্ত শাস্ত্রে তাদের বিপুল অবদান রেখেছিলেন। প্রকৃত পেশাজীবী জ্ঞানী মানুষ যারা ইসলামকে কাতিপয় আইনের সমষ্টি হিসাবে নয়, বরং জীবনযাত্রার আদর্শ ও তত্ত্ব, চিন্তার ভিত্তি হিসাবে অবলোকন করেছেন, যে জীবনাদর্শ অনুসারী অসংখ্য মানুঝ জীবন যাপন করছে।–[ মহসিন মাহদী, Ibn Khaldun’s Philosophy of History (শিকাগো, দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ১৯৬৪); ফ্রানজ রোজেনথাল সম্পাদিত ‘The Muqaddimah’ (প্রিন্সটন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৭)।]
আদিযুগের পণ্ডিতগণ যে রাজনৈতিক তত্ত্ব উপস্থাপন করতেন তা ছিল মূল্যবোধ নির্ভর। তারা রাজনৈতিক সম্পর্ক সমূহের তাত্ত্বিক ও বাস্তব সম্পর্কের সূত্র নির্ণয় করতেন। ইসলামী আদর্শ হতে তারা রাজনৈতিক সূত্রাবলী অন্বেষণ করতেন। শরীয়াহ কখনো আদর্শ বিবর্জিত হয়নি। এভাবে তারা তাদের সমগ্র রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রভূমিতে আদর্শবাদী চেতনাকে স্থান দিতেন।
আদি মুসলিক পণ্ডিতগণের সমুজ্জ্বল অর্জনের কারণ ছিল তারা সঠিক প্রশ্ন ও তার উত্তর উপস্থাপন করতেন। রাজনৈতিক সংগঠন কি এবং তার উদ্দেশ্য কি? তাদের যা কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল প্রয়োগ পদ্ধতির ক্ষেত্রে তা ইবনে খালদুনের (হিজরী ৭৩২-৮০৮ সন/ ১৩৩২-১৪০ খ্রিঃ) সমাজ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। ইবনে খালদুন পর্যবেক্ষণ,তুলনা, যুক্তির সুনিপুন ব্যবহার সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের জটিলতার গ্রন্থি উন্মোচন করেছিলেন।
ইবনে খালদুন রাজনৈতিক সংগঠন ও এ সংগঠনের দ্বারা পুরিত উদ্দেশ্য ও মানুষের লক্ষ্যে মাঝে সংযোগসূত্র স্থাপন করতেন। অন্য কথায় ইবনে খালদুন নৈতিক বোধের উপর আলোকপান করতেন, যা ইসলামী আদর্শের এই ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করত। মানব সমাজের প্রতি এ হচ্ছে ইসলামের এক অনন্য সাধারণ অবদান। রাজনীতিতে নৈতিকতার অন্বেষণ বস্তুত একটি সমতা ভিত্তিক মানবিক বিশ্বব্যবস্থা গঠনের প্রথম প্রয়াস।
উপসংহার
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানমূলক অনুসন্ধান ও তার ইসলামী বিকল্পের মাঝে যে বৈশাদৃশ্য উপরোক্ত আলোচনায় উন্মোচিত হয়েছে তাতে পূর্বোক্তটির দুর্বলতা ও ত্রুটি সমূঞই শুধু উৎঘাটিত হয় নি বরং একই সাথে শেষোক্তটির অন্তর্নিহিত ইতিবাচক কল্যানধর্মী গুণাবলীসমূহও চিহ্নিত হয়েছে। যে চিত্রটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রয়োগ পদ্ধতি ও প্রণালীর দিক থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ধারাকে অনুসরণ করেছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি ও প্রণালী হতে আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত চেতনা সমূহকে বিসর্জন দিয়ে ‘মূল্যবোধ নিরপেক্ষ’ এক ধরনের সমাজ বিজ্ঞান নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ‘জ্ঞানের জন্য জ্ঞান বলে কিছু নেই। বস্তুনিষ্ঠ, মূল্যবোধ নিরপেক্ষ রাজনীতি ও রাষ্ট্র ধারণ বলে বর্তমান কোন কিছু নেই। রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের যান্ত্রিক ধারণা,তাত্ত্বিক গঠন, বাস্তব নিরীক্ষা এ সবকিছুই পাশ্চাত্য খ্রিষ্টবাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার রঙ্গে রঞ্জিত, যা আবার মর্মমূলের দিক থেকে সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ, মূলবোধ নিরপেক্ষ রাজনীতি ও রাষ্ট্র ধারণা বলে বর্তমানে কোন কিছু নেই। রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের যান্ত্রিক ধারণা, তাত্ত্বিক গঠন, বাস্তব নিরীক্ষা এ সবকিছুই পাশ্চাত্য খ্রিষ্টবাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার রঙ্গে রঞ্জিত, যা আবার মর্মমূলের দিক থেকে সম্পূর্ণ বস্তুতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। এ ধরনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান মুসলিম সমাজে চাহিদা ও প্রয়োজনীয়া মেটাতে পারে না এবং তার ফলে এটা মুসলিম সমাজে সাংস্কৃতিক শিকড় গড়তে পারে না।
ইসলামী মূল্যবোধের পরিধির মধ্যে থেকে ইসলাম জ্ঞানের অনুসন্ধানের তাগিদ প্রদান করে। এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণকে সঠিক পন্থা বলে মনে করে না। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে যে যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তার পরিবর্তে ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান উদ্দেশ্যের ও লক্ষ্যে নিরিখে বিচার বিশ্লেষণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খণ্ড খণ্ড দৃষ্টিভঙ্গির বদলে জারিত ও সঞ্জীবিত। কুরআন ও সুন্নায় যা আছে এবং মদীনার রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে মূল বৈশিষ্ট্য ও চেতনা বিদ্যমান, তা ইসলামী রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনার ভিত্তি। তার আলোকেই সকল জ্ঞান ও বাস্তব প্রচেষ্টা পরিচালিত হবে। যেখানেই মানবিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে, সেখানেই নৈতিক চেতনার প্রশ্নটিও রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান তাই মূল্যবোধ নিরপেক্ষ ও বিবর্জিত কিছু হতে পারে না। ইসলাম গুরুত্বের সাথে ঘোষণা করে যে, রাজনীতির নৈতিক লক্ষ্য থাকতে হবে এবং সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন, ব্যক্তি ও গ্রুপের নৈতিক দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করতে হবে। রাজনীতি ও নৈতিকনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অবক্ষয়িত বিশ্বে এ শিক্ষাটিকে ফিরিয়ে আনতে হলে এটিকে নতুন করে গ্রহণ করতে হবে।
ইলম বা জ্ঞান হচ্ছে মানবজাতির উপর স্রষ্টার অর্পিত একটি দায়িত্ব ও দান। এ জ্ঞান অর্জিত হতে পারে প্রত্যাদেশ ও যুক্তি হতে, পর্যবেক্ষণ ও স্বজ্ঞা থেকে, ঐতিহ্য এবং তাত্ত্বিক ভাবনা থেকে। রাজনৈতিক চিন্তনের এ বহুমুখী পন্থা ও পদ্ধতিকে অবশ্যই ঐশী প্রত্যাদেশের চিরন্তন মূল্যবোধের অধীন হতে হবে। জ্ঞানের অনুসন্ধানকে সম্পৃক্ত হতে হবে কুরআন প্রদত্ত ধারণা তাওহীদ, খিলাফত, ইবাদত, ইলম, আদল, ইসতিসলাহ বা জনকল্যাণ ইত্যাদির সাথে। ইসলামের চিরন্তন মূল্যবোধের পরিধি কাঠামোর মধ্যে থেকে জ্ঞানের অন্বেষণ করলে তা মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খিলাফতের মর্যাদা ও তাৎপর্য প্রদান করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সকল কাজ এবাদতের পর্যায়ে উন্নীত হয়। অন্যকথায় এবস ইতিবাচক কর্মমাণ্ড অন্যান্য বিষয়াবলীর মধ্যে হারাম কাজ জুলুম ও দা’য়া বা অপচয়কে পরিহার ও পরিত্যাগ করে।
কুরআনে বিধৃত মূল্যবোধসমূহ ইসলামকে একটি সার্বজনীন চরিত্র প্রদান করেছে। ইসলামী মূল্যবোধসমূহের চিরন্তনসমূহের চিরন্তনতা ইসলামী পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে জ্ঞানের যে অন্বেষা ও অনুসন্ধান পরিচালিত হয় তাকেও বিশ্বজনীন মর্যাদা প্রদান করে। মুসলিম জাতি যাকে ভালো কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকার নির্দেশ ও দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তার ইসলামী কাঠামোর মধ্যে থেকে জ্ঞান চর্চা করা ব্যতিরেকে স্থায়ী কোন শুভ ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।