খিলাফতঃ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা
ইসলাম ধর্মের সাথে রাজনীতি, আইন ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, খলিফাতুল্লাহ বা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে –এই গুরুত্বারোপের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঐশী ইচ্ছঅ ও নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্বসমাজকে সঠিকভাবে গঠন ও রূপদান। ইসলাম ও রাজনৈতিক ব্যবস্তা অবশ্যই সমার্থক নয়, তবু রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামে ধর্মব্যবস্থা বাস্তবায়নের বাহন হিসানে গণ্য করা হয়।–[এই পুস্তকে ‘Political Order, ‘Political System’ এবং ‘Polity’ শব্দসমূহ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দসমূহের অর্থ অভিন্ন, যার অর্থ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিন- ও সরকারভিত্তিক একটি সমাজ। এই শব্দসমূহ ‘রাষ্ট্র’ শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে, যেখানে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ভৌগোলিক ও অন্যান্য তাৎপর্যগত অর্থ রয়েছে।] এ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ইসলামী ঐশী নীতিমালা প্রয়োগের যন্ত্রস্বরূপ, যা একজন বিশ্বাসী মানুষের জীবনের সকল অঙ্গনে পরিব্যপ্ত ও জীবনের সকল দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। রোজেনথাল যা প্রয়োজন মনে করেননি তার বিপরীতের ফকিহগণ তাই এ প্রশ্ন উত্থাপন করতে বাধ্য হয়েছেন যে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা কেন এবং আদৌ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা কেন এবং আদৌ রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা।–[ ই.আই.জি রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam An Ientoductory Outline’ (ক্যামব্রিজ, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮), পৃ:২৪] উম্মাহর প্রয়োজন ও ইসলামী বিশ্বজনীনতার প্রসঙ্গে আল কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও অসংখ্য হাদীসের বাণীর প্রেক্ষাপটে ফকিহগণ একটি ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাঠামো বিনির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদের আগমন ও পরবর্তীতে মুসলিম ভূখণ্ডসমূহ ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক দখল ও শাসনের অব্যাহত প্রবাহ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর চলমান আইনগত, রাজনৈতিক ও দার্শনিক নিরীক্ষামূলক আলোচনা ও গবেষণার ধারাকে স্তিমিত করে দেয়। উপনিবেশবিরোদী স্বাধীনতা আন্দোলন সসমূহে ইসলাম মূল ঐক্যশক্তি হিসাবে কাজ করেছে এবং বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে যার প্রেক্ষাপটে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রশ্নটি পুনর্জীবিত ও উত্থাপিত হয়েছে। তখন হতে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সাহিত্য আত্মপ্রকাশ করেছে যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র বিষয়ে ভাবনা, চিন্তা ও বিশদভাবে বিশ্লেষণ হয়েছে; তবু এর প্রকৃতি, ধরন ও রূপরেখার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অস্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থতা এখনো রয়ে গিয়েছে এবং পাশ্চাত্যের জাতি ধারণার সাথে প্রায়শই এর তাত্ত্বিক ধারণার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে।
রাষ্ট্র
গ্রীক দার্শনিকগণ প্রথম রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে সুবিন্যস্ত আলোচনার সূত্রপান করেন। এরিস্টটলের মতে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক জীব, একটি যুথবদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশে বাস করা তার প্রকৃতি, কেবলমাত্র যার মধ্যদিয়ে সে তার সর্বোচ্চ নৈতিক সত্তার বিকাশ ঘটাতে পারে।–[ এরিস্টটল, ‘The Politics’; অনুবাদ জে.এ. সিনক্লেয়ার (ইংল্যান্ড, পেনগুইন বুকস, ১৯৯২) পৃ: ২৮] প্লেটো ও এরিস্টটলের মতে সাধারণ কল্যাণ ও নৈতিক পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন। তাঁদের মতে রাষ্ট্র কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক সংগঠন নয় বরং এটা একই সাথে ধর্মীয় সম্প্রদায় সংঘ ও সামাজিকীকরণ সংস্থা হিসাবে কাজ করে-যা সাধারণভাবে ব্যক্তি মানুষের মন ও আত্মার উৎকর্ষ সাধনে লিপ্ত থাকে। তাঁরা ব্যক্তিমানুষকে এমন এক সত্তা রূপে দেখেছেন যার স্বাভাবিক প্রবণতা শুভের দিকে এবং তাই তারা মানুষের নৈতিক দিকের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাজনৈতিক আবহে মানুষের যুথবদ্ধতার অনুভূতির তথা নৈতিক বিশ্বাসের সাধারণ ঐক্যমত্যের উপর তারা জোর দিয়েছেন।
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলীর (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রি.) সময় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণা ও গুরুত্ব সমূহ পরিবর্তিত হতে থাকে। তাত্ত্বিকগণ এমন স্বার্থপর এক প্রাণী রূপে দেখতে থাকেন যার ক্ষমতার পর আরো ক্ষমতা প্রাপ্তির অদম্য ও অবিশ্রান্ত লিপ্সা শুধু মৃত্যুবরণ করার পূর্ব পর্যন্ত অনিশেষ থাকে।–[ টি হবস, ‘Leviathan’; সম্পাদনা: সি.বি স্যাকফারসন (হারমন্ডসওয়ার্থ, ইংল্যান্ড, পেনগুইন বুকস, ১৯৬৮) পৃ: ১৬১] পরবর্তীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে শুভবোধ ও নৈতিকতা হতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে কেন্দ্রীভূত ও নিবদ্ধ হয়। এ আলোচনা চলতে থাকতে কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-৮৩ খ্রি.) ও ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০ খ্রি.) পর্যন্ত, যাদের কাছে সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনা বহুলাংশে ঋণী। মার্ক্স ও ওয়েবার উভয়েই জনসংখ্যা, ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্বকে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য করে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই মর্মে রায় প্রদান করেন। পক্ষান্তরে তাঁরা রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণীবর্গের বিশ্লেষণ ও তাদের আচরণের উর আলোচনা কেন্দ্রীভূত করেন। প্রত্যেক শ্রেণীবর্গের মধ্যে ব্যক্তিমানুষ একটি স্বার্থপর সদস্য, এই ধারণার উপর ভিত্তি করে উভয়ই তাতে তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছেন। উভয়ে রাষ্ট্রকে দেখেছেন ক্ষমতা, শক্তি আধিপত্যকে শাসন ব্যবস্থঅর বস্তুগত ভিত্তির নিরিখে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে বিষয়াবলীর উপর তুলনামূলক গুরুত্ব আরোপ, লক্ষ্য ও কাংখিত লক্ষ্য সাধনে পন্থা ও উপায় নির্ণয়ের ভিন্নতার মাঝে।
রাষ্ট্র সম্পর্কে কার্লমার্ক্সসের ধারণা
মার্ক্সের মতে রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণী স্বার্থ বিরোধ ও শ্রেণী সংগ্রামের ফসল এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী গোষ্ঠী দ্বারা।
বর্জুয়া রাষ্ট্র হচ্ছে উৎপাদনের উপকরনের অধিকারী শোষক শ্রেণীর হাতে সমাজের নিগৃহীত ও শোষিত শ্রেণীর উপর শাসন ও শোষনের যন্ত্র। সরকার হচ্ছে শাসক শ্রেণীর ‘পরিচালন বা নির্বাহী পরিষদ’, যারা শাসক শ্রেণীর দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সমাজের মানুষের আচার আচরণ ও কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করে। বর্জুয়া রাষ্ট্রে রয়েছে একধরনের আপেক্ষিক স্বায়ত্বশাসন এবং নিরপেক্ষতার বহিঃআবরণ।
ধরনের দিক থেকে এটা গণতান্ত্রিক হতে পারে, কিন্তু এ রাষ্ট্রের গঠন কাঠামো এমন অসমভাবে বিন্যস্ত যাতে সংখ্যালঘু বর্জুয়া শ্রেণীর অব্যাহত আধিপত্য অক্ষুণ্ণ থাকে। মার্ক্সের মতে যেহেতু রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণী ভিত্তিক, এবং শ্রেণীর অস্তিত্বে রয়েছে বিরোধ ও বিভাজন,তাই বর্জুয়া রাষ্ট্রে পরস্পর বিরোধী শক্তির প্রবণতা বিরাজ করে। মার্ক্সের মতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উচ্চমাত্রার উৎপাদন মুষ্ঠিমেয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদের কেন্দ্রতবন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গভীর দারিদ্রের বিনিময়ে অর্জিত হয়। তিনি মনে করেন, এই ব্যবস্থা অবশ্যই কমিউনিষ্ট সমাজ দ্বারা অপসারিত হবে, যেখানে সম্পদ ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের বিকাশ ঘটবে এবং প্রত্যেকের প্রয়োজন পূরিত হবে। এ ধরনের একটি ব্যবস্থায় কোন সংঘাত থাকবেনা, ফলে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রেরও কোন আবশ্যকতা থাকবে না। এভাবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটাবে।–[রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সসীয় ধারণা সম্পর্কে দেখুন, ফ্রেডারিক এনজেলস ‘Origin of the Family, Private Property and the State’ (মস্কো, প্রগ্রেস পাবলিসার্স, ১৯৬৯); কার্ল মার্ক্সস, ‘The 18th Brumaire’ (মস্কো, প্রগ্রেস পাবলিসার্স, ১৯৬৯)।]
রাষ্ট্র সম্পর্কে ম্যাক্সওয়েবারের মতবাদ
রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সসীয় বিশ্লেষণের বহু বিষয়ের সাথে ম্যাক্সওয়েবের একমত পোষণ করে, তবে তিনি শ্রেণীহীন সমাজের ধারণাকে অবাস্তব বলে অভিহিত করেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মার্ক্সসীয় সমালোচনাকে প্রত্যাখান করে তিনি মন্তব্য করেন যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে তেমন কোন ফারাক নেই, কেননা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেমন বর্জুয়াশ্রেণী আধিপত্য করে থাকে। তাঁর মতে রাষ্ট্র হচ্ছে ‘ব্যক্তির উপর ব্যক্তির প্রাধান্য ও আধিপত্য, যা শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে বিস্তার করা হয়ে থাকে’।–[ ম্যাক্স ওয়েবার ‘Politics as a Vocation’, এইচ.এইচ. গার্থ ও সি. রাইট মিলস সম্পাদিত From Max Weber’ (লন্ডন, রুলেজ এন্ড কেগান পল, ১৯৭০); পৃ: ৭৮।] ওয়েবার এ সম্পর্ককে বিশ্লেষণধর্মী ও প্রয়োজনীয় মনে করেন, যেহেতু সম্পত্তিই প্রাধান্য ও আধিপত্যের বস্তুগত ভিত্তি ও উপকরণ সরবরাহ করে, সেই আধিপত্য প্রশাসনিক বা নিপীড়নমূলক যাই হোক না কেন। এই আধিপত্যকে কিভাবে আইন সঙ্গত রূপ দেয়া যায় তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রদান করাকেই তিনি তার সমীক্ষা হিসাবে গ্রহণ করেন ‘সহিংসশক্তির প্রয়োগ রীতি সম্পর্কে অবহিত’ কোন সামাজিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান না থাকলে সমাজে ‘নৈরাজ্যের’ সৃষ্টি হবে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।–[ ম্যাক্স ওয়েবার ‘Politics as a Vocation’, এইচ.এইচ. গার্থ ও সি. রাইট মিলস সম্পাদিত From Max Weber’ (লন্ডন, রুলেজ এন্ড কেগান পল, ১৯৭০); পৃ: ৭৮।] রাষ্ট্রকে এমন একটি ‘মানব সংগঠন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যা একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে বৈধভাবে শক্তি প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার দাবী করতে পারে’।–[ ম্যাক্স ওয়েবার ‘Politics as a Vocation’, এইচ.এইচ. গার্থ ও সি. রাইট মিলস সম্পাদিত From Max Weber’ (লন্ডন, রুলেজ এন্ড কেগান পল, ১৯৭০); পৃ: ৭৮।] শক্তি প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকারকে যুক্তিযুক্ত বলা যায় এ কারণে যে এতে সংঘাত, সংঘর্ষের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। আধিপত্যের যৌক্তিকতা অবশ্য বৈধ আদেশ পালনের সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করে।
Dahl প্রণীত Who Governs? গ্রন্থটিতে রাষ্ট্রো সম্পর্কে ম্যাক্সওয়েবারের ধারণার উপর ভিত্তি করে বহুমাত্রিক রাজনীতির বিষয়ে সমীক্ষা ও পর্যালোচনা পরিচালনা করা হয়েছে।–[ Robert Dahl, ‘Who Governs?: Democracy and Power and Powes in an American City’ (নিউ হেভেন, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬১)।] Dahl রাষ্ট্রকে শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী কেন্দ্রীয় স্থান অধিকারী লোকসমষ্টি ও শাসিত শ্রেণীর লোকবর্গের সম্মিলন হিসাবে দেখেছেন। রাজনৈতিক জগতটি বিভিন্ন শ্রেণীর লোক সমষ্টির দ্বারা গঠিত যাদের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক শক্তি ও সম্পদ রয়েছে। বিভিন্ন স্বার্থ ও সম্পদরাজির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি হিসাবে জননীতি নির্ণীত হয়।
পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক উভয় প্রেক্ষাপট হতে রাষ্ট্র ধারণার অবয়বগ্রহণ কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। এতে রাষ্ট্রীয় আচরণের ব্যাখ্যায় জনসংখ্যা, ভূ-খণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্বের সনাতন বিশ্লেষণের সাথে শ্রেণী বিশ্লেসণ বা গোষ্ঠী মিথস্ক্রিয়া ও গতিশীলতা যুক্ত হয়েছে। যে শ্রেণী অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সেই শ্রেণীই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব ব্যবস্থাও সমাজতন্ত্রের পথে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বর্জুয়া রাষ্ট্র কাঠামোর কতিপয় বৈশিষ্ট্য ও উপাদান অক্ষুণ্ণ রাখে। উভয় ব্যবস্থাতে শ্রেণী ও জাতীয় স্বার্থকে সমাজের ব্যক্তি মানুষের স্বার্থ ও অধিকারের উর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়। পরিশেষে উভয় ব্যবস্থাই ব্যক্তি মানুষের আধ্যাত্মিক এমনকি বস্তুগত কল্যাণের বিষয়েও সমাজের সামগ্রিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করে।
ইসলামী ব্যবস্থার নিরিখে রাষ্ট্রের ধারণা
রাষ্ট্রের পাশ্চাত্য মডেল মুসলমানদের নিকট গ্রহযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। যে কাঠামো ইসলাম অনুমোদন করে তা জনগোষ্ঠী বা ভূ-খণ্ড দ্বারা সীমাবদ্ধ ন। জনগোষ্ঠী ও ভূ-খণ্ড নিশ্চিতভাবে প্রয়োজনীয় কিন্তু এগুলো একটি বিশ্বব্যবস্থা গঠনের পথে যান্ত্রিক প্রয়োজন মাত্র। ইসলাম শুধুমাত্র একটি ভূ-খণ্ডের অভিলাষী নয় বরং সমগ্র বিশ্বের ভূ-খণ্ডকে একমাত্র স্রষ্টার ঐশী ইচ্ছঅর বাস্তাবয়ন ক্ষেত্র হিসাবে পরিণত করতে চায়। ইসলাম হচ্ছে বিশ্বজনীন, তাই একটুকরো ভূ-খণ্ডের মাঝে একে সীমাবদ্ধ করা যায় না। একই সাথে ইসলামের বাণী কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতিসত্তার প্রতি নয় বরং সমগ্র মানব সমাজের জন্যে। জাতি-রাষ্ট্রের মত নয়, বরং ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে এমন এক মুক্ত সমাজ যার দুয়ার ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। দেশপ্রেম এবং স্বদেমের প্রতিরক্ষা ইসলামে স্বীকৃত ও উৎসাহিত। জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা, যেখানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় তাও ইসলামের ধ্যান-ধারণা ও আইনী-আওতায় একটি বিজাতীয় ধারণা এবং এত বায়াত গ্রহণ বা শুরা ব্যবস্থার সাথে সমার্থক বিবেচনা করা যায় না। ইসলামী রাজনীতিতে আইন পরিষধ শরিয়া দ্বারা পরিচালিত এবংআইন পরিষদের কাজ হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত নীতিমালা ও মূল্যবোধ সমূহ বাস্তবায়ন করা। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থঅ একটি আদর্শগত ধারণা। বিশ্বাসীদের নিয়ে এ সমাজ গঠিত এবং এর লক্ষ্য আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীন ও বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করা, আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারজন্য চূড়ান্তভাবে চেষ্টা করা এবং সৎকাজকে উদ্বুদ্ধ করা ও অসৎকাজকে নির্মূল করা। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্যের মত নয় বরং এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং তা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের চরিতার্থ নয়।
তৌহিদে অবিচল বিশ্বাস ও শরীয়া দ্বারা শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে উভয়ের স্বার্থ নিয়ন্ত্রিত। ইসলাম পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের মত জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের সার্বভৌম বৈধতার বিশ্বাসী নয়। ইসলামী ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্তের সার্বভৌম বৈধতার উৎস হচ্ছে শরীয়াহ এবং নির্ধারিত পদ্ধতিতে তা বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে ঐশী ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ।
ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই কোন উদ্দেশ্য নয় বরং ইসলামের মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের পন্থা বা উপলক্ষ –তা হলো সর্বমানুষের বস্তুগত ও আত্মিক কল্যাণের জন্যে একটি বিশ্বজনীন নৈতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি। ইসলামের রাজনৈতিক কাঠামো ও ব্যবস্থা হচ্ছে কতগুলো চিরকালীন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিকে স্থাপিত। এ গভীরমত মূল্যবোধসমূহ হচ্ছে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উৎস এবং তা ব্যক্তির সাথে রাজনীতির ও রাজনীতির সাথে সমগ্র সমাজের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত করে। এই মূল্যবোধ ও ঐশী অনুশাসন সমূহ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের নীতিমালা নির্ধারণ করে যার মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ বাস্তব রূপ লাভ করে।
ইসলামে রাষ্ট্রের ধারণা
জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা, যার আরবী পরিভাষা হচ্ছে ‘দাওলাহ’ তা ইউরোপে সার্বভৌমত্বের (দিয়াদাহ) ধারণার মত্য সাম্প্রতিক ধারণা ও পরিভাষা। ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির সাথে জাতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারণাটি সম্পৃক্ত এবং সার্বভৌমত্বের ধারণাটি প্রথমত: ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ডীন বডিন (১৫৩০-৯৬ খ্রি.) কর্তৃক উদ্ভাসিব। তাই এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে রাষ্ট্রের পরিভাষাটি যেমন কুরআনে ব্যবহৃত হয়নি তেমনি রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময়েও এ পরিভাষাটি প্রচলিত ছিল না।–[‘দুলাই’ শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে (৫৯:৭)। ‘ঘূর্ণায়মান বৃত্ত’ পারিভাষিক অর্থে, এতে বুঝান হয়েছে সম্পদ শুধুমাত্র ধনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্টিত হওযা উচিৎ নয়। রাষ্ট্র অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়টি, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পরিবর্তনের ক্ষেত্র ছাড়া। আহমেদ দেভুটুগলু দেখিয়েছেন যে, ধাতুরূপ ‘দওল’ হতে ‘দাওলাহ’ শব্দটি তিনক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম : ইহা রাজনৈতিক শক্তির পরিবর্তন বুঝিয়েছেন, দ্বিতীয়ত: চলমান রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ধারাবাহিকতা বেং সর্বশেষে জাতিরাষ্ট্র।
দ্রষ্টব্য Ahmed Davutoglu, ‘Alternative Paradigms: The Impact of Islamic and Western Weltanschauung on Political Theory (ম্যারিল্যান্ড, ইউনিভার্সিটি প্রেস অব আমেরিকা, ১৯৯৪) পৃ: ১৯০) পৃ: ১৯০।] প্রথম যুগের ফকিহগণ ‘খিলঅফণ’ বা ‘ইমামত’ শব্দদ্বয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বুঝাতে ব্যবহার ররেছেন। ‘দাওলাহ’ পরিভাষাটি হিজরী সপ্তম শতকের প্রথম দিকে বহুলভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং ক্ষমতাহীন খলিফার নামেমাত্র আনুগত্যশীল মুসলিম রাজবংশ সমূহকে আখ্যায়িত করতে ব্যবহৃত হয়।–[ আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে জারীর আল তাবারী, ‘Tariks al Tabari’; সম্পাদনা এম. জে. দি. গোয়েজী (লইডেন: ই.জে.ব্রিল, ১৯৯১); ভলিউম ১.১ পৃ: ৮৫-১১৫] ‘খিলাফত শব্দের বিকল্প’ বিহাসে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ পরিভাষাটি প্রচলন লাভ করতে আরে আটশতাব্দী পেরিয়ে যায়।–[ হামিদ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’ (লন্ডন, ম্যাকমিলান প্রেস, ১৯৮১, পৃ: ৬৯)] এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ১৯২৪ সালে খিলাফতের বিলুপ্তিসহ অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়। তবে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ পরিভাষাটি ভাষার একটি অপপ্রয়োগ এবং একে ‘ইসলামী রাজনীতি’ বা ইসলামী রাজনৈতকি ব্যবস্থা’ শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা সঙ্গত। যদিও ‘রাষ্ট্র’ বা ‘রাজনীতি’ শব্দদ্বয় কুরআনে ব্যবহৃত হয়নি, তবে এর অপরিহার্য যে উপাদানসমূহ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠন করে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ আল কুরআনে রয়েছে। এ হতে প্রতীয়মান যে পরিভাষা না হলেও এ ধারণাগুলি আল কুরআনে বর্ণিত এবং বোঝান হয়েছে।–[ মজিদ খাদ্দুরী, ‘The Nature of the Islamic State’, ইসলামিক কালচার, ভলিউম-২১, ১৯৪৭, পৃ: ৩২৭] উদাহরণস্বরূপ কুরআনে কতিপয় নীতিমালা বা কার্যাবলীর উল্লেখ রয়েছে যা একটি সমাজরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অস্তিত্বের নির্দেশ করেছে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের জন্য সংগঠিত কর্তৃত্বের উল্লেখ রয়েছে। এসবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন শব্দাবলী যেমন ‘আহাদ’ (চুক্তি), ‘আমানাহ’ (বিশ্বস্ততা), ‘ইতায়অহ’ (আনুগত্য) এবং ‘হুকুম’ (কানুন বা বিচার)।–[ এই ধারণাগুলি মনষুর উদ্দীন আহমেদ প্রণীত ‘Islamic Political System in the Modern Age: Theory and Practice’ গ্রন্থে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে (করাচী: সাদ, ১৯৮৩), পৃ: ২৭-৪৩] যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপনের জন্য রয়েছে সাধারণ আইন বা নির্দেশনা। এসব আইন বা নির্দেশনার লক্ষ্য হচ্ছে অন্যান্য ব্যবস্থা হতে ভিন্ন বিশেষগুণে গুণান্বিত ‘ভারসাম্যমূলক ও ন্যায়পরায়ণ মুসলিম সম্প্রদায়’ গঠন, যা হচ্ছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক সমাজ। অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এমন কতিপয় বাধ্যবাধকতামূলক ধর্মীয় কার্য যথা যাকাত সংগ্রহ, দুষ্কৃতকারী ও দুর্বৃত্তদের শাস্তি প্রদান, জিহাদ সংগঠণ ইত্যাদি, যা কোন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আনুষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ ছাড়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়।
ছক ৬.১ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালা
নীতিমালা অর্থ কুরআনের প্রাসঙ্গিক আয়াত
তাওহীদ ‘আল্লাহপাকের অবিচ্ছেদ্য অবিভাজ্য ঐশ্বরিকতা ১:২;৩:১৫৪:৫:৩৮-৪০;৬:১০২,১৬৪;৭:৩,৫৪;১০:৩১;১২:৪০;১৩:৩৭;১৫:৩৬;৪২:১০;৪৮:৪;৫৭:২-৩;১১২:১-৪;
শরীয়াহ ‘পাণির প্রস্রবনের দিকের পথ’
কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী আইন ৫:৪৮;৭:১৬৩:৪২:১৩;২১:৪৫:১৮
আদালাহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ৪:৫৮; ১৩৫; ৫:৩; ৯,৪৫; ৭:২৯; ১৬,৯০,১৫২;৪২:১৫; ৫৫:৯
স্বাধীনতা (হুররিয়াহ) শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তি ও সামষ্টিক কল্যাণ লাভের জন্য ব্যক্তি ও সামষ্টিক কল্যাণ লাভের জন্য ব্যক্তি ইচ্ছার প্রবণত অনুযায়ী কাজ করার স্বাধীনতা
২:২৮৬;৪:৮০;১০:৯৯;১৮:২৯; ৭৪:৩৯,৫৬;৭৬:২৯;৮১:২৮
সমতা (মুসাওয়াহ) ব্যক্তিমানুষের স্ফুরণের জন্য সমতাভিত্তিক সুযোগ ২:৩০;৪:১;৬:১০৪,১৫১;১২:৪০
শুরা পারস্পরিক পরামর্শ ২:২৩৩;৩:১৫৯;৪২:৩৮
ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালা
ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কুরআন কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রদান করেছে (ছক: ৬.১ দ্রষ্টব্য)। প্রথম হচ্ছে তাওহীদ, যার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহর অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য ঐশ্বরিকতা। এই নীতিমালা স্বকীয় ও নিজস্ব ক্ষমতা, কাউকে কতিপয় বিষয় করা বা না করার নির্দেশ দানের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা থাকা স্বীকার করে না আদেশদানকারী সে সত্তা ‘হবস’ বর্ণিত সম্রাট বা আইনগত কাঠামোয় ‘রাষ্ট্র’ যাই হোক না কেন।
কেননা কুরআন ঘোষণা করে, ‘আদেশ দান করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর’ (৬:৫৭)। ‘কে এই মহাবিশ্বের প্রভু’ (১:১) এবং (কে) হিদায়েত প্রদান করেন’ (৮৭:৩)। আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশ মানবজাতির কাছে দু’ভাবে এসেছে: প্রথমত কুরআন, যে ঐশী গ্রন্থ হতে ইসলামের সকল নির্দেশনা ও অধ্যাদেশ সমূহ অনুসৃত। দ্বিতীয়ত: শেষ নবী (সা) এর আদর্শ জীবনাচরণ বা সুন্নাহ যা কুরআনের সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাদানকারী সূত্র। এ দু’য়ের সমন্বয়ে গঠিত শরীয়াহ যা সমল কর্তৃত্বের উৎসমূল (বিষয়টি চতুর্থ অধ্যায়ে বিষদভাবে আলোচিত হয়েছে)। এর অর্থ,কোন কর্তৃত্বের উৎসমূল (বিষয়টি চতুর্থ অধ্যায়ে বিষদভাবে আলোচিত হয়েছে।) এর অর্থ, কোন কর্তৃত্বের প্রদত্ত কোন আইন, পদ্ধতি, বিধিবিধান, সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত আইনত বাধ্যতামূলক ও বৈধভাবে জনগনের উপর প্রয়োগযোগ্য হতে পারে না যদি না তা খোদায়ী আইনের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। কুরআন সুস্পষ্টভাবে বিশ্ববাসীদের প্রতি আহবান জানায়, ‘আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তদানুযায়ী তাদের মধ্যে তোমরা বিচার কর’ (৫:৪৯) এবং কুরআন আদেশ লংঘনকারীদের খেয়ানতকারী’ ‘দুষ্কৃতিকারী’ ও ‘বিদ্রোহী’ বলে আখ্যায়িত করে নিন্দা করেছে (৫:৪৪, ৪৫, ৪৭)। শরীয়াহর পতাকা উর্ধে তুলে ধরে ইসলাম ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে নয় বরং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সরকারের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছে।
পরবর্তী নীতি হচ্ছে ‘আদালাহ’ তথা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, ‘যদি তা পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন এমন কি নিজের বিরুদ্ধেও হয়’ ৪:৫৫, ৪: ১৩৫)। বিশ্বাসীদের ন্যায়পরায়ণ হতে আদেশ করা হয়েছে, কেননা ‘ধর্মপরায়ণতার পরেই ন্যায়পরায়ণতার স্থান’ (৩৮:২৪)। নবী-রাসূলগণ আগমন করেছেন যাতে মানুষ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারে’। (৫৭:২৫)।
‘সত্য’ ও ‘আল্লাহ’র পথ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনার জন্য নবী করিম (সা) নির্দেশিত হয়েছিলেন’ (২:২৪);অধিকাংশ তাফছীরকার সত্য ও আল্লাহর পথ’ শব্দদ্বয় বলতে ন্যায়পরায়ণতা’ ও ‘সুবিচার’ বুঝিয়েছেন। কুরআনে ন্যায়বিচারের তাৎপর্য বোঝাতে বহুবিধ শব্দ যথা’ সুন্নাতুল্লাহ’ (আল্লাহর পথ বা পন্থা), ‘মিজান’ (দাড়িপাল্লা), ‘কিসত’ ও ‘আদল’ (উভয় শব্দই সুবিচার অর্থে) ব্যবহৃত হয়েছে।
ব্যক্তিমানুষ কর্তৃক সৎকাজের দায়িত্বপালন, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ; বিদ্রোহ, অবিচার, লজ্জাকর ও গর্হিত কাজ পরিহার; অসৎইচ্ছা বা বিদ্বেষের বলে অন্যের ক্ষতি করা হতে বিরত থাকা প্রভৃতি বিষয়ের উপর কুরআন বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন শুধুমাত্র, দুর্বল ও নিপীড়িতের প্রতি সুবিচারের কথাই বলেনি এবং সমাজে হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী ও সীমালংঘনকারীদের প্রতি কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। কুরআন ব্যক্তিমানুষের কাছে এমন উচ্চতর নৈতিক আদর্শ দাবী করে যে প্রয়োজনে সে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্য প্রস্তুত থাকবে। একটি ন্যায়পরায়ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থঅ হলো এমন সব ন্যায়বান ও দক্ষ সরকারী কর্মমর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয় যারা ন্যায় ও সততার সাথে জননীতি পরিচালনা এবং সকল সম্পদ ও সুযোগ ন্যায়পরায়ণতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিলি বন্টন ও বিন্যস্ত করবে।
আদালাহ হচ্ছে স্বাধীনতা ও সমতা’র দু’টি মৌলিক নীতি দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ হচ্ছে ন্যায় ও সুবিচারের এমন একটি অপরিহায্য শর্ত ও পরিবেশ যে, জনগণ স্বাধীনভাবে ঘোষণা করতে পারে এবং বিশ্বাস ও পছন্দমাফিক স্বীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।–[ আবদুলহামিদ আবু সুলায়মান ‘Crisis in the Muslim Mind’; অনুবাদ : ইউসুফ তালাল ডিলরেনযো (জারনডন, International Institute of Islamic Thought, ১৯৯৩), পৃ: ৮৯] কুরআনের বাণী ‘লা ইকরাহা ফী আদ-দ্বীন’ (২:২৫৬) যার অর্থ ‘দ্বীন-ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই’। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয়ের প্রসঙ্গেই বলা হয় নাই, বরং মানবজীবনের সকল বিষয়ের দিকে এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মানব জীবনকে জোর জবরদস্তির মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মত বিষয়কে কুরআন প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামে যে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে তা শুধু মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য নয় বরং ইসলামী রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু ও অমুসলিম সমাজের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলামী সমাজ রাষ্ট্রে অমুসলমান নাগরিকদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিজস্ব ভাষা ব্যবহার, পালন ও সংরক্ষণের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। মনে রাখতে হবে, সকল সম্প্রদায়ের জন্য এই স্বাধীনতা চূড়ান্ত নয় বরং তাদের দায়িত্ব সচেতনতা ও পরিচিতি ও মাত্রাবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীনতার অধিকার অস্বীকার যেমন চরমভ্রান্তি, তদরূপ স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতার দাবীও দায়িত্বজ্ঞানহীন।
স্বাধীনতার ধারণাটি সবার জন্য সমতার প্রস্তাবনা করে- এ স্বাধীনতা হচ্ছে অধিকার, আজাদী, সুযোগসুবিধা ও নাগরিক দায়িত্ব সচেতনতা ভিত্তিক। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা নির্বিষেশে সবার জন্য এ স্বাধীনতার দুয়ার উন্মোচিত থাকবে এবং সবাইকে তা ভোগ করার সুযোগ থাকতে হবে। একই আইনের সবাই কম সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে; বিশেষ কোন শ্রেণী বিশেষভাবে আলাদা কোন সুবিধার দাবীদার ও ভোক্তা হতে পারবে না। নৈতিক উচ্চমান ও তাকওয়া ব্যতিরেকে কুরআন কোন ব্যক্তির, জাতির উপর অন্য জাতির, কোনরূপ প্রাধান্য স্বীকার করে না (৪৯:১৩)। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আজ হতে সকল মানুষ ‘চিরুনীর দাঁতের মত সমান। এই নীতিমালাসমূহ কুরআন ও হাদীসে অতীব গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। এবং সকল সময়ে শরিয়ার অপরিবর্তনীয় নীতি হিসাবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। মোহাম্মদ আসাদের মতে, ‘কেবলমাত্র এই নীতিমালার আলোকে ও ভিত্তিতে ইসলামী সমাজের ধারণাটি যুক্তিগ্রাহ্যতা ও তাৎপর্য খুঁজে পায়।–[ মোহাম্মদ আসাদ, ‘The Principles ofState and Government in Islam’ (জিব্রালটার, দার আল আন্দালুস, ১৯৮০) পৃ: ৩৩]
সর্বশেষ কুরআন ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিমালা হিসাবে শূরার (পারস্পরিক আলোচনা বা পরামর্শ) বিধান ঘোষণা করেছে।–[কুরআনে ‘শুরা’ শব্দটি ৩ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে (২:২৩৩; ৩:১৫৯; ৪২:৩৮)।
ধাতুরূপ ‘শাওয়ারা’ বা ‘শউইর’ অর্থ- আলাপ করা, পরামর্শ দেয়া এবং এভাবে ‘শুরা’র অর্থ আলাপ আলোচনা। আল তাবারী ও আল কুরতুবী উভয়েই একমত পোষণ করেছেন যে, আলাপ আলোচনা ও পরামর্শের বিধান আল্লাহর পক্ষ হতে একটি অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ এবং ‘যে সব বিষয়ে কোন ঐশী প্রত্যাদেশ নেই, সে সব ক্ষেত্রে আলাপ আলোচনা করা অপরিহার্য। দ্রষ্টব্য আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে আহমদ কুরতুবী, ‘Al Jami li-Ahkam al-Quran’ (বৈরুত, Dar Ihya al-Turath al Arabi, 1958) ভলিউম-২; পার্ট-৪ পৃ: ২৪৯ এবং আল-তাবারী ভলিউম: ৩-৪, পৃ: ১০০
উল্লেখ্য নবী করিম (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদার সময় ‘শুরা’ প্রচলিত ছিল এবং এই সময়কালকেই আদর্শ সময়কাল হিসাবে ধরতে হবে। ইসলামের পরবর্তী ইতিহাসের ‘শুরা’ তার মৌলিক রূপ হারিয়ে ফেলে। তবে বর্তমানে বিষয়টি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তবে এর তেমন কোন প্রয়োগ হচ্ছে না।] কুরআন মহানবী (সা) কে ‘জনগণের বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা বা পরামর্শের’ নির্দেশ দিয়েছে (৩:১৫৯) এবং ঈমানদার হিসাবে তাদের উল্লেখ করেছে যারা ‘নিজেদের বিষয় পারস্পরিক আলোচনার’ মাধ্যমে নিষ্পন্ন করে। (৪২:৩৮)। আবদুল ওয়াহিদ আল সুলায়মান শুরা ব্যবস্থার ব্যাখ্যায় বলেন:
(শুরা) ঐ পদ্ধতি যাতে মুসলমানগণ পরস্পর বসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গসমূহ আলোচনা করে এবং ন্যায়বিচারের দার্শনিক ধারণার আলোকে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূঞ বাধ্যতামূলকভাব পালনীয় করে নেয়। যদি বিষয়টি ন্যায় বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয় বরং দুটি সমভাবে গ্রহণযোগ্য বিষয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নেবার বিষয় হয় তবে সংখ্যালঘিষ্টদের মতামতকেও বিবেচনায় রেখে ভোটাভুটির পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। একই পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে যদি কোন সর্ববাদিসম্মত পূর্ব নজীর ভিত্তিক সিদ্ধান্ত না থাকে এবং এরূপ ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এরূপ ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে প্রত্যেককে তার মতামত প্রকাশ করতে দিতে হবে এবং প্রাসঙ্গিক নজীরসহ বিবেচনায় রাখতে হবে।–[ আবদুলহামিদ আবু সোলায়মান, ‘Islamization of knowledge with Special Reference to Political Science’, American Journal of Islamic Social Science, ভলিউম- ২, সংখ্যা-২; ১৯৮৫, পৃ: ২৮৫]
নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায়ের নির্দেশের সমগুরুত্বে কুরআনে শূরা’র প্রসঙ্গ ব্যক্কত হয়েছে। কুরআন ও হাদীসের বাণী ও প্রসঙ্গের প্রেক্ষাপটে শূরা’র অর্থ হচ্ছে জনসাধারণের নিজস্ব বিষয়াদি পরিচালনা ও নিষ্পত্তির জন্য নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করা। এতে এই জ্ঞান ও বিজ্ঞতাই ব্যক্ত হয়েছে যে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর নিষ্পত্তি শরীয়ার নির্দেশনার সীমারেখায় রেখে জনগণের সম্মিলিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উপর ছেড়ে দেয়া সমীচীন। ধারণাটি হচ্ছে যদি প্রত্যেক ব্যক্তিকে আইনের মূলভাব অনুধাবন করে নিজের মতামত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা দেয়া হয় তবে সবার সুচিন্তিত অভিমত সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করবে। শুরা শুধুমাত্র জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে না একই সাথে তা স্বৈরাচারী শাসন প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসাবে কাজ করে। তবে শুরা ব্যবস্থা কার্যকরীভাবে কাজ করে কেবল মাত্র যদি স্বাধীনতা ও সমতার দু’টি মৌলিক নীতি সঠিকভাবে পালন করা হয়।–[ Ahmet Davutoglu, ‘Alternative Paradigms’ পৃ: ১৩২] তাই দেখা যাচ্ছে, ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, সরকার শুধুমাত্র আইনের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করবে না, একই সাথে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা অনুসারে সিদ্ধান্ত সমূঞ গ্রহণও বাস্তবায়িত করবে। তাই ইকবালের ভাষায় এটা বলা যুক্তিযুক্ত যে, ইসলামী রাজনৈতিক ব্যভস্থঅ সময়-কালের প্রেক্ষপটে তাওহীদ, আদল, সমতা, শুরা ও স্বাধীনতার ধারণা সমূহকে একটি সুনির্দিষ্ট মানব সংগঠনের মাধ্যমে রূপদাদের প্রচেষ্টা।–[ মোহাম্মদ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious in Islam (লাহোর: মোহাম্মদ আশরাফ, ১৯৭১), পৃ: ১৫৫।]
মহানবী (সা) সময়কালের ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা
কুরআনে যে সমাজ ব্যবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে নবী মোহাম্মদ (সা) এর পরিচালনা ও নির্দেশনায় সে সমাজ ব্যবস্থার মর্মবস্তু ও গঠন প্রকৃতিতে মদীনায় বাস্তবরূপ লাভ করেছিল। মদীনায় হিজরত কালে কুরআনের যে পনেরটি আয়াত নাজিল হয়েছিল (১৭:২৩-৩৭) তাতে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের ‘নির্দেশনামূলক রূপরেখা ও নীতিমালা’ বর্ণিত হয়েছিল।
মদীনায় আগমনের কয়েক মাসের মধ্যে মহানবী (সা) পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান রচনা করেন,যা প্রারম্ভিক মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।–[ মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ, ‘The First Written Constitution in the World’ (লাহোর, আশরাফ, ১৯৭৫)।] উম্মতের ইসলামী ধারণা অনুযায়ী মদীনার রাজনৈতিক জীবনকে তা পুনর্গঠিত করে (ধারা ২); নবী করিম (সা) কে এই নব্য কমনওয়েলথের প্রধান হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে (ধারা: ২৩,৪২); শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা, বিবাধমান দলের মধ্যে আপোষ মিমাংসা ও বহিঃশক্তির আক্রমণ হতে প্রতিরক্ষার ব্যবস্তা করা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর ভূমিকাকে সুনির্দিষ্ট করে দেয় (ধারা ৩৭, ৩৯, ৪৪)। এ মহান দলিল সমতা ও সাম্যের নীতি, স্বৈরশাসনের প্রত্যাখ্যান ও আইনের নিরিখে দুর্বলতম বিশ্বাসী নাগরিকেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করে (ধারা ১৫,১৭)। এ রাজনৈতিক ব্যবস্থঅয় ইহুদীদের তাদের ধর্মীয় স্বাধীনাত ও অধিকারসহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক বৈষয়িক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকারসহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক বৈষয়িক ও ধর্মীয় প্রধান হিসাবে মহানবী (সা) এ নবীন রাষ্ট্রের সামাজিক সম্পর্ক তত্ত্বাবধান করতেন, কুরআনের আলোকে আইন রচনা ও প্রয়োগ করতেন,সেনাবাহিনী গঠণ এবং তার অধিনায়কত্ব করতেন।–[ রাসূলুল্লাহ (সা) ২৫ বার সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেছিলেন, যার মধ্যে ৯ বার যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। দ্রষ্টব্য মাওলানা গওহর রহমান, ‘Islami Siyasat’ (লাহোর: আল মানার বুক সেন্টার, ১৯৮২), পৃ: ১৮৯-৯৩।] যখন সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে তখন সাহাবাদের সাথে পরামর্শক্রমে তিনি ঐসব ভূখণ্ডের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। বস্তুত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেসব বিষয়ে কোন ঐশী প্রত্যাদেশ ছিলনা, ঐগুলি তিনি সাহাবাদের সাথে পরামর্শক্রমে নিষ্পত্তি করেন। কখনো কখনো তিনি জনগণকে জমায়েত করতেন, বিবেচ্য বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করতেন এবং পরামর্শ সভা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতো তদানুযায়ী কার্য করতেন, যার অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরন হচ্ছে হিজরী ৩ সাল/৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ওহুদ যুদ্ধের সময়খার বিখ্যাত পরামর্শ।
কতিপয় দিক থেকে মদিনার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এ ব্যবস্থার সদস্যপদ নির্ণীত হতো ঈমান বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে, যাতে সকল বিশ্বাসীগণই ছিলেন পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ এবং এ প্রেক্ষাপটে আল্লাহর রাহে তাঁরা একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রাতৃসমাজ গড়ে তুলেছিলেন।
একতার ছায়াতলে সকল মানুষ ছিল বিভেদহীনভাবে সমান, শুধুমাত্র তাকওয়া ঐশী গুণ ছাড়া (অর্থাৎ ধর্মপরায়ণতা, খোদাভীতি ও শুভবোধ)। এ ধরনের পরস্পর সম্পর্ক কাঠামোর মধ্যে কোনরূপ শ্রেণী সংগ্রামের অবকাশ ছিলনা; কারণ মানুষের বিশ্বাসে এ বোধ কাজ করত যে, সবাই আল্লাহর গোলাম এবং একমাত্র তিনিই সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে, এবং তার জীবনের লক্ষ্য হলো শরীয়ার বাস্তবায়ন। আল্লাহর খলীফা হিসাবে ব্যক্তি মানুষের সম্পাদনের জন্য কর্তব্য কর্ম রয়েছে, পরিপূরণের জন্য অঙ্গীকার রয়েছে এবং তাকে কঠোর নিষ্ঠার সাথে সুউচ্চ ও সমুন্নত পরম আদর্শের দিকে ধাবিত হতে হয়। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে, মদীনার রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যঘণ জন-বিষয়াবলীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। কুরআনের নির্দেশনা ও উম্মতের সাথে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্তাবলী গৃহীত হতো। ১০ বৎসর পরিসীমার নির্দেশনা ও উম্মাহ এমন একটি সরকার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে, যার সম্ভাবনা ছিল গভীর ও সুবিশাল।
খোলাফা রাশেদা
মহানবী (সা) এর তিরোধানের পর উত্তরাধিকার প্রশ্নে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামী চেতনা ও আদর্শের আলোকে ও উম্মতের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার নিরিখে তা নিষ্পন্ন হয়েছিল। উত্তরাধিকার মনোনয়নে তারা দু’স্তর বিশিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করেন। ১. পরামর্শ, মনোনয়ন ও উম্মতের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক নির্বাচন (আল বায়াতে আল খাস), এবং ২. পরবর্তীতে আল বায়াত আল-আম বা সর্বসাধারণ কর্তৃক সমর্থনের মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ। প্রথম খলিফা আবু বকর খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক নির্বাচিন হয়েছিলেন এবং হিজরী ১১সন/৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে জনসাধারণ কর্তৃক বায়াতের মাধ্যমে এ নির্বাচন নিশ্চিত করা হয়েছিল। উম্মতের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনাক্রমে প্রথম খলিফা,ওমরকে দ্বিতীয় খলিফা হিসাবে মনোনিত করেন এবং হিজরী ১৩ সন/৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে সর্বসাধারণ কর্তৃক তা সমর্থন লাভ করে। একটি নির্বাচন মন্ডলী কর্তৃক তৃতীয় খলিফা ওসমান মনোনিত হন এবং পরবর্তীতে হিজরী ২৩ সন/৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তা সর্বসাধারণের দ্বারা সমর্থিত হয়। তৃতীয় খলিফা হত্যা এবং উদ্ভুত বিশৃংখল পরিস্তিতি,উম্মতের প্রতিনিধিবর্গ আলীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। আলী সাধারণ মানুষের মতামতভিত্তিক অনুমোদনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং তদনুযায়ী হিজরী ৩৫ সন/৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচিত হন।–[বিস্তৃত বিবরণের জন্য দেখুন আল তাবারী, ‘Tarikh a-Rasul wa al-Muluk’ (কায়রো: দার আল মারিফ আল ইসলামিয়া, ১৯৬২), ভলিউম ৩-৫; সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ সম্পাদনা খুরশীদ আহমদ (লাহোর, ইসলামী পাবলিকেসন্স, ১৯৬৩), পৃ: ২৪৯-৫২।] উত্তরাধিকার নির্বাচনের এই পদ্ধতিসমূহ ছিল কুরআনের অন্তর্নিতিহ অর্থ ও তাৎপর্যমন্ডিত শুরা’র নীতিমালা দ্বারা উজ্জীবিত। এভাবে এ পদ্ধতিসমূহ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে এবং মৌলিক সূত্র ও নীতিমালা হিসাবে বিরাজ করছে।
একথা নিশ্চিত যে খলীফা নবী নন এবং তাঁরা তদরূপ কোন আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় প্রাধান্য বা অধিকার ভোগ করেন না। তিনি ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ধর্মের মূলতত্ত্ব তুলে ধরার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং শরীয়ার আওতায় উম্মতের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের কার্য আঞ্জাম দেয়ার জন্য দায়িত্বশীল। খলীফার আনুগত্য করা আল্লাহ ও নবী করিম (সা) এর অনুবর্তিতা করার শর্তাধীন। আবু বকর তাঁর অভিষেক ভাষণে বর্ণনা করেছেন, যদি খলিফা শরীয়ার সীমারেখা হতে সরে পড়েন, তবে তিনি আনুগত্যলাভের অধিকার হারিয়ে ফেলেন। এর তাৎপর্য হচ্ছে উম্মাহ সকল কাজে খলীফাকে সহায়তা করবে ও পথ দেখাবে, তিনি ইসলামী নীতিমালা হতে বিচ্যুত হয়ে পড়েছেন কিনা তা লক্ষ্য রাখবে, যদি তিনি ‘বিপথগামী’ হয়ে পড়েন তবে তাকে সংশোধণ করবে এবং সুপরামর্শের মধ্যদিয়ে তাকে কার্যসম্পাদনের সাহায্য করবে।–[ ইবিস ইউসুফ সম্পাদিত, ‘Nusus al-Fikr al-Siyasi al Islami’ গ্রন্থে আল বাকিলানী ও আল তৌহিদ-কে উদ্ধৃত করা হয়েছে (বৈরুত, হায়াত প্রেস, ১৯৬৬ পৃ: ৫৬। আরো দ্রষ্টব্য তাকী আল দ্বীন ইবনে তাইমিয়া, ‘al-Siyasah al-Shariyah fi Islah al Ra’y wa ra’iyah (মিশর, দারুল কিতাব আল আরাবী)]
খোলাফায়ে রাশেদার কাল ছিল আদর্শ ও বাস্তবতার সামঞ্জশীলতার মূর্ত প্রতীক। খলিফা কুরআন ও হাদীসের অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলতেন এবং জনগণের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রীয় কার্যাদি পরিচালনা করতেন। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই জনগণের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হত না। [২৬নং টীকাটি নেই……………]
শুরা ব্যবস্থা ছিল শরীয়াহর অন্তর্নিহিত মর্ম অনুযায়ী জনগণের অধিকার, খলিফা কর্তৃক প্রদতত্ কনো দানদক্ষিণা বা আনুকুল্য নয়। ইসলামী সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে খলিফাকে শরীয়াহর বিধান অনেক সময় ইজতিহাদের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হতো, কিন্তু তা সব সময় সুনির্দিষ্ট নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং শুরা’র পরামর্শক মণ্ডলীর সদস্যরদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই করা হতো।–[দু’টি ক্ষেত্রে (উসামা’র অভিযান এবং রিদ্দা বা ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) আবু বকর পরামর্শদাতাদের সর্বসম্মত মতকে অগ্রাহ্য করেছিলেন (মওদুদী, The Islamic Law and Constitution, পৃ: ২৪৬)। উসামা’র অভিযানের ক্ষেত্রের ব্যাখ্যা হলো যেখানে কুরআন ও সুন্নায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেখানে পরামর্শ বা আলাপ আলোচনার প্রয়োজন নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই উসামাকে সেনাপতি নিযুক্ত করে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; আবু বকর শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ’র নির্দেশ মোতাবেক উসামার অভিযানে যাত্রা করার আদেশ বাস্তবায়ন করেছিলেন। আবু বকরের নিজের ভাষায় ‘রাসূলুল্লাহ যে পতাকাকে তুলে ধরেছিলেন, তা গুটিয়ে নেবার’ অধিকার তাঁর নেই, এবং আল্লাহর রাসূল যাকে দিয়েছিলেন তাঁকে (উসামা) পদচ্যুত করার ক্ষমতাও তার নেই। (ডঃ মজিদ আলী খান, ‘The Pious Caliphs’; লন্ডন: দিওয়ান প্রেস, পৃ: ৩২-৩)। জাকাত প্রদানে অস্বীকারকারী ও ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আবু বকর ‘শুরা’র পরামর্শকে অগ্রাহ্য করেননি। তিনি ওমরসহ শুরার সদস্যদের আসনে বলিষ্ঠভাবে এ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে তাদের হৃদয় জয় করে নেন। (মোহাম্মদ এস.এল আওয়া, ‘On the Political System of the Islamic State’, ইন্ডিয়ানা, আমেরিকান ট্রাষ্ট পাবলিকেসন্স, ১৯৮০, পৃ: ৫)।] এ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খলিফা আইনের শাসন নিশ্চিত করেন, পৃথক আইন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন ও শাকস-শাসিত নির্বিশেষে বিচার পদ্ধতির বিধিমালা প্রণয়ন করেন। সংক্ষেপে ন্যায়পরায়ণ খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ছিল:
আইনের শাসনের ভিত্তিতে (রাজনৈতিক গণতন্ত্র ও শরিয়ার নির্দেশমালা) একটি নির্বাচিত শাসনতান্ত্রিক ও জনগণতান্ত্রিক সরকার, আর্থ-সামাজিক নায় বিচারভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ (আর্থ-সামাজিক গণতন্ত্র); এবং সর্বোচ্চ উচ্চাদর্শ ভিত্তিক শরীয়াহর শাসন যা শাসকবর্গকে জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে স্পৃক্ত রেখেছিল (নৈতিক গণতন্ত্র)।–[ এস. ওয়াকার আহমাদ হোসাইনী, ‘Principles of Environmental Engineering System Planning in Islamic Culture (পি.এইচ.ডি থিসিস, ফ্যাকাল্টি অব ইঞ্জিরিয়ারিং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ১৯৭১) পৃ: ১৩৮।] মদীনায় নবী করিম (সা) এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী খোলাফায়ে রাশেদার সময়কালকে সময়ের মানদণ্ডে বিবেচনা করা হয় যে:
খোলাফায়ের রাশেদীনের যুগ, ইতিহাসে ইসলামী সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের যুগ হিসাবে চিহ্নিত। সে যুগের অর্জনগুলি ছিলো সকল অঙ্গনে, সকল ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ। সর্বযুগের মুসলশানগণ দিকনির্দেশনা, উৎসধারা ও উৎসাহ উদ্দীপনার জন্য যেসব কীর্তির দিকে মুখ ফেরায়।–[ আবদুল হামিদ আবু সোলাইমান, ‘The Ummah and Its Civilizational Crisis’ আই.আর আল ফারুকী ও এ.ও. নাফিস সম্পাদিত ‘Social and Natural Sciences’ (জেদ্দা;কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, ১৯৮১) পৃ: ১০৩।]
উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা
ইবনে খালদুনের ব্যাখ্যানুসারে সাম্রাজ্য প্রসারের সাথে সাথে আরবদের গোষ্ঠী অনুভূতি রাজকীয় কর্তৃত্বের চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে। ধর্মের লাগমের শক্তি হ্রাস পায়।–[ ইবনে খালদুন, ‘The Muqaddimah An Introduction to History; সম্পাদনা: এন.জে.দাউদ (প্রিন্সটন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮১) পৃ: ১৬৬] খিলাফত রাজত্বতন্ত্র বা রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ায় ‘সিয়াসাহ দীনিয়াহ’ রূপান্তরিত হয় ‘সিয়াসাহ আকরিয়াহ’ এর পর্যায়ে, ‘আসাবিয়াহ’ তত্ত্ব যাতে সমর্থন যোগায়। উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (হিজরী ৪১-১৪২সন/৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) উত্তরাধিকার হিসাবে তার পুত্র ইয়াজিদের পদায়নের মাধ্যমে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। হাসান আল বাসরীরর মতে এ মনোনয়ন উম্মাহর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের উপর একটি সুগভীর দুর্নীতিপরায়ণ প্রভাব বিস্তার করে।–[ জালাল আল দ্বীন আবদ আল-রাহমান ইবনে আবু বরক আল সায়ুতী ‘Tarikh al-Khulafa (বৈরুত, দার আল তাকাফাহ) পৃ: ২২৪।] একটি সাম্যতাভিত্তিক সমাজের প্রধান হিসাবে ধর্মপ্রাণ নির্বাচিত খলিফার স্থান দখল করে নেয় সাম্রাজ্যের মালিক হিসাবে বংশানুক্রমিক খলিফা, যিনি চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার অধিকারী হন। শুরা’র নীতিমালা দুমড়ে মুচড়ে ফেলা হয় এবং একটি আরব যোদ্ধা অভিজাততন্ত্র উমাইয়া খিলাফতের স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের দায়িত্ব গ্রহণ করে। রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধনাম কেন্দ্রীয়করণ ও সামরিকীকরণ স্বৈরতান্ত্রিক ও এককেন্দ্রীক সরকারের জন্ম দেয়।–[ John L. Esposito, ‘Islam and Politics’ (নিউইয়র্ক: Syrcunse University Press, 1991), পৃ: ১৪-১৫]
আব্বাসীয় আমলে (হিজরী ১৩২-৬৪৬ সন/৭৫০-১২৫৮খ্রিষ্টাব্দে) প্রাতিষ্টানিক খিলাফতের মহিমা ও মর্যাদা আরো ক্ষুণ্ণ হয়। আব্বাসীয় খলিফাদের আনুকূল্যে জাঁকজমকপূর্ণ সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও, এ শাসনকাল ছিল বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ভিত্তিক খলিফা নির্বাচন, আড়ম্বরপূর্ণ দরবারী আনুষ্ঠানিক, অতিরিক্তভাবে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক সংগঠনের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া হতে এটলাণ্টিক পর্যন্ত বিশাল বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড শাসন প্রভৃতি দ্বারা বিচ্যুতিপূর্ণ। দশক শতকের মধ্যভাগ হতে রানৈতিক বিভক্তি ও ভঙ্গুরতা, খিলাফতের শক্তির ক্ষয়িষ্ণুতার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সেনাধ্যক্ষরা আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল সমূহের স্বাধীন শাসকরূপে আবির্ভুত হতে থাকে। খলিফাদের কার্যকর ক্ষমতা হ্রাসের সাথে সাথে, সামরিক কমান্ডারগণ নিজস্ব অঞ্চলের বাস্তব শাসক হিসাবে সুলনাত রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। সর্বশেষে হিজরী ৬৫৬ সন/১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খানের নেতৃত্বে মাঙ্গোলরা আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদ অবরোধ করে এবং তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।
আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের ফলে একটি বিশ্বজনীন খিলাফতের অধীনে শাসিত উম্মতের ঐক্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়ে। খিলাফতের রাজনৈতিক ঐক্যের স্থলে বিশাল বিশাল অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য মুসলিম সালতানাতের জন্ম হয়।–[ John L. Esposito, ‘Islam and Politics’ (নিউইয়র্ক: Syrcunse University Press, 1991), পৃ: ২৫।] ষোড়শ শতকের মধ্যে তিনটি প্রধান সালতানাত আত্মপ্রকাশ করে; পূর্ব ইউরোপ ও নিকটপ্রাচ্যে অটোম্যান, পারস্যে সাফাভী এবং পাকভারত মোগল সালতানাত। এসব সালতানাত সমূহকে আঞ্চলিক ও স্থানীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয় তবে সামগ্রিকভাবে ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে শাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। অমুসলিম প্রজাদের প্রতি সহনশীলতা এবং সকলের প্রতি ন্যায়ানুগ ও ক্ষমতাভিত্তিক ইসলামী আচরণ এ সালতানাত সমূহের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যরূপে বিবেচিত।–[ Marshall G.S. Hodgson ‘The Venture of Islam’ (শিকাগো, ইউনিভার্সিটি শিকাগো প্রেস, ১৯৭৪), ভলিউম-৩; পৃ: ১৪-১৫]
তিনটি মুসলিম সালতানাতের মধ্যে মুসলিববিশ্বেস সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিশ্চিতভাবে দীর্ঘস্থায়ী ছিল অটোম্যান সালতানাত। অটোম্যান বুদ্ধিজীবীদের মতে অটোম্যান সুলতানদের অবস্থান ছিল খলিফার মত, তাঁরা ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমান্ত প্রসারে অন্যদের চেয়ে বেশী সচেষ্ট ছিলেন এবং তারা শরীয়াহকে মান্য ও উলেমাদের সম্মান করতেন।–[ I Metin Kunt ‘The Later Muslim Rmpires’; Marjorie Kelly সম্পাদিত, ‘Islam: The Religions and Political life of a World Community’ (নিউইয়র্ক, প্রেগার, ১৯৮৪) পৃ: ১২৭।] অটোম্যান খলিফাগন শরীয়াহর অভিভাবক ও ইসলামী ঈমান আকিদার সংরক্ষণকারীর ভূমিকা পালন করতেন। তদসত্ত্বেও অটোম্যান খিলাফতের সাথে ইবনে খালদুন বর্ণিত ‘মুলক’ এর অধিক সাদৃশ্য ছিল, যা ছিল শরীয়াহর সাথে সুলতানদের ধর্মনিরপেক্ষধরনের কানুন ও ফরমানের সংমিশ্রণ। অটোম্যান আইন ছিল শরিয়ার সাথে কানুনের (খলিফার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আদেশ) মিশ্রফল। ক্রমান্বয়ে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মদ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়েল পর তারা খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা লাভ করে। মোস্তফা কামাল (আতাতুর্ক) এর নেতৃত্বে, ১৯২২ সালে তুরস্কের জাতীয় সংসদ সুলতানাত হতে খিলাফত পৃথক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং খিলাফত ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে।–[অটোম্যান খিলাফতের বিস্তৃত বিবরণের জন্য দেখুন এলান. আর. টেলর, ‘The Islamic Question in Middle East Politics’ (বোল্ডার, ওয়েষ্টভিউ প্রেস, ১৯৮৮), পৃ: ২৩-১৫। আরো দ্রষ্টব্য হামিদ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’ (লন্ডন, ম্যাকমিলান প্রেস, ১৯৮২), পৃ: ৫২-৫] পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে খিলাফত ব্যবস্থার অবসান ঘটান হয় এবং আতাতুর্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পত্তন করেন। খিলাফতের অবসানের কারণ হিসাবে হামিদ এনায়েত ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে:
প্যান-ইসলামী ধারণার সাথে তুর্কী জাতীয়তাবাদের অসামঞ্জস্যশীলতা; জনগণের মধ্যে পশ্চিমা ধরনের আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা এবং ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতে বহুজাতিক ইসলমী দেশের সংজ্ঞা। এসব ধারণার মদ্যে সংঘাত এবং পরিশেষে বাস্তব কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে খিলাফতের অবাস্তব অস্তিত্ব খিলাফতের অবসান ঘটায়।–[ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’ পৃ: ৫৫] কতিপয় পণ্ডিতের ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ ব্যতীত বিশ্বব্যাপী খিলাফত পুনর্জাগরণের কোন শক্তিশালী উদ্যোগ কোথাও গৃহীত হয়নি। মুসলমানদের শক্তি ও সাধনার অধিকাংশ ঔপনিবেশিক শক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য হতে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টায় ব্যয়িত হয়। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অবসান এবং অসংখ্য স্বাধীন ও আধা-স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পশ্চিমা আদলে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।
বর্তমানে মুসলিম জাহানে ৫২ টি রাষ্ট্র বিদ্যমান। কিছু রাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক, অর্ধেকের বেশী দেশের (৫২টির মধ্যে ২৬টি) শাসনতন্ত্র ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ঘোষণা করেছে (পরিশিষ্ট-সি দেখুন।)। তদসত্ত্বেও কোনদেশেই শরীয়াহকে কোন দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বাঙ্গীন আইন হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি।
প্রথম যুগের মুসলিম চিন্তাবিদ ও আইনজ্ঞগণ
উপরের আলোচনা হতে এটা প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী (সা) এবং চার খলিফার সময়কার মদীনায় আদর্শ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হতে পরবর্তীকালে শান পদ্ধতি অনেকদূরে সরে গিয়েছিল এবং ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। খিলাফতকে কেন্দ্র করে বিচ্যুতি ও বিতর্ক মুসলিম আইনজ্ঞ ও চিন্তাবিদদের লিখনীতে স্থান পেয়েছে। বিচ্যুতি ও পাথ্যর্ক সমূহকে বড় করে দেখাতে গিয়ে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা অনেক সময় বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগে মুসলমান চিন্তাবিদগণ মুসলিম শাসন পদ্ধতির যে সাধারণ ঐক্যভিত্তি অবলোকন করেছেন তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মুসলিম পণ্ডিতগণ নিশ্চিতভাবে দেখিয়েছেন যে, মদীনার মডেলটি ছিল সর্বোচ্চ আদর্শস্থানীয়; ইসলামী রাজনৈতিক কর্তৃত্বের লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণভাবে ইসলামের সংরক্ষণ ও শরিয়াহর বাস্তবায়ন, যা ‘আদল’ ও ‘শুরা’র ভিত্তিতে সংস্থাপিত; রাজনীতিকে কখনো নৈতিককা হতে উদ্ভুত প্রয়োজনীয় বর্ধিত অংশ বলে মনে করতেন।–[ এনায়েত, ‘Modern Islamic Political Thought’ পৃ: ২-৪]
ঐতিহাসিকভাবে মহানবী (সা) এর তিরোধানের পর ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থঅর একমাত্র রূপ ছিল খিলাফত। মুসলিম চিন্তাবিদগণ তাই খিলাফতের ধারণার উৎস, খলিফার গুণাবলী, নির্বাচনের প্রকৃতি ও পদ্ধতি এবং সরকারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইত্যাদির উপর বিস্তারিত তাত্ত্বিক দর্শন ও পর্যালোচনা গড়ে তোলেন। ইমামত বা খিলাফতের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে শিয়া, খারেজী ও অধিকাংশ মুতাজিলাপন্থীসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ চিন্তাবিদগণ মনে করেন যে, ইমামত হচ্ছে অপরিহার্য কেননা এর সাথে ঐশী বিধান সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী জড়িত। তারা অবশ্য এ প্রয়োজনীয়তার কারণ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে আল আশারী, আল বাগদাদী (মৃত্যু হিজরী ৪২৯ সন/১০৩৭ খ্রি.), আবু আল হাসান মাওয়ার্দী (হিজরী ৪৫০-৫০৫সন/১০৫৮-১১১১ খ্রি.) মনে করেন যে, ইমামত কার্যকারণ দ্বারা নয় বরং ঐশী প্রয়োজনীয়তা দ্বারা চিহ্নিত ও প্রয়োজনীয়।–[ আবদ আল কাদির আল বাগদাদী, (বৈরুত: al-Farqbayn al-Firaq দার আর ফিকর, ১৯৭৩); আবু হাসান আলী ইবনে মোহাম্মদ আল মাওয়ার্দী, ‘al-Ahkam al-Sultaniyah’ (কায়রো, হালাবী, ১৯৭৩)] পক্ষান্তরে মুতাজিলা পন্থীরা মনে করেন যে, ঐশী প্রত্যাদেশ নয় বরং যৌক্তিক কারণ দ্বারা ইমামতের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত ও স্বীকৃত। ইবনে তাইমিয়া অবশ্য মনে করেন যে, মানুষের বিষয়াবলীর পরিচালনা ও নিষ্পত্তির প্রয়োজনে যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তার দাবী ঐশী প্রত্যাদেশের দাবীর চেয়ে কম নয়। এর সাথে যোগ করেছেন যে, মানুষের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত প্রবণতা রয়েছে, যা সাধারণ কল্যাণ ও সুখের জন্য পরস্পরের সাথে সহযোগীতার জন্য তাকে অনুপ্রাণিত উদ্ধুদ্ধ করে। একটি সামাজিন শৃঙ্খলাময় ব্যবস্থা ব্যতিরেকে এই সাধারণ কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব নয় এবং সেদিকে ধাবিত করার জন্য কিছু কর্তৃত্বের প্রয়োজন।–[ দেখুন ইবনে তাইমিয়া, ‘Al-Siyasah al-Shariyah’] ইবনে খালদুন কর্তৃক এ সমাজতাত্ত্বিক যুক্তি পরম্পরা বিষদভাবে আলোচিত হয়েছে।
মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও আইনবিশারদগণ তাদের তাত্ত্বিক পর্যালোচনা এ ধরনের উপর আরম্ভ করেন যে, ইসলমী সরকার শরিয়ার উপর ভিত্তিশীল, যা ধর্ম ও জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনের মধ্যে কোনরূপ আলাদা দেয়াল গড়ে তোলেন এবং জীবনের এমন কোন কার্যাবলী ও দিক নেই যাকে শরীয়ার সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করেনি। এই শরীয়া আইনের পরিসীমার মধ্যে রাজনৈতিক কর্তৃক এবং তার অন্তর্গঠনশৈলী সংজ্ঞায়িত।
রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী সমাজব্যবস্থঅ বা উম্মাহ।–[ উম্মাহ এর বিস্তৃত বিবরণের জন্য অধ্যায়- ৫ দ্রষ্টব্য।] শাসনকর্তা, যাদের প্রাথমিক ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানে খলিফা, ইমাম বা আমীর হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে তারা কেউ সার্বভৌম সম্রাট ধরনের কোন কর্তৃপক্ষ ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন Primusinter-Pares তথা সমদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিত্ব। উম্মতের মধ্যে শাসক ও শাসিতের অবস্থান একই কাতারের। তাদের মধ্যে তাকওয়া ভিন্ন অন্তর্নিহিত মর্যাদার কোন পার্থক্য নেই, যা রয়েছে তা হচ্ছে বিশেষ ভুমিকা পালনের। ইমাম শরীয়ার বিধান অনুযায়ী প্রশাসন কার্য পরিচালনা করবেন, যার ব্যত্যয় ঘটলে উম্মতের উপর তাঁর প্রতি আনুগত্যের আর কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না।–[ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার উপর আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য অধ্যায় -৭]
ইসলামী সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও বিশদভাবে বর্ণিত আছে: তা হচ্ছে ইসলামের পরিপূর্ণ সংরক্ষণ ও ঐসব শর্তাবলী পূরণ ও বজায় রাখা যাতে একজন ঈমানদার মানুষ নির্বিঘ্নে তার ঐশী নির্দেশিত তাকওয়ার জীবন যাপনে অগ্রসর হতে পারে। নবুয়তের কার্যাবলী উত্তরাধিকার হিসাবে অব্যাহত রাখা এবং ‘ঈমান-আকিদা সংরক্ষণ ও মানুষের দুনিয়াবী কার্যাবলী সুচারুভাবে পরিচালনা করা’। ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হিসাবে আল-মাওয়ার্দী অভিমত ব্যক্ত করেছেন।–[ আল মাওয়ার্দী, ‘al-Ahkam al-Sultaniyah’ পৃ: ৬। আরো দ্রষ্টব্য ই.আ জে রজনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’ পৃ: ২৮] ইবনে তাইমিয়া আরে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ইসলামী রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম যে ধর্ম ও জীবন বিধান হিসাবে জীবনের সকল স্তর ও মানবতার সর্বমাত্রায় বিস্তৃত এবং ‘আল্লাহর আদেশ-নিষেধই যে চূড়ান্ত’ তা সুনিশ্চিত করা। ইবনে খালদুন আল-মাওয়ার্দীর ‘জাগতিক বিষয় পরিচালনা’ ও ইবনে তাইমিয়ার ‘আল্লাহর আদেশ নিষেধই চূড়ান্ত’ এ দু’টি বক্তব্যকে এভাবে সমন্বিত করেছেন যে শরীয়ার বিধানানুসারে সকল জাগতিক বিষয়াবলীকে ইহকালীন কল্যাণের সাথে সংযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। ইবনে খালদুন এভাবে ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জগতে কল্যাণ লাভের জন্য মানুষের শরীয়তের উদ্দেম্যের অনুসরণকারীর বিষয়টি সহজ ও বেগবান করাকে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন্
ইসলামী রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বিষয়াবলীর উপর সকল আলোচনা মূলত: প্রধাননির্বাহী কর্মকর্তা, যার হাতে সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত এবং কোন ক্ষমতাই বৈধ নয় যতক্ষণ না তিনি কোন ক্ষমতা অন্যকে অর্পণ করেন, সেই আলোচনার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, কোন গ্রহণযোগ্য কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে জনগণের বিষয়াবলী সুষ্ঠুভাবে নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই ঈমানের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য এবং যতক্ষণ তিনি শরীয়ত লংঘন না করেন ততক্ষণ তার আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক। এর সাথে একমত পোষণ করে কারণ হিসাবে গাজ্জালী ব্যাখ্যা করেন যে, ইমাম উম্মতের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে শৃংখলা রক্ষা করেন, শান্তি-শৃঙ্খলার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন এবং সর্বশেষে তাঁর সকল কর্তৃত্ব শরীয়ত হতে উৎসারিত।–[ লিওনার্ড রাইন্ডার, ‘Al-Ghazalis Theory of Government’ দি মুসলিম ওয়ার্ল্ড, ভলিউম- ৪৫, সংক্যা ৩ (১৯৫৫), পৃ: ২৩৬] তবে ইমাম কি পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন সে বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আল-মাওয়ার্দী, আবু ইয়ালা এবং আল বাগদাদী উম্মতের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ (কর্তৃক নির্বাচন) আবু বকরের খিলাফত প্রাপ্তি, খলিফ কর্তৃক পরবর্তী খলিফা মনোনয়ণ (ওমরের খিলাফত প্রাপ্তি), নির্বাচক মন্ডলী কর্তৃক মনোনয়ন (ওসমানের খিলাফত প্রাপ্তি) এবং জনগণ কর্তৃক সরাসরি নির্বাচন (আলী) ইত্যাদি উদাহরণকে ইমাম নিয়োগের বৈধ পন্থা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বদর আল-দীন ইবনে জামাহ (হিজরী ৬৩৯-৭৩৩ সন/১২৪৪-১৩৩৩খ্রিষ্টাব্দ) পরবর্তীতে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে খলিফা হওয়াকে বৈধ পন্থঅ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
যদিও খিলাফতের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে মুসলিম চিন্তাবিদগণ ঐকমত্য পোষণ করতেন, তবে তারা তাদের ব্যক্তিগত চিন্তা অনুযায়ী একাধিক ইমাম থাকার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করতেন। আল আশারীর চিন্তার বিরোধিতা করে আল-মাওয়ার্দী একাধিক ইমাম থাকার বিষয়টি অনুমোদন করেননি, সম্ভবত এ কারণে যে তার ধারণায় সম্ভবত: এটা ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে ক্ষুণ্ণ করবে। আল বাগদাদী একাধিক ইমামের ধারণাকে অনুমোদন না করলেও একই সাথে দু’জন খলিফার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন এ শর্তে যে তাদের শাসিত অঞ্চল পরস্পর বেশ দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হবে। লক্ষণীয় যে খারেজীরা কোন এক সময়ে বহুসংখ্যক ইমামের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। ইমাম তাইমিয়া তাদের সাথে একমত পোষণ করে একই সময়ে একাধিক ইমামের ধারণাকে সমর্থন করেন।
প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তাকে এমন সব গুণে গুণান্বিত হতে হবে যা তাঁর দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পাদনে সহায়ক হবে। তাই এমন কোন মুসলিম পণ্ডিত পাওয়া যাবেনা যিনি পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পাদনে সহায়ক হবে। তাই এমন কোন মুসলিম পণ্ডিত পাওয়া যাবেনা যিনি শাসনকর্তার গুণাবলীর উপর বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেননি। আল মাওয়ার্দীর মতে শাসনকর্তার নিম্নবর্ণিত থাকতে হবে যথা ন্যায়পরায়ণতা (আদালাহ), জ্ঞান (ইলম), শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা (সালামাহ), স্বচ্ছ বিচারবুদ্ধি (রে’এ), সাহস ও সুদৃঢ়তা (সুজাহ ওয়া নাজদাহ) এবং কোরাইশ বংশোদ্ভূত (নোসাব)। ইবনে খালদুন গুণাবলীকে হ্রাস করে পাঁচটি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ইলম, আদালাহ, কাফাআহ, সালামাহ ও নাসাব।–[ রজেনথাল, ‘Political Thought in Medieval Islam’, পৃ: ২৯,৪০, ২৩৬] আল গাজ্জালী কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে একই রূপ গুণাবলীর উল্লেখ করেছেন। এসব গুণাবলীর তালিকার মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও নৈতিক গুণ সুস্পষ্টভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্বের অধিকারী। এ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের উপর ম্যাকিয়াভেলী’র মত চিন্তানায়কদের প্রভূত প্রভাব বিদ্যমান। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক জমিনের উপর আল্লাহর ছায়া স্বরূপ মর্মে অনেক মুসলিম আইনজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি শরীয়াহর অনুশাসন বাস্তবায়ন করেন, জনগণের মধ্যে সাম্য বজায় রাখেন। সংক্ষেপে একজন ন্যায়পরায়ণ ইমাম এমন পরিস্থিতি সৃজন করবেন যাতে সঠিক ধর্মাচরণ ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ন্যায়পরায়ণ শাসকের আনুগত্য তাই বাধ্যতামূলক এবং তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) অনুবর্তীতার সমার্থন বিবেচনা করা হয়।
সমকালীন মুসলিম চিন্তা ও সরকারের গঠন
১৯২৪ সালে অটোম্যান খিলাফত ব্যবস্থঅর পতন ও তার পূনর্জাগরণের সম্ভাবনাহীনতা খিলাফতের প্রকৃতি ও কার্যের বিষয়ে মুসলিম পণ্ডিতবর্গের মধ্যে তুমুল বিতর্কের জন্ম দে। এ আলোচনা অনেকাংশে আব্বাসীয় আমলে যে আলোচনার সূচনা হয়েছিল তারই ধারাবাহিতকা। খিলাফতের তাত্ত্বিক আদর্শের বিষয়ে আল মাওয়ার্দী, আলল গাজ্জালী এবং আল বাকীলানী’র মত শীর্ষস্থানীয় মুসলিম চিন্তাবিদ ও আইনজ্ঞ যে ধারণা পোষণ করতেন তার সাথে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সমকালীন আলোচনা সমূহের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যতা রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে নতুন বিষয়টি যুক্ত হয়েছে তা হলো খিলাফতের ধারণার নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ এবং নয়া ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার গঠনের ক্ষেত্রে বিস্তারিত বিবরণ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া হতে শুরু করে নতুন ধারাটি হাসান আল বান্না, সাইয়িদ কুতুব, আবুল আলা মওদুদী, হাসান আল তুরাবী প্রমুখের লিখনীতে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তাদের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা বিশ্বব্যাপী মুসলিম মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এ প্রেক্ষিতে তাদের চিন্তাদর্শনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান এক্ষেত্রে প্রয়েঅজনীয় ও প্রাসঙ্গিক।
সূচনাতেই বলতে হয়, সমকালীন মুসলিম চিন্তাবিদগণ খিলাফতের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্জীবিত করা দরকার বলে মনে করেন না। তারা খোলাফায়ে রাশেদা’কে ইসলামী সমাজ ও সরকারের চনম উৎকর্ষ হিসাবে মনে করেন, যা ইবনে তাইমিয়ার মতে ইতিহাসে নতুন করে পুননির্মাণ করা সম্ভব নয়। তারা বিশ্বজনীন খিলাফত বা রাজনৈতিক বিশ্বজনীনতার কোন প্রয়োজনীয়া রয়েছে বলেও মনে করেননা। তাদের মতে যেহেতু উম্মতের ধারণা ভূ-খণ্ড ভিত্তিক নয় বরং সমগ্র বিশ্বব্যাপী, তাই বহু মুসলিম রাজনৈতিক সরকার ও ইসলামী ভূ-খণ্ডের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী ও গ্রহণযোগ্য। ইবনে তাইমিয়ার মতে তাই সমগ্র ইসলামী বিশ্বকে একটিমাত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে আনয়ন বা ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কোন আবশ্যকতা নেই। বরং ইসলামী দেশসমূহের সমবায়ে কনফেডারেশন গঠন করা যেতে পারে।–[ কমরুদ্দিন খান, ‘The Political Thought ofIbn Taymiyyah’ (ইসলামাবাদ, ইসলামিক বুক ফাউন্ডেশান, ১৯৮৩), পৃ: ১৮৪] ১৯৬৫ সালে সাইয়েদ মওদুদী একইভাবে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের আহবান জানান।–[ আবুল আলা মওদুদী, ‘Unity of the Muslim World’ (লাহোর : ইসলামী পাবলিকেসন্স, ১৯৬৭), পৃ: ১৮৪] এসব মুসলিম চিন্তাবিদদের নিকট খিলাফত হচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে, এমন একটি ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালার ভিত্তিতে মানবতার কল্যাণ সাধন। সংক্ষেপে খিলাফত হচ্ছে ইসলামী শিক্ষার আলোকে একটি সমাজ-রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা। আবদুল হামিদ আবু সুলায়মান মন্তব্য করেছেন যে:
নিজেদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক আশা আকাঙ্ক্ষা ও কল্যাণ বাস্তবায়নের জন্য উম্মাহ যে ধরনের সরকার নিজেদের জন্য পছন্দ ও বাঞ্ছনীয় মনে করবে তাকেই খিলাফত ব্যবস্থা হিসাবে মনে করতে হবে এবং সে ব্যবস্থাকেই উম্মাহর সমর্থন করা প্রয়োজন।–[ আবদুলহামিদ আবু সুলায়মান, ‘Crisis in the Muslim Mind’ পৃ: ১৩৯]
ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে খিলাফতকে অস্বীকার করা যায় না, অধিকন্তু ইহা ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থঅর মূল চিহ্ন ও তাৎপর্যবহ।
ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার গঠন
ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজস্ব আদর্শগত তাত্ত্বিক ভিত্তি ও গঠনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা স্বাতন্ত্রমণ্ডিত। পাশ্চাত্যের প্রাচ্যতত্ত্ব বিশারদগণ ‘ধর্মতন্ত্র’ (থিউক্রেসী বা এক বা একাধিক দেবতার ধারণামাত্রিক সরকার) ‘বিশ্বজনীন রাজতন্ত্র’ (এক ধরনের আইনমাত্রিক সরকার) প্রভৃতি যে সব পরিভাষা ব্যবহার করেছেন তা ইসলামী রাজনৈতিক সরকারকে চিহ্নিত করার উপযোগী পরিভাষা ব্যবহার বা প্রকৃত সংজ্ঞা নয়।–[ সি. রাইডার স্মীথ, ‘Theory’, in Encyclopedia of Religion and ethics (নিউইয়র্ক, চার্লস স্ক্রীবনার, ১৯২৪); টি. ডব্লিউ আরনল্ড, ‘The Proceeding of Islam’ (লন্ডন, কনস্ট্যাবল, ১৯৩৫)] ইসলামী রাষ্ট্রের কতিপয় চিন্তা, দর্শন ও প্রথার সাথে অনৈসলামিক রাষ্ট্রের কতিপয় বৈশিষ্ট্যের মিল খুজেঁ পাওয়া যেতে পারে, তবে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা মৌলিকভাবে, ‘… এমন বৈশিষ্ট্য ও মাত্রিকতা রয়েছে যা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব, আধুনিক পাশ্চাত্যমডেল হতে তা বিপুলাংশে পৃথক এবং কেবলমাত্র নিজস্ব প্রেক্ষাপটে ও স্বকীয় পরিভাষা দ্বারাই একে সফলভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে’।–[ আসাদ, The Principles of State and Government in Islam’, পৃ: ২১] ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা মির্নাণে সাইয়িদ আবুল আলা মওদুদীর ভাষায়, (ইহা) আল্লাহর বান্দা হিসাবে তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য সম্মিলিতভাবে কর্মরত কতিপয় মানুষের সমবায় ও প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়’।–[ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ‘The Process of Islamic Revolution’ (দিল্লী: মারকাজী মাকতাবাহ জামাতে ইসলামী, হিন্দ, (১৯৭০) পৃ: ৯] মোহাম্মদ আসাদের মতে এ ব্যবস্তা ‘জাতির জীবনে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সচেতন প্রয়োগ ও রাষ্ট্রের মৌলিক সংবিধানে ঐসব নীতি আদর্শের সুস্পষ্ট প্রতিফলন’ দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’।–[ আসাদ, The Principles of State and Government in Islam’, পৃ: ১] যেহেতু এ ব্যবস্থাটি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রয়োজন ও ইসলামী চেতনার ভিত্তিতে সংস্থাপিত তাই এর রয়েছে কতিপয় গতিশীলতা এবং … এতে বহুরকম মডেলের অবকাশ রয়েছে, যার সাথে একটি সমাজের বিকাশের স্বাভাবিক এবং সমকালীন সমাজের নতুন নতুন প্রয়োজনের বাদী মেটাবার স্থিতিস্থাপকতা ও সামঞ্জস্যশীলতা রয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসলামের সামগ্রিক ধারণা এসব মডেলগুলোর শেষ প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়’।–[সাইয়েদ কুতুব, ‘Ma’rakat al-Islam wa-al-Rasmaliyah’ (বৈরুত: দার আল শুরুক, ১৯৭৫) পৃ: ৬৬; Yvonn Y. Hadda’ Sayyed Qutb: Ideologues ofIslamic Revival; John L. Esposito সম্পাদিত ‘Voice of Resurgent Islam’ (নিউইয়র্ক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৩), পৃ: ৭১]
শাসনতান্ত্রিক সরকার
ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে মানব জীবন ও সমাজ ব্যবস্তার সকল দিক ব্যাপ্তকারী শরীয়ার নীতিমালার ভিত্তিতে স্থাপিত একটি শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা।–[ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার লিখিত সংবিধানের ধারণাটির উৎসে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রণীত মদীনার লিখিত সংবিধান। পরবর্তী মুসলিম শাসকবৃদন্দ আর লিখিত সংবিধান প্রবর্তন করেননি; তারা ফরমান, প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। সমকালীন পণ্ডিতবর্গ যথা রশীদ রিদা, মওদুদী প্রমুখ লিখিত সংবিধানের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। দ্রষ্টব্য মোহাম্মদ হাশিম কামালী ‘Characteristics of the Islamic state’ ইসলামিক স্ট্যাডিজ, ভলিউম- ৩২, সংখ্যা- ১, ১৯৯৩, পৃ: ২৬-২৭] সাইয়েদ মওদুদীর মতে নিম্নবর্ণিত বিষয় সমূহ শরীয়াহর অন্তর্ভুক্ত:
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, ব্যক্তিচরিত্র, নৈতিকতা, অভ্যাস, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদি, প্রশাসন, নাগরিকদের কর্তব্য ও অধিকার, বিচার ব্যবস্থঅ, যুদ্ধ ও শান্তির নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ পৃ: ২৬-২৭]
জাতীয় নৃতাত্ত্বিক ও সম্প্রদায়গত ভিন্নতা নির্বিশেষে ন্যায়, সমতা ও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা ও সামষ্টিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে শরীয়াহ বিশেষভাবে মুরা’র কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়। শরীয়াহ রাজনৈতিক ব্যবস্থার গঠনশৈলী ও কার্যবৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দেয়নি। শরীয়াহর এ অন্তর্নিহিত স্থিতিস্থাপনকা ও গতিশীলতা ইসলামী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক পদ্ধতি উদ্ভাববের সুযোগ রেখেছে, এ শর্তে যে গৃহীত কোন পদ্ধতি শরীয়ার অনুশাসনের মর্মবস্তুর সাথে সংঘাতপূর্ণ হবে না।–[ জাস্টিস জাভেদ ইকবাল, ‘The Concept of State in Islam’; মুমতাজ আহমেদ সম্পাদিত ‘State in Islam’,Politics and Islam (ইন্ডিয়ান পলিস, আমেরিকান ট্রাষ্ট পাবলিকেসন্স, ১৯৮৬) পৃ: ৪৭] ফলে মুসলিম পণ্ডিতগণ ঐশী ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পন্থা উদ্ভাবনে শক্তির সমন্বয়ে নীতির কথা ব্যক্ত করেছেন। মোহাম্মদ আসাদের মতে এ নীত-দর্শন ‘রাজনৈতিক তত্ত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিশেষভাবে ইসলামী মূল্যবোধ জারিত অবদান সঞ্চায়িত করেছে’।–[ আসাদ, The Principles of State and Government in Islam’, পৃ: ৫২] শক্তির সমন্বয়ে এই তত্ত্ব সরকারের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধন করেছে, কেননা এই তিনটি বিভাগের প্রশাসনিক আদেশ, নীতি নির্ধারণ ও প্রণীত বিধান হতে উদ্ভূত সমস্যা ও বিরোধের নিষ্পত্তির ক্সেত্রে সরকারের তিনটি বিভাগ পরস্পর সম্পর্কিত যৌথ কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে।
নির্বাহী বিভাগ
সরকারের নির্বাহী অঙ্গ হচ্ছে ‘কর্তৃত্বের নিউক্লিয়াস অংশ এবং সরকারের সক্রিয় শক্তি’।–[ আবদুল রহমান আবদুল কাদির কুর্দী, ‘The Islamic State: A Study based on the Islamic Holy Constitution’ লন্ডন, ম্যানমেল, ১৯৮৪) পৃ: ৯০] কুরআন ও হাদীসে একে ‘উল-আল আমর’ ও ‘উমারা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং নির্বাহী বিভাগের নেতৃত্ব করবেন ‘আমীর’ (প্রধান নেতা), যিনি সর্বাধিক, সম্মানিত’ এবং ‘সর্বাধিক ধর্মপরায়ণ’ ব্যক্তিবর্গের মধ্য হতে নির্বাচিত হবেন। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানে ৩১ জন উমেলা’ সমবায়ে অনুষ্ঠিত কনভেনশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তা হবে ‘সর্বসময়ে একজন পুরুষ,যার ধর্মপরায়ণতা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞঅন এবং স্বচ্ছ ও সঠিক বিচার ক্ষমতার বিষয়ে জনগণ বা তাদের প্রতিনিধিদের গভীর আস্থা থাকবে’।–[ মওদুদী, The Islamic Law and Constitution আরো দ্রষ্টব্য ‘Nizam-e-Hukumat ke Bara Me Ansari Kamishan Ki Report’ (ইসলামাবাদ, প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব পাকিস্তান প্রেস, ১৯৮৪), পৃ: ১৬] মোহাম্মদ আসাদ বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট যে কেবলমাত্র একজন মানুষ যিনি আইনের ঐশী উৎসে বিশ্বাসী তথা যিনি একজন মুসলিম শুধু তাঁকেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান করা যেতে পারে।–[ আসাদ, ‘The Principles of state and Government in Islam’ পৃ: ৪০] ধর্মপরায়ণতা ছাড়াও খলিফাকে প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানী ও দক্ষ প্রশাসক হতে হবে। সাইয়েদ কুতুবের ভাষায় শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন ও উম্মাহর স্বার্থসংরক্ষণে দক্ষতার উপর খলিফার গ্রহণযেগ্যতা নির্ভরশীল।–[ সাইয়েদ কুতুব, ‘Marakat al-Islam wa al-R’asmaliyah’ পৃ: ৭৩-৪] সমাজের অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তাও সমভাবে আইনের আওতার অধীন। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে, অভিযুক্ত হলে তিনি কোনরূপ বিশেষ মর্যাদা বা সুযোগ পাবেন না এবং শরীয়ার অনুশাসনের গুরুতর লংঘনের ক্ষেত্রে তাকে অপসারিত করা যাবে। ফলে দেখা যায় প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তার কার্যাবলী ও ক্ষমতাকে লাগামবদ্ধ করা হয়েছে। আমীর তার নিজস্ব কোন ক্ষমতার কারণে ঐ উচ্চ পদে আসীন নন, অথবা বিশেষ কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক থাকার কারণেও নয় বরং উম্মাহর বিবিধ বিষয়াবলীর দায়িত্ব ও শরীয়াহর সংরক্ষক ও অভিভাবক হিসাবে ঐ মর্যাদাবান আসনে আমীর সমাসীন। রাজতন্ত্র কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় কেননা ইসলামে বাদশাহীতন্ত্রের কোন স্থান নেই, বংশানুক্রমিকভাবে উত্তরাধিকার নির্বাচনেরও কোন অবকাশ নেই’।–[ গডফ্রে এইচ. জ্যানসেন, ‘Militant Islam’ (নিউইয়র্ক; হারপার এন্ড রো, ১৯৭৯), পৃ: ১৭৩] যদিও শুরার নীতিমালার মাধ্যমে পরবর্তী খলীফা বা আমীর নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, তবু নির্বাচনের পদ্ধতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতির উল্লেখ করা হয়নি। ফলে উম্মাহ নির্বাচনের পদ্ধতি উদ্ভাবনে স্বাধীন –সে নির্বাচন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, আনুপাতিক ইত্যাদি যে কোন প্রকরণের হতে পারে, তবে শর্ত থাকে যে এ পদ্ধতিসমূহ
শরীয়াহকে আক্ষরিক ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্যের সাথে পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে।
আইন বিভাগ
আমীর কাজ করবেন আইন পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে। সমকালীন পণ্ডিতগণ আইন পরিষদকে ‘শুরা’, ‘ইজতিহাদ’ ও ‘ইজমা’ এর বহিঃপ্রকাশ ও সমার্থক মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হাসান আল তুরাবী খিলাফত ব্যবস্থাকে ‘নির্বাচিত পরামর্শক সংস্থা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পরবর্তীকালে এই মহান প্রতিষ্ঠান বংশানুক্রমিক, স্বৈরাচারী বা বলপূর্বক দখলকারী রূপ পরিগ্রহ করে।–[ হাসান আল তুরাবী ‘The Islamic State’, সম্পাদনায় জন এল. এসপোসিটো ‘Voices ofResurgent Islam’ (নিউইয়র্ক, হারপার এন্ড রো, ১৯৭৯) পৃ: ১৭৩] এই পরামর্শ বা আইনসভা অবশ্যই পুনর্জীবিত করতে হবে এবং ইকবালের মত এ পরিষদের আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের (ইজতিহাদ) এখতিয়ার থাকবে, যার ভিত্তিতে উম্মতের ঐকমত্য (ইজমা) স্থাপিত হবে। শুধু এভাবেই আইন ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি সঞ্চালন করা সম্ভব হবে এবং কার্যভার ক্রিয়াশীলাবর্তিত অস্তিত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে’।–[ মোহাম্মদ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ পৃ: ২৪৩।] মুসলিম মনীষীগণ ‘আহল-আল-হাল ওয়াআল-আকদ’ ও ‘শুরা’র ভিত্তিতে আইনসভা আঙ্গিকের তাত্ত্বিক রূপদান করেছেন; এ দু’টি ধারণা অতি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী প্রতিষ্ঠান, যার প্রথমোক্তটি শেষোক্তটির চেয়ে আকৃতিতে ছোট। এ দু’টি প্রতিষ্ঠান খলিফা নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে মিলিত হয়ে যৌথভাবে কাজ করে।
অধিকাংশ পণ্ডিত অভিমত ব্যখ্ত করেছেন যে আইনসভার অধিকাংশ সদস্যকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে হবে। তবে কিছুসংখ্যক সদস্য থাকবেন যারা হবেন আধুনিক আইনশাস্ত্র বিভাগের কার্যক্রমের নীতিমালা রচনা করবে।–[ দ্রষ্টব্য কুর্দী, ‘The Islamic State’পৃ: ৯৯-৯।] আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে দু’টি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকবে; একটি হচ্ছে শরীয়াহর অনুশাসনের স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় চরিত্র এবং অন্যান্য বাকী বিষয়াবলী প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তনশীল ও স্থিতিস্থাপক। কুরআনে নির্দেশিক নীতিমালা ও মূল্যবোধ, যা ইসলামী শাসনতন্ত্রের মৌলিক উপাদান, তার চরিত্র হচ্ছে স্থায়ী; এগুলির বিষয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবেনা, বা এতে কোন রূপ পরিবর্তন আনা যাবেনা বরং হুবহু অনুসরণ করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অন্যান্য বিষয়াবলী, যে বিষয়ে কুরআন-হাদীসের কিছু বলা হয়নি, তা হলো ইসলামী শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থঅর পরিবর্তনশীল অংশ। এ অংশটির পরিধিও বিশাল, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তনযোগ্য। সংক্ষেপে আইনসভার কাজ হচ্ছে শরীয়ার সুস্পষ্ট বিধানসমূহকে আইনের রূপ দান করা এবং যেখানে কুরআন-হাদীসের কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেখানে শরীয়ার সীমারেখার মধ্যে ন্যায়, সমতা ও বিচার বুদ্ধির ভিত্তিতে আইন ও বিধান রচনা করা।
ইসলামে আইন পরিষদের বিষয়টি কোন কোন মহলে এ ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিয়েছে যে আইনসভার ভূমিকা শুধু মাত্র পরামর্শ প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তার তা গ্রহণ বা বর্জণ করার নিজস্ব এখতিয়ার রয়েছে। হাসান আল তুরাবী, সাইয়িদ কুতুব, আবদ আল কাদির আওদাহ (ইন্তেকাল হিজরী ১৩৫৭ সন/১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে) ও অন্যান্যদের মতে সকল জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তির জন্য শুরার পরামর্শ অনুসরণ বাধ্যতামূলক এবং এ প্রক্রিয়ার (শুরা) সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের শাসকের জন্য অবশ্য পালনীয়। এমনকি সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী যিনি আইনসভার পরামর্শমূলক ভুমিকার বিষয়ে অভিমত ব্যখ্ত করেছেন, তিনিও মন্তব্য করেছেন শুরা’র সিদ্ধান্ত অনুসরণে বর্তমানে অনীহার ভাব পরিলক্ষিত হবার ক্ষেত্রে আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত পরিপালনে নির্বাহী বিভাগের ভূমিকাকে বাধ্যতামূলক করে দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ পৃ: ২৩০।]
বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগ, যা ‘কাদা’ নামে অভিহিত, নির্বাহী বিভাগ হতে স্বাধীন এবং শরীয়াহর কঠোর অনুবর্তিতার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করা এর কাজ। উলেমা কনভেনশন তাদের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের রূপরেকা এ মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেছে যে বিচার বিভাগ হবে সকল দিক থেকে স্বাধীন যাতে নির্বাহী বিভাগের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্তভাবে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Law and Constitution’ পৃ: ৩৩৪।] পণ্ডিতবর্গ সুদৃঢ়ভাবে মন্তব্য করেছেন যে শাসক কর্তৃক বিচার পতিদের নির্বাচন দ্বারা কোনভাবে বিচার বিভাদের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। শরীয়াহর একই আইন দ্বারা নির্বাহী ও আনি বিভাগ পরিচালিত; তাই শরীয়ার বাস্তবায়নে বিচার বিভাগের অন্যকোন কর্তৃপক্ষ হতে কর্তৃত্ব লাভের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। অপরদিকে বিচার বিভাগের বিস্তারিত কার্যাবলীর পরিধি এত ব্যাপক যে সরকারের সকল অঙ্গ ও কার্যাবলী বিচার বিভাগের পরিসীমার মধ্যে পড়ে। অন্য সকল নাগরিকের মত প্রধান নির্বাহী শাসনকর্তা বা সরকার প্রধানকেও বাদী বা বিবাদী হিসাবে আদালতের আদেশ বিচারালয়ে হাজিরা হতে হয়। আল তুরাবী মন্তব্য করেছেন যে:
তিনি (শাসক) কোনরূপ দায়মুক্তির সুবিধা ভোগ করেন না এবং তার সরকারী বা ব্যক্তিগত যে কোন কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করা যেতে পারে। এ হচ্ছে ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আইনের মূলনীতি, যা শরিয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।–[ হাসান আল তুরাবী, ‘The Islamic State’ পৃ: ২৪৮-৯] অন্যান্যসহ বিচারিক ঘোষণার ইস্যু অন্তর্ভুক্ত।–[ দ্রষ্টব্য কুর্দী, ‘The Islamci state’, পৃ: ৮৫] বিচার বিভাগীয় রিভিউ এর ক্ষমতার বিষয়ে কিছুটা মতদ্বৈতা রয়েছে’। কিছু আধুনিক চিন্তাবিদ বিচার বিভাগকে আইনের সাংবিধানিক বিষয়টি বিচার ক্ষমতা প্রদানকে সমর্থন করেন না। তারা বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও ভূমিকাকে শুধুমাত্র আইনবিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইন তার অভিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা অবলোকন ও পরিবীক্ষণের ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাকার ক্ষমতা ব্যক্ত করেছেন।–[ কামাল এ. ফারুকী, ‘The Evolution of Islamic Constitutional Theory and Practice’ (করাচী, ন্যাশনাল পাবলিশিং হাউজ, ১৯৭১) পৃ: ৭২-৩] হাসান আল তুরাবী বিপরীত মত পোষণ করে ‘বিচারকদের শরীয়ার অভিভাবক হিসাবে গণ্য করে আইনের সকল ক্ষেত্রে তাদের রায় প্রদানের ক্ষমতার অনুকূলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।–[ হাসান আল তুরাবী, ‘The Islamic state’ পৃ: ২৪৯] এই মতামতের সাথে মোহম্মদ আসাদ ঐকমত্য পোষণ করেছেন এবং আবদুল কাদির কুর্দি বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।–[ কুর্দী, ‘The Islamic state’ পৃ: ৮৬-৭] সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর মতে যদিও খোলাফায়ে রাশেদার সময় বিচার বিভাগের এ ধরনের কোন ক্ষমতা ছিলনা, কিন্তু বর্তমান সময়ে যেহেতু মানুষের কুরআন হাদীসের জ্ঞানের বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি নেই, তাই তিনি কুআন-সুন্নাহর পরিপন্থীভাবে রচিত সংবিধান, আইন ও বিধিকে অবৈধ ও আইনগত ভিত্তিহীন হিসাবে ঘোষণা করে বাতিল করে দেয়ার ক্ষমতা বিচার বিভাগকে প্রদান সমীচীন বলে মনে করেন।–[ মওদুদী, The Islamci Law and Constitution’ পৃ: ২২৮] শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানী উলেমাবৃন্দ, মোহাম্মদ আসাদ ও আনসারী কমিশন রিপোর্ট এ মত সমর্থন করে।
সরকারের গঠন ও ধরন
সমকারীন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতগণ এ বিষয়ে একমত যে কুরআন ও সুন্নাহ কোন বিশেষ ধরনের সরকারের রূপরেখা অথবা বিস্তারিত শাসনতান্ত্রিক তত্ত্ব বর্ণনা করেনি। এ হতে মতামত উপস্থাপিত হয়েছে যে ইসলামে রাজনৈতিক সরকার নানা রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, ‘এটা কোন যুগে মুসলমানরা কি ধরনের সরকার চায় তথ্য যেটি তাদের উপযোগী সেভাবেই মুসলিম জনগণ সরকার গঠন করবে’।–[ আসাদ, The Principles of State and Government in Islam’ পৃ: ২৩]
খলিফার ধারণার সাথে সমধর্মী বিধায় মেহাম্মদ আসাদ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধানকে হতে হবে প্রয়োজনীয় গুণাবলী সম্পন্ন যার হাতে জাতির সকল বিষয় নিষ্পত্তির দায়িত্ব অর্পন করা যায়। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির সার্বিক কার্যকলাপের উপর নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে কাজ করবে।–[ আসাদ, The Principles of State and Government in Islam’ পৃ: ৬৫-৭] সাইয়েদ মওদুদী ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্তাকে যতদূর সম্ভব খোলাফায়ে রাশেদার অনুসরণ হবার পক্ষে রায় প্রদান করেছেন। এ ধরনের সরকার বর্তমান প্রচলিত কোন ধরনের সরকারের মত নয়।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Laq and Constitution’ পৃ: ২৪১] এ সরকার সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন ধরন ও প্রকৃতির সরকার –এটি একটি ধর্মাশ্রয়ী গণতন্ত্র, একটি ঐশ্বরিক গণতান্ত্রিক সরকার, কেননা এর অধীনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে মুসলমানদের সীমিত জনগণতান্ত্রিক সার্বভৌমত্ব প্রদান করা হয়েছে।–[ মওদুদী, ‘The Islamic Laq and Constitution’ পৃ: ১৩৯-৪০]
আনসারী কমিশন বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছে এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ন্যায় একজন ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার হিসাবে নির্বাচনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছে। কমিশন অবশ্য ইসলামী সরকার ব্যবস্থা মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসিত, বৃটিশ পার্লামেন্টারী বা ফরাসী পদ্ধতির অনুসরণ হবে মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেনি। বরং কমিশন একে শুরা পদ্ধতি বলে অভিহিত করেছে উপর্যুক্ত বিদ্যমান ব্যবস্থা সমূহের ভালো দিক সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।–[ AnsariKamishan ki Report, পৃ: ১২-১৫] নেতা সর্বদা শরীয়াহ ও ইজমার অনুবর্তী থাকবে এই শর্তে সরকারের নির্বাহী বিভাগের যে কোন রূপ পরিগ্রহ করতে পারবে মর্মে হাসান আল তুরাবী অনাপত্তি ব্যক্ত করেছেন।–[ হাসান আল তুরাবী ‘The Islamic State’ পৃ: ২৪৮] অধিকন্তু ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য কিছু ভারসাম্যমূলক বিধি নিষেধ আরোপ করার পর ইসলামী সরকারের তিনটি বিভাগীয় কার্যাবলীর সুনির্দিষ্ট বিভক্তিকরণের কোন কঠোর তত্ত্ব যৌক্তিক ও সমন্বিতভাবে উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়।–[ হাসান আল তুরাবী ‘The Islamic State’ পৃ: ২৪৯] সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম পণ্ডিতবর্গ যে ধরনের ব্যবস্থায় সরকার প্রধান আইনসভা কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত বা মজলিসে শুরা ব্যবস্থা তা ছক ৬.২-এর প্রদর্শিত হয়েছে। উভয় মডেলের শরীয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রতিফলিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্য। সরকারের তিনটি অঙ্গসংস্থার একই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সরকারের ত্রয়ী বিভাগের মধ্যে সংঘাতমুক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি করবে।
উপসংহার
কুরআন ও সুন্নাহ কোন শাসনতান্ত্রিক তত্ত্ব উপস্থাপন না করলেও এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্তঅর সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রদান করেছে যা সর্ব অবস্থায় বাস্তবায়নযোগ্য। মুসলমান সমাজ সাধারণভাবে ঐকমত্য পোষণ করে যে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাওহীদ, শরীয়াহ, শুরা, ন্যায়বিচার, সমতা ও স্বাধীনতার ভিত্তির উপর স্থাপিত। এই নীতিমালা যুক্তিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্দিষ্ট ভূখন্ড, জাতিসত্তা বা অন্য কোন রূপ বিবেচনা দ্বারা সীমায়িত নয়। এ ব্যবস্তঅ জাতীয়তাবাদ, জনগণান্ত্রিক সার্বভৌমত্ব ও সরকারের তিনটি বিভাগে কঠোর বিভাজনমূলক ধারণা সমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছে। পক্ষান্তরে এ ব্যবস্থা বিশ্বজনীন মূল্যবোধ, শরীয়াহর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ও সরকারের তিন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সমন্বয় ও সংহতিকরণের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছে।
সরকারের প্রশাসনের নির্বাহী দায়িত্ব প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা- খলীফা বা আমীর এর উপর ন্যস্ত। নির্বাহী কর্মকর্তার ধরন যা’ই হোক না কেন, আমীর সবসময়ই নির্বাচিন হবেন এবং সর্বদা শরীয়াহ ও তার অধীনে প্রণীত ইজমা’র অনুবর্তী হবেন। আমীর একটি পরামর্শক মণ্ডলী দ্বারা সহায়থা প্রাপ্ত হবেন, যে সংস্থাটি ‘লাগাম ধরা ও ছাড়ার কাজে’ পারদর্শী। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত এই ‘পরামর্শ সভা’ বর্তমানে প্রচলিত আইনসভার অনুরূপ বহুবিধ কার্যাবলী সম্পাদন করে। তবে পরামর্শক মণ্ডলী কর্তৃক আইন প্রণয়নের কাজটি শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কার্যক্ষেত্রের দিক থেকে বিচার বিভাগ একটি স্বাধীন সংস্থা, যা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে শরীয়াহর আলোকে বিচার পরিচালনা করবে ও আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করবে।
শরীয়াহ
জনগণ >>>>> আইন সভা >>> বিচার বিভাগ >>> নির্বাহী বিভাগ
— নির্বাচিত করে
— মনোনয়ন দান করে
ছক ৬.১: ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা : জনগণ নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ
জনগণ >>>>> আইন সভা >>> বিচার বিভাগ >>> নির্বাহী বিভাগ
— নির্বাচিত করে
— মনোনয়ন দান করে
ছক ৬.২ ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা : পরোক্ষভাবে নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ
যে নীতিমালা, মূল্যবোধ, গঠন কাঠামো উপরে বর্ণিত হয়েছে তা হতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, ইসলামী সরকারকে রাষ্ট্রশাসিত বা পার্লামেন্টারী পদ্ধতিতে সরকারের মত কোনটাই বলা যায়না। আইনের শাসন, আলোচনা ও নির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে আপাত সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও সামগ্রিক ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক জীবন দর্শনের কোন সামঞ্জস্য বা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানবরচিত আইনের সাথে শরীয়ার কোন মিল নেই, ইজতিহাদ বলতে চিন্তাভাবনার লাগামহীন স্বাধীনতা বোঝায় না, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে শুরা ব্যবস্থার কোন সামঞ্জস্যতা নেই।
গণতন্ত্র হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার সামগ্রিক বিবর্তনের ফসল; এর ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান হচ্ছে শতাব্দীব্যাপী চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিজয় জনিত ফলাফল; জনগণের ভোটের অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, দল গঠনের স্বাধীনতা ইত্যাদির উপর গুরুত্বারোপ হলো ঊনবিংশ শতকে উদীয়মান শিল্প শ্রমিকদের দাবির ফল। সংক্ষেপে গণতন্ত্র হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শনের এমন এক ফসল যেখানে মানুষের সবকিছু কেবলমাত্র বস্তুগত মানদণ্ডে বিচার করা হয় এবং যেখানে মানুষের আধ্যাত্মিক বিষয়টি সামান্যতম গুরুত্বও লাভ করেনা। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা আইন ব্যক্তিমানুষের যা খুশী করার স্বাধীনতার উপরই জোর দিয়ে থাকে। ধর্ম থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করা হয় এবং দুর্বলের প্রতিপক্ষ হিসাবে সবলের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন প্রণীত হয়। যে সুবিচারের নীতির কথা তারা বলে তা তাদের স্বার্থের অনুকূল না হলে তাকে হিমাগারে পাঠিয়ে দেয় হয়। ন্যায়ের নামে বস্তুত পেট্রোলিয়াম তৈলের জন্য কুয়েতকে রক্ষার নামে ইরাককে গুড়িয়ে দেয়া হয়। তৈল না থাকলেও বসনিয়াকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় আর জালিম সার্বদের মুসলিম গণহত্যা চালিয়ে যেতে দেয়া হয়। এ রূপধারী গণতন্ত্র তাই ইসলামী পরিমণ্ডলে অগ্রহণযোগ্য।
ইসলামী রাজনৈতিক সরকার মানুষের পারলৌকিক মুক্তির লক্ষ্যে তাদের ইহকালীন জীবনের কল্যাণের জন্য নিবেদিত। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিসীমা সুবিস্তৃত এবং তার সীমারেখা বস্তুগত জীবনকে ছাড়িয়ে মানুষের ভবিষ্যৎ পরকালীন জীবনের দিকে ধাবিত। ইসলামী রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঐশী ইচ্ছা অনুযায়ী মানব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সত্রিয়ভাবে সাড়া দেয়া, একই সাথে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপদান করা যতক্ষণ পর্যন্ত না তা শরিয়তের সীমারেখাকে ডিঙ্গিয়ে না যায়। ব্যক্তিমানুষের সুস্থ জীবন, জীবনবোধ ও তার উন্নয়নের লক্ষ্যে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা শান্তিশৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া কুরআনের ভাষায় ইসলামী রাজনীতির দায়িত্ব ও লক্ষ্য হচ্ছে:
সালাত (প্রার্থনা ও আরাধনা) কায়েম করা, জাকাত (শুদ্ধকারী কর) আদায় করা, ন্যায় ও সত্যকে উৎসাহিত করা এবং ভ্রান্তি ও অনাচারকে দূর করা। সকল বিষয়ের শেষ ফয়সালা মহান আল্লাহর সমীপে (২২:৪১)।