উপক্রমণিকা
ইসলাম, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এবং মুসলিম বিশ্ব
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চিন্তাধারা মুসলিম বিশ্বে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। এ মতাদর্শকে মুসলিম দেশসমূহে শাসন-পদ্ধতির মানদণ্ড রূপে পরিবর্তন করার প্রয়াস চলছে। বস্তুতপক্ষে ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতাদর্শকে জোড়ালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামী বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আক্রমণের প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামী বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিদ্বেষ প্রসূত আক্রমণ ইসলামী মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিমণ্ডলে অবক্ষয়ী ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে।
পাশ্চাত্য আচার আচরণ ও প্রাতিষ্টানিট কাছামোর অন্ধ অনুকরণ কত্ত্বেও মুসলিম বিশ্ব নতুন সহ্রাব্দের স্বনির্ভর প্রবৃদ্ধির দোরগোড়ায় পৌছতে ব্যর্থ হয়েছে। আর মুসলিম জাতি পরিণত হয়েছে নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে বিস্মৃতপরায়ণ এক জনগোষ্ঠীতে। স্বকীয় বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চেতনা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতাদর্শ বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে তার বিশ্লেষণ, মুসলিম জীবন পদ্ধতি ও চিন্তাধারার উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতাদর্শের আক্রমণের ফলে সৃষ্ট ক্ষতির পরিসর ও প্রকৃতির বিষয়ে মূল্যায়ন বিষয়ে এ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ প্রতিবেশের কারণে উৎপত্তি উৎস, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতাদর্শ নানা সৃষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, তৃতীয় বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মডেল হিসাবে ভিন্ন ভিন্নভাবে আলোচনা করা সমীচীন হবে।
পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধারণাটি বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অধিকাংশ প্রটেষ্ট্যান্ট দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্র থেকে চার্চের পৃথকীকরণ বোঝায়। ক্যাথলিক দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পুরোহিততন্ত্র বর্জিত মতবদা (Laicism ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখানে যাজকশ্রেণী হতে সর্বসাধারণের পার্থক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।–[Sacularism শব্দটি ল্যাটিন Seaculum শব্দ হতে এসেছ, যার অর্থ যুগ বা প্রজন্ম। কিন্তু খ্রিষ্টান ল্যাটিনে এর অর্থ ইহজগত। Laicism শব্দটি এসেছ গ্রীক শব্দ Laos (জনগণ) এবং Laikos হতে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সম্পর্কে বিস্তৃত জানার জন্য দেখুন, Eris S. W aterhouse, Secularism ; Encyclopedia of Religion and Ethics(Edinburg: T&T Clark, 1954) Vol. xi. পৃঃ ৩৪৭-৫০।]
আসলে উভয় শব্দই একই জিনিসের দু’টি দিক এগুলো চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ প্রসংগে ব্যবহৃত হয়েছে।
একটি দার্শনিক মতবাদ হিসাবে ১৮৬৪ সালে জ্যাকব হলিওক ইংল্যান্ডে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারণার প্রবর্তন করেন।–[ Owen Chadwick, The srcularization of the European mind (ক্যাস্বব্রিজ: ক্যামব্রীজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৫)। বহুলভাবে প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ ইহজগতমুখীনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও উদার নৈতিকতাবাদ।
প্রথম এবং দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে মানবজাতির পরম লক্ষ্য শুধুমাত্র জাগতিক জীবনের স্বাচ্ছন্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়া উচিৎ। ধর্ম বা পরকালীন জীবনের সাথে জাগতিক জীবনকে জড়িয়ে ফেলার প্রয়োজন নেই। পশ্চিমা বিজ্ঞান কার্য ও কারণ সম্পর্কে এক বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে এবং সত্যের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নিউটনের পদার্থবিদ্যা কার্যকারণ সম্পর্ককে সার্বজনীনতার রূপ প্রদান করেছে। এভাবে ঐশী প্রত্যাদেশ, ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও ধারণা এবং কর্তৃত্বকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। -[Irving M, Zeitlin, ‘Ideology and the Developmen of Sociological Theory,’ (নিউজার্সী; প্রেনটিস হল ইনক, ১৯৬৮); পৃ৩-৭।]
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ‘উদার নৈতিকতাবাদের ভিত্তি রচিত হয়েছে মানবতাবাদের ধারণার উপর। মানবতাবাদ ব্যক্তি মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এ প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখ স্বাচ্ছন্দের অনুসন্ধান ও তা লাভ করা মানুষের জন্মগত অধিকারের প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
উদারনীতিবিদদের দাবির মধ্যে এক ধরনের ধর্মীয় আপোষহীনতার উপাদান লক্ষ্য করা যায়। তাহলো নিজের বিবেক অনুসারে যে কোন ধারণা ও বিশ্বাস অনুসরণের অধিকার। তারা মনে করে এ হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের সহজাত ও চূড়ান্ত অধিকার। জন স্টুয়ার্ট মিলেরভাষায়, এ পৃথিবীর মহৎ চিন্তাবিদগণ মুক্তি ও স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তি মানুষের বিবেকের স্বাধীনতাকে তার অবিভাজ্য অধিকার বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ তার ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য স্বীয় বিবেক ছাড়া অন্য কোন সত্তার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। -[John Stuart Mill, চডইউক কর্তৃক উদ্ধৃত, ‘On Liberty’, The Secularization of European Mind, পৃ. ২৭]
জোফারসনের ভাষায়, ব্যক্তি মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে উদারনৈতিক মতবাদ ‘রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে পৃথকীকরণের একটি দেয়াল’ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অর্থ দাঁড়ায়, এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে একটি ধর্মের তুলনায় অন্য ধর্মকে অধিক গুরুত্ব প্রদর্শন করা হয় না, সেখানে একটি ধর্মের বিপরীতে অন্য ধর্মের অনুকূলে কোনরূপ শিক্ষা বা সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা হয় না, এমন একটি রাষ্ট্র যা ধর্মশিক্ষা ও ধর্মচর্চাকে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করে না। [John Stuart Mill, চডইউক কর্তৃক উদ্ধৃত, ‘On Liberty’, The Secularization of European Mind, পৃ. ২৭]
উল্লেখ্য, নির্বাচন, প্রচারমাধ্যম, সরকারের তিন অংগ তথা আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মডেলকে রাজনৈতিকভাবে কার্যকর করা হয়।-[Altaf Gauhar ‘Islam and Secularism’, আলতাফ গওহর সম্পাদিত, The Challlenge of Islam )লন্ডন,ইসলামিক কাউন্সিল অব ইউরোপ), ১৯৭৮) পৃঃ ৩০২]
বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট পদে জনসাধারণের ভোটের মাধ্যমে উপযুক্ত লোক নির্বাচনের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে। পত্র পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমের কাজ হলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ ও প্রতিফলনের মাধ্যমে ‘গণ-বিবেক’ হিসাবে কাজ করা। সরকারের তিনটি অংগ, শাসন, বিচার ও আইন বিভাগের কাজ হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের সকল অংশের মতামত প্রতিফলন নিশ্চিত করা।
এরূপ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো সর্বাধিক দক্ষতা অর্জন। এর বৈশিষ্ট্য হলো স্বনির্ভর প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা অর্জন করা। এরূপ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্ম, নৈতিকতা বা নন্দন তত্ত্বের প্রতি এক ধরনের অনাগ্রহ বা নিরাসক্তি প্রদর্শন করা হয়। -[ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, ১৯৭৪, ভলিউম-৯, পৃঃ ৫২৩; প্রাগুক্ত উদ্ধৃত পৃঃ ৩০০।]
কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিচালিকা শক্তি হিসাবে উদারনৈতিকতা, মানবতাবাদ ইত্যাদি হিসাবে অভিহিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধর্মনিরপেক্ষ সংজ্ঞায় বর্ণনা করা হলেও এ সব প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞার মধ্যে খ্রিষ্টানধর্ম, দর্শন ও মূল্যবোধের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ডব্লিউ সি স্মীথ স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেনঃ গণতন্ত্রের ধারণার উৎসস্থল দু’টিঃ গ্রীক এবং ইহুদী-খ্রিষ্টান দর্শন ও ঐতিহ্য। পশ্চিমা গণতন্ত্র অত্যন্ত প্রবলভাবে খ্রিষ্টান ধ্যান-ধারণা পুষ্ট। -[ ডব্লিউ, সি, স্মিথ, ‘Pakistan as an Islamic State, (লাহোর, আশরাফ, ১৯৫৪), পৃঃ ৪৯।]
এসব তথ্য হতে বলা যায়, ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের তত্ত্ব সত্ত্বেও খ্রিষ্টান ধ্যানধারণার প্রতি রাষ্ট্র ছিল অনুকূল। অন্যকথায় পশ্চিমা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতে খ্রিষ্টান ধ্যান ধারণা জড়িত। তাই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্টের পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই খ্রিষ্টানধর্মের প্রতি কোনরূপ বিরূপ ধারণা পোষণ করা সম্ভব ছিল না।
হলিওকের ভাষায়, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল পরস্পর নিরপেক্ষ। অনেক উদারনীতিবাদী নিজদের খ্রিষ্টান চিন্তাধারা হতে প্রভাবমুক্ত করতে অপারগ হয়েছেন। বস্তুত তারা তাদের রচনায় ধর্মযাজন সেইন্ট অগাস্টিনের কল্পিত স্বর্গরাজ্যের ধ্বংস সাধন করে পুরান ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন সালসমলা দিয়ে পূর্বতন চিন্তাচেতনাকেই পুননির্মাণ করেন। -[ কার্ল বেকার, ‘The Heavenly City of the Eighteen Century Philosophers’, (নিউ হ্যাভেন, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৩২), পৃঃ ৩১।] অষ্টাদশ শতকের এ ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত চলে আসচে।
মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ভালো সমর্থন লাভ করে। আধুনিকতা অর্জনের জন্য কতিপয় মুসলিম শাসকবর্গ এ ধর্মনিরপেক্ষ মডেল প্রয়োগ করেন। কেউ কেউ এজন্য উদারপন্থা আবার কেউ স্বৈরতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করেন। ১৯২০ এর দশকে কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে আমূল পাশ্চাত্যকরণনীতি তান্ত্রিকতার উদাহরণ। তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোণষা করা হয়। পাশ্চাত্য পোশাক ও রোমান বর্ণমালা বাধ্যতামূলক করা হয়। মাজার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তিউনিশিয়ার হাবিব বরগুইবা ব্যাপারে অধিকতর নমনীয় পন্থা গ্রহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামের নাম অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মহিলাদের পর্দাপ্রথা (হিজাব) নিষিদ্ধ করেন। ১৯৬১ সালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার নামে তিউনিশীয় জনগণকে রমজান মাসে রোজা পালন করার আহবান জানান। অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ উষর ভূমিতে পতিত হয়। অর্থাৎ কোন কিছু ভালো ফলোৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। বিগত দু’দশকে দেশ দু’টিতে সক্রিয় ও সংগঠিত ইসলামী আন্দোলনের উত্থান তার প্রমাণ।
মার্কসবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে বস্তুগত, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধিত হয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। পশ্চিমের অগ্রগতির এসব ফলাফলের তাৎপর্য কার্লমার্ক্সের চেয়ে কেউ এতবেশী অনুধাবন করতে পারেনি।
কার্লমার্ক্সের ভাষায়
বর্জুয়া সভ্যতা মানুষে মানুষে নগ্ন স্বার্তপরতা আর অর্থকড়ির লেনদেন ছাড়া কোন বন্ধন অবশিষ্ট রাখেনি। এ বর্বর সভ্যতা সৎ ও শুভ উদ্দেশ্যের পরম আনন্দ ও পবিত্রতা, শুভবুদ্ধি ও পৌরুষদীপ্ত উদ্দীপনা, নিষ্কলুষ অনুভূতিরাশিকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হিসাব-নিকাশের বেড়াজালে আবন্ধ করেছে। পাশ্চাত্য বর্জুয়া সভ্যতা চরিত্রের শুদ্ধাচারিতার মানবিক বৈশিষ্ট্যের উপর স্থান দিয়েছে অর্থকে।
পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রে যে স্নেহ-মমতা ও সৌহার্দ্য বিরাজ করে, তা ছিঁড়ে ফেলে তথায় শুধু অর্থের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। -[ কার্ল মার্ক্স এন্ড ফ্রেডরিক এনজেলস, ‘Manifesto of Commanist Party’ (নিউ ইয়র্ক, ইন্টারন্যাশনাল পাবলিসার্স, ১৯৪৮), পৃঃ ১১]
পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর্যুক্ত বীভৎসতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে কার্লমার্ক্স আর্থ-সামাজি মতবাদের তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, ইতিহাসের গতিধারায় সমাজ বিবর্তনের মধ্যদিয়ে একটি শ্রেণীহীন সমাজ গঠিত হবে। কার্লমার্ক্স তার মতবাদের বিজয়ের অনিবার্যতার বিষয়ে একধরনের ধর্মীয় অনুভূতির মত বিশ্বাস পোষণ করতেন। তিনি তার মতবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে সুনিশ্চিত ছিলেন। তাঁর প্রদত্ত তত্ত্ব বা মতবাদটি মার্ক্সবাদ নামে অভিহিত। ‘ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচারিত বিভিন্ন প্রকার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মধ্যে মার্ক্সবাদই সবচেয়ে শক্তিশালী মতবাদ। -[ Chadwick, ‘The Secularization of Eutopean Mind, পৃঃ ৬৬।]
মার্ক্সবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মূলতঃ পাশ্চাত্য ইতিহাস, সমাজ সংগঠন ও পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি হতে সৃষ্টি হয়েছে। এ মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পশ্চিমা জগত হতে এসেছেন। এ মতবাদের সমগ্র দর্শন পাশ্চাত্যের বর্জুয়া উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাঠামোর উপর নির্মিত হয়েছে।
মার্ক্সবাদী মতাদর্শ মৌলিকভাবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে পাশ্চাত্যেরই বিদ্রোহ হিসাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে মার্ক্সবাদী ধর্মনিরপেক্ষবাদের মৌলনীতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ (বস্তুবাদ, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমুখীতা ও মানবতাবাদ ইত্যাদি) অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মডেলের সাথে অভিন্ন।
মার্ক্সবাদের সাথে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মডেলগুলির তেমন কোগ গুণগতপার্থক্য নেই। শুধুমাত্র উভয়ের সাধারণ উপাদানগুলির মধ্যে তুলনামূলকভাবে একটির উপর অন্যটিকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আরো একটি পার্থক্য হলো মার্ক্সবাদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী অন্যান্য মডেলের চেয়ে স্বতন্ত্রভাবে বর্জুয়া সভ্যতার কুফল হতে মুক্তিলাভের সুনির্দিষ্ট পন্থার দিকে দিক নির্দেশ করেছে। কার্লমার্ক্স বর্জুয়া সভ্যতা-সংস্কৃতি, সংগঠন ও উৎপাদন পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করে উল্লেখ করেছেন যে, বর্জুয়াতন্ত্র মানবিক মূল্যবোধকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। অপরদিকে খ্রিষ্টীয় মতবাদের সমালোচনা করে কার্লমার্ক্স বলেছেন যে, খ্রিষ্টধর্ম আত্মনিগ্রহ, কাপুরুষতা, নতজানুনীতি, ক্ষয়িষ্ণুতা, আত্ম অবমাননা, জীবনবিরোধী বৈরাগ্যবাদ তথা মানবেতর সমাজের সমস্ত নেতিবাচন দিকগুলো প্রচার করে থাকে। -[ মার্ক এনজেলস, ‘On Religion’ ‘কস্কো, প্রগরেস পাবলিসার্স, ১৯৫৭); পৃঃ ৮৩]
মার্ক্সবাদের বক্তব্য গভীরতা ও তীব্রতার দিক থেকে ধর্মীয় চরিত্রের ন্যায় অনমনীয়। অন্যান্য পশ্চিমা মতবাদমসূহ ধর্মকে পরোক্ষভাবে মোকাবেলা করেছে। অপরদিকে মার্ক্সবাদ ধর্মকে সরাসরি আক্রমন করেছে। কার্লমার্ক্স তার ডক্টরেল থিসিসের ভূমিকায় বলেছেন, ‘এক কথায় আমি সব ধরনের ঈশ্বরকে ঘৃণা করি’। মার্ক্সের মতে ধর্ম হচ্ছে অবাস্তব। ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে কার্য ও কারণ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক নিয়ম সম্পর্কে দাসত্ব ও বিচ্ছিন্নতার জন্য ধর্ম দায়ী। ধর্ম মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতাকে রুদ্ধ করে মনুষ্যত্বের মৌলিক গুণ হতে মানুষকে বঞ্চিত করে। ধর্ম তাই অবাস্তব এবং অনাকাংখিত।
কার্ল মার্ক্সের অভিমত অনুযায়ী
ধর্ম হচ্ছে মানুষের কাল্পনিক সুখের অন্বেষা। তাই প্রকৃত সুখ লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে এসব তথাকথিত ধর্মের অবসান। বাস্তব জগত সম্পর্কে সকল প্রকার কল্পনা বিলাসের অবসান করতে হলে প্রকৃত প্রস্তাবে ঐ সব অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে যা এরূপ ধর্মান্ধ কল্পনাবিলাসের জন্ম দেয়। -[ কার্ল মার্ক্সস এন্ড ফ্রেডেরিক এনগেলস, Collected Works, Vol. 2 (লন্ডন; লরেন্স এন্ড উইশার্ট, ১৯৭৫), পৃঃ ১৭৬]
প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ঘটনাচক্রের প্রতি সচেতন প্রতিবাদ হতে কার্লমার্ক্সের নিরীশ্বরবাদের জন্ম। ঘটনাপুঞ্জসমূহ হচ্ছে পৈত্রিক ইহুদীধর্মের কারণে কার্লমার্ক্সের শৈশবকালে তাঁর প্রতি সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্যের অভিঘাত, প্রেমিকার প্রতি তাঁর ভালোবাসায় যাজকশ্রেণীর কুপমন্ডুক বিরুদ্ধাচরণ, তাঁর পিতাকে লুথার প্রবর্তিত ধর্ম গ্রহণে বাধ্যকরণ। -[ KarlR. Popper ‘The Open Society and Its Enemies, Vol.2 (লন্ডন: রুলেজ এন্ড কেগান পল, ১৯৬২) পৃঃ ২৫৫]
মার্ক্সবাদ সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হয় এবং অতঃপর পরিবর্তিত রূপে বাস্তবায়িত হয় গণচীনে। নিরীশ্বরবাদী মার্ক্সবাদ প্রবর্তনের জন্য এসব দেশে প্রচলিত ধর্মসূহকে সমাজ ও প্রগতি বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করে অত্যন্ত সংগঠিতভাবে সরকারীভাবে দমননীতি পরিচালনা করা হয়। এভাবে সব মার্ক্সবাদী বামপন্থী সমাজে বাম মতাদর্শের একচেটিয়া কর্তৃত্ব বিরাজ করে। -[ Alan Bullock and Oliver Stallybrass, The Harper Dictionary of Modern Thought (নিউইয়র্ক, সাপ্তাহিক হার্পার এন্ড রো, ১৯৭৭), পৃঃ ৫৪৬] এর অর্থ এসব বামপন্থী মার্ক্সবাদী শাসনকর্তৃত্ব সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করে মার্ক্সবাদী নিরীশ্বরবাদী মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য অব্যহত জোরদার প্রচারণা চালিয়ে যায়। এ তুমুল প্রপাগান্ডার জোয়ারে একমনকি মুসলিম বিশ্বের কেউ কেউ এ তথাকথিত নব্য হিব্রু নবী কার্লমার্ক্সের কথাকে ঐশীগ্রন্থের মত ভক্তি করতে থাকে। কার্লমার্ক্সের ধ্যানধারণাকে তারা অবিচল শ্রদ্ধা সহকারে ঐশী প্রত্যাদেশের মত নির্ভুল হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাঁকে এমন এক ঈশ্বর রূপে তারা পূজার নৈবেদ্য নিবেদন করছে যে, ঈশ্বর অন্যান্য সকল ধরনের ঈশ্বরের ধারণাকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে।
তৃতীয় বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
অন্যান্য আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর মত পাশ্চাত্য জগত থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতামর্শকে তৃতীয় বিশ্বে আমনাদী করা হয়েছে। একে উপর থেচে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত মুসলিম দেশসমূহের নেতৃবৃন্দ বুঝতে পেরেছিলেন, নিরীশ্বরবাদী মার্ক্সবাদের ত প্রশ্নই উঠে না, এমনটি ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের অনুসরণের মাধ্যমে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে দেয়াল রচনার প্রচেষ্টাও এসব প্রাচ্যদেশের গভীর ধর্মানুরাগী জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবে। তাই এসব দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতাদর্শকে রূপ ও রং বদলাতে হয়েছে। কৌশল হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথিত ইতিবাচক গুণাবলীর প্রশস্তি গাওয়া শুরু করেন। ভারতের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি মনীষী গজেন্দ্র গদকারের ভাষায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছেঃ
ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বস্তুতপক্ষে মানবজীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্যরূপে স্বীকার করে।… ভারতীয় সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ভারত প্রতিপালিত সকল ধর্মমতই সমান ও স্বাধীনতা, সমানাধিকার ও প্রতিরক্ষার অধিকারী। -[ PB. Gajendradkar ‘The Concept of Secularism, Secular Democracy, (নিউ দিল্লি, সাপ্তাহিক), বার্ষিক সংখ্যা, ১৯৭০; পৃঃ ১।]
ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপযুক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধরে নিলে এর অর্থ দাঁড়ায় ধর্ম জনজীবনের কোন অঙ্গন হতে অনুপস্থিত থাকবে না। সরল অর্থে রাষ্ট্র সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ করবে। সকল ধর্ম সমান রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমাজ জীবনে অংশগ্রহণের সমান অধিকার লাভ করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারত বা অন্যকোন দেশ প্রকৃত প্রস্তাবে এ ধরনের সুন্দরভাবে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ লালন বা চর্চা করে না। এ ধরনের ‘ইতিবাচক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের’ ধারণাটি ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রণীত, ঘোষিত ও লালিত হয়েছে। অপরদিকে দেখা যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারণাটি শুশু স্বীকৃতিই প্রদান করেননি বরং রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম হিসাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভূমিকায় স্থান দিয়েছেন। তিনি রেডিও-টেলিভিশনের কর্মসূচির প্রারম্ভে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানধর্মের পবিত্র গ্রন্থ হতে পাঠ করার নির্দেশ প্রদান করেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অন্তর্নিহিত ইসলামী চেতনা, ঐতিহ্য ও চরিত্রের প্রেক্ষিতে এ ঘোষণা মুসলিম জন-মানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদকে বাতিল করে দেশের সংবিধানে ইসলামী রূপরেখা প্রদান করেন।
মুসলিম দেশসমূহ যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে উদাহরণ হিসাবে তারা হচ্ছে গিনি, গাম্বিয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া, সেনেগাল ও তুরস্ক। যদিও এসব দেশগুলির অধিকাংশই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেনি তবুও এসব দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র সুস্পষ্ট। নাইজেরিয়ার ১৯৭৯ সালের সংবিধানের দশম অনুচ্ছেদ বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র কোন ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি তবুও এসব দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র সুস্পষ্ট। নাইজেরিয়ার ১৯৭৯ সালের সংবিধানের দশম অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র কোন ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে গ্রহণ করবে না’। যদিও শব্দচয়নের দিক থেকে উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদটি সুস্পষ্ট নয় তবুও দেশটিতে যেভাবে ধর্মীয় বিষয়াবলীকে দেখা হয় তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, এসব দেশের সংবিধান প্রণেতা ও প্রয়োগকারীরা ভারতীয় সংবিধানের ধারণা ও ভাষ্যকেই গ্রহণ করেছে।
ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তাই এমন এক মতবাদ যার উৎসস্থল এমন কিছু হিসাবে বিবেচনা করা যায় যা ঐশ্বরিক নয় বরং এ মতাদর্শ সম্পূর্ণভাবে মানব রচিত। এর দার্শনিক ভিত্তি মানুষ ও স্রষ্টার পৃথকীকরণের মধ্যে নিহিত। পক্ষান্তরে ইসলাম হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বরিক। এর ভিত্তি হচ্ছে স্রষ্টার ইচ্ছা ও আদর্শের অভিব্যক্তি আল কোরআন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাহ। এর প্রেক্ষিত হচ্ছে সর্বব্যাপী এককেন্দীক এক বিশ্বাসের বৃত্ত যা জীবনের সর্বক্ষেত্রকে পরিব্যপ্ত অস্তিত্বের বাস্তবতা ব্যতীত আর কোন সত্ত্বা নেই। আল্লাহর প্রবল পরাক্রমশালী শক্তির বাইরে কিছুই নেই। এসব হচ্ছে ইসলামের মর্মকথা।
ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মধ্যে সামঞ্জস্যতা প্রদর্শনের জন্য বহু পণ্ডিত ব্যক্তি কষ্টকর প্রয়াস চালিয়েছেন। যুক্তি হিসাবে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সার্বজনীন কল্যাণ ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে উন্নত চিন্তাসমৃদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে মানবগোষ্ঠীকে উদ্ধুদ্ধ করে থাকে। -[ R Hrothuysen, ‘Secularism’; এডউইন আর এ, সেলিগম্যান সম্পাদিত, ‘Encyclopedia of Social Science’, (নিউ ইয়র্ক, ম্যাকমিলান, ১৯৫৪), ভলিউম ৮, পৃঃ ৬৩।] যেহেতু ইসলাম এ ধরনের উদ্ধুদ্ধকরণে বিশ্বাসী, তাই ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে অভিহিত করা যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে, ইসলাম সত্যে উপনীত হবার লক্ষ্যে যুক্তি ও বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানের উপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। ইসলাম প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গকে ইজতিহাদ বা গবেষণার অধিকার দিয়েছে। জ্ঞানার্জনকে বাধ্যতামূলক করেছে। বিশ্বাসীদের সৎকাজ করার এবং অসৎকাজ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ঈমানদার ব্যক্তিবর্গকে উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করেছে। প্রজ্ঞা ও যুক্তিপূর্ণ উদ্ধুদ্ধকরণের মাধ্যমে বিশ্বমানব সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা পরিচালনা করা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে। এ সার্বিক পর্যালোচনা ও দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে ইসলামে ধর্মান্ধতার কোন ছোঁয়া নেই। এর অর্থ এ নয় যে ইসলামের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কোন মিল রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যদিও সকল আদর্শবাদ ও মরমী মতবাদকে অস্বীকার করে, তবুও এর ধর্মনিরপেক্ষ আবরণের মধ্যে ধর্মের সাথে সমার্থক কতিপয় প্রাচীন আদর্শবাদী ধারণাকে অনুপ্রবেশ ঘটানোর বা সন্নিবিষ্ট করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। -[ R Hrothuysen, ‘Secularism’; এডউইন আর এ, সেলিগম্যান সম্পাদিত, ‘Encyclopedia of Social Science’, (নিউ ইয়র্ক, ম্যাকমিলান, ১৯৫৪), ভলিউম ৮, পৃঃ ৬৩।]
অবশ্য এর ফলে ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মধ্যে কোন রূপ মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি (১.১ নং ছক দ্রষ্টব্য)। ইসলাম ঈমানদার ব্যক্তির জীবনের সকল অঙ্গনে অনুশাসন করে। ঈমানদারদের জীবনের সকল অঙ্গনে অনুশাসন করে। ঈমানদারদের জীবনের স্বরূপ এবং মৌলিক কেন্দ্রবিন্দুকে ইসলাম বিদ করে দেয় এবং একই সাথে সমাজের প্রতি তার আনুগত্যের মানদণ্ডকেও নির্ধারণ করে দেয়। তৌহিদ বা একত্ববাদ হচ্ছে ইসলামের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ তৌহিদ স্রষ্টার একত্ব এবং তাঁর একক সার্বভৌমত্বকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে। ইসলামী বিশ্বাসের সামগ্রিকতা ও বিশ্বজনীনতা এ ঐশী বিধানের অন্তর্নিহিত সারবস্তু। আল্লামা ইকবালের ভাষায়, ‘ইসলামের চূড়ান্ত বাস্তবতার স্বরূপ হচ্ছে আধ্যাত্মিক। পক্ষান্তরে অন্তর্মূখী ইসলামী জীবন তার ডালপালা ছড়িয়ে রাখে জাগতিক কর্মকাণ্ডে। ইসলামের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ ঘটে প্রকৃতি, বস্তুনিচয় এবং বৈষয়িক বিষয়সহ সবকিছুতে। ফলে বৈষয়িক বিষয়সমূহ তার সত্তার মূলে দিক থেকে পূত পবিত্র। -[ স্যার মোহাম্মদ ইকবাল, The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ (লাহোর, আশরাফ, ১৯৭১), পৃঃ ১৫৫।]
তাই সর্বশেষ ওয়াটার হাউজ এর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভ্রান্তি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের ক্ষেত্রে নয় বরং এর জ্ঞানগত বিষয়ে নিহিত। -[ ওয়াটার হাউজ, ‘Secularism’, পৃঃ ৩৪৯।]
ছক. ১.১ ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইসলাম
উৎসমূলঃ সম্পূর্ণভাবে মানব ইহজগতমুখী উৎসমূলঃ ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ,
রচিত এবং ইহজগতমুখী;
যুক্তি, পর্যাবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ, যুক্তি পর্যবেক্ষণ ও
উপর গুরুত্ব আরোপ করে; অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্বারোপ করে;
বল্লাহীন প্রবৃত্তির ইচ্ছাভিত্তিক শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে
মানবতাবাদে বিশ্বাসী; ঐশ্বরিক মানবতাবাদে বিশ্বাসী;
ধর্ম ও রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন ও রাজনীতি ও ধর্মকে
আলাদা করে রাখে। একসূত্রে গ্রথিত করে।
ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করে
অপরদিকে ইসলাম ধর্মের মতে একটি কাজ বিষয়ের দিক থেকে আপান দৃষ্টিতে যতই বৈষয়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ মনে হোক না কেন, কাজটির প্রকৃত স্বরূপ কর্তা ব্যক্তির নিয়ত বা মনের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নির্ণিত হয়। পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তির কাজ বস্তুগত স্বার্থপরতাপূর্ণ পূতঃপবিত্রতাহীন হিসাবে অভিহিত ও চিহ্নিত হবে যদি উক্ত ব্যক্তি জীবন প্রবাহের পশ্চাতে যে অসীম ঐশ্বরিক বৈচিত্রতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা সচেতন না থাকে। আবার সে কাজই গভীর আধ্যাত্মিক চেতনা সঞ্জীবিত হবে যদি ঐ ব্যক্তি বিপুল ঐশ্বরিক চেতনা প্রবাহের বৈচিত্রের অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে। -[ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religion Thought in Islam’ পৃঃ ১৫৪।]
খ্রিষ্টীয় মতবাদ মনে করে যে, চার্চ (ধর্ম) ও রাষ্ট্র একই বাস্তব বিষয়ের এপিঠ ও ওপিঠ। এ চিন্তাধারাকে সঠিক বলে অভিহিত করা যায় না। কেননা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার ক্ষেত্রে দেখা যাবে হয় এ পিছ অথবা অন্যপিঠ। এর কারণ নিম্নের যুক্তি পরস্পরায় নিহিত রয়েছেঃ
স্থান-কালের প্রেক্ষিতে বস্তুই মননে পরিণত হয়। যে সত্তা মানুষ নামে অভিহিত তাকে দেহসত্তা বলি যখন যে বহির্জগতের সাথে ক্রিয়াশীল থাকে। আবার সেই ব্যক্তি সত্তাকেই আমরা আত্মা নামে অভিহিত করি যখন ঐ ব্যক্তি ঐশ্বরিক পরমসত্তার ‘জাত’ ও ‘সিফাতের’ বিভূতির মাঝে ফানা বা বিলীন হয়ে যায়। -[ ইকবাল, ‘The Reconstruction of Religion Thought in Islam’ পৃঃ ১৫৪।]
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের গঠনপ্রণালী প্রক্রিয়া
ইউরোপীয় মহাদেশে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক বিবর্তনের ধারা প্রবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উন্মেষ ও গঠণপ্রণালী প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। রেঁনেসা, চিন্তাজগতের পুনর্গঠন, বৃদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ, ফরাসী বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লব এ সবই ক্রমপুঞ্জিভূতভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনার জন্ম দিয়েছে। -[ দ্রষ্টব্য, ক্রেইন ব্রিন্টন, ‘The Shaping of Modern’ Thought (নিউজার্সী, প্রেনটিস হল, ১৯৬৩)।] এ বীজ লুকায়িত ছিল খ্রিষ্টীয় জগতের এই চিন্তাধারার মাঝে যে, ‘সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও আর খোদার প্রাপ্য খোদাকে দাও’।
এ চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করলে অর্থ দাঁড়ায় যে, মানব সমাজ পৃথক দু’টি জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব দ্বারা পৃথকভাবে অনুশাসিত হবে এটা ঐশ্বরিকভাবে নির্ধারিত হয়ে আছে। খ্রিষ্টীয় চিন্তাধারায় কোন সত্তাই একই সাথে জাগতিক সাম্রাজ্য ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে খ্রীষ্টীয় জগতের এ বিশ্বাস যে, মানব ইতিহাস ঈশ্বরের ইচ্ছার অভিব্যক্তি প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব কায়েম হবে। এ উভয় খ্রীষ্টীয় চিন্তাধারা যুক্তভাবে বিশ্বের জাগতিক ঘটনা প্রবাহসমূঞ সংগঠন ইন্দন যুগিয়েছে। খ্রিষ্টীয় ধর্মের আধুনিক যুক্তিবাদের ভিত্তিতে নব্য ব্যাখ্যা ও আপোষকামী সমন্বয় ও ঐক্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী চার্চ ও রাষ্ট্র বিতর্কেরপরিসমাপ্তি টানা হয়। ইমানুয়েল কান্ট, সেইন্ট সিমন, আগষ্ট কঁমের লেখনী হতে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীগণ খ্রিষ্টধর্ম বা এর কোন ভার্সন বা প্রকরণকে আধুনিক ইউরোপীয় মানসগঠনে উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসানে কাজ করেছে।
অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার উদ্ভব ও উত্থানের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টান ধর্মের অবদান এবং ইউরোপীয় অভ্যন্তরীণ গতিশীলতাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান শুধুমাত্র এ উত্থানের কারণ নির্ণয়ে আংশিক উত্তর মাত্র। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী উত্থানের মূখ্য কারণ খুঁজতে হবে ইসলাম ধর্মের প্রতি খ্রিষ্টীয় চিন্তাধারার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। পূর্বসূরী ইহুদী ধর্মের মত খ্রিষ্টধর্মও নিজকে অন্যান্য ধর্ম হতে শ্রেষ্ঠতর ধরনের এ ধারণা হতে উদ্ভুত ঘৃণা ও ভয়ের পরিবেশে জন্ম লাভ করেছিল। ইসলাম ধর্মের প্রতি খ্রিষ্টধর্মের বিদ্বেষ ছিল ছূড়ান্ত। ইসলাম কেবল মানব ধর্মের বিশ্বজনীনতাকেই চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং কুরআনের ১১২ সূরা নাসের মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় ত্রিত্বমতবাদের ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। এর পরই শুরু হলো ইতিহাসের নজীরবিহীন ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং ব্যাপকভাবে খ্রিষ্টানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। ফলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের খ্রিষ্টীয় চরিত্রের একক সংহতি বিনষ্ট হলো এবং পাশ্চাত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের সূচনা হলো। -[ এস এম নকব আল আত্তাস, ‘Islam, Secularism and Philosophy of Future’ (লন্ডন, ম্যানসেল, ১৯৮৫) পৃঃ ৯৫] প্রতিক্রিয়া হিসাবে খ্রিষ্টীয় সমাজের সমস্ত প্রতিভা ইসলাম ধর্ম, তার নবী ও পবিত্র গ্রন্থের বিকৃতি ও কুৎসা রটনায় সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।–[ ইহা বেলজিয়ান ইতিহাসবিদ Henri Pirenne এর থিসিস, প্রাগুক্ত উদ্ধৃত, পৃঃ ৯৫]
পরবর্তীতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও অন্যান্য জ্ঞানে সজ্জিত হয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্র সেনাবাহিনী ও বাণিজ্য কোম্পানীসমূহ মুসলিম বিশ্বকে পরাজিত করে উপনিবেশবাদ, আধা উপনিবেশে পরিণত করল। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও খ্রিষ্টধর্মের উত্থান ইতিহাসের একই ধারাবাহিকতার ফসল। ‘যীশুর জন্য পৃথিবীকে জয় কর’- পাশ্চাত্য সভ্যতার এ মিশন আধুনিকতার পতাকাবাহী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ক্যাথলিক ইনষ্টিটিউটের ব্যারন কারা দ্য ভক্স ১৯০১ সালে ঔপনিবেশবাদীদের অভিযানের উদ্দেশ্যকে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমাদের মিশন মুসলিম বিশ্বকে ভেঙ্গে বিভক্ত করে দেয়া, এর নৈতিক সংহতিকে বিনষ্ট করা… তাই আমাদের মুসলিম বিশ্বের এই বিভেদ প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে হবে যাতে ভৌগলিক জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসার লাভ করে এবং বিভিন্ন মুসলিম জাতিসত্ত্বার মধ্যে অভিন্ন ইসলামী উম্মাহর চেতনা বিনষ্ট হতে থাকে। আমাদেরকে রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, বৃটিশ শাসিত মিশরকে ফরাসী শাসিত সুদান বা মুক্ত আরব উপদ্বীপ হতে সুস্পষ্টরূপে ভিন্ন সত্ত্বা হিসাবে রূপ দান করতে হবে। মিশরকে আমাদের আফ্রিকান ইসলাম ও এশীয় ইসলামের মধ্যে বাধার দেয়াল হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। এক কথায় ইসলাম ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ও মুসলমানদের বিতরকার ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সুফীবাদপন্থী উভয় সম্প্রদায়কে ব্যবহার করতে হবে।–[‘Questions Diplomatique et Colonials, ১৫ মে, ১৯০১, পৃঃ ৫৮৮; মারওয়ান আর বুখারী কর্তৃক উদ্ধৃত ‘Colonial Scholarship and Muslim Revivalism in 1900’, Arab Studies Quarterly, ভলিউম-৪, সংখ্যা ১ ও ২; ১৯৮২, পৃঃ ৫] রাশিয়ার চিন্তাবিদ ও সমাজতাত্ত্বি ইউজিন ডি রবার্ট বলেন যে, ‘ইউরোপকে মুসলিম বিশ্বের অভিজাত ও চিন্তাশীল সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে… ইসলামী বিশ্বে রেলওয়ের ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে এবং ইসলামী বিশেষ ভূখণ্ড ও শিল্পকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ঔপনিবেশিক শিকলে আবদ্ধ করতে হবে… প্রধান মুসলিম বিশ্বশক্তি আটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে’।–[‘Questions Diplomatique et Colonials, ১৫ মে, ১৯০১, পৃঃ ৫৮৮; মারওয়ান আর বুখারী কর্তৃক উদ্ধৃত ‘Colonial Scholarship and Muslim Revivalism in 1900’, Arab Studies Quarterly, ভলিউম-৪, সংখ্যা ১ ও ২; ১৯৮২, পৃঃ ৫]
ঔপনিবেশবাদ এবং অভিজাত শ্রেণীর গঠন ও উত্থান
ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো মুসলমানদের নিজস্ব ভাবমূর্তি এবং আপন সাংস্কৃতিক পরিচয়। এটি সম্ভব হয়েছিল প্রগতি এবং ‘নবজাগরণ’ নামধারী ঔপনিবেশিক নীতির মাধ্যমে, যাকে ‘খ্রীষ্টান’ ও আধুনিক শিক্ষঅ’ এ শব্দদ্বয়ের সমার্থক হিসাবে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃটিশ শিক্ষাবিদ লর্ড ম্যাকলে অভিমত ব্যক্ত করলেন যে, উন্নতমানের একটি ইউরোপীয় লাইব্রেরীর এক শেলফ পুস্তক আরব উপদ্বীপ ও ভারত উপমহাদেশের সমগ্র দেশীয় সাহিত্য ও দর্শন হতে উন্নততর। এই উক্তি বৃটিশ শিক্ষানীতির চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করল যা প্রাচ্য শিক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইংরেজী শিক্ষা চালু করল।–[ দ্রষ্টব্য, D.K Hingoram, ‘Education in India Before and After Independece’, Education Forum, ভলিউম-১৯, নং ২, ১৯৭৭, পৃঃ ২১৮-১৯।] আফ্রিকা বিশেষ করে নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে লর্ড লুগার্ড অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করলেন। সেখানে একইরূপ শিক্ষানীতি চালু হলো। দেশীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংক্রমণ ঘটানোর মাধ্যম হিসাবে শিক্ষানীতিকে ব্যবহার করা হলো। এ শিক্ষানীতির লক্ষ্য স্থির করা হলো বৃটিশ রাঝ্যের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে দেশীয় সমাজের মধ্য হতে একদল কেরানী, অনুগত সহযোগী ও দালাল শ্রেণী সৃষ্টি করা যাতে বৃটিশ সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির শিকড়কে আরো বিস্তৃত করা যায়। লর্ড ম্যাকলে বৃটিশ রাজ্যে শিক্ষানীতির লক্ষকে এভাবে সংক্ষেপে ব্যক্ত করেন যে, ‘এমন একটি শ্রেণী সৃষ্টি কর যারা বৃটিশ শাসকশ্রেণী ও লক্ষকোটি দেশীয় শাসিত শ্রেণীর মদ্যে দোভাষীর কাজ করবে, যে শ্রেণীটি রক্ত ও বর্ণে হবে ভারতীয় কিন্তু রুচি, চিন্তাচেতনা, নৈতিকতা, ধ্যানধারণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে হবে ইংরেজ মানসিকতা সম্পন্ন।–[ দ্রষ্টব্য, D.K Hingoram, ‘Education in India Before and After Independece’, Education Forum, ভলিউম-১৯, নং ২, ১৯৭৭, পৃঃ ২১৮-১৯।]
দেশীয় ধর্মীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রথা বা প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত সকল আইন-কানুন, আচার আনুষ্ঠাতিকতার দেশজ ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করা হলো। ঔপনিবেশিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির পূর্ণ প্রয়োজনের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার আগ্রাসন নীতি অনুসরণ করা হলো ও চাপিয়ে দেয়া হলো।–[ দ্রষ্টব্য, W.A.J. Archibold, ‘Outlines of Indian Constitutional History’, (লন্ডন, কার্জন প্রেস, ১৯২৪); পৃঃ ৭৩।]
ঔপনিবেশিক এই নীতি খ্রিষ্টীয় যাজক শ্রেণী, উদারমতাবলম্বী এবং উপযোগবাদীদের নিকট হতে সার্বিক সমর্থন লাভ করল। ভারতে এ ধরনের শীর্ষস্থানীয় পাদ্রী ব্যক্তিত্ব ছিলেন চার্লস গ্রান্ট, নাইজেরিয়ায় রেভারেন্ড ওয়াল্টার মিলার। ওয়াল্টার মিলার এবং লর্ড লুগার্ড যৌথ উদ্যোগে ‘জারিয়া প্রকল্প’ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রকল্প চালু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল উত্তর নাইজেরিয়ার জারিয়া অঞ্চলের গোত্র প্রধানদের পুত্র সন্তান ও ‘মাল্লাম’ নামধারী শ্রেণীর মধ্যে উল্লেখিত শিক্ষাক্রম চালু করা।–[ A. Balis Fabunwa, ‘History of Education in Nigeria’, (লন্ডন, এলেন এন্ড আনউইন, ১৯৭৪) পৃঃ ১০৩।] ইংরেজী শিক্ষঅ প্রতিষ্ঠানসমূহ পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের সার্বিক সহায়তায় ইসলামী শিক্ষঅ ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত ও ক্রমান্বয়ে ইসলামী শরীয়া ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলো। কোথাও যদি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়া হতো, তা হতো সরকারী অর্থানুকুল্য ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগ। যেখানে সরকারী অর্থ অনুদান প্রদান করা হতো, সেখানে আনুষ্ঠানিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণের মান ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাক্রম চাপিয়ে দেয়া হতো।
সভ্যতার ধারক-বাহক রূপে খ্রিষ্টবাদ, বাণিজ্য ও উপনিবেশবাদ এই ত্রয়ী–[ A. Balis Fabunwa, ‘History of Education in Nigeria’, (লন্ডন, এলেন এন্ড আনউইন, ১৯৭৪) পৃঃ ১০৩।] শক্তির সাফল্য প্রতিভাত হলো মুসলিম সমাজের মদদ্যে হীনমন্যতাবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে। উপনিবেশিক শক্তি শাসিত মুসলিম সমাজ নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে লজ্জা ও হীনমন্যতাবোধ দ্বারা আক্রান্ত ও পরাভূত হয়ে বিজাতীয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মূল্যবোধকে বরণ করে নিলো। মুসলিম সমাজ উপনিবেশবাদীদের অনুকরণে তাদের জীবনধারার অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হলো। পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদীদের সমাজ মডেলের অনুসরণে নিজেদের সমাজ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় মেতে উঠল। এ পরিস্থিতিকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু : বিজিত ভারতীয়দের জীবনের চরম উচ্চাশা হিসাবে স্থির হলো বিজয়ী ইংরেজদের চোখে সম্মানিত হিসাবে পরিগণিত হওয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজদের কাতারে একটু স্থান করে নিতে পারা। সমরাস্ত্র বা কুটনীতির চেয়েও ভারতে বৃটিশদের এটাই সবচেয়ে বড় বিজয়।–[ জওহরলাল নেহেরু, (নিউইয়র্ক, জন ডে, ১৯৪১), পৃঃ ২৬৪] সামগ্রিকভাবে উপরোক্ত বক্তব্যটি আফ্রিকা ও মুসলিম বিশ্বের জন্য সমভাবে সত্য। মুসলিম সমাজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক বিদঘুটে মিশ্রণে পরিণত হলো- ফলে বহিঃবিশ্বের কোথায়ও সে খাপ খাইয়ে নিতে পারল না এবং স্বদেশে হলো পরবাসী।
একজন মুসলমান যতবেশী পশ্চিমা আদলে নিজকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করলো, সে প্রকৃতপক্ষে ততবেশী বর্বরে পরিণত হলো। তার জীবন পরিণত হলো তার অতীত হতে বিচ্ছিন্ন শিকড়ে, পাশ্চাত্যের আচার আচরণের বিকৃত জগাখিচুড়ীতে। তার পরিণতি হলো না ইসলামী, না পশ্চিমা –যাকে আধুনিক যুগের সাংস্কৃকিত বর্বরতার জলজ্যান্ত নজীর হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।–[ ইসমাইল রাজী আল ফারুকী, ‘Islamization of Knowledge: General Principles and Workplan’ (মেরীল্যান্ড, International Institute of Islamic Thought, 1982), পৃঃ ৫]
প্রকৃত প্রস্তাবে বলা যায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই সার্বিকভাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল –বাকী বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর এর প্রভাব শুধুমাত্র সামান্য প্রলেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যুগ যুগান্তরের পিরামিড সদৃশ কৃষক সমাজের বিশাল ভিত্তিতে পাশ্চাত্য প্রভাবের কোন ছোঁয়া লাগে নি। প্রথম থেকেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গকে উচ্চতর ইংরেজী শিক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হতো এবং তাদের ঔপনিবেশিক আইন ও নীতিশাস্ত্রে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হতো। পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারা একদল নব্য অভিজাত শ্রেণী গড়ে তোলা হল। ইংরেজী শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর উপর পাশ্চাত্য শিক্ষাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সমূহ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হলো।
ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক নেতৃত্ব শ্রেণীকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হলো। আইন ও ফিকাহ শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ উলেমা শ্রেণীকে পাশ্চাত্য আইন শাস্ত্রে শিক্ষিত দেশীয় শ্রেণীবর্গ দ্বারা উৎখাত করা হলো। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও লালিত স্থানীয় নেতৃত্ব শ্রেণীকে সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়া হলো। এরাই কালক্রমে উপনিবেশবাদীদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী উত্তরসূরীর ভূমিকা পালন করে। এই শ্রেণীই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মুসলিম সমাজের পাশ্চাত্যকরণ প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তী অস্ত্রে পরিণত হলো। উল্লেখিত শ্রেণীর সমাজে উদারনৈতিক চিন্তার বীজ বপন ও সমধর্মী প্রতিষ্ঠান সমূহের গোড়াপত্তন করে। এসব চিন্তাচেতনা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোকে তারা সংবিধানের মাঝে অঙ্গিভূত করে। আরো যেসব বিষয়ে তারা সামাজিক বুনিয়াদ তৈরী করল তা হলোঃ
ক. জাতীয়তাবাদী নীতিমালা ব্যক্তি মানুষকে সার্বিক ও শর্তহীনভাবে সমাজ কাঠামোর মূলে আত্মোৎসর্গের আহবান জানায়;
খ. জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণার প্রবর্তন এবং এর ভৌতকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর ভিত্তি স্থাপন;
গ. ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুসৃত নীতি পরিণামে দেশীয় অর্থনীতিকে পাশ্চাত্য অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করে এবং নির্ভরশীল করে তোলে;
জাতীয়তাবাদ
ভূখণ্ড, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা ইত্যাতি বিভিন্ন উপাদান মিলে গঠিত জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী দুনিয়ায় পরিচিত পরিভাষা হিসাবে স্থান পায়নি। এক মানবজাতি হিসানে মানুষে মানুষে যে প্রকৃতিগত গভীর বন্ধন রয়েছে তাকে জাতীয়তাবাদ ছিন্ন করে দেয়। জাতীয়তাবাদ মানবজাতিকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করে। একই ধর্ম বিশ্বাস উম্মতকে খণ্ড খণ্ড করে উপস্থাপন করে। কৃত্রিম সীমান্ত রেখা গড়ে তোলে। এতদসত্ত্বেও ঔপনিবেশবাদের পথ ধরে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বে ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব বিস্তার করে এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন নেয়। কেননা এ তত্ত্ব তাদের কিছু উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক ছিল। “একটি সমাজের ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত বিশেষ ধরনের অভিজাত শ্রেণীগোষ্ঠীর জন্য এই লক্ষ্য পূরণ ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ”।–[ জে.এন. রোজমেন সম্পাদিত, International Politics and Foreign Affairs’ (লন্ডন, Colliers Macmillan, ১৯৬৯); পৃঃ ২৭] মুসলিম বিশ্বকে খণ্ড বিখণ্ড করা ও ইসলামের ধর্মীয় একত্বকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার জন্য জাতীয়তাবাদ ছিল ঔপনিবেশবাদীদের হাতের শক্তিশালী অস্ত্র। পশ্চিমা ধ্যান ধারণাপুষ্ট স্থানীয় নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত প্রভাবশালী শ্রেণীসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি ও গণ আন্দোলন পরিচালনার জন্য জাতীয়তাবাদী ধারণাকে ব্যবহার করে। জাতীয়তাবাদ এভাবে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকটি জাতীয় রাষ্ট্রের নিজস্ব সীমান্ত, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিজস্ব স্বার্থ বলয় গড়ে উঠল। এ ধরনের রাষ্ট্রসমূহ ভৌগোলিক, অর্থনৈকিত বা যোগাযোগ ব্যবস্থার সামঞ্জস্য সঙ্গতির কোন তোয়াক্কা না করেই বেঙের ছাতার মত বেড়ে উছল। ফলে একই সমাজভুক্ত একই জাতিসত্তার মুসলিম জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভক্ত হয়ে পড়ল। এভাবে জাতিসত্তার মুসলিম জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভক্ত হয়ে পড়ল। এভাবে আফ্রিকার হাউসা ও ফুলানী মুসলমানরা নাইজার, নাইজেরিয়া, শাদ রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হলো। এর পরিণতি দাঁড়াল মানুষ তার জাতিগোষ্ঠী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। জাতিসমূহ ঘন ঘন সংঘর্ষ ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল। ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি নিঃশেষিত হতে লাগল। এসব মুসলিম রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা, দুর্বলতা ও সার্বক্ষণিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার প্রবণতা এ সাক্ষ্যই বহন করে যে, এসব দেশ দেশজ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তি ছাড়াই কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও ক্ষমাতাসীন শাসকগোষ্ঠী এ সব জাতীয় রাষ্ট্রের সীমান্ত রেখা জনগণের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য কোন যৌক্তিকতা বহন করে কিনা এ প্রসঙ্গে কখনো কোন আত্মসমীক্ষা বা প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। অভ্যন্তরীণ শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদী বহিঃশক্তির সমর্থনের মধ্য দিয়ে এসম জাতীয় রাষ্ট্রের কোনটিই তাদের জনগণের কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বরং বৃহৎশক্তিবর্গের আধিপত্যবাদের এ যুগে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ তৃতীয় শ্রেণীর করদরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহ
এসব রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর প্রধান কর্মকাণ্ড ও লক্ষ্য থাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক নীতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা নির্বাচন পদ্ধতি, প্রচার মাধ্যম ও সরকারের তিনটি অঙ্গের পুনরাবৃত্তিক পরিচালনা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিচালনার মধ্য দিয়ে স্বীয় স্বার্থ হাছিল করা। এটা সবাইর জানা যে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল স্তম্ভের মত এসব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগ্রলোকে ইউরোপ হতে এনে উপনিবেশসমূহে স্থাপন করা হয়েছে। এসব জবরদখলকৃত উপনিবেশগুলিতে স্থাপিত পাশ্চাত্যের পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহে চাপিয়ে দেয়া, ওয়েষ্টমিনিস্টার মডেলের প্রতিস্থাপন হাস্যকর অনুকরণের জলন্ত নমুনা মাত্র। উপনিবেশসমূহে কখনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। ভোট প্রদানের অধিকার ছিল সীমিত, নিয়ন্ত্রিত এবং প্রায়শই নির্দিষ্ট দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য কারচুটি করা হতো।
সমগ্র আইনসভা নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল একটি সুপরিকল্পিত প্রতারণা… বিচার ব্যবস্থা ছিল এমন যা সমস্ত স্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যা করত।… প্রশাসনিক বস্তুনিষ্ঠতা ছিল উপনিবেশবাদীদের নিজ দেশে জনগণের অধিকারের গ্যারান্টি। এ গ্যারান্টি উপনিবেশসমূহে পরিণত হয়েছিল জনগণের পায়ের শিকলে। যে গণমাদ্যম উপনিবেশবাদীদের নিজ দেশে জনমত প্রকাশের বাহন তা তাদের অধিকৃত উপনিবেশ সমূহে বিজিত বুদ্ধিজীবী সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।–[ গওহর, ‘Islam and Secularism’ পৃঃ ৩০৩]
ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথেষ্ট ব্যবহারে দীক্ষা লাভ করে নব স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের শাসকবর্গ উপলব্ধি করল যে, এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ বাঁচিয়ে রাখার মধ্যেই তাদের ক্ষমতা অব্যাহত রাখার রক্ষাকবচ নিহিত রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এসব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সাথে শাসকবর্গের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বিধায় এসব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের যে কোন প্রচেষ্টা তাদের পক্ষ হতে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতো। ফলে এসব ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাসমূহ নব্য স্বাধীন দেশসমূহে ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার হিসাবে আবারো জাঁকিয়ে বসল।
মুসলিম দেশসমূহে নির্বাচন একটি দুষ্ট প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক পক্ষ বিরোধীদলকে দমিয়ে রাখে, জনগণের উপর দমননীতি পরিচালনা করে ও নিজেদের প্রার্থীদের ভোট প্রদানে বাধ্য করে, রাজনৈকিত সভায় গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়, ভোট কারচুপি ও বাক্র ছিনতাইয়ের মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থীদের জিতিয়ে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ভোটের রায় পাল্টে দেয়ার জন্য সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে। আলজেরিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচন এর জ্বলন্ত উদাহরণ। পশ্চিমা গণতন্ত্রে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে যে প্রক্রিয়া ও মনোভাব রয়েছে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম দেশসমূহের বর্তমান শাসকবর্গের নিকট হতে প্রত্যাশা করা যায় না। ফলশ্রুতিতে নির্বাহী বিভাগের উপর আইনসভার যে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা তা লক্ষ্য করা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনসভা ভেঙ্গে দেয়া হয় অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য পার্লামেন্টের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি অথবা সামরিক শাসকদের মনমত লোকদের নিয়ে পার্লামেন্ট গঠন করা হয়। সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠিত হয়, সে পার্লামেন্টের ক্ষমতা এতই সীমিত যে তাকে শুধুমাত্র শাসকবর্গের সিদ্ধান্তসমূহকে অনুমোদনের রাবার স্ট্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
এসব দেশে নাগরিক অধিকার বিপুলভাবে খর্ব করা হয়েচে। সংবাদপত্র সেন্সরশীপের মাধ্যমে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত সমালোচনা করার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। সংবাদ পত্রের উপর খড়গহস্তের নীতিতে অবাধ সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। স্বেতশুভ্র উইগ পরিহিত বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দকে শাসকবর্গের যে কোন নীতি ও সিদ্ধান্তকে আইনসঙ্গত হিসাবে রূপ দেয়ার জন্য উদ্বিগ্ন দেখা যায়। সরকার এ শ্রেণীর বিচারকদেরকে স্বীয় স্বার্থে পৃষ্ঠপোষকাত করে। শাসকবৃন্দ ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এতবেশী শ্রম ও শক্তি ব্যয় করে যে জনগণের কল্যাণের জন্য স্বল্প সময়ই অবশিষ্ট থাকে। জনগণ বহুস্তর বিশিষ্ট এবং স্বীয় স্বার্তকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্রের মোকাবেলায় অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করে। এ শাসন পদ্ধতি সর্বব্যাপ্ত ক্ষমতার মদমত্ততায় বিনা চ্যালেঞ্জে অগ্রসর হতে থাকে। জনগণের জন্য রাজনীতির এই পাশাখেলা সামান্যই বয়ে আনতে পারে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
অর্থনীতিতে শাসক শ্রেণী পশ্চিমা মডেলকেই অধিক পসন্দ করে। এ অর্থনীতির মোদ্দা কথা হচ্ছে শিল্পোন্নয়ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবৃদ্ধির উচ্চহার অর্জন কিন্তু মানুষের বস্তুগত ও সামাজিক পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে এ অর্থনীতির অবদান সন্তোষজনক বলে মনে হয়নি।
৫২টি মুসলিম দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের পরিসংখ্যান মুসলিম বিশ্বের দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরেছে। বৃহৎ আরববিশ্বের ১৪ মিলিয়ন কিলোমিটার ভূখণ্ড ও আফ্রিকার মুসলিম দেশসমূহের ৫.৮ মিলিয়ন কিলোমিটার ভূমি। অথচ বর্ণিত এ মুসলিম দেশগুলোর সামষ্টিক জিএনটি এবং জিডিপি এর হার হচ্ছে যথাক্রমে ৭৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৭৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের বাৎসরিক মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ মাত্র ১০০০ মার্কিন ডলার যা অনুন্নত দেশের পর্যায়ভুক্ত। আরব, এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশসমূহের ১৯৯১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার শ্রমশক্তির পরিমাণ যথাক্রমে ১৭% , ৫৩% এবং ৩৩%। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষিতে কাজ করে। কোন মুসলিম দেশই প্রকৃত অর্থে শিল্পোন্নত দেশ নয়। আফ্রিকার মুসলিম দেশসমূহে শিল্পক্ষেত্রে গড়ে ১০% এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে গড়ে ২০% লোক শিল্পক্ষেত্রে কাজ করে। অর্থনীতির আন্তর্জাতিক স্তরবিন্যাসে অধিকাংশ মুসলিম দেশকে মাথাপিছু স্বল্প আয়ের দরিদ্র দেশ হিসাবে অভিহিত করা যায়। এসব দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কম প্রবৃদ্ধির হার, উচ্চ নিরক্ষরতার হার, স্বল্প গড় আয়ুর অবস্থা বিরাজ করে এবং দেশগুলি নগরায়নের দিক থেকে মাঝামাঝি মাত্রার (পরিশিষ্ট-সি-দ্রষ্টব্য)।
সাধারণভাবে বলা যায় স্বাধীনতা লাভের তিন দশক পরেও মুসলিম দেশসমূহ অর্থণৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করতে পারেনি। অপরদিকে দারিদ্র্য বেড়েছে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে, কৃষিখাত ধ্বংসের মুখে এবং ক্রমবর্ধমান হারে ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়ছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পারিবারিক বন্ধক শিথিল হয়েছে এবং জৈবিক অনাচার বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে যে উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে তা বস্তুত নগরকেন্দ্রিক অপরাধ।
পতিতাবৃত্তি, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অন্যান্য অবক্ষয়ে পর্যবসিত হয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায় মুসলিম জগগোষ্ঠী শুধুমাত্র দারিদ্র্য দ্বারাই পীড়িত হয়নি বরং তারা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শিকড় হতেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উৎসাহব্যঞ্জক শুধু এটুকু যে, তারা তাদের দুর্দশা সম্পর্কে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে এবং তথাকথিত এ আধুনিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করছে।
উপসংহার
ধর্মনিরপেক্ষতাবদা এখন ক্রমেই সচেতন আক্রমণের মুখে। মুসলিম দেশসমূহ ক্রমেই ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে মোহমুক্ত হয়ে উঠছে। তারা উপলব্ধি করছে যে এ ধরনের বিজাতীয় আদর্শ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ মুসলিম সমাজের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মুসলিম সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন মিটাতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সমর্থ হয়নি। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির যথার্থতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ যে শুধুমাত্র গভীর আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, ঐতিহ্যবাহী জীবন যাত্রায় ভাঙ্গন ও আধ্যাত্মিক মুসলিম মানসে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে সে উপলব্ধির জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমে পশ্চিমা মডেল ও ধ্যানধারণার অনুকরণ একটি ক্ষুদ্র এলিট বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যারা ক্ষমতায় আরোহন করে সে অন্ধ অনুকরণকে জাতীয় জীবনের সকল অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে এবং এভাবে তারা পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদারে পরিণত হয়ে বৃহত্তর সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছে। এ স্বার্থভোগী এলিটশ্রেণী পশ্চিমা শিক্ষা-দীক্ষা অনুযায়ী চলতে গিয়ে মুসলিম জাতিসত্তা, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি চেতনা সকল কিছুকে অবক্ষয় ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের সম্মুখে আজকের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজের স্বকীয়তাকে পুনঃ চিহ্নিত করা এবং নিজের ভাগ্যকে পুনঃ নির্মাণ করা। এজন্য প্রয়োজন মুসলমানদের নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিশ্বাসের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও পুনঃ আস্থা স্থাপন। এজন্য আজকের প্রয়োজন পশ্চিমা ধ্যান ধারণার সুষ্ঠু জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে শরিয়ার আলোকে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নতুন সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করা। ১৯৯৪ সালে তুরস্কের মিউনিসিপ্যালিট নির্বাচনে মুসলিম পার্টি ও আলজেরিয়ার সংসদ নির্বাচনে ইসলামিক কমিউনিজমের ব্যর্থতা এবং কমিউনিস্ট চিন্তাধারা কর্তৃক ‘আফিম’ বলে আখ্যায়িত ধর্মের বিজয় ঘোষিত হয়েছে।