৯
বাংলার বিখণ্ডকরণ
১৯০৫ সালে ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলা জোড়া লেগেছিল ৭ বছর পর ১৯১১ সালের শেষ দিনটিতে এসে। তারপর বাংলা বিভাগের কথা প্রথম উচ্চারিত হলো ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের কণ্ঠে। ১৯৪৬ সালের ১৬ই এপ্রিল মিশন এক দরকষাকষি বৈঠকে বসেছিল জিন্নার সাথে। তারা বলেছিল, পাকিস্তানের জন্যে দাবীকৃত পুরো এলাকা এবং পুরো স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব –এই দুই জিনিস জিন্নাহ একসাথে কিছুতেই পাবেন না। হয় সর্বভারতীয় ইউনিয়নের অধীনে দাবীকৃত পুরো এলাকা নিয়ে পাকিস্তান ফেডারেশন গঠনে রাজী হতে হবে, নয়তো খণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাব নিয়ে খণ্ডিত পাকিস্তানে তাকে রাজী হতে হবে, যা হবে পুরো স্বাধীন ও সার্বভৌম। জিন্নাহ তখন পুরো স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বদলে সর্বভারতীয় ইউনিয়নের অধীনে পাক্সিতান ফেডারেশন গঠনকেই পছন্দ করেছিলেন, তবু বাংলা ভাগে তিনি রাজী হননি।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 132] কিন্তু জিন্নাহ রাজী না হলেও বাংলা বিভাগের দাবী উঠল কংগ্রেস ও হিন্দু এলিটদের তরফ থেকে ১৯৪৭ সালের শুরু থেকে। অথচ এই কংগ্রেস এবং এই হিন্দু এলিটরাই ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হলে স্বরাজ ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে বৃটিশকে বঙ্গভঙ্গ রহিত করতে বাধ্য করেছিল। কারণটা পরিস্কার। বৃটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় কোলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দু এলিটদের জমিদারী পূর্ববঙ্গকে পায়ের তলায় রাখা এবং তার উপর শাসন শোষন কায়েম রাখার জন্যে অখণ্ড বাংলার তখন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বৃটিশ শাসনমুক্ত স্বাধীন পরিবেশে এই শোষণ শাসন সম্ভব নয় বলে এবং অখণ্ড বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয়ে সেই কংগ্রেস ও হিন্দু এলিটরা বাংলা ভাগে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। খণ্ডিত পাকিস্তান টিকবেনা –এ ধারণাও তাদের বাংলা বিভাগ দাবীর একটা মৌল কারণ হিসেবে কাজ করে। শরৎ বসু ও কিরণ শংকরের মত দু’কজন হিন্দু নেতা অখণ্ড বাংলার পক্ষে কাজ করেছেন। কিন্তু সেটা তাদের একান্তই ব্যক্তিগত, তাদের দল ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করেননি। তাই কারও সাহায্য সহযোগিতা তাঁরা পাননি। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে অখণ্ড বাংলা প্রশ্নে কোন মতনৈক্য ছিল না। কিছুটা মতবিরোধ ছিল ‘বাংলা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে, না অখণ্ড স্বাধীন বাংলা পাকিস্তানের অংশ হবে’ –এই প্রশ্ন নিয়ে। বলা যায়, অখণ্ড ভারত ও ভারব বিভাগ প্রশ্ন নিয়ে সর্বভারতীয় পর্যায়ে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই দ্বন্দ্বই হিন্দুরা মিনি আকারে সৃষ্টি করেছিল বাংলা প্রদেশে। ফল হিসেবে ভারত বিভাগের মতই বাংলা বিভাগ হয়ে উঠেছিল অপরিহার্য।
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলার ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ১১৩টিতে জয়ী হবার পর কংগ্রেস এবং বাংলার হিন্দু এলিটরা দেওয়ালের এ লিখন পড়ল যে বাংলার মুসলিম জনগণের উপর হিন্দু আধিপত্যের দিন শেস হয়ে গেছে। এরপর বাংলা সহ ভারতে একটি মুসলিম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি যখন ১৯৪৭ সালের শুরু থেকে একটা অদম্য রূপ পরিগ্রহ করল, তখন বাংলার হিন্দু এলিটরা এবং তাদের সংগঠনগুলো বাংলা ভাগের জন্যে সোচ্চার হয়ে উঠল। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতা ডাঃ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭, বাংলার গভর্ণর ফ্রেডারিক বারোজ-এর সাথে দেখা করে এক বিবৃতিতে বললেন, ভারত যদি ভাগ হয়, তাহলে বাংলাও ভাগ করে হিন্দু সংখ্যাগুরু অঞ্চল আলাদা করতে হবে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 8.] এর পক্ষকাল পরে অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য কৃপালনী বাংলা বিভাগ দাবী করে বিবৃতি দিলেন।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 8. (সিরাজ উদ্দীন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। তার গ্রন্থটি ১৯৭০ সালের অক্টোবর প্রকাশিত হয়)।] ২৯শে মার্চ, ১৯৪৭ বাংলার রাজা-মহারাজা শিরীষচন্দ্র নন্দী, বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদ মহাতব, মহারাজা প্রবোধচন্দ্র ঠাকুর, মহারাজা কুমার সীতাংশু কান্তা, আচার্য চৌধুরী প্রমুখ। তারা বাংলা বিভাগের পক্ষে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করলেন।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৩৪।] তারকেশ্বরে বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৪৭ সালের ৫ই এপ্রিল। সম্মেলন শ্যামা প্রসাদকে বাংলায় পৃথক হিন্দু আবাসভূমি গড়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব দান করল এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, ৩০শে জুনের মধ্যেই এই লক্ষ্যে ১লাখ স্বেচ্ছাসেবক তৈরী করা হবে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 9.] মুসলমানদের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। বাংলার প্রধানমন্ত্রী মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী ৮ ও ৯ই এপ্রিল পরপর দুইটি বক্তব্য দিলেন। বাংলা-ভাগ দাবীর তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন, আমি অখণ্ড ও বৃহত্তর বাংলার পক্ষে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 10.] ঠিক এপ্রিলের এই ৯ তারিখেই বাংলার ভূমি ও জেলমন্ত্রী মুসলিম লীগ নেতা ফজলুর রহমান অখন্ড ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার দাবী করে বললেন যে, এটা হিন্দু-মুসলমান উভয়ের জন্যে কল্যাণকর হবে। আর যদি হিন্দুরা এভাবে থাকতে না চায় তাহলে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশ, যা হবে কায়েদে আযমের পরিকল্পনা অনুসারে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র, ছেড়ে দিয়ে গোটা ভারত তারা নিয়ে নিক। লোক বিনিময়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধান করা যাবে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page ১১.] মন্ত্রী ফজলুর রহমান স্বাধীন স্বার্বভৌম অখণ্ড বাংলা দাবী করার একদিন পর ১১ই এপ্রিল বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় আইন-পরিষদের ১১ জন হিন্দু সদস্য ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে বাংলার পশ্চিম ও উত্তর অংশে দু’টি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবী করে স্মারকলিপি পেশ করলেন।‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page ১২.]
একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয়, বাংলার ভূমি ও জেল মন্ত্রী ফজলুর রহমানই প্রকাশ্যে প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার দাবী করলেন। ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশে দুইটি স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমির কথা বলা হয়েছিল। পরে ১৯৪৬ সালের কনভেনশনে মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব সংশোধন করে একক একটি মুসলিম আবাসভূমির প্রস্তাব করে। পরবর্তীকালে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি গ্রুপ বাংলাকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাখার পক্ষে মত পোষণ করতে থাকেন। এমনকি দিল্লী কনভেনশনে ভারতের পূর্বে ও পশ্চিমে একক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যিনি প্রস্তাবক ছিলেন, সেই সোহরাওয়ার্দীও পরে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা গঠনের কথা বলেন। যা হোক, মন্ত্রী ফজলুর রহমান এই গ্রুপেরই একজন এবং তিনিই সর্বপ্রথম অখণ্ড স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার দাবী ঘোষণা করলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার দিল্লী প্রস্তাব অনুসারে লীগ সভাপতি মিঃ জিন্নাহ এর প্রতিবাদ করার কথা ছিল, কিন্তু এর প্রতিবাদ না করে এর প্রতি সমর্থনই দান করলেন। এপ্রিলের শেষ দিকে জিন্নাহ পাঞ্জাবে মুসলিম লীগের সরকার গঠন প্রশ্ন নিয়ে মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে দেখা করেছিলেন। পাঞ্জাব নিয়ে আলোচনা কালে মাউন্ট ব্যাটেন কতকটা অপ্রাসঙ্গিকবাবেই জিন্নাহকে বললেন, “সুরাবর্দী (সোহরাওয়ার্দী) এবং তার বন্ধুরা ‘স্বাধীন বাংলা’ গঠন করার চেষ্টা করছে। ‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ সম্বন্ধে আপনার কি মত? অবশ্যি স্বাধীন বাংলা পাকিস্তানের বাইরে থাকবে’। এর জবাবে জিন্নাহ কোন সংকোচ না করে বললেন যে, ‘বাংলা স্বাধীন হলে আমি খুশী হব। কলকাতা ছাড়া বাংলার মূল্য নেই। তারা (বাঙ্গালীরা) যদি একত্র থাকে এবং অখণ্ড বাংলা গঠন করে, তাহলে তারা নিশ্চয় আমাদের সাথে সদ্ভাব রাখবে’। মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নাহকে বললেন, সুরাবার্দী বলেছেন যে, বাংলা স্বাধীন এবং অখণ্ড পৃথক দেশ হিসেবে কমনওয়েলথের ভেতরে থাকতে চায়’। জিন্নাহ জবাব দিলেন, ‘নিশ্চয় আমিও পাকিস্তানকে কমনওয়েলথের ভেতর রাখতে চাই।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৬৮, ২৬৯, ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস, ওয়ালী খান, পৃষ্ঠা ১১৬, ‘দি গ্রেট ডিভাইড’, এস, ভি, হডসন, পৃষ্ঠা ২৪৬।] এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলা সম্পর্কে জিন্নার চিন্তার সুন্দর, সরল ও সহজ অভিব্যক্তি ঘটেছে। তাঁর এই চিন্তা সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, “বাংলা অবিভক্ত, অখণ্ড দেশ হিসেবে থাকবে এ কথা জিন্নাহ বিশ্বাস করেছিলেন। এই ব্যাপারে তার সহকর্মী লিয়াকত আলী খানও জিন্নার সঙ্গে একমত ছিলেন। লিয়াকত আলী ভাইসরয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী এরিক মিসয়াভিলকে বলেছিলেন যে, তিনি বাংলা ভাগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন না। কারণ তিনি জানেন বাংলা ভাগ করা হবে না, হয়তো বাংলা এক পৃথক দেশ হবে। ….জিন্নাহ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিলেন যে বাংলা এবং পাঞ্জাবকে অখণ্ড রাখতে তিনি পারবেন এবং বাংলা হবে এক ‘স্বাধীন অখণ্ড দেশ”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৬৯।]
কিন্তু কায়েদে আযম জিন্নার এ বিশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হয়নি কারণ হিন্দু ভারতের কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মত সংগঠনগুলো এবং বাংলার হিন্দু এলিটরা তা হতে দেয়নি। এমনকি যেসব হিন্দু এলিটদের উদার, মানবতাবাদী এবং বাংলার জনগণের বন্ধু বলে আমরা জানি, তারাও সেদিন চরম হিন্দুবাদী ও ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালের ২২শে এপ্রিল হিন্দুমহাসভা ও কংগ্রেস নেতা ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ দিল্লীতে একটা মিটিং ডাকেন। এ মিটিং এ ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ এক দীর্ঘ ভাষণে সাম্প্রদায়িকতা খতিয়ান হাজির করে বঙ্গ-ভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যান করেন।–[‘অখন্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭২।] আর এক গুচ্ছ হিন্দু ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানী, যাদের মধ্যে ছিলেন রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকার, ডঃ মেঘনাদ সাহা, ডঃ শিশির কুমার মিত্র ও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যয়, বৃটিশ-ভারত-সচিব লিস্টওয়েলের কাছে পাঠানো এক তারবার্তায় বলেন, ‘দাঙ্গাজনিত জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলার শিক্ষা, বাণিজ্য এবং শিল্প প্রায় ধ্বংসের পথে। বাংলার সাম্প্রদায়িক মন্ত্রীসভা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সম্পূর্ণ অক্ষম। অসাম্প্রদায়িক সরকারের অধীনে জীবনের নিরাপত্তা এবং শিল্প, বাণিজ্য ও শিক্ষার অব্যাহত উন্নতির নিশ্চয়তা বিধানের জণ্যে অবিলম্বে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠনের দাবী জানাচ্ছি। এটা নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে পশ্চিম বাংলার প্রাণ কোলকাতার বিকাশে সাহায্য করবে”।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭২।] হিন্দুমহাসভার মত কংগ্রেসও মরিয়া হয়ে ওঠে বাংলা বিভাগের জন্যে। বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি বাংলা বিভাগ দাবী করে একটি স্মারকলিপি ২৯শে এপ্রিল, ১৯৪৭ ভাইসরয়, নেহেরু ও প্যাটেলের কাছে পাঠায় এবং ৩০শে এপ্রিল তারিখে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক কালিপদ মুখোপাধ্যয় বাংলা ভাগের পক্ষে তদ্বির করার জন্যে দিল্লী যান।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭১।] এই ৩০শে এপ্রিল তারিখেই বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স তার এক বৈঠকে বাংলা বিভাগ দাবী করে। এ সভায় এন, আর, সরকারও অখণ্ড বাংলার প্রচেষ্টাকে বিদ্রুপ করে জিন্নাহ ও সোহরাওয়ার্দীর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘বাংলার হিন্দুগণ হিন্দুপ্রধান অঞ্চল (কোলকাতা সহ) নিয়ে আলাদা একটি প্রদেশ গঠন করবে যা ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিট হবে।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭১।] এই সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলুই আসামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার দাবী করেন এবং বাংলার অখণ্ড স্বাধীনতার বিরোধিতা করে গান্ধীর কাছে নিম্নলিখিত এস, ও, এস, পাঠানঃ ‘বাংলাকে যদি স্বাধীন রাষ্ট্রত্বের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে আসাম কেন্দ্র (দিল্লী) থেকে এবং অন্যান্য সম্মতিদানকারী প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সমুদ্রে তার কোন নির্গমন পথ থাকবে না, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক থেকেই আক্রমণের শিকার হবে। ইউনিয়নের (ভারত রাষ্ট্রের) সাথে আসামকে যোগাযোগ রাখতেই হবে …..সমুদ্রে নির্গমন পথ তাকে পেতেই হবে”।–[‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এস সিদ্দিকী, বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪৮।] ১লা জুন, ১৯৪৭, ভারত বিভাগের যখন চূড়ান্ত মুহুর্ত, কোলকাতায় কংগ্রেস, হিন্দুমহাসভা, নিউবেঙ্গল এ্যাসোসিয়েশন ও অল ইণ্ডিয়া ডিপ্রেসড ক্লাসেস’-একসাথে একটা জঙ্গী সমাবেশের আয়োজন করল। সমাবেশ হিন্দু প্রধান প্রদেশ গঠনের দাবী তুলল। এ সমাবেশে নেতৃত্ব দান করেছিলেন বাংলার খ্যাতিমান ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার। আর কোলকাতায় হিন্দু মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো এক বাক্যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পৃথক প্রদেশ গঠনের জন্যে জনমত তৈরী করছিল।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭৩।]
এক কথায় বাংলার সকল হিন্দু দল ও সংগঠন একযোগে অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার বিরোধিতা করে বাংলা বিভাগ দাবী করল। এর মধ্যে শরৎ বসু, কিরণ শংকরের মত দু’একজন হিন্দু ব্যক্তিত্ব মাত্র অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার পক্ষে কাজ করেছিলেন। তাও কতকটা আধা-গোপন ভাবে। প্রকাশ্যে সভা মিছিল এঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রকাশ্যে বিবৃতিও তারা কম দিয়েছেন। তাদের কাজটা অনেকটা লবী ওয়ার্কের মত ছিল। এ লবী করে তারা বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কিংবা কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতা –কারোরই সমর্থন আদায় করতে পারেননি। এদের কাজও শুরু হয় বিতর্ক শুরু হবার অনেক পর। বাংলার সোদপুরে গান্ধী এলে শরত বসু তাঁর সাথে দেখা করলেন। এটা ৯ই মে, ১৯৪৭ এর ঘটনা। এসময় গান্ধীর সাথে অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার প্রশ্ন নিয়ে আরো অনেকেই দেখা করেন। এর মধ্যে ১০ই মে শরত বসু ও আবুল হাশিম, ১১ই মে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও ভূমিমন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং ১২ই মে মুহাম্মদ আলী ও আবুল হাশিম গান্ধীর সাথে আলোচনা করেন। গভীর আবেগ নিয়েই শরত বাবুরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছিলেন। কিন্তু ফল হয়েছিল শূন্য। গান্ধী বাংলা বিভাগের পক্ষে বা বিপক্ষে তার মত গোপন করে বলেছিলেন যে, দেশ (বাংলা) ভাগ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় তার জন্যে দায়ী থাকবেন এবং সব চাইতে বেশী দায়ী থাকবেন বাংলার মুসলিম লীগ সরকার। ….এক সময় বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সংঘবদ্ধ হয়ে বাংলার একতা রক্ষার উদ্দেশ্যে লর্ড কার্জনকে তার মত পাল্টাতে বাধ্য করেছিল। সোহরাওয়ার্দী যদি বাংলা ও বাংগালীর প্রতি গভীর ভালবাসা আপন অন্তরে ধারণ করে থাকেন, তাহলে তার বক্তব্য অবশ্যই হিন্দু মনকে আনন্দিত ও আশ্বস্ত করবে। কারণ হিন্দু মনকে আজ ভীতি ও সন্দেহ আচ্ছন্ন করে আছে’।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৬১।] এখানে এই বক্তব্যে গান্ধী তার মত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ না করলেও হিন্দুদের বাংলা বিভাগের যুক্তি যে সমর্থন করেন, সে বিষয় মোটেই অস্পষ্ট নয়। এই সময়ের আলোচনা কালে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম গান্ধীকে জানিয়েছিলেন, ‘হাজার মাইল দূর থেকে পাকিস্তান আমাদের শান করবে তা আমাদের জন্যে ঘৃণার ব্যাপার’। এর উত্তরে গান্ধী আবুল হাশিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পাকিস্তান যদি ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাজ্য গঠনের আহবান জানায় তবে কি স্বাধীন বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করবে? এর উত্তরে আবুল হাশিম দিতে পারেননি, চুপ করে ছিলেন। গান্ধী দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি যে বাঙালী সংস্কৃতির কথা বললেন, তার মূল উৎস উপনিষেদ, বর্তমানকালে রবীন্দ্রনাথ তাকে শুধু বঙ্গদেশীয় নয়, সর্বভারতীয় রূপে প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ কি স্বেচ্ছায় ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের জন্য আহবান জানাবে?’ আবুল হাশিম এবারও চুপ করে ছিলেন।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৬১, ১৬২।] গান্ধীর এ দু’টি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বাংলা সম্পর্কে হিন্দুদের চিন্তাধারার গোটাটাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। হিন্দুরা অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলা সমর্থন করতে পারেনি কারণ তারা নিশ্চিত ছিল সংখ্যাগুরু মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলা আসলে হবে মুসলিম বাংলা এবং তার আত্মিক যোগ-সূত্র থাকবে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথেই। গান্ধীর দ্বিতীয় প্রশ্নটাও এই কথাই বলেছে, কিন্তু অন্যভাবে। কারণ বাঙালী হতে হলে তাদেরকে হিন্দু উপনিষদ গ্রহণ করতে হবে এবং গঠন করতে হেব ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্র। এটা মুসলমানরা পারবে না। পারবেনা যে আবুল হাশিমের নীরবতাই তার প্রমাণ। আবুল হাশিম নীরব ছিলেন, কিন্তু ক্রুব্ধ হয়েছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। গান্ধী সোহরাওয়ার্দীকে বাংলা সংঘটিত প্রতিটি মৃত্যুর জন্যে দায়ী করলে সোহরাওয়ার্দী সমস্ত গোলযোগের স্রষ্টা হিসেবে গান্ধীকে দায়ী করেন এবং পরে বাইরে এসে বলেন, ‘কি অদ্ভুত লোকঙ কি বলছেন তাতে তাঁর কোন পরোয়া নেই’।–[Mahatma Gandhi’, The Last Phase’, by Pyarelal, vol-2]
শরত বসুও গান্ধীর সাথে আলোচনায় কোন সুবিধা করতে পারলেন না। পরে ১২ই মে তিনি নিজ উদ্যোগেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার ছয়দফা নীতিমালা ঘোষণা করলেন। নীতিগুলো হলোঃ ১) বাংলা হবে সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ২) প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র প্রণীত হবার পর আইনসভার নির্বাচন হবে এবং নির্বাচন হবে যুক্ত নির্বাচন ভিত্তিক, ৩) বাংলার আইনসভা ঠিক করবে অবশিষ্ট ভারতের সাথে তাদের কি সম্পর্ক হবে, ৪) বর্তমান মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা বাতিল হবে এবং অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে, ৫) বাংলার প্রশাসন বাঙ্গালীর দ্বারা পরিচালিত হবে এবং হিন্দু ও মুসলমানের অংশ হবে সমান সমান, ৬) কংগ্রেস থেকে ৩০ এবং মুসলিম লীগ থেকে ৩১ জন সদস্য নিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থা গঠিত হবে।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৬৩।]
শরতবাবু তার এই নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে ২০শে মে, ১৯৪৭ তাঁর বাসভবনে এক ভোজসভায় আয়োজন করলেন। এই আলোচনায় অংশ নিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মুহাম্মদ আলী (বগুড়া), মন্ত্রী ফজলুর রহমান, কিরণ শংকর রায়, সত্যরঞ্জন বকশী এবং শরতবাবু নিজে। আলোচনা শেষে শরতবাবুর নীতিমালা সামনে রেখে স্বাধীন সার্বভৌম বাংরার জন্যে নতুন একটা ফর্মূলা তৈরী হলো। বলা হলোঃ (১) বাংলা হবে একটা স্বাধীন দেশ। (২) হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের আসন সংখ্যা সংরক্ষণ করে যুক্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মুক্ত বাংলার নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। জনসংখ্যা অনুপাতে হিন্দু ও তপশীলি সম্প্রদায়ের প্রদত্ত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পান এবং অন্য সম্প্রদায়ের ২৫% ভোট পান, তাহলে তাকে নির্বাচিত ঘোষনা করা হবে। যদি কোন প্রার্থী এরূপ শর্তপূরণে ব্যর্থ হয়ে শুধুমাত্র তার সম্প্রদায়ের ব্যাপক ভোট লাভ করেন, তাহলে তাকেও নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। (৩) স্বাধীন বাংলার এরূপ প্রস্তাব মহামান্য রাজা মেনে নিয়েছেন বা বাংলা ভাগ করা হবে না এরূপ ঘোষণা তিনি করলে মন্ত্রীসভা সমান সংখ্যক (প্রধানমন্ত্রী বাদে) হিন্দু মুসলিম (তপসিলীসহ) সদস্য নিয়ে গঠন করা হবে। এই মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী হসেব একজন মুসলমান এবং স্বরাষ্টমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু। (৪) নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী আইনসভা ও মন্ত্রীসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত হিন্দু (তপসিলী সহ) ও মুসলিমদের মধ্যে থেকে পুলিশ ও মিলিটারীসহ সমস্ত চাকুরীতে সমান সংখ্যক লোক নিয়োগ করা হবে। (৫) ৩০ জন সদস্য নিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী গণপরিষদ গঠন করা হবে যার ১৬ জন সদস্য হবেন মুসলমান এবং ১৪ জন হবেন হিন্দু।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৬৪, ১৬৫।]
এ ফর্মূলা প্রণীত হবার পর শরৎ বাবু এ বিষয়টি প্রথমেই জানালেন গান্ধীকে একটা চিঠির মাধ্যমে। এখানে লক্ষণীয়, শরত বাবু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করছেন না, যোগাযোগ করছেন গান্ধীর সাথে যিনি তখন কংগ্রেসের দায়িত্বে ছিলেননা এবং তখনকার চলমান ঘটনা প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের সাথেও শরতবাবুর আনুষ্ঠানিক আলোচনার কোন খবর পাওয়া যায়নি। যা হোক, শরত বাবু ২৩শে মে ১৯৪৭, গান্ধীকে যে চিঠি লিখলেন তাতে বলা হলো, “গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় (২০শে মে) আমার বাড়ীতে একটা আলোচনা সভা হয় …..আমরা পরীক্ষামূলক একটা প্রস্তাবে রাজী হয়েছি, এর সাথে তার একটা কপি আপনার বিবেচনার জন্যে পাঠানো হলো। সত্যায়িত করার জন্যে অন্যদের উপস্থিতিতে এতে আবুল হাশিম ও আমি দস্তখত করি। অবশ্য অনুমোদনের জন্য এ প্রস্তাবকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সামনে পেশ করতে হবে। …..যদি আপনার সাহায্য, উপদেশ ও নির্দেশে দু’টি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষামূলক এগ্রিমেন্টের ভিত্তিতে একটা চূড়ান্ত মতৈক্যে পৌঁছাতে পারে, তাহলে আমরা বাংলার সঙ্গে আসামের সমস্যার সমাধান করতে পারবো”।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দিকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪৪, ১৪৫।)]
পরদিন অর্থাৎ ২৪শে মে তারিখে গান্ধী এর জবাব দিলেন। লিখলেন, “খসড়াটিতে প্রতিশ্রুতিমূলক এমন কিছু নেই যাতে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা কিছু করা যাবে না। সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা এবং আইন প্রণয়নের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে থাকতে হবে অন্ততঃপক্ষে হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন। এই স্বীকৃতিও তাতে থাকা উচিত যে, বাংলার রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে বিধৃত এক অভিন্ন সংস্কৃতি, মূল যার নিহিত আছে উপনিষদের দর্শনে”।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দিকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪৪, ১৪৫।)]
লক্ষণীয়, গান্ধী এই চিঠিতে নতুন কিছু বললেন না। কোলকাতায় সোদপুরে তিনি সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিমকে যে কথা বলেছিলেন সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। অর্থাৎ বাংলার মুসলমানদের সংখ্যাগুরত্বের পাশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতা এবং বাংলার মুসলমান কর্তৃক বাংলার অভিন্ন সংস্কৃতি হিসেবে হিন্দু উপনিষদকে গ্রহণ করার প্রশ্নই আবার গান্ধী তুললেন। আর বোধ হয় তিনি চেয়েছিলেন এ দু’টির মধ্যে একটা গভীর যোগসূত্র সৃষ্টি করতে। যেমন, মুসলমানরা বাংলার অভিন্ন সংস্কৃতি হিসেবে যদি হিন্দু উপনিষদকে গ্রহণ করে, তাহলেই হিন্দু সংখ্যালঘুরা মুসলমানদের ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারে, নিরাপদ বোধ করতে পারে। সোজা কথায়, মুসলমানরা মুসলমান থাকা অবস্থায় হিন্দুরা নিরাপদ বোধ করতে পারে না। গান্ধীর এ এক অসম্ভব শর্ত।
শরতচন্দ্র বোস আবুল হাশিমের সাথে পরামর্শ করে গান্ধীর এ চিঠির জবাব দিলেন। বললেন, ‘সরকারের শাসন কার্য পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে অন্ততঃপক্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সহযোগিতা থাকতে হবে –আপনার এই প্রস্তাবের ব্যাপারে শহীদের (সোহরাওয়ার্দীর) সঙ্গে আলোচনা করতে পারিনি। আজ বিকেলে প্লেনে করে সে দিল্লী যাচ্ছে। আমি যদি দিল্লী আসি, সেখানে তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। শহীদ ও ফজলুর রহমান এই শর্তগুলো নিয়ে জিন্নাহ ও তার ওয়ার্কিং কমিটির সাথে আলোচনা করবে। তাদের সাথে আমার যে সব কথাবার্তা হয়েছে, তাতে বুঝতে পেরেছি বাংলাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যদি একটা সমঝোতায় আসতে পারে, তাহলে জিন্নাহ পথের বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দীকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪২, ১৪৩)।]
কিন্তু শরৎবসু-আবুল হাশিম ফর্মূলাটি কংগ্রেস কমিটি ও মুসলিম লীগ কমিটিতে আলোচনা ও অনুমোদনের জন্যে কখনও পেশ করা হয়েছিল বলে প্রমাণ নেই। বোধ হয় তার আগেই গান্ধীর ঐ শর্ত ফর্মূলাটিকে গলা টিপে মারে। গান্ধীর জীবনীকার পিয়ারী লাল লিখেছেন, “যা হোক, মনে হয় শেষ পর্যন্ত মিঃ শরৎ সার্বভৌম বাংলার সিদ্ধান্তসহ সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে যে অন্ততঃপক্ষে হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠতের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সহযোগিতা সমর্থন থাকতে হবে –মিঃ গান্ধীর এই প্রস্তাবে মিঃ সোহরাওয়ার্দী বা মুসলিম লীগকে রাজী করাতে পারেনি”।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দীকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪৪, ১৪৫)] গান্ধীর দ্বিতীয় শর্তটি, বাংলার অভিন্ন সংস্কৃতি হিসেবে মুসলমান সমাজ কর্তৃক হিন্দু উপনিষদ গ্রহণের প্রশ্নটি শরত বাবু সম্ভবত সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগের কাছে পেশ করতেও সাহস পাননি।
বস্তুত শরত বাবু এবং তার সাথী কিরণ শংকর, প্রমুখের কোন চেষ্টাই হালে পানি পায়নি। হিন্দু সমাজ কিংবা কংগ্রেস কারো কাছেই তাঁর জায়গা পাননি। শরত বাবু অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলা সংক্রান্ত তাঁর নিজস্ব ফর্মূলা প্রণয়নের (১২ই মে, ’৪৭) তিনদিন পর এবং শতর-হাশিম ফর্মূলা প্রণয়নের (২০ মে, ৪৭) তিন দিন আগে অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেসের অত্যন্ত প্রভাবশালী নোত বল্লব ভাই প্যাটেল শরৎ বাবুকে সতর্ক করে দিয়ে এই চিঠ লিখেনঃ “আমি দুঃখিত যে, আপনি সর্বভারতীয় রাজনীতি, এমনকি প্রাদেশিক রাজনীতি থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। আপনি আমাদের সাথে কোন যোগাযোগই রাখছেন না। আমি আশা করি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ব্যাপকতর অংশ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন এবং প্রাদেশিক ও সর্বভারতীয় রাজনীতির ব্যাপারে আপনার কার্যাবলী আমাদের অবহিত করবেন”।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭৪, ১৭৫।] প্যাটেরের এই চিঠিত শরতৎ বসুর বিচ্ছিন্ন ও অসহায় দশার চিত্রই ফুটে উঠেছে এবং প্যাটেল অত্যন্ত ভদ্র ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, শরৎ বাবুর কার্যাবলীর সাথে কংগ্রেসের কোন সম্পর্ক নেই। ২০ মে ৪৭ তারিখে অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলা সংক্রান্ত শরৎ হাশিম ফর্মূলা প্রণীত হবার পর অনুরূপ আরেকটা চিঠি সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল লিখেছিলেন কিরণ শংকরকে। সে চিঠিতে বলা হলোঃ “লোক মুখে ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এমন কিছু ধুম্রজাল সৃষ্টি হতে দেখছি, যে ব্যাপারে আমরা একদম অন্ধকারে। এসব ধুম্রজালের সাথে আপনার এবং শরৎ বাবুর নাম জড়ানো হচ্ছে। আমি মনে করি আপনাদেরই স্বার্থ এটা দেখা যে, এ ধরনের গুজব-ধুম্রজাল আর বেশী ছড়িয়ে না পড়ে। এখন এক সংকটকাল চলছে এবং দেশ ভাগের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ইস্যু। কংগ্রেসের সকল লোকের উচিত ব্যক্তিগত সকল প্রবণতা পরিত্যাগ করে কংগ্রেসের দলীয় নীতির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ব্যক্তিগত সকল মত দলীয় নীতির সাথে সংগতিশীল হতে হবে এবং এক্ষেত্রে মতানৈক্যের কোন অবকাশ নেই। আমি নিশ্চিত যে, কংগ্রেসের একজন সুশৃঙ্খল সদস হিসাবে আপনি আমার এই পরামর্শকে অভিনন্দিত করবেন”।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭৫।] প্যাটেলের এই চিঠিটি শরৎ বসুর কাছে লিখা চিঠির চেয়ে অনেক কঠোর এবং স্পষ্ট। এতে পরিস্কার ভাবেই কিরণ শংকর ও শরৎ বসুকে অখণ্ড বাংলার ধুম্রজাল থেকে বেরিয়ে কংগ্রেসের দলীয় নীতির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হতে বলা হয়েছে। অনেকের মতে এই চিঠির পর কিরণ শংকর অখণ্ড বাংলার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৭৫।] শরৎ বোসের জন্যে গান্ধীর তরফ থেকে আরও বড় আঘাত অপেক্ষা করছিল। সেটা এল ৮ই জুন তারিখে। ৭ই জুন, ১৯৪৭, অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ গ্রহণ করে এবং গান্ধীও এর প্রতি সম্মতি জানায়। এ উপলক্ষে গান্ধী ৮ই জুন এক প্রার্থনা সভায় যোগ দেন এবং অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এই তারিখে শরৎ বসুকে লিখা এক চিঠিতে গান্ধী বলেন, “আমি আপনার খসড়া পড়েছি। এবার পণ্ডিত নেহেরু ও সরদার প্যাটেলের সঙ্গে স্কীমটি নিয়ে মোটামুটি আলোচনা করেছি। উভয়েই তাঁরা এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী এবং তাদের অভিমত এই যে, এটা হিন্দু এবং তফসিলী সম্প্রদায়ের নেতাদেরকে বিভক্ত করার একটা কৌশলমাত্র। তাদের কাছে এ বিষয়টা সন্দেহ মাত্রই নয়, প্রায় একটা দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁরা এও মনে করেন যে, তফসিলী সম্প্রদায়ের ভোট হস্তগত করার জন্যে মুক্তহস্তে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। ব্যাপারটা যদি তাই হয়, তাহলে অন্ততঃ বর্তমানের জন্য এ সংগ্রাম আপনার পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ দুর্নীতির দ্বারা ক্রয় করা ঐক্য খোলাখুলি বিভক্তির চেয়ে নিকৃষ্টতার হবে, বিভক্তি হোক হৃদয়ের প্রতিষ্ঠিত বিভক্তির এবং হিন্দুদের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি। এও আমি দেখছি যে, ভারতের দু’টি অংশের বাইরে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন আশা নেই”।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দীকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪৯)]
গান্ধীর এই চিঠি ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ করল শরৎ বোসকে। ৯ই জুন তারিখেই তিনি একটি টেলিগ্রাম মারফত চ্যালেঞ্জ করলেন গান্ধীকে এই বলেঃ ‘অভিযোগ যদি মিথ্যা হয়, তাহলে অভিযোগকারীকে শাস্তি দিন। আর সত্য হলে ঘোষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতাকে শাস্তি দিন।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দীকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৫০)।]
শরৎ বোসকে এ অসহায় আবেদন অরণ্যে রোদনে পরিণত হলো। তিনি যেদিন গান্ধীকে ঐ টেলিগ্রাম পাঠান, সেদিনই (৯ই জুন) মিঃ জিন্নাহকে তিনি একটা চিঠি লিখেন। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ও কংগ্রেসের দিক থেকে হতাশ হয়ে তিনি জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের সহযোগিতা চাইলেন। তিনি লিখলেন, “বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে, কিন্তু এখনও তাকে বাঁচানো যায়। …যে অনুরোধ আমি আপনার কাছে করছি, তা আমাদের সাক্ষাতকালে আপনি যে মতামত প্রকাশ করেছিলেন তার অনুসরণেই। কিন্তু আমার প্রতীয়মান হয় যে, আপনি যদি আপনার সদস্যদের কাছে শুধুমাত্র আপনার মতামত প্রকাশ করেন, তাহলে পরিস্থিতিকে রক্ষা করা যাবে না।….
বাংলাদেশের আইন পরিষদের মুসলিম সদস্যরা যদি নির্দেশ মত একযোগে ভোট দেন, …..আমি মনে করি লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পরিষদের আরেকটি সভা ডাকতে বাধ্য হবেন, যাতে সামগ্রিকভাবে এই প্রদেশ নিজস্ব সংবিধান পরিষদ পেতে চায় কিনা –এই ইস্যুর উপর সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে”।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দীকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৪৮)।]
শরৎ বসুর এই চিঠিতে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়ঃ (১) জিন্নাহ অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার পক্ষে ছিলেন, (২) অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার পক্ষে বাংলার আইনসভার হিন্দু সদস্যরা ভোট দেবেনা, কিন্তু বাংলার মুসলিম সদস্যরা এক যোগে যাতে এর পক্ষে ভোট দেয় সেই দায়িত্ব জিন্নাহকে গ্রহণ করতে হবে এবং (৩) বাংলার মুসলিম সদস্যরা স্বাভাবিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার (পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন) পক্ষে ভোট দেবে না, সুতরাং জিন্নাহকে তাদের রাজী করানোর জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু শরৎ বাবু জানতেন না, তাঁর এই ফর্মূলা কার্যকর হবার মত নয়। কারণ, হিন্দু সদস্যরা যদি বাংলা ভাগ করার পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা অনুসারে মুসলিম লীগ সদস্যদের কোন প্রকার মতামত ছাড়াই বাংলা ভাগ হয়ে যাবে। জুন, ’৪৭-এর এ সময়কালে শরৎ বাবু এবং তাঁর মত দু’একজন ছাড়া কংগ্রেস এবং হিন্দুসমাজের কেউই অখণ্ড এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার পক্ষে ছিল না। শরৎ বোস গান্ধীকে তার সর্বশেষ (বাংলা বিভাগের আগে) চিঠি লিখলেন ১৪ই জুন, ১৯৪৭। তিনি বললেন, “আমি লক্ষ্য করছি যে, জওয়াহের লাল ও বল্লভ ভাই উভয়েই সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী। এটা যে হিন্দু ও তফসিলী সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে বিভক্তি করনের একটা কৌশল মাত্র, তাঁদের এ অভিমতের ব্যাপারে আমি একমত নই। যা হোক, আমাকে বলতেই হবে যে, তফসিলী সম্প্রদায়ের ভোট হস্তগত করার জন্যে মুক্ত হস্তে টাকা ব্যয় করা সম্পর্কে যে সন্দেহ নেই, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন”।–[‘Mahatma Gandhi’, The Last Phase’ by Pyarelal, Vol-2 (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দীকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১৫০. ১৫১)।]
এরপর শরৎ বোস কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগ করলেন। কংগ্রেস এবং হিন্দু সমাজের মতেরই জয় হলো, পরাজিত হলেন শরৎ বোস। এক ব্যক্তি একটি জাতি হতে পারে না, তা আবার প্রমাণিত হলো।
অন্যদিকে বাংলার মুসলমানরা এবং মুসলিম লীগ একবাক্যে অখণ্ড বাংলার দাবী করেছে। এ দাবী শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। ছোট খাট বিবৃতি দেয়া ছাড়াও ২৭শে এপ্রিল (১৯৪৭) বাংলার প্রধানমন্ত্রী দিল্লী গিয়ে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলার পক্ষে। তিনি বলেন, অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ সার্বভৌম বাংলা হবে একটা মহান দেশ, যা হবে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধিশালী’। সোহরাওয়ার্দী তার এ বিবৃতিতে বাংলা বিভাগ দাবী করার জন্যে বাংলার একশ্রেণীর হিন্দুর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এটা অসহনশীল হতাশবাদীদের কাজ’।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 16.] এদিন বিকেলেই সোহরাওয়ার্দী দিল্লীতে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এই তারিখেই খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাগের বিরোধিতা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার দাবী করে একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “আমার সুচিন্তিত অভিমত এই যে, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা গঠন মুসলিম ও অমুসলিম সকলের জন্যেই কল্যানকর হবে। একইভাবে বাংলা বিভাগ অধিবাসীদের জন্যে হবে মারাত্মক”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 18.] এর একদিন পর ৩০শে এপ্রিল তারিখে সর্বভারতীয় লীগের সভাপতি মিঃ জিন্নার একটা বিবৃতি সংবাদপত্রে এল যাতে তিনি বাংলা বিভাগ দাবীর নিন্দা করে বললেন, “এটা একটা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 21.] এই দিনই বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের একটি দীর্ঘ বিবৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। এ বিবৃতির প্রথম অংশে তিনি অখণ্ড ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলেন এবং দ্বিতীয় অংশেগিয়ে উপসংহার টেনে বললেন, “লাহোর প্রস্তাব কখনই ভারতে একক একটি মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেনি”। আবুল হাশিমের বিবৃতির ৪ দিন পর ৫ই মে, ১৯৪৭, বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরাম খান এক বিবৃতিতে বললেন, “কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে কেউ ধারণা করতে পারেন যে, পাকিস্তান প্রশ্নে লীগ হাইকমাণ্ড এবং বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে প্রবল চিন্তা-বৈষম্য রয়েছে। সম্পূর্ণভাবে এটা ভিত্তিহীন। বাংলা মুসলিম লীগ দৃঢ়ভাবে ১৯৪০ সালের লাহোর রেজুলেশন এবং কায়েদে আযমের পেছনে রয়েছে। ….পাকিস্তান থেকে পৃথক স্বাধীন বাংলার কোন প্রশ্নই উঠে না। …..যারা হিন্দু ও মুসলমানের সম্মিলিত বাঙালী জাতি’র কথা বলেন এবং সেই জাতীয়থার ভিত্তিতে যারা স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম বাংলার কথা বলে, তারা পরিস্কারভাবে আমাদের শত্রুদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছেন, যারা মুসলিম বাংলাকে স্যান্ডউইচ করার জন্যে বাংলার পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে দু’টি হিন্দু বাংলা দাবী করছে”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 21.]
লক্ষণীয় মুসলিম লীগের দুই নেতা, আকরাম খান ও আবুল হাশিম সম্পূর্ণ দুই বিপরীত কথা বললেন। আসলে সে সময় বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যে দুই মত দানা বেঁধে উঠেছিল এটা তারই প্রতিফলন। এই দুই মতের একদিকে ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, মন্ত্রী ফজলুর রহমান, আবুল হাশিম, প্রমুখ কয়েকজন। আর অন্যদিকে ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক লীগ সভাপতি আকরাম খান, হাবিবুল্লাহ বাহার, নূরুল আমিন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, তমিজুদ্দিন খান প্রমুখসহ সংখ্যাগুরু লীগ সদস্যগণ। আকরাম খানের এই বিবৃতির মাধ্যমে দুই পক্ষের বিরোধ প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর তা বেড়ে চলল। বিশেষ করে ১১ই মে থেকে ১৩ই মে পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, ফজলুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী গান্ধীর সাথে বার বার দেখা করেন ও আলোচনা করেন। এই আলোচনা মুসলিম লীগের অন্য পক্ষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এই বিক্ষুব্ধ হবার একটা কারণ হলো ৯ই মে, ১৯৪৭, মুসলিম লীগ প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটি অখণ্ড বাংলা ও অন্যান্য বিষয়ে হিন্দুদের সাথে আলোচনার জন্যে একটা সাব কমিটি গঠন করে, যার আহবায়ক ছিলেন নূরুল আমিন। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ এই সব-কমিটিকে পাশ কাটিয়ে গান্ধী ও হিন্দু নেতাদের সাথে আলাপ করেন। এমনকি ২০মে শরৎ বসুর বাড়ীতে অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় যে মিটিং এ, সেখানে সাব কমিটির আহবায়ক সহ অনেকেই হাজির ছিলেন না এবং মুসলিম লীগ প্রাদেশিক কমিটিও এ ব্যাপারে কিছু জানতনা। এসব নিয়ে সংশয় সন্দেহ এবং বিরোধ তীব্রতর হতে থাকে। লীগ কাউন্সিল সদস্য এম, এন, হুদা ১৩মে’র এক বিবৃতিতে আবুল হাশিম ও অন্যদের এ ধরনের আলোচনা করার অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেন।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 28.] এম, এন, হুদার সমর্থনে আবুল হাশিম, প্রমুখের অনধিকার আলোচনাকে চ্যালেঞ্জ করে বিবৃতি দেন হাবিবুল্লাহ বাহার ১৪ই মে তারিখে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 31.] আবুল হাশিম এর জবাব দিলেন ১৭ই মে। বললেন, ভালো কাজের জন্যে কোন দায়িত্ব পাওয়ার দরকার হয় না।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 36.] ১৪ই মে, ১৯৪৭, সোহরাওয়ার্দী দিল্লী গেলেন সম্ভবত কংগ্রেস ও লীগ হাইকমাণ্ডের সাথে আলোচনার জন্যে। এর ১ দিন পরেই বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি আকরাম খান সহ হাবিবুল্লাহ বাহার, নুরুল আমিন, ইউসুফ আলীও দিল্লী গেলেন। উদ্দেম্য উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে লীগ হাই কমাণ্ডের সাথে আলোচনা করা। পাল্টা-পাল্টি এই ব্যাপার কারোরই নজর এড়ায়নি। কিন্তু রেজাল্ট কি হয়েছিল, সুনির্দিষ্টভাবে তার কিছুই জানা যায় নি। কারণ লীগ হাই কমাণ্ড এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে সোহরাওয়ার্দী বাংলা বিভাগ ঠেকাবার জন্যে জিন্নাহকে অনুরোধ করেছিলেন।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 30.] অন্যদিকে আকরাম খান মিশনের সদস্যরা কোলকাতা ফিরে বলেন ১৯শে মে’ তারিখে, তাদের মিশন সফল হয়েছে। কিন্তু সফলতা কি সেটা তাঁদের কাছ থেকে পরিস্কার জানা গেলনা। আকরাম খান বললেন, “বাংলা বিভাগ নিয়ে মুসলিম লীগের মধ্যে কোন প্রকার মতবিরোধ নেই। লাহোর প্রস্তাবের সাথে অসংগতিশীল এমন কোন প্রস্তাবই আমরা মানব না”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 35.] হাবিবুল্লাহ বাহার বললেন যে, কোন হিন্দু নেতার কোন প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে মুসলিম লীগের কাছে আসুন”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 35.] ইউসুল আলী চৌধুরী বললেন, ‘কংগ্রেস কিংবা কোন হিন্দু সংগঠনের সাথে যারা আলোচনা করছেন, তাদের কারো একথা ভাবা ঠিক নয় যে, মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে তারা দায়িত্বশীল এবং তারা যা করবেন মুসলিম লীগ তা মেনে নেবে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 35.] ১৯শে মে’ তারিখেই আবুল হাশিম গ্রুপের পক্ষ থেকে মন্ত্রী ফজলুর রহমান তাদের কার্যক্রমের ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, “আলোচনার শুরুতেই আমরা একথা পরিস্কার করে দিয়েছি, যে সমঝোতাতেই আমরা পৌঁছিনা কেন, তা প্রাদেশিক মুসলিম ওয়ার্কিং কমিটি এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কর্তৃক অনুমোদিত হবে। …আমরা কোন সমঝোতায় এখনো পৌঁছিনি। কায়েদে আযমের মত সম্পর্কে আমরা অবহিত এবং সে অনুযায়ীই আমাদের আলোচনা চলবে। …..মুসলিম লীগ সোহরাওয়ার্দী, নুরুল আমিন, হাবিবুল্লাহ বাহার, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী ও আমাকে সদস্য করে সাব কমিটি গঠন করেছে (আলোচনার জন্যে), কিন্তু কমিটির বাইরে কেউ আলোচনা করতে পারবে না এমন কথা মুসলিম লীগের ঐ রেজুলেশনে নেই”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 38, 39.] কিন্তু দুঃখের বিষয় ফজলুর রহমানের এই বিবৃতির পরদিনই শরৎ বসুর অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলার নীতিমালা প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো, সেখানে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও ফজলুর রহমান গেলেন, কিন্তু আলোচনার জন্য দায়িত্বশীল সাব-কমিটির আহবায়কসহ অন্য সদস্যদের সেখানে নেয়া হলো না।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 41.] তবে আনন্দের ব্যাপার মুসলিম লীগ এর জন্যে কোন খারাপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে হাবিবুল্লাহ বাহার ২৪শে মে জানালেন, “শরৎ-সোহরাওয়ার্দী ফর্মূলা আশা করা হচ্ছে ২৭মে তারিখে এ বিষয়ের জন্যে দায়িত্বশীল সাব কমিটিতে পেশ করা হবে এবং ফর্মূলাটি অতঃপর প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে পেশ করা হবে ২৮শে মে তারিখে।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 45.]
বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকটি ২৮শে মে তারিখেই অনুষ্ঠিত হলো। ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জন সদস্যের মধ্যে ২৪ জন উপস্থিত ছিলেন। অনুপস্থিত ছিলেন সোহরাওয়ার্দী, এম, এ, এইচ, ইস্পাহানী এবং শিক্ষামন্ত্রী মোয়াজ্জেমুদ্দিন হোসেন। মিটিং-এর যে বিবরণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তা এইঃ
“২৮শে মে বুধবার রাত ৮টা থেকে ৫ ঘন্টব্যাপী আলোচনার পর বাংলার রাজনীতি বিষয়ে মুসলিম লগের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি অথবা গঠিত সাব কমিটির করার কিছুই নেই।
ওয়ার্কিং কমিটি পাকিস্তান দাবীকে দৃঢ়ভাবে সমর্থণ করছে। কমিটি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করছে এবং ঘোষণা করছে যে, ভারতের মুসলমানদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র বিষয়ে আলোচনা ও নিষ্পত্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে দায়িত্বশীল এক মাত্র তিনিই। বাংলার মুসলমানরা তার সিদ্ধান্তের পেছনে থাকবে।
বাংলার রাজনৈতিক সমস্যা বিষয়ে আলোচনার জন্যে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্তৃক গঠিত সাব-কমিটিও বাতিল করা হয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটর একজন সদস্য গতকাল (২৯শে মে) এক সাক্ষাতকারে জানান, যেহেতু বাংলার মানুষের সাধারণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার জন্যে দলীয়ভাবে কোন ব্যক্তি বা কমিটিকে দায়িত্ব দেয়নি, তাই লীগের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্যে সাব কমিটিকে অব্যাহত রাখার কোন অর্থ হয় না”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 47-48.]
এইভাবে মুসলিম লীগের মধ্যমকার দ্বন্দ্বমান দুটি মতের বিলয় ঘটল তখনকার মত দলীয় সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। তবে মুসলিম লীগের মধ্যে কোন বিতর্ক ছিল না অখণ্ড বাংলার ব্যাপারে। মুসলিম লীগের উপরোক্ত প্রস্তাবের ২ দিন পরে মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহার বাংলা ভাগ বিরোধী এক জনসভায় বলেন, “এক শ্রেণীর স্বার্থ শিকারী হিন্দু বাংলা ভাগের জন্যে আন্দোলন চালাচ্ছে। মুসলমান এবং তফসিলী হিন্দুরা বাংলা ভাগের বিপক্ষে। ….অখণ্ড বাংলা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হবে”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain’, page 50.]
লীগ সভাপতি মিঃ জিন্নাহ বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন শেষ পর্যন্ত। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারত বিভাগ পরিকল্পনা নিয়ে লণ্ডন যান ১৮ই মে, ১৯৪৭। বাংলা বিভাগের বিষয়টা তখন জানতে পেরে জিন্নাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৮২।] এটুকু প্রতিবাদ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন লণ্ডন যাবার পর জিন্নাহ বৃটিশ মন্ত্রীসভার কাছে টেলিগ্রাম করেন বাংলা ভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত না নেবার জন্যে।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৮৩।] তারপর ২রা জুন ১৯৪৭ কংগ্রেস ও শিখরা যখন ভারত বিভাগ পরিকল্পনার প্রতি লিখিত সম্মতি জানাল, তখন মিঃ জিন্নাহ মাউন্ট ব্যাটেনকে গিয়ে বাংলা ভাগের ব্যাপারে তাঁর তীব্র আপত্তির কথা জানালেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৮২।]
কিন্তু তবু বাংলা ভাগ হলো। কেন ভাগ হলো? কেউ কেউ বলতে চান, বাংলা স্বাধীন-সার্বভৌম হলে এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তান না হলে বাংলা ভাগ হতো না। এ ধারণা একেবারেই ভুল। বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলকে ভাগ করে নিয়ে পৃথক হিন্দু প্রদেশ গঠন করার বিষয়টা ছিল হিন্দুদের স্থির সিদ্ধান্ত। পাকিস্তান না হলেও এটা তারা করতো। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের নেতা ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দিল্লীর এক জনসভায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, “The Septaration must not be dependent on Pakistan. Even if Pakistan is not conceded and some form of a week and loose centre cnvirage in the Cabinet Mission Scheme is accepted by the Muslim League. We shall demand the creation of new province composed of the Hindu majority areas in Bengal.” অর্থাৎ এই ‘পৃথক হওয়াটা পাকিস্তান হওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। এমন কি যদি পাকিস্তান নাও হয়, কোন প্রকার দুর্বল ও শিথিল কেন্দ্রের ব্যবস্থাযুক্ত ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মুসলিম লীগ গ্রহণও করে, তুব আমরা বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ দাবী করব’।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৩৩, ১৩৪, (এই তথ্যটি কোলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকার ২২ শে এপ্রিল, ১৯৭৪, সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত)।] তাছাড়া কংগ্রেস স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (৪ঠা এপ্রিল, ১৯৪৭) বাংলা প্রদেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অবশিষ্ট অংশকে ভারতের সাথে একীভূত করার জন্যে। মুসলমানরা তাদের এ সিদ্ধান্তের সাথে একমত হবেনা, তাই বাংলা ভাগ তাদের জন্যে ছিল অপরিহার্য এবং তাই করেছে।
বাংলা বিভাগে বোধ হয় সবচেয়ে বেশী আহত হয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি বাংলা বিভাগকে এবং স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ভেংগে যাওয়াকে বাংলার পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত বলে অভিতিহ করলেন। কিন্তু যে হিন্দুদের সাথে একত্রে স্বাধীনভাবে ঘর করার সাধ তিনি করেছিলেন, শীঘ্রই সে হিন্দুদের যে চেহারা তিনি দেখলেন তা কিছুতেই তাঁর সাধের সাথে সংগতিপূর্ণ হল না। “হিন্দুজনতা তাঁর পাশে গুঞ্জন তুলে বলছিলঃ মুসলমান শুয়র, খুনি ও চোর’। এমন এক চিৎকার তুলেছিল তারা, যা শুধুমাত্র ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ ভারতেই শোনা যেতে পারেঃ ‘এই অধঃপতিত গরু-খোরকে ফাঁশিতে লটকানো হোক’। এই পরিস্থিতিতে প্রশংসনীয় শান্তভাবে আগাগোড়া বসে থাকলেন মিঃ সোহরাওয়ার্দী”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 45. (উদ্ধৃতঃ ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ, সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ১৫২)।]
স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী বললেনঃ “যন্ত্রণার অবসান ঘটেছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে এবং বাংলা শীঘ্রই ভাগ হচ্ছে। ….মুসলিম বাংলাকে এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, অর্জন করতে হবে পাটের উৎপাদনকারী হিসেবে বিশ্বকে সে নিয়ে আসতে পারে পায়ের তলায় এবং থাকবে শক্তিশালী ভবিষ্যত নিশ্চিত। …..পাকিস্তানের আইনসভায় মুসলিম বাংলার থাকবে শক্তিশালী কণ্ঠ, শাসনতান্ত্রিক বিকাশে পারবে সে অবদান রাখতে, অবদান রাখবে সে কৃষির উন্নয়নে এবং পাকিস্তানের সমৃদ্ধি বিধানে”।–[‘Days Decisive’, Serajuddin Hussain, page 57]