১
বিশ শতকের রাজনৈতিক পটভূমি
রাজনীতি বলি, ইতিহাস বলি, সবই মানুষকে নিয়ে। বাংলাদেশে মানুষের দু’টি প্রধান অংশ, মুসলমান ও হিন্দু। এদের রাজনৈতিক তৎপরতা তাই এখানকার রাজনীতির মৌল ধারা। এই ধারার জন্ম হাজার বছরেরও বেশী আগে যখন শাহ জালাল ও শাহ মখদুমের মত মুসলিম মিশনারীরা বাংলাদেশে এলেন মানুষকে মুক্তির দিশা দিতে। তারপর ১২০৩ খৃষ্টাব্দ থেকে সাড়ে পাঁচশ বছর মুসলমানরা শাসন পরিচালনা করল বাংলাদেশে। এর আগে বাংলাদেশ হিন্দু সেন রাজাতের হাতে ছিল ১০৬ বছর। তারও আগে বৌদ্ধ পাল রাজারা বাংলাদেশ শাসন করেছে ৩৪৭ বছর। আর ১৭৫৭ সালে মুসলমানদের হাত থেকে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিল ইংরেজরা। ইংরেজ শাসনে হিন্দুরা হলো অনুগত প্রজা আর মুসলমানরা হলো বিদ্রোহী। এইভাবে শুরু হলো শাসিতের কাতারে দাঁড়ানো মুসলমান ও হিন্দুদের নতুন এক রাজনীতি। বাংলা চৌদ্দ শতক আর ইংরাজ বিশ শতকের রাজনৈতিক ঘটনাবলী এই রাজনীতিরই উত্তরাধিকার”।–[বাংলা চৌদ্দ শতক ইংরাজী ১৮৯৩-১৯৯৩]
এই রাজনীতির স্বরূপটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ১৭৫৭ সালে ইংরেজের হাতে মুসলমানরা শুধু তাদের রাজ্য হারালনা, হারাল তাদের সর্বস্ব। একদিন যাদের দরিদ্র হওয়া অসম্ভব ছিল, সেই মুসলমানরা কাঠুরিয়া ও ভিস্তিওয়ালায় পরিণত হলো।–[‘দি ইণ্ডিয়ান মুসলমানস’, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার।] মুসলমানরা প্রত্যাখ্যান করল ইংরেজ শাসন এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও হারানো সব অধিকার আদায়ের জন্যে তারা হাতে তুলে নিল অস্ত্র। শুরু করল তারা সশস্ত্র সংগ্রাম। মুসলমানদের এই প্রতিরোধ সংগ্রামকে ইংরেজরা ধ্বংস করল তাদের পশু শক্তি আর হৃদয় বিদারক ইংরেজের দেয়া সব অনুগ্রহ এবং সকল সুযোগ সুবিধা। তারা ইংরেজের ছত্রছায়ায় বসে জাতি গঠন ও জাতির সার্বিক বিকাশে মনোযোগ দিল। মুসলিম রাজত্বকালে মুসলমানরা হিন্দুদের জাতীয় অস্তিত্বের গায়ে হাত দেয়নি।–[(ক) “মুসলমানাধিকৃত ভারত এবং ইংরাজাধিকৃত ভারতের মধ্যে কত প্রভেদ। মুসলামানাধিকারে ভারতবর্ষ ভারতবাসীরই আয়ত্তাধীন ছিল, তখন বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে স্বীয় মনুষ্যত্বের অনুশীলন করিবার সম্পূর্ণ প্রত্যক প্রজারই বিদ্যমান ছিল।….অতীতকে হৃদয়ে ও দেহের রক্তে পাইয়াছি বলিয়াই আমরা নিশ্চয়ই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী হইব, নচেৎ ব্যবিলনবাসী, বা রেড ইণ্ডিয়ান, প্রাচীন মিসরবাসীর মত আদাদেরও ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলীন হইতে হইত”।–(ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা শ্রী অরবিন্দ ও বাঙলায় বিপ্লববাদ’-উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, ৬/১-এ বাঞ্ছারাম অক্রুর লেন, কলিকাতা, পৃষ্ঠা-১২৮)।
(খ) “মুসলিম শাসনে এদেশের হিন্দু অধিবাসীরা মুসলমানদের মতই সকল প্রকার রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। রাষ্ট্রের উচ্চতম পদ, সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব, প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতা, সম্মানিত মন্ত্রীর আসন, প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়োগের ব্যাপারে ধর্ম কিংবা জন্মস্থান কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতো না। হিন্দুরা ভুমি মঞ্জুরী লাভ করত, খাজনা মওকুফ পেত এবং উচ্চ বেতন ছাড়াও অফিস সংলগ্ন ভুমি ব্যবহারের সুযোগ তাদের ছিল”। (Memorial to the Supreme Court in Calcutta, 1823, by Dwarkanath Thakur and Raja Rammuhan Roy.] কিন্তু হিন্দুদের জাতীয় সত্তা ও শক্তির এই নতুন বিকাশ মুসলমানদের বৈরী হয়ে উঠল এবং বাংলা তেরো শতক ও ইংরেজী উনিশ শতকের শেষ দিকে তা মুসলিম জাতিসত্তা বিনাশী রূপ পরিগ্রহ করল। উনিশ শতকের এই রাজনৈতিক পটভূমি সামনে না আনলে বিশ শতকের রাজনীতি বুঝা যাবে না।
পলাশীতে মুসলমানদের যেদিন পতন, তাদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামের শুরু বলা যায় সেদিন থেকেই। ১৭৬৪ সালে বাংলার বিদ্রোহী নবাব মীর কাশেম স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন বক্সারের যুদ্ধে। কিন্তু তার আগেই জনতার কাতার থেকে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। ১৭৬৩ সালে ফকির বিদ্রোহীরা বাকেরগঞ্জে ইংরেজ কোম্পানীর কুঠি আক্রমণ করলো। সেই যুগে পীর, ফকির, আলেমরা ছিল সমাজ-নেতা। ফকির বিদ্রোহ নামের এই বিদ্রোহটি তাদের দ্বারাই সংগঠিত হয়। নবাবের পরাজিত বাহিনীর অংশ বিশেষ ফকিরদের এই সংগ্রামে শামিল থাকতে পারে। ফকির সন্ন্যাসীরাও বিদ্রোহী নবাব মীর কাশিমের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ফকির বিদ্রোহের নেতা ছিলেন মজনু শাহ। ১৮৮৭ সালে তার মৃত্যুর পর মুসা শাহ, চেরাগ আলী, সোবহান শাহ, মাদার বকশ, করিম শাহ, প্রমুখ ফকির নেতা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এদের সংগ্রাম ছিল ইংরেজ কোম্পানীর বিরুদ্ধে। কোম্পানীর অনুগত ও অত্যাচারী জমিদার, মহাজন, এমনিক একশ্রেণীর সুদখোর সন্ন্যাসী নেতার বিরুদ্ধেও এরা সংগ্রাম করেছেন। ইংরেজ কোম্পানীর সৈন্যের সাথে ফকির বিদ্রোহীদের বহু সংঘর্ষ হয়েছে। গোটা উত্তর-বংগ সহ কোম্পানীর সৈন্যের সাথে ফকির বিদ্রোহীদের বহু সংঘর্ষ হয়েছে। গোটা উত্তর-বংগ সহ বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে ইংরেজ শঅসনকে তারা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। ১৮০০ খৃষ্টাব্দের দিকে নানা কারণে ফকির বিদ্রোহ ঝিমিয়ে পড়ল, ১৮২৫ সালের দিকে পাগলাপন্থী নামে করিম শাহের নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হতে দেখি সেটাও আসলে ফকির বিদ্রোহেরই একটা অংশ।
ফকির বিদ্রোহ যখন ঝিমিয়ে পড়ছে, তখন আমাদের বাংলাদেশকে একটা মহা বিদ্রোহ, একটা মহা উত্থানের সাথে জড়িয়ে পড়তে দেখছি। এই মহা উত্থানের নায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী শিখরাজার বিরুদ্ধে মুসলমানদের এক মহা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। ইংরেজ অধিকৃত ভারত থেকে হিজরত করে আফগান সীমান্তে ঘাঁটি গেড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু করলেন তিনি ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে ইংরেজ মিত্র শিখদের সাথে এক যুদ্ধের মাধ্যমে। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরুর প্রস্তুতি তিনি শুরু করেছিলেন এর প্রায় এক দশক আগে। বাংলাদেশসহ গোটা ভারত সফর করে মুসলিম জনপদকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন এক মহাবিদ্রোহের জন্যে।
ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার এই মহাবিদ্রোহহে ‘ইতিহাসের এক বৃহত্তম ধর্মীয় পুনরুত্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। হাণ্টার ছিলেন একজন বৃটিশ রাজকর্মচারী এবং সব ইংরেজের মতই তিনি এই ‘পুনরুত্থান’ বা বিদ্রোহের ছিলেন ঘোর বিরুধী। কদর্থ করতে গিয়ে এই বিদ্রোহের তারা নাম দিয়েছিলেন ওহাবী আন্দোলন। হাণ্টারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই আন্দোলন সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্যে। এই রিপোটর্ করতে গিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন তিনি। স্বীকার করেছেন তিনি এই আন্দোলনের বিস্ময়কর শক্তি ও বিস্তৃতির কথা। তিনি লিখেছেন, “সারা ভারতে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ইতিহাসের এক বৃহত্তম ধর্মীয় পুনরুত্থান সাধিত করল তারা। তাঁদের অসংখ্য ছোট ছোট মিশনারী দল ছিল। দক্ষ সংগঠনের মাধ্যমে তারা মুরিদগণের তাকিদে একজন করে প্রচারক নিযুক্ত হয়। ভ্রাম্যমান মিশনারীরা মাঝে মাঝে এই সকল জেলা সফর করে সেখানকার স্থায়ী প্রচারকদের উদ্যমকে জাগ্রত রাখতে থাকে। এই সব প্রচারকদের অশুভ প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এরা এমন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল যে, স্ত্রীলোকেরা তাদের গহনাপত্র স্বেচ্ছায় ধর্মান্ধদের তহবিলে দান করেছিল। দলের পর দল সংগ্রহ করে ধর্মান্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। দেশের সর্বত্র মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে তারা গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অজস্র রাজদ্রোহমূলক সাহিত্য, পাটনায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় প্রচার কেন্দ্র এবং সারা বাংলার আনাচে কানাচে প্রচারকদের আনাগোনা ছাড়াও জনগণের মধ্যে রাজদ্রোহমূলক কাজে উৎসাহ সৃষ্টির জন্যে ওহাবীরা একটি চতুর্থ সংগঠন গড়ে তুলেছে। এই ভাবে পল্লী বাংলার বিভিন্ন স্থানে এক ধরনের বিদ্রোহী কলোনী গড়ে তুলেছে। অর্থ সংগ্রহ ব্যবস্থাটা সহজ ও স্বয়ং সম্পূর্ণ ছিল। গ্রাম গুলোকে বিভিন্ন আর্থিক এলাকায় বিভক্ত করে প্রত্যেক এলাকার জন্যে একজন করে প্রধান ট্যাক্স আদায়কারী নিয়োগ করা হয়। যে গ্রামের জনসংখ্যা খুব বেশী সেখানে একাধিক আদায়কারী নিয়োগ করা হয় এবং তার মধ্যে একজন মৌলবী থাকতেন যিনি সমাজে এমামতি করতেন। একজন জেনারেল ম্যানেজার রাখা হয় যিনি মুসলমানদের দুনিয়াবী কাজের তদারক করতেন। এ ছাড়াও একজন অফিসার থাকতেন তার কাজ ছিল বিপদজনক চিঠিপত্র বিলি বণ্টন ও রাজদ্রোহ মূলক খবরাখবর আদান-প্রদান করা।…..”-[‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’, ডব্লিউ হাণ্টার, খোশরোজ কিতাব মহল, নতুন সংস্করণ, পৃষ্ঠাঃ ৩৮, ৬৫, ৬৬, ৬৮।]
মহাবিদ্রোহের এই বিস্ময়কর সংগঠন ১৮২৬ সাল থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত ইংরেজের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম পরিচালনা করে। পশু শক্তি ইংরেজের হাতে এ সংগ্রাম বার বার মার খেয়েছে, কিন্তু সংগ্রাম তবু শেষ হয়নি। হাণ্টার সাহেব লিখছেন, “আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বশেষ অভিযান পর্যন্ত ইতিহাস আলোচনা করলম। ওহাবীদের যুদ্ধাত্মক তৎপরতা ভারতের সর্বত্র যে বিস্তার লাভ করেছিল তার ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এই গ্রন্থের কলেবর বিরাট আকার ধারণ করবে।
ধর্মান্ধদের দ্বারা সীমান্তে বিরামহীন অশান্তি বিরাজমান রাখা ছাড়াও তিনবার বৃহদাকার ঐক্যজোট সংগঠিত হয়েছে এবং প্রত্যেকবারই বৃটিশ ভারতকে একেকটি যুদ্ধের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু এদের নির্মূল করার জন্যে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মান্ধদের ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত যে ভেঙ্গে পড়েছে তার নিদর্শন তাদের নিজেদের অবস্থা থেকেই বুঝা যাচ্ছে। তাদের প্রধান নেতারা ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছে এবং অবশিষ্টরাও বুঝতে পেরেছে যে সক্রিয় হলে তাদেরও একই পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সীমান্তের সশস্ত্র শিবিরগুলো এখনও টিকে আছে এবং সময়মত সেগুলো হয়তো বিরাট ধর্মীয় মহা সম্মিলনের রূপ গ্রহণ করবে। আজ সকালেই (১৪ জুন, ১৮৭১) আমি এই পরিচ্ছেদ রচনার কাজ শেষ করার সময় জানতে পারলাম যে, ব্লাক মাউন্টেনের উপর বিদ্রোহী শিবির থেকে আরেকটি আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে”।–[‘দি ইন্ডিয়া মুসলমানস’, ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার, খোশরোজ কিতাব মহল, নতুন সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৯০, ৯১।] বস্তুত এই মহাবিদ্রোহ এই উপমহাদেশের আজাদী পাগল মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রামের এক মহাকাহিনী। এই কাহিনীতে জড়িয়ে আছে শত ফাঁসির মঞ্চ, হাজারো নির্বাসন আর লাখো মানুষের অশ্রুর ইতিহাস।
এই মহা বিদ্রোহে বাংলার ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৮৩১ সালে এই বিদ্রোহের নায়ক সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী বালাকোটের রণাঙ্গণে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে শীর্ষ সাথীগণসহ শাহাদাত বরণ করেন। এই বিপর্যয়ের রণাঙ্গণে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে নয়জন বাংলাদেশীর নাম পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে ছিলেন আরও চল্লিশজন।–[‘জিহাদ আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা’, মওলানা মুহিউদ্দীন খান, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃষ্ঠাঃ ১০৩]
অবশ্য এই সংখ্যা দিয়ে এই মহাবিদ্রোহে বাংলার মুসলমানদের ভূমিকার মূল্যায়ন করা যাবে না। উইলিয়াম হাণ্টারের ভাষায়, “বাঙ্গালীদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ফলেই ধর্মান্ধদের আন্দোলন এরূপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল”।–[‘দি ইণ্ডিয়ান মুসলমানস’, ডব্লিউ হাণ্টার, পৃষ্ঠাঃ ৩৯।] কিন্ত এটাও ঠিক নয় যে, এই মহাবিদ্রোহে বাংলার মুসলমানরা শুরু মাথাই খরচ করেছে, আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে গোটা বাংলা ছিল এই মহাবিদ্রোহের বারুদাগার। জীবন ও অর্থ দুই-ই অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে বাংলার মানুষ এই মহাবিদ্রোহকে সফল করে তোলার জন্যে। উইলিয়াম হাণ্টার তার গ্রন্থের শুরুতেই লিখেছেন, “বাংলার মুসলমানরা আবার এক বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। তারা একেক দল ধর্মান্ধকে পাঠিয়েছে, যারা শিবির আক্রমণ করেছে, গ্রাম পুড়িয়েছে, আমাদের প্রজাদের হত্যা করেছে এবং আমাদের সেনা বাহিনীকে তিন-তিনটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে লিপ্ত করেছে। আমাদের সীমান্তের ওপারে মাসের পর মাস ধরে গড়ে উঠা শত্রু বসতির লোক নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক মোকদ্দমার বিচার থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের প্রদেশসমূহের সর্বত্র বিস্তারিত হয়েছে এক ষড়যন্ত্রের জাল। পাঞ্জাবের উত্তরে অবস্থিত জনহীন পর্বতরাজির সঙ্গে উষ্ণ মণ্ডলীয় গঙ্গা অববাহিকার জলাভূমি অঞ্চলের (বাংলার) যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে রাজদ্রোহীদের নিরবচ্ছিন্ন সমাবেশের মাধ্যমে। সুসংগঠিত প্রচেষ্টায় তারা ব-দ্বীপ অঞ্চল (বাংলা) থেকে অর্থ ও লোক সংগ্রহ করে এবং দুই হাজার মাইল দূরে অবস্থিত বিদ্রোহী শিবিরে তা চালান করে দেয়। বাংলার এমন কোন জনপদ ছিল না যেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ সাহেবের সংস্কারের বাণী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। প্রতিট ধার্মিক পরিবারের যুবকরা সীমান্তে গিয়ে জিহাদ করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। বৃটিশ সরকারের গোয়েন্দার চোখ ফাঁকি দিয়ে একদিন তারা হঠাৎ করে সীমান্তের মুজাহিদ কাফেলায় যোগ দেবার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ত। জমির খাজনা পরিশোধ করতে অসমর্থ কৃষকরাও জিহাদের জন্য নিয়মিত অর্থ প্রদান করতে কুণ্ঠিত হতো না।–[‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’, ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার, পৃষ্ঠাঃ ১।]
ইংরেজী উনিশ শতকের দ্বিথীয় দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত বাংলার মুসলমানরা ইংরেজের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ তৎপরতায় ব্যাপৃত ছিল। বৃটিশ ভারতের বিদ্রোহ প্রচেষ্টায় শামিল হয়। একটি হাজী নিসার আলী ওরফে তিতুমীর পরিচালিত মুক্তি সংগ্রাম, দ্বিতীয়টি হাজী শরীয়তুল্লাহর মুক্তি আন্দোলন এবং তৃতীয়টি ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
তিতুমীরের মুক্তি সংগ্রামের সময়কাল উনিশ শতকের তৃতীয় দশক। ১৮৩১ সালে নারকেল বাড়িয়ার রণাঙ্গনে তিতুমীরের পরাজয় ও শাহাদাত লাভ হলো। আর হাজি শরীয়তুল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলনের সময়কাল ১৮১৯ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮৬২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই দুইটি আন্দোলন প্রকৃতিগত দিক থেকে ইংরেজ কথিত ওহাবী আন্দোলন অর্থাৎ বৃটিশ ভারতের পশ্চিম সীমান্ত ভিত্তিক মহাবিদ্রোহেরই অংশ। ওহাবী আন্দোলন বা সৈয়দ আহমদ শহীদ সৃষ্ট মহাবিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের আল-কুরআন ও হাহিদের শিক্ষায় পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনা এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ের ন্যায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য ছিল তিতুমীর ও ফারায়েজী আন্দোলনেরও। ইংরেজ আমলা মিঃ আই, আর কোলভিন নারকেল বাড়িয়ার ঘটনা ও যুদ্ধ সম্পর্কিত রিপোর্টে তিতুমীরের আন্দোলন সম্পর্কে লিখেছেন, “ঐ লোকদের আদর্শ ছিল প্রায় সার্বিকভাবেই সারা ভারতব্যাপী প্রচারিত সৈয়দ আহমদের আদর্শেরই অনুরূপ। এরা পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার পরিত্যাগ করে মৌল ও নিখাদ মোহাম্মদী ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়”।–[‘Titumir And His Followers in British Indian Record: by Dr Muin-ud-din Ahman Khan. Page 41]
উইলিয়াম হাণ্টারও ফারায়েজীদের সম্পর্কে অনুরূপ কথাই লিখেছেন। তার ভাষায়, “গাঙ্গের ব-দ্বীপ এলাকার ধর্মান্ধ মুসলমানরা নিজেদেরকে ওয়াহাবী না বলে ফারায়েজী অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনাবশ্যকীয় আচারানুষ্ঠানাদি বর্জনকারী হিসেবে পরিচিত করে। কলকাতার পূর্ব দিকের জেলা সমূহে এদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৪৩ সালে এই সম্প্রদায়টি এতদূর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে, তাদের সম্পর্কে তদন্তের জন্যে সরকারকে বিশেষ তথ্যানুসন্ধান কমিশন নিয়োগ করতে হয়। বাংলার পুলিশ প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্টে বলা হয় যে, মাত্র একজন প্রচারক সম্পর্কে তদন্তের জন্যে সরকারকে বিশেষ তথ্যানুসন্ধান কমিশন নিয়োগ করতে প্রায় আশি হাজার অনুগামীর এক বিরাট দল গড়ে তুলেছে এবং তারা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বার্থকে গোটা সম্প্রদায়ের স্বার্থ বলে বিবেচনা করে থাকে। পরবর্তী খলিফারা, বিশেষতঃ ইয়াহিয়া আলী, পূর্ববঙ্গের ফরায়েজীদের ওহাবীদের সাথে একত্রীভূত হরে। গত তের বছর ধরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিহতদের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মামলায় আটক বন্দীদের মধ্যেও উভয় সংস্থার লোকদেরকে পাশপাশি অবস্থান করতে দেখা গেছে।–[‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমান’, ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার, পৃষ্ঠা ৮৪, ৮৫।]
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহ তৎপরতায় মুসলমানদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। কিন্তু এ সংগ্রাম বাংলাদেশে গণরূপ পাবার আগেই শেষ হয়ে যায়। তবু ঢাকার লালবাগ দুর্গে কমপক্ষে ৪০ জন বাঙালী বিদ্রোহী সৈনিক জীবন দেয়, ফাঁসিতে জীবন দেয় আরও বহু। এঁদেরই পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত আজকের বাহাদুর শাহ পার্ক।–[“বর্তমানের শহীদ বাহাদুর শাহ পার্ক” নামে পরিচিত ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে একযোগে ষাটজন মুসলমানকে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ মাসের পর মাস বৃক্ষ শাখায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। (History of Indian Mutiny by Kate & Malleson-Quated by Abul Hashim in ‘Integration of Pakistan’]
এই ভাবে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীতে পরাজয়ের পর রাজ্যহারা মুসলমানদের যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলো, তা চললো, উইলিয়াম হাণ্টারের ভাষায়, ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। একথা হয়তো ঠিক ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের পর সশস্ত্র সংঘাতে ভাটা পড়ে, কিন্তু মুসলমানদের বিদ্রোহাত্মক মনোভাব শেষ হয়ে যায়নি। এর প্রকাশ নানাভাবে ইংরেজের সাথে অসহযোগিতা ও ইংরেজের সব কিছু বর্জন করার মধ্যে দিয়ে ঘটেছে।
ইংরেজ বিরোধী এই অব্যাহত বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার কারণে মুসলমানদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। অনেকে ফাঁসিতে জীবন দিয়েছে, আন্দামানের নির্বাসনে গিয়ে হারিয়ে গেছে শত শত মানুষ, ইংরেজের জেলে ধুকে ধুকে মরেছে হাজার হাজার মুক্তি সংগ্রামী, আর ইংরেজের বিদ্বেষ ও বৈষম্য নীতির শিকার হয়ে গোটা মুসলিম জাতির জীবন কাঠামো সব দিক থেকে ধ্বংস হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ বাংলাদেশের মুসলমানদের করুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে স্বয়ং উইলিয়াম হাণ্টার একথা স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, “মহামান্য রানীর মুসলমান প্রজাদের প্রতি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালতে ব্যর্থ হয়েছি। ভারতীয় জনসমষ্টির একটা বিরাট অংশ, যাদের সংখ্যা তিনি কোটির মত হবে, বৃটিশ শাসনে নিজেদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে। মাত্র গতকালই যে দেশে তারা ছিল বিজেতা ও শাসক, আজ সে দেশেই ভরণ পোষণের যাবতীয় সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। …..তাদের প্রতি আমাদের উপেক্ষা এবং আমাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতাই এর কারণ। এ দেশে শাসন কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত হবার আগে মুসলমানরা এখনকার মত এই ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করেছে, একই খাদ্য খেয়েছে এবং মূলতঃ একই ভাবে জীবন যাপন করেছে। আজ অবধি কিছুদিন পরপরই তারা পুরানো জাতীয় চেতনার অভিব্যক্তি ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু বৃটিশ শাসনে আর সব ব্যাপারেই তারা জাতি হিসেবে ধ্বংস হযে গেছে।–[‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’, ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার, পৃষ্ঠা ১৩১।]
উইলিয়াম হাণ্টারের এই বক্তব্য থেকে পরিস্কার যে মুসলমানদের জাতীয় চেতনার শক্তি ছাড়া এই সময় মুসলিম জাতি রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকুরী-সব দিক থেকেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
এই যখন মুসলমানদের অবস্থা, তখন মুসলমানদের প্রতিবেশী হিন্দু জনগণ ইংরেজ শাসকদের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে জাতীয় সমৃদ্ধি ও জাতি গঠনের দিকে প্রচণ্ডভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। মুসলমানদের বৃটিশ বিরোধী কোন সংগ্রামেই তারা সহযোগিতা দান করা দুরে থাক, সুনজরেই দেখেনি। বৃটিশ ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত ভিত্তিক মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা সুযোগ পেলেই বিদ্রুপ করেছে। কংগ্রেসে যোগ দানে অনিচ্ছুক মুসলমানদের বিদ্রুপ করতে গিয়ে বঙ্কিম চন্দ্র ‘প্রচারে’ লিখেছিলেন, “এক্ষণে শুনিতেছি, চাচাদিগের কোন দোষ নাই। তাহারা পূর্ণ স্বাধীন নহেন। বালক কলের পুতুল লইয়া খেলা করে দেখিয়াছে। সেগুলির কল টিপিলেই দাড়ি নড়ে শুনিয়াছি। পাহাড়ে বসিয়া বড় বড় লোকে নাকি কল টিপিতেছে, তাই ইহারা দাড়ি নাড়িতেছেন”।–[‘দৈনিক বসুমতি’, ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪১।] এখানে বঙ্কিম চন্দ্র পাহাড়ে বসা লোক বলতে সীমান্তের মুসলিম যুদ্ধ শিবিরের লোকদের বুঝিয়েছেন। বস্তুত হিন্দুরা ইংরেজ প্রেমে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিল যে, বালাকোট ও নারকেল বাড়িয়ায় ভারতের মুসলমানরা যখন ইংরেজের হাতে জীবন দিচ্ছে, তখন তারা বলছে, “আমাদের যদি বলা হয় বৃটিশ কিংবা কার শাসন তোমরা চাও। উত্তরে আমরা একবাক্যেই বলিব-বৃটিশ শাসন। এমনকি হিন্দু শাসনও নয়”।–[‘Daily Reference of the Hon’ble, Prosomno Kumar Tagor, July-1831.] এমনকি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাংলার হিন্দুরা বিশেষ করে হিন্দুদের সচেতন শ্রেণী সমর্থন করেনি। তাই তো দেখি, ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজের কামানের গোলায় মানুষ যখন জীবন দিচ্ছিল, তখন হিন্দু পত্রিকা ‘সংবাদ ভাস্কর’ লিখছে, “আমরা পরমেশ্বরের সমীপে সর্বদা প্রার্থনা করি, পুরুষানুক্রমে যেন ইংরেজাধিকারে থাকিতে পারি, ভারত ভূমি কত পূণ্য করিয়াছিলেন এই কারণ ইংরেজ স্বামী পাইয়াছেন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত যেন ইংরেজ ভূপালদিগের মুখের পান হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করে”।–[‘সংবাদ ভাস্কর’, ২০ শে জুন, ১৮৫৭।]
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তারা কি দৃষ্টিতে দেখেছে, বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি কি নিষ্ঠুর মনোভাব প্রকাশ করেছে, তার কিঞ্চিত দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যায়। ঐ ‘সংবাদ ভাস্করই’ লিখছে, “আগ্রা, দিল্লী, কানপুর, অযোধ্যা, লাহোর প্রদেশীয় ভাস্কর পাঠক মহাশয়েরা এই বিষয়ে মনোযোগ করিবেন এবং পাঠ করিয়া বিদ্রোহীদের আড্ডায় ইহা রাষ্ট্র করিয়া দিবেন, সিপাহীরা জানুক বৃটিশ গভর্নমেণ্ট সিপাহী ধরা আরম্ভ করিয়াছেন আর বিদ্রোহী সিপাহী সকল শোন শোন, তোদের সর্বনাশ উপস্থিত হইল, যদি কল্যাণ চাহিস তবে এখনও বৃটিশ পদানত হইয়া প্রার্থনা কর, ক্ষমা করুন। গত বুধবার বেলা দুই প্রহর দুই ঘন্টাকালে সৈন্য পরিপূর্ণ এক জাহাজ অতি সুদৃশ্য দৃষ্ট হইল, গোরা সৈন্যরা পাঁচশ সিপাহীকে হাতে হাতকড়ি পায়ে বেড়ি দিয়া লইয়া আসিয়াছে, গভর্নমেণ্ট সিপাহীদের যে ক্রোধ করিয়া রহিয়াছেন, তাহাতে বলিদান দিবেন ইহাই জ্ঞানগ্রাহ্য হইতেছে। কালিঘাটে বহুকাল নরবলি হয় নাই। আমাদিগের রাজেশ্বর যদি হিন্দু হইতেন, তবে এই সকল নরবলি দ্বারা জগদম্বার তৃপ্তি করিতেন”।–[…………….]
সাধারণভাবে হিন্দুদের এ মনোভাব বৃটিশ সরকারও জানতেন। তাই সিপাহী বিদ্রোহের সব দায় এসে মুসলমানদের ঘাড়েই বর্তেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ হবার পর যে প্রচণ্ড হত্যালীলা শুরু হয় তার প্রাথমিক শিকার হন ওহাবী আন্দোলন চিহ্নিত আলেম সমাজ। তাই বিপ্লব পরবর্তীকালে শহীদ হলেন শত শত আলেম। সাত’শ আলেম ফাঁসিতেই জীবন দিলেন। আন্দামানে নির্বাসনে গেলেন মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী, মওলানা ইয়াহিয়া আলী, মওলানা আবু জাফর থানেশ্বরী, মওলানা মুফতি এনায়েত আলীর মত শত শত বরেণ্য আলেম। এক কথায় মুসলিম জাতীয় শক্তিকে একদম নির্মূল করার প্রয়াস চলে। সেদিনের দিল্লীর বিবরণ দিতে গিয়ে কবি গালিম লিখেছেন, “মুসলমানদের অবস্থা দেখে কাঁদবে এমন একজন মুসলামনও দিল্লীতে অবশিষ্ট ছিল না”। আর আন্দামানে বন্দী দশায় মৃত মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী তাঁর আত্মকথায় লিখেন যে, “স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছে একথা প্রমাণ হলেই শুধু কোন হিন্দুকে ধরা হতো, কিন্তু পালাতে পারেনি এমন কোন মুসলমান সেদিন বাঁচেনি”।–[‘আযাদী সংগ্রাম’ ১৮৫৭, অনুবাদঃ মওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ১৭।] মওলানা ফজলে হক ‘আসসাওরা তুল হিন্দিয়া’ বা ‘বাগী হিন্দুস্তান’ শীর্ষক তাঁর আত্মকাহিনীতে তাঁর দেখা অনেক কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বীর নায়ক ছিলেন আহমুদুল্লাহ শাহ। আহমদুল্লাহ শা’র বাহিনী যখন সামনে দাঁড়ানো ইংরেজ বাহিনীকে মোকাবিলায় রত, তখন সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দানকারী দেশীয় হিন্দু রাজা বলদেও সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে পেছন থেকে আহমদুল্লাহ শাহকে আক্রমণ করায় তিনি পরাজিত ও শহীদ হন।–[‘আযাদী সংগ্রাম’ ১৮৫৭, মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী, অনুবাদঃ মওলানা মুহিদউদ্দীন খান, পৃষ্ঠাঃ ২৯।] ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে দিল্লী রক্ষার যে দীর্ঘ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মওলানা মোজাহেদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করিয়াই নাসারা ইংরেজ বাহিনী পর্যুদস্ত হইবার উপক্রম হইল। তাহারা তখন পূর্ব দেশীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট সৈন্য সাহায্য চাহিয়া পাঠাইল। হিন্দুরা অতি দ্রুততার সহিত তাহাদিগকে উপর্যুপরি সৈন্য ও অস্ত্র সাহায্য পাঠাইতে লাগিলেন। এই নতুন সাহায্যে বলীয়ান হইয়া নাসারা বাহিনী পুনরায় তীব্র আক্রমণ আরম্ভ করিল। অল্প দিনের মধ্যে পর্বতোপরিস্থিতিত খৃষ্টান শিবিরে প্রচুর অস্ত্র, রসদ এবং সৈন্য আসিয়া সববেত হইল। তাহাদের মধ্যে লালমুখো ইংরেজ হইতে শুরু করিয়া নিকৃষ্ট ও নীচ শ্রেণীর হিন্দু ভাড়াটিয়া সৈন্য পর্যন্ত সর্বশ্রেণীর মানুষই দৃষ্টিগোচর হইত”।–[‘আযাদী সংগ্রাম’ ১৮৫৭ মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী অনুবাদঃ মওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠাঃ ৯।]
বস্তুত দেশের হিন্দু অধিবাসীরা সাধারণভাবে সব সময় ইংরেজদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, অন্তত বিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সহযোগিতাকালীন সময়ে হিন্দুরা ইংরেজের শিক্ষা, ইংরেজের চাকুরী, ইংরেজের অধীন ব্যবসায় বাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ করে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে প্রায় সব জমিদারি তারা পেয়ে যাওয়ায় শিক্ষা, অর্থ, রাজনীতি সব ক্ষেত্রে হিন্দুরা জাতি হিসেবে শক্তিশালী ও সচেতন হয়ে ওঠে। এই সচেতনতার একটা বড় কারণ ছিল হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে খৃষ্টান ধর্মের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি। “প্রত্যেক প্রেসিডেন্সী শহর কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ এভাবে উদ্রিক্ত হয়। প্রবলভাবেই হয় কলিকাতায়, সেখানে ‘ইয়ং বেঙ্গলী গোষ্ঠী’ হিন্দু ধর্মের সব কিছুই দোষণীয় ভাবতে থাকে এবং প্রকাশ্যে হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করা বীরত্ব ও গর্বের বিষয় বিবেচনা করতে থাকে। তারা প্রকাশ্যে গৃহে, বাহিরে সর্বত্র দল বেঁধে গরুর গোশত ভক্ষণ ও মদ্যপান করতো। ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ও নানাভাবে ইংরেজের সাথে মেলা-মেশা, পাশ্চাত্য ভাবধারা বিশেষত মিল, বেন্থামের শিক্ষার প্রভাবে এ অবস্থার উদ্ভব ঘটে”।–[মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তরঃ আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ১১৩।] উদ্ভুত এ পরিস্থিতিতে হিন্দু ধর্মের সংস্কার এবং হিন্দু জাতীয়তার উত্থান ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে। হিন্দু ধর্মে ভাঙ্গনের এ জোয়ার রোধ করতে এগিয়ে আসেন শীর্ষ হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা। রাজা রামমোহন রায় ‘হিন্দুধর্মের গণ্ডির মধ্যেই আত্মরক্ষা করে ভাঙনের গতিরোধ করলে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তন করে। নিরাকার পরম ব্রহ্মের উপাসনা করাই এ মতের সারমর্ম’।–[‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তরঃ আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ১১৪।] ব্রাহ্মমতের এ বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকে মনে করেন, ‘ব্রাহ্মসভা’ বা ‘ব্রাহ্মমত’ হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক। একথা মোটেই ঠিক নয়। ব্রাহ্মমত পোষণের জন্যে হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করতে হয় না। শুধু অমানবিক ও অসামাজিক প্রথা ও আচারগুলো (যেমন সতীদাহ) পরিত্যাগ করে সাধারণ মন্দিরে পরম ব্রহ্মের উপাসনা করতে হয় আদি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে। ‘রাজা রামমোহন নিজে একজন ধার্মিক হিন্দু ছিলেন এবং সেই সঙ্গে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণও’।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৭।] ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার রামমোহন সম্পর্কে এই সাক্ষ্যই দিয়েছেন। লিখছেন তিনি, “একথা বিশেষভাবে স্মরণ রাখা উচিত, রামমোহন কখনও নিজেকে হিন্দু ব্যতীত অন্য ভাবেননি এবং জীবনের শেস দিন পর্যন্ত তিনি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যারা তাঁকে নতুন ধর্মের প্রবর্তক বলেছে। তার আয়োজিত সাপ্তাহিক ব্রাহ্মসভার অধিবেশনে গোঁড়া ব্রাহ্মণ দ্বারাবেদপাঠ করানো হতো এবং কোন অব্রাহ্মণের সে প্রকোষ্ঠে প্রবেশাধিকার ছিলনা। রাজা রামমোহন মৃত্যুকাল পর্যন্ত ব্রাহ্মনের উপবীত ধারণ করেছেন”।–[‘An Advanced history of India’ by Dr. R.C Mazumdar, Page. 877.] বলা যায়, রামমোহনের এই সংস্কার আন্দোলন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখকে নিষ্ঠাবান হিন্দু হতে সাহায্য করেছিল। রামমোহন রায়ের পর হিন্দুধর্মের আরেক অকুতোভয় সংস্কারক হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হিন্দু ধর্মের সংস্কার হিন্দুদের জাতীয় চেতনায় যে আঘাত হানে, তা ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী এবং পরে বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা হংসরাজ, লালা লাজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, বিপিন চন্দ্রপাল প্রমুখের নেতৃত্বে মুসলিম ‘বিরোধী আগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করে। এ আন্দোলনের স্বরূপ আলোচনার আগে এ আগ্রাসী উত্থানের উৎস নিয়ে আরেকটু আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
ইংরেজী ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঝড়ের বেগ নিয়ে হিন্দু জাতীয়তার যে রাজনৈতিক উত্থান আমরা লক্ষ্য করি, তার ভিত্তিভুমি রচনা করে তাদের ঊনিশ শতকের সাহিত্যিক সাংস্কৃতির উত্থান। হিন্দুদের এই সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক উত্থান শুর হলো ১৮০১ খৃষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ চালুর মধ্যে দিয়ে। এই বিভাগের প্রধান ছিলেন শ্রীরামপুরের পাদরী উইলিয়াম কেরী। আর এ বিভাগে পণ্ডিত হিসেবে নেয়া হলো মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি, শ্রীপতি মুখোপাধ্যয়, আনন্দ চন্দ্র, কাশীনাথ, পদ্মলোচন চুড়ামনি ও রামরাম বসুকে।
এই পণ্ডিতরা দু’টি কাজ করলেন। এক, মুসলিম আমলের বাংলা গদ্যের ধারা বাদ দিয়ে তারা সংস্কৃতি শব্দ ভারাক্রান্ত নতুন বাংলা গদ্যের উদ্ভব ঘটালেন। দুই, বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে হিন্দু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সামনে আনলেন। রাম রাম বসু লিখলেন ‘প্রতাপাদিত্য’, মৃত্যুঞ্জয় লিখলেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’ ও ‘রাজাবলী’, রাজিব লোন লিখলেন ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র’। এসব গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে প্রতাপাদিত্য, রূপ সনাতন ও বীরবল প্রভৃতি যেসব চরিত্র সামনে এল সেগুলো হিন্দু ইতিহাসের উপজীব্য চরিত্র। মৃত্যুঞ্জয়ের ‘রাজাবলী’ হলো চন্দ্রবংশের ক্ষেত্রজ-সন্তান বিচিত্রবীর্য থেকে বাংলাদেশে কোম্পানী শাসন প্রতিষ্ঠার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস। এ ইতিহাসে মুসলিম শাসন আমলকে বিদ্বেষদুষ্ট ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ‘এই ভাবেই ভাষা ও বিষয় বস্তুর দিক দিয়ে পণ্ডিতদের সাধনায় সংস্কৃত ও হিন্দুদের মাহাত্ম প্রতিষ্ঠায় ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি হয়েছিল প্রশস্ত ক্ষেত্র’।–[‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর’, আব্দুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৪।]
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা চালু এবং ছাপাখানা বিস্তার লাভের পর হিন্দুদের দ্বারা একের পর এক পত্রিকা প্রকাশ পেতে শুরু করে। এসব পত্রিকার মধ্যে রয়েছে দিগদর্শন (এপ্রিল ১৮১৮), সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ (জুন, ১৮১৮), ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ (সেপ্টেম্বর ১৮২১), সম্বাদ কৌমুদী (ডিসে, ১৮২১), ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১), ইত্যাদি। এসব পত্রিকার সবগুলোই হিন্দুদের। মুসলমানরা সংবাদ পত্র জগতে প্রবেশ করে আরও প্রায় একশ’ বছর পরে। হিন্দুদের এসব পত্রিকা হিন্দুধর্ম ও জাতিসত্তার বিকাশে অমূল্য ভূমিকা পালন করে। পত্রিকাগুলো অব্যাহত ধারায় তৈরী করে চলে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যুগান্তকারী যে হিন্দুলেখকদের আমরা দেখি, তা এ পত্রিকাগুলোর হাতে গড়া। ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ভূমিকা সম্পর্কে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, “এই পত্রিকাটি বাংলায় সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঈশ্বর চন্দ্রের প্রতিভা গদ্য, পদ্য ও ব্যঙ্গাত্বক লেখার মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত ধারায় মানুষের তৃষ্ণা মোচন করেছে। বঙ্কিম চন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্রের মত বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভার বেশ কয়েকজন এ পত্রিকায় শিশু কলাম লিখার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য জীবন শুরু করেন। সাহিত্য প্রতিভার সন্ধানে এবং তরুণ লেখকদের উৎসাহ দানে ঈশ্বরগুপ্ত নিরলস ছিলেন।–[Dr. Donesh Chandra sen, ‘Bangali Language & Literature’, Page 762.] রাম রাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য’ (১৮০১) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ‘রাজাবলী’ (১৮০৮), ইত্যাদির মাধ্যমে হিন্দু জাতির যে ঐতিহ্য সন্ধান শুরু হয়, তা উনিশ শতকের চতুর্থ কোয়ার্টারে এসে বঙ্কিম সাহিত্যে চরম অসহনশীল ও বিনাশী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। অবশ্য বঙ্কিমের আগে ভূদেব মুখোপাদ্যয়-এর ‘অঙ্গুরী বিনিময়’ (১৮৫৭) উপন্যাসে মুসলিম ইতিহাসের বিকৃতি ও মুসলিম বিদ্বেষের নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখি। তথাকথিত এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে শিবাজীকে প্রথমবারের মত হিন্দুদের জাতীয় বীর ও হিন্দু উত্থান ও অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়।
বঙ্কিম তার সাহিত্যে শিবাজীর এই রূপকে ষোল কলায় পূর্ণ করলেন এবং ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার নামে মুসলিম ইতিহাস-বিকৃতির বন্যা বইয়ে দিলেন। মুসলামনদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর আকর হয়ে দাঁড়াল তার সাহিত্য।
বঙ্কিমের উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘রাজাসিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ই সবচেয়ে বিপজ্জনক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিতে এ দু’টি উপন্যাস অনন্য। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে। ‘আনন্দ মঠ’ও প্রকাশ করা হয়েছে এই একই সময়ে অর্থাৎ ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে।–[‘বঙ্কিম রচনাবলীঃ উপন্যাস সমগ্র’, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।] ‘রাজ সিংহ’ রচিত হয় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে। এতে আওরঙ্গজেবকে বিকৃত চরিত্র, ইসলাম ও মুসলমানদের কদর্য রূপ এবং হিন্দু রাজপুতদের সাহসিকতা, সংগ্রাম ও ঔদার্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসের টার্গেট ছিল মুসলমানকে হীন ও ম্লেচ্ছ করে দেখানো এবং হিন্দুদের আদর্শ ও উত্থানকে আকাশস্পর্শী করে চিত্রিত করা। ‘আনন্দ মঠে’ ভবানন্দ মহেন্দ্রকে বলছে, “সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউয়ের পেটে ছেলে রেখে সোয়াস্তি নাই, পেট চিরে ছেলে বার করে। সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণা-বেক্ষণের সম্বন্ধ, আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই। ধর্ম গেল, এখন প্রাণ যায়। এ নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর হিন্দুর হিন্দুয়ানি থাকে না”।–[‘বঙ্কিম রচনাবলীঃ উপন্যাস সমগ্র’, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।] উল্লেখ্য, বাংলায় মুসলিম শাসন শেষ হবার প্রায় এক’শ ২৫ বছর পর বঙ্কিম এসব কথা লিখছেন। অথচ যে বৃটিশ শাসন ও শোষণের মধ্যে বসে তিনি লিখছেন, সেই বৃটিশের বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। যেমন, ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসে ক্যাপ্টেন টমাসকে ভবানন্দ বলছেন, “কাপ্তান সাহেব, তোমায় মারিবনা, ইংরাজ আমাদের শত্রু নহে। কেন মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? ….ইংরাজের জয় হউক, আমরা তোমাদের সুহৃদ”।–[‘বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস’, নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, পৃষ্ঠা ৪৯১।]
বঙ্কিম মুসলমানদের তাড়াতে চান, মুসলমানদের দেশ ছাড়া করতে চান। তাঁর লক্ষ্য কি? বিভিন্নভাবে ব্রাহ্মণরাই বঙ্কিম উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আনন্দ মঠ উপন্যাসেও সর্বময় কর্তা একজন ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণ। ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে যিনি দেবী চৌধুরানীকে দীক্ষা দিলেন তিনিও ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারী। ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসেও তাই। এখানেও আনন্দ মঠের মতই ব্রাহ্মণ মাধবাচার্য রূপে হেমচন্দ্রকে ডেকে বলছেন, ‘তুমি দেবকার্য না সাধিলে কে সাধিবে? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে? যবন নিপাত তোমার একমাত্র ধ্যান হওয়া উচিত”।–[‘বাংলা সাহিত্যের নূতন ইতিহাস’, নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, পৃষ্ঠা ২৯।] এই ব্রাহ্মণদের ‘ব্রাহ্মণ্য শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠাই যে বঙ্কিমের আদর্শ, ইহা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ব্রাহ্মণ বঙ্কিম চন্দ্রের রচনায় নিরপেক্ষ ভাবে সৎ। তাহার শাসনের প্রতিষ্ঠা হইলেই শ্রেষ্ঠ শাসনের প্রতিষ্ঠা হইবে। তাহার চরিত্র, বুদ্ধি ও নৈতিকতা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন কখনো উঠে নাই। দেবী চৌধুরাণী, ভবানন্দ, চন্দ্রশেখর, হেমচন্দ্র আর যত রাজা ও সামন্ত ইহারা সকলেই ব্রহ্মাচারী ব্রাহ্মণের আজ্ঞাবহ-কর্মী। ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের কোন পরামর্শ-সভা নেই, মানুষের কোন পরামর্শ তাহাকে চালিত করেনা। তিনি ধ্যানস্থ হইলে যোগের মহিমায় আপ্তবাক্য শুনিতে পান, তাহাই জীবানন্দ, ভবানন্দ, চন্দ্রশেখর, হেমচন্দ্র আর যত রাজা ও সামন্ত ইহারা সকলেই ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের কোন পরামর্শ-সভা নেই, মানুষের কোন পরামর্শ তাহাকে চালিত করেনা। তিনি ধ্যানস্থ হইলে যোগের মহিমায় আপ্তবাক্য শুনে পান, তাহাই জীবানন্দ, ভবানন্দ ও হেমচন্দ্রের জন্য আইন”।–[‘বাংলা সাহিত্যের নূতন ইতিহাস’, নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, পৃষ্টা ৪৯৫, ৪৯৬।]
ব্রাহ্মণ্যবাদী উত্থানের এই লক্ষ্যের কারণে বঙ্কিম “রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ-মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভুত হলেন। এবং এভঅবে তীব্র সাম্প্রদায়িকতায় যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে তার দ্বিতীয় নজীর নেই।….অস্ত্রের মুখে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় কালের প্রলেপে সে ক্ষত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু লেখনির মুখে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তার নিঃশেষ নেই, নিরাময় নেই। যুগ থেকে যুগান্তরে সে ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।…তিনি মুসলমান বিদ্বেষের যে বিষবহ্নির উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতি ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষে শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে”।–[‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৯]
হিন্দুদের “ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক সাম্প্রদায়িকতার যে কদর্য পংকিল ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হলো, অতঃপর তার পদাংক অনুসরণ করে পণ্ডিত অপণ্ডিত ও সাহিত্যিক অসাহিত্যিক বর্ণহিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় সে আবর্তে পরমানন্দে অবাগহন করে আসছেন লেখনি চালনা করে”।–[‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা-৩৪০] সবচেয়ে দুঃখের বিষয় “মানবতাবাদী’র পোশাক পরা রবীন্দ্রনাথ এ হিন্দু মানসিক গণ্ডির বাইরে যেতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের শিবাজী উৎসব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের যে রূপ আমরা দেখি তার সাথে বঙ্কিমের চেহারার কোন পার্থক্য নেই। ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের মত ‘ধর্মরাজ্য’-এর স্বপ্ন দেখেছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ
“সেদিন শুনিনি কথা,
আজি মোরা তোমার আদেশ
শির পাতি লব,
কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে সর্বশেষ ধ্যানমন্ত্র তব।
ধবজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন
দারিদ্রের বল।
এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে
এ মহাবচন
করিব সম্বল”।–[‘শিবাজী উৎসব’ কবিতাটির সম্পূর্ণাংশ এই বইয়ের পরিশিষ্ট-১ এ দেখুন।]
এই ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শিবাজীকে জাতীয় বীর, জাতীয় নেতা, জাতির পথিকৃৎ হিসেবে ধরে শিবাজীর স্বপ্ন ভারতে ‘ধর্মরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে একমাত্র সম্বল বানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত কাজী আবদুল ওদুদ সম্ভবত মুখ রক্ষার জন্যে বলেছিলেন যে, ‘শিবাজী উৎসব’ উপলক্ষে লিখিত এ কবিতা রবীন্দ্রনাথ পরে বর্জন করেছিলেন। কিন্তু এটা ডাহা মিথ্যা কথা। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই পশ্চিম বাংলার সরকারী ও শান্তি নিকেতনী সংস্করণে এ ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘দুরাশা’ গল্পেও বঙ্কিম মানসিকতার সাক্ষাত মিলে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ যখন উগ্র, তীব্র হয়ে উঠছে সেই সময় ১৩০৫ সালে অর্থাৎ ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ এ গল্প লেখেন। এ গল্পে তিনি দেখান, বাদাউনের কুমারী নবাবজাদী ব্রাহ্মণ সেনাপতি কেশরলালের প্রেমে অন্ধ হয়ে পড়েন, কিন্তু তার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হন। অতপর নবাবজাদী সারাজীবন ব্যাপী সাধনা করেছেন ব্রাহ্মণ হবার জন্যে। এই গল্প পড়ে সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক বেদনাহত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বঙ্গের প্রিয় কবির তো এই কীর্তি!’-[কাজী ইমদাদুলহক গ্রন্থাবলী (বাঃ উঃ বোর্ড, সহ) ১ম খণ্ড, ৪৪-এ, ৪৫।] বঙ্কিম সাহিত্যে, বিশেষ করে উপন্যাসে, কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবেযে ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণ’কে দেখি, তার সাথে রবীন্দ্রনাথের গোরা’ উপন্যাশের ‘গোরা’ চরিত্রের কি কোন মৌলিক পার্থক্য রয়েছে? নাই। স্বয়ং কাজী আবদুল ওদুদ তার বাংলার জাগরণ গ্রন্থে লিখছেন, ‘ভঙ্গভংগের একটা বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে লিখিত ‘গোরা’ উপন্যাস (১৯০৯) খানিতে রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রীতি ও গভীর ভাবপ্রবণতার অঞ্জন চোখে মাখিয়া হিন্দু ধর্মের বিকার গুলিকেও রমণীয় করিয়া দেখিয়াছেন। তাহার সমস্ত কবি কল্পনা, সমস্ত গভীর সমবেদনা, সমস্ত পরিতাপ, তীব্র আবেগ হ্নিদু ধর্ম নামে অভিহিত যে অতীত গৌরবে লুপ্ত প্রায় ভগ্নাবশেষ, তাহার দিকে অনিবার্য ভাবে ধাবিত হইয়াছে”।–[কাজী আবদুল ওদুদ-এর ‘বাংলার জাগরণ’-এ উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৫৮ (রবীন্দ্র জীবনী দ্রষ্টব্য)।]
রবীন্দ্রনাথ তার বিশাল সাহিত্যে মুসলিম জাতির জন্যে কিছু করেননি।–[“মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারিনা। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেদেরই সৃষ্টি করা”। (নওয়াব আলী চৌধুরী সাহেব একটি ভাষণে মুসলমান বিদ্বেষ পূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন)।] কিন্তু সুযোগ পাওয়ার পর মুসলিম জাতিকে আঘাত দিতে তিনি ছাড়েননি। কথা কাব্যের ‘বিচার’ কবিতায় তিনি মৈশুরপতি হৈদারালীর’ ‘দর্প ধ্বংস’ করেছেন এবং ‘জোগাতে যমের খাদ্য’ ‘যবন নিপাত’ করতে চলেছেন।–[‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৩, ৮৪, ৮৫।] রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তম খন্ডের ‘মাসী’, ‘বন্দী বীর’, ‘হোলী খেলা’, প্রভৃতি কবিতায়ও তার এই মানসিকতার সাক্ষাত মিলে। গল্পগুচ্ছর ‘রীতিমত নভেল’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সবচেয়ে নগ্নভাবে ধরা পড়েছেন। তিনি লিখছেন, “আল্লাহু আকবর’ শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিন লক্ষ যবন সেনা, অন্যদিকে সহস্র আর্য সৈন্য। “হর হর বোম মোম!’ পাঠক বলিতে পার, কে ঐ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশ জনমাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহনে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কর নিক্ষিপ্ত বজ্রের ন্যায় শত্রু সৈন্যের উপর আসিয়া পতিত হইল? বলিতে পার, কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবন সৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহার অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল? কাহার বজ্রমন্দ্রিত ‘হর হর বোম বোম” শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল? কাহার উদ্যত অসির সম্মুখে ব্যাঘ্র-আক্রান্ত মেষ যুথের ন্যায় শত্রু সৈন্য মুহুর্তের মধ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়নপর হইল? ইনি সেই ললিত সিংহ”।–[‘গল্পগুচ্ছ’, অখণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯।] এখানে রবীন্দ্রনাথ বংকিমের মত শুধুই মুসলিম বিদ্বেষ নয়, মুসলিম বৈরিতায়ও অবতীর্ণ। বর্ণণা, শব্দচয়ন কোন ক্ষেত্রেই এখানে বঙ্কিমের সাথে রবীন্দ্রনাথের কোন পার্থক্য নেই।
সাহিত্য সমাজের প্রতিচ্ছবি, সাহিত্য সমাজ-মনের রূপকার। এ কারণে বঙ্কিম সাহিত্যে উনিশ শতকের চতুর্থ কোয়ার্টারে মুসলিম বিনাশী যে রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তার প্রকাশ এ সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও দেখা গেল। এই ক্ষেত্রে মুসলিম বিনাশী আন্দোলনের প্রথম ধ্বজা উড়ালেন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-৯৩)। তিনি ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আর্য সমাজ’। এরপর ‘গো-রক্ষা-সমিতি’। এইভাবে স্বামী দয়ানন্দ সনাতন হিন্দুত্বের মাহিমায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু কালচারে অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং উপমহাদেশে আরও দু’টি ধর্ম ইসলাম ও খৃষ্টান ধর্মকে অস্বীকার করে এক হিন্দু ভারতীয় কালচারের প্রচার করেন।–[‘Misra’, পৃষ্ঠা ৩৮২, ৩৮৩ (আব্দুল মওদুদ কর্তৃক তার গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ২৮৭)।] “হিন্দু পুনরুত্থান আন্দোলন তখন আর নির্দ্যেষ ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের মধ্যে নিবদ্ধ রহিল না। এখন হইতে এই আন্দোলন খোলাখুলি মুসলিম বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হইল”।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, -মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১১৭।] ‘দয়ানন্দের আর্যসমাজ হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধটা যতো বিচ্ছিন্ন করেছে, যতো সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে এদেশে শান্তি শৃংখলা নষ্ট করেছে, আর কোনও হিন্দু ‘ধর্ম-সমাজ’ তার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। আর্য সমাজের ‘শুদ্ধি করণ’ ‘গোরক্ষিণী’ এবং ‘হিন্দুর ভারত হিন্দুর হবে’ আন্দোলন যে তীব্র বিষক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, আজও তার গলিত পুঁজ-রক্তে হিন্দুমন বিষাক্ত হয়ে আছে’।–[‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর’, আব্দুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ২৮৭] আর্য সমাজ ও তার উত্থানবাদী প্রচার সে সময় কি সমাজ-পরিবেশের সৃষ্টি করল, তার একটা সুন্দর বিবরণ পাওয়া গেছে সে সময়কার একজন অধ্যাপকের জবানীতে: ‘সঠিক কাজ করতে কোনও দেরী সমীচীন নয়। হিন্দুদের কোনও প্রতিনিধিত্ব মূলক সংস্থা-যেমন হিন্দু মহাসভা কিংবা এ উদ্দেশ্যে আহুত সর্বভারতীয় হিন্দু সম্মেলন-অবিলম্বে একটি সুপ্রীম কাউন্সিল গঠন করুক এদেশে সব বিদেশী ধর্মকে ‘হিন্দু’ রূপদান করতে। এই কাউন্সিলের কাজ হবে, চারটি বিদেশাগত ধর্মকে ‘হিন্দু’ করতে সঠিক নামকরণ করার। আমাদের প্রস্তাব, ইসলামকে ‘নিরাকার সমাজ’, খ্রীষ্টধর্মকে ‘ইঙ্গ পুজক সমাজ’, ও ইহুদী ধর্মকে ‘পবিত্র সমাজ’ নাম দেয়া যেতে পারে। হিন্দু নেতারা যদি এসব ধর্মকে এদেশে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ‘হিন্দু’ করে ফেলতেন, তাহলে এসব ধর্মানুসারীরা হিন্দু আচার অনুষ্ঠান গ্রহণ করে হিন্দুত্বে বিলীন হয়ে যেতো এবং ‘হিন্দু জাতির’ অন্তর্গত হতো”।–[‘The Hindu Muslim Riots’ By Ratish Mohan]
স্বামী দয়ানন্দ মারা গেলেন ১৮৮৩ সালে। কিন্তু তাঁর ‘আর্য সমাজ’ এর মিশন শেষ হয়ে গেলনা। ‘দয়ানন্দের মতবাদ ও কার্যক্রম পরবর্তীযুগে কংগ্রেস কর্মী গঙ্গাধর তিলক, লালা হংসরাজ, লালা লাজপত রায় ও স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রমুখ গোঁড়া হিন্দুরা আরও ব্যাপকভাবে চালাইয়া যাইতে থাকে। বস্তুত, স্বামী দয়ানন্দের অপেক্ষাও তাহারা অধিক কার্যক্ষম ছিলেন। কেননা কংগ্রেসের মত এক সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান তাঁহাদের কুক্ষিগত ছিল”।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১১৮।]
ঠিক এই সময় আরেকটি হিন্দু চরমপন্থী সংস্থার উদ্ভব ঘটে। স্বামী বিবেকানন্দ এ সময় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (মৃত্যু ১৮৮৬)-এর নামানুসারে ‘রাম কৃষ্ণ মিশন’ গড়েছিলেন। তিনি এই মিশনকে এক চরমপন্থী হিন্দু সংস্কার-সংস্থার রূপান্তরিত করলেন। স্বামী বিবেকানন্দের প্রচার ছিল, হিন্দু কৃষ্টি ও সভ্যতা দুনিয়ার সেরা এবং প্রাচ্য প্রতীচ্যের সকল ঐশ্বর্যের মূলে রয়েছে হিন্দু ধর্ম। ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজ নামে কোন কিছু যে তার চার পাশে আছে, তাকে তিনি ভ্রুক্ষেপই করতেন না।
রামকৃষ্ণপরমহংস দেবের মৃত্যুর এক বছর আগে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হলো। লর্ড ডাফরিন এদেশের ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দুদের সাহায্যে ভারতে ইংরেজ শাসন সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে এদেশের মানুষের মন-মানসিকতা আঁচ করা এবং কি করে তাদের অভাব অভিযোগের প্রতিবিধান করা যায়, তারই পথ বাতলানোর জন্যে লর্ড ডাফরিন এ্যালেন অক্টিভিয়ান হিউমের মাধ্যমে ৫০ জন সদস্য নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ গঠন করলেন। বস্তুত এই কংগ্রেস ছিল অসন্তোষ নিরসনের একটা ‘বক-চোষক’ গদি।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুব রহমান, পৃষ্ঠা ১৩৩, ১৩৪।] ১৮৮৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বোম্বেতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনেই কংগ্রেসের মনোভাব সুস্পষ্ট করে তোলা হলো। অধিবেশনের সভাপতি বাংগালী খৃষ্টান উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী তার সভাপতির ভাষণের উপসংহারে বললেন, “কংগ্রেসের একান্ত কামনা ভারতে বৃটিশ শাসন চিরস্থায়ী হোক এবং কংগ্রেসের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রশাসনিক বিষয়ে অংশীদারিত্ব”।–[‘Moderates and Extremist in National Congress’, by Daniel Agrow.] আরেকজন বাঙালী হিন্দু, হিন্দুদের জাতীয়তাবাদী পুনরুত্থানের নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর অংশ গ্রহণে অনুষ্ঠিত ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসের কোলকাতা সম্মেলনের সভাপতি দাদাভাই নওরোজী বললেন, “এমনকি কংগ্রেস সদস্যদের অস্থি মজ্জা পর্যন্ত বৃটিশের প্রতি অনুগত। হিন্দু রাজত্বের গৌরবময় যুগেও কি কেউ কল্পনা করতে পারতো যে, ভারতের বিভিন্ন স্থান হতে আগত প্রতিনিধিদের নিয়ে কংগ্রেসের মত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা সম্ভভ? এটা শুধু বৃটিশ শাসনেই সম্ভব হয়েছে”।–[‘Moderates and Extremist in Indian National congress’, by Daniel Agrov.] ১৮৯৫ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ সম্মেলনে বাংগালী নেতা ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরোধা বলে কথিত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সভাপতির ভাষণে বললেন, “ইংলন্ডের নিকট আমরা উৎসাহ ও সহানুভূতি কামনা করি। রাজনীতির ক্ষেত্রে ইংলন্ড আমাদের পথ প্রদর্শক। আদর্শের ক্ষেত্রে ইংলন্ড আমাদের গুরু”।–[‘Moderates and Extremists in Indian National congress’. By Daniel Agrov.]
হিন্দুজাতির উত্থানবাদী শিক্ষিত হিন্দুরা এইভাবে ইংরেজদের সাথে আপোষ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে একক টার্গেটে পরিণত করল। সচেতন অনেক মুসলমান এটা সেই সময়েই বুঝতে পেরেছিল। ১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে যখন কংগ্রেস অধিবেশন চলছিল, সেই সময় বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের নেতা এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ লাক্ষ্মৌতে বললেন, “যদি কেউ ভবিষ্যতে হিন্দু শাসনের জোয়ালে আবদ্ধ হয়ে আর্তনাদ করার ইচ্ছা রাখে, সে যেন কংগ্রেসে যোগ দেয়”।–[‘Indian National Congress and the Muslim since 1982’, by Dr. Padma Shaha.]
কংগ্রেসের সর্বভারতীয় ছত্রছায়ায় বালগঙ্গাধর তিলকের মত কংগ্রেস কর্মীরা উনিশ শতকের শেষ লগ্ন ও বিশ শতকের সূচনা লগ্নে আরেক মুসলিম বিনাশী আন্দোলনকে আরও তীব্র ও স্পষ্টতর করে তুললো। “১৮৯৮ সালে কেশরী পত্রিকায় তিলক গো-হত্যা নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠা করিয়া মুসলমানদের খোলাখুলি এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আহবান করেন এবং বৃটিশ সরকারকে মসজিদের সামনে বাজনা বন্ধের আইন প্রত্যাহার করতে বললেন। তিনি গীতা হইতে প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিলেন যে, মহাভারতের দৃষ্টিতে আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কর্তব্য বিশেষ। অতএব যে সব পরদেশী (মুসলমান) এই দেশে বাস করিতেছেন তাহাদের এই দেশ হইতে বাহির করিয়া দেওয়া কিংবা হত্যা করা দোষের নয়”।–[‘Stateman of India’, by Robert Biron (উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ৬০।)] এর আগে ১৮৯৫ সালে রায়গড়ের এক জনসভায় এর চেয়েও স্পষ্ট ভাষায় বাল গঙ্গাধর তিলক বলেন, “আমাদিগকেও শিবাজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। ঢাল-তলোয়ার লইয়া অসংখ্য মুসলমান বহিরাগতকে হত্যা করিতে হইবে। যদিও এইরূপ যুদ্ধে আমাদের কিছু হইবে, তাহা হইলেও এইরূপ স্বার্থ-ত্যাগের প্রয়োজন আছে”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’ ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ৬০।]
আর এর এক বছর পর ১৮৯৬ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক আয়োজন করলেন ‘শিবাজী উৎসবের’। মারাঠা শিবাজীর মৃত্যুর ২১৬ বছর পর এই প্রথম শিবাজী উৎসব অনুষ্ঠিত হলো ভারতে। সুতরাং ভারত ইতিহাসের শুধু উল্লেখযোগ্য ঘটনাই এটা নয়, ইতিহাসের দিক-নির্দেশক একটি মাইল ফলকও। আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়, এই শিবাজী উৎসব আয়োজনে যিনি নেতৃত্ব দিলেন, সেই বাল গঙ্গাধর তিলক সামান্য কেউ নন। তিনি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর আদর্শের উত্তরসূরী, তিনি একজন প্রভাবশালী কংগ্রেস-নেতা। ভারতীয় হিন্দুদের জাতীয় আন্দোলনের পথিকৃত’, ‘রাষ্টগুরু’ রূপে সম্মানিত এবং ‘সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ বাংগালী’ বলে কথিত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর চোখে এই তিলক ‘দাক্ষিনাত্যের একজন মুকুটহীন সম্রাট। মিঃ ব্যানার্জীর ভাষায়, ‘পেশোয়া’-এর দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁর (তিলকের) আবির্ভাব’।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৬২। শিবাজীর পরে মহারাষ্ট্রে তার পক্ষ থেকে ভারতে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যারা চালাতেন তাঁরা পেশোয়া বলে অভিহিত হতেন।] কেউ কেউ তিলককে বলেছেন ‘রাজাধিরাজ ছত্রপতি তিলক মহারাজ’। আর কেউ ঘোষণা করেছেন, ‘তিলক লোকমান্যই আমাদের শিবাজী’। এহেন বাল গঙ্গাধর তিলকই নেতৃত্ব দেন শিবাজী উৎসবের। শিবাজী উৎসবের সাথে বাঙ্গালী হিন্দুদের মন ও মেধাও এক হয়ে যায়। যে মা ‘কালী’ বাংগালীদের ভাগ্য বিধাতা, তিনি ছিলেন শিবাজীরও রক্ষাকর্তা। ভবানী ব্যতীত শিবাজীকে কল্পনা করা যায় না’।–[শিবাজী উৎসবের দশম বার্ষিক উপলক্ষ্যে তিলক বাংলায় এলে (১৯০৬) যে সম্বর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, সে সভায় তিলক এই মন্তব্য করেন।] শিবাজী আপন খড়গকে আপনার অধিক সম্মান করিতেন, কারণ এই খড়গই তাহাকে ভবানীর নিকট প্রিয় করিয়া দিয়াছিল’।–[‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বালার বিপ্লববাদ’, উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৩০।] এই ভবানী-প্রীতি ও ভবানী প্রেমের দিক থেকে শিবাজী ও বঙ্কিম একাত্ম। তাই শিবাজী উৎসবে এসে বন্দেমাতরম ও শিবাজী অচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। রত্মাগিরির শিবাজী মন্দিরে বন্দে মাতরম শব্দগুলো শিলাবক্ষে খোদিত হয়ে আছে। শিবাজী উৎসবে এসে একাত্ম হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। শুধু একজন যোগদানকারী হিসেবে নয়, শিবাজী উৎসবকে তিনি তাৎপর্যমণ্ডিত ও স্বরূপে রূপায়িত করেছিলেন ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা লিখে। যাতে তিনি বলেছিলেন ‘এক ধর্মরাজ হবে এ ভারতে এ মহাবচন করিব সম্বল’। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ শিবাজী উৎসব উপলক্ষে ‘এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’-এ মহাবচন স্মরণ করেছেন শুধু নয়, একে সম্বল করার অংগীকার করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো ভারতে এক ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং শিবাজী-এ দু’য়ের মধ্যে সম্পর্ক কি? এ বিষয়টি পরিস্কার হলে ‘শিবাজী উৎসব’-এর তাৎপর্য এবং শিবাজীর মৃত্যুর ২১৬ বছর পর ‘শিবাজী উৎসব’ উদযাপনের অবস্থা ও সময়গত গুরুত্বের দিকটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনার প্রয়োজন।
উনবিংশ শতকে মুসলিম প্রভাব-প্রতিপত্তির শ্মশানভূমির উপর হিন্দুদের জাতীয়তাবাদী জাগরণ ছিল সর্বাত্মকভাবে ধর্মীয়। এই জাগরণ অবশেষে হয়ে ওঠে শক্তিকামী, সামরিক। তারা ভাবতে থাকে তাদের দুর্বলতার কারণেই তাদের ধর্ম যুগের অবসান ঘটেছে, বিপর্যয় ঘটেছে, বিপর্যয় ঘটেছে তাদের জাতীয় জীবনে এবং পতন ঘটেছে তাদের। তাদের এ চিন্তার সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে ‘যুগান্তর’-এ প্রকাশিত তাদের ‘ধর্ম ও স্বাধীনতা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে। বলা হয়েছেঃ
“যেদিন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে ভারতের ক্ষাত্রতেজ নির্বাপিত প্রায়, সেইদিনই এই দেশে কলির প্রথম প্রবেশ। পরীক্ষিতের কোষ মধ্যে অসির ঝংকার ধ্বনি শুনিয়া কলি আরও কিছুদিন চুপ করিয়াছিল, কিন্তু পরীক্ষিতের তক্ষক দংশনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে বিদেশী আক্রমণের সূত্রপাত। ভাবপ্রবণ বৌদ্ধ আচার্যগণ সকলের জন্যেই ত্যাগ মার্গের ব্যবস্থা করিলেন। ফলে ভারতও নির্বীয হইয়া পড়িল। আত্মরক্ষায় অশক্ত হইয়া দাঁড়াইল। শক, হুন, প্রভৃতি বহুবিধ জাতি আসিয়া ভারতবর্ষে রাজ্য পাতিয়া বসিল। পৌরাণিক যুগে আবার ক্ষত্রিয় জাতি জাগিয়া উঠিয়া ভারতের মুখ উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছিল। ‘গান্ধার অবধি সীমা’ আবার নবজীবন সঞ্চারে প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু হায়! সেই সৌভাগ্য গর্বের মধ্যেই আমাদের পতনের বীজ নিহিত ছিল। নতুন করিয়া সমাজ গঠন করিবার সময় আমরা যাহাদিগকে হীন জাতি ভাবিয়া সমাজের একপার্শ্বে ফেলিয়া রাখিয়াছিলাম তাহার কেহ স্বদেশ প্রেমে সঞ্জীবিত হয় নাই। দেশ যেন কেবল ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের। অন্য জাতি যেন কেহই নহে। তাহারও ফল ফলিল। রাজপুতদিগের প্রতাপ যখন গৃহকলহে ব্যয়িত হইতে লাগিল, যুদ্ধ যে কেবল সমর কৌশল দেখাইবার জন্য নহে, স্বদেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য-এ কথা যখন রাজপুতরা ভুলিয়া গেল, তখন পশ্চিম হইতে ঝঞ্ঝাবায়ুর মত আসিয়া তুর্কিরা দেশ অধিকার করিয়া ফেলিল। অনাদরে অব্যবহারে ভারদের ব্রহ্মজ্ঞান ও ক্ষাত্রবীর্য নিস্প্রভ হইতে লাগিল”।–[‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লবাদ’, উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয় প্রকাশক, ফার্মা কে, এল, মুখোপাধ্যয়,, ৬/১-এ বাঞ্ছারাম আক্রুর লেন, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ১৬৮, ১৮৫, ১৮৬।]
পতনের এই কারণ চিহ্নিত হবার পর উনবিংশ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণ আন্দোলনে ব্রহ্মজ্ঞান ও ক্ষত্রিয়তেজ এই দুইয়ের সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করা হলো। তারা অনুভব করল তাদের প্রয়োজন ধর্মরাজ্য। আর এ ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্যে প্রয়োজন ক্ষাত্র-তেজ। যে ধর্মরাজ্য তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাইল তার জন্যে তাদের প্রয়োজন ঐতিহ্যিক প্রেরণা। এই প্রেরণার সন্ধান করতে গিয়ে তারা যা পেল সংক্ষেপে তা এইঃ
“প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুরানাদি আলোচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্টই হৃদয়ঙ্গম হয় যে, প্রাচীন আর্য সভ্যতায়, ধর্মরাজ্য স্থাপন রূপ একটি আদর্শ সুব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। মহাভারতে বর্ণিত প্রসঙ্গের চরম পরিণতি এই ধর্মরাজ্য স্থাপন রূপ আদর্শের প্রতিষ্ঠায় এবং সেই বিচিত্র ঘটনা চিত্রে কেন্দ্র স্থানীয় ঐশ্বর্যশালী বসুদেব তনয়ের সকল চেষ্টা ও প্ররোচনার মূলে এই ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠারূপ উদ্দেশ্য যে নিহিত ছিল তাহাও বিবেচনার দ্বারা প্রতিপন্ন হয়। এই ধর্মরাজ্য সংস্থাপন করিবার জন্য ভগবান শীকৃষ্ণের একান্ত চেষ্টার বিষয় মহাভারতে বর্ণিত হইয়াছে। ধর্মরাজ্য স্থাপন দ্বারা তিনি একদিকে যেমন ভারতের স্বধর্ম পালনের সুব্যবস্থা করিবার প্রয়াসী হইয়াছিলেন, অপরদিকে মোক্ষতত্বের ব্যাখ্যা করিয়া তিনি ধর্মকে মোক্ষের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিয়াছেন। তিনি স্বধর্ম পালনের জন্য যেমন একদিকে অর্জুনকে বলিতেছেন, ‘তম্মাত্বমুক্তিষ্ঠ যশোলভস্ব’, অপরদিকে মোক্ষের প্রতি অনুরাগী করিবার জন্যে তাহাকেই বলিতেছেন ‘নিস্ত্রৈগুন্যো ভবার্জুন’। আর্যসভ্যতা বা আর্য সভ্যতার দুইটা মূল তত্ব স্বধর্ম ও মোক্ষ গীতাতে পরিকীর্তিত হইয়াছে। প্রাচীন কাল হইতে প্রত্যাগমন করিয়া ভারতে মুসলমান বিজয়ের পর একমাত্র শিবাজীকেই ভারতে ধর্মরাজ্য সংস্থাপনে ব্রত গ্রহন করিতে দেখিতে পাওয়া যায়। শিবাজী ধর্মরাজ্য সংস্থাপন কার্যে যখন প্রথম উদ্যোগী হন, তখন রামদাস স্বামী তাহাকে একখানি পত্রে লেখেনঃ ‘আমাদের তীর্থ সকল বিধ্বস্ত হইয়াছে, ব্রাহ্মণগণের আবাস ভূমি সমূহ অপরিবিত্রীকৃত হইয়াছে, সমগ্র পৃথিবী বিপ্লব পূর্ণা হইয়াছে, ধর্ম বিলুপ্ত হইয়াছে, ধর্ম বিলুপ্ত হইয়াছে। এই কারণে আমাদের ধর্মের দেবমূর্তি সমূহের ও গোব্রাহ্মণের রক্ষার জন্য নারায়ণ আপনার হৃদয়াস্থ হইয়া প্রেরণ করিয়াছেন’। বাস্তবিকই ধর্ম বিলুপ্ত হইবার আশংকা হইতেই মহারাষ্ট্র দেশে সপ্তদশ শতাব্দীর অদ্ভুত বিপ্লবের সৃষ্টি হইয়াছিল’।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৮২, ১৮৫, ১৮৬।]
ভাগ্যই বলতে হবে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের। ধর্মরাজ্য ও শিবাজী এক হয়ে তাদের সামনে এসেছে। মুসলিম বিজয়ের পর ভারতে একবারই মাত্র হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে এবং সে কাজে ব্রতী হয়েছিলেন শিবাজী। সুতরাং বাঞ্ছিত ক্ষাত্রতেজও শিবাজীর মধ্যে মূর্ত। মুসলিম শাসন-কালে অনেক হিন্দু নৃপতি ও নেতা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেটা তারা করেছে রাজ্য রক্ষা বা রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে, ধর্মরাজ্যের জন্যে নয়। শিবাজীই একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি রাজ্য রাজত্বের জন্যে নয়, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যেই লড়াই করেছেন সারাজীবন। ব্রহ্মজ্ঞানের ক্ষেত্রে শিবাজীর পূর্ণতা লাভেরই এটা প্রমাণ। এইভাবে বিস্ময়কর শিবাজী চরিত্রে ব্রহ্মজ্ঞান ও ক্ষাত্রতেজ উভয়ই বিস্ময়কর ভাবে সমশক্তিতে বিদ্যমান। হিন্দু ইতিহাসের এই বিস্ময়কর শিবাজী চরিত্রের স্রষ্টা উপরে উল্লেখিত রামদাস স্বামী স্বয়ং। রামদাসের এই সৃষ্টি কিভাবে ও কেন এবং কোন মিশন রামদাস শিবাজীকে দিয়েছিলেন তা না জানলে ‘শিবাজীর সংগ্রাম’-এর মর্ম বুঝা এবং শিবাজীর মৃত্যুর ২১৬ বছর পর ১৮৯৬ সালে ইতিহাসের এক ক্রান্তি লগ্নে ‘শিবাজী উৎসব’-এর তাৎপর্য হৃদয়ংগম করা পূর্ণতা লাভ করবেনা। রামদাসের সে সৃষ্টি কাহিনীটি এইঃ
“…..শিবাজী মোক্ষ সাধনের নিমিত্ত সদগুরুর সন্ধান করিতে করিতে ‘মহাসমর্থ’ রামদাস স্বামীর বিষয় সম্যক অবগত হন। তারপর তার দর্শন লাভ করিবার জন্য তিনি প্রায় উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। অতঃপর নানা স্থানে অনুসন্ধান করিতে করিতে সহসা এক পর্বতে স্বামীর সহিত শিবাজীর সাক্ষাৎকার ঘটে। তিনি সমর্থের চরণ বন্দনা করিয়া তাহার নিকট মন্ত্রোপদেশ গ্রহণের ও তাহার সেবার অধিকারই হইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। স্বামী বলিলেন, ‘তুমি প্রাসাদ বিহারী রাজপুত্র, আমরা অরণ্যচর সন্যাসী, ধর্মসাধনও সহজসাধ্য নহে। অতএব তুমি এ বিষবৃশ অভিলাষ পরিত্যাগ কর। অকারণ ‘ভেকধারণ’ করিয়া জগৎকে প্রতারিত করায় ফল কি?’ এই কথা শুনিয়া রাজপুত্র বাষ্পাকুল লোচনে বলিলেন, ‘রাজ্য-ধন সমস্তই আপনার চরণে সমর্পণ করিয়াছি। এই দাসকে দীনহীন জানিয়া অনুগ্রহ প্রকাশে সনাথ করিবার আদেশ হউক’। শিবাজীর সংকল্প অটল দেখিয়া রামদাস তার প্রার্থনা পূর্ণ করিতে স্বীকৃতি হইলেন। শিবাজী স্নানাদি সমাপন করিয়া ভক্তিপুত হৃদয়ে যথারীতি স্বামীর নিকট পরমার্থতত্ব সম্বন্ধে দীক্ষা গ্রহণ করিলেন। ঘটনা ১৫৭১ শতাব্দের বৈশাখ শুক্লা নবমী বৃহস্পতিবার দিবসে শিবাজীর দ্বাবিংশ বয়ঃক্রম কালে সংঘটিত। স্বামীর উপদেশে ‘আত্মজ্ঞান’ লাভ করিয়া সংকল্প বিকল্পাত্মক সংসারের প্রতি শিবাজীর বিরাগ জন্মিল। রামদাস তাহাকে গৃহে গমন করিতে আদেশ করিলে তিনি বলিলেন, ‘রাজ্য বৈভব ইতঃপূর্বেই শ্রীচরণে অর্পণ করিয়াছি। আর এই ‘দুনিয়ার মায়াবিভ্রমে’ মুগ্ধ না হইয়া গুরদেবের চরণ সেবায় জীবনপাতপূর্বক পরমার্থ সাধন করিব’। ইহা শুনিয়া রামদাস শিবাজীর সংশয় ভঞ্জনের জন্য তাহাকে গীতোক্ত কর্মযোগের উপদেশ প্রদান করিলেন। সমস্ত কর্মফল ইশ্বরে সমর্পণ পূর্বক অনাসক্তভাবে ধমৃ পালন করিয়া লাভ করিয়াছিলেন, তাহাও তিনি শিবাজীর নিটক বিবৃত করিলেন। এই প্রসঙ্গে দেশের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করিয়া শিবাজীকে তৎপ্রতিকারে প্রবৃত্ত করিবার জন্য তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা ‘শিব দিগ্বিজয়’ নামক গ্রন্থ হইতে এস্থলে অবিকল অনুদিত হইলঃ
যবনগণ বহুদিবস হইতে যথেচ্ছাচার করিতেছে, তাহাদিগকে শাস্তি দিতে পারে, হিন্দুগণের মধ্যে এরূপ পরাক্রমশালী পুরুষ কেহ নাই। দুষ্টগণের অত্যাচারে দেব-ব্রাহ্মণদের উচ্ছেদ সাধিত হইয়াছে, সমস্ত ধর্ম ভ্রষ্ট হইয়াছে, নাম সংকীর্তন বিলুপ্ত হইয়াছে, পাপীগণের বল বৃদ্ধি হওয়ায় ধার্মিকগণ দুর্বল হইয়াছে, এই সংকটকালে সকলের সুখ সম্মান লোপ পাইয়াছে। বিপদাগমন হেতু এই পাপকালের আবির্ভাব হইয়াছে, দেবতাগণ (দেবমূর্তি সমূহ) অত্যাচার ভয়ে লুক্কায়িত হইয়াছেন। ব্রাহ্মণগণ তিলকমালা প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়া যবনদিগের অনুকারী হইয়াছে। রঘুপতি এই সকল সহ্য করিতে পারেন না বলিয়া যবনদিগের বিরুদ্ধে তোমার যোজনা করিয়াছেন। তুমি ঈশ্বর সম্ভুত পুরুষ এক্ষণে সময়ের অনুরূপ ধর্ম স্থাপন করা তোমার কর্তব্য। ধর্মের জন্য জীবন বিসর্জন কর; নিজের প্রাণ পণ করিয়াও শত্রুদিগের সকলকে বিনাশ কর। তাহাদিগকে প্রহারে জর্জ্জরিত করিয়া তাহাদিগের নিকট হইতে আপনার রাজ্য প্রতিগ্রহণ কর। ধর্মনীতির উপর রাজ্যের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। ধর্মনীতি পালন না করিলে সকলই মিথ্যা। আপনার মান রক্ষার জন্য অসি গ্রহণ করিয়া যিনি বৈরীকুল সংহার করেন, জগতে তাহার বাহুকীর্তি প্রচারিত হয়। সহকারে উপার্জন করিবে। এ সময়ে শৌর্য প্রকাশ করিয়া ভগবৎ কৃপা লাভ কর। বাহুবলে ধর্ম স্থাপন কর। এ বিষয়ে আলস্য করিওনা। কাপুরুষতা ও ভীরুতা পরিত্যাগ কর। বিপদকে যিনি ভয় করেন, সৌভাগ্য তাহাকে পরিত্যাগ করে’।
রামদাস স্বামীর কর্মযোগমূলক এই উপদেশবাক্য শিবাজীর হৃদয়ে ধর্মরাজ্য স্থাপনের সংকল্প বিপুল উৎসাহ সহকারে আবার জাগ্রত হইয়া উঠিল। তিনি গুরুদেবের আদেশ মত আবার লোকালয়ে ফিরিয়া আসিলেন এবং সেই দিন হইতে সুমহৎ সাধনার প্রবৃত্ত হইলেন”।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লব বাদ’, উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৮৬, ১৮৭, ১৮৮।]
‘শিবাজী উৎসব’-এর মাধ্যমে ১৮৯৬ সালে শুধু এই শিবাজীকে স্মরণ করা নয়, শিবাজীর সংগ্রাম সাধনার উদ্বোধন করা হলো। এর মাধ্যমে উনবিংশ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ‘ধর্মরাজ্য’ ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করল। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যে ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ ও ‘ক্ষাত্র তেজ’-এর প্রয়োজন তার ‘মডেল’ বা ‘প্রেরণা’ হিসেবে সামনে এনে বসানো হলো শিবাজীকে। এ ‘শিবাজী-বিগ্রহ’ সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মত কবি, মানবতাবাদী কবি, আধুনিক কবিও করজোড়ে গাইলেনঃ “সেদিন শুনিনি কথা, আজ মোরা তোমার আদেশ শির পাতি লব, কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে সর্বশেষ ধ্যানমন্ত্রতব। এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে এ মহামবচন করিব সম্বল”। শুধু তাই নয়, তিনি মারাঠি শিবাজীর সাথে বাঙ্গালা ও বাঙ্গালীকে একাত্ম করে শিবাজী উৎসব কবিতায় বললেন, “মারাঠির সাথে আজি হে বাঙ্গালি, এক কণ্ঠে বল
‘জয়তু শিবাজী’।
মারাঠির সাথে আজি হে বাঙালি, একসঙ্গে চলো
মহোৎসব সাজি।
আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম পুরব
দক্ষিণ ও বামে
একত্রে করুক ভোগ এক সাথে একটি গৌরব
এক পুণ্য নামে”।
বস্তুত শিবাজী উৎসবের মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শিবাজীর ‘ধ্যানমন্ত্র ধর্মরাজ্য’কে শির পেতে গ্রহণ করল আনুষ্ঠানিকভাবে এবং সেই সাথে হাত পেতে গ্রহণ করল শিবাজীর ক্ষাত্র-তেজ খড়গকে, যে খড়গকে শিবাজী প্রাণের চেয়ে বেশী ভালভাসতেন, যার কারণে ‘মা ভবানী ভালবাসতেন শিবাজীকে’।
উনবিংশ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শতাব্দী শেষে যে উপসংহারে পৌঁছল, সেই উপসংহার বলো শিবাজী উৎসব। এই উপসংহার অনুসারেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম মুসলিম বিনাশী রূপ পরিগ্রহ করল। হিন্দু সাপ্তাহিক যুগান্তরের পাতায় ২১৬ বছর আগের শিবাজী ও রামদাস যেন কথা বলে উঠল। যমন (মুসলমান) নিধনের জন্য রামদাস যা বলেছে, শিবাজী যা করেছে, ‘যুগান্তর’ তাই ঘোষণা করলঃ
“ধর্ম সাধনের জন্য আত্মরক্ষা ও আত্মরক্ষার জন্যে যে পশুবলেরও আবশ্যক একথা ভুলিয়া আমরা সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করিয়া দিতেছি। যে দুর্বল, পরপদানত, সে কখনও আত্ম-শক্তির পূর্ণ বিকাশ না দেখিয়া মুক্তি লাভের অধিকারী হইতে পারেনা। যে পরাধীন, তাহার পক্ষে কখনও ধার্মিক হওয়া সম্ভবপর নহে। গুরুর আর এখন ইহা ভিন্ন অন্য কিছু শিখাইবার নাই, ছাত্রেরও আর শিখিবার অন্য কিছু নাই। ইহাই এখন যুগ ধর্ম।
নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে, পল্লীতে পল্লীতে, এই আকাঙ্ক্ষা জাগাইয়া দাও। এবং যখন ইহা প্রবল হইয়া উঠিবে, তখন ম্লেচ্ছ-নিবহ নিধন করিবার জন্যে, সাধুগণের পরিত্রাণের জন্যে, ধর্ম রাজ্য সংস্থাপনের জন্যে, যিনি অবতীর্ণ হইবেন এস আমরা তাঁহার উদ্দেশ্যে প্রণাম করিয়া তাহার পদানুসরণের জন্য প্রস্তুত হই”।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লব বাদ’, উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৬৮, ১৭০, ১৭১।]
“ভারতবাসী, তুমি কি হৃদয়ের সহিত বিশ্বাস করিতে পার যে, ‘বন্দেমাতরম’ সেই ধর্মরাজ্য স্থাপনের আহুতিমন্ত্র। তুমি কি এই মহামন্ত্রের অপূর্ব মাহাত্ম আজও বুঝিয়াছ? তুমি কি বুঝিয়াছ এই মন্ত্রসহযোগে যশ, মান, ধন, গ্রাস ধর্মরাজ্য স্থাপন রূপ যজ্ঞে আহুতি দিতে পারিলে যজ্ঞ সুসিদ্ধ হইবেই হইবে? তুমি কি অন্তরে উপলব্ধি করিয়াছ যে আজ সেই মহাযজ্ঞে সফল আহুতি দান করিবার জন্য ভারতের প্রাচীন ধর্মরাজ সংস্থাপকগণ অন্তরীক্ষে উপস্থিত আছেন? তবে, এস ভাই, আজ এই নব্যকুরুক্ষেত্রে ভগবান বাসুদেবকে চিরসারথিত্বে বরণ করিয়া ভবানীপুত্র অমর শিবাজীকে অগ্রগামী জানিয়া ‘বন্দোমতরম’ মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে ধর্মরাজ্য স্থাপন-যজ্ঞে প্রাণ উৎসর্গ করিয়া অনন্তকালের জন্যে ধন্য হইয়া যাই”।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লব বাদ’, উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৩২।]
এই নব্য কুরুক্ষেত্রের ধর্মরাজ্য স্থাপন যজ্ঞে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে মুসলমানদের এনে দাঁড় করানো হলো। অথচ মুসলমানরা তখন ইংরেজদের প্রায় দেড় শতাব্দীর হত্যা-জেল-জুলুম নিপীড়ন-নির্যাতনে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, অসহায়, অরক্ষিত। এই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইংরেজের অনুগ্রহ ও সাহায্য পুষ্ট, অর্থ-বিত্তে বলীয়ান, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হিন্দুদের এই চ্যালেঞ্জ মুসলমানদের জন্যে সেদিন অস্তিত্ববিনাশী এক মহাঅসম যুদ্ধের আহবান ছাড়া আর কিছু ছিলনা।
এ পটভূমিতেই বিদায় নিল উনবিংশ শতক (বাংলার ত্রয়োদশ শতাব্দী) এবং আগমন ঘটল বিশ শতকের (বাংলা চতুর্দশ শতাব্দীর)।