১০
পূর্ব পাকিস্তান হলো বাংলাদেশ
পাকিস্তানের জন্মকে ঐতিহাসিক ‘একটি জাতির জন্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে একথা বলা হয়নি। আসলে ভারত-উপমহাদেশের দুই প্রান্তের দুই ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের জন্মকে একটা রাষ্ট্রের জন্ম বলার চাইতে একটা জাতির জন্ম বলাই যুক্তিযুক্ত। দুইটি ভূখণ্ড মাঝখানে হাজার মাইলেরও বেশী ভিন্ন রাষ্ট্রের দেয়াল নিয়ে একটা রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভ করার দৃষ্টান্ত আধুনিক ইতিহাসে নেই। হাজার হাজার মাইল ব্যবধান নিয়ে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এলাকা মূল মার্কিন ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে। কিন্তু আলাস্কা ক্রয় সূত্রে এবং হাওয়াই দখলি সূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম তাদেরকে নিয়ে হয়নি। বৃটেন ও ফ্রান্সের অনেক দূরবর্তী ভূ-খণ্ড রয়েছে। কিন্তু সেগুলো উপনিবেশ, মূল রাষ্ট্র নয়। মালয়েশিয়ার মূল ভূ-খণ্ড ও তার সারাওয়াক অঞ্চলের মধ্যে অনেক ব্যবধান, কিন্তু তাদের মধ্যে কোন ভিন্ন রাষ্ট্রের দেয়াল নেই। সুতরাং ভারত উপমহাদেশের দুই প্রান্তের দুই ভূ-খণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভ একেবারেই অনন্য একটা ঘটনা। এই অনন্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে দুই ভূ-খণ্ডের মানুষের এক জাতিত্বের ধারণা থেকে। বৃটিশ ভারতের ‘ভারতীয়’রা হিন্দু ও মুসলিম দুই পরিচয় নিয়ে মুসলমানরা গঠন করল পাকিস্তান রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হলো উপমহাদেশে মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে নতুন জন্মলাভের ফলেই। অতএব জাতির জন্মটাই এখানে মুখ্য। এ কারণেই পাকিস্তানের জন্মকে একটা রাষ্ট্রের জন্ম না বলে একটা জাতির জন্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে। আজকের দুনিয়ায় যখন ভাষা ও অঞ্চল ভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের বন্যা বয়ে চলেছে, সেই সময় মুসলিম জাতি ভিত্তিক ভারত বিভাগ এবং রাষ্ট্র গঠন আধুনিক বিশ্বের এক নজীর বিহীন ঘটনা। এই জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গড়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলমানরা অনন্য এক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
কিন্তু রাষ্ট্রটি টিকলনা আড়াই যুগও। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ২৫তম স্বাধীনতা দিবস আসার আগেই ভেঙ্গে পড়ল রাষ্ট্রটি। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলো। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পরিণত হলেও ৪৭-এর ভারত বিভাগের অক্ষুণ্নই থাকল। পূর্ব পাকিস্তান যেমন ছিল মুসলিম আবাসভূমি, বাংলাদেশও সেই পরিচয়কেই গ্রহণ করল। বাংলাদেশ এ পরিচয়কে বড় করে না দেখলে আঞ্চলিক স্বার্থ সুযোগ ও ভাষার ঐক্যকে সামনে রেখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে মিশে যাওয়াই তার জন্যে যুক্তিযুক্ত ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ টিকেনি কেন? টিকেনি কারণ, বিভাগটা ছিল প্রশানসিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনা প্রসূত। এর বিরুদ্ধে কলকাতাইয়ারা শক্তিশালী যুক্তি উত্থাপন করেছিল অখণ্ড বাংলার, অখণ্ড বাঙালী ও অখণ্ড বাঙ্গালী জাতিসত্তার। শেষে এই যুক্তিই জয়ী হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বঙ্গ বিভাগের প্রশ্নে এ যুক্তি উঠেছিল। বলা হয়েছিল বাংলার অখণ্ডত্বের কথা। কিন্তু হিন্দু জনগোষ্ঠী ও তাদের সংগঠন এর সাথে একমত হয়নি। না হওয়ার কারণ বারত বিভক্তিটা ছিল জাতিগত বিভাগ। হিন্দুরা গোটা বাংলাকে মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিতে রাজী হয়নি। বরং তারা বঙ্গমাতাকে এভাবে কেটেছিল যাতে পূর্ব পাকিস্তান একটা পোকায় কাটা রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং যাতে অবশেষে মুসলিম স্বতন্ত্র আবাসভূমিটি না টেকে –মুসলিম জাতি সত্তা বিসর্জন দিয়ে যেন আবার মিলিত হয় হিন্দু ভারতের সাথে। এ উদ্দেশ্যের মধ্যেও ছিল জাতিগত বিদ্বেষ। এই জাতিগত মানস-বিভাগের কারণেই হিন্দুদের ঐ দুরাশা সফল হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান যখন স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ-এ পরিণত হলো তখনও বাংলাদেশ ৪৭-এর দেশ বিভাগের দর্শনকে বিসর্জন দিয়ে পশ্চিম বংগ তথা ভারতের সাথে এক হয়ে যায়নি। সুতরাং স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি পৌণে এক শতাব্দীর সংগ্রামে গড়ে উঠা ৪৭-এর ভারত বিভাগ ভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শনে কোন পরিবর্তন নিয়ে এলনা। পরিবর্তন যা হলো সেটা আকৃতিগত। পাকিস্তান ভেঙে এক অংশ স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হলো, অপর অংশ পাকিস্তানই থাকল।
কিন্তু পাকিস্তান ভাঙার এই কাজটা হলো রক্তক্ষয়ী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে দুই আঞ্চলিক শক্তির বিজয় হলো। পূর্ব পাকিস্তানে বিজয় লাভ করল শেখ মুজিদের আওয়ামীলীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি। গণতন্ত্রের বিধান অনুসারে সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থনপুষ্ট শেখ মুজিব সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময়কাল এবং শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক তুলে জাতীয় পরিষদ আহবানও করা হলো না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরও হলো না। তার বদলে শুরু হলো ভূট্টো-সামরিক কোটারী-পাঞ্জাবী স্বার্থের কুৎসিত ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র যুক্তির বদলে শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করল এবং সামরিক শক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের দাবী দমন করতে চাইল। এই পরিস্থিতিই ডেকে নিয়ে এল রক্তক্ষয়ী সংঘাত। এই সংঘাতেই ভেঙে গেল পাকিস্তান এবং সৃষ্টি হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা।
এই ঘটনা অনেক ঘটনার পরিণতি। ভারতে বৃটিশ রাজত্বের সমাপ্তি পর্বে জাতি হিসেবে মুসলমানদের নতুনভাবে রাজনৈতিক অভ্যুদয় ঘটেছিল এবং তারা পাকিস্তান নামক একটা রাষ্ট্রের মালিক হয়েছিল। কিন্তু এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের উপর যে পবিত্র দায়িত্ব এসে বর্তায়, তা পালন করার মত ইসলাম নির্ধারিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নীতিনিষ্ঠা তাদের মধ্যে ছিল না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই এর নগ্ন প্রকাশ ঘটেছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ভারতের ক্ষমতাসীন মহলের ষড়যন্ত্র। যার লক্ষ্য ছিল ৪৭-এর ভারত বিভাগের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমি যেভাবে পারা যায়, যতটুকু পারা যায় ক্ষতি করা।
শুরু থেকেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র অনুশীলনের সুযোগ হয়নি। আর বলা যায়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও মুসলিম লীগে গণতন্ত্রের অনুশীলন বড় বেশী দেখা যায়নি। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মনে-প্রাণে গণতন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তাঁর সমকক্ষ কোন নেতা মুসলিম লীগে না থাকায় স্বাভাবিক ও সংগতবাবেই মুসলিম লীগে তাঁর একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ ৩০ বছর তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। অথচ পাশাপাশি হিন্দু কংগ্রেসে প্রায় প্রতি বছরই সভাপতি পরিবর্তন হতো। ফলে কংগ্রেসে সমমানের বহু নেতৃত্বের বিকাশ যেভাবে ঘটেছিল মুসলিম লীগে তা হয়নি। মুসলিম লীগের সিদ্ধান্তসমূহ আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হতো, কিন্তু কায়েদে আযমের অভিমতের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিল না। এক সেট সমমানের নেতৃত্ব না থাকার কুফল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছিল। কায়েদে আযম ছিলেন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট, নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল ছিলেন তিনি, সেই সাথে তিনি ছিলেন গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রী সভার বৈঠকে তিনিই সভাপতিত্ব করতেন। লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বটে, কিন্তু শীর্ষ নির্বাহী দায়িত্ব কায়েদে আযমকেই পালন করতে হতো। হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের অভিভাবক পর্যায়ে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ক্ষমতার এই এককেন্দ্রীকতা অপছন্দ করেছিলেন এবং বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।–[Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 252.] কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকারীন সংকট, জটিলতা, ইত্যাদি কারণে কায়েদে আযমের পক্ষে নিছক গভর্ণর জেনারেলের আরাম কেদারায় বসে থাকা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া কায়েদে আযম এজন্যে যথেষ্ট সুযোগও পাননি। স্বাধীনতা লাভের এক বছর ঊনত্রিশ দিনের মাথায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু যে শূন্যতার সৃষ্টি করল তা পূরণ করার কেউ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনকে নিয়ে এসে বসানো হলো গভর্ণর জেনারেলের আসনে। মুসলিম লীগের সভাপতির জন্যে লোক খোঁজাখুজি করে অবশেষে তা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাঁধেই অর্পণ করা হলো। লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিম উদ্দীনের মধ্যে সম্পর্ক সব সময়ই ভাল ছিল। সুতরাং তাদের আমলে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার পত্তন হবার খুবই সুযোগ ছিল। কিন্তু নানা কারণে সে সুযোগ হয়নি, সে সময়ও পাওয়া যায়নি। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে লিয়াকত আলী খান নিহত হলেন। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের আকাশে যে অশুভ কালো মেঘটি দানা বেঁধে উঠেছিল তা শীঘ্রই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল। অশুভ কালো মেঘটি দানা বেঁধে উঠছিল পাকিস্তানের ক্ষমতার আসনকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল পাঞ্জাব। প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে তাদেরই ছিল একাধিপত্য। কিন্তু পাকিস্তানের মূল নেতৃত্বে তখন পাঞ্জাবীরা ছিল না। কায়েদে আযম ছিলেন পাকিস্তান এলাকার বাইরে থেকে আসা রিফুজী। লিয়াকত আলী খানও তাই। আর নাজিম উদ্দীন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এই নেতৃত্বের অধীনে যে শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছিল, তাতে পাঞ্জাবের একাধিপত্য খর্ব হবার আশংকা দেখা দিয়েছিল। এই আশংকাকে কেন্দ্র করে যে অশুভ চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠছিল, তারই ছোবলে প্রাণ দিলেন লিয়াকত আলী খান।–[‘Friends not Master’, Field Marshall Ayub Khan, page 41.] আর এ চক্রান্তেরই শেষ ছোবল ছিল ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা না দেয়া এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে দিয়ে হলেও ক্ষমতা পাঞ্জাবের হাতে কুক্ষিগত রাখা।
লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর নাজিম উদ্দীন হলেন প্রধানমন্ত্রী এবং পাঞ্জাবের অভিজ্ঞ বৃটিশ আমলা ও পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ বসলে গভর্ণর জেনারেলের আসনে। গোলাম মোহাম্মদের কোন রাজনৈতিক চরিত্র ছিল না, তিনি ছিলেন মনে প্রাণে আমলা। আর ছিলেন পাঞ্জাব এবং সিভিল ও মিলিটারী আমলা স্বার্থের প্রতীক।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 262, 263.] সুতরাং আমলা গোলাম মোহাম্মদ এবং রাজনীতিক নাজিম উদ্দীনের দৃষ্টিভংগির মিল হলো না। পাঞ্জাবী স্বার্থের অশুভ থাবার কাছে সুশিক্ষিত নামিজ উদ্দিন নতি স্বীকার করতে চাইলেননা। মন্ত্রী সভায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে লাগল। পাঞ্জাবী গ্রুপ সেখানে সুস্পষ্টভাবেই মাথা তুলল।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 266.] খাজা নাজিম উদ্দিন নতি স্বীকার কারলেন না, কিন্তু হারালেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। ১৯৫৩ সালের অক্টোবর গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ বরখাস্ত করলেন নাজিম উদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়া হলো বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে। নতুন প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব পরিত্যাগ করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যাসাম্য মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রশ্নে আপোশ করলেন। বাংলা ও উর্দুকে যৌথভাবে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারেও ঐকমত্য হলো। এই সমঝোতা ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হলো। এরপর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় বলা হলো যে, ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করার জন্যে খসড়া শাসনতন্ত্র পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হবে। কিন্তু এই আপোশমূলক ফর্মূলাও পাঞ্জাবের স্বার্থবাদী মহলটিকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। তারা মনে করল পাকিস্তান ৫ ইউনিটে বিভক্ত হওয়ায় তাদের স্বার্থ বিপন্ন হবে পূর্ব পাকিস্তানের মোকাবিলায়। এই স্বার্থেরই ক্রীড়নক ছিলেন গভর্ণর গোলাম মোহাম্মদ। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই তিনি শাসনতন্ত্র পাশ হওয়ার পথ রুদ্ধ করার জন্যে ১৯৫৩ সালের ২৪শে অক্টোবর মন্ত্রীসভা বাতিল করলেন এবং গণপরিষদ ভেঙ্গে দিলেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে মামলা দায়ের করা হলো। সুপ্রীম কোর্ট আদেশটিকে বৈধ ঘোষণা করল, তবে তার রায়ে বলল, রাষ্ট্র প্রধান কোন শাসনতন্ত্র জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে অবশ্যই সাবেক গণপরিষদ যেভাবে নির্বাচিত হয়েছিল, সেভাবে একটি গণপরিষদ নির্বাচিত করতে হবে। সুপ্রীম কোর্টের রায়ের ফল হিসেবেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
পাকিস্তানের শাসন মহলের এবং প্রভাবশালী চক্রের এই অগণতান্ত্রিকতা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিকাশ শুধু ব্যাহত করেনি, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার সম্পর্ককেও বিষাক্ত করে দিয়েছিল। বিশেস করে পূর্ব পাকিস্তানে এটা হয়েছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখানে মুসলিম লীগের একটা গ্রুপ আরেকটা গ্রুপের সাথে আচরণ করছিল শত্রুর মত। বাংলায় মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটি গ্রুপ বিভাগ-পূর্ব অর্থাৎ পাকিস্তান পূর্ব কালেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মূখ্যত স্বাধীন ও অখণ্ড বাংলার প্রশ্ন নিয়ে তখন মুসলিম লীগের দুইটি ধারা সকলেই দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।
এই গ্রুপ বিভক্তির একদিকে ছিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, মন্ত্রী ফজলুর রহমান, আবুল হাশিম, প্রমুখ। অন্যদিকে মওলানা আকরম খান, নুরুল আমিন, নাজিম উদ্দীন সহ মুসলিম লীগ ওয়ার্কিক কমিটির প্রায় পনর আনা সদস্য। এই শেষোক্ত গ্রুপের অভিযোগ ছিল সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমরা স্বাধীন বাংলার নামে খেয়াল-খুশী ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেন। শেষোক্ত এই ধারাটিই মুসলিম লীগের মূলধারা ছিল এবং দেশ বিভাগ অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের এই অংশটিই ক্ষমতা হাতে পায়। সেহারাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন অন্য গ্রুপটি দেশ বিভাগের পরও কোলকাতায় থেকে যাওয়ায় এই সুযোগ তারা আরও বেশী হারায়। মুসলিম লীগের ক্ষমতায় বসার পর যে উদারতা ও গণতান্ত্রিকতার পরিচয় দেয়া উচিত ছিল তা তারা দেয়নি। বরং শত্রুতামূলক আচরণে অবতীর্ণ হয়। দেশ বিভাগের পরপরই অখণ্ড বাংলা মুসলিম লীগ ভেঙে দেয়া হয় এবং সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীসহ তাদের গ্রুপের লোকদের বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কমিটি গঠিত হয়। এমনকি মুসলিম লীগের সাধারণ সদস্যপদ গ্রহণের পথও সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। আতাউর রহমান খানের মত লোকও বারবার ধর্না দিয়েও মুসলিম লীগের প্রাথমিক সদস্যপদের রশীদ বই পাননি।–[‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা ৩৭।] এই অবস্থায় ‘মুসলিম লীগ কর্মীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রথম নারায়নগঞ্জে ও পরে টাঙ্গাইলে কর্ম সম্মেলন করে নেতাদের কাজের তীব্র প্রতিবাদ করে এবং মুসলিম লীগের দরজা খুলে দেবার দাবী জানায়।–[‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা ৩৮।] এই দাবীর প্রতি কোন কর্ণপাত করা হয়নি। ফল হিসেবে গঠিত হলো পাল্টা মুসলিম লীগ। নাম দেয়া হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকার ‘রোজ গার্ডেন’-এর হল কামরায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটা কার্যকরী কমিটি গঠিত হলো।
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন মুসলিম লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ভয়ানক শত্রুতার সৃষ্টি করল। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরোধিতাকে ‘হিন্দুস্তানের লেলিয়ে দেয়া পাগলা কুত্তা’ বলে অভিহিত করা হলো। উল্লেখ্য, দেশ বিভাগের পর কোলকাতায় থাকা অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী উভয় বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্যে দেবতোষ দাসগুপ্ত, দেবনাথ সেন, সুব্রত রায়, প্রমুখ হিন্দুনেতাদের শামিল করে একটি শান্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন এবং বাংলাদেশ সফরের আয়োজন করেছিলেন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সোহরাওয়ার্দীর এই উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং বলে যে, শান্তি বাহিনীর বাংলাদেশ সফর এটাই প্রমাণ করার জন্যে যে, বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী দাঙ্গা-হাঙ্গামা আছে। সোহরাওয়ার্দীকে শুধু মুসলিম লীগ থেকে বাদ দেয়া নয়, তার পার্লামেন্ট সদস্যপদও বাতিল করা হয়। অবশেষে বাধ্য হয়েই সোহরাওয়ার্দী ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়াম মুসলিম লীগ’ গঠন করেন। ১৯৫৩ সালের ২১শে এপ্রিল সোহরাওয়ার্দীর ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ও ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে’ একত্রিত করে পাকিস্তান ভিত্তিক ‘পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ গঠনের জন্যে সোহরাওয়ার্দীকে আহবায়ক নিযুক্ত করা হয়।
এইভাবে মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন গ্রুপের অসহনশীলতা ও অগণতান্ত্রিকতার কারণে মুসলিম লীগ দুই ভাগ হয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুই দ্বন্দ্বমান দলে রূপ নিল। আর এর অনেক আগেই বাংলার জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তাঁরও ছিল একটা স্বতন্ত্র দল। ১৯৫৪ সালের ১০ই মার্চের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও খেলাফতে রব্বানী পার্টির সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয় ১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই তারিখে। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচনে অবতীর্ণ হলো।–[বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত ২১ দফঅ ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
“নীতিঃ কোরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ আইন প্রণয়ন হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারনের ব্যবস্থা করা হইবে।
১। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
২। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকদের উদ্ধৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে।
৩। পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ, পাটচাষীদের পাটের ন্যায্যামূল্য দান, মুসলিম আমলের পাট কেলেংকারীর তদন্ত।
৪। সমবায় কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন, সকল কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন।
৫। পূর্ব পাকিস্তানের লবণ শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, লবণ কেলেংকারীর জন্য দায় মুসলিম লীগ মন্ত্রী সভার সদস্যদের শাস্তি বিধান।
৬। খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা ও খরার হাত হইতে রক্ষা।
৭। পূর্ব পাকিস্তানকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত, কৃষিতে যুগোপযোগী করিয়া দেশকে শিল্প ও খাদ্যে স্বাবলম্বী করা। ILO এর বিধান অনুসারে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা।
৮। শিল্পী ও কারিগর অনুসারে শ্রমিকদের কাজের আশু ব্যবস্থা।
৯। প্রাথমিক, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূল শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষকদের ন্যায়সংগত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা।
১০। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, সরকারী ও বেসরকারী স্কুলের মধ্যকার পার্থক্য দূর করা, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ভাতার ব্যবস্থা।
১১। ‘ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ বাতিল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসন দান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সহজলভ্য ও ছাত্রাবাসকে অল্প ব্যয়সাধ্য করা।
১২। শাসন ব্যয়, হ্রাস, উচ্চ বেতন কমিয়ে, নিম্ন বেতন বাড়িয়ে সামঞ্জস্য বিধান, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীদের ১ হাজার টাকার বেশী বেতন না দেয়া।
১৩। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ রিশাওয়াত বন্ধ করা, ১৯৪০ সালের পরবর্তী পিরিয়ডের জন্যে সরকারী ও বেসরকারী পদাধিকারী ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ এবং অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।
১৪। ‘জন নিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স’ প্রভৃতি কালাকানুন বাতিল, বিনাবিচারে মুক্তি দেয়া এবং সংবাদপত্র ও সভাসমিতিরি অধিকার নিরংকুশ করা।
১৫। বিচার ও শাসন বিভাগকে পৃথক করা।
১৬। যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে কম বিলাসের বাড়ীতে বাস করবেন।
১৭। ভাষা শহীদদের শাহাদাতের স্থানে শহীদ মিনার স্থাপন ও শহীত পরিবারের ক্ষতিপূরণ।
১৮। ২১শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ও সরকারী ছুটি ঘোষণা।
১৯। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের পূর্ব পাকিস্তানকে স্বশাসিত ও সভরিণ করা হইবে, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা ছাড়া সব বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের হাতে থাকবে, নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে, অস্ত্র তৈরীর কারখানা স্থাপনসহ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
২০। যুক্তফ্রন্ট কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের মেয়াদ বাড়াবে না, মেয়াদ শেষ হবার ছ’মাস আগে মন্ত্রীসভার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা।
২১। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভার আমলে পরিষদের কোন সদস্যপদ খালি হলে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা, পর পর ৩টি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রীসভার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। (অলি আহদের ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ গ্রন্থ থেকে (পৃষ্ঠা ২০১, ২০২, ২০৩, ২০৪, ২০৫) (সংক্ষিপ্ত) ] পাকিস্তানের সে প্রথম নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগের ১৪৩টি আসন, কৃষক শ্রমিক পার্টির ৪৮টি আসনসহ যুক্তফ্রন্ট পেল মোট ২২৩টি আসন। অন্যদিকে মুসলিম লীগ পেল মাত্র ১০টি আসন। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানে তখন মুসলিম লীগই ক্ষমতায় ছিল। পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টের ৪০ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হলো পাকিস্তান গণপরিষদ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য।বিধান অনুসারে এই পরিষদ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর পরিণত হবে আইন পরিষদ বা জাতীয় পরিষদে এবং গঠন করবে শাসনতান্ত্রিক সরকার।
এইভাবে পাকিস্তান নতুন এক শাসনতান্ত্রিক পর্যায়ে প্রবেশ করল এবং জাতির সামনে গণতন্ত্রের সূর্য উদিতও হয়েছিল। কিন্তু স্বার্থপরতা, ষড়যন্ত্র, অগণতান্ত্রিকতা ও অসহনশীলতার কালো মেঘ গণতন্ত্রের নির্মল সে সূর্যালোক মানুষকে দেখতে দেয়নি। গণপরিষদের একমাত্র কাজ ছিল শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। গণপরিষদের তিন প্রধান গ্রুপ, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্ট। এর মধ্যে মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্ট একমত হয়ে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে শাসনতন্ত্রের খসড়া পার্লামেন্টে উত্থাপন করল এবং তা পার্লামেন্টে পাশ হলো ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী। স্বাধীনতার প্রায় ৯ বছর পর জাতি একটা শাসনতন্ত্র পেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শাসনতন্ত্রে প্রেসিডেন্টের অনুমোদন নিয়ে। প্রেসিডেন্ট তখন জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। তিনি বললেন, তিনি শাসনতন্ত্রে দস্তখত করবেন, যদি তাঁকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 361.] ইস্কান্দার মির্জা শুধু এ দাবী আদায় করেই ছাড়লেন না, কেন্দ্রীয় সরকারকে কুক্ষিগত করারও ব্যবস্থা করলেন। তার ষড়যন্ত্রে মুসলিম লীগ দ্বিধা বিভক্ত হলোএবং ভাগ হয়ে যাওয়া অংশটি রিপাবলিকান পার্টি নাম পরিগ্রহ করল। ফলে শাসনতন্ত্র পাশকারী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রে ছয়মাসের বেশী টিকলনা। এরপর সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান জোটের সরকার গঠিত হলো। কিন্তু এ সরকারও এক বছরের বেশী টিকলনা। আসন্ন নির্বাচনের ভয়ে ভীত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা নির্বাচন বানচালের জন্যে সোহরাওয়ার্দকে পদত্যাগে বাধ্য করলেন এবং আই চুন্দ্রীগড়ের নেতৃত্বে গঠিত হলো নতুন মন্ত্রীসভা। দুইমাসেই এ মন্ত্রী সভা ভেঙে পড়ল। এরপর গঠিত হলো ফিরোজ খান নুন মন্ত্রীসভা। এ মন্ত্রীসভা যখন ১৯৫৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচী নিয়ে সামনে এগুচ্ছিল, এই সময় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পার্লামেন্ট, কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকার বাতিল করলেন এবং জারি করলেন সামরিক শাসন। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জার আশা পূরণ হলো না। জেনারেল আইয়ুব খান ষড়যন্ত্রের নটরাজ মির্জাকে সরিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা হাতে নিলেন।
কেন্দ্রে যখন গণতন্ত্রের দেহ নিয়ে শকুনের ঐ মহোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদেও গণতন্ত্রের দেহ ব্যবচ্ছেদ চলছিল। চলছিল অস্থিরতা, অসহনশীলতা, অগণতান্ত্রিকতার সয়লাব। প্রদেশের রাজনীতি যেমন কেন্দ্রে পৌঁছল, তেমনি কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রও প্রদেশকে ক্লেদাক্ত করল।
১৯৫৪ সালের ১০ই মার্চের নির্বাচনের দুই মাস পাঁচ দিন পর যুক্তফ্রন্টের আভ্যন্তরীন ক্ষমতাদ্বন্দ্বের একটা পর্যায় শেষে শেরে বাংলার নেতৃত্বে যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হলো, কেন্দ্রের সেই গোলাম মোহাম্মদের তরফ থেকে আসা ৯২ ক ধারা শীঘ্রই তার কণ্ঠরোধ করল। শুধু মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়া নয়, শেরে বাংলাকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেয়া হলো এবং বিদেশ সফররত মাওলানা ভাসানীকে দেশে ফিরতে দেয়া হলো না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়া এবং ৯২ ক ধারা প্রত্যাহারের পর ‘দেশদ্রোহী’ বলে আখ্যায়িত শেরে বাংলার সাথে আপোশ করে তার দলের আবু হোসেন সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী করে সরকার গঠন করা হলো ১৯৫৫ সালের জুনে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর কেন্দ্রে হাওয়া বদলের প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের পতন ঘটল এবং আরেক দফা দল বদলের মধ্য দিয়ে ১৯৫৬ সালে ৬ই সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হলে আতাউর রহমানকে মুখ্য মন্ত্রী করে। এই সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বছর দেড়েক নিরাপদ রাজত্ব করার সুযোগ পায়। কিন্তু সুখ যেন আমাদের রাজনীতির ধাতে নেই। ১৯৫৭-এর মাঝামঝির দিকে আওয়ামী লীগের ৩০ জন সংসদ সদস্য দল ত্যাগ করে ন্যাপে যোগ দেন। ফলে আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। প্রাদেশিক গভর্ণর শেরে বাংলা ফজলুল হক সুযোগ পেয়ে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা বাতিল করে স্বদলীয় এবং যুক্তফ্রন্ট নেতা আবু হোসেন সরকারকে সরকার গঠনের জন্যে আহবান করেন। আওয়ামী লীগ তখনও কেন্দ্রে ক্ষমতায়। সুতরাং কেন্দ্র শেরে বাংলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করলো না, বরং গভর্ণর শেরে বাংলাকেই পদচ্যুত করা হলো এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা পুনর্বহাল হলো। কিন্তু সংসদে আস্থা ভোটে পরাজিত হলো আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা। এদিকে আবু হোসেন সরকারের যুক্তফ্রন্ট সরকারও ক্ষমতায় থাকতে পারলো না ন্যাপের চরম সুবিধাবাদী আচরণের কারণে। তাদের এই আচরণের কারণে এক সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে দুইটি মন্ত্রীসভার পতন ঘটল। এই অরাজক অবস্থায় প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করা হলো সংকট উত্তরণের জন্যে। দুইমাস পরে প্রেসিডেন্টের শাসন প্রত্যাহারের পর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা পুনর্বহাল করা হয় এবং সেপ্টেম্বরে (১৯৫৮) ডাকা হলো পূর্ব পাক পরিষদের অধিবেশন। অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে। অধিবেশনের দ্বন্দ্বমান গ্রুপের সংঘাতকালে নিহত হলেন ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী। এই ঘটনার মাত্র ১৩দিন পর ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর পার্লামেন্ট ও শাসনতন্ত্র বাতিল করে জারি করা হলো সামরিক শাসন।
এরপর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন এবং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের যুগ। ১৯৬৯ সালের ২৩শে মার্চ আইয়ূব খান পদত্যাগ করলে জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করে শাসনতন্ত্র ও পার্লামেন্ট বাতিল করেন। ইয়াহিয়ার অধীনেই পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং অতীতের মত সে নির্বাচনও বাতিল করা হয়। তারই পরিণতিতে আসে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা।
সুতরাং পাকিস্তানের একটা কোটারী স্বার্থের স্বেচ্ছাচারিতা ও ষড়যন্ত্রের হাতে পণবন্দী ছিল পাকিস্তানের জনগণ। এই জনগণেরই একটা অংশ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অবশেষে এর হাত থেকে মুক্তির যে সংগ্রাম শুরু করে, তাই-ই ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
এই মুক্তির চেতনাকে আরো কয়েকটি বিষয় সাহায্য করে, তার মধ্যে প্রথমেই স্মরণ করতে হয় অর্থনৈতিক বঞ্চনার অনুভূতি।
পূর্ব পাকিস্তান ভূ-খণ্ড ছিল বৃটিশ ভারতের সবচেয়ে বঞ্চিত এলাকা। বৃটিশ বেনিয়াদের সবচেয়ে বেশী শোষনের শিকার হয়েছে এই অঞ্চল। ছিয়াত্তর এবং পঞ্চাশের মন্বন্তরের হৃদয়বিদারক ঝড় বয়ে গিয়েছিল এই অঞ্চলের উপর দিয়ে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার এই অঞ্চলে কোথাও এক তৃতীয়াংশ, কোথাও অর্ধেক লোক মারা যায়। বৃটিশ আমলের শেষ পর্যন্ত এই বাংলাদেশ অঞ্চলের ভাগ্যের কোন উন্নতি হয়নি। বৃটিশ যুগে আধুনিক শিল্প-অর্থনীতির যে বিকাশ ঘটেছিল, তার কোন ছাপ পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলে লাগেনি। এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ শহর ঢাকা একটি জেলা শহরের বেশী কিছু ছিল না। লোক সংখ্যা ছিল মাত্র ১ লাখের মত।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 327.] তৎকালীন বিশ্বের পাট সম্পদের ৭৫ ভাগ উৎপাদিত হতো বাংলাদেশ অঞ্চলে, কিন্তু একটিও পাটকল এখানে গড়ে উঠেনি। সব পাটকলের অবস্থান ছিল কোলকাতায়। নামকাওয়াস্তে দুইটি বস্ত্রকল ছিল গোটা বাংলাদেশে। বৃটিশ আমলের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অঞ্চল ছিল কৃষিপণ্য ও কাঁচামালের সরবরাহের ক্ষেত্র।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে একটা জেলা শহর ঢাকা যেমন প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় উন্নীত হলো, তেমনি বাংলাদেশেও উন্নয়নের ছোয়া লাগল। ৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল-এই দুই দশকের মধ্যে পাট কলের সংখ্যা শুন্য থেকে প্রায় ৭০ টিতে উন্নীত হলো। আর বস্ত্রকলের সংখ্যা ২টি থেকে ৪৩টিতে গিয়ে পৌঁছল। এইভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সবক্ষেত্রেই উন্নয়নের যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু শত শত বছরের অবহেলিত, বঞ্চিত এ অঞ্চলের জনগণের কাম্য ছিল, তা এলো না। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শিল্প-কারখানার সংখ্যা বাড়ল বটে অনেক, কিন্তু তাতে এ অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিলনা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পাট শিল্পের শতকরা ৬৬ ভাগ ও বস্ত্র শিল্পের ৪৭ ভাগ স্থায়ী মূলধন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টাকার বেশী মূলধন-বিশিষ্ট শিল্প সমূহের ৬টি ব্যতীত বাকী সব কয়টির মালিকানা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন ব্যক্তিদের হাতে।–[‘Nationalisation of Industries in Bangladesh: Background and Problems’, Rehman Sobhan.]
এই সাথে চাকুরী-বাকুরীসহ অন্যান্য অকৃষিজ অর্থকরী ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর যেভাবে সামনে এগুবার কথা ছিল তা পারলনা। এর একটা বড় কারণ ছিল এ অঞ্চলের মানুষের যুগ-যুগান্তরের কৃষি নির্ভরতা এবং নতুন শিল্প-কারিগরী-ব্যবসার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ ও অনভিজ্ঞতা। কিন্তু স্বাধীনতার প্রাক্কালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধজনিত অভাব-দারিদ্র থেকে উদ্ভুত প্রয়োজনের তাকিদ এ অঞ্চলের মানুষকে প্রথমবারের মত শহরমুখী এবং শিল্প ব্যবসায়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলছিল। স্বাধীনতার পর হিন্দু শিল্প-ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে হিন্দুস্তানে চলে যাবার পর এই ক্ষেত্র তাদের জন্যে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এ সুযোগ তাদের কপালে জুটলনা। কাজী আনওয়ারুল হক-[কাজী আনওয়ারুল হক পূর্ব পাকিস্তানের একজন শীর্ষ আমলা। ১৯৩৩ সালে তিনি পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। ইনি পুলিশের আইজি, পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী এবং জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।] লিখছেন, “কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে রিফুজী আসায় সমস্যা জটিলতর হয়েছিল। রিফুজী যারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল তারা ছিল শহুরে। পেশায় ছিল ব্যবসায়ী, দোকানকার, কারিগর, আধা-দক্ষ শ্রমিক, ইত্যাদি। ….আর হিন্দু যারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারত চলে গিয়েছিল তারা ছিল বিভিন্ন চাকুরে, ব্যবসায়ী ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই এদের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান ভারত থেকে আসা ঐ মুসলিম রিফুজীরাই পূরণ করেছিল”।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 329, 330] এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল একটা বিদঘুটে অবস্থা। ভারত থেকে আসা রিফুজীদের অধিকাংশই ছিল অবাঙ্গালী। শিল্প ব্যবসায়ে এদের সরব উপস্থিতি সামজে এদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 330] সেই সময়ের পরিস্থিতিতে এই অবস্থায় ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এ অবস্থা থেকৈ কি সংকটের সৃষ্টি হতে পারে তা আঁচ করতে রাজনীতিকরা ব্যর্থ হন। যার ফলে অনুসৃত হতে থাকল ভুলনীতি, যা সৃষ্টি করল বাঙালী ও অবাঙালীদের মধ্যে আস্থা ও সমঝোতার সংকট।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 330] পূর্ব পাকিস্তানের একজন শীর্ষ আমলা এবং পরবর্তীকালে রাজনীতিক কাজী আনওয়ারুল হকের ভাষায়, “পূর্ব পাকিস্তানে নতুন সমাজ বিনাসে দু’টি ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিকে অধিকাংশ জনসমষ্টি সম্বলিত বাঙালী জনগণ, অন্যদিকে ছিল ক্ষুদ্র সংখ্যার অবাঙালী। বাঙালী জনগণ প্রধানতঃ কৃষির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল, আর অবাঙালীরা হিন্দুদের দেশত্যাগের ফলে শূন্য হয়ে পড়া শিল্প-বাণিজ্যের স্থান এসে পূরণ করল। প্রধানতঃ কৃষির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া বাঙালীদের উন্নয়ন হলো স্থবিরতায় আক্রান্ত, অন্যদিকে স্বাধীনতা-উত্তর শিল্প বাণিজ্যের নতুন বিকাশ অবাঙালীদের দ্রুত সমৃদ্ধি দান করল।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, page 331] এইভাবেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে জনতার কাতারে একই দেশের নাগরিকদের মধ্যে একটা শ্রেণী বৈষম্য গড়ে উঠল। যা মুহাজির ও আনসার (অবাঙালী ও বাঙালী) দের মধ্যে সখ্যতার বদলে সৃষ্টি করল বিদ্বেষ, সমন্বয়-সম্মিলনের পরিবর্তে বিভেদ। এই বিভেদ বিদ্বেষই উত্তরকালে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশ অঞ্চলের বাঙালী জনগণের জন্যে যা পূর্ব পাকিস্তানকে পরিণত করল স্বাধীন বাংলাদেশ।
পাকিস্তানী শাসক মহলের অবিবেচনা ও স্বৈরতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত হলো পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনগণের মুখের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করা এবং তাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দিয়ে পাকিস্তানের কারও ভাষা নয় এমন ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন সব মানুষ। ’৪৭ সালে যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হলো বরকত, সালাম, জব্বার, প্রমুখ দেশের অমর সন্তানদের শাহাদাতের মাধ্যমে। শুধু দাবী করে যে ন্যায্য অধিকার অর্জন করা যায়নি, রক্তদানের মাধ্যমে তা অর্জিত হলো। বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা।
পাকিস্তানের তদানীন্তন শাসকবর্গের রাজনৈতিক চরিত্রে যেমন গণতন্ত্র ছিলনা, তেমনি দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত সমূহের মধ্যে কোন সুবিচার ছিল না। ’৪৭ এর স্বাধীনতার পর যুগ-যুগান্তর ধরে শোষিত বঞ্চিত অবহেলিত বাংলাদেশ অঞ্চলের জনগণের প্রতি যে বিশেষ নজর দেয়ার প্রয়োজন ছিল ঐ শাসকরা তা দেয়নি। এতো গেল একদিক, অন্যদিকে সরকারের গৃহীত পুঁজিবাদী, অগণতান্ত্রিকও কোটারী স্বার্থপীড়িত দৃষ্টিভংগী রাজনৈতিক ক্ষেত্রের স্বেচ্ছাচারিতার মতই পূর্ব পাকিস্তানের উপর জুলুম হিসেবে চেপে বসল।
“শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাদির ভিতরও এমন কোন বিধান সন্নিবিষ্ট করা হয়নি যার ফলে বাধ্যতামূলকভাবে দুই বিচ্ছিন্ন অংশের সমানভাবে সকল ক্ষেত্রে উন্নতি করা সম্ভবপর হয়। ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের মধ্যে শাসনতন্ত্রে বলা হয়েছে বটে যে, দেশের প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উভয় অংশের সমান অধিকার দেয়া হবে। কিন্তু কিভাবে সে ব্যবস্থা কার্যকরী করা হবে সে সম্বন্ধে পরিস্কার কোন নির্দেশনা ছিল না। এমনকি এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিধান অনুযায়ী কাজ চলছে কিনা সেটাও পর্যবেক্ষণ করার জনে কোন বিশিষ্ট অফিস বা কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে দুই প্রদেশের ভিতর শাসনতান্ত্রিক সুবিধাদি সমীকরণের যে সদিচ্ছা তা প্রায় কাগজে কলমেই পর্যবসিত হয়েছে”।–[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রকাশ ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৯৪।] এরই ফল হিসেবে দুই প্রদেশের মধ্যে গড়ে উঠল বৈষম্যের পাহাড়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে এই বৈষম্যের পাহাড় ছিল নিম্নরূপঃ–[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রকাশ ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৯৪, ৯৫।]
চাকুরীর ক্ষেত্র | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েট | ৮১ শতাংশ | ১৯ শতাংশ |
দেশ রক্ষা | ৯১.৯ শতাংশ | ৮.১ শতাংশ |
শিল্প | ৭৪.৩ শতাংশ | ২৫.৭ শতাংশ |
স্বরাষ্ট্র | ৭৭.৫ শতাংশ | ২২.৫ শতাংশ |
তথ্য | ৭৯.৯ শতাংশ | ২০.১ শতাংশ |
শিক্ষা | ৭২.৭ শতাংশ | ২৭.৩ শতাংশ |
স্বাস্থ্য | ৮১.০০ শতাংশ | ১৯.০০ শতাংশ |
কৃষি | ৭৯.০০ শতাংশ | ২১.০০ শতাংশ |
আইন | ৬৫.০০ শতাংশ | ৩৫.০০ শতাংশ |
শিল্প ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পীড়াদায়ক বৈষম্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৬১-৬২ সাল পর্যন্ত মূলধন ও বিনিয়োগ বাবদ পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়া হয় ২৭৮ কোটি টাকা, আর পশ্চিম পাকিস্তানকে দেয়া হয় প্রায় ৪৪৫ কোটি টাকা। এই সময়কালে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ঋণ বাবদ প্রায় ১৬১ কোটি টাকা, আর পশ্চিম পাকিস্তান প্রায় ২৯৩ কোটি টাকা।–[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রকাশ ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৯৭।] কতিপয় কর যেমন শুল্ক, বিক্রয়কর, আবগারী ও আয়কর সেই সময়ের বিধান অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার আদায় করতো এবং তার একটা অংশ প্রদেশদ্বয়ের মধ্যে বণ্টন হতো। এই বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিশেষ নজর দেবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু পরে পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনের প্রতি উপেক্ষা করে বৈষম্য দৃষ্টি অনুসরণ করা হতে থাকে। নীচের দৃষ্টান্ত থেকে এর প্রমাণ মিলবেঃ-[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, পৃষ্ঠা ৯৮, ৯৯।]
সন | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান |
১৯৪৮-৪৯ | ২.৪৯ কোটি টাকা | ১.৯০ কোটি টাকা |
১৯৫০-৫০ | ৫.৩৯ কোটি টাকা | ৩.৬৭ কোটি টাকা |
১৯৫০-৫১ | ৬.৬৮ কোটি টাকা | ৫.২৮ কোটি টাকা |
১৯৫১-৫২ | ৯.৩৬ কোটি টাকা | ৭.৭২ কোটি টাকা |
১৯৫২-৫৩ | ৯.৬৬ কোটি টাকা | ৯.২২ কোটি টাকা |
১৯৫৩-৫৪ | ৮.৮৪ কোটি টাকা | ৮.৬৩ কোটি টাকা |
১৯৫৪-৫৫ | ৯.০৬ কোটি টাকা | ১০.০৪ কোটি টাকা |
১৯৫৫-৫৬ | ১১.২৭ কোটি টাকা | ১১.৫১ কোটি টাকা |
১৯৫৬-৫৭ | ১০.৭৮ কোটি টাকা | ১৪.৪১ কোটি টাকা |
১৯৫৭-৫৮ | ১০.৮৩ কোটি টাকা | ১৪.৬৩ কোটি টাকা |
১৯৫৮-৫৯ | ১৪.৯৮ কোটি টাকা | ২০.০৪ কোটি টাকা |
১৯৫৯-৬০ | ১৩.২১ কোটি টাকা | ১৬.৬৮ কোটি টাকা |
১৯৬০-৬১ | ১৪.৬৮ কোটি টাকা | ২৩.০২ কোটি টাকা |
১৯৬১-৬২ | ১৫.৯২ কোটি টাকা | ২২.৫১ কোটি টাকা |
আন্তঃ আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চনার শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তান শিল্প-কারখানার দিক দিয়ে অনুন্নত থাকায় এবং পশ্চিম পাকিস্তান এই ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে লেনদেনের ভারসাম্য ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান বার্ষিক গড় পড়তা ৮৫ কোটি টাকার জিনিস কিনতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, আর পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে কিনতো বার্ষিক গড়ে ৩৭ কোটি টাকার জিনিস।–[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, পৃষ্ঠা ৯৮, ৯৯।] অনুরপ বৈষম্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের ক্ষেত্রে। পূর্ব পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতো বেশী, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান এ মুদ্রা ব্যয় করতো বেশী। ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৬১-৬২ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের চিত্র নিম্নরূপঃ –[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, পৃষ্ঠা ১০৯।]
অঞ্চল | বৈদেশিক মুদ্রা আয় | বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় |
পূর্ব পাকিস্তান | ১৩০৫ কোটি টাকা | ৭৮৯ কোটি টাকা |
পশ্চিম পাকিস্তান | ৯৯৩ কোটি টাকা | ১৮৮৪ কোটি টাকা |
পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ উন্নয়নেও নজর দেয়া হয়নি। পাট পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতো। কিন্তু ৪৭-এর স্বাধীনতার পর পাটের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ কোন নজর দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার সময়ে পাটের উৎপাদন ছিল ৬৯ লাখ বেল। ভারত ১৯৪৭ সালের পর তার পাটের উৎপাদন ১৭ লাখ বেল থেকে ১৯৬৩ সালে ৭২ লাখ বেলে উন্নীত করে, আর বাংলাদেশ অঞ্চলে পাটের উৎপাদন ৬৯ লাখের অংক কখনই অতিক্রম করেনি, বরং উৎপাদন কমেছে। পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মোট পাট উৎপাদনের নিম্নোক্ত তুলনামূলক চিত্র থেকে বিষয়টি সকলের কাছে পরিস্কার হবেঃ-[‘আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা’, ওয়াজেদ আলী সরকার, পৃষ্ঠা ৫০-৫১।]
বৎসর | পূর্ব পাকিস্তানে পাট উৎপাদন | ভারতে পাট উৎপাদন | বিশ্বের চাহিদা |
১৯৪৭-৪৮ | ৬৯ | ১৭ | ৮৮ |
১৯৪৮-৪৯ | ৫৬ | ২৩ | ৯২ |
১৯৪৯-৫০ | ৪৩ | ৩১ | ৭৭ |
১৯৫০-৫১ | ৬১ | ৩৩ | ১০১ |
১৯৫১-৫২ | ৬৬ | ৪৭ | ৯৩ |
১৯৫২-৫৩ | ৬৮ | ৫৩ | ৯২ |
১৯৫৩-৫৪ | ৩৬ | ৩৭ | ১০১ |
১৯৫৪-৫৫ | ৪৬ | ৪৩ | ১১৪ |
১৯৫৫-৫৬ | ৬৫ | ৫৪ | ১৩১ |
১৯৫৬-৫৭ | ৫৯ | ৫৮ | ১৩০ |
১৯৫৭-৫৮ | ৬১ | ৬০ | ১৩৯ |
১৯৫৮-৫৯ | ৬২ | ৬৮ | ১৫৮ |
১৯৫৯-৬০ | ৫৫ | ৫৭ | ১৬৬ |
১৯৬০-৬১ | ৪৫ | ৫৯ | ১৬৪ |
১৯৬১-৬২ | ৬৩ | ৬৩ | ১৬৯ |
১৯৬২-৬৩ | ৬৪ | ৬৬ | ১৭৮ |
১৯৬৩-৬৪ | ৬৩ | ৭২ |
উপরের চিত্র প্রমাণ করছে যে পাট পূর্ব পাকিস্তানের মনোপলি ছিল, সে মনোপলি স্বাধীনতার অর্ধযুগের মধ্যেই ধসে পড়ল। যে পাটের উপর ভরসা করে সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালে বড় আশা করে বলেছিলেন, “পাটের উৎপাদনকারী হিসেবে বিশ্বকে সে (পাকিস্তান) নিয়ে আসতে পারে পায়ের তলায় এবং এর শিল্প ভবিষ্যত নিশ্চিত”, সেই পাট-ভাগ্য গিয়ে অন্যের ঘরে উঠল।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্দশার পাশাপাশি তার এই অর্থনৈতিক দুর্দশা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের মানুষের বিক্ষোভ-বিতৃষ্ণাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই বিক্ষোভ-বিতৃষ্ণা পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্যের বুনিয়াদকে দ্রুত দুর্বল করে তুলছিল, অবশেষে তা ধসে পড়ে ১৯৭১ সালে। ভেঙ্গে যায় পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান রূপান্তরিত হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে।
যে অন্যায়, অবিচার, জুলুম ও বৈষম্য নীতির ফল হিসেবে পাকিস্তান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার সৃষ্টি হয় তার মূলে ছিল জাতীয় আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার অভাব এবং তজ্জনিত জাতিপ্রেম ও দেশ-প্রেমের অনুপস্থিতি। দুর্ভাগ্যের বিষয় মুসলিম জাতিসত্তার প্রতি যে ভালোবাসা এবং মুসলিম জাতিসত্তা রক্ষার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম জাতিসত্তার প্রতি সেই ভালোবাসা এবং তাকে রক্ষার সেই আকাঙ্ক্ষা যেন হঠাৎ করেই উবে গেল শাসক মহল থেকে।
বলা হয়, কায়েদে আযমের হাতেই পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষ বা আদর্শ বিবর্জিত রাজনীতির যাত্রা পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি নাকি চেয়েছিলেন মুসলিম লীগও না থাকুক। এই জন্য নাকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ছয়মাস পর্যন্ত মুসলিম লীগের কোন মিটিং তিনি দেননি।–[‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা ৩৮, ৩৯, ৪০।] কায়েদে আযমের আরেকটি বক্তব্যকে কায়েদে আযমের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যে বক্তব্য তিনি রেখেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১১ই আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে। এ বক্তব্যে তিনি বলেন, “এই মৌল নীতি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করছি যে, আমরা সকলে একটি রাষ্ট্রের মালিক। সকলে সমান নাগরিক। এখন আমি ভাবছি, আমাদের এই আদর্শকে আপনারা সামনে রাখুন এবং আপনারা দেখবেন এক সময় হিন্দু আর হিন্দু থাকছে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকছে না, কারণ এগুলো প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, রাজনৈতিকভাবে আমরা সকলেই একই রাষ্ট্রের নাগরিক”।–[‘Pakistan from Jinnah to Zia’, Muhammad Munir, Document Press, New Delhi-110048, Page: 53.] একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এই বক্তব্যে কায়েদে আযম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে হিন্দু মুসলমানের পরিচয়ের কথা বলছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির কথা বলেননি। পরবর্তীকালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই নীতির কথা সুস্পষ্টভাবেই তিনি উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৮ সালে মার্কিনীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে কায়েদে আযম বলেন, “আমি জানিনা পাকিস্তানে অবশেষে কি ধরনের শাসনতন্ত্র প্রণীত হতে যাচ্ছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তা হবে গণতান্ত্রিক যার মূলে থাকবে ইসলামের মৌল নীতিমালা। ইসলামের এই নীতিমালা ১৩০০ বছর আগে যেমন ছিল, এখন তেমনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলাম এবং তার আদর্শবাদই আমাদেরকে গণতন্ত্র শিখিয়েছে। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে সাম্য, সুবিচার এবং সকলের প্রতি সু-ব্যবহারের নীতিমালা। আমরা ইসলামের এই মহান ঐতিহ্যের উত্তরসূরী এবং আমরা যারা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করছি তাদের মধ্যে এই বোধ জীবন্ত”।–[‘Pakistan from Jinnah to Zia’, Muhammad Munir, Document Press, New Delhi-110048, Page: 54.]
কায়েদে আযমের এই উক্তির মধ্যে তাঁর চিন্তাধারা পরিস্কার এবং এর মধ্যে শাসনতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষতার সামান্য চিহ্নও লক্ষণীয় নয়। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৯শে অক্টোবর পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে করাচীতে বলেন, “আমরা মুক্ত মানুষ হিসাবে জীবন যাপন করব এবং এ জীবনের আমরা বিকাশ ঘটাব আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসারে যার মূলে থাকবে ইসলামের সুবিচার ও সু-ব্যবহারের আদর্শ”।–[‘Pakistan from Jinnah to Zia’, Muhammad Munir, Document Press, New Delhi-110048, Page: 54.] ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ কায়েদে আযম বলেন, “ইসলাম এটাই আমাদের শিক্ষা দেয় এবং আপনারা আমার সাথে একমত হবেন যে, আপনি যা ভাবুন, যাই হোন আপনি মুসলমান। আপনারা এখন একটা জাতি। আপনারা একটা রাষ্ট্রের পত্তন করেছেন-বিশাল রাষ্ট্র। এটা আপনাদের। এটা পাঞ্জাবীদের নয়, সিন্ধীদের নয়, বাঙালীদের নয়, এর মালিক আপনারা মুসলমানরা। পাকিস্তান ‘থিয়োক্রাটিক’ বা ‘ধর্মরাজ্য’ ধরনের রাষ্ট্র নয়। ইসলাম আমাদের কাছে তাদেরকে আমরা আমাদের বিশিষ্ট সহযোগী হিসাবে স্বাগত জানাব”।–[‘Pakistan from Jinnah to Zia’, Muhammad Munir, Document Press, New Delhi-110048, Page: 54, 55.] এখানেও কায়েদে আযম পাকিস্তানকে ইসলামের নীতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রই বলেছেন। ‘পাকিস্তান থিয়োক্রাটিক’ বা ‘ধর্মরাজ্য’ ধরনের রাষ্ট্র নয়’ কায়েদে আযমের এই কথার ভুল বুঝা-বুঝির কোন অবকাশ নেই। এখানে কায়েদে আযম ‘থিয়োক্রাটিক’ রাষ্ট্র বলতে মধ্যযুগীয় ইউরোপের যাজকতন্ত্রীয় রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, যেখানে অন্য ধর্ম ও অন্য বিশ্বাসের কোন স্থান ছিল না, যেখানে যাযকরা রাষ্ট্রনায়কদের মাথায় স্বেচ্ছাচারিতা ও সুবিধাবাদের রাজত্ব কায়েম করেছিল, যার সাথে প্রকৃত ধর্মের কোনই সম্পর্ক ছিল না। পাকিস্তান ইসলামের আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সব ধর্ম ও সব বিশ্বাসের লোক মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে থাকতে পারবে, কায়েদে আযম এখানে এই কথাই বলেছেন।
কায়েদে আযম পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ পাননি। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর উত্তরসূরী মুসলিম লীগ নেতারাও ইসলামের শ্লোগান দিতেন। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেও ইসলাম ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবী জোরদার হয়ে উঠেছিল। এরই ফল ছিল শাসনতন্ত্রের ‘মৌল নীতি হিসেবে গণপরিষদে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ পাশ হওয়া। প্রস্তাবটি ছিল প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের একটা অংশ, যাতে বলা হলো, “সমগ্র বিশ্বের সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি পাকিস্তানী জনগণের মাধ্যমে যে দায়িত্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করেছেন তা পবিত্র আমানত হিসেবে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে বাস্তবায়িত করতে হবে”।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, Page 264.] আদর্শ প্রস্তাবটিতে আও বলা হয়, “মুসলমানরা যাতে কোরআন-সুন্নাহর বিধান অনুসারে জীবন যাপন করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে”।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, Page 264.] মনে করা হলো, আদর্শ প্রস্তাবের এ দাবী পূরণ করার জন্যে শাসনতন্ত্রকে ইসলামী চরিত্র দান করা হচ্ছে।
কিন্তু শাসনতন্ত্রই তৈরী হলো না। ফলে আইন, শাসনতন্ত্র ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ইসলামী নীতি ও আদর্শের বাস্তবায়ন সম্ভব হলো না। অবশেষে ১৯৫৬ সালে যে শাসনতন্ত্র তৈরী হলো, তাতে পাকিস্তানের নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ রাখা হলো বটে, কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন কোন বিধান রাখা হলো না যার দ্বারা আইন ও ব্যবস্থাপনার ইসলামীকরণ সম্ভব হতে পারে। আইন ও আচরণের ক্ষেত্রের এই লক্ষ্যগত শূন্যতার পূরণের জন্যে ভালো কোন জিনিস যদি না রাখা হয়, তাহলে খারাপ ও বিজাতীয় জিনিস সে শূন্য স্থান পূরণ করবেই। পাকিস্তানে এই ঘটনাই ঘটেছিল। এ বিষয়টাকে কাজী আনওয়ারুল হক সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। তিনি লিখছেন, “মুসলমানদের নিজস্ব আবাসভূমি সৃষ্টিকারী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন জাতির সমাজ গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় আদর্শকে সমুন্নত করে তুলতে ব্যর্থ হলেন। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ সংগ্রাম ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভকারী জাতির জীভন গঠনের জন্যে কোন নীতি-আদর্শ যে প্রয়োজন, তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই দেখায়নি। ক্ষমতা ও পদের তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে জনগণের অভিভাবক বলে পরিচিত এবং জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে জনগণকে দিক-নির্দেশনা দিতে সমর্থ আলেম সমাজও খুব অসহায় হয়ে পড়ে। —-এই হতাশাব্যঞ্জক পরিবেশে নব্য স্বাধীন সমাজ পরিমণ্ডলে বিজাতীয় আদর্শ ও নীতি তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মন-মানসে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করল যা জাতিকে লক্ষ্যচ্যুতি ও পরিচয় বিকৃতির দিকে ঠেলে দিল। —-কম্যুনিষ্টরা নিঃসন্দেহে তাদের লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত প্রাণ। তারা সমান-শৃঙ্খলা ধ্বংস করতে খুবই সিদ্ধহস্ত। তাদের অভিজ্ঞতা ও কাজ সবই তারা বিরোধীদলের পক্ষে নিয়োগ করেছিল সরকারকে হেনস্থা করার জন্যে। তাদের বিক্ষোভ, অপপ্রচার এবং চাপ সৃষ্টি-কৌশল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক চরিত্রই পাল্টে দিয়েছিল”।–[‘Under Three Flags’, Kazi Anwarul Haque, Page 264.] একদিকে আদর্শিক শূন্যতা, অন্যদিকে বামপন্থীদের অপপ্রচার মানুষের উপর বিশেষ করে তরুণ মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি ইসলামের বিরোধিতা করা। এই বিরোধিতাকে কার্যকর ও যৌক্তিক করার জন্যে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়-অব্যবস্থাপনাকে বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পুর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল, কিন্তু তারা যেভাবে যতটা বলতো, ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব, ’৪৭ থেকে ’৭০ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে যে শিল্প স্থাপন হয়েছিল, মূলত তার উপরই বাংলাদেশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। পাট ও পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন তখন যা ছিল, এখন তার চেয়ে বাড়েনি। অথচ তখন প্রচার শুনলে মনে হতো, পূর্ব পাকিস্তানে কিছুই হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় সব হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।–[‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি শহরকে আধুনিক অর্থে কেউ শহর বলতোনা। —-এই ঢাকাই হলো আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা লাহোর এবং করাচীর মতো দু’টো শহর পেলো। এ দু’টি শহরই ছিল দু’টো প্রদেশের রাজধানী। কিন্তু হঠাৎ করে একজন বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাকে ’৪৪ সাল থেকেই চিনতাম। আমি যখন ইসলামিয়া কলেজের লেকচারার, শেখ মুজিবুর তখন সেখানে ছাত্র এবং আমাদের মতো তিনিও এককালে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যখন তিনিই বললেন, স্যার দেখেছেন এলফিনস্টোন রোডের সমস্ত চাকচিক্যের মূলে রয়েছে পূর্ববঙ্গের পাট, আমি বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম এ নতুন তথ্য তিনি আবিস্কার করলেন কোথা থেকে? এ রাস্তাটির বয়সও যেমন কমপক্সে পঞ্চাশ ষাট বছর তেমনি দোকানগুলিও প্রাক-পাকিস্তান যুগের। কিন্তু তিনি (শেখ মুজিব) তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সবকিছুর মূলে রয়েছে বঞ্চিত, অবহেলিত, শোষিত পূর্ব পাকিস্তানের দান। কিন্তু এই যুক্তি আমরা কিভাবে স্বীকার করি? অথচ ’৭১ সালে যে বিস্ফোরণ ঘটে, তখন লাখ লাখ বাঙালী তরুণ এই বিশ্বাস নিয়েই সংগ্রামে নেমে ছিলো যে, পাকিস্তান থেকে তারা শোষণ ছাড়া আর কিছুই প্রত্যাশা করতে পারে না”। (একাত্তরের স্মৃতি, ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, পৃষ্ঠা ৩১)।] এই উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের কিছুই হয়নি, পূর্ব পাকিস্তানের অংগুলি সংকেত করে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেনঃ
“বৃটিশরা যেমন এদেশের সম্পদ লুটে এদেশের মুসলিম সমাজকে ধ্বংস করে তাদের সাম্রাজ্যের পত্তন করেছিলেন এবং ইংল্যাণ্ডে এক নতুন বিত্তবান সমাজের উত্তঅনের পথ সুগম করেন, তেমনি এদেশ থেকৈ বিদায় নেবার প্রাক্কালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে তারা এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটান। সরকারী হিসেবে এই মন্বন্তরে ৩০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এবং সরকারী কমিশন বলেছিল যে, এই দুর্ভিক্ষ ছিল ম্যানমেড (কৃত্রিম)। এই বিধ্বস্ত অঞ্চলই ’৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট রূপান্তরিত হয়েছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ ৪৮ সাল থেকেই আবার শুনতে আরম্ভ করি যে, আমাদের সমস্ত দুর্দশার কারণ করাচীস্থ তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা, উপেক্ষা এবং শোষণ। পাঞ্জাব বা সিন্ধু অঞ্চলে যেমন যুদ্ধের সময় কোন দুর্ভিক্ষ হয়নি, তেমনি ১৭৫৭ সাল থেকে উনিশ শতাব্দীর শেষ অবধি সময় পর্যন্ত যে নির্যাতন বাংলার মুসলমানদের সইতে হয়েছে তার নজীর পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাসে নেই। হান্টার সাহেবের সে বিখ্যাত বইয়ের কথা এখানে উল্লেখ করার হয়তো দরকার নেই। তিনি বলেছিলেন যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পূর্বে যারা ছিলেন বাংলার সম্ভ্রান্ত সমাজ তারাই পরিণত হলেন কাঠুরিয়া আর ভিস্তির শ্রেণীতে। আগে যেমন কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমানর পরিবারের পক্ষে দারিদ্রের কবলে পতিত হওয়া অসম্ভব ছিল তেমনি ১৮৫৭ এর পর কারো পক্ষে সচ্ছলতা রক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই বিধ্বস্ত সমাজকে নিয়ে ১৯৪৭ সালে আমাদের যাত্রা শুরু। ৪৩ সালে যে দুর্ভিক্ষের কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি তার ভয়াবহতার চিত্র আমার বয়সী কোন লোকের মন থেকে মুছে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা ৭১ সালে ছিল না। জাপানীরা তখন বার্মা দখল করেছে। আরাকান পর্যন্ত থাবা বাড়িয়েছে। কোলকাতায় বোমা পড়ছে এবং যে কোন মুহুর্তে তারা আসাম ও বাংলার একটা অংশ দখল করে নিতে পারে। এই আশংকায় বৃটিশ সরকার পোড়ামাটি বা SCORCHED EARTH নীতি অবলম্বন করে। জেলে ও কৃষকদের নৌকা ধ্বংকস করে ফেরা হয়, ধ্বংস করা হয় ক্ষেত খামারের ফসল। একেতো তখন বার্মা থেকে চাল আমদানী বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে এ অঞ্চলে উৎপাদিত চাল সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনে ক্রয় করে উত্তর ও মধ্য ভারতে চালান দেয়া হয়। দুঃখের বিষয় এই প্রক্রিয়ায় কয়েকজন দুর্নীতিপরায়ণ মুসলমান রাজনীতিবিদও জড়িত ছিলেন। মাড়োয়ারীদের সাথে যোগ-সাজশে এঁরা চাল পাচার করতেন। এ নিয়ে একটা মামলাও হয়। এই মামলার তথ্য উদঘাটন করতে গেলে এমন সব নাম আবিস্কৃত হবে যা শুনলে বর্তমান জেনারেশন রীতিমত আঁৎকে উঠবে। কারণ এরা এঁদেরকে জাতীয় বীর হিসেবে চেনে। ….১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো আমরা দুর্ভিক্ষের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সেই দুর্ভিক্ষের সময় প্রবর্তিত রেশনিং প্রথা ৪৭ সালের পরও চালু ছিল। কিন্তু ’৪৭-এর আগস্টের পর ’৭১ সাল পর্যন্ত অভাব-অভিযোগ হলেও ব্যাপক দুর্ভিক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের কোনো এলাকায়ও হয়নি। যে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে পাকিস্তানের আদর্শের বিরুদ্ধে এ দেশের যুবসমাজকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল, সেটাই হলো পাকিস্তানের পতনের কারণ। …..আমি আগেই বলেছি যে, এই অভিযোগ শুরু হয় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। সুতরাং যা কিছু ঘটেছে তার বিচার আমরা করেছি জণ্ডিস রোগাক্রান্ত চোখ দিয়ে। উন্নয়ন যা হয়েছে প্রথম থেকেই বলা হতো যে প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল একান্তই অপর্যাপ্ত। যেনো দু’তিন বছরের মধ্যেই আমরা আগেকার দু’শ বছরের অনগ্রসরতা অতিক্রম করে পাঞ্জাবের সমান হতে পারি। দেশ গড়তে যে সময় লাগে, বিশেস করে একটা উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে না উঠলে যে এ অঞ্চলের পক্ষে সমানভাবে পাঞ্জাবের মোকাবিলা করা সম্ভব ছিলোনা, সে কথা ভুলেই বসেছিলাম বা সে কথা চাপা দেয়া হচ্ছিল যেনো অল্প শিক্ষিত একজন কবিরাজকে মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের পদে বসিয়ে দিলে তিনি সুচারুরূপে তাঁর দায়িত্ব নিস্পন্ন করতে পারবেন”।–[‘একাত্তরের স্মৃতি’, ডঃ সাজ্জাদ হোসায়েন, পৃষ্ঠা ৯৪, ৯৫, ৯৬।]
দেশ পরিচালনায় জাতীয় আদর্শ, জাতীয় লক্ষ্য ও নীতিবোধের অনুপস্থিতি যেমন দেশের শাসকদের রাজনৈতিক অবিচার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তেমনি তা বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সংখ্যাবৃদ্ধিসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গণকেও কলুষিত করে তুলেছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্বকীয়তার ছাপ দেশ বিভাগের আগে যতটুকু ছিল, এইসব ক্ষেত্রে রেনেসাঁ যতটুকু সৃষ্টি হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর তা যেন উবে যেতে লাগল। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিত আবুল কালাম শামসুদ্দিন তাঁর স্মৃতিকথায় এ সম্পর্কে লিখেছেন,-[আবুল কালাম শামসুদ্নি সাহেবের এই মন্তব্য তাঁর একটি বক্তৃতার অংশ। এ বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সম্মেলনে। এ সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করে আবুল মনসুর আহমদ ও মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। আবুল কালাম শামসুদ্দিন এক অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন।] “পাকিস্তান পূর্ব যুগে এখানকার মুসলমানদের মনে জাতীয় রেনেসাঁর বাণী যেরূপ জোরদার হয়েছিল, পাকিস্তান উত্তর যুগে দেখা যাচ্ছে তা যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। এটা নিশ্চিত দুঃসংবাদ। আবার বিদেশী ও বিজাতীয় সম্মোহন পাকিস্তানী তরুন মুসলিম মানসে মায়াজাল বিস্তার করছে দেখতে পাচ্ছি। তার ফলে যে আত্মস্থতার স্ফুরণ হয়েছিল জাতীয় জীবনে, তা ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার অন্ধ গতানগতিকতার সম্মোহন আমাদের জাতীয় জীভনকে কোন অন্ধকারের অতল গর্ভে ঠেলে দেয়ার আয়োজন করছে। মনে হচ্ছে নেপথ্য থেকে গত যুগের একদল ছিটকে পড়া সম্মোহিত পাণ্ডিত্যাভিমানী এ অপচেষ্টার পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছেন”।–[‘অতীত দিনের স্মৃতি’, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, পৃষ্ঠা ২৭৭।]
১৯৫৮ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দিন যে আশংকার কথা ব্যক্ত করেছিলেন, তার মাত্র একযুগের মাথায় তা একেবারে বাস্তবরূপে পরিগ্রহ করে সামনে চলে এল। সে সময় পর্যন্ত পৌঁছতেই বিশেষ করে তরুণ ও অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর মন-মানস থেকে জাতীয় স্বাতন্ত্র, সংস্কৃতি ও রেনেসাঁর চিন্তা একদম মুছে গিয়েছিল। এরই ফল ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বড় অংশের বাম ও ধর্ম নিরপেক্ষতামুখিতা।
সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের এই বাম ও ধর্মনিরপেক্ষমুখতা দেশের ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতিকে বিদেশমুখী ও পরজীবী অন্যকথায় কোলকাতামুখী করে তুলল। এ সম্পর্কে আবুল কালাম শামসুদ্দিন তার স্মৃতিকথায় দুইটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। একটি ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত মওলানা ভাসানির কাগমারী সম্মেলন। কার্জন হলের সাহিত্য সম্মেলন সম্পর্কে তিনি বলেন, “১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে ‘বাঙলা সাহিত্য সম্মেলনের’ এক অধিবেশন হয়। তাতে আমাকে মনন সাহিত্য শাখার সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। যারা এ সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিলেন, খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারা গেল, তাদের অধিকাংশই ছিলেন ‘বাঙলা সাহিত্য এক ও অভিভাজ্য’-এর নীতির জয় ঘোষণার জন্য সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নাকি পশ্চিম বংগের কয়েকজন প্রবীণ ও তরুণ সাহিত্যিককেও আমন্ত্রণ করেছেন। যাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাঁদের মতামত আগে থেকেই আমার জানা ছিল। তারা শুধু বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের অবিভাজ্যতা সম্পর্কে নয়, বাংলাদেশের অবিভাজ্যতা সম্পর্কেও দৃঢ়মত পোষণ করতেন”।–[‘অতীত দিনের স্মৃতি’, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, পৃষ্ঠা ২৭৫।] আর কাগমারী সম্মেলন সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমাদের সাহিত্যিক দুর্যোগ যে কেটে যায় নাই, বরং অধিকতর বেড়ে গিয়েছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল পরবর্তী আরেকটি সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে। সে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় টাংগাইল জেলার কাগমারীতে। মওলানা ভাসানী ছিলেন এ সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা। বাঙলা সাহিত্য এক ও অবিভাজ্য এ বাণী প্রচারকল্পে এবারও পশ্চিম বাঙলা থেকে পাকা প্রবীণ সাহিত্যিক আমদানির চেষ্টা অব্যাহত ছিল। ফলে আমন্ত্রিত প্রবোধকুমার সান্যাল মহাশয়ও ছিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বিষ উদগীরণে তাঁর অপূর্ব দক্ষতার কথা এখান থেকেও আমরা শুনতে পেয়েছিলাম। তাছাড়া তাঁর অপূর্ব দক্ষতার কথা এখান থেকেও আমরা শুনতে পেয়েছিলাম। তাছাড়া তাঁর সম্পাদিত ‘পদাতিক’ মাঝে মাঝে এখানেও ছিটকে এসে পড়ত। তাতেও চোখে পড়ত ‘নরহত্যা’, ‘নারীধর্ষক’, ‘পশু প্রকৃতি’ পাকিস্তানীদের লোমহর্ষক বর্ণনা। তাছাড়া সম্মেলনের উদ্যোক্তারা বাঙলাদেশের (দুই বাংলার) অবিভাজ্যতা প্রতিপন্ন করার জন্যে কিংবা অন্য কোন কারণে জানি না, সম্মেলন স্থানের বহির্দেশে অসংখ্য গেট করেছিলেন, এবং তাদের মধ্যে অনেকগুলোর নাম করা হয়েছিল ভারতীয় নেতাদের নামে, যেমনঃ গান্ধী গেট, জওহর গেট, সুভাষ গেট, ইত্যাদি। সম্মেলনের কার্যবিবরণী সম্পর্কে যে খবর পাওয়া গেছিল, তার মধ্যে পশ্চিম বঙ্গীয় সাহিত্যিকদের ভাষণগুলি ছির সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাতে নাকি দেশ ভাগের জন্যে যথেষ্ট অশ্রুপাত করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল, দেশভাগ হলেও বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য কখনও ভাগ হতে পারে না, হয় নাই –এক সংস্কৃতিতে আবদ্ধ বাঙালী জাতিত্ব কখনো বিভক্ত হতে পারে না ইত্যাদি”।–[‘অতীত দিনের স্মৃতি’, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, খোশরোজ কিতাব মহল, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৮, ২য় সংস্করণ ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ২৭৬।]
অর্থাৎ আদর্শিক শূনতা এবং বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রভাবশীল হবার ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের বুনিয়াদ নড়বড়ে হয়ে উঠল এবং বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা কোলকাতা ও দিল্লীমুখী হয়ে উঠল। এর সাথে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কোটারীর রাজনৈতিক নির্যাতন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য সোনায় সোহাগা হিসেবে কাজ করল। পরবর্তী দেড় দশকের মধ্যেই ভেঙে পড়ল পাকিস্তান। এই ভেঙে পড়ার পিছনে আদর্শিক দেউলিয়াত্বই মৌল কারণ ছিল, যা কারণ ঘটিয়েছিল রাজনৈতিক নির্যাতন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও।
এই কারণগুলোকে ভারত সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিল পাকিস্তানের দ্বিখণ্ডিত করার জন্যে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভারতের গোপন হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের পতনের একটা বড় কারণ। ইতিহাস বলে, অবস্থার চাপে ভারতের হিন্দু নেতৃবৃন্দ দেশবিভাগ মেনে নিয়েছিল এই আশায় যে, পাকিস্তান আসলেই টিকবেনা। এ সম্পর্কে একজন ভারতীয় ইতিহাসকার বলেছেন, “বিশেষ কারণে (নেহেরুর বক্তব্য অনুযায়ী) নেহেরু দেশ বিভাগকে এক আপোষ মীমাংসার প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করতে রাজী হয়েছিলেন। নেহেরু এবং কংগ্রেস ও দেশবাদীর বদ্ধ ধারণা ছিল যে, পাকিস্তান হবে ক্ষণস্থায়ী। কারণ নেহেরু ও কংগ্রেস নেতারা ভেবেছিলেন রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক দুর্বলতার কারণ বশতঃ পাকিস্তান জীবিত থাকতে পারবে না”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।] কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি’র প্রস্তাবেও এই কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, “When Passion have cooled, a new and s stronger unity based on good will and co-operation will emerge”. অর্থাৎ ‘আবেগ’ যখন ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তখন সহযোগিতা ও শুভেচ্ছার উপর ভিত্তিশীল একটা নতুন ও অধিকার শক্তিশালী ঐক্য সামনে এসে দাঁড়াবে’।
কিন্তু নেহেরুদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পাকিস্তান যখন রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক কারণে ভেঙে পড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না এবং ‘আবেগ ঠান্ডা হলেই ভারত আবার জোড়া লেগে যাবে’ –এই আশাবাদ যখন বাস্তবরূপ নিল না, তখন ভারত উদ্যোগী হয়ে কলকাঠি নাড়তে শুরু করল। ভারতে একটি পত্রিকা তার মূল্যবান অনুসন্ধানী রিপোর্টে লিখেছে, “Bangladesh was the result of a 10 year long promotion of dissatisfaction against rulers of Pakistan. The real seeds of discontent in East Pakistan were sown by the arronant, power crazed Punjabi ruling elite from West Pakistan. When the simmering disenchantment of two decade began to boil over. India grabbed the opportunity. Raw’s successes included winning over Mujib-ur-Rahman, funding his election, training, and arming the Mukti Bahini”. অর্থাৎ বাংলাদেশ পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ পরিবর্ধনের দশ বছর ব্যাপী চেষ্টার একটা ফল। পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষের বীজ প্রকৃতপক্ষে বপন করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্নীতি ও ক্ষমতালোভী পাঞ্জাবী শাসক চক্র। যখন পূর্ব পাকিস্তানের দুই যুগের অসন্তোষ টগবগিয়ে উঠল, তখন সে সুযোগকে লুফে নিল ভারত। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর বড় সাফল্য হলো মুজিবুর রহমানকে জয় করা, তার নির্বাচনের খরচ যোগানো এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং অস্ত্র সরবরাহ করা’। ভারতের ‘ইলাষ্ট্রেটেড উইকলি অব ইণ্ডিয়া’ পত্রিকার একটি বক্তব্যেও আমরা এই যার স্বীকৃতি পাই। বলা হয়েছে, “One of the most glorius chapters in the history of RAW, and in the carrer of Kao-[‘Kao’-এর পুরো নাম ‘রামেশ্বর নাথ কাও’। তিনি একযুগের বেশিকাল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা –‘Raw’ এর শীর্ষ নেতা হিসেবে কাজ করেছেন।] , was the operation leading to the creating of Bangladesh. That country would never, have been born but for the operation carried out by RAW for several years before the Indian army action. The first meeting between IB operatives and Shaikh Mujib had taken place as early as in 1963 and after RAW was set up in 1968, it anticipated virtually every major political and military development that took place in what are, then East Pakistan”. অর্থাৎ ‘র’ এর ইতিহাসে এবং ‘কাও’ এর জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় হলো ‘র’ এর সেই তৎপরতা যা সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ। সেই দেশটির জন্ম কখনই হতো না যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর আগের বছরগুরোতে ‘র’কাজ না করতো। ভারতের আই, বি ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা এজেন্টের সাথে শেখ মুজিবের প্রথম সংযোগ স্থাপিত হয় ১৯৬৩ সালে এবং ১৯৬৮ সালে ‘র’ প্রতিষ্ঠিত হবার পর পূর্ব পাকিস্তানের যাবতীয় রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলীর পেছনে এই সংস্থার হাত তৎপর ছিল”। ভারতের সাথে শেখ মুজিবের এই ধরনের যোগাযোগের কথা আওয়ামীলীগনেতা আব্দুর রাজ্জাকও বলেছেন। তাঁর কথা “তিনি (শেখ মুজিব) তখনই আমাদের বললেন ভারতের সাথে তার একটা লিংক আপ আগে থেকেই ছিল -১৯৬৬ সাল থেকে। তারা তাদের সবরকম সাহায্য করবে। তুই ওই ঠিকানায় দেখা করবি। তখন উনি চিত্তরঞ্জন সুতারের সাথে দেখা করতে বললেন। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধুর সাথে ভারতের সংযোগ করিয়ে দেয়। তবে ১৯৬৯ সালে জেল থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধু লণ্ডন যান। সেখানে সুতার ও অন্যান্য ভারতের লোক লণ্ডনে তাঁর সাথে দেখা করেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে ভারতের সহযোগিতায় ব্যাপারটি চূড়ান্ত হয়”।–[আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাতকার নিয়ে সাপ্তাহিক মেঘনার প্রচ্ছদ কাহিনী, ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৭।]
আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক তাঁর সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, “আমরা ভারতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছি স্বাধীনতার জন্যে অন্য কোন কারণে নয়”।–[আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাতকার নিয়ে সাপ্তাহিক মেঘনার প্রচ্ছদ কাহিনী, ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৭।] আব্দুর রাজ্জাকের এই উক্তি অনেকের ক্ষেত্রে ঠিক হলেও, সবার ক্ষেত্রে ঠিক নয়। ১৯৬৩ কিংবা ১৯৬৬ সালে আওয়ামীলীগ স্বাধীনতার কথা ভাবেনি, শেখ মুজিবও নন। আর আব্দুর রাজ্জাক সাহেবরা তো তখন ছাত্র মাত্র। আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব যে তখন স্বাধীণতার কথা ভঅবেননি, তার বড় স্বাক্ষী শেখ মুজিবের নিজস্ব জবানবন্দী। আগরতলা মামলায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলে তিনি আদালনের দেয়া এক হলপ করা জবানবন্দীতে বলেন, “স্বাধীনতার-পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতে আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে আমাকে আমার লেখা-পড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে। স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, এর ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিল এবং এখনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিকতার পথানুসারী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান। —সামকির শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং দেড় বছর কাল বিনা বিচারে আটক রাখে। আমাকে এইভাবে আটক রাখাকালে তাহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। কিন্তু আমি ঐ সকল অভিযোগ হইতে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। —অতঃপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলো, তখন আমাকেও জননিরাপত্তায় অর্ডিন্যান্স বলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং ৬ মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনর্জীবিত করা হয় এবং সম্মিলিত বিরোধীদের অংগদল হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। —-১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মিলনীর বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যামলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান ছয়দফা কর্মসূচী উপস্থিত করি। ছয়দফা কর্মসূচীতে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের জন্যই আঞ্চলিক সায়ত্তশাসনের দাবী করা হইয়াছে। অতঃপর আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকূলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয়দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠিত প্রবৃত্ত হয়। ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী প্রশাসনযন্ত্র আমাকে ‘অস্ত্রের ভাষায়’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযোগে একডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি যখন খুলনায়, একটি জনসভা করিয়া যশোর হইয়া ঢাকা ফিরিতেছিলাম, তখন তারাহার যশোরে আমার পথ অবরোধ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে ঢাকা হইতে প্রেরিত এক গ্রেফতারী পরোয়ানা বলে এইবারের মতো আমাকে গ্রেফতার করে। …..কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্যে এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনোবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। ……আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচী রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নহি। ….বর্তমান মামলা উল্লিখিত নিষ্পেষন ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নহে। আমি কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে কোন কিছু করি নাই কিংবা কোন দিনও এই উদ্দেশ্যে কোন স্থল, নৌ বা বিমান বাহিনীর কোন কর্মসূচীর সংস্পর্শে কোন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই। ……আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছু জানি না”।–[‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের লিখিত বিবৃতি’, বিচিন্তা, ২৫শে অক্টোবর, ১৯৮৭।] এই জবানবন্দীতে শেখ মুজিব নিজেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন ত্যাগী কর্মী, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে পেশ করেছেন এবং বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতা তিনি চান তা অস্বীকার করেছেন। প্রকৃতই বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতা চাইলে তিনি এইভাবে মিথ্যা কথা বলতেন না। কোন স্বাধীনতা সংগ্রামী এইভাবে মিথ্যা কথা বলে না, বলতে পারে না। বস্তুত শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতা অর্জনের কোন তৎপরতায় তখন জড়িত ছিলেন না এবং তিনি এ বিষয়ে কিছু অবহিতও ছিলেন না। আওয়ামী লীগ পন্থী বুদ্ধিজীবী জনাব কামরুদ্দিন আহমদ এ সম্পর্কে লিখছেন, ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে আমার ‘Socio-political history of Bangladesh’ প্রকাশিত হয়। বইটি হঠাৎ এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, ছয়মাসের মধ্যেই প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। ঐ বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণ করা হয়। ঐ পুস্তকখানি প্রকাশিত হবার পরপরই সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর রূপ নেয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওরা দু’জন আমার অফিসে যেত আমার সঙ্গে বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্যে। সিরাজুল আলম খান তখন মুখে বাংলার স্বাধীনতার কথা না বললেও স্বাধীনতা লাভের জন্যে শেখ মুজিবের অজ্ঞাতে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গুপ্ত সংস্থা গঠন করেছিলেন। ঐ সংগঠন সমূহের জন্যে প্রচারপত্র লিখা হতো ও তাদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এই সংগঠনের কথা আওয়ামী লীগ নির্বাহী কমিটির কেউ এমনকি শেখ সাহেবও জানতেন না”।–[‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’, কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১০৪।] আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানের যে এই ধরনের গোপন আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, তার স্বীকৃতি আব্দুর রাজ্জাকও দিয়েছেন। তাঁর উক্তিঃ “১৯৬৪ সালে আমরা কয়েকজন যুবক দেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। তখন আমি, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমদ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লব পরিষদ’ গড়ে তুলি। এই পরিষদকে ইংরেজীতে বলা হতো বিএলএফ……”।–[‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ’, গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে আব্দুর রাজ্জাকের উক্তি।] উল্লেখ্য, আব্দুর রাজ্জাকদের গোপন আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এই আন্দোলনের সাথে ভারতের যোগাযোগ থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং ভারত তার স্বার্থে এদেরকে ব্যবহার করার ব্যাপারটা খুবই সংগত। তবে রাজ্জাক আরেফদের এই বামপন্থী আন্দোলনের সাথে শেখ মুজিবের কোন সম্পর্ক ছিল না এবং তাদের পরিকল্পিত স্বাধীনতা’র সাথেও নয়।
সুতরাং ১৯৬৩ সালে বা ৬৪ সালে কিংবা ৬৯ সালে ভারতের সাথে শেখ মুজিবের যে সংযোগ বা সাক্ষাত হয় তার লক্ষ্য শেখ মুজিবের কাছে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতা ছিল না। আর আগরতলার ষড়যন্ত্র কালীন আগরতলায যে ষড়যন্ত্র বৈঠক হয়, সেখানে শেখ মুজিব নয়, বলা হয়েছে মুজিব-পন্থীরা ছিলেন। এ মুজিব পন্থীরা আব্দুর রাজ্জাক ও সিরামুল আলম খানের মত লোকরাই হবে যারা শেখ মুজিবকে পাশ কাটিয়ে সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলার কথা ভাবতেন এবং এজন্যে ভারতের সাথে যোগাযোগও রাখতেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় মজলুম ও ক্ষমতা লোলুপ নেতা হিসেবে শেখ মুজিব ক্ষমতায় যাবার সহায় হিসেবে সাহায্য সহযোগিতার জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ করলে করতেও পারেন এবং ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ নিতে পারেন। শেখ মুজিবের দিক থেকে এটাই লক্ষ্য কিন্তু ভারতের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। শেখ মুজিব ও অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগকে ভারত সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছিল তার স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। স্বার্থটা ছিল পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করা এবং এইভাবে গোটা ভারতকে আবার মুঠোয় আনা।
ভারতের উদ্দেশ্য যাই হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও সাহয্যের ছিল ইতিবাচক অবদান। এতে বাংলাদেশ উপকৃত হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়লাভ হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এতে ভারতের পাকিস্তান ভাঙার উদ্দেশ্য সফল হলেও বাংলাদেশকে কুক্ষিগত করে ভারতের পূর্বাঞ্চলকে জোড়া লাগানোর কিংবা বাংলাদেশের মুসলিম চরিত্র পাল্টানোর উদ্দেশ্যে তার পূরণ হয়নি। বাবু বসন্ত চ্যাটার্জীর ভাষায়ঃ “বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে আমাদের দেশের এমনকি সর্বোচ্চ পদাধিকারীও নির্লজ্জের মত দাবী করে আসছেন যে, এই ঘটনা (বাংলাদেশের স্বাধীনতা) দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধ্বংসের পর বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের একটিও সু-যুক্তি তারা দিতে পারেন কিনা। তাঁদের দাবীকৃত তত্ত্বটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তার একমাত্র যুক্তিসিদ্ধ পরিণাম হওয়া উচিত ভারতের সাথে বাংলাদেশের পুণসংযুক্তি, বাংলাদেশী হিন্দুদের যা যথার্থ কাম্য। যারা সবসময় দ্বি-জাতিতত্বের মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদের ঢাকপিটাচ্ছেন তারা কি প্রস্তাব দিতে পারেন যে, ১৯৪৭ সালে যে তত্ত্বের উপর দেশ বিভক্তি হয়েছিল তা যেহেতু আর অস্তিত্ববান নয়, তাই দেশটি কোলকাতার অনুগ্রহ নির্ভর সেই পূর্বেকার অবস্থায় ফিরে যাওয়াই ভাল?”-[‘Inside Bangladesh Today’, Page 150.] বসন্ত বাবু যে প্রস্তাব আহবান করেছেন, সে প্রস্তাব দেয়ার মত লোক ভারতে অবশ্যই আছে এবং বেশি পরিমাণে আছে, কিন্তু সে প্রস্তাব শোনা ও মানার মত কোন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীকে পাওয়া যাবে না। অবশ্য ১৯৭১ সালের ২৮শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিশেস তিনজন সংখ্যালঘু নেতা দিল্লীতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেবার প্রস্তাব দেন।–[আওয়ামী লীগের এমপি এবং আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এক সাক্ষাতকারে এই তথ্য দেন। ১৯৭১ সালের ঐ সময় জনাব চৌধুরী দিল্লীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি ঐ তিন হিন্দুনেতার একজনের নাম বলেন এবং তিনি হলেন আওয়ামী লীগ নেতা চিত্তরঞ্জন সুতার। (দ্রষ্টব্যঃ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ‘র’ এবং সিআইএ-এর ভূমিকা’-মাসুদুল হক মজুমদার, মৌল প্রকাশনি, বাংলা বাজার, পৃষ্ঠা ১২৩-১২৪।] এরা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশী নয়। বাংলাদেশে বাস করলেও এদের শেকড় ভারতে। এ কারণেই তারা বাংলাদেশকে ভারতের শামিল করার প্রস্তাব দিতে পেরেছিল। বাংলাদেশ বা কোন একজন বাংলাদেশীও এদের সাথে নেই। বস্তুতঃ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়েছে, পতাকা পাল্টেছে, জাতীয় সংগীত পাল্টেছে, কিন্তু ’৪৭ এর দেশবিভাগ ঠিক আছে, তার ভিত্তিও টিক রয়েছে। ব্যাপারটা নাম পাল্টানোর মত পরিচয় এবং চরিত্র পাল্টানো নয়। আর পাল্টানো সম্ভবও নয়। জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের গ্যারান্টি। অন্যকথায় দ্বি-জাতিতত্ত্বই বাংলাদেশ।