৫
সংহার মূর্তির আবার উত্থান
লাক্ষ্ণৌ প্যাক্ট যেমন হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার স্মরণীয় দলিল, তেমনি এ দলিল আবার নতুন বৈরিতার ভিত্তিও। লাক্ষ্ণৌ চুক্তি মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন ও পৃথক প্রতিনিধিত্বের অধিকার দিয়েছিল। অবশ্য এ অধিকার মুসলমানরা মর্লি-মিণ্টো সংস্কারের মাধ্যমে পেয়েছিল। কংগ্রেস লাক্ষ্ণৌ চুক্তিতে এটা মেনে নিয়েছিল মাত্র। কিন্তু কংগ্রেসের ভেতর ও বাইরে একটি শক্তিশালী মহল এটা মেনে নিতে পারেনি। ১৮৮২ সালে পৌরসভাগুলোতে মুসলমানদের জন্যে পৃথক নির্বাচনের সিদ্ধান্তের তারা যেমন বিরোধিতা করেছে, তারা যেমন বিরোধিতা করেছে ১৯০৯ সালে মর্লি-মিণ্টো সংস্কার প্রদত্ত মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার, ঠিক তেমনি তারা মেনে নিল না লাক্ষ্ণৌ চুক্তির পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে। তারা বুঝতে পেরেছিল মুসলমানরা পৃথক জাতি সত্তা নিয়ে তাদের হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লাক্ষ্ণৌ চুক্তির পর পরই তারা কিছু বললনা। কারণ কংগ্রেসের স্বরাজ, স্বদেশী বা রাজনৈতিক আন্দোলনে কংগ্রেস মুসলমানদের সহযোগিতা চায়। কিন্তু খেলাফত আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলন যখনি স্তিমিত হয়ে পড়ল, তখনই হিন্দুরা মাথা তুলল, রুখে দাঁড়াল পৃথক নির্বাচন, পৃথক প্রতিনিধিত্বের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্য আরও হিন্দুনেতাদের নিয়ে পুনর্গঠিত করলেন হিন্দু মহাসভা। শুধু হিন্দু মহাসভাই নয়, গড়ে উঠল আরও কিছু জংগী হিন্দু সংগঠন। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর নিস্ক্রিয় ‘আর্য সমাজকে সক্রিয় করে তোলা হলো। লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে ‘সংগঠন’ এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নেতৃত্বে ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ ঝড়ের বেগে কাজ শুরু করে দিল। মুসলিম বিরোধী তাদের সংঘবদ্ধ উত্থানের একটা বড় কারণ ছিল খেলাফত আন্দোলনে মুসলমানদের ভূমিকা। ‘খেলাফত’ ও অসহযোগ আন্দোলনে মুসলমানরা বহুক্ষেত্রেই হিন্দুদের কৃতিত্ব ম্লান করে দিয়েছিল এবং একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিল। হিন্দুরা এটা মোটেই পছন্দ করেনি’।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি, পৃষ্ঠা ১৫০।] তাছাড়া ১৯১৯ সালের মণ্টেগু চেমস ফোর্ড সংস্কারের কয়েকটি দিকও হিন্দুদের উদ্বেগের কারণ ঘটিয়েছিল। এই আইন এককেন্দ্রীক সরকার ভেঙ্গে দেবার পথে একটা পদক্ষেপ বলে হিন্দুদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল। তারা বুঝতে পারল, প্রদেশগুলো স্বায়ত্ত্বশাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলমানরা প্রাধান্য পেতে চলেছে। এর ফলে হিন্দুরা, সংখ্যাগরিষ্ঠরা গোটা দেশের উপর একতরফা আধিপত্য করার অধিকার হারাচ্ছে। এ কারণেই গান্ধী অবশেষে এই আইন প্রত্যাখ্যান করেন। এসব কারণ একত্রে মিলিয়ে মুসলমানদের সব ‘অনর্থের মূল’ ঠাওরে তাদের বিরুদ্ধে হিন্দুবাদী সংগঠনগুলো মারমুখী হয়ে উঠল। এসব সংগঠন জোর করে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করাও শুরু করল। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘রাজমুকুক’-এর ভাষায়, “—–হাজার হাজার গরীব মুসলমানকে প্রলোভন দ্বারা হিন্দু করা হইতেছে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি মাত্র উল্লেখ করিব। বাঙ্গালা ১৩০০ (১৮২৩) সালের ২রা আষাঢ় তারিখের আনন্দ বাজার বলেন যে, ‘আর্য সমাজীদের চেষ্টায় আগরার শিকরারা গ্রামের ৬০০শ’ মুসলমানকে শুদ্ধ করিয়া লওয়া হইয়াছে। অন্যান্য গ্রামেও ২০০শ’ শুদ্ধি কার্যে যোগ দিয়াছে’।–[‘রাজমুকুট’ সাইদ উদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ২১৯, ২২০ (ফুট নোট সহ)।] শুধু মুসলমাদনদের ধর্মান্তরিত করা নয়, মুসলমানদের মসজিদ দখলও তারা শুরু করল। ঐ ‘রাজমুকুট’ লিখছে, “মসজিদ লইয়া হিন্দু-মুসলমানে নানাস্থানে বিবাদ হইয়াছে। তন্মধ্যে আমি একটা মাত্র ঘটনার উল্লেখ করিব। তাজমহলের ন্যায় মধ্যস্থলে একটা গম্বুজ ও চারিকোণে মিনার আছে, পূর্বদিকে দরজা আছে (মন্দিরের ন্যায়, চূড়া ছিল না, ও দক্ষিণ কিম্বা পশ্চিম দিকেও দরজা ছিলনা, কেবল হিন্দু বাড়ীর নিকট) –এরূপ একটি জুমা মাসজেদকে হিন্দুগণ মন্দির বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং পুলিশ ও ডিঃ ম্যাঃ সাহায্যে মুসলমানদের নামাজ পড়া বন্ধ করিলেন ও হিন্দু সংবাদ পত্রে তারবার্তা দিলেন যে, ঝালকাঠির দুর্বৃত্ত মুসলমানেরা জোর পূর্বক হিন্দু মন্দির অপবিত্র করিয়াছে (আনন্দ বাজার, ডিসেম্বর, ১৯২৩)। এই বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় কলিকাতা হইতে সরকারী এমারত পরীক্ষক তথায় উপস্থিত হইয়া মাসজেদ বলিয়া প্রকাশ করেন”।–[‘রাজমুকুট’ সাইদ উদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ২২০, ২২১ (ফুট নোট সহ)।]
হিন্দু সংগঠনগুলোর উস্কানীমূলক এই ধরনের আচরণের ফলেই দেশব্যাপী দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। এক হিসেবে ১৯২০ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত ১২৭টি দাংড়া সংঘটিত হয়। এই দাংড়ার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন সুভাস বসু। তিনি লিখছেন, “১৯২২ সালে মহরম উপলক্ষে দাঙ্গা শুরু হয়, ১৯২৩ সলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং ৩০০ জন মারা যায়। ১৯২৪ সালে ছোট বড় ১৮টি দাঙ্গা হয়। ১৯২৫ সালে ইতস্তত কিছু গোলমাল দেখা দেয়, কিন্তু ১৯২৬ সালের দাঙ্গা পূর্বের রেকর্ড ভংগ করে। এ বছর ৩১টি দাঙ্গায় ১৬০০ জন নিহত হয়। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারী-মে মাসের দাঙ্গায় বোম্বেতে ২০০ জন মারা যায়। ১৯৩১ সালের কানপুর দাঙ্গা সমগ্র ভারতকে কাঁপিয়ে তোলে। এতে মৃতের সংখ্যা ৪০০/৫০০ জন। বহু সংখ্যক মন্দির ও মসজিদ ধ্বংস করা হয়”।–[“The Indian Struggle’, by Subhash Bose (উদ্ধৃত: ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, পৃষ্ঠা ২০৪, ২০৫] এই দাঙ্গা প্রসঙ্গে গান্ধী বললেন, “হিন্দু-মুসলিম সমস্যা মানুষের আয়ত্বের বাহিরে চলে গেছে”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, পৃষ্ঠা ২০৫।] বাইরে যাবার কথাই। গান্ধী এ সময় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয় হরিজন সেবায় মন দিয়ে বলা যায় দাঙ্গার জন্যে মাঠটা ফাঁকা করেই দিয়েছিলেন। গান্ধীর কংগ্রেস তো দাঙ্গাকে সহায়তাই দান করেছে। কংগ্রেস তখন দাঙ্গাবাজদেরই দখলে। “১৯২১ সালেও অর্থাৎ গান্ধী যুগেও একটি সুসংগঠিত মুসলমান বিরোধী কর্মী দল কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যার অর্ধেক স্থান দখল করে বসলেন এবং কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানে তাঁদের গুরুত্ব হয়ে উঠল সংখ্যানুপাতে ঢের বশী”।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৩৩।]
১৯২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া মুসলিম বিরোধী দাংগা হিন্দুদের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা মুসলিম বিদ্বেষের সশস্ত্র বিস্ফোরণ। বঙ্গভঙ্গ রদ-আন্দোলনের সময় হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষ প্রচণ্ডভাবে মাথা তোলে, কিন্তু সে সময় হিন্দু স্বদেশীয়দের প্রথম টার্গেট ছিল বৃটিশ, তাদের বোমা নিক্ষেপ হয়েছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার তারা টার্গেট করল মুসলমানদের। তারা ভাবল, ইংরেজদের মাথায় বোমা মেরে মুসলমানদের দাবী-দাওয়া ও উত্থান বন্ধ করা যাবে না। বঙ্গভঙ্গ তারা রদ করেছে, কিন্তু লাক্ষ্ণৌ প্যাক্ট ও মণ্টেগু-চেমস ফোর্ডের সংস্কারের মাধ্যমে গোটা বঙ্গই মুসলমানদের হাতে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে। সুতরাং হিন্দুরা মুসলমানদের মাথা ভেঙ্গেই ব্যথা দূর করতে চাইল। মুসলিম বিরোধী দাংগা এরই রেজাল্ট। এই দাংগায় সংখ্যাগুরুর সংহার মূর্তির সামনে মুসলমানরা ছিল অসহায় এক আত্মরক্ষাকারী। দাংগার জন্যে পরিবেশ ও উত্তপ্ত অবস্থা তারা সৃষ্টি করে আসছিল বহুদিন ধরে। ‘আল-এসলাম’-এর ভাষায় “১ম, সাহিত্যের দিক দিয়া হিন্দুদিগের মুসলমানদের প্রতি অযথা ও অন্যায় আক্রমণ, ২য়, গো কোরবানীতে বাধা প্রদান, ৩য়, মুসলমানদের রাজকর্ম লাভে হিন্দু কর্তৃক বাধা প্রদান, ৪র্থ, মুসলমানদের প্রতি হিন্দু জমিদারদের অবৈধ আচরণ এবং সাধারণ হিন্দুরাও পথে-ঘাটে, রেলে-ষ্টিমারে, হাটে, বাজারে তাহাদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণাসূচক ব্যবহার ও শ্লেষোক্তি প্রয়োগ”, প্রভৃতি ছিল এই সব দাঙ্গার প্রস্তুতি পর্ব। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় হিন্দুদের মানসিকতা ও তৎপরতা, মুসলমানদের অবস্থা ও মনোভাব সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। ১৯২৩ সালে দাঙ্গা যখন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে, তখন সাপ্তাহিক ছোলতান লিখল, “কিছুকাল হইতে ভারতবর্ষে বিশেষত পাঞ্জাবে ও ভারতে, উত্তরে পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হিন্দু সংগঠন সমিতি দ্বারা যে কি ভীষণ ও বিষময় ফল ফলিতে আরম্ভ করিয়াছে তাহা বর্ণনা করা অসম্ভব। এই ‘হিন্দু সংগঠনের’ সূত্রপাত করিয়াছেন ভারতের প্রসিদ্ধ জননায়ক পণ্ডিত মদন মোহন মালবীয়া। —উদ্দেশ্য হইতেছে, মোছলমানগণের শক্তিতে বাধা প্রদান, মোছলমানদিগকে সুযোগ মত জব্দ ও কাবু করা, ক্রমে ক্রমে মোছলমান শক্তি চূর্ণ করিয়অ তাহাদিগকে হয় পদানত করিয়া রাখা, অথবা সম্ভব হইলে ভারত ছাড়া করা। এই সকল উদ্দেশ্য নিয়ে ‘হিন্দুসংগঠন’ স্থাপিত। —-গভর্নমেন্ট এই সকল ব্যাপারে নিরব। —-আমরা এ সকল অবস্থা দেখিয়া শুনিয়া কংগ্রেস ও স্বরাজহিতৈষী হিন্দুদিগের নিকট বিনীত অনুরোধ করিতে বাধ্য হইতেছি যে, তাঁহারা এই হিন্দু সংগঠন আন্দোলন বন্ধ করিতে প্রাণপন চেষ্টা করুন, অন্যথা ভারতে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হইবে, সেই রক্তস্রোতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ভাসিয়া যাইবে”।–[‘ছোলতান’, ৮ম বর্ষ, ১৩শ সংখ্যা, ২৫ শে শ্রাবণ, ১৩৩০ (২৫ শে মে, ১৯২৩) উদ্ধৃত ‘সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’, মুস্তফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮০।] “দেশের দুর্ভাগ্য-অশান্তির কারণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটিয়া গেল। সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ক্রমে ভারতের নানা দিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। —-বঙ্গদেশে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করিতেছিল, দুঃখের বিষয় ফরিদপুরে —-ভীষণ দাঙ্গা বাধিয়া গিয়াছে। —-হায় হতভাগ্য ভারতবাসী! কোথায় তোমাদের স্বরাজ-আর কোথায় তোমাদের আপোষে মাথা ফাটাফাটি। কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মীদের অবিলম্বে এই বিবাদ মিটাইবার চেষ্টা করা কর্তব্য”।–[‘ছোলতান’, ৮ম বর্ষ, ১৩শ সংখ্যা, ২৫ শে শ্রাবণ, ১৩৩০ (২৫ শে মে, ১৯২৩), উদ্ধৃত ‘সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’,] “লাহোরের আর্য্য পত্রিকা কেশরী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য মিঞা মোহাম্মদ ফয়্যাজ খাঁর একখানি চিঠির প্রত্যুত্তর দিতে যাইয়া শেষ প্রেরিত মহাপুরুষ হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া ছাল্লামের প্রতি ভীষণ ও অশ্লীল আক্রমণ করিয়া বসিয়াছেন। —কেশরী অবিলম্বে ক্ষমা প্রার্থনা ও ত্রুটি স্বীকার না করিলে কোলকাতার ডেলি নিউজ পত্রের সম্পাদকের ঐ অপ্রীতিকর মন্তব্যের দ্বারা যেরূপ কলিকাতায় রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হইয়াছিল, পাঞ্জাবে তথা সমগ্র ভারতে আবার সে অভিনয় সংঘটিত হইবে। —মুছলমানগণ দুনিয়ার সকল প্রকার অত্যাচার, উৎপীড়ন সহ্য করিতে পারে, কিন্তু ধর্মের প্রতি অবমাননা, বিশেষত ধর্ম প্রবর্তকের প্রতি বেআদপী ও অসম্মান সূচক এক মুহুর্তের জন্য সহ্য করিতে প্রস্তুত নহে”।–[ ৮ম বর্ষ, ১৩শ সংখ্যা, ২৫ শে শ্রাবণ, ১৩৩০ (১৫ই জুন, ১৯২৩), উদ্ধৃত ‘সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ –মুস্তফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮৪।] “দাঙ্গার ফলে মুছলমানগণ শহীদ হইলেন, তাহাতেও হিন্দু-ভ্রাতাগণের তৃপ্তি হইতেছেনা। মালাবারে বহু সহস্র মোপালা ধ্বংস প্রাপ্ত হইল, জাতটাই ধ্বংসের দশায উপনীত হইয়াছে, অথচ ইহাতেও আমাদের হিন্দু ভ্রাতাগণের প্রাণের জ্বালা মিটিতেছেনা। তবে কি শান্তির উপায় সেই হিন্দুমহাসভা ও শুদ্ধির প্রস্তাবমতে কোটি কোটি মুসলমানকে হিন্দু করা?”-[‘ছোলতান’ ৮ম বর্ষ, ১৮ সংখ্যা, ২৮ শে ভাদ্র, ১৩৩০ (১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩) উদ্ধৃত ঐ, পৃষ্ঠা ২৮৫]
১৯২৪ সালে গোটা ভারতে মোট ১৮টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। তার মধ্যে দিল্লীর দাঙ্গাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হক চৌধুরী তার ‘দিল্লীর গাজী ও শহীদগণ’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন, “বিগত কোরবানী উপলক্ষে দিল্লীতে যে মহামারী কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে, তাহার মূলীভূত ৩টি কারণ আজ খুব স্পষ্ট হইয়াই আমাদের চক্ষের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিয়াছে। উহার প্রথম কারণ, গো-কোরবানী ও গো-জবেহ বন্ধ করিবার জন্য হিন্দুদিগের চিরাচরিত অন্যায় আব্দার ও অসঙ্গত ষড়যন্ত্র, দ্বিতীয় কারণ, প্রবল হিন্দুগণ কর্তৃক মুসলমানদিগের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার, ইহার প্রমাণ স্বরূপ বঙ্গীয় জমিদারদিগের জুলুম, আর শাহবাদের ঘটনা এবং দিল্লীর একটি কূপ হইতে পানি তুলিবার অপবাদে দশ বারজন হিন্দুর পক্ষে সম্মিলিত একটি অষ্টম বর্ষীয় মুসলমান বালককে নির্মম প্রহার করা, প্রভৃতি বহু ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। তৃতীয় কারণ, মুসলমানের ধর্ম কর্মে গভর্ণমেন্টের অন্যায় হস্তক্ষেপ। —বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে স্ব স্ব কর্ম করিতে পারিবে’ —–এই উদার ঘোষণাবলীর অবমাননা করিয়া গভর্ণমেন্ট এখন বহু স্থানেই হিন্দুর মনতুষ্টি সাধনের জন্যে মুসলমানের ধর্ম এবং জাতিগত সাধারণ অধিকারে হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। দিল্লীতে ঠিক এই ঘটনাই ঘটিয়াছিল”।–[‘ইসলাম দর্শন’, ৪র্থ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, আশ্বিন ১৩৩১ (সেপ্টেম্বর, ১৯২৪), উদ্ধৃত ঐ, পৃষ্ঠা ২৮৫।]
হিন্দু সংগঠনগুলোর ক্রম বর্ধমান মুসলিম বিদ্বেষী তৎপরতা এবং তাদের এ তৎপরতার প্রতি হিন্দু পত্রিকাগুলোর অন্ধ সমর্থন বিষয়ে ১৯২৫ সালে ইসলাম দর্শন ও রওশন হেদায়েৎ পত্রিকা লিখে, “মালব্যজী এবং লালাজীর সমস্ত বাকচাতুরীর পুরু আবরণ ভেদ করিয়া তাঁহাদের প্রধানতম শিষ্যগণের মুখে সংগঠনের প্রকৃত স্বরূপ যেরূপভাবে ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহা অতি ভয়াবহ। কিছুদিন পূর্বে লালা লাজপত রায়ের অন্যতম সহযোগী লালা হরদেও লাল প্রকাশ্য ভাবেই মুসলমানদিগকে হয় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ অথবা সসম্মানে জীবন লইয়া ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করিবার জন্য প্রকাশ্য হুকুম জারি করিয়াছিলেন। সম্প্রতি স্বামী শ্রদ্ধানন্দের প্রধানতম সহযোগী স্বামী সত্যদেব আরও স্পষ্ট ভাষায় শুদ্ধি সংগঠনের উদ্দেশ্য পরিব্যক্ত করিয়াছেন। —আর্য সমাজ ও শুদ্ধি সংগঠনের দল তথা হিন্দু সমাজের ঐ প্রচেষ্টা কেবল যে পশ্চিম ভারতেই সীমাবদ্ধ আছে তাহা নহে। বঙ্গদেশের হিন্দু সভা, শুদ্ধি সভা ও নারী রক্ষা সমিতির কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য করিলে এবং তৎপ্রতি হিন্দু সমাজ ও হিন্দু সংবাদপত্রের গভীর সহানুভূতি দেখিলে, এদেশেও উহার আয়োজন কিরূপ বিপুল উদ্যমে পরিচালিত হইতেছে, তাহা অতি সহজেই অনুমিত হইবে। —অসহযোগী ‘সাভেন্ট’, ‘স্বরাজী’, ‘ফরওয়ার্ড’ ও উদারপন্থী ‘হিন্দুস্থান’ হইতে আরম্ভ করিয়া মদরত ‘বেঙ্গলী’, গাঁজারত ‘নায়ক’, মোসলেম বিদ্বেষ বিদগ্ধা বিকৃতরুচি ও রাহুরূপিণী ‘বসুমতি’ এবং সাম্য মৈত্রীর ধ্বজা ধারিণী ‘সঞ্জীবনী’ পর্যন্ত সকলেই একবাক্যে ও একসুরে আর্য্য সমাজীদের কার্যকলাপ এবং ‘শুদ্ধি সংগঠন ও নারীরক্ষা’ আন্দোলন সমর্থন করিয়া যাইতেছেন। এ অবস্থায় মুসলমান সমাজের কর্তব্য কি? বিধর্মীয় এই সমবেত আক্রমণ হইতে তাহাদের আত্মরক্ষার উপায় কি? তা ধীরভাবে বিবেচনা করিয়া কর্তব্য নির্ধারণের জন্য আমরা দেশের আলেম, নেতা, কর্মী ও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিগণকে আকুল কণ্ঠে আহবান করিতেছি”।–[‘ইসলাম দর্শন’ অগ্রহায়ন ১৩৩২ (১৯২৫), উদ্ধৃত সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ মু্সতফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮১।] “সম্প্রতি স্বামী সদানন্দ ‘সতর্কীকরণ ও হিন্দু সংগঠনের আবশ্যকতা’ নামক এক খানি ইসলাম বিদ্বেষপূর্ণ পুস্তক লিখিয়া ইসলামে ভীষণ আঘাত করিয়াছেন। —এই প্রকার বিষ্ঠা বমন করিয়া স্বামীজির কি লাভ হইয়াছে তাহা আমরা বুঝিতে অক্ষম। তবে এই প্রকার ইসলাম বিদ্বেষ পূর্ণ কদর্য্য পুস্তক প্রচারে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ঘটাইয়া শান্তিভঙ্গ হইতে পারে ইহা নিশ্চয়। এই জন্য আমরা সদাশয় গভর্ণমেণ্টেরর বিশেষত সি আই ডি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। আর ভাই মোসলমানদিগকে বলিতেছি —-যাহাতে এই পুস্তক সরকার হইতে বাজেয়াপ্ত হয় ও গ্রন্থকারের কঠিন শাস্তি হয় তজ্জন্য সকলে চেষ্টা করুন”।–[‘রওশন হেদায়েৎ’ ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, চৈত্র ১৩৩২ (১৯২৫), উদ্ধৃত সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ মু্সতফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮২।]
এই সব আবেদন, আবহান কোন কাজে লাগেনি। প্রবল হিন্দু সংখ্যাগুরু ও হিন্দু সংবাদপত্রকে কিছুই বুঝানো যায়নি, সি আই ডি কিংবা সরকার কিছুই করেনি। দুর্বল মুসলমানদের কিছু করার তো সাধ্যও ছিলনা। ১৯২৬ সালে মুসলিম বিরোধিতা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। এই বছর ৩৬টি ভয়াবহ ধরনের দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। নিহতের সংখ্যা সরকারী হিসেবেই গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজারে। এই হত্যাকাণ্ড দর্শনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কলম আর্তনাদ করে উঠেছিল। যার প্রকাশে তার স্বভাবসুলভ ভংগীতে তিনি বলেন, “মারো শালা যবনদের!” ‘মারো শালা কাফেরদের’! আবার হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। —-দেখিলাম, হতআহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিলনা, মন্দিরের প্রধান দেবতা সাড়া দিলনা। শুধু তাহাদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল”।–[‘গণবাণী’, ২৬শে আগস্ট, ১৯২৬ (উদ্ধৃত সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ মু্সতফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮৬)।] নজরুলের এই পাইকারি কথায় সত্য-মিথ্যা পৃথক করা হয়নি। পৃথক করা হয়নি জালেম থেকে মজলুমকে, আর এটা সম্ভবও ছিলনা তাঁর পক্ষে। ‘সত্যাগ্রহী’ পত্রিকায় এই সত্যপ্রকাশটা সুন্দরভাবে ঘটে। সত্যাগ্রহী বলল, “এই কলিকাতার গত দাঙ্গার জন্য আর্য্য সমাজীরা কি পরিমাণ দায়ী, এ কথা যাঁহারা আগাগোড়া দাঙ্গা সম্পর্কিত সংবাদ রাখেন, তাহারা নিশ্চয় অবগত আছেন, এবং গভীরভাবে মনে মনে উপলব্ধি করিয়াছেন। এই সমস্ত দেখিয়া-শুনিয়া মনে হয়, কোন কালেও আর্য্যসমাজীদের ইচ্ছা শুভ নহে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে চিরবিরোধের সৃষ্টি করিতে তাহাদের অভ্যুত্থান”।–[‘সত্যাগ্রহী’, ১৪ই পৌষ, ১৩৩৩ (১৯২৬) উদ্ধৃত, সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ মু্সতফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮২।]
১৯২৭ সালে ৩১টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় ১৬০০ মানুষ জীবন দেয়। আর ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী প্রচারণাও এ সময় তুঙ্গে ওঠে। ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয় আহতকারী ‘রঙ্গিলা রসুল’ বই নিয়ে গণ্ডগোলের ঘটনা এ সময়েই ঘটে। বিচারে গ্রন্থের লেখককে শুধু ছেড়ে দেয়া নয়, তার সাফাই গাওয়া হয়। এই অবিচার মুসলিম বিদ্বেষী তৎপরতাকে আরও উৎসাহিত করে। এ সম্পর্কে ‘মোসলেম দর্পণ’ এর মন্তব্য, “বর্তমান সময় ভারতবর্ষে যে সকল হিন্দু মোসলেম বিদ্বেষ প্রচার করাকে তাহাদের জীবনের একটা মহান কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিয়া লইয়াছে এবং অহরহ এই বিদ্বেষ বহ্নি প্রচার করত উভয় সম্প্রদায় তথা সমগ্র ভারতে অশান্তির অনল প্রজ্বলিত করত দিন দিন নতুন ইন্ধন যোগাইয়া দেশের শান্তি ও শৃংখলাকে অচিরে অস্মীভূত করিবার প্রয়াস পাইতেছে, অপিচ তজ্জন্য আনন্দ ও আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছে, তাহাদের মধ্যে আর্য্য নামধারী ভণ্ড সম্প্রদায় যে স্পর্ধার চরম সীমায় উপনীত হইয়াছে, ইহা বর্তমান ‘রঙ্গিলা রসুল’ ও তৎসংক্রান্ত বিচার-বিভ্রাট দ্বারা স্পষ্টই প্রমাণিত হইয়া যাইতেছে। —-এই মোকদ্দমার রায়ে জাষ্টি দিলীপ সিংহ যে সকল যুক্তি ও অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন তাহাও মোসলমান সমাজের পক্ষে একান্তই অসহনীয়। তাঁহার মতে, ‘রঙ্গিলা রসুল’ পুস্তকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর প্রতি তীব্র শ্লেষ বাক্য ও ঘৃণিত গালাগালি বর্তমান থাকিলেও উহা ব্যক্তিগত এবং উহা দ্বারা নাকি ধর্মের অবমাননা ও আইনের সীমা লংঘন করা হয়না। —তিনি ‘রঙ্গিলা রসুল’ এর গ্রন্থকারকে বেকসুল খালাস দিয়াছেন। —-বিচারক দিলীপ সিংহের এবম্বিধ দৃষ্ট নজিরের ফলস্বরূপ ইতিমধ্যেই দেশের চারদিকে অশান্তির অনল জ্বলিয়া উঠিয়াছে। কোন কোন হিন্দু সংবাদপত্রে এখন প্রকাশ্য ভাবে হজরতের নিন্দা সূচক ও ইসলাম বিদ্বেষমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইতেছে”।–[‘মোসলেম দর্পন’, ৩য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, জুলাই ১৯২৭, উদ্ধৃত, সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ মু্সতফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮৩।]
মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই বিদ্বেষ প্রচার অব্যাহত থাকে এবং মুসলিম বিরোধী দাংগা চলে তিরিশের দশকেও অনেকখানি জুড়ে। ১৯৩১ সালের দাংগায় চার পাঁচ’শ লোক নিহত হয়। ঢাকায় বড় দাংড়া হয় ১৯৩০ সালে। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ‘সওগাত’ বলেছিল, “ঢাকায় সম্প্রতি বিষম সাম্প্রদায়িক দাংগা হইয়া গিয়াছে। চিরাচরিত প্রথা অনুসারে এ ব্যাপারে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর এবং মুসলমানরা হিন্দুদের উপর সকল দোষ চাপাইয়া দিয়া নিজ নিজ নির্দোষিতা প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন। —-আমরা বরাবর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার নিন্দা করিয়াছি এবং ঢাকার ব্যাপারেও দাঙ্গাকারীদের নিন্দা করিতেছি। দুঃখের বিষয় কয়েকখানি হিন্দু চালিত সংবাদপত্র ঢাকার হিন্দুদের ভণ্ডামীকে বীরত্বের পরিচায়ক বলিয়া প্রকারান্তরে তাহার প্রশংসাই করিয়াছেন”।–[
‘সওগাত’, ৭ম বর্ষ, ৯ম-১০ম সংখ্যা, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৭ (১৯৩০), উদ্ধৃত সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’ মু্সতফা নুরউল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮৬।]
হিন্দু পত্র-পত্রিকা ও হিন্দু রাজনীতিকদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলনা। হিন্দু রাজনীতিকরা কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে হিন্দু মহাসভা ও শুদ্ধি আন্দোলনের সাথে ছিলেন। কেউবা মৌন থেকে তাদের সহযোগিতা করছিলেন। মানুষ প্রেমী, মুসলিম দরদী বলে কথিত মিঃ গান্ধী দাঙ্গা শুরু হবার পর হরিজন সেবায় মনোনিবেশ করলেন। ভীষণ ব্যস্ত দেখা গেল তাঁকে লবন-সত্যাগ্রহ নিয়ে। মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা ও শুদ্ধি আন্দোলনের প্রধান নায়ক স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে নিরস্ত করার কোনই চেষ্টা গান্ধী করেননি, কখনও সমালোচনা করেছেন এরও কোন প্রমাণ নেই। বরং গান্ধী সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলন বিষয়ে ‘হাণ্টার কমিটি’র কাছে সাক্ষ্য দান কালে লর্ড হাণ্টারের প্রশ্নের জবাব দেবার সময় স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে ‘আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী’ বলে অভিহিত করেন এবং আন্দোলন বিষয়ে তাঁর সাথে পত্রালাপের কথা স্বীকার করেন।–[‘সত্যাগ্রহ’, মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী (অনুবাদক-শৈলেশ কুমার বন্দোপাধ্যয়), প্রকাশক অমর সাহিত্য প্রকাশন, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ১৪।] বিশের দশকের শুরুতে শীর্ষ হিন্দুনেতাদের মধ্যে বাংলার চিত্তরঞ্জন দাসই মুসলমানদের কিছুটা সমব্যথী হয়ে উঠেন এবং কংগ্রেসে থেকেও তাঁর রাজনৈতিক লাইনটা আলাদা করে নেন। ১৯১৯ সালের মণ্টেগু-চেমসফোর্ড এর ব্যবস্থা অনুসারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে কংগ্রেস দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় এবং নির্বাচনে যোগ না দেয়ার পক্ষে গ্রুপ অর্থাৎ গান্ধী গ্রুপই জয়লাভ করে। এই অবস্থায় পার্লামেণ্টে গিয়ে ইংরেজকে বিরোধিতার নীতিতে চিত্তরঞ্জন দাস কংগ্রেসের আভ্যন্তরেই স্বরাজ পার্টি গঠন করলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের এ সিদ্ধান্ত বিশেষ করে বাংলার যুব মহলে উৎসাহের সৃষ্টি করে। সোহরাওয়ার্দীর মত যুবনেতারা স্বরাজ্য পার্টিতে যোগদান করেন। স্বরাজ্য পার্টিকে শক্তিশালী করার জন্যে সি, আর দাস মুসলমানদের সহযোগিতা আন্তরিকভাবে কামনা করছিলেন। কিন্তু ১৯২৩ সালে স্বরাজ্য পার্টি বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও স্বরাজ্য পার্টি থেকে মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলমান মুসলিম আসন থেকে নির্বাচিত হলেন। ‘আইন সভাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রতিনিধিদের সাহায্য না পেলে কোন প্রগতিমূলক কাজ করাই সম্ভব হচ্ছিল না। চিত্তরঞ্জন এটা বুঝতে পেরে মুসলমানদের সন্তুষ্ট করে তাঁদের সাহায্য সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আশায় ১৯২৩ সালে সিরাজগঞ্জ প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মিলনীতে তার বিখ্যাত হিন্দু-মুসলিম চুক্তি সম্পাদন করলেন’।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৩৫।] স্যার আব্দুর রহীম, মৌলবী আব্দুল করিম, মৌলবী মুজিবুর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং জে, এম, সেন গুপ্ত, শরৎ বসু, জে, এম, দাসগুপ্ত, ডঃ বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ হিন্দু নেতৃবৃন্দ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক এই চুক্তি সম্পাদনে চিত্তরঞ্জন দাসকে সাহায্য করেছিলেন।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১০৬, ১০৭।] বাংলার হিন্দু মুসলিম সমঝোতার জন্যে সম্পাদিত এই চুক্তির শর্তগুলো ছিলঃ
ক) ব্যবস্থাপক সভায় জনসংখ্যা-[যে ব্যবস্থা চালু চিল তাতে ব্যবস্থাপক সভার মোট আসনের মুসলিম সদস্য শতকরা ৪০ ভাগ। অথচ এদের জনসংখ্যা শতকরা ৫৪ ভাগ।] অনুপাতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে এবং প্রতিটি সম্প্রদায় স্বতন্ত্রভাবে তাদের সদস্য নির্বাচিত করবে।
খ) স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ (মুসলমান) ও সংখ্যালঘিষ্ঠ (হিন্দু) প্রতিনিধির সংখ্যা জনসংখ্যা অনুসারে শতকরা ৬০ এবং ৪০ ভাগ নির্দিষ্ট থাকবে।
গ) সামগ্রিকভাবে সরকারী চাকুরীতে ৫৫% মুসলমান নিয়োগ করা হবে এবং যতদিন পর্যন্ত মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি অনুপাতে না পৌঁছে ততদিন পর্যন্ত ৮৮% চাকুরী মুসলমানরা পাবেন।
ঘ) মসজিদের সামনে বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ থাকবে।
ঙ) ঈদের সময় মুসলমানগণ বিনা বাধায গরু কোরবানীর সুযোগ পাবেন।
চ) এসব নীতিমালা যাতে সুষ্ঠুভাবে পালিত হয় তার জন্য একটি কমিটি থাকবে এবং এর অর্ধেক সদস্য হিন্দু এবং অর্ধেক সদস্য থাকবেন মুসলমান।
মুসলমানদের প্রতি সুবিধাভোগী হিন্দুদের শুভেচ্ছার এটা একটা ঐতিহাসিক দলিল। লাক্ষ্ণৌ চুক্তি বাংলার মুসলমানদের যে অধিকার হরণ করেছিল, ১৯১৯ সালের মণ্টেগগু চেমসফোর্ড সংস্কার তাদের যে অধিকার দেয়নি, বেঙ্গলপ্যাক্ট তাদেরকে সেই অধিকার দিল। ১৯২৩ সালের আইন-পরিষদ নির্বাচনের পর বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদিত হয়, বেঙ্গল প্যাক্টের পরপরই ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, বেঙ্গল প্যাক্টের পরপরই ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সোহরাওয়ার্দী নির্বাচিত হলেন ডেপুটি মেয়র। আর চীফ একজিকিউটিভ অফিসার ও ডেপুটি চীফ একজিকিউটিভ অফিসার হলেন যথাক্রমে সুভাষ বোস এবং হাজী আব্দুর রশীদ।
এইভাবে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। কিন্তু লাক্ষ্ণৌ প্যাক্টের মতই এই চুক্তিটি শিক্ষিত, সচেতন এবং প্রভাবশালী হিন্দুমহলের প্রচণ্ড বৈরিতার সম্মুখীন হলো। ‘সবচেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ হলো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দল। যাঁদের উপর চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসের পরিচালনার ভার অর্পন করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এমনকি গান্ধীবাদী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ পর্যন্ত প্রকাশ্য বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে করে আমরা তাদের একটার পর একটা দাবী বাড়িয়ে তুলতেই সাহায্য করছি’।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৩৫ (ডঃ প্রফুল্ল চন্দ্রের বক্তব্যের জন্যে দেখুন ‘দি বেঙ্গলা’, ২৭শে এপ্রিল, ১৯২৭।] কেউ কেউ আরও স্পষ্ট করে বললেন, ‘চিত্তরঞ্জন দাস মুসলমানদের নিকট দেশকে বিকিয়ে দিচ্ছেন এবং এ চুক্তি তিনি কখনও প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবেন না”।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১০৭।] চিত্তরঞ্জন দাস ইন্তেকাল করলেন ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন। এরপরই বেঙ্গল প্যাক্ট বিরোধী এ হিন্দু মনোভাব তীব্র হয়ে উঠল। এ ক্ষেত্রে গান্ধীর ভূমিকা একটা বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। বাংলার নেতৃত্বের জন্যে তিনি মুসলিম বিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদীদেরই বেছে নিয়েছিলেন। ‘গান্ধীজী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে চিত্তরঞ্জনের জায়দায় বাংলার নেতা করেছিলেন। শুধু সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের দাবী মেটাবার জন্য গান্ধীজী যে যতীন্দ্রমোহনকে বাংলার নেতা করেছিলেন তার উল্লেখ স্বরাজ্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডঃ মুকুন্দরায় জয়াকর-[ইনি পরে বিলাতের প্রিভিকাউন্সিল জজ নিযুক্ত হয়েছিলেন।] উনিশ’শ পঁচিশ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর লাল লাজপত রায়কে এক চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন এই ভাষায়ঃ ‘বাংলা থেকে বন্ধুরা জানিয়েছেন অন্যায় হস্তক্ষেপের দ্বারা গান্ধীজী যে সেনগুপ্তকে বাংলার নেতা করে দিলেন তাতে পার্টি শিগগির ভেঙ্গে যাবে”।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৩৬ (আরও দেখুনঃ ‘মাই লাইফ ষ্টোরি’, ২য় ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৩০)] ডঃ মুকুন্দরায় ঠিকই বলেছিলেন। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর স্বরাজ্য পার্টি আর স্বরাজ্য পার্টি থাকলোনা, হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক সহযোগিতার যে সর্বনিম্ন একটা সাহসী বুনিয়াদ চিত্তরঞ্জনগড়ে তুলেছিলেন তাকে ধ্বসিয়ে দেয়া হলো। মওলানা আবুল কালাম আজাদ এ সম্পর্কে লিখেন, “এই সাহসী ঘোষণা (বেঙ্গল প্যাক্ট) বঙ্গীয় কংগ্রেসের ভিত্তি পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছিলো। বহু কংগ্রেস নেতা তুলমানমুলকভাবে এর বিরোধিতা করলেন এবং মি;ঃ দাসের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিরেন। তাকে সুবিধাবাদের এবং মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য অভিযুক্ত করা হলো। —এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, তিনি দেহত্যাগ করবার পর তার কিছু সংখ্যক শিষ্য তার আদর্শকে খর্ব করে দিলেন এবং তার এই ঘোষণাটিকে বাতিল করে দেয়া হলো। ফল এই হলো যে, বাংলার মুসলমানরা কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়াল এবং দেশ বিভাগের প্রথম বীজ বপন করা হলো’।–[‘India wins Freedom’ পৃষ্ঠা ২১ (উদ্ধৃতঃ ‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, পৃষ্ঠা ৩৬)।] দেশ বিভাগের বীজ বপিত হলো শুধু বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের মাধ্যমে নয়, কংগ্রেস ও স্বরাজ্যপার্টির হিন্দুরা বাংলার আইন পরিষদের হিন্দু জমিদার-সামন্তদের স্বার্থ যেভাবে সমর্থন করল এবং শোষিত মুসলিম সংখ্যাগুরুদের স্বার্থের যেভাবে তারা সর্বনাশ করতে চাইল তাও মুসলমানদেরকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করল। এই চিন্তার ফল হিসাবে বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে স্বরাজ্য পার্টির পাল্টা ‘বঙ্গীয় প্রজা কমিটি’ গঠন করলেন। এ সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “১৯২৮ সারের প্রজাস্বত্ব আইনের প্রশ্নে দল নির্বিশেষে সব হিন্দু মেম্বাররা জমিদার পক্ষে এবং দল নির্বিশেষে সব মুসলিম মেম্বারা প্রজার পক্ষে ভোট দেন। আইন সভা স্পষ্টত সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত হয়। পর বৎসর সুভাস বাবুর নেতৃত্বে কৃষ্ণনগর কংগ্রেস সম্মিলনীতে (২২ শে মে, ১৯২৬) দেশ বন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল করা হয়।–[চিত্তরঞ্জন দাসের বিশ্বস্ত শিষ্য ‘শরৎচন্দ্রবসু প্যাক্ট বিরোধীদের নেতার স্থান নিয়েছিলেন’। (‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, পৃষ্ঠা ৩৭)] কি মুসলমানদের স্বার্থের দিক দিয়া, কি প্রজার স্বার্থের দিক দিয়া, কোন দিক দিয়াই কংগ্রেসের উপর নির্ভর করিয়া চলা আর সম্ভব থাকিলনা। —–আমরা মুসলমান কংগ্রেসীরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের নেতৃত্বে কংগ্রেস বর্জন করিয়া ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ গঠন (১৯২৯) করি। স্যার আব্দুর রহীম এই সমিতির সভাপতি ও মওলানা আকরম খাঁ ইহার সেক্রেটারী হন। মৌঃ মুজিবুর রহমান, মোঃ আব্দুল করিম, মৌঃ ফজলুল হক, ডঃ আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, খান বাহাদুর আব্দুল মোমিন সি আই ই ইহার ভাইস প্রেসিডেন্ট, মোঃ শামসুদ্দিন আহমদ ও তমিযুদ্দিন সি আই ই ইহার ভাইস প্রেসিডেন্ট, মোঃ শামসুদ্দিন আহমদ তমিযুদ্দিন খাঁ জয়েন্ট সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। এইভাবে রাজনৈতিক মত ও দল নির্বিশেষে বাংলার সমস্ত হিন্দু নেতা জমিদারের পক্ষে কংগ্রেস এবং সমস্ত মুসলিম নেতা প্রজার পক্ষে প্রজা সমিতিতে সংঘবদ্ধ হইলেন। এই পরিস্থিতি লক্ষ্য করিয়া দেশপ্রিয় জে, এম, সেনগুপ্ত একদিন আফসোস করেছিলেন, আজ হইতে কংগ্রেস শুধু মুসলিম বাংলার আস্থাই হারাইলনা, প্রজা সাধারণের আস্থাও হারাইল। মিঃ সেনগুপ্তের ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়া গিয়াছিল’।–[‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, আবুল মনসুর আহমদ।]
বেঙ্গল প্যাক্ট হিন্দু কংগ্রেস বাতিল করলে মওলানা আজাদ যেকথা বলেছিলেন, জে এম সেনগুপ্ত যেকথা বলেছিলেন, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও সে ধরনের কথাই বললেন। তাঁর কথা, “মুসলমানরা আর কংগ্রেসকে বিশ্বাস করেনা। কারণ গয়া কংগ্রেসে হিন্দু-মুসলমানের সর্ব ভারতীয় চুক্তি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কংগ্রেস তা পালন করেনি’।–[‘অমৃত বাজার পত্রিকা’, ১৫ই ডিসেম্বর ১৯২৭ (উদ্ধৃতঃ ‘ভারত কি করে ভাগ হলো, পৃষ্ঠা ৩৭, ৩৮)।] উল্লেখ্য, গয়া কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি এ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারেই বেঙ্গল প্যাক্ট করেন। এ প্যাক্টকে সর্ব ভারতীয় রূপ দেয়া কংগ্রেসের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু তা না করে, ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ কেই তারা হত্যা করল। ১৯২১ সালের পর স্বামী শ্রদ্ধানন্দদের প্রচারে উত্তপ্ত হয়ে উঠা ভারতে যখন মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা চলছিল, যখন বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদনের মাধ্যমে অন্তত বাংলার হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চলছিল, তখন মুসলিম লীগ সর্বভারতীয় পর্যায়ে মুসলমানদের স্বার্থ নিয়ে কংগ্রেসের সাথে বুঝাপড়ার রত ছিল এবং চেষ্টা করছিল হিন্দু-মুসলিম এক সাথে থেকে ভারতকে স্বাধীন করার আন্দোলন পরিচালনা করতে। মিঃ জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং এক সাথে আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা তিনি বাদ দেননি। মুসলিম লীগের অধিবেশনে তিনি বললেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বে একান্ত প্রয়োজন হিন্দু মুসলিম ঐক্য। এই একই কথা তিনি বারবার বলতে থাকলেন ১৯২৬ সাল পর্যন্ত।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৫৩।] হিন্দু মহাসভা এবং আর্যসমাজীয়দের মুসলিম খেদাও আন্দোলন তখন গোটা দেশে। মুসলিম বিরোধী দাংগায় কম্পমান গোটা দেশ। জিন্নার এ কথাগুলো হিন্দুদের কান স্পর্শ করলনা, অন্যদিকে মুসলিম লীগের অনেকে বিরক্ত হলো জিন্নার আপোশমুখিতায়। এই সময় ১৯২৭ সালে এল সাইমন কমিশন। ১৯২৪ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় আইন সভার বিরোধী দলীয় নেতা মতিলাল নেহেরু ভারতের নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্যে গোল টেবিল বৈঠকের যে প্রস্তাব এনেছিলেন তা গরিষ্ঠা ভোটে গৃহীত হয়। বৃটিশ সরকার সাইমন কমিশন গঠন করে কার্যত সে দাবীই মেনে নিল।–[‘ইতিহাস অভিধান (ভারত)’, যোগনাথ মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ৩৩৭] যে সব বিষয়ের উপর সাইমন কমিশনকে রিপোর্ট প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়, সে বিষয়গুলো হলো, ভারতবাসী দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্যে কতটা প্রস্তুত হয়েছে, দায়িত্বশীল সরকার গঠনের অনুকূল পরিবেশ ভারতে কতটা সৃষ্টি হয়েছে এবং কি ধরনের শাসনতন্ত্র ভারতের সব ধরনের জনমত ও স্বার্থকে সন্তুষ্ট করতে পারবে।–[–[‘ইতিহাস অভিধান (ভারত)’, যোগনাথ মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ৩৩৭]] সাইমন কমিশনের মিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু এতে ছিলনা ভারতীয় কোন সদস্য। তাই কংগ্রেস একে ‘প্রত্যাখ্যান করল। মুসলিম লীগের স্যার মুহাম্মদ শফীসহ কিছু সদস্য সাইমন কমিশনকে সহযোগিতা করতে চাইলেন। কিন্তু জিননআহ সাইমন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ ছিল শারীরিক হত্যাকাণ্ড এবং সাইমন হল আত্মার হত্যাকাণ্ড’।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১০০।] সাইমন কমিশনকে বয়কট করা হলো। এই বয়কন আন্দোলনে জিন্নাহ সফল ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করলেন। জিন্নাহ এই ভূমিকা লক্ষ্য করে গান্ধী এ সময় বলেছিলেন, “উদারপন্থী নির্দলীয় ও কংগ্রেস একসঙ্গে একত্র হয়ে এই বয়কটে এত ভাল করেছে দেখে আমি আনন্দিত হয়েছি’।–[‘ইয়ং ইন্ডিয়াঃ কালেকটেড ওয়ার্কস অব মহাত্মা গান্ধী’, ছত্রিশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫।] জিন্নাহ শুধু বয়কট সফল করে গান্ধীর মত তাঁর দায়িত্ব শেষ করলেন না। সাইমন কমিশনের জবাব হিসেবে এবং সবদলের জন্যে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, ভারতের জন্যে এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের স্বার্থে একটা প্রস্তাবনা প্রণয়ন করলেন। ১৯২৭ সালের ২০ শে মার্চ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের এই সম্মেলন জিন্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো-
‘ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র রচনার যে কোন পরিকল্পনার বিভিন্ন আইন সভায় প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রস্তাবের ভিত্তিতে মুসলমানদের সমঝোতায় সম্মত হওয়া উচিতঃ
(১) সিন্ধুকে বোম্বাই প্রদেশ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র একটা প্রদেশ গঠন করতে হবে।
(২) অন্যান্য প্রদেশের মত উত্তরত-পশ্চিম সীমান্ত ও বেলুচিস্তানে একই ধরনের শাসন-সংস্কার প্রবর্তন করতে হবে। যদি তা করা হয়, তাহলে মুসলমানরা সকল প্রদেশে যুক্ত নির্বাচন প্রথা গ্রহণ করতে সম্মত আছে এবং অন্যান্য প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমানদের যতটা বিশেস সুবিধা দেবে, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুদের সেই মোতাবেক বিশেস সুবিধা দেবে।
পাঞ্জাব ও বাংলায় প্রতিনিধিত্বের হার জনসংখ্যার অনুপাতে হবে। কেন্দ্রীয় সংসদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশের কম হবেনা, বরং তাও হবে যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে’।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২১০, ২১১।]
কংগ্রেস তথা হিন্দুদের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যাথার কারণ ছিল মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন। ঐক্যেল স্বার্থে মুসলমানরা এ প্রস্তাবের মাধ্যমে সে অধিকার পরিত্যাগ করতে রাজী হলো। অবশ্য সাইমন কমিশন সমর্থনকারী স্যার শফীর গ্রুপটি যুক্ত নির্বাচন মেনে নিলনা। এই ক্ষুদ্র গ্রুপটি পৃথক হয়ে গেল এবং এদের দ্বারা পাঞ্জাবে শফী লীগ গঠিত হলো।–[‘কায়েদে আযম’ আকবর উদ্দীন, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২১০, ২১১।] বাংলা থেকেও এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল।–[‘কায়েদে আযম’ আকবর উদ্দীন, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২১০, ২১১।] এই ভাঙ্গন ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও শুধু হিন্দুদের সাথে ঐক্যের স্বার্থেই জিন্নাহ এই প্রস্তাবের উপর অটল ছিলেন এবং তা পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন। এই প্রস্তাব ‘দিল্লী প্রস্তাব’ নামে পরিচতি হলো।
মুসলিম লীগ জিন্নার এই ‘দিল্লী প্রস্তাব’ ১৯২৭ সালে কংগ্রেসকে দেয় তার বিবেচনার জন্যে। ১৯২৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী দিল্লীতে সর্বদলীয় সম্মেলন বসল। এই সম্মেলনের সব পক্ষের দাবী সামনে রেখে ভারতের জন্যে সংবিধানের একটা রূপরেখা প্রণয়নের লক্ষ্যে একটা কমিশন গঠন করা হলো। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন মতিলাল নেহেরু। স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু, স্যার আলী ইমাম, সুভাষচন্দ্র বসু, মাঠাও রাও এ্যাটা, এম আর জয়াকার, এন, এম, যোশী এবং সরদার মংগল সিং হলেন কমিশনের সদস্য। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে জয়াকার এবং যোশী কমিশনের কোন মিটিং এ যোগ দেননি। অসুস্থ স্যার আলী ইমাম একটি মাত্র মিটিং এ যোগ দিতে পেরেছেন।–[‘Indian National Congress and the Muslims since 1928’, Dr. Padma Shah.] কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলো। রিপোর্টে পৃথক নির্বাচন প্রথা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের যৌথ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু মুসলমানদের জন্যে কোন আসন সংরক্ষিত থাকলো না। মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকল, কিন্তু নির্বাচন হবে মিলিত ভোটের মাধ্যমে। বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলমানদের জন্যে আসন সংরক্ষণ থাকলোনা। রিপোর্টে দৃঢ় এককেন্দ্রীক শাসনের ব্যবস্থা করা হলো। সব মিলিয়ে নেহেরু রিপোর্ট মুসলমানদের সব দাবী-দাওয়াই অস্বীকার করল। হতাশা নেমে এলো মুসলিম লীগ মহলে, মুসলমানদের মধ্যে। জিন্নাহ বললেন, নেহেরু রিপোর্ট হিন্দুর রিপোর্ট ছাড়া আর কিছু নয়।–[‘Years of Destiny: India 1926-1932’, by J. Coatman ‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১০১।] মওলানা শওকত আলী মন্তব্য করলেন যে, যৌবনে তিনি শখ করে একটি গ্রেহাউন্ড কুকুর পুষতেন। কিন্তু তিনি কুকুরটিকে খরগোষ তাড়া করতে দেখেননি। কিন্তু এ রিপোর্টে তাঁর মতে একটি গ্রেহাউন্ড একটি খরগোশকে তাড়া করে ফিরছে।–[(উদ্ধৃতঃ ‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৭৬)।] নেহেরু রিপোর্টের ভূয়শী প্রশংসা করলেন মিঃ গান্ধী। এ ধরনের একটি চমৎকার রিপোর্ট প্রণয়নের জন্যে মিঃ গান্ধী ধন্যবাদ জানিয়ে টেলিগ্রাম পর্যণ্ত করলেন মাতিলাল নেহেরুকে। গান্ধীর এ আনন্দে আহত হয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলী বললেন, “আপোষ রফার জন্যে মুসলমানদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে গান্ধী ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার প্রতি চোখ বন্ধ রেখে তিনি সাম্প্রদায়িকতার উচ্ছেদ চান। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাম্প্রদায়িক নীতির পৃষ্ঠপোষক। নেহেরু রিপোর্ট সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের নীতির পৃষ্ঠপোষক। নেহেরু রিপোর্ট সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের জুলুমকে আইনানুগ করার প্রচেষ্টা মাত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতাকে এ রিপোর্ট জাতীয়তাবাদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অপরদিকে সংখ্যাগুরুদের জুলুম হতে সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচের দাবীকে সাম্প্রদায়িকতা বলে আখ্যায়িত করেছে”।–[‘The Indian National Congress and the Muslims since 1928’, (উদ্ধৃতঃ মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৭৭)।] এই অবস্থায় কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের সংঘবদ্ধ হতে বললেন। ‘ভয় পাবার কিছু নেই’ বলে তিনি মুসলমানদের আশ্বস্ত করলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১০১।]
নেহরু রিপোর্টের চূড়ান্ত বিবেচনার জন্যে ১৯২৮ সালের ২২শে ডিসেম্বর কোলকাতায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস এবং সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। কোলকাতায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস এবং সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। কোলকাতায় মুসলিম লীগ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হলো যে, পৃথক নির্বাচনের ধারা বজায় রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় সংসদে এক তৃতীয়াংশ আসন সংখ্যালঘুদের জন্যে সংরক্ষিত রাখতে হবে এবং অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশকে দিতে হবে।–[‘রোজেজ ইন ডিসেম্বর’, চাগলা, পৃষ্ঠা ৯৬ (উদ্ধৃতঃ ‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, ১০২)।]
নেহেরু রিপোর্ট নিয়ে সর্বদলীয় সম্মেলনে চারদিন ব্যাপী আলোচনা হলো। চূড়ান্ত দিন ২৮ শে ডিসেম্বর জিন্নাহ মুসলমানদের দাবী দাওয়া সম্পর্কে তার সমাপনী বক্তব্যের উপসংহারে বললেন, “ভারতকে এগিয়ে যাবার জন্যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত এবং এমন একটি আবহাওয়া সৃষ্টি করতে হবে যেন দেশের সব সম্প্রদায় সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে’। জিন্নার বক্তৃতার সমালোচনা করলেন স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু, হিন্দুমহাসভার এম, আর, জয়াকার প্রমুখ। স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের দাবীকে খুব অযৌক্তিক মনে করলেন না। তিনি বললেন যদি জিন্নাহ খারাপ ও দুষ্ট ছেলে হন —-তাহলে উনি যা চান দিয়ে দিন। এম, আর জয়াকার প্রতিবাদ করে বললেন, জিন্নাহ খারাপ কিংবা দুষ্ট ছেলে নন। দেশের গণ্যমান্য মুসলিম (কংগ্রেস নেতা) মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ আনসারী, ডাঃ কিচলু সবাই নেহেরু রিপোর্ট সমর্থন করেছেন”।–[‘History of Freedom Movement in India’, Tarachand, Vol, Page 39.] আলোচনা এবং গোটা পরিস্থিতি জিন্নাহকে খুবই আহত করল। তিনি অত্যন্ত ধীর ও শান্তকণ্ঠে বললেন, “আজ আমরা এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমরা চাই হিন্দু-মুসলমান স্বাধীনতার পথে একসঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাক। এই কাজ করবার জন্য আপনাদের শুধু মুসলিম লীগ নয়, সমস্ত ভারতের মুসলমানদের সাহায্যের দরকার হবে এবং আমি আপনাদের কাছে একজন মুসলমান নাগরিক হিসাবে নয়, একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বলছি, আপনারাকি সামান্য কয়েকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেলেই সন্তুষ্ট হবেন? আপনারা কি চাননা যে, মুসলিম ভারত আপনাদের সঙ্গে এগিয়ে যাক? সংখ্যালঘুদেরকে কি সংখ্যাগুরুদের দেবার মত কিছুই নেই? অতএব আমার এ ‘সামান্য ছোট দাবীকে অস্বীকার করা কিংবা আমি যেন কোন চাপ সৃষ্টি না করি এই অনুরো বৃথা। আমার এই দাবী যদি সামান্য ‘ছোট দাবী’ হয় তাহলে স্বীকার করে নিতে আপত্তি কেন? শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠই এই দাবীকে স্বীকার করে নিতে পারে। আমি এই দাবী পেশ করছি। কারণ, আমার মনে হয় মুসলমানদের কাছে এই দাবী যুক্তিসঙ্গত। আমরা সবাই এই দেশের সন্তান, অতএব আমাদের এক সঙ্গে বসবাস করতে হবে, কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে যতই বিভেদ থাকনা কেন, ঝগড়া-বিবাদ বাড়িয়ে কোন ফল হবেনা। আমরা যদি এই বিষয়ে একমত না হতে পারি, বন্ধু হিসেবে আমরা এক অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। বিশ্বাস করুন, যতদিন ভারতে হিন্দু-মুসলিম এক না হবে, ততদিন দেশের কোন উন্নতি হবে না, এবং আমি মনে করি, কোন প্রকার যুক্তিতর্ক, বাধা-বিপত্তি আমাদের মীমাংসার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেনা। হিন্দু-মুসলমানদের মিলন দেখলে আমি সবচাইতে বেশী খুশী হবো”।–[‘মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’, এম এইচ সৈয়দ, পৃষ্ঠা ৪৩২-৪৩৫ (উদ্ধৃতঃ ‘স্বাধীনতার অজানা কথাঃ পৃষ্ঠা ১০৩)।]
নেহেরুর জীবনীকার মাইকেল এডওয়ার্ডস বলছেন যে, “জিন্নার এই বক্তৃতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল, “আমরা বন্ধু হিসেবে একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই’। এই কথাটি বলার সময় তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল”।–[‘নেহেরু’, মাইকেল এডওযার্ডস, পৃষ্ঠা ৪৩ (উদ্ধৃতঃ ‘স্বাধীণতার অজানা কথা’, পৃষ্ঠা ১০৪)।]
জিন্নার এই অশ্রু মাড়িয়েই সেদিন কোলকাতা কনভেনশনে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে দেয়া হলে জিন্নাহ পরাজিত হয়েছিলেন।
এই পরাজয়ে জিন্নাহ খুব বিচলিত হলেন। তাঁর কাছে এটা ছিল ‘হিন্দু ও মুসলমানের পথ আলাদা হয়ে যাওয়া।–[‘Central Legistlature ib British India’, by Rashiduzzaman, Page 25, 26.] কলকাতার এই কনভেনশনের পর থেকে জিন্নার রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এল। নাগপুরের কংগ্রেস অধিবেশনে তার রাজনৈতিক জীবনে প্রথম পরাজয় হয়েছিল, কলকাতার অল পার্টি কনভেনশনে তার দ্বিতীয় পরাজয় হল। তারপর কিছুদিনের বিশ্রাম এবং এরপর থেকে আমরা তাঁকে ভিন্ন রূপে মুসলমান জনগণের নেতা হিসাবে দেখতে পাব’।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাতিদ্য, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ১০৪।]
সংখ্যালঘু মুসলমানদের অশ্রু না মাড়িয়ে যদি সেদিন জিন্নার সংশোধনীগুলো গ্রহণ করা হতো, তাহলে ইতিহাসের ধারা হয়তো অন্যদিকে বইতো। কিন্তু ‘উগ্র আর্যত্বের দাবীদার কংগ্রেস সর্বভারতব্যাপী তাদের প্রভুত্ব কায়েমের স্বার্থে বিভোর ছিল”।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৭৮।]
তারা মুসলমানদের সামান্য ছাড় দিতেও রাজী হয়নি। রাজী হবে কি করে? তারা তো চেয়েছিল, মুসলমানদের পদানত করে কিংবা দেশছাড়া করে গোটা ভারত কুক্ষিগত করতে। তাদের সংহার মূর্তির বারবার উত্থান তো এই কারণেই। কিন্তু তাদের স্বপ্ন সফল হয়নি। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের সাথে নিয়ে আত্ম-রক্ষার একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। যার ফল ছিল ভারত বিভাগ। এই ভারত বিভাগ যখন বাস্তব হয়ে হিন্দু নেতাদের সামনে এল, তখন গান্ধীর মত অনেকেই তাদের অন্যায় অবিচার বুঝতে পেরেছিলেন। এ সম্পর্কে একটা সুন্দর কাহিনী বলেছেন সাবেক বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারী আবুল হাশিম। এ কাহিনীটি বর্ণনা করেছেন আবুল হাশিমের ছেলে বদরুদ্দীন উমর তার এক আলোচনায়। কাহিনীটি এইঃ ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট। গান্ধী কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় আবুল হাশিম তার সাথে দেখা করেন। সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে আবুল হাশিম বলছেন, “আমাদের কথাবার্তার শেষ পর্যায়ে আমি গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করলাম, পাকিস্তানের বদলে আজ জিন্নাহ যদি তার ১৪ দফা প্রস্তাব দেন তাহলে তাঁর মনোভাব কি হবে”। তিনি বললেন, ‘হাশিম, আমি খুব আগ্রহে তা করবো”। শ্রদ্ধার সাথে এবং বিনয়ের সুরে আমি মন্তব্য করলাম, মহাত্মাজী আপনাকে তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, আপনি যখন জিন্নার ১৪ দফা অগ্রাহ্য করেছিলেন, সে সময় ১৫ই আগষ্ট আপনার দৃষ্টিগোচর হয়নি”।–[‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’, ঈদ সংখ্যা, ১৯৮৭।]