৬
নির্যাতিতের আত্মোপলব্ধি
কোলকাতার সর্বদলীয় কনভেনশন থেকে মুসলমানরা শুধু খালি হাতে নয়, বুকভরা হতাশা নিয়েও ফিরে এল। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উদগ্রীব ছিলেন জিন্নাহ। ঐক্যের খাতিরেই জিন্নাহ মুসলিম লীগকে অনেক ত্যাগ স্বীকারে রাজী করিয়েছিলেন, এমনকি দলের ভাঙন পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেহেরু রিপোর্ট থেকে এক ইঞ্চিও নড়লনা। আঘাত পেয়েছিলেন জিন্নাহ বেশী। তার স্ত্রীও মারা গেলেন এসময়। হঠাৎ আইন ব্যবসায়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জিন্নাহ। যেন এর মাঝেই তিনি সবকিছু ভুলতে চাইলেন। মুসলানরাও নিজেদের দিকে ফিরে তাকাল। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের একগুয়েমী, অসহনশীলতা, বৈরিতা থেকে তারা বুঝল, মুসলমানদের জাতিগত আত্মরক্ষার বিষয়টিকে কিছুতেই ছোট করে দেখা চলবেনা। মুসলমানরা ‘দিল্লী প্রস্তাব’ ও নেহেরু রিপোর্টের সংশোধনীতে হিন্দুদের যে ছাড় দিয়েছিলেন, সেখান থেকে তারা ফিরে এল। ১৯২৯ সালে ৩১ শে ডিসেম্বর এবং ১৯৩০ সালের ১লা জানুয়ারী দিল্লীতে নিখিল ভারত মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। মুসলমানদের প্রায় সকল দলের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যোগ দিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন স্যার শফি, আল্লামা ইকবাল, আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং জমিয়তে ওলামার প্রতিনিধিগণ। সম্মেলনে নিম্নোক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হলো- (১) ফেডারেল পদ্ধতির রাষ্টগঠন করতে হবে এবং অবশিষ্ট (রেসিডুয়ারী) ক্ষমতা প্রদেশের হাতে রাখতে হবে, (২) স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে হবে, (৩) মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশ সমূহে তাদের চলতি ‘ওয়েটেজ’ সংরক্ষণ করতে হবে, (৪) কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলমানদের এক তৃতীয়াংশ আসন থাকবে, (৫) সর্বপ্রকার সরকারী চাকুরীতে মুসলমানদের যথাযোগ্য অংশ নিশ্চিত করতে হবে এবং (৬) মুসলমানদের শিক্ষা, উন্নয়ন, ভাষা, ধর্ম, ব্যক্তিগত আইন ও মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ করতে হবে।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৪২।] জিন্নাহ এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু জিন্নাহ চলমান ঘটনা প্রবাহ থেকে দূরে থাকতে পারেননি, তিনি দিল্লীতে মুসলিম লীগের একটি সম্মেলন আহবান করলেন। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্যে পৃথক হয়ে যাওয়া স্যার শফির গ্রুপকেও তিনি আহবান করেন, কোলকাতার সর্বদলীয় কনভেনশন ব্যর্থ হয়ে যাবার পর স্যার শফির গ্রুপের সাথে জিন্নার ব্যবধান কমে এসেছিল। তাদের সংগে আলোচনায় সাব্যষ্ত হয়েছিল যে, উভয় দল একই সময়ে অধিবেশন করবে এবং যুক্ত অধিবেশন একই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করবে। এই সম্মেলনের জন্যে জিন্নাহ যে প্রস্তাব প্রণয়ন করলেন, তা তার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ঐক্য-চিন্তার জ্বলন্ত নিদর্শন। কোলকাতার সর্বদলীয় সম্মেলন থেকে তিনি চোখের জল নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এর পরও তিনি ঐক্যের দরজা বন্ধা করতে এবং নিজেদের দিক থেকে কোন ত্রুটি রাখতে চাইলেন না। জিন্নাহ তার প্রণীত প্রস্তাবে বললেন, ‘যেহেতু ১৯২৮ সালের খৃষ্টমাস কলিকাতার সর্বদলীয় সম্মেলন আহবানের উদ্দেশ্য ছিল একটি শাসন সংস্কার পরিকল্পনা তৈরি করা এবং প্রধান রাজনৈতিক দল সমূহ কর্তৃক সেটাকে জাতীয় চুক্তি হিসাবে অনুমোদন করা এবং যেহেতু নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কর্তৃক তা গৃহীত হয়নি, যেহেতু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মাত্র এক বছরের জন্য উক্ত রিপোর্ট গ্রহণ করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে, এই এক বছর অর্থাৎ ১৯২৯ সালের মধ্যে বৃটিশ পার্লামেণ্ট রিপোর্ট মোতাবেক ‘শাসন পদ্ধতি সংস্কার না করলে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে আইন অমান্য আন্দোলন চালাবে; এবং যেহেতু হিন্দু মহাসভা চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, নেহেরু রিপোর্টের সাম্প্রদায়িক সমঝোতা সম্পর্কিত একটি শব্দও পরিবর্তন করলে তারা তাৎক্ষণাৎ অনুমোদন প্রত্যাহার করবে, —–
সেহেতু মুসলিম লীগ নেহেরু রিপোর্ট গ্রহণে অক্ষম। —লীগ সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করার পর সুদৃঢ় ও সুস্পষ্ট মত প্রকাশ করেছে যে, নিম্নলিখিত মৌলিক নীতিগুলি স্বীকৃত না হলে ভারতের মুসলমানরা ভারতের শাসন ব্যবস্থার যে কোন বাবী শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবেনাঃ
১। ফেডারেল পদ্ধতিতে ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং প্রদেশ সমূহের হাতে অবশিষ্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে।
২। সবগুলি প্রদেশকে একই ধরনের স্বায়ত্ব শাসন দিতে হবে।
৩। দেশের সমস্ত আইন সভা ও অন্যান্য নির্বাচিত সংস্থাগুলি এমনভাবে গঠন করতে হবে যেন প্রতিটি প্রদেশের সংখ্যালঘুরা এমন কি কম সংখ্যক সম্প্রদায়ও সেগুলিতে পর্যাপ্ত ও সক্রিয় প্রতিনিধি পাঠাতে পারে।
৪। কেন্দ্রীয় আইনসভার মুসলিম প্রতিনিধিদের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশের কম হলে চলবেনা।
৫। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতিনিধি নির্বাচন এখনকার মতই স্বতন্ত্র নির্বাচনের ভিত্তিতে করতে হবে। তবে যে কোন সম্প্রদায় যে কোন সময়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহন করতে পারে।
৬। আঞ্চলিক পুনর্বণ্টনের কোন প্রয়োজনীয়তা যদি কখনও দেখা দেয়, তবে তা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব, বাংলা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কোন ক্রমেই নষ্ট করা চলবেনা।
৭। সকল সম্প্রদায়কে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্থাৎ বিশ্বাসমত উপাসনা, অনুষ্ঠান, প্রচারণা, সংগঠন ও শিক্ষার স্বাধীনতা দিতে হবে।
৮। সিন্ধুকে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা করতে হবে।
৯। কোন আইন সভায় ও নির্বাচিত সংস্থায় যদি কোন সম্প্রদায়ের তিন চতুর্থাংশ প্রতিনিধি সদস্যও এই মর্মে অভিযোগ করে যে, অমুক বিল বা প্রস্তাব অথবা এর অংশ বিশেষ তাদের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হবে তবে সেই বিল বা প্রস্তাব অথবা সে সবের কোন অংশবিশেষ গ্রহণ করা চলবেনা। এ ধরনের অপরাপর সমস্যারও অনুরূপ কার্যকরী ও বাস্তব সমাধান খুঁজে নিতে হবে।
১০। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে অপরাপর প্রদেশে অনুসৃত নীতি প্রয়োগ করতে হবে।
১১। রাষ্ট্র এবং অপরাপর স্বায়ত্ত শাসিত সংস্থা সমূহের চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই অন্যান্য ভারতীয়দের সাথে মুসলমানদেরকেও পর্যাপ্ত অংশ দিতে হবে।
১২। কমপক্ষ এক তৃতীয়াংশ মুসলমান মন্ত্রী না হলে কেন্দ্রে বা প্রদেশে কোন মন্ত্রী সভা গঠিত হতে পারবেনা।
১৩। শাসনতন্ত্রে মুসলিম সংস্কৃতি সংরক্ষণ, মুসলমানদের শিক্ষা, ভাষা, ধর্ম ও নিজস্ব আইনের ও মুসলমান দাতব্য প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে পর্যাপ্ত রক্ষা কবচের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং এসব যেন রাষ্ট্র ও অপরাপর স্বায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত সাহায্য ও দানের ন্যায্য অংশ পায়, তারও ব্যবস্থা করতে হবে।
১৪। ভারতীয় ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের ঐকমত্য ব্যতিরেকে কেন্দ্রীয় আইনসভা শাসনতন্ত্রীয় কোন পরিবর্তন করতে পারবেনা।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীণ, পৃষ্ঠা ২৪৪, ২৪৫, ২৪৬।]
জিন্নাহ তাঁর বিখ্যাত এই ‘চৌদ্দদফা প্রস্তাবটি সম্মেলনে পেশ করার সময় সকলের প্রতি আবেগপূর্ণ আহবান জানিয়ে বললেন, “যদি আপনারা কোন দায়িত্ব নিতে চান, গৃহীত সিদ্ধান্তকে যদি গুরুত্ব সহকারে কার্যকরী করতে চান, মুসলিম ভারতে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে যদি আপনারা তুলে ধরতে চান তাহলে একমাত্র সববেত সিদ্ধান্তের দ্বারাই সম্ভব হবে পারে”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, সাইদ, পৃষ্ঠা ১৯৫, ১৯৬।]
জিন্নাহ মুসলিম লীগের এ সম্মেলনে কংগ্রেসভুক্ত মুসলিম নেতা যেমন মওলানা আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ আনসারী, ডাঃ সালাম, ডাঃ কিচলু, প্রমুখকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তারা এসেছিলেন। কিন্তু জিন্নাহ যে সমঝোতার মনোভাব এঁদের কাছ থেকে আশা করেছিলেন, তা পাননি। গান্ধী-নেহেরু-মালব্যরা যেমন কিছু শুনতে রাজী ছিলেননা, এঁরাও তাই। জিন্নার আবেগপূর্ণ আহবানের এরা জবাব দিয়েছিল অত্যন্ত জঘন্যভাবে। মাঝখানে কিছু সময় জিনআহ সম্মেলনে ছিলেন না, সেই সময় আমন্ত্রিত হয়ে আসা কংগ্রেসীরা মঞ্চ দখল করে কংগ্রেস নেতা ডাঃ আলমকে সভাপতির আসনে বসিয়ে বিশৃংখল এক পরিবেশে নেহেরু রিপোর্টের সমর্থনে প্রস্তাব উত্থাপন করে। কেউ একজন তা সমর্থনও করে। সভাপতির আসন থকে সেই হট্টগোলের মধ্যে ডাঃ আলম ঘোষণা করেন প্রস্তাব পাশ হয়েছে।–[‘Quid-I-Azam’, by G Allana, Page 214, 215.] এই সময়ই বাইরে থেকে শত শত লোক এসে দরজা ভেংগে হলে প্রবেশ করে এবং কংগ্রেসীদের ঝেটিয়ে বের করে দেয়। এর অল্পক্ষণ পরেই জিন্নাহ এলন। সংগে সংগে শান্ত হলো সম্মেলন। সংশোধনী সহ জিন্নার পেশকৃত চৌদ্দদফা পাশ হয়ে গেল। সংশোধনীতে বলা হলো, চৌদ্দ দফর অপরাপর দফাগুলি যদি কংগ্রেস মেনে নেয় তাহলে লীগ যুক্ত নির্বাচনে সম্মত হতে পারে।–[‘Pathway to Pakistan’, Khalikuzzaman, Page 101.] দুঃখের বিষয় জিন্নাহ যে কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করার জন্য যুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থা তাঁর চৌদ্দ দফায় রেখেছিলেন, সেই কংগ্রেসীরাই উন্মত্তের মত কাণ্ড করে বেরিয়ে গেল সম্মেলন থেকে।
কংগ্রেস মুসলমানদের এ শুভেচ্ছার প্রতি নমনীয়তার প্রতি, ঐক্য আকাঙ্ক্ষার প্রতি একবারও ফিরে চাইলনা। বরং মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক বলে বিষোদগার করল হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস একইভাবে। তারা তাদের সংখ্যাধিক্যের শক্তি দিয়ে বৃটিশকে বাধ্য করে তাদের দাবী আদায় করে নেয়ার পথে অগ্রসর হলো। মুসলমানরা কোলকাতা কনভেনশন থেকে বেরিয়ে আসার পর ঐ সম্মেলনেই কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভা নেহেরু রিপোর্ট পাশ করেছিল এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে বৃটিশ সরকার নেহেরু রিপোর্টভুক্ত দাবী সমূহ মেনে না নিলে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ব শাসন (ডোমিনিয়ন ষ্ট্যাটাস) এর পরিবর্তে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করবে।–[উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহেদ, পৃষ্ঠা ১৫২।]
কংগ্রেসের এই আলটিমেটাম শেষ হবার দুই মাস দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৯২৯ সালের ২৯শে অক্টোবর ভারতের বড়লাট লর্ড অরউইন ঘোষণা করলেন, সাইমন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী-[সাইমন কমিশনের রিপোর্ট তখনও প্রকাশিত হয়নি। রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালের জুন মাসে।] বৃটিশ সরকার ভারত ও রাজণ্যবর্গ শাসিত ভারতের সমস্ত দল ও গোষ্ঠীকে নিয়ে ভারতীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্যে এক গোল টেবিল বৈঠক আহবান করবে। এই সাথে তিনি আরও ঘোষণা করলেন যে, ১৯১৭ সালের ঘোষণা বাণীর অন্তর্নিহিত অর্থই ভারতকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসন দান করা।
মুসলিম লীগ ও অন্যান্য অনেক জাতিগোষ্ঠী গোল টেবিলের আইডিয়াকে গ্রহণ করলো। গ্রহণ করার প্রথম কারণ হলো, জিন্নাহ নিজেই ১৯২৯ সালের জুন মাসে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ডকে লেখা দীর্ঘ চিঠিতে সাইমন কমিশনের তীব্র সমালোচনা করে একটি সর্বদলীয় আলোচনা বৈঠক দাবী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “বৃটেনের কথার উপর ভারত আস্থা হারিয়েছে। ভারতের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে পাওয়া ও বৃটেনের আন্তরিকতা প্রমাণ করাই হচ্ছে সর্বপ্রথম কাজ।
—-সাইমন কমিশনের রিপোর্ট ও ভারত সরকারের মতামত পাওয়ার পরে এবং প্রস্তাবগুলোকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়ার আগে বৃটিশ সরকারের উচিত হবে ভারতের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো এবং তাদের সাথে একটা বৈঠকে বসে তাদের মতামত গ্রহণ করা। (কারণ বর্তমানে ভারতের সর্বসম্মত কোন অভিমত পাওয়া সম্ভব নয়।) —-এ বৈঠকের উদ্দেশ্য হতে হবে ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করা–.”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, সাঈদ, পৃষ্ঠা ২০১, ২০৯ (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৫১)।] গোলটেবিলের প্রস্তাব জিন্নার গ্রহণ করার দ্বিতীয় কারণ ছিল, তখন অপ্রকাশিত সাইমন কমিশন রিপোর্টের অনেকগুলো যেমন ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা, সর্বাধিক প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা, বোম্বাই থেকে সিন্ধুকে পৃথক করার প্রতি সহানুভূতি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কিছুটা শাসন সংস্কার, প্রভৃতি মুসলিম লীগের অনুকূলে এসেছিল।–[‘Report of the Indian Statutary Commission. Vol.2, Page 13-103 (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৫৩, ২৫৪)] তৃতীয় কারণ ছিল, বৃটিশ সরকারের কাছে মুসলিমদের আলাদা প্রতিনিধিত্ব এবং সর্বদলীয় আরও একটি আলোচনার সুযোগ লাভ’। এসব দিক সামনে রেখেই জিন্নাহ অরউইনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নেতৃবৃন্দের একটা ঘরোয়া বৈঠক ডাকলেন। যাতে কংগ্রেসের এম, সি চাগলা, মিসেস সরোজিনী নাইডু, হিন্দু মহাসভার এস, আর, জয়াকারের মত লোকও ছিলেন। এই বৈঠক থেকেই অরউইনের ঘোষণার প্রতি সমর্থন সূচক বিবৃতি যায়।–[Quid-I-Azam, by G Allana, Page 219.] সবাইকে জড়িত করার জিন্নাহর এই কৌশল আংশিক ফল দিয়েছিল। হিন্দুমহাসভা প্রথম গোল টেবিলেও গিয়েছিল।
কিন্তু অরউইনের ঘোষণার কংগ্রেস সন্তুষ্ট হলোনা। কারণ, কংগ্রেসের দাবী অর্থাৎ নেহেরু রিপোর্ট ঐ গোল টেবিলে গৃহীত হবে এর কোন নিশ্চয়তা বড় লাটের কথায় নেই। গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের শর্ত হিসেবে কংগ্রেস চারটি বিষয় উত্থাপন করল। এক, গোলটেবিলকে ডোমিনিয়ন ষ্ট্যাটাসের অর্থাৎ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনের সংবিধান রচনার ক্ষমতা দিতে হবে, দুই, গোলটেবিলের অধিকাংশ সদস্য হতে হবে কংগ্রেসের মনোনীত প্রতিনিধি, তিন, সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে, এবং চার, সাময়িক কালের জন্য ডোমিনিয়ন সরকারের কাঠামোর একটি সরকার গঠন করতে হবে।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১০৮।] কংগ্রেসের এই দাবীর নাম দেয়া হলো দিল্লী মেনিফেস্টো। এই দিল্লী মেনিফেস্টোর মাধ্যমে কংগ্রেস আবার এ কথাই বলল যে, ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করবে একা কংগ্রেস, আর কেউ না। এটা মেনে নিলে গোল টেবিলেরও আর প্রয়োজন হয় না।
কংগ্রেসের এই দিল্লী মেনিফেস্টো বৃটিশ সরকার গ্রহণ করল না। কংগ্রেসের আলটিমেটাম যেদিন শেষ হচ্ছে সেদিন অর্থাৎ ১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর লাহোরে কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আলটিমেটাম অনুসারে এই সম্মেলনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করা হলো। গান্ধী সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, এক, বর্তমান পরিস্থিতিতে গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের প্রয়োজন নেই, দুই, কংগ্রেসের আদর্শ হলো, ‘স্বরাজ, মানে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’, এই পূর্ণ স্বাধীনতা পাবার জন্যে সংসদ ও বিধান সভাকে বর্জন করতে হবে, তিন, সত্যাগ্রহ এবং ট্যাক্স না দেবার আন্দোলন শুরু করার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হোক।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১০৯।] গান্ধীর দাবীতে বিনা সংশোধনীতেই এই প্রস্তাবগুলো কংগ্রেস গ্রহণ করলো। এই সাথে কংগ্রেস নেহেরু রিপোর্ট বাতিল করলো।–[‘উপমহাদেমের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলশান’, ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৫২।] এর অর্থ কংগ্রেস সংখ্যাগুরু হিন্দু নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত যে স্বরাজ চায় সেই স্বরাজ আদায় করবে।
সিদ্ধান্ত অনুসারে কংগ্রেস সদস্যরা সংসদ ও বিধান সভা থেকে ইস্তফা দিল। ২৬শে জানুয়ারী (১৯৩০) কে ‘স্বাধীনতা দিবস’ ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, এদিন সবাই ‘পূর্ণ স্বরাজের’ শপথ গ্রহণ করবে।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১১০।] ঠিক হলো গান্ধীজী তার আন্দোলন শুর করার সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী ছাত্ররা স্কুল-কলেজ বর্জন করবে, উকিল কোর্টে যাবে না, আইন-আদালত বর্জন করা হবে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ধাপ হিসেবে ‘গান্ধী মদ প্রস্তুত বন্ধ করা, লবণ ট্যাক্স বাতিল করা, প্রভৃতি ১১ দফা দাবী উত্থাপন করে ঘোষণা করলেন এসব দাবী অবিলম্বে মেনে না নিলে লবণ ট্যাক্স বন্ধ করার মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলন তিনি শুরু করবেন।–[‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ পট্রভি সিভারামিয়া, পৃষ্ঠা ৩৬৩, ‘কালেকটেড ওয়ার্কস অব মহাত্মা গান্ধী’, ৪৩শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১১-৪১৬।]
১৯৩০ সালের ১২ই মার্চ দক্ষিণ ভারতের সবরমতী আশ্রম থেকে বোম্বাই এর সমুদ্রোপকুলবর্তী লবণ কেন্দ্র ডান্ডীর দিকে গান্ধীর পদব্রজে যাত্রা আরম্ভ থেকে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। ৫ই এপ্রিল গান্ধী তার লোকজন সমেত ডান্ডী পৌঁছলেন এবং লবণ আইন ভংগ করলেন। ‘ইতিমধ্যে দেশের বহু ছাত্র স্কুল বর্জন করল এবং অনেকে সরকারী চাকুরী ইস্তাফা দিলেন। চারদিকে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এ সময়ে ভারতের সর্বত্র ধর্মঘটের দিকে পা বাড়াল। চারদিকে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাও বৃদ্ধি পেল।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১১১, ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’ বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ১১১।]
সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটলো বাংলায়। চট্টগ্রামে সূর্যসেনের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হলো। শুধু অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নয়, চট্টগ্রামে বৃটিশ কর্তৃত্বকেও তারা চ্যালেঞ্জ করল। প্রকৃত পক্ষে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার যে প্রস্তাব গ্রহণ কর, চট্টগ্রামে তারই পূর্ণ বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিল সূর্যসেনরা। এ বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে, কিন্তু তার আগে গান্ধী পরিকল্পিত ও কংগ্রেস আহুত সূর্যসেনদের এ আন্দোলন সম্পর্কে মুসলিম লীগের পলিসি সম্পর্কে দু’একটা কথা বলা দরকার।
কংগ্রেসের এ আন্দোলন ছিল এককভাবে কংগ্রেসের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে। কংগ্রেসের এই দাবী হলো, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের পরিকল্পিত, নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত স্বরাজ যাতে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব থাকবেনা। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের। এ আন্দোলন ছিল মুসলিম লীগ অর্থাৎ মুসলিম স্বার্থের পাল্টা একটি আন্দোলন। এ আন্দোলনের সাফল্যের অর্থ মুসলমানদের বৃটিশের খপ্পর থেকে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের খপ্পরে পড়া। সুতরাং কংগ্রেসের এই আন্দোলনকে জিন্নাহ মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করলেন এবং আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করলেন।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৫৬, ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৫৮।] ১৯৩০ সালে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনে মওলানা মোহাম্মদ আলী মুসলমানদের কংগ্রেস হতে দূরে থাকার আহবান জানিয়ে কংগ্রেসের এই আন্দোলন সম্পর্কে আরও স্পষ্ট কথা বললেন। তিনি বললেন, “গান্ধী উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিন্দু মহাসভার পক্ষে কাজ করছেন। তাঁর যাবতীয় কার্যক্রমের লক্ষ্য হলো হিন্দু রাজত্ব স্থাপন এবং মুসলমানদের পদানত করে রাখা”।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৭৯, ‘Towards Pakistan’, ডঃ ওয়াহিদুজ্জামান, পৃষ্ঠা ৬৩।] এখানেই শেষ নয় গান্ধীর আইন অমান্য শুরু হওয়ার পর মওলানা মোহাম্মদ আলী বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডোনাল্ডকে লিখেছিলেন, “মহাত্মা গান্ধী এবং মতিলাল নেহেরু হিন্দু মহাসভার পদাংক অনুসরণ করে চলেছেন। আমি আমার ক্ষমতার যতটুকু শক্তি আছে তার সমস্ত দিয়ে আপনার সরকারকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি”।–[‘স্পীচেস এণ্ড রাইটিংস অব মোহাম্মদ আলী’, (উদ্ধৃতঃ ‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, পৃষ্ঠা ১০৮)।]
চট্টগ্রামে সূর্যসেনের আন্দোলন ছিল মিঃ গান্ধীর পদাংক অনুসরণে এবং গান্ধীরই আইন অমান্য আন্দোলনের একটা অংশ। সূর্যসেন ছিলেন কংগ্রেসের একজন নিষ্ঠামান কর্মী। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে মতিলাল নেহেরু জওহর লাল নেহেরুকে লিখেছিলেন, “বাংলার বিপ্লবীরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে গভীরভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন”।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৫১।] সূর্যসেন ছিলেন এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বিপ্লবীদেরই একজন। তিনি ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন পর্যন্ত যাবতীয় বিপ্লবী কার্যক্রম চট্টগ্রামের কংগ্রেস অফিসকে কেন্দ্র করেই সম্পাদিত হয়েছে। সূর্যসেন ছিলেন কংগ্রেস রাজনীতির সাথে একাত্ম। ১৯২৮ সালে কোলকাতার যে সম্মেলনে নেহেরু রিপোর্ট পাশ করা হয় এবং যে সম্মেলনে লীগ-কংগ্রেস বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয় ও জিন্নাহ অশ্রুসজল চোখে বিদায় নেন, সে সম্মেলনে সূর্যসেন ছিলেন কংগ্রেস প্রতিনিধি এবং গান্ধীপন্থী হাইলাইনারদের একজন।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্নেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ৮১।] এরপর ১৯২৯ সালে লাহোরে কংগ্রেসের যে সম্মেলনে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে কংগ্রেস এককভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা ও আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে, সে সম্মেলনেও সূর্যসেন চট্টগ্রাম থেকে কংগ্রেসের প্রতিনিধি ছিলেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মতে এই সময় সূর্যসেন চট্টগ্রাম জিলা কংগ্রেসের সর্বেসর্বা ছিলেন এবং তার পছন্দমত লোক তিনি কংগ্রেসের লাহোর সম্মেলনে নিয়ে গিয়েছিলেন।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ৯০।] চরম মুসলিম বিদ্বেষী নেতা এবং হিন্দু মহাসভার দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা মদন মোহন মালব্যের সাথেও সূর্যসেনের একাত্মতার পরিচয় এ সম্মেলনকালে পাওয়া যায়। পণ্ডিত মদন মোহন মালব্যের সভাপতিত্বে একটি সর্বভারতীয় হিন্দু ছাত্র সংগঠন তৈরী করার সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ঐ সময় লাহোরে নিখিল ভারত ছাত্র কনভেনশন ডাকা হয়েছিল। সূর্যসেন এই কনভেনশনের জেন্যও প্রতিনিধি নিয়ে যান। তার কংগ্রেস প্রতিনিধিদেরও অনেকে সেখানে যোগদান করে।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ৯০।] বস্তুত সূর্যসেন মদন মোহন মালব্যের মতই কট্টর পন্থী একজন কংগ্রেস নেতা এবং কংগ্রেসের সব প্রোগ্রামই আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন করেন। ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারী তারিখকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২৯ সালের লাহেরা অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। সারা ভারতে বিভিন্ন স্থানে এই দিন কংগ্রেস রচিত ‘স্বাধীনতা দিবসের’ সংকল্প পাঠ করা হয়। —চট্টগ্রামেও কংগ্রেস সেক্রেটারী সূর্যসেন ‘স্বাধীনতা দিবসে’ কংগ্রেস পতাকা উত্তোলন ও অন্যান্য কর্মসূচ পালন করেন।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১০০।] ১৯৩০ সালের ৬ই এপ্রিল মিঃ গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেস কর্মী ও জনগণের উদ্দেশ্যে বাণী পাঠান। প্রতি গ্রামে নিষিদ্ধ লবণ তৈরি ও আমদানী শুরু করা হোক। —-ছাত্রগণ সরকারী স্কুল-কলেজ বর্জন করুন, সরকারী চাকুরেরা চাকুরী ছেড়ে দিয়ে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করুন। আমরা শিগগিরই দেখতে পাব স্বরাজ করে দ্বারে সমাগত হবে তার জন্যে অপেক্ষা না করে স্বরাজ হাতে তুলে নেওয়ার জন্যে অস্ত্রাগার লুট করার সিদ্ধান্ত নিলেন সূর্যসেন। নিজেদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে পুলিশকে বিভ্রান্ত ও নিজেদের ব্যাপারে সরকারকে নিশ্চিন্ত রাখার জন্যে ১৯৩০ সালের ১৬ই এপ্রিল একটা ইস্তাহার ছাড়লেন সূর্যসেন। পূর্ণ স্বরাজ আমাদের দ্বারে সমাগত”।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১০২।]
ইস্তাহারটি এই-
“দেশের দিকে দিকে স্বাধীনতার তূর্যধ্বনি শোনা যাইতেছে। সর্বত্র আইন অমান্যের সংগ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। ১৯২১ সালে যেই চট্টগ্রাম ছিল সবার পুরো ভাগে আজ সেই চট্টগ্রাম পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে –ইহা ক্ষোভ ও লজ্জার বিষয়। —কলিকাতা ও অন্যান্য স্থানে লবন আইন ছাড়া অন্য আইন (যেমন রাজদ্রোহ আইন) অমান্যও আরম্ভ হইয়াছে। কালবিলম্ব না করিয়া আমরাও ২১শে এপ্রিল হইতে আইন অমান্য করিব স্থির করিয়াছি। ইহার জন্যে সর্বসাধানের সহানুভূতি চাই, সত্যাগ্রহী সেনা চাই। লোক ও টাকা চাই।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১০৪।]
শ্রী সূর্যসেন
সম্পাদক
চট্টগ্রাম জিলা কংগ্রেস কমিটি
সূর্যসেনরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করলেন ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল। এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কালেও সূর্যসেন ছিলেন নিখান কংগ্রেস কর্মী, এবং বন্দেমাতরমের নির্জলা সৈনিক। অস্ত্রাগারের বিরাট লোহার গেট যখন দেওয়াল থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তখন উল্লসিত বিপ্লবীদের গগণ বিদারী ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে চট্টগ্রামের নৈশ-আকাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১২১।] ‘একরকম বিনা আয়াসেই জিলার বিদেশী শক্তির শেষ প্রধান সশস্ত্র গাটি বিপ্লবীদের দখলে এসে গেল, তখন আবারও জোর গলার ধ্বনি উঠল ‘বন্দে মাতরম’ ‘স্বাধীন ভারত কি জয়’।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১২৬।] রিজার্ভ ফোর্সের শেষ প্রধান এই সশস্ত্র ঘাটি বিনা আয়াসে দখলে আসার পেছনে একটা কাহিনী আছে। এই ঘাটি দখলের জন্যে ‘বিপ্লবীরা যখন পাহাড়ের গা বেয়ে উপর দিকে উঠছেন, তখন তাঁরা ধ্বনি দিতে থাকেন ‘বিপ্লবীরা যখন পাহাড়ের গা বেয়ে উপর দিকে উঠছেন, তখন তাঁরা ধ্বনি দিতে থাকেন ‘গান্ধীরাজ হো গিয়া, ভাগো’। তাদের বক্তব্যকে আকাশের দিকে গুলীর আওয়াজ দিয়ে তারা সঠিক ভাবে বুঝাবারও চেষ্টা করছিল। ফলে সশস্ত্র পুলিশের মধ্যে বিভ্রান্তি।–[তখনকার রিজার্ভ ফোর্সে হিন্দী-উর্দুভাষী লোকই ছিল বেশী।] সৃষ্টি হয় এবং রিজার্ভ ফোর্সের সিপাহী ব্যারাকের বিপরীত দিক থেকে পালাতে শুরু করে।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১২৬।] সূর্যসেনদের এই ‘গান্ধীরাজ’ ছিল মূলত পণ্ডিত মদন মালব্যদের ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সূর্যসেনের বিপ্লবী সৈনিকরা ছিল গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহী সেনা’, আনন্দ মঠের ‘বন্দে মাতরম’ মুখরিত ‘সন্তান সেনা’। এই কারণেই সূর্যসেনের বাহিনীতে কোন মুসলমান ছিল না। যারা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছিল, যারা জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে সূর্যসেনের সাথী ছিল, তাদের মধ্যে একজন মুসলমানও ছিলনা।–[জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে সূর্যসেনের সাথীদের পূর্ণ তালিকা (উল্লেখ্য, এই যুদ্ধে সূর্যসেন তার গোটা বাহিনীকেই ব্যবহার করেন):- সর্বাধিনায়ক সূর্যসেন, নির্মল সেন, আম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত লালাসিং, লোকনাথ বাল, উপেন ভট্টাচার্জ, মধুদত্ত, নরেশ রায়, বিষু ভট্ট্রাচার্য, লাল মোহন সেন, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হিমাংগু সেন, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, নির্মল লালা, দেশ প্রসাদ গুপ্ত, আনন্দ গুপ্ত, মনীন্দ্র গুহ, সহায়রাম দাস, প্রভাস বল, ফনীন্দ্র নন্দী, রজত সেন, ত্রিপুরা সেন, দ্বিজেন্দ্র দস্তিদার, বিধু সেন, মনোরঞ্জন সেন, কালিপদ চক্রবর্তী, শশাংক দত্ত, নারায়ন সেন, স্বদেশ রায়, সৌরিন্দ্র দত্ত চৌধুরী, নিতাই ঘোষ, সুধাংশ বোস রায়, বনবিহারী দত্ত, ফাতীর সেন, শান্তি নাগ, সরোজ গুহ, ভবতোষ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, কালি কিংকর দে, ক্ষিরোদ ব্যানার্জী, সীতারাম বিশ্বাস, ধীরেন দে, অশ্বিনী চৌধুরী, ‘নিরঞ্জন রায়, শংকর, ননীদেব এবং কৃষ্ণ চৌধুরী। (‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, পুর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৫২)] পাহাড়তলী অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় বিপ্লবীরা লালদিঘী ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একজন মুসলিম ড্রাইভারকে জোর করে পাহাড়তলী নিয়ে গিয়েছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম ছিল আহমদ। লুণ্ঠন কাজ শেষে ড্রাইভারের চোখে মুখে এসিড ঢেলে তাকে বিকৃত ও বিকলাঙ্গ করে দেয়া হয়েছিল। ড্রাইভারের বক্তব্য অনুযায়ী সে যেহেতু মুসলমান ছিল এবং লুণ্ঠনকারীদের চিনিয়ে দিতে পারত, এ কারণেই তার চোখে-মুখে এসিড ঢালা হয়েছিল।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৪৪ (দ্রষ্টব্যঃ চট্টগ্রামের সাইফউদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী বার-এট-ল, লিখিত ‘সাম্প্রদায়িক দুষ্ট সন্ত্রাসবাদী সূর্যসেন’ প্রবন্ধ)] আসলে সূর্যসেনের আন্দোলনটাই এমন ছিল যে, তাতে কোন মুসলমান শামিল হওয়া সম্ভব ছিল না। সূর্যসেনের সহযোগী শ্রীমতি কুন্দপ্রভা সেন তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন যে, দেশ সেবা শিক্ষা নেবার উদ্দেশ্যে সূর্যসেনের সাথে দেখা করলে তিনি বললেন যে, ‘পুঁজো করতে হবে বুকের রক্ত দিয়ে’। এই পুজোর বিবরণ দিতে গিয়ে কুন্দ প্রভা লিখছেন, “আমি পিছু পিছু চললাম, কিছুদূর এগিয়ে একটা মন্দিরের কাছে দু’জনেই পৌছলাম। দরজা খোলাই ছিল। মাষ্টার দা আর আমি ভেতরে ঢুকলাম। তারপর তিনি টর্চ জ্বালালেন। দেখলাম, ভীষণ এক কালী মূর্তি। মাষ্টার দা এক হাতে লম্বা একখানা ডেগার বের করে আমার হাতে দিলেন, মায়ের সামনে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো কর। ওখানে বেল পাতা আছে। বুকের মাঝখানের চামড়া টেনে একটুখানি কাটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোটা রক্ত বের হল। তা বেল পাতায় করে মাষ্টার দার কাছে নিয়ে গেলাম। —-আমি মায়ের চরণে রক্ত আর মাথা রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম’।–[‘কারাস্মৃতি’, কুন্দ প্রভা সেনগুপ্তা (উদ্ধৃতঃ ‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, পৃষ্ঠা ১৪৩)] ভারতের বিখ্যাত কম্যুনিষ্ট নেতা মোজাফফর আহমদ যথার্থই লিখেছেন, “বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু রাজত্বের পুন প্রতিষ্ঠা”।–[‘আমার জীবন ও ভারতে কম্যুনিষ্ট পার্টি’, মোজাফফর আহমদ।] গান্ধীর অসহযোগ, স্বরাজ্য, আইন অমান্য আন্দোলন প্রভৃতি সবই ছিল এই হিন্দুরাজত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই কারণেই বাংলার জননেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে গান্ধী, সূর্যসেনদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ১৭ দিন পর গান্ধী গ্রেপ্তার হলে এই বিষয়ের উপর এক আলোচনায় শেরে বাংলা বলেন, “ভারতের ৭ কোটি মুসলমানের ৭০ জনও কংগ্রেসের সমর্থক নয়। মিঃ গান্ধী যে রকম গণ্ডগোল সৃষ্টি করেছেন তাতে তাঁকে গ্রেফতার করে রাখার জন্যে আমি ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি”।–[১৯৩০ সালের মে মাসে কোলকাতা কর্পোরেশনের এক সভায় গান্ধীর গ্রেফতারকে নিন্দা করার জন্যে আনীত এক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় শেরে বাংলা একথা বলেন। (উদ্ধৃতঃ ভারত কি করে স্বাধীন হলো, পৃষ্ঠা ১০৯)।]
আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, সূর্যসেনরা তাদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দায়, মুসলমানদের উপর চাপাতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে সুন্দর একটি তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী ও সংগ্রামী পরিবারের সন্তান ব্যারিষ্টার স, এ, সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, “বিপ্লবী সর্বাধিনায়ক শ্রী সূর্যসেনের অধিনায়কত্বে তারই পরিকল্পনা ও পরিচালনায় সম্পন্ন হলো চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। এই বিপ্লবী প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও একটি ঘটনা, বলা যায় উপঘটনা। কোন ইতিহাসে সে উপ-ঘটনার কথা লেখা না হলেও আজও চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষের মুখে তা জলজ্যান্ত সত্য হয়ে আছে। ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসেই অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে সাড়া জাগানো মুসলিম কনফারেন্স। ঐ কনফারেন্সের আকর্ষন বৃদ্ধির জন্যে তাতে যোগ দিয়েছিলেন এই উপমহাদেশের চিরস্মরণীয় মল্লবীর গামা। মুসলিম কনফারেন্সের কর্মীদের মাথায় ছিল তুর্কি টুপি, গায়ে বিশেষ রকমের ব্যাজ। সম্মেলনের পরপরই আরম্ভ হলো বিপ্লবীদের অভিযান। অভিযান শেষে বিপ্লবীদের পালাবার পথে দেখা গেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুসলিম কনফারেন্স কর্মীদের অনুরূপ তুর্কী টুপি ও বিশেষ ধরনের ব্যাজ। তাতে সহজেই অনুমান হতে পারে, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রভৃতি বেআইনী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ঐ কনফারেন্স কর্মীরা। সরকারের কাছেও তাই মনে হয়েছিল। —কিন্তু যার কর্মতৎপরতায় ব্যর্থ হয়ে যায় বিপ্লবীদের অনিষ্টকারী এই সাম্প্রদায়িক পরিকল্পনা, তিনি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার খান বাহাদুর মোমিন সাহেব। তাঁরই তদন্তে উৎঘাটিত হয় সত্যিকার ঘটনা। বেঁচে যায় মুসলিম কনফারেন্সের কর্মীবৃন্দ”।–[‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, ১৭৫৭-১৯৪৭’, এস, এ, সিদ্দিকী বার-এট-ল, পৃষ্ঠা ১১১, ১১২।] এই ঘটনা প্রমাণ করে মুসলমানরা ছিল সূর্যসেনের আন্দোলনের প্রতিপক্ষ। গান্ধী তথ্যকংগ্রেসের আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে তখন মুসলিম লীগ তথা মুসলমানদের চরম প্রতিপক্ষ হিসেবেই তৎপরত ছিল। সূর্যসেনের আন্দোলন কংগ্রেসেরই আন্দোলন, তাই ঐ ঘটনায় বিস্ময় বোধ করার কিছু নেই। আইন অমান্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জওহরলাল নেহেরু গ্রেপ্তার হলেন ১৪ই এপ্রিল, আর গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা হলো মে মাসে। আইন অমান্য আন্দোলন চলতেই থাকলো। বন্দীদের মুক্তি দিতে চাইলেন ভারত সরকার, কিন্তু কংগ্রেসের অন্য সব দাবী মেনে নিতে অপারগতা জ্ঞানপ করলেন। একসঙ্গে সবগুলো দাবী পুরণের দাবীতে অটল রইল কংগ্রেস। এর মধ্যেই প্রথম গোলটেবিল বৈঠক শুরু হলো ১৯৩০ সালের ১২ই নভেম্বর। মোট ৮৯ জন প্রতিনিধি ছিলেন ১৬ জন এবং ১৬ জন ছিলেন ভারতের দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধি। অবশিষ্ট ৫৭ জন ছিলেন কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য দল যেমন মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, হরিজন, প্রভৃতির প্রতিনিধি। গোলটেবিলে মুসলিম প্রতিনিধি ছিলেন জিন্নাহ, আগা খান, স্যার মুহাম্মদ শফী, মওলানা মুহাম্মদ আলী, এ, কে, ফজলুল হক প্রমুখ। কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে হিন্দুদের মধ্যে প্রধান ছিলেন স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু, শ্রী নিবাস শাস্ত্রী, রামস্বামী আয়ার, জয়াকর, চিমনলাল সিতলাবাদ, রামস্বামী মুদালিয়ার প্রমুখ। গোলটেবিলের সামনে বিবেচ্য বিষয় ছিল সাইমন কমিশনের রিপোর্ট। উদ্বোধনী ভাষণে জিন্নাহ ভাবী শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করে বলেন, “ভারতের পরিস্থিতি এমন যে, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি শিখ, কি খৃষ্টান বা পারসিক, কি বঞ্চিত শ্রেণী, কি বণিক অথবা ব্যবসায়ী সমাজ-ভারতের প্রত্যেকেই আজ জোর দাবী জানাচ্ছে, ভারতকে পূর্ণ রূপেই স্বায়ত্ত্ব শাসন দিতে হবে।—-আমার বক্তব্য হলো গোটা বেঠকের আলাপ আলোচনার একটা বিষয়কেই মৌলিক নীতি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। তা হলো, ভারতবাসী ভারতের মালিকানা চায়। আপনারা যে শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন, অথচ আইন সভার নিকট দায়ী কোন ক্যাবিনেটের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব হস্তান্তরিত করা হবে না, এ আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না। —স্বায়ত্ত্ব শাসন জিনিসটা অবাস্তব কিছু নয়। সরকারের দায়িত্ব যদি এমন কোন ক্যাবিনেটের উপর অর্পিত হয় যা আইন সভার নিকট দায়ী, তবে প্রথেমেই যে বিষয়টার প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলো, বিভিন্ন স্বার্থ সংরক্ষিত রইলো কিনা। ভারতে যে সব সম্প্রদায় রয়েছে তাদের স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুণ্ন করে আপনার কোন শাসনতন্ত্রই তৈরী করতে পারেন না। প্রথমেই আসে সংখ্যালঘু সমস্যার কথা। এই সমস্যার মোকাবিল করতে হবে। সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেই তারা রাষ্ট্রীয় কাজে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করতে ও আনুগত্য দেখাতে পারে। তা যদি না পারেন, তাহলে যত শাসনতন্ত্রই তৈরী করুন না কেন, তা সফল ও কার্যকরী হবে না”।–[‘Speeches and statement of Quaid-I-Azam’, রফিক আফজাল, পৃষ্ঠা ৩১৩, ৩১৭।] শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক বলেছিলেন, “আমাদের সমাজের যে অবস্থা এবং এর চাহিদার যে বৈচিত্র রয়েছে, তাতে একটা মাত্র পন্থাই খোলা রয়েছে বলে আমি মনে করি। —পুরাতন দাবী উত্থাপন করেই আমাদের বলতে হচ্ছে যে, ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে পর্যাপ্ত রক্ষা কবচের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক পর্যায়ে কোন সরকারের অগ্রগতি সম্ভব ও কার্যকরী হবে না। এ রকম রক্ষা কবচ ছাড়া কোন শাসনতন্ত্রই মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না”।–[‘Indian Round Table Conference Proceedings’, Page 246.] হিন্দু নেতৃবৃন্দও বক্তৃতা করলেন। কংগ্রেস গোলটেবিলে আসেনি। কিন্তু হিন্দু মহাসভার এবং অন্যান্য নেতারা যে বক্তৃতা করলেন তাতে মুসলমানদের কোন কথা তাঁরা বুঝেছেন বলে মনে হলো না। মুসলমানদের অন্যান্য দাবী মানা দূরের কথা ফেডারেল রাষ্ট্র পদ্ধতির মত সাধারণ দাবীও তারা মেনে নিতে রাজী হলো না। আগা খান এ সম্পর্কে লিখেছেন, “আমি তাদেরকে বিশেষভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। এককেন্দ্রীক ভারতের কথা চিন্তা না করে তারা যদি ফেডারেশনের নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে তার ফল ভালই হবে এবং গোটা দেশের জন্যে বিরাট ও ত্বরিত পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। এ ব্যাপারে আমরা যে নিশ্চয়তা চাচ্ছিলাম, তা হলো- সত্যিকার একটি শাসনতন্ত্র: যেখানে পাঞ্জাব ও বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে শাসনতান্ত্রিক প্যাঁচ খাটিয়ে সংখ্যালঘু করা চলবেনা, সিন্ধুকে বোম্বাই থেকে আলাদা করে নিয়ে তাকে একটা স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শাসনতান্ত্রিক সরকারের নীতি চালু করা এবং সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্ভিসের চাকুরী প্রদানের বিষয়ে মুসলমানদের জন্যে সুনির্দিষ্ট ভাবে শাসনতান্ত্রিক নিশ্চয়তা”।–[‘Recollection and Reflection’, চিমনলাল সিতলাবাদ, পৃষ্ঠা ৩৫৮ (উদ্ধৃত ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৬১)।]
১২ই নভেম্বর ১৯৩০ থেকে ১৯শে জানুয়ারী ১৯৩১ পর্যন্ত গোলটেবিলের দীর্ঘ আলোচনা এবং বিভিন্ন সাব কমিটিতে বিবিধ বিষয়ে নানা আলোচনার পর স্থির হয়, (১) বৃটিশ ইন্ডিয়া ও যোগদানেচ্ছু রাজ্যসমূহের সমন্বয়ে একটি ফেডারেল সরকার গঠন করা হবে, (২) প্রদেশ সমূহ থেকে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা তুলে দেয়া হবে, (৩) বোম্বাই থেকে সিন্ধুকে পৃথক করার প্রস্তাব নীতিগতভাবে স্বীকৃত হয়, কিন্তু এর আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনার জন্যে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়, (৪) উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে গভর্ণরের প্রদেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সকল বিষয়ে মোটামুটি মতৈক্য হওয়া সত্ত্বেও রেসিডিউয়ারী ক্ষমতা ফেডারেল সরকারের অথবা প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত হবে, তা সাব্যস্ত হয়নি এবং সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু সমস্যারও কোন সমাধান হয়নি”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৬৬।] অথচ ভাবী শাসনতন্ত্রের জন্য এ দু’টিই ছিল প্রধান বিষয়। এদিক থেকৈ আগা খানের কথায় বলা যেতে পারে, প্রথম গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়েছিল”।
এই ব্যর্থতা সম্পর্কে বোম্বাই ক্রনিকল-এর বিশেষ সংবাদদাতা লিখেন, “আমি বুঝলাম যে, সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে যদি আলাদা করে দেখা হয়, তাহলে মুসলমানরা যুক্ত নির্বাচন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব মেনে নেবে। অপরাপর যেসব সাম্প্রতিক দাবী ছিল, মাননীয় আগা খান ও মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে মুসলমানরা সেসব বিষয়ে তেমন কিছু জোর দিচ্ছিল না। সম্মেলনে মুসলমানদের উপরোক্ত শর্তাবলী গৃহীত হলে তারা ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাসের দাবীতেই ঐক্যবদ্ধ হতে চেয়েছিল। মহাসভাপন্থীরা বাদে অপরাপর হিন্দুরা এ বিষয়ে রাজী ছিল। এ বিষয়ে জয়াকরের অভিমত দুঃখজনকভাবেই ঐক্যবদ্ধ ভারতের বিপক্ষে ছিল”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, এম, এইচ, সাঈদ, পৃষ্ঠা ২১৪, ২১৫।]
প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের বিদায়ী ভাষণে (১৯শে জানুয়ারী, ১৯৩১) বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড আশা প্রকাশ করলেন, কংগ্রেস পরবর্তী বৈঠকে যোগ দেবে। স্বাভাবিক ভাবে ভাইসরয় লর্ড অরউইন কংগ্রেসের প্রতি নরম হলেন। ১৯৩১ সালের ২৫শে জানুয়ারী তিনি গান্ধী ও কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মুক্তি দিলেন। মুক্তি লাভের পর গান্ধী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্যে কয়েকটি শর্ত আরোপ করলেন। যেমন, অবশিষ্ট রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া, দমন নীতি বন্ধ করা, ছাটাইকৃত কর্মচারীদের পুনর্বহাল করা, সরকারের একচেটিয়া লবন ব্যবসায় বন্ধ করা, পুলিশ অত্যাচারের তদন্ত করা ইত্যাদি। এ শর্তগুলোর মধ্যে প্রথম গোলটেবিলে যোগদানের জন্যে যে সব শর্ত দিয়েছিল, তার নামগন্ধ নেই অর্থাৎ গান্ধী তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। গান্ধীর সাথে ভাইসরয় লর্ড অরউইনের বার ছয়েক বৈঠক হলো। ফল হিসেবে সম্পাদিত হলো ‘গান্ধী অরউইন প্যাক্ট’ এবং গান্ধী রাজী হলেন গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে। এ প্যাক্ট অনুসারে গান্ধী অর্থাৎ কংগ্রেসকে যা ছাড়তে হলো এবং সে যা লাভ করল তার যোগফল হলো জিরো। বৃথাই গেল গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন। এ চুক্তি কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির সদস্যদের বিশেষ করে নেহেরুকে নিরাশ করল। তিনি বললেন —এ চুক্তি আমাদের আন্দোলনকে দুর্বল করবে”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১১৪।] তাছাড়া গান্ধী অরউইন বৈঠকে গান্ধী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের পক্ষে কোন জাতীয়তাবাদী (কংগ্রেস পন্থী) মুসলমানকে প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবী পরিত্যাগ করেন এবং একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৮০] পরে গান্ধী ডাঃ আনসারীকে গোলটেবিলে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে বৃটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন, কিন্তু সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বৃটিশ সরকার। অথচ ডাঃ আনসারী তখন কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি। এটা ছিল কংগ্রেসের বিরাট পরাজয় এবং মুসলিম রাজনীতির বিজয়।
লণ্ডনে যখন প্রথম গোলটেবিল চলছিল, তখন ১৯৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর এলাহাবাদে মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলন কবি আল্লামা ইকবাল। এই সম্মেলনটি একটি ঐতিহাসিক মূল্য রাখে। কারণ এই অধিবেশনেই ইকবাল তার ‘দুই জাতি’ মতবাদটি ব্যক্ত করলেন। এই দুই জাতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইকবাল ‘পাকিস্তান’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি বটে, তবে তিনি বললেন যে, ‘মুসলিমদের জন্যে ভারতের মধ্যে এক মুসলিম ভারত গঠন করতে হবে।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১১২।] আল্লামা ইকবালের এই বক্তব্য ছিল উদ্ভুত বাস্তবতার একটি সকণ্ঠ উচ্চারণ। বিশ শতকের এই সময় থেকে বিভিন্ন সময় থেকে বিভিন্ন জনের লেখনি, গান ও চিন্তায় মুসলিম স্বাজাত্যবোধ ও আত্মচেতনা নতুন এক অবয়ব নিয়ে বিকশিত হতে থাকে।
প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের পর ১৯৩১ সালের মার্চে নিখিল ভারত মুসলিম কনফারেন্সের কার্যকরী কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর বৈঠক ঘোষণা করল, “সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্পর্কে গোলটেবিল বৈঠকে হিন্দু প্রতিনিধিতের মতের প্রেক্ষিতে মুসলমানরা দাবী করছে যে, হিন্দু মুসলিম সমস্যা সমাধানের পূর্বে ভারতের শাসনতন্ত্র তৈরী করলে মুসলমানরা তা গ্রহণ করবে না এবং গোলটেবিল বৈঠকে যে ফেডারেল কাঠামো তৈরীর ব্যবস্থা হয়েছে তারও সংশোধন প্রয়োজন”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৭০] এ সময়ে জিন্নার একটি উক্তিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক বসে ১৯৩১ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। বৈঠকের আগে তিনি লণ্ডন থেকে বোম্বাই এসেছিলেন। বোম্বাইয়ে তিনি বললে, “মুসলমানরা যদি সংগঠিত না হয়, তাহলে তাদের মুক্তি নেই। কোন সরকার কখনও সংখ্যালঘুদের চিরকাল দাবিয়ে রাখতে পারে না।—-আপনাদের খোলাখুলি বলতে চাই যে, হিন্দুরা নির্বোধ, তাদের বর্তমান আচরণও অত্যন্ত বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক। হিন্দুদের অধিকাংশের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনারা হয়তো জানেন যে, আমি জানি। —-পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দুরা মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দিতে রাজি নয়। —হিন্দুরা উত্তমরূপে জানে যে, এই প্রদেশ দু’টিতে মুসলমানদের ভোটার সংখ্যা মাত্র চল্লিশজন (কারণ ভোটার লিস্ট হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণেই তৈরী)’।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৭১।]
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শুরু হলো ১৯৩১ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। চললো ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বৈঠকের চেয়ারম্যান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড বৈঠকের শুরুতেই বললেন, “যদি ভারতীয় প্রতিনিধিগণ সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে অক্ষম হন, তাহলে সকলে সম্মত হলে তিনি এর শালিশী করবেন”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৭২।] সম্মতি দিল সকলে। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে জিন্নাহ ও অন্যদের সাথে আল্লামা ইকবালও যোগ দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানই ছিল সবচেয়ে মৌলিক ও প্রধান বিষয়। সুতরাং গোলটেবিলের বাইরে ঘরোয়া আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার উদ্যোগ নিলেন আগা খান। লণ্ডনের রিজ হোটেলে আগা খানের কক্ষে এই আলোচনার ব্যবস্থা হলো। একটা আপোশ রফায় পৌঁছার জন্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এই আলোচনা সম্পর্কে আগা খান তার স্মৃতি কথা লিখেনঃ
“আমরা প্রেস ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলার জন্য দাঁড়ালাম। তারপর আলোচনার জন্যে বসলাম। আলোচনার সূত্রপাত করে আমি মহাত্মাজীকে বললাম, ‘তিনি যদি মুসলমানদের সত্যিকার পিতার স্থান গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে তারা আজাদী অর্জনের জন্যে তাকে যথাসাধ্য সহায়তা করে যাবে’। মহাত্মাজী আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, মুসলমানদের জন্যে কোন পিতৃসুলভতা আমি অনুভব করিনা। তবে রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার কথা যদি বলেন, তাহলে সহযোগিতার মনোভাব নিয়েই আমি আলাপ আলোচনা করতে প্রস্তুত আছি। আমি কোন ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিতে পারি না’। প্রাথমিক আলোচনায় বেশি কিছু অগ্রগতি হলোনা। পরে অধিক রাত্রিতে রিজ হোটেলে আমার কামরায় আরো কয়েক দফা আলোচনা হয়। সেখানে আমিই ছিলাম মেজবান। আলোচনার এক দিকে ছিলেন মিঃ জিন্নাহ ও স্যার মুহাম্মদ শফী, অন্যদিকে ছিলেন মহাত্ম গান্ধী ও অন্যরা। —এটা কোন আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল না। আলোচনা পুরা দায়িত্ব মিঃ জিন্নাহ ও স্যার মুহাম্মদ শফীর উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
কয়েকটি বিশেস বিষয়কে কেন্দ্র কেই আলোচনা আবর্তিত হচ্ছিল। যেমন, ভারতে এক জাতি রয়েছে, না দুই জাতি? ইসলাম কি কেবল সংখ্যালঘুদের অথবা যে সব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে তারা বিশেষ রাজনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ব লাভের হকদার? কংগ্রেসের মনোভাব ছিল অনেকটা তত্ত্বগত ও অবাস্তব। তারা তাদের একজাতিত্বে অনড় রইল অথচ আমরা জানতাম ইতিহাস তা সমর্থন করে না। —-
মহাত্মা আমাদের উপর একটা প্রধান ও মৌলিক শর্ত চাপাতে চাচ্ছিলেন। তা হলঃ কংগ্রেস যেভাবে স্বরাজ-স্বায়ত্ত শাসনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে, কোন রকম নিশ্চয়তা দানের আগে মুসলমানদেরকে সেটাই লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এতে মিঃ জিন্নাহ যে জওয়াব দিয়েছিলেন তা-ই ছির সঠিক। তিনি বলেছিলেন, “রাউন্ডটেবিলে অপরাপর যে হিন্দু প্রতিনিধিরা এসেছেন, তাঁদের উপর এই শর্ত না চাপিয়ে কেন শুধু মুসলমানদের উপরেই এটা চাপাতে চান? বিষয়টা আলোচনায় বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল।
আমাদেরকে দলে ভেড়াবার গুরুত্ব মহাত্মা বুঝতে পেরেছিলেন, কে জানে? হয়তো তিনি আমাদের মতামত গ্রহণযোগ্য বলেই বুঝতে পারতেন, কিন্তু পণ্ডিত মালব্য ও হিন্দু মহাসভাপন্থীরা তাঁর উপর দারুণ চাপের সৃষ্টি করেছিল”।–[‘Memories’, আগা খান, পৃষ্ঠা ২২৭-২৩১। (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন ২৭২-২৭৩)।]
এই শেষ কথাটির প্রতিধ্বনি করেছেন লর্ড জেটল্যাণ্ডও। তিনি গোলটেবিল বৈঠকে অন্যতম ইংরেজ সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, “সম্ভবতঃ তিনি (গান্ধী) তাদের (মুসলমানদের) সঙ্গে সুযোগ সুবিধার খাতিরে একমত হতেন। কিন্তু তাঁর পাশেই ছিলেন হিন্দু মহাসভার অনমনীয় নেতা পণ্ডিত দমন মোহন মালব্য। দুর্বলতার কোন চিহ্ন দেখলেই তিনি তাঁকে সতর্ক করে দিতেন। বর্ণ হিন্দুদের পুরাতন ঐতিহ্য সংরক্ষক এই উগ্র নেতার উপস্থিতিতে গান্ধী কর্তৃক মুসলমানদের মত গ্রহণের কোন সম্ভাবনা ছিলনা”।–[‘ইস্ট এশিয়া এসোসিয়েশন’, এর সভায় লর্ড জেটল্যাণ্ড-এর বক্তৃতা। (The Asiatic Review, London), Vol-xxvii, 1932. ৩৭৪ পৃষ্ঠা, উদ্ধৃত Muslim Separatism, by A. Hamid. পৃষ্ঠা ২২১)]
গান্ধীর উপর হিন্দু মহাসভার প্রভাব ছিল। কারণ চিন্তার দিক দিয়ে হিন্দু মহাসভার সাথে তাঁর কোন পার্থক্য ছিলনা। গান্ধী বাইরে যে উদারতার ভান করতেন সেটা সংখ্যালঘুদের ঠকাবার জন্যেই। তিনি হরিজন দরদী সেজে এবং এক অনশন করে অচ্ছুত হরিজনদের নেতা ডঃ আম্বেদকরকে ‘পুনা প্যাক্ট এ রাজি করিয়ে ভারতের কোটি কোটি হরিজন-অচ্ছুতদের ভবিষ্যত চিরতরে মুছে দিয়েছেন। সেটাই তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু পারেননি। চেষ্টার কিন্তু কোন ত্রুটি ছিলনা। একারণেই কোন যুক্তির ধার তিনি ধারেননি, একগুয়েমী তিনি ছাড়েননি।
ভারতীয়দের প্রধান দু’টি পক্ষ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে আপোষ রফা সম্ভব হলোনা। তখন ভারতে অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ দল সমূহের (যেমন অস্পৃশ্য বা হরিজন, এ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ভারতীয় খৃষ্টানদের একাংশ, ইউরোপীয় বনিক সমিতি) প্রতিনিধিগণ ও মুসলমান প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছল। এরা স্বতন্ত্র নির্বাচন সমর্থন করল এবং দাবী করল যে, তারা বৃটিশ ভারতের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৬ ভাগ। লণ্ডনে সংখ্যালঘু কমিটির দশম অধিবেশনে আগা খান সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব পেশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ গান্ধী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেনএবং দাবী করলেন যে, কংগ্রেস গোটা ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার ৮৫ বা ৯৫ ভাগের প্রতিনিধি।–[Indian Round Table Conference Second Session Proceedings, Appendi iii, ৫৫০-৫৫৫, ৫৩৭, ৫৯৩ পৃষ্ঠা। (উদ্ধৃত: ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৮০)]
কোন ভাল ফল ছাড়াই নিছক আলাপ আলোচনা ও তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হয়ে গেল ১৯৩১সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখে। এ গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হবার পর গান্ধী নতুন একটা প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি তার এ প্রস্তাবে বললেন যে, হিন্দু মুসলিম সমঝোতার প্রশ্নটি এখন মুলতুবি রাখা হোক এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৭৮।] হিন্দু সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এই মত পোষণ করছিলেন। কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, প্রভৃতি হিন্দু প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবীই ছিল যে, ‘ভারত স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দু মুসলিম সস্যার সমাধান করা যাবে”।–[‘কায়েদে আযম, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৭৯।] মিঃ জিন্নাহ গান্ধীর এ প্রস্তাবের জবাবে বললেন, “এ সম্পর্কে (হিন্দু মুসলিম সমঝোতার প্রশ্ন) কিছু কতা উঠেছে, তা আমি ভাল করেই জানি। বলা হচ্ছে, এ সমস্যার দিকে মন দিয়ে কাজ নেই, চলুন আমরা অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু আমি বৃটিশ প্রতিনিধিদের যা বলেছি, এখানে বাবুদেরকেও তাই বলছিঃ ভারতীয় মুসলিম প্রতিনিধি তথা মুসলমানদের মনে সত্যি সত্যি বিশেষ ক্ষোভ রয়ে গেছে। অন্য সব কিছুই যখন আপনারা পুরোপুরিভাবে সমাধান করতে চান এবং প্রস্তুতিও এখন সম্পূর্ণ হয়ে আছে, তখন সাম্প্রদায়িক সমস্যারও সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এটা এমন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যে, আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার আগেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের সামনে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরী সিদ্ধান্ত। এই পন্থাটা আমরা বেছে নিয়েছি এই কারণে যে, এই পন্থাটা বেছে নিতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে”।–[‘Speeches and Statements of Quid-I-Azam’, রফিক আফজাল, পৃষ্ঠা ৪০৮।] কায়েদে আযমের এ কথা ছিল মুসলিম জনমতের প্রতিধ্বনি। মুসলমানদের দাবী ছিল, আগে হিন্দু মুসলিম সমস্যার সমাধান করতে হবে। কারণ পরে হিন্দু মুসলিম সমস্যার কথা বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে তলিয়ে যাবে। চিরাচরিত ভাবে তখন বলা হবে, হিন্দু মুসলিম সমস্যা একটা সমস্যাই নয় বরং এই অজুহাতে ওটা চাপা দেওয়া হবে। উপরন্তু প্রতিনিধিত্বশীল পদ্ধতির সরকারের কাছে সংখ্যাই হলো প্রধান কথা এবং এদিক দিয়ে মুসলমানরা দুর্বল।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ২৭৯।] গোলটেবিলে চাপ দিয়ে কিছু আদায় করতে গান্ধী যখন ব্যর্থ হলেন, তখন আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি ফিরে গেলেন আবার। ১৯৩২ সালের ৪ঠা জানুয়ারী গান্ধী ও কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের গ্রেফতার করা হলো। তাদের গ্রেফতারের পর ধীরে ধীরে আন্দোলন আর থাকলো না। ‘প্রথম চার মাস আন্দোলন খুব জোরে চলেছিল, তারপর এপ্রিল মাসে আন্দোলনে ভাটা পড়ে”।–[‘Mahatma Gandhi’, by B.R. Nanda, Page 180.] এইভাবে আন্দোলন দিয়ে বৃটিশকে বাধ্য করে এক তরফা স্বার্থ-সিদ্ধির পথ গান্ধীর আরেকবার ব্যর্থ হয়ে গেল।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের শেষে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড এক ঘোষণায় বলেছিলেন, “যেহেতু ভারতীয় প্রতিনিধিগণ নিজেদের মধ্যে একমত হতে পারেননি, সেহেতু বৃটিশ সরকার যথাসম্ভব ন্যায়পরায়ণতার সাথে প্রয়োজনীয় রক্ষা কবচসহ সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ১৮০।] এই ঘোষণা অনুযায়ীই ১৯৩২ সালের ১৬ই আগষ্ট বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করা হলো। এই রোয়েদাদে পৃথক নির্বাচন মেনে নেয়া হলো এবং মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে কিছু সংশোধনীসহ ‘ওয়েটেজ’-[‘ওয়েটেজ’ নীতি হলোঃ সংখ্যালঘুদেরকে তাদের জনসংখ্যার অনুপাতের চেয়ে বেশী আসন সুবিধা দেয়া।] নীতি গ্রহণ করা হলো। অনুরূপভাবে বাংলা ও আসামে ইউরোপীয়দের এবং পাঞ্জাবে শিখদের ‘ওয়েটেজ’ দেয়া হলো। সিন্ধুকে বোম্বাই থেকে আলাদা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে গভর্ণর শাসিত প্রদেশে পরিণত করা হলো। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে অচ্ছুত বা হরিজনদেরকে হিন্দুদের থেকে আলাদা সংখ্যালঘু বিবেচনা করে আলাদা আসন দেয়া হলো। সর্বশেষ এই বিধানটি অবশ্য টেকেনি। অচ্ছুতদেরকে হিন্দুদের সাথে রাখার জন্যে গান্ধী আমরণ অনশন শুরু করলে অচ্ছুত নেতা ডঃ অম্বেদকর হিন্দু নেতাদের চাপে গান্ধীর প্রাণ বাঁচাবার স্বার্থে গান্ধীর দাবী মেনে নেন এবং এই ভাবে অচ্ছুতরা আলাদা জাতি সত্তার সুযোগ হারায়। এই সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে পৃথক নির্বাচনসহ মুসলমানদের কিছু দাবি মানা হলেও আসন সংখ্যার দিক দিয়ে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫৪.৮% ভাগ। সেই অনুসারে তাদের আসন পাবার কথা ছিল ১৩৫টি, কিন্তু পেল ১১৯টি। অনুরূপভাবে পাঞ্জাবে মুসলিম জনসংখ্যা শতকরা ৫৬ জন। অথচ পেল ১৭৫টি আসনের মাত্র ৮৫টি, অর্ধেকেরও কম। বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো তাদেরকে আহত করে। আল্লামা ইকবাল বললেন, “অপরাপর সম্প্রদায়ের চাইতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষোভ অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত। বৃটিশ বিবেক কিভাবে এ বে-ইনসাফী করে যাচ্ছে, সত্যি আমি বুঝতে পারছিনা”।–[ইকবালের বিবৃতিঃ ২৪শে আগস্ট, ১৯৩২ Pakistan Movement: Historic Documents, Page 100-103] কিন্তু সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের পৃথক নির্বাচনের বিধান কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভাকেই আঘাত করেছিল বেশী, তা সত্ত্বেও কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদের অনুসারী একজন লেখক মন্তব্য করেছেন “মুসলিম লীগ সংগঠনের পক্ষ থেকে এইরূপ বাটোয়ারা প্রস্তাবে আনন্দিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু অপরাপর জাতীয়তাবাদী মুসলিম সংগঠনসমূহকে সঙ্গে লইয়া ইহার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা কংগ্রেসেরই কর্তব্য ছিল, কিন্তু সেইরূপ সক্রিয় ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। —ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদের উক্তি হইতে ইহা পরিস্কার বুঝা যায় যে, জাতীয়তাবাদী মনোভাবের অন্তরালে হিন্দু সংহতি রক্ষার চিন্তাও কিছু কিছু কংগ্রেসী নেতার মনে উদিত হয়। নতুবা ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ সাম্প্রদায়িক বাটোয়রাকে সমগ্রভাবে ভারতবর্ষে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিবার বাস্তব চিত্র উল্লেখ করিবার সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু সংহতি নষ্টের বিষয় উল্লেখ করিতেন না”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৬৩।]
সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের আন্দোলনের ইচ্ছা ছিল না তা নয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা খোদ হিন্দুদের ঘরেই আগুন দিয়েছিল। অচ্ছুত বা হরিজনরা যদি হিন্দু জাতিদেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়, তাহলে হিন্দু জাতি শুধু দুর্বল নয়, তারা ভারতে সংখ্যালঘুও হয়ে যাবে। এটা ছিল কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার জন্যে মহা সংকট। এই মহা সংকটের দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। তাই এই মহা সংকট উত্তরণের জন্যে গান্ধী সামগ্রিকবাবে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার বিরুদ্ধে নয়, শুধু অচ্ছুতদের পৃথক নির্বাচন ও আলাদা আসন বাতিলের জন্যেই আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। গান্ধী ও কংগ্রেসের এই মনোভাব থেকে এ কথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, হিন্দু জাতির স্বার্থ রক্ষাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। হিন্দু জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্যে তারা যেমন মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন সহ মুসলমানদের পৃথক জাতিসত্তা অস্বীকার করে, তেমনি হিন্দু জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্যে প্রয়োজন হলে তারা আবার এসব কথা ভুলেও যেতে পারে’। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের সময় এটাই ঘটেছিল। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের সময় এরই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখব। বস্তুত কংগ্রেস ও হিন্দুরা মুসলমানদেরকে কোন ছাড় দিয়ে হিন্দু স্বার্থ ও হিন্দু জাতিসত্তার স্থায়ী ক্ষতি করার চাইতে মুসলমানদের দূরে ঠেলে দিতে সব সময়ই রাজী হয়েছে। এর পেছনে দর্শন বোধ হয় এটাই যে, হিন্দু জাতি ঠিক থাকলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের এক সময় না এক সময় গ্রাস করা যাবেই। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় পর্যায়ে কোন আন্দোলন না হলেও মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ বাংলায় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা ফুঁসে উঠেছিল। এর কারণ বোধ হয় এটাই যে, হিন্দু জাতি ঠিক থাকলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের এক সময় না এক সময় গ্রাস করা যাবেই। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় পর্যায়ে কোন আন্দোলন না হলেও মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ বাংলায় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা ফুঁসে উঠেছিল। এর কারণ বোধ হয় এটাই যে, হিন্দুরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের শাসনে আসার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে হিন্দুদের এ অবস্থা ছিল না। অচ্ছুতদের সাথে নিয়ে হিন্দুরা সেখানে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলায় সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অর্থাৎ মুসলমানদের গরিষ্ঠতা লাভের বিরুদ্ধে শুধু হিন্দু রাজনীতিকরা নন, অরাজনৈতিক হিন্দু ব্যক্তিত্বও মাঠে নামলেন। এ সম্পর্কে মরহুম আবুল কালাম শামসুদ্দীন তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, “এ আন্দোলনে শুধু হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক নেতারাই অংশ গ্রহণ করলেন তা নয়, কংগ্রেসী নেতারাও এ ব্যাপারে কম গেলেন না। এমন কি, ব্রাহ্ম (মতাবলম্বী) রামানন্দ চট্টোপাধ্যয়কে পর্যন্ত এ সময়ে হিন্দু মহাসভার খাতায় নাম লিখিয়ে হিন্দু মহাসভার সভাপতি বনেযেতে দেখা গেল। শুধু কি তাই? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হিন্দু মহাসভা কর্তৃক আহুত কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত রোয়েদাদ বিরোধী সভায় সভাপতিত্ব করলেন এবং গুরু-গম্ভীর ভাবে রোয়েদাদে বৃটিশ সরকার কর্তৃক মুসলিম লীগের দাবীর স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা করলেন। আর মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক বল আখ্যায়িত করতেও ভুললেন না”।–[‘অতীত দিনের স্মৃতি’, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পৃষ্ঠা ১৪৩।] বাংলায় হিন্দুদের এ আন্দোলন হিন্দু-মুসলমান ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তুলল এবং মুসলমানদের কাছে কংগ্রেস মূলত এক ভীষণ প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল। মরহুম আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, “শুধু কিছু সংখ্যক শো বয় ছাড়া আর সব মুসলমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও কর্মী পুরুষ কংগ্রেসের বাইরে এলেন এবং সদলবলে মুসলিম লীগে যোগদান করলেন। জীবন্মৃত প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ নবজীবনে উজ্জীবিত হয়ে উঠল”।–[‘অতীত দিনের স্মৃতি’, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পৃষ্ঠা ১৪৩।]
বিস্ময়ের ব্যাপার, রবীন্দ্রনাথ মুসলিম বিরোধী হিন্দু স্বার্থের পক্ষের কোন আন্দোলন থেকেই কখনও পিছিয়ে থাকেননি। ১৯৮৬ সালের শিবাজী উৎসবে তিনি হাজির ছিলেন, কবিতা লিখেছেন। বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেও তিনি প্রথম কাতারের একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেখানেও তিনি হাজির, সভাপতিত্ব করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বিরোধী আন্দোলনের সাথেও তাকে দেখা গেল একাত্ম। এসব থেকে প্রমাণ হয় হিন্দু মহাসভার জাতি চিন্তা এবং রবীন্দ্রনাথের জাতি চিন্তার মধ্যে কোনই পার্থক্য ছিল না। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ভাষায়, “স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মত মনীষীও এ প্রকার উক্তি করতে দ্বিধা করেননি যে, মুসলমানরা ধর্মে ইসলামানুসারী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা ‘হিন্দু মুসলমান’। বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে এই ‘হিন্দু মুসলমান’ সৃষ্টির চেষ্টাই অব্যাহত গতিতে শুরু হয়েছিল (কলকাতা) বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে”।–[অতীত দিনের স্মৃতি’, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পৃষ্ঠা ১৫০।] এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেই ছির সোহরাওয়ার্দীর সংগ্রাম, এ.কে. ফজলুল হকের সংগ্রাম, মুসলিম লীগের সংগ্রাম, জিন্নার সংগ্রাম। সুতরাং এ সংগ্রামকে তোন রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক বলতেই পারেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের চোখে মুসলমানরা তো কোন জাতি নয়।
তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক শুরু হলো ১৯৩২ সালের ১৭ই নভেম্বর। এই বৈঠক চলেছিল মোট আটত্রিশ দিন। এ বৈঠকে জিন্নাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কংগ্রেসও এ বৈঠকে আসেনি। সরকারীভাবে গোলটেবিল না বলে বলা হয়েছে ‘জয়েন্ট পার্লামেন্টারী কমিটি’র বৈঠক। এই বৈঠকে স্বতন্ত্র সিন্ধু প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তৎকালীন ভারত সবিচ স্যার স্যামুয়েল ঘোষণা করেন যে, ভারতের প্রস্তাবিত আইন সভায় মুসলিমদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে।–[‘ইতিহাস-অভিধান’ (ভারত), যোগনাথ মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৩২।]
তিনটি গোলটেবিল আলোচনার ফল হিসেবে বৃটিশ সরকার ১৯৩৩ সালের ১৫ই মার্চ ভারতের শাসনতন্ত্রের উপর একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করলেন। শ্বেতপত্রে ভারতে একটি ফেডারেল আইন সভায় থাকবে রাজ্য সভা (উচ্চতর সভা) ও আইন সভা (নিম্নতর সভা)। রাজ্য সভার মেয়াদ হবে ৭ বছর এবং আইন সভার ৫ বছর। রাজ্য সভার ২৬০ জন সদস্যের ১৫০ জন বৃটিশ ভারত থেকে ১০০ জন দেশীয় রাজ্য থেকে এবং অবশিষ্ট ১০ জন থাকবে মনোনয়ন থেকে। বৃটিশ ভারতের ১৫০ জন সদস্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অনুসারে মুসরমানরা পাবে এই সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আসন। আইন সভার ৩৭৫ সদস্যের ২৫০ জন বৃটিশ ভারতের এবং ১২৫ জন আসবেন দেশীয় রাজ্যের শাসক হিসেবে। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অনুসারে ২৫০ জন পাবে সাধারণ হিন্দু, মুসলমান ৮২, অচ্ছুত (হিন্দু) শ্রেণী ১৯, শিখ ৬, ভারতীয় খৃষ্টান ৮, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ৪, ইউরোপীয় ৮, নারী ৯, শিল্প ও বাণিজ্য ১৪, ভূস্বামী ৭ এবং শ্রমিক ১০। কিছু আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ এবং শ্বেতপত্র দুটোকেই গ্রহণ করল। লীগ বলল, “যদিও এ সিদ্ধান্ত মুসলিম দাবীর তুলনায় অপ্রতুল, তবুও দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে মুসলমানরা এটা মেনে নিচ্ছে। তবে তাদের সমুদয় দাবী মেনে নেওয়ার জন্য চাপ তারা দিয়ে যাবেই”।–[‘Towards Pakistan’, Dr. Waniduzzaman, Page 70.] কংগ্রেস শ্বেতপত্র প্রত্যাখ্যান করল, এর দ্বারা কার্যত সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদকেও প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস এ রোয়েদাদ অনুসারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তাতে অংশগ্রহণ করল।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৩৪ সালের অক্টোবর নভেম্বরে। নির্বাচনে কংগ্রেস মোট আসন পেল ৫৫টি, সরকার পক্ষ ৫০টি এবং জিন্নার নেতৃত্বে এল ২২টি আসন। এমতাবস্থায় জিন্নার নেতৃত্বাধীন ২২টি ভোট যে দিকে যাবে তারাই জয়ী হবে।
পার্লামেণ্টের প্রথম অধিবেশন বসল ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। ১৯৩৩ সালের শ্বেতপত্রের ভিত্তিতে প্রণীত একটি রিপোর্ট জয়েন্ট পার্লামেন্টারী কমিটি বৃটিশ পার্লামেণ্টে পেশ করে। সেই রিপোর্টটিই বিবেচনার জন্যে এল এই ভারতীয় পার্লামেন্টে। ফেব্রুয়ারী অধিবেশনেই তা পেশ করা হলো। রিপোর্টের বিবেচ্য বিষয় ছিল তিনটি, (১) দেশীয় রাজ্যসমূহসহ সর্ব ভারতীয় ফেডারেশন গঠন, (২) প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন কিছু শর্তসহ এবং (৩) সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ। এ তিনটি বিষয় নিয়ে বাকযুদ্ধ শুরু হলো পার্লামেণ্টে।
রিপোর্টের তীব্র সমালোচনা করে কংগ্রেসের নেতা যে প্রস্তাব উত্থাপন করলেন তা এইঃ “সমগ্র রিপোর্ট অগ্রাহ্য করা হোক, তবে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ সম্পর্কে তার দল নিরপেক্ষ থাকবে অর্থাৎ কোন মত প্রকাশ করবে না”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৩০০।] এরপর জিন্নাহ তিনদফা সম্বলিত একটি প্রস্তাব পার্লামেণ্টে উত্থাপন করলেন। প্রস্তাবটি এইঃ
(১) সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ মাফিক ব্যবস্থাত ততদিন বলবত থাকবে যতদিন সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়সমূহ সর্বস্বীখৃত কোন পরিকল্পনা উপস্থিত করতে না পারছে।
(২) প্রাদেশিক সরকার সম্পর্কীয় ব্যবস্থা অসন্তোষকর ও নৈরাজ্যজনক। এতে বহু আপত্তিকর বিষয় আছে, যথা, দ্বিতীয় পরিষদ গঠন, গভর্নরদের বিশেস ক্ষমতা দান, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ সম্পর্কে বিশেস নিয়ম, যার দ্বারা প্রশাসক এবং আইন সভার কর্তৃক ও ক্ষমতা অকার্যকরী করা হয়েছে। সুতরাং এই সকল আপত্তিকর বিষয়গুলি বাদ না দেয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ভারতের কোন দলের সন্তুষ্টি সাধন করবে না।
(৩) ‘নিখিল ভারত ফেডারেশন’, নামে কথিত কেন্দ্রীয় সরকার সংক্রান্ত পরিকল্পনা সম্বন্ধে পরিষদের মত এই যে, “এটা মূলত মন্দ, বৃটিশ ইন্ডিয়ার জনগণের নিকট সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য এবং সেই কারণে ভারত সরকারর নিকট সোপারেশ করা হচ্ছে যে, তারা বৃটিশ সরকারকে এই অংশ সম্পর্কে বিধান তৈরী না করতে অনুরোধ করুন, এবং কেবল বৃটিশ ভারতে প্রকৃত ও সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা অবিলম্বে করুন এবং তজ্জন্য সমস্ত পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে ভারতীয় মতের (নেতৃবৃন্দের) সাথে পরামর্শ করুন”-[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৩০০, ৩০১।] মিঃ জিন্নার প্রস্তাব পেশ শেষ হবার পর কংগ্রেস দলের নেতা ভুল ভাই দেশাই জিন্নার প্রথম দফা প্রস্তাবের উপর একটা সংশোধণী পেশ করলেন। যাতে বলা হলো, ‘এই পরিষদ বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বাতিল বা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে’। ভুলা ভাই এর এ সংশোধনী সঙ্গে সঙ্গে ৪৪-৪৮ ভোটে বাতিল হলো।
প্রস্তাবের উপর অতপর আলোচনা শুরু হলো। সরকার পক্ষ ও কংগ্রেস বক্তৃতা করল। কংগ্রেসের দলনেতা ভুলা ভাই দেশাই জিন্নাহকে তীব্র আক্রমণ করে বললেন, “রাজনীতির সাথে ধর্ম ও জাতির প্রশ্ন জড়িত করা উচিত নয়”।
ভুলাভাই দেশাই এবং সরকার পক্ষের বক্তব্যের জবাব দিতে উঠে জিন্নাহ বললেন, রাজনীতির মধ্যে আনা উচিত নয়, তার এই মন্তব্যের সাথে আমিও একমত। ভাষার প্রশ্নটিও এমন কিছু নয়। এক একটা করে বিবেচনার করলে আমি তার সঙ্গে একমত। ধর্ম হচ্ছে মানুষ আর তার আল্লাহর মধ্যের ব্যাপার। তার এই কথাতেও আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু তাকে একটি বিষয় বিবেচনা করতে বলি –এটা কি একমাত্র ধর্মের সমস্যা? এটা কি শুধু ভাষার সমস্যা? নয়, স্যার, এটা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের প্রশ্ন এবং এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা। (কয়েকজন মুসলমান সদস্য-সভ্যতা ও তমদ্দুনেরও প্রশ্ন) অন্যান্য দেশে কি সংখ্যালঘু সমস্যা নেই? সেই সব দেশে তারা এই সব সমস্যার মোকাবিলা ও সমাধান করেন এবং এই সমস্যা (আমাদেরও) মোকাবিলা ও সমাধান করতে হবে। এখন সংখ্যালঘু বলতে কি বুঝায়? সংখ্যালঘু হচ্ছে কতকগুলি বিষয়ের একত্র সমাবেশের ফল । হতে পারে যে, সংখ্যালঘুদের ধর্ম অন্যদের থেকে পৃথক, তাদের জাতি হয়তো পৃথক, তাদের ভাষা হয়তো পৃথক, তাদের তমুদ্দিন হয়তো পৃথক। এই সবগুলোর –ধর্ম, তমদ্দুন, জাতি, ভাষা, কথা, সঙ্গীত, ইত্যাদির –সমন্বয়ে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের একটা স্বতন্ত্র সত্তা দিয়ে থাকে এবং সেই স্বাতন্ত্র সত্তা রক্ষাকবচ চায় সত্তা হিসেবে। নিশ্চয়ই এই সমস্যাকে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা রূপে মোকাবিলা করতে হবে। এড়িয়ে না গিয়ে অবশ্যই এর সমাধান করতে হবে”।–[Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, I. Shah Muhammad Ashraf, Lahore.]
এরপর জিন্নাহ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ সম্পর্কিত হিন্দু সদস্যদের আপত্তির জবাব দিতে গিয়ে বললেন, “আমাদের হিন্দু বন্ধুরা হয়তো সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে সন্তুষ্ট নন। আমি এই পরিষদকে বলছি যে, আমার মুসলিম বন্ধুরাও এতে সন্তুষ্ট নন। কারণ, এতে তাদের সব দাবী স্বীকার করা হয়নি। আমার নিজের তরফ থেকে বলছি, আমিও সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে সন্তুষ্ট নই, আর ব্যক্তিগতভাবে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের (সর্বদলীয়) নিজস্ব পরিকল্পনা প্রকাশ না করতে পারছি, ততক্ষণ আমার আত্মসম্মান বজায় থাকবে না। কিন্তু আমি পরিষদকে বলতে চাই, আমি এটা গ্রহণ করেছি। কারণ, একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, তবুও আমরা সমঝোতায় উপনীত হতে পারিনি। এই কারণে আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক আমি এটা গ্রহণ করেছি। কারণ যদি তা গ্রহণ না করি তাহলে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা তৈরীর সম্ভাবনা থাকে না”।–[Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, I. Shah Muhammad Ashraf, Lahore.]
মিঃ জিন্নাহ তার দীর্ঘ ভাষণে ফেডারেল পরিকল্পনা এবং প্রাদেশিক সরকার পরিকল্পনা বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করলেন।
বিতর্ক শেষে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো ভোটে দেয়া হলো। ভোটে জিন্নাহ উত্থাপিত তিনটি প্রস্তাবই পাশ হলো। এটা জিন্নাহ অর্থাৎ মুসলমানদের একটা বড় পার্লামেণ্টারী বিজয়। এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ও, এম, নাম্বিয়ার তার ‘From India Press Gallery’তে লিখেছেন, “মিঃ জিন্নাহ কংগ্রেস দলকে উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিলেন যে, কংগ্রেসের উপর ভারতীয় মুসলমানদের আস্থা নেই এবং আইন পরিষদে বা বাইরে কোথাও ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিকূল যে কোন পরিকল্পনা তারা সমর্থন জানাতে অস্বীকার করবে”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, এম, এইচ, সাঈদ, Page 23.]
এখানে বলা প্রয়োজন যে, পার্লামেন্টে এই বিতর্ক অনুষ্ঠানের আগে হিন্দু মুসলিম সমঝোতার জন্যে ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ গভীর আগ্রহ নিয়ে মিঃ জিন্নার সাথে কয়েকবার বৈঠকে বসবেন। কিন্তু পাঞ্জাব ও বাংলার কায়েমী স্বার্থবাদী হিন্দু ও শিখদের অসম্ভব দাবী ও মনোভাবের কারণে আপোষ আলোচনা ব্যর্থ হয়।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৩০৪।] উল্লেখ্য, এ ধরনের উদ্যোগ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বহুদিন পর নেয়া হয়। এ সম্পর্কে ‘Abvance’ পত্রিকা মন্তব্য করেছিল, “কংগ্রেসের পক্ষে এতো মাস চুপ করে থাকা ঠিক হয়নি, বিশেষত যখন তারা (কংগ্রেস) সাম্প্রদায়িক সমঝোতায় সামগ্রিক চেষ্টা করা হবে বলে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৩০৪।] কংগ্রেস এভাবে চুপ করেছিল কারণ, তাদের আশা ছিল বৃটিশকে ভয় দেখিয়ে এবং সংখ্যাধিক্যের জোরে তারা সংখ্যালঘুদের হাতের মুটোয় আনতে পারবে।
‘ভারত শাসন আইন’ বা বহু আকাঙ্ক্ষিত ‘শাসনতন্ত্র’ বিধিবদ্ধ হলো ১৯৩৫ সালের আগষ্ট মাসে। ১৯৩০ সালে সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর তিন তিনটি গোলটেবিল বৈঠক এবং অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার পর অবশেষে এই আইন বিধিবদ্ধ হলো। এই ভারত শাসন আইনের প্রধান দিক দুটিঃ একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা, অন্যটি প্রাদেশিক। ভারতের দেশীয় রাজ্যসমূহসহ একটি ভারতীয় ফেডারেশন গঠনের ব্যবস্থা হলো। ফেডারেশনের কেন্দ্রে ভাইসরয়ের নেতৃত্বে একটা ‘কাউন্সিল অব মিনিস্টারস’ থাকবে। কেবল পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে মন্ত্রীসভা আইন সভার কাছে দায়ী থাকবে। দ্বিতীয়ত ভারতের এগারটি প্রদেশে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নিকট পূর্ণ দায়িত্বশীল মন্ত্রীসভা থাকবে। প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতামতকে সামনে রেখে অধিকাংশ সদস্যের নেতাকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন্যে আহবান জানানো গভর্ণরের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। রেসিডিউয়ারী ক্ষমতা ইচ্ছামত বরাদ্দ করার ক্ষমতা গভর্ণর জেনারেলকে দেয়া হলো। ভারত শাসন আইনে মুসলমানদের যে সব দাবী স্বীকৃত হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে, সিন্ধুর স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হওয়া, শর্তযুক্ত হলেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভ, কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল পার্লামেণ্টে এক তৃতীয়াংশ আসন লাভ, স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা বজায় থাকা, ইত্যাদি। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঠিক রাখা হলো, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবের প্রতি সুবিচার করা হলো না। এ দু’টি প্রদেশে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতা বিনষ্ট করা হলো। পাঞ্জাবে মুসলমানদের আসন পাওয়ার কথা শতকরা ৫৬ ভাগ, পেল ৪৯ ভাগ এবং বাংলায় পাওয়ার কথা ৫৪ ভাগ আসন, পেল ৪৭ ভাগ।
কংগ্রেস নেতা জওহর লাল নেহেরু এই ভারত শাসন আইনকে ‘ক্রীতদাসের সংবিধান’ বলে অভিহিত করলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১২০।] তিনি ১৯৩৬ সালে লাক্ষৌতে কংগ্রেস অধিবেশনে ঘোষণা করলেন যে, ‘এ আইনের বলে ভারতের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা অর্পিত হয়নি। তাই এটা সর্বতোভাবে বর্জনীয়।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৮২।] কিন্তু কংগ্রেসের বড় বড় নেতারা এসব কথা বললেও ক্ষমতা লোভী কংগ্রেস সদস্যগণ ১৯৩৫ সালের বিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১২০।] তাই কংগ্রেস তার ফয়েজপুর অধিবেশনে প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল। তবে বলল যে, যে সব প্রদেশে গভর্ণর তার বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেবেন, ঐসব প্রদেশেই শুধু কংগ্রেস সরকার গঠন করবে।–[‘গভর্নর জরুরী আইন দ্বারা মন্ত্রী সভা ভাঙিয়া দিতে পারিতেন এবং সমস্ত ক্ষমতা নিজ হস্তে গ্রহণ করিতে পারিবেন” –এই সকল বিষয়ের প্রতি মুসলিম লীগের পক্ষ হইতে পূর্বেই আপত্তি করা হইয়াছিল, কিন্তু তখন কংগ্রেস তাহার সহিত সহযোগিতা করে নাই। বরং না গ্রহণ না বর্জন নীতির অন্তরালে পরোক্ষভাবে (কংগ্রেস) শর্তসমূহ মানিয়া লইয়াছিল”। (উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৭৬, ১৭৭)।] কংগ্রেস ফেডারেল পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করল।
‘ভারত শাসন আইন’ সম্পর্কে মুসলিম লীগের আনুষ্ঠানিক মতামত প্রকাশ পেল ১৯৩৬ সালের ১১ ও ১২ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশনে। স্যার সৈয়দ ওয়াজীর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কায়েদে আযম এ সম্পর্কিত যে প্রস্তাব আনলেন, তা এইঃ
“বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বারংবার অসন্তোষ ও অস্বীকৃতি ঘোষণা করার পরও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আদলে গঠিত যে শাসনতন্ত্র ভারতবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। লীগ মনে করে যে, প্রাদেশিক পরিকল্পনায় বহু আপত্তিকর বিষয় রয়েছে যার ফলে সরকারের সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভা ও আইন পরিষদের প্রকৃত ক্ষমতা নস্যাত করা হয়েছে। এতদসত্বেও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রাদেশিক পরিকল্পনা কাজে লাগানো উচিত। —-লীগের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্তর্ভুক্ত নিখিল ভারত ফেডারেল পরিকল্পনা মূলত খারাপ। এটা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। পশ্চাদমুখী ও ক্ষতিকর এবং বৃটিশ ভারত বনাম ভারতীয় দেশীয় রাজ্য সমূহের প্রেক্ষিতে বৃটিশ ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর এবং ভারতের বহু আকাঙ্ক্ষিত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা ও বিলম্ব সৃষ্টি করবে। সেই কারণে এটা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণের অযোগ্য”।–[‘Pakistan Movements: Historic Document’, by G. Allana, Page 123, 124.] এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু অবস্থাগত কারণে উভয় পক্ষই প্রাদেশিক পরিকল্পনাকে গ্রহণ করেছে, আর প্রত্যাখ্যান করেছে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে। অথচ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারতো, তাহলে এমনভাবে বৃটিশ পরিকল্পনা তাদের গলধকরণ করতে হতো না। বরং তারা উভয়পক্ষ মিলে সর্বসম্মতভাবে কোন শাসন পরিকল্পনা পেশ করলে তা বৃটিশরা গ্রহণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। প্রধানত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হবার কারণেই বৃটিশের পক্ষ থেকে বিকল্প হিসেবে এই ভারত শাসন আইন এসেছে।
ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষিত ঐকমত্য কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, প্রভৃতি হিন্দু সংগঠনের অযৌক্তিক একগুয়েমীর কারণেই হয়নি। ভারত শাসন আইনের প্রাদেশিক পরিকল্পনা মেনে নেয়ার মাধ্যমে কংগ্রেস কার্যত মুসলমানদের সব দাবীই মেনে নিয়েছে। অথচ কংগ্রেসের এই মেনে নেয়াটা যদি অসময়ে এবং বৃটিশেরা ডিকটেশনের না হয়ে মুসলিম লীগের সাথে আপোষ হতো, তাহলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিজেদের পছন্দমত শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারতো এবং তাদের শর্তে বৃটিশকে রাজী হতে বাধ্য করতে পারতো। কিন্তু কংগ্রেস এ পথ মাড়ায়নি। এর কারণ কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের জাতীয় অস্তিত্ব এবং মুসলমানদের কোন জাতীয় দাবীর প্রতি স্বীকৃতি দিতে চায়নি। ভারত শাসন আইনের প্রাদেশিক পরিকল্পনা তারা যে মেনে নিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করার জন্যেই। কংগ্রেস তার ফয়েজপুর অধিবেশনে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই ঘোষণা করেছিল, ‘১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে বানচাল করার জন্যে তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছে’।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৮২।] অর্থাৎ কংগ্রেস নির্বাচনের সুযোগে ক্ষমতায় গিয়ে ভারত শাসন আইন অর্থাৎ মুসলমানদের অর্জিত সুবিধাগুলো বাতিল করার মত পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যেমন করে তারা বাতিল করতে বাধ্য করেছিল মণ্টেগু চেমসফোর্ড আইন, যার মাধ্যমে মুসলমানরা কিছু সুবিধা অর্জন করেছিল। কংগ্রেসের অন্ধ ও বিদ্বেষাত্মক নীতির কারণেই তার সঙ্গে মুসলিম লীগের ঐক্য হতে পারেনি। কংগ্রেসের এই নীতি সম্পর্কে মিঃ জিন্নাহ মুসলিম লীগের উপরোক্ত সম্মেলনে বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উটপাখির মতো কাজ করছে, তারা বালিতে মাথা গুঁজে মনে করছে অন্য কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না। কংগ্রেস সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব দাবী করে কিন্তু স্বতন্ত্র সম্প্রদায়গুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করে না। কংগ্রেসের ভাব হচ্ছে এইঃ আমাদের সাথে শামিল যদি হতে চাও, আসতে পারো, ইচ্ছা হয় তফাৎ থাকো”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, Sayid, Page 224, 245.] ইতিহাসকার ওয়ালব্যাংকও জিন্নার কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, “ভারতের ব্যাপারে কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোন দলের কথা বলার অধিকার গান্ধী অস্বীকার করেন”।–[‘A Short History of India and Pakistan’, ট. ওয়াল্টার ওয়ালব্যাংক, পৃষ্ঠা ১৮৬।]
এতদসত্ত্বেও মিঃ জিন্নাহ মুসলিম লীগের ঐ সম্মেলনেই কংগ্রেসের প্রতি ঐক্যের আহবান জানিয়েছিলেন। বৃটিশ ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে সামনের দিনগুলোতে আইন পরিষদের ভেতরে ও বাইরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, “—এ যেন দাবার ছক নিয়ে চারটি দল বসেছে। একটি হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে বৃটিশ জনসাধারণ, আর তিনটি হচ্ছে দেশীয় রাজন্যবর্গ, হিন্দু ও মুসলমান। গ্রেট বৃটেনের উদ্দেশ্য হল, তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখা। —এর প্রতিকারের একমাত্র পন্থা হচ্ছে শাসনতান্ত্রিক (বা নিয়মতান্ত্রিক) আন্দোলন। এর অর্থ হচ্ছে, আইন পরিষদগুলোকে এমনভাবে চালাতে হবে যাতে আইন পরিষদের মধ্যে ও বাইরে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে বৃটিশ সরকার তাদের (ভারতীয়দের) ইচ্ছা পূরণে বাধ্য হবে। —প্রধান সম্প্রদায় দু’টি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে তবে এই উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, by Sayid, Page 224, 245.]
জিন্নার এই আহবান কংগ্রেসের অন্ধ মন ও বন্ধ কানে কোনই ক্রিয়া করেনি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল ১৯৩৬ সালেই। কংগ্রেস ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে তার এক অধিবেশনে ১৯৩৫ সালের সংবিধান (ভারত শাসন আইন) প্রত্যাখ্যান ও জনগনের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত বিধানসভা কর্তৃক প্রণীত সংবিধান রচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচীকে অন্তর্ভূক্ত করে নির্বাচনী মেনফেস্টো প্রকাশ করে। অন্যদিকে এ বছরই জুন মাসে মুসলিম লীগ মিঃ জিন্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে নির্বাচনী বোর্ড ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ সমর্থন করে এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্নমুখী কর্মসূচীসহ নির্বাচনী মেনিফেস্টো প্রণয়ন করে। কংগ্রেসে ও মুসলিম লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো তুলনা করলে দেখা যাবে এক পৃথক নির্বাচন বা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রেই দুই দলের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। এই ঐক্যের দিকটিকে সামনে রেখেই কংগ্রেসের সাথে একটা সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কায়েদে আযম তার এক ভাষণে বললেন, “কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে আদর্শগত কোন বিরোধ নেই। ভারতের পূর্ণ স্বাধীণতা উভয়েরই কাম্য। তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে নাকি তার দেশের জন্যে পূর্ণ স্বাধীনতা চায় না”।–[‘Muhammad Ali Jinnah’, Sayid, Page 224, 245.]
কায়েদে আযমের এ কথাগুলোর মধ্যে উভয় সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য ও একক উদ্দেশ্যের বিষয়টাই তুলে ধরা হয়েছে। এর দ্বারা তিনি কংগ্রেসকে কাছে টানে চেয়েছেন, যাতে করে উভয়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়। ১৯৩৭ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে হিন্দুরা বলা যায় ঐক্যবদ্ধভাবেই কংগ্রেসের পতাকা তলে সমবেত হলো। কিন্তু মুসলমানরা তা পারল না। বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগ ছাড়াও একাধিক মুসলিম দল ও গ্রুপ নির্বাচন করতে এগিয়ে এল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পাঞ্জাবে ফজলে হোসেনের নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট পার্টি, বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি, সিন্ধুতে আব্দুল্লা হারুনের নেতৃত্বে ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট পার্টি, যুক্ত প্রদেশে নবাব ছত্রীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল এগ্রিকালচারিষ্ট পার্টি। আর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তো খান আব্দুল গাফফার খানের মাধ্যমে কংগ্রেসেরই একচ্ছত্র প্রাধান্য চলছিল। এই অবস্থায় মুসলিম লীগ নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে খুবই খারাপ করল। এর ফলে গোটা ভারতের ৪৮৪টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেল মাত্র ১০৮টি আসন,-[মুসলিম লীগ মাদ্রাজে ২৭টি মুসলিম সিটের মধ্যে ১১টি, বোম্বাইয়ে ২৯টির মধ্যে ২০টি, বাংলায় ১১৯টির মধ্যে ৪০টি (ফজলুল হকের প্রজাপার্টি ৩৮টি), যুক্ত প্রদেশে ৬৪-এর মধ্যে ২৮টি, পাঞ্জাবে ৮৪-এর মধ্যে ২টি, বিহারে ৩৯-এর মধ্যে শূন্য, মধ্য প্রদেশে ১৪-এর মধ্যে শুন্য, সীমান্ত প্রদেশে ৩৬-এর মধ্যে শূন্য, আসামে ৩৪-এর মধ্যে ৯টি, উড়িষ্যায় ৪-এর মধ্যে শূন্য, সিন্ধুতে ৩৫-এর মধ্যে শূন্য আসন লাভ করে।] অবশিষ্ট মুসলিম আসন চলে গেল আঞ্চলিক মুসলিম দলগুলোর হাতে। তবে কংগ্রেস মুসলিম সিট পাওয়ার ক্ষেত্রে একদম ভূমিশয্যা নিল। আব্দুল গাফফার খানের উপর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উনিশটি আসন বাদ দিলে গোটা ভারতে কংগ্রেস পেল মাত্র ৭টি মুসলিম আসন। অন্যদিকে গোটা ভারতের ৮০৮টি হিন্দু আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেল ৭১১টি আসন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ কম সিট পেলেও সর্ব ভারতীয় একক বৃহৎ মুসলিম সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হলো। আর কংগ্রেস মাত্র ৭টি মুসলিম সিট ও ৭১১টি হিন্দু সিট নিয়ে হিন্দু সংগঠনে রূপান্তরিত হলো এবং এর দ্বারা মুসলিম লীগের দাবীই প্রমাণিত হলো যে, কংগ্রেস ভারতীয় হিন্দুদেরই একটি রাজনৈতিক দল।–[‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ১৩০।]
নির্বাচনের ফল কতকগুলো বাস্তবতা ও সমস্যাকে সামনে নিয়ে এল। প্রমাণ হলো, সর্বভারতীয় মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন মুসলিম লীগ অত্যন্ত দুর্বল। এর কারণও ছিল। সাইমণ্ডস-এর ভাষায় ‘১৯৩৭ সাল থেকে লীগ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই প্রতিষ্ঠান, জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য খুব কম চেষ্টাই করা হয়েছিল”।–[‘Making of Pakistan’, আর. সাইমণ্ডস, পৃষ্ঠা ৫৩।] মুসলিম লীগের সীমাবদ্ধতার কথা জিন্নাহও এভাবে স্বীকার করেছেনঃ
“১৯৩৬ সালের জুন মাসে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় পার্লামেণ্টারী বোর্ড গঠিত হয়েছিল এবং অন্যান্য প্রাদেশিক বোর্ডও গঠিত হয়। —-এ কাজে বাধা ছিল অনেক এবং কাজটি কম বৃহৎ নয়। কারণ এর আগে প্রস্তুতি নেয়া হয়নি, অথবা দক্ষ ও উপযুক্ত সংগঠকও ছিল না। ভারতের মুসলমানরা সংখ্যায় লঘিষ্ঠ ও দুর্বল, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ এবং অর্থনৈতিক দিকে তাদের কোন অবস্থান না থাকায় সমগ্র ভারতব্যাপী নির্বাচন পরিচালনা একটা দুরূহ কাজ ছিল”।–[‘Speeches & Writings of Mr. Jinnah, Vol-I’, পৃষ্ঠা ২৬।] একদিকে ছিল এই দুর্বলতা, অন্যদিকে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের আপোষহীন আগ্রাসী মনোভাব মুসলমানদের উদ্বিগ্ন করে তুলল। নির্বাচনে হিন্দুদের ঐক্য ও সংখ্যাগুরুত্ব কংগ্রেসকে ১১টি প্রদেশের ৬টি প্রদেশে সরকার গঠনে অবাধ সুযোগ এনে দিল। অন্যান্য প্রদেশেও লীগের দুর্বলতা ও মুসলমানদের অনৈক্যকে কংগ্রেস তার স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ পেল । এই অবস্থায় কংগ্রেসের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধ এবং মুসলমানদের সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করা যায় কিভাবে, সে চিন্তা মুসলিম চিন্তাশীলদের ভাবিয়ে তুলেছিল। এই ভাবনার কিছু পরিচয় পাওয়া যায় নির্বাচনের পরপরই জিন্নার কাছে লিখা আল্লামা ইকবালের কয়েকটি চিঠিতে। তার মধ্যে সংকট থেকে মুসলমানদের স্থায়ী উত্তরণের দিক নির্দেশনাও রয়েছে। কবি ইকবালের তিনটি চিঠি এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছেঃ
[এক]
[সম্পূর্ণরূপে গোপনীয়, লাহোর ২০শে মার্চ, ১৯৩৭]
প্রিয় মিঃ জিন্নাহ
আমার বিশ্বাস আপনি ভারতীয় জাতীয় সম্মেলনে পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর বক্তৃতা পাঠ করেছেন এবং তার অন্তরালবর্তী মুসলিমের প্রতি যে নীতি অনুসৃত হয়েছে, আশা করি সে সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল আছেন। আমার বিশ্বাস, নূতন সংবিধান যে অন্তত পক্ষে ভারতীয় মুসলমানদেরকে ভারত এবং মুসলিম এশিয়ার রাজনৈতিক বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মসংগঠনের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে সে সম্বন্ধেও আপনি পুরোপুরি ওয়াকেফহাল। যদিও আমরা দেশের অন্য যে কোন প্রগতিশীল পার্টির সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, তবুও একথা আমাদের ভুলে গেলে কিছুতেই চলবে না যে, নৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এশিয়াতে ইসলামের ভবিষ্যৎ মুখ্যত ভারতীয় মুসলমানদের একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ সংগঠনের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমার মতে নিখিল ভারত জাতীয় সম্মেলনে একটা সমুচিত জবাব দান করা উচিত। তার জন্য অবিলম্বে দিল্লীতে সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন আহবান করা আপনার উচিত। তাতে খ্যাতনামা মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের আমন্ত্রণ করা হবে। এ সম্মেলনে পুনর্বার আপনাকে জোরের সঙ্গে পরিস্কার ভাষায় আলাদা একটি রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে মুসলমানদের লক্ষ্যের কথা বলতে হবে। ভারত এবং ভারতের বাইরের জগতকে জানানোর প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, অর্থনৈতিক সমস্যাই ভারতের একমাত্র সমস্যা নয়। মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে, অধিকাংশ মুসলমানের কাছে সাংস্কৃতিক সমস্যা ভারতীয় মুসলমানদের কাছে অধিকতর গুরুত্বসম্পন্ন। কোনো ক্রমেই তা অর্থনৈতিক সমস্যার চাইতে কম গুরুত্বসম্পন্ন নয়।
আপনার অন্তরাল
মুহম্মদ ইকবাল
[দুই]
[ব্যক্তিগত, লাহোর ২৮শে মে, ১৯৩৭]
প্রিয় মিঃ জিন্নাহ
আপনার চিঠিখানা যথাসময়ে আমার কাছে পৌঁছেছে এবং সে জন্য আপনাকে অশেস ধন্যবাদ। আমি শুনে আনন্দিত হয়েছি যে আমি মুসলিম লীগের সংবিধান এবং কার্যসূচী পরিবর্তন করা সম্বন্ধে যা লিখেছিলাম, আপনি তা মনে রেখেছেন। মুসলিম ভারত যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন তার গুরুত্ব আপনি সম্পূর্ণরূ উপলব্ধি করেন, সে সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। লীগ কি উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের, না মুসলিম জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করবে, শেষ পর্যন্ত লীগকে তাই স্থির করতে হবে। নেহায়েত সঙ্গত কারণেই মুসলিম জনসাধারণ লীগের প্রতি কোন আগ্রহ এ পর্যন্ত প্রদর্শণ করেনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম জনসাধারণের জীবনের উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না, তা আমাদের জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হবে না। নূতন সংবিধান অনুসারে উচ্চপদসমূহ উচ্চ শ্রেণীর অধিকারে চরে যাবে। অপেক্ষাকৃত ছোট চাকরিগুলো মন্ত্রীদের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দরহাতে চলে যাবে। অন্যান্য বিষয়েও আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহ মুসলিম জনসাধারণেল জীবনধারণের উন্নতি করার কথা চিন্তাও করেনি। ভারতের সমস্যা দিনে দিনে তীব্রতর হয়ে উঠছে। দু’শো বছর ধরে তাদের অধঃপতন হচ্ছে একথা মুসলমানেরা বুঝতে শুরু করেছে। সাধারণত তাদের বিশ্বাস, হিন্দু মহাজন এবং ধনীকেরাই হলো তাদের দারিদ্রের কারণ। বিদেশী শাসনও যে তার জন্য সমানভাবে দায়ী এ বোধ এখনো তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়নি পুরোপুরি, কিন্তু সে ধারণা অবশ্যই আসবে। জওয়াহের লাল নেহেরুর নাস্তিকতাবাদী সমাজতন্ত্রে মুসলমানদের যথেষ্ট রকম সাড়া দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে মুসলমানদের দারিদ্র সমস্যার সমাধান করা যায়। এ সমস্যা সমাধানে লীগের ভূমিকার উপরই লীগের সম্পূর্ণ ভবিষ্যত নির্ভর করছে। লীগ যদি এ ধরনের কোন প্রতিশ্রুতি দিতে না পারে, তাহলে মুসলিম জনসাধারণ লীগের প্রতি আগের মতো উদাসীন থাকবে, সে ব্যাপারে আমি এক রকম নিশ্চিত। সৌভাগ্যবশত ইসলামী আইন প্রয়োগ করে তার সমাধান এবং আধুনিক ভাবধারা অনুসারে বিকাশের একটি পন্থা রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে ইসলামী আইনের সতর্ক পর্যবেক্ষণ করে আমি এ উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, যদি সে আইন যথার্থরূপে বুঝে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সকলে অন্ততপক্ষে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু অর্জন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এদেশে ইসলামী শরিয়তের প্রয়োগ এবং বিকাশ সম্পূর্ণ স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহের প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সম্ভব নয়। অনেক বছর ধরে এই ছিলো আমার সৎবিশ্বাস এবং এখনো আমি বিশ্বাস করি যে, মুসলমানদের ভারতের সমস্যা এবং শান্তিপূর্ণ ভারতের জন্য এ হচ্ছে একমাত্র পন্থা। তা যদি ভারতে সম্ভব না হয়, তা’হলে তার একমাত্র বিকল্প হলো গৃহযুদ্ধ, প্রকৃত প্রস্তাবে যা কিছু দিন ধরে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার আকারে চলছে। আমার ভয় হচ্ছে দেশের কোন কোনো অংশে, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্যালেস্টাইনের অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
আধুনিক সমস্যাগুলি হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের পক্ষে সমাধান করা অধিকতর সহজ। কিন্তু আমি উপরে যেমন বলেছি, মুসলিম ভারতের এ সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব করে তোলার জন্য আঞ্চলিক পুনর্বণ্টন ব্যবস্থার প্রয়োজন অপরিহার্য এবং চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পন্ন একটি বা একটির বেশী মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টি করতে হবে। এরকম একটি দাবী তোলার সময় এসেছে, আপনি কি একথা মনে করেন না? সম্ভবত জওয়াহের লাল নেহরুর নাস্তিকতাবাদী সজাতন্ত্রের উত্তরে এই হবে আপনার দেওয়ার মতো যথার্থ উত্তর। সে যাহোক আমি আপনাকে আমার গভীর চিন্তার কথা প্রকাশ করলাম। আশা করি আপনি তা আপনার ভাষণে কিংবা মুসলিম লীগের আগামী অধিবেশনের আলাচনায়ও ব্যক্ত করা যায় কিনা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখবেন। এই সঙ্কটের সময়ে মুসলিম-ভারত আশা করে যে আপনার প্রতিভা বর্তমান দুঃখকষ্ট হতে মুক্তি দেবার মতো কোনো পন্থা আবিস্কার করতে সক্ষম হবে।
আপনার অন্তরঙ্গ
মুহম্মদ ইকবাল
[তিন]
[ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়, লাহোর ২১শে জুন, ১৯৩৭]
প্রিয় মিঃ জিন্নাহ
আপনার চিঠিখানা গতকাল আমার হস্তগত হয়েছে এবং সে জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি জাতি আপনি ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু আমি আশা করি, ঘন ঘন চিঠি লিখি বলে আপনি কিছু মনে করেন না। কারণ আপনি হচ্ছেন একমাত্র মুসলিম যিনি সম্পূর্ণ ভারতে যে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে, তাতে যথার্থ নেতৃত্ব দান করতে পারেন। আমি আপনাকে বলছি, আমার এক ধরনের প্রকৃত গৃহযুদ্ধের মধ্যেই বাস করছি। আমি আপনাকে বলছি, আমরা এক ধরনের প্রকৃত গ্রহযুদ্ধের মধ্যেই বাস করছি। পুলিশ এবং মিলিটারী না থাকলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তো। গত কয়েক মাসের মধ্যে ভারতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে অনেকগুলো দাঙ্গা হয়ে গেছে। গত তিন মাসর মধ্যেই একমাত্র উত্তর-পশ্চিম ভারতে কমছে কম তিনটা দাঙ্গা হয়েছে এবং হিন্দু ও শিখ মিলে চার চার বার রসুলুল্লাহর মর্যাদাহানি করেছে। চারবারের প্রত্যেকটিতেই মর্যাদাহানি কারীদেরকে হত্যা করা হয়েছে। সিন্ধুতে কোরান শরীফও জ্বালানো হয়েছে। আমি সতর্কভাবে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি। এ সকল ঘটনা অর্থনৈতিক কিংবা ধর্মীয় নয়। বিশুদ্ধভাবেই রাজনৈতিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহেও মুসলমানদেরকে হিন্দু এবং শিখরা কোণঠাসা করে রাখার আকাঙ্ক্ষা রাখে। নূতন সংবিধান মতে মুসলমানদেরকে মুসলিম প্রধান প্রদেশসমূহেও অমুসলমানদের উপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। তার ফলে মুসলিম মন্ত্রীসভাও কোন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। মুসলমানদের উপর অবিচার করে যাদের উপর তারা নির্ভরশীল তাদের সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা এর একটি এবং তারা যে চূড়ান্তভাবে নিরপেক্ষ তা তাদের কাছে প্রমাণ করাই এর অন্য একটি কারণ। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, আমাদের যে সংবিধান বর্জন করার সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, একমাত্র হিন্দুদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য নূতন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে হিন্দুরা নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা মুসলমানদেরকে একদম গণনায় না ধরলেও পারে। কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে মুসলমানদের নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। তার ফলে মুসলিম মন্ত্রীসভাও কোন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাখা হয়েছে। তার ফলে মুসলিম মন্ত্রীসভাও কোন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। মুসলমানদের সম্পূর্ণভাব হিন্দুদের উপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। এ সংবিধান ভারতীয় মুসলমানদের অপরিমিত ক্ষতি সাধনের জন্য অভিসন্ধিমূলকভাবে যে প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। তাছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যা, যা মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়, এটা তার কোনো সমাধান করে নাই।
ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব স্বীকার করে তাদের কেবল একটি সাম্প্রদায়িক ন্যায্যা প্রাপ্যই মঞ্জুর করা হয়েছে। কিন্তু সে সংবিধানে একটি জাতির দারিদ্র নিরসনের কোনো ব্যবস্থা নেই এবং তার কিছু করতে পারে না, তার অস্তিত্বের স্বীকৃতিরও কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট যে মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন, তা মোটেই ভুলে যাবার কথা নয়। অন্য হিন্দু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিন্দু মহাসভা, যা হিন্দু জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি বলে আমার মনে হয়েছে, ঘোষণা করেছে যে, ভারতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিতভাবে জাতি গঠন করা অসম্ভব। সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ ভারতের প্রতিষ্ঠার একমাত্র পন্থা হলো ভারতকে জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত ভাবে পুনর্বন্টন করা। অনেক বৃটিশ রাজনীতিবিদও তা বুঝেন। এ সংবিধানের কারণে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছে, শীগগিরই তা ভারতের প্রকৃত অবস্থা তাদের দৃষ্টি খুলে দেবে। আমার মনে পড়ে লর্ড লোথিয়ান আমাকে ইংলন্ড ত্যাগ করার প্রাক্কালে বলেছিলেন, আমার পরিকল্পনাই হলো ভারতের বিসংবাদের একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান, কিন্তু সে জন্য পঁচিশ বছর সময়ের প্রয়োজন। পাঞ্জাবের কতিপয় মুসলমান উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম সম্মেলন আহবানের কথা বলেছেন এবং তা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। সে যা হোক, আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমাদের সম্প্রদায় এখনো যথেষ্ট রকমের সুসংবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল নয়, সে কারণে এ রকম একটি সম্মেলন আহবান করার যথার্থ অবস্থা এখনো প্রস্তু হয়নি। কিন্তু আমি মনে করি যে, আপনি অন্তত বক্তৃতায় মুসলমানেরা শেষ পর্যন্ত কোন কর্মপন্থা গ্রহণ করবে তার আভাস দেবেন।
আমার মনে হয়, একটি মাত্র ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শ সম্বলিত নূতন সংবিধানর কোনো আশা নেই। মুসলিম প্রদেশসমূহের সমবায়ে পৃথক একটি যুক্তরাষ্ট্র, আমার উপরে বর্ণিত সূত্র অনুসারে গঠন করাই হলো ভারতের একমাত্র শান্তিপূর্ণ পন্থা এবং মুসলমানদেরকে অমুসলমানদের প্রভুত্ব থেকে রক্সা করার একমাত্র উপায়। ভারতের ভেতরে অথবা বাইরের অন্যান্য জাতিসমূহের মতো উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং বাঙলার মুসলমানদের কেন জাতি বলে মেনে নেয়া হবে না? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং বাঙলার মুসলমানদের বর্তমানে মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশসমূহকে অগ্রাহ্য করা উচিত। মুসলিম সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে এটাই হবে প্রকৃষ্ট পন্থা। সুতরাং কোনো মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে না করে পাঞ্জাবে মুসলিম লীগের অধিবেশনের ব্যবস্থা করলে সবদিক দিয়ে ভালো হয়। আগস্ট মাসটা লাহোরের জন্য ভালো নয়। আমি মনে করি অক্টোবরের মাঝামাঝি লাহোরের আবহাওয়া যখন ভালো হবে, তখন মুসলিম লীগের আগামী অধিবেশন লাহোরে অনুষ্ঠিত হওয়ার যুক্তিযুক্ততা প্রসঙ্গে আপনি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখবেন। পাঞ্জাবে নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ দ্রুত বৃদ্দি পাচ্ছে। এবং মুসলিম লীগের আগামী অধিবেশন লাহোরে অনুষ্ঠিত হলে পাঞ্জাবের মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটার সম্ভাবনা বর্তমান রয়েছে।–[‘ইকবালের এ চিঠিগুলো আকবর উদ্দীনের ‘কায়েদে আযম’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৩৪৮-৩৫৩।]
আপনার অন্তরঙ্গ
মুহম্মদ ইকবাল
ইকবালের এই পত্রগুলোতে প্রধানত তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। এক, মুসলমাদের নিরাপত্তা, দুই, মুসলিম লীগকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা এবং তিন, ভারতে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র-ফেডারেশন গড়ার যৌক্তিকতা। তিনটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ সংক্রান্ত পরামর্শ সে সময়ের জন্যে ছিল এক দিকনির্দেশিকা। খোদ কায়েদে আযমের ভাষায় “আমি মনে করি এই সকল পত্র বিশেষত যেগুলোতে মুসলিম ভারতের ভবিষ্যত সম্পর্কে তার মতামতের বিশ্লেষণ পরিস্কার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলোর প্রভূত ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে”।–[‘Iqbal’s letters to Jinnah’ পুস্তিকার ভূমিকা দ্রষ্টব্য।]
নির্বাচনের পর মিঃ জিন্নাহ একদিকে মুসলিম লীগকে শক্তিশালী এবং অন্যদিকে কংগ্রেসের প্রতি সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করলেন। চেষ্টা করলেন মুসলিম লীগ, কংগ্রেস এবং অন্যান্য দলসমূহের মিলিত মন্ত্রীসভা গঠনের, যাতে করে এক সাথে চলা ও কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল বাংলা এবং পাঞ্জাবেও কংগ্রেসের সাথে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠনের প্রস্তাব জিন্নাহ করলেন।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৭৭।] জিন্নার মনে বোধ হয় তখনও এ ক্ষীণ আশা জেগে ছিল যে, কংগ্রেস অববশেষে বাস্তবতা মনে নেবে এবং উভয়পক্ষের সম্মানজনক এক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজী হবে। কিন্তু তা হলো না। ‘কংগ্রেসের পক্ষে সে অবস্থায় যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠনের আবহাওয়া অনুকূল থাকলেও কংগ্রেস লীগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল’।–[‘Parliamentary Government in India’, by স্যার বি. পি. সিংহ, পৃষ্ঠা ২১৬।] শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, যৌথ মন্ত্রীসভা গঠনর জন্যে যে শর্ত আরোপ করল, তা অত্যন্ত অপমানকর। শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরীর ভাষায়, “কংগ্রেসের শর্তসমূহ মুসলিম লীগের পক্ষে মানিয়া লইবার অর্থই হইল লীগ সংগঠনের আত্মহত্যা”-[‘ভারতে মুসলিম রাজনীতি’, শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৪৯।] এই ধরনের অপমানকর শর্ত আরোপ মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলার ক্ষেত্রে করা হয়।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, পৃষ্ঠা ১৭৮।] উত্তর প্রদেশের জন্যে কংগ্রেস যে শর্ত আরোপ করে তা এইঃ
ক) মুসলিম লীগকে উত্তর প্রদেশ এ্যাসেম্বলীতে পৃথক দল হিসেবে সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
খ) সকল মুসলিম লীগ সদস্যকে কংগ্রেস দলে যোগদান করতে হবে।
গ) উত্তর প্রদেশ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ড ভেঙ্গে দিতে হবে।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, পৃষ্ঠা ১৭৯।]
শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী যথার্থই বলেছেন এ ধরনের শর্ত আরোপ করা আর মুসলিম লীগকে আত্মহত্যা করতে বলা একই কথা’। প্রকৃত পক্ষে কংগ্রেস মুসলিম লীগ তথা মুসলমানদের স্বতন্ত্রের বিলুপ্তিই চাইছিল। এই মনোভাবের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়ে এই সময় নেহেরু কোলকাতায় বলেই ফেললেন, “আজ দেশে মাত্র দুইটি শক্তি আছে, কংগ্রেস এবং বৃটিশ সরকার। —কংগ্রেসের বিরোধিতা করার মানে হলো ইংরেজ শাসনকে স্বীকার করে নেওয়া”।–[‘নেহরু’ প্রথম খণ্ড, এস, গোপাল, পৃষ্ঠা ২২৪।]
নেহেরুর এই ধরনের উক্তি শুধু মুসলিম লীগের ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ করা নয়, একেবারে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। নির্বাচনে বিরাট বিজয় লাভের ফলে মনে হয় কংগ্রেসের মুখোশ খুলে গিয়েছিল। ভারতের ১১টি প্রদেশের ৬টিতে ক্ষমতায় গিয়ে এবং আরও কয়েকটিতে কোয়ালিশন করে কংগ্রেস মনে করছিল গোটা ভারতে শুধু তারাই আছে, ভারত শুধু তাদেরই। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কোলকাতাতেই এক জনসভায় নেহেরুর জবাব দিতে গিয়ে বললেন, “আর একটা তৃতীয় শক্তি আছে এবং সেটি হচ্ছে ভারতের দশ কোটি মুসলমানের প্রতিনিধিত্বশীর প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ।—ভারতীয় জাতীয়তাবাদরে একচেটিয়া কোন অধিকার যেমন কংগ্রেসের নেই, তেমনি তারা এর একমাত্র অভিভাবকও নয়। আমি সব সময়েই বলেছি, মুসলিম লীগ দেশের আজাদী হাসিলের জন্য যে কোন প্রগতিশীল দলের সাথে হাত মেলাতে রাজী আছে। তবে এর জন্যে সংখ্যালঘু সমস্যার একটা সন্তোষজনক সমাধান করতে হবে। তাছাড়া, সর্বসাধারণের অভিমত অগ্রাহ্য করে আমরা কখনও কোন দলের সাথে মিশে যেতে পারিনা, সে দল যত বিরাট এবং তার নীতি ও কর্মসূচী যত উন্নতই হোক”।–[‘India Wins Freedom: The other Side’, by W. Khan, Page 75 এবং ‘নেহেরু’, প্রথম খণ্ড, এস. গোপাল, পৃষ্ঠা ২২৪।] জিন্নাহ নেহেরুকে আরও বললেন, “মুসলিমদের নিয়ে আপনি কোন চিন্তা-ভাবনা করবেন না। ওদের বাদ দিয়ে কথা বলুন”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১২৫।] এক বক্তৃতায় নেহেরু জিন্নার জবাব দিতে গিয়ে বললেন, “জিন্নাহ আপত্তি করেছেন কংগ্রেস যেন বাংলার মুসলিমদের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ না করেন। —কিন্তু আমি জানতে চাই মুসলিম কে? যারা জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে অনুসরণ করে তারাই কি মুসলিম? এরা কি চায়? মুসলিম লীগের দাবী কি? —-মুসলিম লীগ কি ভারতের স্বাধীনতার দাবী করে? তারা কি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে? —-আমি মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের চাইতে প্রতিদিন আরও অসংখ্য মুসলিম জনগণের সংস্পর্শে আসি”-[‘জিন্নাহ’, স্ট্যানলি ওলপোর্ট, পৃষ্ঠা ১৪৭, ১৪৮, ‘নেহেরু’, প্রথমখণ্ড, এস, গোপাল, পৃষ্ঠা ২২৪, ‘নেহেরু এ পলিটিক্যাল অটোবায়োগ্রাফি’, মাইকেল ব্রেমার, পৃষ্ঠা ২৩৩।] জিন্নাহও এর ত্বরিত জবাব দিলেন, “পিটার প্যানের মত নেহেরু কখনই বড় হবেন না। নেহরু নিজেকে সবজান্তা ব্যক্তি বলে গণ্য করেন —নিজের ব্যাপার ছাড়া তিনি দুনিয়ার সব সমস্যার ঝক্কি নিতে চান। —-এবং অন্যের ব্যাপারে অনর্থক নাক গলান”।–[‘নেহেরু’, প্রথম খণ্ড, এস. গোপাল, পৃষ্ঠা ২২৪ এবং ‘জিন্নাহ’, স্ট্যানলি ওলপোর্ট, পৃষ্ঠা ১৪৮।]
নেহেরুর শেষ উক্তিটা শুনে মনে হবে, মুসলিম লীগের মুসলমানদের বিরুদ্ধেই বুঝি তার এই রাগ, অন্য মুসলমানদের তিনি বোধ হয় বন্ধু। কিন্তু তা নয়। কংগ্রেসপন্থী মুসলমানদেরকেও কংগ্রেস পাত্তা দেয়নি। কংগ্রেসপন্থী জাতীয়তাবাদী মুসলিম দল যারা সব সময় কংগ্রেসের সাথে এতদিন সহযোগিতা করে আসছিল এবং যারা যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠন করার জন্য কংগ্রেসের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছিল, তাদেরকেও কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় গ্রহণ করেনি”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৮৩।] কেন গ্রহণ করেনি এ সম্পর্কে তদানীন্তন কংগ্রেস সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ নিজেই লিখছেন, “কংগ্রেস ব্যবস্থা পরিষদে প্রবেশ একটি সুস্পষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট একটি নীতির অনুসরণে। কাজেই কোন সাম্প্রদায়িক নীতির উপর নির্ভর করে এমন কোন ব্যক্তিকে মন্ত্রী পরিষদে গ্রহণ করলে নির্বাচক মণ্ডলীকে প্রতারিত করা হবে”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৮৩ (দ্রষ্টব্যঃ ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের ‘খণ্ডিত ভারত’)।] ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের এই দাবী সত্য নয়, কারণ চরমতম সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভাকে মন্ত্রীসভায় গ্রহণ করতে কংগ্রেসের বাধেনি। আসল কথা হলো, অস্তিত্ববাদী কোন মুসলমানকে কংগ্রেস তার মন্ত্রীসভায় স্থান দিতে রাজী ছিল না। এই জন্যই খাকসার পার্টি, খোদাই খিদমতগার পার্টি, ইউনিয়নিষ্ট পার্টি, মোমেন পার্টি, আহরার পার্টি, প্রজা পার্টি ইত্যাদি মুসলিম দল কংগ্রেসের মন্ত্রীসভায় স্থান পায়নি। কারণ তারা সব ছেড়ে ছুড়ে নিজেদের কংগ্রেসের মধ্যে বিলীন করতে চায়নি। যে সব মুসলমান স্বতন্ত্র সত্তা-পরিচয় বিসর্জন দিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিতে পেরেছিল তাদেরকেই শুধু কংগ্রেসের পরিষদে ও মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছিল। এ বিষয়ের দিকে অংগুলি সংকেত করেই জিন্নাহ বলেছিলেন, “যে সবল মুসলমান তাহাদের সমাজের প্রতি যতখানি দুষমনি করিতে পারিবে, তাহারাই কংগ্রেসের নিকট ততখানি আদরের হইবে”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৮৫।] ঠিক এই কথাই অন্যভাবে বলেছিলেন বাংলার জননেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকও। বৃটিশ বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং কংগ্রেস ও হিন্দুদের সাথে চলার তিক্ত অভিজ্ঞতার অধিকারী শেরে বাংলা বলেন, “আমাকে যখন হিন্দুগণ সমালোচনা করিয়া কঠিন মন্তব্য করেন, তখন আমি বুঝতে পারি যে, আমি নিশ্চয়ই মুসলমান সমাজের উপকার করিয়াছি”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ১৮৫।]
লীগ কংগ্রেস তথা হিন্দু মুসলশান সহযোগিতার আরেকটি সম্ভাবনা এইভঅবে ব্যর্থ হয়ে গেল। নির্বাচনের আগে কিংবা পরে-কোন সময়ই ঐক্যের সম্ভাবনা কাজে লাগল না। যুক্ত প্রদেশের ইংরেজ গভর্ণর স্যার হ্যারি হেগ লিখেছেন, “সাধারণ নির্বাচনের সময় একটা ব্যাপারে আমার বিশ্বাস ছিল যে, নির্বাচনের পর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হবে”।–[‘Asiatic Review’, London, 1940. Vol.36. Page 126-143 (উদ্ধৃতঃ Towards Pakistan. ওয়াহিদুজ্জামান, পৃষ্ঠা ৮৫।] কিন্তু তা হয়নি কংগ্রেসের কারণেই। শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, “জিন্নাহ নিতান্ত জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমানের মত লক্ষ করিয়াছিলেন যে, রাজণীতি ক্ষেত্রে সদিচ্ছা, ভালবাসা এবং স্নেহ ও শ্রদ্ধা তখনই দেখানো উচিত যখন তুমি শক্তিশালী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কংগ্রেস উপযুক্ত হইয়া এবং জয়ী হইয়া এইরূপ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারে নাই এবং লীগ যখন সহযোগিতার জন্যে অর্ধেক পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়াছিল, তখন একদিকে কংগ্রেস সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করে, অন্যদিকে কংগ্রেসের সভাপতি গণলীগের সহিত আপোষ আলোচনা চালাইতে থাকে। কংগ্রেসের নীতিভ্রষ্টতা যেমন দেখা যায়, তেমনি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর অস্বচ্ছতা প্রকাশ পায়”।–[‘ভারতে মুসলিম রাজনীতি’, শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী।] শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী আরও লিখেছেন, “লীগকে কোণঠাসা করিবার শেষ ইচ্ছা কংগ্রেসের থাকিলে ১৯৩৭ সালই ছিল উপযুক্ত সময়, যখন কংগ্রেস যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং মন্ত্রীসভা গঠন করিয়াছিল এবং লীগ দুর্বল ছিল ও কংগ্রেসের সহিত সহযোগিতার আহবান জানাইছিল”।–[‘ভারতে মুসলিম রাজনীতি’, শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী।] কিন্তু এ সুযোগ গ্রহণ করতে হলে তো মুসলিম লীগ ও মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ও সমান সত্তা হিসেবে কংগ্রেসের মেনে নিতে হতো। কংগ্রেস এই স্বীকৃতি দিতে রাজী ছিল না।
এখানে বলা আবশ্যক, ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ জিন্নার সাথে আপোশ আলোচনার একটা মহড়া চালান। মহড়া বলছি এজন্য যে, এতে আন্তরিকতা নয়, রাজনীতিই বেশী ছিল। আলোচনা যখন ব্যর্থ হলো, রাজেন্দ্র প্রসাদ হঠাৎ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ব্যর্থতার জন্যে জিন্নাহকে দায়ী করলেন এবং আপোশ মীমাংসার প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘যদি জিন্নাহ প্রস্তাবিত মুসলমান নেতাদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে তিনিও (রাজেন্দ্র প্রসাদ) কংগ্রেসের দ্বারা তা মঞ্জুল করিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
জিন্নাহ এক পাল্টা বিবৃতিতে সংবাদপত্রে ঐ ধরনের বিবৃতি প্রদান এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে আপোশ আলোচনার পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং বলেন, “বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ আমাদের আলোচনার সূত্রের কথা ভুলে গেছেন। বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ ও অন্য কংগ্রেস নেতাগণ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ সম্পর্কিত তিক্ত বিতর্ক নিরসনের উদ্দেশ্যে আমার সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। বিবেচ্য প্রশ্ন ছিলঃ সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায় সমূহের সম্মতিযুক্ত বিকল্প প্রস্তাব স্থিরীকৃত না হওয়া পর্যন্ত ম্যাকডোনাল্ড রোয়েদাদ অনুযায়ী কাজ করা যায় কিনা। বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ ও তার বন্ধুদের পক্ষে এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়নি। এরপর প্রস্তাব আসে যে, যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতির ভিত্তিতে মুসলমানদের স্বার্থ অধিকতর সংরক্ষিত হয়, এমন প্রস্তাব এল আমি (জিন্নাহ) বিবেচনা করবো কিনা। —-স্বভাবতই আমি উত্তরে বলি যে যদি এরূপ কোন পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়সমূহ অর্থাৎ হিন্দু ও শিখদের দ্বারা সমর্থিত হয়, তাহলে অবিলম্বে আমি তা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সামনে পেশ করবো। মুসলমানদের দ্বারা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ যেহেতু গ্রহীত হয়েছে, তাই এখন যদি কোন বিকল্প প্রস্তাব আনয়ন করতে হয়, তাহলে তা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ দুই সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু ও শিখদের পক্ষ থেকে আসা উচিত। ——১৯৩৫ সালের জানুয়ারী মাসে দিল্লীতে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদকে যা বলেছিলাম তার পুনরুক্তি করে বলছি যে, যদি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ তার ফর্মূলা কংগ্রেসের দ্বারা গৃহীত হওয়া সম্পর্কে এত নিশ্চিত থাকেন, তাহলে কংগ্রেসের অনুমোদনসহ প্রস্তাবটি আমার নিকট পাঠালে আমি অবিলম্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাছে পেশ করবো। ——আমি মুসলমানদের ও জনসাধারণকে জানাচ্ছি, অতীতের কোন ঘটনার দ্বারা আমি বিন্দুমাত্র প্রভাবিত নই। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোন সম্মানজনক সমঝোতা হরে আমার চাইতে বেশী খুশী কেউ হবে না এবং আমি তাতে সর্বাধিক সাহায্য করবো। আমার আন্তরিকতার প্রমাণ স্বরূপ জানাচ্ছি যে, মাত্র গত মে মাসে মিঃ গান্ধী যখন তিথলে ছিলেন, তখন হিন্দু মুসলমান সমস্যা সমাধানের অনুরোধ করে আমি তার কাছে বার্তা পাঠাই। ১৯৩৭ সালের ২২শে মে তারিখে এর উত্তরে মিঃ গান্ধী আমাকে জানান, “পারলে আমি কিছু করতাম, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ অসহায়। ঐক্যের উপর আমার বিশ্বাস পূর্বের মতই উজ্জ্বল কিন্তু এই নিবিড় অন্ধকারে আমি কোন আলো দেখতে পাচ্ছি না”।–[‘ভারতে মুসলিম রাজনীতি’, শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী।] অন্ধকারে আর আলো জ্বলেনি। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের আপোশ মহড়ার এই বিবৃতির পর ইতি ঘটে। প্রকৃত পক্ষে আশেপাশের কোন চিন্তা তখন কংগ্রেসের মাথায় ছিল না। তারা তখন প্রায় ৭টি প্রদেশে সরকার গঠন করেছে। আর মুসলিম লীগের মাত্র একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা বাংলা প্রদেশে শেরে বাংলার প্রজাপার্টির সাথে। এমন দুর্বল মুসলমানদের সঙ্গে ভারতের দুই তৃতীয়াংশ রাজত্বের প্রত্যক্ষ অধিপতি কংগ্রেস আপোশ আলোচনায় আসবে কেন? শ্রী বিনয়েন্দ্র চৌধুরী যাকে দুঃখজনক বলেছেন, সেটাই ছিল কংগ্রেসের কাছে গৌরবের।
কিন্তু দিন কারো সমান যায় না। মুসলিম লীগেরও গেল না। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর মুসলিম লগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে লাগলো। ১৯৩৭ সালেই মুসলিম লীগের নতুন ১৭০টি শাখা গঠিত হলো, মুসলিম লীগে যোগদান করল অগণিত মানুষের স্রোত। বাংলার শেরে বাংলা নতুন করে মুসলিম লীগের সহযোগী হলেন। সোহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন ও শেরে বাংলার মিলিত শক্তি বাংলায় মুসলিম লীগকে নতুন জীবন দান করলো। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশেও পরিস্থিতি একদম পাল্টে গেল। আল্লামা ইকবাল, নওয়াব আহমদ ইয়ারখান দওলতানা প্রমুখের চেষ্টায় পাঞ্জাবে নতুন হাওয়া বইল। পাঞ্জাব ইউনিয়নিষ্ট পার্টির নতুন নেতা স্যার সিকান্দার হায়াত খান মুসলিম লীগে যোগদান করায় পাঞ্জাব মুসলিম লীগের হাতে চলে এল। একদিকে মুসলিম লীগের এই উত্থান, অন্যদিকে অধিকাংশ প্রদেশের নতুন শাসক কংগ্রেসের মুখের উপর ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে লাক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ঐতিহাসিক এই কারণে যে, প্রকৃতপক্ষে এখান থেকে মুসলিম লীগ মুসলিম গণসংগঠন হিসেবে তার অগ্রযাত্রা শুরু করে দলীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, কিভাবে কংগ্রেস অন্য দল ভাঙিয়ে, কোথাও বা স্বার্থান্বেষী কোন মুসলমানকে লোভ দেখিয়ে মন্ত্রীর গদীতে বসিয়ে মুসলমানদের প্রতিনিধিরূপে প্রচার করছে, হিন্দীকে জাতীয় ভাষা এবং বন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত করা হচ্ছে, কংগ্রেসের পতাকাকে মানতে ও সম্মান করতে সকলকে বাধ্য করা হচ্ছে –এসব বিষয় উল্লেখ করার পর বললেনঃ
“শুরুতে যতটুকু ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার দ্বারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় একথা প্রমাণ করেছেন যে, হিন্দুস্তান হচ্ছে হিন্দুদের জন্যে। জাতীয়তাবাদের নামে কংগ্রেসেরই হম্বিতম্বি চলছে। হিন্দু মহাসভা টু শব্দটিও করছে না। —–এই পরিস্থিতিতে মুসলমানের সামনে আজ একটিমাত্র পন্থাই সুস্পষ্ট খোলা আছে। সময় থাকতেই তা তাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাদের আজ সংহত হতে হবে। –আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে মুসলমানের সামনে আজ একটি মাত্র পন্থাই সুস্পষ্ট খোলা আছে। সময় থাকতেই তা তাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাদের আজ সংহত হতে হবে। —আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে মুসলমানেরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করুক, এই আমি দেখতে চাই। আমাদের আজ এমন একদল লোকের প্রয়োজন যারা বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যাদের সাহস ও সংকল্প দুইই রয়েছে; গোটা পৃথিবী বিরোধিতা করলেও যারা খালি হাতেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পিছপা হবে না। —সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাথে কোন সমঝোতা সম্ভব নয়। কেননা, কোন হিন্দু নেতাই দায়িত্ব নিয়ে কোন কথা বলেন না এবং এ বিষয়ে কোন গরজও দেখা যায় না। —সমানে সমানে এবং উভয় পক্ষ যদি পরস্পরকে শ্রদ্ধ ও ভয় করে, তবেই সমঝোতা সম্ভব, যদি দুর্বল পক্ষই কেবল আবেদন করে, তাতে তার দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। রক্ষাকবচ ও সমঝোতার বিষয়টা যদি ক্ষমতার দ্বারা পরিচালিত না হয়, তাহলে তা ছেঁড়া কাগজের টুকরা ছাড়া আর কিছুই হবে না। -তা বুঝতে রাজনীতি জ্ঞানের কোন প্রয়োজন হয় না। রাজনীতির অর্থই হল ক্ষমতার অধিকার –কেবল ইনসাফ, তার ব্যবহার আর সদিচ্ছার জন্য চিৎকার করলেই তা লাভ করা যায় না। –এরা (কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ) তিন রকম কথা বলেন। একটা কথা হচ্ছে, হিন্দু মুসলিম সমস্যা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আর একটা কথা হচ্ছে, ‘মুসলমানদের বর্তমান সংহত ও অসহায় অবস্থায় মুসলমানদের সামনে কিছু টুকরো টাকরা ফেলে দিলেই তাদের বশে আনা যাবে’। তৃতীয় কথাটি হচ্ছে, ‘নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখা যাচ্ছে না’। —আজ নিজেদেরকেই ভাগ্য নির্ধারণ করতে হবে। কেবল একটা মাত্র জিনিসই মুসলমানদের পারে তাদের হারানো বুনিয়াদ খুঁজে নিতে। তা হল, নিজেদের আত্মাকে জাগ্রত করতে হবে। নিজেদের মহান ভ্রাতৃত্বের বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে, একটা মাত্র রাজনীতির পতাকা তলে সমবেত হওয়ার সবক এখতিয়ার করতে হবে। মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক, মোসাহেব, প্রতিক্রিয়াশীল –এ ধরনের কোন শ্লোগান চিৎকারে বিচলিত হলে চলছে না। —এই সকল শব্দ মুসলমানদের মধ্যে হীনমন্যতা সৃষ্টির জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মুসলিম লীগ আইন পরিষদের ভেতরে বাইরে বৃটিশ সরকার বা কোন দল বা পার্টির হাতে মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে দেবে না। —-আমার বক্তব্য হলো, জনকল্যাণের জন্য গঠনমূলক ও প্রগতিশীল কোন কর্মসূচী প্রণয়ন করা আজ আমাদের অবশ্য কর্তব্য। সেই সাথে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নতির পন্থা ও উপায় আপনাদের খুঁজে নিতে হবে। —কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে শতবার চিন্তা ভাবনা করে দেখুন। কিন্তু যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, একপ্রাণ, এক দেহ নিয়ে তা কার্যকরী করুন”।–[‘Speeches & Writings of Mr. Jinnah’ জামিল উদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৯-২৪।]
মিঃ জিন্নার বক্তৃতার পর আরও কয়েকজন বক্তৃতা দিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলার জননেতা এ, কে, ফজলুল হক এবং মওলানা আকরম খাঁ। আকরম খাঁ হিন্দুদের বন্দেমাতরম সঙ্গীতের বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলেন শ্রোতাদের কাছে। আর এ, কে, ফজলুল হক তার বক্তৃতায় এমন কথা পর্যন্ত বললেন যে, ইউ, পি’র একজন মুসলমানের জানের বদলা বাংলায় আমরা দু’জনের জান নিয়ে ছাড়বো”।–[‘Pathway to Pakistan’, by Khaliquzzaman, Page 171.]
১৯৩৭ সালের মুসলিম লীগ সম্মেলনের মাধ্যমে লীগের নতুন উত্থান মুসলমানদের মধ্যে যেমন আশা, আবেগ, উন্মাদনার সৃষ্টি করলো, তেমনি কংগ্রেস ও হিন্দুদেরকেও সচেতন করে তুললো। ওয়াল্টার ওয়াল ব্যাংক-এর ভাষায় “মুসলিম লীগের পুনরুজ্জীবনে মিঃ নেহেরু ও তার সহকারীদের চৈতন্যোদয় হল। বিষয়টিকে তারা (মুসলিম লীগের) আপোষহীন মনোভাব হিসেবে গণ্য করলেন। এর পরেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একটা প্রস্তাব পাশ করল যাতে সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি পরিপূর্ণ মর্যাদা দানের কথা বলা হল”।–[‘A Short History of India and Pakistan’, টি. ওয়াল্টার ওয়ালব্যাংক, পৃষ্ঠা ১৮৮।] যে গান্ধী ১৯৩৭ সালের ১৯শে অক্টোবর কায়েদে আযমকে লিখলেন, “আপনার বক্তৃতা পড়ে মনে হলো এর সমস্তই যুদ্ধ ঘোষণা। তবে শুধু আশা করেছিলাম যে, আপনি অন্ততঃ এই বেচারীকে উভয়ের যোগসূত্র রূপে রাখবেন। (সে জন্য) আমি দুঃখিত। ঝগড়া করতে দু’জনের দরকার হয়। যদি আমি শান্তি প্রতিষ্ঠাকরী না হতে পারি তবু আমাকে (ঝগড়ার মধ্যে) এক পক্ষ হিসেবে পাবেন না।…..”-[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
গান্ধীর এ চিঠির জবাব দিলেন কায়েদে আযম ৫ই নভেম্বর তারিখে। তিনি লিখলেন, “—আমার বক্তৃতাকে যুদ্ধ ঘোষণা গণ্য করাতে আমি দুঃখিত। এটা সম্পূর্ণরূপে আত্মরক্ষামূলক। আবার পড়বে ও বুঝতে চেষ্টা করবেন। স্পষ্টতঃ আপনি গত বারো মাসের ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি দেননি। —আপনাযে ‘যোগ-সেতু ও মান্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে রাখা সম্বন্ধে (বলছি), আপনি কি মনে করেন না যে, আপনার পূর্ণ নিরবতা আপনাকে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে এক করে দিয়েছে, যদিও আপনি কংগ্রেসের চার আনা সদস্যও নন? —-পত্রে আমি কোন সুনির্দিষ্ট বা গঠনমূলক প্রস্তাব দেখতে পাচ্ছি না”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
এই ভাবে জিন্নাহ-গান্ধী পত্রালাপ চলল। ১৯৩৮ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী গান্ধী মিঃ জিন্নাহকে লিখলেন, “আপনি আমার নিরবতার জন্যে অভিযোগ করেছেন। এই নিরবতার কারণ সম্পর্কে আমি পুরোপুরিই সচেতন। —আপনার বক্তৃতা যে যুদ্ধ ঘোষণা তা আপনি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু আপনার পরবর্তী কালের বক্তব্য আমার প্রথম ধারণাকে সুদৃঢ় করেছে”।–[শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।] কায়েদে আযম এর জবাবে ১৫ই ফেব্রুয়ারী লিখলেন, “আপনার অভিমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনি লাক্ষ্ণৌর বক্তৃতা ও পরবর্তীকালের বক্তব্যগুলোকে যুদ্ধ ঘোষণা বলে মনে করেছেন, আসলে তা নয়। সে সব যে আত্মরক্ষামূলক বক্তব্য, সে কথাই আমি আবার বলব। —আপনি আরও বলেছেন, আমার বক্তব্যে আপনি সেই পুরাতন জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিটিকে খুঁজে পাননি। আপনার এ বক্তব্য কি সঠিক হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? জাতীয়তাবাদী কোন ব্যক্তি বিশেষের একচেটিয়া অধিকার নয়, বর্তমানের জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিরুপণও খুব সহজ নয়।—
মূল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা পত্র দ্বারা সম্ভব নয়”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।] এর উত্তরে গান্ধী ২৪শে ফেব্রুয়ারী লিখলেন, “হিন্দু মুসলিম বিষয়ে আমি ডাঃ আনসারির জীবিতকাল পর্যন্ত তার পরামর্শ মত চলতাম, তার মৃত্যুর পর মওলানা আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে আমার পরামর্শদাতা”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।] এরপর গান্ধী মিঃ জিন্নাহকে মওলানা আজাদের সাথে সাক্ষাত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মিঃ জিন্নাহ গান্ধীর এ কৌশল পছন্দ করেননি। তাছাড়া এ সময় জিন্নার কাছে বড় বিষয় ছিল আলোচনা কোন মর্যাদা নিয়ে হবে। মর্যাদার বিষয়টা সুচিহ্নিত হবার পরেই শুধু ঠিক হতে পারে আলোচনা কার সাথে কি নিয়ে হওয়া উচিত। ১৯৩৮ সালের ৩রা মার্চ জিন্নাহ গান্ধীকে লিখেছেন, “আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে মুসলিম লীগ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রাখা উচিত নয় যে, মুসলিম লীগই ভারতে একক ক্ষমতা সম্পন্ন ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান, পক্ষান্তরে কংগ্রেস ও গোটা দেশের অপরাপর হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসেবেই আপনি কথা বলছেন, —-মাত্র এই ভিত্তিতেই আমরা এখন এগিয়ে যেতে পারি”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
জিন্নার এ প্রস্তাব ছিল তখন কংগ্রেসের হজমের অযোগ্য বস্তু। এই পয়েন্টে এসেই জিন্নাহ-গান্ধী পত্রালাপ অচলাবস্থায় পৌঁছে। তবে ঠিক হলো যে, ১৯৩৮ সালের এপ্রিলে তারা সাক্ষাৎ করবেন।
গান্ধীর সাথে জিন্নার যখন পত্রালাপ চলছিল, সেই সময় ১৯৩৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী নেহেরু জিন্নাহকে পত্র লিখেন। যে নেহেরু হিন্দু মুসলমান সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করতেন না, সেই নেহেরুই ১৯৩৭ সালের মুসলিম লীগ (লাক্ষ্ণৌ) সম্মেলনের পর এই সমস্যার ব্যাপারে জিন্নার সাথে পত্রালাপ শুরু করলেন।–[জিন্নাহ নেহেরু এই পত্রালাপ ১৯৩৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিল।] নেহেরু এক পত্রে লিখলেন, “আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিষয়টি বিবেচনা করতে যাচ্ছি। আমার মনে হয় আপনি যে পথে এগুতে চান, তা আশাপ্রদ নয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমে তর্ক চালানো যে আদৌ সমীচিন নয় সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত। —-মতের পার্থক্য ও ঐক্যের আসল সূত্র কোনগুলি, তা জানার জন্যে আমি আগ্রহী। —-আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এ সম্পর্কে আমি এখনও অন্ধকারেই আছি। আপনারা শেষ পত্রেও এ বিষয়ে কোন আলোক দেখতে পাইনি। এ বিষয়ে যদি কোন আলোকপাত আপনি করেন এবং কোন বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে, যা বিবেচনা করা যেতে পারে, তা যদি আপনি দেখিয়ে দেন, তাহলে আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকবো”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। পৃষ্ঠা ৩৯-৪১]
মিঃ জিন্নাহ ৩রা মার্চ (১৯৩৯) নেহেরুর এ চিঠির জবাবে বললেন, “আপনার চিঠিতে আপনি যে বিষয়টার উপর জোর দিয়েছেন তা হলো, মতবিরোধের কারণগুলো এক এক করে আমাকেই ফর্দ করে আপনার বিবেচনার জন্যে আপনার কাছে পাঠাতে হবে। তারপর তার ভিত্তিতেই চিঠিপত্র লেনদেন হবে। আমার বিবেচনায় এটা আকাংখিত ও সুষ্ঠু পন্থা নয়। আপনি যে পন্থার উর জোর দিচ্ছেন, তা মামলারত কোন দুই ব্যক্তির ব্যাপারে খাটতে পারে, যেখানে এ পন্থায় সম্ভব নয়। —-আপনি যখন বলেন যে, আমার আশংকা হয় মতবিরোধের মূল কারণ কি তা জানি না, তখন আপনার এ অজ্ঞতায় কৌতুক বোধ না করে আমি পারি না। বিষয়টা সম্পর্কে পড়াশুনার জন্যে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। আত্মতৃপ্ত কোন মনোভাব গ্রহণ করবেন না”।–[শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। পৃষ্ঠা ৩৯-৪১]
জিন্নার এই চিঠির জবাবে নেহেরু তার ৭ই মার্চ (১৯৩৯)-এর চিঠিতে নিজেই বিরোধীয় তিন-[তিনটি বিষয়ঃ (ক) সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ যেখানে স্বতন্ত্র নির্বাচন ও আসন সংরক্ষণের বিষয় রয়েছে। (খ) ধর্মীয় অধিকারের নিশ্চয়তা এবং (গ) সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও এ বিষয়ের নিশ্চয়তা।] বিষয়ের উল্লেখ করে বললেন, “বর্তমানে এই তিনটিই হলো মূল বিষয়। আরো ছোট খান বিষয় থাককে পারে। কিন্তু যেহেতু আপনি মূল বিষয়ের কথা বলেছেন, সে জন্য সেগুলো আর উল্লেখ করলাম না। —-সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ-এর ব্যাপারে কংগ্রেসের অভিমত বিশ্লেষিত হয়েছে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারের নিশ্চয়তা কংগ্রেস যথাসাধ্য দিয়েছে। এ বাদেও যদি কিছু নিশ্চয়তার প্রয়োজন থাকে, তবে তার উল্লেখ করা প্রয়োজন…..”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। পৃষ্ঠা ৩৯-৪১] ১৯৩৯ সালের ১৭ই মার্চ জিন্নাহ নেহেরুর এ চিঠির জবাবে লিখলেন, “যে প্রশ্নটি নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম, আমি যতদূর বুঝেছি, সেটা ছিল, সরকারে, দেশের শাসনে ও জাতীয় জীবনে মুসলমানদের ধর্ম, তমদ্দুন, ভাষা, ব্যক্তিগত আইন এবং রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ সম্পর্কিত রক্ষাকবচ। এ ব্যাপারে বহু প্রস্তাবই দেয়া হয়েছে। আপনি সম্ভবতঃ ১৪ দফার নাম শুনে থাকবেন। —আমার মনে হয়, কংগ্রেসের হরিপুর অধিবেশনে আপনি বলেছিলেন, ‘অণুবিক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই আমি তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সমস্যা পর্যবেক্ষন করেছি। যদি আদতেই কিছু না থাকে তবে কি দেখতে পাওয়া যায়?’ সম্ভবতঃ আপনি মিঃ অ্যনের সাক্ষাতকার পড়ে থাকবেন। সেখানে তিনি মুসলিম লীগের কতিপয় দাবী তুলে ধরে কংগ্রেসের প্রতি হুসয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। পৃষ্ঠা ৩৯-৪১] নেহেরু এই চিঠির জবাব দিলেন ৬ই এপ্রিল তারিখে। এই চিঠিতে নেহেরু মুসলমানদের ডজনেরও বেশী দাবীর একটা তালিকা তুলে ধরলেন। তারপর এক এক করে তিনি দাবীগুলোর ব্যাপারে তার মত জানিয়ে দিলেন। জিন্নাহ এ চিঠির জবাবে লিখলেন, “আমি আপনাকে যা লিখেছিলাম, তা থেকে সরে গিয়ে বা তার বিকৃত অর্থ ধরে নিয়ে আপনি যা করছেন, তাতে আমি শুধু দুঃখই প্রকাশ করতে পারি। আপনার অনুরোধক্রমে যে বিষয়গুলি আপনার নিকট তুলে ধরেছিলাম, আপনি সে সবেরও ভুল ব্যাখ্যা করে বসে আছেন। চিঠিতে আপনি আগের থেকেই যেভাবে নিজের রায় দিয়ে দিয়েছেন এবং এতসংক্রান্ত বেশ কিছু সংখ্যক বিষয় সম্পর্কে আপনার অনড় সিদ্ধান্ত যেভাবে অগ্রিম প্রকাশ করেছেন, তাতে আমি বেশ দুঃখ পেয়েছি। এতে যে নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে, তাতে আলোচনার দ্বারা আর কোন সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। পৃষ্ঠা ৩৯-৪১]
এভাবেই জিন্নাহ নেহেরু পত্রালোচনার ইতি ঘটে। এই পত্রালাপ থেকে এ কথা পরিস্কার, (ক) কংগ্রেস মুসলমানদের সমস্যা বা বিরোধীয় বিষয়কে প্রথমে স্বীকৃতিই দিতে চায়নি, অজ্ঞতার ভান করে, (খ) পরে সমস্যাগুলো উল্লেখ করলেও সমাধানের ব্যাপারে নতুন কোন কথা বলেনি, পুরাতন সেই কথাগুলোই নতুন করে সামনে এনেছে, যার কারণে অতীতে বার বার সমঝোতা প্রচেষ্টা ভেঙে গেছে।
সুভাষচন্দ্র বসুর সাথেও ১৯৩৮ সালের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জিন্নার পত্রালাপ চলে। এ সময় সুভাষবসু কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবেই তিনি এ পত্রালাপ করেন। এ পত্রালাপেরও লক্ষ্য ছিল সমঝোতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু ফল হয়নি। আপোষ আলোচনা ব্যর্থ হবার প্রধান কারণ ছিল কংগ্রেস কর্তৃক মুসলিম লীগকে মুসমরানদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দানে অসম্মতি। সুভাষ বসুতার ১৯৩৮ সালের ২৫শে জুলাই তারিখের চিঠিতে মুসলিম লীগ সভাপতি মিঃ জিন্নাহকে জানান, “লীগের একক মর্যাদা স্বীকার করার বিরুদ্ধে হুসিয়ারী দিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির নিকট ইতিমধ্যেই অনেক চিঠিপত্র এসেছে। মুসলিম লীগের বাইরেও অনেক মুসলিম প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ সব পত্র লেখকের অনেকেই কংগ্রেসের গোঁড়া সমর্থক। —-তদুপরি, ব্যক্তিগতভাবেও অনেক মুসলমান কংগ্রেসের সদস্য। মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর এদের অনেকের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। বিপুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী সীমান্ত প্রদেশও কংগ্রেসের দৃঢ় অনুসারী। —-এমতাবস্থায় কংগ্রেসের পক্ষে মুসলিম লীগকে একমাত্র ক্ষমতাসম্পন্ন ও প্রতিনিধিত্বশীল মুসলিম প্রতিষ্ঠান (লীগের প্রস্তাব অনুসারে ‘একমাত্র’ শব্দটি বাদ দেওয়া সত্ত্বেও মূলতঃ এর অর্থ তাই দাঁড়ায়) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব নয়”।–[ শরিফুদ্দিন পীরজাদার ‘Quaid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। পৃষ্ঠা ৩৩-৪৬]
সুভাষ বসুর এ চিঠির জবাব দিলেন কায়েদে আযম ২রা আগষ্ট (১৯৩৮)। চিঠিতে তিনি বললেন, “উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যে কংগ্রেস-কোয়ালিশন উজীর সভা বিদ্যমান, সে বিষয়টি লীগ কাউন্সিল অবগত আছে। কিন্তু লীগ কাউন্সিলের দৃঢ় অভিমত হলো, কংগ্রেসের মধ্যেকার এই সব মুসলমান কখনো ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে না, করতেও পারে না। এর কারণও খুব সোজা। কারণ, তারা সংখ্যায় খুব নগণ্য। তাছাড়া কংগ্রেসের সদস্য হওয়ার দরুন তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হওয়ার বা তাদের তরফ থেকে কথা বলার অধিকার হারিয়েছে। —(যে সব মুসলিম প্রতিষ্ঠানের কথা কংগ্রেস বলেছে) —ঐ সব প্রতিষ্ঠান যদি এককভাবে বা যুক্তভাবে মুসলমানদের তরফ থেকে কথা বলার অধিকারী হতো, তাহলে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বা মিঃ গান্ধীর পক্ষ থেকে হিন্দু মুসলমান সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে মুসলিম লীগের সাথে যোগাযোগ করার কোনই প্রশ্ন উঠতো না”।–[‘Quid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’ শরীফ উদ্দীন পীরজাদা, পৃষ্ঠা ৩৩-৪৬।]
জিন্নার এই যুক্তির কোন জবাব ছিল না কংগ্রেসের কাছে। জিন্নার এই চিঠির কোন জবাব দেননি সুভাষ বসু। জবাব দেয়ার কিছু ছিল না। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারী নির্বাচনের পর মুসলিম লীগ সর্ববৃহৎ এবং একমাত্র সর্বভারতীয় মুসলিম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু তখনও যে দুর্বলতা লীগের ছিল, সে দুর্বলতা ১৯৩৭ সালের অক্টোবরের লীগ সম্মেলনের পর কেটে যায়। মুষ্টিমেয় কিছু কংগ্রেসী মুসলমান ছাড়া মুসলিম লীগ এখন মুসলিম জনগণের সংগঠনে পরিণত হয়েছে, একথা বুঝেই তো নেহেরু, গান্ধী এবং সুভাষ মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নারসাথে আলোচনা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এই বুঝাটা তারা মুখে স্বীকার করতে চাইল না। এর কারণ বোধ হয় এটাই যে কংগ্রেস কোন নিরপেক্ষ সংগঠন ছিল না। ভারতের অচ্ছুত (হরিজন) সম্প্রদায়ের নেতা ডক্টর আম্বেদকরের ভাষায় “কংগ্রেস যে একটি হিন্দু সংস্থা, তা অস্বীকার করে লাভ নেই। যে প্রতিষ্ঠান হিন্দুদের প্রাধান্য তাতে কার্যতঃ হিন্দু মানসিকতার প্রতিফলন হবেই এবং হিন্দুর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন জানাতে হবেই। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে একটিই পার্থক্য রয়েছে। তা হল, মহাসভার বক্তব্য কিছু রূঢ় এবং কংগ্রেসের বক্তব্যে থাকে রাজনীতি এবং ভদ্রতা”।–[‘Pakistan or the Partition of India’, বি. আর. আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ৩০।] এই হিন্দুবাদী সংগঠন কংগ্রেস, যার লক্ষ্য গোটা ভারতের উপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, মুসলিম লীগকে স্বীকৃতি দিতে পারে না। কারণ তার ফলে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও তাদের দাবীর বৈধতাও স্বীকার করে নিতে হয় এবং ভারতের উপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তাহলে আর কোন পথ থাকে না। সুভাষ বসুর সাথে আলোচনার সময় মুসলিম লীগ মুসলমানদের একক সংগঠন হবার দাবী পরিত্যাগ করেছিল শুধু কংগ্রেসকে তুষ্ট করার জন্যেই, তবু কংগ্রেস মুসলিম লীগকে মেনে নেয়নি।–[‘জিন্নার কাছে লেখা সুভাষবসুর ২৫শে জুলাই, ১৯৩৮-এর চিঠি দ্রষ্টব্য।] এই অস্বীকৃতির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে এক উৎকট মুসলিম বৈরিতা, এক সীমাহীন মুসলিম বিদ্বেষ এবং এক ভয়ংকর সংহার মূর্তি ভদ্র ভাষার বাঁধনে প্রচ্ছন্ন ছিল। এরই নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখেছি ভারতে কংগ্রেস শাসিত ও প্রভাবিত প্রদেশগুলোতে। ১৯৩৭ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৯৩৯ সালের ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত ভারত শাসন আইনের অধীনে কংগ্রেস ভারতে ছয়টি প্রদেশে-[যুক্ত প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ, মাদ্রাজ ও বোম্বে।] ক্ষমতাসীন ছিল। এই কংগ্রেসী শাসনে মুসলমানরা ধর্ম, সংস্কৃতি, চাকুরী, ব্যবসায় সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়। ইংরেজ লেখক আয়ান স্টিফেনের ভাষায় “যুক্ত প্রদেশ ও অন্যান্য স্থানের প্রাদেশিক মন্ত্রীরা ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার বিষয়টাকে নিজেদের দৈনন্দিন কাজের অঙ্গীভূত করে নেন। এত অহিন্দুদের মধ্যে বিরূপতা দেখা দেয়। মুসলমানদের উপর সব রকমের চাপ ও হয়রানির অভিযোগ শোনা যেতে থাকে। স্কুলের ছাত্রদের হিন্দু পদ্ধতিতে জোড় হাতে মিঃ গান্ধীর প্রতিৃকতি পূজা করার ব্যবস্থা চালু করা হয়। বঙ্কিম চট্টোপাধ্যয়ের আপত্তিকর উপন্যাসের ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতও ছাত্রদের গাইতে বলা হয়। গরুর গোশত খাওয়া বন্ধের জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চলে। উর্দু ভাষা ও বর্ণমালা বন্ধ করার ব্যবস্তা করা হয়। বড় বড় চাকুরীতে হিন্দুদের নিয়োগ করা হতে থাকে”।–[‘Pakistan Old Country: New Nation’, Jon Stephens, Page 93.] কংগ্রেস মন্ত্রীসভার দু’বছর শাসনকালে ৩০টি ভয়াবহ ধরনের দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে কংগ্রেসের পূর্ণ সমর্থক মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর বাসস্থান ফয়জাবাদ জেলার টাণ্ডা নামক ছোট্ট শহরে দাঙ্গায় সত্তর জন মুসলমান পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এবং দু’শ জনকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরানো হয়। মধ্য প্রদেশের চাঁদপুর বিশোয়ারায় প্রায় চার’শ মুসলমানকে গ্রেফতার করে দড়ি দি পা বেঁধে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে। সেসন কোর্টে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ২ জনের ফাঁসি, ২৪ জনের দ্বীপান্তরবাসের দন্ড দেয়া হয়। হাইকোর্ট-[হাইকোর্টের অধিকাংশ বিচারক তখন ইংরেজ।] এদের সকলকেই খালাস দেয় এবং রায়ে বলে যে, “মামলাটা বড় করুণ। সাক্ষীর পর সাক্ষী যে জবানবন্দী দিয়েছে, তার প্রত্যেকটাই মিথ্যা। —-সম্পূর্ণ মামলাটাই সাজানো। এ যেন এমন একটা বীভৎস উৎসব যাতে সাক্ষীরা কে কতজন মুসলমানকে ফাঁসির কাঠে ঝোলাতে পারে, তাই নিয়ে পরস্পরের প্রতিযোগিতা চলেছে”।–[‘কায়েদে আযম’, (আকবর উদ্দীন) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৪০১।] এইভাবে নিম্ন আদালতগুলোতে কংগ্রেসী মন্ত্রীরা ও পরিষদ সদস্যগণ হস্তক্ষেপ করতেন এবং কোর্টকে প্রভাবিত করতেন, যার কারণে এলাহাবাদ হাইকোর্টকে তার এক রায়ে বলতে হয়, “এটা প্রত্যেকেরই জানা উচিত যে, এই কোর্ট তার কোন বিচারকের উপর, বিশেষতঃ অসহায় জুনিয়র বিচারকদের উপর প্রভাব বিস্তার বরদাশত করবে না”।–[‘Pirpur Report, 1939’, পৃষ্ঠা ১৮ (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪০২।] দুই বছরের শাসনে কংগ্রেস ছয়টি প্রদেশে যে কি বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ তদানীন্তন ‘পীরপুর রিপোর্ট’ ও ‘শরিফ রিপোর্টে’ পাওয়া যায়। সরেজমিন তদন্তের পর মুসলিম লীগ নিয়োজিত কমিশন এ রিপোর্ট তৈরী করেছিল। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল সে সম্পর্কে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক জওহর লাল নেহেরুকে লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে বলেছিলেন, “কংগ্রেসের নীতির দরুণ এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যেখানে (পূর্বের) অদলীয় সরকারসমূহ কর্তৃক আরোপিত বিধি নিষেধের বেড়া মারমুখো হিন্দরা ভেঙ্গে ফেলেছে। মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপরে তারা নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাদের ইচ্ছা কি? —না, গোমাতাকে সম্মান দেখাতেই হবে, মুসলমানদের গরুর গোশত খেতে দেয়া হবে না, মুসলমানদের ধর্মকে হেয় করতেই হবে, কেননা এটা কি হিন্দুর দেশ নয়? সে কারণেই আজান দেয়া বারণ করা, মসজিদে মুসল্লীদের উপর হামলা, নামাযের সময়মসজিদের সামনে বাজনা বাজানোর মত কাজ হচ্ছে। —-সুতরাং মর্মান্তিক ঘটনার পর মর্মান্তিক ঘটনা যদি ঘটেই চলে এবং দুধের নহরের পরিবর্তে যদি রক্তের স্রোত বয়ে থাকে, তবে বিস্ময়ের কি আছে”।–[‘Towards Pakistan’ by Wahiduzzaman, Page 1]
ভারতের ছয়টি প্রদেশে কংগ্রেসী শাসন সম্পর্কে বিদেশীদের মন্তব্য থেকেও কংগ্রেসের স্বরূপ পরিস্কার হয়ে যায়। ইতিহাসকার টি, ডব্লিউ, ওয়ালব্যাংক লিখছেন, “এদেশে কংগ্রেস শাসনের এমন অন্যান্য দিক রয়েছে, যাতে মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ ও ভীত হয়ে উঠেছিল। —-‘সরকারী চাকুরীর প্রায় সবগুলো পদে কংগ্রেসীদের নিয়োগ করা হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকার মুসলমানদের উর্দু ভাষার পরিবর্তে হিন্দীকেই শিক্ষার মাধ্যম করার দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। সর্বশেষ কংগ্রেস গণ-সংযোগ অভিযানের নামে মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে টেনে এনে নেহেরু ও গান্ধীর দলে ভিড়ানোর ব্যবস্থা করে”।–[‘A Short History of India and Pakistan’, টি, ডব্লিউ, ওয়ালব্যাংক, পৃষ্ঠা ১৮৭।] সি, বি, বার্ড উড লিখছেন, “কংগ্রেসের রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে এমন এক ধরনের টোটালিটারিয়ান নিয়ন্ত্রণ যেখানে সকল প্রকার বিরুদ্ধবাদিতাকে জাতীয় যন্ত্রের মত শোষণ করাই তার নিয়ম”।–[‘A Continent Experiments’, সি, বি, বার্ডউড, পৃষ্ঠা ১৯।] লণ্ডনের ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ানে প্রকাশিত (১৮ই আগষ্ট, ১৯৪২) এক পত্রে ভারতীয় খৃষ্টান রেভারেণ্ড বানার্জী বলেন, “এ সময়ে কংগ্রেস ছিল জার্মানীর নাৎসী দলের ভারতীয় সংস্করণ”। একজন বৃটিশ পর্যটক এফ, ইয়েটস ব্রাউন লিখছেন, “কংগ্রেস শাসনের প্রথম দু’বারের মধ্যে দাঙ্গা দ্বিগুণ হয়েছে”।–[‘The Indian Pageant’, এফ, ইয়েটস ব্রাউন, পৃষ্ঠা ১৪৯।] স্যার জেমস ক্রেয়ার বলেছেন, “কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে যেগুলি সুপরিকল্পিত এবং মুসলমানদের সন্দেহ প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট।–[‘Fortnightly Review, March, 1940, ‘India and Future’ (প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)।] এল, এফ, রাশব্রুক উইলিয়ামস লিখেছেন, “কংগ্রেস শাসন থেকে সংখ্যালঘুরা এই সত্যই উপলব্ধি করতে পারলো যে, প্রশাসনিক, এমনকি শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচ তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। কেননা, বিষয়টা শাসক গোষ্ঠীর মানসিকতার সাথে জড়িত। আর শাসক দল অর্থাৎ কংগ্রেস অপরাপর দলগুলিকে রাজনীতির ক্ষেত্রে পরাজিত বলেই মনে করে। তাছাড়া, সমঝোতা বলে কোন শব্দ কংগ্রেসের অভিধানে আছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস কেবলমাত্র নিজেকেই প্রগতি, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের ‘সোল এজেণ্ট’ বলে মনে করে”।–[‘Reflections of Indian Discontent’, এল, এফ, রাশব্রুক উইলিয়ামস, পৃষ্ঠা ২৩৮, ২৩৯।]
কংগ্রেস শাসন মুসলমানদের এই উপলব্ধিই দিয়েছিল। ১৯৩৯ সালের ২২শে মার্চ ভারতীয় আইন পরিষদে এক বিতর্ককালে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বললেন, “সে কারণেই তাদের (কংগ্রেসের) প্রতি আমার বক্তব্য হলো, আপনাদের সাথে আমাদের কোন সহযোগিতা চলতে পারে না। হয়তো তারা বলবেন, ঠিক আছে এখানে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। হ্যাঁ, আপনারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেন, আপনারা অগ্রগামী থাকতে পারেন, আর্থিক দিক থেকেও আপনারা শক্তিশালী হতে পারেন এবং একথাও আপনারা ভাবতে পারেন যে, সংখ্যা গণনাই এখানে শেষ কথা। কিন্তু আমি আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই, আপনাদের উভয়কেই (সরকার ও কংগ্রেসকে) পরিস্কার করে বলে দিতে চাই, আপনারা এককভাবে বা যৌথভাবে আমাদের এই জাগরণকে বানচাল করতে পারবেন না। যে ইসলামী সংস্কৃতি কৃষ্টির আমরা উত্তরাধিকারী, সেই কৃষ্টি সংস্কৃতিকে আপনারা কোন দিনই ধ্বংস করতে পারবেন না। এই যে প্রেরণা, তা ছিল, এখনও আছে এবং চিরকাল থাকবে। আপনারা আমাদের বল প্রয়োগ দ্বারা কোণঠাসা করতে পারেন, আমাদের উপর জুলুম চালাতে পারেন এবং যা খুশী আমাদের অনিষ্টও আপনারা করতে পারেন, কিন্তু শেষ বারের মতো আমরা এই কঠোর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, যদি আমাদের ধ্বংসই হয়ে যেতে হয়, তাহলে সংগ্রাম করেই আমরা ধ্বংস হবো।
—-বৃটিশ সরকার আমাদের প্রাথমিক অধিকার ও নাগরিকত্বের মর্যাদা সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গভর্ণর ও গভর্ণর জেনারেল বিশেষ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলি এখণ প্রতারণা অপেক্ষাও জঘন্য প্রমাণিত হয়েছে”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, জামিল উদ্দীন আহমদ পৃষ্ঠা ৮৪, ৮৫।] উল্লেখ্য, এর মাস আড়াই আগে মুসলিম লীগের পাটনা সম্মেলনেও মিঃ জিন্নাহ এ ধরনের কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, “কংগ্রেস হিন্দু মুসলিম সমজোতার আশা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, জামিল উদ্দীন আহমদ পৃষ্ঠা ৭০।]
বৃটিশ সরকারের অধীনে প্রদেশ শাসনের কর্তৃত্ব পেয়ে কংগ্রেস অর্থাৎ হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতি যে মারমুখো আচরণ করলো তাতে স্বাধীন ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের রূপ কেম হবে তা মুসলমানরা বুঝল। মুসলমানরা উপলব্ধি করল, স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্র মুসলমানদের কোন কাজেই আসবে না। গণতন্ত্রের পোশাকে সংখ্যাগুরুর শাসন ভয়াবহ ধরনের জাতীয় স্বৈরতন্ত্রের রূপ শাসন আইন কিংবা সংখ্যাগুরুর শাসন ভয়াবহ ধরনের জাতীয় স্বৈরতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করবে। এই উপলব্ধি থেকে মুসলিম লীগ ভাবল, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন কিংবা সংখ্যালঘুদের জন্যে শাসনতান্ত্রিক কোন গ্যারাণ্টি মুসলমানদেরকে সংখ্যাগুরুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবেনা। সুতরাং হিন্দু মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা হওয়া উচিত বলে মুসলিম লীগ মনে করতে লাগল। মিঃ জিন্নাহ ১৯৩৯ সালের শেস দিকে লণ্ডনের ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ানকে একটা সাক্ষাতকার দনে। তাতে এই চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সে সাক্ষাতকারে তিনি বলেনঃ “প্রতিনিধিত্বমূলক কোন সরকারের সম্পর্কে মুসলমানদের সর্বদাই ভীতি ও ও আশঙ্কা ছিল, ভারতে গণতন্ত্র প্রবর্তন সম্পর্কে তো বটেই। ১৯০৮ সালের মর্লি-মিণ্টো সংস্কারে ও ১৯১৬ সালে লাক্ষ্ণৌতে হিন্দু মুসলিম চুক্তিতে মুসলমানেরা যে স্বতন্ত্র নির্বাচন, ওয়েটেজ, নির্ধারিত রক্ষা-কবচ চাচ্ছিল, তা ছিল সেই ভীতি ও আশঙ্কারই বহিঃপ্রকাশ। প্রদেশসমূহে এই নতুন শাসনতন্ত্র চালু হওয়ার পর বিষয়টা (মুসলমানদের আশঙ্কা) সন্দেহাতীত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষতঃ কংগ্রেস হাই-কমাণ্ড যেভাবে নিজেদেরনীতি ও কর্মসূচী বাস্তবায়িত করে চলেছেন, তাতে দেশের অপরাপর দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজেকে নিকৃষ্টতার ফ্যাসিবাদী ও ক্ষমতাশালী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত কাই যে কংগ্রেসের মতলব-তা প্রকট হয়ে উঠেছে। শাসনতন্ত্রের কার্যক্রমের দ্বারা এটাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারতে গণতান্ত্রিক পার্লামেণ্টারী সরকার গঠন অসম্ভব। কেননা, এর ফলে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সরকারই চিরদিনের মত হাতিয়ারের সহায়তায় এই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের উপরে নিজেদের শাসন ও প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
সুতরাং অন্যান্য কারণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা না করেও একথা আমি বলতে পারি যে, আমার বিচার বিবেচনায়, ভারতে গণতন্ত্রের অর্থই হবে হিন্দুরাজ কায়েম করা। কিন্তু মুসলমানেরা এই অবস্থার নিকট কোনক্রমেই নতি স্বীকার করতে পারেনা। এ ছাড়াও ছয় কোটির মত অস্পৃশ্য রয়েছে, প্রায় ষাট লক্ষের মত রয়েছে খৃষ্টান, ইহুদী, পারশিক ও বৃটিশ নাগরিক। সুতরাং সকল দিক সতর্কতার সাথে বিবেচনা করেই মুসলিম লীগ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের সমস্যাবলী পুনর্বার নতুন করে বিবেচনা করতে হবে। এবং যেহেতু মুসলিম লীগই ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু মুসলিম লীগের সমর্থন ও অনুমোদন ব্যতীত মহামান্য সরকারের পক্ষে কোন ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি দান করা উচিত হবে না।
মুসলমানেরা ভারতে আজাদী কামনা করে না, এ ধরনের কোন অপপ্রচারে হয়ত বৃটেনবাসীরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। আমরা নিঃসন্দেহে আজাদী ও মুক্তি কামনা করি। তবে প্রশ্ন হল যে, মুক্তি কার এবং সে আজাদী কাদের? মুসলিম ভারত পূর্ণ আজাদী ও পূর্ণ মুক্তিই কামনা করে। এবং নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিষয়সমূহ নিজেদের প্রতিভা অনুযায়ী বিকাশ সাধনের পক্ষপাতী। তারা কারো দ্বারা শাসিত বা ধ্বংস হতে চায় না এবং সেই সাথে তারা এও চায় হিন্দু ভারতেও তারা (হিন্দুরা) অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক।
কংগ্রেস জোর দিয়ে বলেছে যে, তারাই শুধু ভারতীয়দের প্রতিনিধি। তাদের এই দাবী যে শুধু ভিত্তিহীন তাই নয়, ভারতের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। তারা নিজেরাও এটা ভাল করেই জানে যে, তারা গোটা ভারতের প্রতিনিধি নয়। এমনকি তারা গোটা হিন্দু সমাজেরও প্রতিনিধি নয়। মুসলমানদের জন্য তো নয়ই। যদিও তারা পাশ্চাত্যের সাধারণ চলতি অভিমতানুসারে, মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবেই অভিহিত করতে চায়, তবুও আসল সত্য এই যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে ও বাংলায় মুসলমানেরা নিঃসন্দেহে সংখ্যাগরিষ্ঠ। করাচী থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতের এই এলাকায় যে জনসংখ্যার বাস সংখ্যার দিক থেকে তা গ্রেট বৃটেনের দ্বিগুণ এবং আয়তনের দিক থেকে দশ গুণ বড়। কংগ্রেস যতদিনে অহমিকার এই আসমান থেকে মাটিতে নেমে না আসবে এবং বাস্তবতার মুখোমুখি না দাঁড়াবে ততদিন পর্যন্ত ভারতে অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য দায়ী হবে তারাই। ফ্যাসিবাদ ও গায়ের জোরে আজ তারা যে নীতি ও কর্মসূচী ব্যাপক ভাবে চালু রেখেছে তাতে ভারতে কোন দিনই শান্তি কায়েম হতে পারে না”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, জামিল উদ্দীণ আহমদ, পৃষ্ঠা ৮৮-৯১]
১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো জার্মানী কর্তৃক পোলণ্ড আক্রমণের মাধ্যমে। আর ৩রা সেপ্টেম্বর বৃটেন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। যুদ্ধ ঘোষণার পর বৃটেন স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয়দের সাহায্য-সহযোগিতা কামন করলো। বৃটেনের এ কেবায়দা অবস্থাকে কংগ্রেস একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহন করল। ইতিপূর্বেও কংগ্রেস যখনই সুযোগ পেয়েছে বৃটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করেছে। সে স্বার্থটা হলো, ভারতের কর্তৃত্ব একক ভাবে কংগ্রেসের হাতে পাওয়া। এবারও তাই করল। কংগ্রেস সহযোগিতা শর্ত হিসেবে যে দাবীগুলো পেশ করলো, তাকে এ চারটি দফায় ভাগ করা যায়ঃ
(১) বৃটেনকে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ঘোষণা করতে হবে। অন্য কথায় নাৎসীবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই যদি এই যুদ্ধ হয়, তাহলে ভারত থেকেও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান করতে হবে এবং ভারতের শাসনব্যবস্থা ও যুদ্ধ পরিচালনায় মিত্র শক্তিবর্গের সঙ্গে সহযোগিতার পূর্ণ দায়িত্ব ভারতকেই দিতে হবে।
(২) এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গভর্ণর জেনারেলে একজিকিউটিভ কাউন্সিল কার্যতঃ বাতিল করে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ক্যাবিনেট গঠন করতে হবে।
(৩) কংগ্রেস ভারতের সকল শ্রেণীর জনসাধারণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিধায় ক্যাবিনেট গঠনের দায়িত্ব কংগ্রেসকে দিতে হবে এবং কংগ্রেস মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ক্যাবিনেট গঠন কার্যে সমঝোতা করবে।
(৪) স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে গণ-পরিষদ গঠন করতে হবে এবং এই গণ-পরিষদ যে শাসনতন্ত্র তৈরী করবে, বৃটিশ সরকার ও পার্লামেণ্টকে সেটা চূড়ান্ত বলে স্বীকার করে নিতে হবে।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪৯১।]
কংগ্রেসের এ দাবীর এক কথায় অর্থ কংগ্রেসের হাতে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কংগ্রেসই ক্যাবিনেট গঠন করবে, সেই যুদ্ধ পরিচালনা করবে এবং তার নিয়ন্ত্রিত গণপরিষদই চূড়ান্ত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে, তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরের আর বাকি কোথায়। ক্যাবিনেট গঠনে মুসলিম লীগের সাথে সমঝোতার কথা কংগ্রেস বলেছে বটে, তবে সমঝোতা হবে কংগ্রসের কর্তৃত্বের অধীনে। সুতরাং কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। ভারতের ভাইসরয় কংগ্রেসের এ দাবীর জবাবে যা বললেন তা হলো:
(১) বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে যুদ্ধের লক্ষ্য সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ধারণা করা যায়। তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে সকল দেশের জনসাধারণ যাতে শান্তিতে বাস করতে পারে, আক্রমণের ভয়ে সর্বদা সশঙ্কিত না থাকে সেই ব্যবস্থা করার জন্যই এই যুদ্ধ। এই প্রসঙ্গে অন্যতম বৃটিশ নেতা স্যার স্যামুয়েল হোর বলেছিলেন, বৃটেন সাম্রাজ্যবাদের পর্যায় অতিক্রম করেছে এবং অন্যান্য দেশের জনসাধারণকে স্বায়ত্বশাসনে সাহায্য করাই তার বর্তমান নীতি।
(২) যুদ্ধ চলার সময় নতুন শাসনতন্ত্র তৈরী করার কাজে মনোনিবেশ করা যেতে পারে না। তবে যুদ্ধান্তে বৃটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতাদের ও দেশীয় রাজ্যসমূহের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন শাসনতন্ত্র তৈরীর ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত আছে।
(৩) ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধিতের গভর্ণর জেনারেলের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে যোগদানের উদ্দেশ্যে কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে এবং তাদের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের জন্য সদস্যদের সমান মর্যাদা, ক্ষমতা ও ভাতা দেওয়া হবে। তাছাড়া যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি পরামর্শ সংস্থা গঠন করা হবে।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪৯১, ৪৯২, ৪৯৩।]
বৃটিশ সরকার কংগ্রেসের দাবী মানল না, কিন্তু তারা একটা জিনিস মানল, যুদ্ধের পর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বদলে নতুন শাসনতন্ত্র তৈরী করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগও ভারতের বৃটিশ সরকারের কাছে কতিপয় দাবী উত্থাপন করল। ৫ই নভেম্বর (১৯৩৯) লীগ সভাপতি মিঃ জিন্নাহ যুদ্ধে সহযোগিতার শর্ত হিসেবে নিম্নলিখিত চারটি দাবী উত্থাপন করলেন এবং জবাব চাইলেনঃ
(১) অবস্থানুযায়ী যথাসম্ভব শীঘ্র, অথবা যুদ্ধের অব্যাবহিত পরে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছাড়াও ভারতের দাবী শাসনতন্ত্রের সমস্যা সম্পূর্ণরূপে নতুনভাবে পরীক্ষা ও পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
(৩) ফিলিস্তিনের আরবদের সকল ন্যায়সঙ্গত দাবী বৃটিশ সরকারকে পূরণ করতে হবে।
(৪) কোন মুসলিম শক্তি বা দেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের নিয়োগ করা হবে না।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪৩১, ৪৯২, ৪৯৩।]
এই দাবী উত্থাপন ছাড়াও জিন্নার চিঠিতে কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস সরকার কর্তৃক মুসলমানদের উপর অত্যাচার অবিচারের প্রতিকার দাবী করা হয়।
ভারতের বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে জিন্নার এ চিঠির জবাব দেয়া হলো ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে। বলা হলোঃ
(১) আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এই যে, বৃটিশ সরকারের অনুমোদন মোতাবেক ১৮ই অক্টোবর তারিখে আমি যে ঘোষণা প্রকাশ করেছিলাম তদ্বারা ১৯৩৫ সালের আইনের কোন অংশ অথবা তৎ-ভিত্তিক কোন নীতি ও পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনার বহির্ভূত নয়।
(২) দ্বিতীয় প্রশ্ন সম্বন্ধে আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, ভারতের শাসনতান্ত্রিক গুরুত্ব সম্পর্কে বৃটিশ সরকার সম্পূর্ণ অবহিত এবং এ বিষয়ে কোন ভুল ধারণা থাকা ঠিক নয়।
(৩) বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনে আরবদের যুক্তিসঙ্গত দাবী পূরণের চেষ্টা করে আসছে এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন।
(৪) পরিশেষে আপনি ভারতের বাইরে কোন মুসলিম শক্তি বা দেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণ না করার বিষয় উল্লেখ করেছেন। সৌভাগ্যবশতঃ প্রশ্নটি অবাস্তব। কারণ, বৃটিশ সরকার কোন মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নয়। অবশ্য আপনি বুঝতে পারেন যে, এ রকম একটা ব্যাপক নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এর ফলে ভবিষ্যতে অচিন্তিতপূর্ব পরিস্থিতিতে ভারতের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী বৃটিশ সরকার ভারতের মুসলমানদের মনোভাব সংরক্ষণের জন্য সর্বপ্রকার সতর্কতা অবলম্বন করেছেন”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪৯১, ৪৯২, ৪৯৩।]
এখানে উল্লেখ্য, এর আগে ১লা নভেম্বর, ১৯৩৯ তারিখে ভারতের বৃটিশ ভাইসরয় গান্ধী, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও জিন্নাহকে আলোচনার জন্যে ডেকেছিলেন এবং লীগ ও কংগ্রেসের প্রস্তাবের বিরাট ব্যবধানের কথা উল্লেখ করে এ সম্পর্কে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আগে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতার আহবান জানান। এই আহবান সামনে রেখে কায়েদে আযম জিন্নাহ সমঝোতার জন্যে নিম্নলিখিত শর্ত আরোপ করেনঃ
“(১) প্রদেশসমূহে যুক্ত বা কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন, (২) প্রাদেশিক আইন পরিষদসমূহে মুসলিম বিরোধী আইন প্রণয়নকালে মুসলমান সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ বিরোধিতা করলে উক্ত রূপ আইন প্রণয়ন করা হবে না, (৩) সরকারী বা পাবলিক ভবনসমূহে কংগ্রেসী পতাকা তোলা যাবে না, (৪) বন্দে মাতরম সঙ্গীত সম্বন্ধে একটা সমঝোতা করতে হবে, (৫) মুসলিম লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা থেকে কংগ্রেসকে বিরত হতে হবে”।–[দ্রষ্টব্য: ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪৯১, ৪৯২, ৪৯৩।]
মুসলিম লীগের এ শর্তগুলো ভারতের বৃটিশ ভাইসরয় আইন পরিষদে কংগ্রেস দলের প্রধান ভুলাভাই দেশাই-এরসাথে আলোচনা করেন। কিন্তু গান্ধীর মনোভাব আপোশ আলোচনা বানচাল করে দেয়। ফলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে, লীগ-কংগ্রেসের মধ্যে সাময়িক যে আপোষ হতে পারতো তা আর হলোনা।
এদিকে কংগ্রেসের দাবী ভারতের বৃটিশ সরকার প্রত্যাখ্যান করায় এর প্রতিবাদে ১৯৩৯ সালের ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে সমস্ত কংগ্রেস মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করল এবং তাদের দাবী মেনে নিতে বৃটিশকে বাধ্য করার জন্য ধর্মঘট, মিছিলসহ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে দিল। এই ব্যাপারটা বৃটিশও ভালভাবেই অনুভব করেছিল। ১৯৩৯ সালের ২রা নভেম্বর বৃটিশ “হাউস অব লর্ডসে” বক্তৃতা দিতে গিয়ে মার্কুইস অব স্যালিসবারী সরকারের পক্ষ থেকে বলেন, “কংগ্রেস আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বৃটেনকে বাধ্য করতে চায়”।–[‘The Struggle for Pakistan’, আই, এইচ, কোরায়শী, পৃষ্ঠা ১৪৭।]
মুসলমানদের কংগ্রেস শাসন থেকে মুক্তি করায় মুসলিম লীগ ২২শে ডিসেম্বর ‘নাজাত দিবস’ ঘোষণা করল।
মুসলিম লীগ কংগ্রেসের নতুন আইন অমান্য আন্দোলনকে ভয়ের চোখে দেখল। যুদ্ধের কারণ দুর্বল হয়ে পড়া বৃটিশ সরকার কংগ্রেসের সমর্থন আদায়ের জন্যে কংগ্রেসের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে পারে, এ ভয় তারা করল। এ ভয় তাদের বাড়ল স্যার জাফরুল্লাহ খানের কথায়। জাফরুল্লাহ খান ১৯৪০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী গোপনে একজন মুসলিম সদস্যকে বললেন, “বৃটিশ সরকার কংগ্রেসকে তোষণের জন্যে অনেকদূর অগ্রসর হতে প্রস্তুত। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগের কোন রকম সমঝেঅতায় উপস্থিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন, নতুবা You may miss the bus.”-[Path way to Pakistan, by: Khalikuzzaman, Page 232] স্যার জাফরুল্লাহর কথা অবিশ্বাসের কোন উপায় ছিলনা, কারণ ‘তিনি ভারতের বৃটিশ ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিল’ এর সদস্য বিধায় তিনি অনেক কিছুই জানতে পারেন। কিন্তু কংগ্রেসের সাথে সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব ছিলনা মুসলিম লীগের। এই কথায় জিন্নাহ বললেন আলিগড়ের এক ছাত্র সভায়। বললেন তিনি, “মিঃ গান্ধীর শর্তে কোন সমঝোতা সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ সম-পর্যায়ভুক্ত গণ্য না করলে সমঝোতা হতে পারে না। যে কোন হিন্দুর মতো আমাদেরও এই দেশের শাসন ব্যবস্থায় অংশ গ্রহণ করার অধিকার আছে। —কংগ্রেস ক্ষমতা হাতে পেয়ে দেশের উপর হিন্দুদের পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখেছিল”।–[১৯৪০ সালের ৬ই মার্চ কায়েদে আযম আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সভায় এ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ‘(কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৪৬৯) এই ছাত্র সভায় কায়েদে আযম আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। সেটা হলো, ‘ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়, তারা স্বতন্ত্র একটা জাতি। স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে তাদের মর্যাদা সব দিক দিয়ে হিন্দুদের সমকক্ষ’।]
এই আধিপত্যকে আরও সার্বিক ও সুবিস্তৃত করার জন্যেই কংগ্রেস নতুন করে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করল। এই অবস্থায় কংগ্রেসের সাথে যেমন সমেঝাতা সম্ভব নয়, তেমনি এক শাসনতন্ত্রের অধীনে তাদের সাথে বসবাসও সম্ভব নয়। মুসলিম লীগ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার পরই জিন্নাহ ১৯৪০ সালের ৬ই মার্চ ভারতের বৃটিশ ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাত করে তাকে জানিয়ে দিলেন, “২৩শে মার্চের সাধারণ অধিবেশনে মুসলিম লীগ ভারত বিভাগের দাবী করবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫১১।] এটা কায়েদে আযমের স্বকল্পিত বা হঠাৎ করে বলা কোন উক্তি ছিলনা। এর দু’দিন আগে ৩রা ও ৪ঠা মার্চ মুসলিম রীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।
১৯৪০ সালের ২২শে মার্চ লাহোরে বসল মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সাধারণ অধিবেশন। চলল ২৩ তারিখ পর্যন্ত। এই অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের আগে মুসলিম লীগ সভাপতি কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভাষণ দিলেন তা ঐ প্রস্তাবের ভূমিকা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিন্নাহ তাঁর দীর্ঘ ভাষণেল একটি অংশে বললেন, “আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ভারতে স্বাধীনতা চাই। কিন্তু তা ভারতের সকলের জন্য হওয়া চাই, কেবল একটি অংশ অথবা তার চাইতেও খারাপ যা কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন দলের স্বাধীনতা এবং মুসলমান ও সংখ্যালঘুদের দাসত্ব হলে চলবেনা। —গত সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতার ফলে আমরা এখন অত্যন্ত আশংকাগ্রস্ত এবং কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা। কংগ্রেস ও বৃটিশের মধ্যে যে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি (অলিখিত) হতে পারে, একথা আমরা কখনো বিশ্বাস করতে পারিনা। —-নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি ব্যতীত আর কারো উপর আপনারা নির্ভর করতে পারেন না। এই হচ্ছে আপনাদের একমাত্র শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। আমাদের একটা দাবী হচ্ছে অবস্থানুযায়ী যথাসম্ভব শীঘ্র অথবা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে ভারতের ভাবী শাসনতন্ত্র সামগ্রিকভাবে নতুর পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ১৯৩৫ সালের আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। বৃটিশ সরকারকে কোন ঘোষণা করতে বলার উপর আমাদের আস্থা নেই। এই সব ঘোষণার কোন মূল্য নেই। —কংগ্রেস বলে, ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত গণপরিষদ দ্বারা শাসনতন্ত্র গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে এবং এখনই ভারতকে ‘মুক্ত ও স্বাধীন’ ঘোষণা করতে হবে। সংখ্যালঘিষ্ঠদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ অবশ্যই এই পরিষদ রক্ষা করবে। যদি তারা (মুসলমানরা) তাতে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে বিষয়গুলি অতি উচ্চ ও নিরপেক্ষ আদালতে মীমাংসার জন্য দিতে তিনি প্রস্তুত আছেন’। (গান্ধীর) এই প্রস্তাব অবাস্তব ও অকার্যকর। —–বৃটিশ এদেশ থেকে যাক বা না যাক, (এই প্রস্তাব অনুসারে) ব্যাপক ক্ষমতা জনগণের নিকট হস্তান্তরিত হবে। (সে ক্ষেত্রে) প্রথমতঃ গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে মুসলমানদের মতানৈক্য হলে কে ট্রাইবুন্যাল নিয়োগ করবে? আর যদি বা মতানৈক্যেল ফলে সালিশী নিয়োগ করা সম্ভব হয়, তাহলে ট্রাইবুন্যালের সিদ্ধান্ত কে কার্যকরী করবে? কার্যত তা করা হচ্ছে কিনা তাই বা কে দেখবে? কারণ তার আগেই তো বৃটিশরা প্রধানত বা সম্পূর্ণরূপে ক্ষতা হস্তান্তর করবে। তাহলে ট্রাইব্যুনালের রোয়েদাদ কার্যকরী করবে কে? উত্তর সেই একই –হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠরাই করবে এবং সেটা বৃটিশ বেয়নেট অথবা মিঃ গান্ধীর ‘অহিংসা’ (?) দ্বারা করা হবে। আমরা কি আর তাদের বিশ্বাস করতে পারি? –তিনি (গান্ধী) বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। কিন্তু আমি কি তাঁকে দেখতে পারি যে, তিনি সংগ্রাম করছেন একটা গণপরিষদের জন্য, যা মুসলমানরা গ্রহণ করতে রাজী নয়, যেখানে মুসলমানরা হবে এক তৃতীয়াংশ। মুসলমানরা বলতে চায়, এভাবে কেবল মাথা গুণতি দ্বারা তার কোন মীমাংসায় উপনীত হতে পারবে না, বন্ধুদের সাথে কাজ করতে হলে প্রয়োজন অন্তরের মিল। —-কেবল আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চাই।
বৃটিশ সরকার মুসলমানদের উপর কোন শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দিক, এ আমরা চাই না। যদি আমাদের বিনা অনুমোদনে ও সম্মতি ছাড়া কোন অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে ভারতের মুসলমানরা তাতে বাধা দেবে। —-ভুলবশতঃ সর্বদাই মুসলমানদের সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে এবং আমরাও বহুদিন যাবৎ এই ধারণা পোষন করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। মুসলমানরো সংখ্যালঘিষ্ঠ (সম্প্রদায়) নয়। যে কোন সংজ্ঞায় মুসলমানরা একটা পৃথক জাতি।
—-এমনকি বৃটিশ ভারতের মানচিত্র থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা এই দেশের বৃহৎ অংশসমূহ দখল করে আছি এবং এই সকল অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ –যথাঃ বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান। —হিন্দু মুসলিম সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান কি?
এই প্রশ্ন উত্থাপনের পর মিঃ জিন্নাহ ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে ভারতের একজন শীর্ষ হিন্দু নেতা লালা লাজপত রায়ের লেকা একটা চিঠির-[চিত্তরঞ্জন দাসের কাছে লেখা রাজপত রায়ের চিঠির একাংশঃ
“একটা বিষয় যা আমাকে অত্যন্ত উদ্বেগগ্রস্ত করে তুলেছে এবং যে সম্পর্কে আমি অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করতে বলি তা হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম একতা। বিগত ছয় মাসের বেশীর ভাগ সময় আমি নিজেকে মুসলিম জাতির ইতিহাস ও আইন শাস্ত্র অধ্যয়নে নিয়োজিত করেছি এবং আমার ধারণা এই ঐক্য সম্ভবও নয়, বাস্তব সম্মতও নয়। অসহযোগ আন্দোলনে মুসলিম নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতা স্বীকার করেও আমি মনে করি তাদের ধর্ম এ রকম কোন কিছুকে কার্যকরী ভাবেই বাধা প্রদান করে। আপনার মনে আছে হাকিম আজমল খান ও ডঃ কিসলুর সাথে আমরা যা আলোচনা হয়েছিল তা কোলকাতায় আমি আপনার কাছে রিপোর্ট করি। হিন্দুস্তানে হাকিম আজমল খান অপেক্ষা চমৎকার লো হতে পারে না। কিন্তু কোন মুসলিম নেতা কি কোরআনকে অতিক্রম করতে পারেন? —কিন্তু আমি যা অনুধাবন করেছি তা যদি সত্য হয় তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, যদিও বৃটিশের বিরুদ্ধে একতাবন্ধ হতে পারি, তবুও আমরা বৃটিশ শাসন পদ্ধতি অনুযায়ী শাসন (অর্থাৎ নিছক সংখ্যাগুরুর কর্তৃত্ব) প্রতিষ্ঠা করতে পারিনা। —কিন্তু প্রতিকার কী?] উল্লেখ করলেন এবং বললেন, “বারতের সমস্যা আন্তঃ সাম্প্রদায়িক নয়, এটা আন্তর্জাতিক এবং এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা হচ্ছে, ভারত বিভাগ করে প্রধান জাতিগুলিকে স্বায়ত্ব শাসিত স্বতন্ত্র আবাসভূমি দেওয়া। –আমি বুদ্ধিজীবীদের নিকট আবেদন জানাচ্ছি। পৃথিবীর সকল দেশের বুদ্ধিজীবীরাই সমস্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রপথিক হয়েছেন। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এখন কি করতে চান? বন্ধুগণ আমি আপনাদের মনস্থির করতে বলছি, এবং জনগণকে সংহত করার পন্থা স্থির করতে বলছি। আপনাদের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করুন। জনগণ সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছে। তারা কেবল আপনাদের নেতৃত্বের অপেক্ষায় আছে। ইসলামের সেবক হিসেবে আপনারা এগিয়ে আসুন”।–[আমি ভারতের সাত কোটি মুসলমানকে ভয় করিনা। (কারণ সংখ্যায় হিন্দুরা তিনচারগুণ বেশী) কিন্তু হিন্দুস্তানের সাতকোটির সাথে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, আরব, মেসোপটেমিয়া ও তুরসক্রে সশস্ত্র মোর্চা অপ্রতিরোধ্য।]
জিন্নার বক্তৃতার পর অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হলো। উত্থাপন করলেন তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক। প্রস্তাবের সমর্থন উত্থাপন করলেন যুক্ত প্রদেশের চৌধুরী খালিকুজ্জামান। তারপর একে একে সমর্থন জানালেন ভারতের বিভিন্ন প্রদশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত জনসমুদ্রেও গগণবিদারী ‘আল্লাহু আকবর’ আওয়াজ তুলে সমর্থন জানাল যুগান্তকরী এই প্রস্তাবের পক্ষে। প্রস্তাবে বলা হলোঃ
(১) ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কার্যকরী সমিত ও কাউন্সিল শাসনতন্ত্র সম্বন্ধীয় ব্যাপারে যে সব ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন এই সভা তাহা সমর্থণ ও অনুমোদন করিতেছে এবং এই অভিমত ব্যক্ত করিতেছে যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অঙ্গীভূত যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা দেশের বিশেস অবস্থায় পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ও অচল; এবং মুসলিম ভারতের পক্ষে গ্রহণের একেবারে অযোগ্য।
(২) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন যে নীতি ও পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে রচিত ভারতের সমস্ত দল, স্বার্থ ও সম্প্রদায়ের সহিত পরামর্শক্রমে তা পুনর্বিবেচিত হইবে বলিয়া সম্রাটের গভর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে বড়ঘাট ১৯৩৯ সালে ১৮ই অক্টোবর তারিখে ঘোষণা প্রচারিত করেন’ এই সভা তাহা আশাপ্রদ বলিয়া মনে করে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে যে, সমগ্র শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনাটি যদি নতুন করিয়া আদ্যান্ত পরীক্ষিত না হয় তাহা হইলে মুসলিম ভারত সন্তুষ্ট হইবে না এবং তাহাদের সমর্থন ও অনুমোদন ব্যতিরেকে অন্য কোন পরিকল্পনা তাহাদের পক্ষে বিবেচিত হইবে না।
(৩) প্রস্তাব করিতেছে যে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বর্তমান অধিবেশনে সুচিন্তিত অভিমত এই যে, নিম্নলিখিত মৌলিক নীতির উপর নির্ভর করিয়া রচিত নয় এমন কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকরী ও মুসলিম ভারতের পক্ষে গ্রহণযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবে না। ভৌগোলিক দিক দিয়া সন্নিহিত অঞ্চলগুলিকে প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস দ্বারা এরূপভাবে পৃথকীকৃত ও গঠিত করিতে হইবে, যাহাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে লইয়া এমন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয় যে তাহার অন্তর্ভুক্ত উপাদানসমূহের প্রত্যেকটি হইতে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।
(৪) এই সকল অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের ধর্মগত, কৃষ্টিগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শাসন বিভাগীয় ও অন্য বিষয় সম্বন্ধীয় অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য তাহাদের সহিত পরামর্শ ক্রমে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনার মধ্যে যথোপযুক্ত কার্যকরী ও আদেশাত্মক রক্ষাব্যবস্থার বিধান করিতে হইবে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলসমূহের মুসলমানরা যেখানে সংখ্যালঘু সে স্থানেও বিশেষ করিয়অ মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির ধর্মগত, কৃষ্টিগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও ক্রমে যথোপযুক্ত কার্যকরী ও আদেশাত্মক রক্ষা ব্যবস্থার বিধান করিতে হইবে”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ২৮১, ২৮২।]
মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশন থেকে দুটি জিনিস বেরিয়ে এল। এক, একটা উপলব্ধির পূর্ণতা, দুই সেই উপলীব্ধজাত নীল নক্সা বা কর্মসূচী। উপলীব্ধটা হলো যে, মুসলমানরা ভারতের সংখ্যালঘু নয়, তারা একটা জাতি। এই সত্যটা সত্য হিসেবে আগেও ছিল, কিন্তু এর উপলব্ধিটা সক্রিয় ছিল না। এই কারণেই ১৯০৯ সালের মার্লি-মিণ্টো, ১৯১৯ সালে মণ্টেণ্ড চেমসফোর্ড এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের সংখ্যালঘু তত্ব তাদের মেনে নিতে আপত্তি হয়নি, বরং সংখ্যাগুরুর কাছ থেকে সংখ্যালঘুর রক্ষাকবচ আদায়ই ছিল কায়েদে আযমকে লেখা চিঠিতে আল্লামা ইকবাল মুসলিম জাতি সত্তার স্বতন্ত্র অধিকারের প্রতি স্পষ্ট অংগুলি সংকেত করেছিলেন এবং মওলানা মওদূদী ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘মুসলমান ও বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত’ শীর্ষক লেখায় সংখ্যাগুরু হিন্দুদের অধীনে গণতন্ত্রের অসারতা এবং মুসলমানদের সক্রিয় উত্থান শুরু হয় কায়েদে আযমের মধ্যে।–[‘মওলানা রাজনীতিতে ১৯৩৮-৩৯ সালে ‘তরজুমানুল কোরআনে’ প্রকাশিত এক ধারাবাহিক প্রবন্ধের মাধ্যমে কংগ্রেসের অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে মুসলমানদেরকে সাবধান করে দেন। উপরন্তু তিনি এ উপমহাদেশে মুসলমানদের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন। কংগ্রেসের ধর্ম নিরপেক্ষতার মুখোশ তিনি খুলে দেন এবং প্রমাণ করেন যে, ভারতের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে গণতন্ত্র অনুপযোগী। কারণ এখানে মুসলমানদের একভোট এবং তিনটি ভোট রয়েছে কংগ্রেসের। তিনি হিন্দুদের জাতীয় সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করে এ মতামত ব্যক্ত করেন যে, পৃথক নির্বাচন অথবা পরিষদের কিছু বেশী সংখ্যক আসন লাভ এবং চাকুরীর একটা সংখ্যার হার নির্ধারণ মুসলমান জাতির রাজনৈতিক সমস্যার কোন সমাধান নয়। তিনি এ ব্যাপারে তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন”। (Evolution of Pakistan’, শরীফুদ্দিন পীরজাদা, পৃষ্ঠা ১৯১।] ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসের মুসলিম দলনাকারী দুঃশাসন এই উপলব্ধিটিকে জ্বলন্ত করে তুলল যে, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সজীব জাতি মুসলমানরা সংখ্যালঘু হিসেবে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের অধীনে বাস করতে পারবে না। একটা পূর্ণ জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জাতীয় আবাসভূমি তাদের চাই। এই চাওয়া ছিল ঐ মহান উপলব্ধির একটা মহত্তম পুরস্কার। এ পুরস্কারেরই একটি নাম ‘বাংলাদেশ’ ভারত উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে, আরেকটি নাম ‘পাকিস্তান’ ভারতের পশ্চিম প্রান্তে। এই পুরস্কার গুলিই প্রমাণ করছে ঐ উপলব্ধির উত্থান ছিল কত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত এই উপলব্ধির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থান ও পূর্ণতা লাভ ছিল ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সময়ের সেরা ঘটনা।