৮
বিজয় এল বাস্তবতার
জি, আল্লানার ভাষায় “২৩শে মার্চ (১৯৪০) তারিখে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর হিন্দু ও কংগ্রেস আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। মুসলিম লীগ যে এখন ভারত বিভক্ত করে দু’টো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য দাবী করছে, এটা তারা বুঝতে পারল। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল তারা। গর্জাতে লাগলেন হিন্দু নেতারা। এই প্রস্তাবের নিন্দাবাদ করার জন্যে হিন্দুরা একে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ আখ্যা দিল।–[১৯৩২ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী তার ‘Now or Never’ পুস্তিকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, ইরান, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, প্রভৃতি নিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাব থেকেই ‘পাকিস্তান’ নামের উদ্ভব।] মুসলিম লীগও তাদের অভিযোগে খুশী হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ তারিখের প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব”।–[‘Quid-e-Azam’, জি, আল্লানা, পৃষ্ঠা ৩১৯, ৩২০।]
অনেক হিন্দু নেতা পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করে বললেন, ‘উন্মাদ ভিন্ন আর কেউ এতে বিশ্বাস করতে পারে না’। নেহেরু একে ‘কাল্পনিক’ আখ্যায়িত করে বললেন, ‘এ হলো সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের বিড়ালের খাবার মতো’ তিনি ঘোষণা করলেন, ‘ভারতের সংবিধান স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় একতার উপর ভিত্তি করে তৈরী করতে হবে’।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১৪০।] আর গান্ধী বললেন, “মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব আমাকে হতবুদ্ধি করেছে”। তিনি আরও বললেন, “ভারতের অঙ্গচ্ছেদ করার পূর্বে আমার অঙ্গচ্ছেদ কর”।–[‘কালেকটেড অয়ার্কস অব মহাত্মা গান্ধী’, একান্ন খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৭ এবং ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫২৪।]
জাঁদরেল হিন্দু নেতারাও এতটা বেসামাল হয়ে পড়ার কারণ, তারা কল্পনা করেনি যে, দুর্বল সংখ্যালঘুদের সংগঠন মুসলিম লীগ ভারত বিভাগরে মত দাবী তোলার সাহস সত্যিই পাবে। তাদের কল্পনাতীত বিষয় যখন তাদের সামনে বাস্তব রূপ নিয়ে হাজির হলো, তখন তারা সত্যিই হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল তারা ‘মুসলিম জাতি’ নামক অত্যন্ত মূল্যবান শিকারটি হাত ছাড়া হয়ে যাবার আশংকায়। হিন্দু নেতাদের ক্রোধ ও আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হলেন কায়েদে আযম। তাদের অনেক গাল-মন্দ ও অভিযোগ শোনার পর কায়েদে আযম জবাবে বললেন,-[১৯৪১ সালের ২রা মার্চ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের বিশেষ অধিবেশনে কায়েদে আযমের বক্তৃতা।] “আমি মিঃ গান্ধী থেকে শুরু করবো। তিনি বলছেন যে, এর দ্বারা ভারতের অঙ্গচ্ছেদ করা হবে। কথাটা শুনতেই আতংক উপস্থিত হয়। মুসলমানরা যাতে ভারতের অঙ্গচ্ছেদ না করে সে জন্যে কি তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে? জিজ্ঞাসা করি, ভারত কবে এক ছিল? কখনো এক ছিল কি? অঙ্গচ্ছেদ শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে কেন? এরপর তাঁর (গান্ধীর) শিষ্য মিঃ রাজা গোপালচার্য আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়েনে। বলেছেন, এটা যেন একটা শিশুকে দ্বিখণ্ডিত করার মত। জিজ্ঞাসা করি, শিশুটা কোথায় যে তাকে দ্বিখণ্ডিত করা হচ্ছে? এটাও যথেষ্ট হলো না মনে করে তিনি আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, এটা যেন দুই হিন্দু ভাই ঝগড়া করছে ও তাদের একজন গো’মাতাকে দু’টুকরো করতে চাচ্ছে। —-সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মনোভাবের প্রতি আমি পরম শ্রদ্ধা পোষণ করি। কিন্তু রাজা গোপালচার্যের মতো একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আমি ‘গো’মাতাকে’ দু’টুকরো করার প্রস্তাব করছি –এই উপমা দিয়ে যখন হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগ আরো উত্তেজিত করতে চান, তখন আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তাঁদের আর কোন যুক্তি না থাকায় এই নৈরাশ্যজনক পন্থা অবলম্বন করেছেন”।–[Speeches & Writings of Mr. Jinnah’, পৃষ্ঠা ২২১, ২৩০।]
নেহেরু লাহোর প্রস্তাবকে ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা’ বলে অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার জন্যে দুঃখ এই যে, বৃটিশরা এবং বৃটিশ সরকার লাহোর প্রস্তাবকে সুদৃষ্টিতে দেখেননি। লাহোর প্রস্তাবের ব্যাপারে বৃটিশের যে তাৎক্ষণিক দৃষ্টিভংগীর প্রকাশ ঘটেছিল সেটা কংগ্রেসের খুবই কাছাকাছি। ১৯৪০ সালের ২রা এপ্রিল ইংল্যাণ্ডের ‘ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান’ বলে “তিনি (কায়েদে আযম) ভারতীয় রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেণ এবং পাকিস্তান দাবী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বুকে আঘাত করেছে ও এর ফলে ভারতরে স্বায়ত্ত শাসনের অগ্রগতি ব্যাহত হবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫৪০।] এর ২০ দিন পরে বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট মিঃ এমারীও অনুরূপ উক্তি করেন। তিনি বলেন, “—এই তথাকথিত পাকিস্তান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে যে বিপুল অসুবিধা রয়েছ সে সম্বন্ধে আমি এখানে আলোচনা করতে চাই না। —কিন্তু শেস পর্যণ্ত আমরা ভারতকে যে ঐক্য, আভ্যন্তরীণ শান্তি ও আইনের শাসন দিয়েছি, সেটা বৃটিশের পক্ষে কম গৌরবের বিষয় নয়”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫৪০।]
সম্মুখ পথে মুসলিম লীগকে কাবু করা যাচ্ছে না দেখে কংগ্রেস মুসলমানদের মধ্যে বিভেগ ও মুসলিম লীগে ভাঙন সৃষ্টির হীন পথ অনুসরণ করলো। এ কাজে তারা ব্যবহার করলো কংগ্রেসী মুসলমানদের। কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আজাদকে দিয়ে পাঞ্জাবের লীগ নেতা শওকত হায়াতকে লীগ থেকে ভাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হলো।–[‘Path yay to Pakistan’, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, পৃষ্ঠা ৩১৫।] কায়েদে আযম যথাসময়ে জানতে পারায় শেষ রক্ষা সম্ভব হয়। পাঞ্জাবের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাতেও কংগ্রেস এই প্রচেষ্টা চালায়।–[‘Quid-e-Azam: As I see him’, হাসান ইস্পাহানী, পৃষ্ঠা ৪৯, ৫০।] কংগ্রেসের এই প্রচেষ্টা সফল হয় সিন্ধুতে। কারণ সিন্ধুর প্রধানমন্ত্রী খান বাহাদুর আল্লাবকস ছিলেন একজন কংগ্রেসপন্থী। এই আল্লাবকস দিল্লীতে একটি সম্মেলন ডেকে কংগ্রেসের কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে ঘোষণা করলেন, “ভারতের নয় কোটি মুসলমান ভারতের আদি অধিবাসীদের বংশধর ও উত্তরাধিকারী এবং তারা এই মাটিরই সন্তান। ধর্মান্তর কোন ক্রমেই জাতীয়তা পৃথক করতে পারে না”।–[‘ভারতের মুসলিম রাজনীতি’, বিনয়েন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৫৭।] কিন্তু এসব করে কংগ্রেস মুসলিম জনমতের উপর কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারল না। বরং যে কংগ্রেসী মুসলমানরা এসব কাজে অংশ নিল তারা মুসলিম মহলে নিন্দিত হলো। শেরে বাংলার মত সর্বজন প্রিয় নেতাও বাংলায় কংগ্রেসের সাথে মিলে মন্ত্রীসভা গঠন করায় মানুষেল ব্যাপক অসন্তুষ্টি কুড়িয়েছিলেন। এই অবস্থায় কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ জিন্নার স্মরণাপন্ন হলেন। ১৯৪০ সালের ১২ জুলাই তিনি এক গোপন তারবার্তায় জিন্নাহকে লিখলেন, “—কংগ্রেসের দিল্লী প্রস্তাবে জাতীয় সরকার বলতে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গঠিত সরকার বুঝায়, একদলীয় সরকারের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তি বাদ দিয়ে সাময়িক বন্দোবস্তে যোগ দিতে কি লীগ রাজী হতে পারে না? যদি তাই হয়, তারযোগে বিষয়টি পরিস্কার জানান”।–[‘Quid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’, শরীফুদ্দীন পীরজাদা, পৃষ্ঠা ৩।] এর জবাবী তারবার্তায় কায়েদে আযম বললেন, “আপনার টেলিগ্রাম আস্থা সৃষ্টি করে না। পত্র দ্বারা বা অন্য উপায়েও আমি আপনার সাথে আলোচনা করতে অস্বীকার করি। কারণ আপনি মুসলিম ভারতের সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়েছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে, আপনাকে মাত্র ‘লোক দেখানো’ কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে ও তদ্বারা বাইরের দেশগুলোকে প্রতারণা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনি মুসলমান বা হিন্দু কারো প্রতিনিধি নন। কংগ্রেস হচ্ছে একটা হিন্দু সংস্থা। যদি আপনার আত্মসম্মান থাকে, আপনি এখনি পদত্যাগ করুন। এতোদিন লীগের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য কাজ করেছেন। আপনি নিজেই জানেন যে, তাতে আপনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। ও পথ ছাড়ুন”।–[‘Quid-I-Azam Jinnah’s Correspondence’, শরীফুদ্দীন পীরজাদা, পৃষ্ঠা ৩।]
মওলানা আজাদের কাছে পাঠানো জিন্নার এই তারবার্ত নিসন্দেহে খুব কঠোর। তবে তা বাস্তবতার নিরেট প্রতিধ্বনি। এই সত্য কথাগুলো মওলানা আজাদকে এইভাবে বলার দ্বিতীয় লোক আর ভারতে ছিল না। একমাত্র জিন্নাহই তা পারতেন এবং তিনি তাই বলেছেন। আর একথাগুলো বলা জিন্নার জন্যে অপরিহার্য ছিল। কংগ্রেসী মুসলমানরা যেভাবে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, যেভাবে তারা মুসলিম লীগকে কষ্ট দিচ্ছিল এবং মওলানা আজাদ তাঁর ঐ তারবার্তায় যে প্রতারণামূলক প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন, তাতে মওলানাকে ঐ ভাবে স্পষ্ট কথা বলা ছাড়া বোধ হয় আর উপায়ও ছিল না। মওলানা প্রস্তাবকে এই জন্যেই প্রতারণা বলা ছাড়া বোধ হয় আর উপায়ও ছিল না। মওলানার প্রস্তাবকে এই জন্যেই প্রতারণা বলা যেতে পারে যে, মওলানা তার তারবার্তায় ‘জাতীয় সরকার’ বলতে ‘বহুদলীয় সরকার’ বুঝিয়েছেন তা কংগ্রেসের আসল কথা নয়, কংগ্রেসের আসল রূপ এটা নয় মোটেই। কংগ্রেস মুসলিম লীগ বা কোন মুসলিম দলের অস্তিত্ব স্বীকারই করে না। মওলানা আজাদ জিন্নাহকে টেলিগ্রাম পাঠাবার মাত্র ক’দিন আগে জুন মাসে গান্ধী তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় এই কথাটি অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় বিশ্ববাসীকে পুনর্বার জানিয়ে দিয়েছিলেন। মিঃ গান্ধী তাঁর এই বক্তব্যে বলেন, “সকল দলকে আহবান করে একটা সাধারণ সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে আমার নিকট আবেদন করা হচ্ছে। তারা বলেন, তা হলেই (অর্থাৎ সমঝোতার পর) আমরা গ্রেটবৃটেনের নিকট যা চাইবো, তা পাবো। এই বন্ধুরা একটা আসল কথা ভুলে যাচ্ছেন। কংগ্রেস সমগ্র ভারতের পক্ষে কথা বলার দাবী করে এবং নির্ভেজাল স্বাধীনতা চায়। যারা তা চায় না, কংগ্রেস তাদের সাথে সাধারণভাবে সমঝোতায় পৌঁছতে পারে না। একটিমাত্র গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আছে –অর্থাৎ কংগ্রেস, অন্য সবই স্ব-মনোনীত অথবা অংশ বিশেষ কর্তৃক নির্বাচিত। এমতাবস্থায়, বর্তমানে মাত্র দুটি পক্ষ আছে –কংগ্রেস ও যারা কংগ্রেসের পক্ষ অবলম্বন করে এবং যারা করে না। এই দুয়ের মধ্যে কোন এক পক্ষ কর্তৃক তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্জন ব্যতীত পারস্পরিক সাক্ষাতের (বা আলোচনার) সাধারণ ক্ষেত্র নেই”।–[গান্ধীর ‘হরিজন’ পত্রিকা, জুন ১৯৪০ (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫৪৯)।] এখানে গান্ধী কংগ্রেস ও কংগ্রেস মতাবলম্বী ছাড়া অণ্য দলের অধিকার, অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন। একমাত্র কংগ্রেস ও কংগ্রেস পন্থীদেরকেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলছেন এবং অন্যরা কংগ্রেস পন্থী না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে আলোচনা, এমনকি সাক্ষাতও করা যায় না বলে গান্ধী মন্তব্য করছেন। এই যখন কংগ্রেসের মানসিকতা, তখন তার সাথে মিলে মুসলিম লীগ জাতীয় সরকার গঠন করতে পারে কেমন করে? অথচ এই উদ্ভট প্রস্তাবই মওলানা আজাদ কায়েদে আযমকে দিয়েছিলেন। আসলে প্রস্তাবটি ছিল একটা রাজনৈতিক প্রতারণা, যার লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে নীতিচ্যুত করে বেকায়দায় ফেলা।
অন্যদল বিশেষ করে মুসলিম লীগের অস্তিত্ব ও অধিকার অস্বীকার করার এই যে কংগ্রেসের নীতি, তার লক্ষ্য ছিল ভারতের কর্তৃত্ব এককভাবে কংগ্রেসের হাতে নিয়ে আসা। এই দাবীতেই কংগ্রেস যুদ্ধে বৃটিশকে সক্রিয় সহযোগিতা করেনি বরং শুধু করে আইন অমান্য আন্দোলন, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো চাপ দিয়ে বৃটিশের কাছ থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা হাত করে নেয়া। ১৯৪০ সালের শুরু থেকেই যুদ্ধে বৃটেনের অবস্থা খারাপ হতে লাগল এবং কংগ্রেসের চাপে বৃটিশের নতি স্বীকারের উদ্বেগও বাড়ল। এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবেই লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্যে পৃথক ও স্বাধীন আবাসভূমির দাবী উত্থাপন করা হল এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে মুসলিম লীগ বৃটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলল, যাতে বৃটিশ কংগ্রেসের একক দাবী মেনে নেবার সুযোগ না পায়। সম্ভবত এরই ফল হিসেবে ১৯৪০ সালের ১৮ই এপ্রিল বৃটিশ সেক্রেটারী অব ষ্টেট ভারত সম্পর্কে যে ঘোষণা দিলেন, তার এক জায়গায় বললেন, “—যে যুক্ত ভারতের ধারণা বহু ভারথীয় ও ইংরেজকে পরিশ্রম করতে প্রেরণা দিয়েছে, তার বাস্তবায়নের জন্যে ভারতের বিবিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ মতৈক্য হওয়া আবশ্যক। কারণ, আমি ভাবতে পারি না যে, এ দেশের কোন সরকার বা পার্লামেণ্ট ভারতের আট কোটি মুসলমানের উপর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক এমন শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেবে, যার অধীনে তারা শান্তিতে ও স্বস্তিতে বাস করতে পারবে না”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫৫৮।]
বৃটিশ সেক্রেটারী অব ষ্টেটের এই বক্তব্যে মুসলমানদের ইচ্ছার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সত্য, কিন্তু কংগ্রেসের দাবী অখণ্ড ভারতের চিন্তা যে তাদের মাথায় রয়েছে, এ কথারও প্রকাশ ঘটেছে। এই চিন্তা এবং কংগ্রেসের চাপ একত্র হয়ে যে কোন সময় মুসলমানদের প্রতি দেয়া বৃটিশের প্রতিশ্রুতি পাল্টে দিতে পারে। মুসলিম লীগের এই আশংকা জুনের দিকে দারুণভাবে বৃদ্ধি পেল, যখন যুদ্ধে বৃটেনের অবস্থা আরও সংগীন হয়ে উঠল। জার্মানীর নাৎসী বাহিনীর হাতে এপ্রিলে নরওয়ে ও ডেনমার্ক এবং মে’তে বেলজিয়াম ও হল্যাণ্ডের পতন ঘটার পর ১৯৪০ সালের ২২শে জুন ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করার উদ্বেগজনক খবর ভারতে এল। নাৎসী বাহিনী তখন বলা যায় বৃটেনের মাথার উপর। এই অবস্থায় কংগ্রেস ঘোষণা করল, “যদি বৃটিশ সরকার যুদ্ধের পর ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে’ –এই দ্বিধাহীন ঘোষণা দেয়, তাহলে কংগ্রেস দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে তৎক্ষণাৎ অস্থায়ী জাতীয় সরকারে যোগ দিতে প্রস্তুত আছে”।–[‘Mahatma Gandhi’, বি. আর. নন্দ, পৃষ্ঠা ২১৮।] বৃটিশও তার গরজে কংগ্রেসের প্রতি নরম হলো। পরিস্থিতি বৃটিশ সরকারকে কোন সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়, এ চিন্তা মুসলিম লীগের মধ্যে বড় হয়ে দেখা দিল। ১৯৪০ সালের ২৭শে জুন জিন্নাহ ভারতের বড় লাটের সাথে সাক্ষাত করলেন এবং ১লা জুলাই তারিখে একটা স্মারক লিপি প্রেরণ করলেন বড় লাটের কাছে। তাতে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বলা হলোঃ
১) ভারতের বিভাগ সম্পর্কিত লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি বিরোধী কোন ঘোষণা অথবা বিবৃতি বৃটিশ সরকার করতে পারবে না।
২) বৃটিশ সরকারকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, মুসলিম ভারতের পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত বৃটিশ সরকার কোন অন্তর্বর্তী বা চরম পরিকল্পনা গ্রহণ করবে না।
৩) ইউরোপের দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থঅর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখঅর ও বহিরাক্রমণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকার সমূহে মুসলিম লীগকে সমান অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
৪) ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিল সম্প্রসারিত করার পর যদি কংগ্রেস যোগদান করে, তাহলে মুসলমান সদস্যদের সংখ্যা হিন্দুদের সমান হবে, আর যদি কংগ্রেস যোগদান না করে, তাহলে মুসলমান সদস্যদের সংখ্যাধিক্য থাকিবে। কারণ, কংগ্রেস যোগ না দিলে মুসলমানদেরই প্রধান ভার বহন করতে হবে।
৫) যে সকল প্রদেশে ৯৩ ধারা প্রবর্তিত হয়েছে, সেই সকল স্থানে বেসরকারী পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে এবং তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য থাকতে হবে।
৬) অন্ততঃ ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি ‘যুদ্ধ কাউন্সিল’ গঠন করতে হবে। ভাইসরয় কাউন্সিলের সভাপতি হবেন, কংগ্রেস যোগ দিয়ে হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের সংখ্যা সমান থাকবে, না দিলে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য থাকবে।
৭) একজিকিউটিভ কাউন্সিল, যুদ্ধ কাউন্সিল ও প্রাদেশিক পরামর্শদাতাদের মুসলশান সদস্যগণ মুসলিম লীগ কর্তৃক মনোনীত হবে।
কংগ্রেস মুসলিম লীগের এ প্রস্তাবকে ভালো চোখে দেখার কথা নয়। তাদের মতে ‘এরূপ দাবীর অর্থ মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছঅড়া আর কিছু নয়’।–[‘খণ্ডিত ভারত’, ডঃ রাজেন্দ্র, পৃষ্ঠা ১৮০।] বৃটিশ সরকারও একে ভালো চোখে দেখল না। মুসলিম লীগের এ স্মারক লিপির জবাবে ভাইসরয় ১৯৪০ সালে ৬ই জুলাই জিন্নাহকে এক নোটে জানালেন, “মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যম মুসলিম প্রতিনিধি প্রেরণের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেন। কিন্তু দায়িত্ব হবে সমষ্টিগতভাবে গভর্ণর জেনারেলের পরিষদের। বড়লাটের শাসন পরিষদের সদস্যরূপে কে কে গৃহীত হবেন বড় লাটের সাথে পরামর্শ করে ভারত সচিব তা স্থির করবেন। এই হল প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার কথা। —বড় লাটের সস্প্রসারিত শাসন পরিষদের অথবা উহার বেসরকারী উপদেষ্টা রূপে যে সকল মুসলিম সদস্য গৃহীত হবেন, তাদের মনোনয়নের দায়িত্ব মুসলিম লীগের উপর অর্পণ করা নিয়মতান্ত্রিক দিক দিয়ে অসম্ভব। কিন্তু প্রয়োজন বোধে কারও নাম যদি আপনি প্রস্তাব করেন তা যথাযোগ্য গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে না, এরূপ আশংকার কোন হেতু নেই”।–[‘খণ্ডিত ভারত’, ডঃ রাজেন্দ্র, পৃষ্ঠা ১৮০।] এই চিঠিতে ভাইসরয় তার সরকারের নীতির কথা বললেও ভাইসরয়ের এ জবাব কংগ্রেসকে খুশী করলো। কিন্তু এই ঘটনার ৩৮ দিন পর ১৯৪০ সালের ১৪ই আগষ্ট বৃটিশ সেক্রেটারী অব ষ্টেট ভারতের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে যা বললেন তাতে আবার হতাশ হলো কংগ্রেস। সচিব বৃটেনের হাউস অব কমন্স এ বলে, “এ কথা সত্য যে, কংগ্রেস এককভাবে বৃটিশ ভারতের সর্ববৃহৎ দল। কিন্তু সেই কারণে তারা যে সমগ্র ভারতের পক্ষে কথা বলার দাবী করে –এ দাবী ভারতে জটিল জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমূহ অস্বীকার করে। এর অন্য অংশ (বা উপাদান) সমূহ কেবল সংখ্যায় লঘিষ্ঠ হিসাবে তাদের দাবী করে না; পরন্তু তারা দাবী করে ভারতের ভাবী নীতি স্থিরীকরণের ব্যাপারে স্বতন্ত্র মৌলিক অংশ হিসাবে স্বীকৃতি। —ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতে, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংস্কৃতিতে তাদের ও তাদের স্বদেশবাসী হিন্দুদের মধ্যে গভীর পার্থক্য রয়েছে এবং এই পার্থক্য ইউরোপের বিভিন্ন জাতির মধ্যে পার্থক্য অপেক্ষা গভীরতর। —এতদসত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে মুসলমানরা যে কংগ্রেসের কাজে অংশগ্রহণ করেনি তা নয়, কিন্তু দলগত (সমষ্টিগত) ভাবে মুসলমানেরা তফাৎ থেকেছে। বর্তমান আইনের (১৯৩৫ সালের আইনের) ব্যাপারে তাদের প্রধান আপত্তি এই যে, এর দ্বারা কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের অত্যন্ত অধিক ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে। তারা ভৌগলিক, অঞ্চল ভিত্তিক নির্বাচিত গণ-পরিষদ কর্তৃক রচিত শাসনতন্ত্র মোটেই চায় না। যে কোন শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনায় তারা স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে স্বীকৃতি দাবী করে, এবং কেবল এমন ধরনের শাসনতন্ত্র তারা গ্রহণ করতে রাজী আছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাত থেকে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেবে”।–[‘The Indian Annual Register, 1940’, Vol-11, পৃষ্ঠা ৩৭৫]
এই বৃটিশ বক্তব্যে জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বার্থের প্রতি একটা স্বীকৃতি আছে বটে, কিন্তু মুসলিম লীগের ভারত বিভাগ বা পাক্সিতান দাবীকে সমর্থন করা হয়নি। বরং ঐক্যবদ্ধ ভারতের চিন্তা তুলে ধরে এখানে লাহোর প্রস্তাবের বিরোধিতাই করা হয়েছে। তবু যেহেতু এই বৃটিশ বক্তব্যে মুসলিম জাতি সত্ত্বাকে স্বীকার করা হয়েছে, তাই কংগ্রেস এই বৃটিশ বক্তব্যের ঘোরতর বিরোধিতা করল। ১৯৪০ সালের ১৮ থেকে ২২শে আগস্ট অনুষ্ঠিত অধিবেশনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বৃটিশের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিরোধ বৃদ্ধির অভিযোগ এনে বৃটিশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল এবং এই কমিটির ১৩ই অক্টোবর (১৯৪০) এর অধিবেশনে কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। যদিও এই আইন অমান্য আন্দোলনের কারণ হিসেবে তারা যুদ্ধের বিরোধিতাকে সামনে রাখল, তবু সকলের কাছেই একথা পরিস্কার ছিল যে, আসলে কংগ্রেস চাচ্ছে চাপ দিয়ে বৃটিশকে তাদের দাবী মানতে বাধ্য করতে। কংগ্রেসের এই মনোভাবকে জিন্নাহ স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন ১৯৪০ সালের নভেম্বর দিল্লীতে তাঁর এক বক্তৃতায়। তিনি বললেন, “হিন্দুরা, কংগ্রেস দেশের জনগণের স্বাধীনতা বা মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করছে, একথা আমি স্বীকার করতে অক্ষম। তাদের আইন অমান্য আন্দোলনের কারণ আমরা জানি। বৃটিশ সরকারও জানে। কংগ্রেসই ভারতীয় জনগণের একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান, এই স্বীকৃতি জোর করে বৃটিশ সরকারের নিকট থেকে আদায় করতে চায়। কংগ্রেস বলছেঃ ‘আমার সাথে সমঝোতা কর। আমাদের সাথে চুক্তি কর এবং মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা কর”।–[‘Speeches & Writings of Mr. Jinnah’, জামিল উদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৮২।] ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারীতে লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কংগ্রেসের আন্দোলনের মুখে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলঃ “পরিস্থিতির প্রয়োজনে মুসলিম লীগ এ দেশের মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জণ্যে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হতে দ্বিধা করবে না”।
এই সময় মুসলিম শক্তির একটা পরীক্ষাও হয়ে যায়। ১৯৪১ সালের জুলাই এ ভারতের ভাইসরয় স্যার সিকান্দার হায়াত, এ, কে ফজলুল হক, স্যার মুহাম্মদ সা’দ উল্লাহ, স্যার সুলতান আহমদ, ছতরীর নবাব ও বেগম শাহ নওয়াজকে ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্য করলেন মুসলিম লীগের অজান্তে। তাদের নেয়ার পর জিন্নাহকে চিঠি দিয়ে জানান হলো। মুসলিম লীগ যুদ্ধে বৃটিশকে সমর্থন করছিল, সহযোগিতা দিতেও রাজী ছিল, ডিফেন্স কাউন্সিলে অংশ গ্রহণেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু মুসলিম লীগের প্রস্তাব ছিল, ডিফেন্স কাউন্সিলে মুসলিম কাউকে নিতে হলে মুসলিম লীগের মাধ্যমে নিতে হবে। বৃটিশ কর্তৃপক্ষ এর অন্যথা করল। স্বাভাবিক ভাবেই একে মুসলিম লীগ মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং মুসলিম লীগের শক্তি পরীক্ষার একটা চেষ্টা বলে মনে করল। সুতরাং মুসলিম লীগ এর প্রতিবাদ করল এবং মুসলিম লীগ সদস্যদের ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে পদত্যাগের আহবান জানাল। যারা পদত্যাগ করল না, তাদেরকে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করা হলো। বহিস্কৃতদের মধ্যে বাংলার শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকও ছিলেন। নীতির প্রশে।ন এই আপোষহীনতা মুসলিম লীগের সংহতি বৃদ্ধি করেছিল এবং অন্যদের কাছে মুসলিম লীগের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৪১ সালের শেষে এসে জাপান জার্মানীর পক্ষে দিয়ে আমেরিকা ও বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় এবং বিদ্যুত গতিতে বার্মা দখলে এনে ভারত সীমান্তে এসে হাজির হওয়ায় বৃটেনের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠল। এ সময় জাপানীরা কোলকাতায় বোমা ফেললে ভারতীয় জনগণের মধ্যেও ত্রাসের সৃষ্টি হলো। ভারতীয় জনগণের সহযোগিতা এই সময় বৃটেনের জন্যে অপরিহার্য হয়ে উঠল। সুযোগ বুঝে কংগ্রেস ১৯৪১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে গৃহীত ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে অনিবার্য সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু একমাত্র মুক্ত ও স্বাধীন ভারতই জাতীয় ভিত্তিতে দেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে এবং এই যুদ্ধের বিপর্যয়ের মধ্য থেকে উদ্ভাবিত বৃহত্তর সমস্যাসমূহ সমাধানে সাহায্য করতে পারে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৫৮৫।] কংগ্রেস এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে তার আগের দাবীর ই প্রতিধ্বনি করল, যে দাবীতে কংগ্রেস ভারতকে স্বাধীনতা দানের সুস্পষ্ট ঘোষণা চেয়েছিল এবং যুদ্ধকালীন সময়ে কংগ্রেসকে ভারতে মন্ত্রীসভা গঠন করতে দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। যার অর্থ ছিল মুসলমান সহ সকল সংখ্যালঘুর অধিকার ও অস্তিত্ব উপেক্ষা করে কংগ্রেস কর্তৃক ভারতের শাসন কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করা। কংগ্রেস শুধু এই প্রস্তাব গ্রহণ নয়, তার পাশাপাশি বৃটিশের প্রতি তাদের শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিল।
এই অবস্থায় ভারতের সংখ্যাগুরু জনগণের প্রতিনিধি কংগ্রেসের চাপে যুদ্ধে বিপর্যস্ত বৃটেনের নতি স্বীকারের আশংকা দেখা দিল। উদ্বিগ্ন মুসলিম লীগ ২৬ থেকে ২৭শে ডিসেম্বর (১৯৪১ ) তার ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে বলল, “—–সাম্প্রতিক ঘটনাবলী লক্ষ্য করলে আশংকা হয় যে, —নীতি বর্জন করে কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে। সেই কারণে ওয়ার্কিং কমিটি বৃটিশ জনসাধারণ ও সরকারকে সাবধান করে দিচ্ছে যে, যদি —-প্রতিশ্রুতি থেকে কোন রূপ বিচ্যুতি ঘটে তাহলে মুসলামনেরা এটাকে বিশ্বাস ভংগ রূপে গণ্য করবে। তাছাড়া ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবী বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত বা ঘোষণা করা হলে মুসলিম ভারত তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করবে”।–[‘Quid-e-Azam’, G. Allana, পৃষ্ঠা ৩৩৫, ৩৩৬।] এই প্রস্তাব গ্রহণের ৫ দিন পরে ২রা জানুয়ারী (১৯৪২) লীগ সভাপতি কায়েদে আযম এক বিবৃতিতে আরও স্পষ্টভাবে বললেন, “—কংগ্রেস ভারতের আশু শর্তহীন স্বাধীনতার এবং অখণ্ড ও গণতান্ত্রিক ভারত ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নে বয়ঃপ্রাপ্তদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত গণপরিষদ গঠনের দাবী বিন্দুমাত্র ত্যাগ করে নাই। এর সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠা। মুসলমানদের কাছে এটা কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না। —-মুসলিম ভারত বাঁচার তাগিতদে এবং আন্তনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস ও অন্যান্য হিন্দু প্রতিষ্ঠান সমূহ মুসলমানদের সর্বভারতীয় সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করে সমগ্র ভারতের উপর প্রাধান্য ও শাসন প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছে। এই ভাবে তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহের উপর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার —ব্যবস্থা করছে”।–[‘Quid-e-Azam’, G. Allana, পৃষ্ঠা ৩৩৫, ৩৩৬।] এর মাস খানেক পরে ফেব্রুয়ারী (১৯৪২) মাসে কোলকাতার এক অনুষ্ঠানে জিন্নাহ তার বক্তৃতায় বললেন, “মুসলমানদের পায়ের তলায় রাখবার ও হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের (কংগ্রেস ও হিন্দুদের) চালবাজি নিতান্ত শিশুও বুঝতে পারে, কিন্তু তাদের এই চালবাজি কখনো সফল হবে না –সময়ে তা প্রমাণিত হবে। —-বাঙালী মুসলমানেরা ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে এবং অবশিষ্ট ভারতও ঐক্যবদ্ধবাবে বাঙলার সাথে দাঁড়াবে”।–[‘Quid-e-Azam’, G. Allana, পৃষ্ঠা ৩৩৫, ৩৩৬।]
এখানে উল্লেখ্য, মুসলিম লীগ দলগতভাবে বৃটিশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করেনি, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করতে লীগ কাউকেই বাধা দেয়নি। পাঞ্জাব ও বাংলার প্রধানমন্ত্রীগণ বিশেষ করে পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী শওকত হায়াত খান পুর্নোদ্যমে বৃটিশকে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। অন্য পক্ষে দাবী আদায়ের লক্ষ্যে কংগ্রেস ১৯৩৯ সাল অর্থাৎ যুদ্ধের শুরু থেকেই আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল চিয়াং কাইশে ভারতে এলেন। বৃটিশ সরকারই তাঁকে নিয়ে এল কংগ্রেসকে বুঝাবার জন্যে, যাতে কংগ্রেস বৃটিশকে তার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করে। উল্লেখ্য, চিয়াং কাইশেকের সাথে নেহেরুর পূর্ব পরিচয় ছিল। কিন্তু চিয়াং কাইশেকের আগমনে কোন ফল হয়নি। তখন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মওলানা আজাদ। চিয়াং কাইশেকের সাথে আলোচনায় কংগ্রেস সেই কথাই বলল যা তারা বার বার বলে আসছে। যুদ্ধে ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিকতার পক্ষে থাকতে চায় কিনা –চিয়াং কাইশেকের এমন একটা প্রশ্নের জবাবে মওলানা আজাদ বলেন, “যুদ্ধ শেষে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের প্রতিশ্রুতি এবং যুদ্ধকালীন অবস্থায় কংগ্রেসকে সর্ববিভাগে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে বর্তমান ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসন মেনে নিয়ে সহযোগিতা করতে কংগ্রেস প্রস্তুত”।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ২৯২।] কংগ্রেসের এ দাবীর সরলার্থ হলো, ‘ভারতের মুসলমান ও অন্যান্য সকল সংখ্যালঘুরদাবী ও অধিকার’ পদদলিত করে সমগ্র ভারত কংগ্রেসের একাধিপত্য স্থাপন। কংগ্রেসের এ মানসিকতার কারণেই কোন সমঝোতা-প্রয়াস ফলপ্রসূ হয়নি।
একদিকে যুদ্ধে বৃটেনের খারাপ অবস্থা, অন্যদিকে ভারত-সমস্যা সমাধানের জন্যে মিত্রদের চাপে বাধ্য হয়ে বৃটিশ সরকার একটা সুস্পষ্ট সমাধান প্রস্তাব নিয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে পাঠালেন ভারতে। ১৯৪২ সালের মার্চে তিনি ভারতে এলেন। তাঁর মিশনের অন্যান্য সদস্য ছিলেন, লর্ড পেথিক লরেন্স এবং মিঃ এম, ভি, আলেকজাণ্ডার। স্যার ক্রিপস কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই হয়তো বৃটিশ সরকার আশা করে তাকেই পাঠিয়েছিলেন সমস্যা সমাধানের জন্যে। এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস বৃটিশ সরকারের দেয়া প্রস্তাব ঘোষণা করলেনঃ
“ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতিসমূহ সম্পর্কে এদেশ উদ্বেগ প্রকাশিত হওয়ার মহামান্য সম্রাটের সরকার সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে ভারতের যথাশীঘ্র সম্ভব স্বায়ত্বশাসন লাভের উদ্দেশ্যে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান, সেগুলো নির্দিষ্ট পর্যায়ে উল্লেখ স্পষ্ট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটা নতুন ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করা যা একটি ডোমিনিয়ন হবে এবং এই নতুন ডোমিনিয়ন বৃটেন ও অন্যান্য ডোমিনিয়নের রাজার প্রতি আনুগত্যের সাধারণ সূত্রে আবদ্ধ থাকবে, কিন্তু অন্যান্য ডোমিনিয়নের সকল বিষয়ে সমান থাকবে, আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে কোন মতেই অধীনস্থ থাকবে না। মহামান্য সম্রাটের সরকার এই লক্ষ্যে নিম্নোক্ত ঘোষণা প্রকাশ করছেনঃ
১) যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যাবহিত পরে ভারতের জন্যে একটা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে নিম্ন বর্ণনানুযায়ী একটি নির্বাচিত সংস্থা গঠিত হবে।
২) এই শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থার দেশীয় রাজ্যসমূহের অংশগ্রহণের জন্যে নিম্ন বর্ণনানুযায়ী ব্যবস্থা থাকবে।
৩) মহামান্য সম্রাটের সরকার উক্ত রূপে রচিত শাসনতন্ত্র গ্রহণ ও কার্যকরী করার দায়িত্ব গ্রহণ করছে, কিন্তু শর্ত হলোঃ
ক) বৃটিশ ভারতের কোন প্রদেশ যদি নতুন শাসনতন্ত্র গ্রহণে সম্মত না হয়, তাহলে তার ক্ষেত্রে বর্তমান শাসনতন্ত্র বজায় থাকবে এবং যদি পরে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে তবে সেরূপ ব্যবস্থা থাকবে। এইরূপ যোগদানে অনিচ্ছুক প্রদেশগুলো যদি ইচ্ছা করে, তাহলে সম্রাটের সরকার একই রূপ পন্থায় রচতি ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের পূর্ণ সমমর্যাদা সম্পন্ন নতুন শাসনতন্ত্রে সম্মতি দিতে প্রস্তুত থাকবে।
খ) সম্রাটের সরকার এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থার মধ্যে আপোশ আলোচনার দ্বারা এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এই সন্ধিচুক্তিতে বৃটিশের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত সমস্ত বিষয় সন্নিবেশিত হবে; এতে সম্রাটের সরকার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু বৃটিশ কমনওয়েলথের অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ভবিষ্যত সম্পর্ক সম্বন্ধে কোন প্রকার বাধা নিষেধ আরোপিত হবে না।
৪) যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বে ভারতের প্রধান সম্প্রদায়গুলি যদি অন্য কোন পন্থা সম্পর্কে একমত না হয়, তাহলে নিম্নোক্ত উপায়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থা গঠিত হবে।
যুদ্ধেল পর প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হবে এবং নির্বাচনের ফলাফল জানবার অব্যাবহিত পরে সমস্ত প্রাদেশিক আইনসভার নিম্ন পরিষদসমূহ একক ইলেক্টোরাল কলেজ হিসেবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থার সদস্য নির্বাচন করবে। নতুন সংস্থার ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্য সংখ্যার প্রায় এক দশমাংশ হবে।
৫) ভারতের বর্তমান সংকটপূর্ণ সময় থেকে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ অপরিহার্যরূপে অবশ্যই সম্রাটের সরকারের হাতে রাখতে হবে। কিন্তু ভারতের সামরিক, নৈতিক ও বস্তুগত সম্পদ পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর দায়িত্ব ভারতের জনগণকে গ্রহণ করতে হবে। দেশের কমনওয়েলথ ও জাতি-ইউনিয়নের পরামর্শ সভায় আশু ও কার্যকরী অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সম্রাটের সরকার ভারতের প্রধান প্রধান অংশ সমূহের নেতৃবৃন্দকে আহবান করার ইচ্ছা করেন। এই রূপে তারা ভারতের ভাবী স্বাধীনতার জন্যে অতি প্রয়োজনীয় কাজে সক্রিয় ও গঠনমূলক সাহায্য প্রদানে সক্ষম হবেন”।
সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দানের পর ক্রিপস মিশন ২৫শে মার্চ থেকে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সাথে এ নিয়ে আলাপ করেন। ২৭শে মার্চ তারিখে সাক্ষাত হয় মিঃ গান্ধীর সাথে। গান্ধী ক্রিপসকে বলেন যে, “ক্রিপস যে প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন, তার বাইরে যদি তাঁর কিছু দেয়ার না থাকে তাহলে ক্রিপস পরবর্তী জাহাজে ইংল্যাণ্ড ফেরত যেতে পারেন”।–[‘History of the Freedom Movement in India’, Vol-4, Page 345 (Tarachand)] দলগত ভাবে কংগ্রেস তার প্রতিক্রিয়া জানাতে আরও সময় নিল ৫ দিন। কংগ্রেস ২রা এপ্রিল তার প্রস্তাবে বলল, যেহেতু পরিকল্পনায় প্রদেশসমূহকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে এবং ভারতের অখণ্ডতা নষ্ট করার পথ সুগম করা হয়েছে, তাই প্রস্তাবটি কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্য নয়। যে কারণে কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল, সেটাই ছিল মুসলিম লীগের জন্য প্রস্তাবটি গ্রহণ করার পক্ষে প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু তবু মুসলিম লীগ ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারল না। মুসলিম লীগ ১১ই এপ্রিল তার প্রস্তাবে বলল, “যদি ক্রিপস প্রস্তাবে একাধিক ইউনিয়ন গঠনের ব্যবস্থার দ্বারা পরোক্ষভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা স্বীকৃত হয়েছে, তথাপি —বর্তমান আকারে বৃটিশ সরকারের প্রস্তাব লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ, দুই জাতির জনগণকে একক ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাস করতে বাধ্য করা উচিত নয় এববং যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ইউনিয়ন গঠন তাতে মুসলমানদের যোগ দিতে বাধ্য করা সংগত নয়”।
উল্লেখ্য যে, কংগ্রেস ২রা এপ্রিল তারিখ ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও তা গোপন রাখলো। শুধুমাত্র চিঠিতে বিষয়টি ক্রিপস মিশনকে জানায় এবং তার সাথে দর কষাকষিতে লিপ্ত হলো। দরকষাকষি ব্যর্থ হবার পর ১১ই এপ্রিল কংগ্রেস চূড়ান্তভাবে ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আর এই প্রত্যাখ্যানের কারণ যেটা কংগ্রেস প্রকাশ্যে বলেছিল (২রা এপ্রিলের প্রস্তাব অনুসারে), সেটা ছিল না। ক্রিপস নিজেই বলেছেন, “বৃটিশ সরকারের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার কারণ সম্বন্ধে কংগ্রেস বাইরে যা প্রকাশ করছে তা ঠিক নয়, পরন্তু —সেক্রেটারী অব স্টেট ও ভাইসরয়ের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত সম্পূর্ণ জাতীয় সরকার গঠনের কংগ্রেসী দাবী বৃটিশ স্বীকার করতে রাজী না হওয়ায় কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬০০] আসলে কংগ্রেসের ২রা এপ্রিলের প্রস্তাব ছিল বৃটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির একটা কৌশল এবং গান্ধীর ২৭শে মার্চের উক্তিও ছিল তাই। ২রা এপ্রিলের পর কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অবিরাম চাপ দিয়ে গেছে যুদ্ধকালীন অবস্থায় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের পরিবর্তে কংগ্রেসের মনোনীতদের নিয়ে একটা পূর্ণ জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় বৃটিশ সরকারকে রাজী করতে। এই ভাবে কংগ্রেস যে কোন উপায়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হাত করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। “গান্ধী, নেহেরু, রাজেন্দ্র, মওলানা আজাদ প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের এ প্রসংগে বক্তব্য এই ছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হাতে পেলে সাম্প্রদায়িক তথা হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান আপনাতেই হয়ে যাবে। বৃটিশ সরকারের পক্ষে তখনকার পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা অসম্ভব হবে। এতদ্ব্যতীত কেন্দ্রীয় সরকারী ক্ষমতা আয়ত্তাধীন হওয়ার পর গণপরিষদ গঠন ও ইচ্ছামত শাসনতন্ত্র তৈরী করাও খুব সহজ হবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬০০] কিন্তু বৃটিশের অস্বীকৃতির জন্যে যুদ্ধেল ডামাডোলের সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকার হস্তগত করার কংগ্রেসের এ সাধ পুরণ হয়নি। এই অবস্থাতেই কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয় ১১ই এপ্রিল তারিখে। আর ব্যর্থ ক্রিপস মিশন ১২ই এপ্রিল স্বদেশ যাত্রা করে।
ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলো, কিন্তু এর মাধ্যমে স্পষ্ট হলো যে, বৃটিশ সরকার ভারতের সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যাপারে দৃঢ় এবং সে কারণেই নতুন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কংগ্রেস লীগের সমঝোতার উপর বৃটিশ সরকার জোর দিচ্ছিল। এ ছাড়া বুঝা গেল যে, বৃটিশ সরকার একক ভারতীয় ইউনিয়ন গঠনের পক্ষপাতি হওয়া সত্তেও এক বা একাধিক প্রদেশের প্রস্তাবিত ভারতীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকার দাবী স্বীকার করার মাধ্যমে বৃটিশ সরকার পরোক্ষভাবে ভারত বিভাগের সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন। এতে মুসলিম লীগেরই জয় হলো।–[‘India Wins Freedom: The other Side’, A. W. Khan, পৃষ্ঠা ১৩৮ (মূল বিবরণের জন্যেঃ ‘India Pakistan Year Book, 1948 দ্রষ্টব্য)।] আর মুসলিম লীগের জন্যে যেটা জয় ছিল, সেটা কংগ্রেসের কাছে পরাজয়।
এই পরাজয় এবং পর্দা-অন্তরালের দরকষাকষিতে ব্যর্থ হয়ে কংগ্রেস বিশেষ করে গান্ধী ভীষণ ক্রুব্ধ হলেন। মনে হলো ভারতে বৃটিশের অস্তিত্ব তিনি মুহুর্তের জন্যেও বরদাশত করতে রাজী নন। তাঁর বৃটিশ বিরোধী এ মনোভাব উদ্দীপ্ত হয়েছিল জাপানী বিজয়ের দ্বারাও। কংগ্রেস নেতা মওলানা আজাদের মতে “এই সময় গান্ধীর ধারণা হয়েছিল যে, মিত্র শক্তিরা (বৃটেন পক্ষ) এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না”।–[‘India Wins Freedom: A. K. Azad, Page 41.] ক্ষুব্ধ গান্ধী হয়তো তখন মুধু জাপানের বিজয় নয়, জাপানের ভারত বিজয়ও কামনা করছিলেন। মওলানা আজাদের সাক্ষ্যঃ “গান্ধী তাঁকে (মওলানা আজাদকে) স্পষ্টতঃ বলেন, যদি জাপানী বাহিনী কখনও ভারতে আসে তাহলে তারা আমাদের শত্রু হিসেবে আসবে না, আসবে বৃটিশের শত্রু রূপে”।–[‘India Wins Freedom: A.K. Azad, Page 41.] বস্তুতঃ এই চিন্তায় উৎসাহিত হয়েই ক্রিপস মিশন চলে যাবার পর গান্ধী বলে বসলেন, “বৃটিশের ভারত ত্যাগ নিয়ে আলোচনার কোন প্রশ্ন উঠে না। তারা হয় (ভারতের) স্বাধীনতা স্বীকার করবে, নয়তো করবে না”।–[‘India Pakistan Year Book, 1948, Page 922.] গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের এই মনোভাবে উজ্জীবিত হয়েই কংগ্রেস বৃটিশের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করলো। ১৯৪২ সালের ১৫ই জুলাই কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি তার এক প্রস্তাবে বলল, “কংগ্রেস দীর্ঘকাল ধরে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, কিন্তু বিদেশী শক্তির উপস্থিতির দরুন সমাধান সম্ভব হয়নি। —বৈদেশিক অধীনতা ও হস্তক্ষেপ শেষ হলে পক্ষগণ পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছাবে। তাছাড়া ভারত স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বৈদেশিক আক্রমণ কার্যকরীভাবে রোধ করা যাবে না। সেই কারণে অনতিবিলম্বে বৃটিশের ভারত ত্যাগ করা উচিত। যদি তা না করা হয় তাহলে ১৯২০ সাল থেকে এ যাবত যে ‘অহিংস শক্তি সঞ্চিত হয়েছে’ কংগ্রেস তা প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে”।–[‘Documentation on the India Situation Since the Crips Mission’, New York, 1942, Page 28, 29.]
মওলানা আজাদের মতে কংগ্রেসের এ কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি লক্ষ্য ছিল বৃটিশকে ভয় দেখানো এবং তার উপর চাপ সৃষ্টি করা। আর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্য, যুদ্ধকালীন সময়ে কংগ্রেসকে জাতীয় সরকার গঠনের অধিকার দিতে বৃটিশকে বাধ্য করা। মওলানা আজাদ বরেছেন, “প্রস্তাবটি অনেকটা দরকষাকষির জন্যে করা হয়েছিল”।–[‘India Wins Freedom’, A.K. Azad, Page 80.] এই দরকষাকষির জন্যেই গান্ধী তাঁর আশ্রম-বাসিনী শিষ্যা মীরা বেনকে-[মীরা বেন জাতিতে ইংরেজ। আসল নাম মিস শ্লেড।] ভাইসরয়ের নিকট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফল হয়নি। ভাইসরয় লর্ড লিনথিগো তার সাথে দেখা করতেই রাজী হননি। এই ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে ক্রুব্ধ কংগ্রেস ১৯৪২ সালের ৭ই আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ১৫ই জুলাই তারিখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাব অনুমোদন করে বলল, “যদি বৃটিশ ভারত ত্যাগে অসম্মত হয়, তাহলে গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস সংগ্রাম আরম্ভ করা হবে। গান্ধী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন এবং মুসলিম লীগের মত দলগুলোকে ‘ভুই ফোঁড়’ আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করলেন, “এ হবে জনগণের সংগ্রাম…..। কতকগুলো দলের সাহায্যে কংগ্রেসকে ধ্বংস করা অসম্ভব”।
কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের ও বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করলেন মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ। তিনি বললেন, “এই আন্দোলনের ফলে কেবল যে উগ্রতা দেখা দেবে তাই নয়, পরন্তু এর ফলে বহু রক্তপাত ও নির্দোষ মানুষের জীবন নষ্ট হবে, একথা কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ জানেন না বিশ্বাস করা অসম্ভব। এই সংকটকালে বল প্রয়োগ দ্বারা তারা তাদের সকল দাবী আদায় করতে চান, অথচ এই দাবী পূরণ হলে অন্য সকল স্বার্থের, বিশেষতঃ মুসলমানদের স্বার্থ কোরবানী করা হবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬২০।] জিন্নাহ আরও বললেন যে, কংগ্রেস বৃটিশ সরকারকে ব্ল্যাক মেইল করতে চাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে বৃটিশ সরকারকে ভারতে এমন একটা সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে ও এমন একটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে চাপ দিচ্ছে যা ভারতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করবে।–[‘The Great Divide’, by S. V. Huson, Page 106.] ১৬ থেকে ২০ শে আগষ্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত দীর্ঘ এক প্রস্তাবে মুসলিম লীগ বলল, “বৃটিশ সরকার কর্তৃক কংগ্রেস তোষণনীতি অনুসরণ এবং মুসলিম লীগের বিভাগ নীতি বৃটিশ সরকার অগ্রাহ্য করার ফলে ভারত ছাড় আন্দোলন-রূপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। —মুসলিম লীগ স্বাধীনতা চায়, কিন্তু কংগ্রেস যে স্বাধীনতা চায়, তাতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তান ধ্বংস করা হবে। ওয়ার্কিং কমিটি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করেছে যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা এবং মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবী করে ও সেই সাথে হিন্দুস্তান তথা হিন্দুদের স্বাধীনতাও দাবী করে।–[‘Pakistan Movement, Historic Document’, G. Allana, Page 221-225] অতপর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন থেকে মুসলমানদের সম্পূর্ণ তফাৎ থাকার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, “আশা করা যায়, মুসলমানদের উপর কোন প্রকার উৎপীড়ন অথবা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হবে না”।–[‘Pakistan Movement, Historic Document’, G. Allana, Page 221-225] কিন্তু মুসলিম লীগের এ শেষ আশাবাদটা পূর্ণ হয়নি।
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাব গ্রহণ করার পরপরই অর্থাৎ ৯ই আগষ্ট তারিখে গান্ধী, নেহেরু সহ শীর্ষস্থানীয় সকল কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়ে যায় সংগে সংগেই। গান্ধীর জীবনী লেখক বি, আর নন্দের ভাষায়, “কয়েকটি প্রদেশে বিশেষতঃ বিহার, যুক্ত প্রদেশ, বাঙলা ও বোম্বাইতে জনতার ক্রোধ বাঁধ ভাঙার মত প্রবাহিত হয় এবং বৃটিশ শাসনের প্রতীকসমূহের উপর তারা চড়াও হয়। ডাকঘর, থানা, আদালত পুড়িয়ে দেয়া হয়, রেল লাইন, রেল ভবনসমূহ ও রেলের জিনসপত্রের ক্ষতি করা হয়, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কেটে দেয়া হয়”।–[‘Mahatma Gandhi’ B.R. Nanda, Page 230-31.] কয়েকটি স্থানে ট্রেনযাত্রী ইউরোপীয়কে হত্যা করা হয়।–[‘Pathway to Pakistan’, Khalikuzzaman, page 285-286.] কিন্তু হিন্দুদের এই হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বড় লক্ষ্য ছিল মুসলমানরা। ৯ই আগস্ট গোলমাল শুরু হওয়ার পর থেকেই মুসলমানদের উপর “নানা স্থানে হিন্দুদের অত্যাচারের খবর জিন্নার অফিসে আসতে থাকে।–[‘Muhammad Ali Jinnah: A Political Study’, M.H. Saiyed, Page 335] বিশেষতঃ বিহার ও যুক্ত প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে পুলিশের মুসলদান দারোগাকে হত্যা করা হয়, কনষ্টেবলদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়”।–[‘Pathway to Pakistan’, Khalikuzzaman, page 285-286.] কংগ্রেসের এই হিংসাত্মক আন্দোলনের সময় ৭৫০ জন লোক নিহত হয়, আহত ১২ শতের অধিক। সম্পদের ক্ষতি হয় অপরিমেয়।
কংগ্রেসের এই ধ্বংস ও বিদ্রোহকে কংগ্রেসী ঐতিহাসিকরা স্বতঃস্ফুর্ত বলে অভিহিত করেছেন। আসলে তা নয়। এটা ছিল কংগ্রেসের সুপরিকল্পিত একটা বিদ্রোহ। কংগ্রেস ধরে নিয়েছিল, নেতাজী সুভাষ বসুর পরিচালনায় জাপানী বাহিনীর প্রবেশ আসন্ন। তারা প্রবেশ করলেই কংগ্রেস শাসন ক্ষমতা হাতেনেবে। কংগ্রেসের বিদ্রোহ ছিল তারই প্রস্তুতি। কংগ্রেস নেতা মওলানা আজাদের ভাষায় “মে ও জুন (১৯৪২) মাসে সমগ্র পরিকল্পনা তৈরী করা হয়। –পরিকল্পনায় ছিল এই যে, জাপানীরা যেমনি বাংলায় পৌঁছবে ও বৃটিশ বিহারের দিকে পশ্চাদপসরণ করবে, অমনি কংগ্রেস দেশের শাসন ভার গ্রহণ করবে”।–[‘India Wins Freedom’, A. K. Azad, Page 73, 74-81.] বহু দরকষাকষি এবং অনেক চাপ ও হুমকি ধমকি সত্বেও বৃটিশের ঘাড়ে চড়ে যখন ভারতের কর্তৃত্ব দখল করা সম্ভব হয়নি, তখন কংগ্রেস এইভাবে জাপানীদের সহায়তায় ভারতের ক্ষমতা একক হাতে কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু কংগ্রেসের এ আশাও সফল হলোনা। জাপানী বাহিনী ভারত প্রবেশ যেমন হলোনা, তেমন কংগ্রেসের বিদ্রোহ কয়েক সপ্তাহের বেশী টিকলোনা। কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হয়েছিল আগস্টের ৯ তারিখ থেকে এবং তা শেস হয়ে গেল সেপ্টম্বরের (১৯৪২) মধ্যেই।
কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন ব্যর্থ হবার পর ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টা নিস্তব্ধ রাজনীতির কাল। এ সময় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ জেলে ছিলেন এবং বাইরে কংগ্রেসের আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছিল। মুসলিম লীগ এ সয়টাকে দলের বিস্তার ও শক্তি বৃদ্ধির জন্যে কাজে লাগায়। ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে দিল্লীতে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে কায়েদে আযম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পুনঃ নির্বাচিত হন। পুনঃনির্বাচিত জিন্নাহ মুসলিশ লীগের এ সম্মেলনে এক অস্বাভাবিক দীর্ঘ ভাষণ দেন, যার মধ্যে ছিল অতীতের বিস্তারিত পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা। ভাষণটিকে মুসলমানদের সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ও অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা হয়। এতে তিনি ১৮৬১ সাল থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির বর্ণনা দেন।–[বক্তৃতাটি পূর্ণ বিবরণ এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত হলো।]
১৯৪৩ সালের ২০শে অক্টোবর লর্ড ওয়াভেল ভারতের নতুন ভাইসরয় হিসেবে ভারতে আসেন। ভারতের ভবিষ্যত সম্পর্কে লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৪ সালের ১৭ই জুলাই ভারতের আইন পরিষদে বললেন, “আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে যুদ্ধ জয়, কিন্তু সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্যেও আমাদের তৈরী হতে হবে… ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা তৈরী করা কঠিন কাজ। তবে বৃটিশ সরকারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলতে পারি যে, বৃটিশ কমনওয়েলথের স্বাধীন অংশীদার হিসেবে পূর্ণ ও শর্তহীন স্বায়ত্ত শাসিত উন্নতিশীল ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনই বৃটিশ জনসাধারণের ইচ্ছা। —আপনারা ভূগোল পরিবর্তন করতে পারবেন না। —ভারত একটা স্বাভাবিক ইউনিট”।–[‘Transfer of power in India’, V.P Menon, Page 153, 154.] এই বক্তৃতায় ওয়াভেল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের খুব প্রশংসা করেন, তবে বলেন যে, “১৯৪২ সালের ৮ই আগস্টের প্রস্তাব প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারীদের মুক্তি দেয়া সম্ভব হয়”।–[‘Transfer of power in India’, V.P Menon, Page 153, 154.] উল্লেখ্য, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তখন জেলে আটক ছিলেন।
ওয়াভেলের বক্তব্যে ছিল কংগ্রেস তোষণের সুর। বিশেষ করে ঐক্যবদ্ধ ভারত সম্পর্কে ওয়াভেলের উক্তি মুসলিম লীগকে খুবই বিক্ষুব্ধ করল। ভাইসরয়ের এই উক্তির উত্তরে কায়েদে আযম বললেন, ‘ভাইসরয় কংগ্রেসের সরোবরে সাঁতার কাটছেন”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৫৯।]
স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৪৪ সালের ৬ই মে গান্ধীকে জেল থেমে মুক্তি দেয়া হলো। উল্লেখ্য, এর আগে জেল থেকে ওয়াভেলের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে গান্ধী বলেন যে, আগস্ট আন্দোলনের (ভারত ছাড় আন্দোলণ) হিংসাত্ম কার্যাবলীর জন্যে কংগ্রেস মোটেই দায়ী নয়’। উত্তরে ওয়াভেল কংগ্রেসের কার্যক্রমের ব্যর্থতা উল্লেখ করেন এবং বাধা দানের নীতি পরিত্যাগ করে সহযোগিতার জন্যে আবেদন করেন।–[‘Transfer of Power in India’, V. P. Menon, Page 155, 156.] পরে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথাই অস্বীকার করেন। ১৯৪৫ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের পক্ষে জওহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও গোবিন্দ বল্লভ পন্থ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি অথবা গান্ধীজি কারও দ্বারা এই আন্দোলন অনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয়নি”।–[‘India Today’, R.P Dutt, Page 564.] গান্ধীজি জেল থেকে বেরিয়ে ওয়াভেলের পরামর্শ মোতাবেক ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাবের আইন অমান্য বিষয়ক অংশটি প্রত্যাহার করে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
মিঃ গান্ধী জেল থেকে বেরুনোর ২৮দিন আগে ১৯৪৪ সালের ৮ই এপ্রিল রাজা গোপালাচারী হিন্দু মুসলিম ঐক্যের একটি পরিকল্পনা জিন্নার কাছে পেশ করেন। রাজা গোপালাচারীর এই ফর্মূলায় বলা হলোঃ
“ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মধ্যে আপোশ মীমাংসার শর্তাবলী, যাতে মিঃ জিন্নাহ ও গান্ধীজি একমত হলেন এবং তারা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা করবেন।
(১) স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র রচনায় নিম্নলিখিত শর্ত সাপেক্ষে মুসলিম লীগ ভারতের স্বাধীনতার দাবী সমর্থন করবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকার গঠনে কংগ্রেসের সহযোগিতা করবে।
(২) যুদ্ধ শেস হওয়ার পর ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি জেলা সমূহ, যেখানে মুসলমানরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই সকর জেলার সীমানা চিহ্নিত করার জন্যে একটি কমিশন নিয়োগ করা হবে। পরিচিহ্নিত অঞ্চলের অধিবাসীরা হিন্দুস্তান থেকে আলাদা হতে চায় কিনা তা নির্ধারণের জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে অথবা অন্য কোন কার্যকরী পন্থায় গণভোট গ্রহণ করতে হবে। যদি অধিকাংশ অধিবাসী সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দেয় তাহলে সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করা হবে এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো স্বাধীন ইচ্ছামত যে কোন রাষ্ট্রে যোগদান করতে পারবে।
(৩) অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সকল দলের নিজ নিজ বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ থাকবে।
(৪) বিভাগ সাব্যস্ত হলে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য পারস্পরিক চুক্তি হতে হবে।
(৫) অধিবাসীদের স্থানান্তর ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে গণ্য হবে।
(৬) বৃটেন কর্তৃক ভারত শাসনের সমস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তরের পর এই সকল ব্যবস্থা কার্যকরী করার বাধ্যবাধকতা থাকবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৬০।]
এই পরিকল্পনার সাথে লিখিত পত্রে রাজা গোপালাচারী জিন্নাহকে জানান যে, “বিরোধ নিষ্পত্তির একটা ভিত্তির অবতারণা করছি। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে আমি গান্ধীজির সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং তিনি এতে পূর্ণ অনুমোদন দান করেছেন…..”।–[‘কায়েদে আযম’ আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৬০।] গোপালাচারির এ ফর্মূলার ব্যাপারে হাঁ বা না বলা জিন্নার জন্যে সম্ভবপর ছিলনা কতকগুলো কারণে। যেমনঃ (১) মুসলিম লীগের সাথে আলোচনা করার আগেই তাকে এ ফর্মূলা গ্রহণ অথবা বর্জন করতে হবে, (২) ফর্মূলার ভালো মন্দ নিয়ে আলোচনা করা যাবেনা, পুরোটাই গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে এবং (৩) গান্ধী ও গোপালাচারী কংগ্রেসের দায়িত্বশীল নেতা দূরের কথা, সাধারণ সদস্যও নন, অথচ জিন্নাহ মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। গান্ধী ও গোপালাচারীর কথা বলার মধ্যে কোন দলীয় বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু জিন্নার আছে। তাছাড়া ফর্মূলার শর্তাবলীতে এমন সব বিষয় আছে যা অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর এবং মুসলিম লীগের এ পর্যন্তকার দাবী ও সিদ্ধান্তের খেলাফ, যা জিন্নাহ মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। যেমনঃ (১) এক নম্বর ফর্মূলায় উল্লেখিত স্বাধীন ভারতে ভাবী শাসনতন্ত্রের রূপরেখা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। (২) এই ১ নং ফর্মূলায় এমনভাবে কথা বলা হয়েছে যাতে মনে হয় মুসলিম লীগ স্বাধীনতা চায়না, যা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। (৩) এছাড়া এক নম্বর ফর্মূলার মূল পক্ষ বানানো হয়েছে কংগ্রেসকে, আর মুসলিম লীগকে সহযোগী, অথচ মুসলিম জাতির প্রতিনিধি হিসাবে মুসলিম লীগ সমান মর্যাদা সম্পন্ন। (৪) ফর্মূলার দ্বিতীয় শর্তে সকল অধিবাসীর গণভোট দেয়ার পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে মুসলমানদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে এবং জেলাওয়ারী গণভোট গ্রহণের ফলে পাকিস্তান হবে জেলাওয়ারী ও শতধা বিচ্ছিন্ন, তাছাড়া অঞ্চল চিহ্নিত করলেও ভোটের জন্যে যে কমিশন হবে তা গঠন করবে কে এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে কে? (৫) চার নম্বর শর্তে উল্লেখিত চুক্তি সম্পাদনের দায়িত্ব কে পালন করবে, কারণ বিভাগোত্তর সরকার গঠনের আগেই এটা হচ্ছে। (৬) ফর্মূলার ষষ্ঠ শর্ত অনুসারে বৃটিশ কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে? সেটা যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে হয়, তাহলে সেখানে কংগ্রেস যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং তারা যদি কোন অজুহাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়?
এসব অসুবিধা ও ফাঁক ফোকর সামনে থাকা সত্ত্বেও জিন্নাহ রাজা গোপালাচারীকে জানিয়ে দিলেন, তিনি ফর্মূলাটি মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। জিন্নার এই জবাবের প্রেক্ষিতে রাজা গোপালাচারী ১৯৪৪ সালের ৮ই জুলাই এক টেলিগ্রাম মারফত আলোচনা ভেঙ্গে দিলেন এবং বললেন, যেহেতু কায়েদে আযম এই ফর্মূলার অনুমোদনে অনিচ্ছুক, তাই লীগ কাউন্সিলে এটা পেশ করে কোন লাভ নেই’।
লক্ষণীয় যে, গান্ধীর কাছ থেকে অনুমোদন নেয়ার এক বছর পর রাজা গোপালাচারী জিন্নার কাছে ঐ ফর্মূলাটি পেশ করেছিলেন। কেন তিনি এত দেরী করেছিলেন বা কেন তাকে এত দেরী করানো হয়েছিল? আবার তাড়াহুড়া করে আলোচনা তিনি ভেঙ্গে দিলেনই বা কেন? প্রথম প্রশ্নটির উত্তর আমরা পাই ‘Gandhi-Jinnah Talks’ পুস্তিকার ভূমিকায় লিয়াকত আলী খানের কাছ থেকে। তিনি লিখেন, “মিঃ গান্ধীর অনুমোদন প্রাপ্ত ফর্মূলাটি গোপনীয়তা এক বছরেও বেশী সময় ছিল। এসময় গান্ধী ও ভাইসরয়ের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার জন্যে আলাপ-আলোচনা চলছিল। —বৃটিশ সরকার জাতীয় সরকার গঠনের দাবী মেনে নিলে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সফল হতো। —কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাদের চেষ্টা সফল হলে মুসলিম লীগ তথা কায়েদে আযমের সাথে আলোচনার কোনই প্রয়োজন হতোনা”।–[‘কায়েদে আযম’ আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৬১।] অর্থাৎ মুসলিম লীগকে পাশ কাটিয়ে এককভাবে বৃটিশের কাছ থেকে দাবী আদায়ে ব্যর্থ হবার পর মুসলিম লীগকে সাথে পাবার আশায় জিন্নার কাছে এসেছিল কংগ্রেস। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা এর উল্টো। সেটা হলো, “কায়েদে আযমকে হাত করতে মুসলিম লীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে অক্ষম হয়ে গান্ধী ও কংগ্রেস আবার বৃটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে উৎগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন”।–[‘কায়েদে আযম’ আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৬৪।] এর আরও একটা কারণ এই ছিল যে, ইতিমধ্যে গান্ধী জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং বৃটেনে শ্রমিক দল কংগ্রেসের সঙ্গে আপোশ করার জন্যে বৃটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল। এতে বৃটিশ সরকারের সাথে আলোচনার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল মনে হয়। আলোচনা ভেঙ্গে দেয়ার মাত্র ২দিন পর ইংল্যাণ্ডের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘নিউজ ক্রনিকলের’ বিশেষ প্রতিনিধি স্টুয়ার্ট গোল্ডার এসে গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন। মনে করা হয় তিনি কোন উচ্চ মহলের প্রতিনিধি ছিলেন। তার কাছে গান্ধীও নরম সুরে কথা বলেন। যেমন তিনি বলেছিলেন, “১৯৪২ সালে যা দাবী করা হয়েছিল, ১৯৪৪ সালে তা করা যায় না, আইন অমান্য আন্দোলনও আর করা যায় না। বর্তমানে বেসামরিক শাসন ব্যবস্থার উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব সম্পন্ন জাতীয় সরকার পেলেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন”।–[‘India Wins Freedom: The Other Side’, A. W. Khan, Page 1777] আসলে গোপালচারীর ফর্মূলা ছিল জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের জন্যে একটা ফাঁদ। কায়েদে আযম এ দাবী মেনে নিলে টাকার জোরে মীরজাফর সৃষ্টি করে কংগ্রেস তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে নিত। কংগ্রেসের এ ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিলে ‘মাদ্রাজ সানডে অবজারভার’ পত্রিকার বিরুদ্ধে আনীত রাজা গোপালাচারীর মানহানি মামলার বিবরণীতে। এই মামলার সাক্ষী রাজা গোপালাচারীর সহকর্মী ও বন্ধু মিঃ গুণবর্ধন কোর্টে সাক্ষ্য দান কালে বলেনঃ আমি (গুনবর্ধন) তাঁকে (গোপালাচারীকে) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কংগ্রেস মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে নাকচ করার পরেও তিনি কেন পাকিস্তান দাবীকে সমর্থন করে চলেছেন? তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেন, ‘এ সম্বন্ধে ঘোষণা সমূহকে বিশেষ মনোযোগের সাথে আপনার পড়া উচিত। দেখতে পাবেন, আমি যা বলেছি মিঃ জিন্নার স্কিম হতে তা সম্পূর্ণ পৃথক। সোজাসুজি পাকিস্তান দাবীর বিরুদ্ধাচরণ করে কংগ্রেস একটা মস্তবড় ভুল করেছে। মিঃ জিন্নাহ চেয়েছিলেন পাকিস্তানের মুসলিমরাই কেবল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে, আমি বলি পাকিস্তানের হিন্দু মুসলিম উভয়েই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে। পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বাঙ্গালার অমুসলিমরা গণনায় সংখ্যালঘিষ্ট হলেও অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে ভীষণ শক্তিশালী। যদি তারাদেখতে পায় যে, এ অঞ্চলগুলো পৃথক হবার উপক্রম করেছে, তখন কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়ে এ সুযোগকে তারা নস্যাত করে দেবে। পাকিস্তান দাবীকে বাধা দিলেই তা অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠবে। —কংগ্রেস এখানেই ভুল করেছে। আর আমি এ ভুলের সংশোধন করেছি মাত্র। জাতীয় গভর্ণমেণ্ট গঠনের ব্যাপারে একবার কোন রকমে আমরা যদি লীগের সমর্থন পাই এবং কংগ্রেস হাতে ক্ষমতা পায় তখণ এ সংকটের কি করে আমাদের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় তা আমরা জানি”।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাঈম উদ্দিন আহমদ, মেম্বার কেন্দ্রীয় পরিষদ, নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্র লীগ, প্রথম সংস্করণ, ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ৬৮, ৬৯ (দ্বিতীয় সংস্করণ-১৯৭০)।] এই জীবন্ত সাক্ষ্যের পর আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখেনা যে, কেন রাজা গোপালাচারী গান্ধীর সাথে শলা-পরামর্শ করে ফর্মূলাটি জিন্নার কাছে পেশ করেছিলেন এবং কেন তাড়াহুড়া করে জিন্নাহকে দিয়ে পাশ করিয়ে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। মিঃ জিন্নাহ কংগ্রেসের এই ফাঁদকে শুধু ছিঁড়েই ফেলেননি। বিখ্যাত হিন্দুনেতা শ্রী নিবাস শাস্ত্রীর ভাষায়ঃ “ফর্মূলা (গোপালাচারী ফর্মূলা) লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মিঃ জিন্নাহ জয়ী হয়েছেন। তিনি কংগ্রেস ও দেশের উপর সর্বাধিক প্রভাব সম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পাকিস্তানের নীতি স্বীকার করিয়ে নিয়েছেন।–[গোপালাচারী ফর্মূলা প্রতারণামূলক ছিল বটে, কিন্তু দ্বারা গান্ধী ও গোপালাচারী দেশ বিভাগ অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব তা নীতিগত স্বীকার করেছিলেন।] রাজনীতিকদের মধ্যে তিনি ভাগ্যবান। চার বছর আগে তিনি লর্ড লিনলিথিগোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে পরামর্শ না করে এবং তাদের সম্মতি না নিয়ে ভারতের ভাবী শাসনতন্ত্রে কোন পরিবর্তন আনা হবে না। মিঃ জিন্নাহ এ বিষয়েও গর্ব করতে পারেন। —কংগ্রেস তার পূর্বতন দাবীর বিরুদ্ধে গিয়ে স্বীকার করেছেন যে, মুসলিম লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি….”।–[‘India Wins Freedom: The other side’, A. W. Khan, page 184.]
রাজা গোপালাচারী ও জিন্নার মধ্যকার আলোচনা ভেঙ্গে পড়ার ঠিক দু’মাস পরে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে (১৯৪৪) জিন্নাহ ও গান্ধীর মধ্যে আলোচনা শুরু হলো। আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মিঃ গান্ধী। কিন্তু গান্ধীর এ উদ্যোগ ছিল ব্যক্তিগত। অর্থাৎ নিজ দায়িত্বে তিনি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। তবে তিনি অনুমোদন করিয়ে নেবেন। অন্যদিকে জিন্নাহ মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়ে এবং তাদের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নিচ্ছিলেন। সুতরাং এদিক থেকে আলোচনায় জিন্নাহ ও গান্ধীর অবস্থান সমান ছিল না। এটা ছিল আলোচনার একটা অসুবিধাজনক দিক। আলোচনায় এ অসুবিধা বা ফাঁক গান্ধী ইচ্ছা করে সৃষ্টি করে রাখতেন, বেকায়দায় পড়লে যাতে তিনি বলতে পারেন, যা তিনি বলেছেন বা মেনে নিয়েছেন তা তাঁর ব্যক্তিগত, কংগ্রেসের নয়। গান্ধীর এ দ্বি-মুখিতায় বিরক্ত হয়েই সম্ভবতঃ ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো ওয়াভেলকে বলেছিলেন, “গান্ধীজী জীবিত থাকা অবস্থায় এই দেশে কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১৪৮, (দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, ১৯৮৭)।]
আলোচনায় মিঃ গান্ধী প্রথমে রাজা গোপালাচারীর ফর্মূলাকেই ভিত্তি হিসেবে ধরলেন। পরে মুসলিম লীগের প্রস্তাবকে ভিত্তি করে আলোচনা হলো। সর্বশেষে গান্ধী নিজস্ব একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। গান্ধীর পরিকল্পনাটি ছিল নিম্নরূপঃ
“ক) কংগ্রেস ও লীগ কর্তৃক অনুমোদিন একটা মিশন সীমানা নির্ধারণ করবে। নির্ধারিত অঞ্চলের অধিবাসীদের মতামত সেই অঞ্চলের পূর্ণ বয়স্কদের ভোটের দ্বারা বা অনুরূপ কোন পন্থায় জেনে নিতে হবে।
খ) পৃথক হবার পক্ষে ভোট হলে এটা অবধারিত হয়ে যাবে যে বৈদেশিক শাসন হতে ভারত মুক্ত হবার পর যত শীঘ্র এই অঞ্চলগুলো মিলিত হয়ে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে। সুতরাং ভারতবর্ষ দু’টো স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে। সুতরাং ভারতবর্ষ দু’টো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়বে।
গ) পৃথক হবার জন্যে সন্ধিপত্র থাকবে। এতে পররাষ্ট্র নীতি, দেশরক্ষা, আভ্যন্তরীন যানবাহন, শুল্ক, ব্যবসায়-বাণিজ্য থাকবে, কারণ এসব বিষয় চুক্তিকারী পক্ষগুলোর ভিতর তখনও সমাধানের বিষয় বলে প্ররিগণিত হবে।
ঘ) দু’টো রাষ্ট্রে সংখ্যালঘিষ্টদের অধিকার সংরক্ষণের শর্তও এই সন্ধিপত্রে থাকবে।
ঙ) কংগ্রেস ও লীগ কর্তৃক এ চুক্তি গৃহীত হবার সঙ্গে সঙ্গেই উভয় দল মিলিত ভাবে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এক কর্মসূচী গ্রহণ করবে”।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাই উদ্দীন আহমদ (প্রকাশ, ডিসেম্বর ১৯৪৫) পৃষ্ঠা ১০১।]
এই ফর্মূলায় গান্ধীজী নতুন কিছুই বললেন না। রাজা গোপালাচারীর ফর্মূলা থেকে গান্ধীর এ ফর্মূলাটি অনেকটা সংক্ষিপ্ত এবং ভাষাও কিছুটা পৃথক, কিন্তু মূল বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে রাজা গোপালাচারীর ফর্মূলা আর গান্ধীর এ ফর্মূলার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যাহোক আলোচনা তিক সপ্তাহ ধরে চলে। আলোচনাটা একটু ব্যতিক্রম ধর্মী। উভয়ের মধ্যে যে আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল মূলত দু’টি বিষয়ের উপর। একটি দ্বিজাতিতত্ব ও অন্যটি ভারত বিভাগ পদ্ধতি।
গান্ধী দ্বিজাতিতত্ব অর্থাৎ মুসলমানরা কোন পৃথক জাতি, একথা মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। আলোচনার সময় জিন্নাহকে তিনি বলেন, “ধর্মান্তরিত একদল মানুষ ও তাদের বংশধরেরা পূর্ববর্তীদের থেকে স্বতন্ত্র জাতীয়তা দাবী করার নজীর আমি ইতিহাসে খুঁজে পাইনা। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ভারতে যদি একজাতি থেকে থাকে, তাহলে তাদের সন্তানদের বড় একটা অংশ ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও সেই একজাতিই থাকে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] এর উত্তরে কায়েদে আজম বলেন, “আমরা বলি জাতীয়তার যে কোন সংজ্ঞায় মুসলমান ও হিন্দুরা দু’টো প্রধান জাতি। —-আমাদের রয়েছে সুনির্র্দিষ্ট (স্বতন্ত্র) সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ভাষা ও শিল্প ও স্থাপত্য, নাম ও পরিচয়, মূল্যবোধ, আইন ও নীতিমালা, আচার ও পঞ্জিকা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যোগ্যতা ও আকাঙ্ক্ষা। —আন্তর্জাতিক আইনের সব নিয়মে আমরা একটা আলাদা জাতি।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] দ্বিজাতিতত্ত্বের আলোচনায় সুবিধা করতে না পেরে গান্ধী ১৯শে সেপ্টেম্বর আলোচনায় বললেন, “দ্বিজাতিতত্বের আলোচনায় সুবিধা করতে না পেরে গান্ধী ১৯শে সেপ্টেম্বর আলোচনায় বললেন, “দ্বিজাতিতত্বের বিতর্ক বাদ দিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ভত্তি করে কি সমাধান করতে পারিনা?” –[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] জিন্নাহ উত্তর দিয়েছিলেন, “মুসলমানরা আঞ্চলিক ভিত্তিতে আন্তনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবী করেনা, তারা এই দাবী করে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে। সুতরাং দ্বিজাতিতত্বে বাদ দিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] গান্ধী তার পরিকল্পনায় ভারত বিভাগের প্রতি স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, কিন্তু মুসলমানদেরকে জাতি হিসাবে স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। এর মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে ছিল গান্ধীর কুটকৌশল। স্বতন্ত্র জাতি স্বীকার করা এবং আঞ্চলিক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মেনে নেয়ার মধ্যে রয়েছে গুরুতর পার্থক্য। এই পার্থক্যের কারণেই জিন্নাহ মেনে নিতে পারেননি রাজা গোপালাচারীর ফর্মূলা এবং গান্ধীর ফর্মূলাও। গান্ধী ফর্মূলায় ‘ভারত বিভাগ পদ্ধতি’ নিয়ে আলোচনা এখানে এসেই ব্যর্থ হয়। বিভাগ পদ্ধতির ক্ষেত্রে গান্ধীর পক্ষ থেকে তার ফর্মূলার ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘যে সকল জেলায় মুসলমানদের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্থাৎ অন্তত শতকরা ৭৫ জন মুসলমান রয়েছে। সেগুলি গণভোট ছাড়াই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রর অন্তর্ভূক্ত হবে। বাকি সকল জেলার অধিবাসীদের গণভোট নিতে হবে।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] উত্তর কায়েদে আযম বললনঃ যেহেতু মুসলমানরা স্বতন্ত্র জাত হিসেবে বিভাগ দাবী কর (অঞ্চলগত দাবীতে নয়), সেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল (শতকরা ৫০ ভাগের বেশী) ও প্রদেশসমূহের (শতকরা ৫০ ভাগের বেশী) সকল অধিবাসীর গণভোট গ্রহণের প্রশ্ন ওঠেনা। (কারণ, স্বভাবতই ঐ সকল অঞ্চলের সংখ্যালঘু অমুসলমানরা বিভাগ দাবী করছে না)”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] তাছাড়া জেলাওয়ারী গণভোটের মধ্যে মুসলমানদের জন্যে যে আরেকটা অন্ধকার দিক রয়েছে তার দিকে অংগুলি সংকেত করে জিন্নাহ বললেন, ‘জেলাওয়ারী গণভোট গ্রহণের ফলে পাকিস্তান হবে ‘পোকায় খাওয়া’ অর্থাৎ (পাকিস্তান অঞ্চলের) মাঝে মাঝে হিন্দুস্তান হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান’।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৪, ৬৭৫।] গান্ধী ফর্মূলার ভারত-বিভাগ পদ্ধতিত আরেকটা শর্ত এই ছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরিত অর্থাৎ বৃটিশ মাসন বিলোপের পর অন্তর্বর্তী সরকার গণভোট গ্রহণ ও বিভাগের ব্যবস্থা করবে। জিন্নাহ এ শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। ‘কারণ গান্ধীর প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকার হবে সম্পূর্ণ হিন্দু প্রভাবিত, তাতে মুসলমানেরা হবে সংখ্যালঘিষ্ঠ। যৌথ দায়িত্ব ভিত্তিক অন্তর্ভর্তী সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সকল প্রশ্নের সমাধান হবে বিধায় উক্ত রূপ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর নানা পন্থায় বিভাগ প্রস্তাব বানচাল করে দিতে পারে’।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৩, ৬৭৪।] বিভাগ-প্রস্তাব বানচাল হওয়া সংক্রান্ত জিন্নার আশংকা যথার্থ ছিল। প্রকৃত পক্ষে বিভাগ প্রস্তাব বানচাল করা যাবে এই আশাতেই গান্ধী ও গোপালাচারী ভারত বিভাগে রাজী হয়ে ঐ সুকৌশল ফর্মূলা পেশ করেছিলেন। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কিঞ্চিত প্রকাশ ঘটেছে রাজা গোপালচারীর মানহানির মামলায় মিঃ গুনবর্ধনের সাক্ষ্যে। এ আশংকার কারণেই জিন্নাহ আগে চাচ্ছিলেন বিভাগ, তারপর স্বাধীনতা, আর ঐ ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য গান্ধী চাচ্ছিলেন আগে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা হস্তান্তর তারপর বিভাগ। গান্ধী ফর্মূলায় গণভোট ও দেশ বিভাগের আগেই চুক্তি সম্পাদনের কথা। গান্ধীর সাথে আলোচনায় জিন্নাহ এ ধরনের শর্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “পাকিস্তানের রূপ কি হবে তা জানার পূর্বেই প্রতিরক্ষা, অর্থ, পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, শুল্ক, যোগাযোগ, ইত্যাদি বিষয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে। —এটা স্বাধীনতা নয় এটা এক ধরনের প্রাদেশিক অটোনমি, যাতে অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে বিপুল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ফেডারল কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এ সকল বিষয়ে দু’টো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র যেভাবে পারস্পরিক চুক্তি সম্পাদন করে, স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন হিন্দুস্তান সেই ভাবেই চুক্তি সম্পাদনের ব্যবস্থা করবে”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৭৪, ৬৭৫।]
দ্বিজাতিতত্ব ও ভারত বিভাগ পদ্থতি বিষয়ে উপরোক্ত প্রবল মত পার্থক্যের কারণেই জিন্নাহ গান্ধীর মধ্যকার আলোচনা ব্যর্থ হলো। আলোচনা শেষে তাঁরা উভয়ে এক যুক্ত ইশতেহারের মাধ্যমে তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করলেন। পরে গান্ধী ১৯৪৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর আলোচনায় ব্যর্থতার কথা স্বীকার করলেন। পরে গান্ধী ১৯৪৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর আলোচনার ব্যর্থতার জন্যে জিন্নাহকে অভিযুক্ত করে এক সাংবাদিক সাক্ষাতকার দিলেন।–[‘জিন্নাহ ও গান্ধীর এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে উল্লেখ করা হলো।] এর উত্তরে ১৯৪৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে জিন্নাহ গান্ধীর অভিযোগের জবাব দিলেন।–[‘জিন্নাহ ও গান্ধীর এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে উল্লেখ করা হলো।] আলোচনার পর গান্ধী জিন্নার উপর বিক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ এই হতে পারে যে, গান্ধী জ্নিনার সাথে তার আলোচনায় কৌশলগত দিক দিয়ে ঠকে গিয়েছিলেন। গান্দীর জীবনীকার বি, আর, নন্দের ভাষায়, ‘এক সময় যে মহাত্মা ভারত বিভাগকে পাপ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, তিনি পরে (মুসলমানদের) আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকার সম্পর্কিত পন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এটা জিন্নার আরেক দফা জয় বলতে হবে।–[‘Mahatma gandhi’, B. R. Nanda, page 239.]
জিন্নাহ গান্ধী আলোচনা ব্যর্থ হবার পর এবং ১৯৪৫ সালের জুনে বৈঠক শুরু হবার আগে আরও দু’টি ঘটনা ঘটে। একটি অদলীয় সম্মেলন, আরেকটি লিয়াকত দেশাই ফর্মূলা উত্থাপন। অদলীয় সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিলেন স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু। দলীয় লীগ কংগ্রেস আলোচনায় যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, তা তিনি অদলীয় সম্মেলনের মাধ্যমে করতে চাইলেন। সম্মেলনটি অদলীয় হলেও স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু গান্ধীর আশীর্বাদ-[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাঈম উদ্দিন আহমদ, প্রথম প্রকাশ ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ৭৩।] নিয়েই তাঁর কাজে হাত দিয়েছিলেন, অথচ এধরনের কোন সাক্ষাত তিনি জিন্নার সাথে করেননি। এই অদলীয় সম্মেলন ১৯৪৫ সালের ৭ই এপ্রিল যে পনেরটি প্রস্তাব পেশ করল তাও কংগ্রেস মত অনুসারেই প্রণীত-[অদলীয় সম্মেলনের ১৫টি প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ হলোঃ
ক) ভারত ভাগ করা যাবেনা।
খ) ভাবী শাসনতন্ত্র রচনার জন্যে (খসড়া) ১৬০ জন সদস্য সম্বলিত একটি শাসতন্ত্র তৈরী সংস্থা গঠন করতে হবে।
গ) দেশীয় রাজ্যসমূহকে ইউনিট হিসেবে যোগদান করতে দিতে হবে।
ঘ) বৃটিশ ভারতের কোন প্রদেশকে প্রস্তাবিত ইউনিয়নে যোগদান না করা কিম্বা ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার দেয়া হবেনা।
ঙ) পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করতে হবে।] এবং লীগের পাকিস্তান প্রস্তাবের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মজার ব্যাপার যাদের সম্মেলনে আহবান করা হয় তারা সবাই হয় কংগ্রেস অথবা হিন্দু মহাসভার অন্ধ বিশ্বাসী, নইলে সরকারের দালাল। কমিটিতে যে ২/৩ জন মুসলিমকে নেয়া হয়েছিল। তারাও সরকারের খেতাব ধারী”।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাঈম উদ্দিন আহমদ, প্রথম প্রকাশ ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ৭৩।] ১৯৪৪ সালের ১৯শে নভেম্বর দিল্লীতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সম্মেলনের স্ট্যান্ডিং কমিটি ১০ই ডিসেম্বর জিন্নার সাথে সাক্ষাতের উদ্যোগ নিল। তাদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করে জিন্নাহ তাদের জানিয়ে দিলেন, দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আমি অদলীয় সম্মেলন অথবা এর স্ট্যান্ডিং কমিটিকে স্বীকার করিনা। তিনি (তেজবাহাদুর সাপ্রু) যেন এটাকে তার প্রতি ব্যক্তিগত অসৌজন্য প্রকাশ বলে মনে না করেন।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-2, Jamiluddin Ahmed, page 152, 155.] বস্তুত অদলীয় সম্মেলন ছিল কংগ্রেসেরই পেছন দরজার একটি পরিকল্পনা। যার জন্যে রাজা গোপালাচারী উৎসাহের সাথে বলেছিলেন, “এ সম্মেলন যে রায়ই দিক না কেন মুসলিমদের তা মেনে নেয়া উচিত”।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাঈম উদ্দিন আহমদ, প্রথম প্রকাশ ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ৭৪।] যা হোক, তেজ বাহাদুর সাপ্রুদের পরিশ্রমই ধুশু সার হয়েছিল, সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তারা এক ইঞ্চিও আগাতে পারেননি। ভি.পি. মেননের ভাষায়ঃ “বিশিষ্ট ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া সত্ত্বেও কমিটির প্রচেষ্টা অগ্রগতির সহায়ক হয়নি। একদিকে কমিটিতে প্রথম শ্রেণীর কোন মুসলমান ছিলেন না, অন্যদিকে পাকিস্তানের ধারণা এবং পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিম লীগের মনোভাব অধিকতর বিরোধী হয়”।–[‘Transfer of power in India’, V.P. Menon, page 179] দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সহকারী নেতা লিয়াকত আলী খান এবং কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা ভুলা ভাই দেশাই এর মধ্যকার জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কিত একটা চুক্তি। চুক্তিতে বলা হয়েছিল,
“বর্তমান শাসন ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই কংগ্রেস ও লীগ নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে একটা সাময়িক জাতীয় সরকার গঠন করতে সম্মত আছেঃ
ক) নতুন একজিকিউটিভ কাউন্সিলে কংগ্রেস ও লীগ উভয়েই সমান সংখ্যক আসন পাবে।
খ) এই রূপে প্রতিষ্ঠিত গভর্ণমেণ্ট অনুন্নত সম্প্রদায় ও শিখদের স্বার্থকে অবহেলা করবেনা।
গ) সামরিক সর্বাধিনায়ক এই কাউন্সিলের একজন এক্স-অফিসিও সভ্য হবেন।
ঘ) নির্বাচিত আইন সভায় অধিকাংশ সভ্য যে প্রস্তাব সমর্থন করবেনা, সেরূপ কোন প্রস্তাব এই কাউন্সিল কার্যে পরিণত করবেনা।
ঙ) গভর্ণমেন্ট গঠন করবার অব্যাবহিত পরেই এই নতুন সরকার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বন্দী সভ্য ও অন্যান্য কংগ্রেসীদের মুক্তি দেবেন।
চ) কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্ট গঠিত হবার পর বর্তমানে যে সমস্ত প্রদেশে ৯৩ ধারা প্রচলিত আছে সেই সমস্ত প্রদেশে লীগ-কংগ্রেস যুক্ত সরকার গঠিত হবে।
ছ) উল্লেখিত নীতির উপর ভিত্তি করে বড়লাটের ভারতের জন্য নতুন প্রস্তাব পেশ করতে বলা হবে”।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাইম উদ্দীন আহমদ, প্রথম সংস্করণ ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ১০২।]
পরবর্তী কালের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, লিয়াকত আলী খান ও ভুলা ভাই দেশাই তাঁদের স্ব স্ব দলের সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই এই চুক্তি করেছিলেন। অন্তত মুসলিম লীগ এ বিষয়টা জানত না। জিন্নার ভাষায় তিনি এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নন এবং যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা লীগের অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি।–[‘Transfer of power in India’, V.P. Menon, page 176-178.] অন্যদিকে লিয়াকত আলী খানও বাকায়দা কোন চুক্তি সম্পাদনের কথা স্বীকার করেননি। চুক্তিটি প্রকাশ হলে তিনি এক বিবৃতিতে বলেন যে, দেশাই তাঁর সাথে সাধারণভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা করেছিলেন।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৬৯৭।] সব দিকের বিবেচনায় মনে হয় সংসদীয় কংগ্রেস দলের নেতা ভুলা ভাই দেশাই এ পরিকল্পনার প্রণেতা এবং তিনি এটা করেছিলেন গান্ধীর পরামর্শে। ১৯৪৫ সালের ১৩ই জানুয়ারী ভাইসরয়ের পি,এস এবং ২০শে জানুয়ারী ভাইসরয় ওয়াভেলকে চুক্তি সম্পর্কে অবহিত করার সময় ভুলা ভাই দেশাই গান্ধীর অনুমোদনের কথা তাকে বলেছিলেন। লিয়াকত-দেশাই পরিকল্পনা খুব বেশীদূর এগোয়নি, তবে এই ফর্মূলা পরবর্তী বৃটিশ ফর্মূলা ও সিমলা আলোচনা ভিত্তি ছিল। এদিক থেকে লিয়াকত দেশাই পরিকল্পনার একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কংগ্রেস পরে লিয়াকত-দেশাই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে এবং দেশাই কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। এমনকি অবশেষে দেশাই পর্যন্ত এ ধরনের চুক্তির কথা অস্বীকার করেন।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাইম উদ্দিন আহমদ, প্রথম প্রকাশ পৃষ্ঠা ৭৫।] মনে করা হয় এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যে দ্বিজাতিতত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল, সেই ভুল শোধরানোর জন্যেই এই চুক্তি অস্বীকার করা কংগ্রেসের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় গান্ধী এ ধরনের চুক্তির অনুমোদন দিয়েছিলেন কেন এবং কংগ্রেস নেতা দেশাই এটা প্রণয়ন করে ভাইসরয়ের কাছে হাজির করেছিলেন কেন? এর একটা সুন্দর জবাব পাওয়া যায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য জনাব নাঈম উদ্দিন আহমদের কাছে। তিনি ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থে বলেন, “দেশাই-লিয়াকত চুক্তির একটা গোপনীয় কারণও ছিল। এ ব্যাপারটা কংগ্রেসের গত কয়েকমাসের কার্যকলাপ দেখে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন জেলে থেকে কংগ্রেস কর্মীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। কিন্তু বেরিয়ে আসার উপায় কি? আগস্ট বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে তারা এতবড় গুরুতর অন্যায় ও ভুল করেছিলেন যে, নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করবার কোন উপায় ছিলনা, নিজেদের বিবেকের নিকটেই এরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। একমাত্র লীগের সাথে আপোষ রফার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে রাজী হওয়ার দ্বারাই নেতৃবৃন্দকে জেল হতে বের করে আনা সম্ভব। —-এই চুক্তির কারণেই ওয়াভেল রাজবন্দীদের মুক্ত করতে শুরু করেন। দেশাইজীর চাল সাফল্য বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে গেল”।–[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাইম উদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ৭৫ (তৃতীয় সংস্করণ ১৯৭০)।]
লীগ-কংগ্রেস সমঝোতা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর ভারতের বৃটিশ সরকার সমস্যা সমাধানের জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করল। ১৯৪৫ সালের প্রথম কোয়াটরআর শেষ হবার আগেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মিত্র শক্তির বিজয়ের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আশু হয়ে উঠবে। অন্যদিকে সমঝোতায় পৌঁছার ক্ষেত্রে লীগ কংগ্রেসের বার বার ব্যর্থতায় ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ বৃটিশ সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করলেন। এ বিষয়ে লর্ড ওয়াভেল লণ্ডন গেলেন। লণ্ডন থাকার সময় তিনি লিয়াকত-দেশাই চুক্তি সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন।–[‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ১৪৮।] কারণ ব্যক্তিগতভাবে ওয়াভেল চুক্তিটি খুবই পছন্দ করেছিলেন।
জুন মাসে ওয়াভেল ফিরে এলেন ভারতে। ১৯৪৫ সালের ১৪ই জুন ওয়াভেল সফরের ফল হিসেবে বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট এমারি হাউস অব কমন্সে ভারতের আশু রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের একটা পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন যে, যদি ভারতের প্রধান রাজনেতিক দল সমূহ জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সর্বপ্রকার সাহায্য করতে স্বীকার করে, তাহলে যুদ্ধোত্তর কালীন পুনর্গঠনের কার্য সম্পাদনের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকারগঠন করতে বৃটিশ সরকার প্রস্তুত আছে। জাতীয় সরকার সম্পর্কিত তার ঘোষনায় বলা হলো, “ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাদের মধ্য থেকে সদস্য নিয়োগ করে ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিল পূণর্গঠন করা হবে। সদস্যদের মধ্যে মুসলমান ও বর্ণহিন্দুদের সংখ্যা সমান থাকবে। ভাইসরয় ও প্রধান সেনাপতি ব্যতীত কাউন্সিলের অন্য সকল সদস্য ভারতীয় হবেন। প্রদেশসমূহ থেকে ৯৩ ধারা প্রত্যাহার করে প্রধান দলগুলির প্রতিনিধি নিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাসমূহ গঠন করা হবে। উপজাতীয় ও সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয় ব্যতীত অন্য সমস্ত পররাষ্ট্র বিষয় ভারতীয় সদস্যদের অধীনে দেয়া হবে। তবে এই অন্তর্বর্তী পরিবর্তন দ্বারা ভারতের জন্যে এক বা একাধিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে কোন রকম বাধা থাকবেনা”। এই একই তারিখে ভারতে লর্ড ওয়াভেল এক বেতার বক্তৃতার মাধ্যমে বৃটিশ সরকার ঘোষিত এই পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দিলেন এবং এই পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনার জন্যে তিনি ২৫শে জুন সিমলায় একটি সম্মেলন আহবান করলেন।
এই বৃটিশ পরিকল্পনাটি লিয়াকত-দেশাই ফর্মূলার যে ধারণা তার খুব কাছাকাছি। প্রধান পার্থক্য হলো, লিয়াকত-দেশাই ফর্মূলায় জাতীয় সরকারে লীগ-কংগ্রেস প্যারেটির কথা বলা হয়েছিল, আর বৃটিশ পরিকল্পনায় সেখানে মুসলিম ও বর্ণহিন্দুর মধ্যে প্যারেটির কথা বলা হলো। এতে কংগ্রেস ও লীগ উভয় পক্ষেলই কিছু লাভ-ক্ষতি হলো। লীগ-কংগ্রেস প্যারেটির মধ্যে জাতীয় সরকারে মুসলিম লীগের অংশ সুনির্দিষ্ট ছিল, কিন্তু এতে দ্বি-জাতিতত্বের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি ছিলনা। এতে এক দিকে মুসলিম লীগ লাভ করেছিল, অন্যদিকে তার ক্ষতি হচ্ছিল। আর মুসলিম ও বর্ণহিন্দুর প্যারেটির মধ্যে দ্বি-জাতিতত্বের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি মুসলিম লীগ পেল। কিন্তু জাতীয় সরকারে মুসলিম লীগের অংশ সুনির্দিষ্ট হলোনা। যেহেতু কংগ্রেসে কিছু মুসলমান ছিল এবং যেহেতু কংগ্রেস নিজেকে মুসলমানদেরও প্রতিনিধি বলে দাবী করে, তাই কংগ্রেস জাতীয় সরকারে মুসলমানদের ভাগ থেকে একটা অংশ দাবী করে, তাই কংগ্রেস জাতীয় সরকারে মুসলমানদের ভাগ থেকে একটা অংশ দাবী করে, তাই কংগ্রেস জাতীয় সরকারে মুসলমানদের ভাগ থেকে একটা অংশ দাবী করতে পারে। এটা ছিল কংগ্রেসের জন্যে বড় লাভের দিক, কিন্তু তার জন্যে ক্ষতির দিক হলো, দ্বি-জাতিতত্ব এর ফলে স্বীকৃতি পেয়ে গেল। বৃটিশ পরিকল্পনায় কংগ্রেসের সবচেয়ে অসন্তোষের দিক ছিলো, এতে কংগ্রেসকে কার্যত বর্ণহিন্দুর সংগঠন বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং এ দ্বারা বর্ণহিন্দু থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরকে জাতি হিসেবে বিচ্ছিন্ন করা হলো।
কংগ্রেসের জন্যে ক্ষতিকারক দু’টি বিষয়েরই তীব্র প্রতিবাদ করলো কংগ্রেস। গান্ধী বললেন, “বরঞ্চ কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে সমতার ব্যাপারটা উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু বর্ণ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সমতার নীতি গ্রহণ করার ফরে ‘অপরিবর্তনীয় ধর্মীয় বিভাগ সৃষ্টি করা হবে”।–[‘The Struggle for Pakistan’, I. H. Querishi, page 233.] ২১ থেকে ২২শে জুন তারিখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ভাইসরয় আহুত সিমলা সম্মেলনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার প্রতিনিধিদেরকে জাতীয় সরকার সম্বন্ধে তিনটি নীতিগত দিক সুনির্দিষ্ট করে দিল। নীতি তিনটি হলোঃ (১) প্রস্তাবিত ব্যবস্থা অস্থায়ী ধরনের হতে হবে, (২) সাম্প্রদায়িক সমতা নীতি গ্রহণের অযোগ্য, (৩) সাম্প্রদায়িকতা সমতা নীতি প্রাদেশিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, এবং (৪) জাতীয় সরকারে মুসলমান সদস্যগণ কেবল মুসলিম লীগ দ্বারা মনোনীত হবেনা।
কংগ্রেসের এই দুর্বল সিদ্ধান্তের মধ্যে তার দ্বিধাগ্রস্ততার ছাপ পরিস্ফুট এবং এটা তার নৈতিক অবস্থান দুর্বল হওয়ারই প্রমাণ। কংগ্রেসের উল্লেখিত চারটি নীতির মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে। তৃতীয় নীতির দ্বারা দ্বিতীয় নীতিকে বাতিল করা হয়েছে। এখানে কংগ্রেসের নীতিগত অবস্থানের সারাংশ এই যে, কংগ্রেস দ্বিজাতিত্ব মেনে নিচ্ছে, কিন্তু জাতীয় সরকারে মুসলমানদের যে ভাগ, তা থেকে কংগ্রেসকে অংশ দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সিমলা কনফারেন্সে কংগ্রেসের এটাই ছিল নীতিগত অবস্থান।
কংগ্রেসের এই মনোভাবের জবাবে দিল্লী থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগের মুখপত্র ‘ডন’ এ বলা হলো, ‘শুধু মাত্র মুসলিম লীগ কর্তৃক মনোনীত মুসলিম সদস্যদেরকেই ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে নিতে হবে। কারণ মুসলিম লীগই ভারতের মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান’।
একটা প্রশ্ন, কংগ্রেস জাতীয় সরকারে দ্বিজাতিতত্ব সহ মুসলিম ও বর্ণহিন্দু প্যারেটির পরিকল্পনার প্রতি এত তাড়াতাড়ি সায় দিল কেন? সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে কংগ্রেস এটা মেনে নেবার কারণ হলো, জাতীয় সরকারে মুসলমানদের ভাগ থেকে একটা অংশ যদি কংগ্রেস হাত করতে পারে, তাহলে জাতীয় সরকারে সে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এই সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরেই সে ভারতের ভবিষ্যত শাসন ও পরিকল্পনায় দ্বিজাতিতত্ব প্রতিরোধের পথ করে নেবে। কংগ্রেসও মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পেল এই কাজটা তার জন্যে সহজ হবে। একজন কংগ্রেসী নেতা মিঃ রঙ্গ এর একটি প্রকাশ্য বিবৃতি এ রকম ছিলঃ “সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হোক অথবা সফল হোক কংগ্রেস জিতবেই। কংগ্রেস ওয়াভেল পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে লীগ-বৃটিশ যোগাযোগ নষ্ট করে দেবে। সম্মেলন ব্যর্থ হলেও কংগ্রেস এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, সরকার লীগকেই এজন্যে দায়ী করবে। সম্মেলন সাফল্যমণ্ডিত হলে (পাঞ্জাবের) ইউনিয়নিষ্টদের সহযোগিতায় কংগ্রেস লীগকেই জব্দ করবে। আমরা যদি ইউনিয়নিষ্টদের সহযোগিতা পাই, তাহলে লীগের কণ্ঠ রোধ করা সহজ হবে। —সরকারী পদগুলো আমরা অধিকার করব। এবং ক্ষমতা হাতে পেলেই লীগকে প্রাণান্ত করে তুলব”-[‘পাকিস্তান আন্দোলন’, নাইম উদ্দিন আহমদ, প্রথম সংস্করণ ১৯৪৫ (ডিসেম্বর), পৃষ্ঠা ৭৭।] ২৫শে জুন সিমলায় কনফারেন্স শুরু হলো। আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দিল জাতীয় সরকারে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের অধিকার নিয়ে। জাতীয় সরকারে মুসলিম সদস্য মনোনয়নের একক অধিকার মুসলিম লীগ দাবী করল। বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এবং কংগ্রেস এটা মেনে নিতে অস্বীকার করল। কংগ্রেস জাতীয় সরকারে মুসলমানদের ভাগ থেকে একটা অংশ দাবী করল। অচলাবস্থার এক পর্যায়ে এসে ২৯শে জুন (১৯৪৫) মিঃ জিন্নাহ এক বিবৃতিতে সকলকে জানিয়ে দিলেন, “যে কোন ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত সমঝোতায় আমরা অংশ গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। —-কিন্তু মুসলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে কংগ্রেস বা অন্য কোন দল কোন মুসলমান সদস্য নিয়োগ করবে, এ নীতিতে লীগ সম্মত হতে পারেনা। —ভাইসরয়ের প্রস্তাবিত কাউন্সিল গঠনের যে রূপ প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মুসলিম লীগ তথা মুসলমানদের সদস্যগণ সংখ্যালঘিষ্ঠ হবে এবং যেহেতু কেবিনেট ধরনে (অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুযায়ী সরকারকে পরিচালনার নীতি) কাউন্সিল গঠনের ইংগিত দেয়া হয়েছে, সেই হেতু মুসলিম লীগ সদস্যগণ কোণঠাসা হওয়ার ও লীগের পাকিস্তান দাবী বানচাল হওয়ার বাস্তব আশংকা আছে। এমনকি, ভাইসরয়ের বিশেষ ক্ষমতাও কার্যকরীভাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারবেনা”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-1, Jamiluddin Ahmed, page 175-180.] এর পর ৭ই জুলাই জিন্নাহ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে জানালেন, “(১) একজিকিউটিভ কাউন্সিলের মুসলমান সদস্যগণ একমাত্র মুসলিম লীগ কর্তৃক মনোনীত হতে হবে, এবং (২) সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা সদস্যগণ কর্তৃক অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জন্যে রক্ষাকবচ থাকতে হবে”।–[‘Quid-I-Azam’s Correspondence’, Sharifuddin Peerzada, page 311-319 (জিন্নাহ ওয়াভেল পত্রাবলীর জন্য দ্রষ্টব্য)।]
৯ই জুলাই ভাইসরয় ওয়াভেল এর উত্তরে জিন্নাহকে জানালেন যে, দ্বিতীয় দফায় জিন্নাহ যা চেয়েছেন, সে ধরনের কোন নিশ্চয়তা দিতে তিনি অপারগ’। এর একদিন পর ১১ই জুলাই তারিখে লর্ড ওয়াভেল জিন্নাহকে জানিয়ে দিলেন, পাঁচ মুসলিম আসনের মধ্যে চারজন তিনি লীগ থেকে নিতে সম্মত আছেন, তবে পঞ্চম আসনে লীগ বহির্ভূত একজন পাঞ্জাবী (ইউনিয়নিষ্ট পার্টির) মুসলমানকে নেয়া হবে’।
কংগ্রেস ওয়াভেলের এ প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। মুসলিম সদস্যদের একটা আসন কংগ্রেস না পাওয়া সত্বেও এটা মেনে নিয়েছিল। কারণ কংগ্রেস নিশ্চিত ছিল পাঞ।জাবের ইউনিয়নিষ্ট পার্টি থেকে যাকে নেয়া হবে তাকে কংগ্রেসের পক্ষে পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত এ প্রস্তাবের দ্বারা লীগকে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের একক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, অর্থাৎ মুসলিম শক্তি এর দ্বারা বিভক্ত হবে। এটা কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সাধনের সহায়ক।
লর্ড ওয়াভেলের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করলেন জিন্নাহ। তিতি ভাইসরয় ওয়াভেলকে জানিয়ে দিলেন, ‘ওয়াভেল পরিকল্পনার সাথে লীগ কোন সহযোগিতা করতে পারবেনা’। তিনি সুস্পষ্টভাবে আরও জানালেন, “১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে; সেই প্রস্তাবের মৌলিক দিক রক্ষা করে লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে প্রস্তুত আছে; এটা প্রথম শর্ত। দ্বিতীয় শর্ত হলো, যেহেতু মুসলশানরা একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় নয়, বরং সমান সংখ্যক আসন দাবী করেছিল। ওয়াভেল প্রস্তাবে এ শর্ত দুটিই নস্যাত করা হয়েছে”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamiluddin Ahmed, page 185-188]
মিঃ জিন্নার তরফ থেকে অসহযোগিতার জবাব পাওয়ার পরেই ভাইসরয় ওয়াভেল সিমলা আলোচনা ভেঙ্গে দিলেন। ভীষণ ক্রুব্ধ হলো এতে কংগ্রেস। লীগকে বাদ দিয়েই তারা বৃটিশের সাথে সমঝোতা করে জাতীয় সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছিল। সুতরাং সিমলা আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার সাথে সাথে হিন্দু পত্রিকাগুলো জিন্নার উপর খড়গহস্ত হল। তারা জিন্নাহকে ভারতের স্বাধীনতার সাথে প্রতিবন্ধক, স্বার্থপর, দাম্ভিক, ইত্যাদি নানাভাবে গালি-গালাজ করতে লাগল। এই সাথে বৃটেনের টাইমস, ডেইলি টেলিগ্রাফ, অবজার্ভার, নিউজ ক্রনিকাল প্রভৃতি পত্রিকাও জিন্নার উপর দোষারোপ করতে শুরু করল। প্রকৃতপক্ষে এই অভিযোগগুলো ছিল উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর শামিল। মুসলিম লীগকে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের অধিকার সম্পূর্ণটা না দেয়া সংক্রান্ত কংগ্রেসের ২১ ও ২২ শে জুনের প্রস্তাবটিই ছিল বিরোধের মূল উৎস। ওয়াভেলও এর সাথে সায় দিয়েছিলেন। তাছাড়া একজিকিউটিভ কাউন্সিলের গঠন শেষ পর্যন্ত এমন করা হয়েছিল যাতে মুসলমান নগণ্য সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছিল। তার উপর যদি আবার একটি মুসলিম আসন কংগ্রেসের অধিকার ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে লীগ কোন ভূমিকাই পালন করতে পারতো না। এই অবস্থাতেই জিন্নাহকে ভারতের মুসলমানদের স্বার্থে শক্ত ভূমিকা নিতে হয় যা ছিল ন্যায় সঙ্গত। জিন্নার জীবনীকার আকবর উদ্দীন লিখছেন, “সম্মেলনের ব্যর্থতার জন্যে কায়েদে আযমকে দায়ী করার পূর্বে দুটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, সম্মেলনের আরম্ভে ওয়াভেল বারোজন সদস্য নিয়ে একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করবেন বলেছিলেন। তন্মধ্যে ৫ জন বর্ণ হিন্দু (কংগ্রেস), ৫ জন মুসলমান, ১ জন তফসিলী ও একজন শিখ সদস্য থাকবে। পরে এই সংখ্যা পরিবর্তিত হয়ে ৫:৫:৩ শেষে ৫:৫:৪ হয়। কায়েদে আযম ভাইসরয়কে জানিয়েছিলেন যে, ১৪ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন লীগ সদস্য হলেও লীগ বিপদজনকভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, আবার এই ৫জনের মধ্যে যদি একজন অ-লীগ পাঞ্জাবী মুসলমানকে নেওয়া হয়, তাহলে লীগ অধিকতর সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে যায়। তৃতীয়ত, লীগ বহির্ভূত একজন পাঞ্জাবী মুসলমানকে সদস্য নিয়োগ করার অর্থই হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭০৩, ৭০৪।] যা কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রকে সাহ্যা করতো এবং বিপন্ন করে তুলতো মুসলিম সংগ্রামকে। সিমলা আলোচনা সম্পর্কে ইতিপূর্বে উল্লেখিত হিন্দু নেতা মিঃ রঙ্গ এর বিবৃতি এরই একটা বড় প্রমাণ।
সিমলা সম্মেলনের ব্যর্থতার দোষ মুসলিম লীগের উপর চাপিয়ে খুশী হলো বৃটিশ সরকারও। এতে করে তারা কংগ্রেসের কাছে নির্দোষ সাজার একটা সুযোগ পেল। কিন্তু সেই সাথে তারা মুসলিম লীগের গুরুত্ব স্বীকার না করে পারলনা। বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট আমেরী ভাইসরয় ওয়াভেলকে লিখলেন, “এবার কংগ্রেস নেতাদের বোঝা উচিত যে, সিমলা সম্মেলন ব্যর্থ হবার কারণ হলো মুসলিম লীগ। বৃটিশ সরকার, আপনি ও আমি কেউ কংগ্রেসের আকাঙ্ক্ষার প্রতিবন্ধক নই। —আগামী শীতের নির্বাচনে মুসলিম লীগ কয়টি আসন পাবে কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে কি না জানি না। তবে নির্বাচনে যদি লীগের জয় লাভ হয়, তাহলে আমরা লীগের দাবীকে অবহেলা করতে পারবোনা”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ১৪৮ (ষ্ট্যানলি ওফপোর্টের জিন্নাহ থেকে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ২৪৫, ১৪৬)।] যে যাই বলুক সিমলা সম্মেলনের ব্যর্থতা মুসলিম লীগের জন্যে শাপে বর হয়েছিল। আলোচনায় মুসলিম লীগের ভূমিকা ও জিন্নার দৃঢ়তা মুসলিম লীগকে যেন নতুন জীবন দিয়েছিল। এস, ভি, হাডসনের ভাষায়, “(সিমলা সম্মেলনের) তাৎক্ষণিক ফল ছিল মুসলিম লীগ এবং মুসলিম লীগ নেতার মর্যাদা বৃদ্ধি। সিমলা কনফারেন্সে মিঃ জিন্নাহ যে শক্তি দেখান তা একদিকে মুসলিম লীগকে ধাক্কা দিয়ে বহু সামনে এগিয়ে দেয়, অন্যদিকে তাদের (কংগ্রেসপন্থী) মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্যে ছিল এটা মারাত্মক একটা আঘাত”।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 126, 127.]
সিমলা সম্মেলন সমাপ্তি ঘোষণার মাত্র ১১ দিন পর ২৬ শে জুলাই বৃটেনে নতুন নির্বাচনে চার্চিলের বদলে এটলির সরকার ক্ষমতা এল। এর ১৯ দিন পর ১৫ই আগস্ট (১৯৪৫) জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। আর ভাইসরয় ওয়াভেল শীতকালে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষনা দিয়ে আলোচনার জন্যে ২১শে আগস্ট বৃটেন গেলেন। ফিরে এলেন ১৬ই সেপ্টেম্বর এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর তিনি শীতকালে সাধারণ নির্বাচন, নির্বাচনের পর শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, শাসন পরিচালনার জন্যে একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন ও পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ঘোষণা দিলেন। ওয়াভেলের ঘোষণায় ‘স্বাধীনতা দান’ এর কথা না থাকায় কংগ্রেস এবং ‘পাকিস্তান’ এর উল্লেখ না থাকায় মুসলিম লীগ এর তীব্র প্রতিবাদ করল। পরে বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট লর্ড পেথিক লরেন্স আলোচনার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের দ্রুত সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় লীগ ও কংগ্রেস নির্বাচনে অংশ গ্রহণে সম্মত হলো।
নির্বাচন মুসলিম লীগের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। কারণ মুসলিম লীগই যে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল একমাত্র একথা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করলে আর কারো কিছু বলার থাকবেনা।
ভারতীয় মুসলমানদের মনোভাব ও মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তার এসময় কংগ্রেসপন্থী মুসলমানরা হতাশ হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে কংগ্রেস যদি মুসলমানদের মনোভাবের প্রতি সম্মান না দেখায় এবং কিছু ছাড় দিতে রাজী না হয়, তাহলে কংগ্রেস কোন মুসলিম ভোট পাবে না। এই আশংকাতেই কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজা এই সময় গান্ধীকে গিয়ে বলেন, “যাতে তারা (মুসলমানরা) নিরাপত্তা বোধ করে, সেই ধরনের কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাদের আশংকা দূর করা সম্ভব। —ভারতের ভাবী শাসনতন্ত্রে পূর্ভ স্বায়ত্ত শাসিত ইউনিট সময়হের সমন্বয়ে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার হবে। —ভোটার তালিকা এমনভাবে তৈরী করতে হবে যাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে। যতদিন না সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস দূর এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে দল গঠিত হয়, ততদিন কেন্দ্রীয় পরিষদে এবং কেন্দ্রীয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলে হিন্দু মুসলিম প্রতিনিধিত্বে সমতা রাখতে হবে। পর্যায়ক্রমে হিন্দু ও মুসলমানের ভারতীয় ফেডারেশনের প্রধান হওয়ার কথা থাকবে”।–[‘Transfer of power in India’, S. V Hudson, page 131.] মওলানা আজাদের এই প্রস্তাবের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গান্ধী বললেন, “কোন সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না, বুঝতে পারলে ঐক্যবদ্ধ বা অখণ্ড ভারতই যে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের সার্বোৎকৃষ্ট পন্থা, এটা তারা উপলব্ধি করবে”।–[‘Transfer of power in India’, S. V Hudson, page 222.] তবে কংগ্রেস তার প্রস্তাবে কিছু সান্ত্বনার কথা বলল। কংগ্রেস কমিটির প্রস্তাবে বলা হলো, “কমিটি ঘোষণা করছে যে, কোন অঞ্চলকে তাদের বিঘোষিত ও প্রতিষ্ঠিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে থাকতে বাধ্য করা হবে না। —নতুন কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় কিংবা উল্লেখযোগ্য কোন গ্রুপের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় এমন কোন নীতিগত পরিবর্তন আনা হবে না। একটি শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের আওতায় সর্বোচ্চ সম্ভাব্য স্বায়ত্ত শাসন দেয়া হবে আঞ্চলিক ইউনিট গুলোকে”।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 131.]
কংগ্রেসের এই প্রস্তাবে মুসলমানদের নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং একক একটি শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের কথা আবারও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই প্রথম বারের মত কংগ্রেস –প্রস্তাবে আঞ্চলিক কোন ইউনিটকে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে সরে যাবার বিষয় স্বীকার করা হলো। কংগ্রেসের এই স্বীকৃতির মাধ্যমে, এস, ভি, হাডসনের ভাষায়, ‘পাকিস্তানের দরজা খুলে গেল যদিও তা পোকা খাওয়া’ ধরনের এবং যদিও দরজাটা আবর্তন ধর্মী”।–[‘The Great Divide’, S. V Hudson, page 131.] এটুকু দ্বিধাগ্রস্ত নমনীয়তা কংগ্রেস এজন্যেই দেখিয়েছিল যে, মুসলিম ভোট তারা চাই, যাতে সে প্রমাণ করতে পারে কংগ্রেস হিন্দু ও মুসলমান সকলের প্রতিনিধি।
মুসলিম ভোট লাভেরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা কংগ্রেস এসময় করে। পণ্ডিত নেহেরুর ভাষায়, “আমরা মুসলমানদের আস্থা অর্জন করবো এবং সম্পূর্ণভাবে তাদের কংগ্রেসে নিয়ে আসবো। কিন্তু আমরা আর কখনো মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে যাব না”।–[‘The Indian Annual Register’, Vol-11, page 94.]
অন্যদিকে নির্বাচনের কিছু দিন আগে জিন্নাহও বললেন (২৪শে নভেম্বর, ১৯৪৫) “আমাদের কোন বন্ধু নেই। বৃটিশ অথবা হিন্দুরা আমাদের বন্ধু নয়। আমরা পরিস্কার বুঝতে পারছি যে, এ দুয়ের সাথেই আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। এরা উভয়েই যদি আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়, তাহলেও আমরা ভীত হবোনা। আমরা তাদের যুগ্মশক্তির বিরুদ্ধে লড়বো এবং ইনাশাআল্লাহ পরিণামে আমরা বিজয়ী হবো”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Jamaluddin Ahmed, Vol-11, page 239.] এ বিজয়ের জন্যে এমনকি জিন্নাহ আইন অমান্য, শক্তি প্রয়োগ এবং কোন ত্যাগ স্বীকারকেই বাদ রাখেননি চিন্তা থেকে। তিনি মুসলমান জনতাকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, “আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন বৃথা একবিন্দু মুসলিম রক্তপাত হতে দেবোনা। আমি মুসলমানদের কখনও হিন্দুদের গোলাম হতে দেবনা। ভুলে যাবেননা, ত্যাগ এর সঠিক সময় সম্পর্কে আপনাদের সেনাপতি সম্পূর্ণ অবহিত। সময় যখন আসবে আমি দ্বিধা করবোনা এবং একপদও পিছিয়ে যাবোনা”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Jamaluddin Ahmed, Vol-11, page 243.] কিন্তু শক্তি নয়, ব্যালট যুদ্ধেই জিন্নাহ জয়ী হলেন।
১৯৪৫ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন হলো ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে। ফলও হলো ঐতিহাসিক। হিন্দু বা অমুসলিম কেন্দ্রগুলোতে কংগ্রেস পেল ৯৯.৩ ভাগ ভোট আর মুসলিম কেন্দ্রগুলোতে মুসলিম লীগ পেল ৮৬.৬ ভাগ ভোট। কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলমানদের জন্যে বরাদ্দ ৩০টি আসনের সব কটিই পেল মুসলিম লীগ। প্রাদেশিক পরিষদগুলোতে মুসলমানদের জন্যে বরাদ্দ মোট আসন ছিল ৪৯৫ টি, এর মধ্যে মুসলিম লীগ পেল ৪৩৪টি আসন।–[‘Transfer of power in India’, E.W.R. Lumby, page 61] অন্যদিকে হিন্দু আসনগুলোর প্রায় সবগুলোই দখল করল কংগ্রেস। নির্বাচনের এই ফল কার্যত ভারতকে দুই শিবিরে বিভক্ত করে দিল। মুসলিম লীগ যেমন নির্বাচনে ‘পাকিস্তান’ দাবীর উপর রেফারেন্ডাম হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তেমনি কংগ্রেসও নির্বাচনকে ‘পাকিস্তান’ বনাম ‘অখণ্ড হিন্দুস্তান’ এর নির্বাচন-যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিল।–[‘Transfer of power in India’, E.W.R. Lumby, page 63] এই নির্বাচন যুদ্ধে পাকিস্তানই জয়ী হলো। কারণ, ‘অখণ্ড হিন্দুস্তান’ এর পক্ষে কংগ্রেস কোন মুসলিম সমর্থন পেলনা। এছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, ভারতের মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন হলো মুসলিম লীগ।
কিন্তু নির্বাচনের এই রায় অনুসারে নয়, ভিন্ন ধারায় চলল বৃটিশ সরকারের চিন্তা। ভাইসরয় ওয়াভেল অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন, শাসনতন্ত্র তৈরীর জন্যে একটা সংস্থা গঠন এবং প্রদেশসমূহে কোয়ালিশন সরকার গঠনের সুপারিশ করলেন। এই সময় একটি বৃটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদল ভারত সফরে এসেছিলেন অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে। ওয়াভেলের সুপারিশ এবং এই পার্লামেণ্টারী প্রতিনিধিদলের সফরকে সামনে রেখে মিঃ জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, “সর্বভারতীয় একক শাসনতন্ত্র তৈরীর সংস্থা দ্বারা সংবিধান প্রস্তুতিতে মুসলিম ভারত কিছুতেই সম্মত হবেনা। কারণ এই প্রকার সংস্থার মুসলমানরা হবে অসহায় সংখ্যালঘু এবং ফলে তাদের চিরকালের জন্যে হিন্দু প্রাধান্যের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে। —এছাড়া পাকিস্তানের দাবী ক্ষুণ্নকারী কোনরূপ অস্থায়ী সরকার গঠনেও আমরা সম্মত হতে পারিনা। কারণ, এর দ্বারা হিন্দু ভারত ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের কৌশল অবলম্বন করছে”।–[–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamaluddin Ahmed, page 258, 259]
বৃটিশ পার্লামেণ্টারী প্রতিনিধিদল ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে গেল। ফিরে গিয়ে তাদের অনেকেই বললেন, “দেশের যেখানেই তারা গিয়েছিল সেখানেই তারা শুনেছেন যে, দেশের মুসলমানেরা পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র চায়। তাদের এ দাবীকে অগ্রাহ্য করা যায় না”।–[‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪ (উদ্ধৃত স্বাধীনতার অজানা কথা, পৃষ্ঠা ২০৩)।]
প্রদেশগুলোতে মুসলিম আসনে নির্বাচনের ফলঃ
প্রদেশ | মোট মুসলিম আসন | মুসলিম লীগ পায় | প্রদেশ | মোট মুসলিম আসন | মুসলিম লীগ পায় |
বাংলা | ১১৯ | ১১৩ | উড়িষ্যা | ৪ | ৪ |
পাঞ্জাব | ৮৬ | ৭৯ | যুক্ত প্রদেশ | ৬৬ | ৫৫ |
সীমান্ত প্রদেশ | ৩৮ | ১৭ | বোম্বাই | ১৪ | ১৪ |
আসাম | ৩৪ | ৩১ | মাদ্রাজ | ২৯ | ২৯ |
বিহার | ৪০ | ৩৪ | মধ্যপ্রদেশ | ১৪ | ১৪ |
সিন্ধু | ৩৫ | ২৮ |
এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, পার্লামেণ্টারী প্রতিনিধিদলের সদস্য আর, ভি মোরেনসনের কথা। তিনি বলেন, “ভারতের প্রধান দু’টি দলের সম্বন্ধে আমি এখনো আশাবাদী। —-দু’টি দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা এখনও সম্ভব হতে পারে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, সম্ভবত ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’-এর ভিত্তিতে মুসলিম প্রদেশসমূহের স্বতন্ত্র সংরক্ষণ ও সেই সাথে সর্বভারতীয় ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা সংরক্ষন দ্বারা একটা উপায় স্থির করা যেতে পারে। —কংগ্রেস এ পর্যন্ত পাকিস্তান স্বীকার করেছে। সেক্রেটারী অব স্টেট এখন এই সূত্র ধরে কাজ করতে পারেন”।–[‘Muslim League: Yesterday and Today’, A. B. Rajput, page 102, 103.]
নিঃসন্দেহে বৃটিশ সেক্রেটারী অব ষ্টেট এই সূত্র ধরেই এগিয়ে ছিলেন এবং এই সূত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরী পরিকল্পনা দিয়েই ক্যাবিনেট মিশনকে ভারত পাঠানো হয়।
১৯৪৬ সালে ২৪ শে মার্চ ক্যাবিনেট মিশন ভারতে এলেন। এ শক্তিশালী মিশনের সদস্য ছিলেন স্বয়ং ভারত-সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও নৌ-সচিব লর্ড আলেকজাণ্ডার। ক্যাবিনেট মিশন ভারতে আসার মাত্র ৮দিন আগে ১৫ই মার্চ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী একটা মারাত্মক বিবৃতি দেন।তিনি বলেন, “সংখ্যালঘুদের অধিকার ও তারা যাতে ভীতিমুক্ত হয়ে বাস করতে পারে, সে সম্বন্ধে আমরা সজাগ। কিন্তু আমরা কোন সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অগ্রগতিতে ভেটো দেয়ার অধিকার দিতে পারিনা”।–[‘Transfer of power in India’, V.P Menon, page 234, 235.]
বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কথায় উজ্জীবিত হয়ে কংগ্রেস নেতা বল্লভ ভাই প্যাটেল হুংকার ছাড়লেন, “(১) ভারত অনিতিবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর দাবী করছে, (২) সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণের জন্য রক্ষাকবচ দিতে কংগ্রেস রাজী আছে, কিন্তু মিঃ জিন্নার ভারত বিভাগ দাবী কংগ্রেস স্বীকার করে না, এবং (৩) প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে গুরুতর হাঙ্গামার আশংকা কংগ্রেস করে না”।–[‘Muslim League: Yesterday and Today’, A.B Rajput, page 106, 107.]
বল্লভ ভাইয়ের এ বিবৃতির ৮দিন পর কায়েদে আযম ৩১শে মার্চ রয়টার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাতকারেএর কড়া জবাব দিলেন। বললেন, “একটা কথা নিশ্চিত, পাকিস্তানের প্রশ্নে কোন আপোষ হবেনা। কারণ এরই উপর আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। —আমরা কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল বা অন্য কোন প্রকার একক ভারতীয় শাসনতন্ত্রের বিরোধী। আমরা বাঁচতে চাই এবং অন্যদেরও বাঁচাতে চাই”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamiluddin Ahmed. Page 276, 280.]
১৯৪৬ সালের ১৪ই মার্চ ক্যাবিনেট মিশন দিল্লী এসে প্রথমে নেতৃবৃন্দের সাথে ঘরোয়া আলোচনা শুরু করল। এই পর্যায়ে তারা আলোচনা করলেন কায়েদে আযম, গান্ধী, আজাদ, নেহেরু, ভূপালের নওয়াব, শ্যামাপ্রসাদ, স্যার তেজ বাহাদুর, জয়াকর, প্রমুখ নেতৃবৃনদ্রে সাথে।
কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আজাদ ঘরোয়া আলোচনা কালে মিশনকে কংগ্রেসের দাবী সম্পর্কে বললেন, ‘কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতা চায় এবং ভারতের ভাবী শাসনত্নত্র ভারতীয় গণপরিষদই প্রণয়ন করবে। কিন্তু ভারতীয় সেই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে অন্তর্বর্তীকারীন একটা সরকারের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে থাকবে ১৫ জন সদস্য। যার ১১ জন প্রদেশ থেকে আর ৪ জন হবেন সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি। কংগ্রেস ভারতের ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় রাজী, কিন্তু কিছুতেই ভারত বিভাগ মেনে নেবেনা। মিশন যখন মওলানাকে বললেন, এই ফেডারেল ব্যবস্থায় মুসলিম মেজরিটি প্রদেশগুলো যদি তাদের মধ্যে সাব-ফেডারেশন গঠন করতে চায় তাহলে? প্রথমটায় মওলানা এর তীব্র প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু পরে যুক্তির মুখে তিনি স্বীকার করলেন, বিষয়টা চিন্তা করে দেখা যেতে পারে।
এইভাবে জিন্নাহ, গান্ধী, নেহেরু প্রমুখের সাথে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষে মিশন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে ব্যবধান দেখতে পেল তা তাদের ভাষায়ঃ “প্রথমে পাকিস্তান গঠন, তারপর ফেডারেশন বা চুক্তির আকারে ভারতীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রশ্নটি বিবেচনা, অথবা প্রথমে ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন, তারপর প্রাদেশিক বা তদ্রুপ স্বায়ত্ত শাসনের আকারে পাকিস্তান এর প্রশ্নটি বিবেচনা”।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 138.] এ দুয়ের প্রথমটি মুসলিম লীদের দাবী এবং দ্বিতীয়টি কংগ্রেসের দাবী।
মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যকার এই ব্যবধান দূর করার জন্যে মিশন ১৯৪৬ সালের ১৬ই এপ্রিল জিন্নার সাথে দীর্ঘ বৈঠক করলেন। বৈঠকে বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট তাকে বললেন, তারা জিন্নার দাবীর গুরুত্ব অনুধাবন করেন, কিন্তু পাকিস্তান দাবী অন্য পক্ষগুলোর কাছ থেকে মানিয়ে নেয়া সম্ভব হবেনা। দাবীকৃত পুরো এলাকা এবং পুরো স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, এই দুই জিনিস জিন্নাহ এক সাথে কিছুতেই পাবেন না। তারপর মিশন সমাধান হিসেবে অন্য পক্ষগুলোর গ্রহণ সাপেক্ষে জিন্নার কাছে দু’টি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করলঃ (১) সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাবের মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাসমূহ এবং কলকাতা বাদে বাংলার মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাসমূহ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে। এ পাকিস্তানকে অবশিষ্ট হিন্দুস্তানের সাথে একটি চুক্তি ভিত্তিক ইউনিয়নে মিলিত হতে হবে, (২) একটি সর্বভারতীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্র গঠিত হবে। এ ইউনিয়নের অধীনে আসামের মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চল বাদ দিয়ে গোটা আসাম, বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান ফেডারেশন সৃষ্টি হবে। শর্ত থাকবে ইউনিয়নের কোন অংশ বা ফেডারেশন ১৫ বছর কিংম্বা এ ধরনের একটি সময়ের পর ইচ্ছা করলে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 139.] এই দুই বিকল্পের মধ্যে জিন্নাহ দ্বিতীয়টির প্রতি আগ্রহ দেখালেন, তবে তিনি বললেন, বিষয়টি যদি প্রস্তাব আকারে কংগ্রেসের তরফ থেকে আসে তাহলে মুসলিম লীগ এটা বিবেচনা করবে।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 140.] পরে এই দুই বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে মিশনের পক্ষ থেকে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস প্রথমে গান্ধী এবং তারপর নেহেরুর সাথে আলোচনা করলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা এ নিয়ে জিন্নার সাথে কোন আলোচনা করতেই রাজি হলেন না”।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 141.]
এর ক’দিন পর মিশন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কাছে সমস্যার সমাধান হিসেবে একটা ফর্মূলা পেশ করলেন। ফর্মূলাটি এইঃ (১) কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের নির্বাচিত সদস্যদের থেকে প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, (২) এই সরকারের দায়িত্ব হবেঃ (ক) সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিষয়ক শাসনতান্ত্রিক বিধি প্রণয়ন, (খ) বৃটিশ ভারত দ্বিধা বিভক্ত হবে, না এক থাকবে না নিরূপন করা, (৩) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে এই কাজ করতে হবে, (৪) তা করতে ব্যর্থ হলে বাংলা, সিলেট, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে গণভোট নিয়ে দেখা হবে সেখানকার মানুষ পাকিস্তান চায় কি না। শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ চাইলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবে। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এই প্রস্তাব নেহেরু কাছে হাজির করলে তিনি সরাসরি এটা প্রত্যাখ্যান করলেন। আর জিন্নাহ বললেন, ঐ এলাকার মানুষ ইতিমধ্যে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে বলেই দিয়েছে তারা পাকিস্তান চায়।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 142.] অতঃপর মিশন ১৬ই এপ্রিল তারিখে জিন্নার কাছে দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে যে প্রস্তাব পেশ করেছিল, সেই প্রস্তান নতুন আকারে পেশ করল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাছে। প্রস্তাবটি হলো, দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের মত কয়টি বিষয় নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন থাকবে। তার অধীনে থাকবে মুসলিম প্রধান প্রদেশ গুলোর একটি গ্রুপ এবং হিন্দু প্রদেশগুলোর একটি গ্রুপ।
‘দুই পক্ষ থেকে চারজন করে প্রতিনিধি নিয়ে ৫ই মে থেকে সিমলার এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। আলোচনায় থাকল তিন এজেন্ডা (১) প্রদেশগুলোর গ্রুপ (২) ইউনিয়ন সরকার ও (৩) শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী ব্যবস্থা। আলোচনা চলেছিল ১২ই মে পর্যন্ত। চারদিন আলোচনার পর এক পর্যায়ে জিন্নাহ মুসলিম প্রদেশগুলোর গ্রুপ স্বীকার করা হলে কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন সরকার গঠনে রাজী হলেন।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page 143.] কিন্তু কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদ কংগ্রেসের পুরানো দাবী নতুন করে উত্থাপন করায় সব কিছু ভণ্ডুল হয়ে যাবার উপক্রম হলো। কংগ্রেস সভাপতি লিখিত ভাবে মিশনকে জানালেন, ‘কংগ্রেসের দাবী হলো স্বাধীনতা, বৃটিশ সৈন্যের প্রত্যাহার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবাধ অধিকার দান এবং কংগ্রেস প্রদেশগুলো নিয়ে কোন প্রকার গ্রুপ গঠনের বিরোধী’। কংগ্রেস আরও বলল, ‘সম্মলনে ভারত ভাগ বিষয়ক কোন আলোচনা আসবেনা। এটাকে যদি আসতে হয় আসবে বর্তমান বৃটিশ শাসন মুক্ত ভারতের গণ পরিষদে’।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page ১৪৩.] কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদের চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গান্ধী মিশনকে পরামর্শ দিলেন যে, মিশনের উচিত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে যে কোন এক পক্ষকে বেছে নেয়া এবং তার হাতে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা, যাতে সে তার মত করে কাজ করতে পারে।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page ১৪৩.] এছাড়া মিঃ গান্ধী মিশনকে কার্যক্ষম কোন পরিকল্পনা তৈরীর ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলেন। এ চ্যালেঞ্জের জবাব হিসেবেই মিশন ৮ই মে তারিখে একটি পরিকল্পনা কংগ্রেস ও লীগের হাতে তুলে দিলেন। মিশনের সে পরিকল্পনাটি ছিল এইঃ (১) সর্বভারতীয় একটি ইউনিয়ন সরকার ও আইন সভা, যার অধীনে থাকবে দেশরক্ষা, বিদেশ নীতি, মৌলিক অধিকার এবং অর্থব্যবস্থার আবশ্যকীয় অংশ, (২) অন্য সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে, (৩) নিজস্ব আইন সভা ও প্রশাসন ব্যবস্থার অধিকার সহ প্রদেশগুলোর গ্রুপ, (৪) ইউনিয়ন আইন সভায় হিন্দু ও মুসলিম প্রদেশ গুলোর গ্রুপ থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি থাকবে। (৫) ইউনিয়ন সরকারও এই সংখ্যা সাম্য অনুসারে গঠিত হবে, (৬) ১০ বছর পর পর শাসনতন্ত্র পুনর্বিবেচনা, (৭) শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কার্যক্রমঃ প্রাদেশিক পরিষদে বিভিন্ন পক্ষের যে হারে প্রতিনিধিত্ব আছে, সেই হার অনুসারে প্রতিনিধি আসবে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী গণপরিষদে। প্রাথমিক কাজের পর গণপরিষদ তিন ভাগে বিভক্ত হবেঃ (১) হিন্দু মেজরিটি প্রদেশ গুলোর গ্রুপ, (২) মুসলিম মেজরিটি প্রদেশগুলোর গ্রুপ এবং (৩) দেশীয় রাজ্যগুলোর গ্রুপ। প্রথম দুইটি গ্রুপ তাদের স্ব স্ব প্রদেশসমূহ এবং চাইলে প্রদেশসমূহের গ্রুপের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। এরপর গ্রুপে থাকা না থাকা প্রদেশগুলোর ইচ্ছাধীন হবে। এর পর গণপরিষদের তিনটি গ্রুপ একত্রে মিলে সর্বভারতীয় ইউনিয়ন সরকারের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। সম্প্রদায়গত কোন প্রশ্নে বিরোধ দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যের রায় অনুসারে তার সমাধান হবে।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, page ১৪৪.]
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এই পরিকল্পনা নিজ হাতে গান্ধীকে দেন এবং গান্ধীর সাথে বসে এই পরিকল্পনা লাইন বাই লাইন পড়া হয়। পড়া শেষে গান্ধী বলেন, ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে পরিকল্পনাটি সমস্যা সমাধানের অনুকূলে মনে হচ্ছে।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, পৃষ্ঠা ১৪৪.] অন্য দিকে লর্ড ওয়াভেল পরিকল্পনাটি নিয়ে জিন্নার সাথে আলাপ করেন। পরিকল্পনার ব্যাপারে জিন্নাহকে খুব উৎসাহী মনে হলোনা। তবে মিশন মনে করলেন, কংগ্রেস পরিকল্পনাটি গ্রহণ করলে জিন্নাহ রাজী হবেন।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, পৃষ্ঠা ১৪৪.] কিন্তু মিশনের এই আশা পূরণ হলো না। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদ লিখিতভাবে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ভাষায় পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করলেন। উপসংহারে তিনি নতুন এই প্রস্তাব দিলেন, “সমঝোতায় যদি পৌঁছা না যায়, তাহলে পরামর্শ দিব যে, নির্বাচিত কেন্দ্রীয় পরিষদের কাছে দায়িত্বশীল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবিলম্বে গঠন করা হোক এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কারী গণপরিষদ নিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে যে বিতর্ক তা স্বাধীন কোন ট্রাইব্যুনালের কাছে পেশ করা হোক”।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, পৃষ্ঠা ১৪৪.] মওলানা আজাদের এই কথার পর জিন্নাহ বলেন যে, এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় আর কোন লাভ হবে না। এরপরও মিশন তাদের ৭ দফা ফর্মূলা নিয়ে ৯ই মে নেহেরুর সাথে আলোচনায় বসলেন এবং প্রস্তাব করলেনযে, দুই পক্ষ এক সাথে বসুক একজন নিস্পত্তিকারীর সামনে। যে পয়েন্টে উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ হবে, সে পয়েণ্টে নিস্পত্তিকারীর রায় হবে চূড়ান্ত। মিঃ জিন্নাহ এ ধরনের ব্যবস্থার উপর মুসলমানদের ভাগ্য ছেড়ে দিতে অস্বীকার করলেন।
ক্যাবিনেট মিশনের ২৪শে মার্চ থেকে ৯ই মে পর্যন্ত আলোচনার সারাংশ দাঁড়াল এইঃ মি জিন্নাহ অর্থাৎ ‘মুসলিম লীগ প্রদেশগুলোর হিন্দু ও মুসলিম গ্রুপ ব্যবস্থার সাথে সর্বভারতীয় ইউনিয়ন ব্যবস্থাকেও সমঝোতার স্বার্থে মেনে নিয়েছিল, অন্যদিকে কংগ্রেসও সর্র্বভারতীয় ইউনিয়ন ব্যবস্থার সাথে প্রদেশগুলোর গ্রুপ ব্যবস্থা মানতে রাজী হয়েছে। তবে বিরোধের বিষয় হলো, মুসলিম লীগ প্রথমে গ্রুপ গঠনের পক্ষপাতী, তারপর ইউনিয়ন গঠন নিয়ে হিন্দু গ্রুপের সাথে আলোচনা করতে চায়, অন্যদিকে কংগ্রেস প্রথমে সর্বভারতীয় ইউনিয়ন গঠনের পক্ষপাতী, তারপর গ্রুপ নিয়ে আলোচনা করতে চায়। জিন্নাহ কিছুতেই কংগ্রেসের ফর্মূলায় একমত হতে রাজী নন, কারণ জিন্নার ভয় হলো, একবার সর্বভারতীয় ইউনিয়ন গঠন হলে এবং সংখ্যাগুরু হিন্দুরা একবার ক্ষমতা হাতে পেলে মুসলমানদের দাবীর প্রতি আর কর্ণপাত করবে না।
আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছলে ক্যাবিনেট মিশন ১১ই মে তারিখে কংগ্রেস ও লীগ উভয়কেই সমস্যা সমাধানে তাদের মত লিখিতভাবে পেশ করতে বলল। উত্তরে কংগ্রেস সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে যে পরিকল্পনা পেশ করল তা হলোঃ (১) সর্বভারতীয় সরকার ও আইন সভা সম্বলিত ফেডারেল ইউনিয়নের শাসনতনন্ত্র প্রণয়নের জন্যে একটি গণপরিষদ গঠন, (২) ফেডারেল ইউনিয়নের অধীনে থাকবে পররাষ্ট্র, দেশ রক্ষা, যোগাযোগ, মৌলিক অধিকার, মুদ্রা, শুল্ক ও পরিকল্পনা এবং অন্যান্য একান্ত আবশ্যকীয় বিষয়সহ প্রয়োজনীয় অর্থ ও রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার এবং শাসনতন্ত্র ভেঙ্গে পড়া ও জাতীয় জরুরী অবস্থা মোকাবিলার শক্তি, (৩) গণপরিষদ দ্বারা এসব বিষয় নির্ধারিত হয়ে যাবার পর প্রদেশগুলো অবশিষ্ট বিষয় নিয়ে গ্রুপ গঠন করতে পারে এবং (৪) সর্বভারতীয় শাসনতন্ত্রে সম্প্রদায়গত কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দিলে তা সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নিষ্পত্তি হবে। নিষ্পত্তি না হলে কোন নিষ্পত্তিকারীর রায়ের উপর ছেড়ে দেয়া হবে।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, পৃষ্ঠা ১৪৩.] আর মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বিরোধ নিষ্পত্তির যে পরিকল্পনা পেশ করা হলো তা এইঃ (১) ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের গ্রুপ তাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে স্বতন্ত্র গণপরিষদ গঠন করবে, (২) মুসলিম এই গ্রুপের নাম হবে পাকিস্তান ফেডারেশন, (৩) এই পাকিস্তান ফেডারেশন দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র এবং দেশ রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা সর্বভারতীয় ইউনিয়নকে দিয়ে অবশিষ্ট বিষয়সমূহের কোনটি ফেডারেশনে থাকবে, কোনটি ফেডারেশনের প্রদেশগুলোতে যাবে তা নির্ধারণ করবে, (৪) পরে সর্বভারতীয় ইউনিয়নের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে হিন্দু প্রদেশগুলোর ফেডারেশন ও মুসলিম প্রদেশগুলোর ফেডারেশন মিলে যৌথ গণপরিষদ গঠন করবে, (৫) এ গণপরিষদ ঠিক করবে সর্বভারতীয় ইউনিয়নের কোন আইন সভা থাকবে কিনা, কিভাবে এর অর্থায়ন হবে, কিন্তু কিছুতেই ট্যাক্স আরোপের কোন ক্ষমতা ইউনিয়নকে দেয়া যাবে না। এবং (৬) বিরোধীয় কোন বিষয়ে ইউনিয়ন সরকার তিন চতুর্থাংশের কম ভোটে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেনা।–[‘The Great Divide’, S. V. Hudson, পৃষ্ঠা ১৪৩.]
দুই পক্ষের দুই মতের মধ্যে ব্যবধান এতই মৌলিক ধরনের যে, এই বিষয়ে আর আলোচনা নিরর্থক। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে মিশন ১২ই মে তারিখে আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার ঘোষণা প্রকাশ করল এবং বলল যে শীঘ্রই মিশন নিজস্ব পদক্ষেপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ক্যাবিনেট মিশন তার নিজস্ব পদক্ষেপ হিসেবে ১৬ই মে (১৯৪৬) সুদীর্ঘ বিবৃতি সমেত যে পরিকল্পনা, যা ‘ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান’-[ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের পূর্ণ বিবরণ এই গ্রন্থের শেষে পরিশিষ্ট আকারে দেয়া হলো।] হিসে পরিচিত, পেশ করে তার সার সংক্ষেপ হলোঃ (১) বৃটিশ বৃটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহের সমন্বয়ে ইউনিয়ন অব ইণ্ডিয়া গঠিত হবে। ইউনিয়নের এখতিয়ারে থাকবে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা যোগাযোগ এবং এই সকল বিষয় পরিচালনার জন্যে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা। ইউনিয়নের একটি প্রশাসন ও একটি আইন সভা থাকবে। (২) অবশিষ্ট সমস্ত ক্ষমতা থাকবে প্রদেশসমূহের হাতে। (৩) প্রদেশসমূহের সরকারও আইন পরিষদ সহ গ্রুপ গঠনের অধিকার থাকবে। যে সব প্রাদেশিক বিষয় গ্রুপের এখতিয়ারে থাকবে, তা গ্রুপ কর্তৃক স্থির হবে। (৪) শাসনতন্ত্র চালু হওয়ার ১০ বছর পর এবং অতপর প্রত্যেক দশ বছর অন্তর যেকোন প্রদেশের শাসনতন্ত্রের পূনর্বিবেচনার দাবী করার অধিকার থাকবে। (৫) শাসনতন্ত্র তৈরীর জন্যে গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক প্রদেশকে প্রতি দশ লক্ষে একজন প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেয়া হবে; এবং প্রধান প্রধান সম্প্রদায়ের (সাধারণ, মুসলিম ও শিখ) জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী প্রাদেশিক পরিষদসমূহ নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পরিষদ সদস্যগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। (৬) গণ-পরিষদের সাম্প্রদায়িক গঠন নিম্নরূপ হবে।
গ্রুপ-ক
প্রদেশ | সাধারণ | মুসলিম | শিখ | মোট |
মাদ্রাজ | ৪৫ | ৪ | ৪৯ | |
বোম্বাই | ১৯ | ২ | ২১ | |
যুক্ত প্রদেশ | ৪৭ | ৮ | ৫৫ | |
বিহার | ৩১ | ৫ | ৩৬ | |
মধ্যপ্রদেশ | ১৬ | ১ | ১৭ | |
উড়িষ্যা | ৯ | ০ | ৯ | |
মোট | ১৬৭ | ২০ | – | ১৮৭ |
গ্রুপ-খ
প্রদেশ | সাধারণ | মুসলিম | শিখ | মোট |
পাঞ্জাব | ৮ | ১৬ | ২৮ | |
সীমান্ত প্রদেশ | ০ | ৩ | ৩ | |
সিন্ধু | ১ | ৩ | ৪ | |
মোট | ৯ | ২২ | – | ৩৫ |
গ্রুপ-গ
প্রদেশ | সাধারণ | মুসলিম | শিখ | মোট |
বাংলা | ২৭ | ৩৩ | ৬০ | |
আসাম | ৭ | ৩ | ১০ | |
মোট | ৩৪ | ৩৬ | – | ৭০ |
বৃটিশ ভারতের সর্বমোট প্রতিনিধি সংখ্যা | ২৯২ |
দেশীয় রাজ্যসমূহের মোট প্রতিনিধি সংখ্যা | ৯৩ |
মোট | ৩৮৫ |
প্রথমে প্রতিনিধিগণ সকলে একত্রে দিল্লীতে মিলিত হযে কার্য পব্ধতি স্থির করার পর উপযুক্ত গ্রুপ অনুযায়ী তিন ভাগে বিভক্ত হবে, প্রত্যেক গ্রুপ স্বতন্ত্র অধিবেশনে গ্রুপের প্রাদেশিক শাসনতন্ত্র তৈরী করবে এবং সেকশনের সকল প্রদেশের সমন্বয়ে গ্রুপ শাসনতন্ত্র তৈরী করা বা না করার বিবেচনা করবে।যদি এরূপ শাসনতন্ত্র তৈরী প্রয়োজনীয় গণ্য হয় তাহলে এখতিয়ারভুক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন শাসনতন্ত্র চালু থাকার পর যে কোন প্রদেশের পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার থাকবে।
(৭) ইতিমধ্যে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে।
ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান প্রকাশিত হবার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন গান্ধী। তিনি বললেন, “গণপরিষদের ইচ্ছঅমত পরিকল্পনার যে কোন অংশ উন্নত বা বর্জন করার অধিকার আছে; নতুন গণপরিষদকে সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন সংস্থা আখ্যা দেয়া যায় না। যথা, মিশন কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের এখতিয়ারভুক্ত করার জন্যে কয়েকটি বিষয় নির্দিষ্ট করেছে, কিন্তু গণপরিষদ ইচ্ছা করলে সেগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে পারে। তেমনি গণ-পরিষদ ইচ্ছা করলে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য বাতিল করতে পারে। গ্রুপ সম্বন্ধে কোন প্রদেশকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বিশেস গ্রুপে যোগদানে বাধ্য করা যেতে পারে।–[‘Transfer of power in India’, V.P Menon page 269] গান্ধী এখানে সরাসরি পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করলেন না, আবার গ্রহণও করলেন না। যা বুঝাতে চাইলেন তা হলো, পরিকল্পনা ঠিকই আছে, তবে ভবিষ্যত গণপরিষদ এটা এইভাবে মেনে নেবে সে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। তা করলে গণপরিষদ সার্বভৌম হবে না। অর্থাৎ পরিকল্পনাটি গ্রহণ, বর্জন ও সংশোধনের অধিকার গণপরিষদের থাকবে”।
লীগ প্রেসিডেন্ট জিন্নার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেল ২৩শে মে তারিখে। তিনি বললেন, ‘মিশন মুসলিম লীগের সার্বভৌম পাকিস্তান দাবী প্রত্যাখ্যান করেছে। একমাত্র পাকিস্তানই ভারতে স্থিতিশীল সরকার এবং উপমহাদেশর জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে”।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 151.] এরপর তিনি মিশনের প্রস্তাবের কতকগুলি ক্রুট তুলে ধরে বলেন যে, এই সকল প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুতর এবং মুসলিম লীগ কাউন্সিলের আসন্ন অধিবেশনে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তার আগে মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ বা বর্জন করা সম্বন্ধে তিনি নিজের মত ব্যক্ত করবেন না।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamiluddin Ahmed, page 298]
২৪শে মে তারিখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তার এক দীর্ঘ প্রস্তাবে মিশনের প্রস্তাব সম্পর্কে অনেকগুলো আপত্তি ও প্রশ্ন উত্থাপন করল। যার মধ্যে প্রধান ছিল, প্রদেশ সমূহের গ্রুপিং ও অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রশ্ন। প্রদেশগুলোর গ্রুপিং সম্পর্কে কংগ্রেসের প্রস্তাবে বলা হলো যে, সংশ্লিষ্ট প্যারাগ্রাফ পড়ে তারা বুঝেছে, গ্রুপ গঠনের আগে প্রথমেই প্রদেশগুলো ঠিক করবে তারা তাদের জন্য নির্ধারিত গ্রুপে যাবে কিনা। তবে কংগ্রেস সব বিষয় তাদের কাছে পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখল।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 152]
লীগ প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির আপত্তি ও প্রশ্নগুলো প্রকাশিত হবার পর ক্যাবিনেট মিশন ও লর্ডওয়াভেল সকলের অবগতির জন্যে প্রকাশিত এক ব্যাখ্যায় বললেন যে, (১) মিশনের পরিকল্পনা সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করতে হবে, আংশিক গ্রহণ বা বর্জন করা যাবেনা। (২) পরিকল্পনায় বর্ণিত পদ্ধতিতে গণপরিষদ গঠিত হবার পর বৃটিশ সরকার পরিষদের কাজে হস্তক্ষেপ করবেনা, কিন্তু দু’টি বিষয়ের দিকে তারা লক্ষ্য রাখবে, (ক) সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, (খ) বৃটিশ সরকারের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন। (৩) পরিকল্পনা অনুসারে প্রদেশ সমূহকে নির্দিষ্ট গ্রুপে যোগদান করতেই হবে; শাসনতন্ত্র তৈরী হওয়ার পর জনসাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। (৪) অন্তর্বর্তী সরকারের সকল দফতর ভারতীয় সদস্যদের হাতে থাকবে এবং দৈনন্দিন কাজে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের সর্বাধিক স্বাধীনতা থাকবে।–[‘কায়েদে আযম’ আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৪৭, Great Divide, S.V. Hudson, page 152.]
ভি, পি মেননের মতে কংগ্রেস এই সময় ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার চাইতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ফর্মূলার প্রতি বেশী আগ্রহী হয়ে উঠে।–[‘Transfer of power in India’, V.P Menon, Page 276.] অর্থাৎ কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দিকেই ঝুঁকে পড়ে বেশী। ২৫শে মে তারিখে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদ লর্ড ওয়াভেলের কাছে লিখিত এক পত্রে তাঁর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে এ নিশ্চয়তা দাবী করেন যে, (১) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাইসরয় নামমাত্র প্রধান হবে, (২) কার্যত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ডোমিনিয়ন ক্যাবিনেট (স্বায়ত্বশাসিত সরকার রাষ্ট্র) এর মর্যাদা পাবে, এবং (৩) কেন্দ্রীয় পরিষদে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায় দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করণের জন্যেএকটি কনভেনশন আহবান করা হবে।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudsom, page 153.] অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবাধ ক্ষশতার অধিকারী করার কংগ্রেসী লক্ষ্য এখাবে সুস্পষ্ট। কংগ্রেসের এ দাবীর জবাবে লর্ড ওয়াভেল তাঁর ইতিপূর্বেকার ব্যাখ্যামূলক বিবৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৃটিশ সরকারের উপর আস্থা রাখার আবেদন জানালেন এবং বললেন যে, ভারতে আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে চাই।
৬ই জুন (১৯৪৬) তারিখে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। এ অধিবেশনে লীগ ঘোষণা করল, পাকিস্তানই লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য তবে উদ্ভুত সংকট বিবেচনা করে, বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে এবং যেহেতু মিশন প্রস্তাবিত গ্রুপ ব্যবস্থার ‘ক’ ও ‘গ’ সেকশন গঠনের মধ্যে পাকিস্তানের দাবী অনেকখানি পূরণ হয়, তাই লীগ কাউন্সিল ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী গণপরিষদে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করছে। মুসলিম লীগ কর্তৃক ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ অনেককে বিশেস করেকংগ্রেসকে দারুণভাবে বিস্মিত করলো। ‘কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ মনে করেছিলেন যে, লীগ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করবেই এবং সেই কারণে তারা অধিকতর সুবিধা আদায়ের জন্যে মিশনের সাথে দরকষাকষি করছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল এ দরকষাকষির ফলে মুসলিম লীগকে বাদ দিয়েই কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে এবং গ্রুপিং সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা কার্যকরী করতে পারবেন’।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৪৮, ৭৪৯।] কিন্তু দূরদর্শী জিন্নাহ ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, ‘এই সময় মিশনের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলে লীগকে বৃটিশ সরকার ও কংগ্রেস উভয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। তাতে ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের পর কংগ্রেসের যে অবস্থা হয়েছিল, মুসলিম লীগকে তেমনভাবে একটা ক্ষতিকর অচলাবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৪৮, ৭৪৯।] লীগ মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণের পর বেকায়দায় পড়ল কংগ্রেস।
কংগ্রেস এরপর মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ-বর্জন সম্পর্কে কোন কথা না বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠল। এটা লক্ষ্য করে জিন্নাহ ৮ই জুন তারিখ ভাইসরয় লর্ডওয়াভেলকে লেখা এক চিঠিতে নিশ্চয়তা দাবী করলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারে ৫ জন লীগের, ৫ জন কংগ্রেসের, ১ জন শিখ ও ১ জন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান অর্থাৎ সব মিলে মোট ১২ জন সদস্য থাকবে –এই মর্মে ভাইসরয়ের সাথে দেখা করলেন এবং দাবী করলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারে ১৫ জন সদস্য থাকতে হবে। যার মধ্যে ৫ জন হবেন কংগ্রেসী হিন্দু, ৪ জন লীগের, ১ জন লীগ বহির্ভূত মুসলমান, ১ জন অকংগ্রেসী হিন্দু, ১ জন তফসিলি, ১ জন ভারতীয় খৃষ্টান, ১ জন শিখ ও ১ জন কংগ্রেসী মহিলা। লর্ড ওয়াভেল নেহেরুর এ দাবী মেনে নিলেন না। ১৩ই জুন তারিখেই কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আজাদ লর্ড ওয়াভেলের সাথে দেখা করে জানিয়ে দিলেন, ১২ সদস্যের অন্তর্বতী সরকার কংগ্রেস কিছুতেই মেনে নেবে না। কংগ্রেসকে রাজী করানোর স্বার্থে লর্ড ওয়াভেল তখন ১৩ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার প্রস্তাব করলেন। যাতে থাকবেন, ৬ জন কংগ্রেস, ৫ জন মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সদস্য। কংগ্রেস ওয়াভেলের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো।
এই অবস্থায় অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্যে ক্যাবিনেট মিশন ও ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ১৬ই জুন তারিখে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। যাতে থাকবে কংগ্রেসের ৬ জন, মুসলিম লীগের ৫ জন, শিখ ১ জন, ১ জন ভারতীয় খৃষ্টান এবং ১ জন পার্সী সদস্য। এই সাথে সদস্যদের নামও ঘোষণা করা হলো।–[১৪ জন সদস্যদের নামঃ বলদেব সিং, স্যার এনপি, ইঞ্জিনিয়ার, জগজীবন রাম, নেহেরু, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, হরে কৃষ্ণ মাতহাব, জন মাথাই, মিঃ রাজ গোপালাচারী, রাজেন্দ্র, প্রসাদ, বল্লভ ভাই প্যাটেল, মুহাম্মদ ইসমাঈল খান, খাজা নাজিমুদ্দীন, ও আব্দুর রব নিশতার।] এবং জানিযে দেয়া হলো, “প্রধান দু’টি দল অথবা এদের মধ্যে কোনটি যদি এইভাবে কোয়ালিশন সরকার গঠনে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে ভাইসরয়ের ইচ্ছা যে, তিনি ১৬ই মে ঘোষিত (ক্যাবিনেট মিশন) পরিকল্পনা গ্রহণকারীদের মধ্য থেকে যতদূর সম্ভব প্রতিনিধিত্বশীল অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৫২।]
এই ঘোষণা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল কংগ্রেসের মধ্যে। ২০শে জুনের দিকেই পরিস্কার হয়ে গেল কংগ্রেস এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করবে। রাজা গোপালাচারী মিশনকে অনুরোধ করলো তারা যেন মওলানা আজাদের হাত শক্তিশারী করেন যাতে তিনি গান্ধীর মোকাবিলা করতে পারেন। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদ অন্তর্বর্তী সরকার পরিকল্পনা গ্রহণে রাজী ছিলেন। আর দীর্ঘমেয়াদী মিশন পরিকল্পনাকে তো মওলানা আজাদ তার নিজের পরিকল্পনা বলেই মনে করতেন।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 157] রাজা গোপালাচারীর কথায় স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস দেখা করলেন মওলানা আজাদের সাথে। কিন্তু আজাদ তখন মানসিকভাবে এতই ক্লান্ত যে, তিনি অবস্থার উন্নয়নে কিছু করতে পারবেন তা মনে করেন না। এরপর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস দেখা করলেন গান্ধীর সাথে। আলোচনা ব্যর্থ হলো। গান্ধী প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারকে ভালো কিছু মনে করেন না।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 157]
২৫শে মে তারিখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভাইসরয় প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করল। কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত যখন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদ ভাইসরয়কে জানালেন, তখন কিন্তু তিনি এই সাথে লিখলেন, “কিছু বিষয় (যেমন প্রদেশ সমূহের গ্রুপ) সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা সাপেক্ষে কংগ্রেস ১৬ই মে ঘোষিত মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল”।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 158. ‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ৩৩৬।] বস্তুত এই ঘটনা কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মওলানা আজাদকে খুবই বেদনা দিয়েছিল। তিনি লিখেন, “কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জল ঘটনা। এর অর্থ এই ছিল যে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের একটা কঠিন প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বের মাধ্যমে শেষ না হয়ে আলাপ-আলোচনা এবং চুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা হয়ে গেল। —-কিন্তু তখনও জানতাম না যে ইহা অপরিপক্ক এবং ভবিষ্যতে হতাশা অপেক্ষা করছে”।–[‘India Wins Freedom’, A. K. Azad, page 151.]
কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার পর মিশন ও ভাইসরয়ের ১৬ই জুনের ঘোষণা অনুযায়ী কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মুসলিম লীগ ও অন্যান্যদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হয়। কিন্তু ভাইসরয় এই প্রতিশ্রুতি থেকে নগ্নভাবে সরে দাঁড়ালেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন মূলতবী করে তার জায়গায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন। জিন্নাহ এই বৃটিশ ওয়াদা ভংগের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। জবাবে ভাইসরয় ওয়াভেল যে মজার যুক্তি দেখালেণ তা এইঃ ‘লীগ ও কংগ্রেস উভয়েই মিশনের পরিকল্পনা গ্রহন করছে (যদিও কংগ্রেস স্বল্প মেয়াদী অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরাকর গঠনের পরিকল্পনা প্রত্য্যাখান করেছিল), এমতাবস্থায় কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করতে অস্বীকার করায় স্বল্পকালের জন্যে একটা মুলতুবী রাখা শ্রেয়’। জবাবে জিন্নাহ বললেন, কংগ্রেস কখনই মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। কংগ্রেস প্রকাশ্যে স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও তারা প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করেনি। কারণ, মিশনের পরিকল্পনা সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু কংগ্রেস দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা শর্তাধীন গ্রহণ করেছে।
মিঃ জিন্নাহ যে ঠিক বলেছিলেন শীঘ্রই তা প্রমাণ মিলল। কাবিনেট মিশন ভারত ত্যাগ করলো ২৯শে জুন (১৯৪৬)। ৬ই জুলাই তারিখে বোম্বাইতে কংগ্রেস কাউন্সিলের অধিবেশন বসল। মওলানা আজাদকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হলেন নেহেরু। নেহেরু সভাপতি হয়েই ঘোষণা করলেন, “ক্যাবিনেট মিশনের দীর্ঘমেয়াদী অথবা স্বল্পমেয়াদী কোন পরিকল্পনাই কংগ্রেস গ্রহণ করেনি। কংগ্রেস মাত্র শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী গণপরিষদে যোগ দিতে চেয়েছে, এর বেশী কিছু নয়। গণপরিষদটি হবে সার্বভৌম এবং প্রদেশগুলোর গ্রুপ ব্যবস্থা কার্যকরী হবে না। —-তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়াও থাকতে হবে শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, মুদ্রা এবং করারোপের শক্তি। —সংখ্যালঘু প্রশ্নটি ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এ ব্যাপারে বৃটিশ সরকার কিংবা বাইরের কোন হস্তক্ষেপ আমরা বরদাশত করবোনা”।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 163]
সম্মেলন শেসে সাংবাদিক সম্মেলনে নেহেরু আরও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, “কংগ্রেস যেটা ভাল মনে করবে সেভাবেই গণপরিষদে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা পরিবর্তন ও সংশোধন করা হবে”।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 163]
জিন্নাহ কংগ্রেসের এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করলেন এবং দাবী করলেন, বৃটিশ সরকারের এখন পরিস্কার বলা দরকার যে, “কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি”। ক্যাবিনেট মিশনের একজন সদস্য স্যার পেথিম লরেন্স ১৮ই জুলাই বৃটিশ পার্লামেণ্টে বললেন, “পক্ষগুলো ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণের পর গণপরিষদে গিয়ে এর অন্যথা করার অধিকার নেই”।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 163] কিন্তু কংগ্রেস তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই অধিকারই ছিনিয়ে নিতে চাইল।
উপমহাদেশীয় সমস্যার এক সংকট সন্ধিক্ষণে কংগ্রেসের এই আচরণ ঘটনাকে জটিল ও সংঘাতমুখর করে তুলল। সমকালীন সব ঐতিহাসিক কংগ্রেসের এই অযৌক্তিক আচরণের নিন্দা করেছে। ঐতিহাসিক ওয়াল ব্যাংক লিখছেন, ‘এই ধরনের মন্তব্য দ্বারা ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবগুলো সম্পূর্ণ নস্যাত করে দেয়া হলো। জিন্নার আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়ে গেল। জিন্নার আশংকা ছিল যে, গণপরিষদে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ, লীগ তাতে যোগ দিলে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবসমূহ বাতিল করে দেবে এবং তাদের ইচ্ছানুরূপ সরকার গঠন করবে এবং তাতে মুসলমানদের অধিকারের আর কোন নিশ্চয়তা থাকবেনা।–[‘A Short History of India and Pakistan, Wallbank, page 224.] অন্য এক ঐতিহাসিক লাম্বি বললেন, “নেহেরু ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন এবং ক্ষমতা হস্তগত হওয়ার সময় সন্নিকট দেখে তিনি এই প্রকার উগ্র হয়ে উঠেছিলেন। তিনি (নেহেরু) মনে করেছিলেন, বৃটিশের আসন্ন (ভারত) ত্যাগ নিশ্চিত হয়ে উঠেছে এবং ঐক্যের মধ্যে স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছার বন্যায় মুসলিম লীগকে কোণঠাসা করা অথবা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। —-মুসলিম মনোভাবের গভীরতা সম্পর্কে এই ভ্রান্ত ধারণার ফলে কংগ্রেস মনে করেছিল যে তার প্রাধান্য অপ্রতিরোধ্য এবং সেই কারণে এই মর্মান্তিক খেলা খেলেছিল”।–[‘The Transfer of Power in India’, E.W.R. Lumby, page 109, 110] আরেকজন ইতিহাসকার লিউনার্ড মোজলে লিখেন, “কি বলছেন তা কি নেহেরু বুঝতে পেরেছিলেন? পৃথিবীকে তিনি বলেছিলেন একবার ক্ষমতা হাতে পেলে কংগ্রেস তার কেন্দ্রীয় (সরকারী) ক্ষমতা ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা ইচ্ছামত পরিবর্তন করার জন্যে ব্যবহার করবে। কিন্তু মুসলিম লীগ সমঝোতার খাতিরে পরিকল্পনাটি সুনির্দিষ্টভাবে (অপরিবর্তনীয়) ভাবে গ্রহণ করেছিল। এটা একটা আপোষমূলক পরিকল্পনা, যা পরে কোন পক্ষের অনুকূলে পরিবর্তন করা যায় না। নেহেরুর মন্তব্য সরাসরি পরিকল্পনাকে স্যাবোটাস করেছিল”।–[‘Last Days of the British Raj’, Leonard Mostley, page 28.] ভারতের একজন ইতিহাসকার এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “বোম্বাই এর এই সাংবাদিক সম্মেলন ছিল নেহেরুর চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের এক বড় ভুল পদক্ষেপ। বলা হয়, ১৯৩৭ সালে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের সময় নেহেরু লীগের সঙ্গে সহযোগিতা না করে এক ভুল করেছিলেন। এবার তিনি তার দ্বিতীয় ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। —-দেশের একতা বজায় রেখে দেশ স্বাধীন হবার এই প্ল্যান ছিল ক্যাবিনেট মিশনের শেষ চেষ্টা”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২১৬, ২১৭।]
সমগ্র ভারতের ক্ষমতা বুক্ষিগত করার কংগ্রেসের এই চেষ্টা এবং বৃটিশ সরকারের নিস্ক্রিয়তা ও নীরবতার মুখে জুলাইয়ের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখে (১৯৪৬) বোম্বাই এ মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। লীগ সভাপতি বিক্ষুব্ধ মিঃ জিন্নাহ সম্মেলনে বললেন, “মুসলিম লীগের সকল সততা, সদিচ্ছা ও সুবিচারমূলক চেষ্টা, এমনকি আবেদন-নিবেদন ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেসের খপ্পরে পড়েছে। তারা (মিশন) নিজের খেলা খেলছেন। কংগ্রেস মনে করে, ওরা মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে যেতে পারবো। ইচ্ছা করলে তারা যেতে পারে। তবে আমরা ভীত নই এবং এরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা কিভাবে করতে হয় তাও আমরা জানি। —-একমাত্র মুসলিম লীগই পরিস্কারভাবে সততার সাথে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ব্যাপারে মিশন তাদের ওয়াদা খেলাফ করেছে। মিশন ভীত ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। —আমার মনে হয়, আমরা সকল যুক্তি নিঃশেষ করেছি। গঠনের ব্যাপারে মিশন তাদের ওয়াদা খেলাফ করেছে। মিশন ভীত ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। —-আমার মনে হয়, আমরা সকল যুক্তি নিঃশেষ করেছি। সাহায্য লাভের জন্যে অন্য কারো দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। যাওয়ার মত কোন বিচারালয় নেই। একমাত্র বিচরালয় হচ্ছে মুসলিম জাতি। আমি মনে করি, সময় এসেছে যখন (যখন কথাটা আমি বার বার বলে আসছি) নিয়মানুবর্তিতা, ঐক্য ও আমাদের জাতির ক্ষমতার উপর আস্থাশীল হওয়া মুসলিম লীগের ও আমাদের উচিত। যদি যথেষ্ট শক্তি না থাকে, শক্তি সৃষ্টি করুন। যদি আমরা তা করি, তাহলে মিশন ও বৃটিশ সরকারকে কংগ্রেস যে অসহযোগিতায় ভয় দেখাচ্ছে আমরা তা থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারবো। আসুন আমরাও বলি যে, আমরা তাই করবো (অর্থাৎ অসহযোগিতা করবো)”।–[এই উদ্ধৃতি ও বিষয়গুলো আকবর উদ্দীন লিখিত ‘কায়েদে আযম’ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। পৃষ্ঠা ৭৫৬]
মুসলিম লীগ এই সম্মেলনে দুইটি প্রস্তাব গ্রহণ করলো। প্রথমটি ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা সম্পর্কিত, দ্বিতীয়টি ভবিষ্যত কর্মসূচী সংক্রান্ত। প্রথম প্রস্তাবে বলা হলোঃ “অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সম্পর্কে ওয়াভেল প্রথমে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (৫:৫:২) তা বিবেচনা করে কাউন্সিল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ক্যাবিনেট মিশন সেই প্রতিশ্রুতি ভংগ করেছে। এতদ্ব্যতীত কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করা মুসলিম লীগের পক্ষে বিপজ্জনক এবং সেই কারণে পূর্বে মিশনের প্রস্তাবসমূহ গ্রহণের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হলো”। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হলো, “পাকিস্তান অর্জনের জন্যে, তাদের (মুসলমানদের) অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে, তাদের সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্যে এবং বৃটিশের ও বর্ণহিন্দুদের দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা অবলম্বনের সময় এসেছে। ওয়ার্কিং কমিটিকে প্রত্যক্ষ কর্মপন্থার (Direct Action) পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো এবং বৃটিশ প্রদত্ত সমস্ত উপাধি বর্জন করার জন্যে মুসলমানদের আহবান জানানো হলো”।–[এই উদ্ধৃতি ও বিষয়গুলি আকবর উদ্দীন লিখিত ‘কায়েদে আযম’ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। পৃষ্ঠা ৭৫৭, ৭৫৮।]
প্রস্তাব গ্রহণের পর লীগ সভাপতি জিন্নাহ বললেন, “আমরা আজ একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। শাসনতান্ত্রিক বৈধপন্থা ব্যতীত মুসলিম লীগ অন্য কোন পন্থা এতকাল কাজ করেনি। আজ বাধ্য হয়েই আমরা এ পন্থা অবলম্বন করেছি। আজ আমরা সকল শাসনতান্ত্রিক সংগত পন্থা থেকে বিদায় নিলাম। এখন আর সমঝেঅতার কোন অবকাশ নেই। এবার আমরা অগ্রসর হবো। আপনারা (কংগ্রেস ও বৃটিশ) যদি শান্তি চান, আমরা সংগ্রাম চাইনা। আর আপনারা যদি যুদ্ধ চান, আমরা দ্বিধাহীনভাবে মোকাবিলা করব”।–[এই উদ্ধৃতি ও বিষয়গুলি আকবর উদ্দীন লিখিত ‘কায়েদে আযম’ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। পৃষ্ঠা ৭৫৭, ৭৫৮।]
এখানে উল্লেখ্য, মুসলিম লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনের ৪ দিন আগে ২২শে জুলাই তারিখে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল লীগ প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ এবং কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নেহেরুকে গোপন চিঠি মারফত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবে কংগ্রেস থেকে ৬ জন, মুসলিম লীগ থেকে ৫ জন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু থেকে ৩ জন মোট ১৪ সদস্য নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল। জবাবে নেহেরু একে সংগে সংগেই প্রত্যাখ্যান করেন এবং দাবী করেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল নামমাত্র একজন প্রধান থাকবেন এবং সংখ্যালঘু সদস্যদের মনোনয়ন বৃটিশ সরকার দিতে পারবেন না।–[‘The Great Divide’, S.V Hudson, page 164] অর্থাৎ কংগ্রেস সংখ্যালঘু সদস্যদের মনোনয়নের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ণ স্বাধীনতাতে ভারতের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কাজে লাগাতে চায়। অন্যদিকে জিন্নাহ লর্ড ওয়াভেলের চিঠির জবাব দেননি। ২৯শে জুলাই মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শেষ হলে জিন্নাহ তাঁর এক বক্তব্যে এ সম্পর্কে বলেন যে, ওয়াভেলের প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্যে অনুকূল বিষয়গুলোকে, অতীতে যা ছিল, প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে,-[‘The Great Divide, S.V. Hudson, page 165.] তাই প্রস্তাবটি মুসলিম লীগের বিবেচন্য নয়।
২৯শে জুলাই এর মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের পর মজার ঘটনা ঘটল। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান কার্যত প্রত্যাখ্যান করে কংগ্রেস ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে যে মহা ভুল করেছিল, কংগ্রেসের যে সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের জন্যে ‘সাবোটাজ’ ছিল এবং কংগ্রেসের ‘সাবোটাজ’ কার্যক্রম লীগকে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করেছিল, সেই ‘ভুল, সেই ‘সাবোটাজ’ এর জন্যে শাস্তির বদলে বৃটিশ সরকার কংগ্রেসকে পুরস্কৃত করলো। লীগের সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই লর্ড ওয়াভেল ৬ই আগস্ট তারিখে নেহেরুকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্যে আহবান জানালেন। এই খবর ওয়াভেল জিন্নাহকে জানালেন ৮ই আগস্ট তারিখের এক পত্রে। এই ৮ই আগস্ট তারিখেই কংগ্রেস তড়িঘড়ি করে তার ওয়ার্কিক কমিটির মিটিং এ ওয়াভেলের সরকার গঠনের আমন্ত্রণকে আনন্দের সাথে স্বাগত জানান। যেহেতু মুসলিশ লীগকে টেক্কা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কুক্ষিগত করার সুযোগ পাচ্ছে, তাই কোন শর্তের কথা কংগ্রেস তখন মনে করেনি, এমনকি যে শর্ত নেহেরু মাত্র ১৪ দিন আগে আরোপ করেছিলেন ওয়াভেলের ২২ শে জুলাই এর প্রস্তাবের বিপরীতে, সে শর্তও নয়।
সরকার গঠনে আহুত হবার ৬ দিন পর নেহেরু জিন্নাহকে লিখলেন যে, —অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে যদি এ বিষয়ে আপনি আমার সাথে আলোচনা করতে চান, তাহলে আমি সানন্দে আপনার সঙ্গে বোম্বাই অথবা যেখানেই থাকুন দেখা করতে প্রস্তুত আছি।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৬৩, ৭৬৪)।] নেহেরুর এ চিঠির জবাবে জিন্নাহ ১৫ই আগস্ট এক পত্রে লিখলেন, “ভাইসরয় ও আপনার মধ্যে কি (আলোচনা হয়েছে আমি কিছুই জানিনা, অথবা আপনাকের কি চুক্তি হয়েছে তাও আমি জানিনা। এইমাত্র জানি, যা আপনি ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি আপনাকে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রূপে অনতিবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব পেশ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং আপনি তা গ্রহণ করেছেন। —-এর অর্থ যদি এই হয় যে ভাইসরয় আপনাকে গভর্ণর জেনারেলের একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করার দায়িত্ব দিয়েছেন এবং আপনাকে গভর্ণর জেনারেলের একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করার দায়িত্ব দিয়েছেন এবং আপনার পরামর্শ মতো একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করতে আগেই তিনি সম্মত হয়েছেন, তাহলে এই ব্যবস্থা স্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। —যাই হোক হিন্দু মুসলিম প্রশ্ন ও এই গুরুতর অচলাবস্থার সমাধানের জন্যে যদি কংগ্রেসের পক্ষ থেকৈ আপনি আমার সাথে সাক্ষাত করতে চান, তাহলে আজ (সন্ধ্যে) ছয়টায় সানন্দে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজি আছি”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamiluddin Ahmed, p 333, 336, (‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৬৩, ৭৬৪)।] এই দিনই নেহেরু জিন্নার এ চিঠির জবাব দিলেন, “—-আমার ও ভাইসরয়ের মধ্যে কিছুই হয়নি এবং আমার নিকট প্রস্তাব করা ও আমার তা গ্রহণ করা ব্যতীত অন্য কোন বন্দোবস্ত হয়নি। —আমরা সর্বদাই এই বিষয়ে (হিন্দু-মুসলিম সমস্যা) আলোচনা করতে ও পন্থা বের করতে প্রস্তুত আছি। তবে বর্তমানে আমরা অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা চিন্তা করছি। —-অস্থায়ী কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে এই বিষয়ে বিবেচনা করার ও এই সমস্যা সমাধানের সুবিধা হবে। বৃহত্তর প্রশ্ন সম্পর্কে আপনার সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু আমার কোন নতুন প্রস্তাব নেই। সম্ভবত আপনি কোন নতুন পন্থা বাতলাতে পারবেন”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamiluddin Ahmed, p 333, 336, (‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৬৩, ৭৬৪)।]
এখানে লক্ষণীয়, নেহেরু সরকার গঠনের আগে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা আলোচনা করতে চাননা। এটা কংগ্রেসের পুরানো কৌশল। আগে ক্ষমতা, তারপর সমাধান, যাতে ক্ষমতার জোরে, সমাধানটা ইচ্ছামত করা যায় এবং চাপিয়ে দেয়া যায়। আরেকটা লক্ষণীয় বিষয়, এই সমস্যা সমাধানে নেহেরুর কোন চিন্তা নেই, প্রস্তাব নেই। এটাও কংগ্রেসের পুরানো কৌশল। মুসলমানদের তারা কিছু দেবেন না, কিন্তু প্রস্তাব এলে তা প্রত্যাখ্যান করবেন।
নেহেরুর চিঠির জবাব জিন্নাহ ঐ দিনই দিলেন। বললেন, “—-আপনি কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এর কতকগুলির সাথে আমি একমত মনে করবেন না। —-যেহেতু আপনি আমার সাথে দেখা করতে চান, সেহেতু আজ সন্ধ্যে ছয়টায় আপনার সাথে সানন্দে সাক্ষঅত করতে রাজী আছি”।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 165.]
জিন্নাহ-নেহেরু দেখা হলো। দীর্ঘ আলোচনা হলো। হডসনের ভাষায়, ‘কোন পক্ষই তাদের পূর্ব অবস্থান থেকে নড়লেন না এবং আলোচনা ব্যর্থ হলো’।
১৬ই আগস্ট তারিখে জিন্নাহ-নেহেরুর আলোচনা ব্যর্থ হলো। আর এই ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে। ২৯শে জুলাই এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক এদিন দেশের সর্বত্র মিছিল, মিটিং এবং কোথাও হরতালেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বাংলা ও সিন্ধুতে ছিল মুসলিম লীগের সরকার। বৃটিশ সরকার মুসলিম লীগকে পাশ কাটিয়ে নেহেরুকে সরকার গঠনের জন্যে আহবান করলে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, “যদি ভাইসরয় কেন্দ্রে কংগ্রেসী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে তিনি (সোহরাওয়ার্দী) বাংলাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ঘোষণা করবেন এবং এ অঞ্চল থেকে কোন রাজস্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হবে না….”।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 165.] ১৬ই আগস্ট অর্থাৎ ডাইরেক্ট এ্যাকশনের দিন সোহরাওয়ার্দী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। এদিক কোলকাতায় হরতালও ডাকা হয়েছিল। মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ কর্মসূচী বা ডাইরেক্ট এ্যাকশন কোন অশান্তি সৃষ্টির জন্যে ছিল না, এর লক্ষ্য ছিল এদিন মিছিল, মিটিং ইত্যাদির মাধ্যমে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মুসলিম লীগের পদক্ষেপ সবাইকে বুঝিয়ে বলা। ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডের দু’দিন আগে কায়েদে আযম ১৪ই আগস্ট তারিখে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, “আমি মুষলমানদের বলছি, প্রত্যক্ষ কর্মসূচী দিবস কোন সংঘর্ষ সৃষ্টির দিন নয়। তারা যেন মুসলিম লীগের নির্দেশ ঠিক মত মেনে চলে এবং শত্রুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে কোনও প্রকারের গোলযোগের সৃষ্টি না করে বা কোন প্রকারের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের আশ্রয় না নেয়”।–[‘Pakistan in the Formative Stage’, Khalid bin Sayed.]
১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ কর্মসূচীর দিন সারা ভারতেই মিছিল-মিটিং অনুষ্ঠিত হলো, কিন্তু ভয়াবহ দাঙ্গা বেঁধে গেল বাংলায়। দাংগা চলল ১৬, ১৭, ১৮ই আগস্ট –এই তিন দিন ধরে। কোলকাতায় স্টেটম্যান পত্রিকার সম্পাদক ‘আয়ান স্টিফেন’-এর ভাষায় “বেসরকারী সূত্রে হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার আহত এবং হাজার নিহত, ১০ হাজার আহত বলেছেন। আর স্টেটসম্যান পত্রিকার হিসাব মতে ২০ হাজার অথবা কিচু বেশী হতাহত হয়েছিল”।–[‘Pakistan’, Lan Stephens, page 106.] এই হতাহতের তালিকায় মুসলমানদের সংখ্যাই ছিল বেশী। আয়ান স্টিফেন লিখেছেন, “প্রথম দিনের লড়াইয়ে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে নিশ্চয় মুসলমানরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। মুসলমানরা আক্রমণ করবে এই আগাম ধারণায় স্থানীয় হিন্দু প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রচণ্ড প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। —(তবে) হিন্দুদের আক্রমণেও তেমন সুবিধা হয়নি, কিন্তু পাল্লা উল্টে গেল দ্বিতীয় দিনে অপরাহ্নে শিখদের হস্তক্ষেপের ফলে”।–[‘Pakistan’, Lan Stephens, page 106.] শিখদের সাথে নিয়ে মুসলমানদের মার দেবার কথা কংগ্রেস নেতা কিরণ শংকর রায় ১৪ই আগস্ট তারিখেই ঘোষনা করেছিলেন।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৬৯।] হিন্দুরা যে এজন্যে আগে থেকে প্রস্তুত হয়েছিল, একথা বৃটিশ ভারতে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডার জেনারেল টাকোকে এভাবে বলেছেন, “হিন্দুমহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস) এর দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছিল। —-বাংলাতে মহাসভা তৎপর হয়েছিল”।–[‘While Memory Serves’, Sir Francis Tucker, page 143.] যে মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, হরতালের মাঠে হিন্দুরা ছিল এককভাবে, সেখানে যাতে মুসলমানরা না আসতে পারে তা নিশ্চিত করাও ছিল হিন্দুদের একটা লক্ষ্য। জেনারেল টাকোর এর ভাষায়, “তাদের (হিন্দুদের) ক্রোধের অন্যতম কারণ হচ্ছে, এতকাল হরতাল, ধর্মঘট ইত্যাদি জোর করে চাপিয়ে দেয়ার একচ্ছত্র অধিকার ছিল কংগ্রেসের। সুতরাং এক্ষেত্রে অন্য কোন প্রতিযোগীর বিশেষত মুসলিম লীগের মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের দাবীতে তারা ক্রুব্ধ হয়েছিল”।–[‘While Memory Serves’, Sir Francis Tucker, page 143.] ইচ্ছাকৃতভাবে হাঙ্গামার সূত্রপাতও হিন্দুরাই ঘটিয়েছিল। জেনারেল টুকার এর ভাষায়, “১৬ই আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টায় খবর পাওয়া গেল যে, হিন্দুরা মুসলমানদের মিছিল করে শহরে প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্যে টালা ও বেলগাছিয়ার পুলগুলোতে তাদের আটকাবার ব্যবস্থা করেছে”।–[‘While Memory Serves’, Sir Francis Tucker, page 157.] মুসলমানরা শহরের মিটিং স্থলে আসার সময় এবং সভাশেষে বিশৃঙ্খলভাবে যাবার সময় তাদের উপর আক্রমণ শুরু হলো। মিছিল-মিটিং এ যোগ দেয়ার জন্যে এলে তাদের অরক্ষিত বসতিগুলো আক্রান্ত হলে ক্ষয়ত-ক্ষতি বেশী হয়।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৬৯।] কোলকাতার ভয়াবহ দাংগার পর কায়েদে আযম বললেন, “মুসলমানরা শান্তি ভংগের জন্য কোন প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণতো করেই নাই বরং কোলকাতায় তাদের উপর যখন আক্রমণ হয়, তখন তারা আত্মরক্ষা পর্যন্ত করতে সক্ষম হয়নি। —ভাইসরয় লীগকে উপেক্ষা করে যেভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে চলেছেন, তাতে হিন্দুরা উল্লসিত হয়ে মুসলিম লীগ ও মুসলিম মন্ত্রী সভাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এই সুপরিকল্পিত পন্থা অবলম্বন করেছিল। যদি কংগ্রেসী শাসকবৃন্দ মুসলমানদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে ও তাদের উপর অত্যাচার করতে থাকে, তাহলে হাঙ্গামা রোধ করা অত্যণ্ত কঠিন হবে”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-1, Jamiluddin ahmed, page 325, 327.]
দাঙ্গা বিধ্বস্ত কোলকাতা পরিদর্শনের জন্যে লর্ড ওয়াভেল কোলকাতা এলেন। কলকাতার ঘটনা ওয়াভেলের মনকে দারুণভাবে আলোড়িত ও আহত করেছিল। হিন্দু-মুসলিম অনেক নেতার সাথে তিনি দেখা করলেন। দেখা হলো খাজা নাজিমউদ্দীনের সাথেও। আলোচনাকালে ওয়াভেলকে তিনি জানান, “কংগ্রেস যদি ঘোষণা দেয় যে তারা ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাটি মিশনের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় অনুযায়ী গ্রহণ করেছে, তাদের নিজেদের ব্যাখ্যা অনুসারে নয় এবং সে সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যদি সুযোগ দেয়। তবে মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করবে কিনা বিবেচনা করতে পারে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেবে”।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২০৮।]
লর্ড ওয়াভেল কোলকাতা থেকে ফিরে এলেন এই ধারণা নিয়ে যে, দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। তিনি ২৪শে আগস্ট এক বেতার ভাষণে বললেন, “অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ৬:৫:৩ সদস্য হার ভিত্তিক প্রস্তাবটি মুসলিম লীগের জন্যে এখনও উন্মুক্ত আছে। মুসলিম লীগ রাজী হলেই অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন করা হবে”।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 168.] ওয়াভেল মুসলিম লীগকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে আরও বললেন যে, মিশনের পরিকল্পনায় উল্লেখিত প্রদেশগুলোর গ্রুপ ব্যবস্থা আন্তরিকবাবে মেনে চলা হবে, সাম্প্রদায়িক কোন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের মেজরিটির সমর্থন ছাড়া আইন প্রণীত হবে না এবং এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক দেখা দিলে ফেডারেল কোর্ট তার মীমাংসা করবে। কোলকাতার ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পর ওয়াভেল সত্যিই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন মুসলিম লীগকে অন্তর্বর্তী সরকারে নেবার জন্যে। লর্ড ওয়াভেল ২৭শে আগস্ট গান্ধী ও নেহেরুকে ডাকলেন আবার আলোচনার জন্যে। এই দিন গান্ধী-নেহেরুর সাথে ওয়াভেলের যে আলোচনা হয়, তা তখনকার কংগ্রেস রাজনীতি বোঝার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনাটি Leonard Mozeley’ এর গ্রন্থ ‘The Days of British Raj’ থেকে নিচে উদ্ধৃত করা হলোঃ
“ওয়াভেলঃ আপনারা কি আমাকে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, আপনানরা ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন?
গান্ধীঃ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা যে আমরা গ্রহণ করেছি, তা ইতিপূর্বেই আমরা আপনাকে জানিয়েছি। তবে মিশন যেভাবে এটি তৈরী করেছেন, ঠিক সেভাবেই যে এটিকে আমরা গ্রহণ করব, এরূপ নিশ্চয়তা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মিশনের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে।
ওয়াভেলঃ এমনওতো হতে পারে আপনাদের ব্যাখ্যা আর ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের উদ্দেশ্যের মধ্যে পার্থক্য ঘটতে পারে।
গান্ধীঃ অবশ্যই ঘটতে পারে। কিন্তু কথা হলো, ক্যাবিনেট মিশন যা ভাবছে তাঁদের পরিকল্পনায় তার সত্যিকার প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার যা ভাবছে ঐকান্তিকভাবে তাঁরা তার বাস্তবায়নে আগ্রহী।
ওয়াভেলঃ যেহেতু মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ গ্রহণ করছেনা, তাই অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাবেই কংগ্রেসের পক্ষে যাবে। এ অবস্থায় কি করে এই সরকারের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা যায়?
গান্ধীঃ পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আলোচনার আইনসম্মত ভিত্তিটাই হলো আমাদের কাছে মুখ্য। কেননা, নিয়মতান্ত্রিকভাবে বলতে গেলে এ বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলেই কেবল মুসলিম লীগের আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের অমূলক উদ্বেগ, প্রভৃতি প্রশ্নের সুরাহা করা সহজ হবে। কিন্তু এর আগে কিছু করা যাবে না।
গান্ধীর কথায় ওয়াভেল ক্রুব্ধ হয়ে উঠেন এবং বলেনঃ আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না এটা স্রেফ একটা কংগ্রেস সরকার। তাদের মধ্যে নিরপেক্ষতা না থাকাই স্বাভাবিক?
নেহেরুঃ কংগ্রেসের গঠন কাঠামো সম্পর্কে আপনার সঠিক ধারণা নেই মাননীয় ভাইসরয়। কংগ্রেস হিন্দু সমর্থকও নয়, মুসলিম বিরোধীও নয়। এই সংগঠন ভারতের সব শ্রেণীর লোকের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং কখনও তা মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না।
ওয়াভেলঃ কিন্তু পণ্ডিত নেহেরু আপনি কোন মুসলমানের কথা বলছেন? আপনি কি কংগ্রেসী মুসলমানদের ক্রীড়নকদের কথা বলছেন, মুসলিম লীগ মুসলমানদের কথা বলছেন, আপনি কি বুঝতে পারছেন না, এ মুহুর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আপনারা যে মুসলিম লীগের স্বার্থ নস্যাত করতে যাচ্ছেন না, মুসলিম লীগের মনে সে রকম একটি সংশয়হীন ধারণা সৃষ্টি করা। ভুলে যাবেন না মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির এটাই উপযুক্ত সময় এবং শেষ সুযোগ। সে যাই হোক, ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে কংগ্রেসের কাছ থেকে আমি এমন একটা ঘোষনা চাই, যে ঘোষণা মুসলিম লীগকে সন্তুষ্ট করবে এবং একটা স্থিতিশীল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দেবে।
এই কথাগুলো বলার পর লর্ড ওয়াভেল তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ টেনে বের করলেন এবং বললেন, আমি যা বলতে চাই এতে তা রয়েছে।–[ড্রয়ার থেকে বের করা ঘোষণা পত্রের বক্তব্য এই, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে ঘোষিত পরিকল্পনার এই বিষয়টি মেনে নিতে রাজী যে, নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার আওতায় প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত নতুন আইন সভা ১৬ই মে’র বিবৃতির ১৯ (৭) অনুচ্ছেদের প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে না দেয়া পর্যন্ত প্রদেশগুলো তাদের নির্ধারিত গ্রুপ থেকে অন্য কোন গ্রুপে যোগ দিতে বা আলাদা হয়ে যেতে পারবেনা”। Transfer of Power in India’, V.p. Menon, Page 302]
ঘোষণাপত্রটি গান্ধী (হাতে নেয়ার পর পড়ে তা) নেহেরুর হাতে দিলেন। আদ্যোপান্ত পড়ে নেহেরু বললেন, এই ঘোষনা মেনে নেয়ার অর্থ কংগ্রেসকে তার নিজের পায়ে শৃংখল পরিয়ে দিতে বলা।
ওয়াভেলঃ কিন্তু ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান মেনে নিতে হলে এই ঘোষণাপত্রটি আপনাদের মেনে নেয়া উচিত। একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা যে, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাটির তাৎপর্য না জেনেই কংগ্রেস প্রথমে এটা মেনে নিয়েছিল। এই পরিকল্পনায় ভারতকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করার কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। কাজেই এখন আপনারা কথা ঘুরিয়ে এ কথা বলতে পারেন না যে, মিশনের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য আপনারা অনুধাবন করতে পারেননি।
গান্ধীঃ ক্যাবিনেট মিশনের উদ্দেশ্য ও আমাদের ব্যাখ্যা যে এক হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
ওয়াভেলঃ এটা হলো আইনজীবীর কথা। আমি চাই আপনারা সাদা-মাটা ইংরেজীতে আমার সাথে কথা বলুন। আমি একজন সৈনিক। সোজা-সরল কথা আমি বুঝি।
নেহেরুঃ আইনজীবী হয়ে নিশ্চয়ই আমরা কোন অপরাধ করিনি।
ওয়াভেলঃ সে কথা নয়। আমি বলতে চাই, আপনারা আমার সাথে এমন সৎলোকের মত কথা বলুন যারা ভারতের কল্যাণ চায়। বাদ দিন এ প্রসংগ। ক্যাবিনেট মিশনের প্রসংগে আসুন। ক্যাবিনেট মিশনের উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় দিবালোকের মতই স্পষ্ট। সুতরাং এ ব্যাপারে আইনের ব্যাখ্যা চাওয়ার বা বিতর্কে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কংগ্রেসের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নিশ্চয়তা পেলে আমি মনে করি মিঃ জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানে অস্বীকৃতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে রাজী করাতে পারব। অন্তর্বর্তী সরকারে তাদের প্রয়োজন আমরা বোধ করছি। ভারতেও তাদের প্রয়োজন আছে এবং আপনারা গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামের কথাটি যদি চিন্তা করেন,
তাহলে আপনারাও তাদের প্রয়োজন অনুভব করবেন। এ অবস্থায় কংগ্রেসকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের অনুমতি দেয়া হলে সেটা আমার পক্ষে শুধু অবিবেচনার কাজই হবে না, এটা বিপজ্জনক ঝুঁকিও হয়ে দাঁড়াবে।
গান্ধীঃ কিন্তু আপনি তো ইতিমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। আপনি এখন কথার খেলাফ করতে পারেন না।
ওয়াভেলঃ সে পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। কলকাতার হত্যাকাণ্ডের ফলে গোটা ভারত এখন একটা গৃহযুদ্ধের মুখে। এটাকে প্রতিহত করা আমার কর্তব্য। মুসলমানদের বাদ দিয়ে কংগ্রেসকে সরকার গঠন করতে দেয়া হলে গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধ করা যাবে না। মুসলমানরা তখন প্রত্যক্ষ সংগ্রামকে একমাত্র পথ হিসাবে বেছে নেবে।
নেহেরুঃ অর্থাৎ আপনি মুসলিম লীগের ব্লাকমেইলের কাছে নহি স্বীকার করতে যাচ্ছেন”।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, (মাহবুবুর রহমান) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ২০৯, ২১২, ‘The Last Days of the British Raj’, Lenard Mozeley, page 44, 46.]
এইভাবেই ওয়াভেল-গান্ধী-নেহেরু আলোচনা শেষ হয়ে গেল। বিক্ষুব্ধ গান্ধী ওয়াভেলের বিরুদ্ধে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা পাঠালেন। তখন বৃটেনে শ্রমিক দল ক্ষমতায়। শ্রমিক দল সব সময় কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল। সুতরাং এটলী সহজেই গলে গেলেন গান্ধীর কথায়। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জানালেন যে, কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে সমঝোতার অভাবে উগ্র ও ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার বিপদ সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অবহিত, এদের মধ্যে সমঝোতার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি না করার জন্যে এবং পূর্বঘোষিত অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যভার দেয়ার জন্যে ভাইসরয়কে পরামর্শ দিচ্ছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী।
বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ২রা সেপ্টেম্বর নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করলো। ভীষণ খুশী গান্ধী এদিন প্রার্থনা সভা ডেকে বললেন, “দীর্ঘকাল ভারতীয়রা এই দিনের জন্যে লাঞ্ছনা ও কষ্ট স্বীকার করেছে।
……আজ ভারতীয় নেতাদের সাথে মীমাংসার জন্যে তাদের (বৃটিশদের) ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৩১।] কিন্তু কংগ্রেস খুশী হলেও তাদের এই রাজত্বে অশান্তি বেড়েই চলল। বোম্বাই ও আহমাদাবাদের হলো গুরুতর দাংগা। তার ঢেউ গিয়ে লাল বাংলাদেশে। নোয়াখালী, কুবিল্লা, চট্টগ্রাম অঞ্চলে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটল। এক নোয়াখালীতেই দাংগায় তিন শ’র মত লোক নিহত হলো। এই আস্থার মধ্যে ওয়াভেল গিয়ে ধরলেন জিন্নাহকে। দেশের স্বার্থে মুসলিম লীগকে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতেই হবে। জিন্নাহ লিখিতভাবে নয়টি বিষয়ে মতামত ও ব্যাখ্যা দাবী করলেন। এই নয়টি দফার ৮টি অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন ও কাজ সম্পর্কে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯নং দফায় দাবী করলেন, “উপযুক্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এবং উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো সম্বন্ধে সমঝোতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রশ্ন মুলতবি রাখতে হবে”।
ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল কিছু মেনে নিয়ে কিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে লিখিতভাবে জিন্নার প্রস্তাবের জবাব দিলেন। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এসব দাবী, ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিয়ে ওয়াভেল, জিন্নাহ, গান্ধী, নেহেরু, প্রমুখের মধ্যে আলোচনা চলল। অবশেষে ১৩ই অক্টোবর এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মিঃ জিন্নাহ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাইসরয়কে লিখলেন, “মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি সমস্ত বিষয় পর্যালোচনা করার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, যে ভিত্তি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাইসরয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন তা কমিটি অনুমোদন করে না। ….কিন্তু যেহেতু মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাঁচজন সদস্য মনোনয়নের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, সেই হেতু আমার কমিটি অন্যান্য কারণে সাব্যস্ত করেছেন যে, মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় সরকারের সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থা কেবল কংগ্রেসের হাতে ছেড়ে দেয়া মারাত্মক হবে। এতদ্ব্যতীত, মুসলিম ভারতের আস্থাভাজন নয় এমন ব্যক্তিদের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে নিয়োগ করতে আপনি বাধ্য হতে পারেন এবং পরিশেষে অন্যান্য পরিস্থিতি ও কারণে আপনার ১৯৪৬ সালের ২৪শে আগস্ট তারিখের বেতার ঘোষণা এবং আমার নিকট আপনারা ৪ঠা ও ১২ই অক্টোবর তারিখের দু’টি পত্রের ভিত্তিতে আমরা মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাঁচজন সদস্য মনোনীত করতে প্রস্তুত আছি”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৮১।] এরপর ১৫ই অক্টোবর তারিখে এই পাঁচজন সদস্য হিসেবে লিয়াকত আলী খান, আই, আই, চুন্দ্রিগড়, আব্দুর রব নিশতার, গজনফর আলী খান এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এর নাম জিন্নাহ ভাইসরয়ের কাছে পেশ করলেন। কংগ্রেস তার সদস্যের যে জেদ, তারই প্রতিশোধ হিসেবে তফসিলী হিন্দুনেতা নিম্নবর্ণের তফসিলী হিন্দুদের প্রতিনিধি নয়। এতে কাজ হয়েছিল। গান্ধী দারুণভাবে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন, একজন হরিজনকে মনোনীত করে লীগ ক্যাবিনেটের মধ্যে লড়াই করতে এসেছে কি না।–[‘Transfer of Power in India’, V.P Menon,page 317.]
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে, জিন্নাহ নেহেরুর দাবী স্বীকার করে নিয়ে ক্যাবিনেটে যোগ দেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৩২।] একথা ঠিক নয়। ঐতিহাসিক হডসন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘জিন্নাহ যদি কংগ্রেসের কাছ থেকে কিছুই আদায় করে না থাকে, তাহলে কংগ্রেস ও নেহেরুর মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল কেন মুসলিম লীগ সরকারে আসায়?-[‘The Great Divide’ S.V. Hudson, page 172.] বস্তুত কংগ্রেস চায়নি মুসলিম লীগ সরকারে আসুক, তাই ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব নিয়ে অযৌক্তিক ভূমিকা পালন করে মুসলিম লীগকে ভয় দেখিয়ে দূরে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু কৌশলের যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জিন্নাহ ধীর স্থিরভাবে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে নিজের অবস্থান ঠিক রেখেছে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিয়ে সরকারে যোগদান করেছেন। জিন্নাহ সরকারে আসার ক্ষেত্রে এই সুবিধাগুলো আদায় করে নিয়ে সরকারে যোগদান করেছেন। জিন্নাহ সরকারে আসার ক্ষেত্রে এই সুবিধাগুলো আদায় করেনঃ (১) মুসলিম লীগ নেহেরুর আহবানে সরকারে আসে নি, এসেছে ওয়াভেলের আহবানে তার সাথে দরকষাকষি করে এবং কংগ্রেসের সমকক্ষ একটা পক্ষ হিসেবে, (২) ক্যাবিনেট মিশনের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা স্থগিত রাখার শর্তে মুসলিম লীগ সরকারে যোগ দেয়। এর ফলে স্বকল্পিত ব্যাখ্যাসহ মিশনের দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ কংগ্রেসের বন্ধ হয়, (৩) মুসলিম সদস্য না নেয়া সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ যদি কংগ্রেস না মানে, তাহলে এ ধরনের কোন বিধি-নিষেধ মুসলিম লীগের উপরও থাকবে না। এ বিষয়টা স্বীকার করিয়েই লীগ সরকারে আসে। যার ফলে মুসলিম যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে নেয় যা কংগ্রেসের জন্যে মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিল এবং (৪) ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার মুসলিম লীগের অধিকার প্রশ্নাতীত –এ কথা জিন্নাহ সংগ্রেসকে দিয়ে স্বীকার করিয়েছিল।–[গান্ধীর অনুরোধে ভূপালের নওয়াবের মধ্যস্থতায় গান্ধী ও জিন্নার মধ্যে এই ফর্মূলা স্বাক্ষরিত হয়ঃ “The Congress does not challenge or accepts that the muslim league in now is the authoritative representative veorganization of an overwhelming majority or the muslims of India. As and in accordance with democratic principles they alone have today an unquestionable right to represent the Muslim of India, But Congress cannot agree that any restriction or Limitation should be pup upon the Congress cannot agree that any think people from among the member of the Congress as their representatives.” (কায়েদে আযম, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৮২)।]
মন্ত্রীসভা গঠনের পর দফতর বণ্টন নিয়ে বাধল বিরোধ। যেসব পদের সাথে শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত আছে, সেসব পদ, যেমন স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, ও দেশরক্ষা, কংগ্রেস কিছুতেই মুসলিম লীগকে দিতে চাইল না। ওয়াভেলের অনুরোধেও এ তিনটি পদের একটিও কংগ্রেস ছাড়তে রাজী হলো না। দিতে চাইল অর্থ, বাণিজ্য, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও আইনের মত পদগুলো। অবশেষে বৃটিশের মুসলিম আমলা চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মুসলিম লীগকে পরামর্শ দিলেন অর্থ সহ যা দিতে চাচ্ছে তা নেবার জন্যে। এক অর্থ মন্ত্রণালয় দিয়েই কংগ্রেসকে উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে।
যে দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা নিয়ে মন্ত্রীসভার যাত্রা শুরু হলো, সে দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা পরে বেড়েই চলল এবং সরকার ও প্রশাসনকে অচল অবস্থায় পৌঁছে দিল। “প্রকৃত প্রস্তাবে অন্তর্বর্তী সরকারের দু’টি দলের মধ্যে সহযোগিতা ছিল না। একদল অপর দলের সাথে পরামর্শ করতো না। অর্থ দফতর হাতে থাকায় (অর্থমন্ত্রী) লিয়াকত আলী খানের পক্ষে অন্যান্য দফতরের কাছে বাধা দেওয়ার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল। বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন স্বরাষ্ট্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত। তিনিই সবচাইতে ক্রুব্ধ হয়েছিলেন। একটি নতুন চাকরানী নিয়োগ করতে হলেওঅর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ দফতরের মঞ্জুরীর নিয়ম থাকায় লিয়াকত আলী খান অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করতেন। এতদ্ব্যতীত সরকারে দু’টি স্বতন্ত্র দল থাকার ফলে সেক্রেটারিয়েটের সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে দলাদলি দেখা দিয়েছিল। একদলের কর্মচারী অন্যদলের কর্মচারীদের কোন রকম সাহায্য করতেন না”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৯৪, ৭৯৫।] অন্যদিকে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
সরকারের প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস সভাপতি নেহেরু কেন্দ্রীয় পরিষদ আহবানের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। লীগ প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ এর তীব্র বিরোধিতা করলেন। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলও শীঘ্র কেন্দ্রীয় পরিষদ ডাকতে চাচ্ছিলেন। তিনি জিন্নাহকে বুঝিয়ে রাজী করাতে চেষ্টা করলেন। জিন্নাহ বললেন, মুসলিম লীগ যেহেতু ২৯শে জুলাই এর অধিবেশনে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে, তাই মুসলিম লীগ কাউন্সিল এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ না করা পর্যন্ত লীগ সদস্য কেন্দ্রীয় পরিষদে যোগ দিতে পারবে না। ওয়াভেল অনুরোধ করলেন শীঘ্র লীক কাউন্সিল ডেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার জন্যে। কিন্তু জিন্নাহ লীগ কাউন্সিল ডাকলেন না। তাঁর দৃষ্টি ছিল কংগ্রেসের তৎপরতার দিকে। ১৭ই নভেম্বর জিন্নাহ ওয়াভেলের কাছে লিখা এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার সাথে কংগ্রেসের আচরণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বললেন, “যেহেতু কংগ্রেস পূর্ব সিদ্ধান্তে অনড়, তাই লীগ কাউন্সিল আহবানের কোন প্রয়োজন দেখি না। ….আসল প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমে কংগ্রেসকে সুস্পষ্টভাবে মৌলিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে স্বীকার করাতে হবে এবং তারপর কংগ্রেস যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকরে তাহলে (মিশনের) প্রস্তাবসমূহ কার্যকরী করার পন্থা বৃটিশ সরকারকে স্থির করতে হবে”।–[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah, Vol-11, Jamiluddin Ahmed, page 368-370.]
কিন্তু ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল মিঃ জিন্নাহ উত্থাপিত এইসব বাস্তব দিকের প্রতি কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে এবং মিশনের পরিকল্পনা মানা না মানা সম্পর্কে কংগ্রেসকে একটি কথাও না বলে ৯ই ডিসেম্বর (১৯৪৬) কেন্দ্রীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করলেন। তিনি অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ডেকে বললেন, ‘মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে অন্তর্বর্তী সরকারে লীগ সদস্যদের তিনি রাখতে পারবেন না। সংগে সংগেই লিয়াকত আলী খান বললেন, ভাইরসয় যখনই পদত্যাগপত্র দাবী করবেন, লীগ-সদস্যগণ তখনই পদত্যাগ করবে, কিন্তু লীগের শর্তপূরণ না হলে তারা গণপরিষদে যোগদান করবেন না”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৯৬।]
একদিকে রাজনৈতিক অবস্থা যখন এই, দেশব্যাপী সংঘাত সংঘর্ষের অবস্থা তখন ভয়াবহ। ভারতে বৃটিশ কমাণ্ডার স্যার ফ্রান্সিস টুকারের মতে পাঞ্জাবে শিখ-মুসলিম হাঙ্গামা বাধলে সারা ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা তো ভেঙে পড়বেই, তদুপরি সর্বত্র একটা বিপর্যয়মূলক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। এই অবস্থায় লর্ড ওয়াভেল বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেটকে জানালেন, “পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকাশ্য গৃহযুদ্ধ অতি সন্নিকটে”।–[‘Transfer of Power in India’, V.P. Menon, page 314]
ভাইসরয়ের এই বার্তা যাওয়ার পর সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলী বৃটেনে একটা আলোচনা বৈঠক আহবান করলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন, প্রতিপক্ষের দু’জন করে প্রতিনিধি এ আলোচনা বৈঠকে যোগদান করবেন।
লণ্ডন যাওয়ার দাওয়াত পেলেন জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, নেহেরু এবং বলদেব সিং। নেহেরু যেতে অস্বীকার করলেন। যুক্তি দেখালেন, মুসলিম লীগের চাপে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা বাতিল অথবা পরিবর্তনের যে আলোচনা লণ্ডনে ডাকা হয়েছে, সে আলোচনায় কোন লাভ হবে না।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 176.] বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ এটলী নেহেরুর কাছে একটা ব্যক্তিগত পত্র লিখে অনুরোধ করলেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের পূর্ণ বাস্তবায়নই তার লক্ষ্য, পরিকল্পিত গণপরিষদকে সফল করার কাজে নেহেরু যেন তাঁকে সুযোগ দেন।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 176. ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৯৮।] নেহেরু রাজী হলেন লণ্ডন যাবার জন্যে। বিষয়টা জিন্নার নজর এড়াল না। তিনি লণ্ডন যেতে অস্বীকার করলেন এবং এটলী ও নেহেরুর মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয়েছে তার কপি দাবী করলেন, কপি জিন্নাহকে দেয়া হলো এবং সেই সাথে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলী জিন্নাহকে লণ্ডন আসার জন্যে ব্যক্তিগত অনুরোধ করে চিঠি লিখলেন। জিন্নাহ রাজী হলেন এরপর।
লক্ষণীয় যে, কংগ্রেসের প্রতি দুর্বল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নেহেরুর বিশেষ মর্যাদা আদায় এবং আগাম দরকষাকষির প্রতিশোধ হিসেবেই জিন্নাহ লণ্ডন যেতে ঐভাবে অস্বীকার করেছিলেন। ঐ সংকট সন্ধিক্ষণে এর প্রয়োজন ছিল। এটলী এর ফলে আবার বুঝলেন, জিন্নাহ নেহেরুর সমান প্রতিপক্ষ। এ মর্যাদা আদায় করেই জিন্নাহ লণ্ডন গেলেন।
লণ্ডনে আলোচনা শুরু হলো ২রা ডিসেম্বর (১৯৪৬)। জিন্নাহ, নেহেরু, লিয়াকত আলী খান ও বলদেব সিং আলোচনায় বসলেন, বৃটিশ প্রধান মন্ত্রীসভার সাথে। আলোচনা চলল চারদিন ধরে। আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের প্রদেশগুলোর সেকশন বা গ্রুপ এবং একক প্রদেশগুলোর ক্ষমতা ও অধিকার। এ ব্যাপারে ক্যাবিনেট মিশনের ব্যাখ্যার সাথে মুসলিম লীগ একমত ছিল, কিন্তু শুরু থেকেই কংগ্রেস এর মনগড়া একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছিল যা ছিল তার জন্যে সুবিধাজনক এবং ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের উদ্দেশ্যের খেলাফ। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং আইনসভা ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যাখ্যাই গ্রহণ করল। ৬ ডিসেম্বর তারিখে বৃটিশ মন্ত্রীসভা আলোচনা শেষে তাদের ঘোষণা প্রকাশ করল। বলা হলোঃ “(১) ক্যাবিনেট মিশন বরাবর এই মত পোষণ করে এসেছে যে, সমঝোতা না হলে সেকশনের প্রতিনিধিদলের কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দ্বারা সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। মুসলিম লীগ এই মত গ্রহণ করেছে, কিন্তু কংগ্রেস ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। (২) বৃটিশ সরকার আইনগত পরামর্শ নিয়েছেন এবং সেটা হচ্ছে এই যে, ক্যাবিনেট মিশনের মতই ঠিক। এ অংশটি ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে তারিখের বিবৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণপরিষদের সকল দলের এই মত স্বীকার ও গ্রহণ করা উচিত। (৩) ক্যাবিনেট মিশনের বিবৃতির অন্য কোন বিষয় সম্পর্কে মতানৈক্য উপস্থিত হলে তৎসম্পর্কে যে কোন পক্ষ ফেডারেল কোর্টের বিচার দাবী করতে পারে এবং গণপরিষদ ফেডারেল কোর্টের রায় স্বীকার করবে। (৪) বৃটিশ সরকার আশা করেন যে, কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের মত গ্রহণ করবে। (৫) যদি গণপরিষদ এমন শাসনতন্ত্র তৈরী করে যাতে ভারতের জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল না, সেক্ষেত্রে বৃটিশ সরকার দেশের অনিচ্ছুক অংশ সমূহের উপর তা বলপূর্বক চাপিয়ে দিতে পারবে না”।–[‘Transfer of Power in India’, V.P Menon, page 329-330. (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৯৯।)]
বৃটিশ মন্ত্রীসভায় এ ঘোষণা প্রকাশের সময় জিন্নাহ, নেহেরু, লিয়াকত আলী ও বলদেব সিংকে এক সাথে ডাকা হলো। জিন্নাহ সম্পূর্ণটাই গ্রহণ করলেন, শুধু ব্যাখ্যা দাবী করলেন যে, বিতর্কমূলক বিষয়ে ফেডারেল কোর্টের রায় যদি ক্যাবিনেট মিশনের বিরোধী হয়, তাহলে কি হবে? নেহেরুসহ সকলের উপস্থিতিতেই বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেট এর জবাবে বললেন, সে অবস্থায় সমগ্র পরিস্থিতি নতুনভাবে পুনর্বিবেচনা করা হবে।–[‘Transfer of Power in India’, V.P Menon, page 329-330. (উদ্ধৃতঃ ‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৭৯৯।)] নেহেরু এবং বলদেব সিং দু’জনেই বৃটিশ সরকারের এই ঘোষণার সাথে দ্বিমত করলেন। এইভাবে লণ্ডন আলোচনা ব্যর্থ হলো। আলোচনা শুধু ব্যর্থ করা নয়, নেহেরু বৃটিশ সরকারকে হুমকি দিলেন, ‘ভারত অন্য কারুর কাছ থেকে কোন পরামর্শ-উপদেশ গ্রহণ করতে চায় না। কারণ, নতুন ভারত জন্মগ্রহণ করেছে”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৪৩।]
লণ্ডন ঘোষণার কোন তোয়াক্কা না করে, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ না করেই নেহেরু ৯ই ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশন বসালেন। মুসলিম লীগ গণপরিষদ বয়কট করল। লণ্ডন বৈঠকের ১৫ দিন পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এবং ৬ই জানুয়ারী (১৯৪৭) কংগ্রেস কাউন্সিল এক দীর্ঘ প্রস্তাবে একদিকে ক্যাবিনেট মিশন সংক্রান্ত লণ্ডন ঘোষণা গ্রহণ করল, অন্য দিক দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করল। প্রস্তাবের একজায়গায় বলল, “উদ্ভূত অসুবিধা দূর করার জন্যে কংগ্রেস প্রদেশগুলোর গ্রুপ সম্পর্কে বৃটিশ সরকারকে লণ্ডন ঘোষণার ব্যাখ্যা অনুসারেকাজ করতে সম্মত”। এরপরেই আবার বলল, “যা হোক, এটা অবশ্যই পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে যে, “এই সম্মতি অবশ্যই কোন প্রদেশকে বাধ্য করার ক্ষেত্রে কার্যকরী হবে না”।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 177-78] এর অর্থ কংগ্রেস কার্যতই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান মেনে নিল না। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের এই প্রস্তাবকে শঠতা বলে অভিহিত করলো।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৪৩।] এবং ২৯শে জানুয়ারী মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তার করাচী সম্মেলনে বলল যে, ‘কংগ্রেস যেহেতু ক্যাবিনেট মিশন ও লণ্ডন ঘোষণা অনুযায়ী প্রদেশ সমূহের গ্রুপ ব্যবস্থা মেনে নেয়নি এবং যেহেতু কংগ্রেস বা শিখ কিংবা তফসিলী হিন্দু সম্প্রদায় কেউই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করেনি, তাই লীগ কাউন্সিল ডেকে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান নতুন করে গ্রহণের আর প্রয়োজন নেই। এই অবস্থায় বৃটিশ সরকার প্ল্যানটিকে বাতিল ঘোষণা করা এবং কেন্দ্রীয় গণপরিষদ বাতিল করে দেয়া।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 178]
মুসলিম লীগের এই প্রস্তাবে ক্রোধে ফেটে পড়ল। ৫ই ফেব্রুয়ারী কংগ্রেস সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকার থেকে মুসলিম লীগের বহিস্কার দাবী করে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের কাছে স্মারকলিপি পেশ করলেন। কি করবেন, এ নিয়ে মহা বিপদে তখন ওয়াভেল। তিনি লণ্ডনে বৃটিশ সেক্রেটারী অব স্টেটকে লিখলেন, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের গ্রুপ ব্যবস্থা কংগ্রেস যাতে প্রকাশ্যে ও সুস্পষ্টভাবে মেনে নেয়, তার ব্যবস্থা করুন।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 179] কিন্তু লণ্ডন কিছুই করতে পারল না। ১৩ই ফেব্রুয়ারী নেহেরু ওয়াভেলকে লিখলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের মুসলিম সদস্যদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যদি এ ব্যাপারে দেরী করা হয় বা অন্যায় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে কংগ্রেস সদস্যরা তাদের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করবে।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 179] এর দু’দিন পরে প্যাটেল প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, মুসলিম লীগ সদস্যরা যদি অন্তর্বর্তী সরকারে থাকে, তাহলে কংগ্রেস সদস্যরা পদত্যাগ করবে।–[‘The Great Divide’, S.V. Hudson, page 179] কিন্তু লর্ড ওয়াভেলের পক্ষে সরকার থেকে মুসলিম সদস্যদের বরখাস্ত করা তখন সম্ভব ছিল না। জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ তখন উপমহাদেশের মুসলমানদের অবিসংবাধিত প্রতিষ্ঠান। পাঞ্জাবে কংগ্রেস মিত্র খিজির হায়াতের ইউনিয়নিষ্ট পার্টির কারণে এবং সীমান্ত গান্ধী গাফফার খানের কংগ্রেসমুখিতার কারণে এই দুই প্রদেশে মুসলিম লীগের অসুবিধা ছিল, কিন্তু খিজির হায়াত মুসলিম লীগের সাথে আপোশ করতে বাধ্য হওয়ায় এবং সীমান্ত প্রদেশের মানুষ গাফফার খানকে পরিত্যাগ করায় এই অসুবিধা দূর হয়ে যায়। সীমান্ত প্রদেশে গিয়ে নেহেরু জনগণের বিক্ষোভ ও কালো পতাকা স্রোতে মিটিংও করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে নেহেরু নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আর কেন্দ্রীয় পরিষদে বা গণ পরিষদে মুসলিম লীগ না যাওয়ায় এই প্রদেশগুলি বলা যায় কার্যত বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিল। একদিকে এই অবস্থা, অন্যদিকে গোটা দেশ হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ সংঘাতের মুখোমুখি। কোলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকার সে সময়ের সম্পাদক আয়ান স্টিফেনের ভাষায়, “১৯৪৬ সালের হেমন্তের শেষ দিকে গাঙ্গেয় অঞ্চলের পূর্বাংশে বহুস্থানে চাপা গৃহযুদ্ধ চলছিল। নোয়াখালী অঞ্চল, বিহার ও যুক্ত প্রদেশের কোন কোন স্থানে। এই সময় ভারতে বহুসংখ্যক বেসরকারী সৈন্যবাহিনী গড়ে উঠেছিল। এরা প্রত্যেকে উত্তেজনা সৃষ্টি করতো। শহিদী সেনাদল, শহিদী জাঠা এবং মুসলমানদের ছিল মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড।–[‘Pakistan’, Lan Stephens, page 141.] ভারতের বৃটিশ কমাণ্ডার জেনারেল বলেছেন, বছরটির (১৯৪৭) জন্ম হলো যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে। ভারতের ব্যারোমিটার পাঞ্জাবে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে হিন্দু মহাসভা ও এর সংগ্রামী সংস্থা আরএসএস সংঘের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা। যুক্তপ্রদেশে এই দলটি অত্যন্ত শক্তি সঞ্চয় করেছিল। সেখানে তাদের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক।–[‘While Memory Serves’, Sir Francis Tucker, page 107, 203.] ১৯৪৭ সালের শুরুর দিকের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরেকজন রিচার্ড সাইমণ্ড লিখছেন, সারাদেশময় হিংস্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। চরম সংগ্রামের জন্যে বেসরকারী সৈন্য বাহিনীর প্রস্তুতি চলছে। সরকারী কর্মচারীদের তীক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িকতার জন্যে চরম বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজ উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। বৃটিশ সৈন্যদের আগে থেকেই দেশে ফিরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে এবং ভারতীয় সৈন্যদের মনোভাব অনিশ্চিত।–[‘Making of Pakistan’, R. Symonds’, page 70.] এই সার্বিক পরিস্থিতিতে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেসের দাবীতে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে লীগ সদস্যদের বহিস্কার করে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটাতে পারেন না। তিনি যেটা পারেন সেটা হলো বৃটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তিনি তাই করে চললেন।
২০শে ফেব্রুয়ারী (১৯৪৭) তারিখে মুখ খুললো বৃটিশ সরকার, প্যাটেলের আলটিমেটাম দেয়ার ঠিক পাঁচদিন পর। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলী বললেন, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে বৃটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। যদি এ সময়ের মধ্যে সকলের প্রতিনিধিত্ব সম্পন্ন গণপরিষদ একমত হয়ে শাসনতন্ত্র তৈরী করতে সম্মত না হয়, তাহলে উক্ত তারিখে একক কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট অথবা কোন কোন অঞ্চলে বর্তমান প্রাদেশিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় বৃটিশ সরকার বিবেচনা করবে। এই ঘোষণার সাথেই প্রধানমন্ত্রী এটলী ওয়াভেলের বদলে লর্ড ব্যাটেনকে ভারতের ভাইসরয় নিয়োগের কথা ঘোষণা করলেন।
এটলীর ঘোষণায় কংগ্রেস খুশী হলো। খুশী হওয়ার কারণ দুইটি, (১) বৃটিশের ভারত ছাড়ার নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া গেল, (২) নেহেরুর বন্ধু লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভাইসরয় হয়ে আসছেন। মাউন্ট ব্যাটেন ও নেহেরুর আলাপ-পরিচয় হয় সিংগাপুরে। লর্ড মাউণ্ট ব্যাটেন ভারতে এলেন ২২শে মার্চ এবং ভাইসরয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ২৪শে মার্চ, ১৯৪৭।
এটলী কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা এবং মাউন্ট ব্যাটেনের আগমন ভারতের রাজনীতিতে, বিশেষ করে কংগ্রেসের রাজনীতিতে যেন হঠাৎ করেই পরিবর্তন আনল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ৮ই মার্চের (১৯৪৭) সিদ্ধান্ত এরই একটা দৃষ্টান্ত। এই তারিখে কংগ্রেস তার প্রস্তাবে বলল, অন্তর্বর্তী সরকারকে সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ডোমিনিয়ন সরকারের পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। এই সাথে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ও তৎসংক্রান্ত বিরোধের বিষয় সম্পর্কে বৃটিশ সরকারের ৬ই ডিসেম্বর (১৯৪৬) ব্যাখ্যা গ্রহণ করল এবং মুসলিম লীগ সদস্যদের গণপরিষদে যোগদানের আহবান জানাল। আরও বলল, পাঞ্জাবকে দুই অংশে ভাগ করে দিতে হবে।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৮১৪; ‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৫৮]
কংগ্রেসের এই প্রস্তাবে উল্লেখযোগ্য দিক তিনটি। প্রথম, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই ডোমিনিয়ন সরকারের পূর্ণ ক্ষমতা দাবী; দ্বিতীয় ক্যাবিনেট মিশন সংক্রান্ত ৬ই ডিসেম্বরের লণ্ডন ঘোষণা কংগ্রেস কর্তৃক মেনে নেয়া এবং (৩) সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পাঞ্জাব বিভাগ দাবী।
প্রথমটি কংগ্রেসের পুরনো দাবী। দ্বিতীয় বিষয়টি এর পরিপূরক। ৬ই ডিসেম্বরের লণ্ডন ঘোষণা মেনে নিয়ে মুসলিম লীগকে খুশী করে তাকে সাথে নিয়ে, অথবা রাজী না হলে মুসলিম লীগকে দোষ দিয়ে ও তাকে বাদ দিয়ে ডোমিনিয়ন সরকার হাত করা লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাহায্যে, এই ছিল কংগ্রেসের কৌশল। বৃটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ঠিক করার ফলেই কংগ্রেস এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। এই কৌশল অনুসারে মুসলিম লীগ রাজী হলেও ক্ষতি নেই, একবার ক্ষমতা হাতে পেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুসলিম লীগকে দেখে নেয়া যাবে। আর যদি মুসলিম লীগ রাজি না হয়, তাহলে তো ষোল আনা লাভ। সেক্ষেত্রে সব দোষ মুসলিম লীগের উপর চাপানো যাবে এবং বৃটিশ সরকারের সাহায্য পাওয়া যাবে। এই কৌশলের অধীনে গান্ধী এমনকি জিন্নাহকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে। মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে প্রথম বৈঠকেই (৩১শে মার্চ) গান্ধী বলেছিলেন, “কংগ্রেস লীগের মধ্যে ঝগড়ার জন্যে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান করবার সবচাইতে উৎকৃষ্ট পন্থা হলো যে, ভাইসরয় জিন্নাহকে তার নিজস্ব এই সরকার সব মুসলমান কিংবা মুসলমান হিন্দু মিলিয়ে গঠন করতে পারেন। কংগ্রেস এই সরকারকে সমর্থন করবে অবশ্যি যদি জিন্নাহ প্রতিশ্রুতি দেন যে দেশবাসীর স্বার্থ তিনি রক্ষা করবেন”।–[‘জিন্নাহ ওলপোর্ট’, পৃষ্ঠা ৩১৬, ‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার’, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৪।] জিন্নাহ আসার আগেই অবশ্য গান্ধীর এ প্রস্তাব মাঝপথে বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো গান্ধীর রাতারাতি এ পরিবর্তন কেন? উত্তর খুব সহজ। জিন্নাহ প্রস্তাব গ্রহণ করলে তার ঘাড়ে চড়ে সর্বভারতীয় একটা ব্যবস্থার কছে বৃটিশকে ক্ষমতা হস্তান্তর করানো। আর যদি জিন্নাহ গ্রহণ না করে তাহলে কংগ্রেস এর সুযোগ গ্রহণ করবে। এ প্রস্তাবও গান্ধীর ঐ প্রস্তাবে ছিল। কংগ্রেস এসব করেছিল নেহেরুর বন্ধু নতুন ভাইসরয়কে চমৎকৃত করে, তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করার জন্যে। কংগ্রেসের ৮ই মার্চের প্রস্তাবটির তৃতীয় বিষয়টিই এখঅনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসের এটা একটা নতুন বিকল্প। সম্প্রদায় ভিত্তিক পাঞ্জাবের বিভক্তি দাবী করে “পরোক্ষ স্বীকার করে নেয়া হলো যে, যদি একটি প্রদেশকে ভাগ করে নেয়া সম্ভব হয় তাহলে দেশভাগ নীতি গ্রহণ করতে কোন আপত্তি থাকতে পারে না”।–[‘নেহেরু’, মাইকেল ব্রেসার, পৃষ্ঠা ৩৪৫; ‘দি লাস্ট ডেজ অব দি বৃটিশ রাজ’, লিউনার্ড মোসলে, পৃষ্ঠা ৯৮; ‘জিন্নাহ’, ওলপোর্ট, পৃষ্ঠা ৩১১।] এই আপত্তি যে নেই কংগ্রেসের এই প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, ‘মুসলমানরা যদি এই দেশ থেকে চলে যেতে চায় তাহলে কংগ্রেস এবং প্যাটেল কোন আপত্তি করবেন না। কিন্তু ভারতের সে সব প্রদেশ পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য করা যাবে না”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য (দে’জ পাবলিশিং হাউজ, কলিকাতা), পৃষ্ঠা ২৫৯।] এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তান কেমন হবে তার রূপরেখাও প্যাটেল সবার কাছে পরিস্কার করেছিলেন। কংগ্রেসের এ মিটিং এর পর প্যাটেল এই নীতিকে সুস্পষ্ট করে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির সদস্যদের কাছে লিখেছিলেন, “যদি লীগ পাকিস্তান চায় তাহলে সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হলো দেশ ভাগ করা। -পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা। —-আমি মনে করি না, বৃটিশ সরকার এই নীতি অনুযায়ী দেশ ভাগ করতে রাজী হবে। হয়তো পরে বুঝতে পারবে, দেশের শাসন ক্ষমতা দেশের সবচাইতে শক্তিশালী দলের কাছে তুলে দেয়াই বিবেচকের কাজ। যদি তারা বুঝতে না পারে ক্ষতি নেই। কারণ সমস্ত ভারতকে একটি শক্তিশালী (পূর্ববাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তানকে বাদ দিয়ে) কেন্দ্রের অধীনে গঠন করা হবে”।–[দি লাস্ট ডেস অব বৃটিশ রাজ’, লিওয়ার্ড মোসলে, পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯।] শুধু প্যাটেল নয়, “নেহেরু নিজেও এই যুক্তির সাথে একমত ছিলেন। —-পরে এই প্রস্তাব (প্যাটেলের প্রস্তাব) গ্রহণ করবার দিন ঠিক করা হয়”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৫৯।] যা ৮ই মার্চ কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির মিটিং এ পাশ হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, এটলীর ঘোষণার পর এবং মাউণ্ট ব্যাটেন ভারতে আসার পর কংগ্রেসের এই অভাবনীয় পরিবর্তন কেন? প্রধান কারণ হলো, পাঞ্জাবে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। ৫ই মার্চ (১৯৪৭) থেকে প্রায় দু’সপ্তাহ দাঙ্গা চলে পাঞ্জাবে। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর ভাষায়, “মুসলমানদের অপেক্ষা শিখেরা অনেক বেশী সংগঠিত ও অস্ত্রসজ্জিত। কিছু কাল যাবত তারা এজন্যে তৈরী হচ্ছিল”-[‘Hindustan Times’, March 5, 1947] ৪ঠা মার্চ শিখ নেতা তারা সিং হুংকার দেন, “আমাদের মাতৃভূমি আজ রক্ত চাচ্ছে, আমরা রক্ত দিয়ে আমাদের মায়ের তৃষ্ণা মেটাবো। আমরা মুগলিস্তান ধ্বংস করেছিলাম, এবার পাকিস্তান পদদলিত করবো। …..আমি আকালী বাহিনী পুনঃসংগঠিত করতে শুরু করেছি। আমি শিঙা বাজিয়েছি, মুসলিম লীগকে খতম কর”।–[Muslim League Yesterday and Today; A.B Rajput, (বিস্তারিত বিবরণ ১৬৫-১৭৬)।] এই তারিখেই আর একজন শিখ নেতা চৌধুরী লেহারী সিং বলেছিলেন, “আমি জাঠ। জাঠরা বেশী কথা বলে না। মুসলিম শাসন খতম করার জন্যেই জাঠরা শিখধর্ম গ্রহণ করেছিল। সেই জাঠরা এবারও প্রাণ দিয়ে লড়াই করবে”।–[Muslim League Yesterday and Today; A.B Rajput, (বিস্তারিত বিবরণ ১৬৫-১৭৬)।] হিন্দু ও শিখদের এই প্রস্তুতির উপর ভরসা করে কংগ্রেস সম্ভবত মনে করেছিলো, শক্তির দ্বারা যদি পাঞ্জাবে পাকিস্তানের কবর দেয়া যায়, তাহলে জিন্নাহকে কাবু করা যাবে। কিন্তু কংগ্রেসের এ সাধ পূরণ হয়নি। পেণ্ডেলের মুন এর ভাষায়, “বাহাদুরি দেখানোর ফল সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছিলো। সমগ্র প্রদেশে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাংগা আরম্ভ হয় এবং তাতে হিন্দু ও শিখদের অনেক বেশী ক্ষতি হয়”।–[‘Divide and Quit’, Penderel Moon.] যার ফলে মুসলিম লীগকে উৎখাত করতে গিয়ে কংগ্রেসেরই পাঞ্জাব থেকে উৎখাত হবার যোগাড় হলো। অন্যান্য মুসলিম প্রদেশেও কংগ্রেসের জন্যে এই পরিণতি অপেক্ষা করছে, একথা কংগ্রেস বুঝল। এই উপলব্ধি থেকেই কংগ্রেসের পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের প্রস্তাব। চৌধুরী খালিকুজ্জামান লিখলেন, “লাহোর ও অমৃতসরে শিখদের পরাজয়ে কংগ্রেসী মহল অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন এবং ৮ই মার্চ (১৯৪৭) তারিখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের প্রস্তাব গৃহীত হয়”।–[‘Pathway to Pakistan’, Khaliquzzaman.]
উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থতাই নেহেরু ও প্যাটেলের মত নেতাদেরকে বাস্তবতা মেনে নেয়ার দিকে ঠেলে দেয়। এর আরেকটা কারণ, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কর্তক ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ঘোষণা কংগ্রেস নেতাদের পাগল করে তুলেছিল ক্ষমতা নামক সোনার হরিণ হাত করার জন্যে। এই ক্ষশতা যদি অখণ্ড ভারতে না হয়, তাহলে খণ্ডিত ভারতে হলেও অবিলম্বে লাভ করতে হবে। ভি, পি, মেননের এক মন্তব্যেও এর সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে। তিনি প্যাটেলকে বলেছিলেন, ‘ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী অবিভক্ত ভারত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তৎপরিবর্তে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্র গঠন করে ভারত বিভাগ করাই যুক্তিযুক্ত। ডোমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে এই দুই রাষ্ট্রের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরিত হতে পারে। প্যাটেল তাকে নিশ্চয়তা দেন যে, যদি ডোমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়, তাহলে তিনি (প্যাটেল) এই প্রস্তাব গ্রহণের জন্যে কংগ্রেসের উপর প্রভাব বিস্তার করবেন’।–[‘Transfer of Power in India’, V.P Menon, Page 358-359] এই প্রভাবের ফল কংগ্রেসের প্রস্তাব। কংগ্রেসের এই মানসিকতার সাথে মাউন্ট ব্যাটনের চিন্তা মিলে গিয়েছিল। মাউন্ট ব্যাটেন ভারতে আসার পর সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং “বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে —আলাপ-আলোচনা করার পর মাউন্ট ব্যাটেন বুঝতে পারলেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের প্ল্যান কাঠামোর ভেতর সব দলের সম্মতি নিয়ে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। অতএব সমস্যা সমাধান করবার জন্যে অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। আর অন্য পথ হল দেশ ভাগ ও পাকিস্তান গঠন করা”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৫৮।] উভয় পক্ষের মতের এই মিলন আরও সহজ হয়েছিল নেহেরু ও কংগ্রেসের সাথে মাউন্ট ব্যাটেনের গভীর সম্পর্কের কারণে। “নেহেরু এবং কংগ্রেস নেতারা প্রথম থেকেই মাউন্ট ব্যাটেনের গভীর সম্পর্কের কারণে। “নেহেরু এবং কংগ্রেস নেতারা প্রথম থেকেই মাউন্ট ব্যাটেনকে তাদের বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত করলেন। এবং নেহেরু হলেন মাউন্ট ব্যাটেনের দরবারে কংগ্রেসের মুখমাত্র”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৫২।]
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে এই সম্পর্ক ও নির্ভরতার কারণেই মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নাহকে এড়িয়ে চললেন। জিন্নার সাথে প্রথম দিনের আলোচনাতেই তিনি বুঝেছিলেন তার কাছ থেকে কিছুই আদায় করা যাবে না। প্রথম দিন দুই দফা বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু একদফা বৈঠক করেই মাউন্ট ব্যাটেন তাঁর এডিসি’কে বলেছিলেনঃ “উঃ লোকটি একেবারে হিমশীতল, আজই আর একদফা আলোচনা আমি চালাতে পারবোনা”।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৮২৭।] আলোচনার তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়।
মাউন্ট ব্যাটেন ভারতে আসার দু’সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর এবং কার্যত দেশ বিভাগের পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোলেন। তার পরিকল্পনার বিষয় কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলাপ করেছেন, কিন্তু জিন্নার কাছে গোপন রেখেছেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়াতেই মাউন্ট ব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা পরিকল্পনা তৈরী করলেন। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রদেশগুলোর, অথবা যে সকল প্রদেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গ্রুপ গঠন করবে, তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এই পরিকল্পনায় বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের কথাও ছিল। ১৫ ও ১৬ই এপ্রিল ভারতে প্রাদেশিক গভর্ণরদের সম্মেলনে মাউন্ট ব্যাটেনের এ পরিকল্পনা আলোচিত হলো এবং তাদের সম্মতি লাভ করল। ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারত বিভাগের এ পরিকল্পনা নিয়ে মাউন্ট ব্যাটেনের পক্ষ থেকে লর্ড ইসমে ২রা মে তারিখে লণ্ডন গেলেন বৃটিশ সরকারের অনুমোদন লাভের জন্যে। ‘উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ইচ্ছা করলে এককভাবে স্বাধীন থাকতে পারবে’ –এই সংশোধনী যোগ করে বৃটিশ ক্যাবিনেট এ পরিকল্পনা মঞ্জুর করল। ১০ই মে গৃহীত এ পরিকল্পনা নিয়ে ফিরে এলেন ভারতে। এ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্যে মাউন্ট ব্যাটেন ১৭ই মে ভারতীয় নেতাদের বৈঠক করলেন সিমলায়। মে’র প্রথম সপ্তাহেই মাউন্ট ব্যাটেন পরিবারসহ চলে গেলেন সিমলায় এবং অতিথি হিসেবে নিয়ে গেলেন নেহেরু ও কৃষ্ণ মেননকে। লক্ষ্য ছিল ভারতীয় নেতাদের কাছে পরিকল্পনাটি পেশ করার আগেই মাউন্ট ব্যাটেন নেহেরুকে তা দেখাবেন। তাই হলো। কিন্তু নেহেরু ঐ পরিকল্পনায় যেভাবে ভাগ করা হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করলেন। নেহেরু প্রত্যাখ্যান করার পর মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনাটি বাতিল করে দিলেন। লক্ষণীয় যে, লীগ প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ জানার আগেই পরিকল্পনাটি বাতিল হয়ে গেল। জিন্নার সাথে এ নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করলেন না মাউন্ট ব্যাটেন। মতলব হলো, সব ঠিক ঠাক করে তা জিন্নার উপর চাপিয়ে দেবেন।
মাউন্ট ব্যাটেনের প্ল্যান এভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবার পর কৃষ্ণ মেননের তৈরী ভারত বিভাগের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। উল্লেখ্য, এই প্ল্যানটি কৃষ্ণ মেননের ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরের দিকে তৈরী করেছিলেন। এ প্ল্যান নিয়ে কৃষ্ণ মেনন বল্লভ ভাই প্যাটেলের সাথে দীর্ঘ আলোচনাও করেছিলেন। এ প্ল্যানের সাথে প্যাটেল একমত হয়েছিলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৭৮।] আটই মার্চ (১৯৪৭) কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব করে কার্যত যে দেশ বিভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটা প্যাটেলের এই স্বীকৃতিরই একটা ফল। পরে কৃষ্ণ মেনন তার পরিকল্পনার সারাংশ মাউন্ট ব্যাটেনকেও জানিয়েছিলেন। মাউন্ট ব্যাটেনের পরিকল্পনা যখন ব্যর্থ হলো তখন মাউন্ট ব্যাটেনের কৃষ্ণ মেননে স্মরণ করলেন এবং তার সাথে তার প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করলেন। এরপর কৃষ্ণ মেননকে এ নিয়ে আলোচনা করলেন নেহেরুর সাথে। কৃষ্ণ মেননের আলোচনার পর মাউন্ট ব্যাটেন কৃষ্ণ মেননের প্রণীত প্ল্যান নিয়ে আলোচনায় বসলে নেহেরুর সাথে। মাউন্ট ব্যাটেন নেহেরুকে বললেন যে, কৃষ্ণ মেননের প্ল্যান অনুযায়ী উল্লেখিত “ডোমিনিয়ন স্টেটাসের প্রস্তাবানুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি (প্রদেশ নয়) ভারত থেকে আলাদা করা হবে। তারপর ক্ষমতা দুইটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, একটি ‘হিন্দুস্তান’ এবং অপরটি ‘পাকিস্তান’-এর হাতে তুলে দেয়া হবে। দুইটি দেশের পৃথক গভর্ণর জেনারেল থাকবে। দুইটি দেশের সাংবিধানিক সংসদ দ্বারা রচনা না করা পর্যন্ত দুই ডোমিনিয়ন সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনের কাঠামোয় তৈরী করা হবে। এই পন্থানুযায়ী কংগ্রেস ক্ষমতা হস্তান্তর প্রস্তাব গ্রহণ করতে যদি রাজী থাকে, তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার জন্যে ১লা জুন, ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত দেরী করতে হবে না। এই প্রস্তাবে সবুজ সংকেত দেবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা সম্ভব হবে”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৭৯, ২৮০।]
নেহেরু ভারত বিভাগের ব্যাপারে কোন আপত্তি তুলবেন না। প্রশ্ন তুললেন ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’ শব্দ সম্পর্কে। বললেন, ‘যদিও আমি স্বীকার করি ডোমিনিয়ন স্টেটাস পূর্ণ স্বাধীনতার সমান, কিন্তু তবু জনগণ এই সূক্ষ্ম পার্থক্য, বিভেদ বুঝতে পারবে না”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, ‘দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৮০।] উত্তরে মাউন্ট ব্যাটেন বললেন, “প্রয়োজন হলে ‘রাজার’ পদবী থেকে ‘সম্রাট’ শব্দটি বাদ দেয়া হবে”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, ‘দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৮০।] উত্তরে নেহেরু বললেন, “অবশ্যি এই ডোমিনিয়ন স্টেটাস প্রস্তাব অনুযায়ী যে কোন সময়ে ভারত কমনওয়েলথের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, ‘দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৮০।] মাউন্ট ব্যাটেন নেহেরুর এই কথার সাথে একমত হলেন। এই আলোচনার ভিত্তিতেই ১১ই মে (১৯৪৭) নেহেরু এবং প্যাটেল আলোচনা করে স্থির করলেন যে, ডোমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে এই দেশে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে।–[‘দি লাস্ট অব দি বৃটিশ রাজ’, লিওয়ার্ড মোসলে, পৃষ্ঠা ১২০, ‘মাউন্ট ফিলিপ জিগলার, পৃষ্ঠা ৩৮৩]
এই স্বীকৃতি বিষয়ে মাউন্ট ব্যাটেন নেহেরুর সাথে আলোচনা করার পর আনন্দে আটখানা হয়ে সংগে সংগেই দিল্লীতে টেলিগ্রাম করে তার স্টাফ প্রধান লর্ড ইসমেকে জানালেন, ‘ডোমিয়িন স্টেটাসের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের কাছে নির্দিষ্ট তারিখের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা সম্ভব হবে’।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৮১।]
নেহেরু অনুমোদিত ভারত বিভাগের এ পরিকল্পনা নিয়ে মাউন্ট ব্যাটেন ১৮ই মে, ১৯৪৭ লণ্ডন গেলেন। বৃটিশ ক্যাবিনেটে এ নিয়ে আলোচনা হলো এবং পরিকল্পনাটি গৃহীত হলো।
উল্লেখ্য, মাউন্ট ব্যাটেন লণ্ডন যাওয়ার পূর্বক্ষণে পরিকল্পনাটির সার সংক্ষেপ জিন্নাহকে দেখিয়েছিলেন। নেহেরু লিখিত পত্র দ্বারা এ পরিকল্পনার প্রতি স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন। মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নার কাছেও এটা চাইলেন। জিন্নাহ পরিকল্পনার প্রতি মৌখিকভাবে নীতিগত সমর্থন দান করলেন, কিন্তু পরিকল্পনাটি পুরোপুরি না দেখে লিখিত দিতে অস্বীকার করলেন। মাউন্ট ব্যাটেন ভয় দেখালেন যে, জিন্নাহ যদি এই পরিকল্পনা গ্রহণ না করেন, তাহলে ডোমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে একটি কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে’। সংগে সংগেই জিন্নাহ তার অকল্পিত জবাবে বললেন, ‘যা হবার তাই হবে’। ‘মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নার এই জবাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু জিন্নার যুক্তি ছিল যে, তাকে সমগ্র পরিকল্পনা দেখানো হয়নি, দেখানো হয়েছিল ৮ দফা Leads of Agreements যা দেখে তিনি পরিকল্পনাটি লিখিতভাবে গ্রহণ করার দায়িত্ব নিতে পারেন না। তাছাড়া মাউন্ট ব্যাটেন নেহেরু ও কংগ্রেস নেতাদের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে সব কাজ করায় এবং মুসলিম লীগকে দূরে রাখার জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ মাউন্ট ব্যাটেন উপর আস্থা হারিয়েছিলেন।
জিন্নাহ যখন মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনাকে লিখিত মেনে নিতে রাজী হলেন না, সেই সময় কংগ্রেস ভারত ভাগ করে ক্ষমতা গ্রহণের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। নেহেরু শুধু লিখিত প্ল্যানটি মেনেই নিলেন না, ১৮ই মে মাউন্ট ব্যাটেন লণ্ডন যাবার পর ২১ শে মে তারিখেই কৃষ্ণ মেননকে লণ্ডন পাঠালেন এই বার্তা দিয়ে যে, মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ কংগ্রেস মেনে নিয়েছে, কিন্তু শর্ত হলো ১৯৪৭ সালেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
প্রশ্ন হলো কংগ্রেসের এই তাড়াহুড়া কেন? অনেকের মতে তারা তাড়াহুড়া করেছে দুইটি কারণে,-[কৃষ্ণ মেনন মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে লেখা ২১শে মে’র চিঠিতে একথা বলেন। দ্রষ্টব্যঃ ‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, পৃষ্ঠা ২৮৩।] (১) দেরী করলে বাংলা ও পাঞ্জাবে বিভাগ করা কঠিন হবে (২) বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের মাধ্যমে যদি মুসলিম লীগকে পাকিস্তান দেয়া যায়, তাহলে সে পাকিস্তান টিকবেনা এবং আবার তা আসবে কংগ্রেসের কবলে। “নেহেরু ও কংগ্রেসের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে পাকিস্তান হবে ক্ষণস্থায়ী। কারণ নেহেরু ও কংগ্রেস নেতারা ভেবেছিলেন রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক দুর্বলতার কারণ বশতঃ পাকিস্তান জীবিত থাকতে পারবে না”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা (ভূমিকা)] এমনকি কংগ্রেসের প্রস্তাবেও তাদের এ মানসিকতার প্রমাণ মিলে। কংগ্রেসের একটা প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, When Passion have cooled, a new and stronger unity based on goodwill and co-operation will emerge.”-[কংগ্রেস বুলেটিন, ৪ নম্বর ১০ই জুলাই, ১৯৪৭, পৃষ্ঠা ১১ (দ্রষ্টব্যঃ ‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, পৃষ্ঠা x)] অর্থাৎ আবেগ যখন ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তখন শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে একটা নতুন ও অধিকতর শক্তিশালী সম্মিলনী গড়ে উঠবে’। মাউন্ট ব্যাটেন লণ্ডন গিয়েও তার ভারত বিভাগ পরিকল্পনার প্রতি জিন্নাহর আপত্তির কথা তুলেছিলেন, বিশেষ করে চার্চিলের সাথে আলোচনা কালে। বলেছিলেন, “নেহেরু ডোমিয়িন স্টেটাস গ্রহণ করতে রাজী আছে, কিন্তু জিন্নার আপত্তি আছে”। এর পরিপ্রেক্ষিতেই চার্চিল জিন্নার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যাতে বলেছিলেন, ‘এই ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারটি পাকিস্তানের জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন, অতএব এ প্রস্তাব আপতি গ্রহণ করুন”।–[‘মাউন্ট ব্যাটেন’, জিগলার, পৃষ্ঠা ৩৮৫।]
ভারত বিভাগ পরিকল্পনায় বৃটিশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে মাউন্ট ব্যাটেন ৩১শে মে ১৯৪৭ ভারত ফিরে এলে। ২রা জুন তারিখে মাউন্ট ব্যাটেন মুসলিম লীগের জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, সরদার আব্দুর রব নিশতার এবং কংগ্রেসের নেহেরু, প্যাটেল, কৃপালিনী ও বলদেব সিং –এই সাত নেতাকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে বিভাগের পরিকল্পনা পেশ করলেন। তাদের সবাইকে পরিকল্পনার কপি দিয়ে রাত ১২ টার মধ্যে ওয়ার্কিং কমিটির সম্মতিসহ চূড়ান্ত জবাব চাইলেন। তিনি জানালেন, পরদিন (৩রা জুন) সন্ধ্যায় তিনি এক বেতার ভাষণের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের সংবাদ সারা বিশ্বকে জানাতে চান। মিঃ জিন্নাহ ও নেহেরু তার পরেই বেতার বক্তৃতা দেবেন। নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত আইন পার্লামেন্টের বর্তমান অধিবেশনেই পেশ করতে হবে এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তর হবে’। তখন বেলা দশটা। নেহেরু মাউন্ট ব্যাটেনকে বললেন, সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত না হলেও কংগ্রেস পরিকল্পনাটি গ্রহণ করছে। বিকেলে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মত ভাইসরয়কে তিনি লিখিতভাবে জানিয়ে যাবেন।–[‘কায়েদে আযম’, আকবর উদ্দীন, পৃষ্ঠা ৮৩৩।] আর জিন্নাহ বললেন যে, তিনি লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সাথে আলোচনার পর রাত ১১টার সময় এসে জবাব দেবেন।
মিটিং শেষে মাউন্ট ব্যাটেন মিঃ জিন্নাহকে ডেকে নিয়ে একান্তে বললেন, আমরাকোন নেতিবাচক জবাব শুনতে চাই না। মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নাহকে চার্চিলের বার্তার কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ২৮৮।]
সেদিন (২রা জুন) বিকেলেই নেহেরু ও বলদেব সিং কংগ্রেস ও শিখদের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে ভারত বিভাগ পরিকল্পনার প্রতি সম্মতি জানিয়ে গেলেন। রাত এগারটায় জিন্নাহ এসে মাউন্ট ব্যাটেনকে লীগ ওয়ার্কিং কমিটি প্রদেশ (বাংলা ও পাঞ্জাব) বিভাগের বিরোধী একথা জানালেন এবং বললেন, এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব লীগ কাউন্সিলের। লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের জন্যে সাত দিন সময় প্রয়োজন। মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নাহকে বললেন, ইতিমধ্যেই কংগ্রেস ও শিখদের কাছ থেকে সম্মতি পেয়েছি। লীগ এই প্রস্তাব গ্রহণ করে কিনা? আপনি নিজে গ্রহণ করবেন কিনা? জিন্নাহ জবাবে বললেন যে, লীগ যাতে এই প্রস্তাবে সম্মত হয় সে চেষ্টা তিনি করবেন’। মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে একথা বলতে পারি যে, এ প্রস্তাবে আপনার সম্মতি আছে? জিন্নাহ হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন।–[‘জিন্নাহ’, ওলপোর্ট, পৃষ্ঠা ৩২৭, ‘দি লাস্ট ডেজ অব দি বৃটিশ রাজ’, লিউনার্ড মোসলে, পৃষ্ঠা ১৩১।] লক্ষনীয় যে, মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নার কাছ থেকে এ হ্যাঁ সূচক জবাব আদায় করে নিলেন।
একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো। সেটা হলো ভারতীয় ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে কংগ্রেসের রাজনীতিতে গান্ধীর অনুপস্থিতি। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে প্রথম দেখার পর থেকেই গান্ধী দিল্লীর বাইরে বিহার ও বিভিন্নস্থানে অবস্থান করছিলেন। এই ভারত বিভাগ ব্যাপারে তাঁর মত কি ছিল? মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে তাঁর আলোচনার সারকথা কিছুই ছিল না। মে (১৯৪৭) সালের প্রথম সপ্তাহে নেহেরু ও কৃষ্ণ মেনন যখন সিমলায় মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে ভারত বিভাগের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, সে সময় ৬ই মে তারিখে জিন্নাহ ও গান্ধীর মধ্যে একটা আলোচনা হয়। সে আলোচনায় গান্ধী ভারত বিভাগের বিরোধিতা করেন, কিন্তু কিছু করার জন্যে গান্ধী কোন সক্রিয়তা দেখাননি। অথচ তাঁর অজানা ছিল না যে, নেহেরু, প্যাটেল ও কৃষ্ণ মেননরা কি করছেন। জিন্নার সাথে আলোচনা শেষে গান্ধী ফিরে গেলেন আবার বিহারে। তারপর মাউন্ট ব্যাটেন ভারত বিভাগের সবকিছু পাকাপোক্তা করে লণ্ডন থেকে ফিরে এলেন ৩১শে মে, ১৯৪৭ তারিখে, সেই ৩১ মে গান্ধী দিল্লীতে আবির্ভূত হলেন এবং এক প্রার্থনা সভা আহবান করে বললেন, ‘এমনকি গোটা ভঅরত যদি পুড়ে যায়, মুসলমানরা যদি তরবারির সাহায্য নেয়, তবু পাকিস্তান দেব না’। কিন্তু এই অর্থহীন জ্বলে উঠার পরেই তিনি আবার নিভতে শুরু করলেন। ৪ঠা জুন বললেন, ‘ভারত বিভাগ বৃটিশের কোন ত্রুটি নয়, এটা হিন্দু-মুসলিম সমঝোতার ব্যর্থতা’। আর ৭ই জুনের মধ্যে গান্ধী এই পরিমাণ বদলে গেলেন যে, ৭ই জুন তারিখে গান্ধী কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিভাগ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বললেন।–[‘Pakistan’, Lan Stephens, page 206; ‘নেহেরু’, ব্রেসার, পৃষ্ঠা ৩৪৭; ‘মাউন্ট ব্যাটেন’, জিগলার, পৃষ্ঠা ৩৮৯।] অভাবনীয় দ্রুত গান্ধীর এই পরিবর্তন কেন? আসলে গান্ধীর মূল চাওয়া কি ছিল? পরিস্কার জবাব এটাই যে, নেহেরুর সাথে গান্ধীর মতের কোন পার্থক্য ছিল না। তাদের মধ্যে পার্থক্য এটুকুই ছিল যে, নেহেরু দেশ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু গান্ধী পরিকল্পনা অনুসারেই তা গ্রহণ করতে চাননি। চাননি বলেই তিনি এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দিল্লী থেকে বাইরে ছিলেন এবং নেহেরুকে সুযোগ দিয়েছিলেন। “তিনি জানতেন, যদি তিনি দিল্লীতে সরজমিনে উপস্থিত থাকেন তাহলে কংগ্রেসের দেশ ভাগের প্রস্তাবের বিরোধিতা তাঁকে করতে হবে। হয়ত তিনি এ বিরোধিতা করতে চাননি”।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২১৫।]
প্রশ্ন হলো, যে গান্ধী, যে নেহেরু এবং যে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনে উল্লেখিত মুসলমানদের দাবী প্রদেশগুলোর গ্রুপ ব্যবস্থা মেনে নিল না। কেন্দ্র দুর্বল হবে, ভারত দুর্বল হবে, ভারতে অখণ্ডতা নষ্ট হবে –এই অজুহাতে, সেই গান্ধী, সেই নেহেরু এবং সেই কংগ্রেস মাউন্ট ব্যাটেন প্ল্যানে ভারত বিভাগে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল কেন? অথচ ভারতের দাবীদার কংগ্রেস মুসলমানদের সর্বনিম্ন দাবী প্রদেশ সমূহের গ্রুপ মেনে নিয়ে ভারতকে অখণ্ড রাখতে পারতো। কংগ্রেসের এই ভূমিকাকে বিস্ময়কর ডিগবাজি বলে মনে হলেও কংগ্রেস কিন্তু তার পলিসির ব্যতিক্রম কিছু করেনি। সমগ্র ভারত, তা না হলে ভারতের সর্বাধিক অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছিল কংগ্রেসের লক্ষ্য। কিন্তু ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের গ্রুপ ব্যবস্থা মেনে নিলে কলিকাতাসহ গোটা বাংলা, আসাম এবং গোটা পাঞ্জাবসহ গোটা পাঞ্জাবসহ গোটা পশ্চিম ভারত মুসলমানদের অধিকারে চলে যেত এবং মুসলমানরা লাভবান হতো, শক্তিশালী হতো ও তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকে যেত। এতে ভারতের অখণ্ডতা থাকতো বটে, কিন্তু হিন্দুরা ভূখণ্ডগত দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হতো এবং পাকিস্তান বড় ও শক্তিশালী হওয়ার ভবিষ্যতে এই ক্ষতিপূররেন আর কোন পথ থাকতো না। অন্যদিকে মাউন্ট ব্যাটেন প্ল্যান গ্রহণ করায় ভারত ভাগ হলো বটে, কিন্তু পাকিস্তান হলো খণ্ডিত এবং হিন্দুরা ভারতের সর্বাধিক সম্ভব ভূখণ্ড লাভ করল। খণ্ডিত এই পাকিস্তান দুর্বল হবে এবং শীঘ্রই ভেঙে পড়বে, তার ফলে সমগ্র ভারতকে আবার কজ্বায় আনা কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব হবে, এটা ছিল কংগ্রেসের দৃঢ় ধারণা। শুধু ধারণা নয়, এ আশা নেহেরু ব্যক্তও করেছিলেন। ৩রা জুন (১৯৪৭) মাউন্ট ব্যাটনের বক্তৃতার পর নেহেরু যে বেতার বক্তৃতা দেন তাত তিনি বলেছিলন, ‘হয়ত এই পন্থাতেই অদূর ভবিষ্যতে অদূর ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠিত হবে।–[‘Transfer of Power in India’, V.P Menon] বস্তুত কংগ্রেসের কাছে ভারত বিভাগ বড় ছিল না, বড় ছিল সমগ্র ভারতকে সব্জায় আনা। এজন্যে তাদের লক্ষ্য ছিল নগন সুবিধা সর্বাধিক আদায় করে নেয়া এবং ভবিষ্যতের জন্যে নিশ্চিত সুযোগ সৃষ্টি করা। মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষশতা হস্তান্তর করবেন। আর স্যার জর্জ অ্যাবেল তো অত্যন্ত নগ্ন ভাষায় বলেছিলেন, ‘প্রস্তাব গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে জিন্নাহ বলে দিন তিনি কি পাবেন। এটা পরিস্কার বুঝিয়ে না দিলে জিন্নাহ যুক্তি মানবেন না”।–[‘Mission with Mount Batten’, Campbell Johnson, page 58.] সে সময়ের অবস্থা সম্পর্কে জিন্নাহ নিজেই বলেছেন, “কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, মুসলিম লীগের পক্ষে ৩রা জুনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা ভুল হয়েছে। আমি তাদের বলতে চাই, অন্য কোন পন্তা অবলম্বন করলে অকল্পনীয় সর্বনাশ হতো”-[‘Speeches and Writings of Mr. Jinnah’, Vol-11, Jamiluddin Ahmed.] একজন ইতিহাসকার রিচার্ড সাইমন্ডস-এর উক্তিতেও কোন বিকল্পই যে তখন আর অবশিষ্ট ছিল না তা বুঝা যায়। তিনি বলেছেন, “জিন্নাহ নিজে পূর্বে যেটাকে কর্তিত পোকায় খাওয়া পাকিস্তান বলেছিলেন, তাই পরে গ্রহণ করায় মুসলিম লীগের কোন কোন সদস্য লীগের বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন।
কিন্তু এছাড়া অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন কি করে, বুঝা যায় না”।–[Making of Pakistan’, Richard Symods, Page 73.]
২রা জুন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা গৃহীত হবার পর ৩রা জুন বৃটিশ পার্লামেন্টে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলী ভারত বিভাগ পরিকল্পনাটি ঘোষণা করলেন। ঘোষিত মূল প্রস্তাবগুলো হলোঃ যেসব এলাকায় পাকিস্তান গঠিত হবার সম্ভাবনা আছে, সেখানে জনগণের মতামত যাচাই করা হবে। বাংলা, সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে প্রাদেশিক পরিষদ এই প্রশ্ন যাচাই করবে। বাংলা এবং পাঞ্জাবে প্রাদেশিক পরিষদ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যেসব জিলার মুসলিম সংখ্যালঘু এই দুই শাখা হিসেবে মিলিত হবে এবং প্রতিটি শাখা ভিন্নভাবে স্থির করবে যে তাদের প্রদেশ ভাগ করা হবে কিনা। যদি কোন শাখা তাদের প্রদেশ বিভাগ করতে চায় একত্রে থাকতে চায়, তাহলে তারা স্থির করবে যে, কোন সংবিধানে সংসদে তারা যোগ দেবে। ফ্রন্টিয়ার প্রদেশে জনসাধারণের ভোট গ্রহণ করা হবে। কারণ ঐ এলাকায জনগণের ইচ্ছার পরিবর্তনের ইংগিত পাওয়া গেছে। আসামের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জিলা সিলেটে সর্বসাধারণের ভোট গ্রহণ করা হবে এবং যদি বাংলা প্রদেশ ভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সিলেট যদি পাকিস্তান যোগ দিতে চায়, তাহলে সিলেট হবে পূর্ব বাংলার একটি অংশ”।
এটলির ঘোষণার পর ভারতীয় বেতারে ভারত-বিভাগ পরিকল্পনার বিভ্নিন দিকের উপর বক্তৃতা দিলেন মাউন্ট ব্যাটেন। মাউন্ট ব্যাটেনের পর এই ৩রা জুনের বেতার বক্তৃতা দিলেন নেহেরু এবং জিন্নাহ। নেহেরু বললেন যে, ভারত থেকে কয়েকটি অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তিনি আনন্দ সহকারে সম্মতি দিতে পারছেন না, কিন্তু এটা (পরিকল্পনা) যে সঠিক পন্থা, তাতে তাঁর কোন সন্দেহ নেই।তিনি আশা করেন যে, হয়তো এই পন্থাতেই অদূর ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠিত হবে’। মিঃ জিন্নাহ তাঁর ভাষণে বললেন, ‘কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হতে পারছিনা। সম্রাটের সরকারের এই পরিকল্পনা আমরা আপোষ মীমাংসা হিসেবে গ্রহণ করবো কিনা একথা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কি হবে, তা আমি আগে থেকে বিচার-বিবেচনা করতে চাইনা। কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিধান মতে একমাত্র লীগ কাউন্সিলই এ বিষয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে দিল্লীর মুসলিম লীগ মহলের প্রতিক্রিয়া যতটা আমি জানতে পেরেছি তাতে আশাবাদ প্রকাশ করা যায়”।–[‘Transfer of Power in India’, V.P Menon, page 371-376. ‘Muslim League’, Yesterday and Today’, A.B Rajput, দশম পরিচ্ছেদ।]
লক্ষ্য করার মত যে, দুই নেতার বক্তৃতার ডাইমেনশন দুই ধরনের। নেহেরু ভারত বিভাগের জন্যে আপসোস করেছেন, কিন্তু ভারত বভাগের পন্থা পরিকল্পনাকে তিনি সঠিক বলেছেন। আবার আশা করেছেন ভারত পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে। অর্থাৎ নেহেরুর কাছে ভারত বিভাগ একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা এবং কংগ্রেসের ক্ষমতায় যাবার একটা মাধ্যম। বলা বাহুল্য, যে কোন পন্থায় এ ক্ষমতা হাত করার জন্যেই কংগ্রেস এ যাবত অবিরাম চেষ্টা করেছে। আর ভারত বিভাগকে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা মনে করার অর্থ মুসলিম স্বার্থ বিরোধী আক্রমণাত্মক মনোভাব কংগ্রেস ত্যাগ করেনি ,যা কংগ্রেসের মধ্যে দৃষ্ট হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। কংগ্রেসের এই মনোভাবই ভারত বিভাগের মত ঘটনা সংঘটিত করল। অন্যদিকে জিন্নার বক্তৃতায় ভারত বিভাগ মেনে নেয়া হয়েছে, কিন্তু ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ও পন্থার সাথে দ্বিমত পোষন করেছেন তিনি, তবু গ্রহণ করা হয়েছে পরিকল্পনাটি। এখানে জিন্নাহ বা লীগের ভূমিকা আত্মরক্ষামূলক। আর জাতীয় আত্মরক্ষার এই লক্ষ্য নিয়েই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। আত্মরক্ষার পথ সন্ধানেই শেষ পর্যন্ত লীগ ভারত বিভাগ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। গত অর্ধশতাব্দী ধরে দুই জাতির আযাতী সংগ্রাম ছিল এই আক্রমণ ও আত্মরক্ষার সংগ্রাম। সংগ্রাম ছিল হিংস্র নেকড়ে ও দুর্বল খরগোশের মধ্যে। নেকড়ে স্ট্রাটেজী ছিল খরগোশকে থাবার মধ্যে নিয়ে আসা, আর খরগোশের স্ট্রাটেজী ছিল নেকড়ের থাবা পৌঁছতে না পারে এমন একটা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান। সে আশ্রয়ই হলো খণ্ডিত পাকিস্তান।
৩রা জুনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা ও পাঞ্জাবের আইন পরিষদ প্রদেশের বিভাগের পক্ষে রায় দিল। সিন্ধু প্রদেশ সিদ্ধান্ত নিল পাকিস্তানে যোগ দানের জন্যে। বেলুচিস্তানের জির্গা এবং সিলেটেনের গণভোট রায় দিল পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু খেলা শুরু হলো উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে। সেখানে গণভোটের ইস্যু নির্ধারিত ছিল সেখানকার মানুষ পাকিস্তানে যোগ দেবে, না হিন্দুস্তানে যোগ দেবে। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ক্ষমতাসীন লাল-কোর্তা দলের নেতা কংগ্রেসের মিত্র আব্দুল গাফফার খান দাবী করলেন যে, জনগণ স্বাধীন পাখতুনিস্তান চায় কিনা সেটাওরেফারেণ্ডামের ইস্যু হিসেবে যোগ করতে হবে। কংগ্রেস এই দাবীকে সমর্থন করলেন। জিন্নাহ একে ‘বিশ্বাসঘাতকতা প্রতারণামূলক’ বলে মন্তব্য করলেন। মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে এ নিয়ে দরবার করা হলে তিনি বললেন যে, লীগ ও কংগ্রেস এ ব্যাপারে একমত না হওয়ায় তিনি একে গ্রহণ করতে পারলেন না। এরপর গান্ধী জিন্নাহকে বললেন, নিজেদের স্বতন্ত্র শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার সহ সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানে যোগ দিতে অনুরোধ করা হোক। এই সময় গাফফার খান বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সুযোগ চাইলেন। জিন্নাহ এ দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করলেন। মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনায় কোন প্রদেশের এ ধরনের কোন সুযোগ ছিল না। রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হলো। পাকিস্তানের পক্ষে পড়ল ২ লাখ ৯০ হাজার ভোট, আর ভারতের পক্ষে ৩ হাজার ভোট। এইভাবে পাকিস্তানকে আরও খণ্ডিত করার কংগ্রেসের আরেকটা উদ্যোগ ব্যর্থ হলো।
স্যার সেরিল র্যাডক্লিফকে দেয়া হয়েছিল বাউন্ডারি নির্ধারণের দায়িত্ব। তিনি এই দায়িত্ব শেষ করলেন ১৩ই আগস্ট, ১৯৪৭ তারিখে। র্যাডক্লিফের রোয়েদাদ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম পেল পাকিস্তান। এটা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন নেহেরু। বললেন যে, এই রায় তিনি মানবেন না। মাউন্ট ব্যাটেনকে আরও বললেন, স্থানীয় লোকেরা এটা মানবেনা। প্রয়োজন হলে জোর করেই এ এলাকা ছিনিয়ে নেবে।–[‘India Wins Freedom: The Other Side’, by A.W Khan, page 331-336] কিন্তু অবশেষে এই এলাকা পাকিস্তানকেই দেয়া হলো। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সীমানা বণ্টন র্যাডক্লিফের রোয়েদাদা অনুসারে হয়নি। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান, আসাম ও পশ্চিম বংগের সীমারেখা যদিও র্যাডক্লিফের রোয়েদাদ অনুযায়ী প্রবহমান নদীকে ধার্য করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, মর্শিদাবাদের সীমান্ত ব্যতীত নদীয়া ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমানায় একটা শুল্ক খাল ছাড়া আর কিছুই নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বীরভূমের রামপুর হাট মহকুমা ও মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানভুক্ত না হয়ে পশ্চিম বাংলায় রয়ে গেল। নদীয়া ও চব্বিশ পরগণাকে বাদ দিয়ে লোক দেখানো ভাবে খুলনা জেলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হোল। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি সর্বতোভাবে ভংগ করা হলো। পাহাড়ী এলাকতেও দেখা গেল ছোট ছোট পাহাড়ের শীর্ষদেশগুলি ভারতে পড়েছে, আর নিম্নদেশ পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। এমনি কি ছাতকের সিমেন্ট কারখানা পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানে, আর কাঁচামাল চুনাপাথরের ডিপো পড়েছে ভারতে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র দর্শনা চিনিকল ছাড়া কোন কলকারখানাই পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়লনা। সেতাবগঞ্জে পড়ল চিনিকল ও গোটা তিনেক কাগজের কল, যার মালিক ছিল হিন্দুরা এবং ঐ কটিই থাকল পূর্ব পাকিস্তানে। টাকার অভাবে সূতা ও তুলার আমদানি সম্ভব হবে না সে কথা জেনেই এ ব্যবস্থা করা হলো। সারা ভারতে হিন্দু জনসাধারণ কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তান আর্থিক সংকটে পড়ে ধ্বংস হবে বলে উৎফুল্ল হয়ে উঠল’।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান’, ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা ৩৭২, ৩৭৩।] বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা এল। পাকিস্তান স্বাধীনতা উদযাপন করল ১৪ই আগস্ট, এবং ভারত ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭। স্বাধীনতা অর্জনের এই শেস মূহুর্তে দেশীয় রাজ্য ও সম্পদ ভাগাভাগি প্রশ্নে পাকিস্তান প্রতারণার শিকার হলো। দেশীয় রাজ্যগুলো যাতে ভারতে যোগদান করে বা যোগদানে বাধ্য হয়, এমন প্রচেষ্টা মাউন্ট ব্যাটেনের পক্ষ থেকে সজ্ঞানেই করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাজকোষ থেকে প্রাপ্য নগদ ৫৫ কোটি টাকা পাকিস্তানকে দেয়া হলোনা, দেয়া হলোনা সোনা রুপার ভাগ। চক্রান্ত করে ডিফেন্স কাউন্সিল আগাম ভেঙে দিয়ে সামরিক সরঞ্জামের শেয়ার থেকে পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হলো। আর এসব হয়েছিল মাউন্ট ব্যাটেনের সম্মতিতেই। সুতরাং পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হলো বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা ও চরম সংকটের মধ্য দিয়ে। যেন কংগ্রেস জন্মের মুহুর্তেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাইল সবদিক থেকে বঞ্চিত করে। ভারতের বৃটিশ সর্বাধিনায়ক জেনারেল আকিনলেক কংগ্রেসের এই চেহারায় আতংকিত হয়ে ১৯৪৭ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, “আমি নিঃসংশয় দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, পাকিস্তান ডোমিনিয়ন যাতে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, বর্তমান ভারতীয় মন্ত্রীসভা সেজন্যে আপোষহীনভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে বদ্ধপরিকর। ১৫ই আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে নতুন ভারতের প্রতিনিধিরা স্বরূপ প্রকাশে বিরত ছিলেন এবং সাধারণভাবে যুক্তি ও সহযোগিতার ভাব দেখিয়েছেন। ….১৫ই আগস্টের পর অবস্থার অবনতি হয়ে চলেছে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রীগণ, বেসামরিক কর্মচারীরা এবং অন্যান্যরা সামরিক বাহিনী বিভাগের কাজে অবিরাম বাধা দিয়ে চলেছে”। ভারতীয় নেতৃবৃন্দগণ এটা পেরেছেন মাউন্ট ব্যঅটেনের সাহসে। আর মাউন্ট ব্যাটেন এটা করেছেন ভবিষ্যত অখণ্ড ভারতের বুনিয়াদ রচনার জন্যে। তিনি জুনের (১৯৪৭) দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের দেশীয় এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারী হোরেস র্যামবোল্ডকে বলেছিলেন, “আমি শুধু এক ‘অখণ্ড ভারত’ তৈরীর চেষ্টা করছি এবং দেশ যদি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, স্থায়ী হয়, তাহলে আমরা ভারতের কাছে বন্ধুত্ব পাব”।–[‘মাউন্ট ব্যাটেন’, জিগলার, পৃষ্ঠা ৪০৮, ‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ৩১৩।] বলাই বাহুল্য, জেনারেল আকিনলেক ১৫ই আগস্টের পর ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও সরকারের যে, ‘স্বরূপ প্রকাশ’ দেখে আতংকিত হয়েছিলেন, সে স্বরূপ-উপলব্ধি ছিল মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি বা পাকিস্তান দাবীর ভিত্তি, ভারত বিভক্তির কারণ। ভারতীয় হিন্দু নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগ করেছিলেন, কিন্তু তাদের স্বরূপ সংশোধনে রাজী হননি। সম্ভবকত এই আশায় যে, তাদের এই স্বরূপ শক্তিই একদিন তাদের ‘অখণ্ড ভারত’-এর স্বপ্ন সার্থক করবে। অবাস্তব এই চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়েই বাস্তবতা বিজয় লাভ করল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।