সংখ্যাগুরুর সংহার মূর্তি
বিশ শতকের শুরতে হিন্দুদের জাতীয় আন্দোলন সশস্ত্র বিপ্লবী রূপ নিল। ১৯০২ সালেই যতীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে কোলকাতায় সার্কুলার রোডে গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা ১৮৯৬ সালে শিবাজী উৎসবের মধ্যে হিন্দু-উত্থানের যে মারমুখো প্রবণতা দেখেছি এবং বালগঙ্গাধর তিলকের ঘোষণায় হিন্দুদের হিংসাত্মক উত্থানের যে ইংগিত পেয়েছি, তারই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো ‘গুপ্ত সমিতি’র মাধ্যমে। কংগ্রেসের ছায়াতেই এই আন্দোলন চলল। কংগ্রেসের জনশক্তি এবং কংগ্রেসের অনেক নেতা-কর্মী অব্যাহত ভাবে এ আন্দোলনে শক্তি-সঞ্চার করেছে।
বিপ্লবী এ গুপ্ত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী অরবিন্দ। শ্রী অরবিন্দ তাঁর কর্মস্থল বরোদা থেকে বাংলাদেশে বিপ্লবী কর্মতৎপরতা পরিচালনার জন্যে ১৯০১ সালে পাঠান যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যয়কে এবং এর কিছু পরে পাঠান তার ভাই বারীন ঘোষকে।
১৯০২ সালে কোলকাতার সার্কুলার রোডে যে গুপ্ত সমিতি গঠিত হলো, তার পরিচালনার জন্যে ছিল পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি। কমিটির সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার প্রমথ নাথ মিত্র, সহসভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, আর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের) পরিবারের সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।–[‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান’, উমা মুখোপাধ্যয়, হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১০।] কোলকাতার গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো। সমিতির কেন্দ্রগুলোতে শরীর চর্চার সাথে সাথে রাজনৈতিক পাঠও নিয়মিত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। ‘এই বিপ্লবী দলের একটা প্রতিজ্ঞাপত্র ছিল এবং তা ছিল সংস্কৃতি ভাষায়। সমিতির সভ্যপদ গ্রহণ করতে হলে প্রত্যেককে উক্ত প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করতে হতো। শর্ত ছিল –“ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে”।–[‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান’, উমা মুখোপাধ্যয়, হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১১।] প্রতিজ্ঞার এই শর্ত থেকে পরিস্কার, এই বিপ্লবী গুপ্ত আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা। এখানে উল্লেখ্য, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত এই বিপ্লবী গুপ্ত আন্দোলন অতীতের হিন্দু রাজনীতিরই এক ধারাবাহিকতা। ঊনবিংশ শতকেও হিন্দুদের এই ধরনের আন্দোলনের একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত আছে। ১৮৭৯ সালে পূনার চিত পাবন ব্রাহ্মণদের একজন শ্রী বাসুদেও বলবন্ত নিজেকে দ্বিতীয় শিবাজীর মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহারাষ্ট্রের পাহাড়িয়া এলাকায় গিয়ে এক সৈন্য বাহিনী গড়ে তুললেন। দীর্ঘ চার বছর ধরে তিনি ইংরেজদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালালেন। কিন্তু হিন্দুরাজ কায়েম হলো না। ব্যর্থ হলেন তিনি। ব্যর্থ হলেন বটে, কিন্তু হিন্দু মানসে তিনি সৃষ্টি করলেন এক বুক ভরা আশা এবং প্রেরণা। সেই প্রেরণায় জেগে উঠেছিলেন বিষ্ণুহরি চাপেকার নামে এক যুবক কবি। তিনিও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হিন্দুরাজ কায়েমের। তার শিক্ষা, তাঁর দেশ প্রেমমূলক কবিতা মানুষের মধ্যে চেতনার জোয়ার সৃষ্টি করেছিল। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, বাল গঙ্গাধর তিলক, প্রমুখ এই ধারারই দিকপাল। সবাই শিবাজীর একনিষ্ঠ উত্তরসূরী। গান্ধী, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীরা এই ধারারই ছদ্মবেশী নট। কিন্তু শ্রী অরবিন্দরা এলেন শিবাজীর কোষমুক্ত কৃপাণ হয়ে।
কিন্তু ১৯০২ সালে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি বাংলাদেশে তার যাত্রা শুরু করলেও খুব বেশী এগুতে পারল না, গণমানুষের কাতারে এসে দাঁড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। বংগ ভঙ্গ পরিকল্পনা ঘোষণার পর এই সুযোগ তাদের এল। নতুন ভাবে গা ঝাড়া দিল গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি। গঠিত হলো নতুন প্রয়োজন পূরণের জন্যে নতুন সমিতি। বংকিমী আদর্শের অনুকরণে তার নাম দেয়া হলো ‘অনুশীন সমিতি’।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান’ বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১২।] গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির ব্যারিষ্টার পি, মিত্র হলেন এরও সভাপতি। এইভাবে কার্যত এক হযে গেল বিপ্লবী সমিতি ও অনুশীলন সমিতি। বঙ্গভঙ্গ রদে বৃটিশকে বাধ্য করার জন্যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ১৯০৫ সালে আগস্টে ‘বৃটিশ পণ্য বর্জন’ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার মাধ্যমে প্রবল ‘স্বদেশী আন্দোলন’ এ রূপ নিল। এই ‘স্বদেশী আন্দোলন’ এর অস্ত্রে পরিণত হলো গুপ্ত সমিতি বা অনুশীলন সমিতি। এ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। ‘বাংলার শহরে মফঃস্বলে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন নতুন আখড়া, ব্যায়ামাগার ও সমিতি এবং যুবকদের দল দেশোদ্ধারের আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে গ্রহণ করলে এর সভ্যপদ। ১৯০৫ সনের নভেম্বরে পি. মিত্রের উৎসাহে পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে গুপ্ত সমিতির যে শাখা প্রতিষ্ঠিত হলো সেখানেও মুষ্টি যুদ্ধ, ছোরা খেলা, লাঠি খেলা, ব্যায়াম, ঘোড়ার চড়া, সাঁতার দেয়া প্রভৃতি শিক্ষা দেয়া হতো। কলিকাতা অনুশীলন সমিতি ও ঢাকা অনুশীলন সমিতির সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার পি, মিত্র। রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্রুত গতির সাথে তাল রেখে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার প্রায় প্রতি জেলায় ক্লাব ও আখড়া প্রতিষ্ঠিত হলো। সেগুলিও ছির কলকাতাস্থ অনুশীলন সমিতির অন্তর্ভুক্ত। সতীশ বসু (কলিকাতা অনুশীলন সমিতির সেক্রেটারী) ও পুলিন দাস (ঢাকা অনুশীলন সমিতির সেক্রেটারী) উভয়কেই বলা হয় বৈপ্লবিক দলের প্রথম ধারার প্রতিনিধি। এই দুই নেতার নেতৃত্বে বাংলায় হাজার হাজার যুবক তৎকালে শক্তিযোগের সাধনায় তন্ময় হয়ে গিয়েছিল। শক্তিযোগী বাংগালীর নতুন চরিত্র ও মেজাজ লক্ষ্য করে সেদিন সারা ভারতবর্ষের লোকেরা বিস্ময়াভিভুত হয়েছিল।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১৩, ১৪।]
বলা হায়, “১৯০৫ এর আগস্ট মাসে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বাংলার মরা গাঙ্গে নতুন ভাব, আবেগ ও কর্মের জোয়ার এলো। এই জোয়ারে তরী ভাসালেন রবীন্দ্রনাথও। রবিকণ্ঠ থেকে বের হলো ‘জয় মা বলে ভাসা তরী’। প্রত্যক্ষদর্শী বিনয় সরকার বলেছেন, ‘শব্দই হোক আর বস্তুই হোক –দুইয়েই ছিল লাখ লাখ মানুষের স্বার্থ আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, ভাবুকতা আর কৃতিত্ব। কর্মদক্ষতা, চরিত্রবত্তা ও স্বার্থত্যাগ মাখানো। অসংখ্য বাঙ্গালীর সুরও বদলে গেল। মেজাজ দিয়ে ভারতবাসীদের জীবনে ঘটবে পুনরুজ্জীবন। এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাঙ্গালী সেদিন নতুন তেজ ও নতুন সংকল্প নিয়ে স্বাধীনতার মহাযজ্ঞে আত্মহুতি দিতে প্রস্তুত হলো’।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১২, ১৩।] “স্বদেশী আধুনিক বাঙলার ইতিহাসের প্রথম ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন যা বাঙলার সমাজ কাঠামোকে দীর্ণ করেছিল বিপুল ঘটনা বিস্তার ও অর্ভতপূর্ব হিংস্রতা ও স্ববিরোধী চরিত্র প্রকাশ করেছে। বাঙলাদেশে পরবর্তীকালের সব রাজনৈতিক আন্দোলনের পূর্বসূরী ও পথিকৃত ছিল স্বদেশী বাঙালী জাতরি ভবিষ্যতেও নির্ধারণ করেছিল বহুজাত আন্দোলন। এ যুগে ভদ্রলোক শ্রেণীর নতুন নেতা হলেন ‘র্যাডিকাল বিপিন’’বিপিন চন্দ্র পাল, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অরবিন্দ ঘোষ ও বিখ্যাত চিত্তরঞ্জন দাস। গুপ্ত সমিতি, রাজনৈতিক হত্যা ও সন্ত্রাসবাদ, ব্যক্তিগত বীরত্ব প্রদর্শন ও আত্মোৎসর্গ, অসহযোগ, সত্যাগ্রহ, ধর্মঘট, বন্ধ, পিকেটিং,অনশন, প্রভৃতি রাজনৈতিক কলা কৌশল স্বদেশ যুগেরই অবদান। স্বদেশীর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বাংলায় জন্ম হয়েছিল মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা’।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলায় বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ৫৫, ৫৬। (আরও দ্রষ্টব্য: ‘The Seadeshi Movement of Bengal 1903-1904, Sumir Sarkar এবং ‘Elite Confict in pliral society’-J.H. Broomfield. এছাড়া ‘স্বদেশী আন্দোলনের পরবর্তী বাংলায় সমাজতন্ত্র’, Chapter VII)] স্বদেশী আন্দোলনের এ ঢেউ সেদিন আরও অনেকেরই মুখোশ খুলে দিয়েছিল। ‘মহান জাতীয় নেতা’ বলে কথিত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর আচরণেও ‘স্বদেশী’র হিন্দু চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ১৯০৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কলিঘাটের বিখ্যাত কালিমন্দিরে পুজা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বদেশীরা আন্দোলনের শপথ গ্রহণ করে। অনুরূপভাবে বৈদ্যবাটির কালিমন্দিরেও স্বদেশীরা শপথ নেয়। মন্দিরে এই শপথ নেয়ার উদ্যোক্তা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখছেন, “আমি কথা বলছিলাম যখন, আমার চোখ মন্দির এবং প্রতিমার প্রতি নিবদ্ধ ছিল। পারিপার্শ্বিকতা আমার হৃদয়কে আবেগে পূর্ণ করে তুলেছিল। হঠাৎ আমি আবেদন জানালাম জনতার প্রতি, আপনারা উঠুন, চলুন, আমরা আমাদের পূণ্য দেবতার কাছে গিয়ে শপথ গ্রহণ করি। মন্দিরে শপথ বাক্য আমিই পাঠ করিয়েছিলাম। আমি শপথ বাক্য বলছিলাম, আর জনতা দাঁড়িয়ে আমার কথার পুনরাবৃত্তি করছিল”।–[‘Surendranath Banerjee’, পৃষ্ঠা ২২৮-২২৯ (দ্রষ্টব্য ‘বঙ্গভঙ্গ’, মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা ৫৯)।]
স্বদেশীদের এই চরিত্র স্পষ্ট হবার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, ‘বাঙালীর’ শক্তিযোগী বা সামরিক এই উত্থানের লক্ষ্য কি? স্বদেশী আন্দোলনের রাজনৈতিক দর্শন কি ছিল? স্বদেশীদের যে স্বপ্ন ‘স্বরাজের মধ্য দিয়ে ভারতবাসীদের জীবনে ঘটবে পুনরুজ্জীবন’ সেই জীবনের স্বরূপটা কি?
এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আন্দোলনের নেতা শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। এ জবাব দিয়েছেন তিনি তাঁর লিখিত “ভবানি মন্দির’ শীর্ষক পুস্তিকায়। ‘অরবিন্দ চাইলেন ভারতের কোনও এক পর্বত শীর্ষে আরাধ্য দেবী ভবানীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। বহু দনের পরাধীনতা পরিণামে যে ক্লৈব্য ও তামসিকতা ভারতবাসীর মানসকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তার কবল থেকে জনমানসকে মুক্ত করে অরবিন্দ সেখানে ক্ষাত্রতেজের বহ্নিশিখা প্রজ্জলিত করতে চাইরেন। তাই তিনি সেদিন শান্তির ললিত রাণি উচ্চারণ না করে জাতির নয়ন সম্মুখে তুলে ধরলেন শক্তি রূপা ভবানীর মূর্তি।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১৭।] এই ভবানী শিবাজীরও আরাধ্য। শিবাজীর হাতের খড়ড় ছিল ভবানীর প্রিয় এবং খড়ড়ের কারণে শিবাজীও ছিলেন ভবানীর প্রিয়।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১৩০।] খড়গ-হস্ত শিবাজীকে রঘুপতি যোজনা করেছিল যবনদিগের বিরুদ্ধে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১৮৭।] শ্রী অরবিন্দও শিবাজীর এ খড়গ তুলে দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের হাতে, স্বদেশীদের হাতে। লক্ষ্য ঐ একই, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা ‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১১।] বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা এবং স্বদেশী আন্দোলন ছিল এই লক্ষ্য অর্জনের উপলক্ষ। এই কথাটা ‘যুগান্তর’ পত্রিকার ‘ধর্মরাজ্য ও মহারাজা শিবাজী’ নিবন্ধে সুন্দরভাবে স্বীকার করা হয়েছে এইভাবে, “ধর্ম রাজ্যের আদর্শের দ্বারা সর্বসাধারণকে অনুপ্রাণিত করা সম্ভবপর নহে। তাহাদের নিকট ধর্মরাজ্য স্থাপন রূপ আদর্শকে ব্যক্ত না করিয়া স্বদেশ প্রতিষ্ঠারূপ আদর্শকেই স্পষ্ট করিয়া প্রচার করিতে হইবে। শিক্ষিত সম্প্রদায় ধর্মস্থাপন রূপ আদর্শকে সহজেই অবলম্বন করিতে পারিবেন এবং উহারই একমাত্র উপায়স্বরূপ স্বদেশ প্রতিষ্ঠানকে ধ্রুবলক্ষ বলিয়া ধারণ করিয়া জীবন উৎসর্গ করিতে করতে নবজীবন লাভের জন্যে অগ্রসর হইতে হইবে। এই স্বদেশ বা নেশনের প্রতিষ্ঠানই ধর্মরাজ্য স্থাপনের মূল ভিত্তি, অভূতপূর্ব অশ্রুতপূর্ব বিপদরাশির মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া ভারতবর্ষ এই মূল ভিত্তির সন্ধান পাইয়াছে। সমগ্র ভারতকে এ রাজচক্রবর্তিতে সম্মিলিত করিয়া ধর্মরাজ্য স্থাপনরূপ মহাব্রতে ব্রতী হইয়া ভগবান বাসুদেব মহাযজ্ঞ আরম্ভ করিয়া গিয়াছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস অভিনিবিষ্ট হইয়া পাঠকরা দেখিবে এই যজ্ঞে সিদ্ধিলাভ করিবার জন্য ভারতবর্ষ সহস্রবর্ষ ধরিয়া আহুতি মন্ত্রের অনুসন্ধান করিতেছে। “ভারতের দুঃখ তমিস্ররাশির মধ্যে বিদ্যুৎপ্রভায় স্বদেশ বা নেশন প্রতিষ্ঠারূপ আদর্শের প্রকাশ হইয়া সেই মন্ত্রের সন্ধান বলিয়া দিয়াছে। ভারতবাসী, তুমি কি আজ হৃদয়ের সহিত বিশ্বাস করিতে পার যে, ‘বন্দেমাতরমই’ সেই ধর্মরাজ্য স্থাপনের আহুতি মন্ত্র?”-[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’ উমা মুখোপাধ্যয় ও হরিদাস মুখোপাধ্যয়, পৃষ্ঠা ১৩১, ১৩২।]
হিন্দুভারত যুগান্তরের এই সব কথা সবই বিশ্বাস করেছিল। এই সংগে চেয়েছিল যে, সমগ্র ভারতকে এক রাজচক্রে সম্মিলিত করে ধর্মরাজ্য স্থাপনের জন্য ভারতবর্ষ সহস্র বছর ধরে যে আহুতি মন্ত্রের সন্ধান করছে, ‘বন্দেমাতরম’ কে সেই আহুতি মন্ত্র হিসেবে প্রত্যেক হিন্দুই সমস্ত আবেগ দিয়ে গ্রহণ করুক। এই চাওয়ার বিশ্বস্ত বাস্তবায়ন হিসাবে সর্বভারতীয় কংগ্রেসও একে গ্রহণ করল। গ্রহণ করল একে আধুনিক ভারত রাষ্ট্র তার প্রিয় সংগীত হিসেবে।
ভারতে ধর্মরাজ্য স্থাপনের সহস্র বর্ষের সাধনায় আবিস্কৃত আহুতি মন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ অর্থাৎ উৎকট ন্যাশনালিজমকে “মানবতাবাদী”, ‘উদারপন্থী’, বলে কথিতরাও অন্য সকলের মত করেই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দেমাতরম’ এর ‘ন্যাশনালিজম’কে শুধু সর্বান্তকরণে গ্রহণ করা নয়, ‘বন্দেমাতরম’ গানে সুরারোপ করেন।–[‘অখন্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৭৭।] অথচ এই রবীন্দ্রনাথ এই নেশনবাদের বিরুদ্ধে কত শত ভাষায়ই না কথা বলেছিলেন, লিখেছিলেন। যেমনঃ “এই আমাদের ভারতবর্ষ যা অন্ততঃ পঞ্চাশ শতাব্দী তো হবেই শান্তির জীবন যাপন করতে চেয়েছিল এবং চিন্তার গভীরতায় মগ্ন ছিল। এই সেই ভারত, সকল প্রকার রাজনীতি বর্জিত এবং নেশনবদের সাথে সম্পর্কহীন, যার একমাত্র আকাঙ্খা ছিল এই জগতকে আত্মার জগত বলে উপলব্ধি করা তার সঙ্গে এক অনন্ত এবং অন্তরতম যোগসূত্রের উৎফুল্ল চেতনায় জীবনকে অতিবাহিত করা। ব্যবহারে শিশুসুলভ এবং অতীতের জ্ঞান বৃদ্ধ মনুষ্য জাতির এই একান্ত অংশটির উপর পশ্চিমের নেশনবাদ বিস্ফোরিত হলো। আমরা মোগল এবং পাঠানকে দলে দলে আসতে দেখেছিলাম। কিন্তু তাদের আমরা মনুষ্য জাতির অংশ হিসাবেই চিনে নিয়েছি। চিনেছি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক প্রথাগুলোকে এবং তাদের আকর্ষণ ও বিতৃষ্ণাকে। কিন্তু তাদের আমরা কখনও নেশন হিসেবে চিনতে শিখিনি। ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের ভালোবেসেছি অথবা ঘৃণাও করেছি। আমরা তাদের পক্ষে অথবা বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করেছি। যে ভাষায় তাদের সাথে কথা বলেছি তা একদিকে তাদেরও ছিল, অন্যদিকে আমাদেরও এবং এইভাবে এই সাম্রাজ্যের ভাগ্যকে পরিচালিত করেছি যাতে আমরা কার্যকরী ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু এবার আমাদের কার্যাবলীর সম্বন্ধ হচ্ছে কোন বস্তুর সঙ্গে নয়, কোন মনুষ্য জাতির সঙ্গে নয় পরন্তু একক নেশনের সঙ্গে…”।–[ন্যাশনালিজম’, ম্যাকমিলান। (বিমলানন্দ শাসনামল লিখিত ‘স্বাধীনতার ফাঁকি’, (আল-ইত্তেহাদ পাবলিকেশন্স (প্রাঃ) লিমিটেড, ১৮৩ লেনিন সরণী, কলিকাতা কর্তৃক প্রকাশিত) শীর্ষক গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৩৭, ১৩৮)। ]
এই ‘নেশন’ বা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের এই কন্ঠকে আরও তীব্রভাবে উচ্চারিত হতে দেখি আমরা তার জাপান সম্পর্কিত লেখায়। জাপানের জাতীয়তাবাদী উত্থানকে তীব্র আক্রমণ করে তিনি বললেন, “জাপানের পক্ষে যা বিপদজনক তা পাশ্চাত্য সভ্যতার বাহ্যিক অবয়বকে অনুকরণ নয়, পরন্তু পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের গতি শক্তিকে নিজেদের বলে গ্রহণ করা। তার সামাজিক আদর্শগুলিতে রাজনীতির নিকট পরাস্ত হবার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি তার আপ্ত বাক্য হচ্ছে বিজ্ঞান থেকে বের করা, ‘যোগ্যতমই বিদ্যমান থাকবে’, যে আপ্ত বাক্যের আসল অর্থ হচ্ছে ‘নিজেরটা গুছিয়ে নাও এবং তাতে অপরের কোন ক্ষতি হলে গ্রাহ্য করো না’। ….যে আপ্ত বাক্য শুধু অন্ধ ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সাজে যে স্পর্শের দ্বারা যা কিছু জানতে পারে শুধু তাতেই বিশ্বাস করে কারণ সে চোখ দিয়ে কিছু দেখতে পায় না। …..কিন্তু এখন যখন পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রাধান্য রয়েছে সমগ্র মানবসমাজে তখন শিশুকাল থেকে সকল রকম উপায়ে শিক্ষা দেয়া হয় যাতে তারা ঘৃণা ও লোভকে পোষণ করতে পারে এবং তা করা হয় ইতিহাসের অর্ধসত্য ও অসত্য প্রচারের মাধ্যমে, করা হয় অপর জাতিগুলি সম্বন্ধে তথ্যবিকৃতি দ্বারা, করা হয় সেই সকল ঘটনার স্মৃতি-স্তম্ভ রচনা করে যা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মিথ্যা, শুধু মাত্র অন্য জাতি সম্পর্কে অপ্রীতিকর মানসিকতা তৈরী করার জন্যে যেগুলি মনুষ্যজাতির মঙ্গলের জন্যে যত শীঘ্র সম্ভব বিস্তৃ হওয়া উচিত, এই ভাবে জাতি ও দেশগুলির প্রতি এক দুষ্ট অসহিষ্ণুতাকে নিয়ম উৎপন্ন করে। এইভাবে সমগ্র মানব জাতির উৎস সূত্রটিকে বিভক্ত করে তোলা হচ্ছে”।–[‘ন্যাশনালিজম’, ম্যাকমিলান, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৯ (বিমলানন্দ শাসনামলের ‘স্বাধীনতার ফাঁকি’ গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৩৯, ১৪০)।]
রবীন্দ্রনাথের মত এত তীব্র, এত শক্ত ও এত সুন্দর ভাবে জাতীয়তাবাদকে বাংলাভাষায় আর কেউ আক্রমণ করেছে বলে আমি জানি না। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐতিহ্যের খেলাফ বললেন, যে জাতীয়তাবদকে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন বললেন, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ আত্মস্বার্তের পুজা, লোভ ও ঘৃণার উৎস বললেন এবং যে জাতীয়তাবদ রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিবেশী জাতি সম্পর্কে অন্তহীন তথ্যবিকৃতি ও মিথ্যা কাহিনীর জন্মদাতা হিসেবে চিহ্নিত, সেই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে, আয়োজনকে এবং সে জাতীয়তাবদকে রবীন্দ্রনাথ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছেন, তার সাথে একাত্ম হয়েছেন, এমনকি সে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার হিংস্রতার সাথেও তিনি নিজেকে শামিল করেছেন। কারও অজানা নয়, বঙ্কিম সাহিত্য হিন্দুদের হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং খুনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মূল উৎস।–[অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন লিখিত ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’, গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকার ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়’ শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।] বঙ্কিম “রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগাতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নজীর নেই। তিনি মানবতার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তারও তুলনা নেই। ‘রাজ সিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস দুটিতে তিনি মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষ শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় বৃটিশ জাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় বার বার মুখর হয়ে উঠেছিলেন”।–[‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’, সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৯।] বঙ্কিমের এই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করে মুসলমানদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা”।–[‘মুসলিম জননেতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী একটি বক্তৃতায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, “ভারতী পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।] মুসলমানদের সংহারকামী হিংস্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের জনক “শিবাজী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব আরও দুঃখজনক। বাংলাদেশের জন-মানুষের কাছে শিবাজী এবং শিবাজী বাহিনী ‘বর্গীদস্যু’ হিসাবে পরিচিত। যেহেতু ‘শিবাজী মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তাই শিবাজীবাদের প্রবক্তারা লুণ্ঠনকারী এক দস্যূকে জাতীয় বীর হিসাবে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে বিকৃত করেছিলেন”।–[‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ, সিদ্ধিকী বার এট ল, পৃষ্ঠা ৯৩ (উদ্ধৃতি)।] ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারও এই কথাই বলেছেন। তাঁর মতে “সেকালে বাংলায় আমাদের মহৎ বীরদের সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় রাজপুত, মারাঠা ও শিখ বীরদের জীবনী আমদানি করতে হয়েছে”।
জাতীয়তাবাদী নেতাগণ রাজনৈতিক গরজে সামগ্রিকভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে জনমনকে বিভ্রান্ত করতেন। এমনকি ‘শিবাজী উৎসবে’ মুসলমানকে টেনে আনার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করে ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা করতেন এবং ব্যাখ্যা দিতেন”।–[ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দিকী বার এট ল, পৃষ্ঠা ৯৩ (উদ্ধৃতি)।] ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা এবং ইতিহাসকে বিকৃত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছেন। শিবাজীর স্তুতিগান করে তিনি লিখেছেন,
“হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি—
এক ধর্ম রাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতে
বেঁধে দিব আমি। তারপর একদিন মারাঠার প্রান্তর হইতে
তব বজ্র শিখা
আঁকি দিল দিগ-দিগন্তে যুগান্তরে বিদ্যুত বহ্নিতে
মহামন্ত্র লিখা।
মোগল উষ্ণীয় প্রস্ফুরিল প্রলয় প্রদোষে
পুষ্প পত্র যথা
সেদিনও শোনেনি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে
কি ছিল বারতা”।–[‘অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, (আহসানুল্লাহ লিখিত) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৭৬।]
শিবাজীর শুধু স্তুতি নয়, ইতিহাস বিকৃতির পক্ষ নিয়ে শিবাজীর পক্ষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত ইতিহাসকারদের বিদ্রুপ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলে করে পরিহাস
অট্টহাস্য রবে—
তব পূণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস
এই জানে সবে।
অয়ি ইতিবৃত্ত কথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ
ওগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন-‘পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গ বাণী
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে
নিশ্চয় সে জানি”।–[‘অখন্ড বাংলার স্বপ্ন’, (আহসানুল্লাহ লিখিত) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৭৭।]
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের উৎকট ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তার প্রকাশ ঘটেছিল। স্বদেশ-জাতীয়তাকে আরাধ্য দেবীতে পরিণত করা হয়েছিল এবং এই আরাধ্য দেবীর জন্য প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার সব পণ করা হয়েছিল। যুগান্তর পত্রিকায় বলা হলো, “হে বাঙ্গালী, তুমি কি নর-কীট হতে জন্মেছিলে? –যখন বাঙ্গালাদেশ দু’ভাগ হল দেখে সাত কোটি বাঙ্গালী মর্মাহত হয়ে পড়লো, সেদিনকার কথা আজ একবার ভাব। সেদিন স্বদেশের জন্য কোটি কোটি হৃদয়ের ব্যাথা যেমনি এক হল, অমনি মাতৃরূপিনী স্বদেশ শক্তি পলকের মধ্যে বাঙ্গালা দেশের সর্বত্র আপনাকে প্রকাশ করিলেন, বাঙ্গালীও সর্বত্র আচম্বিত ‘বন্দেমাতরম’ বলিয়া উচ্চঃস্বরে মাকে আহবান করিল। –সেদিন যেন এক নিমিষের জন্যে বাঙ্গালীর কাছে মা আমার প্রকাশিত হয়েছিলেন, সেদিন যে বাঙ্গালী বড়ই ব্যথা পেয়েছিল, ভেবেছিল মা বুঝি দ্বিখণ্ড হয়েছে, তাই মা আত্মপ্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি দ্বিখণ্ড হই নাই, তোদের একত্র রেখে সহজেই শক্তিদান কর্তুম, আজ সেই বাঁধা ঘর শত্রুরা ভেঙ্গে দিলে মাত্র; যেদিন আমার জন্যে স্বার্থ ও সংসারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রাণ দিতে অগ্রসর হবি, সেদিন আবার সেই শক্তি তরংগ মাঝে আমার দেখা পাবি, আমি মরি নাই। –এস বাঙ্গালী আজ মার সন্ধানে বেরুতে হবে। সে বার মা আপনি এসে দেখা দিয়েছিলেন, এবার মার জন্য লক্ষ রুধিরাক্ত হৃদয়ের মহাপীঠ প্রস্তুত করে রেখে মাকে খুঁজে খুঁজে কারামুক্ত করে নিয়ে আসব। একবার সকলে বুকে হাত দিয়ে হৃদয়কে জিজ্ঞাসা কর দেখি, প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার, সমস্ত পণ করে আজ মার সন্ধানে বেরুতে পারবে কিনা? —বাঙ্গালীকে ‘বন্দেমাতরম’ মাতৃমন্ত্র শিখাইতে হইবে। ….সর্বাগ্রে মাকে সাক্ষাৎ বন্দনা কর, মাকে তাঁর উপযুক্ত আসনে অধিষ্ঠিত করিলে বিদ্যা, অর্থ, মোক্ষ, ইত্যাদি সবই ক্রমশ আসিয়া পড়িবে”।–[‘স্বাধীণতা আন্দোলনে যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১৪২, ১৪৬ (যুগান্তর পত্রিকার ‘যোগ ক্ষ্যাপার চিঠি’ নামক এই নিবন্ধের রচয়তা ছিলেন, দেবব্রত বসু, ঐ পৃষ্ঠা ১৬)।]
এই হিন্দু-জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সাথে রবীন্দ্রনাথও পুরাপুরি একাত্ম হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দুটি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করে নএবং বঙ্গ-ভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে তিনি ‘রাখি বন্ধন’ দিবস ঘোষণা করেন। ‘রাখি বন্ধন’ এর দিন সকালে গঙ্গাস্নানের মিছলের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটা প্রার্থনা সংগীত গাইলেন। সে প্রার্থনা সংগীতে তিনি বললেন—
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক।
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর পণ বাংগালীর আশা
বাংগালীর কাজ বাংগালীর ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর প্রাণ বাংগালীর মন
বাংগালীর ঘর যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।
এক সংগীত শেষে বীডন উদ্যানে ও অন্যান্য জায়গায় রাখবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার ‘বঙ্গভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক ভাবে ‘ফেডারেশন হলের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। এখানেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অভিভাষণ পাঠ করেন। বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে উল্লেখ করেন, “যেহেতু বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ করিয়াছেন সেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালী জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব”। (অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৮২, ৮৩) রবীন্দ্রনাথের এ কথা মিথ্যা হয়নি। ‘বন্দেমাতরম’ এর খন্ডিত মা’কে অখন্ড করার জন্যে ‘প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার’কে পণ করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল। “১৯০২ সালে তিনি (শ্রী অরবিন্দ) মারাঠী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে তার ছোট ভাই শ্রী যতীন মুখার্জীকে কলকাতায় পাঠান। এ সময়ে যোগেন্দ্র বিদ্যাভুষণ, জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত হন”।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ পুর্নেন্দু দস্তিদার।] রবীন্দ্রনাথ নিজেও একথা বলেছেন, “আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল, তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানরা তখন তাতেযোগ দেয়নি, বিরুদ্ধে ছিল”। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩) গুপ্তবিপ্লবী বা স্বদেশী বা সন্ত্রাসবাদী এই দল কতকটা বাম ঘেষা ছিল।–[‘বিপ্লবী দলের কাজকর্ম ইতালীর কার্বোনারী ও রাশিয়ার গুপ্ত সমিতি গুলোর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছিল’। (‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান’, পৃষ্ঠা ১১)।] তাই বলে ভাববার কোন কারণ নেই যে, এদের শরীরে কোনরূপ অসাম্প্রদায়িকতার নামগন্ধ ছিল। এদের লক্ষ্য যেমন ছিল ধর্মরাজ্য, তেমনি এরা কট্টর ধর্মনীতি অনুসরণ করতো। শ্রী নলিনী কিশোর গুহ তার ‘বাংলার বিপ্লববাদ’ (চতুর্থ সংস্করণ, ১৩৭৬ বাংলা, প্রকাক এক, মুখার্জি কোম্পানী প্রাঃ লিমিটেড, ২ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলিকাতা-২) বইয়ে বিপ্লবী দলের নতুন রিক্রুটদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের যে রীতি-নীতির বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে প্রমাণ হয় বিপ্লবী-স্বদেশীরা পুরোপুরি হিন্দু রীতি-আদর্শের দ্বারা পরিচালিত ছিল। শ্রী গুহ’র বর্ণনা: “বঙ্কিমচন্ত্র আনন্দ মঠে যে জমকালো প্রতিজ্ঞার নমুনা দেখাইয়াছেন, বিপ্লববাদীরাও সে প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে তাহারই অনুকরণ করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নেই। এখানে অনুশীলনের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের নমুনা দিতেছি। এখানে পুলিন বাবু স্বীয় দীক্ষা বা প্রতিজ্ঞা গ্রহণের বর্ণনা করিতেছেন, “পি. মিত্রের আদেশ মতে একদিন (কলিকাতায়) একবেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া সংযমী থাকিয়া পরের দিন গঙ্গাস্নান করিয়া পি, মিত্রের বাড়ীতে তাহার নিকট হইতে দীক্ষা লইলাম। ধূপ দীপ নৈবেদ্য পুষ্প চন্দনাদি সাজাইয়া ছান্দোগ্যোপনিষদ হইতে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করিয়া পি. মিত্র যজ্ঞ করিলেন, পরে আমি আলীঢ়াসনে বসিলাম, আমার মস্তকে গীতা স্থাপিত হইল তদুপরি অসি রাখিয়া উহা ধরিয়া পি মিত্র আমার দক্ষিনে দণ্ডায়মান হইলেন, উভয় হস্তে ধারণ করিয়া যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে কাগজে লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম। পরে যজ্ঞাগ্নির নমস্কার করিলাম।
—–পি. মিত্র যে পদ্ধতিতে আমাকে দীক্ষা দিয়াছেন গুপ্তচক্রের মধ্যে গ্রহণ করিবার পূর্বে আমিও অনুরূপ পদ্ধতিতে আমার বাসায় দীক্ষা দিতাম। এক সঙ্গে দীক্ষা দিতে হইলে ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে পুরাতন ও নির্জন ‘সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে’ যাইয়া একটু জাঁক-জমক করিয়াই দীক্ষা দিতাম। অর্থাৎ সংযম হবিষ্যাণ্ন গ্রহণ করিয়া প্রতিজ্ঞা করাইতাম’ —-পুলিন বাবু দীক্ষান্তে প্রত্যেক সভ্যকে পর্যাপ্তরূপে বিশুদ্ধ ঘৃত ও চিনিযুক্ত কাঁচা দুগ্ধসেবন করিতে দিতেন। এই সকল প্রতিজ্ঞা বা দীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিতে বঙ্কিমের আনন্দমঠের অনুকরণ লক্ষ্য করিবার’।–[‘বাংলার বিপ্লববাদ’, শ্রী নলিনী কিশোর গুহ, পৃষ্ঠা ৭৭, ৭৮।]
স্বদেশী বা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধর্মমত সম্পর্কে সুন্দর কথা বলেছেন, সাহিত্যিক গিরিজাশংকর রায় চৌধুরী। তিনি লিখছেন, “আমরা দেখিয়াছি, দেখিতেছি অরবিন্দ বঙ্কিম প্রদর্শিত জাতীয়তাকেই সজ্ঞানে ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দ হইতেই অনুসরণ করিতেছেন। ব্রাহ্ম সমাজের বা মুসলমানদের ধার তিনি ধারেন না। তিনি একপায়ে দাঁড়াইয়া বগলামন্ত্র জপ ও বগল মূর্তি পূজা শেষ করিয়া আসিয়াছেন। —গুপ্ত সমিতিতে মা কালীও আছেন এবং শ্রী গীতাও আছে। এতে মুসলমান ভ্রাতাগণ যদি বলেন যে, ‘এ ব্যবস্থায় দেশ উদ্ধারের জন্য আমরা যা-ই বা কি করিয়া, আর থাকিই বা কোন মুখে?”-[‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার স্বদেশী যুগ’, গীরিজা শংকর রায় চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৪৫২, ৪৫৩।]
স্বদেশী আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে এর চেয়েও সুন্দর ও স্পষ্ট কথা বলেছেন ভারতের কম্যুনিষ্ঠ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদ তার ‘কম্যুনিষ্ট পার্টি এবং আমার জীবন’ বইতে। তাঁর কথা, “বিখ্যাত সন্ত্রাসবাদী দল ‘অনুশীলন’-লিখিত ঘোষণা পত্রে সমিতির একটি উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের পদানত করে রাখা এবং প্রত্যেক সন্ত্রাসবাদী দলের শর্ত ছিল, অহিন্দুদের প্রবেশ’ নিষেধ”।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’ গ্রন্থে উদ্ধৃত, বিমলানন্দ শাসনামল, পৃষ্ঠা ১০৬।]
রবীন্দ্রনাথের মত কথিত ‘মানবতাবাদী’ ব্যক্তিরা হিংস্র, উগ্র হিন্দু জাতীয় উত্থানের সাথে জেনে-শুনেই নিজেদের শামিল করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের যে ‘জাতীয়তাবাদ’ বিরোধিতা, সেটা হতে পারে কোন কাব্যিক সৌখিনত্ব।
১৯০৫ সালের আগষ্টে মূখ্যত বঙ্গভঙ্গ রদের জন্যে যে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলো, তার দুইটি রূপ। একটি প্রকাশ্য, অন্যটি গোপন। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে চলল স্বদেশী নামের রাজনৈতিক আন্দোলন। অন্যদিকে গুপ্ত সমিতি অনুশীলন সমিতির মাধ্যমে চলল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। বালগঙ্গার তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, লাল লাজপাত রায়, চিত্তরঞ্জন দাস, সরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছিলেন।
১৯০৭ সালের শেষের দিক থেকে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা জোরদার হয়ে উঠল। বাংলার বড়লাট অ্যান্ডু ফ্রেজারের বিশেষ রেলগাড়ির উপর কয়েকবার হামলা হলো। চন্দননগরের কাছে পরপর দু’বার এবং নারায়ণ গড়ে আরেকবার হামলার কাজে ডিনামাইট ব্যবহার করা হয়েছিল। সময়টা ছিল ১৯০৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর। বারিন ঘোষের দল এই তৎপরতা চালায়। টার্গেটদের হত্যার জন্যে পার্সেল বোমাও ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের একটা বোমা বুক-পার্সেল আকারে পাঠানো হয়েছিল কিংসফোর্ডের কাছে। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে চন্দননগরের মেয়রের উপর বোমা হামলা চালানো হলো। ঠিক এই সময়েই বোমা হামলার শিকার হলো কিংসফোর্ডের গাড়ী। কিন্তু বোমাটি কিংসফোর্ডের গাড়ীতে না লেগে আঘাত করল অন্য একটি গাড়ীকে। এ গাড়ীতে আরোহী ছিলেন দু’জন শ্বেতাংগ মহিলা। দু’জনেই নিহত হলো। ঘটনাটা ঘটেছিল মোজাফফরপুর নামক স্থানে। প্রফুল্ল চাকি ও ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন এই হামলার নায়ক। ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়লেন, কিন্তু প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়ার আগেই নিজের গুলীতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিলেন। বিচার হলো ক্ষুদিরামের। বিচারে তার ফাঁসি হলো।
মোজাফফরপুরের ঘটনা ইংরেজ সরকারকে দারুণভাবে বিচলিত করেছিল। গুপ্ত আন্দোলনের লোকদের ধরার জন্যে সরকারের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হন্যে হয়ে উঠল। ঘটনার ২দিন পরেই (২রা মে ১৯০৮) সুপরিকল্পিত ভাবে পুলিশের আটটি দল গুপ্ত সমিতির আটটি ঘাটিতে হানা দিল। ধরা পড়ল গুপ্ত সমিতির সদস্যদের ২৫ জন।–[ধৃতব্যক্তিরাঃ বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, শিশির কুমার ঘোষ, বিভূতিভূষন সরকার, নলিনীকান্ত গুপ্ত, বিজয় কুমার নাগ, উল্লাসকর দত্ত, ইন্দুভূষন রায়, পরেশচন্দ্র মল্লিক, শচীন্দ্র কুমার সেন, কুঞ্জলাল সাহা, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যয়, পূর্ণ চন্দ্রসেন, নরেন্দ্রনাথ বঙ্গী, হেমেন্দ্র কুমার ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যয়, ধরণী নাথ গুপ্ত, অশোক চন্দ্র নন্দী, বিজয় রত্ন সেনগুপ্ত, মতিলাল বসু, অরবিন্দু ঘোষ, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র দাস, কানাইলাল দত্ত এবং নিরাপদ রায়। এ ছাড়া নরেন্দ্র নাথ গোঁসাই, ঋষিকেশ কাঞ্জিলাল সহ আরও ৯ জন ধরা পড়ল পরে। (‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান’, পৃষ্ঠা ৩৫)।] এদের সাথে অরবিন্দ ঘোষও ধরা পড়লেন। সর্বমোট ৩৬ জনের বিরুদ্ধে আলীপুর কোর্টে মামলা দায়ের হরো। ১২৬ দিন শুনানির পর ১৯০৯ সালের ১৪ই এপ্রিল রায় হলো। ফাঁসির আদেশ হলো বারীন ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের।–[পরে হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসির আদেশ বাতিল হয়।] কয়েকজনের হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অবশিষ্টরা বেরিয়ে এলেন দোষ প্রমাণ না হওয়ায়। ইংরেজ সরকার যাকে ধরা ও শাস্তি দেয়ার জন্য সবচেয়ে উদগ্রীব ছিল, সেই অরবিন্দ ঘোষও এদের মধ্যে শামিল ছিল। শ্রী অরবিন্দের পক্ষে চিত্তরঞ্জনদাস যে আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে মামলা পরিচালনা করেছিলেন, তা ছিল এক অনন্য ঘটনা। অরবিন্দ সম্পর্কে বিচারক বিচক্রফটকে সি, আর, দাস অত্যন্ত আবেগ ভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, “যখন সমস্ত তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটবে, যখন উত্তেজনা ও আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং যখন তিনি আর এই মাটির পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন না তারও বহু পরে মানুষ বলবে তিনি ছিলেন স্বদেশ প্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের কবি এবং মানবতার পূজারী। তার দেহাবসানের বহু পরে শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সুদূর সাগর পারের নানা দেশেও তার বাণী ধ্বণিত ও প্রতিধ্বনিত হবে”।–[‘Sir Aurubindo’s Political Thought’, Uma Mukhapadhay & Haridas Mukhopadhay, Page 17.] শিবাজীর চিন্তা, চেতনা ও সংগ্রামের উত্তরসূরী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ সম্পর্কে চিত্তরঞ্জন দাসের এই ধারণা ও মন্তব্য লক্ষ্য করবার মত।
গুপ্ত সমিতির ঐ বিপ্লবীরা ধরা পড়ার পর সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়ল। শ্রী অরবিন্দ জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন, ‘স্বাধীনতার গতিবেগ স্তব্ধ করার জন্য ইংরেজ সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। সভাসমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে, জাতীয় শক্তির কেন্দ্রগুলো একে একে আক্রান্ত ও বিচূর্ণ, জনপ্রিয় নেতারা কারারুদ্ধ বা বহিস্কৃত এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কণ্টকিত ও বিঘ্নিত। কলিকাতা ও ঢাকার অনুশীলন সমিতি, বাকেরগঞ্জের ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’, ফরিদপুরের ‘ব্রতি সমিতি’, ময়মনসিংহের ‘সুহৃদ সমিতি’ ও ‘সাধনা সমাজ’ সরকারী আদেশে বন্ধ ঘোষিত। অরবিন্দ জেলে যাবার পূর্বে, ১৯০৮ সনে বাংলার আকাশে-বাতাসে শুনতে পেয়েছিলেন ‘বন্দেমাতরমের জয়ধ্বনি, কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে এসে, ১৯০৯ সনে, তিনি লক্ষ্য করলেন সেই মাতৃমন্ত্র ক্ষীণ।–[‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর পত্রিকার দান’, পৃষ্ঠা ৪০।]
এভাবেই স্বদেশী আন্দোলনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার একটি পর্যায় স্তিমিত হয়ে পড়ল। এই তৎপরতা কি ব্যর্থ হয়েছিল? না ব্যর্থ হয়নি। এই আন্দোলনের ফলে ইংরেজ সরকার হিন্দুদের মনোভাব টের পেয়েছিল। ইংরেজ সরকার ভীতও হয়েছিল। ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদের যে সিদ্ধান্ত নেয়,তার পিছনে এর ব্যাপক প্রভাব ছিল।–[‘একদিকে সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা এবং অপরদিকে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিন চন্দ্র পাল, আশ্বীনীকুমার দত্ত প্রভৃতির নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ সংগ্রাম এক উচ্চতর রাজনৈতিক পর্যায়ে উপনীত হয়’। (‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ৯৫)।]
সন্ত্রাসী তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়লেও সন্ত্রাসী আন্দোলনের নেতারা বিশেষ করে শ্রী অরবিন্দ তার তৎপরতা বন্ধ করেননি। স্বদেশী আন্দোলনের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে, তিনি সরব থাকলেন। কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ‘দি বেঙ্গলী’, কৃষ্ণকুমার মিত্রের ‘সঞ্জীবনী’ এবং কুমুদিনী মিত্রের ‘সুপ্রভাত’ প্রভৃতি কাগজে শ্রী অরবিন্দ লিখে চললেন। বক্তৃতা করতে থাকলেন, ‘গো রক্ষিণী’ ও ‘স্বদেশী সভা’য়। ১৯০৯ সালে ৩০ শে মে ‘গো রক্ষিণী সভা’র এক বক্তৃতায় তিনি বাল গঙ্গাধর তিলকের সহযোগী বাংলার কংগ্রেস নেতা বিপিনচন্দ্র পালকে অভিহিত করলেন One of the mightest prophets of Nationalism’, অর্থাৎ কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাঁধে তুলে দিতে এগিয়ে এলেন।
কংগ্রেস নেতারাও এগিয়ে গেলেন। এ সময় হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষণের বিশেষ উদ্দেশ্য গঠিত হলো হিন্দু মহাসভা। ‘অনেক কংগ্রেস নেতাও হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেন। কংগ্রেসের উচ্চ নেতৃস্থানে অবস্থান করেও যারা হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন এই সমর্থন তারাই জ্ঞাপন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মদনমোহন মালব্য, লালা লাজপতরায়, বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ।–[‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ৮৯।] দুইটি বিষয় এই হিন্দু মহাসভা গঠনের কাজকে ত্বরান্বিত করেছিল। একটি ১৯০৯ সালের মর্লি-মিণ্টো সংস্কারে মুসলমানদেরকে পৃথক নির্বাচন ও স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের সুবিধা দান। দ্বিতীয়টি হলো গুপ্ত সন্ত্রাসী আন্দোলন স্তিমিত হড়ে পড়া। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংস্থা গঠনের মাধ্যমে গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি, অনুশীন সমিতি অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অনুপস্থিতি জনিত শূন্যতা পূরণ করা এবং মর্লি-মিণ্টোর সংস্কারকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিরোধী আন্দোলন জোরদার করা যা কংগ্রেসকে সাহায্য করবে।
কংগ্রেস এ সাহায্য পেয়েছিল। স্বদেশীদের সাহায্য পুষ্ট হয়ে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। এই চাপই ইংরেজ সরকারকে বাধ্য করল বঙ্গভঙ্গরদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। স্বয়ং বৃটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের বক্তব্যেই এর নিশ্চিত প্রমাণ মিলে। সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের ভাইসরয়, লর্ড হার্ডিঞ্জকে লিখেন, “আমি আশা করি আপনি ভারতের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করে সম্রাটের প্রথম ভারত সফরকে কিভাবে অবিস্মরণীয় করে রাখা যায় সে সর্বাত্মক কর্মসূচী প্রণয়ন ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে যত্নবান হবেন। বাঙালীদের (বাংগালী হিন্দু) সন্তুষ্ট করার জন্যে বোম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর মত উভয় বাংলাকে একত্র করা যায় কিনা সে বিষয়েও বিচার বিবেচনা করবেন। —বাংলার বিরাজমান অসন্তোষ, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ উপশম এবং দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার লাঘবে এই পদক্ষেপ একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি”।–[ভাইসরয়ের প্রতি সম্রাট, ডিসেম্বর ১৬, ১৯১০, HP. ১০৪ (‘বঙ্গভঙ্গ’, মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা ৭৭, ৭৮)।]
হিন্দুদের চাপই অবশেষে কার্যকরী হয়েছিল। সম্রাট যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ভাইসরয়-এর কাছে, তা-ই তিনি কার্যকরী করেছিলেন ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তাঁর দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দানের মাধ্যমে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের চাপ ও অসন্তোষের কথা বিবেচনা করা হলো, কিন্তু মুসলমানদের হৃদয় যে ভেংগে গেল তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হলো না। এইভাবে হিন্দুদের হিংসারই জয় হলো।–[‘বাঙালী হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করায় প্রধান কারণ ছিল, পূর্ব বঙ্গে বাঙালী মুসলমানরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে, সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন’।, (পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’, আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ১১০)।] কিন্তু এই হিংসা দুই জাতিকে দুই প্রান্তে ঠেলে দিল। ‘১৯০৫-এর বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতবর্ষে সৃষ্টি করলো দুটি জাতীয়তাবাদ-একটি হিন্দু, অপরটি মুসলমান’।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল’ হিন্দুস্তান বুক সার্ভিস, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৪।] শুধু তাই নয় ডঃ আম্বেদকরের মতে বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করে এবং সেই সঙ্গে স্বরাজলাভের দাবী করে তারা (হিন্দুরা) একদিন মুসলমানদের পূর্ব ও পশ্চিম উত্তর ভারতের শাসক করে তুলবেন।–[‘পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, ‘ডঃ আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ১১০। সিলেবাস বিতর্ক এবং অতীত ষড়যন্ত্রের কাহিনী’ শীর্ষক নিবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন। তার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় দৈনিক সংগ্রামের ২৬শে এপ্রিল, ১৯৯৩ সংখ্যায়।] ডঃ আম্বেদকরের এই উক্তির অর্ধেকটা সত্যে পরিণত হয়েছে ইতিমধ্যেই।
সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হিংসা এবং মুসলমানদের সর্বনাশ দেখার জেদ বঙ্গভঙ্গ রদ করেই শেষ হয়ে গেলনা এবং মর্লি-মিণ্টো সংস্কারের পৃথক নির্বাচন ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব-সুযোগের বিরোধিতা অব্যাহত রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলোনা, মুসলিম বিরোধী তাদের সহিংস মন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তও মেনে নিতে পারলো না। উল্লেখ্য, বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলমানদের স্বান্তনা দেবার জন্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ভারত সরকার ১৯১২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ঘোষণা করেন।
এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ল হিন্দুরা। ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তারা সভা করল। এই সভায় সভাপতিত্ব করলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ।–[এই তথ্যাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাব আব্দুন নুর তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি…………………………………………..] বিস্ময়ের ব্যাপার, পূর্ববঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জমিদারি চিল, সে রবীন্দ্রনাথও তার মুসলিম প্রজারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হোক তা চাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেদিন একাট্টা হয়ে প্রচারে নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলো। হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন শহরে মিটিং করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করে পাঠাতে লাগলেন বৃটিশ সরকারের কাছে।–[দ্রষ্টব্যঃ Calcutta University Commission report. Vol. IV পৃষ্ঠা ১১২, ১৫১।] ‘এভাবে বাবু গিরীশচন্দ্র ব্যানার্জী, ডঃ স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারক লিপি সহকারে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর উপর চাপ সৃষ্টি করলেন। ডঃ স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে হিন্দু প্রতিনিধিগণ বড় লাটের কাছে এই বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করলেন যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ অধিকাংশই কৃষক। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে তাদের কোন উপকার হবে না।–[দ্রষ্টব্যঃ Calcutta University Commission report. Vol. IV পৃষ্ঠা ১১৩।] বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে সব হিন্দু যেমন এক হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ক্ষেত্রেও তাই হলো। পূর্ববঙ্গের, এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বাধা দেবার জন্যে এগিয়ে এল। ‘A History of Freedom Movement’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, The Controversy that started on the Proposal for founding a university at Dacca, throws interesting on the attitude of the Hindis and Muslims. About two hundred prominent Hindis of East Bengal, headed by Babu Ananda Chandra Ray, the leading pleder of Dacca, submitted a memorial to the Viceroy vehemently against the establishment of a University at Dacca For a long time afterwards. They tauntingly termed this University as ‘Mecca University’.-[‘A History of the Freedom Movement’, গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের Dacca University; Its role in Freedom Movement’ শীর্ষক অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১০ (Published in 1970).] অর্থাৎ ‘ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব যে বিতর্কের সৃষ্টি করল তাতে হিন্দু ও মুসলমানদের ভূমিকা সম্পর্কে মজার তথ্য প্রকাশ পেল। পূর্ব বাংলার প্রায় দুই’শ গণ্যমান্য হিন্দু ঢাকার প্রখ্যাত উকিল বাবু আনন্দ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করে ভাইসরয়কে একটি স্মারক লিপি দিয়েছিল। পরে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে বিদ্রুপ করা হতো’।
হিন্দুদের এই সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের বিরোধিতা ও ঘৃণা তারা অব্যাহতই রাখল। এর একটা সুন্দর প্রমাণ পাই আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি অধ্যাপক শ্রী দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর’ এর বক্তব্যে। শ্রীভাণ্ডারকর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তার এক বক্তৃতায় বলেন “কলিযুগে বৃদ্ধগঙ্গা নদীর তীরে হরতগ নামক একজন অসুর জন্ম গ্রহণ করবে। মূল গঙ্গার তীরে একটি পবিত্র আশ্রম আছে। সেখানে অনেক মুনি-ঋষি এবং তাদের শিষ্যগণ বাস করে। এই অসুর সেই আশ্রমটি নষ্ট করার জন্যে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে একে একে অনেক শিষ্যকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যাবে। যারা অর্থ লোভে পূর্বের আশ্রম ত্যাগ করে এই অসুরের আকর্ষণে বৃদ্ধ গঙ্গার তীরে যাবে, তারাও ক্রমে অসুরত্ব প্রাপ্ত হবে এবং তারা অশেষ দুর্দশাগ্রস্ত হবে’।–[শ্রী ভাণ্ডারকর এই উক্তিটি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার স্মৃতিকথা ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ উল্লেখ করেছেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সভায় শ্রী ভাণ্ডারকরের এ উক্তি করেন, সে সভায় ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।]
পরিস্কার যে, শ্রী ভাণ্ডারকর এই বক্তব্যে ‘হরতগ’ বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর মিঃ ফিলিপ ‘হরতগ’ কে বুঝিয়েছেন। মিঃ হরতগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। শ্রী ভাণ্ডারকরের বক্তব্যে হরতগ-এর ‘আশ্রম’ বলতে বুঝানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আমাদের ‘বুড়িগঙ্গা’ হয়েছে শ্রী ভাণ্ডারকরের বক্তব্যে ‘বৃদ্ধাগঙ্গা’। আর মূল গঙ্গা-তীরের ‘পবিত্র আশ্রম’ বলতে শ্রী ভাণ্ডারকর বুঝিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। শ্রী ভাণ্ডারকরের কথায় ঢাকা অর্থাৎ পূর্ববাংলা অসুরদের স্থান। পবিত্র স্থান কলকাতা থেকে যেসব ঋষি শিষ্য ঢাকায় চাকুরী করতে আসবেন তারাও অসুর হয়ে যাবে। এ থেকেই বুঝা যায়, মুসলমানদর প্রতি শ্রী ভাণ্ডারকরদের বৈরিতা কত তীব্র, ঘৃণা কত গভীর।
তাদের এ বৈরিতার কারণে উপযুক্ত বরাদ্দের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভীষণ অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয় এবং অঙ্গহানিও হয়েছিল। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর ভাষায় “(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়) মুসলমানরা খুবই খুশী হলেন বটে, কিন্তু হিন্দুদের মনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। সাধারণত যারা রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকতেন, তারাও এবার এই প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাস বিহারী ঘোষ ও গুরুদাস বন্দোপাধ্যয়। তাদের প্রধান যুক্তি হলো এই যে, প্রশাসন ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এখন একটি সাংস্কৃতিক বিভাগ করা হচ্ছে। ফলে, এতে গুরুতর বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হিন্দুদের এই বলে আশ্বাস দিলেন যে, তাদের এম আশংকার কোন কারণ নেই। ঢাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার ক্ষমতা ও অধিকার ঢাকা শহরের দশ মাইল পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে”।–[‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এই ভাবে হিন্দুরা একে ‘ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সিন্ডিকেটে হিন্দু যারা নির্বাচিত হয়ে আসতেন তারাও বিশ্ব-বিদ্যালয়ের বৈরিতা ত্যাগ করতেন না, তাদের ভোট বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করারই চেষ্টা করত। ডক্টর রমেশচন্দ্র লিখছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (সিনেটর) সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক ছিলো মুসলমান এবং অর্ধেক ছিলেন হিন্দু। প্রফেসররা কোর্টের সদস্য ছিলেন। বার লাইব্রেরীর অনেক উকিল রেজিষ্টার্ড গ্রাজুয়েটদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে এর সভ্য হতেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকে হিন্দুরা ভাল চোখে দেখেনি, একথা পূর্বেই বলেছি। কারণ হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল বঙ্গভঙ্গ রহিত রকায় মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে, অনেকটা তা পূরণ করার জন্যই এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রীতির চোখে দেখেননি। বাইরে এ বিষয়ে যে আলোচনা হত কোর্টের সভায় হিন্দু সভ্যতের বক্তৃতায় তা প্রতিফলিত হত। অবশ্য ভোটের সময় জয়লাভের ব্যাপারে আমরা অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম। মুসলমান সদস্য এবং হিন্দু শিক্ষক সদস্যরা একত্রে হিন্দু সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশী ছিলেন”।–[‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।]
সংখ্যাগুরু হিন্দুরা মুসলমানদের কোন ভালই সহ্য করতে পারেনি। মুসলিম লীগ গঠন তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল, মর্লি-মিণ্টোর শাসন-সংস্কারে মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তারা বরদাশত করেনি, বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানদের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে তারা সহ্য করতে পারেনি এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের সহ্য হলোনা। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু মনোভাব সবচেয়ে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে ‘গুরুতর বিপদ’ অবলোকন করেছে। এই ‘গুরুতর বিপদ’টা কি? সেটা মুসলমানদের উন্নতি ও উত্থান। অর্থাৎ হিন্দুরা হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের অস্তিত্বের বিরোধী, যা মাথা তুলেছিল শিবাজী, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, শ্রী অরবিন্দের আন্দোলনে। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উত্থিত এই সংহার মূর্তিই সেদিন মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের আত্মরক্ষার সংগ্রামকেই অপরিহার্য করে তুলেছিল।