হিন্দু মুসলিম সহযোগিতার বিদ্যুৎ চমক
হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল ১৯০৯ সালের মধ্যেই, যদিও এর স্মৃতি ইংরেজদের তাড়া করে ফিরেছিল অনেকদিন, যার একটি ফল বঙ্গভঙ্গ রদ। তবু স্বদেশীরা সন্ত্রাসের মাধ্যমে স্বরাজ আনতে পারে না। একথা ভালোভাবেই তখন বুঝা গিয়েছিল। কংগ্রেসের মাধ্যমে স্বদেশীদের রাজনৈতিক উন্মাদনা সৃষ্টিও বন্ধ হয়ে গেল বঙ্গভঙ্গের পর।–[১৯০৮ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে বিপর্যয় নামার পর কংগ্রেসের উগ্রপন্থীদের সুর একটু নরম হয়ে গেল এবং কংগ্রেসের সাথে তাদের অবস্থানও কিছুটা আলগা হয়ে গেল। (দ্রষ্টব্যঃ ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, ইয়াসমিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৯৮)।] তাদের ‘বন্দে মাতরম’ বঙ্গভঙ্গ রদ করাল বটে, কিন্তু তাদের স্বরাজ চিন্তার চাকাকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে নিতে পারল না। উপরন্তু মর্লি-মিণ্টো সংস্কারের মাধ্যমে মুসলমানরা পৃথক নির্বাচন ও স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের অধিকার পেয়ে গেল, যা প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস-স্বদেশীর জন্যে বঙ্গভঙ্গের চেয়ে ছেঅট আঘাত ছিল না। যে মুসলমানদের অস্তিত্বই তারা মিটিয়ে দিতে চায়, তারা পেয়ে গেল জাতি-স্বাতন্ত্রের বড় ধরনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এতে কংগ্রেস স্বদেশীরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, কিন্তু করার কিছুই ছিল না। ঠাণ্ডা মাথার হিন্দু নেতৃত্ব মনে করল, তাদের এই বিক্ষোভ, এই ক্রোধ মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে আরও পরিস্ফুট, আরও চিহ্নিত করবে। মুসলমানদের কাছে নিয়ে আসা, হাতের মুঠোয় নিয়ে আসাকে তারা সমাধান ভাবল। তারা ভাবল, মুসলমানদের বাইরে কিংবা প্রতিপক্ষ রেখে তাদের স্বরাজ চিন্তা খণ্ডিতই থেকে যাবে। গোপাল কৃষ্ণ গোখলে-এর মত নেতা স্পষ্টতই বললেন, মুসলমানদের সহযোগিতা ও সমর্থন ব্যতীত কংগ্রেসের স্বায়ত্ব শাসনের দাবী সরকারের নিকট কোনরূপ গুরুত্ব লাভ করবে না।–[‘বাংলাদেমের ইতিহাস’, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫৪০।] এইভাবে অনেক হিন্দু নেতা মুসলমানদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছার জন্য উদগ্রীব হলেন।–[‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫৩৯।]
অন্যদিকে মুসলিম লীগও কংগ্রেসের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাইল। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে কিছুটা পরিবর্তন এর একটা কারণ। মুসলিম স্বার্থের আপোষহীন নেতা নবাব সলিমুল্লাহ রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন। নবাব মুহসিনুল মুলক মারা গেলেন। নবাব ভিখারুল মুলক এবং সৈয়দ আহমদ বিলগ্রামীকে অন্য দায়িত্বের কারণে মুসলিম নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হলো। তারপর ১৯১৩ সালে সৈয়দ আমীর আলী ও মওলানা মুহাম্মদ আলীর অনুরোধে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগদান করলেন, কিন্তু কংগ্রেস থেকৈ তিনি পদত্যাগ করলেন না। অর্থাৎ তিনি মুসলিম লীগ করতে লাগলেন, কিন্তু কংগ্রেসেও রয়ে গেলেন। কায়েদে আযম মুসলিম লীগে প্রবেশের সময় পরিস্কার শর্ত দিলেন, মুসলিম লীগ ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি তাঁর আনুগত্য বৃহত্তর জাতীয় কার্যক্রমের অর্থাৎ কংগ্রেসের প্রতি তাঁর আনুগত্য কিছুইমাত্র ব্যাহত করবেনা।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, ইয়াসমিন আহমদ, পৃষ্ঠা ২০০। ‘মুহাম্মদ আলী জিন্নাহঃ এমবেসেডর অব হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি’, সরোজিনী নাইডু (উদ্ধৃত ‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’ গ্রন্থে, পৃষ্ঠা ১৬৭)।] এছঅড়া বাংলার মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নবাব সলিমুল্লার পর এ.কে ফজলুল হকই প্রধান হয়ে উঠলেন। ১৯১২ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি সামনে এসে গেলে নএবং নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর মত নেতা পেছনে পড়ে গেলেন। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের এই পরিবর্তন মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের নিকটবর্তী করল। মুসলিম জনমত ও মুসলিম লীগের নীতিতেও এই সময় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বঙ্গভঙ্গ রদ এবং ঢাকা ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গড়িমসি এবং বলকান যুদ্ধে তুরস্কের প্রতি বৃটিশ আচরণ মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এর সাথে যোগ হল আরো একটা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুর হলো। তুরস্কের খলিফা বৃটিশের বিরুদ্ধে জার্মানীর পক্ষে যোগ দিলেন। ভারতের মুসলমানরা বিপদে পড়ে গেল। একদিকে তাতের শাসক বৃটিশকে সমর্থন করার বাস্তবতা, অন্যদিকে ইসলামী বিশ্বের খলিফাকে সমর্থন করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা। অবশেষে মুসলমানদের রায় বৃটিশের বিপক্ষেই গেল। অবশ্য এ ব্যাপারে কায়েদে আযম নিরব থাকার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম নেতৃত্ব এটা মেনে নিলেন না। মুসলিম পত্রিকাগুলো বৃটিশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল এবং আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। এই আন্দোলনের উদ্যোক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার হলেন মওলানা শওকত আলী, মওলানা মহম্মদ আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা জাফর আলী খান, মওলানা আকরাম খান ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ এবং বন্ধ করে দেয়া হলো মুসলিম সংবাদপত্রগুলো। ইংরেজ সরকারের এই পদক্ষেপ মুসলমানদের আরও ইংরেজ বিদ্বেষী করে তুলল। এই অবস্থায় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিক ভাবেই বৃটিশের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে এক সমঝোতা গড়ে তোলার জন্যে আরও বেশি তাগিদ অনুভব করলেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন কায়েদে আযম। তাঁর সামনে স্থির দু’টি লক্ষ্য ছিল- এক, স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার তথা স্বাধীনতা অর্জন। দুই, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সাধন।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, (কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’, অধ্যায় দ্রষ্টব্য) পৃষ্ঠা ১৯৯।] তাঁর বক্তব্য ছিল –হিন্দু মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং সর্বপ্রকার শাসনতন্ত্র সম্মত ও বৈধ পন্থায় যত শীঘ্র সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রিশ কোটি লোকের ঐক্যবদ্ধ দাবী এমন একটা শক্তি সৃষ্টি করবে যা পৃথিবীর কোন শক্তি প্রতিরোধ করতে পারবে না।
এইভাবে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস একে অপরের দিকে এগয়ে আসার ফলে একটা ঐতিহাসিক সমঝোতা সৃষ্টি হলো। এরপর মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সম্মেলন একই শহরে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হতে লাগল এবং নেতারা একে অপরের সম্মেলনে যোগ দিতে লাগলেন। এ ধরনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো বোম্বাইয়ে ১৯১৫ সালে। উল্লেখ করার মত বিষয় হলো, সরোজিনী নাইডু এবং রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠাকামী চরম হিন্দুবাদী নেতা মদনমোহন মালব্য মুসলিম লীগের সম্মেলনে গিয়েছিলেন। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বোম্বাই সম্মেলনে কায়েদে আযম সাংবিধানিক সংস্কারের জন্যে একটা যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটা কমিঠি গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। সাংবিধানিক সংস্কারের এ প্রস্তাব উভয় দল কর্তৃক গৃহীত হলো, যার ফল ছিল লাক্ষ্ণৌ প্যাক্ট। ১৯১৬ সালে লাক্ষ্ণৌতে একই সময়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অধিবেশন বসল। কংগ্রেস অধিবেশনে অম্বিকাচরণ এবং মুসলিম লীগ অধিবেশনে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সভাপতিত্ব করলেন। এই অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাক্ষ্ণৌ প্যাক্ট সম্পাদিত হলো মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে। এই চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কংগ্রেস প্রত্যেক প্রদেশে মুসলিম লীগের পৃথক নির্বাচন ও পৃথক প্রতিনিধিত্বের দাবী স্বীকার কলে নিল। এর মাধ্যমে ১৯০৯ সালে মর্লি-মিণ্টোর শাসন সংস্কারে মুসলমানদের পৃথক প্রতিনিধিত্ব ও পৃথক নির্বাচনের দাবী কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ করল। অর্থাৎ জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অধিকারের দাবী কংগ্রেসের কর্তৃক স্বীকৃত হলো। অন্যদিকে মুসলিম লীগ তাদের বিশেষ দাবীর ক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রদর্শণ করল। বাংলায় ৪০ শতাংশ এবং পাঞ্জাবে ৫০ শতাংশ মুসলিম প্রতিনিধিত্বের বিষয় মুসলিম লীগ স্বীকার করে নিল এবং সংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবী পরিত্যাগ করল। মুসলমানদের ধর্ম-সংস্কৃতির উপর সংখ্যাগুরুদের হস্তক্ষেপ হতে পারে, এ ভয় মুসলমানদের ছিল। এ ভয় দূরীকরণের জন্যে ঠিক হলো যে, ‘কোন সম্প্রদায় সম্পর্কে কোন প্রস্তাব সেই সম্প্রদায়ের তিন চতুর্থাংশ সদস্যের বিরোধিতা থাকলে গৃহীত হবে না’।–[‘History of Freedom Movement in India’, Tarachand, Vol-3, Page 414.] লাক্ষ্ণৌ চুক্তিকে অনেক ঐতিহাসিক মুসলমানরেদ জন্যে কুটনৈতিক বিজয়,-[‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫৪০।] বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বাংলার মুসলমানরা এই চুক্তিতে খুব সন্তুষ্ট হয়নি। বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যায় শতকরা ৫৪ ভাগ। কিন্তু চুক্তি অনুসারে আইন পরিষদের তারা আসন পেল শতকরা ৪০ ভাগ। নওয়াব আলী চৌধুরীর মত মুসলিম নেতারা এ চুক্তির সমালোচনা করলেন। বাংলার বিভিন্ন পত্র পত্রিকা এবং লেখাতেও এর সমালোচনা করা হলো। বলা হলো, “ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মোসলেম নিতান্ত কম বিধায় সেই সব প্রদেশের হিন্দুগণ প্রতিবেশী মোসলেমকে রাজকীয় অধিকার কিঞ্চিত বাড়াইয়া দিয়াছেন, তজ্জন্য উৎকোচ অথবা ঘুষের স্বরূপ বঙ্গীয় হিন্দুগণ বঙ্গীয় মোসলেমের জন্মগত অধিকার শতকরা ৫৪ অংশ হইতে ১৪ অংশ গ্রহণ পূর্ব বঙ্গীয় মোসলেমের মাথা কাটিয়া মাত্র শতকরা ৪০ অংশে আনয়ন করিয়াছেন। এটা মোসলেমের প্রতি ঘোরতর অবিচার করা হইয়াছে। হইতে পারে এই ব্যাপারে বাঙ্গালার পক্ষের মোসলেম নামধারী লোকও ছিলেন। জিজ্ঞাসা করি, তাঁহারা কি কখনও গরীবের ধার ধারেন? সেরূপ মনে হয়না। এতিম অর্থাৎ অভিভাবক হীন বঙ্গীয় গরীব মোসলেমের সম্পত্তি এরূপভাবে কেহ হস্তান্তর করিলেও তাহা গ্রহ্যা হইবে না”।–[‘পথিক’ পত্রিকা, আষাড়-শ্রাবণ সংখ্যা, ১৩৩২ সাল প্রবন্ধের নাম ছিল ‘অকর্তব্য’ লেখক সাঈদ উদ্দীন আহমদ। পরে প্রবন্ধটি লেখকের ‘রাজমুকুট’ গ্রন্থে সংকলিত হয়, পৃষ্ঠা ৩০, ৩১। ‘রাজমুকুট’, প্রকাশিত হয় ২২শে জুলাই, ১৯২৫।] আরও বলা হলো, “বঙ্গীয় মোসলেম হিন্দুর থেকে নিতান্তই হীনবল, সাধারণ কোন অধিকারও তাহারা হিন্দুর নিকট হইতে প্রতিযোগিতা করিয়া লইত পারেন না। কতবার কংগ্রেস হইল, কত লীগ বসিল আবার বঙ্গ সরকার রাজ্যের উন্নতিকল্পে কত রকমে কত মাথা খাটাইলেন, কিন্তু কিছুতেই বঙ্গীয় মুলেমের সম্বন্ধে কোন সৎ সিদ্ধান্ত হইল না। অধিকন্তু ১৯১৬ সনে লাক্ষ্ণৌ শহরে কংগ্রেস ও লীগ মিতালী করিয়া কংগ্রেসকে পূর্ণ ক্ষমতা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হতভাগ্য বাঙ্গালী মোসলেমের জাতীয় স্বার্ধ শতকরা ৫৪ অংশ হইতে একেবারে ৪০ অংশে নামাইয়া দেয়া হইল। তাই বলি, যে দেশের মোসলেম বহু পূর্ব হইতে প্রতিযোগিতা করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটেও যাইতে পারে নাই, যে দেশে তাহারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পোস্ট গ্রাজুয়েট এবং বৈদেশিক শিল্পকলা প্রভৃতিতে কেবল মাতৃগর্ভস্থ ভ্রুনের ন্যায় মাত্র ধক ধক করিতেছেন, যে দেশের শাসন ও বিচার বিভাগে তাহারা নিতান্ত এতিম শিশুটির ন্যায় কালযাপন করিতেছেন, যে দেশের রাজকীয় সকল বিভাগেই হিন্দুগণ একচ্ছত্র রাজ প্রতিনিধি, সেই দেশেই হীনবল মোসলেমের শতকরা ৫৪ অংশ হইতে ১৪ অংশ বলপূর্বক কাড়িয়া নিয়া প্রবল হিন্দু সমাজ আরও প্রতিপত্তি লাভ করিল”।–[‘রাজমুকুট’ সমীচীন পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা ৯১, ৯২, ৯৩ লেখক সাঈদ উদ্দীন আহমদ, প্রকাশ ১৯২৫।] এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে তৎকালীন বাংলার মুসলমানদের ক্ষোভ ও মর্মবেদনার প্রকাশ ঘটেছে। এ মর্মবেদনা ঠিক, কিন্তু মুসলিম নেতৃবৃনদ ভুল করেছিলেন এটা ঠিক নয়। বাংলার জননেতা, এ. কে ফজলুল হক, মওলানা আজাদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ‘হিন্দু-মুসলিম মিলন ও দেশের ভবিষ্যৎ ও সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং দীর্ঘদিন এই সম্প্রীতি প্রবাহকে সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করেন।–[‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, নওরোজ কিতাবিস্তান, পৃষ্ঠা ৫৪১।]
লাক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদনের পূর্ব মুহুর্তে কায়েদে আযম মুসলিম লীগ সম্মেলনে বলেছিলেন, “হিন্দুদের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছামূলক এবং ভ্রাতৃভাবাপন্ন আচরণ হতে হবে। দু’টি সহোদর প্রতীম সম্প্রদায়ের সমঝোতার মাধ্যমে ভারতের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সম্ভব”।–[‘জিন্নাহ’ লেখক: হেক্টর বালিথো।]
পরবর্তী বড় ঘটনা হলো প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধ শেষ হওয়া এবং খেলাফত আন্দোলন শুরু হওয়া। পরে খেলাফতের সাথে স্বরাজ যুক্ত হলো এবং তারপর স্বরাজটাই মুখ্য হয়ে উঠল। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। যুদ্ধে জার্মানী পক্ষের হার হলো। পরাজিত তুরস্ককে খণ্ড-বিখণ্ড করার জন্যে বৃটেন এগিয়ে এল। এই ঘটনা মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করল। অথচ বৃটেন ভারতের মুসলমানদের প্রকাশ্যে এবং সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, যুদ্ধ শেষে বৃটেন তুরস্কের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করবে না। কিন্তু যুদ্ধ শেষে উল্টো ব্যবহার করলো বৃটেন। বলকান অঞ্চল আগেই কেড়ে নেয়া হয়েছিল। বৃটেনের কথায় বিশ্বাস করে ভারতের মুসলমানেরা যুদ্ধে বৃটেনকে সবদিক থেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। এই মুসলমানরা এখন ইংরেজদের ব্যবহারে প্রতারিত বোধ করল। ইংরেজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল মুসলমানরা। খেলাফত আন্দোলন আবার শুরু হলো।
১৯১৮ সালে দিল্লীতে মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সভাপতিত্ব করলেন এ, কে ফজলুল হক। এই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন মওলানা আব্দুল বারী, মওলানা আজাদ সুবহানী, মওলানা ইব্রাহীন শিয়ালকোটি, মওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসারী, মওলানা আহমেদ সাঈদ, মওলানা কিফায়েতুল্লাহ, মওলানা আব্দুল লতিফ প্রমুখ আলেম বৃন্দ। এঁরা অনেকেই কংগ্রেসপন্থী এবং মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে এতদিন দূরে ছিলেন। খেলাফত আন্দোলনের স্বার্থেই এঁরা মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল, মুসলিম লীগকে খেলাফত আন্দোলনে নিয়ে আসা। তারা সফল হয়েছিলেন। কায়েদে আযম খেলাফত আন্দোলন নিয়ে বাড়াবাড়ির পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত ছিল খেলাফত আন্দোলনের জন্য কর্মসূচী ঘোষণার পক্ষে। সভাপতির ভাষণে এ, কে ফজলুল হক জোরালো কণ্ঠে বললেন, “আমার কাছে ভারতে ইসলামের ভবিষ্যত মনে হয় হতাশা এবং উদ্বেগাচ্ছন্ন। দুনিয়াতে মুসলিম শক্তির পতনের যে কোন উদাহরণ ভারতে আমাদের সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক গুরুত্বের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য”।–[‘History of the Freedom Movement in India’, by Tarachand, Page 416.]
খেলাফত আন্দোলনের জন্যে কর্মসূচীর প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করলেও মুসলিম লীগকে এ নিয়ে বেশি দূর এগুতে হলো না। খেলাফত আন্দোল নপরিচালনার জন্যে আলাদা কমিটি গঠিত হলো। কংগ্রেসভুক্ত মুসলিম নেতৃবৃন্দই-[‘কায়েদে আযম যেমন মুসলিম লীগের নেতা হয়েও কংগ্রেসে ছিলেন, তেমনি তখনও বড় বড় মুসলিম নেতা কংগ্রেসযুক্ত ছিলেন।] এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেন। হাকীম আজমল খান ও ডক্টর আনসারী প্রমুখ নেতারাই ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বোম্বাইয়ে সর্বভারতীয় খেলাফত কমিটি গঠন করলেন। ১৯১৯ সালের ১৭ই অক্টোবর গোটা ভারত ব্যাপী ‘খেলাফত দিবস পালিত হলো। সাড়া পড়ে গেল গোটা ভারতবর্ষে। বাংলায় এ, কে, ফজলুল হক ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন গড়ে উঠল। খেলাফত আন্দেঅলনে কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদেরকে দারুণ উৎসাহী দেখা গেল। প্রথম খেলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ১৯১৯ সালের ২৩শে নভেম্বর দিল্লীতে। এতে সভাপতিত্ব করলেন শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক। এই সম্মেলনে গান্ধী ও মতিলাল নেহেরুর মত শীর্ষ কংগ্রেস নেতাই নয়, ভারতে রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠাকামী কট্টর কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্যও যোগদান করেছিলেন। খেলাফত সম্মেলন দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো। প্রথম দিন সভাপতিত্ব করলেন এ, কে, ফজলুল হক এবং দ্বিতীয় দিন সভাপতিত্ব করলেন মিঃ গান্ধী।
খেলাফত আন্দোলনের সাথে মিঃ গান্ধীর এই সংশ্লিষ্টতা খেলাফত আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন সাধন করল। খিলাফতের অধিকার সংক্রান্ত দাবী দাওয়া এবং তা বাস্তবায়নের চাপ ও চেষ্টার চাইতে খেলাফত আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্রের দিকেই ঝুকে পড়ল বেশি। দিল্লীর খেলাফত সম্মেলনে সভাপতির ভাষনে গান্ধী বললেন, ‘মুসলমানদের অন্যায়ের প্রতিকারের জন্যে বয়কট নয়, প্রয়োজন অসযোগিতা’।–[‘History of the Freedom Movement in India’, by Tarachand, Page 417.]
মিঃ গান্ধীর এই ‘অসযোগিতা’ বা ‘অসহযোগ’ মোটেই অপরিচিত নয়। ১৯১৯ সালের মার্চে কালাকানুন ‘রাওলাত আইন’-[‘রাওলাত আইন’-এর বলে বিনা বিচারে যে কোন লোককে আটক রাখার অধিকার সরকার পায়।] পাশ হলে গান্ধী এই অসযোগ ও সত্যাগ্রহের ডাক দিয়েছিলেন। ৬ই এপ্রিল ঘোষিত হয়েছিল সত্যাগ্রহ দিবস। বিভিন্ন শহরে সভা, সমিতি, মিছিল শুরু হয়েছিল। ৬ই এপ্রিল গোটা ভারতে হরতাল, বিক্ষোভ হলো। গোলমালও হলো অনেক জায়গায়। সবচেয়ে বড় গোলমাল হলো পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে। সংঘটিত হয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। রাওলাত আইন বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশের উপর ইংরেজ সৈন্যের গুলিতে ৪শ’জন নিহত এবং আহত হয়েছিল ১২শ’ জনের অধিক। গান্ধী সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, যদিও ভারতব্যাপী জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মুখর হয়ে উঠেছিল। গান্ধী খেলাফত আন্দোলনের সুযোগে তার পরিত্যক্ত সেই অসযোগ আন্দোলনকেই পুনরুজ্জীবিত এবং দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে খেলাফত আন্দোলনকে যুক্ত করে ফেলতে চাইরেন। এই চাওয়াটা আরও পরিপূর্ণতা লাভ করে কংগ্রেসের ১৯২০ সালের মে’ মাসের কলকাতা সম্মেলনে।
ইতিমধ্যে আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটল। ১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অমৃতসরে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অধিবেশন হলো। সদ্য গঠিত ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ’কেও আহবান জানানো হয়েছিল সম্মেলনে। তারাও তাদের আনুষ্ঠানিক সম্মেলন এ সময় অমৃতসরে করল। মওলানা শওকত আল এ সময় কারামুক্ত হলেন। তাঁর সভাপতিত্বে খেলাফত সম্মেলনও অমৃতসরে আহুত হলো। এই জমজমাট অমৃতসরে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা ঘটল। কায়েদে আযম মুসলিম লীগের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হলেন। মুসলিম লীগ সম্মেলনে তুরস্ক ও ভারতের প্রতি বৃটিশ নীতির তীব্র সমালোচনা করা হলো। অন্যদিকে খেলাফত সম্মেলনে দু’টি প্রধান সিদ্ধান্ত হলো। এক, সারা দেশব্যাপী খেলাফত আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচী গৃহীত হলো এবং দুই, সিদ্ধান্ত হলো মিঃ গান্ধী এই খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করবেন।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪০] ভাইসরয় ও ইংল্যাণ্ডে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে খেলাফত আন্দোলনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল প্রেরণের সিদ্ধান্ত অমৃতসর সম্মেলনে গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে ডাঃ আনসারীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বড় লাটের সাথে দেখা করলেন। তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করা হলো তুর্কি সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা এবং খলিফা হিসেবে তুর্কি সুলতানের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার যৌক্তিকতা। কিন্তু ফল কিছু হলো না। এ বছরই মার্চ মাসে মওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধিদল গেলেন বৃটেনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সাথে দেখা করার জন্যে। সেখান থেকেও কোন রেজাল্ট পাওয়া গেলনা।
বৃটিশ সরকারকে এইভাবে বুঝাবার প্রচেষ্টার পাশাপাশি চলছিল আন্দোলনের প্রস্তুতি। ১৯২০ সালের জানুয়ারীতেই মীরাটে অনুষ্ঠিত হলো খেলাফত কনফারেন্স। খেলাফত কমিটিতে গান্ধীর যে অসযোগ পাশ হয়েছিল এই খেলাফত কনফারেন্সে তা অনুমোদিত হলো। এ ছাড়া মিঃ গান্ধী এ বছরেরই মে মাসে কলকাতার কংগ্রেস সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের সাথে ‘স্বরাজ’ দাবী যুক্ত করে অসযোগ আন্দোরনের প্রস্তাব পাশ করিয়ে দিলেন। খেলাফত আন্দোলনের সাথে ‘স্বরাজের’ এই সংযোগ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর পর আন্দোলনের গুরুত্ব খেলাফত সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে স্বরাজ বা স্বদেশ সংক্রান্ত বিষয়ের দিকেই ঘুরে গেল। এই মে মাসেই বোম্বাইতে খেলাফত কমিটির যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো, ‘তাতে অষযোগ কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়া হলো। বলা হলো, দেশবাসী সরকার প্রদত্ত সম্মান সূচক পদ ও পদবী প্রত্যাখ্যান করবে, আইন সভার সদস্যপদ পরিত্যাগ করবে, সরকারের সামরিক ও বেসামরিক পদ থেকে ইস্তফা দেবে, এমনকি প্রয়োজনে কর প্রদান হতেও বিরত থাকবে’।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪১।] নিখিল ভারত কংগ্রেসও এ সময় তার প্ল্যাটফরম থেকে খেলাফত কমিটির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তুরস্কের প্রতি নির্মম ব্যবহারের জন্য বৃটেনের তীব্র নিন্দা করল। জুন মাসে আবার খেলাফত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সবাই এলাহাবাদে একত্রিত হলো এবং বড়লাটকে চরমপত্র প্রদান করল। বলা হলো খেলাফত আন্দোলনের দাবী মেনে না নিলে ১৯২০ সালের ১লা আগষ্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে। জুলাই মাসে সিন্ধুতে অনুষ্ঠিত খেলাফত সম্মেলন থেকৈ মিঃ গান্ধী খেলাফত আন্দোলনকে সহোগিতার জন্যে ভারতের ২৩ কোটি হিন্দুর প্রতি আহবান জানালেন। রামরাজ্যবাদী হিন্দুনেতা বাল গঙ্গাধর তিলক ১লা আগষ্ট থেকে ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানালেন।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অসহযোগের প্রস্তাব ঘোষণা হলো খেলাফত আন্দোলনের প্ল্যাটফরম থেকে, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সম্মেলনেও একে অনুমোদিত দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মুসলিম লীগ প্ল্যাটফরম এ ব্যাপারে নিরব। এর কারণ সম্ভবত এই যে, কায়েদে আযম মিঃ গান্ধীর অসহযোগ প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি।
ইতিমধ্যে মণ্টেণ্ড-চেমসফোর্ড সংস্কার প্রস্তাব ১৯১৯ সালে ২৩ শে ডিসেম্বর আইনে পরিণত হয়েছিল। এই আইন অনুসারে শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, সেচ, বিচার, স্বায়ত্ত্ব শাসন প্রভৃতি দপ্তরগুলি ভারতীয়দের হাতে দেখা হয়, অন্যদিকে অর্থ, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, প্রভৃতি দপ্তরগুলো শ্বেতাংগ সদস্যদের হাতে রাখা হয়। এছাড়া সিদ্ধান্ত হয় নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা মনোনীতদের চেয়ে বেশি হবে। ভারতীয় সদস্যদের হাতে দপ্তরগুলোর ব্যয় বরাদ্দের দাবী আইন সভায় অনুমোদন সাপেক্ষ হবে। কিন্তু ভাইসরয় ও গভর্ণর আইন সভার যে কোন প্রস্তাব বাতিল করতে পারে। অর্থাৎ প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রে ভাইসরয় এবং প্রদেশের গভর্ণরের হাতে ন্যস্ত থাকল। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মণ্টেণ্ড চেমসফোর্ড সংস্কার শাসন ব্যবস্থাকে ভারতীয় করণের পথে একটা বড় অগ্রগতি। জিন্নাহ বললেন, আমরা মণ্টেণ্ড সংস্কার সাময়িকভাবে গ্রহণ করতে রাজি আছি। গান্ধীও অমৃতসরের কংগ্রেস সম্মেলনে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেো এ সংস্কার গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছিলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দেজ পাবলিশিং, কোলকাতা, পৃষ্ঠা ৮৮,৮৯।] কিন্তু পরে গান্ধী তাঁর এই নীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৯২০ সালের পয়লা আগষ্ট থেকে অসহযোগ শুরু হয়ে গেল। গোটা ভারতে পূর্ণ হরতাল পালিত হলো। গান্ধী তাঁর সকল পদক সরকারকে ফিরিয়ে দিলেন। কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর সাথী আলেমবৃন্দ ফতোয়া দিলেন, বৃটিশ শাসিত ভারত ‘দারুল হরব’। তারা নির্দেশ দিলেন যে, এদেশ ছেড়ে মুসলমানদের চলে যাওয়া উচিত।–[‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪১।] জিন্নাহ অসযোগ কর্মসূচীর সাথে একমত ছিলেন না, কিন্তু সরকার সম্পর্কে তার মত প্রকাশ করে বললেন, “এ সরকারকে আর বরদাশত করব না, একটি পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার চাই”।–[পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪১।] অসহযোগ আন্দোলনের ধাক্কায় অচিরেই গোটা দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার এক মাস পর কোলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসল। ১৯২০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের আলোচ্য বিষয় ছিল গান্ধীর প্রস্তাবিত অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগের যে প্রস্তাব এসেছিল তা হোল (১) বৃটিশ সরকারকে প্রদত্ত উপাধি ও অনারারী পদত্যাগ করা (২) সরকারী দরবার ও অনুষ্ঠান বর্জন করা। (৩) পর্যায়ক্রমে সরকারী স্কুল কলেজ বা সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কুল-কলেজ হতে শিক্ষার্থীদের বের করে আনা (৪) আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের বৃটিশ কোর্ট বর্জন করা, (৫) কেরানী, শ্রমিক, সৈনিক হিসাবে মেসোপটেমিয়া যেতে অস্বীকৃতি জানানো এবং (৬) মণ্টেণ্ড চেমস ফোর্ড আইন অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা।–[‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, মাহবুব রহমান, পৃষ্ঠা ১৭১, ১৭২।] গান্ধীর এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করলেন কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মতিলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ। ‘তারা গান্ধীর এই প্রস্তাবকে কিছুতেই স্বীকার করে নিতে রাজী হলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই এই দল থেকে মতিলাল নেহেরু চলে গিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে যোগ দিলেন এবং গান্ধীর হাতকে শক্তিশালী করলেন।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ৯০।] অবশেষে ভোট যুদ্ধে হেরে গেলেন মিঃ জিন্নারা।–[মিঃ জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি হলেও যেহেতু তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেননি, তাই কংগ্রেস সম্মেলনে এসেছিলেন।] গান্ধীর পক্ষে পড়ল ১৮০৬ ভোট, আর জিন্নাহদের পক্ষে পড়ল ৮৮৪ ভোট। ভোটে গান্ধীর এই বিজয়ের রহস্য হলো, গান্ধী পক্ষ ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক ভাড়া করে এনে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে জড়ো করেছিলেন এবং এঁরা গান্ধীর অসহযোগ প্রস্তাবের সপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন’।–[‘জিন্নাহ অব পাকিস্তান’, ষ্ট্যানলী ওলপোর্ট, পৃষ্ঠা ৬৯ (‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, পৃষ্ঠা ৯০, ৯১)।] এ প্রসঙ্গে ডঃ বি, আর, আম্বেদকরও বলেন, “মিঃ ডায়ারস পরবর্তীকালে আমাকে একদিন বলেছিলেন, কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদানকারী অধিকাংশ প্রতিনিধিই ছিল কলকাতার ট্যাক্সিচালক এবং অর্থের বিনিময়ে তারা গান্ধীর কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন”।–[‘Pakistan in the Formative stage’, by Khalid bin Saeed (মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়, পৃষ্ঠা ১৭২)।]
১৯২০ সালের ডিসেম্বরে নাগপুরে কংগ্রেসের আরেকটি সম্মেলন বসল। এখানেও আলোচ্য বিষয় ছিল গান্ধীর অসহযোগ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সম্মেলনে এবং সম্মেলনের বাইরে গান্ধীকে অনেক বুঝালেন অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে। কিন্তু গান্ধী কোন কথার প্রতিই কর্ণপাত করলেন না। আর মিঃ জিন্নাহকে সম্মেলনে কথাই বলতে দেয়া হলো না। জিন্নাহ দাঁড়িয়ে যেই বললেন, ‘মিঃ গান্ধী…….’, অমনি চারদিক থেকে চিৎকার করে বলা হলো, ‘মিস্টার গান্ধী নয়, মহাত্ম গান্ধী বলুন’।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, চিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা ৯১।] জিন্নাহ মহাত্ম গান্ধী বললেন না। তাঁর বক্তব্য তিনি পেশ করতে পারলেন না। এই নাগপুর সম্মেলনেই জিন্নাহ কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করলেন। গান্ধী তার অসহযোগে অটল থাকলেন। কংগ্রেসের নাগপুর সম্মেলনে ঠিক হলো, ‘স্বরাজ’ হবে কংগ্রেসের সংগ্রামের লক্ষ্য বস্তু।–[‘স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৯১ (লক্ষণীয়, কংগ্রেসের লক্ষ্য বস্তু হলো ‘স্বরাজ’ ‘খেলাফত’, এর নামগন্ধ তাদের কথায় নেই)।] গান্ধী তার স্বরাজের ব্যাখ্যা দিতে রাজী ছিলেন না।–[“তার (গান্ধীর) সত্যিকার প্রত্যাশ্যা কি ছিল সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারিনি। হয় তিনি তার গেপানীয় ব্যাপার অসময়ে প্রকাশ করতে চাননি, নতুবা সরকারকে বাধ্য করার মতো কোন কৌশলের স্পষ্ট ধারণা তার ছিলনা”। Subash Bose: The Indian Struggle 1920-1934 “স্বরাজ বিষয়ে গান্ধীজি ছিলেন হাস্যকরভাবে অস্পষ্ট চিন্তাকে তিনি উৎসাহিত করতেন না”। (Jawaharlal Neheru Autobiography’, Page 76.)] গান্ধী খেলাফত, অসহযোগ, স্বরাজ, প্রভৃতির মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে ছিলেন। কোনও পথই সামনে পরিস্কার ছিলনা। জিন্নাহ স্পষ্টই বললেন, গান্ধীজির এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন ব্যর্থ হবে। কিন্তু গান্ধী তার আধ্যাত্মিক শক্তির বরাত দিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘তাঁর অসহযোগ কর্মসূচী গ্রহণ করলে ১৯২১ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ভারত স্বাধীনতা লাভ করবে।–[‘Jinnah’ Hectar Balithe’, (মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়, পৃষ্ঠা ১৭২)।] নাগপুরে সম্মেলনের আগেই জিন্নাহ গান্ধীকে তার অসহযোগ কর্মসূচী সম্পর্কে লিখিত এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, “আমি আপনার কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারবোনা। আজ দেশবাসী বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন মতে বিভক্ত ——আপনার কর্মসূচী শুধু অনভিজ্ঞ, নিরক্ষর এবং অশিক্ষিত যুবকদের আকৃষ্ট করেছে —-এর পরিণাম যে কি হবে আমি কল্পনা করতে চাইনে —আমি জানি যে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে সরকার দায়ী। আরমা যদি মূল কারণের সমাধান না করতে পারি তাহলে এর ফলভোগ আমাদেরই করতে হবে। আমি চাইনা আমার দেশবাসী ধ্বংসের পথে যাক——-.”।–[‘জিন্নাহ অব পাকিস্তান’, ষ্ট্যানলী ওলপোর্ট, পৃষ্ঠা ৭]
এসব বাদানুবাদের অনেক আগেই ১৯২০ সালের ১লা আগস্ট অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক চারদিকে এক উন্মাদনার সৃষ্টি করল। ভারতকে দারুল হরব-ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতা মওলানা আজাদ প্রমুখ মুসলমানদের যখন দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিলেন, দেশ ত্যাগ শুরু হয়ে গেল। প্রথমে সিন্ধু এলাকা থেকে, তারপর গোটা দেশ থেকে। হাজার হাজার মুসলমান আফগানিস্তানে হিজরত শুরু করল। অসহযোগ আন্দোলন শুরুর প্রথম মাসেই প্রায় ১৮ হাজার মুসলমান দেশান্তরিত হলো। হাজার হাজার লোকের আগমনে ভীত হয়ে আফগানিস্তান তার সীমান্ত বন্ধ করে দিল। চরম হতাশগ্রস্ত হলো হিজরত করা হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ। অনেক বীজন নাশ ও অপরিমেয় সম্পদ হানির পর দারুল হরব এর ঘোষণা প্রত্যাহার করা হলো এবং হিজরত বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
দেশত্যাগের ফলে যা ঘটেছিল, চাকুরী ও বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। প্রখ্যাত আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশ তার আইন ব্যবসা ত্যাগ করলেন। উভয় সম্প্রদায়ের অসংখ্য আইনজীবী ও সরকারী চাকুরে একই পথ অনুসরণ করলেন। সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে সুভাষ বসু আন্দোরনে অংশ নিলেন। হাজার হাজার ছঅত্র স্কুল কলেজ ত্যাগ করল। বাংলার জননেতা এ, কে, ফজলুল হক স্বরাজ সমর্থন করলেন, কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে অসহযোগকে মেনে নিলেন না। কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদে যোগ দিলেন।–[‘উপমহাদেশের রাজনীতি এবং স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, ইয়াসমিন আহমদ, পৃষ্ঠা ২৩৬ এবং ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, নওরোজ কিতাবিস্তান, পৃষ্ঠা ৫৪৪, ৫৪৫।] আরেকটি ব্যতিক্রম ছিল, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারী ‘অনুদান প্রত্যাখ্যানে সম্মত হলোনা। এ ধরনের কিছু ব্যতিক্রম ছিল বটে, কিন্তু দেশ ভেসে গেল অসহযোগের বন্যায়। মওলানা শওকত আলী ও মওলানা মুহাম্মদ আলীকে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলো। দেশ আরও ফুঁসে উঠল। গান্ধী অবিলম্বে সকলকে সামরিক ও বেসামরিক চাকুরী ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ পালনের ফল যাই হোক, ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন আইন অমান্য আন্দোলনে রূপ নিল। উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরীচৌবাতে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা থানা আক্রমণ করে ২২ জন পুলিশকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারল। এই ঘটনার পর গান্ধী খেলাফত কমিটির সাথে কোন পরামর্শ না করেই ‘পর্বত প্রমাণ ভুল হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করে’ অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করল। কংগ্রেসও এ ব্যাপারে খেলাফত কমিটির সাথে যোগাযোগের কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গান্ধী ও কংগ্রেস উভয়েই খেলাফত আন্দোলনকে পরিত্যাগ করল। খেলাফত আন্দোলনের সকল নেতাই আকস্মিকভাবে গান্ধী কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন।–[‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ১০১।]
গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে খেলাফত আন্দোলনের কোনই উপকার করেনি। অসহযোগের ঝড় খেলাফতের দাবী দাওয়াকে পেছনে ঠেলে দেয়। গান্ধীর উদ্দেশ্য ছিল খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার নামে তার স্বরাজ আন্দোলনে মুসলমানদের সমর্থন আদায় করা। কংগ্রেসের পক্ষ থেকৈ হঠাৎ করে মুসলমানদের ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়ার মধ্যেও ষড়যন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয়। এ সম্পর্কে এ, বি, রাজপুতের মন্তব্য, “এটা ছিল ঋষির দেশ ম্লেছ শূন্য করার জন্যে মিঃ গান্ধীর পাতা একটি ফাঁদ। গান্ধীর কার্যক্রমের এটাই ছিল লক্ষ্য। এতে তিনি নিঃসন্দেহে আনন্দিত হয়েছিলেন”।–[‘Pakistan in the Formative stage’, by Khalid bin Syeed (মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৭৩)।] জেড, এ, সুলেরী বলেন, “যা কিছু মুসলমানের সর্বনাশের কারণ হতে পারে, তার প্রতিই মহাত্মর মহৎ আশীর্বাদ বর্ষিত হতো”।–[‘Pakistan in the Formative stage’, (‘মুসলিম বাংলার অভ্যুদয়’, গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৭৩)।] গান্ধীর এই রূপ অনেকের কাছেই পরিস্কার ছিল। তাই দেখা যায়, অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ বাংলাকে সয়লাব করলেও সচেতন মহলে প্রশ্ন ছিলই। ১৯২১ সালে লিখিত ও ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘রাজমুকুট’-এ বলা হচ্ছে, “বঙ্গের প্রাচীন নেতা নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সাহেব আজীবন বাঙ্গালীর হিতসাধন করিয়া আসিয়াছেন। লাক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে বাঙ্গালী মুসলমানের জাতীয় অধিকার শতকরা ৪০ অংশে আদায় করায় তিনি ইহার প্রতিবাদ করিয়া কংগ্রেস ও মোশ্লেম লীগ ত্যাগ করিয়াছেন। অধিকন্তু এই অবস্থায় স্বরাজ হইলে বাঙ্গালী মুসলমানেরা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন মনে করিয়াই তিনি কাউন্সিলে প্রবেশ পূর্বক মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করিলেন। নওয়াব বাহাদুর বিশ্বাস করেন যে, স্বরাজ হইলে মুসলমানেরা হিন্দুর নিকট প্রতারিত হইবে। —ভারতের উজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য, অতুলনীয় সাহসী এবং অসীম ধী সম্পন্ন নেতা মৌলবী এ, কে, ফজলুল হক সাহেবও নীরবে সরকার পক্ষ অবলম্বন পূর্বক কাউন্সিলে প্রবেশ করিলেন। —তিনি কাউন্সিলে প্রবেশের পূর্বে যদি বঙ্গীয় হিন্দু ভাইদিগকে উচ্চ কণ্ঠে বলিতেন যে, আমাদের জাতীয় অধিকার প্রত্যেক বিষয়ে শতকরা ৫৪ অংশ হিসাবে প্রদান না করিলে আমরা অবশ্যই উপায়ন্তর অবলম্বন করতে বাধ্য হইব তাহা হইলে তিনি বাস্তবিকই সর্বসাধারণের নিকট প্রশংসা ভাজন হইতেন।—এবং বঙ্গীয় হিন্দু সমাজ স্বকীয় কৃতকার্যের ফলে জগতের সম্মুখে অত্যন্ত লজ্জিত হইতেন। যাহা হউক স্থূল কথা এই যে, এখন যদি আমাদের অংশ বুঝিয়া না পাই, স্বরাজ প্রতিষ্ঠা হইলে আমরা আর উহার নিকটেও দাঁড়াইতে পারিবনা”।–[‘রাজমুকুট’, সাঈদ উদ্দীন আহমদ (প্রকাশ, জুলাই ২২, ১৯২৫), পৃষ্ঠা ১১০, ১১১, ১১২।]
সে সময় মুসলমানদের এ সন্দেহ করার আরও কারণ হলো, স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলনেও মুসলমানদের শ্রমিকের মত ব্যবহার করা হতো এবং সর্ব পর্যায়ের নেতৃত্ব ছিল হিন্দুদের কুক্ষিগত। এ বিষয়টি মুসলমানদের আশংকিত করেছে, তারা এটা মেনে নিতে পারেনি। ১৯২১ সালের ‘রাজমুকুট’ বলছে, “বঙ্গ দেশে হিন্দুদের প্রবল, মোশ্লেম নিতান্ত দুর্বল। স্বরাজের সভাসমিতিতে, শালিশী আদালতে, কংগ্রেস কমিটিতে এবং পূর্ব হইতে সরকারী কাজকর্মে শতকরা ৯৫ জনেরও উপর হিন্দু প্রবেশ করিয়া বসিয়া আছেন। মোশ্লেম তথায় ১০ জনও যাইতে পারিতেছেনা। সভাপতি হিন্দু, প্রচারক হিন্দু, মোশ্লেম ভলান্টিয়ার। —তজ্জন্য অবোধ মোশ্লেম ক্রন্দন করিতেছে। স্বরাজের কার্য্যও বিন্দুমাত্র করিতেছে না। —-আমাদের উপযুক্ত লোক নাই, আমি তাহা স্বীকার করিনা। আমি বলি সকল দিকেই আমাদের যথেষ্ট লোক আছে। —–পেটি আমলাগিরীর জন্য এখনও শত শত আই, এ, বি, এ মোশ্লেম প্রার্থী সরকারের অবহেলায় বার বার বিফল মনোরথ হইয়া ক্ষুণ্ন মনে বেকার বসিয়া আছেন। —-অপর দিকে স্বরাজের কাজের জন্য বেশী বি, এ এম, এ পাশ দরকার হয়না”।–[‘রাজমুকুট’, সাইদ উদ্দীন আহমদ পৃষ্ঠা ৩১, ৬৬ (‘রাজমুকুট’ গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন ‘সাম্যবাদী’র সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক আলী আহমদ ওলী ইছলামাবাদী। ‘রাজমুকুট’-এর অনেক অংশ ‘সোলতান’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়।)]
খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে খেলাফত আন্দোলন করা গান্ধীর লক্ষ্য ছিলনা, একথা গান্ধীর কথা থেকেই প্রমাণ হয়। তিনি বলেছেন, “খেলাফত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমি ও মুহাম্মদ আলী ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। মুহাম্মদ আলীর নিকট খেলাফত ছিল একটি ধর্মীয় ব্যাপার। আর গোমাতার নিরাপত্তা বিধানের জন্য আমি খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলাম। কারণ মুসলমানদের ছুরির তলা থেকে গোমাতাকে রক্ষা করা আমার ধর্মীয় কর্তব্য”।–[‘Pakistan in the Formative stage’, by Khalid bin Sayeed ‘Young India’, ২০-১০-১৯২০] গান্ধীর উদ্দেশ্য সাময়িক ভাবে হরেও সফল হয়েছিল। ১৯২১ সালে ঈদুল আযহার কোন গরু কুরবানী হয়নি।–[‘Pakistan in the Formative stage’, by Khalid bin Sayeed ‘Young India’, ২০-১০-১৯২০] তবে গান্ধী যে ‘ধর্মীয় কর্তব্য’ পালনের জন্য খেলাফত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তা শুধু ঐ কুরবানী বন্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, এ কথা ইতিপূর্বে এ, বি, রাজপুত ও জেড, এ সুলেরীর কথায় কিছুটা পরিস্কার হয়েছে।
মিঃ গান্ধীর এ ‘ধর্মীয় কর্তব্য’ পালন শ্লোগানের মূলে রাজনীতি ছিল এবং এ রাজনীতিটাই মূখ্য ছিল। কোলকাতা ‘মডার্ণ রিভিউ’ এর সম্পাদক বিখ্যাত রামানন্দ চট্টেপাধ্যয় লিখেন, “মৌলানা মোহাম্মদ আলী ও মাহাত্ম গান্ধী –এই দু’জনের বক্তৃতা খুটিয়ে পড়লে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, তাঁদের একজনের কাছে সুদূর তুরস্কে খিলাফতের দুরবস্থার কথাই প্রধান বিবেচ্য, কিন্তু অন্যজনের পক্ষে ভারতের স্বরাজ লাভই প্রধান লক্ষ্য”।–[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’ বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ২৮।]
গান্ধীর স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলন মুসলমানদের ক্ষতিগ্রস্ত করে বেশী। ইংরেজের বিরুদ্ধে মুসলমানরা এক’শ বছরেরও বেশী সময় সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রামের আগুন তাদের অন্তরে ধিকি ধিকি জ্বলছিলই। সুতরাং স্বরাজ ও অসহযোগের যখন ডাক এল, তখন মুসলমানদের সাধারণ ও সংগ্রামী অংশ (আলেম সমাজ) এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের তুলনায় আধুনিক শিক্ষিতরা অংশ গ্রহণ করেছে কম, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। আবার শিক্ষিতদের মধ্যে সাধারণ ভাবে মুসলিমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশী। সমকালীন পত্র পত্রিকা থেকে এর সুন্দর প্রমাণ মিলে। ‘ছোলতান’ পত্রিকায় ‘দেশের কথা’ কলামে জনৈক আবুল কাশেম লিখেছেন, “খেলাফত ও স্বরাজ আন্দোলনে বাঙ্গালা ও আসামের অন্ততঃ ১০০ জনের বেশী নহে। —উত্তর বঙ্গের ৭টি জেলায় শতাধিক উচ্চশিক্ষিত মোসলমান উকিলের মধ্যে একজন মাত্র মাতিয়াছিলেন। আবার তিনি বৎসরাধিক কাল হইতে ঘরে ফিরিয়াছেন। –আলেমগণের মধ্যে একমাত্র রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫০ জনের নাম করিতে পারা যায়, যাহারা ধর্মের নামে, মুক্তির নামে ত্যাগের পরিচয় দিতে এবং লাঞ্ছনা ভোগ করিতে এবং অনেকে কারাক্লেশ ভোগ করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। পূর্ববঙ্গ বিশেষত চট্টগ্রাম বিভাগ ও শ্রীহট্ট জেলার তো কথাই নাই। সেখানে শতাধিক আলেম দেশ ও সমাজের জন্য কারাক্লেশ ভোগ করিয়াছেন এবং এখনও কয়েকজন কারাগারে আছেন। আমি বলিব জাতীয়তা, ধর্মানুরাগ, জাতীয় সহানুভূতি ও দেশাত্মবোধ জ্ঞান যদি বর্তমানে কোন দলে থাকে তবে তাহা সেই পুরাতন ধরনের লোকদের মধ্যেই আছে”।–[‘ছোলতান’, ৮ম বর্ষ, ২১শ সংখ্যা, ১৮ই আশ্বিন, ১৩৩০ (৫ই অক্টোবর, ১৯২৩)।] একথা সত্য গান্ধীর স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলন বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছে। ‘ছোলতান’ এর ‘উচ্চশিক্ষার ফল’ শীর্ষক কলামে বলা হচ্ছে “যে চট্টগ্রাম খেলাফৎ ও স্বরাজ আন্দোলনে যোগদান করেন নাই। —ঢাকাতে কোন উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছে। ‘ছোলতান’ এর ‘উচ্চশিক্ষার ফল’ শীর্ষক কলামে বলা হচ্ছে “যে চট্টগ্রাম খেলাফৎ ও স্বরাজ আন্দোলনে ভারতের শীর্ষ স্থান অধিকার করিয়াছিল সেখানে পূর্ণ আন্দোলনের যুগে উক্ত জিলার প্রায় ২০ জন মোছলমান বি, এল, এর মধ্যে একটি প্রাণীও আন্দোলনে যোগদান করেন নাই। —ঢাকাতে কোন উচ্চ শিক্ষিত লোককে আমরা খেলাফত ও স্বরাজ আন্দোলনে পাইয়াছি বলিয়া মনে হয় না। —রাজশাহী বিভাগের সাতটি জেলার মধ্যে উকিল ও গ্রাজুয়েটদের সংখ্যা দুই শতের কম হইবেনা, তাঁহাদের মধ্যে একজন উকিম কয়েক মাসের জন্যে মাতিয়াছিলেন”।–[‘ছোলতান’ ৮ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা, ৭ই আষাঢ় (২২ শে জুন, ১৯২৩)।] এর কারণ বোধ হয় এই যে, নওয়াব আলী চৌধুরী, এ, কে, ফজলুল হক, মিঃ জিন্নাহ এর মত মুসলিম নেতাগণ স্বরাজ ও অসহযোগ সমর্থন করেন নাই। প্রকৃত পক্ষে এঁরাই ছিলেন আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর আদর্শ। তাছাড়া মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে হিন্দুদের যতটা চিনেছিল, গান্ধীর স্বরাজ ও অসহযোগকে তারা যেভাবে বুঝেছিল, অন্যরা সেভাবে বুঝোনি। খেলাফত আন্দোলনের স্বার্থে মুসলমানদের সাধারণ অংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও আলেম সমাজ আন্তরিকভাবেই স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হয়েছে বেশী। এই তুলনায় হিন্দুদের ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মোসলেম মহাসভার অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষনে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী খুব আবেগ-ঘন ভাষায় এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “স্থায়ী গভর্ণমেন্ট অর্থাৎ Established government-এর সঙ্গে ননকোঅপারেশন চালানো অসম্ভব। নন-কো-অপারেশনের আসল সূত্র হইতেছে গভর্ণমেণ্টের চাকুরী না করা। গভর্ণমেন্টের সমস্ত চাকুরী প্রায় হিন্দুদের একচেটিয়া। আমি জিজ্ঞাসা করি, হিন্দু ভ্রাতারা কয়টি চাকুরী পরিত্যাগ করিয়াছেন, অথচ মাঝখান হইতে অনেক মুসলমান চাকুরী ত্যাগ করিয়া নিজ পরিবারের এবং সমাজের অনিষ্ট সাধন করিয়াছেন। এই নন-কোঅপারেশনের ফলে মালাবারের বীর জাতি আরব বংশীয় মোপালাগণ-[“প্রায় নিরস্ত্র মুসলিম মোপলাদের সাথে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র ও বিমান সজ্জিত বৃটিশ বাহিনীর সংঘর্ষ এক মাসের বেশী চলেছিল। ঐ সংঘর্ষে দশ হাজার মোপালী নারী-পুরুষ নিহত হয়। বিশ হাজারের বেশী মোপালা নর-নারীকে গ্রেফতার করা হয়। অমানুষিক অত্যাচার চলে এদের উপর। এক তরফা বিচারে এক হাজারের বেশী লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়। দুহাজার মোপালাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে আন্দামানে পাঠানো হয়। আট হাজার মোপালাদের দশ বছরের কারাদণ্ড হয়। অবশিষ্ট মোপালাদের ছয় মাসের কম কারাদণ্ড কারও ছিলনা। প্রতিটি মসজিদের ইমামের শাস্তি হয়েছিল। —এক্ষেত্রে গান্ধীর ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। তার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরব ভূমিকা পালন করে। মোপালাদের ব্যাপারে গান্ধী ও কংগ্রেসের নিরব উদাসীনতায় শুধু ভারতের মুসলমান সমাজ নয়, কংগ্রেসী মুসলমান সদস্যগণের মধ্যেও গভীর দুঃখ ও ক্ষেভের সৃষ্টি হয়েছিল”। (‘টেকনাফ থেকে খাইবার’, বিশ্বেশ্বর চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১৪৫, ১৪৬)।] প্রায় সবংশে নির্বংশ করিয়াছে। কিন্তু হিন্দুদিগের সেরূপ কোনও ক্ষতি হয় নাই। সিরাজগঞ্জের মঙ্গলার হাটে বহু মুসলমান অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। —হিন্দুদিগের শত শত কলেজ-বিশেষত কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্পর্শ না করিয়া মোসলমানের সাধের আলীগড় কলেজ এবং লাহোরের ইসলামিয়া কলেজ ভাঙ্গা হইল কিসের জন্যে?-[অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পণ্ডিত মদন মালব্য অসহযোগ আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলীকে, এমনকি গান্ধীকে পর্যন্ত কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি। অথচ এই পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য নিজে খেলাফত কমিটিতে হাজির থেকে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব খেলাফত কমিটিতে পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন। (‘পাকিস্তানঃ দেশ ও কৃষ্টি’, পৃষ্ঠা ১৪২, ‘ভারতের জাতীয় আন্দোলন’, পৃষ্ঠা ১০০)।] পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সহস্র সহস্র মুসলমান অধীর ও উন্মাদ হইয়া নিজ নিজ গৃহে আগুন লাগাইয়া আফগানিস্তানে চলিয়া গিয়াছেন, তাহাতে তাহাদের যারপরনাই ক্ষতি ও ক্লেশ হইয়াছিল। হিন্দু সমাজ সেরূপভাবে কোনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। দেশী বস্ত্র ব্যবহারেও মুসলমানগণ প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন। হিন্দু মাড়োয়ারী দোকানদারেরা বহুমূল্যে দেশী কাপড় বিক্রয় করিয়া প্রচুর পরিমাণে লাভবান হইয়াছেন। পক্ষান্তরে বহুমূল্যে মোটা কাপড় বিক্রয় করিয়া প্রচুর পরিমাণে লাভবান হইয়াছেন। পক্ষান্তরে বহুমূল্যে মোটা কপড় ক্রয় করিয়া মুসলমানেরা দণ্ড দিয়াছেন”।–[‘ইসলাম দর্শন’, ৪র্থ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৩১ (১৯২৪)।] সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর এই উক্তির প্রতিধ্বণি পাই ‘শরিয়াতে এসলাম’ পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে। বলা হচ্ছে, “যত মরণ এই মোসলমানের। স্কুল কলেজ বয়কটে যথার্থভাবে ইহারাই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। দীন দরিদ্র, সহায়-সম্পদহীন মোসলমান ছাত্র কষ্টভোগ করিয়া, কতলোকের হাতপা ধরিয়া একটু পড়িবার সুযোগ করিয়া লইতেছিল, কিন্তু মৎলববাজ কংগ্রেসীদের দূরভিসন্ধিরূপ অশনিপাতে তাহা সমূলে ধ্বংস হইতে চলিয়াছে। স্কুল কলেজ-মাদ্রাসা প্রভৃতি বন্ধ করিয়া দিয়া সহস্র যুবককে ভবঘুরে বানাইয়া, বেকার সমস্যা এবং চোর ডাকাতের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া যে স্বরাজ আসিতে পারে, ইহা আমার বুদ্ধির অগোচর। অবশ্য ইহাতে অনুন্নত সম্প্রদায়ের উন্নতির পথ রুদ্ধ করত; তাহাদিগকে পিষিয়া মারিবার বিঘ্নরহিত পথ অবশ্যই হইতে পারে”।–[‘শরিয়তে এসলাম’, ৫ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, শ্রাবণ, ১৩৩৭ (১৯৩০)।] মাসিক সওগাত স্বরাজকে কটাক্ষ করে লিখেছিল, “আমরা স্বরাজ স্বাধীনতার জন্য সভা করিয়া, চিৎকার করিয়া গলা ফাটাইতেছি, তথাপি ইংরেজ আমাদিগকে স্বরাজ দিতেছেনা বলিয়া সেই সভা করিয়াই ইংরেজের অন্যায় কার্যের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি, ইহাতে ইংরেজ হাসে, কারণ ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর। —-ইংরেজ আমাদিগকে স্বরাজ দেয় না, তাছাড়া বলে, আমরা অতবড় কার্যের যোগ্য হই নাই। আমরা সভা করিয়া ইংরেজের এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া কাগরে প্রতিবাদ ছাপিয়া দেই, কিন্তু আমরা কি সত্যই স্বরাজের যোগ্য হইয়াছি?”-[‘সওগাত’, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, অগ্রহায়ন, ১৩৩৫ (১৯২৮)।]
বলা যায়, স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলন কালে সংখ্যাগুরু জনগণের আন্তরিকতার অভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানরা বৈষম্য, বঞ্চনা ও দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়েছিল এবং সার্বিক যোগ্যতা ও নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবের কারণে এই আন্দোলন আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ব্যর্থও হয়েছিল। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ভাষায়, “১৯২২ সালে অহিংস প্রতিরোধ নীতি বর্জনের কারণ কেবলমাত্র চৌরীচৌবা নয়, যদিও অধিকাংশ লোকের তাই ধারণা। কারণ হলো, ঐ সময় গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সংগঠন দৃশ্যত শক্তিশালী এবং গণভিত্তিক হলেও কার্যত তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া জনসাধারণকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার শিক্ষাও দেয়া হয়নি”।–[‘Jawharlal Neheru, Autubiography’, (উদ্ধৃত-উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, পৃষ্ঠা ১৮৯)।]
১৯২২ সালে স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হবার পর কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃত্বের সাথে খেলাফত আন্দোলনের সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা ঘটে। এর আগেই মুসলিম লীগের সাথে কংগ্রেসের বিচ্ছিন্নতা এসেছিল। এই ভাবেই শেষ হয়ে গেল হিন্দু-মুসলিম সহযোগতার একটি অধ্যায়। সহযোগিতা এসেছিল বিদ্যুৎ চমকের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে, কিন্তু যাবার সময় পেছনে রেখে গেল উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার গাঢ় অন্ধকার।