৭
ভূলুণ্ঠিত পতাকার উত্তোলন
উনিশ শ’ চল্লিশ সাল পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির ধারা একটাই ছিল। সে ধারার বাহক ছিল মুসলিম লীগ। কিছু মুসলিম ব্যক্তি ও সংগঠন কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু তারা ছিল কংগ্রেসী রাজনীতির সাথে যুক্ত, মুসলিম রাজনীতি তারা করেনি। ১৯৪০ সালের পর রাজনীতির এ বহমান স্রোতে ব্যতিক্রমের একটি সুস্পষ্ট বুদ্বুদ উত্থিত হলো। মুসলিম রাজনীতির নতুন এক ধারা এসে পা ফেলল রাজনৈতিক অঙ্গনে। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের ঠিক ১৭ মাস ২ দিন পর মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া মৌল এক উপলব্ধি মূর্ত হয়ে উঠল জামায়াতে ইসলামী নামক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা করলেন যে দর্শনকে সামনে রেখে তা তাঁর ভাষায়ঃ
“দুনিয়াকে ভবিষ্যদের অন্ধকার যুগ থেকে রক্ষা করে তাকে ইসলামের নিয়ামত দ্বারা ভূষিত করার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, এখানে ইসলামের সঠিক ধারণা ও মতবাদ বিদ্যমান আছে, বরঞ্চ সঠিক মতবাদের সাথে একটি সত্যনিষ্ঠ দলেও প্রয়োজন। এ দলের সদস্যদেরকে ঈমানের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও অবিচল হতে হবে এবং আমলের দিক থেকে হতে হবে প্রশংসনীয় ও উচ্চমানের। কারণ তাদেরকে সভ্যতা সংস্কৃতির ভ্রান্ত অবস্থা ও রীতি নীতির বিরুদ্ধে কার্যতঃ বিদ্রোহ করতে হবে এবং এ পথে আর্থিক কোরবানী থেকে শুরু করে কারাদণ্ড এমনকি ফাঁসির ঝুঁকিও নিতে হবে”।–[মাসিক ‘তরজুমানুল কোরআন’, ১৯৪১ এ প্রকাশিত ‘এক সালেহ জামায়াত কি জরুরত’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। (উদ্ধৃতঃ জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৮৪)।] ১৯৪১ সালের প্রেক্ষাপটে মওলানা মওদূদীর এই উচ্চারণ মনে হয় শুনতে খুবই নতুন, কিন্তু তিনি যা বলেছেন তা নতুন মোটেই নয়। তিনি মুসলমানদের ভুলে যাওয়া এক মৌল উপলব্ধির উচ্চারণ করেছেন মাত্র। এই উপলব্ধিকে মৌল বলছি এ কারণে যে, মুসলিম জাতির উত্থানই ঘটানো হয়েছে মানুষকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয়ার এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যে, আর মুসলমানরাই বিশেষ কল্যাণের একমাত্র শক্তি।–[‘তোমরা (মুসলমানরাই) বিশ্বে কল্যাণের শক্তি, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে”। (সূরা আল-ইমরান, ১১০ আয়াত)] মুসলিম জাতি সৃষ্টির এ লক্ষ্য থেকেই মৌল ঐ উপলব্ধিটি বাংময় হয়ে উঠেছিল। সমকালীন এক উদ্বেগ এবং এক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে। মওলানা মওদূদীর ভাষায় “আমার এমন এক স্বাধীনতা প্রয়োজন যার সাহায্যে আমি পতনোন্মুখ ইসলামী শক্তিকে সামলাতে পারি, জীবনের যাবতীয় সমস্যাবলী মুসলমান হিসেবে সমাধান করতে পারি এবং হিন্দুস্তানে মুসলিম জাতিকে একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে পারি।–[মওলানা মওদূদীর ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ’, গ্রন্থের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।] লক্ষণীয়, মওলানা মওদূদী শুধু স্বাধীনতা চাচ্ছেন না, এমন স্বাধীনতা চাচ্ছেন, যা পতনোন্মুখ ইসলামী শক্তিকে নবজীবন দান করবে, এমন স্বাধীনতা তিনি চাচ্ছেন যার দ্বারা মুসলমানরা মুসলমান হিসেবে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের সুযোগ পাবে। এই উপলব্ধি যা বলছে, তা লাহোর প্রস্তাবের রাজনৈতিক লক্ষ্য থেকে অনেক ব্যাপকতর, গভীরতর এবং সামগ্রিক। জাতি হিসেবে মুসলমানদের এ এক আবহমান মানস রূপ। সাময়িকভাবে হারিয়ে যাওয়া এ মানস রূপেরই উদ্বোধন করলেন মওলানা মওদূদী সময়ের এক মহা তাকিদ থেকে। মওলানা বললেন, “এখন আমরা যদি মুসলমান থাকতে চাই এবং স্পেন ও সিসিলীতে মুসলমানদের যে দুর্দশা হয়েছিল ভারতের মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা দেখতে যদি আমরা না চাই, তাহলে আমাদের জন্যে একটি মাত্র পথই খোলা আছে। তা হলো এই যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখ কুফরী সরকারের-[বৃটিশ ভারতে মুসলমানদের অনুসরণীয় পথ সম্পর্কে মওলানার বক্তব্যঃ ‘মুসলমানদের জন্যে দেশের এমন স্বাধীনতা সংগ্রাম হারাম যার ফলে অমুসলিম ইংরেজের হাত থেকে ক্ষমতা ভারতীয় অমুসলিমদের হাতে চলে যাবে। তাদের জন্যে এটাও হারাম যে, তারা এ হস্তান্তর ক্রিয়া চুপচাপ বসে থেকে দেখবে। তাদের জন্যে এটাও হারাম যে, তারা ইংরেজ শাসন কায়েম রাখার সহায়ক হবে”। (মুসলমান আরওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ” গ্রন্থের ভূমিকা দ্রষ্টব্য)] দিক থেকে সত্যনিষ্ঠ সরকারের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা আমরা করব। এ উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এক সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে বদ্ধপরিকর হতে হবে। তার পরিণাম সাফল্য হোক অথবা মৃত্যু। …..আমি মনে করি এ জাতিকে বাঁচাতে হলে এই শেষ সুযোগটিই বাকি আছে। আমাদের বিশেষ মহল যতই পথভ্রষ্ট হোক না কেন, আমাদের জনসাধারণের মধ্যে ঈমানের এক দমিত অগ্নিশিখা বিদ্যমান আছে এবং এটাই আমাদের শেষ সম্বল। এটা নির্বাপিত হওয়ার পূর্বে এ থেকে আমরা অনেক কাজ নিতে পারি। শর্ত এই যে, কিছু এমন মর্দে মুমিন দাঁড়িয়ে যেতে হবে খালেস নিয়তের সাথে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার জন্যে।–[‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ (মুসলমান ও বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত)’ মওলানা মওদূদী, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।] খালেস নিয়তে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার শর্ত পূরণের জন্যেই জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা হলো ১৯৪১ সালে। উপরের আলোচনা থেকে এই আন্দোলনের তিনটি লক্ষ্য বেরিয়ে এলঃ এক, দেশের স্বাধীনতা অর্জন, যেখানে গঠিত হবে মুসলমানদের সরকার, দুই, এই স্বাধীনতা হবে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের জন্যে পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ। এবং তিন, এ সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার জন্যে আত্মনিবেদিত কর্মীদল তৈরী করা। এই তিনটি লক্ষ্যের প্রথমটি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের অনুরূপ এবং শেষ দু’টি জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব। শেষ দু’টি জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব হলেও এ দু’টি ছাড়া যেন লাহোর প্রস্তাব পূর্ণাংগ হচ্ছেনা। এখানেই ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী গঠনের সার্থকতা। লাহোর প্রস্তাব যেমন মুসলমানদের অপরিহার্য রাজনৈতিক প্রয়োজনের ফল, ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা তেমনি ইসলাম ও মুসলমানদের অপরিহার্য সামগ্রিক স্বার্থ চিন্তার একটা পরিণতি।
মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তা ও সাংস্কৃতিক উত্ণা পতনের ইতিহাসে ১৯৪১ সালের এই উপলব্ধি একটা যুগান্তকারী ঘটনা। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এক ধারাবাহিকতার নতুন যাত্রা শুরু হলো এর মাধ্যমে। আধুনিক ইতিহাসে ভারতে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবীর মাধ্যমে এই ধারাবাহিকতার যাত্রা শুরু। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধোত্তর হতাশার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী ভেবেছিলেন, ভারতে ইসলামের গৌরব ও শান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে ইসলামের শিক্ষা ও চরিত্রে মানুষকে আবার সুসজ্জিত করে তুলতে হবে। এ জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত একদল লোক এবং ব্যাপক আন্দোলন। এই লোক তৈরীর জন্যেই তিনি দিল্লীতে খুললেন তার বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই বেরিয়ে এলেন শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলবী, বেরিয়ে এলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ, শাহ ইসমাইল শহীদ, প্রমুখের মত বৃটিশ সাম্রাজ্য কাঁপানো হাজারো বিপ্লবী মুজাহিদ। শুরু হলো আন্দোলন, শুরু হলো তাদের দেশকে স্বাধীন করার, মুসলমানদের মুক্ত করার এবং ইসলামকে বিজয়ী করার সংগ্রাম। বাংলাসহ সমগ্র ভারতে পৌনে এক’শ বছর ধরে চলল বৃটিশের বিরুদ্ধে তাদের অসহযোগ এবং সংগ্রাম। বাংলায় তিতুমীরের সংগ্রাম এবং হাজী শরিয়তুল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলন ছিল এই আন্দোলনেরই অংশ। অবশেষে সিপাহী বিপ্লবোত্তরকালে বৃটিশের ব্যাপক গণহত্যা, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, জেল-জুলুম, ইত্যাদির ফলে এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবের কারণে ১৮৭০ সালের দিকে এই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়, ভূলুণ্ঠিত হয় ‘শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবীর উত্তোলিত পতাকা’। থেমে যায় মুসলমানদের বৃটিশ বিরোধী শতাব্দী কালের অসহযোগ। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আন্দোলনের অন্যতম নেতা সিপাহী বিপ্লবের দিল্লী ফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী গ্রেফতারের কঠিন পরওয়ানা এড়িয়ে চলে গিয়েছিলেন মক্কা শরীফে। আর সিপাহী বিপ্লবের দিল্লী যুদ্ধে আহত মওলানা কাশেম নানতুবিও বৃটিশ গোয়েন্দাদের শ্যেন দৃষ্টি পাশ কাটিয়ে দিল্লী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসা। অনুরূপভাবে হাজারো সংগ্রামী আলেম গ্রাম-গ্রামান্তরে স্ফুলিংগ অনির্বাণ রাখার জন্য শিক্ষা দানমূলক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছিলেন এবং এভাবেই শাহ ওয়ালী উল্লাহ পরিকল্পিত এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ, হাজী শরিয়তুল্লাহ প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের সার্বিক মুক্তি বিধান ও ইসলামকে বিজয়ী করার আন্দোলন তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল জনারণ্যে। অনেক ঘটনার ভীড়ে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের আন্দোলনের পতাকা। এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছিল বৃটিশের সাথে আপোষকারী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য হলো দেশ ও জাতিকে ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত করা। মুসলমানদের এই বিরাট দায়িত্বই গ্রহণ করেছিল মুসলিম লীগ। মুসলিম জাতির জন্যে একটা আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠাই ছিল তার লক্ষ্য, কিন্তু এই আবাস ভূমিকে ইসলামের রাজ্যে পরিণত করার কোন পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি তার ছিলনা। বালাকোট, নারকেলবাড়িয়া ও ফরায়েজী আন্দোলনের উত্তরসূরী আলেম সমাজ ভারতের মুক্তি সংগ্রামে এলন বটে এবং খিলাফত আন্দোলনের মত বিরাট আন্দোলন তারা পরিচালনা করলেন বটে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের পূর্বসূরীদের দায়িত্ব পালন করলেন না, তাদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা তাঁরা তুলে ধরলেন না। ১৯২০ সালে গঠিত হলো জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ। জমিয়তে ইসলামী আদর্শ, মুসলিম কৃষ্টি, পবিত্র স্থান সমূহের মর্যাদা সংরক্ষণ, ইসলামী শিক্ষার অধিকার অর্জন, ইসলামী শিক্ষার আলোকে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন, ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুদ্ধার, ইত্যাদিকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করল। কিন্তু সব লক্ষ্য অর্জনের ভিত্তি যে কাজ, স্বাধীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা, তাকেই তাঁরা পাশ কাটালেন অথবা বর্জন করলেন। শুধু তাই নয়, দেওবন্দ ভিত্তিক আলেমদের প্রধান ও বড় অংশ জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের নেতৃত্বে কংগ্রেসের অখণ্ড জাতিয়তাকে সমর্থন করল। এরা মুসলিম লীগের আন্দোলনের ক্ষতি করার চেষ্টা অব্যাহত ভাবে চালিয়ে গেছে। অর্থাৎ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের ভূলুণ্ঠিত পতাকাকে তারা নির্মমভাবে পদদলিত করেছেন। এই ভূলুণ্ঠিত ও পদদলিত পতাকাকেই ঊর্ধে তুলে ধরলেন মওলানা মওদূদী ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। মওলানা মওদূদীর হাতে শাহ ওয়ালী উল্লাহর ইসলামী আন্দোলন আরও সুন্দর, আরও সুশৃঙ্খল, আরও সুচিন্তিত এবং মহানবী (সঃ) এর শিক্ষা ও আদর্শের আরও ঘনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে উঠল।
১৯৪১ সালে মওলানা মওদূদী কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা তার এক যুগেরও বেশী কালের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ফল। তিনি তার পর্যবেক্ষণে দেখেছিলেন, “দুনিয়ার ফিৎনা ফাসাদের মূল উৎস হলো মানুষেল উপর মানুষের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব। এ থেকেই অনাচার অকল্যাণের সূচনা হয় এবং এ থেকেই আজ হলাহলের বিষাক্ত প্রস্রবণ প্রবাহিত হচ্ছে। —-কোথাও একটি জাতি আরেকটি জাতির খোদা হয়ে বসেছে, কোথাও এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীর খোদা, কোথাও একটি জাতি প্রভুত্ব, কর্তৃত্বের আসন অধিকার করে আছে, কোথাও জাতীয় রাষ্ট্র খোদার আসনে বিরাজমান, কোথাও কো ডিরেক্টর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছেন, ‘আমি ছাড়া তোমাদের আর কোন খোদা আছে বলে আমার জানা নেই’ (সূরা কাসাস, ৮৩) –এটাই হলো সেই অশুভ শক্তি যা মানুষের সকল বিপদ মুসিবত, সকল বিপর্যয় ও ধ্বংস এবং সকল বঞ্চনার মূল কারণ। তার উন্নতি অগ্রগতির পথে এটাই বড় বাঁধা। —-এর প্রতিকার এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না যে, মানুষ সকল খোদায়ীর দাবীদার শক্তিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র আল্লাহকে নিজের ‘ইলাহ’ এবং একমাত্র রাব্বুল আলামীনকে নিজের ‘রব’ বলে মেনে নেবে –এটাই সেই বুনিয়াদী সংস্কার সংশোধনের কাজ যা আল্লাহর মহান নবীগণ মানুষের জীবনে করেছেন”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৮২।] এই মৌল সমসার পটভূমিতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মওলানা মওদূদীর বক্তব্য হলোঃ ‘মুসলমানদের বাঁচার উপায় থাকলে শুধু এর মধ্যেই আছে যে, তাদেরকে আবার নতুন করে জাতির মুবাল্লিগের ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধুমাত্র এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমেই তারা সেসব জটিলতা থেকে মুক্ত হতে পারে যার মধ্যে তারা এখন নিমজ্জিত আছে। —এ কথা তাদের মনে বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে, ইসলামের নিজস্ব একটা জীবন বিধান আছে। তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা আছে, নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে, তার নিজস্ব চিন্তাধারা আছে, নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা আছে –যা সব দিক দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকে অনেক ভালো ও উচ্চমানের। সভ্যতা সংস্কৃতির ব্যাপারে কারো কাছে হাত পাততে হবে, এ ধারণা তাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে”।–[‘জামায়াতে ইসলামী ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৮০।]
মুসলমানদের সার্বিক মুক্তি বিধানই ছিল মওলানা মওদূদীর সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য। এ সার্বিক মুক্তির মধ্যে মুসলমানদের আশু রাজনৈতিক মুক্তির প্রতি মওলানা সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মুসলমানদেরকে হিন্দু জাতি সত্তার মধ্যে গ্রাস করার জন্যে কংগ্রেস যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, মওলানা মওদূদী সর্বশক্তি দিয়ে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। পণ্ডিত নেহেরু তার ‘আমার কাহিনী’ বইতে হিন্দু মুসলিম এক জাতীয়তার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলে মওলানা তার তীব্র সমালোচনা করে বললেন, “কথাগুলো কত সুন্দর, কত নির্দোষ, কত অক্ষতিকর, কিন্তু কত হলাহলপূর্ণ। –এ নতুন পলিসির দিকে লক্ষ্য করলে স্পষ্টই দেখতে পাবেন যে, এ প্রকৃতপক্ষে একটি ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ ভিন্ন রূপে ও আকারে। এ ধর্মীয় শুদ্ধি নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শুদ্ধি। এর পরিণাম ফলও তাই যা ধর্মীয় শুদ্ধির ছিল। —-এ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা একজন সুচতুর ব্যক্তি। তিনি (নেহেরু) বলেন, ‘তোমরা (মুসলমানরা) জাতিহীনও এবং তোমাদের কোন সভ্যতা নেই। অতএব কোন কিছু পরিত্যাগ করার প্রশ্নইত উঠে না। আসলে তোমরা ভারতীয় জাতির লোক। এসো, আপন জাতির সাথে মিশে যাও, পেটের জন্যে প্রচুর অন্ন জুটবে’।–এটাওত এক চুমুক হলালহল। কিন্তু দেখুন, কত বুদ্ধিমান লোক তা মাতৃস্তন্যমনে করে পান করছে”।–[‘জামায়াতে ইসলামী ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭১।] মওলানা মওদূদী মিঃ গান্ধী, কংগ্রেস নেতা ভুলা ভাই দেশাই, প্রমুখের উক্তি পর্যালোচনা করে দেখান যে, তারা খুব বেশী হলে একটা ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক সেকুলার স্টেট’ দিতে পারেন। মওলানা এ ধরনের রাষ্ট্রকেও প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “মুসলমানরা কিছুতেই এ ধরনের রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না। —-মুসলমানদের এতোটা নির্বোধ কি করে মনে করা হল যে, তারা এ ধরনের রাষ্ট্র নিজেদের মস্তকের উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সংগ্রাম করবে? —-এটি জাতি কি স্বয়ং তার কবর খনন করার জন্যে জীবন বিলিয়ে দেবে?”-[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭৩।]
মওলানা মওদূদী কংগ্রেসপন্থী মুসলমানদের কথা ও কাজের তীব্র সমালোচনা করেন এবং তাদের নানা অপপ্রচারের জবাব দেন। একবার বিজনৌরের মাসিক পত্রিকা ‘মদিনা’য় কংগ্রেসের ইসলামিয়াত বিভাগের সদস্য মানযার রিজভী ‘মিঃ জিন্নার ফাঁকা বুলি’ শীর্ষক প্রবন্ধে জিন্নাহকে হেয় করার চেষ্টা করলে মওলানা মওদূদী তার জবাব দিয়ে বললেন “রিজভী সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গীই ভ্রান্ত এবং মিঃ জিন্নারই ঠিক”।–[‘মদিনা’, (বিজনৌর), নভেম্বর, সংখ্যা ৩৭ (‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭২।)] মওলানা মওদূদী কংগ্রেস পন্থী চিন্তাধারার জন্যে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদের মত ব্যক্তিদেরও কঠোর সমালোচনা করেন। এক জাতীয়তা সংক্রান্ত মওলানা আজাদের একটা বিবৃতির জবাবে মওলানা মওদূদী ‘যমযম’ পত্রিকায় লেখেনঃ “আমাদের আসল পজিশন এখন এই যে, যদি তারা (সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু) আমাদের উপর জুলুম করে তাহলে আমাদের কোন কোন প্রতিনিধি সরদার প্যাটল অথবা অন্য কোন সরদারের কাছে আবেদন নিবেদন করবে। তারপর এ জুলুমের প্রতিকার তখনই সম্ভব যখন নেহায়েৎ মেহেরবানী করে তাঁরা অবস্থার প্রেক্ষিতে কোন প্রতিকার করতে চাইবেন। প্রকৃত পক্ষে এ পজিশন কিছুতেই গোলামীর পজিশন থেকে ভিন্নতর নয়, যা এ যাবৎ ইংরেজ শাসনের আমলে আমাদের রয়েছে”।–[‘জামায়াতে ইসলামী ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭৩, ৭৪।] মওলানা মওদূদীর এই স্পষ্ট ও আপোষহীন ভূমিকার জন্যে মিঃ নেহেরু তাকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদী’ বলে আখ্যায়িত করেণ। এই সমালোচনার উত্তরে মওলানা মওদূদী বলেন, “আমরা আমাদের নিজেদের কবর খনন করার ব্যাপারে তাদের হাত শক্তিশালী করতে অস্বীকার করছি। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার দুশমন ও সাম্রাজ্যবাদী তারা নিজেরাই, তারা নিজেরাই স্বাধীনতা অর্জন করার এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এমন পন্থা অবলম্বন করছেন যা ভারতেতর এক চতুর্থাংশ অধিবাসী কিছুতেই মেনে নিতে পারে না”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭২।]
এই সব বাক বিতণ্ডা এবং কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের জুলুম অত্যাচারের প্রেক্ষিতে হিন্দু মুসলমান সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা যখন চারদিকে তীব্র হয়ে উঠল, তখন ১৯৩৯ সালের জানুয়ারী মাসে মওলানা মওদূদী সমস্যা সমাধানের জন্যে তিনটি বিকল্প শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব পেশ করলেন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে পরিস্থিতি সম্পর্কে মওলানা সঠিক বিশ্লেষণ ও ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রমাণ মেলে। বিকল্প প্রস্তাব তিনটি এইঃ
প্রথম প্রস্তাব
“দুই অথবা তার অধিক জাতির দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সুবিচারপূর্ণ পদ্ধতি নিম্নরূপঃ
একঃ রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের (International Federation) মূলনীতির ভিত্তিতে। অন্য কথায় এটা একটি মাত্র কোন জাতির রাষ্ট্র হবে না। বরঞ্চ চুক্তিবদ্ধ জাতিসমূহের একটা রাষ্ট্র (A State of Federation) হবে।
দুইঃ এ ফেডারেশনে শরীক প্রত্যেক জাতি সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের (Cultural Autonomy) অধিকারী হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক জাতি তার জীবনের বিশেষ পরিমণ্ডলে আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও সংস্কার সংশোধনের জন্যে সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
তিনঃ সকলের জন্যে সমান এমন আঞ্চলিক বিষয়সমূহের জন্যে যে কর্ম-পদ্ধতি তৈরি করা হবে তা হবে সমঅংশীদারীত্বের (Equal Partnership) ভিত্তিতে।
সাংস্কৃতিক স্বায়থ্ত শাসনের মূলনীতি হবে নিম্নরূপঃ
১। যে সব জাতি নিয়ে ফেডারাল রাষ্ট্র হবে তার প্রত্যেকটি (Soveregn) সার্বভৌম হবে, অর্থাৎ সে তার কাজের পরিসীমার মধ্যে আপন এখতিয়ার খাটাতে পারবে।
২। শিক্ষা, ধর্মীয় বিষয়াদি (যথা মসজিদ, উপাসনালয়, আওকাফের নিয়ম শৃংখলা, ধর্মীয় নির্দেশাবলী আপন জাতির লোকের উপর কার্যকর করা এবং নির্দেশ লংঘন করা থেকে তাদেরকে বিরত রাখা), বিশেষ সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিষয়াদি (যথা বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার) এবং জাতীয় সামাজিক ব্যবস্থার (National Social System) প্রত্যেক জাতির পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থাকবে এবং কেন্দ্রের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।
৩। এসব উদ্দেশ্যে প্রত্যেক জাতির পৃথক পৃথক জেলা ও প্রদেশ ভিত্তিক কাউন্সিল থাকবে। এসবের উপর থাকবে একটি সুপ্রীম কাউন্সিল। উপরোক্ত বিষয়গুলি এ সব কাউন্সিলে পেশ করা হবে এবং এসব স্থান থেকেই সে সবের জন্যে আইন বিধি অনুমোদন করা হবে। এসব আইনের মর্যাদা দেশীয় আইন থেকে কম মর্যাদাশীল হবে না। এসব কার্যকর করার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো Executive Structure) থাকবে এবং জাতীয় কাউন্সিলের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আইন শৃংখলার ব্যয়ভার বহনের জন্যে কর আরোপ করার ও তা আদায় করার পূর্ব এখতিয়ার এ জাতীয় ব্যবস্থায় থাকবে। দেশের রাজস্ব তহবিল থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ প্রত্যেক জাতির জন্যে বরাদ্দ করা হবে। যেমন ফেডারেল রাষ্ট্র সমূহ এবং ফেডারেল কেন্দ্রের মধ্যে অর্থ বণ্টন হয়ে থাকে।
৪। চুক্তিবদ্ধ জাতিসমূহের (Federal Nations) মধ্যে অথবা ফেডারেশনের কোন অংশ ও কেন্দ্রের মধ্যে কোন আইন সম্পর্কিত বিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসা ফেডারেল কোর্ট (Federal Court) করবে।
৫। নিজদের বিশেষ আইন অনুযায়ী মীমাংসার জন্যে প্রত্যেক জাতির স্থায়ী বিচার ব্যবস্থা থাকবে আর কোর্টগুলোর তার পরিপূর্ণ বিচারের এখতিয়ার থাকবে।
তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্ন আসে। এ সম্মিলিত শাসন ব্যবস্থা অপরিহার্যরূপে ‘সমঅংশীদারীত্বের’ নীতি ভিত্তিক হবে। কারণ এ হচ্ছে সার্বভৌম জাতিসমূহের ফেডারেশন। কোন জাতির একক শাসন ব্যবস্থা নয়”।
দ্বিতীয় প্রস্তাব
“যদি আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের এ কাঠামো গ্রহণ করা না হয় তাহলে দ্বিতীয় এ হতে পারে যে, বিভিন্ন জাতির জন্যে পৃথক পৃথক ভূমি খণ্ডের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। যেখানে তারা তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানাতে পারে। অধিবাসী বিনিময়ের জন্যে পঁচিশ বছর অথবা কমবেশী দশ বছরের মুদ্দৎ নির্ধারিত করতে হবে। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে অধিক পরিমাণ আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করতে হবে, ফেডারেল কেন্দ্রের অধিকার কম করা হবে। এ অবস্থায় আমরা মুসলিম রাষ্টগুলোর সাথে মিলে একটা ফেডারেল রাষ্ট্র বানাতে শুধু রাজীই হবো না বরঞ্চ একে প্রাধান্য হবে।
এভাবে এটা সম্ভব যে পঁচিশ বছরের মধ্যে মুসলমানগণ ভারতে অন্যান্য অঞ্চল থেকে হিজরত করে এসব অঞ্চলে এসে একত্র হবে এবং হিন্দুগণ নিকটস্থ অঞ্চলগুলোতে চলে যাবে”।
তৃতীয় প্রস্তাব
“এ প্রস্তাবও যদি গৃহীত না হয় তাহলে সর্বশেষ দাবী আমাদের এই হবে যে, আমাদের (মুসলমানদের) জাতীয় রাষ্ট্রগুলো পৃথকভাবে গঠন করা হোক। তাদের একটা পৃথক ফেডারেশন হবে। এমনকি হিন্দু রাষ্ট্রগুলোরও একটা পৃথক ফেডারেশন হবে। তারপর এ দুই অথবা ততোধিক ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এই ধরনের (Confederation) হতে পারে যেখানে বিশেষ বিশেষ স্বার্থে যেমন প্রতিরক্ষা, পরিবহন ও বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্তে সহযোগিতা হতে পারে”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭৪, ৭৫, ৭৬।]
এ প্রস্তাব পেশের পর মওলানা মওদূদী যে কথাগুলো বলেন তা সেই সময়ের মুসলমানদের নির্ভয় দৃঢ়তাকেই তুলে ধরে। মওলানা বলেন, “আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীগণ এবং তাদের ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকদের ভালো করে বুঝে নেয়া উচিত যে, বর্তমান শাসনতন্ত্র (১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন) এবং এমন প্রতিটি শাসন ব্যবস্থা যা একজাতীয়তার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে তা কোন অবস্থাতেই আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ৭৬।]
মওলানা মওদূদী হিন্দু মুসলমান সমস্যা সমাধানের জন্যে যে তিন তিনটি শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, তারই তিন নম্বর বিকল্পটি ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ একটু পরিবর্তিত আকারে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের আকারে ভারতীয় মুসলমানদের একক এক দাবীতে পরিণত হলো।
এই কারণেই মুসলমানদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রশ্নে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে কোন পার্থক্যই ছিল না। জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে আদর্শিক আন্দোলন অর্থাৎ ইসলামী আন্দোলন চালাবার সাথে সাথে মওলানা মওদূদী দৃঢ়তার সাথে তার রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছেন যা ছিল ঐ সময়ের একান্ত দাবী। বিশেষ করে কংগ্রেসের ঐ সব আলেম ও মুসলমানের পক্ষ থেকৈ যখন প্রশ্ন তোলা হলো ভারতকে খন্ড-বিখণ্ড করা সহ্য করা যায় কিভাবে, তখন মওলানা মওদূদী বললেন, “মুসলমান হিসেবে আমার কাছে এ প্রশ্নের কোন গুরুত্ব নেই যে ভারত অখন্ড থাকবে, না দশ খণ্ডে বিভক্ত হবে। সমস্ত পৃথিবী এক দেশ। মানুষ তাকে সহস্র খণ্ডে বিভক্ত করেছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবী যত খণ্ডে বিভক্ত হয়েছে, তা যদি ন্যায় সংগত হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও কিছু খণ্ডে বিভক্ত হলেই বা ক্ষতিটা কি? এ দেব প্রতিমা খণ্ড বিখণ্ড হলে মনঃকষ্ট তাদের যারা তাকে দেবতা মনে করে। আমি যদি এখানে এক বর্গমাইলও জায়গা পাই যেখানে মানুষের উপর খোদা ব্যতীত অন্য কারো প্রভুত্ব কর্তৃত্ব থাকবে না, তাহলে এ সামান্য ভূমিখণ্ডকে আমি সমগ্র ভারত অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান মনে করব”।–[‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাশ’, মওলানা মওদূদী (জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২১৫, ২১৬)] কংগ্রেসী মুসলমান ছিল মুষ্টিমেয়। কিন্তু কংগ্রেসী সুতার টানে তাদের নর্তন কুর্দন ছিল খুব বেশী। তারা অভিযোগ তুলল মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবী এবং ইহুদীদের ফিলিস্তিন দাবীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এর দাঁত ভাঙা জবাব দিয়েছেন মওলানা মওদূদী। তিনি বলেন, “পাকিস্তান দাবীর সাথে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমির দাবির কোন তুলনা হতে পারে না। ফিলিস্তিন প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের আবাস ভূমি নয়। ইহুদীদের এ অবস্থা নয় যে, জাতীয় আবাসভূমি স্বরূপ তাদের একটা দেশ আছে যার স্বীকৃতির জন্যে তারা চেষ্টা করছে। বরঞ্চ তাদের দাবী হলো, তাদের জাতীয় আবাসভূমি নয় এমন একটা দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এনে তাদের বসবাসের সুযোগ দেয়া হোক এবং বলপূর্বক সে দেশকে তাদের জাতীয় আবাসভূমি বানিয়ে দেয়া হোক। পক্ষান্তরে পাকিস্তান দাবীর ভিত্তি এই যে, যে সব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলো তাদের জাতীয় আবাসভূমি। মুসলমানদের বক্তব্য এই যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সংগে এক হয়ে থাকার ফলে তাদের জাতীয় আবাসভূমির রাজনৈতিক সত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়বলে তা থেকে তাদেরকে রক্ষা করা হোক এবং অখন্ড ভারতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে হিন্দু ভারত ও মুসলিম ভারত নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হোক। অন্য কথায় মুসলমানদের এ দাবী নয় যে, তাদের জন্যে একটা জাতীয় আবাসভূমি বর্তমান রয়েছে স্বতন্ত্রভাবে সেখানে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করার অধিকার তাদের দেয়া হোক”।–[‘তর্জুমানে কোরআন’, জুলাই-অক্টোবর সংখ্যা, ১৯৪৪।]
এইভাবে মওলানা মওদূদীর পক্ষ থেকে সেদিন পাকিস্তান দাবীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল। বিশেষ করে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবদের উপর লেখা তাঁর ‘মাসয়ালায়ে কাউমিয়াত’ গ্রন্থটি পাকিস্তান আন্দোলনকে সীমাহীন সহায়তা দান করে। কংগ্রেস পন্থী মওলনা হুসাইন আহমদ মাদানীর একজাতীয়তাবাদের মতবাদ খণ্ডন একমাত্র মওলানা মওদূদীই করেছিলেন। মওলানা মওদূদীর ঐ গ্রন্থটির লাখ লাখ কপি বিতরণ করা হয়েছিল গোটা ভারতে। বস্তুত মুসলিম জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে জিন্নাহ ও মওলানা মওদূদী একই অবস্থানে ছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মওলানা মওদূদী বরং অধিকতর স্পষ্ট ছিলেন। নয়া দিল্লী থেকে প্রকাশিত “The Jamaat-Islami of Pakistan’ গ্রন্থে এই দিকটি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
“কতকগুলো ক্ষেত্রে মওলানা মওদূদীর যুক্তি জিন্নার চেয়ে সুশৃঙ্খল ও অকাট্য। সাধারণ মুসলমানদের মতে মওলানা মওদূদী ও জিন্নাহ একই কথা বলছেন। যেমন জিন্নাহ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান দুইটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতি-নীতি ও সাহিত্যের অধিকারী। তাদের একে অপরের মধ্যে বিয়ে হয় না, তারা সঙ্গে বসে খায় না এবং তারা দুই দ্বন্দ্বমান ধারণা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল দুই সভ্যতার অধিকারী। এই দুই জাতির ইতিহাসের দুই উৎস থেকে প্রেরণা পেয়ে থাকে। তাদের বীর আলাদা, কাব্য আলাদা, কাহিনী আলাদা”। ঠিক এই সময়েই মওলানা মওদূদী লেন, “সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস শিক্ষার ধারাবাহিকতা থেকে একটি জাতি তার জাতীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়। যখন কোন জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে একই ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৈতিক ধারণার মধ্যে বাস করে, তখন তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তখন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ধারণ করে। তাদের এই ঐতিহ্য চেতনা এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনে প্রবাহিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তারা যৌথ সত্তা লাভ করে একটা জাতিতে পরিণত হয়। একটি জাতির থাকে নির্দিষ্ট অভ্যাস ও রীতি-নীতি যাতে তারা অভ্যস্ত হয়, থাকে তাদের নির্দিষ্ট জীবনবোধ, যাকে তারা ভালোবাসে এবং এই সব কিছুর যোগফল যা তাই হলো সংস্কৃতি”। এই ভাবে মওলানা মওদূদী তাঁর কথার উপসংহার টেনে বলেন যে, “মুসলমানরা এই বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েও একটা স্বতন্ত্র জাতি”। এছাড়া অখণ্ড ভারতে মুসলমানদের ভাগ্য সম্পর্কে জিন্নাহ ও মওদূদী একই ধরনের ভয় পোষণ করতেন। জিন্নাহ বলেন, ‘মুসলিম ভারত এমন কোন শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে একমত হতে পারে না যা একটা হিন্দু সংখ্যাগুরু সরকারের জন্ম দেবে। হিন্দু মুসলমানকে একত্র করে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেবার অর্থ হবে হিন্দু রাজত্ব’। মওদূদীও ঠিক একই কথা বলেন। তাঁর ঘোষণা, “ভারতে যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যে পৃথক নির্বাচন কিংবা অন্য কোন প্রকার রক্ষা ব্যবস্থাই তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে না’। বস্তুত মওদূদী যা বলছিলেন, দেখা যাবে মুসলিম লীগ তাই দাবী করছিলেন”।–[‘The Jamat-Islami of Pakistan’, Kalim Bahadur, Chetana Publication, New Delhi, Page 40-41]
মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর এই রাজনৈতিক ঐক্য দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে মওলানা তাহলে মুসলিম লীগে যোগ না দিয়ে জামায়াতে ইসলামী গঠন করতে গেলেন কেন? এ ব্যাপারে আগেই কিছুটা বলা হয়েছে যে, মুসলিম লীগ শুধুমাত্র মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করছিল। এ জন্যেই আমরা দেখি কায়েদে আযম মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দাবীকেও রাজনৈতিক পোশাক পরিয়ে পরিবেশন করছেন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন মুসলমানদের সামগ্রিক স্বার্থ নিয়ে, যার ভিত্তি ইসলামী জীবনবোধ। এই কারণেই দুই দলের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এক হয়নি। যেমন বলা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছে এবং সরকার গঠনে রাজী হয়েছে। কিন্তু মওলানা এই পদক্ষেপকে মুসলিম স্বার্থের অনুকুল মনে করেননি। মুসলমানদের ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁর আশঙ্কা সে সময় আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল, যার প্রকাশ আমরা দেখি ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘মুসলমান ও বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত’ নিবন্ধে। এ সময়ের অবস্থা সম্পর্কে মওলানা মওদূদী লিখেন, “—–১৯৩৭ সালে এ আশঙ্কা দেখা দিল যে ভারতের মুসলমানরা ঐ ভৌগলিক জাতীয়তার শিকার হয়ে না পড়ে যা প্রবল ঝনঝনার ন্যায় গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। —অতএব এ আশংকা নির্মূল করার জন্যে আমি পত্রিকায় ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ ধারাবাহিকভাবে ১৯৩৭ সালের শেষে এবং ১৯৩৮ সালে লিখি, যা ১৯৩৯ সালের প্রারম্ভে পুস্তকাকারে প্রকাশ লাভ করে। এসব নিবন্ধাদিতে আমার লক্ষ্য ছিল এই যে, মুসলমানরা যেন অন্তত পক্ষে তাদের মুসলমানিত্বের নিম্নস্তরে নেমে না যায় এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা হারিয়ে না ফেলে। এজন্যে আমি তাদের মধ্যে ইসলামী জাতীয়তার অনুভূতি জাগ্রত করার চেষ্টা করি। তাদেরকে সেই গণতান্ত্রিক ধর্মহীন শাসন ব্যবস্থার অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেই, যা একজাতীয়তার ধারণার ভিত্তিতে ভারতে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছিল। সেই সাথে ঐ সব ‘আইনানুগ রক্ষাকবচ এবং মৌলিক অধিকার’ এর তাৎপর্যও ব্যাখ্যা করি যার উপর আস্থা পোষণ করে মুসলমানগণ ঐ ভয়াবহ গণতান্ত্রিক সংবিধানের জালে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করছিল। একথা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তিই এখঅনে ইসলামকে সমুন্নত দেখতে চায় সে অবশ্যই এ ধারণা পোষন করব যে তার নিকটে পূর্ব থেকেই যে পুঁজি মওজুদ আছে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায়। তারপর সে অতিরিক্ত পুঁজি লাভ করার চেষ্টা করবে। যারা প্রথম থেকে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’তে বিশ্বাসী এবং নিজেদেরকে মুসলমান বলে, তাদের সম্পর্কেই আমাদের প্রথমে চিন্তা করা দরকার। তারা যেন বিনষ্ট হয়ে না যায়। এ জন্যে আমি আমার সর্বর্শক্তি নিয়োগ করি যাতে মুসলমানদেরকে অমুসলিম জাতীয়তার মধ্যে একাকার হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যায় এবং তাদের মধ্যে এ অনুভূতি সৃষ্টি করা যায় যে তারাএকটি স্থায়ী জাতীয়তার ধারক ও বাহক। তাদের জন্যে এ কিছুতেই সম্ভব নয় যে, তারা অন্য জাতির মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ২১৮, ২১৯।]
প্রমাণিত হয়েছে মওলানা মওদূদীর এ দৃষ্টিভঙ্গীই সঠিক ছিল। মুসলিম লীগ ও কায়েদে আযম পরে এই নীতিতেই ফিরে আসছিলেন। তারা এ চূড়ান্ত উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন যে, বিপুল হিন্দু সংখ্যাগুরুত্বের মধ্যে গণতন্ত্র মুসলমানদের জন্যে কোন রক্ষাকবচ নয়, এমনকি অখণ্ড ভারতে একক একটি রাষ্ট্রে কোন প্রকার শাসনতান্ত্রিক গ্যারাণ্টিই মুসলমানদের জন্যে যথেষ্ট হবে না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো তারা বুঝলেন যে, মুসলমানরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি জাতি, তাদের আবাসভূমিও ভারতে চিহ্নিত যেখানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা ভারতে এক রাষ্ট্র এক শাসনতন্ত্রের অধীনে নিজেদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করে ধ্বংসের পথে যেতে পারে না। বস্তুত মওলানা মওদূদী মুসলমানদের মধ্যে এই উপলব্ধি সৃষ্টির জন্যে ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে প্রাণপাত প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগ ও কায়েদে আযম যখন এই উপলব্ধিতে পৌঁছিলেন, তখন মওলানা মওদূদী স্তস্তি প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “আমি এখন দেখছি যে, মুসলিম জাতি খোদার ফজলে হিন্দু জিাতির মধ্যে একাকার হয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেছে। তাদের মধ্যে আপন জাতীয়তার অনুকূলে এতোটা মজবুত হয়েছে যে, কোন নেহেরু এবং গান্ধীর সাধ্য নেই যে, তাদেরকে হিন্দু এবং ভারতীয় জাতীয়তার মধ্যে একীভূত করে ফেলে”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ২২১, ২২০] মওলানার ১৯৩৯ সালের এ ভবিষ্যত বাণী বা অনুমান সত্য প্রমাণ হয়েছিল। নেহেরু গান্ধীর কোন ছল-চাতুরীই লাহোর প্রস্তাব ঠেকাতে পারেনি।
বস্তুত সামগ্রিক লক্ষ্যগত পার্থক্য অর্থাৎ মুসলিম লীগের অসম্পূর্ণতার কারণেই মওলানা মওদূদী মুসলিম লীগে যোগ দিতে পারেন নি এবং জামায়াতে ইসলামী গঠন তাঁর জন্যে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি মওলানাকে চিঠি লিখলে তার জবাবে মওলানা লীগের এ অসম্পূর্ণতার কথাই তুলে ধরেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “আপনারা কখনও এ কথা মনে করবেন না যে কোন প্রকার মতানৈক্যের কারণে আমি অংশগ্রহণ করছি না। প্রকৃত পক্ষে আমার অক্ষমতা এই যে, আমি বুঝতে পারছি না যদি অংশ গ্রহণ করি তাহলে কিভাবে করব। অর্ধ বা অসম্পূর্ণ উপায় পদ্ধতি আমার মনে ধরে না”।–[‘তরজুমানুল কোরআন’, জুলাই-অক্টোবর, ১৯৪৪ (উদ্ধৃত, ‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা ২১৫।)] মুসলিম লীগের এই অসম্পূর্ণতার পটভূমিতে জামায়াতে ইসলামী গঠনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে মওলানা যা বলেছেন তা এইঃ “যদি আমাদের লক্ষ্য হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠা, তাহলে সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে আমাদের জাতিকে নৈতিক দিক দিয়ে তৈরী করে নিতে হবে। এর জন্যে শিক্ষা, দীক্ষা, চিন্তাধারা, নৈতিকতা, তাহযীব তামাদ্দুন, রাজনীতি, প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই আমাদেরকে কাজ করতে হবে। এই কাজ ছাড়া এ উদ্দেশ্য সফল হওয়া বড় কঠিন। —-এ আন্দোলনে সঠিকভাবে ও সকল বিভাগে নেতৃত্ব নির্বাচনের অতি সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে। সমাজতন্ত্রী, নাস্তিক, ধর্মহীন, জায়গীরদার, জমিদার, প্রভৃতি সকলকে একস্থানে একত্র করলে যে ভীড় জমে ওঠে তা কোন দিনই জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে না। এরা তো একেঅপরের ধ্বংস সাধনে ও নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই জাতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ফলে গন্তব্য স্থান থেকে লক্ষ্যচ্যুত হতে হবে। —-মুসলমাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এই যে তারা একটি আদর্শবাদী ও সত্যের দিকে আহবানকারী দল। কোন মূল্যেই যেনতার এ বৈশিষ্ট্য প্রভাবিত না হয়”।–[‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’, পৃষ্ঠা ২১৪]
এক কথায় মুসলিম লীগ ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলন, আর জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মুসলমানদের সামগ্রিক স্বার্থের আন্দোলন অর্থাৎ ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। এ ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শুধু বৃটিশ ভারত নয়, এর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা উত্তর ভারতও। মুসলিম লীগের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হলেই অর্থাৎ মুসলমানদের স্বাধীনতা অর্জিত হলেই মুসলিম লীগের কাজ লক্ষ্যগত দিক থেকে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তখনই প্রকৃতপক্ষে শুরু হবে রাষ্ট্রপরিচালনা ছাড়াও জাতি হিসেবে মুসলমানদের পূর্ণ বিকাশ ঘটানোর আসল কাজ। এ বিরাট ও মহান কাজ আঞ্জাম দেওয়া ছিল জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য। এই লক্ষ্যগত দিক থেকে জামায়াতে ইসলামীর কাজ ভৌগলিক সীমানা ও কালের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। মুসলিম ভারত, হিন্দু ভারত-দু’জায়গাই তার কাজের সমান ক্ষেত্র। তাই তো স্বাধীনতা উত্তরকালে আমরা দেখছি, ভারত, পাকিস্তান, কাশ্মীর, শ্রীলংকা সব জায়গায় জামায়াতে ইসলামী মুসলিম জাতিগঠন ও ইসলামী রেনেসাঁর কাজে প্রাণপাত চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বস্তুত ১৯৪১ সালে মওলানা মওদূদী কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী গঠন ছিল হিমালয়ান উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের এই পতাকা মওলানা মওদূদী পুনঃ উত্তোলন করলেন, তা এই হিমালয়ান উপমহাদেশে প্রোথিত হয়েছিল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, হযরত শাহ জালাল, শাহ মখদুম, খান জাহান আলী, শেখ আহমদ সরহিন্দী, শাহওয়ালী উল্লাহ দেহলবী, হাজি শরীয়তুল্লাহ প্রমুখ মুসলিম জননেতাদের দ্বারা এবং সর্বশেষে তা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের ষাটের দশকে ইসলামকে বিজয়ী করা ও বৃটিশকে উৎখাত করার শত বছর ব্যাপী সংগ্রামের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে। সুতরাং ১৯৪১ সালে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের পুনরুত্থান ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। উপমহাদেশীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক জীবনের সাথে এর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।