১২
পরিশিষ্ট
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা।
২। ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে কায়েদে আযমের ভাষণ।
৩। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে জিন্নাহ-গান্ধীর মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনা ব্যর্থ হবার পর উভয়পক্ষের সাংবাদিক সাক্ষাতকার।
৪। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের পূর্ণ বিবরণ।
পরিশিষ্ট-১
শিবাজী উৎসব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোন্ দূর শতাব্দের কোন্ এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজি
মারাঠার কোন শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে ব’সে,
হে রাজা শিবাজী,
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎ প্রভাবৎ
এসেছিল——
এক ধর্মরাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি’।
সেদিন এ বঙ্গদেশে উচ্চকিত জাগেনি স্বপনে,
পায়নি সংবাদ—-
বাহিরে আসেনি ছুটে, উঠে নাই তাহার প্রাঙ্গনে
শুভ শঙ্কনাদ—-
শান্তমুখে বিছাইয়া আপনার কোমল নির্মল
শ্যামল উত্তরী
তন্দ্রাতুর সন্ধ্যাকালে শত পল্লী সন্তানের দল ছিল বক্ষে করি।।
তার পরে একদিন মারাঠার প্রান্তর হইতে
তব বজ্র শিখা
আঁকি দিগদিগন্তে যুগান্তরের বিদ্যুৎবহ্নিতে
মহামন্ত্রলিখা।
মোগল-উষ্ণীষশীর্ষ প্রস্ফুরল প্রলয় প্রদোষে
পঙ্কপত্র যথা—-
মোগল-উঞ্চীষশীর্ষ প্রস্ফুরিল প্রলয় প্রদোষে
পঙ্গপত্র যথা—
সেদিনও শোনেনি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে
কী ছিল বারতা।
তার পরে শূন্য হল ঝঞ্জাক্ষুব্ধ নিবিড় নিশীথে
দিল্লীরাজশালা—
একে একে কক্ষে কক্ষে অন্ধকারে লাগিল মিশিতে
দীপালোকমালা।
শবলুব্ধ গৃধুদের ঊর্ধ্বংস্বর বীভৎস চীৎকারে
মোগলমহিমা
রচিল শ্মশানশয্যা-মুষ্টিমেয় ভস্মরেখাকাধে
হল তার সীমা।
সেদিন এ বঙ্গপ্রান্তে পণ্য বিপনীর একধারা
নিঃশব্দচরণ
আনিল বণিকলক্ষ্ণী সুরঙ্গপথের অন্ধকারে
রাজসিংহাসান।
বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি
নিল চুপে চুপে-
বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।
সেদিন কোথায় তুমি হে ভাবুক, হে বীর মারাঠি,
কোথা তব নাম!
গৈরিক পতাকা তব কোথায় ধুলায় হল মাটি
তুচ্ছ পরিণাম?
বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলি করে পরিহাস
অট্টহাস্যরবে-
তব পূন্যচেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস,
এই জানে সবে।
অয়ি ইতিবৃত্তকথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ
অগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন’-পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে তব ব্যঙ্গবাণী?
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না
ত্রিদিবে,
নিশ্চয় সে জানি।
হে রাজতপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা
বিধির ভাণ্ডারে
সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা
পারে হরিবারে?
তোমার সে প্রাণোৎসর্গ, স্বদেশলক্ষীর পূজাঘরে সে সত্যসাধন,
কে জানিত, হয়ে গেছে চিরযুগযুগান্ত তরে
ভারতের ধন?
অখ্যাত অজ্ঞাত রহি দীর্ঘকাল হে রাজবৈরাগী
গিরিদরীতলে,
বর্ষার নির্ঝর যথা শৈল বিদারিয়া উঠে জাগি
পরিপূর্ণ বলে,
সেইমত বাহিরেলে বিশ্বলোক ভাবিল বিস্ময়ে
যাহার পতাকা অম্বর আচ্ছন্ন করে, এতকাল এত ক্ষুদ্র, হয়ে
কোথা ছিল ঢাকা।।
সেইমত ভাবিতেছি আমি কবি এ পূর্ব-বারতে
কী অপূর্ব হেরি,
বঙ্গের অঙ্গনদ্বারে কেমন ধ্বনিল কোথা হতে তব জয়ভেরি।
তিন শত বৎসরের গাঢ়তম তমিস্র বিদারি
প্রতাপ তোমার
এ প্রাচীদিগন্তের আজি নবতর কী রশ্মি প্রসারি উদিল আবার।
মরে না, মরে না কভু সত্য যাহা শত অস্থির, আঘাতে না টলে।
যারে ভেবেছিল সবে কোনকালে হয়েছে নিঃশেষ
কর্মপরপারে,
এল সেই সত্য তব পুজ্য অতিথির ধরি বেশ ভারতের দ্বারে।
আজও তার সেই মন্ত্র-সেই তার উদার নয়ান
ভবিষ্যতের পানে
একদৃষ্টে চেয়ে আছে, সেথায় সে কি দৃশ্য মহান,
হরিছে কে জানে।
অশরীরী হে তোপস, শুধু তব তপোমূর্তি ললে আসিয়াছি আজ-
তবু তব পুরাতন সেই শক্তি আনিয়াছ বয়ে,
সেই তব কাজ।
আজি তব নাহি ধ্বজা, নাই সৈন্য, রণ-অশ্বদল
অস্ত্র খরতর আজি আর নাহি ধ্বজা, নাই সৈন্য, রণ-অশ্বদল অস্ত্র খরতর
আজি আর নাহি বাজে আকাশেরে করিয়া পাগল
‘হর হর হর’।
শুধু তব নাম আজি পিতৃলোক হতে এল নামি,
করিল আহবান….
মুহুর্তে হ্রদয়াসনে তোমারেই বরিল হে স্বামী
বাঙালির প্রাণ।
এ কথা ভাবেনি কেহ, এ তিন শতাব্দকাল ধরি,
জানেনি স্বপনে….
তোমার মহৎ নাম বঙ্গ মারাঠারে এক করি দিবে বিনা রণে,
তোমার তপস্যাতেজ দীর্ঘকাল করি অন্তর্ধান
আজি অকস্মাৎ
মৃত্যুহীন বাণী রপে আনি দিবে নতুন পরান-
নূতন প্রভাত।
মারাঠার প্রান্ত হতে একদিন তুমি ধর্মরাজ,
ডেকেছিলে যবে
রাজা ব’লে জানি নাই, মানি নাই, পাই নাই লাজ
সে ভৈরব রবে।
তোমার কৃপাণদীপ্তি একদিন যবে চমকিলা
বঙ্গের আকাশে
যে ঘোর দুর্যোগদিনে না বুঝি রুদ্র সেই লীলা
লুকানো ভরাসে।
মৃত্যুসিংহাসনে আজি বসিয়াছ অমর মুরতি-
সমুন্নত ভালে
যে রাজকিরীট শোভে লুকাবে না তার
দিব্যরাজোতি
কভু কোনোকালে।
তোমারে চিনেছি আজ চিনেছি চিনেছি হে রাজন
তুমি মহারাজ,
তব রাজকর লয়ে আট কোটি বঙ্গের নন্দন
দাঁড়াইবে আজ।
সেদিন শুনি নি কথা-আজ মোরা তোমার আদেশ
শির পাতি লব
কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিব সর্বদেশ
ধ্যানমন্ত্রে তব।
ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরীবসন—
দরিদ্রের বল
‘একধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন
করিব সম্বল।
মারাঠির সাথে আজি হে বাঙালি, এক সঙ্গে চলো
মহোৎসবে সাজি।
আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম পূরব
দক্ষিনে ও বামে
একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব
এক পূর্ণ নামে।
পরিশিষ্ট-২
১৯৪৩ সালের এপ্রিলে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে কায়েদে আযমের ভাষণঃ
সমাগত ডেলিগেট ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
পুনরায় আপনারা যে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করিয়াছেন, তজ্জন্য আমি আপনাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। এই সম্মান ও মর্যাদা যে কোনও লোকেরই কাম্য। আশা করি আগামী বৎসর আমি আপনাদের সহযোগিতায় ও সমর্থনে নিখিল ভারত মোছলেম লীগের নীতি ও কার্যক্রম পরিচালনে সক্ষম হইব। আমি নিখিল ভারত মোছলেম লীগের আভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর একটা হিসাব দিতে চাই।
বাংলার ঘটনাবলী
মোছলেম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনের পর এক বৎসরে মোছলেম লীগ যে ভারতের সবৃত্র অধিক হইতে অধিকতর পরিমাণে শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে তাহাতে সন্দেহের লেশমাত্রও নাই (হর্ষধ্বনি)। আপনারা জানেন, গত ১৬ মাস বাংলায় আমাদের উপর গজব নাজেল হইয়াছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের নিজেদের লোকই মোছলেম স্বার্থের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা প্রদর্শন করিয়াছে। আমি মনে করি এই কয়মাসে বাংলার মুছলমানগণ এমনবাবে নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করিয়াছে যাহার নজীর বাংলার ইতিহাসে নাই (হর্ষধ্বনি)। তাহারা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করিয়াছে। আমি বাংলার মুছলমানদিগকে অভিনন্দিত করিতেছি (শুনুন, শুনুন)। এই ব্যাপারে বাংলার মোছলেম যুবকদের এই কৃতিত্ব অনেকখানি। তাঁহারাই অত্যাচারীর দফা-রফা করিয়া দিয়াছেন (শুনুন, শুনুন ও হর্ষধ্বনি)। কয়েক মাস পূর্বে নাটোর নির্বাচনে ইহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। আমি আনন্দের সহিত বলিতেছি যে, আমাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা যে প্রার্থী দাড় করাইয়াছিলেন তাঁহার জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হইয়া যায়। প্রত্যেক উপনির্বাচনেই আমরা জয়লাভ করিয়াছি। উচ্চ পরিষদের গত নির্বাচনে আমরা সবগুলি আসনই দখল করিয়াছি। ন্যায়-নিষ্ঠার প্রাথমিক নীতি পদদলিত করিয়া ফজলুল হক গবর্নমেন্ট স্বৈরাচার, নির্যাতন, ছল-চাতুরী ও কলা-কৌশল নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন বলিয়া বাংলায় আমরা অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়াছি।
বাংলা এই রূপে প্রমাণ করিয়াছে যে, সেখানে ছল চাতুরী করার আর উপায় নাই। বাংলা এক দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করিয়াছে। উহা হইতে অন্যেরা শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারে (শুনুন, শুনুন ও উচ্চ উল্লাসধ্বনি)। লীগ এক্ষণে জনমতের প্রতীক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মিল্লাতের কর্তৃত্ব এক্ষণে লীগের উপরই অর্পিত হইয়াছে। মোছলেম জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হইলেও ইহার নিকট আপনাদের শির নত করিতে হইবে (পুনঃ পুনঃ হর্ষধ্বনি)।
যদিও আনন্দে আত্মহারা হওয়ার মত কিছু ঘটে নাই, আমি আনন্দিত যে, মুছলিম লীগ পার্টির নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা পরিচালিত হইতেছে। অভ্যর্থনা-সমিতির চেয়ারম্যান সত্যই বলিয়াছেন যে, আসামে লীগ মন্ত্রীসভা, কিংবা লীগ পার্টির প্রভাবান্বিত মন্ত্রীসভা গঠিত হইয়াছে। এইরূপে বাংলা, সিন্ধু এবং পাঞ্জাবেও লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হইয়াছে। আমরা ইহা অভিনন্দিত করিতেছি। কিন্তু আমাদের কর্তব্য সমাধা হইয়াছে, আমরা যেন কখনও এরূপ ভাব পোষণ না করি। ইহা সূচনা মাত্র (উল্লাসধ্বনি)। আমরা মন্ত্রীদের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করিব না পরন্তু মন্ত্রীগণই আমাদের জন্য সকল ত্যাগ স্বীকার করিবেন (উচ্চ হর্ষধ্বনি)। এই মন্ত্রীগণ যতদিন পর্যন্ত লীগের মূলনীতি মানিয়া চলিবেন ততদিন পর্যন্ত আমরা নিশ্চয়ই তাহাদিগকে সমর্থন করিব কিন্তু আমি পুনরায় সুস্পষ্ট ভাবে জানাইয়া দিতে চাই যে, এক্ষণে আমরা এমন এক স্তরে আসিয়া পৌঁছাইয়াছি যে, প্রয়োজন হইলে যে কোন মন্ত্রীসভার সমর্থনে আমরা বিরত থাকিতে দ্বিধাবোধ করিব না (হর্ষধ্বনি)।
মোছলেম সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহ
মোছলেন সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহের কথা ভুলিয়া যাইবেন না। মোছলেম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহ যখন আঁধারে সমাচ্ছন্ন ছিল তখন মোছলেন সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহই তথাই আলোক বিকীরণ করে। মোছলেন সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহ মোছলেম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের উন্নতির জন্য, উপকারের জন্য নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। শুধু মোছলেম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলি দুঃখ কষ্টের ভূমিকায় অভিনয় করিলেই চলিবে এইরূপ ধারণা কখনও মনে স্থান দিবেন না (হর্ষধ্বনি)। সংখ্যালঘু প্রদেশের মুছলমানেরা বহু নির্যাতন ভোগ করিয়াছে এবং উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সাড়ে সাত কোটি মোছলেম ভ্রাতার স্বাধীনতার জন্য আমরা যে কোন পরিণতির সম্মুখীন হইতে প্রস্তুত আছি।
মোছলেম জাতির লক্ষ্য ও আদর্শ
আমাদিগকে অনেক কিছু করিতে হইবে। আমরা কি জন্য সংগ্রাম করিতেছি তাহা অবশ্য এক্ষনে পরিস্কার হইয়া গিয়াছে। যে ব্যক্তি ইহা বুঝে না বলিয়া ভান করে, তাহাকে কি নামে অভিহিত করিব? হয় সে ‘আহমক, না হয় কপট। আমাদের আদর্শ ও দাবী পরিস্কার। আমরা কি চাই? আমাদের নিজস্ব আবাস ভূমিতে এবং যেখানে আমাদের সংখ্যাধিক্য রহিয়াছে সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিতে চাই। অন্য কথায়, যে সমস্ত অঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ও মুছলমানদের সংখ্যাল্পতা রহিয়াছে সে সমস্ত অঞ্চলের সহিত আমরা মিশিয়া যাইতে চাই না। এক্ষণে আমি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করিতেছি।
অতীত ঘটনাবলীর উপর আলোকসম্পাত
প্রথমতঃ ১৮৬১ সনের এবং পরে আইনে বড়লাটের তথাকথিত কাউন্সিলে অতি সামান্য পরিমাণ প্রতিনিধিত্বই দেওয়া হইয়াছিল। ইম্পিরিয়াল কাউন্সিল, লোকাল কাউন্সিল, মিউনিসিপাল বোর্ড, লোকাল বোর্ড অথবা জেলা বোর্ড সমূহে তখন অল্প সংখ্যক নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রেরিত হইতেন। তখন কোন মুসলমানের পক্ষে নির্বাচিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না। তারপর আসে মিন্টোমর্লে প্রস্তাব। এই প্রথম প্রকৃত প্রস্তাবে নির্বাচন নীতির সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হয়। ১৮৮৪ সন হইতে ১৯০৭ সন পর্যন্ত মুছলমানেরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তাহারই ফলে ঐ সময় পৃথক নির্বাচনের দাবী উত্থাপন করে। তখন আমার বয়স খুব অল্প। মহান হিন্দু নেতা গোখলে ও দাদাভাই নৌরজী কতকগুলি নীতি Imbibe করেন। তন্মধ্যে একটি হইতেছে যে, সমানাধিকারের ভিত্তিতে দেশের এই দুইটি প্রধান জাতির মধ্যে যাহাতে বুঝাপড়া হয় তজ্জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ। ঐ সময় মিঃ গোখলে মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেন। তিনি ছিলেন উদার ও উন্নতমনা রাজনীতিক এবং তাহার প্রতিভাও ছিল বিরাট। ১৯০৭ সনে গোখলে ঘোষণা করেনঃ “হিন্দুরা সংখ্যায় অত্যধিক বলিয়া মুছলমানেরা স্বভাবতঃই আশঙ্কা করিতে পারে যে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে তাহারা হিন্দুদের দাসে পরিণত হইতে পারে। তাহাদের এই আশঙ্কা উপহাসের বস্তু নহে। সংখ্যার দিক দিয়া হিন্দুদের অবস্থা যদি মুছলমানদের ন্যায় হইত তবে তাহারাও কি এইরূপ সংশয়ে পতিত হইত না? নিঃসন্দেহে আমাদের মনেও এইরূপ আশঙ্কার উদ্রেক হইত এবং মুছলমানেরা আজ যে নীতি অবলম্বন করিতেছে আমরাও সেই নীতিই অবলম্বন করিতাম”।
মি বিগিন পালের স্বপ্ন
হিন্দু ও মুছলমানের মধ্যে ন্যায় ও যুক্তসঙ্গত শর্তে মিটমাট হইবে, দাদাভাই নৌরজীর ন্যায় মান ব্যক্তি এইরূপ আশা দ্বারা আমাদিগকে অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু স্মরণ রাখিবেন, ঐ সময়ও এমন একদল লোক ছিলেন যাঁহারা হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। বিশিষ্ট হিন্দুনেতা মিঃ বিপিন চন্দ্র পালের একটা উক্তি আমি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি। ১৯১৩ সনে মিঃ পাল ঘোষণা করেনঃ “আমাদের জাতীয় স্বাতন্ত্রের ভিত্তি শুধু আঞ্চলিক পার্থক্য অথবা রাজনৈতিক কিম্বা অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপরই প্রতিষ্ঠিত নহে, এই স্বাতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির উপর। মোচলেম আমলে হিন্দু ও মুছলমান সকলেই একই শাসনাধীনের ছিল কিন্তু তাহার ফলে হিন্দুর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হয় নাই। মুসলমান প্রতিবেশীগণের অনেক আচার পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করিয়াছি; এবং তাহারাও আমাদের অনেক আচার পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু ভাবের রীতিনীতির এই আদান প্রদানে আমাদের কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয় নাই। জাতীয়তা বলিতে এখন আমরা যাহা বুঝি; তাহার মান হইতেছে এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। ইহা শুধু একটি রাজনৈতিক আদর্শ বা ভাবধারাই নহে। ইহা এমন একটা জিনিস, যাহা আমাদেরই সমষ্টিগত জীবন ও কার্যক্ষেত্রের প্রত্যেক স্তরকে স্পর্শ করে। ইহা আমাদের পারিবারিক, সাম্প্রদায়িক, সামাজিক এবং আমাদের অর্থনৈতিক আচার-পদ্ধতির সহিত ওতঃপ্রোতভাবে বিজড়িত হইয়া রহিয়াছে। জাতীয়তা সম্পর্কে আমাদের মনে যে ধারনা রহিয়াছে, কোন কোন দিক দিয়া রাজনীতিই হইতেছে ইহার মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইউরোপের তথাকথিত রাজনৈতিক ভাবধারা অনুসরণে আমাদের প্রকৃত জাতীয় জীবনের উন্মেষ, তো হইবেই না, বরং তাহাতে বাধার সৃষ্টি হইবে”।
তিনি আরও বলেনঃ “ভারতের জাতীয় আন্দোলন মূলতঃ হিন্দু আন্দোলন। ইহা (১) আদর্শগতভাবে (ক) হিন্দুজাতীয়তা (খ) যুক্ত আন্তর্জাতিকা ও (গ) বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের পরিপোষক, (২) কার্যতঃ ইহার উদ্দেশ্য (ক) হিন্দু সংস্কৃতি ও এছলামিক সংস্কৃতি পর্যালোচনায় উৎসাহ দান, পারস্পরিক বুঝাপড়া ও সহযোগিতার মনোবৃত্তি জাগরিত করিয়া তোলা, (৩) বৃটিশ সাম্রাজ্যের আওতায় ক্রমে ক্রমে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র গড়িয়া তুলিয়া তাহা মারফৎ বৃটিশের সহিত সম্পর্ক রাখা এই ফেডারেশনের ভারত, মিছর, আয়ারল্যাণ্ড ও বৃটিশ উপনিবেশসমূহসহ গ্রেট-বৃটেনের সম অংশীদার হইবে এবং (৪) বিশ্ব ফেডারেশন গঠনে সহায়তা করা।
ইহার মতলব কি? হিন্দু জাতীয়তা নয় কী? কিন্তু আমি আশা ছাড়ি নাই। ১৯১৩ সনে কংগ্রেসের করাচী অধিবেশনের পর দ্বিগুন উৎসাহে কাজে লাগিয়া যাই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ভ্রান্ত ধারণা নিরসন করা। হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে আরো অনেকে এ বিষয়ে বিশেষ প্রচেষ্টা করেন। আমার চেষ্টায় কংগ্রেস ও মোছলেম লীগ অন্ততঃপক্ষে একটি শহরে সমবেত হয়। এই ঘটনা ঘটে ১৯১৫ সনে। অক্লান্ত চেষ্টার পর আমি এই দুইটি প্রতিষ্ঠানকে বোম্বাইয়ে সমবেত করিতে সক্ষম হই। ঐ সময় যুদ্ধ চলিতেছিল। কাজেই আশা করা গিয়েছিল যে এই দেশে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সম্পর্কে গভর্ণমেন্ট নীতি ঘোষণা করিবেন। ঐ সময় আমাদের বন্ধু বৃটিশের ইচ্ছা ছিল না যে, এই দুইটি প্রতিষ্ঠান একই শহরে, একই গৃহে সমবেত হয়। এখনও তাঁহাদের এ নীতির পরিবর্তন হইয়াছে বলিয়া আমি মনে করি না। আপনারা জানেন, পুলিশের সম্মুখেই নিখিল ভারত মোছলেম লীগের প্রথম অধিবেশন ভাঙ্গিয়া যায়। আমরা গভর্ণমেন্টকে এ বিষয়ে তদন্ত করিতে অনুরোধ করি। কারণ আমাদের ধারণা ছিল যে, পুলিশের মৌন সম্মতি এবং আমলাতন্ত্রের সমর্থন ক্রমেই মোছলেন লীগ অধিবেশন ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয়। আবি বিস্তৃত বিবরণী দিতে চাই না। ইহা ইতিহাসের বস্তু। পরবর্তী বৎসরের শেষ ভাগে অর্থাৎ ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পুনরায় কংগ্রেস ও লীগ লাখনৌ এ সমবেত হয়। তথায় আমরা লাখনৌ চুক্তি সম্পাদন করি। ইহা হিন্দু মোছলেম লাখনৌ চুক্তি নামে অভিহিত হয় কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নানা উপায়ে ঐ প্যাক্টের অঙ্গহানি করেন। ইহার পর আসে মটেগু-চেমসফোর্ড ঘোষণা।
মিঃ গান্ধীর স্বরূপ
১৯১৬-১৭ সালের কথা। যখন এই সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছিল তখন ভারতাকাশে উদিত হইলেন মিঃ গান্ধী। ১৯২০ সালের ১২ই মে তারিখের “ইয়ং ইন্ডিয়া” পত্রে মিঃ গান্ধী ঘোষনা করেন। স্মরণ থাকিতে পারে যে, ৭ বৎসর পূর্বে এই মাসেই মিঃ বি, পি, পাল তাঁহার ঘোষণা প্রচার করেন। মিঃ গান্ধী কি বলিয়াছিলেন? তিনি বলিয়াছিলেন- “এইগুলিকে আমি রাজনীতি বলিয়া মনে করি না- ধর্ম বলিয়া মনে করি। এইগুলি ধর্মকার্যে সহায়তা করিয়া থাকে”। আপনারা পরে দেখিতে পাইবেন, তিনি তাঁহার ঘোষণা মোতাবেক কি করিয়াছেন। তিনি আরো বলেন, “আমার রাজনৈতিক সত্তা আমার কোন সিদ্ধান্তের উপরই প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। আজকাল রাজনীতি আমাদিগকে সাপের ন্যায় কুণ্ডলী পাকাইয়া ধরিয়া রাখিয়াছে বলিয়া আমি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করি। যে যত চেষ্টাই করুক না কেন ইহা হইতে বাহির হইয়া আসা কাহারো পক্ষে সম্ভব নহে। এই সর্পের সহিত লড়িবার জন্য আমি এবং আমার সহকর্মীগণ, রাজনীতিতে ধর্মের আমদানী করিয়া রাজনীতি ক্ষেত্রে পরীক্ষা কার্য চালাইতেছি”।
পরে বুঝিতে পারিবেন; মিঃ গান্ধী এই পরীক্ষা কার্য চালাইয়াছেন প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থতার মধ্যদিয়া। ১৯২১ সনে নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেসের উপর মাতব্বরী প্রতিষ্ঠার পর ঐ সনের ১২ই অক্টোবর তারিখে “ইয়ং ইণ্ডিয়া” পত্রে মিঃ গান্ধী লিখিয়াছিলেন, “আমি নিজেকে একজন সনাতনী (গোঁড়া) হিন্দু বলিয়া মনে করি, কারণ প্রথমতঃ আমি বেদ, পুরাণ এবং হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসী, আর সঙ্গে সঙ্গে অবতারবাদ এবং পুনর্জ্জন্মেও বিশ্বাসী” অবশেষে তিনি নিজেই একজন অবতার হইয়া পড়েন (হাস্য)।
“দ্বিতীয়তঃ আমি বর্ণাশ্রম ধর্ম (জাতিভেদ প্রথা) ও ইহার বৈদিক নীতিতে বিশ্বাসী। তৃতীয়তঃ আমি গো-রক্ষা কার্য কর্তব্য বলিয়া মনে করি। ইহাকে আমি বিশ্বাসের বস্তু বলিয়াই মানি। চতুর্থতঃ মুর্ত্তি পূজায় আমি অবিশ্বাসী নই”।
কেমন মোলায়েম করিয়া বলিয়াছিলেন, “আমি মূর্ত্তি পূজায়ও অবিশ্বাসী নই”। মিঃ গান্ধীর এই সমস্ত পরিস্কার ও অদ্ব্যর্থক ঘোষণা সত্ত্বেও হিন্দু জাতীয়তাবাদীগণ কিছুটা বিচলিত হইয়া পড়েন। তাঁহারা জানিতেন না এই লোকটা কত চালাক ও চতুর। কাজেই তাঁহাদের মধ্যে কিছুটা আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। তাঁহাদিগকে আশ্বস্ত করার জন্য তিনি পুনরায় ১৯২৪ সনে ঘোষণা করেনঃ “এইরূপ কানাঘুষা হইতেছে উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারাইয়া ফেলিয়াছি। কিন্তু আমি হিন্দু-মনোবৃত্তির প্রতীক এবং আমার হিন্দুত্বের উৎকণ্ঠা সাধন করিতে না পারি তবে হিন্দু ধর্মের প্রতি আমার আস্থা যে শিথিল তাহাই প্রমণিত হইবে”। তথাপি আমি যখন তাঁহাকে একজন হিন্দু হিসাবে আমার সহিত মোলাকাত করিতে বলি তখন তিনি তাহাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবুও তিনি বলেন, তাঁহার দেহের প্রত্যেক অণুপরমাণুই হিন্দু (হাস্য)। ইহার অর্থ এই যে, তাঁহার হিন্দু মনোবৃত্তি অভেদ্য। এই তো গেল ১৯২৪ সনের কথা।
মিঃ গান্ধীর একগুঁয়েমী
আপনারা জানেন, ১৯২৫ সন হইতে হিন্দু মোছলেম বিভেদ দূরীভূত করার জন্য বহু প্রচেষ্টা করা হইয়াছে। প্রত্যেকবার আমরা মিঃ গান্ধী ও কংগ্রেসের দুয়ারে আমাদের প্রস্তাব লইয়া ধর্না দিয়াছি। তাঁহাদের হুজুরে আর্জ্জি পেশ করিয়াছি। যে কোন কারণেই হোক, প্রত্যেকবারই ‘না’ উত্তর আসিয়াছে। তাঁহারা কখনও কোন বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন নাই। আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে, ১৯২৭ সনে দিল্লীতে আমরা কতকগুলি প্রস্তাব রচনা করি। সৌভাগ্য বশতঃই হউক আর দুর্ভাগ্য বশতঃই হউক, ঐ উক্ত সনের শেষ ভাগে কংগ্রেসের মাদ্রাজ বৈঠকে ঐগুলি কার্যতঃ গ্রহীত হয়। একরূপ সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হইয়া যায় এবং যুক্তভাবে রাজনৈতিক দাবী উত্থাপনের জন্য মোছলেম লীগ ও কংগ্রেস কর্তৃক দুইটি কমিটি গঠিত হয়। আমি আপনাদিগকে জানাইতেছি যে, এই দুইটি কমিটির বৈঠক বসিলে মিঃ গান্ধীই সব পন্ড করিয়া দেন। (ধিক্কার ধ্বনি) সুতরাং আমরা আমাদের প্রস্তাবাবলী প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হইলাম। তারপর কি ঘটিল? তারপর আসিল নেহেরুর রিপোর্ট, আপনারা ইহার ইতিহাস জানেন। মরহুম মওলানা মহম্মদ আলি নেহেরু রিপোর্ট সম্পর্কে কি অভিমত প্রকাশ করেন, আমি আপনাদিগকে তাহা বলিব। তিনি বলেনঃ বৃটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন আমলে সরকারী ফেরিওয়ালারা গভর্ণমেন্টের কোন বিজ্ঞাপ্তি প্রচার না করার পূর্বেই চিৎকার করিয়া ভারতে দ্বৈতশাসনের কথা ঘোষণা করিত। তাহাদের ফরমুরা ছিল-খালক খোদাকী-মুলক মালেকা কা-হুকম কোম্পানী বাহাদুর কা (মানুষের মালিক খোদা; দেশের মালিক মহারাণী ভিক্টোরিয়া এবং শাসন কর্তৃত্ব কোম্পানী বাহাদুরের)।
নেহেরু রিপোর্ট
মিঃ গান্ধীর নেহরু পরিকল্পনায় যে শাসনতন্ত্রের প্রস্তাব হইয়াছে তাহার অধীনে সরকারী ফেরিওয়ালা হাঁক ডাক করিয়া ভারতে নূতন দ্বৈত-শাসনের বার্ত্তা ঘোষণা করিবে। তাহাদের ফরমূলা হইবে-খালক খোদা কী; মূলক ব্রিটিশ কা; হকুম মহাসভা বাহাদুরকা; (মানুষের মালিক খোদা, দেশের মালিক ব্রিটিশ এবং শাসন কর্তৃত্ব হিন্দু মহাসভা বাহাদুরের)। (উচ্চ হাস্য)।
মওলানা মোহাম্মদ আলীর উক্তি
কংগ্রেসের জন্য মওলানা মোহাম্মদ আলী যথেষ্ট পরিশ্রম স্বীকার করেন, দুঃখ কষ্ট ভোগ করেন এবং স্বার্থ ত্যাগ স্বীকার করেন। ১৯৩০ সনে বোম্বাইয়ে এক সভার সভাপতি রূপে তিনি বলেনঃ
“মিঃ গান্ধী সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু মহাসভা প্রভাবাধীনে কাজ করিতেছেন। তিনি হিন্দু ধর্মের প্রাধান্যের জন্য এবং মোছলেম জাতির স্বাতন্ত্র মুছিয়া ফেলার নিমিত্ত সংগ্রাম করিতেছেন। আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যাপারে তিনি কখনও মোছলেম জাতির সহিত পরামর্শ করেন নাই। তিনি চান, ভারতীয় মোছলেম জাতির মাথার উপর দিয়া বিজয় রথ চালনা করিতে। আমরা কোন প্রতিশ্রুতি, চুক্তি বা সন্ধি ভঙ্গ করি নাই। আমরা ভারতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই। গত ১০ বৎসর মুছলমানগণ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হইয়াছে। মিঃ গান্ধী অবস্থার উন্নতির জন্য চেষ্টা বা মুছলমানদের প্রতি হিন্দুদের স্বৈরাচারের প্রতিবাদে টু শব্দটি পর্যন্ত করেন নাই। তিনি শুদ্ধি এবং সংগঠন আন্দোলনের প্রতিবাদ করেন নাই। এ সমস্ত আন্দোলনের উদ্দেশ্য হইতেছে ভারতের বুক হইতে এছলাম ও মুছলমানের অস্তিত্ব মুছিয়া ফেলা। তিনি মাদ্রাজ হিন্দু মোছলেম চুক্তি স্বীকার এবং ভঙ্গ করেন। ‘কোন সম্প্রদায় বিশ্বাসঘাতকতা করিবে বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিবে বলিয়া যদি আশঙ্কা কর, তবে সেই সন্ধিপত্র তাহার মুখের উপর ছুড়িয়া ফেলিয়া দাও। আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক ও প্রতিশ্রতি ভঙ্গকারীদের কার্য অনুমোদন করে না’। এক্ষণে কোরআনের এই নীতি অনুসরণ করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই (হর্ষধ্বনি)”।
মিঃ গান্ধীর কারসাজী
এখন দ্বিতীয় গোল-টেবিল বৈঠকের কথা উল্লেখ করা যাক। মিঃ গান্ধী এই প্রথম কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ইহাতে যোগদান করেন। সেখানে কি ঘটিয়েছিল? তিনি পুণরায় কোন না কোন ছুঁতো ধরিয়া আপোষ মীমাংসার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দেন। ডাঃ আম্বেদকরের গ্রন্থে আপনারা দেখিতে পাইবেন যে, লণ্ডনে মোছলেম প্রতিনিধিগণের নিকট তিনি যে সমস্ত শর্ত পেশ করিয়াছিলেন তন্মধ্যে একটি হইতেছে এই যে, আমরা মুছলমানেরা যদি তফছিলী সম্প্রদায়ের পৃথক নির্বাচন বা বিশেষ রক্ষা কবচের দাবীর বিরোধিতা করার প্রতিশ্রুতি দিই তবে তিনি আমাদের প্রস্তাব মানিয়া লইতে প্রস্তুত আছেন। অন্য কথায় তফছিলী সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হউক মিঃ গান্ধী তাহা চাহেন না। আমি এখন আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, যে ব্যক্তির আত্মসম্মান ও ন্যায়-নীতির প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও আছে, সেই ব্যক্তি কি করিয়া এই প্রস্তাবে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করিবেন? তিনি কি করিয়া স্বীকার করিয়া লইবেন যে, এই ছয়কোটি লোক অস্পৃশ্য এবং সনাতনীদের কৃপার পাত্র হইয়া থাকিবে? মিঃ গান্ধীও একজন সনাতনী। ভারতের সুনামে ইহা কলঙ্ক স্বরূপ। মানবতার নামে আমি আপনাদিগকে আশ্বাস দিয়া বলিতেছি, মুছলমানদের চেয়ে তাহাদের প্রতিই আমার খেয়াল অধিক (শুনুন, শুনুন ও হর্ষধ্বনি) মোটের উপর আমরা মুছলমানেরা এইরূপ অন্যায় ও অযৌক্তিক শর্ত মানিয়া লইতে পারি না। দ্বিতীয় শর্ত হইতেছে যে তোমরা মুছলমাদেরা স্বীকার কর যে, তোমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করিবে। আমাদের কি এতই অধঃপতন হইয়াছে যে, এইরূপ একটি প্রস্তাব মানিয়া লইব? যে কোন লোকের চেয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা অধিক ভালবাসি (উল্লাসধ্বনি)। এই প্রস্তাব দ্বারা মনে হয়, দেশের স্বাধীনতার প্রতি ভালবাসা যেন মিঃ গান্ধীর একচেটিয়া। (তিনি স্বাধীনতা চান না’-রব)। কাজেই আপোষ আলোচনা ভাঙ্গিয়া যায়। তাঁহার মনের গহন কোণে সর্বদাই যে জিনিসটি লুক্কায়িত থাকে সংকট সময়ে তাহাই ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বলিয়া ফেলেন। গোলটেবিল বৈঠকের মাইনরিটিজ কমিটির সভায় মিঃ গান্ধী মন্তব্য করেনঃ
“মাইনরিটিজ কমিটি আহবানের সময় ইহা নহে। সাম্প্রকায়িক সমস্যার সমাধান স্বরাজ-শাসনতন্ত্রের মুকুট স্বরূপ হইতে পারে, ভিত্তি নহে। বৈদেশিক শাসনের ফলে আমাদের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি পাইয়াছে, যদি তাহার ফলে উদ্ভব নাও হইয়া থাকে। আমার মনে একটুও সন্দেহ নাই যে, স্বাধীনতার সূর্য্যের তাপে সাম্প্রদায়িক বিভেদরূপ তুষারস্তুপ গলিয়া যাইবে”।
ম্যাকডোনাল্ডোর দাঁতভাঙ্গা জওয়াব
প্রধানমন্ত্রী মিঃ ম্যাকডোনাল্ড মাইনরিটিজ কমিটির উক্ত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মিস্টার গান্ধীর এইরূপ মন্তব্যে তিনি পর্যন্ত উত্তেজিত হইয়া পড়েন। মিঃ ম্যাকডোনাল্ড সম্পর্কে যাহাই বলা হউক না কেন ভারতে আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি তাঁহার মনে গহন কোণে একটা দরদ ছিল। মিঃ গান্ধীর মন্তব্যের জওয়াবে মিঃ রামজে ম্যাকডোনাল্ড বলেনঃ
“সততা অবলম্বন করুন এবং বাস্তবতার সম্মুখীন হউন। সাম্প্রদায়িক সমস্যা একটি বাস্তব সমস্যা। ভারতে এই সমস্যার অস্তিত্ব আছে কি, না নাই? আমি ইহার জওয়াব দিতে চাই না। আমি আপনার উপরই ইহার উত্তরের ভার দিলাম। আপনি সততার সহিত ইহার জওয়াব দিন।
সাম্প্রদায়িক সমস্যার যদি অস্তিত্ব থাকেই, তবে ইহার সমাধানের জন্য ভারতে বা এখানে কেমন করিয়া আলোচনা চালানো যাইতে পারে? ভারতে একটি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূলেই রহিয়াছে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব, সাম্প্রদায়িক অধিকার, সাম্প্রদায়িক রক্ষা কবচ ইত্যাদি সমস্যা”। গোলটেবিলের পালা শেষ হইল। তারপর কি ঘটিল? আমি অতি সংক্ষেপে তাহাই বিবৃত করিতেছি। মিঃ গান্ধী নিম্নোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলি গঠন করিয়াছেনঃ
(১) গান্ধী আশ্রম-সেবাগাঁ, ওয়ার্দ্ধা (গান্ধী নীতির ভ্যাটিকান ও কংগ্রেসের রাজধানী স্বরূপ)।
(২) গান্ধী সেবাসঙ্ঘ (৯ জন সদস্য লইয়া গঠিত গান্ধীজীর স্থায়ী সর্বোচ্চ মন্ত্রণা পরিষদ)।
(৩) গান্ধী হরিজন সেবা সঙ্ঘ (অনুন্নত শ্রেণীর লোকদিগকে হিন্দু ধর্মের আওতায় আনয়ন ও এছলাম বা খৃষ্টধর্ম গ্রহণে তাহাদের বাধাদানের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত)।
(৪) গান্ধী হিন্দী প্রচার সঙ্ঘ (সংস্কৃত মার্কা হিন্দীকে ভারতে রাষ্ট্র ও জাতীয় ভাষা বলিয়া প্রচার এবং উর্দু ভাষার গুরুত্ব হ্রাস ও জনপ্রিয়তা নাশের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত)।
(৫) গান্ধী নাগরী প্রচার সভা (হিন্দী দেবনাগরী বর্ণমালায় ভারতে সমস্ত ভাষা লিখিত হওয়া উচিত এইরূপ ধারণা সৃষ্টির জন্য এবং উর্দু বর্ণমালা প্রচলন রদ করণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত)।
(৬) গান্ধী গ্রাম সুধার সভা (পল্লীগ্রামসমূহে গান্ধী নীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। খাদি বা হস্ত নির্মিত বস্ত্রকে উপাস্য বলিয়া মনে করা হয়)।
(৭) গান্ধী ওয়ার্দ্ধা তালিমী সঙ্ঘ –রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রথার মাধ্যমে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, জাতীয়তা, অর্থনীতি সম্পর্কে গান্ধী-নীতি প্রচারের উদ্দেশ্য ইহা গড়িয়া তোলা হইয়াছে। ওয়ার্দ্ধা পরিকল্পনা অনুসারে দেশের সমগ্র শিক্ষা পরিকল্পনাকে গান্ধী নীতি প্রচারের মাধ্যম করা হইয়াছে। এই গান্ধী-নীতি হইতেছে হিন্দু ধর্মের নয়া রূপ।
(৮) গান্ধী গো রক্ষা সভা (গো অর্চনা সমিতি)।
মিঃ গান্ধী দেবী গো পূজায় অকপট বিশ্বাসী। কাজেই তিনি গো রক্ষা সভা ও গো প্রদর্শনী কংগ্রেসের অঙ্গ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। গান্ধী সেবা সঙ্ঘই এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মূল (হাস্য)। গান্ধী সেবা সঙ্ঘের উদ্দেশ্যে মিঃ গান্ধী বলেনঃ “এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কার্য্য ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। কিন্তু আপনাদের কার্যক্ষেত্র সীমাহীন। আপনাদের প্রতিষ্ঠান হইতেছে মহামহীরূহ বিশেষ। আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে ইহার শাখা বলা যাইতে পারে”।
উপ-মহাত্মার দল
মিঃ গান্ধী সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে তিনটি সুনির্দিষ্ট পার্লামেন্টারী অঞ্চলে বিভক্ত করিয়া তিনজন আঞ্চলিক পার্লামেন্টারী ডিক্টেটর নিযুক্ত করিয়াছেন। এছাড়া প্রায় সবগুলি প্রদেশ এবং অঞ্চলে স্থায়ী ডেপুটি মহাত্মার উদ্ভবেও ক্রমাগত সহায়তা করিয়াছেন। এই সমস্ত ডেপুটি মহাত্মা গান্ধী-নীতি গান্ধীবাদ ও গান্ধী ডিক্টেটরশীপে অকৃত্রিম বিশ্বাসী। ইহারা বার্তা বাহক এবং আদেশ প্রতিপালনকারী। উদাহরণ স্বরূপ ভারত কংগ্রেস কমিটি অফিসের স্থায়ী সেক্রেটারী ‘আচার্য্য’ কৃপালনীর কথা বলা যাইতে পারে। তিনি গান্দীবাদের একজন শ্রেষ্ঠ বাহক ও ব্যাখ্যাকারী। তিনি “গান্ধীয়ান ওয়ে” শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক। ‘কাকা’ কালেকারের উপর হিন্দি ও নাগরীর প্রচার সম্পর্কিত গান্ধী কার্যক্রমের ভার অর্পিত হইয়াছে। মিঃ মাশরু ওয়ালার ওপর গান্ধী সেবা সঙ্ঘের ভার অর্পিত। মিঃ আর্যনায়কম ও মিঃ কুমারাপ্পা ওয়ার্দ্ধা পরিকল্পনার ভার প্রাপ্ত হইয়াছেন। বাঙলার ডেপুটি গান্ধী ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের উপর বাংলার খাদি প্রতিষ্ঠান ও গান্ধী আশ্রমের পরিচালনার ভার ন্যস্ত রহিয়াছে। বিহারে ডেপুটি গান্ধী হইতেছেন ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। তাঁহার উপর ছাদাকত আশ্রমের পরিচালনার ভার অর্পিত হইয়াছে। সীমান্তে হিন্দু প্রভাব বিস্তার ও পাঠানদের সামরিক প্রতিষ্ঠা নষ্ট করার ভার গ্রহণ করিয়াছেন। সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান। হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যাহারা বিভোর পাঠানেরা তাহাদের ভীতি স্বরূপ (উল্লাস)। তাঁহার উপর সীমান্ত প্রদেশে গান্ধী আশ্রমের পরিচালনার ভারও অর্পিত হইয়াছে। সর্দ্দার প্যাটেল হইতেছেন গুজরাট ও বোম্বাইয়ের ডেপুটি গান্ধী। শঙ্কর রাও দেও হইতেছেন মহারাষ্ট্রের উপগান্ধী, ডাঃ পট্টভি সীতারামিয়া হইতেছেন অন্ধ্র প্রদেশের ডেপুটি গান্ধী ইত্যাদি।
হিন্দু কংগ্রেসে ফ্যাসিস্ট নীতি
ইহা আমার নিজের কথা নহে। কংগ্রেসের ত্রিপুরা অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি যাহা বলিয়াছেন, তাহা আমি আপনাদের সমক্ষে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থিত করিতেছি। আমি চাই জনসাধারণ ব্যাপারগুলি অনুধাবন করিয়া নিজে নিজেই সিদ্ধান্তে উপনীত হউক। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শেঠ গোবিন্দ দাস ঘোষণা করেনঃ
“আমাদের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানকে ইতালীয় ফ্যাসিস্ট পার্টির সহিত তুলমান করা যাইতে পারে, যদিও তাহারা হিংসনীতি অবলম্বন করিয়াছে আর আমরা অহিংসনীতি অবলম্বন করিয়াছি। ইতালীয় সকল অধিবাসীই ফ্যাসিস্ট নহে, জার্মান জনসাধারণের সকলেই নাৎসী নহে, কিম্বা সকল রাশিয়ানই কম্যুনিষ্ট নহে। রুশদের স্ব স্ব পার্টির প্রতি আস্থা আছে। প্রত্যেক ভারতবাসীই কংগ্রেসের চারি আনার সদস্য নহে, তথাপি সকল ভারতবাসীই কংগ্রেসের সমর্থক। ফ্যাসিস্টদের নিকট মুসোলিনী, নাৎসীদের নিকট হিটলার এবং কম্যুনিস্টদের নিকট স্ট্যালিনের যেরূপ মর্যাদা কংগ্রেসীদের নিকট মহাত্মা গান্ধীরও সেইরূপ মর্যাদা। বর্তমান কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীরই সৃষ্টি”।
হিন্দু কংগ্রেসের চালবাজী
ভারতের এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদিগকে পুনঃ পুনঃ শুনাইয়া আসিতেছি যে মোছলেম লীগ একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। সুপরিকল্পিত পন্থায়-সঙ্ঘবদ্ধভাবে হিন্দু নেতৃবৃন্দ স্বেচ্ছায় সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লইয়া দুইটি জাতির মধ্যে মীমাংসার সমস্ত আশা ভরসা নির্মূল করিয়া দিয়াছেন। আর এক্ষণে তাঁহারা নিজদিগকে জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রবাদী বলিয়া জাহির করিতেছেন। আমি আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই, ইহাকেই কি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র বলা হয়? (না না ধ্বনি)। গত ২৫ বৎসরে আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি তাহার ফলে এবং সুদৃঢ় প্রমাণকে ভিত্তি করিয়া আজ আমরা এই “না” ধ্বনি উচ্চারণ করিতে পারিতেছি। তাঁহারা জাতীয়তা ও গণতন্ত্রের বড়াই করেন। হয় তাঁহারা ইহা বুঝিতে পারেন না, না হয়, তাঁহারা কপট। পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র এদেশে মানাইবে না-ইহার অর্থ কি তাঁহারা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন না? আমরা তাহাদের বলিঃ গণতন্ত্রের বুলি কপচাইয়া আপনারা শুধু কপটতাই প্রদর্শন করিতেছেন। আপনাদের গণতন্ত্রের অর্থ হিন্দুরাজ। আপনারা চান সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য সকল দিক দিয়া অন্য একটা জাতির উপর আধিপত্য করিতে। আপনারা হিন্দু জাতীয়তা ও হিন্দুরাজ কায়েম করার জন্য অপচেষ্টা করিতেছেন।
গণতান্ত্রিক মুছলমান
আমরা ১৩ শত বৎসর পূর্বে গণতন্ত্রের ছবক গ্রহণ করিয়াছি (হর্ষধ্বনি)। ইহা আমাদের রক্তের সহিত বিজড়িত হইয়া আছে। ইহা মরু প্রদেশের ন্যায় হিন্দু সমাজ হইতে বহু দূরে রহিয়াছে। হিন্দুরা বলেন আমরা গণতান্ত্রিক নই। কিন্তু আমরাই সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব শিক্ষা করিয়াছি। এক শ্রেণীর হিন্দু অন্য শ্রেণীর স্পর্শ করা পানি পান করে না। ইহারই নাম গণতন্ত্র? ইহাই কি সাধুতা? আমরা গণতন্ত্র চাই। কিন্তু যে গণতন্ত্রের ফলে সমগ্র ভারত-গান্ধী আশ্রমে পরিণত হইবে সেই রূপ গণতন্ত্র আমরা চাই না (উচ্চ হর্ষধ্বনি)। এইরূপ গণতন্ত্রে একটি সমাজ বা জাতি স্থায়ী সংখ্যাগুরুত্বের জোরে অন্য একটি স্থায়ী সংখ্যালঘু সমাজ বা জাতিকে এবং উহার নিকট যাহা প্রিয় তাহা ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। আমি হিন্দুদিগকে বলি এইরূপ ভাবগতি পরিহার করুন। আপনারা আপনাদের শয্যা রচনা করিয়াছেন। আপনারা ইহাতে শয়ন করিতে পারেন। আপনারা আপনাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদ লইয়া থাকুন। আমাদের গণতন্ত্র আপনারা প্রাণ ভরিয়া উপভোগ করুন। যদি পারেন, আপনারা আপনাদের হিন্দুস্তান গঠন করুন। আমি আপনাদের সাফল্য কামনা করি। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত একজন মুছলমানের দেহেও প্রাণ থাকিবে ততদিন পর্যন্ত আমরা কিছুতেই এই হিন্দুরাজ কায়েম হইতে দিব না। আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেতা রেডম্যান আলস্টার নেতা কার্সনের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলেন, “দেখুন, আমরা কি কোন রকম মীমাংসায় উপনীত হইতে পারি না? আপনারা আয়ারল্যাণ্ড হইতে পৃথক হইতে চান কেন? ভাবিয়া দেখুন, আলস্টার এবং আয়ারল্যাণ্ডবাসীদের মধ্যে ১০ লক্ষ ভাদের একভাগ বিভিন্নতাও নাই”। কিন্তু কার্সন কি উত্তর দিয়াছিলেন? “আমি আপনার শাসনাধীনে থাকিতে চাই না”। মিঃ গান্ধীর নিকটও আমার জওয়াব এই- “আমি আপনার শাসনাধীন থাকিতে চাই না”। (উল্লাসধ্বনি)।
মীমাংসার জন্য আন্তরিকতা
এই তো হইল অবস্থা। আমি আবেদন জানাইতেছি, আমার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর হিন্দু ভারতের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিবে কিনা জানি না। তবুও আমি তাঁহাদের নিকট আবেদ জানাইতেছি- ‘এই ভাবগতি পরিহার করুন”। আপনারা এই দেশের লোকের স্বাধীনতা কামনা করেন। কিন্তু আপনারা ব্যর্থ হইয়াছেন। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে, আপনারা ব্যর্থ হইয়াছেন। চলুন আমরা ঐ অধ্যায়ের উপর যবনিকাপাত করি। যে সকল সৈন্যবাহিনী পরস্পরের লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিহত করিয়া থাকে, তাহারাও বন্ধুভাবে পরস্পরের সহিত সম্মিলিত হয়। আমরা এখনও ঐরূপ করি নাই। ইহাই রাজনীতি। আমি হিন্দু জনগণের নিকট এই আবেদন জানাইতেছি, আপনাদের নেতৃবৃন্দ যদি ভুল পথে গিয়া থাকেন- আমি বলি তাঁহারা বিভ্রান্ত হইয়াছেন –আর আপনারা যদি তাহা অনুমোদন না করেন, তবে আপনাদের কর্তব্য আগাইয়া আসা এবং নেতৃবৃন্দের নকিট এই দাবী জানানো –‘এই পরস্পর বিধ্বংসী সংগ্রামে ক্ষান্ত হউন এবং সন্ধি স্থাপন করুন। চলুন, পরস্পরকে সমাজ জ্ঞানে একত্রে সম্মিলিত একটা মীমাংসায় উপনীত হই’। ইহাই হইতেছে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কি করিয়া এই কথা বলেন যে, ব্রিটিশই আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে। অবশ্য আমিও ব্রিটিশের প্রতি আস্থা স্থাপন করিতেছি না (হর্ষধ্বনি)। আমি পরে তাহাদের সম্পর্কে কিছু বলিব। আমি আমার দেশবাসীকেও বুঝাইতে চাই যে, আমাদের মধ্যে মিটমাট হইয়া যাক ব্রিটিশ তাহা চাহে না এইরূপ অভিযোগ করিয়া লাভ কি? অবশ্য একথা আমি স্বীকার করি যে, ব্রিটিশ আমাদের নির্বুদ্ধিতার সুযোগ গ্রহণ করিয়াছে। আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখার জন্য ব্রিটিশ যে ফন্দী ফিকির করিতে পারে তাহার চেয়ে আমাদের ফন্দী ফিকিরই শ্রেয়ঃতর (উল্লাস)। ভেদনীতিই ভারদের ব্রিটিশ শাসনের মূলমন্ত্র এই তথ্যের সহিত পরিচিত থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন ঐক্যবদ্ধ হইয়া ব্রিটিশকে তাড়াইয়া দিই না? আমি বলি, বিশ্বের অন্যান্য জাতির নিকট আবেদনন জানাইয়া কোন ফল হইবে না (উল্লাস)। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি –আমাদের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ত্ব শাসনাধিকারের দাবীর প্রতি সহানুভূতিই মাত্র প্রদর্শন করিতে পারে। কাজেই আমাদের নিজেদের সমস্যা মিটাইবার জন্য অন্যান্য জাতির নিকট আবেদন জানাইয়া লাভ কি? অন্যেরা কি করিয়া ইহা করিবে? তাহারা এদেশে আসিয়া শাসন কার্য চালাইয়া যাইবে? আপনাদরে পার্লামেন্টে আমেরিকার প্রতিনিধি প্রেরণ করা হইবে কি? আপনাদের আইন সভাগুলি সঠিকভাবে কার্য চালাইয়া যাইতেছে কিনা তাহা লক্ষ্য করে তবে আমরা যেই তিমিরে আছি, সেই তিমিরেই থাকিব। আপনাদের প্রতিনিধিগণ এবং আপনাদের মন্ত্রীসভাই কাজ চালাইবে। কাজেই আমি বলি, আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার আমাদেরই উপর।
ক্রীপস প্রস্তাব ও পণ্ডিত নেহেরুর কেরামতি
এইবার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কথা উল্লেখ করিতেছি। সম্রাটের গভর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে যে প্রস্তাব লইয়া আসিয়াছিলেন তৎসম্পর্কে আমাদের প্রস্তাবের অধিক আমি আর কিছু বলিব না। এলাহাবাদ অধিবেশনের পর লীগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আপনারা তাহার কারণ অবগত আছেন। ঐগুলির পুনরাবৃত্তি করিয়া আমি আপনাদের সময় নষ্ট করিতে চাই না। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কারণে ক্রীপস প্রস্তাব আমাদের এবং কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্য হয় নাই। মিঃ গান্ধীর সর্বশেষ বক্তৃতা হইতেও পরিস্কার বোঝা যায় যে তিনি শুধু পাকিস্তান পরিকল্পনার বিরোধীই নহেন, পরন্তু ইহাকে ‘পাপ’ বলিয়াও গণ্য করিয়াছেন। ইহার চেয়ে কঠোর শব্দ আর কি হইতে পারে? লক্ষ্য করুন –‘অপরাধ নহে ‘পাপ’। অর্থাৎ আপনারা যদি পাকিস্তানের নাম মুখে আনেন, তবে আপনাদের ইহকাল এবং পরকাল উভয়ই নষ্ট হইবে। এইরূপ প্রকাশ করা যায় যে ক্রীপস প্রস্তাব কংগ্রসের গ্রহণযোগ্য নহে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্রীপস এবং কংগ্রেসের মধ্যে কি ঘটেছিল তাহা আমি অবগত নহি। তবে জনসাধারণ্যে এইরূপ প্রকাশ করা হয় যে, প্রথমতঃ প্রতিষেধাধিকার এবং দ্বিতীয়তঃ দেশরক্ষার প্রশ্ন সম্পর্কে মতানৈক্যের জন্যই ক্রীপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। যাত্রা হউক, ক্রীপস এবং কংগ্রেসের মধ্যে যখন এ বিষয়ে বিতর্ক চলিতেছিল, তখন পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু লিখিত একটি প্রবদ্ধ বেতারযোগে আমেরিকায় প্রেরিত হয়। ১৯৪২ সনের ১৯ তারিখের “নিউ ইয়র্ক টাইমস”-এ উহা প্রকাশিত হয়। উহাতে তিনি বলিয়াছেনঃ
“৩০ বৎসর পূর্বে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট ভারতে ধর্মীয় ভিত্তিতে পৃথক নির্বান প্রথার প্রবর্তন করেন। ইহা একটি মারাত্মক জিনিস। এক্ষণে পুনরায় ভারতকে শুধু দুই ভাগেই বিভক্ত করা নহে, সম্ভবত বহু অংশে বিভক্ত করার পরিকল্পনা প্রবর্ত্তনের চেষ্টা করিয়াছে। এই কারণেই ক্রীপস প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এমন বিক্ষেভের সৃষ্টি হইয়াছে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ইহা মানিয়া লইতে পারে না’। প্রতিষেধাধিকার অথবা দেশরক্ষার প্রশ্ন –না, পাকিস্তান পরিকল্পনাই কংগ্রেস রাজি হইতে পারে নাই বলিয়া –ইহা ক্রীপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে? এই দেশে এক রকম ব্যাখ্যা করা হয় এবং আমেরিকায় অন্য রকম ব্যাখ্যা করা হয় (উল্লাস) আমেরিকানরা নিজেরাও প্রচারবাগীশ। কিন্তু তাঁহাদের জানিয়া রাখা উচিত যে, প্রচারণায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চেয়ে আর কেহই অধিক কেরামতি দেখাইতে পারিবে না।
আইন অমান্য আন্দোলন
এইবার “ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলনের প্রসঙ্গ তোলা যাক। কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নহে, মাত্র বাক্যের স্বাধীনতার জন্য ইহা আরম্ভ করা হয়। কিন্তু কোন রকমের বাক্যের স্বাধীনতা? যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে’ প্রচারণা চালাইবার জন্য বাক্যের স্বাধীনতা?” আমার মনে হয় এখানে যদি আমাদের নিজস্ব গভর্ণমেন্টও প্রতিষ্ঠিত থাকিত; তাহা হইলে দেশের সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানও যদি ইহার সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালাইবার চেষ্টা করিত, তবে আমি ঐ সকল ব্যক্তিকে জেলে প্রেরণ করিতাম। বৈদেশিক গভর্ণমেন্ট তো দূরের কথা যে কোন গভর্ণমেন্ট এই সমস্ত কার্যকরাপ পরিচালনে অনুমতি দিবেন কি করিয়া এইরূপ আশা করা যাইতে পারে? (হর্ষধ্বনি) এখন এই আইন অমান্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা যাক। প্রকৃতই বাক্যের স্বাধীনতার জন্য কি ইহা আরম্ভ করা যায়, না যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বিঘ্ন সৃষ্টি এবং তাঁহাদের দাবী স্বীকারে বৃটিশ গভর্ণমেন্টকে বাধ্য করার জন্য ইহা আরম্ভ করা হয়? ইতিমধ্যে মিঃ গান্ধী বলিতেছিলেন যে, ‘তিনি কখনো আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করিবেন না। কারণ, তাহা মারাত্মক হইবে। লক্ষ্য করুন মিঃ গান্ধী বলেন যে, মোছলেম লীগের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি কখনো আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করিবেন না। গত ২২ বৎসর যাবৎ তিনি বলিয়া আসিতেছিলেন যে হিন্দু মোছলেম ঐক্যই তাঁহার জীবনের চরম লক্ষ্য এবং হিন্দু মোছলেম ঐক্য ছাড়া দেশের স্বাধীনতাও আসিবে না। কিন্তু গত বৎসর জুলাই মাসে তিনি যখন একটা সম্পূর্ণ নতুন পন্থা নির্ধারণ করেন, তখন মোছলেম লীগকে উপেক্ষা করা মারাত্মক বলিয়া বিবেচিত হয় নাই। হিন্দু মোছলেম ঐক্য ছাড়া কোন স্বরাজ, কোন স্বাধীনতা আসিবে না।
গত ২২ বৎসরের এই মত তিনি বদলাইয়া ফেলেন। ৮ই আগস্ট তারিখের প্রস্তাবে মিঃ গান্ধী যখন তাঁহার নীতি ও কার্যক্রম সন্নিবেশিত করেন, যখন সহসা গত ২২ বৎসরের মত হাওয়ায় উড়িয়া যায়। ইহা কি? ইহা হইল –“ভারত ত্যাগ কর” বুলি। বাড়াবাড়িটা লক্ষ্য করুন। মিঃ গান্ধীর ভাবখানা এই –“এই দেশের ১০ কোটি মুসলমান কি বলে তৎপ্রতি ভ্রুক্ষেপ করিও না। আমার ইচ্ছায় আত্মসমর্পণে এই গভর্ণমেন্টকে আমি বাধ্য করিতেছি”। আর এদিকে ব্রিটিশ বলেন, “কংগ্রেসকে প্রতিরোধ করিয়া আমরা তোমাদিগকে রক্ষা করিতেছি। কারণ আমরা যদি কংগ্রেসের দাবীতে আত্মসমর্পণ করি তবে তোমাদেরই বিপদ ঘটিবে এবং স্বার্থহানি হইবে”। কিন্তু মুছলমানেরা বলেনঃ “তোমরা আমাদিগকে এত ভালবাস বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না”। আমরা জানি এইরূপ বলিলে তাঁহাদের সুবিধা হয়। তাঁহারা পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিতেছেন। কারণ তাঁহারা জানেন যে হিন্দু ও মুছলমানের মধ্যে যদি আপোষ মীমাংসা হইয়া যায় তবে তাঁহার ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হইবেন। তাঁহারাও ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি আছে, কিন্তু আমরা ঐক্যবদ্ধ হইতে চাহিতেছি না। ভারতের ঐক্য রক্ষা করিয়া যদি ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব হয়। ভারতকে বিভক্ত করিয়া লইলেও ইহা লাভ করিতে হইবে। (হর্ষধ্বনি)
গভর্ণমেন্টের সুবিধাবাদ নীতি
আমার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ‘যদি হিন্দু’ জনগণের কর্ণকুহরে প্রবেশকরে তবে তাহারা সতর্কতার সহিত বিবেচনা করিয়া দেখুক আমি সত্য বলিতেছি না, অসত্য বলিতেছি। আমি যথার্থ আন্তরিকতার সহিতই বলিতেছি। ব্রিটিশের বিশ্বাস এই যে হিন্দু ও মুছলমানের মধ্যে কখনও মিলন হইবে না। কোনক্রমে যদি মীমাংসা হয়ও তবে যুক্ত ভারতর ছত্রতলে কোন্দলেরই ক্ষেত্র প্রস্তুত হইবে। আর ইহার চূড়ায় অবস্থান করিবেন একজন ইংরেজ ভদ্রলোক প্রায় একশত বৎসর যাবৎ এই বিশ্বাসকে ভিত্তি করিয়াই এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ নীতি পরিচালিত হইতেছে। কাজেই সূক্ষদর্শী ব্রিটিশ যুক্ত গণতান্ত্রিক ভারতকে ভিত্তি করিয়াই তাঁহাদের নীতি পরিচালিত করিয়াছেন। আমি মনে করি, এখনও তাঁহারা এই নীতি বর্জন করেন নাই। ব্রিটিশেরা জানেন যে, তাঁদের মধ্যস্থতা ব্যতীত আমরাকোন মীমাংসায় পৌঁছতে পারিব না। আপনারা যখন বিবাদ করিয়া একে অন্যের মাথা ভাঙ্গিয়া ফেলিবেন তখন বানর আসিবে দুই বিড়ালের বিবাদ মীমাংসা করিতে (হাস্য)। এই কারণেই আজ যাঁহারা দৈবক্রমে ভারত গভর্ণমেন্টের শীর্ষদেশে অবস্থান করিতেছেন সেই বিরাট পুরুষ লর্ড লিনলিথগো এবং তার সচিব মিঃ আমেরী ভৌগলিক হিসাবে ভারত এক- এইরূপ বলিয়া গর্দভের সম্মুখে গাজার দোলাইতেছেন। লণ্ডনের সেই মহাপুরুষ সহসা আবিস্কার করিয়াবসিলেন যে আকবরের আমলেও ভারত ঐক্যবদ্ধ ছিল (হাস্য)। বাস্তবিক তাঁহারা উভয়েই ছিলেন খেলোয়াড়।
বন্ধুগণ! হিন্দুদের বিরুদ্ধে আমার কোন দুরভিসন্ধি নাই। আপনারা জানিয়রা রাখুন কোন অলৌকিক উপায়ে ঐক্যবদ্ধ ভারতের ভিত্তিত হিন্দু ও মুছলমান যদি কোন শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে মীমাংসায় উপনীত হয়ও তবে ব্রিটিশ ভারতেই তাহা হইবে কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বড় বাধা হইয়া দাঁড়াইবে ভারতীয় দেশীয় রাজ্যসমূহ, এইরূপ আরো বহু বাধা রহিয়াছে।
স্বাধীনতা লাভের প্রকৃষ্টতম পন্থা
প্রায় একশত বৎসর যাবৎ ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট এই নীতির অবলম্বন করিয়া আসিতেছেন। তাঁহারা আমাদিগকে কেবল প্রগতি হইতেই দূরে রাখেন নাই পরন্তু বিপথেও চালিত করিয়াছেন। আর বিভ্রান্ত হইবেন না। আমি হিন্দুদিগকে বলি- ব্রিটিশ অন্যের চেয়ে ভাল করিয়াই জানেন –পাকিস্তান আমার জীবদ্দশাতেই আসুক বা উহার পরেই আসুক (আসিবেই-ধ্বনি), ইহাই ভারতের হিন্দু ও মুছলমানদের স্বাধীনতা লাভের প্রকৃষ্টতম পন্থা।
কোন কোন জাতি পরস্পরের লক্ষ লোক হত্যা করিয়াছে। কিন্তু ইহা স্থায়ী নহে। আজ যে দুশমন, কাল যে বন্ধু হইতে পারে। ইহাই তো জীবন, ইহাই তো ইতিহাস।
দায়ী কে?
অতীব দুঃখের বিষয়, কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দই হিন্দু ও মুছলমান উভয়ের স্বাধীনতার পথে বিঘ্নের সৃষ্টি করিয়াছেন। আমাদের মনোভাব সুস্পষ্ট –আমি হিন্দু জনসাধারণ ও হিন্দু নেতৃত্বের প্রতি আবেদন জানাইতেছি। আপনাদের নীতি সংশোধন করুন। কংগ্রেস জোর মিথ্যা প্রচারণা চালাইতেছে বর্তমানে কংগ্রেসের পক্ষে অধিকাংশ প্রচারণাই চালাইতেছে কম্যুনিষ্ট পার্টি। তাহারা যে সকল আবেদন ও বিবৃতি প্রচার করিয়াছেন তাহা একান্তই ভ্রান্তিপূর্ণ।
গান্ধী-প্রস্তাবের অসারতা
সূচনা হইতে ৮ই আগস্ট পর্যন্ত কংগ্রেস-নীতি হইতেছে এই যে, পাকিস্তান দাবীর মূলে কোন যৌক্তিকতা নাই। বড় লাটের সহিত পত্রালাপকালে এই কথা ভুলিয়া গিয়া তিনি লিখিয়াছেন –“গভর্ণমেন্ট স্পষ্টতঃই এই সত্যটি উপেক্ষা করিয়াছেন যে, আগস্ট প্রস্তাবে কংগ্রেস নিজের জন্য কিছু চায় নাই সমগ্র জাতির জন্যই তাঁহারা দাবী জানাইয়াছে। আপনারা অবগত আছেন যে যুদ্ধকালের জন্য নির্বাচিত পরিষদ সদস্যের নিকট একটি জাতীয় গভর্ণমেন্ট গঠনের ভার কায়েদে আযম জিন্নার উপর দিতে রাজী আছে”। এই হইল মিঃ গান্ধীর ভাষা। এই প্রস্তাবের মোদ্দা কথা হইল এই যে, তিনি চান যথারীতি নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের নিকট দায়ী একটি জাতীয় গভর্ণমেন্ট। আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, এই প্রস্তাব যদি কার্যকরী হয় তবে বাকী থাকিবে কি? লর্ড লিনলিথগো অবিলম্বে নিয়মতান্ত্রিক গভণর্ণর জেনারেল হইয়া পড়িবেন –যদি তাঁহাকে বিস্তারিত নাও করা হয় (হাস্য), ইণ্ডিয়া অফিস ও ভারত সচিবের পদ বিলুপ্ত হইবে এবং ভারতের শাসন ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কোনও হাত থাকিবে না। বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়া এবং তৎপরিবর্তে অন্য একটি প্রবর্তন করিয়াই মাত্র কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র চালু করা যাইতে পারে, অন্য কোন উপায়ে নহে। আমার যদি ভুল হইয়া থাকে, তবে সংশোধিত হইতে চাই। একবার যদি কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রের কাঠামো ভাঙ্গিয়া ফেলা হয় তবে প্রাদেশিক শাসনতন্ত্রের কাঠামো টিকিতে পারে না। তেমন অবস্থায় প্রদেশগুলি সম্পর্কে কি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে? এইগুলি কি গভর্নরের শাসনাধীনেই থাকিবে? এই গুলিতে কি বর্তমান শাসনতন্ত্রই চালু থাকিবে? প্রাদেশিক গভর্ণমেন্ট সমূহের পুরোপুরি সংস্কার সাধন করিতে হইবে এবং দেশীয় রাজ্যগুলিসহ সমগ্র ভারতের জন্য সম্পূর্ণ নূতন শাসনতন্ত্র রচনা করিতে হইবে। আমদিগকে প্রশ্ন করা হয়ঃ তাহাতে দোষ কি? পাকিস্তান ‘পরিকল্পনা’ স্থগিত থাকিবে মাত্র। ইহার জওয়াব এই যে, যেই মুহুর্তে মিঃ গান্ধীর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই অবস্তা মানিয়া লওয়া হইবে সেই মুহুর্তে পাকিস্তানের দাবী বিনষ্ট হইবে। তারপর মিঃ গান্ধীর প্রস্তাবকে ভিত্তি করিয়া শাসনতন্ত্র রচনা করিতে গেলে যে তুমুল বাদানুবাদের সৃষ্টি হইবে –এই শাসনতন্ত্র রচনার ভার কাহার উপর অর্পিত তাহা না হয় উল্লেখ নাই করিলাম। এইরূপ শাসনতন্ত্র কার্যকরী হইলে সন্দেহাতীতরূপে ভারতে হিন্দুরাজ কায়েম হইবে। এই অবস্থা আমরা কখনও মানিয়া লইতে পারি না।
আপোষের জন্য আহবান
পাকিস্তানের ভিত্তিতে মিঃ গান্দী যদি প্রকৃতই এখনও লীগের সহিত আপোষ মীমাংসার জন্য অগ্রণী হন তাহা হইলে আমার অপেক্ষা আর হেই উহাকে বেশী অভিনন্দিত করিবে না। আমি বলিতেছি সেই দিনটা হিন্দু ও মুছলমান উভয়ের পক্ষেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ হইবে। আমার নিকট সরাসরি পত্র লিখিতে বাধা কিসের? (হর্ষ)। তিনি বড়লাটের সহিত পত্রালাপ করিতেছেন, কিন্তু আমার নিকট সরাসরি পত্র লেখেন না কেন? এই কাজে কে বাধা দিতে পারে? বড় লাটের নিকট গিয়া বা ডেপুটেশন পাঠাইয়া কিম্বা তাঁহার সহিত পত্রালাপ করিয়া লাভ কি? আমি এ কথা বলার সাহস রাখি যে এ দেশের গভর্ণমেন্ট যত শক্তিশালী হউক না কেন, তাঁহার চিঠি আমার নিকট পৌঁছানোয় তাঁহারা বাধা দিতে পারিবেন না (উচ্চ হর্ষধ্বনি)।
গভর্ণমেন্ট যদি এইরূপ কিছু করেন তবে ব্যাপার গুরুতর হইবে সন্দেহ নাই। কিন্তু মিঃ গান্ধী অথবা কংগ্রেস নীতিতে আমি কোন পরিবর্তনের লক্ষণ দেখিতেছি না।
এতিম রাজনীতিকগণ
আমাদিগকে বলা হয় যে, একটা কিছু করা উচিৎ। কিন্তু আমরা কি করিব? অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নাই। তথাকথিত অদলীয় সম্মেলনে যোগদান করিতে আমাকে অনুরোধ করা হইলে আমি মিঃ রাজগোপালচারীকে বলিয়াছিলাম যে, আমি উহাদে যোগ দিতে চাই না। তাহার কারণও আমি প্রদর্শন করিয়াছিলাম। আমি তাঁহাদের বিরুদ্ধে কিছু বলিতে চাই না। কিন্তু জীবনে তাঁহাদের কিছুটা প্রতিষ্ঠা আছে, কিছুটা অভিজ্ঞতাও আছে। রাজনীতি ক্ষেত্রে তাঁহারা আমাদের বিরুদ্ধবাদী হইতে পারেন। কিন্তু একবার তাঁহারা এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। এই ভদ্রলোকগণ যে প্রস্তাব ও পন্থা গ্রহণ করিয়াছেন এই সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁহারা তাহা অপেক্ষা অধিক কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করিতে পারিতেন। কিন্তু মহান ব্যক্তিরাও ভুল করিয়া থাকেন। মিঃ গান্ধী সব খবরই রাখেন, সংবাদপত্র পাঠ এবং দেশে কি ঘটিতেছে তাহাও জানেন ও বুঝেন। তাঁহার হৃদয়ের যদি পরিবর্তন হইয়া থাকে, তবে তিনি আমার নিকট মাত্র কয়েক ছত্র লিখুন। আমি আপনাদিগকে আশ্বাস দিতেছি, অতীতে আমাদের মধ্যে যত রকম বাদানুবাদ হইয়া থাকুক না কেন মোছলেম লীগ এ ব্যাপারে সাড়া দিতে কসুর করিবে না (তুমুল উল্লাস ধ্বনি)।
ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের মনোভাব
এইবার ব্রিটিশের কথা বলিতেছি। তাঁহাদের বুঝা দায়। তাঁহাদের মনোভাব কি? তাঁহাদের মনোভাব এইঃ কংগ্রেস একটি বিদ্রোহী প্রতিষ্ঠান। ইহা রাজদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত। তাঁহারা গভর্নমেন্ট ও সম্রাটের দুশমন। কাজেই তাঁহাদের সহিত কোন কারবার দরবার চলিতে পারে না। কংগ্রেস একটি দল মাত্র। ভারতের অধিকাংশ লোকের সমর্থন কংগ্রেসের পেছনে নাই, তাহারা ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বিবৃতিতে কি বলা হইয়াছে? লণ্ডনের সংবাদপত্রসমূহ কি বলেন? “সাণ্ডে ক্রনিকেল” এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলিয়াছেনঃ “ভারতের সৈন্যদের বীরত্বের প্রশংসা করিয়া প্রধানমন্ত্রী চার্চ্চিল যে বাণী প্রদান করিয়াছেন তাহাতে ব্রিটিশ জাতির মনে সুস্থ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইবে”। কোথায় সেই সুস্থ প্রতিক্রিয়া? মিঃ চার্চ্চিল অঙ্ক করিয়া দেখাইয়াছেন যে, ভারতের অধিকাংশ লোক কংগ্রেসকে সমর্থন করে না। মোছলেম লীগ প্রসঙ্গে এই বলা যাইতে পারে যে ইহাতে মোটেই সন্দেহ নাই যে আমরা দূরে সরিয়া রহিয়াছি। খোদাকে ধন্যবাদ আমরা দূরে সরিয়া রহিয়াছি, কারণ আমাদের অবস্থা হইতেছে ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘে’র মত। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, আমি ব্রিটিশের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট নই। তাঁহারা বলেন যে, আমাদিগকে এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করিতে তাঁহারা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়িতেছেন। তাঁহারা বলেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরে তাঁহারা প্রস্তুত এবং ইচ্ছুক, এমন কি; ইহার জন্য অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। খৃষ্টমাস সপ্তাহে বড়লাট কলিকাতায় এ ধরনের উক্তি করিয়াছেন। কংগ্রেসকে বে-আইনী ঘোষণা করিয়া অন্যান্যদের সম্পর্কে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট কি করিয়াছেন? তাঁহারা বলেনঃ “কংগ্রেসকে কি করিয়া অগ্রাহ্য করা যায়?” এই অবস্থায় তাঁহারা কি বুঝিতে পারিতেছেন না যে, কেহই তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করে না? তাঁহাদের নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারেই তাঁহারা স্বীকার করিতেছেন যে, কংগ্রেস, সাময়িকভাবে তাঁহাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ও আগ্রহ সাফল্যের সহিত ব্যর্থ করিয়াছে। অথচ কংগ্রেস একটা বিদ্রোহ প্রতিষ্ঠান। এটা তাঁহাদের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি। ভারতের জনসাধারণ হয়তো কংগ্রেসের পশ্চাতে আছে, অথবা নাই। যদি অধিকাংশ লোক না থাকে, দশ কোটি মুছলমান তো নিশ্চয়ই নাই। তখন ভারতকে কি উত্তর দেয়া যায়? তাঁহারা বলেনঃ “আমরা কিছু করতে পারি না। কারণ এই বিদ্রোহী প্রতিষ্ঠানটি আমাদিগকে অচল করিয়া ফেলিয়াছে। তোমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দাও তখন আমরা কেবল তোমাদের প্রশংসা করিতে পারি, আর কিছুই নয়”। ইহা কি সুস্থ মনোবৃত্তির পরিচায়ক? এই মনোবৃত্তি প্রদর্শনের পর কেহ কি এই কথা বিশ্বাস করিতে পারে যে, ক্ষমতা হস্তান্তরে তাঁহার প্রকৃতই ইচ্ছা আছে? আমরা অসংখ্য বার আমাদের মনোভাব প্রকাশ করিয়াছি। কিন্তু আমাদিগকে উপেক্ষা করা হয়, আমাদের বলকে উপেক্ষা করা হয়; কারণ ইহাতে তাঁহাদের সুবিধা হয়। পক্ষান্তরে আমাদিগকে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করার অপবাদ দেওয়া হয় এবং গভর্নমেন্ট প্রায়ই আমাদিগকে হুমকি দিয়া থাকেনঃ “যাহারা আমাদের পক্ষে নহে, তাঁহারা আমাদের বিপক্ষে”। আমি বলিব, ভারতীয় মুছলমানদের মন তিক্ততায় কানায় কানায় ভরিয়া উঠিতেছে। আমি পুনরায় ইহার প্রতি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষন করিতেছি। পরিস্থিতি বাস্তবিকই খুবই গুরুতর। ভারতের মুছলমানদের প্রতি দুর্ব্যবহার জনিত তিক্ততা ও নৈরাশ্য যে তাঁহাদের পক্ষে বিপজ্জনক (উল্লাস) এই কথা আমি এই মঞ্চ হইতে তাঁহাদিগকে জানাইয়া দিতেছি। সুতরাং তাঁহারা নিজেদের অবস্থার পুনর্বিবেচনা করুন। আমাদের দাবী কি? তাঁহারা ঘোষণা প্রচার করুন। সুস্পষ্ট ভাষায় মোছলেম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দানের প্রতিশ্রুতি দিয়া এবং ১৯৪০ সনে মোছলেম লীগের লাহোর অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবের পন্থানুসারে মোছলেম গণ-ভোটের সিদ্ধান্ত মানিয়া লওয়ার ওয়াদা দিয়া অবিলম্বে একটি ঘোষণা বাণী প্রচারের জন্য মোছলেম লীগ ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে অনুরোধ জানাইতেছে।
যুদ্ধ প্রচেষ্টা ও মোছলেম লীগ
ভারত রক্ষাকল্পে এবং সাফল্যের সহিত যুদ্ধ পরিচালনার উদ্দেশ্যে দেশের সমস্ত শক্তি নিয়োগের নিমিত্ত সমানাধিকারের ভিত্তিতে মোছলেম লীগ যে কোন প্রস্তাব বিবেচনা করিয়া দেখিতে রাজি ছিল, এখনও আছে এবং যে কোন দলের সহিত আলোচনা চালাইতে ইচ্ছুক আছে। ১০৪২ সনের ২০শে আগস্ট তারিখে বোম্বাইয়ে এই প্রস্তাব গ্রহীত হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত ইহাকে উপেক্ষা করা হইয়াছে। এই যুদ্ধে আমাদিগকে দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। আমি পূর্বেই বলিয়াছি; এবং এখনো বলি; আমাদের মতামত যাহাই হউক না কেন, ইহাতে কোনই সন্দেহ নাই যে, ভারতবর্ষ যুদ্ধের সম্মুখীন। কোন না কোন ছল-চাতুরীতে, কায়দা কৌশলে ও ছুঁতো-নাতায় আমাদিগকে শুধু নিঃসহায় দর্শকের বূমিকায় অভিনয় করিতে বাধ্য না করার ব্যাপারে কাহার বেশী স্বার্থ আছে? ব্রিটিশের, না আমেরিকা এবং অন্যান্য সম্মিলিত রাষ্ট্রসমূহের কিম্বা আমাদের? তাঁহারা মস্তবড় ভুল করিতেছেন। তাঁহারা এখনও বিপদমুক্ত হন নাই। আমি পূর্বেই বলিয়াছি এখনও বলি যুদ্ধে হার হইলে আমাদের মার্কিন বন্ধুরা নিউইয়র্ক কিম্বা শিকাগো এবং ব্রিটিশের লণ্ডনে যাইতে পারিবেন। আমি আরো বলিতে পারি যে, তাঁহাদের দেশ হিটলার, মুসোলিনী বা মিকাডোর পদানত হইবে না। ঐ কথা আমি চিন্তা করিতে পারি না। যুদ্ধের পরে আমেরিকা দ্বিতীয় শ্রেণীর শক্তিতে পরিণত হইতে পারে। ইহা একটা বিপদ বটে। কিন্তু তাঁহাদের বিপদ এইরূপ নহে যে, তাঁহাদের দেশ বৈদেশিক শক্তির পদানত হইয়া পড়িবে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কি? তাহা এইঃ আমরা যদি পরাজিত হই তবে জাপান অথবা হিটলার আসিবে এবং আমরা হিটলার বা তোজোর পদানত হইব। আমাদের শিকাগোও নাই। আমাদের কি হইবে? দেশরক্ষা ও যুদ্ধ পরিচালনের ব্যাপারে কাহার আগ্রহ ও স্বার্থ বেশি? আমরা অসহযোগিতা করিতেছি, একথা বলা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে সম্পূর্ণ অন্যায় এবং আমরা সহযোগিতা করিতেছি না –একথা বলা আরো অন্যায়। মোছলেম লীগ বলিতেছেঃ আমরা তোমাদের সহিত সহযোগিতা করিতে পারি না, কারণ তোমরা আমাদিগকে অন্ধ অনুসারী হইতে বলিতেছ। তদ্বারা আমরা কি লাভ করার আশা করিতে পারি? আমাদের অর্থ, শোনিত ও অন্যান্য সব কিছুর পরিবর্তে যুদ্ধ জয়ের পরে আমরা কি ফল লাভ করিব? আমরা যদি পরাজিত হই তবে জাপান বা জার্মানী আসিবে। যদি আমরা জয়ী হইত বে অন্ধ অনুসারী হইতে হইবে এবং তাহার পরিবর্তে কিছু বখশিশ পাইব। ইহা দ্বারা কি সহযোগিতা করার উৎসাহ পাওয়া যায়? আত্মসম্মান জ্ঞান সম্পন্ন বা সংঘবদ্ধ কোনও জাতি কি এইরূপ অবস্থা স্বীকার করিয়া লইতে পারে? (না, না, ধ্বনি) ইহাই দৃশ্যপট। অতএব প্রকৃত প্রস্তাবে তাহারা ভুল করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে, কিম্বা ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে চান না এবং জুয়া খেলোয়াড়ের ন্যায় সুযোগ গ্রহণ করিয়া বলিতেছেনঃ “যদি আমরা জয়ী হই, তবে তাহারা এখন যেখানে আছে তাহাদিগকে সেখানেই রাখিব; আর যদি আমরা পরাজিত হই, তবে আমাদের পরে সর্বনাশ আসিবে”।
পাকিস্তান ও ইয়েটস ব্রাউন
আমি পাকিস্তান সম্পর্কে আর অধিক কিছু বলিতে চাই না। পাকিস্তান কি তাহা বুঝিতে কষ্ট হওয়ার কারণ নাই। বহির্ভারতের লোকেরাও ইহা বুঝিয়াছে। মেজর ইয়েটস ব্রাউন তাঁহার নতুন গ্রন্থে লিখিয়াছেনঃ
“মুছলমানের দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া আমাদিগকে সমস্যা অনুধাবন করিয়া দেখিতে হইবে”।
নিম্নে তাঁহার গ্রন্থ হইতে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা হইলঃ
“মুছলমানের দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া আমাদিগকে সমস্যাটা অনুধাবন করিয়া দেখিতে হইবে। কোন বিশ্বকল্যাণকামী অতিমানব অথবা কোন সর্বোচ্চ গভর্নমেন্ট যদি নির্দেশ জারি করেন যে, কোন নিখিল ইউরোপীয় গভর্ণমেন্টের শাসন কর্তৃত্বে আমাদিগকে চলিতে হইবে (অবশ্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থাসহ) এবং এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে নিউটন জাতি কিম্বা শ্লাভরাই হইবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতি, কারণ আমরা ইউরোপে সংখ্যালঘু –তাহা হইলে আমরা ব্রিটিশরা নিশ্চয়ই বেদনাবোধ করিব। তিনি আরো বলেনঃ এই সর্বোচ্চ গভর্নমেন্ট যদি অসীম ক্ষমতা অধিকারী অতিমানবদের সমবায়ে গঠিত হয়, তবুও দাসত্ব শৃঙ্খল মোচন করার মত ক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্তই মাত্র আমরা ইহার আনুগত্য স্বীকার করিয়া চলিব। অতিমানবগণ নিজেদের সিদ্ধান্তের সন্দেহ পোষণ করিতেছেন –এমন লক্ষণ যদি পরিস্ফুট হইয়া উঠে তবুও যদি তাঁহারা দুনিয়ায় এইরূপ প্রচার করিতে থাকেন যে, তাঁহারা সমগ্র ইউরোপের স্বাধীনতা দিয়াছেন এবং সেই জন্য আমাদিগকে আমাদের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে তবে মোছলেম লীগের ন্যায় আমরাও ঘোষনা করিব যে, এইরূপ স্বাধীনতা একটা প্রহসন মাত্র”।
“অতিমানব” মিঃ গান্ধী চান অখণ্ড হিন্দুস্তান। কিন্তু মোছলেম ভারত এই দাবী মানিয়া লইতে পারে না, লইবেওনা ইংরেজগণ তখন কি বলিবে? তখন কি তাহারা বলিবেঃ “ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসমূহের অস্তিত্ব থাকিবে না। আমরা একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে বাস করি, আমাদের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি মাত্র। নিউটনরা আমাদের ভাই! জার্মানদের সংখ্যা ৮ কোটি। যদি প্রস্তাব করা হয়, তাহাদের সকলের জন্য মাত্র একটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে, তবে ইউরোপীয়গণ কি রাজি হইবে। একজন ইংরেজ এবং একজন জার্মানের মধ্যে পার্থক্য কি? তাহারা সকলেই খৃষ্ঠান। তাহাদের পোষাক পরিচ্ছদেও পার্থক্য নাই। তাহাদের ক্যালেণ্ডারও একই। তাহাদের ভাষা, ব্যবস্থা বিজ্ঞান ও কৃষ্টির মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নাই। তাহাদের স্থাপত্য, শিল্প, সঙ্গীত, শাস্ত্র ও সভ্যতার মধ্যেও পার্থক্য নাই। যদি প্রস্তাব করা হয় যে, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ফেডারেল গভর্ণমেন্টের শাসনাধীনে থাকিবে এবং কানাডা ইহার একটি ইউনিটে পরিণত হইবে তবে ইংরেজরাই বা কি বলিবে, আর কানাডিয়ানরাই বা কি বলিবে? তারপর উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা কি হইবেঃ ভৌগলিক হিসাবে আমেরিকা একক, অনুরূপভাবে ইউরোপ ও এশিয়া। এইরূপ পরিকল্পনা যদি স্থির করা হয় তবে তাহারা কি বলিবে? কাজেই মেজর ব্রাউন ঠিকই বলিয়াছেন, মুছলমানের দৃষ্টিকোণ লইয়া সমস্যাটা তলাইয়া দেখিতে হইবে। গভর্ণমেন্ট যদি অসীম ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী অতিমানবদের সমবায়েও গঠিত হয় তবুও দাসত্ব শৃঙ্খল মোচন করার মত শক্তি অর্জন না করা পর্যন্তও আমরা ইহার আনুগত্য স্বীকার করিব না। মোছলেম লীগ এইরূপ স্বাধীনতাকে একটা প্রহসন বলিয়া মনে করিবে (হর্ষ ও উল্লাস)।
হিন্দু পরিকল্পিত স্বাধীনতা
হিন্দু নেতৃবৃন্দের ইহা বুঝা উচিৎ; তাঁহারা আমাদিগকে যে স্বাধীনতা দিতে চান তাহা তাঁহাদেরই পরিকল্পিত। ইহার কাঠামো ঠিক করিবেন তাঁহারাই, আর শাসন কর্ত্তৃত্ব থাকিবে তাঁহাদেরই হাতে। এইরূপ স্বাধীনতা একটা প্রহসন মাত্র (হর্ষ)। প্রথমতঃ আমাদিগকে ভিত্তি ঠিক করিতে হইবে। আমার মনে মোটেই সন্দেহ নাই যে, পাকিস্তানে জনগণের গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হইবে বলিয়াই অনেকে মনে করিতেছেন। শক্তি প্রয়োগ করিয়াই হউক, বা আপোষ-মীমাংসার সাহায্যেই হউক, বৈদেশিক জাতির নিকট হইতেই হউক; বা আমাদের নিজেদের গভর্নমেন্টের নিকট হইতেই হউক; আপনারা যতক্ষণ পর্যন্ত ইহা লাভ করিতে না পারিয়াছেন ততক্ষণ পর্যন্ত শাসনতন্ত্র এবং গভর্নমেন্টের গঠন প্রণালী সম্বন্ধে কোনই প্রশ্ন উঠে না। ফরাসী বিপ্লবের দৃষ্টান্তই উল্লেখ করা যাক। যে পার্টি তদানীন্তন গভর্নমেন্টকে ভাঙ্গিয়া দিতে চাহিয়াছিল, প্রথম সে পার্টিকে দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া পরে গণপরিষদ গঠন করিতে হইয়াছিল। অষ্ট্রেলিয়ার কথা ধরা যাক। সেখানে আপোষ মীমাংসার দ্বারাই কার্যসিদ্ধি করা হয়। ভারতকে দুই ভাগে বিভক্ত করিতে হইবে –প্রথমত এই ব্যাপারে আমাদিগকে একমত হইতে হইবে। ইহার পর শাসনতন্ত্র প্রণয়কারী প্রতিষ্ঠান গঠিত হইবে। জনগণই শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানে তাঁহাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করিবে। সুতরাং আমি মনে করি, অতি সাধারণ ভোটাধিকারের ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়কারী প্রতিষ্ঠান গঠিত হইবে। পাকিস্তানে দুই আনা যাহারা ট্যাক্স দিবেন তাঁহাদের কিম্বা প্রাপ্ত বয়স্ক সকলেরই ভোটাধিকার থাকিবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানে আপনারাই আপনাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করিবেন। আপনারা আপনাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সজাগ না থাকিতে পারেন; এই ক্ষমতার ব্যবহার কি করিয়া করিতে হয় তাহাও আপনারা জ্ঞাত না থাকিতে পারেন। ইহার জন্য দায়ী হইবেন আপনারাই। তবে আমি নিশ্চিত যে, গণতন্ত্র আমাদের দেহ শোণিতের সহিত মিশিয়া রহিয়াছে। ইহা আমাদের অস্থিমজ্জায় বিজড়িত রহিয়াছে। কয়েক শতাব্দীর প্রতিকূল অবস্থার ফলে আমাদের সেই রক্ত চলাচলের গতি মন্থর হইয়া পড়িয়াছে। ইহা জমিয়া গিয়াছে এবং আমাদের ধমনীও স্তব্ধ হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু আল্লাহকে ধন্যবাদ, মোছলেম লীগের প্রচেষ্টায় পুনরায় সেই রক্ত আমাদের ধমনীতে রহিতেছে। পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হইবে জনগণের গভর্ণমেন্ট।
ধনতন্ত্রবাদের নিন্দা
একটা অতি জঘন্য ও কুৎসিৎ প্রথা অবলম্বনে আমাদের সর্বনাশ করিয়া যেসব জমিদার ও পুঁজিবাদী লোক ফাঁপিয়া উঠিয়াছেন আমি তাঁহাদিগকে সাবধান করিয়া দিতেছি। তাঁহারা এত স্বার্থপর হইয়া উঠিয়াছেন যে, তাঁহাদের নিকট যুক্তি তর্ক উত্থাপন করাও কঠিন (তুমুল হর্ষধ্বনি)। জনগণণকে শোষন করার প্রবৃত্তি তাঁহাদের রক্তের সহিত মিশিয়া রহিয়াছে। তাঁহারা এছলামের শিক্ষা ভুলিয়া গিয়াছেন।
পরের ধনে নিজেদের ভুঁড়িকে ফাঁপাইয়া তোলার উদ্দেশ্যে, লোভ ও স্বার্থপরতা বশতঃ এই সমস্ত লোক অন্যের স্বার্থকে গৌণ বলিয়া মনে করেন। ইহা সত্য যে, আমাদের হাতে ক্ষমতা নাই। আপনারা পল্লী অঞ্চলে যাইয়া দেখুন। আমি কতকগুলি গ্রাম পরিদর্শন করিয়াছি। আমাদের লক্ষ লক্ষ লোক দৈনিক একবেলাও আহার করিতে পায় না। এই কি সভ্যতা? ইহাই কি পাকিস্তানের লক্ষ্য? (না, না ধ্বনি)। আপনারা কি লক্ষ্য করিয়াছেন যে, আমাদের লক্ষ লক্ষ লোককে শোষণ করা হইয়াছে? তাহারা দৈনিক একবেলাও খাইতে পায় না।
পাকিস্তানের পরিণতি যদি তাহাই হয় তবে সে পাকিস্তান নিশ্চয়ই আমার কাম্য নয় (হর্ষধ্বনি)। এই সব জমিদার ও পুঁজিবাদী লোক যদি বুদ্ধিমান হন, তবে আধুনিক জীবন ধারার সাথে তাঁহাদিগকে নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া লইতে হইবে। যমি তাঁহারা তাহা না করেন, তবে খোদা তাঁহাদের সহায় হন –আমরা কিছুতেই তাঁহাদিগকে সহায়তা করিব না (শুনুন, শুনুন, পুনঃ পুনঃ হর্ষ ও উল্লাসধ্বনি)। আমাদিগকে আমাদের নিজেদের উপর আস্থা স্থাপন করিতে হইবে। আমাদিগকে ইতস্ততঃ ও দ্বিধাবোধ করিলে চলিবে না। পাকিস্তানই আমাদের আদর্শ আমরা ইহা লাভ করিতে যাইতেছি (হর্ষধ্বনি)। মিল্লাত ও জনসাধারণই ইহার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিবে। আপনারা নিজেদেরকে প্রস্তুত করিয়া তুলুন এবং মনের মত করিয়া একটি শাসনতন্ত্র রচনা করুন। বহু ভুল ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। পাকিস্তানে কিএছলামিক গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হইবে? জনগণের সিদ্ধান্ত অনুসারেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হইবে। একমাত্র সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিতে পারে।
সংখ্যালঘু সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি পাওয়ার অধিকারী। অন্যথায় তাহারা প্রশ্ন করিতে পারেঃ “আপনাদের পরিকল্পিত পাকিস্তানে আমাদের অবস্থা কি হইবে? কাজেই তাহাদিগকে সুস্পষ্টভাবে একটা সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দিতে হইবে। আমরা তাহা দিয়াছিও। আমরা একটি প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছি। উহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে যে, সংখ্যালঘুদিগকে রক্ষা করিতে হইবে, তাহাদের ন্য পুরোপুরিভাবে রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করিতে হইবে। আমি পূর্বেও বলিয়াছি, এখনও বলি, যে কোন সভ্য গভর্নমেন্ট তাহা করিবে এবং করাও উচিত। ইছলামের ইতিহাসে সুস্পষ্ট প্রমাণ রহিয়াছে যে, অমুছলমানদের সহিত কেবলমাত্র ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ ব্যবহারই করা হয় নাই তদুপরি তাহারা উদার ব্যবহারও লাভ করিয়াছে (হর্ষ ও উল্লাস ধ্বনি)।
মিথ্যা প্রচারণা
আমি পাকিস্তান সম্পর্কে আর একটি কথা বলিতে চাই। তাহা হইতেছে এইঃ একটা নতুন ধরনের প্রচারণা চলিতেছে। গো-মাতাকে দ্বিখণ্ডিত করা, ভারত মাতাকে দুইভাগ করা ইত্যাকার দুষ্ট প্রচারণা চলিতেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কিন্তু সর্বশেষ প্রচারনাই হইতেছে সর্বাপেক্ষা কুৎসিৎ ও জঘন্য। তাহা হইতেছে এইঃ মি জিন্নাহ উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে অংশের নিজস্ব সর্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিস্ঠার জন্য প্রচেষ্টা করিতেছেন তাহা হইতেছে পাক আর বাকীগুলো ‘না-পাক’। বহু মহলে এইরূপ মন্তব্য শুনিয়াই আমি আশ্বর্যান্বিত হইয়াছি। মিথ্যা প্রচারণার ফল কি তাহা আপনারা জানেন। আমরা যখন লাহোর প্রস্তাব গ্রহণ করি তখন ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহার করি নাই। কাহার নিকট হইতে আমরা এই শব্দটি পাইয়াছি? (‘হিন্দু’, ‘হিন্দু’ ধ্বনি)। আমি বলিতেছি ইহার জন্য দায়ী তাহারাই। পাকিস্তান নামে অভিহিত করিয়া তাহারা এই প্রস্তাবের মুণ্ডপাত করিতে থাকে। তাঁহারা প্রকৃতই মোছলেম আন্দোলন সম্পর্কে অজ্ঞ। তাঁহারা এই শব্দের জন্য আমাদের উপর দায়িত্ব আরোপ করে। তাঁহারা ‘প্যান-এছলামিজম’ বলিয়া চিৎকার আরম্ভ করে। ইহার পালা শেষ হইলে আসে ‘পাকিস্তান’। তাঁহারা এইরূপ খেলাই খেলিতেছে। আপনারা উত্তমরূপে জানেন যে, কোন কোন শ্রেণীর হিন্দু সংবাদপত্র এবং ব্রিটিশ সংবাদপত্র এই শব্দটির দায়িত্ব আরোপ করে আমাদের উপর। বহুদিন পর্যন্ত আমাদের প্রস্তাবটি লাহোর প্রস্তাব নামে অভিহিত হইতেছিল। এখন ইহা জনসাধারণ্যে পাকিস্তান নামে পরিচিত। আর কতকাল আমরা দীর্ঘ Phraseka ব্যবহার করিব? আমি এখন আমার হিন্দু ও ব্রিটিশ বন্ধুগণকে বলিঃ আমাদিগকে এই শব্দটি দিবার জন্য আমরা আপনাদিগকে ধন্যবাদ জানাইতেছি (হর্ষ ও শুনুন, শুনুন ধ্বনি)।
পাকিস্তান শব্দের গোড়ার কথা
‘পাকিস্তান’ শব্দের গোড়ার কথা কি? মোছলেম লীগ বা কায়েদে আযম ইহা সৃষ্টি করেন নাই। যাহারা উত্তর পশ্চিমের একটা বিশেষ অংশকে অবশিষ্ট ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে চাহিয়াছিলেন লণ্ডনের এমন কয়েকজন যুবক ১৯২৯-৩০ সালে একটি অঞ্চলকে ‘পাকিস্তান’ নামে অভিহিত করেন। তাহারা পাঞ্জাবের P আফগানের A (ক্রমাগত উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এই নামে পরিচিত) কাশ্মীরের K সিন্ধুর S এবং বেলুচিস্তানের Tan এইরূপে Pakistan নামের উদ্ভব হইল। ঐ সময় এ শব্দের অর্থ যাহাই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সভ্য দেশের ভাষাতেই নূতন নূতন শব্দের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে পাকিস্তান শব্দের দ্বারা লীগের লাহোর প্রস্তাবকে বুঝায়। আমাদের এমনই একটা শব্দের প্রয়োজন ছিল এবং এই শব্দটার দায়িত্বও আমাদের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইল। যাহা হউক ইহাতে আমাদের সুবিধাই হইয়াছে। এই পাকিস্তান শব্দের মানে লাহোর-প্রস্তাব।
ফেডারেশনের অসারতা
কোন কোন শাসনতান্ত্রিক পণ্ডিত বলিয়া থাকেনঃ একটা শিথিল ফেডারেশন বা কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করা যাইতে পারে না কেন? এই সম্পর্কে আমি যাহা লিখিয়াছি, তাহা আপনাদের সমক্ষে পাঠ করিতেছি। ইহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেহ কেহ একটা শিথিল ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করিতেছেন এবং ইহার অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলিকে ব্যাপকতম স্বাধীনতা ও অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতা দিবার কথাও বলিতেছেন। কিন্তু তাঁহারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের কথা ভুলিয়া যাইতেছেন। যে রকমের ফেডারেশনই হউক না কেন; পরিণামে ইহা ইহার অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলিকে সকল রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত করিবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইউনিটসমূহ কেন্দ্রীয় শক্তির হস্তে অধিক হইতে অধিকতর পরিমাণে ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত করিবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইউনিটসমূহ কেন্দ্রীয় শক্তির হস্তে অধিক হইতে অধিকতর পরিমাণে ক্ষমতা অর্পণে বাধ্য হইবে। অবশেষে ইউনিটগুলি নিজেই একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্ট স্থাপন করিবে। প্রয়োজনের তাগিদেই ইউনিটগুলি তাহা করিতে বাধ্য হইবে। উদাহরণ স্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহার ইতিহাস এবং কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ইউনিয়ন, জার্মানী ও অন্যান্য দেশ যেখানে ফেডারেল বা কনফেডারেল প্রথা বিদ্যমান আছে; তাহার কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হইয়া ফেডারেশন বা কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তে অধিকতর পরিমাণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছাড়িয়া দিতে হইয়াছে।
ফেডারেশনের অর্থ কি এবং উদ্দেশ্যই বা কি, তৎসম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব বশতঃই ফেডারেশনের এই সমস্ত পরিকল্পনা করা হইয়া থাকে। অবশিষ্ট্যত্মক ক্ষমতা প্রস্তাবিত ইউনিটসমূহেরই থাকুক কিংবা কেন্দ্রীয় শক্তিরই থাকুক, তাহাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না। আসল কথা হইতেছে এই যে, একবার যদি ইউনিটগুলি কেন্দ্রীয় ফেডারেল গভর্নমেন্ট মানিয়া লয় তবে অপরিহার্যরূপে ও একান্ত প্রয়োজনের খাতিরে এইগুলি একটি সর্বশক্তিমান কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টে পর্যবসিত হইবে। আমরা এইরূপ পরিকল্পনার বিরোধী। শুধু তাই নয় যে প্রস্তাবে ফেডারেল বা কনফেডারেল যে কোন কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের আভাস ইঙ্গিত থাকিবে তাহা গ্রহণেও আমরা রাজী হইতে পারি না। কারণ ইহার ফলে পরিণামে মোছলেম জাতি শিক্ষা, কৃষ্টি ও রাজনীতির দিক দিয়া এবং সামাজিকভাবে ও আর্থিক অবস্থার দিক দিয়া পঙ্গু হইয়া পড়িবে এবং এই উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু হিন্দুরাও প্রতিষ্ঠিত হইবে। কাজেই এইরূপ কোন চিন্তাও আপনাদের মনে স্থান দিবেন না। শিথিল ফেডারেশন বলিয়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই।
ভারতীয় বিরোধী বিলের নিন্দা
বোধহয় অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কেই আলোচনা করিয়াছি। দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্প্রতিক ভারতীয় বিরোধী আইন নিঃসন্দেহে নিকৃষ্টতম আইন। বর্তমান সময়ে এইরূপ বিল পাশ করার চেষ্টা অত্যন্ত বিস্ময়কর। একদিকে সাম্রাজ্যের প্রত্যেক অংশকে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করিতে বলা হইতেছে এবং ভারতীয়গণকে রণক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি যুদ্ধ করিতে সম্পূর্ণ সমকক্ষ বলিয়া বলা হইতেছে, পক্ষান্তরে সাম্রাজ্যের অন্যতম সদস্যকে যুদ্ধপ্রচেষ্টার সহায়তার পরিবর্তে তাহাকে এইরূপ বৈষম্যমূলক আইন উপঢৌকন দেওয়া হইতেছে। ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের এজেন্ট ভারত সরকারসহ; সমগ্র ভারতবর্ষ এই আইনের নিন্দা করিয়াছে। তৎসত্ত্বেও ভারত-সচিব তাঁহার বিবৃতিতে এ বিষয়ে তাঁহার কিছু বলার নাই বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। ইহাতে আমি বিস্ময়বোধ করিতেছি। আমাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিতর্ক সম্পর্কে ইহাতে কি আমরা কোনও শিক্ষালাভ করিতে পারি না?
আর একটি বিষয় বলার আছে। সম্প্রতি আর একটি বেদনাদায়ক বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। ভারতীয় দেশীয় রাজ্যসমূহের ব্যাপারে মোটেই সুবিধাজনক নহে। আমি কয়েকটি রাজ্য, যথা-কাশ্মীর, গোয়ালিয়র ও কোটাহঁর কথা উল্লেখ করিব। এ ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক। এই সমস্ত রাজ্যে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু এবং হিন্দুদের হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা রহিয়াছে। উৎকৃষ্টতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ঐ সমস্ত রাজ্যের শাসকদের প্রতি আবেদন জানাইতেছি। সেই রকম যে মুসলমান শাসকের রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য রহিয়াছে, সেখানে তাঁহাদেরও উচিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবহার করা এবং তাঁহাদের আইনসঙ্গত অভাব অভিযোগের প্রতিকার করা। যে জাতি যেখানে সংখ্যাগুরু হইবে সে জাতি সেখানে সংখ্যালঘু জাতির উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করিবে ভারতীয় সমস্যা সমাধানের পন্থা ইহা নহে। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করিলে সমস্যার পথ পরিস্কার হইয়া আসিবে আমি আশা করি, কোন সন্তোষজনক মীমাংসা সম্ভব হইবে। যদি কোন মুসলমান শাসন বা সংখ্যাগুরু মুসলমান হিন্দুদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেন তবে আমি একই রকম দুঃখিত হইব।
উদাত্ত আহবান
পরিশেষে আমি আর একটি কতা বলিতে চাই। আমি মুছলমানদিগকে বলিঃ গত ৭ বৎসর আমরা বহু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়া চলিয়াছি। বর্তমানে আমরা এমন এক স্তরে পৌঁছায়াছি যেখানে আমাদের মনে সন্দেহের লেশ মাত্রও নাই যে, ভারতের দশ কোটি মুসলমান এক্ষণে আমদের পেছনে রহিয়াছে। দশ কোটি মুসলমান অর্থে আমি এই বুঝাইতে চাই যে, কয়েকজন বিশ্বাসঘতক, দুর্বলচিত্ত, অতিমানব কিংবা উন্মাদ ব্যক্তি ছাড়া তাহাদের মধ্যে শতকরা ৯৯ জনই আমাদের সমর্থক। প্রত্যেক জাতি বা সমাজেই কিছু সংখ্যক কলঙ্কিত লোক রহিয়াছে। কোন জাতি বা সমাজই এই পাপ হইতে একবারে মুক্ত নহে। অষ্টাদশ শতাব্দী ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্বংসস্তুপের মধ্য হইতে আধুনিক ভারতের মোছলেম জাতির অভ্যূদয় একটি অলৌকিক ব্যাপার (উল্লাস)। যে জাতি সবই হারাইয়াছিল এবং অদৃষ্টদোষে যাঁতাকলের চাপায় পড়িয়াছিল তাহারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে শুধু জাগে নাই, পরন্তু আধুনিক ভারতে ব্রিটিশের পরেই সামাজিকভাবে সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক, সামরিকভাবে সর্বাপেক্ষা অধিক পৌরুষসম্পন্ন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মীমাংসাকারী হইয়া দাঁড়াইয়াছে (উচ্চ হর্ষ ধ্বনি)। আপনাদিগকে নিজেদের বিশিষ্ট অংশ অনুযায়ী কাজ করিতে হইবে। যাহাতে আমরা পাকিস্তানের পথে জয়যাত্রা করিতে পারি, তজ্জন্য গঠনমূলক কার্য্যক্রম গ্রহণ করিবার পক্ষে ইহাই উপযুক্ত সময়।
জাতির শিক্ষক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি বিধানকল্পে আপনাদের সকলের একযোগে পরামর্শ করিয়া যথোপযুক্ত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। আমি পুনরুক্তি করিয়া বলিতেছি যে, আমাদিগকে গঠনমূলক কার্য্যক্রম গ্রহণ করিতে হইবে, আমি আশা করি আপনারা ইহা পারিবেন। আমি উপসংহারে বলিতে চাইঃ আমাদের গন্তব্যস্থল নিকটবর্তী। ঐক্যবদ্ধ হইয়া অধ্যবসায় সহকারে অগ্রসর হউন। (উচ্চ হর্ষ ও বহুক্ষণ ব্যাপি উল্লাসধ্বনি এবং তুমুল ‘কায়েদে আযম জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘মোছলেম লীগ জিন্দাবাদ’, ধ্বনি)।
[এই বক্তৃতাটি ‘কায়েদে আযমের পত্র ও বক্তৃতাবলী’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গ্রহীত। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে। এর সম্পাদনা ও অনুবাদ করেছেন এম, জহুর হোসেন চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক, জিয়া মুসলিম লীগ চট্টগ্রাম এবং মওলানা নুরুল ইসলাম, প্রেসিডেন্ট, মুসলিম ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম।
উল্লেখ্য, এম, জহুর হোসেন চৌধুরী পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং স্বাধীনতার পর মুজিব সরকারের মন্ত্রী হন।]
পরিশিষ্ট-৩
১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে জিন্নাহ-গান্ধীর মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনা ব্যর্থ হবার পর উভয় পক্ষের সাংবাদিক সাক্ষাৎকারঃ
১৯৪৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখে নিউজ-ক্রণিকল-এর প্রতিনিধির সঙ্গে মিঃ গান্ধীর সাক্ষাৎকারঃ
মিষ্টার গান্ধী আমাকে মিঃ জিন্নার সঙ্গে তার হিন্দু-মুসলমান বিরোধের আপোষ আলোচনা কেন ব্যর্থ হয়েছিলো সে সম্পর্কে বলেছেনঃ
“আমি দ্বি-জাতিতত্ত্ব মেনে নিতে পারিনা। এটাই ছিল মিঃ জিন্নার দাবী। তিনি অবিলম্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধু, সমগ্র পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান এবং আসাম ইত্যাদি প্রদেশ নিয়ে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করতে চান। তিনি গণভোটের মাধ্যমে এ সকল অঞ্চলের অধিবাসীদের মত যাচাই না করে বাকী ভারত থেকে এ সকল এলাকা বিভাগ করার জন্য মিঃ গান্ধীর সমর্থন আদায় করতে চান। তিনি রাজা গোপালাচারীর ফর্মূলাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন”।
পাকিস্তান প্রস্তাব স্বীকার করা এবং আপোষ মীমাংসার কোন সম্ভাবনা আছে কি না, এ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছিলাম। তাঁর মতামত ছিল সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, “এটা আমি প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, আমি মিঃ জিন্নার অকপটতায় বিশ্বাস করি; কিন্তু আমার মনে হয় যে, ভারতকে অস্বাভাবিকভাবে বিভক্ত করা হলে জনসাধারণের সুখ এবং উন্নতি হবে, তিনি এ ধরনের বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছেন। গণভোটের মাধ্যমে মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলোকে নিয়ে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করার প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তানকে উভয়ের পক্ষে কতকগুলো সাধারণ কতক বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে।বৈদেশিক ব্যাপার, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং এ রকম অন্যান্য দফতরের নিয়ন্ত্রণ দু’রাষ্ট্রকে যুগ্মভাবেই সম্পাদন করতে হবে। ভারতের উভয় অঞ্চলের জন্য এ ব্যবস্থা কল্যাণজনক হবে তা স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান। এই ব্যবস্থা মুসলমানদের আভ্যন্তরীন জীবনে কোন রকম হস্তক্ষেপ করবে না এবং তারাও কোন দিক দিয়ে হিন্দুর কর্তৃত্ত্বাধীন থাকবে না। এই বিভাগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে জনসাধারণের মধ্যে কৃত্রিম বাধার প্রাচীর সৃষ্টি হবে না। ধর্ম যাই হোক না কেন, সকলে একই পূর্বপুরুষের বংধধর এবং সকলেই ভারতীয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ মিঃ জিন্নাহ সে ধরনের কোন প্রস্তাবে রাজী হলেন না। আমকে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক কথা মেনে নিতে বলেন”।
আমি মিঃ গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ রকমের কোন বিভাগ দেশবাসীকে দিয়ে গ্রহণ করাতে পারবেন না বলে, নাকি নীতি হিসেবে ভ্রান্ত বলেই গ্রহণ করতে পারেন না’। তিনি জবাবে বললেন, “মূলতঃ নীতি হিসেবেই তা ভ্রান্ত। যদি আমি মিঃ জিন্নার মতামত অভ্রান্ত মনে করতাম সমগ্র পৃথিবী বিপক্ষে গেলেও আমি তা গ্রহণ করতাম এবং সমর্থন জানাতাম নির্দ্বিধায়”।
আমি তার পরে মিঃ গান্ধীর কাছে জানতে চাইলাম, ‘মিঃ জিন্নাহ গণভোট ছাড়া অথবা শুধু মুসলমানের গণভোট মেনে নিয়ে আপনার সঙ্গে একমত হলে আপনি কি রাজী হবেন? তিনি বললেন, “কখনো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিংবা অন্য কোন উপায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যত নির্ধারণে তাদের মতামত ছাড়া কেমন করে সায় দেবো”।
আমি জানতে চাইলাম, ‘জুলাই মাসে স্বল্পস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন যে জাতীয় সরকারের রূপরেখা আপনি ব্যক্তি করেছেন, সে সম্পর্কে মিঃ জিন্নার মনোভাব? মিঃ গান্ধী জবাব দিলেন, “মিঃ জিন্নাহ আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি স্বাধীনতার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসুক। তবে আমার মনে হয়, পাকিস্তান দাবীর প্রতি তিনি যতটা গুরুত্ব আরোপ করেন, স্বাধীনতার দাবীকে অতটা করেন না। অপর দিকে আমার মতামত দেখুন, আমি সব সময়ে বলে আসছি, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা স্বাধীন হতে পারব না। আমরা বন্ধুভাবেই বিদায় গ্রহণ করেছি। আমার ধারণা মিঃ জিন্নাহ একজন ভাল মানুষ। আশা করি আমাদের দু’জনের মধ্যে আবার দেখা হবে। আমি একজন উপাসনা-নির্ভর মানুষ। এই সময়ে জনসাধারণের কর্তব্য হলো পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করে তাদের মতামতের চাপ আমাদের উপর প্রয়োগ করা”।
সাংবাদিক সম্মেলনে কায়েদে আযম
১৯৪৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর মিঃ জিন্নাহ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেনঃ ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত মিঃ গান্ধীর সংবাদপত্রের মতামতের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। তিনি মনে করেন, ‘তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিই আমাদের আপোষ প্রচেষ্টার প্রতিবন্ধক; এটা খুবই দুঃখের বিষয়। দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মন আচরণে স্বাধীন মনের পরিচয় দিতে পারে না’ তাঁর এ উক্তি আমাকে খুবই ব্যথা দিয়েছে। কোন শক্তিই মানুষের মন কিংবা আত্মাকে বেঁধে রাখতে পারে না। আমি নিশ্চিত যে, মিঃ গান্ধীও তাঁর মনকে শৃংখল পরাতে রাজী হবেন না। আমি আশা করি তিনি সর্বদা যে তাড়নায় ভুগছেন তা অতিক্রম করতে সক্ষম হবেন। তৃতীয় পক্ষের বদলে আমাদেরকেই আপোষ মীমাংসায় আসতে হবে। অন্যান্য বিষয়ে মিঃ গান্দী সুনিপুণ ভাষায় যুক্ত এশতেহারের প্রতিকূলে নিজের প্রোপাগাণ্ডা করেছেন। মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্ব করার আমার উপর যে ভার অর্পিত হয়েছে তার চ্যালেঞ্জ করার বদলে তিনি আমার বিরুদ্ধে মুসলমানদের উত্তেজিত করেছেন। তিনি সবসময়েই বলেছেন যে, তাঁর প্রস্তাব অথবা গান্ধী-রাজাজী ফর্মূলা কিংবা তাঁর শেষ মুহুর্তের প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাবের সারাংশ সংযোজিত করেছেন। গান্ধী ও রাজাজীর মধ্যে যে কোন প্রভেদ নেই একথা বুদ্ধিমান মানুষের চোখ এড়াবে না। লাহোর প্রস্তাবের যাবতীয় মূল উপাদানকে অস্বীকার করার পরেই যাকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রস্তাব বলছেন, তা এসেছিলো। শুরুতেই গান্ধী-রাজাজী ফর্মূলাকে এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন বিষয়টি সাধারণের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। মিঃ গান্ধী মন্তব্যের পর মন্তব্যে এবং সাংবাদিক সম্মেলনে এমন সব বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে যাচ্ছেন, যার ফলে তাঁর প্রস্তাবটির প্রধান দিকগুলো সম্পর্কে আমি বাদ্য হয়েই আলোচনা করছি।
(১) একটি জাতীয় ইউনিট হিসেবে অবিলম্বে ভারতে স্বাধীনতা দান।
(২) তাঁর ধারণা অনুসারে অবিলম্বে স্বল্প সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা তাঁরই লেখা ১৫ই সেপ্টেম্বরের পত্রে নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
“স্বল্প সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটি বর্তমান পরিষদের নির্বাচিত সদস্য অথবা নূতনভাবে নিবাচিত পরিষদের কাছে দায়ী থাকবেন। যুদ্ধপূর্ব সময়ে প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা ছাড়া অন্যান্য ক্ষমতা এবং যুদ্ধের পরে এই সরকারই সম্পূর্ণ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করবেন। কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে যে চুক্তি হবে তা এ সরকার কার্যকরী করে তুলবে। প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও উল্লেখ্য যে, তার প্রভাবে একটি তৃতীয় পক্ষকে স্বীকার করা হয়নি; শুধু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রতিরক্ষার মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সরকারী ক্ষমতাকে প্রধান সেনাপতির হাতে তুলে দিয়েছেন। এ থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, কেন্দ্রীয় অথবা যুক্তরাষ্ট্রীয় যে সরকারটি অথবা কেন্দ্রীয় যে সরকারটি গঠিত হবে এবং যার উপর সম্পূর্ণ প্রশাসন কার্যের ভার থাকবে তা কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে অবিসংবাদিতভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যাদের সংখ্যা শতকরা ৭৫ জনের কম হবে না তাদেঁর কাছেই দায়ী থাকতে হবে।
(৩) এ রকম একটি সরকার গঠিত হওয়ার পরে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার দায়িত্ব এ সকরারের উপরই থাকবে। অথবা এ উদ্দেশ্যে একটি সংস্থা নিয়োগ করে সেই সংস্থার উপরই বৃটিশ শাসনের অবসানের পর স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করবেন।
(৪) যাকে তিনি নিজের প্রস্তাব বলেছেন, তাতে বিশদভাবে যুগ্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো বৈদেশিক বিষয়, প্রতিরক্ষা, আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, শুল্ক, বাণিজ্য এবং এ জাতীয় অন্যান্য যুগ্ন স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে চুক্তির খসড়া করবেন এ সরকার এবং তা অবশ্যই একটি সন্তোষজনক এবং কার্যকরী কেন্দ্রীয় সংস্থা অথবা সরকারের অধীনে সকল সময়ের জন্য কার্যকরী থাকবে। তাঁর এ প্রস্তাবের একমাত্র অর্থ হতে পারে যে, যে সব অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় একটি রাষ্ট্রের রক্ত-মাংস বলে ধরা হয় সে সকল বিষয়কে ভারত সরকারের হাতে বৃটিশ কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে তেমনি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত দায়িত্ব এবং কর্তব্য তুলে দেয়া হবে। এ সকল প্রস্তাবে এ কথাই স্পষ্ট, যে সরকার গঠিত হবে, তার পুরোপুরি রক্ষা নিরংকুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতেই থাকবে। আদতে তা হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠার নামান্তর।
(৫) তার পরে জেলাভিত্তিক সীমানা নির্ধারণের নীতি মেনে নেয়া আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর শর্ত হয়ে দাঁড়াবে। মিঃ গান্ধীর মতে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলে যে জেলায় মুসলমানেরা সংখ্যায় শতকরা ৭৫ জন, সে জেলাকেই চিহ্নিত করা হবে। নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে তিনি সিন্ধু, বেলুচিস্তান অথবা উত্তর-পশ্চিম প্রদেশকেই বোঝেন; আর মিঃ রাজা গোপালাচারীর মতে সাধারণতঃ আইনের ভাষায় যা, তাইই হলো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আমি অভিধান হতে জানতে পেরেছি যে, এর অর্থ হলো (ভোটে অংশ গ্রহণ করবে যারা এবং যারা করবে না) সমস্ত জনসাধারণের মধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পাঁচ মিশেলীভাবে গভভোট অথবা অনুরূপ অন্য কোন পদ্ধতির মাধ্যমে অঞ্চলসমূহের চিহ্নিত করা হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের ধরণটা কি ধরনের হবে পূর্বাহ্নে মেনে নিতে পারি কি না বিবেচনার সুযোগ আমাদেরকে না দিয়ে তা স্থির করবেন উপরোক্ত জাতীয় সরকার।
আমরা এ সকল শর্ত মেনে নিলেও আমাদেরকে নিম্নলিখিত শর্তাবলীর অধীন থাকতে হবে। (১) যুদ্ধের পরেই এ বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। (২) জাতীয় সরকারের হাতে ভারত সরকারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব হস্তান্তরের পরই জাতীয় সরকার উপরে বর্ণিত পরস্পর সংলগ্ন জেলাসমূহের সীমানা চিহ্নিত করবার জন্য একটা কমিশন নিয়োগ করবেন। তখন কমিশনটি বাংলা, আসাম এবং পাঞ্জাবে চূড়ান্ত ভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং জাতীয় সরকার কমিশনের রায়কেই কাজে রূপ দিবেন। এলাকাসমূহ আলাদা হতে চাইলেও সামগ্রিকভাবে মতামত যাচাইয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সরকারের রায়কেই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হবে। মেনে নেয়ার পরও যদি রায় মুসলমানদের স্বপক্ষে আসে তাহলে অপরিহার্য বিষয়সমূহ, যেমন বৈদেশিক বিষয়, প্রতিরক্ষা, আভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা, শুল্ক, বাণিজ্য এবং এ রকম অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের ভার একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা বা সরকারের উপর অর্পণ করা হবে এবং তা সকল সময়ের জন্য বলবৎ থাকবে।
এটাই হলো মিঃ গান্ধীর মতে দু’ভাইয়ের ভ্রাতৃভাবে পৃথক করা হওয়া। মিঃ গান্ধী যখন বিরক্তিকরভাবে বারবার বলেন, তাঁর প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাবের মূল দাবী পূরণ করা হয়েছে, তখনই সবচেয়ে আশ্চর্য ঠেকে। তিনি যেভাবে বারবার অত্যন্ত অসরলভাবে বাঁকাচোরা প্রস্তাবের কথা বলে বেড়ান, বাস্তবিকই তা উপলব্ধি করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। জনসাধারণকে বিভ্রান্ত এবং সবকিছু একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে সন্দেহের গহবরে ফেলার অর্থ কি? তাদেঁর প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমরা মরণ-ফাঁদে পা বাড়াবো এবং পাকিস্তানেরও কবর রচিত হবে। কিন্তু তার পরেও তিনি যখন বলেন, “আমি এবং রাজাজী যদি লাহোর প্রস্তাবের মর্ম সঠিক অনুধাবন করতে না পারি, তাহলে আমাদেরকে ওয়াকেফহাল করে তোলা উচিত, তখন কিঞ্চিৎ আশার আলো আমরা দেখতে পাই।
তিন সপ্তাহ ধরে মিঃ গান্ধীর সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় আসার জন্য আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁর রোগ এতো জটিল এবং পুরনো যে, আরোগ্য করে তোলা যে কোন চিকিৎসকেরই সাধ্যের বাইরে। আমি আশা করি তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জনসাধারণ এবং সংবাদপত্র সমূহের কাছে যে আবেদন করেছেন, তা বিফলে যাবে না। কিন্তু তারপরেই তিনি বলেছেন, “আমি আমার অন্তরের বাণীই মেনে চলবো”। আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ তাঁর অন্তরের পাত্তা পাবে না।
মিঃ গান্ধী হয়তো আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে পারেন যে, তাঁর নিজের প্রস্তাব অথবা গান্ধী-রাজাজী ফর্মূলায় লাহোর প্রস্তাবের সারাংশ সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু তা তার অলীক কল্পনা মাত্র। দুই প্রস্তাবের ভাষা ও শর্ত মিঃ গান্দী যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, শুনলে শ্যাম দেশীয় যমজের কথা মনে পড়ে। দুটোর একটাতেও যে লাহোর প্রস্তাবের কোন একটি মুখ্য বিষয় স্থান পেয়েছে, তা বিশ্বাস করা অসম্ভব। তাঁর যে কোন একটি চিঠি, তা যতোই সংক্ষিপ্ত হোক না কেন, স্ববিরোধিতা এবং অসামঞ্জস্যের পরিমাণ এতো বেশি যে, হিসেব করা যায় না। গত তিন সপ্তাহ ধরে এত অসঙ্গতিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন যে, তার সবগুলোর সংকলন করলে চীন দেশীয় ধাঁধার মতো রূপ নেবে। অনেক অসঙ্গতির মধ্যে শুধু আমি একটার উদাহরণ দিচ্ছি। তিনি বলেছেন, “মুসলমানেরা যেখানে স্পষ্টতঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে তাদের আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করার অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু তার অর্থ যদি হয়, দুটি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং দু’য়ের মধ্যে যুগ্ম স্বার্থ সংরক্ষণের কিছু থাকবে না, তাহলে এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া অসম্ভব এবং এটাকে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করার শামিল মনে করি। “একজন অহিংসার প্রবর্তক মহাপুরুষ আমাদেরকে তলোয়ার যুদ্ধের ভীতি প্রদর্শন করেছেন এবং তার মতে আলাপ-আলোচনার পালা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। তার বাদেও তিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে কি ধরনের আলাদা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে চান?
মিঃ গান্ধী আবার হয়তো উত্তেজনার মুহুর্তে বলে ফেলেছেন যে, মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারার মতো উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। অসন্তুষ্ট ভাবে এমন সব মুসলিম প্রতিষ্ঠানের ইঙ্গিতও দিয়েছেন, যেগুলোর পেছনে (গান্ধীর ধারণা) প্রচুর মুসলমানদের প্রচুর সমর্থন বর্তমান। তাদের সঙ্গে লীগের অহি-নকুল সম্পর্ক এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বেও তারা বিশ্বাসী নয়। এ বলে তিনি মুসলিম লীগের মর্যাদাকে খাটো করেছেন এবং মুসলমানদের সংহতি বিনাশ করতে চেয়েছেন। কারণ তিনি নিজেই জানেন, এ কথা সত্য নয়। অবশ্য কোন জাতিই শতকরা একশো ভাগ সংহতি অর্জন করতে পারে না।
এক নিঃশ্বাসে মিঃ গান্ধী বিভাগ নীতি মেনে নেন, কিন্তু পর মুহুর্তে এমন সব প্রস্তাব করে বসেন, যার ফলে মুসলিম ভারতের দাবীর মূল ভিত্তিপ্রস্তর পর্যন্ত তলিয়ে যায়। একদিকে তিনি লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে আপোষ করতে চান, কিন্তু অন্যদিকে লীগের মুসলিম ভারতের প্রতিনিধিত্বের দাবী অস্বীকার করেন। মিঃ গান্ধী হচ্ছেন একজন মূর্তিমান ধাঁ ধাঁ বিশেষ।
সাংবাদিকরা মিঃ জিন্নার কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সীমানা সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলে তিনি পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দেন। পাকিস্তানের সীমানাবর্তী অঞ্চলের অমুসলমান প্রধান এলাকাসমূহ পাকিস্তানে যোগ দেবে না হিন্দুস্তানে যোগ দেবে, তা স্থির করার জন্য কোন কমিশন গঠন করা হবে কি না তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো। মিঃ জিন্নাহ প্রশ্নকারীর দৃষ্টি লাহোর প্রস্তাবের প্রতি আকর্ষন করে বললেন, “প্রস্তাবানুসারে ছ’টি প্রদেশ, যথা পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, বাঙলা এবং আসামের বর্তমান সীমানা অনুসারেই বিভাগ করা হবে, কিন্তু তা আঞ্চলিক সমতা বিধানের অধীন থাকবে”। “অধীন থাকবে” কথাটি তিনি জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন। পরে বুঝিয়ে বললেন, “এক দেশের ক্ষেত্রে নয়, উভয় দেশের জন্যই আঞ্চলিক সমতা বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য”। তিনি বললেন, “আমি পরিস্কার বলেছি, যদি আমরা লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি মেনে নেই, তার পরে পরেই দু’জাতির মধ্যে উদ্ভুত সীমানা চিহ্নিত করণের কাজে হাত দিতে পারি। এক সরকার যেবাবে অন্য সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আপোষে আসে, এও হবে অনকেটা সে রকম”।
একজন সাংবাদিক হঠাৎ করে বসলেন, এখন তো কোন সরকার নেই। মিঃ জিন্নাহ জবাবে বললেন, “উভয় দলই সংবিধান সংস্থা নিয়োগ করবেন। এমনকি কোনো আপোষে আসার আগেও বিষয়টি সংবিধান রচনা সংস্থার এখতিয়ারে থাকবে”। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, “অদূর ভবিষ্যতে মিঃ গান্ধীর সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের কোন সম্ভাবনা আছে কি?” মিঃ জিন্নাহ জবাব দিলেন, “মিঃ গান্ধী এ ব্যাপারে তার অন্তরের বাণীর উপর নির্ভর করেন; আমার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। তাই বলতে পারি না”।
মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টকে পাকিস্তানের সংবিধান সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা আছে কি না জিজ্ঞেস করা হলো। মিঃ জিন্নাহ জবাব দিলেন, “পাকিস্তানের দাবী পয়লা স্বীকৃত হোক, পরে পরিকল্পনা করা হবে”। বিষয়টি আরো খোলাস করার জন্য মিঃ জিন্নাহ পূর্ববর্তী একটি প্রশ্নের প্রতি সাংবাদিকটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “বাস্তবিকই কোন সরকার নাই। যদি বিভাগের নীতি গৃহীত হয়, পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান উভয়কেই তাদের সংবিধান সংস্থা নিয়োগ করতে হবে। ঐ সংস্থাদ্বয়ই দু’টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি দুটো রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্বন্ধ কি রকম হবে তা আলোচনা করে ঠিক করবে। তার পরে দু’টি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অন্যান্য বিরোধের মীমাংসা করবে। আমেরিকা মহাদেশের কথাই ধরুন না। উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ২৫টি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র রয়েছে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চুক্তি এবং আপোষও রয়েছে। এমনকি ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যেও পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ব্যাপারে জোট পর্যন্ত রয়েছে। এসবই হচ্ছে আঞ্চলিক সমতা বিধান করার বিষয়। ভৌগলিকভাবে এক লগ্ন না হলেও দুটি দেশের মধ্যে চুক্তি এবং আপোষ থাকতে পারে। কিন্তু এখানে দুটি দেশ প্রতিবেশী এবং ভৌগলিকভাবে পরস্পর সংলগ্ন।
প্রথম দিকে মিঃ গান্দীর প্রস্তাব অথবা অন্যান্য প্রস্তাবসমূহের লাহোর প্রস্তাবের মূল নীতিকে স্বীকার করা হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মিঃ জিন্নাহ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে বললেন, “মিঃ গান্ধী বলেন তার প্রস্তাব অথবা রাজা গোপালাচারীর ফর্মূলাতে লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতিকে কিভাবে অস্বীকার করা হয়েছে বুঝিয়ে দিতে বলেন। এর জবাবে আমি বলেছি, সে কথা গত ২১ দিন ধরে বুঝিতেছি এবং এখনো বুঝাচ্ছি। জনসাধারণ সম্বন্ধে অন্ততঃ এটুকু বলতে পারি যে, তারা বধির নয়। মিঃ গান্ধী তাঁর মন্তব্য এবং সাক্ষাৎকার সমূহে লীগের মর্যাদাকে খাটো করেছেন এবং মুসলমানদের সংহতি বিনাশ করবার চেষ্টা করেছেন। স্বভাবতঃই আমি তা পছন্দ করি না এবং তিনি নিজেই এর জবাব পাবেন”।
১৯৪৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর লণ্ডনের নিউজ ক্রনিকলের প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাতকার প্রসঙ্গে কায়েদে আযম বলেনঃ
“হিন্দু মুসলমানের সমস্ত বিভেদ নিস্পত্তির জন্য শুধু একটি বাস্তব এবং সঙ্গত পন্থা খোলা রয়েছে। সে জন্য ভারতকে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান দুটো ভাগ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব, বাঙলা এবং আসাম প্রভৃতি মুসলিম প্রধান অঞ্চলে হালের সীমানা অনুসারে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি দিতে হবে। পরস্পরের বিশ্বাস মতো পাকিস্তানে হিন্দু সংখ্যালঘু এবং হিন্দুস্তানে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে সমান ব্যবহার করতে হবে। ওরা যদি আমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারে, আমরাও তাদের উপর আড়াই কোটি মুসলমানের ভার ছেড়ে দিতে রাজী আছি”। মিঃ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা সম্বন্ধে আড়াই ঘন্টা কাল সময়ের সাক্ষাতকারের মিঃ জিন্নাহ আমাদের কাছে উপরোক্তু মতামত ব্যক্ত করেন। মিঃ জিন্নাহ বলেন, “যে প্রস্তাব আমাদেরকে দেয়া হয়েছে, তাতে বুদ্ধির অবমাননা ছাড়া আর কিছু নাই। মুসলমানেরা যেখানে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ নয়, সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাকে রাজী হতে বলা হয়েছিল। আমি মিঃ গান্ধীর কাছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ কি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি জবাব দিয়েছিলেন যেখানে মুসলমানের সংখ্যা সম্পূর্ণ জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ জনেরও বেশি সেখানে আমাদেরকে বিনা ভোটে নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া হবে। এ ব্যাপারে মিঃ রাজা গোপালাচারীর সঙ্গে তার মতামতের পার্থক্য রয়েছে। তার (রাজাজীর) মতামত অনুসারে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আইনগত অর্থ হলো মোট জনসংখ্যার শতকরা একান্ন অংশ। তা হবে শুধু ভোটদানকারীদের নয় সমস্ত জনসংখ্যার শতকরা একান্ন অংশ। কোন পার্টি যে তাতে রাজি হবে না একটা বাচ্চা ছেলেও সে কথা বুঝতে পারে। অতএব আমাকে এমন এক নির্বাচনের প্রস্তাবে রাজি হতে বলা হয়েছে, যা মেনে নিলে পাকিস্তান অঙ্গহীন এবং অচল হয়ে পড়বে। এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যুদ্ধের পরে। তার আগে আমাদেরকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার শতকরা ৭৫ জন সদস্য হিন্দু, তার সহযোগিতা করতে হবে। সুতরাং এটা হবে একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার হিসেবে স্থায়ী প্রতিস্ঠা পাওয়ার পর, যুদ্ধের শেষেই নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং কমিশন নিয়োগের কাজ সম্পন্ন করবে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়, বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিলে পাকিস্তানের কি দশা হবে? তেমনি একটি সরকারের সঙ্গে আমাদেরকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। তাহলে আমাদের হাতে কি থাকবে? তারপরে শুধু সীমানার দিক দিয়ে নয়, পাকিস্তানের অস্তিত্ব হিন্দুস্তানের মধ্যে প্রোথিত একটা দ্বীপের মতো হয়ে দাঁড়াবে। তদুপরি এ সকল অপরিহার্য বিষয় চলে যাবে জাতীয় সরকারের অধীনে”।
“এটা হবে এক ধরনের প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনেই থাকবে। কিভাবে এ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাজ করবে আমি মিঃ গান্ধীকে তার একটা সংজ্ঞা দিতে বলেছিলাম। কারণ এগুলো হলো মৌলিক বিষয়। সুতরাং কেমন করে আমি বর্তমান সংবিধান নাকচের প্রস্তাবে রাজী হয়ে তার বদলে মিঃ গান্ধীর সংযুক্ত ভারতের সম্মিলিত গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টারী সরকার হঠাৎ কার্যকরী করার প্রস্তাবে রাজী হতে পারি? এ রকম প্রস্তাবে রাজী হলে পাকিস্তান প্রশ্ন চিরদিনের জন্য চাপা পড়ে যাবে এবং তার অপমৃত্যু ঘটবে। অথচ মিঃ গান্ধী আমাকে দিয়ে তা-ই করাতে চান। মিঃ গান্ধী বলেন, “আমি যা চাই তাতে আপনি রাজী না হলে ব্যাপক গণবিক্ষোভের সাহায্যে দাবীর প্রতিষ্ঠা করবো”। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন এ ভীতির সামে নত হওয়া আর কংগ্রেস প্রস্তাব মেনে নেয়া একই কথা; অথচ দুটোই পাকিস্তানের পরিপন্থী। বৃটিশ রাজত্বের অবসানে মুসলিম ভারত শুধু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের সম্মুখীন হবে না, পরন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে বৃটিশও হাত মিলাবে। মিঃ গান্ধী যদি ‘গণ-বিক্ষোভে’র সাহায্য গ্রহণ না করেন, তাহলে তিনি আগস্ট প্রস্তাব প্রত্যাহার করতেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাহার তো করেননি, বরঞ্চ তাতে অধিক জোর দিচ্ছেন। আসল কথা হলো, হিন্দুরা মুসলমানদের উপর শাসন চালাতে পারে, তাঁরা সেই ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চান। আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীকে তারা কখনো মেনে নেবে না। আমাদের পথে আরো একটি মৌলক বাধা রয়েছে। মিঃ গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে আর আমি মুসলিম লীগের প্রসিডেন্ট হিসেবেই আলাপ-আলোচনা করেছি। আমি তাঁকে বলেছি যে, যদি আমি আর তিনি কোন মীমাংসায় আসি এবং আমার কমিটি সে মীমাংসা নাকচ করে দেয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানকে মিথ্যাচারের দায়ে দায়ী হতে হবে। আপনার কমিটি নাকচ করে দিলে আপনি ব্যক্তিগতবাবে আলোচনা করেছেন এ অজুহাত দেখাতে পারেন। মিঃ গান্ধী আরো বলেছেন যে, বৃটিশের উপস্থিতির ফলেই আমাদের আপোষ ব্যাহত হচ্ছে। সত্যই কিছু সংখ্যক বৃটিশ আছেন, যারা আমাদের মধ্যে আপোষ হোক এটা চান না। কিন্তু কিছুটা আমাদের ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আমাদের মন এবং আত্মা স্বাধীন। মুসলমানদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী স্বীকার করে নেয়ার পর দশ মিনিটের মধ্যে আপোষে আসা সম্ভব। কোনো শক্তিই তার পথ রোধ করতে পারবে না। তার পরেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রকৃত সহযোগিতার ভাব আসতে পারে। একে অন্যের প্রতি প্রভুত্ব বিস্তারের প্রয়াসে নয়, আপনাপন গ্রহের কর্তা হিসেবে একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গীকে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে”।
[আকবর উদ্দিনের ‘কায়েদে আযম’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।]
পরিশিষ্ট-৪
ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান
বৃটিশ গভর্ণমেন্টের অনুমোদনক্রমে বৃটিশ মন্ত্রীসভা-মিশন ও বড়লাট ১৬ই মে রাত্রে দিল্লী হইতে নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রদান করিয়াছেনঃ-
১। মন্ত্রী মিশনের ভারতাগমনের অব্যবহতি পূর্বে গত ১৭ই মার্চ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ এটলী বলিয়াছিলেন, ভারতবর্ষকে সত্ত্বর পূর্ণ স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করার আন্তরিক উদ্দেশ্য লইয়াই আমার সহকর্মীগণ ভারত যাইতেছেন। কি ধরনের শাসনতন্ত্র বর্তমান সরকারের স্থলাভিষিক্ত হইবে তাহা ভারতীয়গণই স্থির করিবেন। সত্ত্বর সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে সাহায্য করাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।
আমি আশা করি, ভারত ও ভারতীয় বৃটিশ সাধারণতন্ত্রের সহিত যুক্ত থাকতে ইচ্ছুক। আমি বিশ্বাস করি, ইহাতে তাঁহাদের প্রচুর সুবিদাই হইবে।
বৃটিশ সাধারণতন্ত্রের সহিত সংযোগ রাখা বা না রাখা ভারতীয় জনগণের স্বাধীন মতামত সাপেক্ষে। বৃটিশ সাধারণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যের মধ্যে যে সংযোগ তাহা আন্তরিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহা স্বাধীন জনগণের স্বাধীন মিলন। আমি মনে করি, পূর্ণ স্বাধীণতার দাবী করার অধিকারও ভারতের আছে। যথা সম্ভব সত্ত্বর ও সহজে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে সাহায্য করাই আমাদের কর্তব্য।
২। এই ঐতিহাসিক ঘোষনার দায়িত্বভার বহন করিয়া আমরা, মন্ত্রীসভার সদস্যত্রয় ও বড়লাট, দুই প্রধান রাজনৈতিকদলকে সর্বভারতীয় ঐক্য বা বিভাগের মূলসূত্রে একমত হইতে সাহায্য করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। নয়াদিল্লীতে সুদীর্ঘ আলোচনার পরে আমরা সিমলা কনফারেন্সে কংগ্রেস ও মোছলেম লীগকে সমবেত করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। সম্পূর্ণ মত বিনিময়ের পরে উভয় পক্ষই অবশিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবধান দূর করা এবং কোন মীমাংসায় পৌঁছান সম্ভবপর হয় নাই। সুতরাং উভয় পক্ষের অনুমোদিত কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে না পারায় আমরা সত্ত্বর নূতন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা শ্রেষ্ঠ মনে করি, তাহা উপস্থিত করা আমাদের কর্তব্য।
৩। ভারতীয় জনগণ যাহাতে তাহাদের ইচ্ছামত ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র গঠন করিতে পারেন, তাহার আশু ব্যবস্থা করা সাব্যস্ত হইয়াছে। এই শাসনতন্ত্র গঠনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারগ ঠন করাও স্থিরীকৃত হইয়াছে। ক্ষুদ্রই হউক আর বৃহৎই হউক, আমরা সকল শ্রেণীর প্রতি সুবিচার করিতে চেষ্টা করিয়াছি। আমরা মনে করি, ভবিষ্যত ভারত শাসনের কার্যকরী পরিকল্পনা আমাদের এই সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত আছে এবং ইহা দ্বারা ভারতের আত্মরক্ষার সুব্যবস্থা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করা হইয়াছে।
৪। মিশনের সমক্ষে যে রাশীকৃত সাক্ষ্য উপস্থিত করা হইয়াছে তাহার পর্যালোচনা এই বিবৃতির উদ্দেশ্য নহে। এই স্থলে ইহা উল্লেখযোগ্য যে, মোছলেম লীগ সমর্থকগণ ব্যতীত অন্য সকলেই সর্বভারতীয় ঐক্য সমর্থন করিয়াছেন।
৫। ইহা সত্ত্বেও আমরা পক্ষপাতহীন ও নিবিষ্ট মনে ভারত বিভাগের সম্ভাব্যতার কথা চিন্তা করিয়াছি। পাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুগণ চিরকাল তাঁহাদের উপর শাসন চালান, মুছলমানগণের এই ভয় ও ভাবনা আমাদের নিকট বিশেষভাবে উপস্থিত করা হইয়াছে। এই ধারণা মোছলেম জনগণের মনে এত বদ্ধমূলক হইয়াছে যে, কোন রক্ষাকবচ লিপিবদ্ধ করিয়া তাহা দূর করা সম্ভব নহে। ধর্ম, সংস্কৃতি, বৈষয়িক ও অন্যান্য মোছলেম স্বার্থসংশ্লিষ্ট লিপিবদ্ধ বিষয়ের ভার মোছলেম জনগণের হাতে ন্যস্ত করার ব্যবস্থা দ্বারাই ভারতের আভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষা করা যাইতে পারে।
৬। আমরা সর্ব প্রথমেই মোছলেম লীগ উপস্থাপিত সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিষয় চিন্তা করিয়াছি। এই পাকিস্তানের জন্য দুইটা অংশঃ- একটি উত্তর-পশ্চিম, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব লইয়া এবং অপরটি উত্তর-পূর্বে বাংলা ও আসাম লইয়া দাবী করা হইয়াছে।
আবশ্যক মত পরিবর্তনের প্রস্তাব মানিয়া লইতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রথমতঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানগণের নিজেদের শাসনতন্ত্র নির্ধারণের অধিকার ও দ্বিতীয়তঃ সংখ্যালর্ঘিষ্ঠ মোছলেম অধ্যুষিত কোন কোন স্থান শাসন ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য পাকিস্তানের অংশীভূত করার প্রয়োজনীয়তা নীতির উপরেই পৃথক ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী করা হইয়াছিল।
১৯৪১ সালের লোক গণনার সংখ্যানুপাতে উল্লিখিত ছয়টি প্রদেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ অমুছলমানগণের আয়তন সামান্য নহে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল | মুছলমান | অমুছলমান |
পাঞ্জাব | ১,৬২,১৭,২৪২ | ১,২২,০১,৫৭৭ |
উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশ | ২৭,৮৮,৭৯৭ | ২৪,৯২৭ |
সিন্ধু | ৩২,০৮,৩২৫ | ১৩,২৬,৬৮৩ |
বৃটিশ বেলুচিস্তান | ৪,৩৮,৯৩০ | ৬২,৭০১২ |
মোট | ২,২৬,৫৩,২৯৪ | ১,৩৮,৪০,২৩১ |
শতকরা | ৬২.০৭ | ৩৭.৯৩ |
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল | মুছলমান | অমুছলমান |
বাঙ্গালা | ৩,৩০,০৫,৪৩৪ | ২,৭৩,০১,০৯১ |
আসাম | ৩৪,৪২,৪৭৯ | ৬৭,৬২,২৫৪ |
মোট | ৩,৬৪,৪৭,৯১৩ | ৩,৪০,৬৩,৩৪৫ |
শতকরা | ৫১.৬৯ | ৪৮.৩১ |
বৃটিশ ভারতের অন্যত্র প্রায় ২কোটি সংখ্যা-লঘিষ্ঠ মুছলমান ১৮ কোটি ৮ লক্ষ অমুছলমানদের মধ্যে বাস করেন।
এই সংখ্যা হইতে দেখা যাইবে যে, মোছলেম লগের দাবী মত পৃথক ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন দ্বারা সাম্প্রদায়িক সংখ্যা-লঘিষ্ঠতার সমস্যার সমাধান হইবে না। আমরাও পাঞ্জাব, বাঙ্গালা এবং আসামের অমুছলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ জেলাগুলি সার্বভৌম পাকিস্তানের অন্তর্গত করার কোন যৌক্তিকতা দেখি না। পাকিস্তানের পক্ষে যে সকল যুক্তি উপস্থিতিত করা যায়, মোছলেম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিতে পাকিস্তানের বাহিরে রাখার স্বপক্ষেও সেই সমস্ত যুক্তি উপস্থিত করা চলে বলিয়া আমরা মনে করি। এই প্রশ্ন শিখদের অবস্থার উপরে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
৭। কেবলমাত্র মোছলেম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানগুলি লইয়া ক্ষুদ্রতর সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করিয়া কোন মীমাংসায় উপনীত হইতে পারা সম্ভব কিনা তাহাও আমরা চিন্তা করিয়াছি। মোছলেম লীগের মতে এই ধরনের পাকিস্তান সম্পূর্ণ অকার্যকরী হইবে। কারণ (ক) পাঞ্জাবের সমগ্র আম্বালা ও জলন্ধর বিভাগ (খ) শ্রীহট্ট জেলা ব্যতীত সমগ্র আসাম এবং (গ) কলিকাতা নগরী (যেখানে মুছলমান জনসংখ্যা শতকরা ২৩.৬ মাত্র) সমেত সমগ্র পশ্চিম বাঙ্গালা পাকিস্তানের বাহিরে থাকিয়া যাইবে। আমাদেরও দৃঢ় বিশ্বাস যে, পাঞ্জাব ও বাঙ্গালায় এই প্রকার বিভাগ করিয়া কোন মীমাংসা করা তথাকার অধিকাংশ অধিবাসীদের ইচ্ছা ও স্বার্থের পরিপন্থী। বাঙ্গালা ও পাঞ্জাবের নিজস্ব সাধারণ ভাষা, সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বর্তমান। বিশেষতঃ পাঞ্জাবকে বিভক্ত করা হইলে যথেষ্ট সংখ্যক শিখ সীমারেখার উভয় দিকে পড়িয়া যাইবে। অথএব আমরা সিদ্ধান্ত করিতেছি যে, বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধাণ নহে।
৮। উপরোক্ত জোরাল যুক্তি ছাড়া আরও অনেক শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক গুরুতর যুক্তিও বিবেচ্য। ভারতের যানবাহন, ডাক ও তার বিভাগ একীভূত ভারতের ভিত্তিতে স্থাপিত। এই সমস্ত বিভাগ বিচ্ছিন্ন করিলে ভারতের উভয় অংশই গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। ঐক্যবদ্ধ ভারতের রক্ষাব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি আরও প্রবল। ভারতের সামরিক বাহিনীতে সমগ্র ভারতকে রক্ষা করার জন্যই একীভূত করিয়া প্রস্তুত করা হইয়াছে। দ্বিধা বিভক্ত ভারতীয় বাহিনী শুধু তাহার সুপ্রাচীন সুনাম ও সুউচ্চ কর্ম শক্তিই হারাইবে না বরং ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হইবে। ভারতীয় নৌ ও বিমান বহরের কর্মক্ষমতা কমিয়া যাইবে। প্রস্তাবিত পাকিস্তানের উভয় অংশ ভারতের সুভেদ্য সীমারেখায় অবস্থিত। রক্ষা ব্যবস্থার গভীরতায় বিবেচনায় পাকিস্তান ভূখণ্ড অত্যণ্ত অপ্রচুর।
৯। বিভক্ত বৃটিশ ভারতেরস সহিত ভারতীয় রাজন্যবর্গের সম্বন্ধ স্থাপনের গুরুতর অসুবিধার কথাও আমরা বিশেষভাবে বিবেনা করিয়াছি।
১০। সর্বশেষ প্রস্তাবিত পাকিস্তানের ভৌগোলিক সংস্থাপন ও উভয় পাকিস্তানের মধ্যবর্তী ন্যূনাধিক সাত শত মাইল দূরত্বের কথাও বিবেচ্য। উভয়ের মধ্যে সমরকালীন বা শান্তিকালীন যানবাহন ব্যবস্থা হিন্দুস্তানের শুভেচ্ছার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
১১। অতএব বর্তশানে বৃটিশের হস্তে ন্যস্ত ক্ষমতা দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমর্পণ করার পরামর্শ আমরা বৃটিশ গভর্নমেন্টকে দিতে অক্ষম।
১২। এই সিদ্ধান্ত দ্বারা ইহা বুঝায় না যে, আমরা অত্যধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণ নিয়ন্ত্রিত একীভূত ভারতের মুচলমান জনগণের সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন প্লাবিত হইয়া যাইবার সত্যিকার আশঙ্কা ভুলিয়া গিয়াছি। ঈদৃশ আশঙ্কার প্রতিকারার্থে কংগ্রেস এক পরিকল্পনা উপস্থিত করিয়াছেন। এই পরিকল্পনা অনুসারে কেন্দ্রে বৈদেশিক সম্বন্ধ, দেশরক্ষা ও যানবাহন ব্যবস্থাদি যথাসম্ভব কমসংখ্যক বিষয় সংরক্ষিত থাকিবে এবং ইহা ছাড়া প্রদেশগুলিকে সম্পূর্ণ আত্মকর্তৃত্ব দেওয়া হইবে। এই পরিকল্পনানুসারে যদি কোন কোন প্রদেশ বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও শাসন সংক্রান্ত পরিকল্পনায় অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক হন, তাঁহারা উল্লিখিত বাধ্যতামূলক বিষয়সমূহ ছাড়া তাঁহাদের ইচ্ছামত অন্যান্য বিষয়ও কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছাড়িয়া দিতে পারিবেন।
১৩। আমাদের হাতে এই পরিকল্পনা কার্যকরী হইলে বহুবিধ শাসনতান্ত্রিক অসুবিধা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। যাহার ফলে কয়েকজন মন্ত্রী বাধ্যতামূলক বিষয়ের ভার গ্রহণ করিয়া সমগ্র ভারতের নিকট দায়ী থাকিবেন ও অপর কয়েকজন মন্ত্রী ইচ্ছাধীন কেন্দ্রে ন্যস্ত বিষয়ের ভার গ্রহণ করিয়া কেবল মাত্র সেই কয়েকটি প্রদেশের নিকট দায়ী থাকিবেন, এমন একটি শাসন পরিষদ ও ব্যবস্থাপক সভা কার্যকরী করা অত্যন্ত কঠিন। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদে তাঁহাদের প্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নাই এমন বিষয়ে বক্তৃতা করা ও ভোট দান হইতে কোন সভাকে বঞ্চিত করা আবশ্যক হইবে।
এই প্রকার কোন পরিকল্পনা কার্যকরী করার অসুবিধা ছাড়াও আমরা মনে করি যে, যে সমস্ত প্রদেশ কেন্দ্রে কোন ইচ্ছাধীন বিষয় গ্রহণ করেন নাই, তাঁহাদের এই প্রকার উদ্দেশ্যে পৃথকভাবে একত্রীভূত হইবার অধিকার অস্বীকার করা সঙ্গত হইবে না।
১৪। আমাদের প্রস্তাব উপস্থিত করার পূর্বেই আমরা ভারতীয় রাজন্যবর্গ ও বৃটিশ ভারতের সম্পর্ক আলোচনা করিব।
স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বৃটিশ সাধারণতন্ত্রের মধ্যেই হউক বা বাহিরেই হউক, বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা লাভেল পরে ভারতীয় রাজন্যবর্গের সহিত ইংলণ্ডেশ্বরের যে সম্পর্ক এযাবৎকাল বর্তমান আছে, তাহা থাকা সম্ভবপর হইবে না। ইংলণ্ডেশ্বর তখন আর তাঁহার সার্বভৌমত্ব রাখিতেও পারেন না, অথবা নূতন ভারত সরকারের হাতে তাহা ন্যস্তও করিতে পারেন না। দেশীয় রাজ্যের যাঁহাদের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাঁহারাও ইহা সম্পূর্ণ স্বীকার করেন। তাঁহারা আমাদের জানাইয়াছেন যে, ভারতীয় নৃপতিবৃন্দ ভারতের নবজাগরণ ও অগ্রগতির সঙ্গে জড়িত থাকিতে ইচ্ছুক। নূতন শাসনতন্ত্র গঠনের কালেই কিভাবে তাঁহাদের এই শুভেচ্ছা কার্যকরী করা হইবে তাহা সঠিক স্থিরীকৃত হইবে। সমস্ত রাজ্য সম্পর্কে একই ব্যবস্থা করা হইবে তাহা মনে করার কোন কারণ নাই। এই জন্যই পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা বৃটিশ ভারতের প্রদেশসমূহ সম্বন্ধে যেমন বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি, ভারতীয় দেশীয় রাজ্য সম্পর্কে তেমন করি নাই।
১৫। আমাদের মতে যে ব্যবস্থা বিভিন্ন দলের মূল দাবীর পক্ষে ন্যায্যা এবং যে ব্যবস্থা সমগ্র ভারতের স্থায়ী ও কার্যকরী শাসন প্রণালী প্রণয়নের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত, আমরা এখন তাহাই উপস্থিত করিতেছি।
আমরা প্রস্তাব করিতেছি যে, ভারতীয় শাসনব্যবস্থা নিম্নোক্ত মূলনিতর উপর প্রতিষ্ঠিত হউকঃ-
(১) বৃটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহ লইয়া এক ভারতীয় ইউনিয়ন গঠিত হউক। বৈদেশিক সম্পর্ক, দেশরক্ষা ও যানবাহন বিষয়ে সর্বাধিক কর্তৃত্ব এই ইউনিয়নের হস্তে ন্যস্ত থাকিবে ও এ সকল বিষয়ে অর্থ সংগ্রহ করার আবশ্যক কর্তৃত্বও ইহার থাকিবে।
(২) এই ইউনিয়নের বৃটিশ ভারত ও রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি লইয়া গঠিত শাসন ও ব্যবস্থা পরিষদ থাকিবে। ব্যবস্থা পরিষদে কোন গুরুতর সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে তাহা প্রতিনিধি এবং প্রধান দুই সম্প্রদায়ের পৃথক পৃথক ভাবে অধিকাংশ ভোটের দ্বারা স্থিরীকৃত হইবে।
(৩) ইউনিয়নের হস্তে ন্যস্ত বিষয়সমূহ ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকিবে।
(৪) দেশীয় রাজ্যসমূহ ইউনিয়নের হস্তে ন্যস্ত ক্ষমতা ব্যতীত ক্ষমতার অধিকারী রহিবেন।
(৫) প্রদেশসমূহ শাসন ও ব্যবস্থা পরিষদ সম্বন্ধে দলবদ্ধ হইতে পারিবেন এবং এই প্রকার যৌথ প্রদেশসমূহ নিজেদের সাধারণ প্রাদেশিক বিষয় স্থির করিতে পারিবেন।
(৬) ইউনিয়ন ও প্রাদেশিক যৌথ সরকারের শাসন ব্যবস্থায় এই বিধান থাকিবে যে, ব্যবস্থা পরিষদের অধিকাংশ ভোটের দ্বারা প্রথমে দশ বৎসর পরে এবং প্রতি দশ বৎসর অন্তর শাসন ব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা দাবী করিতে পারিবে।
১৬। উপরোক্ত ধারায় কোন বিস্তারিত শাসন প্রণালী লিপিবদ্ধ করা আমাদের ইচ্ছা নহে। আমরা এমন করিতে চাই, যাহাতে ভারতীয়গণই তাঁহাদের নিজেদের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারেন।
১৭। অচিরেই নূতন শাসনতন্ত্র রচনাকারী প্রতিষ্ঠান কার্যকরী করিবার জন্য আমাদের প্রস্তাব উপস্থিত করিতেছি।
১৮। নূতন শাসনতন্ত্র রচনাকারী প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রধানতম সমস্যা ইহাকে সঠিকভাবে সমগ্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব স্থায়ীয় করা। প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটার্ধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন দ্বারা প্রতিনিধি পরিষদ গঠনই সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু ইহাতে নূতন শাসনতন্ত্র রচনায় অনভিপ্রেত বিলম্ব ঘটিবে। অল্পদিন পূর্বে নির্বাচিত ব্যবস্থা পরিষদগুলিকে নির্বাচক হিসাবে ব্যবহার করাই একমাত্র কার্যকরী পন্থা। ব্যবস্থা পরিষদের গঠন প্রণালীর দুইটি ব্যাপার ইহাও একটু শক্ত বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। প্রথমতঃ প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদগুলির সভ্য সংখ্যা সর্বত্র প্রদেশের সমগ্র লোকসংখ্যার অনুপাতে ধার্য্য করা হয় নাই। আসামে এক কোটি অধিবাসীর ব্যবস্থা পরিষদে ১০৮ ন সভ্য আর বাঙ্গালায় লোকসংখ্যা ইহার ছয় গুণ অথচ বাংলার ব্যবস্থা পরিষদের সভ্য সংখ্যা ২৫০। দ্বিতীয়তঃ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়াইয়া দেওয়ায়, কোন কোন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি সংক্যা প্রদেশে তাহাদের জনসংখ্যার অনুপাতে ধরা হয় নাই। বাংলার মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৪৮ কিন্তু লোকসংখ্যায় তাঁহার শতকরা ৫৫। কিভাবে এই অসামঞ্জস্য দূরা করা যায় তাহা আমরা গভীরভাবে চিন্তা করিয়াছি। আমাদের মতে খুব ন্যায্যা ও কার্যকরী উপায় হইতেছেঃ-
(ক) প্রত্যেক প্রদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে বণ্টন করা। প্রতি দশ লক্ষে একজন প্রতিনিধি নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। ইহা প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের কাছাকাছি দাঁড়াইবে।
(খ) প্রাদেশিক আসনগুলি জনসংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে।
(গ) প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নির্বাচিত ব্যবস্থা পরিষদের সভ্যেরা সেই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করিবেন।
আমরা মনে করি, এই উদ্দেশ্য সাধারণ, মোছলেম ও শিখ এই তিন প্রধান সম্প্রদায়ের বিষয় বিবেচনা করিলেই চলে। মোছলেম ও শিখ ছাড়া অন্যান্য সকলেই সাধারণ সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করা হইবে। অন্যান্য ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় জনসংখ্যার অনুপাতে অতি সামান্য প্রতিনিধিত্বই পাইতে পারেন। পরন্তু ইহাতে প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদে তাঁহাদের যে গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছিল, তাহাও নষ্ট হইবার আশঙ্কা আছে। সে জন্য বিংশ অধ্যায়ে সংখ্যালঘিষ্ঠদের বিশেষ বিষয়ে আমরা তাঁহাদের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করিয়াছি।
১৯। (১) আমরা প্রস্তাব করিতেছি যে, প্রত্যেক প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদের সাধারণ, মোছলেম ও শিখ সদস্যরা একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের দ্বারা তাঁহাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিম্নোক্ত সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচন করিবেন।
প্রতিনিধি তালিকা
ক অনুচ্ছেদ
প্রদেশ | সাধারণ | মোছলেম | মোট |
মাদ্রাজ | ৪৫ | ৪ | ৪৯ |
বোম্বাই | ১৯ | ২ | ২১ |
যুক্ত প্রদেশ | ৪৭ | ৮ | ৫৫ |
বিহার | ৩১ | ৫ | ৩৬ |
মধ্য প্রদেশ | ১৬ | ১ | ১৭ |
উড়িষ্যা | ৯ | ০ | ৯ |
মোট | ১৬৭ | ২০ | ১৮৭ |
খ অনুচ্ছেদ
প্রদেশ | সাধারণ | মোছলেম | শিখ | মোট |
পাঞ্জাব | ৮ | ১৬ | ৪ | ২৮ |
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ | ০ | ৩ | ০ | ৩ |
সিন্ধু | ১ | ৩ | ০ | ৪ |
মোট | ৯ | ২২ | ৪ | ৩৫ |
গ অনুচ্ছেদ
প্রদেশ | সাধারণ | মোছলেম | শিখ | মোট |
বাংলা | ২৭ | ৩৩ | ০ | ৬০ |
আসাম | ৭ | ৩ | ০ | ১০ |
মোট | ৩৪ | ৩৬ | ০ | ৭০ |
সর্বমোট বৃটিশ ভারত ২৯২
দেশীয় রাজ্যের সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রতিনিধি ৯৩
মোট ৩৮৫
মন্তব্যঃ
চীফ কমিশনারের প্রদেশের প্রতিনিধি হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদের দিল্লী ও আজমীর মাড়ওয়ারের প্রতিনিধিদ্বয় এবং কূর্গ ব্যবস্থাপক সভা কর্তৃক নির্বাচিত একজন সদস্য ক অনুচ্ছেদে যুক্ত হইবেন। বৃটিশ বেলুচিস্তানের একজন প্রতিনিধি খ অনুচ্ছেদে যুক্ত হইলেন।
(২) গণ-পরিষদের জনসংখ্যানুপাতে অনধিক ৯৩ জন দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধি থাকিবেন। ইহাদের নির্বাচন প্রণালী আলোচনা দ্বারা স্থিরীকৃত হইবে। প্রারম্ভে একটি শালিসী কমিটি দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করিবেন।
(৩) নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ যথাসম্ভব শীঘ্র দিল্লীতে সমবেত হইবেন।
(৪) প্রারম্ভিক সভায় কার্যসূচী স্থির হইবে। সভাপতি ও অন্যান্য কর্মচারী নির্বাচিত হইবেন এবং বিংশ সংখ্যক অনুচ্ছেদে বর্ণিত নাগরিকগণের সংখ্যাল্পদের, উপজাতীয় ও সংরক্ষিত অঞ্চলের অধিকার রক্ষার্থে এক উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হইবে। ইহার পরে প্রতিনিধিগণ পূর্বে ক, খ, গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তিন দলে বিভক্ত হইবেন।
(৫) প্রত্যেক দল তাঁহাদের অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রদেশসমূহের শাসনতন্ত্র রচনা করিবেন। সেই সকল প্রদেশ লইয়া কোন মণ্ডলী প্রতিষ্ঠিত হইবে কিনা এবং হইলে সেই মণ্ডলী কোন কোন বিষয়ের ভার গ্রহণ করিবেন তাহা স্থির করিবেন। নিম্নে আট নম্বর উপধারায় বর্ণিত ব্যবস্থানুসারে কোন প্রদেশ মণ্ডলীর বাহিরে থাকিতেও পারেন।
(৬) প্রতি অনুচ্ছেদের ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিগণ ইউনিয়নের শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পুনরায় সমবেত হইবেন।
(৭) ইউনিয়নের গণ-পরিষদে যদি পনর নম্বর অনুচ্ছেদের ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন অথবা কোন গুরুতর সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, উপস্থিত প্রতিনিধিগণের অধিকাংশের ও দুই প্রধান সম্প্রদায়ের পৃথক পৃথক ভাবে গৃহীত অধিকাংশ দ্বারা তাহা স্থিরীকৃত হইবে। গণ-পরিষদের সভাপতি কোন প্রস্তাবে গুরুতর সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন জড়িত কিনা তাহা স্থির করিবেন এবং যদি দুই প্রধান সম্প্রদায়ের যে কোন এক সম্প্রদায় অধিকাংশ প্রতিনিধি দাবী করেন, তাহা হইলে ফেডারেল কোর্টের পরামর্শ নিয়া তাঁহার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিবেন।
(৮) নতুন শাসনতন্ত্র কার্যকরী হইবার পর যে কোনও প্রদেশ পূর্বে যে দল বা গোষ্ঠীর সহিত তাহাকে সংযুক্ত করা হইয়াছিল তাহা হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারেন। নূতন শাসনতন্ত্রের বিধানমত সাধারণ নির্বাচনের পরেই মাত্র ব্যবস্থা পরিষদ এই সিদ্ধান্ত করিতে পারেন।
২০। নাবিকগণ, সংখ্যাল্প সম্প্রদায় এবং উপজাতীয় ও সংরক্ষিত অঞ্চলের অধিকার সংরক্ষণার্থে যে উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হইবে, তাহাতে সংশ্লিষ্ট স্বার্থবিশিষ্ট সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকিবে। মৌলিক অধিকার, সংখ্যাল্প সম্প্রদায়ের রক্ষা ব্যবস্থা এবং উপজাতীয় ও সংরক্ষিত অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা বিষয়ক প্রস্তাব উপদেষ্টা কমিটি গণ-পরিষদে উপস্থিত করিবেন এবং এই সকল অধিকার কোন প্রাদেশিক গোষ্ঠী অথবা ভারতীয় ইউনিয়নের শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ হইবে তাহাও বলিবেন।
২১। মাননীয় বড়লাট বাহাদুর অবিলম্বে প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদসমূহকে তাহাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করিতে এবং ভারতীয় রাজন্যবর্গকে শালিসী কমিটি গঠন করিতে অনুরোধ করিবেন। আমরা আশা করি বিষয়বস্তুর জটিলতা সত্ত্বেও যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সহিত শাসনতন্ত্র রচনার কার্য্য অগ্রসর হইবে এবং মধ্যবর্তী সময় অতি সংক্ষিপ্তই হইবে।
২২। ভারতীয় ইউনিয়নের গণ-পরিষদ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে সন্ধিপত্র রচতি হওয়া আবশ্যক হইবে।
২৩। শাসনতন্ত্র রচনাকার্য্য চলিতে থাকাকালীন ভারতের শাসনকার্য্য সুষ্ঠুভাবে চলা অত্যাবশ্যক।
প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থিত এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সত্ত্বর প্রতিষ্ঠা করা আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বর্তমান সন্ধিক্ষণে ভারত সরকারের এই গুরুকর্তব্য পালনে সর্বাধিক সহযোগিতা প্রয়োজন। দৈনন্দিন শাসনকার্য্য চালনা ছাড়াও আমাদিগকে দারুণ দুর্ভিক্ষের কবল হইতে দেশবাসীকে রক্ষা করিতে হইবে। মহাযুদ্ধের অবসানে ভারতের পুনর্গঠন পরিকল্পনার সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি প্রেরণ করিতে হইবে। এই সকলের জন্য জনগণের সমর্থনপুষ্ট সরকার আবশ্যক।
মাননীয় রাজ্যপ্রতিনিধি মহোদয় এ বিসয়ে আলোচনা আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি আশা করেন, শীঘ্রই জনগণের আস্থাভাজন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্য হইতে সমর-সদস্য ও অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত ভারতীথয় সদস্য লইয়া এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন। বৃটিশ সরকার ভারত সরকারের এই পরিবর্তনের গুরুত্ব অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন এবং শাসন কার্য্যের দায়িত্ব পালনে শীঘ্র ও সহজে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পূর্ণ করার কার্য্যে পূর্ণ সহযোগিতা করিবেন।
২৪। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের এবং জনসাধারণের এখন পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে এবং তাঁহাদিগের নিকট আমাদের শেষ বক্তব্য এই। আমাদের গভর্ণমেন্ট এবং আমাদের দেশবাসীদের আশা ছিল যে, ভারতবাসীরা যেরূপ নূতন রাষ্ট্রের অধীনে বাস করিতে চায় তাহার গঠন পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁহাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হইবে। কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক দলসমূহের এবং আমাদের পরিশ্রম ও অশেষ ধৈর্য্য ও সদিচ্ছা ইহা সম্ভবপর হয় নাই। আমরা আশা করি যে, সর্ববিধ মত গ্রহণ করিয়া এবং অশেষ বিবেচনা পূর্বক আমরা আপনাদের নিকট এখন যে প্রস্তাব উত্থাপন করিতেছি তাহা অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে এবং অন্তরবিপ্লব ও অন্তরকলহ ব্যতীতই আপনাদের স্বাধীনতা অর্জন করিতে সক্ষম করিবে। আমাদের প্রস্তাব হয়ত আপনাদের সকল দলকে পরিপূর্ণ সুখী করিতে পারিবে না। কিন্তু আমাদের সহিত আপনারাও ইহা উপলব্ধি করিবেন যে, ভারতের ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ মুহুর্তে রাজনীতির দিক হইতে পরস্পর সহযোগিতার একান্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রস্তাব যদি আপনাদের নিকট গ্রহণযোগ্য না হয় তবে অন্য কোন বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনা করিতে আমরা আপনাদের অনুরোধ করিতেছি। ভারতীয় দলসম্যূহের সহিত একযোগে ঐক্যের জন্য চেষ্টা করিয়া আমরা এই মত পোষণ করিতেছি যে, কেবল উক্ত দলসমূহের ঐক্যদ্বারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসার আশা অতি অল্প। সুতরাং মারামারি, অরাজকতা এবং গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। এই শান্তিভঙ্গের ফলাফল এবং স্থিতিকাল অনুমান করা কঠিন, কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, ইহাতে লক্ষ লক্ষ পুরুষ, নারী ও শিশু অত্যন্ত বিপন্ন হইবে। এই অবস্থাকে ভারতীয় জনসাধারণ আমাদের দেশবাসী এবং বিশ্বের জনসাধারণ সমভাবে ঘৃণা করিবে।
সুতরাং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, যে সহযোগিতা এবং সদিচ্ছার ভাব লইয়া আমরা আমাদের প্রস্তাব আপনাদের নিকট উপস্থিত করিতেছি আপনারাও সেই ভাব নিয়াই তাহা গ্রহণ করিবেন এবং কার্য্যকরী করিয়া তুলিবেন। যাহারা ভারতের ভবিষ্যত মঙ্গল কামনা করেন, তাঁহাদের নিকট আমাদের এই নিবেদন যে, তাহারা যেন তাঁহাদের দৃষ্টিভঙ্গী নিজেদের সম্প্রদায় এবং স্বার্থের প্রতি নিবন্ধ না রাখিয়া চল্লিশ কোটি ভারতবাসীর স্বার্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।
আমরা আশা করি, নতুন স্বাধীন-ভারত বৃটিশ সাধারণতন্ত্রের জন্য হওয়াই বাঞ্ছনীয় মনে করিবে। আমরা আশা করি, যে কোন অবস্থায়ই আপনারা আমাদের সহিত নিবিড় বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ থাকিবেন। অবশ্য ইহা আপনাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে। এই বিসয়ে আপনাদের ইচ্ছা যাহাই হউক, বিশ্বের মহান জাতিপুঞ্জের মধ্যে আপনাদের ক্রমবর্ধমান উন্নতি হউক এবং আপনাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হউক, ইহাই আমাদের কাম্য।
[‘ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান’টি চট্টগ্রামের এম, জহুর হোসেন চৌধুরী ও মওলানা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম কর্তৃক অনুদিত ও প্রকাশিত ‘কায়েদে আযমের পত্র ও বক্তৃতাবলী’ থেকে গৃহীত।]
বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ
চট্টগ্রাম-ঢাকা