১১
স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতি
উনিশ শ’ একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙেছে এবং তার ফলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে কিন্তু দ্বি-জাতিতত্ব ধ্বংস হয়নি। এই দ্বি-জাতিতত্ত্ব ধ্বংসের পুরান রাজনীতি নতূন করে শুরু হয়েছে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ ঘিরে। স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর দ্বি-জাতিতত্ত্ব, মুসলিম জাতি-স্বাতন্ত্র ধ্বংসের চেষ্টা চলে। ’৪৭ এর দ্বি-জাতিতত্ত্ব ভিত্তিক স্বাধীনতার চেতনা এবং ’৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনাকে পদদলিত করে ভারতের পোশাকি রাষ্ট্রনীতির দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এর দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপ ও পরিচয় পাল্টানোর চেষ্টা করা হয়। অথচ এর কোন অধিকার ছিল না সংবিধান প্রণেতাদের। সংবিধান প্রণেতারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনগণের ম্যান্ডেট পূরণের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও সংবিধান রচনা করেছিলেন। জনগণ তাদেরকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ম্যান্ডেট দেয়নি কিংবা স্বাধীণতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়, তাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে যুক্তি বা কারণ হিসেবে ৯টি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। যার সারসকথা হলো, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও দেশ শাসনের জন্যে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা দান করেছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগকে অন্যায়ভাবে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। উপরন্তু স্বাধিকারকামী জনগণের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করা হয়েছে এবং গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এই অবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রে বসা এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বীর জনগণ আগ্রসনের মোকাবেলা করে দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে”। এই সব কারণ ও যৌক্তিক ভিত্তি সামনে রেখে জনপ্রতিনিধি হিসেবে ‘জনগণের দেয়া ম্যান্ডেটের সম্মান প্রদর্শনের জন্যে ‘পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে’ ‘পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে’ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাধীনতার লক্ষ্য হিসেবে ঐ ঘোষণায় ‘বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।–[স্বাধীনতার ঘোষণার লক্ষ্যগত এই দিনটি হুবহু ইংরাজী বাক্যটা হলোঃ In order to ensure for the people of Bangladesh, equality, human dignity and social justice. (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫)।] উল্লেখ্য, পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্য-নীতি দুষ্ট কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের এই অধিকারগুলোই ভূ-লুণ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার এই লক্ষ্যগত ঘোষণায় কোথাও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্রের’ কথা বলা হয়নি। আর এমন কথা বলার ম্যান্ডেট ও জনগণের পক্ষ থেকে তাদের দেয়া হয়নি।
বস্তুত বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক যাত্রার শুরুতেই তদানীন্তন সরকার ৪৭-এর দেশবিভাগ ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দু’পায়ে পিষ্ট করলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, অত্যন্ত নগ্ন ও নির্লজ্জভাবে জনগণের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের মূলোচ্ছেদ শুরু হলো। ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’-এর নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে ফেলে নামকরণ করা হলো ‘সলিমুল্লাহ হল’। অনুরূপভাবে ‘জাহাঙ্গির নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ এর নাম থেকে ‘মুসলিম’ এবং কবি নজরুল ইসলাম কলেজ’ থেকে ‘ইসলাম’ শব্দ ঝেটিয়ে বিদায় করা হলো। এইভাবে ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ সূচক সবকিছু মুছে ফেলার প্রচণ্ড এক অভিযান শুরু হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম শিক্ষার আবেদন সূচক কোরআনের আয়াত উৎকীর্ণ ছিল। কোরআনের সে আয়াত তুলে ফেলে মনোগ্রামকে নতুনরূপ দেয়া হলো। আর শাসনতন্ত্রে এমন বিধান রাখা হলো যাতে ‘ইসলাম’ নামের ‘মুসলিম’ নামের কোন রাজনৈতিক দল দেশে গড়ে উঠতে না পারে, কাজ করতে না পারে। তারা যদি পারতো তাহলে মুসলিম জনগণের হৃদয় থেকে তাদের ‘ঈমান’ উপরে ফেলা হতো। কিন্তু তা পারা সম্ভব ছিল না।
মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের মত বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অস্তিত্ব মুছে ফেলারও প্রক্রিয়া জোরে-সোরে চলছিল। ভারতের প্রাচীন ও বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা কোলকাতার ‘দেব সাহিত্য কুটির’ ১৯৭৩ সালে তাদের বিখ্যাত Student Favourite Dictionary’ (A.T. Dev লিখিত)-এর একটি সংশোধিত সংস্করণ বের করে। এই ডিকশনারী ম্যাপসহ বাংলাদেশ-এর পরিচয় পাঠকদের জন্যে তুলে ধরে। যাতে বাংলাদেশকে ভারতের একটা প্রদেশ হিসেবে দেখানো হয়। এতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশ সরকার ডিকশনারীটি বেআইনী এবং এর সকল কপি বাজেয়াপ্ত ঘোষনা করতে বাধ্য হন। এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার একটা গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করে। গেজেট নোটিশের ভাষা খুবই মজার এবং এতে প্রমাণ হয় বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন রাষ্ট্রের মত করে কথা বলতে ভয় পান। গেটে নোটিশটি নিম্নরূপঃ
“No. 1130-sec (111) 15th November, 1973-Wheareas the Govt. is satisfied that the book styled ‘Students’ Favourite Dictionary in English to Bengali edited by Ashu Tosh Dev and Published by S.C. Mazumder, Dev Sahitya Kutir Private Ltd. 21, Jhamapuker Lane, Calcutta and Printed by N.C. Mazumder at B.P.M’s Printing Press (revised and Idnlarged edition, January, 1973) contain matter which tend to influence a section of the citizens of Bangladesh in a manner likely the Prejudicial to safety of Bangladesh which tend to advocate the curtailment or abolition of the Soverignty of Bangladesh. Now therefore the govt. is pleased to declare all copies of the book aforesaid to be forfeted to govt.
এই গেজেট নোটিশে, এ, টি, দেব-এর ডিকশনারী ম্যাপ বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষকে প্রভাবিত করবে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ এ বিষয়টি আহত ও বিক্ষুব্ধ করার কথা প্রতিটি বাংলাদেশীকে এবং বাংলাদেশ সরকারকেও। কিন্তু গেজেট নোটিশে বাংলাদেশ সরকার সেই ভাষায় কথা বলেননি। অথবা বলতে সাহস পাননি। বলেননি এটাই বোধ হয় সত্য। কারণ জাতির স্বাতন্ত্র যার কাছে বড় নয়, তার কাছে জাতীয় রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র বড় হবে কেমন করে? মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র মুছে ফেলার ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও অগ্রণী হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সরকার। ভারতে এখনও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারেনি। কেটে দেয়া হয়েছে এর নামের ‘মুসলিম’ শব্দ।
এ, টি, দেব-এর ডিকশনারীর মতই আরেকটা কাজ করল কোলকাতার দৈনি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। ১৯৭৪ সালের ১৮ই মে তারিখের ‘সম্পাদকীয়’ India and Bangladesh শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে The Chief Minister of Bangladesh’ বলে অভিহিত করা হয়। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ভারত রাষ্ট্রের প্রাদেশিক প্রশাসনিক প্রধানকে ‘চীফ মিনিস্টার’ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ অমৃতবাজার পত্রিকা বাংলাদেশকে ভারতের একটা প্রদেশ মনে করেন।
লক্ষণীয়, দেব সাহিত্য কুটির কিংবা অমৃতবাজার পত্রিকা কেউ তাদের জঘন্যকাজের জন্য মাফ চাওয়া তো দূরে থাক সামান্য দুঃখ প্রকাশও করেনি। এর অর্থ তারা ভুল করেছে বলে মনে করেনা।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সরকারের রাজনীতি ছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত, ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক। এই রাজনীতি অর্থনৈতিকভাবেও দেশকে দেউলিয়ায় পরিণত করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশ থেকে যে সম্পদ লুট করেছিল তার পরিমাণ তখনকার বাজার মূল্য অনুসারে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।–[মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘হক কথা’য় উল্লিখিত ভারত কর্তৃক লুণ্ঠিত দ্রব্যের মূল্যমান অনুযায়ী।] এই সাথে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল ভারতীয় পণ্যের বাজার। এর সাথে সকল নীতি-নৈতিকতার বাধনমুক্ত শাসক মহল ও শাসকদল নিমজ্জিত হয়েছিল সীমাহীন দুর্নীতি ও দুরাচারমূলক কাজে।–[স্বয়ং শেখ মুজিব বলেছিলেন তারঁ চারদিকে রয়েছে চাটার দল।] ক্ষমতাসীন সরকারের এই রাজনীতি দেশের মানুষকে ডুবিয়ে দিয়েছিল দুর্ভাগ্যেল অতল তলে। ফলে ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে পরিচিত শেখ মুজিব পরিণত হলেন সবচেয়ে ‘অবাঞ্ছিত’ মানুষে। লণ্ডনের সানডে টাইমস-এর অন্থনী মাসকারেন-হাস লিখেন, “১৯৭২ সালে নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান বীরের সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন। তিনি তখন সাড়ে সাতকোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। গত সপ্তাহে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছেন। দু’টি ঘটনার মাঝখানের ক’বছরে তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মোহ কেটে গেছে এবং সোনার বাংলার স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে। —মুজিবের ট্রাডেজী এই যে, চার বছরেরও কম সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর উচ্চ মর্যাদা দুশমনে পরিণত হলেন”।–[এন্থনী মাসকারেন-হাস, সানডে টাইমস, ১৭ই আগস্ট, ১৯৭৫।]
শেখ মুজিবের পতনের মাত্র কিছুকাল আগে উপমহাদেশে একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটেযা বাংলাদেশের মানুষকে আতংকিত করে তোলে। সে ঘটনা হলো ভারত কর্তৃক সিকিম দখল। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে ভারত সিকিম দখল করে নেয়। সে সময় বাংলাদেশে উপস্থিত একজন বিদেশী সাংবাদিক এ বিষয়ে বাংলাদেশেল প্রতিক্রিয়ার চিত্র এঁকেছেন এইভাবেঃ “সিকিমের ঘটনার খবর বাংলাদেশের রাজধানীতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং ভারতীয় হাইকমিশনেরসামনে বিক্ষোভ মিধিছলের মাধ্যমে ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদের’ তীব্র প্রতিবাদ করে। —-বাংলাদেশের অধ্যাপকরা এক প্রতিবাদপত্রে লিখলেন, “সিকিমকে ভারতের অংগরাজ্যে পরিণত করার আইনকে আমরা সিকিমের সার্বভৌমত্বের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করি। এ ধরনের সম্প্রসারণ নীতি ভারতের প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির প্রতি এক মারাত্মক হুমকি।…..” বাঙ্গালীরা সিকিমের কোন গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু তাদের ভয় সিকিমের ভাগ্যে যা ঘটেছে বাংলাদেশের ভাগ্যেও মোটের উপর তাই রয়েছে’, বললেন পশ্চিম দেশীয় একজন কূটনীতিবিদ। অপর একজন বললেন, ১৯৭১ সালে যখন নয়াদিল্লী বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন থেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গেছে।
সেদিন খুব দূরে নয় যখন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে ভারত মুখ হাঁ করে এগিয়ে আসবে এবং যখন মুখ বন্ধ করবে তখন বাংলাদেশ ভারতের পেটের ভেতরে।–
বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের বত্রিশ বছর বয়স্ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বললেন, সিকিমে যেমন করেছে তেমনি বাংলাদেশেও ভারত আভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে এবং সেই সমস্যার অজুহাতে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে পারে”।–[হিউস্টন গোস্ট’, হিউস্টন, টেক্সাস, ৩রা নভেম্বর, ১৯৭৪ (উদ্ধৃতঃ ‘বাংলাদেশ ট্রাজেডীঃ বিদেশী সাংবাদিকেরদৃষ্টিতে’, নিশান পাবলিকেশনস, হ্যামভিল রোড, লণ্ডন, মার্চ ১৯৭৭)।]
বিদেশী কূটনীতিক ও বাংলাদেশী জনগণের এ আশংকা যে খুবই বাস্তব তার ইংগিত ভারতীয় পত্রিকাও তখন দিয়েছিল। ভারতীয় একটি পত্রিকা তখন একটা কার্টূন ছেপেছিল যা ছিল খুবই দুশ্চিন্তার। কার্টুনটিতে দেখানো হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিকিমকে ট্রলিতে চড়িয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন, আর অদূরে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের নেতৃবৃন্দ বাচ্চাদের মত ন্যাপকিন গায়ে জড়িয়ে ‘মাসী’কে পরের বার তাদেরকে ট্রলিতে তুলে নিতে অনুরোধ করছেন।–[হিউস্টন গোস্ট’, হিউস্টন, টেক্সাস, ৩রা নভেম্বর, ১৯৭৪ (উদ্ধৃতঃ ‘বাংলাদেশ ট্রাজেডীঃ বিদেশী সাংবাদিকেরদৃষ্টিতে’, নিশান পাবলিকেশনস, হ্যামভিল রোড, লণ্ডন, মার্চ ১৯৭৭)।]
ভারতীয় পত্রিকার এই রসসৃষ্টি এবং প্রতিবেশীদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি এই বিদ্রুপবাণ ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশীর চাইতে বাংলাদেশকেই বেশী আহত ও আতংকগ্রস্ত করেছিল। ভারতষেঘা বলে পরিচিত শেখ মুজিব ও শেখ মুজিবের সরকারকেও বাংলাদেশের মানুষ তখন আতংকের চোখে দেখছিল। তাই ‘মাসী’ ইন্দিরা গান্ধী’র ট্রলি ‘পরের বার’ফিরে আসার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যখন শেখ মুজিব নিহত হলেন এবং তার সরকারের পতন ঘটল, তখন বাংলাদেশের মানুষ কোন দুঃখ নয়, প্রবল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রবাদী ও ভারতঘেরা রাজনীতি ও শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটল। ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব তার পরিবারবর্গসহ মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার একদিন পর একজন বিদেশী সাংবাদিক লিখেছিলেনঃ “তাঁর (মুজিবের) বিপর্যয়ের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রধানতঃ তিনটি উপকরণ মিশে আছে। প্রথমতঃ সামরিক বাহিনীর প্রধান হওয়া সত্ত্বেও মুজিব সেনাবাহিনীকে অবিশ্বাস ও অবজ্ঞা করতেন।——সামরিক অফিসারদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার কোন সুযোগ তিনি ছাড়তেন না। স্পষ্টতই তাদের উপর তিনি গোয়েন্দাগিরী চালাতেন। —মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে অনুগত উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত, সুসজ্জিত, ইউনিফরমধারী রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রেশস্ত্রে, বেতনে-ভাতায়, ব্যয়ে-বরাদ্দে সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়া হতো। উভয়ের স্বার্থের অনেক সংঘাতেই মুজিব অন্ধভাবে রক্ষীবাহিনীকে সমর্থন করতেন। —মুজিবের পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশ শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবনয়ন অনিশ্চয়তা সূচক প্রমাণিত হয়েছে। ‘এক হাজার মসজিদের ‘শহর’ বলে ঢাকা বরাবরই গর্ব করেছে এবং বাঙালীরা ঐতিহ্যগতভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়ে বেশী ধর্মানুরাগী। অপরদিকে বাঙ্গালী মুসলমানরা উপমহাদেশে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা অবিচলিতভাবে সমর্থন করেছিলেন বলেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। এই পশ্চাদভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারাতি জনসমর্থন লাভ করেছেন। গত শুক্রবার জুমা’র নামাজের জন্য কারফিউ উঠিয়ে দিলে মসজিদে এই জনসমর্থন অভিব্যক্ত হয়েছে”।–[এন্থনী মাসকারেন-হাস, সানডে টাইমস, লণ্ডন, ১৭ই আগস্ট, ১৯৭৫।] শাসনতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষমুখী পরিবর্তন শেখ মুজিবের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়, আরওঅনেক বিদেশী পর্যবেক্ষণ একথা বলেছেন। শেখ মুজিব নিহত হবার পরপরই লণ্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ লিখেঃ “বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হলো শহরের বাসিন্দা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের সমর্থনই মুজিবকে নেতা বানিয়েছিল, ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু শাসনতন্ত্র সংশাধনের ফলে মুজিব তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন এবং সেদিন থেকেই নিজেকে অতীতের পাতায় তুলে দিয়ে ছিলেন”।–[অমিত রায়, সানডে টেলিগ্রাফ, ১৭ই আগস্ট, ১৯৭৫।]
“১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার পর থেকে ১২ হাজার মিলিয়ন পাউন্ড বিদেশী সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতির অবক্ষয় কমেনি। কালোবাজারী ও মুনাফাখোরদের অনেকেই আওয়ামী লীগের চাঁই। —-শেখ মুজিবের সাম্প্রতিক রাজনীতি মধ্যবিত্তশ্রেণী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল। মুজিবের মৃত্যুর নির্মম পরিহাস যে, পাকিস্তানীরা তাকে হত্যা করেনি, তাঁর দেশবাসীরাই তাকে হত্যা করেছে। এতে বুঝতে পারা যায় যে, কত দ্রুত বাংলাদেশ আশার উচ্চ শিখর থেকে হতাশা ও নৈরাজ্যের অতল গহ্বরে নেমে এসেছিল। —তাছাড়া আদর্শগত প্রশ্নও ছিল। —–আওয়ামী লীগের নতুন শাসকরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করেছেন”।–[গার্ডিয়ান, লণ্ডন, ১৬ই আগস্ট, ১৯৭৫।]
আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের রাজনীতি আবার স্বাধীন ও জাতীয় চেতনায় ফিরে এল। শাসনতন্ত্রের মৌল ভিত্তির আসন থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বিদায় করা হলো এবং তার জায়গায় প্রতিস্থাপনন করা হলো সংবিধানের শীর্ষে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। ধর্মীয় নামে অর্থাৎ ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ পরিচয় সম্বলিত রাজনৈতিক সংগঠত গড়ার উপর যে বিধি-নিষেধ শাসনতন্ত্রে ছিল, তার বিলোপ সাধন করা হলো। এছাড়া শাসনতন্ত্রে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার যে বিধান ছিল, তারও উচ্ছেদ সাধন হয়ে গেল।
এই শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ফলে জাতি অসহীয় ও অশরীরি এক বন্দীদশার হাত থেকে মুক্তি পেল, অনুভব করল স্বাধীনতার স্বাদ। সংবাদপত্র থেকে রাজনীতি, শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই একটা শাস্তি ও স্বস্তির পরিবেশ ফিরে এল। বিলোপ ঘোষিত সংবাদপত্রগুলো আত্মপ্রকাশ করলো, রাজনৈতিক দলগুলো সাড়ে তিন বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করল। প্রকাশ্যে কাজ শুরু করতে পারল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিমলীগ, ইত্যাদিসহ ইসলাম ও মুসলিম নাম-পরিচয় সম্বলিত রাজনৈতিক দল।
এইভাবে ১৯০৬ সালে উপমহাদেশে যে মুসলিম রাজনীতির নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল, যে রাজনীতির দান মুসলিম আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখণ্ড, সেই রাজনীতি আবার ফিরে এল বাংলাদেশে। অন্যকথায় বাংলাদেশ ফিরে এল তার স্বরূপে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিপ্লবের ঘোষণাকালে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘোষণাকে পরে রক্ষা করা হয়ণি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দল দুটি দেশ শাসন করেছে। এ দু’টি দল ধর্মনিরপেক্ষ নয়, শাসনতন্ত্রের মতই এ দু’টি দর ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ রাখে এবং ইসলামী মূল্যবোধ অনুসরণের কথা বলে, তবু বাংলাদেশ ইসলামী রিপাবলিক হয়নি কিংবা সরকারের আইন ও আচরণের উৎস কোরআন এবং সুন্নাহকে গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্য জাতীয় পার্টির শাসনামলে শাসনতন্ত্র সংশোধন করে ‘ইসলাম’কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে।
ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার ফলে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নীতিগতভাবে ইসলাম ভিত্তিক হয়েছে। কিন্তু কার্যত বাংলাদেশ এখনও ইসলামী রাষ্ট্র হয়নি এবং বাংলাদেশের রাজনীতিও ইসলাম ভিত্তিক হয়নি। বাংলাদেশে বর্তমানে চার ধরনের রাজনীতি আছে। এবং তা হলোঃ ধর্মীয় জীবন বিদান বিরোধী রাজনীতি, ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি, ধর্ম পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ধর্মীয় জীবন বিধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবেক কম্যুনিষ্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ। ধর্মীয় নীতি-আদর্শ ও বিধি-বিধান দ্বারা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি পরিচারিত হোক, তা এরা চাচ্ছে না। ধর্ম নিরপেক্ষ দল হলো আওয়ামী লীগ। এই দল ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপপেক্ষ, কিন্তু কার্যত নীতি ও আচরণের দিক দিয়ে ধর্মীয় জীবন বিধান বিরোধী দলগুলোর সাথে এর কোন পার্থক্য নেই। ধর্ম-পরিচয় ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো হলো বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। মুসলিম লীগকেও এই দলেই ফেলা যায়। এই দলগুলো ইসলামের কথা বলে, ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলে, ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলে এবং ধর্মাচরণমূলক কাজও অনকে করে, কিন্তু ইসলামী নীতি-নিয়ম ও বিধি-বিধান দ্বারা রাষ্ট্র ও সমাজের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালিত হোক এবং সকল আইনের উৎস হোক কোরআন ও সুন্নাহ, এ বিষয়টি তারা এড়িয়ে চলে। এক্ষেত্রে তাদের আচরণ ঠিক ধর্মনিরপেক্ষদের মতই। ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলামী পার্টি, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, প্রভৃতি। এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীই প্রধান এবং ৭৫ উত্তর সবগুলো সংসদেই তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয়। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর নাম হয় জামায়াতে ইসলামী। এখন বাংলাদেশে এর নাম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল চার শ্রেণীর হলেও রাজনৈতিক ধারা মূলত দুইটি। এর একটি হলো ইসলামী জীবন বিধান ও স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসত্তা বিরোধী ধারা, অন্যটি ইসলাম ও স্বতন্ত্র মুসলিজ জাতিসত্তা ভিত্তিক ধারা। প্রথম ধারাটির আদর্শিক নেতৃত্ব দিচ্ছে সাবেক বাম ও সমাজতন্ত্রী দলগুলো। এই ধারাকে সহায়তা দিচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ এবং এই ধারার রাজনীতির যা পুরস্কার তা ষোল আনাই আওয়ামী লীগ ভোগ করছে। ১৫ দলীয় জোট, ৮ দলীয় জোট, নির্বাচনী জোট, ইত্যাদির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এই রাজনীতির ফর কব্জা করে আসছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাদের ক্ষমতায় যাওয়া অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু এই রাজনীতিকে সহায়তা দান করে আসছে এবং এই রাজনীতির সুফল তারাই ভোগ করছে। প্রথম ধারার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের যে ভূমিকা, দ্বিতীয় ধারার রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না ঐ জনগণের ভয়ে, জনগণকে সাথে রাখা গরজে। এ থেকে এ সত্যটি আবারও বেরিয়ে আসছে যে, এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং রাষ্ট্র, সংবিধান ও রাজনীতির সাথে ধর্মের বিচ্ছিন্নতা তারা পছন্দ করেনা। রাজনীতির এই মেরুকরণ থেকে আরও একটা সত্য এখানে বেরিয়ে পড়ে। তা হলো, জামায়াতে ইসলামী স্বতন্ত্র মুসলিম জাতি সত্তা ভিত্তিক ইসলামী রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্বদানকারী হিসেবে এদেশের ধর্মভীরু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ-অনুভূতির সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব করছে। এ সত্যটি অবশ্য এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে স্পষ্ট নয়, জামায়াতে ইসলামী তার এ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হলেও সে যা জনগণকে এখনও তা সে বুঝাতে পারেনি। নির্বাচনগুলোকে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোটই এর প্রমাণ। রাজনীতির এই মেরুকরণ থেকে আরও একটা সত্য বেরিয়ে আসে, সেটা হলো, প্রথম ধারা ও দ্বিতীয় ধারার রাজনীতির সংঘাতে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে কোন ঐক্য নেই। জামায়াত, বিএনপি, মুসলিম লীগ, নেজামে পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, প্রভৃতি দলের মধ্যে অনৈক্য, অসহযোগীতাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। অন্যদিকে প্রথম ধারার রাজনীতি তার পক্ষের সকলের ছাড়াও মাঝে মধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিরও সহযোগীতা, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে লাভ করে থাকে। প্রথম ধারার রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির পূর্বাপর রাজনীতির প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই এ বিষয়টি পরিস্কার বোঝা যাবে। প্রথম ধারার রাজনীতি দেশের বাইরে থেকেও বড় ধরনের সহযোগীতা পাচ্ছে। অথবা বলা যায় প্রথম ধারার সাম্প্রতিক রাজনীতি বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিরোধী বাইরের রাজনীতির একটা অংশ মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর বিশেষ করে পঁচাত্তর-উত্তর রাজনীতিতে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
স্বাধীনতার পর পঁচাত্তরের বিপ্লব-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল ভারতের প্রভাবাধীন। স্বেচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক শেখ মুজিবের সরকারকে এটা মেনে নিতে হয়েছিল।–[শেখ মুজিব সরকারের ভারতমুখিতা সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর উক্তিঃ “পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মুক্তি আমাদের আসে নাই, কেননা আগেকার প্রাদেশিক গভর্ণর ও মন্ত্রীদের চাইতে অধিকতর নগ্নভাবে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা নয়াদিল্লীতে সপ্তায় সপ্তায় গমন করেন, সেখান হইতে যে নির্দেশ দেওয়া হয়, ভারতীয় কিসিঞ্জার বাংলাদেশের অসরকারী প্রধানমন্ত্রী ডিপি ধর (হালে ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত হাত পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ বাবুরা) আসিয়া যে নির্দেশ দিয়া যান, ঠিক সেভাবই দেশ চালানোর এস্তেমাল হইতেছে। বাংলাদেশের বাৎসরিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দিল্লীর অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যায় না, বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার নাম করিয়া অর্থমন্ত্রী নয়াদিল্লীর প্রভুদিগকে উন্নয়ন পরিকল্পনার খসড়া দেখাইয়া আনেন। সবচাইতে লজ্জার ব্যাপার হইল, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জনগণেল পবিত্রতম সনদ শাসনতন্ত্রটিও খসড়া হইবার পর জনগণের কাছে প্রকাশের আগে দিল্লী পাঠানো হইয়াছে। জুন মাসে (১৯৭২) আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন শাসনতন্ত্রের খসড়া বগলদাবা করিয়া বিলাতে যাইবার নাম করিয়া দিল্লীর প্রভুদের খেদমতে হাজির হইয়াছেন। মৎস বিভাগ এমনকি সমবায়ের মত অনুল্লেখযোগ্য দপ্তরের মন্ত্রীরাও এদেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লইবার আগে নয়াদিল্লী কোলকাতা বোম্বাই দৌড়াইয়া ভারতীয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নির্দেশ ও ফরমায়েশ লইয়া আসেন”। (আওয়ামী লীগের কথা ও কাজ ওয়াদাভঙ্গের এক নজির’, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানীর এই বক্তব্যটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত ১৯৭২ সালে জুলাই মাসে। জনৈক ‘মোহাম্মদ হোসেন’-এর ব্যবস্থাপনায় ও তত্ত্বাবধানে পুস্তিকাটি ‘শান্তি প্রেস’ থেকে ছাপা হয়) এর অংশ বিশেষ প্রকাশিত হয় দৈনিক মিল্লাতের ১৫ই আগস্ট ৯১-এর বিশেষ ক্রোড়পত্রে।] অন্যদিকে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অধীনস্থ একটা প্রদেশের বেশী মর্যাদা দেয়া হতো না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের বিপ্লবের পর ভারতীয় এই প্রভুত্বের অবলুপ্তি ঘটে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীন হয় এবং স্বরূপে ফিরে আসে। এই অবস্থায় ভারতের স্বার্থবাদী মহল ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জাতি-সত্তা বিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক তৎপরতায় নানাভাবে ব্রতি হয়।
ভারতের এই তৎপরতা সম্পর্কে কিছু বলার আগে ভারতের ঐ মহলটির বর্তশান রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন। ইতিহাস সাক্ষী, ভারতীয় হিন্দু রাজনীতির ব্রাহ্মনবাদী স্বার্থপরতা ও একগুয়েমীর কারণেই ভারত বিভক্ত হয়। স্বাধীনতার পর ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করে। কিন্তু ভারতে কোন সময়ই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না এবং এখনও নেই। এর কারণ ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর উৎকট সাম্প্রদায়িক আচরণ। স্বাধীনতার পর সে আচরণ আকারে এবং প্রকারে বেড়ে যায়। স্বাধীনতার আগে হিন্দুমহাসভা ও আর এমএস-এর মত যে দলগুলোকে লাঠি হিসেবে ব্যবহার করেছে মুসলমানদের মাথা ভাঙ্গার জন্যে, স্বাধীনতার পর এই দলগুলো আর লাঠি থাকে না, স্বাধীন হয় এবং সংখ্যাতেও বেড়ে যায়। তার সাথে সাথে বর্ধিত হতে থাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী জাগরণ। ভারতীয় রাজনীতির শক্তিকেন্দ্র উত্তর ভারত তথা হিন্দী বেল্ট এই জাগরণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। অযোধ্যার বাবরী মসজিদ নিয়ে তারা গণ্ডগোল বাধায় স্বাধীনতার পরপরই। অবস্থা তখন এমন দাঁড়িয়েছিল যে নেহেরু পর্যণ্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “সাম্প্রদায়িক দিক দিয়ে যুক্তপ্রদেশের অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যুক্ত প্রদেশকে এখন আমার কাছে অচেনা মনে হয়। অযোধ্যার মসজিদ ও ফায়জাবাদের হেটেল নিয়ে যা ঘটল তা খুবই খারাপ। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, আমাদের নিজেদের লোকেরাই একে সমর্থন করছে এবং তারা এটা করতেই থাকে”।–[Nehru to Pant, April 17, 1950, Nehru papers.] মিঃ নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একথাগুলো বলেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রতিবিধানের জন্যে কিছুই করেননি। ভারতীয় একজন সমীক্ষকের ভাষায়, “No action followed and indeed the multifold and intensifying consequences of official impassity and weekness on ayodhoya are with us still”.-[‘Introduction’ chap, Anatomy of a Confrontation, Survepalli Gopal, page 16] অর্থাৎ প্রতিবিধান কিছুই করা হয়নি এবং সেই দুর্বলতা ও স্থবিরতা বহুমুখী ও বর্ধনশীল প্রতিফলন এখনও আমরা অযোধ্যায় ভোগ করছি’। এই ব্যর্থতার স্বীকৃতি নেহেরুর কাছ থেকেও পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায় ‘সত্য এই যে, অনেক অহংকার সত্ত্বেও আমরা আমাদের নিজেদেরকে পশ্চাৎমুখী প্রমাণ করেছি।–[Nehru to Pant, April 17, 1950, Nehru papers. (উদ্ধৃত, ঐ).] এই ব্যর্থতার স্বাক্ষ্য অনেকেই দিয়েছেন। যেমন Stateman লিখছে, “১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর নেহেরু-গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস তাদের ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কিছুই করেনি”।–[‘Congress Legacy’, Samaresh Roy, The Stateman, April 2, 1993; ‘Hindu Politics’, Satyabrata Rai Caudhury, Statesman, March 19, 1993.] অনেকে গান্ধীর জন্যে হা-হুতাশ করেন। তাদের কথা শুনলে মনে হয় স্বাধীনতার পরপরই গান্ধী নিহত না হলে তিনি ভারতকে সব ধর্মের স্বর্গ বানাতেন। তাদের একথা ঠিক নয়। ভারতে গান্ধী মিষ্টার নয়, মহাত্মা। ভারতে তার ভাবমূর্তি রাজনীতিকের নয়, বরং তিনি সেখানে গুরুজী, ধর্মনেতা। এই ভাবমূর্তি তিনি সৃষ্টি করেছিলেন স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতী, বাল গঙ্গাধর তিলকদের মতই ভারতের হিন্দু ‘জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং কংগ্রেসের পেছনে তাদের সমবেত করার জন্যে। আজ ‘রাম’কে নিয়ে ভারতে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে তার আধুনিক সূত্রপাত ঘটিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী নিজে। সমরেশ রায় তার এক নিবন্ধে বলছেন, “গান্ধীর প্রার্থনা সভাগুলো এবং রামের স্তুতিবাচক তার গানের আসর তাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদীতে পরিণত করে। তার এ পদ্ধতি কংগ্রেসকে ভারতে গণভিত্তি রচনায় সাহায্য করে যা তার ছিলনা এবং গান্ধীও পরিনত হন জননেতায়”।–[সমরেশ রায়ের ‘Congress Lagacy’ শীর্ষক এই লিখাটি স্টেটসম্যান এ ছাপা হয় ২রা এপ্রিল ’৯৩ তারিখে। ১৯শে এপ্রিল তারিখে স্টেটসম্যান-এ উক্ত প্রবন্ধের উপর একটা চিঠি ছাপা হয়। চিঠির লেখক সমরেশ রায়ের প্রবন্ধের সাথে কিছু কথা যোগ করেন। ‘Gandhi’s Hindu Hindi Dream’ শীর্ষক চিঠিটি এইঃ
Sit –To supplement Samaresh Roy’s article ‘Congress Lagacy (April 2-3), Mahatma Gandhi was the first leader to find out that the Hindi belt was India’s political never centre. He also know that the Hindu belt could not be consolidated without invoking Hindu sentiments. Gandhi revealed his true colours after the 1937 elections. Cliques were organized in different provinces to prevent non-Hindu and non-Hindi speaking leaders from reaching the top of the provincial Governments which were to be set up. In Bihar Dr. Sri Krishna Singh was made Premier (no provision for chief ministers then) overriding the legitimate claims of a Muslim leader. By all known rules of the game. Veer Nariman should have been Premier of Bombay Presidency. But that was not to be. The Process of selecting a leader was manipulated by Patel in such a manner that B.G Kher was made Premies, Nariman was both a non-Hindu and non-Hindi speaking, but Kher was at least a non-Hindu. The Central Province and Berar had its capital at Nagpur where Marathi-speaking leaders dominated. So in keeping with Ghandhi’s ‘Hindu-Hindi’ model Pandit Ravi Shankar Shukla was installed.
Ghandhi’s ‘Hind-Hindi’ obsession had alienated not only Muslims but also the parsis ‘After the 1937 experience, they ceased to take any active interest in Idian Politics. For the same reason Gandhi promoted Nehru over the head of patel who was a stroger state-man but not a ‘yes’ man.
After subhash Bose’s victory. Gandhi said “Pattabhi Sitaramaya’s defeat is my defeat”. But he did not mean what he said, He climinated a South India by a Bengali who was subcquently replaced by a Hidi-Speaking Hindu president. His apologists may say that patel was the brains behind these mahinations. But he could not have done anything without Gandhi’s approval Ironically it is not the Congress but the BJP that will now stive to realize Gandhi’s Hindi-Hindu Dream. –Yours, etc, B.C. GUPTA, Calcutta, April 4.] কংগ্রেস বরাবর এই নীতিই অনুসরণ করে এসেছে এবং স্বাধীনতা-পূর্ব কালের মতই হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস এর মত দলগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে, পালন করেছে এবং সামনে এগিয়ে দিয়েছে। বরাবরের এই নীতি ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিকে শক্তি ও মর্যাদা দান করেছে এবং শিক্ষিত তরুণ ও যুবকদেরও এর প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সত্যব্রত রায় চৌধুরীর ভাষায়, “সামাজিক বিকাশ গণ হিন্দুবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানকে সাহায্য করেছে। জনতা সরকার ক্ষমতায় (১৯৭৭-৭৯) আসার আগের বছরগুলোতে এবং ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার সময় হিন্দুবাদী রাজনীতির ভিত্তি ছিল উত্তর ভারত ও মহারাষ্ট্রের শিক্ষিত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদিতায় লালিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। কিন্তু ভারতে সত্তরের দশক থেকেই স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগের পর সৃষ্ট গ্রাম ও শহর উভয় এলাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত নতুন প্রজন্ম হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। সামাজিক উদ্ধুদ্ধকরণ সেখানে এমন একটা সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যাতে এই নতুন প্রজন্ম হিন্দুবাদের অনুসরণ এবং একে সহযোগিতাদানকে মর্যাদা ও অস্তিত্বের স্মারক বলে মনে করছে”।–[Hindu Politics Satyabrata Rai Chaudhury, Statesman, March 19, 1993] এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে আর্য সমাজ ও হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরী বিশ্বহিন্দু পরিষদ, শিবসেনা, বজরং দল, আরএসএস, প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং এদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রবল প্রতাপ নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে আবির্ভূত হলো। সুকুমার ভট্টাচার্যের ভাষায়, “১৯২০ সালে ‘হিন্দু মহাসভা’র গঠনে যার সূত্রপাত, ৬ ডিসেম্বর বাবরী মসজিদ ধ্বংসে ১৯৯২-এ তার ক্রান্তিকাল। শাখায় পল্লবে বিস্তারিত হয়ে ‘জনসংঘ’, ভারতীয় জনতা পার্টি, ‘বজরং দল’, শিবসেনা’, ‘আমরা বাঙালী’, ‘সন্তানদল’, ইত্যাদি নামে ও আকারে একটি বীভৎস দানবিকতা বিকট রক্তাক্ত নখদন্ত মেলে আজ ভারতবর্ষের মানসিকতাকে গ্রাস করতে উদ্যত। —–কথায় ও লেখায় প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে মুসলমানরা বহিরাগত, ভারতবর্ষে নেহাৎই যদি তারা থাকতে চান তো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ও অভারতীয় সঙ্গ বহন করে চলতে হবে। —–হিন্দুই একমাত্র খাঁটি ভারতীয়। বছর দশেক আগে প্রথম বিশ্ব-হিন্দু পরিষদের যে বিরাট সমাবেশ হয় দিল্লীতে, তখন চার পাঁচ হাত লম্বা অক্ষরে দিল্লীর ইতস্ততঃ বিরাট দেওয়াল জোড়া বিজ্ঞপ্তি (ইংরেজীতে) দেখা যায়ঃ সকল অহিন্দুই অভারতীয়”।–[‘ভারত বর্ষে আগন্তুক মুসলমান’, সুকুমার ভট্টাচার্য, একালের রক্তকবরী, শারদসংখ্যা, কোলকাতা ১৪০০ সাল।] সম্প্রতি শিবসেনা নেতা এর চেয়েও বড় কথা বলেছেন। মুসলমানরা ভারতবর্ষ না ছাড়লে লাথি মেরে তারা মুসলমানদের ভারতছাড়া করবেন। বাবরী মসজিদ ধ্বংস এবং ভারতের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার ভাষা এটাই।
হিন্দুবাদের এই রূপকে অনেকেই হিন্দু মৌলবাদ বলে অভিহিত করছেন। এবং একে মুসলিম মৌলবাদের সাথে সমার্থক করছেন। এই দৃষ্টিকোন থেকৈই ভারতের বিজেপি, শিবসেনা, হিন্দুমহাসভা ইত্যাদির সাথে জামায়াতে ইসলামীকে তুলনা করা হয়। কিন্তু এই তুলনা কি ঠিক? এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, হিন্দুধর্মে মূল বা মৌল কিছু নেই, তাতে মৌলবাদ নেই, তাই কেউ মৌলবাদীও হতে পারে না। অন্যদিকে ইসলামে মূল আছে, মৌল আছে। একে যদি মৌলবাদ বলা হয়, তাহলে মৌলবাদ আছে। ইসলামের কোরআন, সুন্নাহই এই মৌলবাদ। হিন্দুধর্মে কোন মৌলবাদ নেই, এ সম্পর্কে সুন্দর কথা বলেছেন অমিয়কুমার বাগচী তার Predatory Commercialization and Communalism in India’ প্রবন্ধে। তিনি বলছেনড়, “হিন্দুবাদ একক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল কোন ধর্ম নয় অথবা হিন্দুধর্মে কর্তৃত্বের একক কোন উৎস নেই। হিন্দু ধর্মের পবিত্র বাণী ও বক্তব্য সমূহের শুধু যে বহুমুখী ব্যাখ্যা আছে তাই নয়, বরং প্রতিটি কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে দর্মের জন্যে নতুন পবিত্র বিধি-বিধান এবং বাণী ও বক্তব্য সৃষ্টি করা হয়”।–[‘Predatory Commercialization and Communalism in India’, Amya Kumar Bagchi, Antomy of Confrontater, page 214 (penguin Book, 1991).] অথচ ইসলামের রয়েছে কর্তৃত্বের একক উৎস আল্লাহ। আল্লাহর এ কর্তৃত্ব এসেছে তাঁর বার্তাবাহক রাসূলুল্লাহ (স)-এর মাধ্যমে আল-কোরআন এর আকারে। এবং ইসলামের তত্ত্বীয় ভিত্তি আল-কোরআন ও তদনুযায়ী ‘সুন্নাহ’ যেমন পরিবর্তন হয়নি, তেমনি পরিবর্তনীয়ও নয়। এ কারণে ইসলামে মৌলতা আছে যা হিন্দুধর্মে নেই। হিন্দু মহাসভা, আরএসএস, বিজেপি’রা হিন্দুধর্মের নামে যা বলছে তা ধর্মের পোশাক পরা একটা রাজনৈতিক তত্ত্ব কৌশলমাত্র। এর আধুনিক জন্ম শিবাজীর রাজনীতিতে, যা স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতী, বালগঙ্গাধর তিলক, শ্রী অরবিন্দ, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, প্রমুখের মাধ্যমে আজ আরএসএস, বিম্ব হিন্দুপরিষদ, বিজেপি, শিবসেনাদের রাজনীতি আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে। এদের এই অমৌলবাদী অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারী ও অধার্মিক রাজনীতির সাথে জামায়াতে ইসলামীদের ইসলামের মৌলনীতি ভিত্তিক রাজনীতির কোন তুলনা হতে পারে না।
বিজেপি, আরএসএস ও হিন্দু মহাসভাদের রাজনীতি মূলহীন, অধার্মিক যাই হোক, তাদের ব্রাহ্মণবাদী রাজনীতির আজ ভারতে ব্যাপক প্রভাবশীল। তাদের দলীয় বিস্তার ও শক্তি ক্রমবর্ধমান। ১৮৯৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ভারতের লোকসভায় আসন পেয়েছিল মাত্র ২টি, পরবর্তী নির্বাচনের পায় ৮৮টি আসন। ১৯৯১-এর অন্তর্বর্তী নির্বাচনে আসন পায় ১১৯টি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু বিজেপি’র কোয়ালিশন সরকার টেকেনি। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই ১৮২ আসন পায় এবং জোটসহ পায় ৩০৩টি আসন। বিজেপি’র কোয়ালিশন সরাকর গঠিত হয়। ২০০৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি মোট ১৯২ আসন পেয়ে হেরে যায়। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার যে দায় মাথায় নিয়ে বিজেপি নির্বাচন করেছে, তাতে বলতে গেলে বিজেপি আশাতীত ভাল ফল করেছে।
আর বিজেপি যদি ভারতীয় রাজনীতিতে আরও পেছনে হটে যেতো, কিংবা যায়, তাতে ভারতীয় রাজনীতির কোন হেরফের আমরা দেখিনা। কংগ্রেস ও বিজেপি’র মধ্যে কার্যত কোন পার্থক্য নেই। বিজেপি যে কথা প্রকাশ্যে বলে, সে কথাটা কংগ্রেস সযতনে গোপন রেকে সে অনুসারেই কাজ করে। পার্থক্য শুধু এইটুকু। তাছাড়া আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যাই হোক, বাংলাদেশ নীতির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। দেশ বিভাগ পর্যন্ত হিন্দুমহাসভা ও আরএসএস যেমন রাজনৈতিক ব্যাপারে, বিশেষ করে মুসলমানদের স্বার্থ সম্পর্কিত রাজনীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সাথে সার্বিকভাবে একাত্ম ছিল, তেমনি তারা এই ব্যাপারে আজও একাত্ম রয়েছে। কংগ্রেস ও হিন্দুবাদী বলে পরিচিত দলগুলোর সর্বসম্মত এই বাংলাদেশ নীতিটা কি?
শ্রীলংকার সাথে রাজীব গান্ধী বহু প্রতীক্ষিত চুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হবার পর সমীক্ষন সুনন্দা কে, দত্ত রায় মন্তব্য করেছিলেন, “Now Srilanka appears to have accepted that its foreign policy, defence strategy and even domestic social and political programmes must be governed by the requirements of the government of India’s security —-Jowaharlal Neheru tried to use his stature, experience and mastery of statecraft to awe the region into submission —-Mrs. Gandhi hoped to do the same through the brute force at her command. Her son (Rajib Gandhi) has neither his grandfather’s prestige nor his mother’s strength, but has succeedee where both failed”.-[India’s Monroe Doctrine’, Sunanda K. Datta Ray, Holiday, September 4, 1987.] অর্থাৎ প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের যে ঐতিহ্য ভারতের, রাজীব গান্ধীর সাফল্য তারই একটা অংশ। সিকিমকে ১২ বছর আগে ভারত গ্রাস করেছে। বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটান তাদের ভৌগলিক, চুক্তিসমূহ, এমনকি তাদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে ভারত-নির্ভরতার অসহায় নিগড়ে বন্দী। ভারতের সাথে সম্পর্কের এ দিকটা এতই প্রকাশ্য যে তা কাউকে বলে দেবার প্রয়োজন নেই’। কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের তৎপরতা শুধু এটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আজ। এই শতকের প্রথম দশকে এবং তৃতীয় দশকে হিন্দু রাজনীতির যে সংহার মূর্তি দেখা গেছে এবং ’৪৭ পর্যন্ত তারা অখণ্ড ভারতের শ্লোগানের আড়ালে সমগ্র উপমহাদেশ কুক্ষিগত করার যে রাজনীতি অনুসরণ করেছে, সেই রাজনীতিই এখনও ভারতে মুখব্যাদান করে রয়েছে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাগেশে ভারত অনেকটা ক্লাইভের ভূমিকা পালন করেছে। এসময় পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশে তার শোষণ জারি রাখাসহ বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রদেশসুলভ আনুগত্য আদায়ে ব্যাপৃত ছিল। কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের পর ভারতের এই রাজনীতি বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর চলে দীর্ঘ কূটনৈতিক যুদ্ধ এবং চাপ প্রয়োগের রাজনীতি। ফারাক্কা, তিন বিঘা করিডোর, দক্ষিণ তালপট্টি, পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত শান্তিবাহিনী সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশের উপর। কিন্তু পঁচাত্তরের আগষ্ট-পূর্ব সেই দিন ভারতের আর ফিরে আসেনি। অবশেষে নব্বই-এর দিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হওয়া এবং অবাধ বাক স্বাধীনতার সুযোগে বাংলাদেশে একটি মহলের মধ্যে ভারতের স্বার্থের কণ্ঠ শ্রুত হতে থাকে। কেয়ারটেকার সরকারের আমলে এই কণ্ঠ আরও শক্তিশালী হয়। স্রোতের মত বের হতে থাকে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা। এর অনেকগুলোতে এবং একশ্রেণীর রাজনীতিক ও সংস্কৃতিসেবীদের কণ্ঠে ভারতের রাজনীতির কথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ভারতীয় এ রাজনীতির মূলকথা হলো দ্বি-জাতিতত্ত্ব অবাস্তব ও জিন্নার ষড়যন্ত্র ছিল এটা এবং ভারত বিভাগ ছিল বিরাট এক ভুল। এই ভুল নিরসনের জন্যে অখণ্ড ভারত গঠন অর্থাৎ ’৪৭ পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাবার জন্যে তাদের তরফ থেকে আহবান করা হচ্ছে। এই আহবান ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় আজ খোলাখুলিই জানানো হচ্ছে। Statesman ভারতের ৮৪ বছর বয়সের একটা দাযিত্বশীল দৈনিক। এই দৈনিকে ‘Reunion of India’ শীর্ষক নিবন্ধে সম্প্রতি বলা হয়ঃ “———Now is the time of work for a united states of India with the merger of this country Bangladesh and……”-[‘Reunion of India’, M. Roy, Statesman, Vol-CXXIV, No. 258012] অর্থাৎ বাংলাদেশ ইত্যাদিকে ভারতের সাথে মিলিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের এটাই সময়’। কোলকাতার যে আনন্দবাজার গ্রুপের পত্রিকা ‘দেশ’ বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত’ বলে আখ্যায়িত করে এর স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, সেই আনন্দবাজার গ্রুপেরই পত্রিকা দৈনিক টেলিগ্রাফ ‘Bangladesh are voting against with their feet’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশী হাজার হাজার মুসলমানের ভারত চলে যাবার কল্পিত কাহিনীর উল্লেখ করে লিখে, “তারা (বাংলাদেশী মুসলমানরা) ভারতে সাথে পুনর্মিলিত হচ্ছে। কারণ যখন তারা তাদের সন্তানের চোখ দিয়ে অবলোকন করেছে, দেখেছে ধ্বংস এবং জীবন বিনাশী হতাশা। তারা ভালোভাবেই বুঝে পাকিস্তান স্বপ্ন ছিল না, ছিল আগুন বর্ষণকারী দানব। পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা ১৯৭১ সালে। এখন দ্বিতীয়বার তারা প্রত্যাখ্যান করছে দেশ-বিভাগকে। পাকিস্তান ছিল প্রথম স্বপ্ন, দ্বিতীয় স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঙালী মুসলিম জাতীয়তাবাদ যা রূপ পেয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। এই দ্বিতীয় স্বপ্ন বাংলাদেশকেও তারা আজ প্রত্যাখ্যান করছে”।–[‘Bangladeshis are Voting against partition with their feet, The Telegraph, October 25, 1992.]
ভারতের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও পত্র-পত্রিকাগুলো একদিকে ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র’-এর নাম মুছে ফেলে ভারতের বুকে একে লীন করার কসরত ও প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে, অপরদিকে হিন্দু ধর্মকে মুসলমানদের জন্যে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে একে ‘সুগার-কোটেড’ করে কখনও ‘শান্তিবাদী’, ‘মানবতাবাদী’, আবার কখনও সর্বরোগহরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ করার আপ্রাণ প্রয়াস চালাচ্ছে। এই লক্ষ্যে ইতিহাস পাল্টে দেয়া হচ্ছে এবং ইতিহাসের চরম সাম্প্রদায়িক লোকদেরকে মানবতাবাদী রূপ দিয়ে সামনে আনা হচ্ছে। কোলকাতার দৈনিক Statesman’ লিখছে, “বংকিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যয় বলেছেন প্রকৃত হিন্দু কখনও গোঁড়া ও সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। কংগ্রেসের জন্মের অনেক আগে ‘মনের পবিত্রতা’য় বংকিম চন্দ্র চট্টেপাধ্যয় লিখেছেন, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মনের শান্তি-এই তিনি নিয়ে হিন্দুবাদ গঠিত”।–[‘Reunion of India’, M. Roy, Statesman, Vol-CXXIV, No. 258012] এই ‘Statesman’ ই আবার লিখেছে, “ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে যদি আমরা জিততে চাই, তাহলে রামমোহন রায়, বংকিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে যা আমাদেরকে ধর্ম ও গোত্র-চিন্তার ক্ষুদ্র গণ্ডীর ঊর্ধ্বে উঠতে শিক্ষা দেয়”।–[‘Secular Order’, Subrata Mukherjee, Statesman, July 2, 1993.] স্টেটসম্যান-এর এই দুই উদ্ধৃতিতে বংকিমচন্দ্র, রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথ যা নন সেই রূপ তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে এবং হিন্দুধর্মকে দেয়া হয়েছে শান্তিবাদী ও মানবতাবাদী রূপ, যা ইতিহাস এবং বাস্তবতা উভয়েরই পরিপন্থী। শুধু বংকিম-রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ নয়, গোটা ইতিহাসকেই পাল্টে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং মুসলমানদের নির্মূলকামী শুদ্ধি আন্দোলনের নেতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও তার আর্য সমাজকেও ‘সুগার-কোটেড’ করার চেষ্টা চলছে। বলা হচ্ছে, “৪৭ পর্যন্ত সংগ্রামকে হিন্দু-মুসলমানদের বিরোধ বলা যাবে না, বলতে হবে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব, আর্য সমাজীদেরকেও হিন্দু সংগঠন নামে অভিহিত করা যাবে না, তারা যে ‘হিন্দুবিপ্লব’ ঘটাতে চেয়েছিল তাও মুখে উচ্চারণ করা যাবে না। বলতে হবে এসব মৌলবাদী প্রচারণা”।–[‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদকীয়, ১৬ই জুলাই, ১৯৯৩ (কোলকাতা)।] অর্থাৎ আর্য সমাজ এবং স্বামী দয়ানন্দদেরকেও ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরানো হচ্ছে। অথচ ইতিহাস স্বাক্ষী, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রমুখ হিন্দু নেতাদের ‘আর্য সমাজ’ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যতটা বিচ্ছিন্ন করেছে, যতো সাম্প্রদায়িকতার প্রচার করে এদেশের শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করেছে, আর কোন হিন্দু সংগঠন ততটা পারেনি। আর্য সমাজ শুদ্ধির মাধ্যমে মুসলমানদের হিন্দুকরণ করার যে অভিযান চালিয়েছিল তার একটা দৃষ্টান্ত উদাহরণ হিসেবে আনন্দবাজার পত্রিকা থেকেই তুলে ধরা যায়। ৭০ বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকা খবর দিয়েছিল, ‘আর্য সমাজীদের চেষ্টায় আগরার শিকারা গ্রামের ৬০০ মুসলমানকে শুদ্ধ করিয়া লওয়া হইয়াছে। অন্যান্য গ্রামের ২০০ (দুই শত) শুদ্ধি কার্যে সাম্প্রদায়িক হিন্দুধর্মকে এবং এর সাম্প্রদায়িক নেতাদেরকে মানবতাবাদী, শান্তিবাদী রূপে দাঁড় করানো হচ্ছে।
এইভাবে একদিকে ভারত-বিভাগকে ভুল বলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ভারত-রাষ্ট্রের বুকে লীন করার চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে দ্বি-জাতিতত্ত্বকে অবাস্তব অবাঞ্ছিত অভিহিত করে মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে সরিয়ে এনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘মানবতাবাদী’, ‘শান্তিবাদী’র পোশাক পরিয়ে হিন্দুধর্মের সাথে লীন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একেই বলে ‘Final Solution’ বা ‘শেষ সমাধান’। এই ‘শেষ সমাধানের’ই চেষ্টা করছে ভারতের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবিরা’। এই ‘শেষ সমাধান’ এর জন্য ‘শেষ যুদ্ধও’-[এই ‘শেষ যুদ্ধ’-এর কথা বলা হয়েছে ভারতের শাসক দল কংগ্রেসের পূর্বাঞ্চলীয় কমিটির এক বৈঠকে।] শুরু করা হয়েছে। ভারতের শাসকদল কংগ্রেস কথিত এই ‘শেষ যুদ্ধ’ সম্পর্কে কিছু বলার আগে এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতির স্বরূপ সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলা দরকার।
ভারত কেন্দ্রীক এই রাজনীতির দু’টি দিক লক্ষ্য করার মত। এর একটি হরো ভারত ভিত্তিক কিছু সংগঠন যারা বাংলাদেশের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে রত। ভারত ভিত্তিক এই সংগঠনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘বঙ্গভূমি আন্দোলন’, ‘সোনার বাংলা’, ‘আমরা বাঙালী’, ইত্যাদি। এদের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় খবর বেরিয়েছে সেদেশের এবং এদেশের পত্র পত্রিকায়। এসবের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী তাদের ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি এবং সে ষড়যন্ত্রের সাথে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার বিষয় সকলের সামনে এসেছে। কোলকাতার দৈনিক আজকাল ১৯৮৯ সালের ২২, ২৩ ও ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের ৬টি জেলা নিয়ে হিন্দুদের আলাদা বাসভূমিক ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ প্রতিষ্ঠার ভারতীয় চক্রান্তের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ৩টি ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা লাভের জন্যে এই রিপোর্টই যথেষ্ট। ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ শীর্ষক রঞ্জিত শূর-এর লেখা রিপোর্টটি এইঃ
“বাংলাদেশের দু’টুকরো করে হিন্দুদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য জোর তৎপরতা চলছে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ২০,০০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ গঠনের উদ্যোগ আয়োজন চলছে অনেকদিন ধরে। এতদিন ব্যাপারটা সামান্য কিছু লোকের উদ্ভট চিন্তা বা প্রলাপ বলেই মনে হত। কিন্তু সম্প্রতি দেশী-বিদেশী নানা শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে ব্যাপারটা বেশ দানা বেধে উঠেছে। ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ সরকার। রাষ্ট্রপতি পার্থ সামন্ত। রাজধানী সামন্তনগর (মুক্তি ভবন)। সবুজ ও গৈরিক রঙের মাঝে সূর্যের ছবি নিয়ে নির্দিষ্ট হয়েছে জাতীয় পতাকা। জাতীয় সঙ্গীতঃ ধনধান্যে পুষ্পে ধরা, আমাদের এই বসুন্ধরা। সীমানাঃ উত্তরে পদ্মা, পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে ভারত, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পস্তাবিত সীমানার মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের ছয়টি জেলাঃ খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। এই ছয়টি জেলা নিয়েই ২৫ মার্চ ১৯৮২ ঘোষিত হয়েছে তথাকথিত ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ রাষ্ট্র। স্বাধীন বঙ্গভূমিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সমস্ত উদ্যোগই চলছে কিন্তু পশ্চিম বঙ্গ থেকে। নেপত্যে নায়করা সবাই জানেন এই রাজ্যেই বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর বিভিন্ন জেলা- ২৪ পরগনা, নদীয়া এবং উত্তর বাংলায় চলছে ব্যাপক তৎপরতা। অভিযোগ, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত দুই বাংলাদেশী নেতা কাদের (বাঘা) সিদ্দিকী এবং চিত্তরঞ্জন ছুতোর মদত দিচ্ছেন হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে। প্রবক্তাদের যুক্তি বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসন চলছে। হিন্দুদের জীবন ও সম্পত্তি তাদের হাতে নিরাপদ নয়। বিশেষত বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র ঘোষনার পর ঐ দেশের হিন্দুরা পরাধীন জীবন যাপন করছে। তাই প্রয়োজন হিন্দুদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-বঙ্গভূমি।
বঙ্গভূমি আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সংগঠক নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘ। ১৯৭৭ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় এই সংগঠনকির জন্ম হয়। জন্ম উপলক্ষে ১৫৯ গরফা মেইন রোডের সভায় নাকি উপস্থিত ছিলেন একজন আইএএস অফিসার অমিতাভ ঘোষ। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ কালিদাস বৈদ্য (এমবিবিএস ডাক্তার), সুব্রত চট্টোপাধ্যয় (বিলাত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার), নীহারেন্দ্র দত্ত মজুমদার (পশ্চিম বাংলার প্রাক্তন আইনমন্ত্রী) এবং শরৎ চন্দ্র মজুমদার (বাংলাদেশের প্রাক্তন মন্ত্রী)। অন্য সূত্রের খবর চিত্তরঞ্জন ছুতোরও ঐ সভায় হাজির ছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর সংস্থা গোলপার্কে সভা করে প্রথম প্রকাশ্যে ‘হোমল্যাণ্ড’ দাবী করে। এরপর মাঝে মধ্যে সভা-সমাবেশ হত। এর মধ্যেই নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘে ভাঙন ধরে। ১৯৭৯ সালে হয় দু’টুকরো। ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের নেতৃত্বাধীন নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘের ঠিকানাঃ গরফা মেইন রোড। সুব্রত চ্যাটার্জির নেতৃত্বাধীন নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘের ঠিকানাঃ ৮০ ধনদেবী মান্না রোড, নারকেলডাঙ্গা। এদের থেকে বেরিয়ে আর একটি অংশ তৈরী করে বঙ্গদেশ মুক্তিপরিষদ। ঠিকানা মছলন্দপুর। আরও একটি অংশ তৈরী করে সংখ্যালঘু কল্যাণ পরিষদ। চলে চিত্ত ছুতোরের ভবানীপুরের বাড়ী থেকে। পরস্পরের বিরুদ্ধে চাপান উতোরের মধ্যেই ঢিমেতালে চলছিল ‘বঙ্গভূমি’র পক্ষে প্রচার। কিন্তু ১৯৮২ সালে বঙ্গভূমি আন্দোলন একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়। ঐ বছরের ২৫শে মার্চ ঘোষিত হয় স্বাধীন বঙ্গভূমি রাষ্ট্র। তৈরী হয় ‘সৈন্য বাহিনী’ বঙ্গসেনা। সৈনাধ্যক্ষ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য। সুব্রত চ্যাটার্জীর গ্রুপ ঐ ঘোষণা না মানলেও বঙ্গভূমি দখলের জন্য ঐ বছরেই তৈরী করে ‘অ্যাকশন ফোরাম’ বাংলা লিবারেশন অর্গানাইজেশন (বিএলও)। আরও পরে বঙ্গদেশ মুক্তি পরিষদ তৈরী করে ‘সৈন্য বাহিনী’ লিবারেশন টাইগার্স অব বেঙ্গল (বিএলটি)। নেতা রামেশ্বর পাশোয়ান একজন বিহারী, থাকেন গরফার রামলাল বাজারে। এরপর বিভিন্ন সংগঠন মাঝে মাঝেই বঙ্গভূমি দখলের ডাক দেয়। সীমান্ত অভিযান করে। কিন্তু কখনই ব্যাপারটা এদেশের মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। ’৮৮ এর জুলাই থেকে অবস্থাটা ধীরেধীরে পাল্টাতে শুরু করে। ঐ বছর ২২ জুলাই ‘বঙ্গসেনা’ একটি সম্মেলন করে। এরপরই শুরু হয় একের পর এক কর্মসূচী। সীমান্ত জেলাগুলোতে চলতে থাকে পর পর এক সামবেশ মিছিল মিটিং। ২৩ নভেম্বর ‘বঙ্গভূমি’ দখলের জন্য বনগাঁ সীমান্ত অভিযানে ৮/১০ হাজার লোক হয়। ২২-২৩ জানুয়ারী বনগাঁ থেকে বঙ্গ ‘সেনা’র মহড়া হয়। ২৪ মার্চ ও ২৫ মার্চ হয় আবার বঙ্গভূমি অভিযান। ৭ এপ্রিল রাজীব গান্ধীর কলকাতা আগমন উপলক্ষে সিধু কান ডহরে বিএলও এক জমায়েতের ডাক দেয়। প্রত্যেকটা কর্মসূচীতে ভাল লোক জড়ো হয়। বাংলাদেশে গেল গেল রব উঠে। এপারের সংবাদ মাধ্যমগুলো এই প্রথম গুরুত্ব সহকারে মনোনিবেশ করে খবর প্রচার করে। দেশে-বিদেশে ‘বঙ্গভূমি’র দাবি এবং দাবিদার নিয়ে কম-বেশী হৈচৈ শুরু হয়। আবার ২২ জুলাই অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে বঙ্গভূমি দখলের জন্য কালিদাস বৈদ্যের দাবি ঐ দিন এক লক্ষ লোক জমায়েত হবে।
স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনের নেপথ্য নায়কদের আসল পরিচয় কি? কি তাদের আসল উদ্দেশ্য? কে এই ‘রাষ্ট্রপতি’ পার্থ সামন্ত? কি ভূমিকা নিচ্ছেন ভারত সরকার? এসব তথ্য জানার জন্য অনুসন্ধান চালাই তাদের কর্মস্থলগুলিতে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলি ডাঃ কালিদাস বৈদ্য, সুব্রত চ্যাটার্জী, রামেশ্বর পাশোয়ার, কে পি বিশ্বাস, রাখাল মণ্ডল প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে। অনুসন্ধানের সময় বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে চিত্ত ছুতোরের নামাবার বার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি কিন্তু কিছুতেই দেখা করতে বা কথা বলতে রাজী হননি। এই দীর্ঘ অনুসন্ধানে এটা স্পষ্ট হয়েছে, ‘স্বাধীন’ হিন্দুরাষ্ট্র তৈরীর চেষ্টা আজকের নয়। পঞ্চাশের দশকেই হয়েছিল এর ব্লুপ্রিন্ট। “বঙ্গভূমি ও বঙ্গসেনা” পুস্তিকায় ডাঃ কালিদাস বৈদ্য নিজেই স্বীকার করেছেন যে, ১৯৫২-তে তাঁরা তিনজন যুবক কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যান এবং ‘সংখ্যালঘুদের মুক্তির জন্য ব্যাপক কর্মতৎপরতা’ চালান। ‘গোপনে স্বাধীনতা ও তার সঙ্গে স্বতন্ত্র বাসভূমির কথাও’ প্রচার করেন। ঐ তিন যুবক হলেন কালিদাস বৈদ্য, চিত্তরঞ্জন ছুতোর এবং নীরদ মজুমদার (মৃত)।
বাংলাদেশে বেশ কিছু কাগজে লেখা হয়েছে “বঙ্গভূমি আন্দোলন ভারতেরই তৈরী”। ৮৮ সালের জুলাই থেকেই বঙ্গভূমি আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাধতে শুরু করে। এটা কি নেহাৎই কাকতালীয়? ১৯৮২ সালে যখন ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি সরকার’ ঘোষণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশের কাগজগুলিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মূল সুর ছিল, ইন্দিরার মদতেই এসব হচ্চে। সাম্প্রতিক ‘বঙ্গভূমি’ আন্দোলনের পেছনে নাকি ভারত সরকারের হাত আছে। প্রথম আন্দোলনের মূল হোতা ডাঃ কালিদাস বৈদ্য এবং রহস্যময় চরিত্র চিত্ত ছুতার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে বহুকাল ভারতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির পিছনেও ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বস্তুত ভারতীয় এজেন্ট হিসেবেই এই দু’জন এবং নীরদ মজুমদার তৎকালীন পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন। চিত্তবাবু ওখানে রাজনৈতিকভাবেও বিশেষ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন মূলত তার ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। সংসদের সদস্যও হয়েছিলেন। ডাঃ বৈদ্য এতটা পারেননি। পরবর্তীকালে দু’জনের মধ্যেবিরোধও হয়। ডাঃ বৈদ্য ভারত সরকারে সমর্থন হারান। কিন্তু মুজিব সরকারের ওপর প্রভাব খাটাবার জন্য চিত্ত ছুতারকে ভারত সরকার চিরকালই ব্যবহার করেছে। এখনও ভারত সরকারের তরফে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন চিত্তবাবু। অনেকেই বলে, তাঁর সোভিয়েত কানেকশন নাকি প্রবল। চিত্তবাবু ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের বিশাল বাড়িতে সপরিবারে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। কোথা থেকে আসে ঐ টাকা? ভারত সরকার কেন তাকে জামাই আদরে পুষছেন? তার বসতবাড়িটাও দুর্ভেদ্যও। পাহারা দেন বেশকিছু শক্ত সমর্থ যুবক। যারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ করত। বনগাঁ লাইনে ‘বঙ্গভূমি’ সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার যে, ঐ বাড়িটাই ‘বঙ্গসেনা’র ঘাঁটি। ভারত সরকারের মদদের আরও প্রমাণ, রাজীব গান্ধীর বিবৃতি। তিনি একাধিকবার বিবৃতি দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বাড়ছে অনুপ্রবেশ। আকাশবাণী থেকেও একাধিকবার প্রচার হয়েছে। যেমন, ১৭ জানুয়ারী ‘বঙ্গভূমি’ পন্থীরা বাংলাদেশ মিশন অভিযান করলে ঐ খবর আকাশবাণী প্রচার করে। ১৮ জানুয়ারী রাজীব গান্ধী অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। এছাড়াও বলা যায়, এতদিন ধরে বঙ্গভূমি জিগির চলছে, বারে বারে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে লোক নিয়ে গিয়ে সীমান্তে গণ্ডগোল ছড়ানো হচ্ছে তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার চালানো হচ্ছে, ‘সৈন্যবাহিনী’ ঘোষণা করছে, প্রতিবেশী দেশের এলাকা নিয়ে পাল্টা সরকার ঘোষিত হয়েছে –তবুও পুলিশ তাদের কিছু বলে না কেন? সীমান্তে সমাবেশ বা ওপারে ঢোকার চেষ্টা হলে পুলিশ তুলে নিয়ে কয়েকশ’ গজ দূরে ছেড়ে দেয়। নেতাদের গ্রেফতারও করা হয় না। ভারত সরকারের মদদ না থাকলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ না থাকলে, এটা কি সম্ভব হত?
ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের কথা ডাঃ বৈদ্যও অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, “মদদ নয় প্রশ্রয় দিচ্ছে বলতে পারেন। তবে মদদ দিতেই হবে। আমরা জমি প্রস্তুত করছি’। তিনি বলেন, “আমি ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, কিভাবে রাখছি, কার মাধ্যমে রাখছি বলব না। আমার বক্তব্য ক্রমাগতই তাদের বোঝাবার চেষ্টা করছি। সত্যিই যদি যথেষ্ট লোকজন জড় করতে পারি, তবে ভারত সরকারকে সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেই হবে। আমার একটা সরকার আছে। সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেই হবে। আমরা একটা সরকার আছে। সৈন্যবাহিনী আছে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ‘বঙ্গসেনা’ নামেই ঢুকবে বাংলাদেশে। আমরা সেই পরিস্থিতি তৈরী করার চেষ্টা করছি”। কিভাবে? বঙ্গসেনা, বিএরও, বিএলটি সবার সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি সেটা এরকমঃ ‘বঙ্গভূমি’ পন্থীরা চান বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক অত্যাচার চালাক। যাতে তারা দলে দলে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে শুরু করে। শরণার্থীদের বোঝা বইতে হবে ভারত সরকারকে। ফলে বাধ্য হয়েই তাদের হস্তক্ষেপ করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে কিছু অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের আরও একটা ইচ্ছা, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগুক, ব্যাপক হিন্দু নিধন হোক, যাতে এদেশের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সেন্টিমেন্টকে খুশী করার জন্য ভারত সরকার হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। ‘বঙ্গভূমি’র ফেরিওয়ালাদের স্পষ্ট বক্তব্যঃ ভারত সরকারকে বেছে নিতে হবে দু’টোর একটা। তারা দেড় কোটি হিন্দু শরণার্থীর দায়িত্ব নেবেন, নাকি ‘স্বাধীন হিন্দুরাষ্ট্র’ ‘বঙ্গভূমি’ তৈরী করে দেবেন, যে বঙ্গভূমি একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সিকিমের মত ভারতের অঙ্গরাজ্যে রূপান্তরিত হবে?
ঘোষণা অনুযায়ী স্বাধীন ‘বঙ্গভূমি’ রাষ্ট্রের রাজধানী সামন্তনগর (মুক্তিভবন)। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলি জানিয়েছে, ওদেশে সামন্তনগর বলে কোন জায়গা নেই, মুক্তিভবন বলে কোন বাড়ি নেই। পার্থ সামন্ত স্বাক্ষরিত অধিকাংশ ইস্তেহারই প্রকাশিত হয়েছে মধুমতি প্রেস কুষ্টিয়া থেকে। বাংলাদেশী পত্রিকাগুলি লিখেছে ঐ নামে কুষ্টিয়ায় কোন প্রেস নেই। ২২ জুলাই আবার বঙ্গভূমি অভিযানের ডাক দিয়ে যে ইস্তেহার প্রচারিত হবে তার খসড়া কালিদাস বৈদ্য এই প্রতিবেদককে পড়ে শোনান। কোথা থেকে ছাপা হবে? এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান ডাঃ বৈদ্য। নিশ্চিত পার্থ সামন্তের নামে এ রাজ্যের কোথাও থেকে ছাপা হবে। প্রেস লাইনে কিন্তু থাকবে মধুমতী প্রেস, কুষ্টিয়া। কে এই স্বঘোষিত ‘রাষ্ট্রপতি’ পার্থ সামন্ত? বাংলাদেশের একাধিক কাগজে লেখা হয়েছে, চিত্তরঞ্জন ছুতোরই হল আসলে পার্থ সামন্ত। এই প্রতিবেদক কিন্তু নিশ্চিত যে ,কালিদাস বৈদ্যই হলেন পার্থ সামন্ত। কিভাবে এই সিদ্ধান্তে এলাম? প্রথমত, বঙ্গভূমি আন্দোলনের প্রথম দিককার সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে, যাঁরা ঐ সময় কালিদাস বাবুর সঙ্গে ছিলেন। দ্বিতীয়ত, কালিদাস বৈদ্য এই প্রতিবেদককে পার্থ সামন্তর একটি ব্লক করা স্বাক্ষর দেখিয়ে বলেন, এই স্বাক্ষর দিয়েই প্রমাণ হবে কে পার্থ সামন্ত। ঐ স্বাক্ষরের সঙ্গে কালিদাস বাবুর অসতর্কভাবে ‘পার্থ সামন্ত’ লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি হুবহু এক। তৃতীয়ত, কালিদাস বাবু এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বার বার উত্তেজিত হয়েছেন। যখনই উত্তেজিত হয়েছেন, বলেছেন ‘আমার একটা সরকার আছে। সৈন্যবাহিনী আছে’। পর মুহুর্তে আবার সতর্ক হয়ে বলেছেন, পার্থ সামন্তর সরকার, পার্থ সমান্তর সৈন্যবাহিনী। চতুর্থত, দীর্ঘ আলোচনায় কালিদাস বাবুর কথায়, হাব-ভাবে আচরণে এবং কয়েকদিন ধরে বহু জায়গায় অনুসন্ধান করেই এই প্রতিবেদকের নিশ্চিত ধারণা ডাঃ কালিদাস বৈদ্যই পার্থ সামন্ত।
চলছে সশস্ত্র হওয়ার চেষ্টা? বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এবং বনগাঁ, বগুলাও গোবরডাঙ্গা কলেজের যুব-ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার হয়েছে। বঙ্গভূমির মুক্তির জন্য অস্ত্রশিক্ষা চলছে। অস্ত্রশিক্ষার দুটো দিক। একটি অংশকে শেখানো হচ্ছে কিভাবে বাংলাদেশের ভিতর ঢুকে অন্তর্ঘাত করতে হবে। অন্য অংশকে মিলিটারী ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। কারা দিচ্ছে? প্রচার, আনন্দমার্গ, চাকমারে শান্তিবাহিনী এবং একটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। ‘সেনাধ্যক্ষ’ কালিদাস বৈদ্য ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, আগে যথেষ্ট লোকজন হোক। দেশে-বিদেশে প্রচার হোক। অস্ত্র এবং সৈন্যবাহিনী তো ভারত সরকারই দেবে। বিএলটির রামেশ্বর পাশোয়ান ও কেপি বিশ্বাস এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি। ওটা গোপন। তাঁরা বলেন, দেখুন আমরা কি করি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে বিএলটি অবিলম্বে অন্তর্ঘাতমূলক কিচু কাজ করবে বাংলাদেশে, বনগাঁ লাইনে ব্যাপক প্রচার যে, বিএলটি নেতা সুব্রত চ্যাটার্জি। তিনি জানান, আনন্দমার্গ ও ‘আমরা বাঙ্গালী’ নেতা অমলেশ ভট্টাচার্য বিএলটি-র সাথে যোগাযোগ রাখেন। সুব্রত বাবু জানান, তাদেরও দুজন গিয়েছিল আনন্দমার্গের কাছে ট্রেনিং নিতে কিন্তু তন্ত্র-মন্ত্র হচ্ছে দেখে চলে এসেছে। অন্যদিকে ভারত সরকারের ব্যবস্থাপনায় বিএলও-কে নাকি ট্রেনিং দিচ্ছে চাকমাদের শান্তিবাহিনী। বিএলও-র অন্যম উপদেষ্টা হলেন চাকমা রাজগুরু অগবনশা মহাথেরা। সুব্রত বাবু এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলেন, তাঁরা কিছু ‘টেররিস্ট’ গ্রুপ তৈরীর চেষ্টা করছেন। তবে গণ কাজই হবে আসল।
উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলির ভূমিকাঃ বঙ্গভূমির আন্দোলনে চারটি গ্রুপের প্রত্যেকেই একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। অন্যরা আরএসএস ও আনন্দমার্গের আজ্ঞাবাহী। তাছাড়া ভারত সেবাশ্রম সংঘ ও বিশ্ব হিন্দু পরিষধ নানাভাবেই বঙ্গভূমি আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। আছে সন্তান দলও। কালিদাস বাবু বলেন, তিনি প্রত্যেকের কাছেই গিয়েছিলেন তবে কেউই বিশেষ সাহায্য করেনি। তবে ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী বিজয়ানন্দ মহারাজ বিভিন্ন সভায় এসে তাঁদের আশীর্বাদ করেছেন। আনন্দমার্গ আমরা বাঙালীর মাধ্যমে কাজ করছে বঙ্গভূমির পক্ষে। কালিদাস বৈদ্য জানান, চিত্ত ছুতোরের মাধ্যমে আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাংলাদেশে ‘বঙ্গভূমি’ সংগঠকদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংগঠক ডাঃ সুরঞ্জিত ধর এ ব্যাপারে চিত্ত ছুতোরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। সুব্রত চট্টেপাধ্যয় জানান, বাংলাদেশে ‘হিন্দু লীগ’ গড়া হয়েছে তাদেঁরই পরামর্শে। বিশ্বহিন্দু পরিষদের সাথে যোগাযোগ আছে। তবে রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। ডাঃ ধরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাধারণভাবে আর এস এস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বঙ্গভূমির দৃঢ় সমর্থক বলে বঙ্গভূমি আন্দোলনের কর্মী ও সমর্থকদের বিশ্বাস। বিএলও নেতা সুব্রত চট্টোপাধ্যয় জনসংঘের পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের সভাপতি। বিভিন্ন জায়গায় তিনি হিন্দু সম্মেলন করে থাকেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিজেপি এবং জনসংঘ অনুপ্রবেশ নিয়ে কিছুদিন ধরে যে হল্লা শুরু করেছে সেটাও বঙ্গভূমিওয়ালাদের হাতকেই শক্ত করছে।
ঐক্য প্রচেষ্টাঃ বঙ্গভূমির দাবীদার বিভিন্ন গ্রুপগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। লক্ষ্য, আন্দোলনকে জোরদার করা। এ ব্যাপারে কয়েকটা সভাও হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে চিত্ত ছুতোরই নাকি বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে চিত্তবাবুর বাড়িতে বসেই তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ অনুগামী জানান, এসবের মধ্যে চিত্ত বাবু নেই। টেলিফোনে একই কথা বলেন চিত্ত বাবুর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী দেবী। কালিদাস বাবু এবং সুব্রত বাবু কিছু না বললেও, বিএলটি নেতারা জানিয়েছেন, চিত্ত বাবুর মধ্যস্থতায় অন্তত একটি ‘সমন্বয় কমিটি’ করার জন্য তাঁরা বিশেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে, বাঙালীকে আরেকবার ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা”।–[দৈনিক আজকাল, কোলকাতা, ২২, ২৩ এবং ২৪শে এপ্রিল, ১৯৮৯]
কোলকাতার দৈনি আজকালের এই রিপোর্ট এতই সুস্পষ্ট যে, ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। এই রিপোর্ট থেকে কয়েকটা বিষয় পারিস্কারভাবে জানা গেলঃ (১) বাংলাদেশ বিরোধী এক সক্রিয় ষড়যন্ত্র সীমান্তের ওপারে দানা বেঁধে উঠছে, যার সাথে জড়িত আছে ভারতের নামকরা রাজনীতিক ও পলিটিশিয়ান, (২) এই ষড়যন্ত্রকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে আর এস, এস, বিশ্ব-হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, আনন্দমার্গ ও ভারত সেবা সংঘ এবং পরোক্ষভাবে এর পেছনে রয়েছে ভারতের ক্ষমহাসীন দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, (৩) এই ষড়যন্ত্রকারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, আনন্দমার্গ এবং চাকমাদের শান্তিবাহিনী, (৪) এই ষড়যন্ত্রের আশু লক্ষ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করা, আর দূরবর্তী লক্ষ্য হলো অসন্তোষ ও সাস্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি করে ভারতীয় বাহিনীকে ডেকে আনা, এবং (৫) বাংলাদেশের কিছু দল ও ব্যক্তির সাথে এই ষড়যন্ত্র অথবা ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ ঘিরে ভারতীয় রাজনীতির এই হলো একটা দিক। আরেকটা দিক হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও অখণ্ডভারতপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করা।–[ষড়যন্ত্রের তৃতীয় আরেকটা ফ্রন্টও খোলা হয়েছে। সেটা হলো ‘যুক্তবাংলা’র ষড়যন্ত্র। দিল্লী থেকে পশ্চিম বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে এই ‘যুক্তবাংলা’র কথা কোলকাতায় নয়, বাংলাদেশকে ছড়ানো হচ্ছে। এরও গোপন লক্ষ্য বাংলাদেশ ভারতীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করা।] ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর অবাধ বাক-স্বাধীনতা এবং অঢেল পত্র-পত্রিকার প্রকাশের সুযোগ নিয়ে এই ক্ষেত্রেও ভারত কেন্দ্রীক ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত যে কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা ও লিখা অসম্ভব ছিল, তা এই সময় বলা শুরু হয়েছে। মনে পড়ে ’৯১ সালের সম্ভবত নভেম্বরের দিকে একটা পুস্তিকা আমার হাতে আসে। একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা (যিনি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা ছিলেন এবং মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজনের একজন ছিলেন) পরিচালিত একটি সাপ্তাহিকের নির্বাহী সম্পাদক বলে পরিচয়দানকারী জনৈক ব্যক্তি আরেকজন সহ এসে ঐ পুস্তিকাটি আমাদের দিয়েছিলেন। পুস্তিকাটির নাম ‘A Heretic’, যার অর্থ ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ বা ‘বিদ্রোহী’। প্রকাশক হিসেবে নাম আছে জনৈক সৈয়দ ফয়জুর রহমানের আর প্রকাশের স্থান ৪ নং নিউ সার্কুরার রোড। পুস্তিকাটিতে অখণ্ড ভারতের পক্ষে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেক কথার সাথে বলা হয়েছে, “এই উপমহাদেশই আমাদের দেশ এবং আমরা এই উপমহাদেশের নাগরিক হিসেবেই বাঁচতে চাই। কেটে বিচ্ছিন্ন করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ পুনঃসংযোজিত করার সক্রিয় আন্দোলনই আমাদের প্রত্যাশা পূরণের পথ রচনা করতে পারে”। এই ঘটনার কিছুদিন পর ১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকার কাকরাইল এলাকার একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট একটা অভূতপূর্ব সাংবাদিক সম্মেলন হলো। এ ধরনের কোন সাংবাদিক সম্মেলন ’৪৭-উত্তর কালে বাংলাদেশে হয়নি। সাংবাদিক সম্মেলনকারী সংগঠনকির নাম হলো ‘Continent Resurrection Movement’ বা ‘উপমহাদেশ পুনর্জীবন আন্দোলন’। তারা আহুত সাংবাদিকদের মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করে সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে জানারেন, তাদের লক্ষ্য উপমহাদেশের অখণ্ডতা। তাঁরা ’৪৭ এবং ’৭১-এর বিভক্তি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষন করেন’।–[দৈনিক বাংলা’, ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৯১।] এই সাংবাদিক সম্মেলনের মাত্র একদিন পর ৩১শে ডিসেম্বর ’৯১ তারিখে ঢাকা পিজি হাসপাতাল মিলনায়তনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।–[দৈনিক বাংলা’, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯১।] সেমিনারের বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ, জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদসহ আরও অনেকে। ভারত থেকে কংগ্রেস সমর্থক মওলানা আসাদ মাদানী এ সেমিনারে যোগদান করেন। সেমিনারে মূল বক্তব্য ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করা এবং মুসলিম লীগ ও কায়েদে আযমের উপর ভারত-বিভাগের দায় চাপানো। যেমন মওলানা আসাদ মাদানি বলেন, “মুসলিম লীগের পাশ্চাত্যায়ন ও বৃটিশ আনুগত্য অনুসারে নেতৃবর্গ লাহোর সম্মেলনে ‘পাকিস্তান’ নামে মুসলমানদের জন্যে পৃথক ভূ-খণ্ডের দাবী তোলেন। —এভাবেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে”।–[কংগ্রেসী নেতা মওলানা আসাদ মাদানী এদেশবাদীসে উল্টো কথা শুনিয়েছেন। কংগ্রেসের অপরাধ আড়াল করা এবং অখণ্ড ভারত গড়ার আন্দোলনকে ভারতের জন্যে যৌক্তিক করার জন্যেই তিনি মিথ্যাচার করেছেন। এ মিথ্যাচারের জবাব সে সময়ের ইতিহাস। এখানে শুধু মহাত্মা গান্ধীর বন্ধু পণ্ডিত সুন্দর লাল-এর একটা বক্তব্য মাত্র তুলে ধরছি। তিনি তাঁর ‘Who was responsible for the partition of India’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভারত বিভাগের চিন্তা সর্বপ্রথম করেন লালা লাজপাত রায়। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ্যে এ দাবীর পক্ষে কথা বলতে পারেননি উচ্চ বর্ণের নেতারা। তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে এমন কৌশল অবলম্বন করেন যাতে ভারত ভাগও হয় এবং তার দোষটা গিয়ে মুসলমানদের উপর পড়ে। বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা তাদের কাজের দ্বারা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যাতে মুসলমানরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হন যে, ভারত বিভাগের মধ্যেই তাদের মঙ্গল নিহিত (The congress encouraged the Muslim League ….by action that league feel that in a free (united) India Muslim interest would not protected.)” হিন্দু কংগ্রেস এবং ভারতের বর্ণবাদী নেতারা একাজটি কোন লক্ষ্যে কোন যুক্তিতে করেছিলেন তাও পণ্ডিত সুন্দরজী প্রকাশ করেছেন। মিঃ সুন্দরজীর ভাষায় সেই যুক্তিগুলি ছিলঃ “দেখ এই সুযোগ হারিও না। আর না আসতে পারে সহজে এই সুযোগ। দু’টো অংশকে কেটে ফেল- একটি পূর্বে একটি পশ্চিমে। অবশিষ্ট বড় ও মূল অংশটি আমাদের হাতে থাকবে। কোন অহিন্দু আমাদের অংশে থাকতে সাহস করবে না, থাকলেও আমাদের মত হয়ে থাকবে। ভারতের যে দু’অংশ দু’পাশে থাকল, আমরা শক্তি অর্জন করার পর ঐ দু’টোকে পরে আমরা দেখে নেব”। (Reiance, Delhi, August 13, 1967).] আর জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমদ বলেন, “বাংলাদেশের জনগণকেও দ্বি-জাতিতত্ত্বকে বাদ দিয়ে নতুন আদর্শে চিন্তা ভাবনা করতে হবে”।–[‘দৈনিক বাংলা’, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯২।] পিজি সেমিনারেরর ৩০ দিন পর সাপ্তাহিক বিচিন্তা ‘উপমহাদেশের মানচিত্রের আসন্ন পরিবর্তন’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে।–[৩১শে জানুয়ারী, ১৯৯২ তারিখে ‘বিচিন্তা’র এ সংখ্যা প্রকাশিত হয়।] এ কাহিনীতে রয়েছে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর উপর একটি রিপোর্ট এবং এ আন্দোলনের নেতার একটি সাক্ষাতকার। রিপোর্ট এবং সাক্ষাৎকার দু’টিতেই দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা এবং অখণ্ড ভারতের পক্ষে কথা বলা হয়েছে। ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে রিপোর্টে বলা হয়ঃ “অযৌক্তিক এবং অন্যান্য বিভক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সক্রিয় ছিলেন উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু রাজনীতিক। ….এসব জ্যৈষ্ঠ প্রজন্মের রাজনীতিকরা আবার নতুন করে তাদের রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চাইছেন। …..এ প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’। এই পটভূমি বর্ণনা করার পর বাংলাদেশে এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন,তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। এঁরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ ও জাসদ করতেন। এছাড়াও বলা হয়েছে, “…..তাঁদের পেছনে জাতীয় পর্যায়ের অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিকও রয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাসদ-এর সর্বোচ্চ দু’জন নেতা এই প্রক্রিয়ার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত”। এছাড়া উক্ত প্রচ্ছদ কাহিনীতে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর নেতার যে সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছেতাতে উক্ত নেতা বলেছেন, “ঠিক ’৪৭-এর আগস্টের পূর্বে ভেঙ্গে যাবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই। …..আমরা পুরো উপমহাদেশকে ভাষাভিত্তিক একটি ফেডারেশনে বাঁধতে চাই। দু’পাঞ্জাব আর দিল্লী নিয়ে একটি, আরাকান-কাচীন নিয়ে একটি, শ্রীলংকার তামিল আর মাদ্রাজ নিয়ে একটি, আসাম-মেঘালয় বাংলাদেশ নিয়ে একটি, বেলুচদের নিয়ে একটি। ….ভারতের আগ্রহেই এটা হচ্ছে”।
দ্বি-জাতিতত্ত্ব মুছে ফেলা এবং অখণ্ড ভারত গঠনের লক্ষ্যে সাহিত্য-সিনেমা ক্ষেত্রেও ভারতে কাজ হচ্ছে। এ লক্ষ্যে অনেক উপন্যাস-কাহিনী গড়ে উঠেছে। তার ভিত্তিতে চলচ্চিত্রও তৈরীর চেষ্টা চলছে। একটা দৃষ্টান্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে বিভক্ত দুই পারের মর্ম-যাতনা দেখানো হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে অখণ্ডত্বের একটা আবেদন বিমূর্ত হয়ে উঠে। এ উপন্যাসের ভিত্তিতে সীমান্তের দুই পারের যৌথ উদ্যেঅগে চলচ্চিত্র নির্মানের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। সুনীল বাবুরা ঢাকায় এসে এ লক্ষ্যে একটা উদ্বোধনী সাংবাদিক সম্মেলনও করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সম্ভবত উদ্যোগটাকে স্থগিত রাখা হয়েছে। দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী কাজ বাংলাদেশ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেও হচ্ছে। একশ্রেণীর নবজাত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও ম্যাগাজিন প্রকাশ্যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী এবং ভারতের পক্ষের এই তৎপরতাগুলো, আগেই বলা হয়েছে, ভারত যে রাজনীতি চর্চা করছে তারই একটা রূপ। এ বিষয়টা প্রকাশও পেয়েছে ঐ সব তৎপরতার মধ্য দিয়ে। এই প্রকাশের মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ সেই ’৪৭ থেকে ভারত যা চাচ্ছিল তাই সে করছে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এখানে দুইটি। একটি হলো, হঠাৎ করে ’৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও অখণ্ডভারতমুখী তৎপরতা মাথা তুলে দাঁড়ানো। দ্বিথীয়টি এই তৎপরতার সাথে আওয়ামী লীগ ও জাসদের একটা অংশ সংশ্লিষ্ট হওয়া। অবশ্য গভীরভাবে একটু চিন্তা করলে এ বিস্ময় আর থঅকে না কারণ বাংলাদেশে প্রথম ধারার যে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, তার কাছে দ্বি-জাতিতত্ত্ব একটি অসার বস্তু এবং সেই হেতু মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্থাৎ বাংলাদেশ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ কারণেই এই ধারার রাজনীতির পক্ষ থেকে উপরোক্ত রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ উত্থিত হয়নি। দ্বিতীয়ত ’৯১ থেকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও ভারতের অখণ্ডতামুখী তৎপরতা মাথা তুলেছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে অবাধ বাক-স্বাধীনতা ও বিপুল সংখ্যায় পত্র-পত্রিকা প্রকাশের সুযোগে।
একানব্বই থেকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী এবং ভারতের অখণ্ডতামুখী রাজনীতি বাংলাদেশে মাথা তোলার পর থেকে এখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হলো, বাংলাদেশে নবোত্থিত এই রাজনীতি সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং এসবের পাহারাদার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূলোৎপাটন না করলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের মূলোচ্ছেদ করা যায় না বলেই এই অভিযান। এই অভিযান শুরু করলে প্রথম ধারার রাজনীতির সাথে স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত বেধেছে দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির। দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা আগেই বলেছি, জামায়াতে ইসলামী এবং ঘটনাক্রমে এই জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধকে মুসলমানদের স্বাধীনতা বিরোধী ভারতের একটি তৎপরতা বলে অভিহিত করে। এ বিষয়টা প্রথম ধারার ধর্ম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্যে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং এই অস্ত্র দিয়ে জামায়াতে ইসলামী তথা দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মুণ্ডুপাত করার মোক্ষম সুযোগ করে নিয়েছে। এই লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারলে, তারা মনে করছে, শুধু জামায়াতে ইসলামীর মুণ্ডুপাত হবে না, মূলোচ্ছেদ হবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির, মূলোৎপাট ঘটবে দ্বি-জাতিতত্ত্বের এবং সেই সাথে স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশেরও। এর অর্থ বাংলাদেশ দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং এ ধারার রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামী শুধু ধর্মীয় চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, শুধু দ্বি-জাতিতত্ত্ব নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরও একটা গ্যারান্টি।
বাংলাদেশে প্রথম ধারার ধর্ম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যেকার এই সংঘাতকেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কংগ্রেস ‘বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে। ১৯৯৩ সালের ২২শে জুন নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বয় কমিটির ৮ম বিশেষ সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে রাজনৈতিক মূল্যায়নে বলা হয়, “বাংলাদেশে দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সম্ভবত এটাই শেষ যুদ্ধ। একদল চাইছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অপর দল চাইছে বাংলাদেশে স্বাধীনতার অধ্যায় মুছে ফেলতে এবং প্যান ইসলামিক স্রোতের সাথে মিশে যেতে। অশুভ মৌলবাদী শক্তিগুলো সুপরিকল্পিত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ….একটি আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তির পতাকা সমুন্নত রাখতে ভারতের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে”।–[বাংলা বাজার পত্রিকা ২৩শে আগস্ট ১৯৯৩।]
ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শাখার মূল্যায়ন রিপোর্টকে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ৪৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী রিপোর্ট দিল্লীতে পাঠানো হয়েছে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টে বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তি বলতে বাংলাদেশের প্রথম ধারার রাজনীতি অর্থাৎ ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাকে বুঝানো হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন ধারা বলতে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাকে বুঝানো হয়েছে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টেও জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, ঠিক যেমন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক ধারাটি জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করে থাকে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলাদেশে উল্লেখিত দুই ধারা বা পক্ষের সংঘাতকে ‘বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা এবং এই শেষ যুদ্ধে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারার পক্ষ নেয়াকে ভারতের জন্যে নৈতিক দায়িত্ব বলা। কংগ্রেস তার এই বক্তব্য দ্বারা নতুন করে জানিয়ে দিল, বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটির সাথে শুধু আরএসএস বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, শিবসেনানয় কংগ্রেসসহ গোটা ভারতই শ্যামল রয়েছে। তবে এ কথা না বললেও চলতো। কারণ কারো অজানা নয় যে, কংগ্রেসীরা এ যুদ্ধে আগে থেকে শামিল রয়েছে। বরং উপরের গোটা আলোচনায় এ বিষয়টা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে যে, বাংলাদেশের এ যুদ্ধটা ভারতেরই যুদ্ধ।
তবে কংগ্রেস ঐভাবে কথা বলে একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটির মর্যাদাকে যেমন ভুলুণ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দ্বিতীয় ধারাটির আদর্শিক নেতা জামায়াতের মর্যাদাকে আকাশচুম্বী করে দিয়েছে। কংগ্রেসের রিপোর্ট বলে দিয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটি যথেষ্ট নয়, তাদের সহযোগিতার জন্যে ভারতকেও যুদ্ধে নামতে হচ্ছে। এর দ্বারা কংগ্রেস না চাইলেও এবং বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ধারাটি না চাইলেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাটি। বাংলাদেশী মুসলিম জনগণের ত্রাতায় পরিণত হয়েছে এবং তার স্বাধীনতার সংরক্ষণকারীর স্থান লাভ করেছে। দ্বিতীয় এই ধারার আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলাম পন্থীরা এবং এই ধারার আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলাম পন্থিরা এবং এই ধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলো বিএনপি। বিএনপির স্থপতি মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক। বিএনপির এই বৈশিষ্ট্যই দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দল ও বিএনপি’র জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এই রাজণৈতিক মেরুকরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে যেমন শক্তিশালী করেছে, তেমনি দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের করেছে দিশেহারা। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা রাজনীতির এই জোটগত মেরুকরণ ভাঙার জন্যে করিয়া।
একটা বিষয় কিন্তু অস্পষ্ট থাকছে, বাংলাদেশের উপরোক্ত রাজণৈতিক সংঘাতকে ভারতের কংগ্রেস ‘বাংলাদেশের শেস যুদ্ধ’ বলছে কেন? তাহলে কি কংগ্রেস বাংলাদেশের আয়ু জেনে ফেলেছে? জেনে ফেলেছে যে, এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশ থাকছে না? এর অর্থ কি এই যে, কংগ্রেস ধরে নিয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাতে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা জয়লাভ করবে এবং তার ফলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের কবর রচিত হবে এবং বাংলাদেশ নামক কোন স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে না? বাংলাদেশ না থাকলে বাংলাদেশে আর কোন যুদ্ধেরও প্রশ্ন উঠবে না। সুতরাং এটাই হয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ। সন্দেহ নেই কংগ্রেস হয়তো এভাবেই চিন্তা করেছে।
কংগ্রেসের এই চিন্তা ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার চিন্তার অনুরূপ। ফ্যান্সিস ফকুয়ামা পৃথিবীর শেষ যুদ্ধ দেখতে পেয়েছেন এবং এর মাধ্যমে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে ভবিষ্যতবাণী করেছেন।–[‘The end of History’, Fransis Fukuyama, The National Interest, Summer, 1989.] ফুকুয়ামার মতে সেই যুদ্ধটা সংঘটিত হবে ধর্মীয় আদর্শবাদের সাথে পশ্চিমী ‘উদার নৈতিক গণতন্ত্রের’, যা ভৌগলিক জাতীয়তার সীমা অতিক্রম করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে এবং ইতিহাস পরিপূর্ণতা লাভ করবে। অনেক ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই ফকুয়ামার প্রতিবাদ করেছেন।–[‘The Return of History’ নিবন্ধে Flora Lewis (Sais Review-summer 1990), Responses to Fukuyama’ প্রবন্ধে Allan Bloom (The National Interest, Summer 1989), More Resposes to Fukiyama’ প্রবন্ধে Timothey Fuller The National Interest, Summer, 1989)’, ‘The errors of Endisim’ প্রবন্ধে Samuel p. Huntington (The National Interest, 1989) এবং ‘Huntington’s fault lines’ and Fukuyama’s end of History’: An appraisal’ প্রবন্ধে Tujul Islam Hashmi (Holiday, Dec. 31, 1993) এ বিষয়ের উপর বিস্তারিত ও আকর্ষণীয় আলোচনা করেছেন।] বলেছেন সমাজ ও সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণকারী বিষয় ও উপাদানগুলোকে ফুকুয়ামা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ফুকুয়ামার সমাজ-সভ্যতার সরলীকরণ তত্ত্বটা একেবারেই অবাস্তব। ফুকুয়ামা যা চেয়েছেন তেমন শেষ যুদ্ধও যেমন সামনে নেই, তেমনি ইতিহাসের গতিও রুদ্ধ হচ্ছে না। ভারতীয় কংগ্রেসের ‘শেষ যুদ্ধ’ সম্পর্কেও এই একই কথা। বাংলাদেশে ধর্মবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যত বড় আশাই করুক, একশ্রেণীর ভারতীয়দের বিশেষ রাজনীতি এর প্রতি যতই সাহায্যের হাত বাড়াক, বাংলাদেশের জনগণ এবং জনগণের আদর্শের শক্তির চাইতে তা বড় হবে না। ’৯৬ সালে এই রাজনীতির বিজয় হয়েছিল, কিন্তু ২০০১ সালে এসেই সে রাজনীতির পরাজয় ঘটেছে। জনগণ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হলেও ধর্মবিরোধী, সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির চেহারা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। সুতরাং কোন যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ নয় এবং বাংলাদেশে কোন শেষ যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশাগত উপাদান বাদ দিলে এখানে বৈপরীত্যের চেয়ে সমন্বয়ের এই উপাদানগুলিই মৌল প্রকৃতির। বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটি প্রকৃতপক্ষে বিদেশাগত বিজাতীয় অনুপ্রবেশের ফল। কিন্তু এ ধারাটির যারা ধারক তাদের হৃদয় ধর্মীয় আদর্শবাদমুক্ত নয়, মুক্ত করাও সম্ভব নয়। তাইতো আমরা দেখি, ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি যারা করেন তাদের অনেকেই এমনকি তাহাজ্জুদগোজারও।–[আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকলেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলেন, তাদের অনেকে তাহাজ্জুদ নামাজও পড়েন। এমনকি কম্যুনিষ্ট বলে পরিচিত লোকরাও আজান হলে অনেকে মসজিদে দৌড়ান। তাদের হৃদয় যে ঈমান দৃপ্তি এটা তারই প্রমাণ। আমি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ড্রইং রূপে যেদিন কোরআন দেখলাম, যায়নামাজ দেখলাম, সেদিন সত্যিই আমার বুকটা এক অনাস্বাদিত গৌরবে ভরে গিয়েছিল। এই ঈমান তাদের রাজনীতির চেয়ে বড়, সময় এলেই তার প্রমাণ তারা দেবে। এমনও হতে পারে দ্বিতীয় ধারার যে রাজনীতি, সে রাজনীতির প্রধান শক্তি তারাই হয়ে দাঁড়াবে।] এছাড়া রয়েছে জনগণের চাপ। ধর্মবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যারা করেছেন, তারা কিন্তু তাদের পরিচয় জনগণকে বলতে সাহস পান না। বরং তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ স্লোগান নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হন। সুতরাং দেশের শিক্ষার হার আরও বাড়লে, জনগণ আরও সচেতন হলে এবং দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে দেশে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি আর থাকবে না এবং দেশের রাজনীতিতে আদর্শিক প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ সুদিনের আগমন কতদূরে তা নির্ভর করছে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত দ্বিতীয় রাজনৈতিক ধারাটির ইতিবাচক ও স্বাধীন রাজনীতির সংহতি ও শক্তিবৃদ্ধি এবং সার্বিক সচেতনতা ও গণজাগরণের উপর।