দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পার্থিব কল্যাণ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এত সব ত্যাগ ও বিসর্জন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। এ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার কাজটা যে শুধু পরকালের জন্য মঙ্গলজনক তা নয়, বরঞ্চ আল্লাহর বন্দেগী ও আনুগত্যের ভিত্তিতে যে সমাজ, যে তাহযিব ও তামাদ্দুন গঠিত হবে, সেখানে বিরাজ করবে পরিপূর্ণ ইনসাফ এবং জান ও মালের পূর্ণ নিরাপত্তা।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৫১ পৃষ্ঠায়****************************)
-হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাজ হরো এই যে, তোমরা ইনসাফ ও ন্যায় নীতির ধ্বজবাহী এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। (নিসাঃ ১৩৫)
কথা এখানে এতটুকু বলা হয়নি যে, “তোমরা ইনসাফ কায়েম কর”। বরঞ্চ বলা হয়েছে যে, “ইনসাফ ও ন্যায়-নীতির ধ্বজবাহী হয়ে যায়। তার অর্থ হলো মু’মিনদের কাজ শুধু ইনসাফ কায়েম করাই নয়, ইনসাফের পতাকাবাহী তাদেরকে হতে হবে। তাদেরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এব বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে যাতে করে নিপীড়িত মানব সমাজ থেকে জুলুম, অত্যাচার, অন্যায় ও বে-ইনসাফীর মূলোৎপাটন হয় এবং তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় সুখ-শান্তি, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও পূর্ণ-সুবিচার।
অতঃপর এ মহৎ কাজের সাক্ষ্য দিতে হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নিকটে। ব্যক্তিগত বা দলীয় কোন স্বার্থে অথবা মানুষের প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে যেন এ কাজ করা না হয়, তার জন্য সতর্ক বাণী রয়েছে এ আয়াতে।
বিপদে পৃষ্ঠ প্রদর্শন ঈমানের পরিপন্থী
দ্বনি প্রতিষ্ঠার কাজে যে নানারূপ বিপদের, ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হতে হবে তা এক অবধারিত সত্য। এ বিপদের ঘন্টাধ্বনি শ্রবণ করে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা যে ঈমানের পরিপন্থী সে সম্পর্কে কুরআন বলে-
(আরবী পিডিএফ ৫২ পৃষ্ঠায়****************************)
-হে মু’মিনগণ! ভালো করে জেনে রেখে দাও যে, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ দ্বীন থেকে সরে পড়ে, তো পড়ুক। এরপরও আল্লাহ এমন বহু লোক পয়দা করবেন যারা হবে আল্লাহর প্রিয় এবং আল্লাহও তাদের প্রিয় হবেন। আর যারা মু’মিনদের প্রতি হবে উদার ও কোমল এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর এবং যারা আল্লাহর পথে চরম প্রচেষ্ঠা চালাবে। এ ব্যাপারে তারা কারো তিরস্কার, তর্ৎসনার পরোয়াই করবে না। (মায়েদাহঃ ৫৪)
দ্বীন থেকে সরে পড়ার পর ঈমানের আর কোনো প্রশ্নই থাকে না। এখন এই ঈমানহীন লোকের পরিবর্তে আল্লাহ যাদেরকে ময়দানে নিয়ে আসেন, তারা আলবৎ ঈমানদার। আল্লাহর সঙ্গে গড়ে ওঠে তাদের ভালোবাসার সম্পর্ক। তারা আল্লাহর প্রিয় হয় এবং আল্লাহ হন তাদের প্রিয়। এখন মু’মিনের পরিচয় হলো এই যে তারা মু’মিনদের প্রতি হবে কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।
‘মু’মিনদের প্রতি কোমল’ কথার অর্থ এই যে, একজন মু’মিন অন্য কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে কিছুতেই আপন শক্তি প্রয়োগ করবে না। তার প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, যোগ্যতা, প্রভাব প্রতিপত্তি, ধন-সম্পদ, দৈহিক শক্তি প্রভৃতি কোন কিছুই মুসলমানদেরকে দমিত, উত্যক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজে ব্যবহৃত হবে না। মুসলমান সমাজ তাকে সর্বদা একজন কোমল প্রাণ, দয়ালু, সহানুভূতিশীল ও ধৈর্যশীল লোক হিসেবে দেখতে পাবে।
“কাফিরদের প্রতি কঠোর’ কথাটির তাৎপর্য এই যে, একজন মু’মিন ঈমানের পরিপক্কতা, একনিষ্ঠ দ্বীনদারী, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, চরিত্রের অদম্য শক্তি প্রভৃতি গুণাবলীর কারণে ইসরামের শত্রুর মোকাবিলায় হবে ইস্পাত কঠিন, যাতে করে তাকে তার আপন স্থান থেকে কিছুতেই বিচ্যুত করা না যায়। সে না কারো ভয়ে-শংকিত হবে, না কারো কথায় বিগলিত হবে। প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হলে সে জীবন দিবে। কিন্তু কোনো মূল্যেই নতি স্বীকার করবে না অথবা প্রভাবিত হবে না।
ঈমানের পরিচয়ে আরও বলা হয়েছে যে, সে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করে যাবে। তার জন্য সে কারো তিরস্কার বিদ্রুপের কোন পরোয়া করবে না। না তার চলার গতিকে সে কখনো মন্দিভূত করবে।
এখন কথাটি অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঈমানের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় হলো এই যে, আল্লাহর দ্বীনকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করে যাওয়া এবং এর ফলে একজন মু’মিন যেমন আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হয়ে পড়বে, তেমনি আল্লাহও তার কাছে হবেন সবচেয়ে প্রিয়।
বলা বাহুল্য এ সংগ্রামের ভেতর দিয়েই ঈমানের সত্যিকার পরীক্ষা হয়। এভাবে পরীক্ষার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত মু’মিনদেরকেই বেছে আলাদা করে নেন এবং তাদেরই দ্বারা কাফিরদেরকে পরাভূত করেন। (আলে ইমরানঃ ১৪২)
এ সংগ্রাম ব্যতীত না ঈমানের কোন সাক্ষ্য দান করা সম্ভব হবে, আর না পরজীবনে বেহেশত লাভ করা যাবে। আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৫৩ পৃষ্ঠায়****************************)
(তোমরা কি বেহেশতে যাওয়ার আশা পোষণ করে বসে আছ, যতোক্ষণ না আল্লাহ পারলেন যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তোমাদের মধ্যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম কারা করলো এবং যতোক্ষণ না আল্লাহ এ কথাও জানতে পারলেন যে, কারা অবিরাম ধৈর্য সহকারে এ পথে চললো। (আলে ইমরানঃ ১৪২)
ঈমানের প্রেরনার উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দ্বীনের পথে চলা শুরু করেছেন, যে পথের গন্তব্যস্থান হলো দ্বীনে হকের প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁদেরকে যে প্রতি পদে পদে চরম বাধার সম্মুখীন হতে হবে, তা আগের আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়েছে এবং ইসলামের অতীত ইতিহাসও তার সাক্ষ্য বহন করছে। এখন এ পথে যাঁরা চলেন, তাঁদের মধ্যে একজন সাধারণ মু’মিন অথবা দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কোন কর্মী বা নেতা যদি জীবন ও ধন-সম্পদ বিপন্ন হওয়ার আশংকায় বাতিলের কাছে নতি স্বীকার করে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিত্যাগ করে বাতিলের সাথে সহযোগিতার আকুল আগ্রহ দেখান, তাহলে ঈমানের গণ্ডি থেকে তিনি বেরিয়ে যাবেন এবং এমন ব্যক্তিকে মুনাফিক ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যাঁরা করেন, তাঁদের এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। তাঁদের প্রত্যেকের এমন প্রশিক্ষণ হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং এ মুহুর্তে অগ্নি পরীক্ষার ভেতর দিয়ে অবশ্যই হতে হবে, যাতে করে কোন চরম মুহুতেৃ দ্বীন প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের কোন কর্মী জীবন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তার জন্য অথবা সন্তান-সন্তুতির সুখ স্বাচ্চন্দের জন্য বাতিলের কাছে আত্মসমর্পণ না করে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব যিনি দিবেন, তাঁকে হতে হবে অধিকতর উন্নত চরিত্রের অধিকারী। আপন জীবন, ধন-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র পরিজন সব কিছুকেই আল্লাহর পথে উৎসর্গ করার মনোবল ও সাহস যাঁর আছে এবং বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নজির যিনি পেশ করেছেন, তিনিই দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনার নেতৃত্ব দিতে পারেন। যদি দুর্বল চরিত্রের লোক নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়, তাহলে যে কোন চরম মুহুর্তে গোটা আন্দোলনকে নিয়ে সে নিমজ্জিত হবে এবং রেখে যাবে এক কলংকের ইতিহাস।
আশা করি এরপর বিষয়টি বুঝতে মোটেই কষ্ট হবার কথা নয়। এমনিভাবে যদি আমরা সমগ্র কুরআন পাক আলোচনা করি তাহলে জানতে পারব যে, ঈমানের দাবী শুধু ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাই নয়। ঈমানের দাবী শুধু ইসলামের পাচঁটি স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাই নয়। ঈমানের দাবী অনুযায়ী এ হলো কাজের সূচনা মাত্র। দরজা, জানালা ও ছাদসহ অট্টালিকা নির্মাণ হলেই এ কাজের সমাপ্তি বুঝতে হবে। অনুরূপভাবে ইসরামের প্রাসাদ নির্মাণের জন্য তার সূচনা হরো পাঁচ স্তম্ভের নির্মাণ বা প্রতিষ্ঠা। এ স্তম্ভের উপরে গোটা প্রাসাদ নির্মাণ করাই ঈমানের পরবর্তী দাবী। সে সব দাবী একটি একটি করে কুরআনে বলা হয়েছে। আর এসব দাবী পরিপূর্ণরূপে পারন করেছেন আল্লাহর নবী (স) ও তাঁর প্রিয় সাহাবায়ে কিরাম (রা)। তাই ঈমানের দাবী পরিপূর্ণরূপে পালন করতে হরে একদিকে যেমন কালামে পাক গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে, অপরদিকে নবী ও সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র জীবনকেও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করতে হবে।