ঈমানের দাবী
এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো ঈমানের দাবী। তার অর্থ–ঈমান আনার পর ঈমান আনয়নকারীর মধ্যে কী পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। অবশ্যি ঈমান আনার পর তার মধ্যে কোন দৈহিক পরিবর্তন সম্ভবও নয় এবং বাঞ্ছনীয়ও নয়। ঈমান আনার পূর্বে যেমন মানুষটির দুটি হাত, দুটি চোখ, দুটি কান, একটি নাক ও একটি মাথা ছিল; ঈমান আনার পর তার কোন কম বেশী হবেনা। তার বর্ণেরও কোন পরিবর্তন হবেনা। কিন্তু পরিবর্তণ অবশ্যই হতে হবে তার মানসিকতার, মতবাদ ও চিন্তা ধারার; তার স্বভাব-প্রকৃতির, চরিত্রের, আচার-আচরণের, রুচি ও মননশীলতার।
ঈমান মানুষটির মধ্যে নিয়ে আসে একটি মানসিক বিপ্লব। যার মন-মস্তিষ্ক ছিল জাহেলিয়াত ও অন্ধ-কুসংস্কারে তমসাচ্ছন্ন, ঈমান আনার পর তার মন-মস্তিষ্ক ইসলামের জ্যোতিতে হবে উদ্ভাসিত। ঈমান আনার আগে যে করতো বহু খোদার বন্দেগী, তার মস্তক ঈমান আনার পর কখনো অবনত হবেনা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে। বাতিল ও খোদাদ্রোহী তাগুতের আনুগত্য পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের জন্য সে বিসর্জন দেবে নিজের পরিপূর্ণ সত্তাকে। লম্পট, ব্যাভিচারী, মিথ্যাবাদী, পরিস্বাপহারী ও দুষ্কৃতকারী ঈমান আনার পর হয়ে পড়বে সৎ, সত্যবাদী, পূণ্য-পুত চরিত্রের অধিকারী, দাতা, দয়ালু ও পরোপকারী।
নামায-রোযা প্রভৃতি ঈমানের সর্বপ্রথম দাবী
ইমান আনার সাথে সাথেই একজন মু’মিনের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে কতকগুলো কাজ সমাধা করা। এগুলো তার ঈমানের বহিঃপ্রকাশ, ঈমানের সাক্ষ্য। তা হলো, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও তা জামায়াতের সঙ্গে আদায় করা, রমযানের রোযা রাখা, মালদার হলে যাকাত আদায় করা এবং হজ্ব আদায় করা। কিন্তু এসব করার পরও যদি তার মত মানসিকতায় পরিবর্তন না হয়, পরিবর্তন যদি না হয় তার স্বভাব-চরিত্রের; তাহলে বুঝতে হবে তার নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব প্রভৃতি চরিত্র গঠনমূলক কাজগুলো তার সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়নি এবং তা কবুল হয়নি আল্লাহর দরবারে। এতে করে ঈমানের চাহিদাও তার মোটেই পূরণ করা হয়নি।
অনেকে মনে করে থাকেন, উপরে বর্ণিত কাজ যেমন নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব পালন করলেই তাকে পূর্ণ মূ’মিন বলা হবে। এইতো যথেষ্ট। আর কি চাই?
সকলের জন্য নামায-রোযা এবং মালদারের জন্য যাকাত-হজ্ব ফরয করা হয়েছে। এগুলো ব্যতীত কারো মু’মিন হওয়ার তো ধারণাই করা যেতে পারেনা। ইসলাম রূপ প্রাসাদের ভিত্তিস্তম্ভ বলা হয়েছে এগুলোকে। ভিত্তি ব্যতীত প্রাসাদের কল্পনাই তো করা অবান্তর। কিন্তু তাই বলে বিত্তিই কি প্রাসাদ হতে পারে? ভিত্তির উপরে আরও বহু কিছু গড়ে তুললে তখনই তাকে বলা হবে প্রাসাদ। সেজন্য একজন মু’মিনের কাজ শুধু প্রাসাদের ভিত্তি তৈরী করেই নিশ্চিন্তে বসে থাকা নয়। অর্থাৎ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতি সমাধা করলেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়না। তার ঈমান তাকে আরও বহুকিছু করার দাবী করে। ঈমান যা যা করতে দাবী করে একেবারে সাধ্যের অতীত না হলে, তা যদি করা না হয়, তাহলে বলতে হবে তার পরিপূর্ণ মু’মিন হওয়ার বেশ ত্রুটি রয়ে গেছে।
এখন ঈমানের দাবী কি কি যা পালন করলে একজনকে পরিপূর্ণ মু’মিন বলা যেতে পারে? নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাত প্রভৃতি ও ঈমানের দাবী সন্দেহ নেই। কিন্তু এতটুকুতেই তার দাবী শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। তাই আমাদের সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে।
রসূলই মু’মিনদের সর্বোত্তম আদর্শ
এর জন্য সর্বপ্রথম কুরআনে হাকীমের দিকে দৃষ্টিনিবন্ধ করতে হবে। কুরআনের পাতায় পাতায় মু’মিনের কর্তব্যের কথা সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে।
তারপর এ কুরআনকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (স) তাঁর জীবনের বাস্তব কর্ম পন্থা দিয়ে। তাই নবীর গোটা জীবন কুরআন পাকেরই পূর্ণ আলেখ্য। তারপর আসে সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিত্র।
অতএব, ঈমানের দাবী পুরোপুরি পালন করতে হলে একদিকে যেমন কুরআন থেকে এ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে হবে। অপরদিকে, নবী করিম (সা) ও সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিত্রের পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে।
পূর্ণ মু’মিন হওয়ার জন্য নবী জীবনের অনুকরণ একেবারে অপরিহার্য। তাই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন-
(আরবী পিডিএফ ১৮ পৃষ্ঠায়*****************************)
-প্রকৃত পক্ষে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে আল্লাহর রসূলের মধ্যে। এ আদর্শ প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহকে পাবার এবং আখিরাতের নাজাত লাভ করার আশা পোষণ করে। (আহযাবঃ২১)
এ আয়াতটি আহযাব যুদ্ধের পর পর নাযিল হয়েছে। উহুদ থেকে শুরু করে আহযাব যুদ্ধ পর্যন্ত গোটা পরিস্থিতিকে সামনে রেখে রসূল (স)-এর আচার-আচরণ, চরিত্র ও কর্মপদ্ধতিকে এখানে সর্বোত্তম নমুনা হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো ঐসব লোকদের শিক্ষা দেয়া, যারা আহযাব যুদ্ধের সময় পার্থিব স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অপরের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবার চেষ্টা করেছিল। তাদেরকে বলা হচ্ছে, তোমরা তো ঈমান, ইসলাম এবং রসূলের আনুগত্যের কথা ফলাও করে বলে থাক। কিন্তু তোমাদের একথা ভালো করে জেনে রাখা দরকার যে, যে রসূলের অনুরাসীদের মধ্যে তোমরা শামিল হয়েছো বলছো সে রসূলের আচরণ কি ছিল? যদি কোন দলের নেতা আরামপ্রিয়তার পরিচয় দেয়, ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এবং বিপদের সময় পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, তাহলে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। কিন্তু রসূলে পাকের (স) অবস্থা এই ছিল যে, তিনি অপরকে যেমন বিপদের ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নিজেও সেই ঝুঁকি নিয়েছেন। এবং তার জন্য তিনি ছিলেন সকলের পুরো ভাগে। এমন কোন দুঃখ-কষ্ট, অত্যাচার-নির্যাতন ছিলনা, যা অপরে ভোগ করেছে আর তিনি তা করেন নি। খন্দকের খোদাই কাজে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেছেন। অবরোধ কালে তিনি সবসময় যুদ্ধের সম্মুখভাগে অবস্থান করতেন এবং একমুহূর্তের জন্যও দুশমনের মুকাবিলা থেকে পশ্চাদপদ হননি। বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার পর মুসলমানদের পরিবার পরিজন যেভাবে বিপন্ন হয়েছিল তার পরিবার পরিজনও অনুরূপভাবে বিপন্ন হয়েছিল। রসূল (স) মুসলিমদের একচ্ছত্র নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পরিবার বর্গের নিরাপত্তার কোনই বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়নি। যেমন উদ্দেশ্যের জন্য নবী অপরের কাছে অসীম ত্যাগ ও কুরবানী দাবী করছিলেন, তিনি সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন স্বয়ং সে কুরবানী দেয়ার জন্য এবং দিয়েছেনও। অতএব, যারাই তাঁর আনুগত্যের দাবীদার, তাদের উচিত নবীর প্রতিটি আচার-আচরণ সর্বোত্তম আদর্শ ও নমুনা হিসেবে গ্রহণ করে তার পূর্ণ অনুকরণ করা।
তৎকালীন অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই হলো আয়াতের মর্ম ও ব্যাখ্যা। কিন্তু এই মর্ম কোন বিশেষ অবস্থা ও কালের মধ্যেই সীমিত থাকার কথা নয়। যেহেতু কুরআন সর্বকালের মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক, তাই এ আয়াতের দ্বারা রসূলের জীবনকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের সকল মানুষের জন্য আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। মুসলমান প্রতিটি ব্যাপারে রসূলের জীবনকে নিজের জীবনের জন্য নমুনা হিসেবে গ্রহণ করবে এবং তারই ছাঁচে ঢেলে তৈরী করবে আপন চরিত্র।
এর থেকে জানা গেল, একজন মু’মিনের জীবনের লক্ষ্য হলো, তার জীবনের প্রতিক্ষেত্রে, প্রতি পদক্ষেপে, রসূল পাকের (স) চরিত্র, আচার-আচরণ ও কর্মপদ্ধতির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ ও অনুকরণ করা।
এটাই তার ঈমানের সর্ববৃহৎ দাবী। কুরআন অন্যত্র বলেঃ
(আরবী পিডিএফ ২০ পৃষ্ঠায়*****************************)
আল্লাহর রসূল তোমাদেরকে যা কিছু দেন, তা গ্রহণ কর এবং যতকিছু থেকে দূরে থাকতে বলেন, তার থেকে নিজকে দূরে রাখ এবং ভয় কর আল্লাহকে। অবশ্যই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। (হাশরঃ৭)
‘যা কিছু দেন’ কথার অর্থ হলো যে বিধান এবং জীবন সমস্যার যে সমাধান দেন। এসব বিধান এবং সমাধান একজন মু’মিনের জন্য প্রতি মুহূর্তেই গ্রহণীয় এবং অবশ্য পালনীয়।
পক্ষান্তরে, যেসব বিষয় থেকে রসূল মু’মিনদেরকে বিরত থাকতে বলেন, তার থেকে বিরত থাকা অথবা কোনক্রমেই তা গ্রহণ না করাও ঈমানের দাবী। এ বিষয়ে নবী পাকের (স) এরশাদ হচ্ছে-
(আরবী পিডিএফ ২০ পৃষ্ঠায়*****************************)
যখন আমি তোমাদেরকে কোন বিষয়ে আদেশ করি তখন তোমরা সাধ্যানুযায়ী তা পালন করবে। আর যেসব বিষয় থেকে তোমাদেরকে বিরত থাকতে বলি, সেসব থেকে দূরে থাকবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন হযরত আবু হুরাইরা (রা)।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একবার তিনি তাঁর এক বক্তৃতায় বলেন, “অমুক অমুক ফ্যাশনকারিণী মেয়েদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ”।
একথা শুনার পর জনৈক মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, “এমন কথা আপনি পেলেন কোথায়? কুরআনের কোথাও আমার এ ধরনের কিছু নজরে পড়েনি”।
ইবনে মাসউদ (রা) বললেন, “তুমি যদি কুরআন পড়তে তাহলে নিশ্চয়ই তার মধ্যে এ কথা পেয়ে যেতে। তুমি কি এ আয়াত পড়নি?
(আরবী পিডিএফ ২১ পৃষ্ঠায়*****************************)
মহিলাটি বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পড়েছি”।
ইবনে মাসউদ (রা) বললেন, “নবী (স) এরূপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন যে, এ ধরনের ফ্যাশনকারিণীদের উপরে আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন”। -[আজকাল তথাকথিত মুসলিম নারীগণ নিত্যনতুন অত্যাধুনিক ফ্যাশনের প্রতিই আকৃষ্ট হচ্ছে না; বরঞ্চ তাদের অর্ধউলঙ্গ পোষাক শালীনতা ও লজ্জাশীলতার সকল সীমানা লঙ্ঘন করেছে। ঘরের বাইরে যখন তারা বের হয় তখন তাদের সাজ পোষাকের ফ্যাশন, যৌন আকর্ষণকারী অর্ধ নগ্ন দেহ, নিজকে পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় বানাবার প্রতিযোগিতা সমাজে ব্যাপকহারে যৌন উচ্ছৃঙ্খলার ইন্ধন যোগাচ্ছে। এরপরেও তারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে।
পরিতাপের বিষয়, এমনও কিছু লোক দেখা যায়, যার কপালে সেজদার চিহ্ন, মুখে দাড়ি ও মাথায় টুপি এবং মুসল্লি পরহেজগার বলে যে পরিচিত; সে যখন বাড়ির বাইরে বেরোয়, তখন তার সঙ্গে তথাকথিত আধুনিক বেপর্দা যুবতী বেপর্দা মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়। ঈমানের দাবী পূরণ না করে এমন পরহেযগারীর কানাকড়িও মূল্য আছে কী?]
মহিলাটি বললেন, “হ্যাঁ, এবার বুঝতে পেরেছি”।
(বোখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে ইবনে আবি হাতেম)।
যা হোক কুরআনে হাকীম ও নবীর হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত হলো যে, নীতিগতভাবে নবী মুহাম্মদের (স) জীবন পদ্ধতি হলো মু’মিনদের অনুকরণীয়।