ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা
এখন আমরা নবীর তেইশ বছর ব্যাপী নবী জীবনের পর্যালোচনা করে দেখি যে, এই তেইশ বছরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে সত্যিকার অর্থে আল্লাহর প্রিয় পাত্র বানাবার জন্য কি কি প্রেরণা দান করেছেন। অত্যকথায় ঈমানের অপরিহার্য দাবীগুলো কি ছিল।
আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে-
(আরবী পিডিএফ ২২ পৃষ্ঠায়*****************************)
মানুষ কি একথা মনে করে আছে যে, আমরা ঈমান এনেছি–এতটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং ঈমান এনেছে কি তা তা পরীক্ষা করে দেখা হবেনা? (আনকাবুতঃ২)
একজন মু’মিনের কাছে ঈমানের দাবী কি ছিল, তা নবী (স) ও সাহাবায়ে কিরামের মক্কী জীবনের সূচনা থেকেই আল্লাহ সুস্পষ্টরূপে বলে দিয়েছেন।
যে অবস্থার প্রেক্ষিতে উপরের আয়াত নাযিল হয়েছিল তা হলো এই যে, মক্কার যে ব্যক্তিই ইসলাম গ্রহণ করতো, তার উপরে সব রকমের বিপদের পাহাড় ভেঙে পড়তো। দরিদ্র অথবা ক্রীতদাস হলে অমানুষিক জুলুম নিষ্পেষণের শিকার হতো। দোকানদার ব্যবসায়ী হলে তার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হতো এবং সে এক রকম আর্থিক সংকটের সম্মুখীণ হতো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তার ও অব্যাহতি ছিলনা। নির্যাতন নিষ্পেষণে তারও জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হতো। মুশরিক-কাফিরদের অত্যাচার-উৎপীড়নে মক্কায় এমন এক সন্ত্রাস ও বিভীষিকার সৃষ্টি হয়েছিল যে, কতিপয় মুসলমানকে ঈমান বাঁচাবার তাগিদে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে হয়েছিল।
অনেকে আবার নবীর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও ঈমান আনতে ভয় করতো। অনেকে ঈমান আনার পর অত্যাচার-ঊৎপীড়নের চাপে কাফিরদের কাছে নতি স্বীকার করতো। যদিও এহেন ভয়াবহ অবস্থায় সাহাবায়ে কিরামের মজবুত ঈমান তাঁদেরকে আপন সংকল্পে অবিচল রেখেছিল। তথাপি স্বাভাবিক মানবিক দুর্বলতার কারণে অনেকের মনে এক ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল। তার বহিঃপ্রকাশ হয় একটি ঘটনার দ্বারা।
হযতর খাব্বাব বিন আরাত (রা) বলেন, “যে সময়ে আমরা মক্কায় কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েছিলাম, সে সময়ে একদিন দেখলাম নবী (স) কা’বা ঘরের দেওয়ালের ছায়ায় বসে আছেন। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাদের জন্য দোয়া করছেননা?”
“আমার কথায় নবীর মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করলো। বললেন, “তোমাদের পূর্বে যারা আল্লাহর দ্বীনের উপর ঈমান এনেছিল তাদেরকে অধিকতর নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাদেরকে কাউকে জীবন্ত করাত দিয়ে চিরে দু’খণ্ড করা হয়েছে। কারো শরীরের জোড়ায় জোড়ায় তীক্ষ্ণ লৌহ বিদ্ধ করা হতো যাতে করে তারা ঈমান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্য অবশ্যই সফলতা লাভ করব। তখন অবস্থা এমন হবে যে, এক ব্যক্তি সানয়া থেকে হাজরামাওত পর্যন্ত নির্ভয়ে ভ্রমণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তার ভয় করার আর কেউ থাকবেনা”।
এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেছেন বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ এবং নাসায়ী।
এ সন্ত্রাস ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিকে অসীম ধৈর্য সহকারে নীরবে মেনে নেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের হৃদয়ে এ সত্য প্রতিফলিত করেছেন যে, দুনিয়া এবং আখিরাতের সাফল্যের যে ওয়াদা তিনি করেছেন, শুধু শুধু ঈমানের মৌখিক দাবী করেই তা লাভ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তার জন্য অগ্নি পরীক্ষার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেই ঈমানের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।
বেহেশত এত সহজে লাভ করার বস্তু নয় এবং দুনিয়াতেও আল্লাহর খাস নেয়ামত সমূহ এমন সহজলভ্য নয় যে, ঈমান আনার ঘোষণা করা মাত্রই তা লাভ করা যাবে। লাভ করা জন্য শর্ত হচ্ছে অগ্নি পরীক্ষা।
ঈমান আনার সাথে সাথেই বহু কিছু গ্রহণ ও বর্জন করতে হয়। গ্রহণ ও বর্জনের সর্ব প্রথমে সংঘাত-সংঘর্ষ হবে প্রবৃত্তির সাথে। একজন মু’মিনকে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হতে হবে।
ঈমান আনার পর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুঃখ-কষ্ট এবং জান ও মালের ক্ষতি বরদাশত করতে হবে। ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও লোভ-লালসার দ্বারা পরীক্ষা করা হবে। প্রতিটি প্রিয় বস্তু, ভালোবাসার পাত্র আল্রাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে হবে। এতসব করার পরই ঈমানের সত্যতা প্রমান করা সম্ভব হবে।
বলা বাহুল্য নবী (স) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) ঈমানের দাওয়াত দেয়া ও গ্রহণ করার পর মুহুর্ত থেকেই এসব অগ্নি পরীক্ষার ভেরত দিয়েই কালাতিপাত করেছেন।
তাহলে একথা দিবালোকের মতো পরিস্কার হয়ে গেল যে, ঈমান আনার পর ঈমানের সত্যতা প্রমান করাই হলো সর্বপ্রথম দাবী এবং এ সত্যতার প্রমাণ দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে।
নবী ও সাহাবায়ে কিরামের মক্কী ও মদনী জীবনে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ঈমানের মজবুতির জন্য তথা ঈমানকে বাস্তব জীবনে রূপায়িত করার জন্য যেসব এরশাদ করেছেন, দৃষ্টান্ত স্বরূপ তার কিছু উল্লেখ করা যাক।
মু’মিনের জন্যে আল্লাহর ভালোবাসা হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে
মনে রাখতে হবে যে, কালেমায়ে তাইয়্যেবার মাধ্যমে ঈমানের ঘোষণা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। সেজন্যে হক ও বাতিলের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। একদিকে আল্লাহ অবিশ্বাসী খোদাদ্রোহী ও আল্লাহবিমুখ ইসলামের দুশমন শক্তি অপরদিকে মুষ্টিমেয় হক পুরস্ত ঈমানদারদের ইসলামী শক্তি। ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম বিজয়ী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ উভয় শক্তির মধ্যে সর্বদা চলেছে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ। একটি ছিল আল্লাহর প্রিয় দল (হিযবুল্লাহ) এবং অপরটি ছিল শয়তানের দল (হিযবুশ শায়তান) –বাতিল দর্শন ও মতবাদের দল। এমতাবস্থায় বাতিলের মুকাবিলায় মুসলমানদের ঈমানের দাবী ছিল আল্লাহর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সম্বন্ধ গভীর নিবিড় করা। প্রেম ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা, আনুগত্য, ভয়-ভীতি একান্তভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া।
এ ব্যাপারে আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে
(আরবী পিডিএফ ২৫ পৃষ্ঠায়*****************************)
কিছুলোক এমনও আছে যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্যদের তাঁর শরীক ও প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে নেন এবং তাদের প্রতি এতটা প্রেমানুরাগী হয় যতটা হওয়া উচিত ছিল আল্লাহর প্রতি। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সবকিছু অধিক ভালোবাসে। -(বাকারাহঃ১৬৫)
অর্থাৎ ঈমানের দাবী হচ্ছে এই যে, একজন মু’মিনের জন্য আল্লাহর ভালোবাসা অন্যান্য সকল ভালোবাসার উপরে প্রাধান্য লাভ করবে। কোন কিছুর ভালোবাসাই মু’মিনের মনে এমন স্থান লাভ করতে পারবেনা যা আল্লাহর ভালোবাসার জন্য নির্ধারিত এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের কেবল সেই ভালোবাসা পোষণ করা যায়।–[আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্যদের প্রতি প্রেমানুরাগী তো কাফির মুশরিকরাই হতে পারে। কিন্তু মুসলিম নামে পরিচিত কিছু লোকের মধ্যেও এ ধরনের মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। এদের অনেকে নামায-রোযা, কালেমা যিকর প্রভৃতিও করে এবং আল্লাহ ও রসূলের প্রতি গভীর প্রেমানুরাগের মহড়াও করে। কিন্তু এদের সম্পর্ক ফাসিক-ফাজিল-কাফির মুশরিকদের সাথে। তাদেরকে তুষ্ট রাখার জন্য তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকে। তাদেরকে তুষ্ট করলে যেহেতু তাদের পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা যায়, সেজন্য আল্লাহর অসন্তুষ্টির পরোয়া না করেও তারা এসব গায়রুল্লাহকে (আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যকে) সন্তুষ্ট রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের আনুগত্য করতে গিয়ে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয়। আল্লাহর আইন কানুনকে পদদলিত করে যারা নিজেদের রচিত আইন-কানুন সমাজে চালু করে, তাদের সাথে এদের দহরম-মহরম রাখতে হয়। নতুবা তারা তাদের হালুয়া রুটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে]