বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ঈমানের অর্থ ও মর্ম
ঈমানের দাবী এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে ঈমান বলতে কি বুঝায়।
ঈমান অর্থ কোন কিছুকে নির্ভুল ও সত্য মনে করে তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করা। পরিভাষা হিসেবে ঈমান শব্দটির অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনে হক্ ইসলামকে সত্য ও চিরন্তন বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা। তার সাথে বিশ্বাস করা আখিরাত, রিসালাত, আল্লাহর সকল ফেরেশতা ও তাঁর নাযিল করা সকল আসমানী কিতাব।
আল্লাহকে বিশ্বাস করা বা আল্লাহর উপরে ঈমান আনার অর্থ তাঁকে তাঁর যাবতীয় গুণাবলী সহ বিশ্বাস করা। অর্থাৎ তিনিই সমুদয় সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা, প্রভু, বিশ্ব জাহানের সর্বশক্তিমান মালিক ও পরিচালক, মানুষের একমাত্র ইলাহ, বাদশাহ, প্রতিপালক, শাসক ও আইন দাতা। সকল প্রকার স্তবস্তুতি, বন্দেগী, দাসত্ব-আনুগত্য একমাত্র তাঁরই জন্যে। তিনি আদি, অনন্ত এক ও একক। তিনি সর্বজ্ঞ। এমনি অসংখ্য গুণে তিনি গুণান্বিত। এসব গুণেরও তিনি একমাত্র অধিকারী। এসব গুণে তাঁর নেই কোন শরীক, কোন প্রতিদ্বন্দ্বী।
আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টের, প্রভু ও দাসের, বাদশাহ ও প্রজার শাসক ও শাসিতের। মানুষকে প্রতি মুহুর্তে আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে, তাঁরই শাসন মেনে চলতে হবে, তাঁরই কাছে ভক্তি-শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত করতে হবে। তাঁরই গুণকীর্তন করতে হবে। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যে নিজের জীবন, ধন-সম্পদ উৎসর্গ করতে হবে।
আরেকদিক দিয়ে চিন্তা করলে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, ঈমান প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে প্রভু ও দাসের মধ্যে এবং বাদশাহ ও প্রজার মধ্যে একটা মজবুত চুক্তি। অর্থাৎ বান্দাহ আল্লাহর সাথে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে এই বলেঃ হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রভু বা মনিব এবং আমি তোমার বান্দাহ বা দাস, তুমি আমার বাদশাহ এবং আমি তোমার প্রজা। অতএব, আমি তোমার দাস হিসেবে এবং তোমার প্রজা হিসেবে তোমার সব আদেশ এবং সব আইন মেনে চলব সর্বদা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে। চুক্তির অংশকুটু মেনে নিলে তা পরিপূর্ণ হবে না। তার সাথে এ কথাও বলতে হবে, হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া আর কারো হুকুম, শাসন এবং আর কারো আইন মেনে চলবোনা। অর্থাৎ আল্লাহ বিরোধী সকল শক্তি ও সত্তার আধিপত্য ও আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র তোমারই প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, আনুগত্য ও আইন মনে প্রাণে মেনে নেব। এ শর্তে তোমার সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছি।
আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ১২ পৃষ্ঠায়************)
অর্থাৎ যে তাগুতকে তথা খোদাদ্রোহী শক্তি ও তার হুকুম-শাসন ও আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করলো এবং তারপর আল্লাহর উপর ঈমান আনলো। এর সহজ-সরল অর্থ, ঈমানের পূর্বশর্ত হলো গায়রুল্লাহকে তথা আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল শক্তি ও সত্তাকে প্রত্যাখ্যান। এ কথাগুলো ছোট্ট একটি বাক্যে বলা হয়েছেঃ তা হলো- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।
ঈমানের উপর ঘন্টার পর ঘন্টা যতই আলোচনা করিনা কেন, কিন্তু জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে যদি আল্লাহর হুকুম-শাসন মেনে চলি এবং বহুক্ষেত্রে খোদা বিমুখ ও খোদাদ্রোহী শক্তির হুকুম-শাসন মেনে চলি, তাহলে তা হবে প্রকৃত ঈমানের পরিপন্থী এবং ঈমানের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রূপ। আল্লাহকে স্রষ্টা, রিজিকদাতা ও পালনকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করা, সাথে সাথে তাঁকে আইনদাতা হিসেবে মানতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কিভাবে চললে তার ইহজীবন ও পর জীবন সুখী ও সুন্দর হবে তার জন্য আল্লাহ নির্ভুল আইন দিয়েছেন। এ নির্ভুল আইন প্রণেতা এত মাত্র তিনি, তাঁর আইন পরিহার করে, মানুষের মনগড়া আইন মেনে চলে আল্লাহর সাথে মানুষকে তাঁর অংশীদার গণ্য করা হয় যাকে শিরক বলা হয় যা ঈমানের বিপরীত।
মসজিদে নিয়মিত নামায পড়া এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষের আইন বিনা দ্বিধায় ও সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া ঈমানের পরিপন্থী কাজ।
তাঁর আইন, শাসন মানতে হলে তা যেমন ভালো করে জানা দরকার, তেমনি জানা দরকার তাঁর পূর্ণ পরিচয়। আরও জানা দরকার কিভাবে তাঁর বন্দেগী ও স্তবস্তুত করা যায়, কি কাজ করলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন এবং কি করলে হবেন অসন্তুষ্ট। এসব জানাবার জন্যে মানবজাতির সূচনা থেকেই আল্লাহ ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তা হলো এই যে, তিনি যুগে যুগে সকল দেশে সকল জাতির মধ্যে এক একজন করে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁকে আল্লাহ এসব বিষয়ে সরাসরি সকল জ্ঞান দান করেন, তাঁকে সকল ভুলের ঊর্ধ্বে রাখেন এবং প্রতিমুহুর্তে তাঁকে পথপ্রদর্শন করেন। এসব নবী-রসূলকে ও সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। অর্থাৎ তাঁদের উপরেও পূর্ণ ঈমান আনতে হবে। এই হলো রিসালাতের উপর ঈমান।
দুনিয়ার মানবজাতির কাছে লক্ষাধিক নবী-রসূল পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)। আল্লাহর দ্বীনে হক ‘ইসলাম’ তাঁর মাধ্যমে পরিপূর্ণ রূপে গ্রহণ করেছে। তাঁকে বিশ্বাস করতে হবে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল হিসেবে।
এমনিভাবে ঈমান অর্থ মৃত্যুর পর এক দ্বিতীয় জীবনের উপরও বিশ্বাস স্থাপন করা। এ দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন নয়। মৃত্যুর সাথে সাথে জীবনের শেষ তা নয়। বরঞ্চ তারপরও জীবন চলতে থাকবে।
কিয়ামত ও হাশর
সমস্ত সৃষ্টি যেমন আল্লাহর, তেমনি তাঁরই নির্দেশেই একদিন এই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং তন্মধ্যস্থ যাবতীয় সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তায়ালা এক জগত সৃষ্টি করবেন। তারপর আবার আল্লাহর ইচ্ছায় মৃত্যুবরণকারী প্রতিটি মানুষ পুনর্জীবন লাভ করবে এবং আল্লাহর দরবারে তাদেরকে একত্র করা হবে। একে বলে কিয়ামত। এখানে প্রতিটি মানুষকে দুনিয়ার জীবনের হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে। মানুষকে যে দায়িত্ব সহকারে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল, তা তারা ঠিকঠিক পালন করেছে কিনা, আল্লাহর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করেছে, না ভ্রান্ত পথে চলেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব নেয়া হবে। একে বলে হাশর।
আখিরাত
এ হিসাব-নিকাশের পর যারা ভালো ও সৎ বলে প্রমাণিত হবে, তাদেরকে দেয়া হবে এক অফুরন্ত সুখের স্থান, যেখানে তারা বসবাস করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যাকে বলা হয় জান্নাত বা বেহেশত।
পক্ষান্তরে যারা অসৎ, পাপী ও খোদাদ্রোহী বলে প্রমাণিত হবে, তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। যা এক অতীব দুঃখ-কষ্টের স্থান। এখন থেকে মানুষের জীবন হবে এক চিরন্তন জীবন যার শেষ নেই, অন্ত নেই। একে বলা হয় আখিরাত।
ফিরিশতা
আল্লাহর অসংখ্য ফিরিশতা আছেন। তাঁরা সকলেই আল্লাহর আজ্ঞাবহ দাস। বরঞ্চ আদেশ পালন করাই তাঁদের প্রকৃতি ও স্বভাব। তাঁরা সর্বদা আল্লাহর স্তবস্তুতিতে মগ্ন আছেন। আবার তাঁদের অনেকের উপরে এই বিশ্ব প্রকৃতি পরিচালনার ভার ন্যস্ত আছে। আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তাঁরা এ পরিচালনা করে থাকেন। এদের উপরও পূর্ণঈমান আনতে হবে।
আসমানী কিতাব
তারপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর নির্দেশনামা সম্বলিত আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন তাঁর নবী-রসূলগণের কাছে। এ গুলোর উপরেও পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ‘ আল-কুরআন’ যা নাযিল করা হয়েছিল সর্বশেষ নবী ও রসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (স)-এর উপরে।
ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন শুধু মনে মনে করলেই তা যথেষ্ট হবেনা, মৌখিক স্বীকৃতি ও ঘোষণা প্রয়োজন। একটি পবিত্র কালেমা উচ্চারণের মাধ্যমে ঈমানের ঘোষণা ও স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়।
এ কালেমাটিতে (বাক্য) কুরআনে ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ বলা হয়েছে। তা হলো, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ”।
এর সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো, এ কথা ঘোষণা করা যে, আল্লাহ ব্যতীত এমন আর কেউ নেই, যে ইলাহ হতে পারে। যার কাছে মাথা নত করা যেতে পারে। যার আনুগত্য, বন্দেগী, দাসত্ব করা যেতে পারে। যার আইন-শাসন মানা যেতে পারে। যাকে স্রষ্টা, প্রভু ও প্রতিপালক মনে করা যেতে পারে। এ হলো কালেমাটির প্রথমাংশের অর্থ ও মর্ম।
দ্বিতীয়াংশে বলা হচ্ছে– মুহাম্মদ (স) আল্লাহর রসূল। অর্থাৎ গোটা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তিনি আল্লাহর প্রেরিত রসূল। আল্লাহর আনুগত্য, বন্দেগী, দাসত্ব ও তাঁর আইন-শাসন মেনে চলার ব্যাপারে তিনিই পন্থা বলে দেবেন। এ পথের প্রদর্শক তিনি। মানব জীবনের যাত্রা পথের নেতৃত্ব দিবেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবেন। স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, ভালো-মন্দ তিনিই শিক্ষা দিবেন। তাঁর শিখানো নীতি ও দর্শনের ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে মানবের তাহযিব-তামাদ্দুন সভ্যতা-ভব্যতা, শিল্পকলা, রুচি ও মননশীলতা। মোট কথা তিনি বিশ্ব মানবতার একচ্ছত্র নেতা।
উপরে যা কিছু বলা হলো, তা হলো ঈমান ও ঈমানের মূলমন্ত্র কালেমায়ে তাইয়্যেবার সংক্ষিপ্ত মর্ম।