বাঁচবার উপায় কি?
বাঁচতে হলে তার একটি মাত্র পথ হচ্ছে এই যে, ঈমানের ভিত্তিতে আমরা আমাদের মুসলমান নামে অভিহিত করি সে ঈমানের দাবী পূরণ করতে হবে। পূরণ করতে হলে নিম্নের কর্মসূচী মনে প্রাণে গ্রহণ করে তা কার্যকর করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
এক. আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর কুরআন ও তাঁল শেষ নবীর সুন্নাহর স্মরণাপন্ন হতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নবী পাকের ও সাহাবায়ে কিরামের সীরাত থেকে ইসলামের প্রকৃত রূপ ও আকৃতি জেনে নিতে হবে। মুসলমানের পতনযুগে বাইরের চিন্তাধারা ও ভ্রান্ত দর্শন ইসলামের গায়ে জাহেলিয়াত ও আল-কুরআন যে ইসলাম পেশ করেছে, নবী পাক (স) যে ইসরাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেটাকে ভারো করে জেনে নিতে হবে।
দুই. আমাদের প্রত্যেককে ইসলামের মুবাল্লেগ হতে হবে। সত্যিকার ইসলাম মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। এটা সফল হবে তখন, যখন প্রত্যেক মুবাল্লিগ তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের মূর্ত প্রতীক হবে।
এ উদ্দেশ্যে সাধারণ ওয়ায মাহফিল থেকে বেশী ফলপ্রসু পন্থা হচ্ছে কুরআনের নির্ভরযোগ্য তাফসীর, হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্যের ব্যাপক প্রচার, ব্যক্তিগত সাক্ষাতের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা প্রভৃতি। ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপরে যুব সমাজের উপযোগী করে সাহিত্য রচনা ও তার প্রচার ও প্রসার।
তিন. ইসলামী শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদেরকে সংগঠিত করা এবং তাদরকে ইসলামের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে বাতিল মতবাদ ও চিন্তাধারার মুকাবিলা করার যোগ্য করে গড়ে তোলা এবং সকরে মিলে জামায়াত বদ্ধ হওয়া।
যতোদিন না এ ধরনের পরিপূর্ণ ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্রসম্পন্ন লোক তৈরী হয়েছে, ইসলামের প্রাসাদে যে আগুন ধরেছে তা নির্বাপিত হবে না, মুসলমানদের মধ্যে যারা সকল দিক থেকে চক্ষু বন্ধ করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ইসলামী আমল আখলাকের প্রদর্শনী করেন, এ আগুণ জ্বলতে থাকরে তাঁরাও নিজেদেরকে ও বংশধরকে এ আগুণ থেকে বাঁচাতে পারবেন না। আগুনই অবশেষে জাহান্নামের আগুনে পরিণত হব্
উপরোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাঁধা মুসলমানদের বিশেষ করে আলেম সমাজের অনৈক্য। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বার্থকেন্দ্রিক ছোটখাটো বিবেদ ভুরে গিয়ে ইসলামকে ও মসুলিম মিল্লাতকে বাতিলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্দ হতে হবে। আলেম সমাজের অনৈক্যের কারণে খোদা না করুন একবার যতি বাতির শক্তি মজবুত হয়ে চেপে বসে তাহলে মুসলমানদের নিধন যজ্হের পয়লা শিকার আলেম সমাজই হবে –তার দৃষ্টান্ত রাশিয়ার কমিউনিষ্ট বিপ্রবের পর দেখতে পাওয়া গেছে এবং সাম্প্রতিককালে আফগানিস্তানেও দেখা গেছে। আলেম সমাজ হচ্ছে নবীর আদর্শিক ও নৈতিক উত্তরাধিকারী।
কুরআনও ঘোষণা করেছে –আলেমদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করা (আরবী*****) আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থেকে দুনিয়ার বুকে নবীর (আরবী*****) আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাকে অমলীন রাখার সংগ্রামই নবীর উত্তরাধিকারীর কাজ। এ কাজ অবহেলা করলে আল্লাহর কাছে কৈফিয়ত দেবার কিছুই থাকবে না।
এ দায়িত্ব যে শুধু আলেমদের তা নয়, প্রতিটি মুসলমানের। একজন মুসলমান সকল গোলামি ছিন্ন করে, সকলের শাসন ও প্রভুত্ব খতম করে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার গোলামি অবলম্বন করে তাঁরই শাসন ও প্রভুত্ব কর্তৃত্বের অধীনে নিজেকে সপর্দ করে। সে কখনো মানুষের গোলামি ও শাসন কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারে না। আল্লাহর আইনই তার একমাত্র মেনে চলার আইন এবং নবীর নেতৃত্বের অধীনেই সে তার গোটা জবিন পরিচালিত করবে। অতএব, একজন মুসলমানের ঈমানের দাবীই হচ্ছে এই সে একমাত্র আল্লহার আইনকেই সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়িত ও কার্যকর করার সংগ্রাম করবে, রসূলের (স) আদর্শ অনুযায়ী তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন গড়ে তুলবে, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত করবে। এসব করতে পারলেই তাকে যে আল্লাহ তায়ালার খলিফার মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে, তা অক্ষুণ্ণ রাকতে পারবে।
এ কথা ভালো করে স্মরণ রাখা দরকার যে, আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়ার বুকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ধন-দৌলতের অধিকারী করেছেন, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দান করেছেন, লেখনী শক্তি, বাকশক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি দান করেছেন, বিভিন্ন পদমর্যাদায় ভূষিত করেছেন। এ সব বিভিন্ন নিয়ামত তাকে এ জন্য দেয়া হয়েছে যাতে করে সে এ সবকে আল্লাহর মর্জি মতো ব্যবহার করতে পারে। এসব সম্পদ দান করে তাকে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। সে যদি তার ধন-দৌলত, জ্ঞান-বুদ্ধি, লেখনী ও উদ্ভাবনী শক্তি একমাত্র কোদর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁরই পথে ব্যয় করে তাহরে বুঝতে হবে সে প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করতে পেরেছে। পক্ষান্তরে এ সব সম্পদ যদি ব্যয় করা হয় পার্তিব স্বার্থ ও প্রবৃত্তির পিপাসা মেটাবার জন্য তাহলে খোদার দেয়া সম্পদ সে আত্মসাৎই করবে এবং দাতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে অপরাধী হবে।
ঈমানের দাবী ত এটাই যে, আল্লাহ মানুষকে যা কিছুই দান করেছেন –সে দানের মদ্যে রয়েছে হাত, পা, চোখ, কান, মুখ ও মন-মস্তিষ্ক, সে সব কিছুই ব্যবহার করতে হবে দাতার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এ সব এমন কোন পথে ও এমনভাবে ব্যয় করা যাবে না যাতে দাতা অসন্তুষ্ট হন। এ সবকে আল্লাহর মর্জির বিপরীত পথে ব্যবহার করলে একদিকে তাদের উপর বড় জুলুম করা হবে এবং অপরদিকে নিজের উপরেও জুলুম করা হবে। কিয়ামতের দিন এ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করবে যে তাদেরকে তাদেরও মর্জির বিপরীত এবং আল্লাহ তায়ালারও মর্জির বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে। তার জন্য সে ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে যাকে এ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আমানত স্বরূপ দেয়া হয়েছিল।
এ তো গেল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কথা। মানুষকে ধন-সম্পদ ও জ্হান বুদ্ধিসহ স্বাধীন ইচ্চা ও কর্মশক্তি দেয়া হয়েছে তাকে পরীক্ষা করার জন্য যে এ গুলোকে সে কি তার প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহার করবে –না আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করবে। তার যে ঈমান যা প্রকৃতপক্ষে তার এবং আল্লাহর মদ্যে আল্লাহর দাসত্ব আনুগত্যের চুক্তি তার দাবিই হচ্ছে এই যে তাকে যা কিছুই দেয়া হয়েছে তা অন্য পথে ব্যবহার করায় তার স্বাধীনতা থাকলেও তা ব্যবহার করতে হবে আল্লহরই পথে। খলিফা বা প্রতিনিধির কাজই তাই।
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যমীনের উপর তাঁর খলিফা (Vice Gerent) করেই পয়দা করেছেন। খলিফার কাজই হচ্ছে তার নিয়োগকারীর মর্জি পূরণ করা, তার আইন কানুন যতাযথ পালন করা ও কার্যকর করা, নিজে আইন রচনাকারী হয়ে সবা নয়, স্বেচ্ছাচারী হওয়া নয় এবং এ ধারণা পোষণ করা নয় যে তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। সমগ্র প্রকৃতি রাজ্যে যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে একমাত্র আল্লাহরই মর্জি পূরণ হচ্ছে, তাঁরই আইন মেনে চলা হচ্ছে –তেমনি মানুষের সমাজেও তাঁরই আইন চলবে, তবে তার প্রতিনিধিত্ব করবে মানুষ। মানুষকে শাসক ও আইন রচয়িতা বানানো হয়নি। প্রকৃত শাসক ও আইন প্রণেতার প্রতিনিধি বানানো হয়েছে।
অতএব, মানুষের জন্মগত দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে মানুষের সমাজে তার প্রভু স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার আইন কার্যকর করা। এ আইন অমান্য করার কারণেই মানুসের সমাজে বিপর্যয় ও ধ্বংস নেমে এসেছে। মানব জাতির ইতিহাস তার সাক্ষী।
যারা আল্লহারপ্রতি ঈমান রাকে না তারা এ সত্যটি অস্বীকার করে। কিন্তু যারা ইমান রাখে, তাদের ঈমানের অপরিহার্য দাবীই এই যে, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার আইন কানুন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে কার্যকর করবে, জনগণেল মধ্যে তা মেনে চলার মানসিকতা ও আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এ কাজে তাদের শক্তি ও কর্মপ্রেরণার উৎস হবে আল্লাহর কুরআন, নবী পাকের সীরাত ও সাহাবায়ে কিরামের কর্মপদ্ধতি, বিশেষ করে খিলাফতে রাশেদার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
উপরের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে যে কথা বলা হযেছে তার অর্থ এই যে, ঈমানের সকল দাবী পূরণের কাজ তথা আল্লাহর যমীনে একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব, আইন-শাসন কায়েম করা একাকী বিচ্ছিন্নবাবে করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এর জন্য একটি ইসলামী জামায়াতভুক্ত হতে হবে যার উদ্দেশ্য আল্লাহর পথে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করা। কুরআন যাকে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্রাহ’ বরা হয়েছে।
আশার বিষয় এই যে, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ইসলামের পুনর্জাগরণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্দ আন্দোলন শুরু হয়েছে। আল্লাত তায়ারা ঈমানের দাবীদার মুসলমানদেরকে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
— সমাপ্ত —