বিক্রয় চুক্তিই চূড়ান্ত নয়
ঈমানের দাবী কি, তা উপরের আলোচনায় পরিস্কার বুঝতে পারা গেল। এখন এবিষয়েআরকোনআলোচনারপ্রয়োজননাথাকারইকথা।কারণঈমানেরসবচেয়েবড়োদাবীমু’মিনেরকাছেএইছিলযে, সে তার সবকিছু আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেবে। এখন বিক্রি করার পর ঈমানের দাবী আর কি-ই বা থাকে?
তার জবাব হচ্ছে এইযে, উপরের আলোচনায় এও জানতে পারা গেল যে, জান মাল বিক্রি করে দেয়াটাই ঈমানের দাবীর চূড়ান্ত মীমাংসা নয়। কারণ বিক্রেতার কাছে তার বিক্রিত বস্তু দুটি এখনো রয়ে গেছে এবং জীবন ভর তার কাছেই থাকবে। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই ঈমানের দাবী পূরণও বাকী রয়ে যাচ্ছে। এখন দেখতে হবে যে সে বিক্রীত বস্তুর যথাযথ ব্যবহার করে কিনা যার উপর নির্ভর করছে তার মূল্য পাওয়া না পাওয়া। এখন বিক্রয় চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য ঈমান বার বার তার কাছে যে দাবী করতেই থাকবে, তারই কিছু সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
(আরবী পিডিএফ ৩২ পৃষ্ঠায়*****************************)
তোমরা যারা ঈমান এনেছ, জেনে রেখে দাও। তোমাদেরকে আমি যা কিছু ধন-দৌলত দিয়েছি তার থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় কর ঐ দিন (কিয়ামত) আসার পূর্বে যেদিন না কোন বেচা-কেনা চলবে না দোস্তি মহব্বত আর না কোন সুপারিশ কোন কাজে আসবে। (বাকারাহঃ২৫৪)
এখন দেখা গেল, খোদার সাথে একজন মু’মিনের বিক্রয় চুক্তি হওয়ার পর তার বিক্রীত সম্পদ আল্লাহর পথেই ব্যয় করার তাকীদ করা হচ্ছে। কারণ যে ধন-সম্পদ সে আল্লাহর কাছে বিক্রি করেছে, তা আইনগতভাবে একমাত্র আল্লাহরই পথে ব্যয় করা ব্যতীত তার গত্যন্তর নেই। যদি সে বাঞ্ছিত পথে তা ব্যয় না করে সঞ্চিত করে রেখে দেয়, অথবা অন্য কোন পথে ব্যয় করে, তাহলে সে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করলো। এ ক্রেতা যেহেতু স্বয়ং আল্লাহ এবং যিনি নেহায়েৎ মেহেরবানী করে তার গচ্ছিত সম্পদ খরিদ করে নিচ্ছেন। অতএব, এ বিশ্বাসঘাতকতার মারাত্মক শাস্তিও আইনগতঃ তিনি দিতে পারেন এবং দেবেন।
আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৩৩ পৃষ্ঠায়*****************************)
-যারা আল্লাহর সাথে চুক্তি সুদৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক স্থাপনের আদেশ তিনি দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে এবং যমীনে বিপর্যয় ছড়ায়, তারা অভিসম্পাতের যোগ্য এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাসস্থল।
(রা’দঃ২৫)
আল্লাহ আরও বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৩৩ পৃষ্ঠায়*****************************)
-(ঈমানদারদের কাজ ত এই যে) তারা আল্লাহর সাথে সম্পাদিত চুক্তি পূরণ করে, তা সুদৃঢ় করার পর ভঙ্গ করেনা। আল্লাহ যে যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার আদেশ করেন তা অক্ষুণ্ণ রাখে নিজেদের প্রভূকে ভয় করে এবং এ ভয়ও তারা করে যে কি জানি হয়তো মন্দভাবে এবং কঠোরতার সাথে তাদের হিসেব নেয়া হবে। তাদের চরিত্রের আর একটি দিক এই যে, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ধৈর্যশীল হয়ে পড়ে, নামায কায়েম করে, আমি আল্লাহ তাদেরকে যা দিয়েছি তার থেকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং ভালোর দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে। আখিরাতের সুখের আবাসস্থল তাদেরই জন্য। (রা’দঃ২০-২২)
উপরের আয়াত দুটিতে একত্রে দশটি ঈমানের দাবী পেশ করা হয়েছে
• আল্লাহর সাথে সম্পাদিত চুক্তি পূরণ করা।
• চুক্তি ভঙ্গ না করা।
• আল্লাহর আদিষ্ট ও বাঞ্ছিত সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা।
• আল্লাহকে ভয় করা।
• আখিরাতে হিসেবের কঠোরতার ভয়করা।
• আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের লক্ষ্য মনে করা।
• ধৈর্যশীল হওয়া।
• নামায কায়েম করা।
• প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা।
• ভালোর দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করা।
প্রকৃত মু’মিনের জন্য আখিরাতের বাসস্থান কেমন হবে তাও এ প্রসঙ্গে বলে দেয়া হয়েছে।
(আরবী পিডিএফ ৩৪ পৃষ্ঠায়*****************************)
অর্থাৎ বাসস্থানটি হবে এমন বাগান (জান্নাত) যা হবে তাদের চিরন্তন বাসস্থান। তারা নিজেরা প্রবেশ করবে সে জান্নাতে এবং তাদের মা-বাপ, স্ত্রী-পুত্র পরিজনের মধ্যে যারা নেক হবে তারাও তাদের সঙ্গে প্রবেশ করবে সে জান্নাতে। ফেরেশতাগণ চারদিক থেকে ছুটে আসবেন তাদের খোশ আমদেদ জানাবার জন্য। তারা বলবেন, “আপনাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক। কারণ আপনারা দুনিয়াতে ধৈর্যের সাথে আল্লাহর পথে কাজ করেছেন। তার জন্য এ স্থানের প্রকৃত যোগ্যই আপনারা”। কত সুন্দর আখিরাতের এ আবাসস্থল! (রা’দঃ২৩-৩৪)
মানুষ তার ধন-সম্পদের প্রতিনিধি মাত্র
মানুষকে আল্লাহ যে ধন-সম্পদ দান করেছেন, তার মালিকানা মানুষকে দেয়া হয়নি। এসবের প্রতিনিধি করা হয়েছে মানুষকে। সম্পদের স্রষ্টা ও মালিক আল্লাহ তা মানুষের কাছে গচ্ছিত রেখে তার প্রতিনিধি বানিয়েছে মানুষকে এ শর্তে যে, মানুষ তা ব্যয় করবে আল্লাহরই মর্জি মুতাবেক।
আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৩৫ পৃষ্ঠায়*****************************)
-(হে মু’মিনগণ!) আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আন এবং ব্যয় কর এসব সম্পদ থেকে যার খলিফা বা প্রতিনিধি আল্লাহ তোমাদেরকে বানিয়েছেন। অতএব, যারা ঈমান আনবে এবং সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করবে, তাদের জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিদান। (হাদীদঃ৭)
এ আয়াতে মুসলমানদেরকেই ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে। তার অর্থ ঈমান আনার পর ঈমানের দাবী পূরণ করে চলতে হবে। তারপর আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। এ আদেশ অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত। কারণ ধন-সম্পদের মালিক সে নয়। মালিক আল্লাহ। সে তার প্রতিনিধি। প্রতিনিধির কাজ মালিকের মর্জি পূরণ করা। এ ধন যখন যেভাবে এবং যে পরিমাণে ব্যয় করলে আল্লাহর মর্জি পূরণ হবে ঠিক তেমনিভাবেই করতে হবে।
আল্লাহ মু’মিনের কাছ থেকে তার জান ও মাল উভয়ই খরিদ করে নিয়েছেন। উপরে এর বিশদ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু জানের চেয়ে মালের জন্য অধিকতর তাকীদ করা হয়েছে। তার অর্থ হলো, ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ জানটা দিয়ে দেয়া তেমন কঠিন কাজ নয় এবং এটা মাত্র একবারই দেয়ার বস্তু। একবার দিলেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ধন-সম্পদ বার বার এবং জীবনভর আল্লাহর পথে ব্যয় করা বড়ো কঠিন কাজ। তাই এর দ্বারা ঈমানের কঠিন পরীক্ষা হয়।