গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়
উপরের আলোচনায় এ কথা পরিস্কার হয়েছে যে, ঈমানের দাবী হচ্ছে তার উপর অবিচল অটল হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর একান্ত অনুগত বা সত্যিকার মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করা। এ শুধু এক ব্যক্তির জন্য নয়, বরঞ্চ যারাই ইসলামের কালেমার প্রতি জেনে বুঝে ঈমান এনে মুসলমান হয়েচে তাদের সকলকে সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের মতো জীবন যাপন করতে হবে। একাকী কারো পক্ষে জীবনের সকল ক্ষেত্রে মুসলমান হয়ে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়। তার জন্য একটা পরিপূর্ণ ইসলামী পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থার একান্ত প্রয়োজন। গোটা সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, বন্ধুত্ব-শত্রুতা, যুদ্ধ ও সন্ধি মোট কথা জীবনের সকল ক্ষেত্রের উপর ইসলামের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
একটা অনৈসলামী পরিবেশ অথবা কুফরী শাসনের অধীনে কোন মুসলমানই তার ঈমানের দাবী পুরোপুরি পুরণ করতে পারবে না, যেমন কোন কমিউনিষ্ট শাসনে এ দাবী পালন করা মোটেই সম্ভব নয়, অথবা কোন কুফরী রাষ্ট্রে যতোটুকু ঈমানের দাবী পূরণ করার অনুমতি দেবে তার অধিক পালন করাও যাবে না। অথচ আল্লাহ বলেূন-
(আরবী পিডিএফ ৬০ পৃষ্ঠায়****************************)
-হে ঈমানদারগণ! তোমদের সমগ্র জীবনকে ইসলামের অধীন করে দাও এবং (জীবনের কোন অংশকে ইসলামের বাইরে রেখে) শয়তানের আনুগত্য করো না। (কারণ) সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন। (বাকারাহঃ ২০৮)
মানব জীবন অবিভাজ্য। কিন্তু কেউ যদি কৃত্রিমভাবে জীবনকে বহু ভাগে বিভক্ত করে কোন কোনটিকে ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত করে এবং বাকীগুলো ইসলাম বহির্ভূত করে রাখে তাহলে তাকে পূর্ণ মুসলমান বলা যাবে না। জীবনের এসব ক্ষেত্রে তাকে আল্লাহ ব্যতীত অপরের আনুগত্য করতে হবে। এটাকেই শয়তাদের বা খোদা বিরোধী শক্তির আনুগত্য বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৬১ পৃষ্ঠায়****************************)
-এবং সে (মুসলমান) যেন আনুগত্য করার ব্যাপারে আপন প্রভুর (আল্লাহর) সাথে আর কাউকে অংশীদার না করে। -(কাহফঃ ১১০)
তাহলে জীবনের যে যে ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মতবাদ বা আদর্শের অনুসরণ করা হবে, তা হবে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করারই নামান্তর। মসজিদে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা হবে এবং মসজিদের বাইরে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, কৃষিক্ষেত্রে ও কলকারখানায় আল্লহার পরিবর্তে আনুগত্য করা হবে অন্যের –একে বলা হবে পূর্ণ মুনাফিকী –ইসলামী জীবন পদ্ধতি কিছুতেই বলা যাবে না। সমগ্র জীবনকে আল্লাহর আনুগত্যে সপর্দ করার নামই ত ইসলাম। ঈমানের দাবীও ত তাই। তাহলে চিন্তা করুন একজন মুসলমান কখন এবং কিভাবে সত্যিকার মুসলমান হতে পারে।
কুফরী শাসন ব্যবস্তার অধীনে একজন মুসলমান মুসলমানী জীবন যাপন করতেই পারে না। যে দেশ, ভূখণ্ড বা জনপদে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বের পরিবর্তে মানুষের শাসন কর্তৃত্ব চলে, গোটা সমাজ ও সামাজিক পরিবেশ খোদাদ্রোহিতায় নিমজ্জিত থাকে। দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, ব্যভিচার, মদ্যপান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সংস্কৃতির নামে নারী পুরুষের একত্র সমাবেশ, অশ্লীল নাচ-গান, জুয়া, চরিত্র ধ্বংসকারী ছায়াছবি প্রভৃতি যে সমাজের নিত্যনৈমত্তিক কর্মকাণ্ড সেখানে একজন মুসলমান কি করে তার ঈমান বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
এ সব যে শুধু অমুসরিম বা কাফির রাষ্ট্রেই চলছে তা নয়, বরঞ্চ ব্যাপক আকারে চলছে মুসলিম দেশগুলোতে ও মুসলিম সমাজে। যারা জীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরে নামায-রোযা ও কিছু যিকির আযকারকে শেষ সম্বল হিসেবে আপন সন্তান-সন্ততি ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইসলাম বিরোধী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। তাদের এ চরিত্র ও আচার-আচরণে ইসলামের কোন নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শক্তিশালী ইসলাম বিরোধী শিক্ষঅ ব্যবস্থা ও পরিবেশ যুব সমাজকে ইসলামের বিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরিবেশ যুব সমাজকে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনোভাব পোষণ করতে বাধ্য করছে। এ সবের কারণ এই যে, মুসলমান একটা মিল্লাত হিসেবে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ ও জিহাদী প্রেরণার পরিবর্তে পার্থিব ভোগ-বিলাসের লিপ্সা জাগ্রত হওয়ার ফলে তারা শৃগালের জাতিতে পরিণত হয়। দীর্ঘকাল ধরে গোলামির জীবন যাপন তাদেরকে ইসলামের প্রতি সন্দিহান করেন তোলে। তাদের চিন্তাধারা, মনমানসিকতা, জীবনের মুল্যবোধ, সত্য-অসত্য ও ভালো-মন্দের মানদণ্ড পরিবর্তন হয়ে যায়। মুসলমান হয়েও বিধর্মী প্রভুর মন দিয়ে চিন্তা করা শুরু করে, তাদের চোখ দিয়ে দেখতে থাকে, তাদের রঙে নিজেদের রঞ্জিত করে।
কয়েক’শ বছরের গোলামীর পর স্বাধীনতা লাভ করলেও তারা মানসিক গোলামী পরিত্যাগ করতে পারেনি, এর অনিবার্য পরিণাম দুনিয়ার জীবনেও অশেষ লাঞ্ছনা। আজ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অবস্থঅ এই একই রকমের। আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ, অলি ও অভিভাবক মনে করে তাঁরই উপরে নির্ভরশীল না হয়ে তারা ইসলামের দুশমন বাতিল শক্তির দয়ার উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। তার ফলে শেষ নবী (স) কর্তৃক নির্মিত ইসলামের প্রাসাদে আগুণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সে আগুণে পুড়ে মরছে মুসলমান, ফিলিস্তিন ও লেবাননের মুসলমান, মিশর, লিবিয়া ও আলজেরিয়ার মুসলমান ও ইরাকের মুসলমান। এ আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে মরছে আফগানিস্তানের মুসলমান। অন্যান্য দেশের মুসলমানদের অবস্থাও প্রায় একই রকমের। আজ মুসলমান মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। মুসলমান হয়ে ইসলামের ঘরে আগুণ জ্বালাচ্ছে। মুসরিম যুব সমাজ আজ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পোসণ করছে। ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে ইসলাম বিরোধী শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার সুপরিকল্পিন ষড়যন্ত্র চলছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাচ-গান পর্ণগ্রাফ ও অশ্লীল ছায়াছবির মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্র অবিরাম চলছে।
এ হচ্ছে মুসলিম সমাজের বেদনাদায়ক চিত্রের একটি দিক। অপর অধিকতর বেদনাদায়ক চিত্র এই যে, আপন ঘরে দাউ দাউ করে জ্বরে উঠা আগুনের লেলিহান শিখা দেখেও আমাদের মনে কোন দুশ্চিন্তার কালোমেঘ জমাট বাঁধে না। আমরা সব কিছু থেকে চক্ষু বন্ধ করে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে মশগুল আছি। ধর্মের গতানুগতিক প্রানহীন অনুষ্ঠানাদি নিয়ে পড়ে আছি। খানকা, মাদ্রাসা যিকির-আযকার, কালেমা শিখানোর অর্থহীন মহড়া নিয়ে ব্যস্ত আছি। নবী মুস্তাফার (স) নির্মিত প্রাসাদে আগুন জ্বলছে, তা নিভানোর কোন চিন্তা ও চেষ্টা না করে তার উপরে শুধু দরুদ ও সালাম পাঠ করছি। একে নবী প্রেমের পরিচয় বলা যায় না, নবীর সাথে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আদর্শের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতাই বলতে হবে।