পৃথিবীর আবহাওয়া
আকাশ সম্পর্কে কুরআনের বিবিশ বর্ণনা আমরা আগেই পরীক্ষা করে দেখেছি এখন আমরা আবহাওয়া মন্ডলের কতিপয় ঘটনা সম্পর্কে আয়াত পরীক্ষা করে দেখব। এখন আমরা দেখতে পাব যে, এ আয়াতগুলিতে বর্ণিত তথ্যের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের আদৌ কোন বিরোধিতা নেই।
উচ্চতা
মানুষ উর্ধে আরোহণ করলে অস্বস্তি বোধ করে। উচ্চতা বাড়লে অস্বস্তিও বেড়ে যায়। এ পরিচিত অনুভূতির কথাই সূরা আনআমের ১২৫ আয়তে বর্ণিত হয়েছেঃ”আল্লাহ কাহাকেও সৎপথে পরিচালিত করিতে চাহিলে তিনি তাহার হৃদয় ইসলামের জন্য প্রশস্ত করিয়া দেন এবং কাহাকেও বিপথগামী করিতে চাহিলে তিনি তাহার হৃদয় সংকীর্ণ করিয়া দেন; তাহার কাছে ইসলাম অনুসরণ আকাশে আরোহণের মতই দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে।”
কতিপয় ভাষ্যকার দাবী করেছেন যে, মুহাম্মদের (সঃ) আমলে উর্ধে আরোহণের অস্বস্তির কথা আরবদের জানা ছিল না। কিন্তু এ দাবী আদৌ সত্য নয়। কারণ আরব এলাকার তখনও দু মাইলেরচেয়েও বেশী উচু পর্বত ছিল; সুতরাং ঐ উচ্চতায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার কথা তাদের না জানা থাকার কথা নয়। নবীর আমলে ইয়েমেনের রাজধানী সানা শহরে লোকবস্তি ছিল এবং সমুদ্র সমতল থেকে শহরটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৭, ৯০০ ফুট। কোন কোন ভাষ্যকার আবার এ আয়াতে মহাশূন্য বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু তাও সত্য নয়। মহাশূন্য বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী এ আয়াতে অন্তত নেই।
আবহাওয়া মন্ডলে বিদ্যুৎ
নিচের কয়েকটি আয়াতে আবহাওয়ামন্ডলে বিদ্যুৎ থাকা এবং তাঁর ফলে বাজপড়া ও শিলাপাত হওয়ার কথা বলা হয়েছেঃ
সূরা ১৩ (রাদ) আয়াত ১২-১৩:”তিনিই তোমাদিগকে দেখান বিজলি যাহা ভয় ও ভরসা সঞ্চার করে এবং তিনি সৃষ্টি করেন ঘন মেঘ। বজ্র নির্ঘোষ ও ফেরেশতাগণ সভয়ে তাহার সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং তিনি বজ্রপাত এবং যাহাতে ইচ্ছা উহা দ্বারা আঘাত করেন; তবুও উহারা আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে যদিও তিনি মহা শক্তিশালী।”
সূরা ২৪ (নূর) আয়াত ৪৩:”তুমি কি দেখ না আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, অতঃপর তাহাদিগকে একত্রিত করেন এবং পরে পুঞ্জীভূত করেন। তুমি দেখিতে পাও, অতঃপর উহা নির্গতহয় বারিধারা, আকাশস্থিত শিলাস্তুপ হইতে তিনি বর্ষণ করেন শিলা এবং ইহা দ্বারা তিনি যাহাকে ইচ্ছা তাহার উপর হইতে ইহা অন্য দিকে ফিরাইয়া দেন। মেঘের বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টিশক্তি প্রায় কাড়িয়ালয়।”
এ দুটি আয়াতে স্পষ্টতই বৃষ্টির ঘনমেঘ বা শিলামেঘের গঠন এবং বজ্রপাতের পারষ্পরিক সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। মেঘের ক্ষেত্রে তাঁর উপকারিতার কারণে ভরসা সৃষ্টি করে এবং বজ্রের ক্ষেত্রে ভীতির সঞ্চার হয় কারণ যখন তা পতিত হয় মহা শক্তিশালী আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। এ দুটি ঘটনার মধ্যে যে সম্পর্ক আছে তা আবহাওয়ামন্ডলে বিদ্যুৎ থাকা সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা সাব্যস্ত ও সমর্থিত হয়েছে।
ছায়া
ছায়া যে আছে এবং তা যে চলতে পারে এ ঘটনা এখন খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। নিচের কয়েকটি আয়াতে এ বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছেঃ
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ৮১:”আল্লাহ যাহা কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন তাহা হইতে তিনি তোমাদিগের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করিয়েছেন।”
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ৪৮:”উহারা কি লক্ষ্য করে না আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর প্রতি, যাহার ছায়া আল্লাহর প্রতি বিনীতভাবে সিজদাবনত থাকিয়া দক্ষিণে ও বামে ঢলিয়া পড়ে?”
সূরা ২৫ (লুকমান) আয়াত ৪৫-৪৬:”তুমি কি দেখ না কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়া বিস্তার করেন? তিনি তো ইচ্ছা করিলে ইহাকে স্থির রাখিতে পারিতেন; বরং তিনি সূর্যকে করিয়াছেন ইহার নির্দেশক। অতঃপর তিনি ইহাকে ধীরে ধীরে গুটাইয়া আনেন।”
এ আয়াতগুলিতে আল্লাহর প্রতি তাঁর সৃষ্ট সকল বস্তু ও তাদের ছায়ায় বিনীত ভাব থাকা এবং আল্লাহ ইচ্ছে করলেই তাঁর শক্তির সকল নিদর্শন ফিরিয়ে নিতে পারেন বলে উল্লেখ করা ছাড়াও সূর্য ও ছায়ার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা প্রয়োজন যে, মুহাম্মদের (সঃ) আমলে ছায়ার গতি সূর্যের পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলার গতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে বিশ্বাস করা হত এবং সূর্যোদয় থেকেসূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় পরিমাপের জন্য সূর্য ঘড়ির ক্ষেত্রে এ নীতিই প্রয়োগ করা হত। তৎকালে এ প্রচলিত ব্যাখ্যার কোন উল্লেখ না করেই কুরআনে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে এবং ব্যাখ্যাটির চরিত্র এমন যে মুহাম্মদের (সঃ) পরে বহু শতাব্দী যাবত সহজভাবেই মেনে নেয়া হত। যদিও শেষ পর্যন্ত তা ভুল প্রমাণিত হয়। কুরানে কেবলমাত্র ছায়ার নির্দেশক হিসেবেই সূর্যের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। স্পষ্টতই কুরআনে যে প্রকারে ছ্যার কথা বলা হয়েছে তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ের আধুনিক জ্ঞান ও তথ্যেরকোন বিরোধিতা নেই।
প্রাণী ও উদ্ভিদ রাজ্য
এ অধ্যায়ে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক অনেক আয়াতের সমাবেশ করা হয়েছে। সে সঙ্গে উদ্ভিদ জগত এবং প্রাণী জগতের সাধারণ ও বিশেষ বিষয়ের কতিপয় বৈশিষ্ট সম্বলিত কিছু আয়াতও সংযোজন করা হয়েছে। এ বিষয়ের আয়াত গুলি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। আমি যেভাবে এ আয়াতগুলি শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি তাতে কুরানে বর্ণিত তথ্য সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করি।
শব্দার্থের কতিপয় অন্তর্নিহিত অসুবিধার কারণে এ অধ্যায়ে এবং পরবর্তী অধ্যায়ে কুরআনের এবারত পরীক্ষা করা কখনও কখনও যথেষ্ট নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সহায়তায় সে সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। এ সহায়তা প্রাণীজগত, মানবজগত এবং উদ্ভিদজগতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে এবং এ সহায়তা না হলে কুরআনের বর্ণনার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্যে উপনীত হওয়াই সম্ভব হত না।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে পরিষ্কার ভাবে দেখা যাবে পন্ডিত ব্যক্তিগণ কুরআনের যে সকল তরজমা করেছেন বিজ্ঞানীর কাছে তা অবশ্যই ভুল বলে সাব্যস্ত হবে। প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছাড়া যারা ভাষ্য লিখেছেন তাদের ভাষ্যের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য।
প্রাণের উৎপত্তি
প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে মানুষের মনে সর্বদাই প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তার নিজের প্রাণ সম্পর্কে তো বটেই, তাঁর চারদিকে বিচরনশীল বিবিধ প্রাণ সম্পর্কেও। এ প্রশ্নটি আমরা সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে দেখব। মানুষের পৃথিবীতে আবির্ভাব এবং সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ বিধায় সে সম্পর্কে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব।
কুরআনে যেখানে প্রাণের উৎপত্তি সাধারণ ভাবে বর্ণিত হয়েছে সেখানে এ বিবরণ খুবই সংক্ষিপ্ত। যে আয়াতে এ বর্ণনা আছে সেখানে বিশ্বের গঠন প্রক্রিয়াও বর্ণিত হয়েছেঃ
সূরা ২১ (আম্বিয়া) আয়াত ৩৩:”সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা কি ভাবিয়া দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী মিশিয়া ছিল ওতপ্রোতভাবে; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করিয়া দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিলাম পানি হইতে; তবুও কি উহারা বিশ্বাস করিবে না?”
কোন কিছুর মধ্য হইতে অন্য কোন কিছু পাওয়ার ধারণায় কোন সন্দেহ সৃষ্টি হয় না। এ আলোকে আয়াতটির অর্থ এ হতে পারে যে, পানিকে অপরিহার্য উপাদানরূপে ব্যবহার করেই প্রত্যেকটি প্রাণবান জীব সৃষ্টি করা হয়েছে; অথবা পানিতেই প্রানের উৎপত্তি হয়েছে। এ দুটি অর্থই আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সং সঙ্গতিপূর্ণ। প্রানের উৎপত্তি আসলে পানিতেই এবং সকল জীবকোষের প্রধান উপাদানও পানিই। পানি ছাড়া জীবন সম্ভবই হতে পারে না। অপর কোন গ্রহে প্রাণী আছে কিনা এ প্রশ্ন বিবেচনা করার সময় প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা হয় সেখানে পানি আছে কি?
আধুনিক তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাচীনতম প্রাণ উদ্ভিদ জগতেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামুদ্রিক শেওলা ক্যালব্রিয়ান আমলের পূর্বে অর্থাৎ জ্ঞাত প্রাচীনতম জমিনের আমলেই দেখা গেছে। প্রাণীর অর্থাৎ প্রাণীজগতের জীবকোষ সম্ভবত তাঁর কিছু পরে এসেছে এবং তাও সমুদ্র থেকেই এসেছে।
পানি (ইংরাজী ওয়াটার) আরবী ‘মাআ’ শব্দের অনুবাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘মাআ’ শব্দে আকাশের পানি, সাগরের পানি অথবা যে কোন প্রকারের তরল পদার্থ বুঝা যেতে পারে? প্রথম অর্থের পানি উদ্ভিদ জগতের সকল প্রাণের জন্য অপরিহার্য।
সূরা ২০ (তা-হা) আয়াত ৫৩:”তিনি আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন এবং উহা দ্বারা (জোড়ায়জোড়ায়) বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন।”
উদ্ভিদ জগতের জোড়া সম্পর্কে এ প্রথম উল্লেখ / এ বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। অপর অর্থে অর্থাৎ কোন প্রকারের না বলে শুধু তরল পদার্থ বলা হলে যে পানি বুঝা যায় তাঁর একটি প্রকার সকল জীবের প্রাণ গঠনের মূল ভিত্তি। সূরা ২৪ (নূর) আয়াত ৪৫:”আল্লাহ সমস্ত জীব সৃষ্টি করিয়াছেন পানি হইতে।” পানি শব্দটি যে বীর্যের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয় তা আমরা পরে দেখতে পাব।
সাধারণভাবে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়েই হোক, অথবা মাটিতে উদ্ভিদের উদগম বিষয়েই হোক, অথবা প্রাণীর বীর্য বিষয়েই হোক, কুরানে যে সকল বিবরণ আছে তা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। কুরআন নাযিল হওয়ার সময় প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে যে সকল প্রবাদ ও উপকথা প্রচলিত ছিল কুরআনে তাঁর একটিরও উল্লেখ নেই।
উদ্ভিদ রাজ্য
বৃষ্টির কারণে গাছপালা লতাগুল্ম উৎপন্ন হওয়ার ব্যাপারে যে সকল আয়াতে আল্লাহর রহমতের উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর সবগুলিই পুরোপুরি উধৃত করা সম্ভব। তবে এখানে আমরা মাত্র তিনটি আয়াত উধৃত করছিঃ
সূরা ১৬ নাহল আয়াত ১০-১১:”তিনিই আকাশ হইতে বারিবর্ষণ করেন; উহাতে তোমাদিগের জন্য রহিয়াছে পাণীয় এবং উহা হইতে জন্মায় উদ্ভিদ (ও তৃণলতা) যাহাতে তোমরা পশুচারণ করিয়া থাক। তিনি তোমাদিগের জন্য উহার দ্বারা জন্মান শস্য, জায়তুন, খর্জুর বৃক্ষ, দ্রাক্ষা এবং সর্বপ্রকার ফল।”
সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৯৯:”তিনিই আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর উহা দ্বারা তিনি সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদগম করেন; অনন্তর উহা হইতে সবুজ পাতা উদগম করেন, পরে উহা হইতে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করেন এবং খেজুর বৃক্ষের মাথি হইতে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করেন আর আঙ্গুরের উদ্যান সৃষ্টি করেন এবং জায়তুন ও দাড়িম্বও, ইহারা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসাদৃশও; যখন উহা ফলবান হয় এবং ফলগুলি পরিপক্ক হয় তখন উহাদিগের দিকে লক্ষ্য কর; বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য উহাতে অবশ্য নিদর্শন রহিয়াছে।”
সূরা ৫০ (কাফ) আয়াত ৯-১১:”আকাশ হইতে আমি বর্ষণ করি উপকারী বৃষ্টি এবং তদ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান, শস্যরাজি ও সমুন্নত খর্জুর বৃক্ষ, যাহাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ আমার দাসদিগের জীবিকাস্বরূপ; বৃষ্টি দ্বারা আমি সঞ্জীবিত করি মৃত ভূমিকে, এভাবেই পুনরুত্থান ঘটিবে।”
এরূপ সাধারণ প্রকৃতির তথ্যের সঙ্গে কুরআনের সুনির্দিষ্ট বিষয়ের তথ্যও সন্নিবেশিত হয়েছে।
উদ্ভিদ জগতে ভারসাম্য
সূরা ১৫ (হিজর) আয়াত ১৯:”আমি পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করিয়াছি সুপরিমিতভাবে।”
বিভিন্ন খাদ্যের গুণবৈচিত্র
সূরা ১৩ (রাদ) আয়াত ৪:”ভূমির বিভিন্ন অংশ পরষ্পর সংলগ্ন; উহাতে আছে দ্রাক্ষা-কানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক শিরাবিশিষ্ট অথবা এক শিরবিশিষ্ট খর্জুর বৃক্ষ; উহাদিগকে দেয়া হয় একই পানি এবং ফলের হিসাবে উহাদিগের কতককে কতকের উপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়া থাকি। অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ইহাতে রহিয়াছে নিদর্শন।”
এ আয়াতগুলির অস্তিত্ব বিশেষভাবে লক্ষনীয় কারণ এখানে নেহায়েতই সাদামাটা ভাষায় মৌলিক সত্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং তৎকালীন প্রবাদই বা উপকথার কোন উল্লেখ করা হয়নি। তবে উদ্ভিদ জগতে বংশবিস্তার বিষয়ে কুরআনের বর্ণনাই আমাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।
উদ্ভিদ জগতে বংশ বিস্তার
উদ্ভিদ জগতে দু প্রকারে বংশবিস্তার হয়ে থাকে – যৌন এবং অযৌন। প্রথম প্রকারকেই প্রকৃতপক্ষে বংশবিস্তার বলা যেতে পারে, কারণ এক্ষেত্রে এমন একটি দৈহিক প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রসূতির অনুরূপ এক নতুন জীবের আবির্ভাব ঘটানো।
পক্ষান্তরে অযৌন বংশবিস্তার হচ্ছে নিছক সংখ্যাবৃদ্ধি। মূল গাছ থেকে বিচ্ছিন একটি অংশের মূল গাছের কারেই বিকশিত হওয়া। গুইলিয়ারমন্ড ও মানজেনট এ প্রক্রিয়াকে”বিশেষ ধরনের জন্ম” বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রক্রিয়ার একটি সহজ উদাহরণ হচ্ছে কলম করা ও গাছের ডাল কেটে নিয়ে মাটিতে পুতে তাতে নতুন শিকড় গজানো। সকল গাছ থেকে কলম করা যায় না; কিছু গাছ আছে যা কলম করার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। কোন কোন গাছে এমন মুথা গাছ বা ঝুরি জন্মায় যা বীজের মতই ব্যভার করা যায়। উল্লেখযোগ্য যে যৌন প্রক্রিয়ার ফলেই বীজের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
উদ্ভিদ জগতে একই অথবা একাধিক গাছের পুরুষ ও নারী অংশের সংমিশ্রণের ফলে যৌন প্রক্রিয়ায় বংশবিস্তার ঘটে থাকে। কুরআনে একমাত্র এ প্রক্রিয়ারই উল্লেখ আছে।
সূরা ২০ (তাহা) আয়াত ৫৩:””তিনি আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন এবং উহা দ্বারা (জোড়ায় জোড়ায়) বিভিন্ন প্রকারের উৎপন্ন করেন।”
‘যওজ’ শব্দের অর্থ জোড়ার একটি। এ আরবী শব্দের বহুবচন হচ্ছে ‘আযওয়াজ’। শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে এমন কিছু যা অপর কিছুর সঙ্গে মিলিত হয়ে জোড়া গঠন করে। এ অর্থে শব্দটি বিবাহিত দম্পতি এবং একজোড়া জুতার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
সূরা ২২ (হজ্জ) আয়াত ৫:”তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, অতঃপর উহাতে আমি বারি বর্ষণ করিলে উহা শস্যশ্যামল হইয়া আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ (জোড়ায় জোড়ায়) ।”
সূরা ৩১ (লুকমান) আয়াত ১০:”তিনিই পৃথিবীতে উদগত করেন সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদ (জোড়ায় জোড়ায়)
সূরা ১৩ (রাদ) আয়াত ৩:”তিনি (পৃথিবীতে) প্রত্যেক ফল সৃষ্টি করিয়াছেন দু প্রকারের (জোড়ায়)”
আমরা জানি যে, উচ্চতর পর্যায়ের গাছে বংশবিস্তার প্রক্রিয়ার শেষ বস্তু হচ্ছে ফল। এ জাতীয় গাছের সংগঠন খুবই উন্নত মানের এবং জটিল। ফলের আগের পর্যায় হচ্ছে ফুল এবং সে ফুলের পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গ আছে। স্ত্রী অঙ্গে রেণূ স্থাপিত হওয়ার পর ফল ধরে, তারপর সে ফল পাকার পর বীজ সৃষ্টি হয়। সুতরাং সকল ফলই পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। একথাই কুরআনে বলা হয়েছে উল্লেখযোগ্য যে কোন কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে অনুর্বর ফুল (পুরুষ অস্ত্রী রেণূর সংমিশ্রণ ছাড়া ) থেকেও ফল হতে পারে, যেমন কলা, কয়েক ধরনের আনারস, ডুমুর, কমলা ও আঙ্গুর। এ সকল ফল আবার উর্বর ফুল থেকেও জন্মাতে পারে।
বীজের বহিরাবরণ (অনেক সময় খুবই শক্ত হয়ে থাকে) খুলে যাওয়ার পর যখন অংকুরোদগম হয় এবং তখনই বংশবিস্তার প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায় আসে। বহিরাবরণ খুলে যাওয়ার ফলে শিকড় গজাতে পারে এবং সে শিকড় তখন মাটি থেকে রস টেনে নিয়ে একটি নতুন চারা গজিয়ে উঠতে সহায়তা করে থাকে।
কুরআনে এ অংকুরোদগম প্রক্রিয়ার কথা এভাবে বলা হয়েছেঃ
সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৯৫:”আল্লাহ শস্যবীজ ও আটি (উন্মুক্ত করিয়া) অংকুরিত করেন।” উদ্ভিদজগতের জোড়ায় অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করে কুরআনে এ ধারণাটি আরও ব্যাপক ও সাধারণ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে।
সূরা ৩৬ (ইয়াসীন) আয়াত ৩৬:”পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং উহারা যাহাদিগকে জানে না তাহাদিগের প্রত্যেককে সৃষ্টি করিয়াছেন জোড়া জোড়া করিয়া।”
মুহাম্মদের (সঃ) আমলে”উহারা যাহাদিগকে জানে না” এ বিষয়ে হয়ত নানা প্রকারের আন্দাজ অনুমান থাকবে। কিন্তু আমরা এখন সঠিকভাবেই জানি যে, প্রাণী এবং অপ্রাণী জগতে ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম পর্যায়ে এ জোড়ার অস্তিত্ব আছে। লক্ষণীয় যে, কুরানের এ সকল ধারণা আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সংগে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ।
প্রাণীর রাজ্য
কুরআনে এমন কয়েকটি বিষয় আছে যার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সংগে আধুনিক বিজ্ঞানের মুকাবিলা হওয়া প্রয়োজন। তবে কেউ যদি নিচে উধৃত আয়াতটি গভীর মনোযোগের সঙ্গে অনুধাবন করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কুরআনে আসলে যে কি আছে তা তিনি পুরোপুরিভাবে জানতে পারবেন না।
এ আয়াতে মানুষকে তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত উপলব্ধি করানোর উদ্দেশ্যে প্রাণী জগতের কতিপয় উপাদান সৃষ্টির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই (বিবিধ উপাদান) সৃষ্টি করা হয়েছে, এভাবে বর্ণনা করা কুরআনের একটি সাধারন বৈশিষ্ট এবং মূলত এ বৈশিষ্টের একটি নজীর হিসেবেই আমরা আয়াতটি বিশেষভাবে উধৃত করছি। আয়াতটির লক্ষ্য পল্লী অঞ্চলের অধিবাসীগণ এবং এ দৃষ্টিকোণ ছাড়া অন্য কোনভাবে বিষয়টি বিবেচনার অবকাশ নেই।
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ৫-৮:”তিনি পশু সৃষ্টি করিয়াছেন; তোমাদিগের জন্য উহাতে শীতবস্ত্রের উপকরণ ও বহু উপকার রহিয়াছে এবং হইতে তোমরা আহার্য পাইয়া থাক এবং তোমরা যখন গোধুলি লগ্নে উহাদিগকে চারণভূমি হইতে গৃহে লইয়া আস এবং প্রভাতে যখন উহাদিগকে চারণভূমিতে লইয়া যাও তখন তোমরা উহার সৌন্দর্য উপভোগ কর এবং উহারা তোমাদিগের আরোহণের জন্য ও শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন অশ্ব, অশ্বতর ও গর্দভ এবং তিনি সৃষ্টি করেন এমন অনেক কিছু যাহা তোমরা অবগত নহ।” এ সাধারণ বর্ণনার পাশাপাশি কুরআনে কতিপয় বিশেষ বিশেষ তথ্য দেয়া হয়েছে। বিষয়গুলি হচ্ছে- (১) প্রাণীজগতে বংশবিস্তার (২) প্রাণীজগতে সমাজের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ (৩) মৌমাছি, মাকড়সা ও পাখী সম্পর্কে বর্ণনা (৪) প্রাণী দুগ্ধের উপাদানের উৎস বিষয়ের বিবরণ। এখন আমরা এ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করব।
১) প্রাণীজগতে বংশবিস্তার
সূরা নাজমের ৪৫-৫৬ আয়াতে বিষয়টি খুবই সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছেঃ”তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী স্খলিত শুক্র বিন্দু হইতে।”এখানে”যুগল” বলতে বুঝানো হয়েছে উদ্ভিদ জগত বিষয়ক আয়াতে তা”জোড়া” বলে বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। তবে লক্ষণীয় যে, এখানে যুগলের লিঙ্গ উল্লেখ করা করা হয়েছে। বংশবিস্তারের জন্য অল্প পরিমাণ তরল পদার্থের প্রয়োজন বলে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা সঠিক, সুনির্দিষ্ট, এবং সম্পূর্ণ প্রশংসার যোগ্য।”শুক্র” বুঝা যায় এরূপ শব্দই আরবীতে ব্যবহার করা হয়েছে। এ বর্ণনার প্রাসঙ্গিকতা আমরা পরে আলোচনা করব।
২) প্রাণীজগতে সমাজের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ
সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৩৮:”ভূপৃষ্ঠে বিচরনশীল এমন জীব নাই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোন পাখি ওড়ে না যাহা তোমাদিগের মত এক একটি সমাজ নয়। গ্রন্থে কোন কিছু লিপিবদ্ধ করিতে ত্রুটি করি নাই; অতঃপর স্বীয় প্রতিপালকের দিকে তাহারা সকলে একত্র হইবে।” এ আয়াতের কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমত আয়াতের বর্ণনা থেকে মনে হয় মৃত্যুর পর পশুপাখির কি হবে সে সম্পর্কে এখানে নির্দেশনা আছে। কিন্তু দৃশ্যত এ বিষয়ে ইসলামে কোন নির্দেশ নেই। দ্বিতীয়ত মনে হয় এখানে সাধারণভাবে পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের (তকদির) কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (তকদির বলতে মানুষের ক্ষেত্রে কি বুঝতে হবে ইতিপূর্বে এ গ্রন্থের তৃতীয় অংশের শুরুতে আমরা আলোচনা করেছি) । তকদির সার্বভৌম শক্তি অথবা শর্তাধীন শক্তি হিসেবে অনুমান করা যেতে পারে। শর্তাধীন বা শর্ত সাপেক্ষ তকদির বলতে আমরা সে আচরন বুঝতে চাচ্ছি যা কাঠামোগত বা ক্রিয়াগত বৈশিষ্টের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে; যেমন প্রাণী পরিবেশ বিশেষে তারবিশেষ অনুভূতি অনুসারে কাজ করে থাকে। এ অনুভূতি তাঁর দেহের বাইরের পরিবেশের কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে।
ব্লাশেয়ার বলেছেন, আগের দিনের ভাষ্যাক্র রাজি মনে করেন যে, প্রাণী যে আভ্যন্তরিক অনুভূতি সঞ্জাত কার্য দ্বারা আল্লাহর উপাসনা করে এ আয়াতে তাঁর কথাই বলা হয়েছে। শেখ সি বৌবাকিয়ার হামজা তাঁর কুরআনের তরজমার ভাষ্যে বলেছেন-”আসমানী জ্ঞানে সৃষ্ট অনুভূতির ফলে সকল প্রাণী সমাজবদ্ধ হয় এবং দাবী করে যে প্রত্যেক সদস্যের কাজ সমগ্র শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত হবে।”
সাম্প্রতিক কয়েক দশকে পশুপাখির আচরণ সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর তদন্ত পরিচালিত হয়েছে এবং তাঁর ফলে দেখা গেছে যে, তারা সত্যি সত্যিই সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। এরূপ কোন কোন সমাজের কাজ দীর্ঘদিন যাওবত পর্যবেক্ষণের পর ঐ সমাজের সুনির্দিষ্ট কাঠামো ও সংগঠন আছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। কতিপয় প্রজাতির প্রাণীর ক্ষেত্রে অতি সম্প্রতি তাদের সমাজ সংগঠনের কর্মকর্তাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। মৌমাছি সম্পর্কেই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশী কাজ হয়েছে এবং মৌমাছির আচরণ নির্ণয়ের কাজের সঙ্গে য়ানফ্রিশের নাম জড়িত রয়েছে। এ কাজের জন্য ফ্রিশ, লোরেঞ্জ ও টিনবার্জেন ১৯৭৩ সালে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন।
৩) মৌমাছি, মাকড়সা ও পাখি বিষয়ক বর্ণনা
স্নায়ুতন্ত্র বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ যখন প্রাণীর আচরণ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ব্যবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেখাতে চান তখন তারা প্রথমেই মৌমাছি, মাকড়সা এবং পাখির (বিশেষত যাযাবর পাখি) কথা বলে থাকেন। এ তিন প্রাণীর ক্ষেত্রে নিসন্দেহে অতিশয় উন্নত ধরনের সমাজ সংগঠনের সন্ধান পাওয়া যায়। কুরআনে এ তিন প্রাণীর কথা উল্লেখ থাকার কারনে যে বিশিষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। তাদের চরিত্র ও আচরণ সত্য সত্যই বৈশিষ্টপূর্ণ। এখন আমরা পর পর এ তিন প্রাণী সম্পর্কে আলোচনা করব।
মৌমাছি
কুরআনে মৌমাছি সম্পর্কেই দীর্ঘতম বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সূরা ১৬ (নাহল) ৬৮-৬৯:”তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে উহার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন ‘গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাহাতে; উহার পর প্রত্যেক ফল হইতে কিছু কিছু আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালক তোমার জন্য যে পদ্ধতি সহজ করিয়াছেন তাহার অনুসরণ কর। উহার উদর হইতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়; ইহাতে মানুষের জন্য আছে ব্যাধির প্রতিকার।”
[লক্ষণীয় যে, কুরআনে একমাত্র এভাবেই মানুষের জন্য ব্যাধির প্রতিকারের উল্লেখ আছে। কতিপয় রোগের ক্ষেত্রে মধু সত্যিই উপকারী। এ বিষয়ে বিপরীত যা কিছুই বলা হোক না কেন, কুরআনের অন্যত্র কোথাও আর কোন রোগ প্রতিকারের উল্লেখ নেই।]
প্রতিপালকের পদ্ধতি অনুসরণ কর বলতে আসলে যে কি বুঝায় তা নির্ণয় করা কঠিন; তবে নির্দেশটি বোধহয় সাধারণ অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে। মৌমাছির আচরণ সম্পর্কে এযাবত যে তথ্য আবিষ্কার হয়েছে তাঁর ভিত্তিতে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে যে, তাদের সকল আচরণ তাদের স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মাকড়সা ও পাখির ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে সত্য। মৌমাছির নাচ অপর মৌমাছির সঙ্গে যোগাযোগের একটি উপায়, কতদূরে কোন দিকে অবস্থিত ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা যেতে পারে এভাবে তা তারা একে অপরকে জানিয়ে থাকে। তাছাড়া কোন ধরনের দেহভঙ্গি দ্বারা কর্মী মৌমাছিদের মধ্যে সংবাদ বিনিময় হয়ে থাকে ফন ফ্রিশের গবেষণায় তাও সাব্যস্ত হয়েছে।
মাকড়সা
মাকরসার ঘরের অস্থায়ী অবস্থা বিশেষভাবে দেখানোর জন্যই কুরআনে এ প্রাণীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মাকড়সার ঘরের (জাল) মত হালকা, অস্থায়ী ও ভঙ্গুর জিনিস আর হতে পারে না। কুরআন বলছে, মাকড়সার ঘর তাদের ঘরের মতই মজবুত যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য মনিব গ্রহণ করেছে।
সূরা ২৯ (আনকাবুত) আয়াত ৪১:”যাহারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তাহাদিগের দৃষ্টান্ত মাকড়সা, সে নিজের জন্য ঘর বানায় এবং ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম, যদি উহারা জানিত।”
মাকড়সার গ্রন্থি থেকে নির্গত এক প্রকার লালার সাহয্যে তারা ঘর বানায়। এ রেশমের মত সুতা খুবই মিহি ও হালকা। মাকড়সার জাল এতই দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর যে মানুষের পক্ষে অমন কিছু প্রস্তুত করা আদৌ সম্ভব নয়। এ জালের বিস্ময়কর ও আওসাধারণ কারুকার্য দেখে প্রকৃতি বিজ্ঞানীগণ হতবাক হয়ে গেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, মাকড়সার স্নায়ুবিক কোষের অবস্থান বৈচিত্রের কারণেই জ্যামিতিক ভাবে নিখুত অমন বুননকার্য হয়ে থাকে।
পাখী
কুরআনে পাখীর কথা অনেক জায়গাতেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইব্রাহীম, ইউসুফ, দাউদ, সোলায়মান এবং ঈসা নবীর জীবনের ঘটনা প্রসঙ্গেও পাখির উল্লেখ আছে। কিন্তু আমরা এখানে যে বিষয়ে আলোচনা করছি তাতে ঐ সকল উল্লেখে কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই।
কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে জমীনে প্রাণীর সমাজ এবং আসমানে পাখীর সমাজ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৩৮:”ভূপৃষ্ঠে বিচরনশীল এমন জীব নাই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোন পাখি ওড়ে না যাহা তোমাদের মত এক একটি সমাজ নয়। গ্রন্থে কোন কিছু লিপিবদ্ধ করিতে ত্রুটি করি নাই; অতঃপর স্বীয় প্রতিপালকের দিকে তাহারা সকলে একত্র হইবে।”
অপর দুটি আয়াতে আল্লাহর শক্তির প্রতি পাখির সম্পূর্ণ আত্মসমর্পনের উল্লেখ আছে।
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ৭৯:”তাহার কি লক্ষ্য করে না বিহংগের প্রতি যে আকাশের শূন্যগর্ভে সহজে বিচরণ করে? আল্লাহ উহাদিগকে সেখানে স্থির রাখেন।’
সূরা ৬৭ (মূলক) আয়াত ১৯; “উহারা কি লক্ষ্য করে না উহাদিগের উর্ধদেশে উড্ডীয়মান বিহংগকুলের প্রতি, যাহারা পক্ষ বিস্তার করে ও সংকুচিত করে? দয়াময় আল্লাহই উয়াহদিগকে স্থির রাখেন।”
এ দুটি আয়াতের যে কোন একটি শব্দের তরজমা করা খুবই জটিল ব্যাপার। এখানে যে তরজমা করা হয়েছে তাতে এ ধারনা দেয়া হয়েছে যে, আল্লহ তাঁর নিজ শক্তিতে পাখিকে ধরে রাখেন। মূল আরবী ক্রিয়াপদটি হচ্ছে ‘আমসাকা’, যার মূল অর্থ হচ্ছে ‘হাত স্থাপন করা, আটক করা, ধরা, কাউকে ধরে রাখা।’
কুরআনে আল্লাহর হুকুমের উপর পাখির এ সে সম্পূর্ণ নির্ভরতার উল্লেখ করা হয়েছে, এ অবস্থার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের তুলনা করা যেতে পারে, যে তথ্যে দেখা গেছে যে, কতিপয় প্রজাতির পাখি তাদের চলাফেরার পথের ব্যাপারে, একটি নির্ধারিত ধারা অনুসরণ করে থাকে। এ সকল পাখি, এমনকি তাদের অনভিজ্ঞ শাবকগুলিও অতিশয় দীর্ঘ এবং জটিল পথ অতি সহজেই নির্ভুলয়াবে অতিক্রম করে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট তারিখে তারা আবার তাদের যাত্রাস্থলে ফিরে আসে। ফলে এ সত্যই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, তাদের দেহের স্নায়ুতন্ত্রেই এ সফরের কর্মসূচী পূর্বনির্ধারিত অবস্থায় স্থাপিত আছে। এছাড়া এ কাজের আর কোন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে না। আধ্যাপক হ্যামবার্জার তাঁর”পাওয়ার এন্ড ফ্রেজাইলিটি” (লা পুইসানস আলা ফ্রেজাইলিটে) নামক গ্রন্থে (প্রকাশক ফ্ল্যামারিত্তন, প্যারিস, ১৯৭২ ) প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাসিন্দা এক ধরনের পাখির (মাটন-বার্ড) বিখ্যাত দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। এ পাখি ছয় মাস সময়ে ১৫, ৫০০ মাইলেরও বেশী পথ বাংলা ৪ সংখ্যার কারে সফর করে থাকে এবং সর্বাধিক এক সপ্তাহ বিলম্বে তাঁর যাত্রাস্থলে ফিরে আসে। স্বীকার করতেই হয় যে এ সফরের জটিল নির্দেশাবলী পাখির স্নায়ুতন্ত্রেই স্থাপিত আছে। অতি, অবশ্যই এ সফরসূচী, কিন্তু কে পূর্বনির্ধারণ করেছে?
৪) প্রাণীদুগ্ধের উপাদানের উৎস
এ বিষয়ে কুরআনে যে সংজ্ঞা দেয়া আছে (সূরা ১৬-নাহল আয়াত ৬৬) তা আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এখানে এ আয়াতের যে তরজমা ও ব্যাখ্যা দিয়েছি তা আমার নিজের। কারণ্ এ আয়াতের আধুনিকতম তরজমাতেও তরজমাকারীগণ এমন অর্থ দিয়েছেন যা আমার মতে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। দুটি দৃষ্টান্ত দিইঃ
আর ব্লাশেয়ারে তরজমা (প্রকাশক – জি পি মাইসোনেভু আলারেজ, প্যারিস, ১৯৬৬):”অবশ্যই গবাদি পশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা আছে। তোমাদের পান করার জন্য দিয়ে থাকি বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য উত্তম এবং যা আসে তাদের পেটের হজম হওয়া খাদ্য ও রক্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত জিনিস থেকে।”
অধ্যাপক হামিদুল্লার তরজমা (প্রকাশক- ক্লাব ফ্রাং কাইজ দু লিভার, প্যারিস, ১৯৭১):”অবশ্যই তোমাদের গবাদি পশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা আছে। তাদের পেটের মধ্যে যা আছে, তাদের মল ও রক্তের মধ্য থেকে আমরা তোমাদের পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, পানকারীদের জন্য যা উপাদেয়।”
এ তরজমা দুটি কোন শরীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞকে দেখান হলে তিনি বলবেন ব্যাপারটি অস্পষ্ট, ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তার কারণ এই যে, এমনকি প্রাথমিক ভাবেও বিষয়টি আধুনিক ধারণার সঙ্গে তরজমায় প্রদত্ত ধারণার কোন মিল নেই অথচ এ দুজন তরজমাকারী খুবই বিশিষ্ট আরবী ভাষাবিদ। সকলেই জানেন যে, কোন তরজমাকারী তরজমায় বিশেষজ্ঞ হলেও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ে যদি বিশেষজ্ঞ না হন, তাহলে বৈজ্ঞানিক বর্ণনার তরজমায় তিনি ভুল করতে পারেন। আমার নিজের মতে আয়াতটির সঠিক তরজমা হবে এরূপঃ”অবশ্যই গবাদি পশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা আছে। আমরা তোমাদের পান করতে দেই তাদের দেহের মধ্যে যা আছে, যা নাড়ীর মধ্যকার বস্তু ও রক্তের সংমিশ্রণে প্রস্তুত হয়, সে দুধ বিশুদ্ধ ও উয়াপাদেয় যারা পান করে তাদের কাছে।”
কায়রোর সুপ্রিম কাউন্সিল ফর ইসলামিক এফেয়ার্স সম্পাদিত এবং ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘মুনতাখাব’ নামক গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, আমার এ ব্যাখ্যা তাঁর খুবই কাছাকাছি। উল্লেখযোগ্য যে, সুপ্রিম কাউন্সিল তাদের ব্যাখ্যার জন্য আধুনিক শরীরবিদ্যার সহায়তা গ্রহণ করেছেন।
শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারে আমি আমার ভাষ্যের সমর্থনে বলতে পারি যে আমি ‘তাদের দেহের মধ্যে’ ব্যবহার করেছি; পক্ষান্তরে আর ব্লাশেয়ার ও অধ্যাপক হামিদুল্লাহ তরজমা করেছেন ‘তাদের পেটের মধ্যে’ বলে। আমি লক্ষ্য করেছি যে, আরবী ‘বাতন’ শব্দটির অর্থ ‘মধ্যভাগ’ বা ‘কোন কিছুর অভ্যন্তর ভাগ’- ও হতে পারে, আবার পেটও হতে পারে। শব্দটির এখানে শরীরতত্বগত কোন সুনির্দিষত অর্থ নেই। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতার হিসেবে ‘তাদের দেহের মধ্যে’ বেশ লাগসই ও সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়।
দুধের উপাদানের ‘প্রাথমিক উৎস’ ের ধারণা আরবী ‘মিন’ (ইংরাজী ফ্রম এবং বাংলা থেকে) শব্দ থেকে এবং সংমিশ্রণের ধারনা আরবী ‘বাইনি’ শব্দ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। বাইনি শব্দের অর্থ ‘মধ্যেও’ হতে পারে (ইংরাজী এমং), আবার ‘মধ্যবর্তী’ ও হতে পারে (ইংরাজী বিটুইন) । দুটি দ্রব্য বা দুজন মানুষ একসঙ্গে আনা হল, এ অর্থেও অবশ্য শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আয়াতটির অর্থ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে হলে শরীরবিদ্যার সাহায্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। হজম প্রক্রিয়ার জন্য দেহে যে নির্ধারিত এলাকা বা পথ আছে তাঁর সর্বত্র ক্রিয়াশীল রাসায়ানিক পরিবর্তন থেকেই দেহের সাধারণ পুষ্টি সাধনের সারবস্তু আসে। এ সারবস্তু নাড়ীর আভ্যন্তরিক বস্তু থেকেই আসে। রাসায়ানিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার যথাযথ পর্যায়ে নাড়ীতে আসার পর বস্তুটি নাড়ীর দেয়ালের মধ্য দিয়ে সঞ্চালন প্রক্রিয়ার জন্য নিররাধারিত এলাকার দিকে চলে যায়। এ গমন বা প্রবাহ দুভাবে সাধিত হয়ে থাকে সরাসরিভাবে ‘লিমফ্যাটিক ভেসেল’ নামে পরিচিত নাড়ির মারফত অথবা বৃহৎ সঞ্চালন পথে। অতঃপর ঐ বস্তু কলিজায় উপনীত হয় এবং সেখানে রদবদল হওয়ার পর সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় গিয়ে শামিল হয়। এভাবে সবকিছুই রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।
দুধের উপাদান স্তনগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। রক্ত প্রবাহের পথে হজম হওয়া খাদ্যের যে সারবস্তু সেখানে পৌছায় তা থেকেই ঐ উপাদানগুলি পুষ্টি লাভ করে। সুতরাং রক্ত ঐ সারবস্তুর সংগ্রহকারী ও পরিচালক হিসেবে কাজ করে এবং ঐ বস্তুই দুধ উৎপাদক স্তনগ্রন্থির পুষ্টি সাধন করে থাকে। অবশ্য ঐ সারবস্তু দেহের অন্যান্য সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পুষ্টি সাধন করে থাকে।
এখানে যে প্রাথমিক প্রক্রিয়া সকল কিছু সচল করে তোলে তা হচ্ছে নাড়ীর দেয়াল স্তরে নাড়ীর আভ্যন্তরিক বস্তু ও রক্ত একত্রিত হওয়া। হজম প্রক্রিয়ার ব্যাপারে রাসায়ানিক এবং শরীরতাত্বিক পরীক্ষার ফলে ঠিক এ ধারণাই আবিষ্কৃত হয়েছে। নবী মুহাম্মদের (সঃ) আমলে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল এবং অতি সম্প্রতি মানুষের বোধগম্য হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, দেহে রক্ত সঞ্চালনের ব্যাপারটি অর্থাৎ রক্ত যে দেহে সর্বদা প্রবাহিত হয়ে থাকে, এ তথ্য আবিষ্কার করেন হার্ভে, কুরআন নাযিল হওয়ার প্রায় দশ শতাব্দী পরে।
সেহেতু আমি মনে করি যে, কুরআনে ঐ সকল তথ্য থাকার কোন আম্নবিক ব্যাখ্যা হতে পারে না।