নবীদের গ্রন্থ সমূহ
এ শিরোনামে আমরা সেই সকল নবীর শিক্ষার বিবরণ দেখতে পাই, ওল্ড টেস্টামেন্টে যাদের মূসা, স্যামুয়েল, ইলিয়াস ও এলিশার ন্যায় বড় নবীদের থেকে আলাদা করে শ্রেনীভূক্ত করা হয়েছে। ’ঐ বড় নবীদের শিক্ষার বিবরণ অন্যান্য গ্রন্থে আছে।
নবীদের গ্রন্থে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ঘটনাবলীর বিবরণ আছে।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে আমোস, হোসিয়া, ইসাইয়া ও মিশাহ নবীর গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। আমোস নবীর গ্রন্থ সামাজিক অবিচারের নিন্দাবাদের জন্য বিখ্যাত। হোসিয়া তাঁর ধর্মীয় বিকৃতির জন্য পরিচিত। প্রকৃতি পুজারী সম্প্রদায়ের একজন সেবাদাসী অর্থাৎ পবিত্র বারবনিতাকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ায় তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে দৈহিক যন্ত্রণা ভোগ করেন। এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, জনগণ পাপাচারী হলে আল্লাহ যেমন কষ্ট পান, কিন্তু তবুও তাদের ভালোবাসেন, এ ব্যাপারটিও ঠিক সেরকম। ’ইসাইয়া একজন রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাক্তিত্ব। ’রাজা-বাদশাহগণ তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং সেইমত কাজ করেন। তিনি অতিশয় জাকজমকের সঙ্গে জীবন যাপন করেন। তাঁর নিজস্ব প্রচার কার্য ছাড়াও বিভিন্ন প্রশ্নের তিনি যে জবাব দিয়েছে, তাঁর মুরীদ্গণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত তা প্রকাশ করেছেন। তাঁর শিক্ষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আল্লাহর বিচারকে ভয় করার কথা আছে। তিনি ইহুদীদের মিসর ত্যাগের পর মুক্তি লাভ এবং তাদের ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। দ্বিটিয় ও তৃতীয় ইসাইয়ার ক্ষেত্রে তাদের নবুয়াতির কার্য যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল, তা প্রায় দিবালোকের মতই স্পষ্ট। ইসাইয়ার সমসাময়িক মিশাহর শিক্ষাও মোটামুটি একই ধরনের ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে জেফানিয়াহ, জেরেমিয়াহ, নাহুম ও হাবাক্কুক তাদের ধর্মীয় প্রচার কার্যের জন্য খ্যাতি লাভ করেন। জেরেমিয়াহ শহীদ হন এবং বারুদ তাঁর শিক্ষা ও বানী সংগ্রহ করে একত্রিত করেন। বারুদ সম্ভবত বিলাপ (ল্যামেন্টেশন) এরও লেখক।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইহুদীদের ব্যাবিলনে নির্বাসিত থাকার সময় নবীদের তৎপরতা বিশেষ ভাবে বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে ইজেকিয়েলের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ ছিল। তিনি তাঁর স্বধর্মীদের সান্তনা দিতেন এবং আশার বানী শুনাতেন। ওবাদিয়াহর গ্রন্থে বিজিত জেরুসালেমের দৈন্য দুর্দশা বর্ণনা করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে নির্বাসন শেষ হওয়ার পর হাজ্ঞাই ও জাকারিয়া নবীর তৎপরতা শুরু হয়। তারা মন্দির পুননির্মানের আবেদন জানান। এ পুওনির্মাণ শেষ হওয়ার পর মালাচির নামে কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। এ রচনাগুলি ছিল মূলত আধ্যাত্মিক বিষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখযোগ্য কোন পাঠ না থাকা সত্ত্বেও ইউনুসের গ্রন্থকে যে কিভাবে নবীদের গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাঁর কোন সঙ্গত কারণ খুজে পাওয়া যায় না। ইউনুসের গ্রন্থে যে প্রধান শিক্ষা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পন করার প্রয়োজনীয়তা।
ড্যানিয়েলের গ্রন্থ তিনটি ভাষায় লিখিত। হিব্রু, গ্রীক, ও আর্মায়িক। খ্রিস্টান সমালোচকগণ মনে করেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, এ গ্রন্থে সুসমাচার আছে বটে, কিন্তু তা বিশৃঙ্খল ও স্ববিরোধী। এ গ্রন্থ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মাকাবাইয়ান আমলের। ই জ্যাকোব মনে করেন যে, নাজাতের দিন অতি নিকটে, এ কথা বলে লেখক তাঁর স্বদেশবাসীর ঈমান রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
কবিতা ও জ্ঞানের গ্রন্থ
এ শিরোনামে শ্রেনীবদ্ধ গ্রন্থগুলিতে প্রশ্নাতীত সাহিত্যিক সামঞ্জস্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সামস (প্রার্থনা সঙ্গীত) এবং তা হিব্রু কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনও। অধিকাংশ প্রার্থনা সঙ্গীতের রচয়িতা হচ্ছেন দাউদ। অবশিষ্ট গুলি বিভিন্ন পুরোহিতের রচনা। প্রার্থনা ও উপাসনায় ব্যবহৃত এ স্নগীতের বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রশংসা, ধ্যান, আরাধনা এবং আবেদন নিবেদন।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যে রচিত জবের (হযরত ইয়াউবের) গ্রন্থ জ্ঞান ও বিষয়ের উৎকৃষ্ট একখানি গ্রন্থ।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জেরুসালেমের পতনের পর বিলাপ (ল্যামেন্টেশনস) নামে যে গ্রন্থ রচিত হয়, তাঁর লেখক সম্ভবত জেরেমিয়াহই হবেন।
এছাড়া কয়েকখানি গ্রন্থের নাম পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সং অব সঙ্গস হচ্ছে ঐশীপ্রেমের রুপক সঙ্গীতের সংকলন, বুক অব প্রোভার্বস হচ্ছে সলোমন এর দরবারের অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের বানী সংগ্রহ এবং একলেজিয়াস্টস বাঃ কোহেলেথ হচ্ছে পার্থিব সুখ ও জ্ঞানের সারবত্ত সম্পর্কে গ্রন্থের সংকলন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ে কমপক্ষে সাত শতাব্দী যাবত যা রচনা করেছেন, তা একত্রিত করে মিলিয়ে মিশিয়ে একখানিমাত্র গ্রন্থ বানানো হয়েছে। এ অবস্থায় এ গ্রন্থের একটি অংশ অপর অংশের পরিপূরকই বা হয় কেমন করে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত এ গ্রন্থকে পূর্নাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই গণ্য করা হোল কেমন করে? কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় কথা,”এ গ্রন্থখানিকে ইহুদী ও খ্রিস্টানদেড় অহীর গ্রন্থ’’ বলে গণ্য করা হয় কোন যুক্তিতে? কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু মতপার্থক্য আছে কিন্তু মূল বিষয়ে বিরোধ তেমন প্রকট নয়। অদৃশ্য বিষয়ের ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে বলে গ্রীক ভাষায় এ গ্রন্থকে”ক্যানন” নামে অভিহিত করা হত।
এ রচনা সংগ্রহের সময় কিন্তু খৃস্টান আমলে শুরু হয়নি, হয়েছে ইহুদী আমলে। এবং প্রাথমিক কাজ সম্ভবত খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতেই শুরু হয়েছিল। এ সংকলনের জন্য প্রথম পর্যায়ে কিছু গ্রন্থ বাছাই করা হয়েছিল। অবশিষ্ট গ্রন্থগুলি পরে যোগ করা হয়। তবে লক্ষনীয়, তৌরাত বাঃ পেন্টাটিউকের অন্তর্ভূক্ত পাচখানি গ্রন্থকে সর্বদাই শীর্ষ স্থান দেয়া হয়েছে। নবীদের ঘোষনা (অসদাচরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শাস্তির ভবিষ্যদ্বানী) সত্যে পরিণত হওয়ার পর তাদের শিক্ষার বিবরণ মূল গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পথে আর কোন বাঁধার সৃষ্টি হয়নি। তাদের আশার বানীর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।, খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে নবীদের”ক্যানন” সুস্পষ্ট আকার লাভ করে।
উপাসনায় ব্যবহার করা হয় বলে সামস (প্রার্থনা সঙ্গীত) এর মত অন্যান্য গ্রন্থ ল্যামেন্টেশনস, বুক অব উইজডম ও বুক অব জবের মত গ্রন্থের সঙ্গে একীভূত করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে খৃস্টধর্ম ইহুদী ধর্মের সঙ্গে সংমিশিত ছিল। পরে আমরা দেখতে পাবো যে, কার্ডিনাল ডানিলোর মত আধুনিক সুপন্ডিত লেখক গণ এ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে গবেষণা করেছেন। সাধু পলের প্রভাবে নতুন রূপ গ্রহণের আগে খৃস্টধর্ম ওল্ড টেস্টামেন্টের উত্তরাধিকার বিনা দ্বিধায় মেনে নিত। গসপেলের লেখকগণ ওল্ড টেস্টামেন্টের ধারা কঠোরভাবে মেনে চলতেন। কিন্তু পরে এপোক্রিফা (ধর্মীয় উপকথা) বর্জন করে গদপেল সংশোধন করা হলেও ওল্ড টেস্টামেন্টে তেমন কোন সংশোধন করা হয়নি। সেখানে প্রায় সবকিছুই বহাল রাখা হয়েছে।
মধ্যযুগের শেষভাগের আগে এ বিচিত্র সংকলনের বিরুদ্ধে আপত্তি করার মত সাহস অন্ততপক্ষে পাশ্চাত্য দেশে কারো ছিল না। একজনেরও না। মধ্যযুগের শেষভাগ থেকে বর্তমান যুগের শুরু পর্যন্ত সময়ে দু’একজন সমালোচককে সোচ্চার হতে দেখা যায়, কিন্তু গির্জা কর্তৃপক্ষ সর্বদাই তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে অবশ্য সমালোচনামূলক রচনার কোন অভাব নেই, কিন্তু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ বহু বিষয়ে সুগভীর গবেষণা করলেও তাদের ভাষায়”অসুবিধাজনক” বিষয়গুলির গভীরে যাওয়া থেকে তারা বিরত ক্তহেকেছেন। এমনকি তারা আধুনিক জ্ঞানের আলোকে ঐগুলি পরীক্ষা করে দেখতেও আগ্রহান্বিত হননি। ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে যেখানে বাইবেলের বিবরণের সদৃশ্য আছে, সেখানে তারা সে সাদৃশ্য প্রমাণ ও সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট মেহনত করেছেন, কিন্তুবাইবেলের বিবরণের সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের তুলনা থেকে তারা সযত্নে দূরে থেকেছেন। কারণ তারা উপলব্ধি করেছেন যে, এরুপ তুলনা করা হলে সাধারণ মানুষ ইহুদী ও খৃস্টান ধর্মগ্রন্থের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করবে এবং প্রশ্ন উত্থাপন করবে। অথচ এ ধর্মগ্রন্থগুলি এতদিন যাবত সকল সন্দেহ ও সকল প্রশ্নের উর্ধে রয়েছে।
ওল্ড টেষ্টামেন্ট ও বিজ্ঞানঃ কতিপয় সাব্যস্ত সত্য
ওল্ড টেষ্টামেন্ট ও গসপেলে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা আধুনিক জ্ঞানলব্ধ তথ্যের বিরোধী। এ বিরোধীতা যখন বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘটে, তখন দেখা যায় বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা আগেই দেখেছি যে, বাইবেলে অনেক ইতিহাসগত ভূল তথ্য রয়েছে। ইহুদী ও খৃস্টান বিশেষজ্ঞদের উল্লেখিত এরুপ কয়েকটি ভুল আমরা উধৃতও করেছি। তারা অতিশয় স্বাভাবিক কারণে ভুলগুলিকে ছোট করে দেখিয়েছেন। কারণ তাদের কাছে এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে যে, ধর্মীয় লেখকগণ ধর্ম অনুসারেই ঐতিহাসিক তথ্য পেশ করেছেন এবং ধর্মের প্রয়োজন পূরণ করার জন্যই তারা ইতিহাস লিখেছেন। পরে আমরা দেখতে পাব যে, মথি (ম্যাথু) লিখিত সুসমাচারে (গসপেল) একইভাবে সত্যকে বিকৃত করা হয়েছে এবং সেই বিকৃতিকে সত্য বলে গ্রহণযোগ্য করার জন্য একই ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন পক্ষেই এ প্রক্রিয়া মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
যুক্তির ভিত্তিতে বিবেচনা করা হলে বহু স্ববিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতার সন্ধান পাওয়া যাবে। একটি ঘটনার বিবরণ লিখতে গিয়ে বিভিন্ন লেখক যদি বিভিন্ন উৎসের ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয় এবং কোন কোন বিশেষজ্ঞ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছেন যে, একই ঘটনার একাধিক রুপান্তর করা হয়েছে, মূল বর্ণনায় পরে সংযোজন করা হয়েছে এবং প্রথমে ব্যাখ্যা লিখে পরে তাঁর জন্য মূল বর্ণনা প্রস্তুত করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ তৌরাতের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, ফাদার দ্য ভক্স তাঁর জেনেসিসের তরজমার ভূমিকায় (১৩-১৪ পৃষ্ঠা) এরুপ বহু অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতার উল্লেখ করেছেন। পরে আমরা কয়েকটি নমুনা পেশ করব। তবে মূল বর্ণনা পড়ার পর পাঠক যদি মনে করেন যে, পঠিত বিষয় আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাহলে তাকে বোধহয় খুব দোষ দেয়া যাবে না। আপাতত আমরা কয়েকটি নমুনা পেশ করছিঃ
জেনেসিসে (৬.৩) বলা হয়েছে, বন্যার ঠিক আগে আল্লাহ স্থির করলেন যে, মানূষের জীবনকাল অতঃপর একশত বিশ বছর সীমাবদ্ধ হবে-”তাহার হায়াত একশত বিশ বয়সর হইবেক।” কিন্তু পরে আবার ঐ জেনেসিসেই (১১.১১, ১০.৩২) দেখা যাচ্ছে যে, নূহের দশ জন আওলাদের হায়াত ১৪৮ থেকে ৬০০ বছর পর্যন্ত হয়েছে (পরে সংযোজিত তালিকায় ইব্রাহীম পর্যন্ত নূহের দশজন আওলাদের হায়াতে দেখুন) । এ দুটির বর্ণনায় অসঙ্গতি খুবই স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর কারণ কি? কারণ হচ্ছে এই যে, প্রথম বর্ণনাটি (জেনেসিস ৬, ৩) খৃস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর ইয়াহভিষ্ট গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় বর্ণনাটি (জেনেসিস ১১, ১০-৩২) নেয়া হয়েছে খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর স্যাকারডোটাল সংস্করণ থেকে। এ সংস্করনটিই হচ্ছে নসবনামার মূল উৎস। প্রত্যেক পয়গম্বরের হায়াত এ নসবনামায় একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে বটে কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে ব্যাপারটি অসম্ভব বলে মনে হবে।
এ জেনেসিসেই আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতির শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন দেখতে পাই। নিম্নলিখিত তিনটি গুরুত্তপূর্ণ বিষয়ে এ অসঙ্গতি রয়েছেঃ
(১) দুনিয়া সৃষ্টি এবং তাঁর বিভিন্ন পর্যায়।
(২) দুনিয়া সৃষ্টির তারিখ এবং মানুষের দুনিয়ায় আসার তারিখ।
(৩) বন্যার বিবরণ।
এখন আমরা পর পর এ তিনটি বিষয় আলোচনা করব।
দুনিয়া সৃষ্টি
ফাদার দ্য ভক্স উল্লেখ করেছেন যে, জেনেসিসের”শুরুতেই দুনিয়া সৃষ্টি সম্পর্কে পাসাপাশি দুটি বিবরণ রয়েছে।” এখন এ বিবরণ দুটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, তা আমরা পর পর পরীক্ষা করে দেখব।
প্রথম বিবরণ
জেনেসিসের প্রথম অধ্যায় এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই এ প্রথম বিবরণ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ভূল ও অসত্যের এমন সমাবেশ আর কোথাও নেই। সুতরাং প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদ পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। এখানে যে উধৃতি দিয়েছি, তা বাইবেলের সংশোধিত স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে (রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সনঃ প্রকাশক-বৃটিশ এন্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটির পক্ষে ডব্লু এম কলিনস এন্ড সন্স, ১৯৫২) ।
প্রথম অধ্যায়, শ্লোক ১-২:
“আদিতে ইশ্বর আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল এবং অন্ধকার জলধির উপর ছিল, আর ইশ্বরের আত্মা জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন।”
বর্তমানে আমরা যাকে জ্যোতির্মন্ডল বলি, দুনিয়া সৃষ্টির আগে তা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল বলে স্বীকার করে নেয়া সম্ভব। কিন্তু তখন পানির অস্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করা নিছক কল্পনা মাত্র। পরে আমরা দেখতে পাব যে, জ্যোতির্মন্ডল গঠিত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে গ্যাস বাঃ ধোঁয়ার অস্তিত্ব ছিল বলে যথেষ্ট আভাস পাওয়া যায়। সেখানে পানি থাকার কথা সম্পূর্ণ ভুল।
শ্লোক ৩-৫:
“পরে ইশ্বর কহিলেন দীপ্তি হঊক; তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ইশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ইশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে এক (প্রথম) দিবস হইল।”
জ্যোতির্মন্ডলে যে আলোক প্রবাহিত হয়, তা তারকারাজির জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। পরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। বাইবেলের মতেই সৃষ্টির এ পর্যায়ে তারকারাজি তখনও গঠিত হয়নি। আসলে ১৪ নং শ্লোকের আগে”দীপ্তিসমূহ” উল্লেখই করা হয়নি। ঐ শ্লোকেই চতুর্থ দিনেই আলোক সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে-”রাত্রি হইতে দিবসকে পৃথক করিবার জন্য”, এবং”পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য।” এ বর্ণনা সঠিক। কিন্তু আলোকের কারণ যখন তিন্দিন পরে সৃষ্টি হয়েছিল, তখন প্রথম দিনে আলোকের ইয়ল্লেখ করা অযৌক্তিক। তাছাড়া সৃষ্টির প্রথম দিনেই সন্ধ্যা ও সকালের উলেখ করাও কল্পনা প্রসুত; কেননা, একমাত্র পৃথিবী সৃষ্টির হওয়ার পর এবং তাঁর নিজস্ব জ্যপ্তিস্ক সূর্যের আলোকে পৃথিবী নিজের চারিদিকে একবার পরক্রম করার পরই সন্ধ্যা ও সকাল হওয়ার ধারণা করা সম্ভব হতে পারে।
শ্লোক-৬-৮:
“পরে ইশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হঊক, ও জলকে দুভাগে পৃথক করুক। ইশ্বর এরুপে বিতান করিয়া বিতানের উর্ধাস্তি জল হইতে বিতানের অধঃস্তিত জল পৃথক করিলেন। তাহাতে সেইরুপ হইল। পরে ইশ্বর বিতানের নাম আকাশ মন্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।”
এখানেও পানির সে কাহিনী আছে এবং আকাশ পানিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিভক্তির ফলেই বন্যার বর্ণনা দেয়ার সময় বলা সম্ভব হয়েছে যে, উপরের পানি আকাশ অতিক্রম করে দুনিয়ায় এসে পড়েছে।
কিন্তু পানির এভাবে দুভাগে বিভক্ত হওয়ার ধারণাটি বৈজ্ঞানিক কারণে গ্রহণযোগ্য নয়।
শ্লোক ৯-১৩:
“পরে ইশ্বর কহিলেন, আকাশমন্ডলের নিচস্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল সপ্রকাশ হউক; তাহাতে সেইরুপ হইল। তখন ইশ্বর স্থলের নাম ভূমি ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন; আর ইশ্বর দেখিলেন যে, তাহা উত্তম। পরে ইশ্বর কহিলেন, ভূমি তৃণ, বীজোৎপাদক ওষধি ও স্বজীব স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফলবৃক্ষ ভূমির উপরে উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরুপ হইল। ফলত ভূমি তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বিজোৎপাদক ওষধি, ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবীজ ফলের উৎপাদক বৃক্ষ উৎপন্ন করিল; আর ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইতে দিবস হইল।”
পৃথিবী নিমজ্জিত থাকার সময় ক্রমে ক্রমে জমি ভেসে উঠেছিল, এ ধারণাটি বৈজ্ঞানিকভাবেই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সূর্য সৃষ্টি হওয়ার আগে একটি সুশৃঙ্খল লতা-গুল্ম বৃক্ষ ব্যবস্থা এবং বীজের মারফত তাঁর উৎপাদন প্রবাহ সৃষ্টি হওয়ার ধারণা আদৌ যুক্তিসংগত হতে পারে না এবং একই কারণে দিন রাত্রির বিবর্তন ব্যবস্থাও গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। উল্লেখযোগ্য যে, জেনেসিসের মতেই সূর্য চতুর্থ দিনের আগে সৃষ্টি হয়নি।
শ্লোক ১৪-১৯:
“পরে ইশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে পৃথক করণার্থে আকাশমন্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক, সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দেবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমন্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরুপ হইল। ফলত ইশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব করিতে এক মহাজ্যোতি ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এক জ্যোতি, এ দুই বৃহৎ জ্যোতি এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ করিলেন। আর পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য এবং দিবস ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করণার্থে এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার পৃথক করণার্থে ইশ্বর ঐ জ্যোতিসমূহকে আকাশমন্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন এবং ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকাল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।”
এ বিবরণ মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও একটি বড় অসঙ্গতি আছে। আমরা জানি যে, পৃথিবী ও চাঁদ তাদের মূল জ্যোতিষ্ক সূর্যের খন্ডিত অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পরে সূর্য ও চাদের সৃষ্টি হওয়ার ধারণাটি সৌরজগত সৃষ্টির সর্বজন স্বীকৃত ও সর্বত্র গৃহীত অভিমতের সম্পূর্ণ বিরোধী।
শ্লোক ২০-২৩:
“পরে ইশ্বর কহিলেন, জল নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণীময় হউক এবং ভূমির উর্ধে আকাশমন্ডলের বিতানে পক্ষীগণ উড়ুক। তখন ইশ্বর বৃহৎ তিমিগণের ও যে নানা জাতীয় জঙ্গম প্রানণিবর্গে জল প্রাণিময় আছে, সে সকলের এবং নানা জাতীয় পক্ষীর সৃষ্টি করিলেন। পরে ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর ইশ্বর সে সকলকে আশির্বাদ করিয়া কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও, সমুদ্রের জল পরিপূর্ণ কর এবং পৃথিবীতে পক্ষীগণের বাহুল্য হউক। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে পঞ্চম দিবস হইল।” এ অনুচ্ছেদে এমন কিছু বক্তব্য রয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। বলা হয়েছে যে, সামুদ্রিক জীব ও ডানা বিশিষ্ট পাখির আগমনে প্রাণিজগতের শুরু হয়েছে। এবং এটা ঘটেছে পঞ্চম দিবসে। কিন্তু পরের শ্লোকেই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে প্রাণিজগতের শুরু হয়েছে পরের দিন, অর্থাত ষষ্ঠ দিবসে। একটু পরেই আমরা ষষ্ঠ দিবসের শ্লোক উধৃত করব। সমুদ্রেই প্রাণের শুরু হয়েছে এবং সেখান থেকেই যে পৃথিবীতে প্রাণির আবাদ হয়েছে তা ঠিক, তবে এ বিষয়ে আমরা পর আলোচনা করব। আপাতত আমরা শ্লোকের বিষয়বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। জমির উপরে বসবাসকারী প্রাণী, বিশেষত দ্বিতীয় যুগের এক প্রজাতির সরীসৃপ থেকে পাখির জন্ম হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। উভয় প্রজাতির একই ধরনের কতিপয় দৈহিক বৈশিষ্টের কারণে এ অনুমান সম্ভব বলে মনে করা হয়ে থাকে। বাইবেলে কিন্তু ভূমিতে জীবের আবির্ভাবের উল্লেখ করা হয়েছে ষষ্ঠ দিবসে পাখির পরে। সুতরাং পাখির পরে ভূমিতে অন্য জীবের আবির্ভাবে এ ক্রমিকতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
শ্লোক ২৪-৩১:
“এবং ইশ্বর কহিলেন, ভূমি নানা জাতীয় প্রাণী বর্গ, অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গৃহী পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপন্ন করুক; তাহাত সেইরুপ হইল। ফলত ইশ্বর স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বন্য পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গৃহী পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী যাবতীয় ভূচর সরীসৃপ নির্মাণ করিলেন; আর ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। পরে ইশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি; আর তাহারা সমুদ্রের মৎসদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুগণের উপরে, সমস্ত পৃথিবীর উপরে ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় সরীসৃপের উপরে কর্তৃত্ব করুক। পরে ইশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতে মনুষ্য সৃষ্টি করিলেন; ইশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহা্কে সৃষ্টি করিলেন, পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। পরে ইশ্বর তাহাদিগকে আশির্বাদ করিলেন; ইশ্বর কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভুত কর, আর সমুদ্রের মৎস্যগণের উপরে, আকাশের পক্ষীগণের উপরে এবং ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবজন্তুর উপরে কর্তৃত্ব কর। ইশ্বর আরও কহিলেন, দেখ, আমি সমস্ত ভূতলে স্থিত যাবতীয় বীজোৎপাদক ওষধি ও যাবতীয় সবজী ফলদায়ী বৃক্ষ তোমাদিগকে দিলাম, তাহা তোমাদের খাদ্য হইবে। আর ভূচর যাবতীয় পশু ও আকাশের যাবতীয় পক্ষী, ও ভুমিতে গমনশীল যাবতীয় কীট, এ সকল প্রাণীর আহারার্থে হরিৎ ওষধি দিলাম। তাহাতে সেইরুপ হইল। পরে ইশ্বর আপনার নির্মিত বস্তু সকলের প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সকলই অতি উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে ষষ্ঠ দিবস হইল।”
সৃষ্টির বর্ণনা এখানেই শেষ হয়েছে। আগে যে সকল প্রাণীর কথা বলা হয়নি, লেখক এখানে তাঁর ফিরিস্তি দিয়েছে এবং মানুষ ও পশু খাদ্যেরও বিবরণ দিয়েছেন।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, পাখির আগে অন্যান্য প্রাণীর আবির্ভাবে কথা বলা ভূল হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য প্রাণীড় আবির্ভাবে পরে মানুষের আবির্ভাবের কথা বলা সঠিক হয়েছে। বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ের পর দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম তিনটি শ্লোকে সৃষ্টির বর্ণনা শেষ হয়েছে এভাবেঃ
অধ্যায় ২: শ্লোক-১৩
“এরুপে আকাশমন্ডল ও পৃথিবী এবং তদুভয়স্থ সমস্ত বস্তুব্যুহ সমাপ্ত হইল। পরে ইশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃতকার্য হইতে নিবৃত্ত হিলেন, সেই সপ্তম দিনে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন। আর ইশ্বর সেই সপ্তম দিনকে আশির্বাদ করিয়া পবিত্র করিলেন, কেননা সেই দিনে ইশ্বর আপনার সৃষ্ট ও কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন।” এ বিষয়ে এখন কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।
হিব্রু শব্দ”শাব্বাথ” তরজমার একটি রেওয়াজ মোতাবেক”তিনি বিশ্রাম করিলেন” হয়ে থাকে। এখানেও তাই হয়েছে। কিন্তু আসলে ইশ্বরের বিশ্রাম গ্রহণের ব্যাপারটি একটি কিংবদন্তি মাত্র।
এখানে উধৃত বিবরণটি বাইবেলের স্যাকারডোতাল সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে। এ সংস্করনটি খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে লিখিত হয়। কিন্তু তাঁর কয়েক শতাব্দী আগে লেখা ইয়াহভিষ্ট সংস্করনে ইশ্বরের বিশ্রাম গ্রহণের কোন উল্লেখ নেই। যারা বিশ্রাম দিবসের কথা লিখেছেন, তারা সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস ও সম্ভ্রম সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বলেছেন যে, খোদ ইশ্বরই ঐ দিবস প্রথমে পালন করেছেন। তাছাড়া তারা অপর ছয়টি দিনের সৃষ্টিকার্যও ক্রমিকতা সহকারে বেশ বিস্তারিতভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানে সৃষ্টি সম্পর্কে যে সকল তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, তাঁর ভিত্তিতে বিচার বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, তাদের ঐ ক্রমিকতা আদৌ সঠিক নয় বরং খেয়ালিপনা মাত্র।
সৃষ্টির ক্রমিক পর্যায়গুলি যে মাত্র এক সপ্তাহ সময়ের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে, এধারণাটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বর্তমানে আমরা সঠিকভাবেই জানতে পেরেছি যে, জ্যোতির্মন্ডল এবং পৃথিবীর গঠন পর্যায়ক্রমে বহুদিনে অর্থাৎ অনেক সময়ের মেয়াদে সম্পন্ন হয়েছে। (এই বিষয়ে কুরআনের বিবরণ আমরা পরে পরীক্ষা করব) । যদি বিশ্রাম দিনের কথা উল্লেখ না করেই সৃষ্টির বিবরণ ষষ্ঠ দিনের বিবরণেই সমাপ্ত করা হয়েছে এবং দিন গুলিকে আসল বাঃ প্রকৃত দিন মনে না করে কুরআনের বিবরণের মত সুদীর্ঘ সময় বলে ধরে নেয়ার মত সুযোগ রয়েছে তবূও বাইবেলের বিবরণ ঘটনার ক্রমিকতার অসম্ভাব্যতার কারণেই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ওই বিবরণ কল্পিত ও বানোয়াট। সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে নয়, অন্য কোন উদ্দেশ্যেই এ বিবরণ রচিত ও প্রতারিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিবরণ
প্রথম বিবরণ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরই কোন মন্তব্য বাঃ অন্তবর্তী বক্তব্য ছড়াই জেনেসিস অর্থাৎ আদিপুস্তকে সৃষ্টির দ্বিতীয় বিবরণ শুরু হয়েছে। এখানে অবশ্য একই ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ বিবরণট আরও তিন শতাব্দীর পুরানো এবং খুবই সংক্ষিপ্ত। এখানে পৃথিবী ও আকাশমন্ডল সৃষ্টির তুলনায় মানুষ ও তাঁর বাসোপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বেশী সময় দেয়া হয়েছে।
অধ্যায় ২: শ্লোক ৪-৭
“যেদিন ইয়াউয়েহ ইশ্বর পৃথিবী ও আকাশমন্ডল নির্মাণ করিলেন, সেই সময় পৃথিবীতে ক্ষেত্রের কোন উদ্ভিজ্জ হইত না, আর ক্ষেত্রের কোন ওষধি উৎপন্ন হইত না। কেননা সদাপ্রভূ ইশ্বর পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষাণ নাই, আর ভূমিতে কৃষিকর্ম করিতে মনুষ্য ছিলনা। তবে ভূমি হইতে বন্যা উঠিয়া সমস্ত ভূতলকে জলসিক্ত করিল। আর ইয়াউয়েহ ইশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে মনুষ্য নির্মাণ করিলেন এবং তাহার নাসিকায় ফু দিয়া প্রাণবায়ু প্রবেশ করাইলেন; তাহাতে মনুষ্য সজীব প্রাণী হইল।”
বর্তমান কালের বাইবেলে এ ইয়াহভিষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। পরে স্যাকাডোটাল বিবরণও যোগ করা হয়েছে। তবে বিবরণটি মূলত এমন সংক্ষিপ্ত ছিল কিনা, সে সম্পর্কে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সময়ের বিবর্তনে বিবরণটি কেতেছেটে ছোট করা হয়েছে কিনা তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। অথবা এখন যা পাওয়া যাচ্ছে, তাই মূল বিবরণ কিনা, তাও সঠিক ভাবে জানা যায় না।
এই বিবরণে পৃথিবী ও আকাশমন্ডল নির্মাণের বিস্তারিত বর্ণনা নেই। শুধু বলা হয়েছে যে, ইশ্বর যখন মানুষ সৃষ্টি করেন, তখন পৃথিবীতে উদ্ভিজ্জ ছিল না (তখন ও বৃষ্টি হয়নি), যদিও মাটি থেকে পানি উঠে সমগ্র ভূতল সিক্ত করেছিল। তারপরই বলা হয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টির একই সময়ে”ইশ্বর এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন”। সুতরাং মানুষ ও বৃক্ষলতা একই সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। এ দুই সৃষ্টির মাঝখানে কত কোটি বছর অতিবাহিত হয়েছে, তা অবশ্য আমরা জানি না।
যাহোক, এ বিবরণের বিরুদ্ধে কেবল ঐ আপত্তিই উত্থাপন করা যায়। স্যাকারডোটাল বিবরণে মানুষ ও পৃথিবীর সৃষ্টি একই সপ্তাহে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ইয়াহভিষ্ট বিবরণে তেমন কিছু বলা হয়নি। ফলে এ বিবরণের বিরুদ্ধে তেমন কোন মারাত্মক আপত্তির অবকাশ নেই।
পৃথিবীর সৃষ্টি এবং সেখানে মানুষের আবির্ভাবের তারিখ
ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত ইহুদী পঞ্জিকায় এ দুটি তারিখই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসাব অনুসারে খৃষ্টীয় ১৯৭৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর ৫, ৭৩৬ তম বছর শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে পৃথিবীর বয়স ৫, ৭৩৬ বছরে পড়েছে। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবি সৃষ্টির কয়েকদিন পরে। সুতরাং মানুষের বয়সও ঐ একই দাঁড়ায়।
এ প্রসঙ্গে সামান্য একটি সংশোধনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। প্রাচীনকালে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে সময় গণনা করা হত, কিন্তু বর্তমানে পাশ্চাত্য জগতে সময় গণনা করা হয় সৌরবর্ষের ভিত্তিতে। হিসাব নির্ভুল করার জন্য এ সংশোধন করা প্রয়োজন, কিন্তু সংশোধন যদি না করা হয়, তাহলে হেরফের হয় শতকরা মাত্র তিনভাগ। সুতরাং হিসাব সহজ করার জন্য এ হেরফের আমরা উপেক্ষা করছি। এক হাজার বছরের হিসাব যদি তিরিশ বছর এদিক সেদিক হয়, তাহলে আমাদের মূল বক্তব্য বোধহয় খুব একটা ভূল হবে না। সুতরাং হিব্রু হিসাবের ভিত্তিতে আমরা প্রায় সঠিভাবে বলতে পারি যে, খৃষ্টের জন্মের প্রায় সাইত্রিশ শতাব্দী আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে কি বলে? এ প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেয়া কঠিন। তবে সোউরমন্ডল গঠিত হওয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে একটি যুক্তিসঙ্গত হিসাবেও উপনীত হওয়া যেতে পারে। সৌরমন্ডল গঠিত হওয়ার পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সারে চারশো কোটি বছর অতিবাহিত হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং এ সর্বজন স্বীকৃত হিসাব এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রদত্ত হিসাবের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা সহজেই বের করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা একটু পরে করব। তাঁর আগে আমরা বাইবেল থেকে হিসাব পাওয়ার পদ্ধতির উপর কিছুটা আলোকপাত করব।
বাইবেলের বর্ণনা গভীর মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করলে এ হিসাব পাওয়া যায়। জেনেসিস অর্থাৎ আদিপুস্তকে আদম থেকে ইব্রাহীম পর্যন্ত কত সময় অতিবাহিত হয়েছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর পরের পর্যায়ে, অর্থাৎ ইব্রাহীম থেকে খৃষ্টধর্ম শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত কাল সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা অপর্যাপ্ত। সুতরাং তাঁর পোষকতায় অন্যান্য তথ্যের প্রয়োজন।
আদম থেকে ইব্রাহীম
জেনেসিস বাঃ আদি পুস্তকের ৪, ৫, ১১, ২১, ও ২৫ অধ্যায়ে আদম পর্যন্ত ইব্রাহীমের সকল পূর্বপুরুষের সুনির্দিষ্ট নসবনামা দেয়া আছে। প্রত্যেকের জীবনকাল এবং পুত্রের জন্মের সময় পিতার বয়সও দেয়া আছে। সুতরাং আদম সৃষ্টির কত বছর পর কার জন্ম বা মৃত্যু হয়েছিল তা সহজেই নির্ণয় করা যেতে পারে। নীচের তালিকায় যে সকল তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তা জেনেসিসের স্যাকারডোটাল সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে এবং একমাত্র বাইবেলেই এ তথ্য আছে। এ হিসাব থেকে দেখা যায় যে, আদমের ১, ৯৪৮ বছর পর ইব্রাহীম জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ইব্রাহীমের নসবনামা
—- আদম সৃষ্টির পর জন্মের তারিখ — হায়াত — আদম সৃষ্টির পর মৃত্যুর তারিখ
১) আদম — – ৯৩০ — ৯৩০
সেথ — ১৩০ — ৯১২ — ১০৪২
ইনোশ — ২৩৫ — ৯০৫ — ১১৪০
কেনান — ৩২৫ — ৯১০ — ১২৩৫
মাহালালিল — ৩৯৫ — ৮৯৫ — ১২৯০
জারেদ — ৪৬০ — ৯৬২ — ১৪২২
ইনোক — ৬২২ — ৩৬৫ — ৯৮৭
মেথুছেলা — ৬৮৭ — ৯৬৯ — ১৬৫৬
লামেক — ৮৭৪ — ৭৭৭ — ১৬৫১
১০) নূহ — ১০৫৬ — ৯৫০ — ২০০৬
শেম — ১৫৫৬ — ৬০০ — ২১৫৬
আরফাখশাদ — ১৬৫৮ — ৪৩৮ — ২০৯৬
শেলাহ — ১৬৯৩ — ৪৩৩ — ২১২২
ইবার — ১৭২৩ — ৪৬৪ — ২১৮৭
পেলেগ — ১৭৫৭ — ২৩৯ — ১৯৯৬
রিউ — ১৭৮৭ — ২৩৯ — ২০২৬
সেরুগ — ১৮১৯ — ২৩০ — ২০৪৯
নাহোর — ১৮৪৯ — ১৪৮ — ১৯৯৭
তেরাহ — ১৮৭৮ — ২০৫ — ২৯৮৩
২০) ইবরাহীম — ১৯৪৮ — ১৭৫ — ২১২৩
ইবরাহীম থেকে ঈসা
এ আমলের জন্য বাইবেল কোন সংখ্যাতাত্বিক তথ্য দেয়া হয়নি। সুতরাং ইব্রাহীম থেকে ঈসা পর্যন্ত সময় নির্ণয় করার জন্য আমাদের অন্য উৎসের সন্ধান করতে হবে। বর্তমানে ইবরাহীমের আমল মোটামুটি ভাবে ঈসার আঠার শতাব্দী আগে বলে ধরা হয়ে থাকে। জেনেসিসে ইবরাহীম ও আদমের মধ্যবর্তী সময়ের যে হিসাব পাওয়া যায়, তাঁর ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায় যে, আদম হচ্ছেন মোটামুটি ভাবে ঈসার আটত্রিশ শতাব্দীর আগের মানূষ। এ হিসাব স্পষ্টতই ভুল এবং এ ভুল আসছে বাইবেলের আদম-ইবরাহীম আমলের হিসাব থেকে। অথচ ইহুদী পঞ্জিকা এখনও এ হিসাবের উপরই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ইহুদী পুরোহিতদের আনুমানিক হিসাব এবং আধুনিক তথ্যের মধ্যে যে অসঙ্গতি রয়েছে, তাঁর ভিত্তিতে আমরা অতি সহজেই বাইবেলের সত্যের ঐতিহ্যবাহী রক্ষকদের মুকাবিলা করতে পারি। অথচ বহু শতাব্দী যাবত তাদের এ হিসাবের ভিত্তিতেই ঈসার জীবনের প্রাচীন ঘটনাবলীর সময় নির্ণয় করা হয়েছে।
আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার আগে বাইবেলের প্রত্যেক সংস্করণে একটি ভূমিকা জিড়ে দেয়া হত। সেখানে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে ঐ সংস্করণের সম্পাদনার সময় ঘটনাবলীর ক্রমিকতা ব্যাখ্যা করা হত। বিভিন্ন সংস্করণে সময়ের বেশ হেরফেরও হত। উদাহরণ স্বরুপ ১৬২১ সালের ক্লিমেনটাইন ভালগেট সংস্করণে ইবরাহীমের যামানা আরও আগে বলে ধরা হয়েছে এবং পৃথিবীর সৃষ্টি মোতামুটিভাবে খৃষ্টপূর্ব চল্লিশতম শতাব্দীতে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সপ্তদশ শতাব্দীতে কয়েকটি ভাষায় লিখিত ওয়ালটনের বাইবেলে ইব্রাহীমের পূর্বপুরুষদের যামানার বিবরণ এখানে বর্ণিত নসবনামার অনুরুপ আকারে দেয়া হয়েছে। প্রায় সকল হিসাবই এ নসবনামার সঙ্গে মিলে যায়। আধুনিক যুগের বাইবেল সম্পাদক গণ অবশ্য এ হিসাব ও ভূমিকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন যে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে পৃথিবী সৃষ্টি আরও আগে হয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়েছে; সুতরাং ঐ পুরানো হিসাব এখন আর কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ সঙ্গে পাঠকদের পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া তাদের উচিত ছিল যে, বাইবেলের বর্ণনা অচল হয়ে গেছে এবং তাতে আসল সত্যতা নেই। কিন্তু এ কথাটি তারা বলেননি। পক্ষান্তরে কথার মারপ্যাচে তারা এমন একটি রহস্যময় আবরণ সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে কোনরকম রদবদল ছাড়া বাইবেলের বিবরণ যেমন আছে, ঠিক সেভাবেই যেন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
এ কারণে স্যাকারডোটাল সংস্করণে বর্ণিত নসবনামা এখনও মেনে নেয়া হয়, যদিও এ বিংশ শতাব্দীতে ঐ গালগল্প ভিত্তিক হিসাব আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁর ভিত্তিতে দুনিয়ায় মানুষের আবির্ভাবের কোন সঠি তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিছুটা ইশারা ইংগিত পাওয়া যেতে পারে মাত্র। তবে আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরে নিতে পারি যে, পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মানুষের মত একই অবয়ব বিশিষ্ট আরও প্রাণী আছে বা থাকতে পারে। কিন্তু কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে তাদের থেকে পৃথক বলে চিহ্নিত করে থাকে। এ মানুষের যে প্রাচীনতম অস্থি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে, মানূষের আবির্ভাব লক্ষ্য লক্ষ্য বছর আগে হয়েছে।
এ অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষে অস্থির সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার। বিশেষোজ্ঞদের ভাষায় এ মানুষ ক্রো-ম্যাগনন মানূষ নামে অভিহিত। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষের মত একই অবয়বের প্রাণীর বহু প্রাচীন অস্থিও আবিষ্কৃত হয়েছে বটে এবং সেগুলো স্পষ্টতই আরও আগের আমলের। কিন্তু সেগুলি আসলে মানুষেরই অস্থি কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে।
তবে জেনেসিসে মানুষের আবির্ভাবে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, বৈজ্ঞানিক তথ্য যে তাঁর অনেক আগের সময় নির্দেশ করে থাকে, সে সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাইবেল ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ও বিরোধ রয়েছে।
বন্যা ও প্লাবন
জেনেসিসের ৬ষ্ঠ, ৭ম, ও ৮ম অধ্যায়ে বন্যার বর্ণনা আছে। বর্ণনা আসলে দুটি, কিন্তু তা পাশাপাশি পেশ না করে একত্রে মিশিয়ে একটি বর্ণনার আকারে পেশ করা হয়েছে এবং মিশিয়ে ফেলার কাজটি এমন ভাবে করা হয়েছে, যাতে ক্রমিকতা ও সঙ্ঘবদ্ধতার দিক থেকে বাহ্যত একটি বর্ণনা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ঐ তিনটি অধ্যায়ে স্পষ্ট পরষ্পর বিরোধিতা রয়েছে। কারণ সেই একই, অর্থাৎ বিষয়বস্তু দুটি উৎস থেকে নেয়া হয়েছে। একটি ইয়াহভিষ্ট সংসকরণ, এবং অপরটি স্যাকারডোটাল সংস্করণ।
এ দুটি সংস্করণের বিবরণ থেকে অনুচ্ছেদ বা বাক্য নিয়ে একটির প অপরটি এমনভাবে বসানো হয়েছে যে, ইংরাজী অনুবাদের প্রায় একশো লাইনের মধ্যে কমপক্ষে সতর বার উৎস বদলের সন্ধান পাওয়া যায়।
যাহোক বিবরণতি মোটামুটি এরুপ – মানুষের পাপাচার সীমাহীন হয়ায় আল্লাহ অন্যান্য প্রাণিসহ তাকে ধ্বংস করতে স্থির করেন। তিনি নূহকে সতর্ক করে দেন এবং নৌকা বানাতে বলেন। ঐ নৌকায়, তিনি অন্যান্য প্রাণীসহ নূহকে তাঁর স্ত্রী, তাঁর তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রীদের তুলে দিতে বলেন। এ জায়গা থেকে দুই বর্ণনা পার্থক্য দেখা যায়। এক বর্ণনায় (স্যাকারডোটাল) বলা হয়েছে যে, নূহকে প্রত্যেক প্রজাতির এক জোড়া প্রাণি নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঠি পরের অনুচ্ছেদেই (ইয়াহভিষ্ট) বলা হয়েছে যে, নূহকে তথাকথিত”পবিত্র” প্রাণীর প্রত্যেক প্রজাতির সাতটি পুরুষ ও সাতটি নারী এবং”অপবিত্র” প্রাণীর প্রত্যেক প্রজাতির একটি পুরুষ ও একটি নারী নিতে বলা হয়েছিল। পরে অবশ্য বলা হয়েছে যে, নূহ আসলে প্রত্যেক প্রজাতির এক জোড়া প্রাণী সঙ্গে নিয়েছিলেন। ফাদার দ্য ভক্সের মত বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, এ অনুচ্ছেদটি ইয়াহভিষ্ট বর্ণনার একটি বিকৃত রূপ।
ইয়াহভিষ্ট অনুচ্ছেদে বৃষ্টির ফলে বন্যা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে স্যাক্রডোটাল অনুচ্ছেদে বৃষ্টি এবং মাটি থেকে উঠে আসা পানির কথা বলা হয়েছে।
সমস্ত পৃথিবী, এমনকি পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সমস্ত প্রাণী মারা গিয়েছিল। এক বছর পর পানি সরে গেলে নৌকা আরলত পাহাড়ে ভেড়ে এবং নূহ অবতরন করেন।
উল্লেখযোগ্য যে, বন্যার মেয়াদের হিসাবেও গরমিল রয়েছে। ইয়াহভিষ্ট বর্ণনায় বলা হয়েছে চল্লিশ দিন, আর স্যাকারডোটাল বর্ণনায় আছে একশো পঞ্চাশ দিন।
নূহের জীবনের কোন পর্যায়ে বন্যা হয়েছিল, সে সম্পর্কে ইয়াহভিষ্ট বর্ণনায় কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু স্যাকারডোটাল বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, নূহের বয়স তখন ছয়শো বছর ছিল। এ বর্ণনায় আদম ও ইবরাহীমের সঙ্গে সম্পর্ক দেখিয়ে নূহের নসবনামাও দেয়া হয়েছে। জেনেসিসে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায় যে, নূহ আদমের ১০৫৬ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (নসবনামায় দেখুন) । সুতরাং বন্যা হয়েছিল আদম সৃষ্টি হওয়ার ১৬৫৬ বছর পরে। ইবরাহীমের সম্পর্কের প্রসঙ্গে জেনেসিসে বলা হয়েছে যে, তাঁর জন্মের ২৯২ বছর আগে বন্যা হয়েছিল।
জেনেসিসের মতে বন্যার ফলে সমগ্র মানবজাতি এবং পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত প্রাণী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরে নূহের তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রী গণ দুনিয়ায় মানুষের আবাদ করেন। অর্থাৎ মানবজাতি পূনর্গঠিত হয়। সুতরাং প্রায় তিন শতাব্দী পরে যখন ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেন, তখন মানবজাতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে পুনর্গঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে এ পুনর্গঠন কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? এ একটি মাত্র প্রশ্নেই এ বর্ণনার সত্যতার সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়।
তাছাড়া ইতিহাস্র আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গেও ঐ বর্ণনার কোন সঙ্গতি নেই। ইবরাহীমের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে বলে ধরা হয়েছে। অথচ বন্যা যদি তাঁর তিনশো বছর আগে হয়ে থাকে, তাহলে তো তাঁর জন্ম খৃশটোপূর্ব একবিংশ থেকে দ্বাবিংশ শতাব্দীর মধ্যে হওয়ার কথা।
ইতিহাসের আধুনিক জ্ঞান থেকে জানা যাচ্ছে যে, দুনিয়ায় কয়েকটি এলাকায় ওই সময় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, এবং তাঁর ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
মিসরের ক্ষেত্রে ওই প্রাচীন সভ্যতা মধ্য রাজবংশের (খৃষ্টপূর্ব ২১০০ সাল) আগের আমলের। ঐ আমল মোটামুটিভাবে একাদশ রাজবংশের পূর্ববর্তী প্রথম মধ্যম আমলের সমসাময়িক। ব্যবিলনে তখন উরে তৃতীয় রাজবংশের আমল। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে, এ সভ্যতা প্রবাহে কোন ছেদ পড়েনি, এবং সমগ্র মানব জাতিও ধ্বংস হয়ে যায় নি। অথচ বাইবেলে সেই কথাই বলা হয়েছে।
সুতরাং বাইবেলের এ তিনটি বর্ণনায় সত্য আছে বলে আমরা মেনে নিতে পারি না। নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে আমাদের স্বীকার করা ছাড়া উপায় থাকে না যে, বাইবেলের যে পাঠ এখন আমাদের সামনে আছে, তাঁর সঙ্গে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। এ অবস্থায় আমাদের নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে হয় যে, আল্লাহর অক্ষে সত্য ছাড়া আর কিছু নাযিল করা কি আদৌ সম্ভব? এমন কিছু ধারণা করাও অসম্ভব যে, আল্লাহ মানুষকে যা জানিয়ে দিয়েছেন, তা কেবল অবাস্তবই নয়, পরস্পর বিরোধীও বটে। সুতরাং আমরা স্বভাবতই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, বাইবেলের মূল পাঠে বিকৃতি ঘটেছে এবং বিকৃতি মানুষের দ্বারাই ঘটেছে। মুখে মুখে এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে আসার সময়, অথবা লিখিত হয়ে যাওয়ার পর তা নকল বা সম্পাদনা করার সময় এ বিকৃতি ঘটেছে। প্রায় তিনশো বছরের মধ্যে জেনেসিসের মত গ্রন্থ যখন কমপক্ষে দুইবার সম্পাদিত ও পরিমার্জিত হয়েছে বলে জানা যায়, তখন সেই কিতাবে অবাস্তবতা ও অসম্ভাব্যতা থাকা বোধহয় বিচিত্র কিছু নয়। অবশ্য এ অবাস্তবতা ও অসম্ভাব্যতা এখন আমাদের কাছে এ কারণে ধরা পড়েছে যে, আধুনিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের ফলে পুরোপুরি না হলেও সত্যের কিয়দংশ অন্তত আমরা জানতে পারছি এবং প্রাচীন বিবরণের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। বাইবেলের ভূল ভ্রান্তির জন্য মানুষকে দায়ী করা ছাড়া আর কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নেই এবং সম্ভবত থাকতেও পারে না। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এইযে, ইহুদী ও খৃস্টান এ উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভাষ্যকারই এ যুক্তি মেনে নিতে চান না। এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কোন যুক্তি ও বক্তব্য আছে। সেগুলি সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
বাইবেলের ভ্রান্তি সম্পর্কে খৃস্টান ভাষ্যকারদের বক্তব্য
বৈজ্ঞানিক তথ্য বিচার বিবেচনায় বাইবেলে যে সকল ভ্রান্তি, অসম্ভাব্যতা, ও স্ববিরোধিতার সন্ধান পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে খৃস্টান ভাষ্যকারদের নানাবিধ বকব্য ও ব্যাখ্যা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। কোন কোন ভাষ্যকার কিছু কিছু ভুল স্বীকার করেন এবং কিছু কিছু জটিল সমস্যার সমাধান দিতে চেষ্টা করেন। কোন কোন ভাষ্যকার আবার ভুল এড়িয়ে গিয়ে মূল পাঠের বক্তব্য সমর্থন করে থাকেন। তারা অযৌক্তিক যুক্তির ধুম্রজাল বিস্তার করে সম্ভবত আশা করেন যে, যা যুক্তিসঙ্গতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, তা মানুষ সহজেই ভুলে যাবে।
ফাদার দ্য ভক্স তাঁর জেনেসিসের তরজমার ভূমিকায় এরূপ বিতর্কিত বক্তব্যের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু অবৈধতার বদলে তিনি তাঁর বৈধতাই ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তিনি অবশ্য প্রাচীন ঘটনাবল্লী যুক্তিসঙ্গত আকারে পুনর্গঠন করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাননি। তাঁর মতে”তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস উপ্ত্যকার যে একটি বা দুটি ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি কালক্রমে লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে বিশ্বব্যাপী বন্যার আকার ধারণ করেছে এবং সেইভাবে বাইবেলে লিখিত হয়েছে” তাঁর কোন নিজস্ব গুরুত্ব নেই। এ ঘটনার”আসল তাৎপর্য হচ্ছে মানুষের বিদ্বেষের প্রতি আল্লাহর ইনসাফ এবং সৎ মানুষের প্রতি তাঁর রহমত। বাইবেলের এ ঘটনার লেখক এ তাৎপর্যটিই সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।”
এভাবে জনপ্রিয় কিংবদন্তিকে আসমানী পবিত্রতায় অভিসিক্ত করার যৌক্তিকতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। লেখক তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা উদাহরণ সহকারে বুঝাতে গিয়ে কিংবদন্তি ব্যবহার করেছেন, এ যুক্তিতে ঐ কিংবদন্তিকেও মানুষের বিশ্বাসের অংশ বলে পেশ করা হয়েছে। এ ধরণের যুক্তিকে সঙ্গত বলে মেনে নেয়া হলে পবিত্র ও আল্লাহর কালাম সম্বলিত বলে অভিহিত রচনায় অবশ্য যে কোন ধরনের অসম্ভবকে অতি সহজেই সম্ভব বলে চালিয়ে দেয়া যায়। আর আল্লাহর কালামে এভাবে মানুষের হস্তক্ষেপ হয়েছে বলে যদি স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে অবশ্য বাইবেলের পাঠে সকল প্রকার মানবীয় হস্তক্ষেপ ও রদবদলের একটি সঙ্গত কারণ খুজে পাওয়া যায়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকলেই যদি মূল পাঠেও রদবদল করা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে তো আর বলার কিছুই থাকেনা। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর স্যাকারডোটাল লেখকগণ কিভাবে তাদের খেয়ালখুশী মাফিক মূল পাঠে রদবদল করেছেন। তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও উচ্চবাচ্য করার আর কোন উপায় থাকে না।
বহু খৃস্টান ভাষ্যকার বাইবেলের বর্ণনায় ভুল, অসম্ভাব্যতার ও স্ববিরোধিতার এ কথা বলে ব্যাখ্যা করে থাকেন যে, বাইবেলের লেখক গণ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা মানসিকতার সামাজিক পটভূমিতে তাদের চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন; ফলে গরমিল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ ব্যাখ্যা থেকেই বিভিন্ন ধরনের”সাহিত্যিক স্টাইল” এর কথা চালু হয়েছে। অর্থাৎ সমস্যার একটি সর্বরোগের বটিকা খুজে পাওয়া গেছে। দুটি পাঠের মধ্যে কোন সামঞ্জস্যহীনতা পাওয়া গেলে ঐ ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক পটভূমি এবং ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলের কথা বলেই তাঁর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এ যুক্তি অবশ্য সকলেই স্বীকার করেন না। কিন্তু তবুও তাঁর ব্যবহার ও প্রয়োগ এখনও বন্ধ হয়নি। পরে নিউ টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাব যে, সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা ব্যাখ্যা করার জন্যও ঠিক এ যুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। যুক্তিগ্রাহ্য নয় এমন কোন বিষয়কে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আর একটি কৌশল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। মূল বিষয়ের চারপাশে কৈফিয়ত বা ব্যাখ্যামূলক অন্যান্য নানানবিধ বিষয়ের অবতারণা করা হয়ে থাকে। ফলে পাঠকের দৃষ্টি মূল বিষয় থেকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয়া হয়।
কার্ডিনাল দানিয়েলো বন্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঠি এ পন্থাই অবলম্বন করেছেন।”লিভিং গড” নামক পত্রিকার ফরাসী নাম”ডিউ ডিভান্ট” (নম্বর ৩৮, ১৯৭৪, পৃঃ ৯৫-১১২) প্রকাশিত”ফ্লাড ব্যাপ্টিজম জাজমেন্ট” নামক নিবন্ধে তিনি বলেন,”চার্চের প্রাচীনতম কিঙ্গবদন্তিতে বলা হয়েছে যে, বন্যার ধর্মীয় তাৎপর্যে যীশু এবং চার্চের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। এটা সবিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনা। সমগ্র মানবজাতির উপর একটী রায় স্বরূপ।” তারপর”অক্সিজেন” থেকে উধৃত করে তিনি তাঁর”হোমিলিজ অন ইজেকিয়েল” নামক রচনায় বলেছেন -“সমগ্র বিশ্বের জাহাজডুবি চূড়ায় রক্ষা পায়।” তারপর তিনি আট সংখ্যার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন-“পাহাড়ের চূড়ায় আটজন মানুষ রক্ষা পায়। নূহ, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর তিন পুত্র ও তাদের স্ত্রীগণ। এ কারণে আট সংখ্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ন।” জাস্টিন তাঁর”ডায়ালগ” নামক রচনায় যে যুক্তির অবতারণা করেছেন, সেই যুক্তিকে নিজের পক্ষে প্রয়োগ করে তিনি বলেছেন-“পাহাড়ের চূড়ায় আটজন মানুষ রক্ষা পায়। যীশু যে অষ্টম দিনে মৃত অবস্থা থেকে পুনর্জীবিত হয়ে ওঠেন, ঐ আটজন আসলে তারই প্রতীক মাত্র। নূহ হচ্ছেন যীশুর প্রতিচ্ছবি। বন্যার পর তিনি প্রথম জাতকও বটে। যীশু বাস্তবে যা করেছেন, নূহ পূর্বে তাঁর আভাস দিয়েছেন মাত্র।” এ ভাবে তুলনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন যে, নূহের
নৌকা ছিল কাঠের এবং যীশুর ক্রস ছিল কাঠের। এ সাদৃশ্য ও সাম্নজস্যের সমধিক তাৎপর্যের কারণেই নাকি বন্যার ধর্মীয় মূল্য বিশেষত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ কার্ডিনাল সাহেব বলতে চেয়েছেন যে, যীশুর সঙ্গে যার সম্পর্ক বা সাদৃশ্য নেই, তাঁর আদৌ কোন গুরুত্ব নেই।
এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক তুলনা সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ তুলনা একটি ভাষ্য মাত্র এবং তাও এমন একটি ঘটনা সম্পর্কে যে ঘটনা বাইবেলের ভিত্তিতে একটি বিশ্বজনীন ঘটনা বলেও প্রমানিত হয় না এবং সম্যের দিক থেকেও সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে আমরা বড়জোর মধ্যযুগে উপনীত হতে পারি এবং মধ্যযুগ হচ্ছে এমন একটি যুগ, যখন বাইবেল সম্পর্কে একমাত্র সমর্থনমূলক আলোচনা চাড়া আর কোন প্রকারের আলোচনাই সম্ভব ছিল না।
তবে সুখের বিষয় এই যে, ঐ নিষিদ্ধ যুগের আগেই যুক্তিসঙ্গত মনোভাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তা প্রকাশও করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সেন্ট অগাস্টিনের নাম করা যেতে পারে। তাঁর চিন্তাধারা তাঁর যুগের তুলনায় স্পষ্টতই যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। সে সে যুগে সেই ফাদার্স অব দি চার্চের আমলে বাইবেলের মূল পাঠ সম্পর্কিত আলোচনায় নিশ্চয়ই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কারণ সেন্ট অগাস্টিন তাঁর ৮২ নম্বর চিঠিতে এ ধরনের সমস্যার উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন -” ক্যানোনিক গ্রন্থগুলি সম্পর্কে আমার গভীরতম শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং আমার মনে আদৌ কোন সন্দেহ নেই যে, লেখার সময় লেখকগণ সঠিকভাবেই লিখেছেন এবং কোন ভূল করেননি। কিন্তু এ সকল গ্রন্থে আমি যখন এমন কোন বিবরণ দেখতে পাই যা বাস্তবতার বিরোধী, তখন আমার মনে আর সন্দেহ থাকে না যে, হয় আমার কপিটিতেই ভুল আছে না হয় অনুবাদক মূলের সঠিক অনুবাদ করতে পারেননি, আর না হয় নিজেই ব্যাপারটি ঠিকমত বুঝতে পারিনি। ”
ধর্মগ্রন্থে যে ভূল থাকতে পারে সেন্ট অগাস্টিন তা কল্পনাও করতে পারেননি। ধর্মগ্রন্থ নির্ভুল এ কথাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু সত্য ও বাস্তবতার বিরোধী কোন বিবরণের মুখোমুখী তিনি ভুলের যে সকল সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছেন, তাঁর মধ্যে মূল লেখকের ভুলের কোন উল্লেখ নেই। একজন কৌতুহলী বিশ্বাসীর মনোভাবই এ রকম। তাঁর আমলে বাইবেল ও বিজ্ঞানের যে সকল সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তাঁর মত অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিচার করলে তাঁর অধিকাংশ সমস্যাই অতি সহজেই সমাধান হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে বর্তমান যুগের বিশেষজ্ঞগণ বাইবেলে কোন ভুল আছে বলে স্বীকারই করতে চান না। এ অভিযোগটিকে তারা আদৌ কোন আমল দেন না এবং বাইবেলে যা আছে, তাকেই সর্বশক্তি দিয়ে সমর্থন করে থাকেন। বাইবেলের বিবরণ স্পষ্টতই ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যে তা সমর্থন করা প্রয়োজন, জেনেসিসের ভূমিকায় ফাদার দ্য ভক্স তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।” বর্তমানে ইতিহাস পাঠের জন্য যে বিধান অনুসরন করা করা হয়”,
সেই বিধান মোতাবেক বাইবেলে বর্ণিত ইতিহাস পাঠ না করার জন্য তিনি আবেদন জানিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে ইতিহাস যেন ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় লেখা সম্ভব। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, ইতিহাসে যখন ভুল বর্ণনা করা হয়, তখন তা ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে সত্য বা তথ্য কখনও মূল বিচার্য বিষয় হয় না। অথচ ভাষ্যকারগণ তবুও বাইবেলের বিবরণের সঙ্গে ভূতাত্বিক, জীবাশ্মতাত্বিক, অথবা প্রাগৈতিহাসিক কোন তথ্য মিলিয়ে দেখতে রাজি হন না। তারা বলেন -”এই সকল কোন বিদ্যার তথ্য বা বিধানের সঙ্গে বাইবেলের মিল থাকার প্রয়োজন নেই। কেউ মিল খুজতে গেলে তা হবে অবাস্তব মুকাবিলা এবং কৃত্রিম তুলনা”
(জেনেসিসের ভূমিকা, ৩৫পৃষ্ঠা) । স্পষ্টতই জেনেসিসের যে সকল বিষয় বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী, বিশেষত প্রথম এগারটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তর কথা মনে রেখেই এ মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু ঐ বাইবেলেরই কিছু কিছু বিবরণ যখন আধুনিক অনুসন্ধানে সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে, তখন ফাদার দ্য ভক্স আনন্দ প্রকাশ করতে বিলম্ব করেননি।” এই সকল বিবরণের সত্যতায় যারা সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, তারা এখন দেখতে পারেন যে ইতিহাস এবং প্রাচীন প্রত্নতত্বের তথ্য থেকে তাঁর সমর্থন পাওয়া গেছে।” (জেনেসিসের ভূমিকা ৩৪ পৃষ্ঠা) ।
অর্থাৎ বিজ্ঞানে যদি বাইবেলের সমর্থন পাওয়া যায়, তাহলে তা বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে; কিন্তু সমর্থন যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আদৌ কোন তুলনাই করা যাবে না। এ হচ্ছে ভাষ্যকার ও বিশেষজ্ঞদের যুক্তির ধারা।
আধুনিক ধর্মবিধগণ অবশ্য এ মীমাংসার অযোগ্য সমস্যার মীমাংসা করার জন্য একটি উপায় আবিষ্কার করেছেন। তারা সত্যের চিরন্তন ধারণাকেই বদলে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্যারিস থেকে লা সেঞ্চুরিয়ান কর্তৃক ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ধর্মবিধ ও লোরেজ লিখিত”বাইবেলের সত্য কি?” (কোয়েলে এস্ট লাভেরিটে দ্য লা বাইবেল) নামক পুস্তকে এ নতুন তত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বর্তমান আলোচনার স্বল্প পরিসরে তাঁর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। কেবলমাত্র বিজ্ঞান সম্পর্কে ঐ নতুন তত্বে যে রায় দেয়া হয়েছে, এখানে সেইটুকুই তুলে দিলেই বোধহয় যথেষ্ট হবে -”দ্বিতীয় ভ্যাটিক্যান কাউন্সিল বাইবেলের বিবরণের সত্যতা ও অসত্যতা নির্ণয়ের বিধান দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। মৌলিক বিষয়গুলি বিবেচনা করে দেখলে দেখা যাবে যে এরূপ বিধান প্রণয়ন করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ বাইবেলের বর্ণনার সত্যতা নির্ণয়ের জন্য যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বৈধতা বা অবৈধতা নির্ণয় করতে পারে না।
স্পষ্টই সত্যে উপনীত হওয়ার উপায় হিসেবে”বৈজ্ঞনিক পদ্ধতির” বৈধতা সম্পর্কে রায় দিতে চার্চ সক্ষম নয়। কিন্তু প্রশ্ন তো এখানে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে প্রমানিত তথ্য সম্পর্কে, কোন তত্ব বা পদ্ধতি সম্পর্কে নয়। বাইবেলের মতে সাইত্রিশ বা আটত্রিশ শতাব্দী আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা যে আদৌ সত্য নয় এটা জানার জন্য এ যুগে খুব বেশী বিদ্বান হওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমরা জানি যে, ঐ সময় মানুষের আবির্ভাব হয়নি এবং বাইবেলের নসবনামার ভিত্তিতে ঐ হিসাবে বের করা হয়েছে, তা সন্দেহের অতীত রুপেই ভুল বলে প্রমানিত হয়েছে। লেখক লোরেজ নিশ্চয়ই এ বিষয়ে অবহিত আছেন। মূল সমস্যার মুখোমুখী যাতে না হতে হয়, সেই জন্যই তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে ঐ এড়িয়ে যাওয়া মন্তব্য করেছেন।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত বাইবেলের ভুল তথ্যের মোকাবিলায় খৃষ্টান বিশেষজ্ঞগণ যে এ ধরণের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন, এ ঘটনা থেকেই প্রমানিত হয় যে, ব্যাপারটি তাদের জন্য সত্যই অস্বস্তিকর এবং এ সঙ্গে আর একটি কথাও প্রমানিত হয়ে যায় যে বাইবেলের এ তথ্যগুলি মানুষের রচিত, কোন অহী নয়।
খৃষ্টান জগতের এ অস্বস্তি দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলেই (১৯৬২-১৯৬৫) সবচেয়ে বেশী প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সুদীর্ঘ ইন বছর আলোচনার পর এবং পাচ বার মুসাবিদা করার পর অহী সম্পর্কে একটি ঘোষণার ব্যাপারে তারা একমত হতে সক্ষম হন। প্যারিসে লা সেঞ্চুরিয়ান কর্তৃক ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত অহী সম্পর্কিত ৪ নম্বর কন্সিলিয়ার ডকুমেন্টের ভূমিকায় হিজ গ্রেস ওয়েবার বলেছেন -” যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতি কাউন্সিলকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল, অবশেষে এ ভাবে তাঁর অবসান ঘটে।”
ঐ দলীলে ওল্ড টেস্টামেন্টের অসম্পূর্ণতা (অধ্যায়-৪, পৃষ্ঠা -৫৩) ও অসঙ্গতি অকপটে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে-”যীশু খৃষ্টের নাজাত কায়েম করার আগে মানবিক পরিস্থিতিতে ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। কে আল্লাহ আর কে মানুষ এবং আল্লাহ তাঁর ইনসাফ ও করুণায় মানুষের সঙ্গে কি আচরণ করে থাকেন, ঐ গ্রন্থগুলি থেকেই তা সকলে জানতে পেরেছিল। গ্রন্থগুলিতে যদিও এমন কিছু বিষয়বস্তু রয়েছে যা অসম্পূর্ণ ও অপ্রচলিত তবুও ঐ গ্রন্থগুলিই প্রকৃত আসমানী শিক্ষার বাহন ও প্রমাণ।
যে সকল বিষয়বস্তু সম্পর্কে”অসম্পূর্ণ” ও”অপ্রচলিত” বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলি স্পষ্টতই সমালোচনাযোগ্য এবং একদিন ঐ অনুচ্ছেদ্গুলি হয়ত বর্জনও করা হতে পারে। তবে ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন, মূলনীতিটি এখন বেশ পরিষ্কারভাবেই স্বীকার এবং ঘোষণা করা হয়েছে।
উপরে উদ্ধৃত মন্তব্যটি ভ্যাটিকান কাউন্সিলে অনুমোদিত সাধারণ ঘোষণার একটি অংশ। ঘোষণাটি ২, ৩৪৪ ভোটে গৃহীত হয়। মাত্র ৬ টি ভোট বিপক্ষে পড়ে। তবুও ঘোষণাটি পুরোপুরি সর্বসম্মত হয়েছে, এমন কথা বোধহয় বলা যায় না। আসলে ওই অনুমোদিত ঘোষণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খোদ হিজ গ্রেস ওয়েবার এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যাতে মূল ঘোষণাটিই সংশোধন করে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেছেন,”ইহুদী বাইবেলের কোন কোন গ্রন্থ সাময়িকভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে মাত্র, এবং ঐ গ্রন্থগুলিতে এমন কিছু বিষয়বস্তু আছে, যা অসম্পূর্ণ। ”’
মূল দলীলে যেখানে”অপ্রচলিত” বলা হয়েছে, ব্যাখ্যায় সেখানে বলা হয়েছে”সাময়িকভাবে গ্রহণযোগ্য”, কিন্তু এ দুটি কথায় কি একই অর্থ বুঝা যায়? তদুপরি ওয়েবার”ইহুদী” শব্দটি ব্যবহার করে এরূপ একটি ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, মূল দলীলে হিব্রু বাইবেলেরই সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু মূল দলীলে”ইহুদী” শব্দটি আদৌ ব্যবহার করা হয়নি। আসলে অংশত অসম্পূর্ণ ও অপ্রচলিত বলে কাউন্সিলে যে গ্রন্থের সমালোচনা করা হয়েছে, তা হচ্ছে খৃষ্টানদেরই ওল্ড টেস্টামেন্ট।
উপসংহার
বাইবেল যেমন আছে ঠিক সে আকারেই তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। কেউ এ ক্রমবিকাশ ও ক্রমপরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকলে বশ্বাস করা সম্ভব হবে যে, ওল্ড টেস্টামেন্টে একই ঘটনার বিভিন্ন বিবরণ থাকতে পারে এবং স্ববিরোধিতা, ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, অসম্ভাব্যতা ও প্রমানিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে অসঙ্গতিও থাকতে পারে। মানুষের রচিত একখানি প্রাচীন গ্রন্থে এরূপ ভুলভ্রান্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। একই সময় ও পরিবেশ -পরিস্থিতিতে লেখা অন্য যে কোন গ্রন্থেও ঐ ভুলভ্রান্তি পাওয়া যাবে।
যখন বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক কোন প্রশ্ন উত্থাপন কোঁড়াই সম্ভব ছিলনা এবং অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতা নির্ণয়ের একমাত্র উপায় ছিল ব্যক্তিগত সঙ্গত চিন্তা, তখনই সেন্ট অগাস্টিন বুঝতে পেরেছিলেন যে, আল্লাহ মানুষকে এমন কিছু শিক্ষা দিতে পারেন না, যে বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সুতরাং তিনি এ নীতি নির্ধারণ করেন যে, যা সত্যের বিরোধী তা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে বলে দাবী করা যেতে পারে না। এবং এ নীতির ভিত্তিতে যা বাদ দেয়ার উপযুক্ত তাঁর সবকিছুই তিনি বাইবেল থেকে বাদ দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
পরবর্তীকালে বাইবেলের কোন কোন অনুচ্ছেদ যখন আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হয়েছে, তখন কিন্তু সেই মনোভাব আর অনুসরণ করা হয়নি। সত্যকে সহজভাবে মেনে নিতে রাজী না হওয়ার এ মনোভাব ক্রমে এতই জোরদার হয়েছে যে, সত্য ও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন ঐ অনুচ্ছেদগুলি বাইবেলে বহাল রাখার যৌক্তিকতা বর্ণনা করে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে।
দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল অবশ্য এ আপোসহীন মনোভাবের জোর অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। কারণ ওল্ড টেস্টামেন্টের কোন কোন গ্রন্থ সম্পর্কে তারা এ কথা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ঐ গ্রন্থে এমন কিছু কিছু বিষয়বস্তু আছে যা”অসম্পূর্ণ ও অপ্রচলিত।” এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ অভিমত কি শুধুই অভিমত থেকে যাবে, না বাইবেল থেকে ঐ অনুচ্ছেদগুলি বাদ দেয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে? আসলে কিন্তু অবস্থা দাড়াচ্ছে এই যে, যতদিন বাদ না দেয়া হচ্ছে ততদিন যাবত কিন্তু ঐ অনুচ্ছেদগুলিই”আল্লাহর কাছ থেকে আসা শিক্ষার বাহন ও প্রমাণ” হিসেবে বহাল থেকে যাচ্ছে।