কুরআন হাদীস ও আধুনিক জ্ঞান
ইসলামে কুরানই বিধি-বিধানের একমাত্র উৎস নয়। মুহাম্মদ (সাঃ) জীবন কালে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে বিধিমূলক সম্পূরক তথ্যের অনুসন্ধান করা হয়েছে।
শুরু থেকেই হাদীস লিখিত আকারে আসার প্রচুন থাকলেও বহু হাদীস মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমেও এসেছে। যারা হাদীস সংগ্রহ করে একত্রিত করেছেন তারা কাগজে-কলামে লিপিবদ্ধ করার আগে অতীত ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে তদন্ত করেছেন এবং নির্ভুল তথ্য নির্ণয়ের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। নবীর কথার সকল নির্ভরযোগ্য সংকলনেই প্রথমে যিনি তাঁর পরিবারের সদদ্য বা তাঁর সাহাবী অর্থাৎ সঙ্গীর কাছ থেকে ঐ উক্তি শুনেছেন তাঁর নাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল বর্ণনাকারীর নামই লাগাতার ভাবে পাওয়া যায় এবং একমাত্র এ ঘটনা থেকেই সংগ্রহকারীর নিষ্ঠা, সততা ও পরিশ্রমের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এভাবে মুহাম্মদের (সাঃ) বহু কথা ও কাজের বিবরণ সংগৃহীত হয়েছে। এগুলি হাদীস নামে পরিচিত। হাদীস শব্দের অর্থ”উক্তি” কিন্তু তাঁর কাজের বিবরণও হাদীস নামে অভিহিত করার রেওয়াজ আছে।
মুহাম্মদের (সাঃ) ইন্তেকালের পরবর্তী কয়েক দশকে এরূপ কিছু সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ দুশো বছর পরেও প্রকাশিত হয়। সর্বাধিক নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ও বর্ণনা পাওয়া যায় আল-বুখারী ও মুসলিম নামক সংগ্রহে এবং এ দুখানি সংগ্রহও মুয়াহ্মমদের (সাঃ) ইন্তেকালের দুশো বছর পরে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর মুহাম্মদ মুহসিন খান এ সংগ্রহের আরবী-ইংরেজী প্রভাষক সংকলন প্রস্তুত করেছেন (প্রকাশক-শোঠি ষ্ট্র বোর্ড মিলস (কনভার্সন) লিমিটেড এবং তালিম-উল-কুরান ট্রাস্ট, গুজরানওয়ালা ক্যান্টনমেন্ট, পাকিস্তান। সহি আল-বুখারী, প্রথম সংস্করণ, ১৯৭১) । কুরআনের পর বুখারীর সংগ্রহই সাধারণত সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয়। হৌদাস ও মারকাইস এ সংগ্রহটি ‘লেস ট্রাডিশনস ইসলামিকস’ (ইসলামিক ট্রাডিশনস) নামে ফরাসী ভাষায় তরজমা (১৯০৩-১৯১৪) করেন। ফলে যারা আরবী জানেন না তাদের কাছে এখন হাদীস বোধগম্য হয়েছে। তবে এ ফরাসী তরজমাসহ ইউরোপীয়দের করা কতিপয় তরজমা সম্পর্কে কিছু সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে। কারণ তাতে এমন কিছু ভুল ও অসত্য আছে যা তরজমাগত কারণে না হয়ে ব্যাখ্যাগত কারণে ঘটেছে। ক্ষেত্র বিশেষে সংশ্লিষ্ট হাদীসের অর্থ এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যে, মূল হাদীসে যা নেই তরজমায় সেই ধারণা আরোপ করা হয়েছে।
উৎসের ব্যাপারে কতিপয় হাদীস ও গসপেলের ক্ষেত্রে একটি সাদৃশ্য দেখা যায়। তা হচ্ছে এই যে, সংগ্রাহকদের কেউ বর্ণিত প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না এবং ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক দিন পরে তারা তাঁর বর্ণনা লিখেছেন। গসপেলের মতই সকল হাদীস নির্ভুল বলে গ্রহণ করা হয়নি। কেবল অল্প সংখ্যক হাদীস মোটামুটিভাবে বিশেষজ্ঞদের অনুমোদন লাভ হয়েছে। ফলে আল-মুয়াত্তা, সহি মুসলিম ও সহি আলবুখারী ছাড়া অন্যত্র দেখা যায় যে, একই গ্রন্থে নির্ভুল বলে অনুমদিত হাদীসের পাশাপাশি এমন হাদিসও স্থান পেয়েছে যা সন্দেহজনক অথবা এমন কি সরাসরি বাতিলযোগ্য।
ক্যানোনিক গসপেলের ক্ষেত্রে আধুনিক অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করলেও উর্ধতন খৃষ্টধর্মীয় কর্তৃপক্ষ কখনও তাঁর নির্ভুলতা বিষয়ে প্রশ্ন করেননি। পক্ষান্তরে ইসলামের আদি যুগেই বিশেষজ্ঞগণ সর্বাধিক নির্ভুল বলে বিবেচিত হাদীসেরও বিস্তারিত সমালোচনা করেছেন। অবশ্য বিচারের কষ্টিপাথর মূল গ্রন্থ কুরআন সম্পর্কে কেউ কখনও কোন প্রশ্ন করেননি।
যে সকল বিষয়ে পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কারণে ব্যাখ্যা ও তথ্য পাওয়া গিয়েছে, সেই সকল বিষয় মুহাম্মদ (সঃ) লিখিত অহির বাইরে কিভাবে প্রকাশ করেছেন, তা দেখার জন্য আমি নিজে হাদীস সাহিত্যের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেছি। সহি মুসলিম নির্ভুল হলেও আমি আমার পরীক্ষায় সর্বাধিক নির্ভুল বলে বিবেচিত আল-বুখারী বেছে নিয়েছি। আমি সর্বদা স্মরণ রাখতে চেষ্টা করেছি যে, হাদিস যারা সংগ্রহ করেছেন, তাদের অপরের মৌখিক বর্ণনার উপরে আংশিকভাবে নির্ভর করতে হয়েছে এবং বর্ণনাকারীর ভুল বা নির্ভুলতাসহ তারা ঐ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। এভাবে লিখিত হাদীস একই বিষয়ে বহুলোকের বর্ণিত হাদীস নিঃসন্দেহে নির্ভুল। (সহি মুসলিম গ্রন্থে প্রথম শ্রেণীর হাদীসকে জান্নি বা সন্দেহজক এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর হাদীসকে কাতি বা নির্ভুল বলা হয়েছে)।
কুরআনের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের তুলনা করে আমি যে ফলাফলে উপনীত হয়েছি, তার সঙ্গে হাদীসের বর্ণনা মিলিয়ে দেখেছি। তাঁর ফল খুবই নৈরাশ্যজনক। বিজ্ঞানের মুকাবিলায় কুরআনের বর্ণনা সর্বদাই নির্ভুল পাওয়া যায়। কিন্তু মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক হাদীসের বর্ণনা বৈজ্ঞানিক তথ্যের মুকাবিলায় সন্দেহজনক বলে দেখা যায়। এখানে আমি অবশ্য কেবলমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক হাদীসই পরীক্ষা করে দেখেছি।
কুরআনের কোন কোন আয়াতের ব্যাখ্যামূলক হাদীসের বেলায় ক্ষেত্রবিশেষে এমন ভাষ্য দেয়া হয়েছে যা বর্তমান যুগে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
সূরা ইয়াসিনের ৩৮ আয়াতে সূর্য সম্পর্কে যে বর্ণনা আছে তাঁর গুরুত্ব ও সবিশেষ তাৎপর্য আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি। ঐ আয়াতে বলা হয়েছে-”সূর্য আবর্তন করে তাঁর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে।” অথচ একটি হাদীসে এ ব্যাপারটি এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-”অস্ত গিয়ে সূর্য ……আরশের নিচে পৌছে সিজদা করে এবং পুনরায় উদিত হওয়ার অনুমতি চায় এবং তাকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারপর এমন একদিন আসবে যখন সে সিজদার উপক্রম করবে…। । পুনরায় তাঁর নিজস্ব পথে চলার (উদিত হওয়ার) অনুমতি চাইবে …তখন যে পথে এসেছে সেই পথে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে এবং সে তখন পশ্চিম উদিত হবে…” (সহি আল বুখারী, কিতাবু বাদউল খালক বা আদি সৃষ্টির গ্রন্থ, চতুর্থ খন্ড, ২৮৩ পৃষ্ঠা, ৫৪ অংশ, চতুর্থ অধ্যায়, ৪২১ নম্বর) । মূল পাঠতি অস্পষ্ট এবং তাঁর অনুবাদ করা কঠিন। তবে এ বর্ণনায় যে উপমামূলক কাহিনী আছে তাতে সূর্যের পৃথিবী পরিক্রমার একটি ধারণা পাওয়া যায়। এ ধারণা আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পরিপন্থী। সুতরাং এ হাদীসটির সঠিকতা সন্দেহজনক।
ঐ একই গ্রন্থে (সহি আল বুখারী, কিতাবু বাদউল খালক বা আদি সৃষ্টির গ্রন্থ, চতুর্থ খন্ড, ২৮৩ পৃষ্ঠা, ৫৪ অংশ, ষষ্ঠ অধ্যায়, ৪৩০ নম্বর) মাতৃগর্ভে ভ্রুণের ক্রমবিকাশের পর্যায়গুলি সময়ের হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছে। মানব দেহের উপাদানগুলি শ্রেণীবদ্ধ হওয়ার জন্য চল্লিশ দিন, ‘যাহা লাগিয়া থাকে’ পর্যায়ের জন্য আরও চল্লিশ দিন, এবং ‘চর্বিত গোশত’ পর্যায়ের জন্য তৃতীয় চল্লিশ দিন। তারপর ফেরেশতাদের মধ্যস্থতায় তাঁর তকদির নির্ধারিত হওয়ার পর তাঁর মধ্যে রুহ ফুঁকে দেয়া হয়। ভ্রুণের ক্রমবিকাশের এ বিবরণ বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে মেলে না।
আরোগ্যের সহায়ক হিসেবে (রোগের নাম উল্লেখ না করে) মধুর সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কে একটি মাত্র মন্তব্য (সূরা নাহল, আয়াত ৬৯) ছাড়া কুরআনে রোগের প্রতিকার সম্পর্কে আদৌ কোন উপদেশ দেয়া হয়নি। অথচ হাদীসে এ বিষয়ে বিস্তারিত উপদেশ ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সহি আল-বুখারীর একটি সম্পূর্ণ অংশই (৭৬ অংশ) ঔষধ বিষয়ক। এ অংশটি হৌদাস ও মারকাইসের ফরাসী তরজমায় চতুর্থ খন্ডের ৬২ থেকে ৯১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এবং ডক্টর মুহাম্মদ মুহসিন খানের দ্বিভাষিক আরবী-ইংরেজী সংস্করনে সপ্তম খন্ডের ৩৯৫ থেকে ৪৫২ পৃষ্ঠা বিস্তৃত। এ দীর্ঘ বিবরণে যে অনেক অনুমানভিত্তিক হাদীস আছে সে সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। তবে এ বিবরণের একটি গুরুত্ব আছে-তৎকালে চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ধারণা পোষণ করা সম্ভব ছিল তাঁর একটি পরিচয় এখানে পাওয়া যায়। এ সঙ্গে আল-বুখারীর অন্যান্য অধ্যায়ে চিকিৎসার প্রাসঙ্গিক যে সকল হাদীসে আছে তাও যোগ করা যায়।
এভাবেই আমরা কুনজর, ভূতে-ধরা ও ভারণ-তাড়ন বিষয়ক বিবরণ পাই। অবশ্য এ ব্যাপারে পয়সার বিনিময়ে কুরআনের ব্যবহার নিষেধ আছে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, এক শ্রেণীর দিন-তারিখ যাদুর বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এবং বিষধর সাপের বিরুদ্ধে যাদু প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ঔষধ এবং তাঁর সঙ্গত ব্যবহারের সম্ভাবনা যখন ছিল না তখন সেই মলে স্বাভাবিক ভাবেই নানাপ্রকার টটকার প্রচলন ছিল। রক্ত ঝরানো, আগুনে সেক দেয়া, উকুনের উৎপাতে মাথা কামানো, উটের দুধ ও নানাবিধ জীব ও গাছ গাছড়ার ব্যবহার যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য তালপাতার মাদুর পুড়িয়ে সেই ছাই ক্ষতস্থানে লাগানো হয়। জরুরী পরিস্থিতিতে তৎকালীন বুদ্ধিবৃত্তি ও অভিজ্ঞতার আলোকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। তবে উটের পেশাব পান করতে বলা বোধহয় খুব একটা ভালো কাজ ছিল না।
বিভিন্ন রোগের ব্যাপারে হাদিসে যে ব্যাথাপাওয়া যায় আজকের দিনে তা সঠিক বলে মেনে নেয়া দুষ্কর। কয়েকটি উদাহরন দেয়া যাতে পারেঃ
জ্বরের উৎসঃ”দোযখের উত্তাপ থেকেই জ্বর হয়” এ বক্তব্যের সমর্থনে চারটি বর্ণনা আছে (আল-বুখারী, কিতাবুল তিব, সপ্তম খন্ড, ২৮ অধ্যায়, ৪১৬ পৃষ্ঠা) ।
-প্রত্যেক রোগের প্রতিকার আছেঃ”আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেন নি যার প্রতিকারও তিনি সৃষ্টি করেননি” (ঐ, প্রথম অধ্যায়, ৩৯৫ পৃষ্ঠা) ।
এ ধারণাটি মাছি বিষয়ক হাদীসে উদাহরণ দিয়ে বুঝানো হয়েছে-”কোন পাত্রে মাছি পড়লে সম্পূর্ণ মাছিটি ডুবিয়ে ফেলে দাও, কারণ তাঁর এক পাখায় রোগ এবং অপর পাখায় রোগের প্রতিকার আছে (ঐ, ১৫-১৬অধ্যায়, ৪৫২-৪৫৩ পৃষ্ঠা, এবং কিতাবুল বাদউল খালক, ৫৪ অংশ, ১৫-১৬ অধ্যায়)
-সাপের নজরে গর্ভপাত হয় (অন্ধও হতে পারে) । (ঐ, কিতাবু বাদউল খালক, চতুর্থ খন্ড, ১৩-১৪ অধ্যায়, ৩৩৩-৩৩৪ পৃষ্ঠা)
-দুই ঋতুকালের মধ্যবর্তী সময়ে রক্তপাতঃ এ বিষয়ে হাদীসে আছে (ঐ, কিতাবুল হায়েজ, ষষ্ঠ খন্ড, ৬ অংশ, ২১ ও ২৮ অধ্যায়, ৪৯০পৃষ্ঠা) । একটি হাদীসে রক্তক্ষরণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাদিয়ে বলা হয়েছে যে, রক্তনালীথেকে রক্তপাত হয়। অপর হাদীসে একজন নারীর সাত বছর যাবৎ ঐ রোগ ভোগের বিষয় উল্লেখ করে ঐভাবে কারণ নির্ণয়ের অনুকূলে যে কি যুক্তি ছিল তা জানা সম্ভব নয়। তবে কারণটি হয়ত সঠিক ছিল। এ রোগ রক্তপ্রদর নামে পরিচিত।
-রোগ সংক্রামক নয়ঃ এ বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে সাধারণ বর্ণনা ছাড়াও (ঐ, কিতাবুল তিব, সপ্তম খন্ড, ৭৬ অংশ, ১৯, ২৫, ৩০, ৩১, ৫৩ ও ৪৫ অধ্যায়) কয়েকটি নির্দিষ্ট রোগের কথা বলা আছে- কুষ্ঠ (৪০৮পৃষ্ঠা), প্লেগ (৪১৮ ও ৪২২) । ও উটের পাচড়া (৪৪৭পৃষ্ঠা) । কিন্তু সংক্রামক নয় বলা হলেও তাঁর পাশাপাশি আবার প্লেগ রোগের এলাকায় না যাওয়া এবং কুষ্ঠরোগীর কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থার কারণে এসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব যে এমন কিছু হাদীস আছে যা বৈজ্ঞানিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। এ জাতীয় হাদীসের আসল হওয়া সম্পর্কেও সন্দেহের অবকাশ আছে। তথাপি এ হাদীসগুলির উল্লেখ করার একটি প্রয়োজনীয়তা আছে। উপরে কুরআনের যে আয়াতগুলির উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর মুকাবিলায় এগুলি মিলিয়ে দেখা গেল এবং দেখা গেল যে, কুরআনের আয়াতে একটি কথাও ভুল নেই, একটি বিবরণও বেঠিক নেই। স্পষ্টতই এ মন্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গত স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, নবীর ইন্তিকালের পর তাঁর শিক্ষা থেকে পথ নির্দেশের জন্য দুটি উৎস ছিল-কুরআন ও হাদীস।
-প্রথম উৎস কুরআন। বহু মুসলমানের সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত ছিল এবং নবীর মতই তারা অসংখ্য বার তা আবৃত্তি করতেন। তাছাড়া কুরআন তখন লিখিত আকারেও ছিল। কেননা নবীর আমলেই, এমন কি হিজরতের (৬২২ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ নবীর ইন্তিকালের দশ বছর আগে) আগেই কুরআন লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়েছিল।
-দ্বিতীয় উৎস হাদীস। নবীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীগণ (সাহাবীগণ) এবং অন্যান্য মুসলমানগণ যারা তাঁর কাজের কথার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাদের ঐসব বিষয় মনে ছিল এবং নতুন আদর্শ প্রচারের সময় কুরআন ছাড়াও তারা নিজ নিজ স্মৃতির সহায়তা পেতেন।
নবীর ইন্তিকালের পর কুরআন ও হাদীস সংগ্রহ করে সংকলিত করা হয়। হিজরতের প্রায় চল্লিশ বছর পর প্রথমবার হাদিস সংগ্রহ করা হয়। কিছু কুরআনের প্রথম সংগ্রহ সম্পন্ন হয় আগেই খলিফা আবু বকরের আমলে এবং বিশেষত খলিফা উসমানের আমলে। খলিফা উসমান তাঁর খিলাফাতের আমল (নবীর ইন্তিকালের বার থেকে চব্বিশ বছরের মধ্যে) কুরআনের একটি সুনির্দিষ্ট পাঠ প্রকাশ করেন।
বিষয়বস্তুগত এবং সাহিত্যিক বৈশিষ্টের দিক থেকে কুরআন ও হাদীসের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তাঁর উপর আমরা সবিশেষ জোর দিতে এবং গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। কুরআনের স্টাইলের সঙ্গে হাদীসের স্টাইলের তুলনা করার কথা কল্পনাও করা যায় না। অধিকন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আলোকে বিষয়বস্তু বিবেচনা করা হলে উভয়ের মধ্যকার পার্থক্য ও বিরোধিতায় হতবাক হয়ে যেতে হয়। আমি আশা করি আমি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যেঃ
-একদিকে কুরআনের বর্ণনা প্রায়শ অতি সাধারণ বলে মনে হলেও তাঁর মধ্যে এমন অর্থ ও তথ্য নিহিত আছে যা পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে বা হবে।
-অপরদিকে হাদীসের কোন কোন বর্ণনা তৎকালীন সময়ের ধ্যানধারণার সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ হলেও বর্তমানে তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে সাব্যস্ত হয়েছে। ইসলামী নীতি ও বিধান বিষয়ক যে সকল হাদীসের আসল হওয়া সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই সেই সকল ক্ষেত্রে এ অবস্থা দেখা যায় না।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুহাম্মদ (সঃ) নিজে কুরআন সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন তাঁর নিজের উক্তি সম্পর্কে ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন না। কুরআনকে তিনি আল্লাহর কালাম বলে ঘোষণা করেন। আমরা আগেই দেখেছি সুদীর্ঘ বিশ বৎসর যাবত সর্বাধিক যত্ন ও সতর্কতা সহকারে কুরআনের সূরা ও আয়াত শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। তাঁর জীবিতকালেই কুরআন লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, বহু লোকে মুখস্ত করে ফেলেছিল এবং নামাযে তা প্রতিনিয়ত আবৃত্তি করা হত। পক্ষান্তরে হাদীস মূলত তাঁর কাজের ও ব্যক্তিগত অভিমতের বিবরণ বলে কথিত। এ ব্যাপারে তিনি নিজে কোন নির্দেশ দিয়ে যাননি- তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে যে কেউ ইচ্ছে করলে তাঁর ব্যক্তিগত আচরণের জন্য নজির খুজে নিতে পারেন এবং তা প্রচারও করতে পারেন। তিনি নিজে এ ব্যাপারে কিছু বলে যাননি।
যেহেতু অতি অল্পসংখ্যক হাদীসেই মুহাম্মদের (সঃ) নিজের চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে, সেহেতু অন্যান্য হাদীসে, বিশেষত এখানে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত হাদীসে স্পষ্টতই তাঁর আমলের লোকদের চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। কুরআনের সঙ্গে তুলনা করলেই এ সন্দেহজনক বা জাল হাদিসগুলি যে কত দূরে অবস্থিত তা সহজেই বুঝা যায়। এ তুলনায় একটি পার্থক্য খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে (তাঁর যদি আদৌ কোন প্রয়োজন থেকে থাকে) হাদীসে অর্থাৎ ঐ আমলের রচনায় অনেক বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল তথ্য ও বিবরণ আছে; এবং লিখিত আহির গ্রন্থ কুরআনে এমন কোনই ভুল নেই।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিসের সত্যতা সন্দেহাতীত। কিন্তু বৈষয়িক বিষয়ক হাদীসের ক্ষেত্রে নবীর সঙ্গে অন্য কোন পার্থক্য নেই। একটি হাদীসে মুহাম্মদে (সাঃ) নিজের উক্তি এভাবে বর্ণিত হয়েছে -”ধর্ম বিষয়ে আমি যদি কোন হুকুম দিই তা পালন কর, কিন্তু আমি যদি আমার নিজের বিবেচনায় কোন হুকুম দিই তাহলে মনে রেখ আমি একজন মানুষ মাত্র।” আল সারাকসি তাঁর নীতিমালা’য় (আল উসুল) এ বিবরণটি এভাবে লিখেছেনঃ”আমি যদি তোমাদের ধর্ম বিষয়ে কোন কিছু তোমাদের নজরে আনি তাহলে তোমরা সেইভাবে কাজ কর, আর আমি যদি এ দুনিয়া বিষয়ক কোন কিছু তোমাদের নজরে আনি তাহলে তোমাদের নিজের দুনিয়াবী সম্পর্কে তোমদের তো অনেক ভালো জ্ঞান আছে।”
সাধারণ উপসংহার
এ গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে এসে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে পাশ্চাত্যে যে ধারণা এখন সবচেয়ে প্রবল তা আদৌ বাস্তব সম্মত নয়। ওল্ড টেস্টামেন্ট, গসপেল ও কুরআনের বর্ণনা ও উপাদান যে অবস্থায় সময়ে ও প্রকারে সংগৃহীত ও লিখিত হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। র তিনটি অহির গ্রন্থের আকারে গ্রন্থিত হওয়ার পরিস্থিতি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এ পার্থক্য এবারতের সঠিকতা ও বিষয়গত কিছু বৈশিষ্ট্যকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে।
ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রায় নয় শত বছর যাবত লিখিত অসংখ্য সাহিত্যকর্ম স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থে যে অসংখ্য খন্ড খন্ড বিচ্ছিন্ন রচনা আছে তা বিভিন্ন শতাব্দীতে মানুষের হাতে পরিবর্তিত হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে কোন কোন রচনার সঙ্গে নতুন রচনা জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে কোন রচনার উৎস যে কি তা নির্ণয় করা এখন খুবই কঠিন।
যিশু তাঁর দুনিয়ার দায়িত্ব সম্পন্ন করে যে শিক্ষা রেখে যাতা চেয়েছিলেন, তার কথা ও কাজের বর্ণনা সম্বলিত গসপেল দ্বারা মানুষের কাছে শিক্ষা পৌছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, গসপেলের লেখকগণ তাদের লিখিত তথ্য ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। মৌখিক প্রবাদ ও বর্তমানে নিশ্চিহ্ন কিছু রচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন ইহুদী খৃষ্টান সমাজে যিশুর কর্মজীবন সম্পর্কে যে সকল সংবাদ ও কাহিনী প্রচলিত ছিল তারা তাই লিপিবদ্ধ করেছেন মাত্র। অর্থাৎ তারা মূল উৎস থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করেননি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনার উপরে নির্ভর করেছেন।
এখন আমাদের এ আলোকেই ইহুদী খৃষ্টান ধর্মগ্রন্থ বিবেচনা করতে হবে এবং ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ যে সকল প্রাচীন মতবাদ পোষণ করে থাকেন, বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার স্বার্থেই আমাদের তা সমূলে বর্জন করতে হবে।
উৎসের আধিক্যের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে স্ববিরোধিতা ও পরস্পর বিরোধিতা এসেছে এবং ইতিপূর্বে আমরা তাঁর অনেক নজির উল্লেখ করেছি। মধ্যযুগের ফরাসী কবিগণ তাদের বর্ণনামূলক কবিতায় যেভাবে অতিরঞ্জন করেছেন যিশু সম্পর্কে লিখতে গিয়ে গসপেলের লেখকগণ ঠিক সেই প্রবণতাই দেখিয়েছেন। ফলে প্রত্যেকটি ঘটনা সংশ্লিষ্ট লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে পরিবেশিত হয়েছে এবং বর্ণিত ইহুদী-খৃষ্টান ধর্মগ্রন্থে আধুনিক জ্ঞান বিষয়ে যে অল্প কয়েকটী বিবরণ আছে তা কঠোরতম প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন আছে।
এ পটভূমিকায় বিচার করলে স্ববিরোধিতা, অসম্ভাব্যতা ও সামঞ্জস্যহীনতার আসল কারণ অতি সহজেই খুজে পাওয়া যায়। খৃষ্টানগণ যখন এ অবস্থা উপলব্ধি করে তখন তারা খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। বিশেষত আধুনিক আবিষ্কারের ফল গোপন করার জন্য খৃষ্টান ভাষ্যকারগণ দীর্ঘদিন যাবত যে কথার মারপ্যাঁচ, যুক্তির চাতুর্য ও ভাষার কাব্যিকতা চালিয়ে এসেছেন তাতে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে থাকার পর যখন তাদের উপলব্ধি আসে তখন তারা আরও বেশী আশ্চর্য হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে নিজের হিসেবে মথি ও লুক বর্ণিত যিশুর দুটি নসবনামার উল্লেখ করা যেতে পারে। স্মরণযোগ্য যে এ নসবনামা দুটি পরস্পর বিরোধী এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে নেয়ার অযোগ্য। খৃষ্টানদের অবাক হওয়ার মত এরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, জনের গসপেলের দিকে আমরা একটু বেশী মনোযোগ দিয়েছি, কারণ এ গসপেলের সঙ্গে অপর তিনটি গসপেলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। বিশেষত জনের গসপেলে ইউকারিস্ট অনুষ্ঠানের কোন বিবরণ নেই এবং এ বিষয়টি অনেকেই জানেন না।
কুরআন নাযিল হওয়ার যে ইতিহাস আছে তা অপর দুখানি ধর্মগ্রন্থের সংশ্লিষ্ট ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কুরআন প্রায় বিশ বছর যাবত নাযিল হয় এবং ফেরেশতা জিব্রাইল যখনি যতটুকু মুহাম্মদকে (সাঃ) জানিয়ে দিতে তাঁর পরপরই বিশ্বাসীগণ তা মুখস্ত করে ফেলতেন। তদুপরি মুহাম্মদের (সাঃ) জীবিত কালেই তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। খলিফা উসমানের আমলে নবীর ইন্তিকালের পর বার বছর থেকে শুরু করে চব্বিশ বছর সময়ের মধ্যে কুরআনের চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সংকলন সমাপ্ত হয়েছিল। কুরআন নাযিল হওয়ার সময় সঙ্গে সঙ্গে যারা মুখস্ত করেছিলেন এবং পরে প্রতিদিন নামাযে আবৃত্তি করতেন তারাই ঐ সংকলন পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। আমরা এখন জানি যে সেই সময় থেকেই কুরআন অবিকৃত অবস্থায় সঠিকভাবে সংরক্ষিত আছে। তাঁর আসল হওয়া সম্পর্কে কখনই কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি।
কুরআন তাঁর পূর্ববর্তী দুখানি আসমানী গ্রন্থের সমাপ্তি থেকে শুরু হয়েছে। এ গ্রন্থের বর্ণনায় কোন স্ববিরোধিতা নেই এবং গসপেলের ক্ষেত্রেযেমন দেখা যায় এবারতে মানুষের হস্তক্ষেপ বা রদবদলের তেমনি কোন চিহ্নই এখানে নেই। বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করলে কুরআনের সর্বত্র রচনাগত একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য অতি সহজেই চোখে পড়বে। আর বোইজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, কুরআনের তথ্য ও বর্ণনা আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। অধিকন্তু কুরআনে বিজ্ঞান বিষয়ক এমন সব বিবরণ আছে (যা আমরা আগেই দেখেছি) যে, ঐসব বিবরণ মুহাম্মদের (সাঃ) আমলের কোন মানুষের দেয়া বলে চিন্তাও করা যায় না। এ কারণে কুরআনের যে সকল আয়াত এ যাবত ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে তাঁর মর্মার্থ আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে উপলব্ধি করতে পারছি।
একই বিষয়ে বাইবেল ও কুরআনের বিবরণের মধ্যে তুলনা করলে একটী মৌলিক পার্থক্য অতি সহজেই ধরা পড়ে। বাইবেলের বিবরণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়, অথচ কুরআনের বিবরণ বৈজ্ঞানিক তথ্যের সগে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ আদি সৃষ্টি এবং প্লাবনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মহাযাত্রার ইতিহাস বিষয়ে অবশ্য বাইবেলের সঙ্গে কুরআনের বিবরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল দেখতে পাওয়া যায় এবং এ মিল মূসার আমলের তারিখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রত্নতাত্মিক তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এ একটি মিল ছাড়া অন্যান সকল বিষয়েই বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) বাইবেল নকল করে কুরআন লিখেছেন বলে কোন রকম সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই যে অভিযোগ করা হয়ে থাকে এ পার্থক্য থেকেই সরাসরি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়ে যায়।
বিজ্ঞান বিষয়ে হাদীসে যে সকল বিবরণ আছে তাঁর সঙ্গে কুরআনের বিবরণের তুলনা করলে পার্থক্য এমন প্রকটভাবে দেখা দেয় যে উভয়ের একই উৎস থেকে আসার সম্ভাবনা সঙ্গে সঙ্গেই নস্যাত হয়ে যায়।
এ হাদীসগুলি মুহাম্মদের (সাঃ) উক্তি বলে কথিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এ দাবীর সত্যতা সম্পর্কে ঘোরতর সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে অনুমান করা যায় যে এ ধরনের হাদীসে সেই আমলের সাধারণ ধ্যান ধারণাই প্রতিফলিত হয়েছে।
মুহাম্মদের (সাঃ) আমলে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ যে স্তর পর্যন্ত উপনীত হয়েছিল তাঁর আলোকে বিচার করলে কুরআনের বিজ্ঞান বিষয়ক বিবরণগুলি কোন মানুষের রচনা বলে ধারণা করা আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং কুরআনকে কেবলমাত্র অহির প্রকাশ বলে গণ্য করাই সঙ্গত নয়, বরং সহি হওয়ার যে নিশ্চয়তা খোদ কুরানেই দেয়া হয়েছে সেই কারণে এবং বিজ্ঞান বিষয়ক বিবরণ যার কোনও মানবীয় ব্যাখ্যা হতে পারে না, তার আলোকে এ গ্রন্থকে একটি বিশেষ মর্যাদার আসন দেয়াও যুক্তিসঙ্গত।
— সমাপ্ত —