চার গসপেল ও আধুনিক বিজ্ঞান
চার গসপেলে এমন ঘটনা খুব কমই আছে যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের মুকাবিলায় দাড়াতে পারে।
প্রথমেই ধরা যাক অলৌকিক ঘটনার কথা। এরূপ ঘটনার বহু বিবরণ আছে, কিন্তু কোন অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক মন্তব্য করা তো সম্ভব নয়। অলৌকিক ঘটনা দু প্রকারের আছে। প্রথম প্রকারের ঘটনা মানুষ সম্পর্কে, বিশেষত রোগীকে আরোগ্য করা সম্পর্কে -যেমন উমাদ, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্থ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য করা এবং লাজারাসকে পুনর্জীবিত করা। এবং দ্বিতীয়প্রকারের ঘটনা প্রাকৃতিক নিয়ম বহির্ভুত উপায়ে বস্তুর আচরণ- যেমন যিশুর পানির ওপর দিয়ে হেটে যাওয়া, কিংবা পানি মদে পরিণত হয়ে যাওয়া। কখনও কখনও অবশ্য নিছক স্বাভাবিক ঘটনাও অস্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। কারণ সময়ের ব্যবধান খুবই কম ছিল-যেমন তাৎক্ষনিক ভাবে ঝড় থেমে যাওয়া বা ডুমুর গাছের নিষ্পত্র হয়ে ম্রিয়মান হয়ে যাওয়া এবং একত্রে বিপুল পরিমাণ মাছ ধরা, মনে হয়য় যেন সমুদ্রের সকল মাছ আগে থেকে জাল ফেলার জায়গায়এসে জড়ো হয়ে ছিল।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান বিধায় এ সকল ঘটনা তিনি সহজেই ঘটাতে পারেন এবং তাতে বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। মানুষের কাছে যা দুঃসাধ্য বা অসম্ভব বলে মনে হয়, আল্লাহ্র কাছে তা আদৌ তেমন নয়। কিন্তু তাই বলে যিনি আল্লাহয় বিশ্বাস করেন, তিনি তো প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করতে পারেন না। আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করা এবং প্রাকৃতিক নিয়মে বিশ্বাস করার মধ্যে আদৌ কোন বিরোধ নেই। কারণ এ দুটি আসলে একই মহাশক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
যিশু যে একজন কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করেছিলেন, ব্যাক্তিগতভাবে আমি তা বিশ্বাস করতে রাজি আছি। কিন্তু প্রথম মানব ও ইব্রাহীমের মধ্যবর্তী সময়ে মাত্র বিশ পুরুষের ব্যবধান ছিল, এরূপ কোন বর্ণনা সম্বলিত কোন এবারতকে যখন সঠিক এবং আল্লাহর অনুপ্রানিত বলে ঘোষণা করা হয়, তখন আমি তা মেনে নিতে অক্ষম। লুক তাঁর গসপেলে এ কথাই বলেছেন (৩, ২৩-২৮) । ‘ লুকের এ বর্ণনা এবং এ একই বিষয়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা কেন যে নিছক মানবিক কল্পনা মাত্র, একটু পরেই আমরা তাঁর কারণ বর্ণনা করব।
যিশুর জন্ম সম্পর্কে কুরআনের মত-বাইবেলেও একই বিবরণ আছে। সমগ্র মানবজাতির জন্য সদাহারণ যে প্রাকৃতিক নিয়ম আছে, মাতৃগর্ভে যিশুর উৎপত্তির ক্ষেত্রে সেই নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। ঘটনাটি ঐ প্রাকৃতিক নিয়মের আওতার বাইরে ঘটেছে। মায়ের ডিম্বাশয়ে সৃষ্ট ডিম্বকোষের কোন শুক্রকীটের সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। অথচ সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মে মাতার ডিম্বকোষের সঙ্গে পিয়াত্র শুক্রকীটের মিলিত হওয়ার পরই একটি শিশুর জন্ম গ্রহণ করা সম্ভব হতে পারে। অবশ্য পুরুষের সম্মিলন ছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে জীবের স্বাভাবিক জন্মগ্রহণ সম্ভব হতে পারে এবং বিজ্ঞানের পরিভাষায় এ প্রক্রিয়া”পার্থেনোজেনেসিস” নামে পরিচিত। কোন কোন পতঙ্গ, অমেরুদন্ডী প্রাণী ও পাখির ক্ষেত্রে কখনও কখনও এ প্রক্রিয়ায় জন্ম গ্রহণের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। তবে এ জাতীয় ঘটনা অবশ্যই বিরল ও দুর্লভ। কোন কোন স্তন্যপায়ী জীব, বিশেষত নারী খরগোশের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, পুরুষ সম্মিলন ছাড়া ডিম্বকোষ থেকে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রুণ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তাঁর বেশী অগ্রসর হওয়া আর সম্ভব হয়নি এবং পুরুষ সম্মিলন ছাড়া পূর্নাঙ্গ জন্মগ্রহণের ঘটনা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হোক কিম্বা পরীক্ষাগারেই হোক, এখনও জানা যায়নি। যিশুর ব্যাপারটি একক একক ঘটনা। মেরি কুমারী মাতা ছিলেন। তাঁর সতীত্ব অক্ষুন্ন ছিল এবং যিশু ছাড়া তাঁর আর কোন সন্তান হয়নি। যিশু তাই জীব বিজ্ঞানের নিয়মের ব্যাতিক্রম।
বাইবেলে কখনও কখনও যিশুর ভাই ও বোনের কথা বলা হয়েছে (মথি ১৩, ৪৬-৫০ ও ৫৪-৫৮); মার্ক ৬, ১-৬; জন ৭, ৩ ও ২, ১২ ) । ‘ যে দুটি গ্রীক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘য়্যাডেলফোই’ ও ‘য়্যাডেলফাই’ এবং তাঁর অর্থ হচ্ছে সহদোর ভাই ও সহোদর বোন। মূলে যে সেমেটিক শব্দ আছে, তাঁর অর্থ হচ্ছে আত্মীয়, এবং সম্ভবত চাচাতো ফুফাতো প্রভৃতি ভাই বোন অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। গ্রীক ভাষায় অনুবাদে স্পষ্টতই ভুল করা হয়েছে।
যিশুর নসবনামা
মথি ও লুকের গসপেলে যে দুটি নসবনামা আছে, তাতে বিষয়বস্তুর সত্যতা এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতির ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন আছে। অর্থাৎ নসবনামা দুটির নির্ভুলতা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহের কারণ আছে। খৃষ্টান ভাষ্যকারগণ এ বিষয়ে খুবই বিব্রত করে থাকেন। কারণ ঐ নসবনামা যে আসলে মানুষের কল্পনা প্রসূত, তা তারা আদৌ স্বীকার করতে চাননা। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর জেনেসিসের স্যাকারডোটাল এবারতের লেখকগণ নিজেদের কল্পনা শক্তি প্রয়োগ করে আদি মানুষের আকটি নসবনামা প্রস্তুত করেছিলেন। মথি ও লুক এ নসবনামা থেকে প্রচুর তথ্য নিয়েছেন এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনার সঙ্গে মিধিয়ে নিজের নসবনামা প্রস্তুত করেছেন।
প্রথমেই পরিষ্কার হয়ে যাওয়া প্রয়োজন যে, যিশুর ব্যাপারে পুরুষ নসবনামার আদৌ কোন মূল্য নেই। কারণ তাঁর কোন পিতা ছিল না। সুতরাং তাঁর নসবনামা যদি কেউ প্রস্তুত করতে চায়, তাহলে আসলে তা হতে হবে তাঁর মাতা মেরির নসবনামা।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত বাইবেলের সংশোধিত স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ থেকে মথি বর্ণিত নসবনামা নিচে উদ্ধৃত করা হল। উল্লেখযোগ্য যে, মথির গসপেলের শুরুতেই এ নসবনামা আছেঃ
ইব্রাহীমের পুত্র দাউদ তৎপুত্র যিশু খৃষ্টের নসবনামা
ইব্রাহীম —- ইসহাকের পিতা ছিলেন
ইসহাক —- ইয়াকুবের পিতা ছিলেন
ইয়াকুব —- জুডা ও তাঁর ভাইদের পিতা ছিলেন
জুডা —- তামারের গর্ভজাত পেরেজ ও জেরাহর পিতা ছিলেন
পেরেজ —- হেজরোনের পিতা ছিলেন
হেজরোন —- র্যামের পিতা ছিলেন
র্যাম —- আন্মিনাদাবের পিতা ছিলেন
আন্মিনাদাব —- নাহশোনের পিতা ছিলেন
নাহশোণ —- সালমোনের পিতা ছিলেন
সালমোন —- রাহাবের গর্ভজাত বোয়াজের পিতা ছিলেন
বোয়াজ —- রুথের গর্ভজাত ওবেদের পিতা ছিলেন
ওবেদ —- জেসের পিতা ছিলেন
জেসে —- রাজা দাউদের পিতা ছিলেন
দাউদ —- উরিয়ার স্ত্রীর গর্ভজাত সোলায়মানের পিতা ছিলেন
সোলায়মান —- রেহোবোমের পিতা ছিলেন
রেহোবোম —- আবিজার পিতা ছিলেন
আবিজা —- আসার পিতা ছিলেন
আসা —- জেহোশাফাতের পিতা ছিলেন
জোরাম —- উজ্জিয়ার পিতা ছিলেন
উজ্জিয়া —- জোথামের পিতা ছিলেন
জোথাম —- আহাজের পিতা ছিলেন
আহাজ —- হেজোকিয়ার পিতা ছিলেন
হেজোকিয়া —- মানাসের পিতা ছিলেন
মানাসেহ —- আমোসের পিতা ছিলেন
আমোস —- জোসিয়ার পিতা ছিলেন
জোসিয়া —- জেকোনিয়া ও তাঁর ভাইদের পিতা ছিলেন
এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল ব্যাবিলনে বহিষ্কৃত হওয়ার সময়। বহিষ্কারের পরঃ
জেকোনিয়া —- শিলটিয়েলের পিতা ছিলেন
শিলটিয়েল —- জেরুব্বাবেলের পিতা ছিলেন
জেরুব্বাবেল —- আবিউদের পিতা ছিলেন
আবিউদ —- এলিয়া কিমের পিতা ছিলেন
এলিয়াকিম —- আজোরের পিতা ছিলেন
আজোর —- জাদোকের পিতা ছিলেন
জাদোক —- আচিমের পিতা ছিলেন
আচিম —- এলিউদের পিতা ছিলেন
এলিউদ —- এলিয়াজারের পিতা ছিলেন
এলিয়াজার —- মাটহানের পিতা ছিলেন
মাটহান —- ইয়াকুবের পিতা ছিলেন
ইয়াকুব —- ইউসুফের পিতা ছিলেন, এ ইউসুফ মেরীর স্বামী ছিলেন, মেরীর গর্ভে যিশুর জন্ম হয় এবং তিনি খৃষ্ট নামে অভিহিত হন।
সুতরাং ইব্রাহীম থেকে দাউদ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ, দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বহিষ্কৃত হওয়া পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ এবং ব্যাবিলনে বহিষ্কৃত হওয়া থেকে খৃষ্ট পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ (মথি ১, ১-৭৭) লুক (২, ২৩-৩৮) যে নসবনামা দিয়েছেন, তা মথি থেকে ভিন্নতর। সংশোধিত স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ বাইবেল থেকে তাঁর এবারত উধৃত করা হলঃ
“আর যিশু নিজে, যখন তিনি কার্য আরম্ভ করেন, কমবেশী তিরিশ বৎসর বয়স্ক ছিলেন; তিনি, যেমন ধরা হইত, যোসেফের (ইউসুফের) পুত্র, ইনি এলির পুত্র, ইনি মওতের পুত্র, ইনি জান্নায়ের পুত্র, ইনি যোসেফের পুত্র, ইনি মওথিয়ের পুত্র, ইনি আমোসের পুত্র, ইনি নলুমের পুত্র, ইনি ইষলির পুত্র, ইনি নগির পুত্র, ইনি মাটের পুত্র, ইনি মওথিয়ের পুত্র, ইনি শিমিয়ির পুত্র, ইনি বুদার পুত্র, ইনি যোহানার পুত্র, ইনি রিশার পুত্র, ইনি জেরুব্বাবিলের পুত্র, ইনি শলটিয়েলের পুত্র, ইনি নোরির পুত্র, ইনি মলকির পুত্র, ইনি আদ্দির পুত্র, ইনি কোশমের পুত্র, ইনি ইলমদমের পুত্র, ইনি এরের পুত্র, ইনি যিশুর পুত্র, ইনি ইলিয়েশরের পুত্র্, ইনি মওতের পুত্র, ইনি লেবির পুত্র, ইনি শিমিয়োনের পুত্র, ইনি যুদার পুত্র, ইনি যোশেফের পুত্র, ইনি যোনমের পুত্র, ইনি ইলিয়াকিমের পুত্র, ইনি নিলেয়ার পুত্র, ইনি মিন্নার পুত্র, ইনি মওথের পুত্র, ইনি নাথনের পুত্র, ইনি দাউদের পুত্র, ইনি যিশরের পুত্র, ইনি ওবোদের পুত্র, ইনি বোয়সের পুত্র, ইনি সলমোনের পুত্র, ইনি নহশোনের পুত্র, ইনি আন্মিনাদবের পুত্র, ইনি আদমানের পুত্র, ইনি অনি র পুত্র, ইনি হিশরোনের পুত্র, ইনি পেরশের পুত্র, ইনি যিহুদার পুত্র, ইনি যাকোবের পুত্র, ইনি ইসহাকের পুত্র, ইনি ইব্রাহীমের পুত্র, ইনি তেরহের পুত্র, ইনি নাহোরের পুত্র, ইনি সরুণের পুত্র, ইনি রিয়ুর পুত্র, ইনি পেলগের পুত্র, ইনি এবরের পুত্র, ইনি শেলহের পুত্র, ইনি কেননের পুত্র, ইনি আরফকশদের পুত্র, ইনি শেমের পুত্র, ইনি নোহের পুত্র, ইনি লেমকের পুত্র, ইনি মথুশেলহের পুত্র, ইনি হনোকের পুত্র, ইনি জেরদের পুত্র, ইনি মহললেলের পুত্র, ইনি কৈননের পুত্র, ইনি ইনোশের পুত্র, ইনি শেথের পুত্র, ইনি আদমের পুত্র, ইনি ইশ্বরের পুত্র।”
এ নসবনামা দুভাগে ভাগ করে দুটি পৃথক তালিকায় দেখালে আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝা যাবে। প্রথম তালিকা দাউদের আগে পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় তালিকা দাউদের পরবর্তীকালের।
দাউদের পূর্বে
মথির বিবরণ —————————– লুকের বিবরণ
—– ——- —————————– ১) আদম
—– ——- —————————– ২) শেখ
—– ——- —————————– ৩) ইনোস
—– ——- —————————– ৪) কৈনান
—– ——- —————————– ৫) মহালালিন
—– ——- —————————– ৬) জারেদ
—– ——- —————————– ৭) ইনোক
—– ——- —————————– ৮) মেথুসেলাহ
—– ——- —————————– ৯) লামেক
—– ——- —————————– ১০) নূহ
—– ——- —————————– ১১) শেম
—– ——- —————————– ১২) আরফাকসাদ
—– ——- —————————– ১৩) কৈনান
—– ——- —————————– ১৪) শেলাহ
—– ——- —————————– ১৫) ইবার
—– ——- —————————– ১৬) পেলেগ
—– ——- —————————– ১৭) রিউ
—– ——- —————————– ১৮) সেরুগ
মথি ইব্রাহীমের পূর্ববর্তী ——————১৯) নাহোর
কোন নাম উল্লেখ করেননি। ————– ২০) তেরাহ
১) ইব্রাহীম ——————————– ২১) ইব্রাহীম
২) ইসহাক ——————————– ২২) ইসহাক
৩) যাকোব ——————————– ২৩) যাকোব
৪) জুদাহ ——————————– ২৪) জুদাহ
৫) পেরেজ ——————————– ২৫) পেরেজ
৬) হেজরোন —————————— ২৬) হেজরোন
৭) র্যাম ———————————— ২৭) আরনি
৮) আম্মিনাদাব ————————— ২৮) আদমিন
৯) নাহশোন —————————— ২৯) আম্মিনাদাব
১০) সালমন —————————— ৩০) নাহশোন
১১) বোয়াজ ——————————- ৩১) সালা
১২) ওবেদ ——————————– ৩২) বোয়াজ
১৩) জেসে ——————————– ৩৩) ওবেদ
১৪) দাউদ ——————————– ৩৫) দাউদ
দাউদের পরে
মথির বিবরণ —————————— লুকের বিবরণ
১৪) দাউদ ——————————– ৩৫) দাউদ
১৫) সলোমন —————————– ৩৬) নাথন
১৬) রেহোবোম ———————— ৩৭) মওথা
১৭) আবিজাহ ————————- ৩৮) মেন্না
১৮) আসা —————————– ৩৯) মেলেয়া
১৯) জেহোশাফাত ——————– ৪০) এলিয়াকিম
২০) জোরাম ————————— ৪১) জোনাম
২১) উজ্জিয়া —————————- ৪২) যোসেফ
২২) জোথাম —————————- ৪৩) জুহাদ
২৩) আহাজ —————————– ৪৪) সামিওন
২৪) হেজেকিয়া ————————- ৪৫) লেভি
২৫) মানাসেহ ————————— ৪৬) মওত
২৬) আমোস —————————– ৪৭) জোরিম
২৭) জেসিয়া —————————– ৪৮) এলিজার
২৮) জেকোনিয়া ————————- ৪৯) যোশুয়া
ব্যাবিলনে বহিষ্কার ———————– ৫০) আর
২৯) শিলটিয়েল ————————- ৫১) এলমাদাম
৩০) জেরুব্বাবেল ———————– ৫২) কোসাম
৩১) আবিউদ —————————– ৫৩) আদ্দি
৩২) এলিয়াকিম ————————- ৫৪) মেলাচি
৩৩) আজোর —————————- ৫৫) নেরি
৩৪) যাদোক —————————— ৫৬) শিলটিয়েল
৩৫) আচিম ——————————- ৫৭) জেরুব্বাবেল
৩৬) এলিউদ —————————– ৫৮) রেহসা
৩৭) এলিয়াজার ————————– ৫৯) যোয়ানন
৩৮) মওন ——————————— ৬০) যোদা
৩৯) যাকোব —————————— ৬১) যোসেফ
৪০) যোসেফ —————————– ৬২) সেমিন
৪১) যিশু ———————————- ৬৩) মওথিয়াস
——————————————— ৬৪) মাআথ
——————————————— ৬৫) নাজ্ঞাই
——————————————— ৬৬) এসলি
——————————————— ৬৭) নাহুম
——————————————— ৬৮) আমোস
——————————————— ৬৯) মওথিয়াস
——————————————— ৭০) যোসেফ
——————————————— ৭১) যান্নাই
——————————————— ৭২) মেলচি
——————————————— ৭৩) লেভি
——————————————— ৭৪) মওত
——————————————— ৭৫) হেলি
——————————————— ৭৬) যোসেফ
——————————————— ৭৭) যিশু
পান্ডুলিপিতে ওল্ড টেস্টামেন্টের সঙ্গে মিলের পার্থক্য
বানানের পার্থক্য ছাড়াও দুই গসপেলের নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলি লক্ষনীয়ঃ
মাত্থুর গসপেল
গ্রীক ও ল্যাটিন উভয় ভাষায় রচিত কোডেক্স বেজাই ক্যান্টাব্রিজিনসিস নামক ষষ্ঠ শতাব্দীর অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ পান্ডুলিপিতে কোন নসবনামা নেই। গ্রীক পান্ডুলিপি থেকে নসবনামাতো গায়েব হয়ে গিয়েছেই, এমনকি ল্যাটিন পান্ডুলিপি থেকেও বহুলাংশে গায়েব হয়ে গেছে। প্রথম দিককার পৃষ্ঠাগুলি বোধহয় হারিয়েই গিয়েছে।
মথি যে এ বিষয়ে কিভাবে ওল্ড টেস্টামেন্ট বিকৃত করেছেন, তা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। সংখ্যার একটি চমকপ্রদ প্রদর্শনীর জন্য তিনি নসবনামায় বর্ণিত নামের জোড়া বাধতে শুরু করেন, কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি তিনি শেষ পর্যন্ত তা সমাপ্ত করেননি।
লুকের গসপেল
ইব্রাহীমের পূর্বে – লুক ২০টি নামের উল্লেখ করেছেন কিন্তু ওল্ড টেস্টামেন্টে মাত্র ১৯টি নামের উল্লেখ আছে (পূর্বে প্রদত্ত আদমের বংশধরদের তালিকা দেখুন) । ‘ আরফাকসাদের (১২ নং) নামের পর লুক কৈনান (১৩ নং) নামটি যোগ করেছেন, অথচ আদিপুস্তকে তাকে আরফাকসাদের পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়নি।
ইব্রাহীম থেকে দাউদ – পান্ডূলিপিতে এ সময়ে ১৪ থেকে ১৬ টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
দাউদ থেকে যিশু
কোডেক্স বেজাই ক্যান্টাব্রিজিনসিসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের নমুনা পাওয়া যায়। এ পার্থক্যের কারণ হচ্ছে এই যে, লুক মথির নসবনামা থেকে তথ্য নিয়ে নিজেই একটি খেয়ালি নসবনামা প্রস্তুত করেন এবং নকলনবিশগণ তাঁর সঙ্গে আরও পাচটি নাম জুড়ে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ পান্ডুলিপি থেকে মথির গসপেলের নসবনামাটি হারিয়ে যায়। ফলে এখন মিলিয়ে দেখার আর কোন উপায় নেই।
এবারতে সমালোচনা
আমাদের সামনে যে দুটি নসবনামা আছে, তার দুটিতেই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট আছে- দুটি ধারাই ইব্রাহীম ও দাউদের মারফত প্রবাহিত হয়েছে। বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমরা নসবনামাটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে নেব- (১) আদম থেকে ইব্রাহীম (২) ইব্রাহীম থেকে দাউদ (৩) দাউদ থেকে যিশু।
(১) আদম থেকে ইব্রাহীম
মথি তাঁর নসবনামা ইব্রাহীম থেকে শুরু করেছেন। সুতরাং এখানে তাঁর বিবরণের অস্তিত্ব নেই। একমাত্র লুকই আদম পর্যন্ত ইব্রাহীমের ২০ জন পূর্ব পুরুষের নাম দিয়েছেন। অথচ আদি পুস্তকে (অধ্যায় ৪, ৫ ও ১১) যে মাত্র ১৯ জনের নাম আছে, তা আমরা আগেই দেখেছি।
কিন্তু ইব্রাহীমের পূর্বে মাত্র ১৯ বা ২০ পুরুষ বিদ্যমান ছিলেন, এমন কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? ওল্ড টেস্টামেন্টের আলোচনায় এ সমস্যাটি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। আদি পুস্তকে বর্ণিত আদমের বংশধরদের তালিকার দিকে লক্ষ্য করলে এবং বাইবেলে বর্ণিত সময়ের মেয়াদ বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাব থেকে ইব্রাহীমের জন্মকাল পর্যন্ত মোটামুটীভাবে উনিশ শতাব্দী অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমানে ধরে নেয়া হয় যে, ইব্রাহীম খৃষ্টপূর্ব ১৮৫০ সালে জীবিত ছিলেন এবং তাঁর ভিত্তিতে ওল্ড টেস্টামেন্টের তথ্য মোতাবেক দেখা যায় যে, পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাব মোটামুটি ভাবে খৃষ্টোপূর্ব আটত্রিশ শতাব্দীতে হয়েছিলেন। এ হিসাব নকল করার ব্যাপারে তিনি একটি সুস্পষ্ট অসত্য কথা বলেছেন এবং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চুড়ান্ত ঐতিহাসিক যুক্তি আমরাআগেই দেখেছি।
ওল্ড টেস্টামেন্টের তথ্য বর্তমানে যে আর গ্রহণযোগ্য নয়, তা সকলেই স্বীকার করেন। দ্বিতীয় ভ্যাটিক্যান কাউন্সিলে এ প্রকার তথ্যকে”অপ্রচলিত” বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গসপেলে যে এ বৈজ্ঞানিক ভাবে অসঙ্গত তথ্যই ব্যবহার করা হয়েছে, এ অভিমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা গসপেল এবারতের ঐতিহাসিক নির্ভুলতার সমর্থন করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে এ যুক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ভাষ্যকারগণ এ বিপদের আশংক্যা করতে বিলম্ব করেন নি। তাই তারা এ বলে পার পেতে চান যে, এ নসবনামা সম্পূর্ণ নয় এবং লুক কিছু কিছু নাম বাদ দিয়ে গেছেন। তারা দাবী করেন যে, তিনি উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই নাম বাদ দিয়েছেন। কারণ তাঁর”একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতার ভিত্তিতে অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট সম্বলিত বংশধারার একটি মোটামুটি ধারা কায়েম করা”। (এ ট্রাইকট, লিটল ডিকশনারী অব দি নিউ তেস্তামেন্ত, প্যারিস) । ‘ কিন্তু এবারতে যা আছে তাঁর ভিত্তিতে এ কথা বলার আদৌ কোন যুক্তি নেই। কারণ এবারতে বলা আছে, ক খ -এর পিতা ছিলেন, কিংবা খ-ক এর পুত্র ছিলেন। বিশেষত ইব্রাহীমের আগের জামানার ক্ষেত্রে লুক ওল্ড টেস্টামেন্টের উপরেই নির্ভর করেছেন, আর সেখানে এভাবে বিবরণ দেয়া আছে- ক-এর বয়স প বছর হওয়ার পর তিনি খ-এর পিতা হন; খ-এর বয়স ধ বছর হওয়ার পর তিনি গ-এর পিতা হন। সুতরাং ফাক পড়ার কোন উপায় নেই।
বর্তমান যুগে যে সকল তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, তার ভিত্তিতে লুক বর্ণিত যিশুর ইব্রাহীম-পূর্ব নসবনামা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
(২) ইব্রাহীম থেকে দাউদ
এ আমলের ক্ষেত্রে দুএকটি নাম ছাড়া দুজনের নসবনামা প্রায় মিলে যায়। যে নামগুলি মেলে না, সেগুলি নকলকারীর ভুল বলে সহজেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
কিন্তু তাই বলে কি গসপেল-লেখক মথি ও লুক নির্ভুল বিবরণ দিয়েছেন বলে ধরে নিতে হবে?
ইতিহাসবিদগণের হিসাব মুতাবিক দাউদ খৃষ্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকের মানুষ ছিলেন এবং ইব্রাহীম ছিলেন খৃষ্টপূর্ব ১৮০০-১৮৫০ সালের দিকের মানুষ। এখন মথি বা লুকের বিবরণ সঠিক বলে মেনে নিতে হলে স্বীকার করে নিতে হয় যে, মোটামুটি ভাবে আটশত বছর সময়ের মধ্যে ১৪ থেকে ১৬ পুরুষ বাস করেছে। কিন্তু এটাকি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার? এ আমলটি সম্পর্কিত গসপেল বিবরণে যা বলা হয়েছে, তাতে সম্ভাব্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সীমারেখা প্রায় অতিক্রম হয়ে গেছে।
(৩) দাউদের পরের আমল
দাউদ থেকে যোসেফ পর্যন্ত অর্থাৎ যিশু পর্যন্ত বংশধারা মিলাতে গেলে দেখা যায় যে, মথির বিবরণের সঙ্গে লুকের বিবরণ আদৌ মিলছে না।
লুকের ব্যাপারে কোডেক্স বেজাই ক্যান্টাব্রিজিনসিসে যে সুস্পষ্ট জালিয়াতি করা হয়েছে, আপাতত তা বাদ দিয়ে রেখে সর্বাধিক সম্মানিত দুটি পান্ডুলিপি কোডেক্স ভ্যাটিক্যানাস এবং কোডেক্স সিনাইটিকাসে কি বলা হয়েছে, তা আমরা মিলিয়ে দেখতে পারি।
লুকের নসবনামায় দাউদের (৩৫নং) পরে এবং যিশু (৭৭নং) পর্যন্ত মোট ৪২টি নাম আছে। পক্ষান্তরে মথির নবনামায় দাউদ (১৪নং) থেকে যিশু (৪১নং) পর্যন্ত মোট ২৭টি নাম আছে। দাউদের পরে যিশুর যে সকল (কাল্পনিক) পূর্বপুরুষের নাম দেয়া হয়েছে, তা দুজনের বিবরণে দু রকম। তাছাড়া বর্ণিত নামও দুই বিবরনে এক রকম নয়। কিন্ত এখানেই শেষ নয়।
মথি আমাদের বলেছেন যে, ইব্রাহীমের পর যিশুর নবনামায় ১৪টি নাম যে কিভাবে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, তা তিনি আবিষ্কার করেছেন। প্রথম ভাগ ইব্রাহীম থেকে দাউদ পর্যন্ত, দ্বিতীয় ভাগ দাউদ থেকে ব্যাবিলনে দেশান্তর হওয়া পর্যন্ত এবং তৃতীয় ভাগ দেশান্তর থেকে যিশু পর্যন্ত। তার এবারতের প্রথম দুভাগে ১৪টি করে নাম আছে বটে-কিন্তু তৃতীয় ভাগে আছে মাত্র ১৩টি নাম, ১৪টি নয়। তার দেয়া তালিকায় দেখা যায় যে, শিয়ালথিয়েলের নাম আছে ২৯ নম্বরে, আর যিশুর নাম ৪১ নম্বরে। তার এবারতের এমন কোন পাঠ খুজে পাওয়া যায় না, যেখানে তৃতীয় ভাগে ১৪টি নাম দেয়া আছে।
মথি তাঁর দ্বিতীয় ভাগে নামের সংখ্যা ১৪টি করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টের এবারতে ব্যাপক রদবদল করেছেন। দাউদের ছয়জন আওলাদের নাম (১৫ থেক ২অ নম্বর) ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু দ্বিতীয় বংশাবলী অধ্যায়ে আই-ওরামের (২০ নম্বর) তিনজন আওলাদের যে আহাজিয়াহ, জেয়াশ ও আমাজিয়াহ নাম দেয়া আছে, তা তিনি গোপন করেছেন। অন্যত্র মথি বলেছেন যে, জেকোনিয়াহ (২৮ নম্বর) জোসিয়ার পুত্র, কিন্তু ওল্ড টেস্টামেন্টের দ্বিতীয় রাজাবলী অধ্যায়ে দেখা যায় যে, জোসিয়া ও জেকোনিয়ার মাঝখানে আর একজন আছেন এবং তাঁর নাম এলিয়াকিম।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, দাউদ থেকে ব্যাবিলনে দেশান্তর হওয়া পর্যন্ত সময়ে ১৪ টি নামের একটি কৃত্রিম তালিকা পেশ করার জন্য মথি ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণিত নসবনামা রদবদল করেছেন। তাছাড়া মথির তৃতীয় ভাগে একটি নাম কমও আছে। অর্থাৎ বাইবেলের বর্তমানে চালু সংস্করণগুলির কোনটিতেই পুরাপুরি ১৪টি নাম নেই। একটি নাম কম থাকার ব্যাপারটি হয়ত কোন প্রাচীন নকলনবিশের ভুল বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হতে পারে, কিন্তু সেটা আসলে কোন বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে এই যে, কোন ভাষ্যকারই এ ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য না করে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। তাদের এ নীরবতার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা কি হতে পারে?ডব্লু ট্রিলিং তাঁর”দি গসপেল একর্ডিং টু ম্যাথু” (প্রকাশক – ডেসক্লি, প্যারিস) নামক গ্রন্থে মাত্র একটি বাক্য লিখে নীরবতার এ পূণ্যময় ষড়যন্ত্র বরবাদ করে দিয়েছেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একুমেঙ্ক্যাল ট্রানশ্লেশন ও কার্ডিনাল ডানিয়েলো সহ এ গসপেলের বিভিন্ন ভাষ্যকার মথির ৩*১৪ হিসেবের বিরাট প্রতীকধর্মী তাৎপর্যের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ এ তাৎপর্য মথির কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এ হিসাবে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণিত নাম গোপন করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
মথির এ কাজের সমর্থনে যুক্তি দেখানোর জন্য ভাষ্যকারগণ যে কোন না কোন অজুহাত খাড়া করতে পারেন, তাতে আদৌ কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মথি যা দেখাতে চেয়েছেন, নাম গোপন করার ফলে সেই মূল উদ্দেশ্যই যে বরবাদ হয়ে গেছে, এ সত্যটি এড়িয়ে যাওয়ার তাদের উপায় কি?
আধুনিক বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য ও মন্তব্য
কার্ডিনাল ডানিয়েলো তাঁর”গসপেলস অব চাইল্ডহুড” (প্রকাশক এডিশনস দ্য সিউইল, প্যারিস) নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, মথির”সংখ্যাতাত্বিক প্রকল্পায়নের’ একটি বিশেষ প্রতীকধর্মী গুরুত্ব আছে, কারণ এ প্রস্তাবনাতেই যিশুর বংশ পরিচয় প্রমানিত হয়েছে এবং লুকও বিষয়টি সমর্থন করেছেন। তার মতে মথি ও লুক আসলে ইতিহাসবিদ এবং তারা”ঐতিহাসিক অনুসন্ধান” সমাপ্ত করেছেন এবং ঐ নবনামা তারা”যিশুর পারিবারিক দস্তাবেজ থেকে সংগ্রহ করেছেন।”
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যিশুর পারিবারিক দস্তাবেজের কোন হদিশ কখনই পাওয়া যায়নি। লেখক বলেছেন যে, তিনি ইউসেবিয়াস পামফিলি লিখিত ধর্মীয় ইতিহাস থেকে ঐ দস্তাবেজের অস্তিত্বের কথা জানতে পেরেছেন। কিন্তু খোদ পামফিলির যোগ্যতা এবং নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে বলার মত অনেক কথাই আছে। তাছাড়া যিশুর পারিবারিক দস্তাবেজ দু রকমের দুখানি নসবনামাই বা থাকবে কেন?দুজন তথাকথিত ‘ঐতিহাসিক’ দু রকমের দুখানি নসবনামা দিয়েছেন বলেই কি ঐ দস্তাবেজে দুখানি ভিন্ন ভিন্ন নসবানামা আবিষ্কার করতে হয়েছে?
কার্ডিনাল ডানিয়েলোর এ দৃষ্টিভঙ্গির যারা সমালোচনা করেছেন, তাদের সকলের প্রতিই তিনি খড়গহস্ত হয়েছেন-”গসপেলের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহু বিশেষজ্ঞই পাশ্চাত্য মনোবৃত্তি ইহুদী-খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সেমিটিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের কারণে তাদের পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তারা প্লেটো, ডেসকার্টে, হেগেল ও হিডেগার প্রভাবিত নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি ঐ ব্যাখ্যায় আরোপ করেছেন। সুতরাং তারা যে নানাবিধ বিষয়বস্তু একত্রে মিশিয়ে ফেলেছেন, তা সহজেই বুঝা যায়।” অথচ ঐ কাল্পনিক নসবনামার প্রতি সমালোচনামূলক মনোভাব গ্রহণ করার সঙ্গে প্লেটো, ডেসকার্টে, হেগেল বা হিডেগারের মত দার্শনিকদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
মথির ৩X১৪ উপপাদ্যের অর্থ খুজতে গিয়ে লেখক একটি উদ্ভট প্রস্তাবনা উত্থাপন করে তা বিশ্লেষন করেছেন। তার কথাগুলিই এখানে উধৃত করা যেতে পারে-”আসলে এখানে ইহুদী ওহীর সাধারণ দশ সপ্তাহের কথা বলা হইয়াছে। আদম থেকে ইব্রাহীম পর্যন্ত সময়ের জন্য প্রথম তিন সপ্তাহ বাদ দিতে হবে; তাহলে বছরগুলির সাত সপ্তাহ অবশিষ্ট থাকবে; তার প্রথম ছয় সপ্তাহ হবে সাতের ছয়গুন, যার সম্পর্ক হচ্ছে, চৌদ্দর তিনটি শ্রেণীর; আর অবশিষ্ট সপ্তম সপ্তাহ শুরু হয়েছে যিশুর সময় থেকে, কারণ যিশুর সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়ার সপ্তম যুগ শুরু হয়েছে।” এ ধরনের ব্যাখ্যা স্পষ্টতই মন্তব্যের অযোগ্য।
একুমেঙ্ক্যাল ট্রানশ্লেশন-নিউ টেস্টামেন্ট এর ভাষ্যকারগণও একই ধরনের হাস্যকর সংখ্যাতাত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মথির ৩X১৪ উপপাদ্য তারা এভাবে ব্যাখায় করেছেনঃ
(ক) ১৪ সংখ্যাটি হিব্রু নাম ডেভিডের ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যাতাত্বিক যোগফল হতে পারে- ডি=৪, এবং ভি=৬, সুতরাং ৪+৬+৪=১৪।
(খ) ৩X১৪=১৬X৭ এবং ইব্রাহীমের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যে পবিত্র ইতিহাসের শুরু হয়েছে, তার ষষ্ঠ সপ্তাহের শেষে যিশু আগমন করেন।”
লুকের ক্ষেত্রে ঐ গ্রন্থে আদম থেকে যিশু পর্যন্ত ৭৭টি নাম দেয়া হয়েছে এবং পুনরায় ৭ সংখ্যাটি এভাবে আনা হয়েছে- ৭৭-কে ৭দিয়ে ভাগ করা হয়েছে, অর্থাৎ ৭X১১=৭৭। স্পষ্টতই কোন শব্দ যোগ দিয়ে বা বিয়োগ করে যে সংখ্যাতাত্বিক পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তাঁর সর্বত্র ৭৭টি নাম সম্পূর্ণ কৃত্রিম ও কাল্পনিক। তবে লক্ষ্যনীয় যে, সংখ্যার এ খেলার সঙ্গে উপপাদ্যটি বেশ মিলে গিয়েছে।
গসপেলে যিশুর যে দুটি নসবনামা আছে, তার ভিত্তিতে খৃষ্টান ভাষ্যকারগণ মথি ও লুকের কল্পনাশক্তির মতই চিন্তার কসরত দেখিয়েছেন।
বিবরণের স্ববিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতা
চারটি গসপেলের প্রত্যেকটিতে এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আছে, যা হয়ত একটি মাত্র, কিংবা কয়েকটি, কিংবা সকল গসপেলেই আছে। এরূপ কোন ঘটনার বিবরণ যখন একটিমাত্র গসপেলে পাওয়া যায়, তখন কিছু গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়। কখনও দেখা যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হয়ত কেবলমাত্র একখানি গসপেলে বর্ণিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ যিশুর পুনরুত্থানের দিন স্বর্গে আরোহণের কথা বলা যেতে পারে। অন্যত্র বিভিন্ন ঘটনা দুই বা ততোধিক গসপেলে খুবই ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। খৃষ্টানগণ সাধারণত এ সকল স্ববিরোধিতা পেক্ষা করে থাকেন; কিন্তু একাধিক গসপেলের মধ্যে এ পার্থক্য যদি কখনও তারা আবিষ্কার করেন, তাহলে সত্যিই তারা বিস্মিত হয়ে যান। তাদের এ বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে এই যে, দীর্ঘদিন যাবত তাদের এ আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, নিউ টেস্টামেন্টের লেখকগণ যে সকল ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তার প্রত্যেকটি তারা নিজ চোখে দেখেছেন।
এ জাতীয় অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতার কিছু কিছু ঘটনা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে যিশুর শেষ বয়সের ঘটনায় এবং বিশেষত তাঁর নির্যাতন ভোগের পরবর্তী ঘটনাবলীতেই বর্ণনার পার্থক্য এবং স্ববিরোধিতার নজীর বেশী পাওয়া যায়।
নির্যাতনের বিবরণ
ফাদার রোজেট নিজেই লক্ষ্য করেছনে যে, পাসওভারের ঘটনাটি (মিসরের দাসত্ব থেকে ইহুদঈদের মুক্তিলাভের স্মারক উৎসব ) শিষ্যদের সঙ্গে যিশুর শেষ ভোজের প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন গসপেলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জন বলেছেন যে, শেষ ভোজ”পাসওভার উৎসবের আগে” অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু অপর তিনজন ইভানজেলিস্ট বলেছেন যে, ভোজটি ঐ উৎসব চলাকালেই হয়েছে। এ পার্থক্যের ফলে একটি স্পষ্ট অসম্ভাব্যতা দেখা দিয়েছে- পাসওভার উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে খোদ ভোজের ব্যাপারটিই অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। ইহুদী ইতিহাসে পাসওভারের গুরুত্ব এবং খৃষ্টান ইতিহাসে শিষ্যদের কাছ থেকে যিশুর শেষ বিদায় গ্রহণকালীন ভোজের গুরুত্ব সম্পর্কে যারা ওয়াকিহাফ আছেন, তাদের পক্ষে একথা বিশ্বাস করা কিভাবে সম্ভব যে, ইভানজেলিস্টগণ ঐ ঘটনা দুটির পরম্পরা বিলকুল ভুলে গিয়েছেন?
একইভাবে প্যাশনের (যিশুর নির্যাতিত ও ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা) বর্ণনা এক একজন ইভানজেলিস্ট একেক ভাবে দিয়েছেন। বিশেষত জনের বর্ণনা অপর তিন জনের বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের। তাছাড়া জন শেষ ভোজ ও প্যাশনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা খুবই দীর্ঘ -মার্ক ও লুকের বর্ণনার প্রায় দ্বিগুন এবং মথির বর্ণনার প্রায় দেড় গুন। জনের গসপেলে চার অধ্যায় (১৪-১৭) ব্যাপী শিষ্যদের প্রতি যিশুর একটি দীর্ঘ বক্তৃতা আছে। এ বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে, তিনি তাঁর শেষ উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁর শেষ ধর্মীয় ওছিয়ত দিয়েছেন। কিন্তু অপর তিনখানি গসপেলে এ বক্তৃতার চিহ্নমাত্রও নেই। পক্ষান্তরে মথি, লুক ও মার্ক গেথসিমেন বাগানে যিশুর প্রার্থনার যে বিবরণ দিয়েছেন, জন তাঁর উল্লেখ মাত্রও করেননি।
জনের গ্রন্থে ইউকারিস্টের বিবরণ নেই
জনের গ্রন্থে প্যাশনের বিবরণ পড়তে গিয়ে যে বিষয়টি পাঠকের কাছে সবচেয়ে বড় আকারে ধরা পড়ে, তা হচ্ছে এই যে, তিনি যিশু ও তাঁর শিষ্যদের শেষ ভোজকালীন ইউকারিস্ট (পবিত্র রুটি ও মদ খেয়ে যিশুর একাত্ম হওয়া) অনুষ্ঠানের কোন উল্লেখই করেননি।
শেষ ভোজের অংকিত চিত্র সম্পর্কে অবহিত নন এমন খৃষ্টান সম্ভবত একজনও খুজে পাওয়া যাবে না। ঐ ছবিতে দেখা যায় যিশু শেষ বারের মত তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে এক টেবিলে বসেছেন। দুনিয়ার প্রায় সকল খ্যাতনামা শিল্পীই এ ছবিটি একেছেন এবং তাতে দেখা যায় যে, জন যিশুর পাশেই বসে আছেন। উল্লেখযোগ্য যে, এ জনকেই আমরা ঐ নামে প্রচলিত গসপেলের লেখক বলে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত।
অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও একথা সত্য যে, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই জনকে চতুর্থ গসপেলের লেখক বলে মনে করেন না। এবং এ গসপেলে ইউকারিস্টের কোন উল্লেখ নেই। অথচ রুটি ও মদ পবিত্র হয়ে যিশুর দেহ ও রক্তে পরিণত হওয়ার ঐ ঘটনা খৃষ্টান উপাসনার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হলেও অন্যান্য ইভানজেলিস্টগণ এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন; কিন্তু জন এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি। চারজনের বর্ণনায় কেবলমাত্র দুটি বিষয়ে সামঞ্জস্য পাওয়া যায়- পিটারের অস্বীকৃতি এবং একজন হাওয়ারির বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী (জুডাস ইসকারিয়টের নাম কেবলমাত্র মথি ও জন উল্লেখ করেছেন) । ‘ আর যিশু যে ঐ ভোজের আগে তাঁর শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়েছেন, তা একমাত্র জনের বর্ণনাতেই পাওয়া যায়।
কিন্তু জনের গ্রন্থে ঐ ইউকারিস্টের উল্লেখ না থাকার কারণ কি?নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে যে জবাবটি প্রথম মনে আসে তা হচ্ছে এই যে, অপর তিনখানি গ্রন্থের কাহিনী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে জনের গ্রন্থের ঐ অংশটি সম্ভবত হারিয়ে গেছে। কিন্তু খৃষ্টান ভাষ্যকারগণ এরূপ কোন সিদ্ধান্ত উপনীত হননি। তাদের কিছু অভিমত এ প্রসঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
এ ট্রাইকট তাঁর দি লিটল ডিকশনারী অব দি টেস্টামেন্ট নামক গ্রন্থে”লাস্ট সাফার” শিরোনামে বলেছেন-”বারোজন শিষ্যের সঙ্গে যিশু শেষ খানা খেয়েছিলেন ঐ এবং ঐ সময় তিনি ইউকারিস্ট অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন প্রথম তিনটি গসপেলে (মথি, মার্ক ও লুক) এ বিষয়ে বর্ণনা আছে এবং চতুর্থ গসপেলে (জন) বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।” কিন্তু”ইউকারিস্ট”শিরোনামে তিনি লিখেছেন -”প্রথম তিনখানি গসপেলে এ অনুষ্ঠান প্রবর্তনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে; এটা নবীর ধর্মীয় শিক্ষাদান পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যিশুর ‘জীবনের রুটি’ বিষয়ক বক্তৃতার বিবরণ প্রসঙ্গে জন (৬, ৩২-৫৮) ঐ সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় আরও অনেক তথ্য ও বিবরণ যোগ করেছেন।”অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, জন যে ইউকারিস্ট প্রবর্তনের কোন বর্ণনাই দেননি, এ কথা তিনি আদৌ উল্লেখ করেননি। তিনি অনেক তথ্য ও বিবরণের যে কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে ইউকারিস্ট প্রবর্তনের কোন সম্পর্ক নেই, কারণ জন মূলত শিষ্যদের পা ধুয়ে দেয়ার ঘটনাটিই বর্ণনা করেছেন। ভাষ্যকার ট্রাইকট ‘জীবনের রুটি’ প্রসঙ্গে যে উল্লেখ করেছেন, তা একটি সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার। শেষ ভোজের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। মূসার নেতৃত্বে মিসর থেকে পালিয়ে আসার পর ইহুদীগণ বিরান ময়দানে অবস্থানের সময় আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদিন মান্না নামের যে খানা পেত, যিশু তাঁর বক্তৃতায় সে কথা উল্লেখ করেছিলেন মাত্র এবং একমাত্র জনের গ্রন্থেই এ উল্লেখের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রুটির কথা বলতে গিয়ে যিশু প্রসঙ্গত ইউকারিস্টের যে উল্লেখ করেন, জন তাঁর পরবর্তী অনুচ্ছেদে তাও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অপর তিনখানি গ্রন্থে এ প্রসঙ্গের কোন উল্লেখ নেই।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অপর তিনজন যা বলেছেন সে সম্পর্কে জন কিছু বলেননি; আবার জন যা বলেছেন (যিশুর কথিত ভবিষ্যদ্বাণী) সে সম্পর্কে তারাও কিছু বলেননি। বিস্ময়ের ব্যাপার বৈকি!
নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেলের একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন-এর ভাষ্যকারগণ জনের গ্রন্থে ইউকারিস্ট সম্পর্কে বিবরণ না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলেন-”জনসাধারণ ত প্রাচীন ইসরায়েলের কিংবদন্তি বা রেওয়াজ সম্পর্কে তেমন আগ্রহশীল নন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি ইউকারিস্ট প্রবর্তনের ঘটনাটি বর্ণনা করেননি।”এ যুক্তি কিভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে? জন ইহুদীদের প্রাচীন রেওয়াজে আগ্রহী না হতে পারেন, কিন্তু নতুন খৃষ্টান ধর্মের অমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান তিনি কিভাবে উপেক্ষা করতে পারেন?
খৃষ্টান বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে এতই বিব্রতবোধ করে থাকেন যে, জনের রচনার মধ্যে তারা যিশুর জীবনের এমন একটি ঘটনা আবিষ্কার করতে চান, যেখানে ইউকারিস্টের অনুরূপ কোন ঘটনার বিবরণ বা ইশারা পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ও কুলম্যানের কথা বলা যেতে পারে। তিনি তাঁর”দি নিউ টেস্টামেন্ট” নামক গ্রন্থে বলেছেন-”পানিকে মদে রূপান্তরিত করা এবং পাচখানি রুটি দিয়ে পাচ হাজার লোককে আহার করানোর ঘটনার মধ্যে শেষ ভোজের তথা ইউকারিস্ট অনুষ্ঠানের আগাম ইশারা আছে।” স্মরণ করা যেতে পারে যে, কানা নামক স্থানে একটি শাদীর মজলিসে মদের ঘাটতি দেখা দিলে যিশু পানিকে মদে রূপান্তরিত করেন। জন তাঁর গ্রন্থে (২, ১-১২) এ ঘটনাটি যিশুর প্রথম মুজেজা হিসাবে বর্ণনা করেছেন, এ চারজন ইভানজেলিস্টের মধ্যে একমাত্র তিনিই এ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। পাঁচখানি যবের রুটি অলৌকিক ভাবে সংখ্যায় এত বেশী হয়েছিল যে, পাঁচ হাজার লোকের আহার অনায়াসে হয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনা দুটি বর্ণনার সময় জন কোন বিশেষ মন্তব্য করেননি এবং আধুনিক বিশেষজ্ঞগণ যে অনুরূপ ঘটনায় তাঁর আভাস পেয়েছেন বলে দাবী করেছেন তাকে বড়জোর তাদের কল্পনা শক্তির অস্বাভাবিক বিস্তার বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কুলম্যান ঐ ধরনের যুক্তি আরও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যিশু যে একজন পক্ষাঘাতগ্রস্থ ও একজন অন্ধকে আরোগ্য করেন, তাঁর মধ্যে”বাপটিজমের ভবিষ্যদ্বাণী আছে” এবং যিশুর ইন্তেকালের পর”তাঁর দেহের এক পাশ থেকে যে পানি ও রক্ত বেরিয়েছিল, তাঁর মধ্যে বাপটিজম ও ইউকারিস্ট একই সুত্রে প্রথিত হওয়ার প্রমাণ আছে।” এ ধরনের যুক্তি সম্পর্কে আর কি মন্তব্য করা যেতে পারে?
ফাদার রোজেট তাঁর ‘ইনিশিয়েশন টু দি গসপেল’ নামক গ্রন্থে অসকার কুলম্যানের আর একটি অদ্ভুত যুক্তি এভাবে বর্ণনা করেছেন-”অসকার কুলম্যানের মত কোন কোন ধর্মবিদ শেষ ভোজের পূর্বে (যিশু কর্তৃক শিষ্যদের) পা ধুয়ে দেয়ার ঘটনাকে ইউকারিস্ট প্রবর্তনের প্রতীক রূপে গণ্য করে থাকেন।”
জনের গ্রন্থে ইউকারিস্টের উল্লেখ না থাকার ব্যাপারটি সাধারণ খৃষ্টানদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ধর্মবিদগণ যে কোন স্তরে নেমে গিয়ে কি সব যুক্তির অবতারণা করেছেন তা লক্ষ্য করলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
মৃত্যুর পর যিশুর হাজির হওয়া
মথির গ্রন্থে যিশুর মৃত্যুর সময় একটি কথিত আলৌকিক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কল্পনাশক্তির যে অবাধ বিস্তার করা হয়েছে, উদাহরণ হিসাবে তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যিশুর কবর থেকে পুনরুত্থানের পরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে চারজন গসপেল লেখক চার রকমের, অর্থাৎ পরস্পর বিরোধী বিবরণ দিয়েছেন। ফাদার রোজেট তাঁর ‘ইনিশিয়েশন টু দি গসপেল’ গ্রন্থের ১৮২ পৃষ্ঠায় এ পরস্পর বিরোধী এবং এমন কি হাস্যকর বিবরণের কিছু নজীর উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন -”যে সকল মহিলা কবরে সমবেত হয়েছিলেন, তাদের সংখ্যা প্রথম তিনখানি গসপেলে তিন রকমের দেয়া আছে। জনের গসপেলে কেবল একজন মহিলার কথা বলা হয়েছে, এবং তিনি হচ্ছেন মেরি ম্যাগডালেন। কিন্তু তিনি আবার বহুবচনে কথা বলেছেন- ‘তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে, তা আমরা জানি না’ – সুতরাং মনে হয় তিনি একা ছিলেন না। মথির গ্রন্থে একজন ফেরেশতা মহিলাদের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, তারা গ্যালিলিতে যিশুর দেখা পাবেন। কিন্তু কিছুক্ষন পরে যিশু তাঁর কবরের পাশেই তাদের দেখা দেন। লুক সম্ভবত এ স্ববিরোধিতা অনুমান করে তাঁর নিজের গ্রন্থে বিবরণটি একয়ু বদলে দেন। ফেরেশতা বললেন- ‘গ্যালিলিতে থাকার সময় তিনি আপনাদের কিভাবে বলেছিলেন তা স্মরণ করুন …। প্রকৃতপক্ষে লুক যিশুর তিনবার হাজির হওয়ার কথা বলেছেন। জনও তিনবারের কথা বলেছেন – দুবার জেরুসালেমে একটি উপরতলার কামরায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে এবং একবার গ্যালিলি উপসাগরের তীরে। মথি গ্যালিলিতে মাত্র একবার হাজির হওয়ার কথা বলেছেন।”
ফাদার রোজেট তাঁর এ পরীক্ষা থেকে মার্কের সংশ্লিষ্ট বিবরণ বাদ দিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেন যে, ঐ অংশটি”সম্ভবত অন্য কারও রচনা।”
ঐ সকল তথ্য থেকে প্রমানিত হয় যে, যিশু পাঁচ হাজারেরও বেশী লোকের সঙ্গে দেখা দিয়েছেন, জেমসের সঙ্গে দেখা দিয়েছেন, সকল হাওয়ারির সঙ্গে দেখা দিয়েছেন এবং পলের নিজের সঙ্গেও দেখা দিয়েছেন বলে করিমথিয়ানদের নিকট লিখিত পলের প্রথম চিঠিতে (১৫, ৫-৭) যে উল্লেখ আছে, তার আদৌ কোন ভিত্তি নেই।
অবস্থা যখন এই, তখন তাজ্জবের কথা হচ্ছে এই যে, ফাদার রোজেট ঐ একই গ্রন্থে যিশুর পুনরুত্থান বিষয়ে কোন কোন রচনায় বালসুলভ কল্পনার সাড়ম্বর বর্ণনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। অথচ এ মন্তব্য মথি ও পল সম্পর্কেই সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য; কারণ ঐ বিষয়ে তাদের বক্তব্য অন্যান্য হাওয়ারিদের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধী।
তাছাড়া যিশুর পলের সঙ্গে দেখা দেওয়া সম্পর্কে লুক ‘হাওয়ারিদের তৎপরতায় (এক্টস অব এপোসলস) যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে ঐ বিষয়ে পলের নিজের বর্ণনার যথেষ্ট গরমিল রয়েছে। এ অবস্থা লক্ষ্য করে ফাদার কানেনগিসার তাঁর ‘ফেথ ইন দি রিজারেকশন, রিজারেকশন অব ফেথ’ (১৯৭৪) নামক গ্রন্থে জোর দিয়ে বলেছেন যে, পল যিশুর পুনরুত্থানের”একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী এবং নিউ টেস্টামেন্টের অপর কোন লেখক ঐ সম্মান দাবী করতে পারেন না এবং তাঁর রচনার মারফত তাঁর কথা সরাসরি আমাদের কাছে এসেছে।” অথচ পুনরুজ্জীবিত যিশুর সংগে তাঁর ব্যাক্তিগত ভাবে দেখা হয়েছে বলে তিনি কখনও উল্লেখ করেননি। অবশ্য”তিনবার খুবই সতর্কতার সংগে তিনি বিষয়টির অবতারণা করেছেন বটে, কিন্তু কখনও কোন বর্ণনা দেননি।”
যে পল প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সত্ত্বেও পরিষ্কার করে কিছু বলেননি, তার সংগে গসপেলের বর্ণনার পরষ্পর বিরোধিতা স্পষ্টতই প্রকট ও প্রকাশিত।
অসকার কুলম্যানও তাঁর”দি নিউ টেস্টামেন্ট” নামক গ্রন্থে লুক ও মথির বর্ণনার মধ্যে বিরোধিতা লক্ষ্য করেছেন। লুক বলেছেন, যিশু জুডিয়ার দেখা দেন; আর মথি বলেছেন গ্যালিলিতে।
এ প্রসঙ্গে জন ও লুকের বর্ণনার পরষ্পর বিরোধিতাও লক্ষ্য করা যেতে পারে। জন বলেছেন (২১, ১-১৪) যে, যিশু কবর থেকে উঠে এসে তিবারিয়াস সাগর তীরে জেলেদের সংগে দেখা দেন; ফলে তারা এত বেশী মাছ ধরতে সক্ষম হয় যে, তা বয়ে নিয়ে যাওয়াই তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়ে। এ কাহিনী আসলে ঐ একই স্থানে অলৌকিকভাবে মাছ ধরার কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং লুক এ কাহিনীটি (৫, ১-১১) যিশুর জীবিত কালের ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন।
যিশুর এ দেখা দেয়ার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ফাদার রোজেট তাঁর গ্রন্থে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে, ঘটনার”অসংলগ্ন, অস্পষ্ট ও বিশৃংখল চরিত্র বরং বিশ্বাসই উৎপন্ন করে”। কারণ ঐ সকল তথ্য থেকে এ কথাই প্রমানিত হয় যে, ইভানজেলিস্টগণের মধ্যে এ ব্যপারে কোন যোগসাজশ ছিল না; নইলে তারা সকলে মিলে অতি অবশ্যই একটি মাত্র বর্ণনা দিতেন, কিন্তু তাদের মধ্যে যোগসাজশ হওয়া আদৌ সম্ভব ছিল কি? এ যুক্তি সত্যিই অদ্ভুত। আসলে তারা হয়ত তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ে প্রচলিত কিংবদন্তিই লিপিবদ্ধ করেছেন, এবং সকল কিংবদন্তিতেই (তাদের অজ্ঞাতে) কল্পনার বিস্তার ছিল। ঘটনার বর্ণনায় অত স্ববিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতা থাকার কারণে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
যিশুর স্বর্গারোহণ
স্ববিরোধিতা আরও আছে, বিবরণের একেবারে শেষ পর্যন্তই আছে। কারন জন বা মথি যিশুর স্বর্গারোহণের কথা আদৌ উল্লেখ করেননি, উল্লেখ করেছেন কেবল মাত্র মার্ক ও লুক।
মার্ক বলেছেন (১৬, ১৯), যিশু”উর্ধে স্বর্গে উত্থিত হইলেন এবং ইশ্বরের ডানপাশে আসন গ্রহণ করিলেন”, কিন্তুতিনি যিশুর কবর থেকে বেরিয়ে আসার যে ঘটনা বলেছেন, তার কতদিন পর স্বর্গারোহণের ঘটনা ঘটে, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। উল্লেখযোগ্য যে, মার্কের বাইবেলের সর্বশেষ অনুচ্ছেদে ঐ বাক্যটি আছে। ফাদার রোজেট মনে করেন যে, অনুচ্ছেদটি”জাল”, কিন্তু চার্চের মতে বিলকুল সহি।
তারপর লুকের বিবরণ। একমাত্র লুক স্বর্গারোহণের ঘটনার একটি অবিরোধিত বিবরণ দিয়েছেন (২৪, ৫১) । তিনি বলেছেন-”তিনি তাহাদের হইতে পৃথক হইলেন এবং উর্ধে স্বর্গে নীত হইলেন।” তাহাদের বলতে এখানে এগার জন হাওয়ারির কথা বলা হয়েছে, কারণ দ্বাদশ হাওয়ারির জুরাস আগেই ইন্তেকাল করেন। কবর থেকে বেরিয়ে আসা এবং হাওয়ারিদের সঙ্গে দেখা দেয়ার বিবরণের পর স্বর্গারোহণের কথা বলা হয়েছে; ফলে মনে হয়, কবর থেকে বেরিয়ে আসা এবং স্বর্গে আরোহণের ঘটনা একই দিনে ঘটেছিল। ‘হাওয়ারিদের তৎপরতা কিভাবে লুক (সকলেই তাকে লেখক বলে মনে করেন) প্যাশন ও স্বর্গারোহণের মাঝামাঝি সময়ে হাওয়ারিদের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন-”নির্যাতন ভোগের পর তিনি জীবিত অবস্থায় (যার অনেক প্রমাণ আছে) তাদের সামনে হাজির হন। এভাবে চল্লিশ দিন হাজির হন এবং ইশ্বরের রাজ্যের কথা বলেন (অধ্যায় ১, ৩)
এ বর্ণনার ভিত্তিতেই ইস্টারের (যিশুর কবর থেকে উত্থিত হওয়ার উৎসব) চল্লিশ দিন পর স্বর্গারোহণের উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এ উৎসবের তারিখটি লুকের গসপেলের বর্ণনার সরাসরি বিরোধী। অপর কোন গসপেলে এ তারিখের যৌক্তিকতা অন্য কোন ভাবে দেখানো হয়নি।
এ সামঞ্জস্যহীনতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল খৃষ্টান মাত্রই এ বিষয়ে বিব্রত বোধ করে থাকেন। ‘একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন’ গ্রন্থে এ বিষয়টি করা হয়েছে বটে, কিন্তু কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। শুধু বলা হয়েছে যে, যিশুর মিশনের সঙ্গে এ চল্লিশ দিনের হয়ত কোন সম্পর্ক থাকতে পারে।
তবে যে সকল ভাষ্যকার সবকিছুই ব্যাখ্যা করতে চান এবং সকল অসামঞ্জস্যের সামঞ্জস্য বিধান করতে চান, তারা সেই বিষয়ে কিছু অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বাইব্লিক্যাল স্কুল অব জেরুসালেম কর্তৃক ১৯৭২ সালে সম্পাদিত ‘দি সিনপসিস অব দি ফোর গসপেলস’ গ্রন্থে (দ্বিতীয় খন্ড, ৪৫১ পৃষ্ঠা) এরূপ একটি অদ্ভুত ব্যাখ্যা আছে। সেখানে”স্বর্গারোহন”শব্দটির সমালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে-”প্রকৃত পক্ষে দৈহিক অর্থে কোন স্বর্গারোহন ঘটেনি, কারণ ইশ্বর যেমন নিচে থাকেন না, তেমনি উপরেও থাকেন না?”এ মন্তব্যের অরররথ অনুধাবন করা বড়ই মুশকিল। কারণ লুক যদি উর্ধলোকে আরোহণই না বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি আসলে কি বুঝিয়েছেন?এ গ্রন্থের অন্যত্র বলা হয়েছে,”এক্টস অব এপোসলস গ্রন্থে কবর থেকে উত্থিত হওয়ার চল্লিশ দিন পর স্বর্গারোহণের ঘটনা ঘটে বলে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি সাহিত্যিক কৌশল; এবং যিশুর দুনিয়ায় হাজির হওয়ার যে পরিসমাপ্তি ঘটেছে, এ কথা গুরুত্বসহকারে বুঝানোর জন্যই এ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। লুকের গসপেলে অবশ্য ইস্টার রবিবারের সন্ধ্যায় স্বর্গারোহণের ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ কবর থেকে উত্থিত হওয়ার দিন সকালে শূন্য কবর আবিষ্কৃত হওয়ার পরবর্তী কালীন বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করার সময় লুক দুই ঘটনার মধ্যে কোন বিরত দেননি। এটা অতি অবশ্যই একটি সাহিত্যিক কৌশল। যিশুর কবর থেকে উত্থিত হওয়া এবং শিষ্যদের সঙ্গে দেখা দেয়ার মাঝখানে কিছুটা সময় অতিবাহিত হতে দেয়ার জন্যই এ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
এ ব্যাখ্যার অর্থ যে আসলে কি, তা স্পষ্টই বোধগম্য নয়। তবে ভাষ্যকার যে কথার জাল বুনে নিজেই একটি বিব্রতকর ও অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা বুঝতে সম্ভবত তেমন অসুবিধে হয় না। ফাদার রোজেট তাঁর গ্রন্থে এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেখানে তাঁর নিজের এ সংকট আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি আবার একবার নয়, দুবার স্বর্গারোহণের কথা বলেছেন- যিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে উত্থান ও স্বর্গারোহণ একই ঘটনার দুটি অংশ বটে, কিন্তু শিষ্যদের দৃষ্টিতে তাঁর দেখা হওয়ার ঘটনার পরিসমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বর্গারোহণের ঘটনা ঘটেনি। চার্চের আমল যাতে শুরু হতে পারে, সেজন্য শিষ্যদের অনুপ্রানিত করার পরই তিনি তাদের সঙ্গে দেখা দেয়ার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে স্বর্গারোহণ করেন।
যে সকল পাঠক এ সুগভীর যুক্তির (যার কোন কিতাবি বুনিয়াদ নেই) অর্থ বা তাৎপর্য অনুধাবন করতে অক্ষম, তাদের হুশিয়ার করে দিয়ে ফাদার রোজেট বলেছেন-”অন্যান্য বহু ঘটনার মত এ ক্ষেত্রেও ধর্মীয় তাৎপর্য উপেক্ষা করে বাইবেলের বর্ণনা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হলে সমস্যাটি সমাধানের অযোগ্য বলেই মনে হবে। কোন বাস্তব ঘটনাকে সামঞ্জস্যহীন প্রতীকে প্রকাশ করার ব্যাপারে এখানে নেই। এখানে যা আছে তা হচ্ছে এই যে, আমরা আমাদের পার্থিব জীবনের অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যা বুঝতে সক্ষম, ঠিক সেই ধরনের বিষয় ও বস্তুর মারফত ধর্মীয় লেখকগণ রহস্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং তাদের এ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের প্রতি সর্বদা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
আসলে ব্যাখ্যার অযোগ্য বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকারগণ এ ধরনের অর্থহীন বাক্যজাল বিস্তার করে থাকেন। অবশ্য সমর্থনের অযোগ্য কিছু সমর্থন করতে গেলে এছাড়া আর কোন উপায়ও থাকে না।
যিশুর শেষ কথোপকথন ও জনের গসপেলের প্যারাক্লিট
একমাত্র জনই শিষ্যদের সংগে যিশুর শেষ কথোপকথনের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। শেষ ভোজের পর এবং যিশুর গ্রেফতার হওয়ার আগে এ ঘটনা ঘতে। ঘটনা শেষ হয়েছে যিশুর একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে। জনের গসপেলের চারটি অধ্যায় (১৪-১৭) ব্যাপী এ ঘটনা ও বক্তৃতার বিবরণ আছে। অপর কোন গসপেলে অবশ্য এ বিষয়ে কোন উল্লেখমাত্রও নেই। ঐ চারটি অধ্যায়ে যে সকল বিষয় বর্ণিত হয়েছে, খৃষ্টানদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত। শাগরেদদের কাছ থেকে একজন মহাসম্মানিত ওস্তাদের বিদায় গ্রহণের উপযোগী ভাবগম্ভীর ও পবিত্রতার পরিবেশে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
অথচ যিশুর আধ্যাত্মিকতাঁর প্রমাণ সম্বলিত এ মর্মস্পর্শী বিদায় দৃশ্যটির মথি মার্ক ও লুকের গ্রন্থে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ অনুপস্থিতির সম্ভাব্য ব্যাখ্যা কি হতে পারে? প্রশ্ন করা যেতে পারে-আদিতে ঐ প্রথম তিনখানি গসপেলে কি ওই এবারত ছিল? পরে কি তা গায়েব করা হয়েছে?কেন? এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। জবাব কোথাও খুজে পাওয়া যায় না। বিষয়টি সত্যিই রহস্যাবৃত এবং দূর্জ্ঞেয়।
এ ঘটনার প্রধান প্রধান বিষয়, যা যিশুর বক্তৃতায় আছে, তা হচ্ছে যিশু বর্ণিত মানুষের ভবিষ্যত অবস্থা, শিষ্যদের সমাবেশে তাঁর বক্তৃতা করার সবিশেষ আগ্রহ, তাদের মারফত সমগ্র মানব জাতির সামনে সত্য উপস্থাপিত করা এবং তাদের দুনিয়া ত্যাগের পর মানুষকে অতি অবশ্যই যে পথ প্রদর্শকের অনুসরণ করতে হবে, তার পরিচয় তুলে ধরা এবং এ ব্যাপারে তাঁর নিজের নির্দেশ ও সুপারিশ পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয়া। জনের গসপেলে ঐ পথ প্রদর্শককে গ্রীক ভাষায়”প্যারাক্লিটোস” বলা হয়েছে; ইংরেজী ভাষায় বলা হয়ে থাকে”প্যারাক্লিট”। ঐ গসপেলের সংশ্লিষ্ট মূল অনুচ্ছেদগুলি হচ্ছে নিম্নরূপঃ
“তোমরা যদি আমাকে প্রেম কর, তবে আমার আজ্ঞা সকল পালন করিবে। আর আমি পিতার নিকটে নিবেদন করিব এবং তিনি আর একজন সহায়ক (প্যারাক্লিট) তোমাদিগকে দিবেন।” (১৪, ১৫-১৬) কিন্তু প্যারাক্লিট শব্দের অর্থ কি? জনের গসপেলের যে এবারত বর্তমানে প্রচলিত আছে তাতে শব্দটির ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ
“কিন্তু সেই সহায়ক, পবিত্র আত্মা যাহাকে পিতা আমার নামে পাঠাইয়া দিবেন তিনি সকল বিষয়ে তোমাদিগকে শিক্ষা দিবেন, এবং আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছি সেই সকল স্মরণ করাইয়া দিবেন।” (১৪-২৬)
“তিনি আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন।” (১৫-২৬)
“সত্যের আত্মা যখন আসিবেন, তখন পথ দেখাইয়া তোমাদিগকে সমস্ত সত্যে লইয়া যাইবেন; কারণ তিন আপনা হিতে কিছু বলিবেন না; বরং যাহা যাহাঁ শুনিবেন তাহাই বলিবেন, এবং আগামী ঘটনাও তিনি তোমাদিগকে জানাইবেন। তিনি আমাকে মহিমান্বিত করিবেন।” (১৬, ১৩-১৪)
জনের চারটি অধ্যায় (১৪-১৭) এখানে পুরোপুরি উধৃত করা হয়নি। তবে যেটুকু উধৃত করা হয়েছে তাতে মূল বক্তব্য সঠিকভাবেই ব্যক্ত হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, ইবারতে ‘প্যারাক্লিট’ ‘পবিত্র আত্মা’ একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি সহজে চোখে পড়ার মত নয়। বিশেষত এ কারণে যে, ইবারতের উপশিরোনামগুলিই সাধারণত তরজমায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং ভাষ্যকাররা তাদের রচনায় প্রাচীন ভাবধারাটিই তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকেন। তবুও যদি অর্থ উপলব্ধি করতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগে তাহলে তিনি অপরাপর বিশেষজ্ঞের যে কোন ব্যাখ্যা পড়ে নিতে পারেন। এ ট্রাইকট তাঁর”লিটল ডিকহনারি অব দি নিউ টেস্টামেন্ট” গ্রন্থে প্যারাক্লিট শব্দটির ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেনঃ
“এ শব্দটি গ্রীক ভাষা থেকে তরজমা করা এবং একমাত্র জনই নিউ টেস্টামেন্টে এ নাম বা উপাধিটি ব্যবহার করেছেন। শেষ ভোজের পর দেয়া যসিহুর বক্তৃতার যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন, সেখানে তিনি চারবার এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (১৪, ১৬ ও ২৬; ১৫, ২৬ এবং ১৬, ৭) । ‘আর একবার ব্যবহার করেছেন তাঁর প্রথম পত্রে (২, ১) । ‘গসপেলে শব্দটি পবিত্র আত্মার প্রতি এবং পত্রে যিশুর প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছে। প্যারাক্লিট শব্দটি খৃষ্টের জন্মের পরবর্তী প্রথম শতাব্দীতে গ্রীক ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। অর্থ উকিল, পক্ষ সমর্থনকারী, সুপারিশকারী, মধ্যস্থকারী। যিশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, পিতা ও পুত্র আত্মা পাঠিয়ে দেবেন। পুত্র তাঁর মর-জীবনে তাঁর শিষ্যদের উপকারে যে শয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন, ঐ আত্মা স্থলাভিষিক্ত হয়ে সেই ভূমিকা পালন করবেন। তিনি যিশুর বিকল্প হয়ে প্যারাক্লিট বা শক্তিমান মধ্যস্থকারী হিসেবে মধ্যস্থতা করবেন।”
এ ভাষ্যকারের মতে তাহলে দেখা যাচ্ছে, যিশুর দুনিয়া ত্যাগের পর এ পবিত্র আত্মাই মানুষের শেষ পথ প্রদর্শক হবেন। এ অভিমত কি জনের ইবারতের সঙ্গে মিলে যায়? এপ্রশ্ন উত্থাপন করার প্রয়োজন আছে, কেননা কারণ থেকে ফলাফল আসে। এ যুক্তির ভিত্তিতে বিচার করা হলে দেখা যায় যে, নিচের কথাগুলি পবিত্র আত্মার প্রসঙ্গে ঠিক মানায়না -”তিনি আপনা হইতে কিছু বলিবেন না, বরং যাহা যাহা শুনিবেন তাহাই বলিবেন এবং আগামী ঘটনাও তিনি তোমাদিগকে জানাইবেন।” পবিত্র আত্মার কথা বলা এবং শুনতে পারারা ক্ষমতা থাকার ব্যাপারটি অকল্পনীয়। যুক্তি ও সংহতির স্বার্থে এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হওয়া উচিত, কিন্তু আমার জানা মতে কোন ভাষ্যকারই এ প্রশ্নটি উত্থাপন বা বিবেচনা করেননি।
এ বিষয়ে সঠিক ধারনা লাভের জন্য মূল গ্রীক ইবারতটি দেখে নেয়া প্রয়োজন। কারণ সকলেই স্বীকার করে থাকেন যে, জন অন্য কোন ভাষাতে নয়, গ্রীক ভাষাতেই লিখেছিলেন। আমি ‘নোভাম টেস্টামেন্টাম গ্রায়েস ‘ (নসল এন্ড এন্ডাল, ইউনাইটেড বাইবেলস সোসাইটি, লন্ডন, ১৯৭১) নামক গ্রীক ভাষার বাইবেলকাহ্নি পড়ে দেখেছি।
ইবারতের সমালোচনা করতে গেলে প্রথমেই বিভিন্নতা খুজে দেখতে হয়। জনের গসপেলের যতগুলি পান্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে একমাত্র সুরিয়ানি ভাষায় লিখিত বিখ্যাত পালিম্পসেস্ট সংস্করণের ১৪, ২৬ অনুচ্ছেদে এমন একটি বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়, যার ফলে বাক্যের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। (এ পান্ডুলিপিটির চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীতে লিখিত হয় এবং ১৮১২ সালে এগনেস এস লুইস কর্তৃক সিনাই পাহাড়ে আবিষ্কৃত হয়। প্রথম এবারতের উপরে অপর একটি ইবারত লেখা ছিল, এবং এ দ্বিতীয় ইবারতটি উঠিয়ে ফেলার পর মূলের সন্ধান পাওয়া যায়। এ কারণে পান্ডুলিপিটির নাম পালিম্পসেস্ট রাখা হয় ) । ‘এখানে ‘পবিত্র আত্মা’ বলা হয়নি, সেরেফ আত্মা বলা হয়েছে। নকলনবিশ কি ভুলক্রমে ‘পবিত্র’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন, নাকি পবিত্র আত্মার কথা বলা ও শুনতে পাবার ক্ষমতা থাকার হাস্যকরতা লক্ষ্য করে ইচ্ছাকৃতভাবেই পবিত্র শব্দটি লেখেননি? এছাড়া এ পান্ডুলিপিতে আরও কিছু বিভিন্নতা আছে কিন্তু সেগুলি মূলত ব্যাকরণগত এবং অর্থের কোন হেরফের ঘটায়না; ফলে তা নিয়ে আর আলোচনার কোন দরকার নেই। এক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে এই যে, ‘কথা বলা’ ও ‘শুনতে পাওয়া’ ক্রিয়াপদের যে অর্থ এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে, জনের গসপেলের অন্যান্য সকল পান্ডুলিপিতেও ঠিক সেই অর্থই প্রয়োগ করা হয়েছে।
‘শুনতে পাওয়া’ ক্রিয়াপদটি গ্রীক ভাষার”আকৌও” ক্রিয়াপদের তরজমা, অর্থ ‘শব্দ অনুধাবন করা’ এ শব্দ থেকেই ‘একৌস্টিকস’ (ধ্বনিবিজ্ঞান) শব্দটি এসেছে।
‘কথা বলা’ ক্রিয়াপদটি গ্রীক ভাষার ‘লালেও’ ক্রিয়াপদের তরজমা; সাধারণ অর্থ শব্দ বের করা, বিশেষ অর্থ কথা বলা। গসপেলের গ্রীক ইবারতে এ শব্দটি ঘনঘন ব্যবহার করা হয়েছে এবং ধর্ম প্রচারের সময় যিশু যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেছেন, তখনই এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পবিত্র আত্মা কর্তৃক অনুপ্রানিত হয়ে কথা বলার সময় ঐ বিশেষ শব্দটির প্রয়োগ হয় না, বরং সাধারণভাবে মানুষের স্বাভাবিক কথা বলার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ হয়। গ্রীক ভাষায় নিতান্ত নৈমিত্তিক অর্থেই শব্দ নির্গত হবার ক্ষেত্রে ঐ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
সুতরাং যে সকল প্রাণীর কথা বলার ও শুনতে উপযোগী ইন্দ্রিয় আছে, কেবলমাত্র তাদের ক্ষেত্রে ‘আকৌও’ ও ‘লালেও’ ক্রিয়াপদ দুটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। পবিত্র আত্মার ক্ষেত্রে আদৌ প্র্যোগ করা যেতে পারে না।
এ কারণে জনের গসপেলের গ্রীক ভাষার পান্ডুলিপির যে অনুচ্ছেদে ১৪, ২৬) পবিত্র আত্মা শব্দ দুটি রয়েছে, তা আদৌ বোধগম্য নয়-”কিন্তু সেই সহায়ক, পবিত্র আত্মার ক্ষেত্রে আদৌ প্রয়োগ করা যেতে পারে না।
পবিত্র আত্মা শব্দ দুটি বাদ দিলে সমগ্র ইবারতের অর্থ পরিষ্কার ও বোধগম্য হয়ে ওঠে। জন অবশ্য তাঁর প্রথম পত্রে এভাবে বোধগম্য কথাই বলেছেন। যেখানে তিনি প্যারাক্লিট বলতে যিশুকে বুঝিয়েছেন এবং এ প্যারাক্লিট হচ্ছেন ইশ্বরের পক্ষের মধ্যস্থতাকারী (গসপেলের বহু তরজমা ও ভাষ্যে, বিশেষত প্রাচীন তরজমা ও ভাষ্যে প্যারাক্লিট শব্দটি ‘সান্তনা দানকারী’ বলে তরজমা করা হয়েছে; কিন্তু এ তরজমা সম্পূর্ণ ভুল) । ‘জনের মতে, যিশু বলে (১৪, ১৬) -”আর আমি পিতার নিকট নিবেদন করব এবং তিনি আর একজন প্যারাক্লিট তোমাদের দিবেন,” অর্থাৎ তিনি বলছেন য, এ দুনিয়ার জীবনে তিনি নিজে যেমন মানুষের জন্য ইশ্বরের পক্ষের মধ্যস্থতাকারী ছিলেন, ঠিক সেইরূপ”আর একজন” মধ্যস্থতাকারী পাঠিয়ে দেয়া হবে।
সুতরাং যুক্তি ও সঙ্গতির আলোকে বিচার করলে দেখা যায় যে, জন বর্ণিত প্যারাক্লিট যিশুর মতই একজন মানুষ, এবং তাঁর কথা বলা ও শুনতে পাবার ক্ষমতা আছে। সুতরাং যিশু যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা হচ্ছে এই যে, ইশ্বর পরে আর একজন মানুষকে দুনিয়ায় পাঠাবেন; এবং তিনি জন বর্ণিত ভূমিকা পালন করবেন, অর্ত্থাৎ নবী হিসেবে ব্যবহৃত শব্দগুলির যথাযথ অর্থ গ্রহণ করা হলে এ হচ্ছে তাঁর এবারতের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা।
বর্তমানকালের এবারতে যে ‘পবিত্র আত্মা’ শব্দ দুটি দেখতে পাওয়া যায়, তা সম্ভবত পরে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই যোগ করা হয়েছে। মূল অর্থে যে যিশুর আর একজন নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, তখন বদল করার মতলবেই এ ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়। কারণ খৃষ্টীয় চার্চ যখন গঠিত হয়, তখন তাঁর অন্যতম শিক্ষা ছিল এই যে, যিশু হচ্ছেন সর্বশেষ নবী, এবং তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না।
উপসংহার
চারখানি গসপেল ঐতিহাসিকভাবে নির্ভুল, আদি ও অকৃত্রিম, এবং যিশু যা করেছিলেন এবং যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা ঐ গসপেলের মারফত বিশ্বস্তভাবে বাহিত হয়ে এসেছে। খৃষ্টানদের এ প্রাচীনপন্থী মতবাদ ভ্যাটিক্যানের সাম্প্রতিকতম কাউন্সিলেও সমর্থিত হয়েছে। অথচ এ গ্রন্থে যে সকল তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং বিশিষ্ট খৃষ্টান ধর্মবিদদের যে সকল অভিমত উধৃত করা হয়েছে, তাতে নির্ভুলতা ও অকৃত্রিমতার ঐ দাবী সরাসরি বাতিল হয়ে যায়।
এ বিষয়ে কয়েক প্রকারের যুক্তি দেখানো যেতে পারে।
একই বিষয়ে একাধিক গসপেলের বিবরণ পরষ্পর বিরোধী এবং পরষ্পর বিরোধী দুটি ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া আধুনিক জ্ঞান থেকে পাওয়া বাস্তব তথ্যের বিরোধী কোন দাবী বা অসম্ভাব্যতা ও অসমতা বহু খৃষ্টানেরই নজরে পড়ে না। ঘটনাক্রমে কখনও পড়লে তারা বিস্মিত হন; কারণ, পাদ্রী ও ভাষ্যকারদের কাল্পনিক রহস্যময় ও কাব্যিক ব্যাখ্যা পড়ে তাদের মন-মগজ আগে থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকে। কোন কোন বিষয় ‘অসুবিধাজনক’ বলে অভিহিত করে ভাষ্যকারগণ তা ব্যাখ্যা করার জন্য যে অনাবশ্যক বাক্যজাল বিস্তার করে থাকেন, তাঁর কয়েকটি উদাহরন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া গসপেলে এমন কিছু অনুচ্ছেদ আছে, যা জাল বলে স্বীকার করা হয়ে থাকে; কিন্তু চার্চ সেগুলি সহীহ বলে ঘোষণা করে থাকে।
ফাদার কানেনগিসারের মতে, এবারতের আধুনিক সমালোচনার ফলে এমন সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যা ‘বাইবেলের ধর্মীয় বর্ণনা পদ্ধতির জন্য বিপ্লবাত্মক’, এবং তাঁর ফলে গসপেলে লিখিত যিশু সম্পর্কিত তথ্য ও ঘটনাবলী এখন আর আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করার প্রয়োজন নেই’, কারণ ঐ সকল বিবরণ বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ সামনে রেখে রচিত হয়েছে, অন্য কথায়, ঐগুলি ‘যুদ্ধকালীন রচনা’। আধুনিক অনুসন্ধানের ফলে ইহুদী-খৃষ্টবাদের ইতিহাস এবং বিভিন্ন সম্প্রয়ায়ের মধ্যকার বিদ্বেষ ও বৈরিতার কথা বিস্তারিতভাবে জানাগেছে। সেই পটভূমিকায় রচিত বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ তাই আধুনিক পাঠকের কাছে রীতিমত বিব্রতকর। যদিও বহু খৃষ্টান এখনও মনে করেন যে, গসপেল লেখক ইভানজেলিস্টগণ তাদের বর্ণিত ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন, তথাপি ঐ ধারণা এখন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে প্রমানিত হয়েছে। জেরুসালেমের বাইবেল স্কুলে যে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে (ফাদার বেনয় ও ফাদার বয়েসমার্ড), তাতে সুস্পষ্টরূপে প্রমানিত হয়েছে যে, গসপেলগুলি কয়েকবার লিখিত ; পরিমার্জিত ও সংশোধিত হয়েছে। তাছাড়া, ফাদারদ্বয় পাঠকদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে, গসপেলে তারা যেন”যিশুর কোন উক্তি সঠি বা সরাসরি ভাবে পাবার আশা না করেন।”
তবে গসপেলগুলির যে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যিশু সম্পর্কিত বর্ণনার মারফত আমরা এ গ্রন্থগুলি থেকে লেখকদের পরিচয় ও চরিত্র জানতে পারি, তারা যে নিজ নিজ আদি খৃষ্টান সম্প্রদায়ের প্রবাদ ও কিংবদন্তির মুখপাত্র ছিলেন, সেকথা জানতে পারি, এবং বিশেষত পলের সঙ্গে ইহুদী-খৃষ্ট সম্প্রদায়ের বিবাদ ও বিরোধের কথা জানতে পারি। কার্ডিনাল ডানিয়েলোর গ্রন্থ এ সকল বিষয়ে একখানি নির্ভরযোগ্য কোষগ্রস্থ।
কোন কোন ইভানজেলিস্ট যে তাঁর নিজস্ব মতবাদের সমর্থনে যিশুর জীবনের কোন কোন ঘটনা বিকৃত করেছেন, তাতে বিস্মিত হবার কি আছে? কোন কোন ঘটনা যে তারা বাদ দিয়েছেন, তাতে বা বিস্মিত হবার কি আছে? আর বর্ণিত কোন কোন ঘটনা যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক তাতেই বা বিস্ময়ের কি আছে?
এ সকল প্রশ্ন থেকে গসপেলের সঙ্গে মধ্যযুগীয় বর্ণনামূলক কবিতার তুলনা করার জন্য আমাদের মনে একটি স্বাভাবিক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। ‘সং অব রোলান্ড’ (চ্যানসন দ্য রোলান্ড) নামক কবিতার সঙ্গে তুলনাটি বোধহয় সবচেয়ে নিখুত হতে পারে। এ কবিতার একটি সত্য ঘটনা কল্পনার আলোকে বর্ণিত হয়েছে এবং এ জাতীয় কবিতার মধ্যে এ কবিতাটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, রোলান্ড রাজা শার্লিমেনের পশ্চাদরক্ষী বাহিনী পরিচালনার সময় আকস্মিকভাবে রণক্ষেত্রে গিরিপথে শত্রুপক্ষের হাতে আক্রান্ত হন। ঐতিহাসিক মতে ঘটনাটি ৭৭৮ সালের ১৫ই আগস্ট ঘটেছিল (এগিনহার্ড) এবং তেমন কোন গুরত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলনা। কিন্তু কাব্যের বর্ণনায় এ সামান্য ঘতনাটিকে ধর্মযুদ্ধের একটি গৌরবময় অধ্যায় এবং রণকৌশলের শ্রেষ্ঠতম নিপূণতার মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে। কবিতায় কল্পনার ব্যাপক বিস্তার আছে বটে, কিন্তু সেই কারণে সত্য ঘটনাটি মিথ্যা হয়ে যায়নি। কারণ, একথা সত্য যে, শত্রুদের হামলা থেকে নিজের দেশকে রক্ষার জন্য শার্লিমেনকে বহু যুদ্ধবিগ্রহ করতে হয়েছিল এবং রোলান্ড সম্পর্কিত ঐ ঘটনাটি ছিল তাঁরই একটি অংশ।
গসপেল সম্পর্কেও ঐ একই কথা বলা যেতে পারে। মথির কল্পনাপ্রবণতা, বিভিন্ন গসপেলের পষ্পর বিরোধিতা, অসম্ভাব্যতা, আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে গরমিল হওয়া, বারবার এবারত বিকৃত হওয়া প্রভৃতি এ কথাই প্রমাণ করে যে, বাইবেলে এমন অনেক অনুচ্ছেদ ও অধ্যায় আছে, যার একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে মানুষের কল্পনা। কিন্তু তাই বলে যিশুর মিশন তাতে মিথ্যা হয়ে যায় নি। যিশুর মিশিনের ব্যাপারে আদৌ কোন সন্দেহ নেই। সন্দেহ আছে তাঁর প্রকারে ও প্রক্রিয়ায়।