আকাশমন্ডলীর ক্রমবিকাশ
বিশ্বজগত সৃষ্টির আধুনিক ধারণার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক কুয়াশা থেকে ক্রমে ক্রমে জ্যোতিষ্কমন্ডলী, তারকা, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ- উপগ্রহের সৃষ্টি হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে সৌরজগতে এবং সাধারণভাবে সমগ্র বিশ্বজগতে এ বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ এখনও চলছে।
যারা এ ধারনার সঙ্গে পরিচিত তারা কুরআনের কয়েকটি আয়াতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে আগ্রহী হতে পারেন। এ সকল আয়াতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বহিপ্রকাশের উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআন আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে-” (আল্লাহ) সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করেছেন; প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করে”
এ বাক্যটি সূরা রাদের ২ আয়াতে, সূরা লুকমানের ২৯ আয়াত, সূরা ফাতিরের ১৩ আয়াত এবং সূরা যুমারের ৫ আয়াতে আছে।
এছাড়া সূরা লুকমানের ৩৮ আয়াতে একটি গন্তব্য স্থানের ধারণার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট স্থানের ধারণা সংযুক্ত আছে-”সূর্য আবর্তন করে তাঁর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে। ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট।”
‘নির্দিষ্ট গন্ডি’ আরবী ‘মুসতাকার’ শব্দের বাংলা তরজমা। এ শব্দের সঙ্গে যে একটি সুনির্দিষ্ট স্থানের ধারণা সংযুক্ত আছে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। এখন আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে এ সকল বিবরণের তুলনা করলে কি দেখতে পাওয়া যায়?
কুরআনে সূর্যের আবর্তনের একটি সীমানা এবং গন্তব্যস্থলেরও উল্লেখ আছে। চাঁদের একটি নির্দিষ্ট গন্ডির কথা বলা আছে। এবিবরণের অর্থ উপলব্ধি করতে হলে সাধারণভাবে তারকামন্ডলী এবং বিশেষত সূর্যের আবর্তন সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা অবহিত হওয়া প্রয়োজন। তদুপরি চাঁদ সহ যে সকল জ্যোতিষ্ক সূর্যের গতি অনুসরণ করে থাকে তাদের আবর্তন্ পথ সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন।
জ্যোতির্পদার্থবিদদের মতে সূর্যের বয়স ৪৫ হাজার কোটি বছর। অন্যান্য তারকার ন্যায় সূর্যের ক্রমবিকাশেরও একটি পর্যায় বনির্ণয় করা সম্ভব। বর্তমানে সূর্য প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। হাইড্রোজেন অণুর হেলিয়াম অণুতে পরিবর্তিত হওয়া এ পর্যায়ের বৈশিষ্ট। এ পর্যায়টি আরও ৫৫ হাজার কোটি বছর যাবত বহাল থাকবে। কারণ, এ জাতীয় তারকার মেয়াদ মোট ১০০ হাজার কোটি বছর বলে ধরা হয়ে থাকে। এ জাতীয় অন্যান্য তারকার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, প্রথম পর্যায়ের পর একটি দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। তখন হাইড্রোজেনের হেলিয়ামে রূপান্তরিত হওয়া শেষ হয়ে যায়, তারকার বাইরের আবরণ সম্প্রসারিত হয়ে যায় এবং সূর্যের তাপের পরিমাণ কমে আসে। শেষ পর্যায়ে আলো যথেষ্ট কমে যায় এবং তাঁর ঘনত্ব অনেক বেড়ে যায়। এ অবস্থা ‘হোয়াইট ডুয়ার্ফ’ জাতীয় তারকার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়।
উপরে যে বছরের আনুমানিক হিসাব দেয়া হয়েছে তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে সময়ের মেয়াদ সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া, কিন্তু আসলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ক্রমবিকাশের ব্যাপারটির উপর আলোকপাত করা। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এখন অনুমান করা সম্ভব যে ৩০ থেকে ৫০ হাজার কোটি বছর পরে পরে সৌরজগতে বর্তমানে যে অবস্থা তা আর থাকবে না। অন্যান্য যে সকল তারকার ক্ষেত্রে শেষ পর্যায় পর্যন্ত তাদের বিকীরণ প্রক্রিয়া ও ক্রমবিকাশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, ঠিক তাদের পরিণামের মতই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব যে, সূর্যও একদিন শেষ হয়ে যাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, সূরা লুকমানের ৩৮ আয়াতে সূর্যের একটি নিজস্ব গন্তব্য স্থানের দিকে অতিক্রম করার কথা আছে।
আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় ঐ স্থানটি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এবং তাঁর সৌরশীর্ষ (সোলার এপেক্স) নামও দেয়া হয়েছে। সৌরমন্ডল প্রকৃতই মহাশূন্যে ক্রমবিকশিত হয়ে হারকিউলেস তারকারাজির এমন একটি বিশেষ স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যার অবস্থান এখন সঠিকভাবে নির্ণয় হয়ে গেছে এবং তাঁর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১২ মাইল বলে নির্নয় করা হয়েছে।
উপরে উধৃত কুরআনের আয়াতের প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এ তথ্যগুলির উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ, দেখা যাচ্ছে যে কুরআনের বর্ণনার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে।
বিশ্বজগতের সম্প্রসারণ
আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধিক বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে এই যে, বিশ্বজগত ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ ধারণা এখন প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত, তবে কিভাবে হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু মতভেদ আছে।
প্রথমে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ব থেকে এ ধারণার জন্ম হয় এবং পরে পদার্থবিদ্যার তারকারাজির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁর সমর্থন পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি তারকামন্ডলী ক্রমে ক্রমে নিজ কেন্দ্রের দিকে সরে যায় বলে অপর তারকামন্ডলী থেকে তাঁর দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। বিশ্বজগতের আকারও সেই অনুপাতে বেড়ে যাবে। এ সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষ্কমন্ডলী যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে তা আলোর গতির চেয়ে বেশী দ্রুত।
এ আধুনিক ধারণার সঙ্গে সূরা জারিয়াতের ৪৭ আয়াতের তুলনা করা যেতে পারে। আল্লাহ বলেছেনঃ”আমি আকাশ নির্মাণ করিয়াছি আমার ক্ষমতা বলে এবং অবশ্যই আমি উহা প্রসারিত করিতেছি।”
‘আকাশ’ আরবী ‘সামা’ শব্দের তরজমা এবং এ শব্দে পৃথিবীর উর্ধলোকে অবস্থিত জগত বুঝানো হয়েছে। আরবী ক্রিয়াপদ ‘আওসা’র বহুবচনের বর্তমান কালের রূপ ‘মুসিউনা’। আওসা শব্দের অর্থ বিস্তৃত করা, প্রসারিত করা, সম্প্রসারণ করা, ব্যাপক করা, বৃহৎ করা। মুসিউনার অর্থ ‘আমরা উহা প্রসারিত করিতেছি।’
কোন কোন অনুবাদক এ তাৎপর্য উপলব্ধি করতে না পারায় এমন অনুবাদ করেছেন যা আমার কাছে ভুল মনে হয়েছে; যেমন ফরাসী তরজমায় আর, ব্লাশিয়ার বলেছেন-”আমরা উদারভাবে দান করি” কোন কোন অনুবাদক আবার অর্থটি উপলব্ধি করা সত্বেও সাহস করে প্রকাশ করতে পারেননি। হামিদুল্লাহ আকাশ ও মহাশূন্য সম্প্রসারণের কথা বলেছেন বটে তবে একটি জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্নও বসিয়ে দিয়েছেন। অনেক অনুবাদক অবশ্য সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য অবহিত হওয়ার পর তাদের ভাষ্যে এখানে প্রদত্ত অর্থই প্রয়োগ করেছেন। কায়রোর সুপ্রিম কাউন্সিল ফর ইসলামিক এফেয়ার্স সম্পাদিত ‘মুনতাখাব’ নামক ভাষ্যগ্রন্থে এ অর্থই দেয়া হয়েছে। সেখানে সুস্পষ্ট ভাষায় বিশ্বজগতের সম্প্রসারিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
মহাশূন্য বিজয়
এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে কুরআনের তিনটি আয়াতের প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। একটি আয়তের সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে মানুষ এক্ষেত্রে কি সাফল্য অর্জন করতে পারে এবং পারবে। অপর দুটি আয়াতে মক্কার অবিশ্বাসীদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা যদি আকাশে উঠতে পারত তাহলে সেখানকার দৃশ্যভাবে দেখে বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে পড়ত। এখানে এমন একটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যা ঐ অবিশ্বাসীদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না।
প্রথমত আয়াতটি হচ্ছে সূরা রহমানের ৩৩ আয়াত -”হে জিন ও মনুষ্য সম্প্রদায়। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করিতে পার অতিক্রম করিও, কিন্তু তোমরা তাহা পারিবে না শক্তি ব্যতিরেকে।”
এ তরজমার কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রথমত”যদি” শব্দতি দ্বারা প্রস্তাবনার সফলতা কোন সম্ভব বা অসম্ভব অবস্থার উপর নির্ভর করে বুঝায়। কিন্তু আরবী ভাষায় ওই অবস্থার ক্ষেত্রে এমন একটি ব্যঞ্জণা আনা সম্ভব যা অনেক বেশী সুস্পষ্ট। সম্ভাব্যতা প্রকাশের জন্য ‘ইযা’, সম্পাদন যোগ্য কাজের ‘ইন’ এবং সম্পাদনের অযোগ্য কাজের জন্য ‘লাও’ শব্দ প্রয়োগ করা যেতে পারে। আলোচ্য আয়াতে ‘ইন’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় কাজটি সম্পাদনাযোগ্য বলে বুঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের পক্ষে আকাশ ও পৃথিবীর সীমানা অতিক্রম করা প্রকৃতপক্ষেই সম্ভব। কোন কোন ভাষ্যকার যে নিছক দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, শব্দ প্রয়োগের ঐ বৈশিষ্ট থেকেই তা ভুল প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত আল্লাহ জিন ও মানুষকে সম্বোধন করেছেন, কোন কাল্পনিক প্রাণীকে নয়। তৃতীয়ত ক্রিয়াপদ ‘নাফাজা’ ও তাঁর পরে সম্বন্ধযুক্ত পদ ‘মিন’ এবং তাঁর তরজমা করা হয়েছে ‘অতিক্রম করা’। কাজী মিরস্কির অভিধান অনুসারে পদটির অর্থ হচ্ছে ‘কোন বস্তুর ভিতরে প্রবেশ করে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা’ (যেমন তীর কোন বস্তুর একদিক দিয়ে ঢুকে অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়) । সুতরাং গভীর অনুপ্রবেশ এবং অনুপ্রবিষ্ট এলাকার বাইরে যাওয়া বুঝা যাচ্ছে।
চতুর্থত মানুষের ঐ কাজের জন্য যে শক্তির (সুলতান) প্রওজন হবে তা সর্বশক্তিমানের কাছ থেকেই আসবে বলে মনে হয়। কারণ ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহর রহমত উপলব্ধি করার আহবান জানানো হয়েছে।
সুতরাং মানুষ যে একদিন মহাশূন্য জয় করবে এ আয়াতে তাঁর সুস্পষ্ট আভাস রয়েছে। লক্ষণীয় যে, আয়াতে শুধু আকাশ জয় নয়, পৃথিবী অতিক্রম অর্থাৎ পাতাল জয়ের আভাস আছে।
অপর দুটি আয়াত হচ্ছে সূরা হিজরের ১৪ ও ১৫ আয়াত। প্রসঙ্গ থেকে বুঝা যায় আল্লাহ এখানে মক্কার অবিশ্বাসীদের কথা বলেছেন-”যদি উহাদিগের জন্য আকাশের দুয়ার খুলিয়া দিই এবং উহারা দিনের বেলা উহাতে আরোহণ করে, তবুও উহারা বলিবে, ‘আমাদিগের দৃষ্টি মোহাভিষ্ট হইয়াছে; নতুবা আমরা এক যাদুগ্রস্থ সম্প্রদায়।”
ঐ কথায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যদেখে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। এমন দৃশ্য মানুষ যা কখনও কল্পনাও করেনি।
লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, বাক্যটি ‘যদি’ আরবী’লাও’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। অর্থাৎ বাক্যের প্রস্তাবণা এমন শর্তের অধীন করা হয়েছে যা পূরণ করা আয়াতে উল্লেখিত লোকদের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।
মহাশূন্য বিজয় সম্পর্কিত আয়াতে আমরা দেখেছি, আল্লাহর দেয়া বুদ্ধিমত্তা ও আবিষ্কার ক্ষমতার বলে মানুষ একদিন মহাশূন্য জয় করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ আয়াতে এমন একটি দৃশ্যের কথা বলা হয়েছেযা মক্কার অবিশ্বাসী লোকেরা কখনই দেখতে পাবে না। কিন্তু এ দৃশ্য অন্যদের পক্ষে দেখা সম্ভব এবং দেখার পর তাদের (নভোচারী মানুষ) মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হবে এ আয়াতে তাঁর বর্ণনা আছে- তাদের দৃষ্টি বিভ্রান্ত হবে, মাতাল অবস্থায় যেমন হয়, যাদুগ্রস্থ অবস্থায় যেমন হয়।
১৯৬১ সালে প্রথমবার নভোযানে মহাশূন্যে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসার পর থেকে নভোচারীগণ এ যাবত ঠিক ঐ অভিজ্ঞতাই লাভ করেছেন এবং অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা ঠিক ওই কথাই বলেছেন। একথা এখন সর্বজনবিদিত যে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপর থেকে দেখলে আকাশ আর নীল রঙের দেখা যায় না। কারণ, বায়ুমন্ডল সূর্যের আলো শুষে নেয়ার কারণে তাঁর নীচে থেকে দেখলে আকাশের রং নীল দেখা যায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পরে উঠে মানুষ আকাশকে কালো দেখতে পায় এবং বায়ুমন্ডল সূর্যের আলো শুষে নেয়ার ঐ একই কারণে নীল রঙের আবৃত্ত অবস্থায় দেখতে পায়। চাঁদের কোন বায়ূমন্ডল না থাকায় ঐ অবস্থায় কালো আকাশের সম্পূর্ণ অভিনব, অভুতপূর্ব, এবং ঐ দৃশ্যের ছবি এখন বর্তমান কালের মানুষের কাছে খুবই পরিচিত।
এক্ষেত্রেও আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে কুরআনের বর্ণনা মিলিয়ে দেখলে বিস্ময়ে অভিভূত ও হতবাক হয়ে যেতে হয়। কুরানের ঐ বর্ণনা সুতরাং কোন মতেই চৌদ্দশো বছর আগের একজন বর্ণনা হতে পারে না।
পৃথিবী
এ গ্রন্থে এ পর্যন্ত আলোচিত অন্যান্য বিষয়ের মত পৃথিবী সম্পর্কিত আয়াতগুলিও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। এ সকল আয়াতকে শ্রেণীবদ্ধ করা দুরূহ এবং আমি এখানে যেভাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছি তা একান্তভাবেই আমার নিজস্ব পদ্ধতি।
সঠিকভাবে অর্থ উপলব্ধির করার জন্য প্রথমে এমন সব আয়াত বেছে নেয়া যেতে পারে যেগুলিতে একই সঙ্গে একাধিক বিষয়ের উল্লেখ আছে। এ আয়াতগুলির একটি সাধারণ প্রয়োগ যোগ্যতা আছে এবং বর্ণিত উদাহরনের ভিত্তিতে আল্লাহর মহানুভবতা অনুধাবনের জন্য মানুষের প্রতি আহবান আছে।
অন্যান্য আয়াতে আরও সুনির্দিষ্ট বিষয়ের অবতারণা আছে, যেমন -পানির বিবর্তনচক্র ও সমুদ্র, পৃথিবীর উপরিভাগের প্রকৃতি এবং পৃথিবীর আবহাওয়া।
সাধারণ বিবরণের আয়াত
এ শ্রেণীর আয়াতে সাধারণত স্ররষ্টির প্রতি স্রষ্টার করুণা ও মহানুভবতা উপলব্ধির যৌক্তিকতা থাকলেও মাঝে মধ্যে এমন বর্ণনা আছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কৌতুহলোদ্দীপক। বিশেষত কুরআন নাযিলের সময় তৎকালীন মানুষের মধ্যে যে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে এ সকল ধারণা -বিশ্বাস ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পক্ষান্তরে ঐ সকল আয়াতে এমন সব সহজ ধারণা প্রকাশিত হয়েছে যা আরবদের কাছে সহজবোধ্য ছিল। কারণ ভৌগলিক কারণে কুরআন প্রথমত তাদের প্রতিই নির্দেশিত হয়েছিল। তারা ছিল মক্কা ও মদীনার বাসিন্দা এবং আরব উপদ্বীপের বেদুঈন। কিন্তু তা ছাড়াও ওই সকল আয়াতে সাধারণ প্রকৃতির এমন সব ধারনা আছে যা থেকে যে কোন স্থান অসময়ের অধিক অগ্রসর মানুষ গভীরতর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং এটাই কুরআনের বিশ্বজনীন ও আন্তর্জাতিক হওয়ার আলামত।
আগেই বলেছি আয়াতগুলির কোন শ্রেণিবিভাগ নেই। সুতরাং এখানে আমরা সুরার নম্বরের ক্রমিকতা অনুসরণ করছি।
সূরা ২ (বাকারা), আয়াত ২২:” (আল্লাহ) তিনিই যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করিয়াছেন এবং আকাশ হইতে পানি বর্ষণ করিয়া তদ্বারা তোমাদের জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন। সুতরাং জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাড় করাইও না।”
সুরা২ (বাকার) আয়াত ১৬৪:”আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে, যাহা মানুষের হিত সাধন করে তাহা সহ সমুদ্রে বিচরনশীল জুযান সমূহে আল্লাহ আকাশ হইতে যে বারি বর্ষণ দ্বারা ধরিত্রীকে তাহার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাহাদের এবং তাহার যাবতীয় জীবজন্তুর বিস্তারণে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্য নিদর্শন রহিয়াছে।”
সূরা ১৩ (রাদ) আয়াত ৩:”তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করিয়াছেন এবং উহাতে পর্বত ও নদীতে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং প্রত্যেক ফল সৃষ্টি করিয়াছেন দু প্রকারের। তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছদিত করেন। উহাতে অবশ্যই নিদর্শন রহিয়াছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।”
সূরা ১৫ (হিজর), আয়াত ১৯-২১:”পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করিয়াছি এবং উহাতে পর্বতমালা সৃষ্টি করিয়াছি; আমি পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু সৃষতি করিয়াছি সুপরিমিতভাবে এবং উহাতে জীবিকার ব্যবস্থা করিয়াছি তোমাদিগনের জন্য আর তোমরা যাহাদিগের জীবিকাদাতা নহ তাহাদিগের জন্যও। আমার নিকট আছে প্রত্যেক বস্তুর ভান্ডার এবং আমি উহা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করিয়া থাকি।”
সূরা ২০ (তাহা) আয়াত ৫৩-৫৪:” (তিনিই আল্লাহ) যিনি তোমাদিগের জন্য পৃথিবীকে করিয়াছেন বিছানা এবং উহাতে করিয়া দিয়াছেন তোমাদিগের চলিবার পথ, তিনি আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন এবং উহা দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন। তোমরা আহার কর ও তোমাদিগের পশু চরাও; অবশ্যই উহাতে নিদর্শন আছে বিবেক সম্পন্নদিগের জন্য।”
সূরা ২৭ (নমল), আয়াত ৬১:” (তিনিই আল্লাহ) যিনি পৃথিবীকে করিয়াছেন বাসোপযোগী এবং উহার মাঝে প্রবাহিত করিয়াছেন নদী-নালা এবং উহাতে স্থাপন করিয়াছেন সুদৃঢ় পর্বত ও দু দরিয়ার মধ্যে সৃষ্টি করিয়াছেন অন্তরায়; আল্লাহর সহিত অন্য কোন ইলাহ আছে কি? অবুও উহাদিগের অনেকেই উহা জানে না।”
এখানে পৃথিবীর উপরিভাগের স্তরের সাধারণ দৃঢ়তাঁর কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি যে পৃথিবী গঠিত হওয়ার প্রথম পর্যায়ে ঐ স্তর শীতল হওয়ার আগে দৃঢ় ছিল না। এখনও অবশ্য স্তরের সর্বত্র সমান দৃঢ় নয়; কারণ এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে ঘনঘন ভূমিকম্প হয়। দু দরিয়ার মাঝখানের অন্তরায় প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, বড় বড় নদীর পানি খাড়ির মুখে সমুদ্রের পানির সঙ্গে মিশে যাবে বা।
সূরা ৬৭ (মূলক) আয়াত ১৫:”তিনি তোমাদিগের জন্য ভূমিকে সুগম করিয়া দিয়াছেন; অতএব তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাহার প্রদত্ত জীবনোপকরণ হইতে আহার্য গ্রহণ কর; পুনরুত্থানের পর প্রত্যাবর্তন তাহারই নিকট।”
সূরা ৭৯ (নাযিয়াত) আয়াত ৩০-৩৩:”অতঃপর (আল্লাহ) পৃথিবীকে বিস্তৃত করেন; তিনি উহা হইতে উহার প্রস্রবণ ও চারণভূমি বহির্গত করেন এবং পর্বতকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেন; এ সমস্ত তোমাদিগের ও তোমাদের পশুর ভোগের জন্য।”
এরূপ অনেক আয়াতে পানির গুরুত্ব এবং মাটিতে পানি থাকার সুফল অর্থাৎ মাটির উর্বরতার উপর জোর দেয়া হয়েছে। মরুভূমির দেশে মানুষের বাচা মরা পানিরই উপরেই নির্ভর করে সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কুরআনে এ প্রসঙ্গটির অবতারণা এ ক্ষুদ্র ভৌগলিক তাৎপর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতে সৌরজগতে একমাত্র পৃথিবী গ্রহেই পানি আছে এবং কুরআনে এ বৈশিষ্টের উপরই জোর দেয়া হয়েছে। পানি না থাকলে পৃথিবী চাঁদের মতই একটি মৃত গ্রহ হয়ে যেত। কুরআনে পৃথিবী সম্পর্কিত নানা বিষয়ের মধ্যে পানির কথাই প্রথমে বলা হয়েছে। তাছাড়া পানির বিবর্তন চক্রটিও কুরআনে নিখুত ও নির্ভুল ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
পানির বিবর্তনচক্র ও সমুদ্র
মানব জীবনে পানির ভূমিকা বিষয়ক কুরআনের আয়াতগুলির যদি পরপর পরে শুনানো হয় তাহলে দেখা যাবে যে সেখানে এমন সব কথা বলা হয়েছে যা আমাদের কাছে অতি সহজেই বোধগম্য। কারণ বর্তমান যুগে আমরা প্রায় সকলেই পানির প্রাকৃতিক বিবর্তনচক্র সম্পর্কে কমবেশী অবহিত আছি।
এ বিষয়ে প্রাচীনকালে যে সকল ধারণা প্রচলিত ছিল তা বিবেচনা করে দেখা যায় যে এগুলি মূলত অনুমান ও কল্পনা ভিত্তিক ছিল। কুরান নাযিল হওয়ার সময় ঐ ধারণাগুলি প্রচলিত থাকলেও খোদ কুরআনে তা কোন স্থান পায়নি। সেও কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের কিছু অংশ অনুমান ভিত্তিক যুক্তি অনুসারে সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও সেই সকল ধ্যান-ধারণা বর্তমা যুগে আর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
মাটির নিচের পানি যে উপর থেকে চুইয়ে আসে তা অনুমান করা সহজ ছিল। প্রাচীনুকালে খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতেরোমের অধিবাসী ভিটরুভিয়াস পোলিও মারকাস
এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অনেকে এ ধারণাকে ব্যতিক্রম বলে মনে করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বহু শতাব্দী যাবৎ (এবং এ সময়ই কুরআন নাযিল হয়েছে) পানির গতিচক্র সম্পর্কে মানুষ সম্পুর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করে এসেছে।
এ বিষয়ে দুজন বিশেষজ্ঞ জী পাসটিনি এবং বি ব্লাভোক্স বিশ্বকোষের (ইউনিভার্সালিস এনসাইক্লোপিডিয়া) প্রবন্ধে সমস্যাটির একটি উত্তম ইতিহাস দিয়েছেন। তারা বলেছেন-” খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে মিলেটাসের থেলস এ মতবাদ পোষণ করতেন যে সমুদ্রের পানি বায়ু চালিত হয়ে স্থলভাগের দিকে ধাবিত হয়, এবং সেই পানি মাটিতে পড়ার পর মাটির ভিতরে প্রবেশ করে। প্লেটো এ মতবাদে বিধ্বাস করতেন এবং মনে করতেন যে মাটির নিচের কোন গভীর সুরঙ্গপথ (টারটাস) দিয়ে ঐ পানি আবার সাগরে ফিরে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ মতবাদের অনেক সমর্থক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ডেসকার্টেস। এরিসটোটল মনে করতেন যে, মাটির নিচের পানি বাষ্প হয়ে পাহাড়ী এলাকার ঠান্ডায় জমে গিয়ে ভূগর্ভে হ্রদ সৃষ্টি করে থাকে এবং সেই পানিই ঝর্ণার আকারে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এ মতবাদে সেনেকা (প্রথম শতাব্দী) ও ভলগার এবং আরও অনেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত পোষণ করতেন। ১৫৮০ সালে বার্নার্ড পালিসি পানির গতিচক্র সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা গঠন করেন। তিনি বলেন যে, মাটির নীচে যে পানি আছে তা উপর থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে আসা। সপ্তদশ শতাব্দীতেই ম্যারিওট এবং পি পেরোন্ট এ মতবাদ সমর্থন ও অনুমোদন করেন।”
কিন্তু আল কুরআনের নিম্নবর্ণিত বিভিন্ন আয়াতে মুহাম্মদের (সঃ) আমলে প্রচলিত নানাবিধ ভ্রান্ত ধারণার চিহ্নমাত্র নেই।
সূরা ৫০ (কাফ) আয়াত ৯-১১:”আকাশ হইতে আমি বর্ষণ করি উপকারী বৃষ্টি এবং তদ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান, শস্যরাজি ও সমুন্নত খর্জুর বৃক্ষ, যাহাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খর্জুর আমার দাসদিগের জীবিকা স্বরূপ; বৃষ্টি দ্বারা আমি সঞ্জীবিত করি মৃত ভূমিকে, এ ভাবেই পুনরুত্থান ঘটিবে।”
সূরা ২৩ (মুমিনুন) আয়াত ১৮-১৯:”এবং আমি আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করি পরিমিতভাবে, অতঃপর আমি উহা মৃত্তিকায় সংরক্ষিত করি আমি উহাকে অপসারিত করিতেও সক্ষম। অতঃপর আমি উহা দ্বারা তোমাদিগের জন্য খর্জুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করি; ইহাতে তোমাদিগের জন্য আছে প্রচুর ফল; আর উহা হইতে তোমরা আহার করিয়া থাক।”
সূরা ১৫ (হিজর) আয়াত ২২:”আমি বৃষ্টি গর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করি এবং উহা তোমাদিগকে পান করিতে দেই; উহার ভান্ডার তোমাদিগের নিকট নাই।”
এ আয়াতের দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে। বৃষ্টি গর্ভ বায়ু বা ফলনশীল বায়ুর অর্থ এই যে, বায়ু দ্বারা অনেক ফল-ফুলের বীজ ও রেণু বাহিত হয়। অপর অর্থ এ হতে পারেযে, বায়ু দ্বারা অনেক বৃষ্টিহীন মেঘ বৃষ্টিপূর্ণ মেঘে পরিণত হতে পারে। নিচের আয়াতগুলির মত অনেক ক্ষেত্রেই বায়ুর এ ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছেঃ
সূরা ৩৫ (ফাতির) আয়াত ৯:”আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করিয়া উহা দ্বারা মেঘমালা সঞ্চালিত করেন। অতঃপর তিনি উহা নির্জীব ভুখন্ডের দিকে পরিচালিত করেন, অতঃপর তিনি দ্বারা ধরিত্রীকে উহার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন। পুনরুত্থান এরূপেই হইবে।”
লক্ষনীয় আয়াতের প্রথম অংশ বর্ণনামূলক এবং তারপর কোন অন্তর্বর্তীকালীন বিরতি ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে। বর্ণনার এ আকস্মিক পরিবর্তন কুরআনে হামেশাই দেখা যায়।
সূরা ৩০ (রুম) আয়াত ৪৮:”আল্লহ, তিনি বায়ু প্রেরণ করেন, ফলে ইহা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে; অতঃপর তিই ইহাকে যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়াইয়া দেন, পরে ইহাকে খন্ড-বিখন্ড করেন এবং তুমি দেখিতে পাও উহা হইতে নির্গত হয় বারিধারা; তিনি তাহার দাসদিগের মধ্যে যাহাদিগেরপ্রতি ইচ্ছা ইহা দান করেন; উহারা তখন হর্ষোৎফুল্ল হয়।”
সূরা ৭ (আরাফ) আয়াত ৫৭:”তিনিই স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে বায়ুকে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন। যখন উহা ঘন মেঘ বহন করে তখন উহাকে নির্জীব ভূখন্ডের দিকে প্রেরণ করি, পরে উহা হইতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তৎপর উহার দ্বারা সর্বাধিক ফল উৎপাদন করি। এভাবে মৃতকে জীবিত করি যাহাতে তোমরা শিক্ষা লাভ কর।”
সূরা ২৫ (ফুরকান) আয়াত ৪৮-৪৯:”তিনি স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন এবং আকাশ হইতে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করেন, উহা দ্বারা মৃত ভুখন্ডকে সজ্জীবিত করিবার জন্য এবং অসংখ্য জীবজন্তু ও মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য।”
সূরা ৪৫ (জাসিয়া) আয়াত ৫:”নিদর্শন রহিয়াছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রাত্রি ও দিবসেরপরিবর্তনে, আল্লাহ আকাশ হইতে যে বারি বর্ষণ দ্বারা ধরিত্রীকে তাহার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাহাতে এবং বায়ুর পরিবর্তনে।”
এখানে বায়ু দ্বারা বৃষ্টির চক্র পরিবর্তনের উপর জোর দেয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
সূরা ১৩ (রাদ) আয়াত ১৭ (অংশ):”তিনি আকাশ হইতে বৃষ্টিপাত করেন, ফলে উপত্যকা সমূহ উহাদিগের পরিমাণ অনুযায়ী প্লাবিত হয় এবং প্লাবন তাহার উপরিস্থিত আবর্জনা বহন করে।”
সূরা ৬৭ (মুলক) আয়াত ৩০: ‘বল, তোমরা ভাবিয়া দেখিয়াছ কি যদি পানি ভূগর্ভে তোমাদিগের নাগালের বাহিরে চলিয়া যায়, কে তোমাদিগকে আনিয়া দিবে প্রবহমান পানি?”
সূরা ৩৯ (যুমার) আয়াত ২১ (অংশ):”তুমি কি দেখ না আআলহ আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করেন অতঃপর ভূমিতে রূপে স্রোত রূপে প্রবাহিত করেন এবং তদ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন?”
সূরা ৩৬ (ইয়াসীন) আয়াত ৩৪:”উহাতে আমি সৃষ্টি করি খর্জুর ও আঙ্গুরের উদ্যান এবং উৎসারিত করি প্রস্রবণ।”
শেষের তিনটি আয়াতে প্রস্রবণ এবং যে প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি দ্বারা তা পূর্ণ করা হয় তাঁর উপর জোর দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন এবং প্রসঙ্গত স্মরণ করা প্রয়োজন যে, মধ্য যুগে বিশ্বাস করা হত এবং এরিস্টটলের মত জ্ঞানীজনও মনে করতেন যে, ভূগর্ভ থেকেই প্রস্রবণের পানি আসে। ফ্রান্সের ন্যাশনাল স্কুল অব এগ্রোনমির অধ্যাপক এম আর রেমেনিয়েরাস বিশ্বকোষ (এনসাইক্লোপিডিয়া ইউনিভার্সালিস) তাঁর হাইড্রোলজি (পানি বিজ্ঞান) বিষয়ক প্রবন্ধে পানির গতিচক্রের প্রধান প্রধান পর্যায়ের একটি বর্ণনা দিয়েছেন এবং প্রাচীন কালে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে উত্তম সেচ ব্যবস্থার উল্লেখ করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, তৎকালীন ধারনা ও মতবাদ ভ্রান্ত ছিল বলে সাধারণ মানুষ তাদের সেচ কার্যে অভিজ্ঞতার উপরই বেশী নির্ভর করত। তিনি বলেন,”রেনেসার (১৪০০-১৬০০ খৃষ্টাব্দ) আমল পর্যন্ত নিছক দার্শনিক মতবাদই বহাল ছিল। তারপর বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে গবেষণা শুরু হওয়ায় সেই মতবাদ বাতিল হয়ে যায়। লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) এরিস্টটলের মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ‘ওয়ন্ডারফুল ডিসকোর্স অনদি নেচার অব ওয়াটার এন্ড ফাউনটেনস বোথ ন্যাচারাল এন্ড আর্টিফিশিয়াল’ প্যারিস ১৫৭০) নামক গ্রন্থে বার্নার্ড পলিসি পানির গতিচক্র এবং বৃষ্টির পানির দ্বারা ঝর্নার সিঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেন।”
ঠিক এ কথাই অর্থাৎ বৃষ্টীর পানির ভূগর্ভে প্রবেশ করে উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার ব্যাপারটিই সূরা যুমারের ২১ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
সূরা নুরের ৪৩ আয়াতে বৃষ্টি ও শিলার কথা বলা হয়েছেঃ ‘তুমি কি দেখ না আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, অতঃপর তাহাদিগকে একত্রিত করেন এবং পরে পুঞ্জীভুত করেন, তুমি দেখিতে পাও, অতঃপর উহা হইতে নির্গত হয় বারিধারা; আকাশে অবস্থিত শিলাস্তুপ হইতে তিনি বর্ষণ করেন শিলা এবং ইহা দ্বারা তিনি যাহাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা তাহার উপর হইতে ইহা অন্য দিকে ফিরাইয়া দেন। মেঘের বিদ্যুৎঝলক দৃষ্টিশক্তি প্রায় কাড়িয়া লয়।”
এ প্রসঙ্গে সূরা ওয়াকিয়ার তিনটি আয়াতের (৬৮-৭০) বিষয়বস্তুর উপর বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজনঃ
“তোমরা যে পানি পান কর সে সম্পররেক কি তোমরা চিন্তা অরিয়াছ? তোমরাই কি ইহা মেঘ হইতে নামাইয়া আন, না আমি উহা বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করিলে উহা লবণাক্ত করিয়া দিতে পারি। তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করনা?”
আল্লাহ যে সর্বশক্তিমান এবং তিনি যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, আল্লাহর মিঠা পানিকে নোনা পানিতে পরিণত করতে পারারা ক্ষমতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করার মধ্যে দিয়েও সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। আধুনিক যুগে মানুষ অবশ্য কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং মানুষের বৃষ্টি সৃষ্টির ক্ষমতা থাকা বিষয়ে কুরআনে যে বর্ণনা আছে তাঁর প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করা কি কারো পক্ষে সম্ভব?
এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছেঃনা, সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে মানুষের ক্ষমতার যে সীমাবদ্ধতা আছে তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। ফরাসী আবহাওয়া অফিসের বিশেষজ্ঞ এম এ ফ্যাসি বিশ্বকোষ (ইউনিভার্সালি এনসাইক্লোপিডিয়া) ‘বৃষ্টি’ শিরোনামে লিখেছেনঃ”যে মেঘ বৃষ্টির জন্য পরপক্ক হয়নি, অথবা সেইরূপ বৈশিষ্ট লাভ করেনি সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করানো কখনই সম্ভব হবে না।” অর্থাৎ প্রাকৃতিক অবস্থা অনুকূল না হলে কারিগরি জ্ঞান প্রয়োগ করে মানুষের পক্ষে বৃষ্টির প্রক্রিয়া তরান্বিত করা কখনই সম্ভব হবে না। তা না হলে খরা বা অনাবৃষ্টি কখনই হতে পারত না। অথচ বাস্তবে দেখা যায় খরা বা অনাবৃষ্টি হামেশাই হয়ে থাকে। সুতরাং বৃষ্টি বা আবহাওয়ার উপরে নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা মানুষের জন্য স্বপ্নই থেকে যাবে।
পানির গতি বিবর্তনের জন্য যে প্রাকৃতিক স্থায়ী নিয়ম আছে মানুষ ইচ্ছা করলেই তা লংঘন করতে পারে না। আধুনিক পানি বিজ্ঞানের ধারণা মুতাবিক এ প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে নিম্নরূপঃ
সূর্যরশ্মি থেকে আসা ক্যালোরির কারণে সমুদ্র এবং প্ররতিহিবীর পৃষ্ঠের পানি বাষ্প হয়ে যায়। এ বাষ্প আবহাওয়া মন্ডলে উঠে গিয়ে ঘনীভুত হয়ে মেঘে পরিণত হয়। বাতাস এ মেঘকে বিভিন্ন দূরত্বে নিয়ে যায়। মেঘ তখন বর্ষণ না করে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে, অথবা অন্যান্য মেঘের সঙ্গে মিলিত হয়ে আরও ঘনীভূত হয়ে যেতে পারে, অথবা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে বিবর্তনের কোন এক পর্যায়ে বর্ষণ ঘটাতে পারে। এ বৃষ্টি সাগরের (ভূপৃষ্ঠের শতকরা ৭০ ভাগ সাগর) পতিত হওয়ার পর বিবর্তন চক্রের কাজ আবার নতুন ভাবে শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি যখন মাটিতে পড়ে তখন তা গাছপালায় গ্রহণ করতে পারে এবং এভাবে তাদের জন্ম ও বিকাশে সহায়তা করে। গাছপালা থেকে কিছু পানি আবার আবহাওয়া মন্ডলে ফিরে যায়। অবশিষ্ট পানি মাটিতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে মাটির তলদেশ হয়ে সাগরে ফিরে যায় কিম্বা ঝর্না ও নদীতে প্রবাহিত হয়।
পানি বিজ্ঞানের আধুনিক তথ্যের সঙ্গে এ অধ্যায়ে উধৃত কুরআনের আয়াতগুলির মিলিয়ে দেখলে উভয়ের মধ্যে অদ্ভুত মিল ও সাদৃশ্য ধরা পড়ে।
সাগর
সাগরের ব্যাপারটি অবশ্য একটু ভিন্ন ধরনের। কুরআনে সাগর সম্পর্কে এমন কোন বর্ণনা নেই যার সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য মিলিয়ে দেখা যাতে পারে। তবে একটি বিষয় যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করাপ্রয়োজন যে, কুরআন নাযিল হওয়ার সময় সাগর সম্পর্কে যে সকল মতবাদ, উপকথা বা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল, কুরানের কোথাও তাঁর কোন সমর্থন নেই।
কয়েকটি আয়াতে সাগর ও নৌ চালনার বিষয় আছে। সেখানে সাধারণভাবে দর্শনযোগ্য বিষয় থেকে আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা অনুধাবন করার জন্য চিন্তার খোরাক আছে। নিচের কয়েকটি আয়াত নজির হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
সূরা ১৪ (ইব্রাহীম) আয়াত ৩২:”তিনি নৌযানকে তোমাদিগের অধীন করিয়াছেন যাহাতে উহা সমুদ্রে বিচরণ করেতাহার বিধানে।”
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াতে ১৪:”তিনিই সমুদ্রকে অধীন করিয়াছেন যাহাতে তোমরা উহা হইতে তাজা মৎস্যহার করিতে পার এবং যাহাতে উহা হইতে আহরণ করিতে পার রত্নাবলী যদ্বারা তোমরা অলংকৃত হও; এবং তোমরা দেখিতে পাও, উহার বুক চিরিয়া নৌযান চলাচল করে এবং ইহা এওন্য যে তোমরা যেন তাহার অনুসন্ধান করিতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”
সূরা ৩১ (লুকমান) আয়াত ৩১:”তুমি কি লক্ষ্য কর না যে আল্লাহ অনুগ্রহে নৌযানগুলি সমুদ্রে বিচরণ করে তোমাদিগকে তাহার নিদর্শনাবলী দেখাইবার জন্য? প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য ইহাতে অবশ্যই নিদর্শন রহিয়াছে।”
সূরা ৫৫ (রহমান) আয়াত ২৪:”সমুদ্রে বিচরনশীল পর্বতপ্রমান অর্ণবপোতসমূহ তাহারই নিয়ন্ত্রণাধীন।”
সূরা ৩৬ (ইয়াসীন) আয়াত ৪১-৪৪:”উহাদিগের জন্য এক নিদর্শন এ যে আমি উহাদিগের পিতৃপুরুষদিগকে বোঝাই নৌযানে আরোহণ করাইয়াছিলাম এবং উহাদিগের জন্য অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করিয়াছি যাহাতে উহারা আরোহণ করে। আমি ইচ্ছা করিলে উহাদিগকে নিমজ্জিত করিতে পারি; সে অবস্থায় উহারা কোন সাহায্যকারী পাইবে না এবং উহারা পরিত্রাণও পাইবে না- উহাদিগের প্রতি আমার অনুগ্রহ না হইলে এবং উহাদিগকে কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করিতে না দিলে।”
এখানে স্পষ্টতই নৌযানে মানুষ বাওহন অর্থাৎ অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে নূহকে (আঃ) নৌযানে বহন করে শুষ্ক জমিনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার কথা বলা হয়েছে।
সমুদ্র সম্পর্কে আর একটি দৃশ্যমান বিষয় তাঁর অস্বাভাবিক বৈশিষ্টের কারণেই সহজে নজর পড়ে এবং এ বৈশিষ্ট বড় বড় নদী এবং সমুদ্রের প্রবেশপথেও দৃশ্যমান হয়ে থাকে। কুরআনে এ বৈশিষ্টের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
এ বৈশিষ্ট হচ্ছে এ যে নদীর মিঠা পানি সাগরের নোনা পানির সঙ্গে মেশে না। টাইগ্রিস (দাজলা) ওইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদী যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে এ দৃশ্য দেখা যায়। ওই খাড়ি এক শতাধিক মাইল দীর্ঘ একটি সাগর বিশেষ এবং শাতিল আরব নামে অভিহিত। এ উপসাগরের অভ্যন্তরে যখন সাগরের ঢেউ আসে তখন নদীর মিঠা পানিকে শুষ্ক স্থলভাগের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় এবং এভাবে সেচকার্যের সহায়তা করে। এ বিষয়ে কুরআনের এবারতের অর্থ উপলব্ধি করার জন্য অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, আরবী”বাহর” শব্দে বিপুল পরিমাণ পানি বুঝায় এবং সেই অর্থে সাগরও যেমন বুঝায় তেমনি নীলনদ, টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের মত বড় বড় নদীও বুঝায়। ইংরাজী ‘সি” (ওণণ) শব্দ এ সাধারণ অর্থই বহন করে।
মিঠা পানি ও নোনা পানি না মেশার বৈশিষ্টটি নিচের তিনটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ
সূরা ২৫ (ফুরকান) আয়াত ৫৩:”তিনিই দু দরিয়াকে প্রবাহিত করিয়াছেন, একটির পানি মিষ্ট, সুপেয় এবং অপরটির পানি লোনা, খর। উভয়ের মধ্যে তিনি রাখিয়া দিয়াছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।”
সূরা ৫৫ (ফাতির) আয়াত ১২:”দুটি দরিয়া একরূপ নহে-একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়, অপরটির পানিলোনা, খর। প্রত্যেকটি হইতে মৎস্যহার কর এবং তোমাদিগের ব্যবহার্য রত্নাবলী আহরণ কর।”
সূরা ৫৫ (রহমান) আয়াত ১৯, ২০ ও ২২:”তিনি প্রবাহিত করেন দু দরিয়া যাহারা পরষ্পর মিলিত হয়, কিন্তু উহাদিগের মধ্যে রহিয়াছে এক অন্তরাল যাহা উহারা অতিক্রম করিতে পারে না। উভয় দরিয়া হইতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল।”
মূল ঘটনার বর্ণনার পর উভয় প্রকার পানি থেকে যা পাওয়া যায় তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ মাছ, মুক্তা ও প্রবাল। মিঠা পানি ও নোনা পানি না মেশার ঘটনা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর ক্ষেত্রে একক বা একমাত্র ঘটনা নয়। অন্যত্রও এ ঘটনা আছে। কুরআনে টাইগ্রিস এবন ইউফ্রেটিস নদীর নাম উল্লেখ না থাকলেও সাধারণত মনে করা হয় যে এ দু নদীর দিকেই ইশারা করা হয়েছে। দূরতম গভীর সাগরে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের মিঠা পানি নোনা পানির সঙ্গে মেশে না।
পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ
পৃথিবীর গঠন খুবই জটিল। এখন মোটামুটি ভাবে অনুমান করা সম্ভব যে, একটি অতিশয় পুরু স্তর থেকে খুবই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে পৃথিবি গঠিত হয়েছে। তার কেন্দ্রস্থলে পাথর জাতীয় পদার্থ এখনও গলিত ও উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে এবং উপরের স্তরটি ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করেছে। উপরের স্তর বা পৃথিবীর ত্বক খুবই পাতলা; তার পরিমাপ মাইলের হিসাবে কিম্বা বড়জোর দশ মাইলের ইউনিটে করা হয়ে থাকে। পৃথিবির কেন্দ্রস্থল থেকে পরিধির দূরত্ব ৩, ৭৫০ মাইলের চেয়ে কিছু বেশী। সুতরাং ত্বকের পরিমাপ গড়পড়তা হিসেবে গোলকের পরিধির একশো ভাগের একভাগও হয় না। অথচ সকল ভূতাত্বিক ঘটনা এ ত্বকের উপরেই ঘটেছে। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে পৃথিবির ত্বকে যে ভাঁজের সৃষ্টি হয়েছে তাঁর ফলেই পর্বতমালা গঠিত হয়েছে। ভূতত্ববিদদের নিকটে এ প্রক্রিয়া ‘অরোজেনেসিস’ নামে পরিচিত এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে ভাঁজের ফলে পর্বত গঠিত হয়েছে ঠিক সে ভাঁজের কারণেই পৃথিবির ত্বক আনুপাতিক ভাবে নিচে নেমে গিয়েছে এবং এভাবে পর্বতের জন্য শক্ত বুনিয়াদ সৃষ্টি হয়েছে।
পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে সাগর ও জমিনের বন্টন ও অনুপাতের বিষয়টি অতি সম্প্রতি সাব্যস্ত হয়েছে এবং এখনও এমন কি সাম্প্রতিকতম ও জ্ঞাত আমলে ব্যাপারেও আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ রয়েছে। সাগরমালা সম্ভবত পাঁচ কোটি বছর আগে গঠিত হয়ছে বলে মনে করা হয়েথাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সমগ্র ভূখন্ড সম্ভবত একটিমাত্র খন্ডের আকারে ছিল এবং পরে তা খন্ডিত হয়ে বিভিন্ন মহাদেশের আকার ধারণ করে। কোন মহাদেশ বা তাঁর অংশ বিশেষ (উত্তর আটলান্টিক মহাদেশ এবং ইউরোপের অংশবিশেষ) সামুদ্রিক অঞ্চলে পর্বত গঠিত হওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
আধুনিক ধারণা মতে জমিন গঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পর্বতের গঠন অ বিকাশই প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে চতুর্থ পর্যায় পর্যন্ত জমিনে গঠন বিভিন্ন ভারসাম্যের উপর প্রভাব বিস্তারকরেছিল। জমিনের কোন অংশ নতুন ভাবে গরে উঠেছে এবং এভাবে লক্ষ্য লক্ষ্য বছর যাবত সাগর ওজমিনের বন্টন ও অনুপাত পরিবর্তন করেছেন। এভাবে পরিবর্তন হতে হতে বর্তমানে পৃথিবীর জমিনেরপরিমাণ সাগরের পরিমাণের দশ ভাগের মাত্র তিন ভাগে এসে দাড়িয়েছে।
এভাবে বিগত কয়েক লক্ষ্য বছরে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এখন মোটামুটি ভাবে তাঁর একটি বর্ণনা দেয়া সম্ভব হতে পারে।
পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের প্রসঙ্গে কুরআনে কেবলমাত্র পর্বতের গঠন প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। নিচের আয়াতগুলিতে পৃথিবীর গঠন প্রসঙ্গে মানুষের প্রতি আল্লাহর করুণার কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে আর কিছু বোধহয় বলার মত নেই।
সূরা ৭১ (নূহ) আয়াত ১৯-২০:”এবং আল্লাহ তোমাদিগের জন্য ভূমিকে করিয়াছেন বিস্তৃত যাহাতে তোমরা চলাফেরা করিতে পার প্রশস্ত পথে।”
সূরা ৫১ (যারিয়াত) আয়াত ৪৮:”আমি ভূমিকে বিছাইয়া দিয়াছি, আমি কত সুন্দরভাবে বিছাইয়াছি ইহা।”ভূমিকে কার্পেটের মত বিছিয়ে দেয়ার কথা বলে হয়েছে। এ কার্পেট হচ্ছে পৃথিবীর ত্বক, একটি অতিশয় শক্ত খোসা যার উপরে আমরা বাস করি। এ ত্বক না থাকলে পৃথিবী কোন প্রাণীর বাসের উপযোগী হতে পারত না। কারণ পৃথিবির অভ্যন্তরভাগ তরল উত্তপ্ত এবং জীবন বিধ্বংসী। পর্বতমালা এবং ভূপৃষ্ঠ ভাজ হুয়ার ফলে তাদের শক্ত ও শক্তিশালী হওয়া বিষয়ে কুরআনে যে বিবরণআছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সূরা ৮৮ (গাশিয়া) আয়াত ১৯-২০:”পর্বতমালা কিভাবে সংস্থাপিত হইয়াছে (তাবুর মত) এবংভুতলকে কিভাবে সমতল করা হইয়াছে?”পর্বতমালা কিভাবে জমিনে প্রোথিত হয়েছে পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে তাঁর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।
সূরা ৭৮ (নাবা) আয়াত ৬-৭:”আমি কি ভূমিকে বিছানা ও পর্বতকে কীলক সদৃশ করি নাই?” কীলক হচ্ছে তাবুর টানা দড়ি বাঁধার জন্য মাটিতে পোতা খুঁটা (আওতাদ, ওয়াতাদের বহুবচন) জমিনের ভাজগুলিই যে পর্বতের বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করে আধুনিক ভূতত্ববিদগণ তা স্বীকার করেছেন। তাদের মতে একেকটি ভাঁজের আকার এক থেকে দশ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। এ ভাজগুলি ভূত্বককেও শক্তিশালী করে থাকে। এ পটভূমিকায় নিচের আয়াতগুলির প্রতি খেয়াল করা যেতে পারেঃ
সূরা ৭৯ (নাজিয়াত) আয়াত ৩২:” এবং পর্বতকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেন।”
সূরা ৩১ (লুকমান) আয়াত ১০:”তিনিই পৃথিবীতে স্থাপন করিয়াছেন পর্বতমালা যাহাতে ইহা তোমাদিগকে লইয়া ঢলিয়া না পড়ে।”
সূরা নাহলের ১৫ আয়াতে এ একই কথা বলা হয়েছে এবং সূরা আম্বিয়ার ৩১ আয়াতেও এ একই ধারণা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছেঃ”এবং আমি পৃথিবীকে সৃষ্টি করিয়াছি সুদৃঢ় পর্বত যাহাতে পৃথিবী উহাদিগকে লইয়া এদিক ওদিক ঢলিয়া না যায়।”
এ আয়াতগুলিতে এ ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে যে পর্বতগুলো যেভাবে স্থাপন করা হয়েছে তাঁর ফলে স্তিতিশীলতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। এ ধারনা আধুনি ভূতাত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।