মহাযাত্রা
মূসা ও তাঁর অনুসারীদের মিসর থেকে মহাযাত্রা (কেনানের পথে প্রথম পর্যায়) একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কখনও কখনও মূলত কিংবদন্তি বলে অভিযোগ করা হলেও ঘটনাটি প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং পরিচিত পটভূমিকায় অবস্থিত।
ওল্ড টেস্টামেন্টের পেন্টাটিউক অর্থাৎ তৌরাতের দ্বিতীয় গ্রন্থে (যাত্রাপুস্তক) এ ঘটনা বর্ণিত আছে। সেখানে বিরাণভূমিতে সফর এবং সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির একটি বিবরণ আছে। কুরানেও এ বিষয়ে দীর্ঘ বিবরণ আছে। সূরা আরাফ, ইউনুস, তাহা ও শুয়ারা সহ দশটিরও অধিক সূরায় ফেরাউনের সঙ্গে মূসা ও তাঁর ভাই হারুণের সম্পর্ক এবং তাদের মিসর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ বর্ণনা আছে। এছাড়াও অন্যত্র সংক্ষেপে অথবা স্মারক হিসেবে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। আমার নিজের জানা মতে মিসরীয় পক্ষের প্রধান নায়ক ফেরাউনের নাম সাতাশটি সূরায় মোট চুয়াত্তর বার উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনা মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, প্লাবনের ঘটনার তুলনায় এ ঘটনার ব্যাপারে উভয় বর্ণনার মধ্যে অনেক মিল আছে। অমিল অবশ্যই আছে, তথাপি আমরা দেখতে পাব যে বাইবেলের বর্ণনার যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কারণ এ বর্ণনা থেকেই সংশ্লিষ্ট ফেরাউন, কিম্বা বলা যায় সংশ্লিষ্ট দুজন ফ্রাউনকে সনাক্ত করা যায়। সনাক্ত করার এ প্রক্রিয়াটি বাইবেল থেকেই শুরু হয়েছে এবং কুরআনে বর্ণিত তথ্য দ্বারা পুর্নতা লাভ করেছে। তার সঙ্গে সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত তথ্য যোগ করে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখলে ঘটনাটি একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় স্থাপন করা যেতে পারে।
বাইবেল বর্ণিত মহাযাত্রা
বাইবেলের বর্ণনা শুরু হয়েছে ইয়াকুবের সঙ্গে ইহুদীদের মিসের প্রবেশের কথা স্মরণের মধ্য দিয়ে। ইয়াকুব সেখানে ইউসুফের সঙ্গে মিলিত হন। পরে যাত্রাপুস্তক ১, ৮, মতেঃ”পরে মিসরের উপরে এক নতুন রাজা উঠিলেন, তিনি যোসেফকে জানিতেন না।”
তারপর অত্যাচার শুরু হয়। ফেরাউন পিথোম ও রামিসেস শহরে (যাত্রাপুস্তক ১, ১১) নির্মানের কাজে ইহুদীদের মজুর হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আর তাদের সংখ্যা যাতে না বাড়তে পারে সে জন্য ইহুদীদের প্রত্যেকটি নবজাত পুত্র সন্তানকে নদীতে ফেলে দেয়ার হুকুম দেন। মূসা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম তিন মাস তাঁর মা তাকে কোন মতে লুকিয়ে রাখেন এবং তারপর তাকে ঝুড়িতে করে নদীর তীরে রেখে আসেন। ফেরাঊনের কন্যা ঘটনাক্রমে শিশুটিকে দেখতে পেয়ে বাড়ি নিয়ে যান এবং তাঁর দেখাশুনার দায়িত্ব একজন পরিচারিকার উপর অর্পন করেন। এ পরিচারিকা আসলে ছিলেন মূসার মা। মূসার বোন দূরে লুকিয়ে থেকে রাজকন্যাকে তাঁর ভাইকে নিয়ে যেতে দেখেন এবং শিশুটিকে না চেনার ভান করে একজন ভাল পরিচারিকার সন্ধান দেয়ার কথা বলে শিশুর মাকেই সে কাজে লাগিয়ে দেন। শিশুটি ফেরাউনের অন্যতম পুত্র হিসেবেই লালিত পালিত হয় এবং তাঁর না রাখা হয় মূসা।
যৌবনে মূসা মিডিয়ায় (মাদায়েন) নামক একটি দেশে চলে যান। সেখানে তিনি বিয়ে করেন এবং বহুদিন বাস করেন। এ পর্যায়ে বাইবেলে (যাত্রাপুস্তক ২, ২৩) এক গুরুত্বপূর্ণ খবর দেয়া হয়েছে-”এ সময় মিসর রাজ্যের মৃত্য হইল।”
আল্লাহ মূসাকে ফেরাউনের নিকট যেতে এবং তাঁর ভাইদের মিসরের বাইরে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন (বাইবেলে জলন্ত ঝোপের কাহিনীতে এ হুকুমের কথা আছে) । এ দায়িত্ব পালনে মূসাকে তাঁর ভাই হারুণ সাহায্য করেন। মিসরে ফিরে যাওয়ার পর মূসা হারুণকে সঙ্গে নিয়ে ফেরাউনের কাছে যান। যে ফেরাউনের আমলে মূসার জন্ম হয়েছিল এ ফেরাউন ছিলেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত উত্তরাধিকারী।
ফেরাউন মূসার অনুসারী ইহুদীদের মিসর ত্যাগের অনুমতি দিলেন না। আল্লাহ পুনরায় অহি নাযিল করে মূসাকে ফেরাউনের কাছে পুনরায় অনুরোধ জানাতে হুকুম দিলেন। বাইবেল অনুসারে এ সময় মূসার বয়স ছিল আশি বছর। তিনি যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তা তিনি যাদুর মারফত ফেরাউনকে দেখালেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। আল্লাহ প্লেগের আকারে মিসরের উপরে গজব নামিয়ে দিলেন। নদীর পানি রক্তে পরিণত হল, কোটি কোটি ব্যাঙ, ডাশ ও মাছি লোকালয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল, মানুষ ও প্রাণীর দেহে ফোঁড়া দেখা দিল, গৃহপালিত পশু মারা গেল, ঘনঘন শিলাপাত হল, পঙ্গপালে দেশ ছেয়ে গেল, সর্বত্র অন্ধকার নেমে এল এবং প্রথম সন্তানের মৃত্যু হতে লাগল। কিন্তু তথাপি ফেরাউন ইহুদীদের মিসর ত্যাগের অনুমতি দিলেন না।
ফলে তারা রামিসেস শহর থেকে বেরিয়ে পড়ল। মহিলা ও শিশু ছাড়া তারা সংখ্যায় ছয় লক্ষ্ ছিল (যাত্রাপুস্তক ১২-৩৭) । পরে আমরা অবশ্য দেখতে পাব যে এ সংখ্যা অতিরঞ্জিত। ফেরাউন”আপন রথ প্রস্তুত করাইলেন ও আপন লোকদেরকে সঙ্গে নিলেন। আর মনোনীত ছয়শত রথ রথ তৎসমূদয়ের উপরে নিযুক্ত সেনানীদেরকে লইলেন। এভাবে মিসর- রাজ ইসরায়েল সন্তানদের পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন; তখন ইসরায়েল সন্তানেরা উর্ধ হস্তে বহির্গমন করিতেছিল।” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৬ ও ৮) । ফেরাউনকে বাহিনী সমুদ্রতীরে গিয়ে মূসার লোকজনকে ধরে ফেলল। মূসা তাঁর লাঠি উচু করলেন, সমুদ্র দুভাগ হয়ে গেল এবং তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে পা না ভিজিয়েই ওপারে চলে গেলেন।” পরে মিসরীয়রা, ফেরাউনের সকল অশ্ব ও রথ এবং অশ্বারূঢ়গণ ধাবমান হইয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করিল। (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৩)”জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল, তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না। কিন্তু ইসরায়েল সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে চলিল্প এবং তাহাদের দক্ষিণে ও বামে জল প্রাচীর স্বরূপ হইল। (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮-২৯)
যাত্রাপুস্তকের বর্ণনা খুবই পরিষ্কার। ফেরাউন তাঁর বাহিনীর সামনে ছিলেন এবং তিনি পানিতে ডুবে মারা গেলেন। কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে-”তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না।” এ ঘটনাটি বাইবেলের গীতসংহীতায় (সামস) ১০৬ গীতের ১১ স্তোত্র এবং ১৩৬ গীতের ১৩ ই ১৫ স্তোত্রেও বর্ণিত হয়েছে। সেখানে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে, কারণ”তিনি সুফ-সাগরকে দ্বিভাগ করিলেন এবং তাহার মধ্য দিয়া ইসরায়েলকে পার করিলেন, কিন্তু ফেরাউন ও তাহার বাহিনীকে সুফ-সাগরে ঠেলিয়া দিলেন।” সুতরাং বাইবেলে অনুসারে ফেরাউন যে সাগরে ডুবে মারা যান সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর লাশের কি গতি হল সে সম্পর্কে বাইবেলে কোন খবর নেই।
কুরআনে বর্ণিত মহাযাত্রা
কুরআনে এ মহাযাত্রার যে বিবরণ আছে তা মটামুটি ভাবে বাইবেলের বর্ণনার মতই। তবে বিবরণটি বিভিন্ন সূরায় ছড়িয়ে আছে ফলে তা একত্রিত করে পড়ে দেখার প্রয়োজন হয়।
কুরআনে মহাযাত্রার সময়কালীন গদিনশিন ফেরাউনের নামু উল্লেখ করা হয়নি। ফলে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব নয়। বাইবেলেও নাম নেই তবে শুধু এটুকুই জানা যায় যে, তার একজন মন্ত্রীর নাম ছিল হামান। কুরানে ছয়বার তাঁর উল্লেখ আছে (সূরা কাসাস আয়াত ৬, ৮ ও ৩৮; সূরা আনকাবুত আয়াত ৩৯; এবং সূরা মুমিন আয়াত ২৪ ও ৩৬)
ফেরাউন ইহিদীদের নির্যাতনকারী। সূরা ১৪ (ইব্রাহীম) আয়াত ৬:”মূসা তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তিনি তোমাদিগকে মর্মান্তিক শাস্তি দিত, তোমাদিগের পুত্রগণকে জবাই করিত ও তোমাদের নারীগণকে জীবিত রাখিত।”
সূরা আরাফের ১৪১ আয়াতেও একইভাবে ঐ নির্যাতনের বর্ণনা আছে। ইহুদীগণ মিসরে দাস জীবন যাপনের সময় যে শহর নির্মাণ করেছিল কুরআনে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি। বাইবেলে নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
মূসাকে শিশুকালে নদীর তীরে রেখে যাওয়ার ঘটনাটি সূরা তাহা’র ৩৯-৪০ আয়াত এবং সূরা কাসাসের ৭-১৩ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। কুরানের বর্ণনামতে মূসাকে ফেরাউনের পরিবার পরিজন নিয়ে যায়। সূরা ২৮ (কাসাস) আয়াত ৮-৯:”ফেরাউনের লোকজন মূসাকে উঠাইয়া লইল। ইহার পরিণাম তো এই ছিল যে, সে উহাদিগের শত্রু ও দুঃখের কারণ হইবে। ফেরাউন, হামান ও উহাদিগের বাহিনী ছিল অপরাধী। ফেরাউনের স্ত্রী বলিল, ‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়ন-প্রীতিকর। ইহাকে হত্যা করিও না, সে আমাদিগের উপকারে আসিতে পারে, আমরা তাহাকে সন্তান হিসাবেও গ্রহণ করিতে পারি। ‘ প্রকৃত পক্ষে উহারা উহার পরিণাম বুঝিতে পারে নাই।
মুসলিম কিংবদন্তি মতে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া মূসার লালন-পালন করেন। কুরআনের বর্ণনায় দেখা যায় ফেরাউনের স্ত্রী নন, তার বাড়ির লোকজন মূসাকে নদীর তীরে কুড়িয়ে পায়।
সূরা কাসাসের ১৩-২৮ আয়াতে মূসার যৌবনকাল, তার মাদায়েনে অবস্থান ও তাঁর বিয়ের বর্ণনা আছে। বিশেষত জ্বলন্ত ঝোপের ঘটনাটি সূরা তাহা’র প্রথম ভাগে এবং সূরা কাসাসের ৩০-৩৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
কুরআনে মিসরের উপরে দশটি আসমানী গজব নাযিল হওয়ার কথা নেই (বাইবেলে আছে); সংক্ষেপে পাঁচটি গজবের (বন্যা, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাং ও রক্ত) উল্লেখ আছে (সূরা আরাফ আয়াত ১৩৩)
কুরআনে মিসর থেকে মহাযাত্রার বিবরণ আছে, কিন্তু বাইবেলে যে ভৌগলিক তথ্য বা অসংখ্য মানুষের উল্লেখ আছে কুরআনে তা নেই। ছয় লক্ষ্য পুরুষের তাদের পরিবার-পরিজন সহ দীর্ঘদিন যাবত মরুভূমিতে অবস্থানের যে বর্ণনা বাইবেলে আছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কুরআনে ইহুদীদের পিছনে ধাবমান ফেরাউনের মৃত্যু এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ সূরা ২০ (তাহা) আয়াত ৭৮:”অতঃপর ফেরাউন তাহার সৈন্যবাহিনীসহ তাহাদিগের পশ্চাদ্ধাবন করিলে সমুদ্র উহাদিগকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করিল। ইহুদীরা পার হয়ে গেল। ফেরাউন মারা গেল এবং তাঁর লাশ পাওয়া গেল।” লাশ পাওয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির উল্লেখ বাইবেলে নেই।
সূরা ১০ (ইউনুস) আয়াত ৯০-৯২:”আমি বনি ইসরায়েলকে সমুদ্র পার করাইলাম এবং ফেরাউন ও তাহার সোইন্যবাহিনী বিদ্বেষ পরবশ হইয়া ও ন্যায়ের সীমা লংঘন করিয়া তাহাদিগের পশ্চাদ্ধাবন করিল। পরিশেষে যখন সে নিমজ্জমান হইল তখন সে বলিল, আমি বিশ্বাস করিলাম যে বনি ইসরায়েল যাহাতে বিশ্বাস করে তিনি ব্যাতীত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।”
“এখন ইতিপূর্বে তো তুমি অমান্য করিয়াছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। আজ আমি তোমার দেহ চরাভূমিতে রক্ষা করিব যাহাতে তুমি তোমার পরবর্তীদিগের জন্য নিদর্শন হইয়া থাক। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্মন্ধে অনবধান।”
এ ব্যাপারে দুটি বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
প্রথমত ফেরাউনের বিদ্বেষ ও ন্যায়ের সীমা লংঘনের ব্যাপারটি মূসা কর্তৃক তাকে হেদায়েত করার প্রচেষ্টার আলোকে উপলব্ধি করতে হবে; এবং দ্বিতীয়ত ফেরাউনকে রক্ষা বা উদ্ধার করা বলতে তাঁর লাশকে রক্ষা বা উদ্ধার করাই বুঝতে হবে, কারণ ফেরাউনকে যে দন্ডিত করা হয়েছে তা কুরআনেই বলা হয়েছে। সূরা ১১ (হুদ) আয়াত ৯৮।
“সে (ফেরাউন) কিয়ামতের দিনে তাহার সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকিবে এবং সে তাহাদিগকে লইয়া অগ্নিতে প্রবেশ করিবে।”
প্রসঙ্গত লক্ষণীয়্য যে, ইতিহাস, ভূগোল ও স্থাপত্যবিদ্যার আলোকে যে সকল ঘটনা যাচাই করে দেখা সম্ভব সে সকল ঘটনার বর্ণনায় কুরআনে ও বাইবেলে নিম্নরূপ পার্থক্য আছেঃ
-মূসার অনুসারী ইহুদীগণ যে শহর নির্মাণ করেছিল এবং মহাযাত্রার পথে যে সকল স্থান অতিক্রম করেছিল কুরআনে তাঁর নামের কোন উল্লেখ নেই।
-মূসার মাদায়েনে অবস্থান কালে কোন ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে বলে কুরআনে কোন উল্লেখ নেই।
-ফেরাউনকে হেদায়েতের চেষ্টা করার সময় মূসার সময় কত ছিল তা কুরআনে বর্ণিত হয়নি।
-কুরআনে মূসার অনুসারিদের সংখ্যার কোন উল্লেখ নেই, বাইবেলে স্পষ্টতই অতিরঞ্জিত করে বলা হয়েছে ছয় লক্ষ্য পুরুষ ও তাদের পরিবার-পরিজন; অর্থাৎ সর্বমোট বিশ লাখেরও বেশী নরনারী।
-ফেরাউনের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ উদ্ধার হওয়া সম্পর্কে বাইবেলে কোন উল্লেখ নেই। আমাদের বর্তমান বিবেচনার জন্য উভয় গ্রন্থের বর্ণনার এ সাধারণ বিষয়গুলি লক্ষণীয়ঃ
-মূসার অনুসারী ইহুদীদের উপরে ফেরাউনের অত্যাচারের যে ঘটনা বাইবেলে বর্ণিত আছে কুরআনে তাঁর সমর্থন আছে।
-কুরআন বা বাইবেলে মিসরের রাজার কোন নাম উল্লেখ করা হয়নি।
-মহাযাত্রার সময় ফেরাউনের মৃত্যু হওয়া বিষয়ক বাইবেলের বর্ণনা কুরআনে সমর্থিত হয়েছে।
কিতাবের তথ্যের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানের মুকাবিলা
বনি ইসরায়েলের মিসরে অবস্থানের মেয়াদ এবং তাদের মিসর ত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বাইবেলে ও কুরআনে যে বর্ণনা আছে তাতে এমন কিছু তথ্য পাওয়া যায় যার সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানের মুকাবিলা চলতে পারে। তবে এ মুকাবিলা আসলে অসম হতে বাধ্য, কারণ কিছু তথ্য বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে এবং অবশিষ্ট তথ্য নিয়ে কোন আলোচনা করাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
১) কিতাবে বর্ণিত কিছু তথ্যের বিবেচনা
মিসরে বনি ইসরায়েলঃ
স্পষ্টতই ভুলের কোন ঝুকি প্রায় শো নিয়েই বলা সম্ভব যে বাইবেলের বর্ণনা মুতাবিক (আদিপুস্তক ১৫, ১৩ এবং যাত্রাপুস্তক ১২, ৪০) ইহিদীগণ ৪০০ অর্থাৎ ৪৩০ বছর মিসরে অবস্থান করেছিল। আদিপুস্তক ও যাত্রাপুস্তকের বর্ণনার এ সামান্য পার্থক্য সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে, ইব্রাহীমের অনেক পরে ইয়াকুব-পুত্র ইউসুফ যখন তাঁর ভাইদের নিয়ে মিসরে যান তখন থেকেই ইহুদীদের মিসরে অবস্থানের মেয়াদ শুরু হয়। তবে লক্ষণীয় যে একমাত্র বাইবেলেই এ তথ্য আছে, আল কুরআনে কেবলমাত্র মিসরে যাত্রার উল্লেখ আছে কিন্তু কোন সন-তারিখের উল্লেখ নেই এবং এ ছাড়া এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে এমন কোন দলীল আমাদের হাতে নেই।
পি মনটেট থেকে ডানিয়েল-রপস পর্যন্ত আধুনিক ভাষ্যকারগণ মনে করেন যে, সম্ভবত খৃষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউসুফ ও তাঁর ভ্রাতাগণ যখন মিসরে উপনীত হন, ঠিক সেই সময় হাইকসোসকগণও মিসর অভিমুখে রওনা হয় এবং সম্ভবত হাইসোসদেরই কোন নরপতি নীলনদের উপত্যকায় অবস্থিত আভারিসে তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান।
কিন্তু এ অনুমান যে বাইবেলের বর্ণনার সম্পূর্ণ বিরোধী সে সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। কারণ, বাইবেলেবলা হয়েছে (রাজাবলী-১, ৬, ১) যে খৃষ্টোপূর্ব ১৭১ সালে সোলায়মানের ভজনালয় নির্মাণের ৪৮০ বছর পূর্বেই
ইহুদীগণ মিসর থেকে মহাযাত্রা করে মোটামুটিভাবে খৃষ্টপূর্ব ১৪৫০ সালে এবং মিসরে প্রবেশ খৃষ্টপূর্ব ১৮৮০-১৮৫০ সালে হওয়ার কথা। অথচ ঠিক এ সময়ই নাকি ইব্রাহীম জীবিত ছিলেন এবং বাইবেলের অন্যান্য তথ্য থেকে জানা যায় যে, তাঁর ও ইউসুফের আমলের মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে ২৫০ বছর। সুতরাং ঘটনার ক্রমিকতার বিবেচনায় বাইবেলের এ বিবরণ আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পরে আমরা এ বিষয়ে ফাদার দ্য ফক্সের ব্যাখ্যা দেখতে পাব। আর ঐ যে আধুনিক ভাষ্যকারদের অনুমান, তার বিরুদ্ধে আপত্তির একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে বাইবেলের (রাজাবলী-১) এ বর্ণনা, অথচ বর্ণনাটি যে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় তা আমরা আগেই দেখতে পেয়েছি।
কিতাবের বর্ণনা ছাড়া ইহুদীদের মিসরে অবস্থানের অন্য কোন প্রমাণ বা চিহ্ন তেমন পাওয়া যায় না। প্রাচীন মিসরের প্রতীকচিত্রে অবশ্য আপিরু, হাপিরু বা হাবিরু নামের একশ্রেণীর শ্রমিকের উল্লেখ দেখা যায় যাদের (সঠিক বা বেঠিক ভাবে) হিব্রু অর্থাৎ ইহুদী বলে সনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ইমারত নির্মাণের শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক প্রভৃতি ছিল। কিন্তু তারা কোথা থেকে এসেছিল তাঁর কোন হদিস পাওয়া যায় না। ফাদার দ্য ফক্স বলেছেন-”তারা স্থানীয় লোক নয়, স্থানীয় সমাজের কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে তারা নিজেদের দাবী করে না এবং স্থানীয়দের মত পেশা বা মর্যাদাও তাদের নেই।”
মিসর-রাজ তৃতীয় টুথমোসিসের আমলের একখানি প্যাপিরাস দলীলে তাদের”আস্তাবলের শ্রমিক” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় আমেনোফিস তাদের ৩ হাজার ৬ শত জনকে কেনান থেকে বন্দী করে এনেছিলেন বলে জানা যায়। ফাদার দ্য ফক্স লক্ষ্য করেছেন যে তাদের মধ্যে অনেকে সিরীয়-ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিল। প্রথম সেথোসের আমলে (খৃষ্টপূর্ব ১৩০০ সাল) কেনানের বেথ-শিয়ান অঞ্চলে আপিরুগণ যথেষ্ট গোলযোগ সৃষ্টি করেছিল। দ্বিতীয় রামেসেসের আমলে তাদের কিছু লোককে খনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং কিছু লোককে মন্দিরের সুউচ্চ প্রবেশদ্বার নির্মাণের জন্য পাথর বহনের কাজে লাগানো হয়। বাইবেল থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, একই সময়ে তাদের মিসরের উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী শহর নির্মাণের কাজে নিয়োগ করা হয়। মিসরীয় রচনায় খৃষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে একবার আপিরুদের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় তৃতীয় রামেসেসের আমলে।
আপিরু শব্দটি কেবলমাত্র মিসরেই ব্যবহৃত হয়নি, সুতরাং এ শব্দে একমাত্র হিব্রুদেরই বুঝানো হয়েছে কিনা তা বলা কঠিন। শব্দটি দ্বারা মূলত হয়ত জবর-মজুর বা ক্রীতদাস বুঝানো হয়ে থাকতে পারে এবং পরে তা একটি পেশার নামে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি আধুনিক শব্দের ব্যবহারের নজীর স্মরণ করা যেতে পারে। ফরাসী ভাষায় সুইসি (সুইস) শব্দটির কয়েক প্রকার অর্থ আছে। সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী, ঐ দেশ থেকে প্রাচীন ফরাসী রাজার অধীনস্থ ভাড়াটিয়া সৈনিক, ভ্যাটিকানের প্রহরী বা খৃষ্টাণ চার্চের কর্মচারী।
তবে অবস্থা যাই হয়ে থাকুক না কেন ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসেসের আমলে তাদের দিয়ে যে কাজ করানো হয়েছিল তা যে জবর-মেহনত বা বাধ্যতামূলক শ্রম ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি যে ইহুদীদের উপরে জুলুম করতেন সে সম্পর্কেও কোন সন্দেহ নেই। বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে যে রামিসেস ও পিথম শহরের উল্লেখ আগে তা নীলনদ উপত্যকার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ঐ একই এলাকার বর্তমান যুগের তানিস ও কানতির শহর অবস্থিত এবং এ দুই শহরের ব্যবধান প্রায় পনের মাইল। দ্বিতীয় রামেসেসের নির্মিত রাজধানীও এ এলাকায় ছিও এবং তিনিই ইহুদীদের উপরে জুলুম করতেন।
এ পরিবেশ-পরিস্থিতিতেই মূসা জন্মগ্রহণ করেন। নদীর পানি থেকে তাঁর উদ্ধারের ঘটনাটি আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর একটি মিসরীয় নামও আছে। পি মনটেট তাঁর ইজিপ্ট এন্ড দি বাইবেল নামক গ্রন্থে (প্রকাশক ডিলাসক্স এন্ড নিসল, নিউফসাটেল, ১৯৫৯) দেখিয়েছেন যে, রাংক রচিত প্রতীক চিত্র ভাষার অভিধানে মানুষের প্রচলিত নামের তালিকায় মেসু বা মেসি নামটিও রয়েছে। কুরআনে অবশ্য মূসা নামই ব্যবহৃত হয়েছে।
মিসরে দুর্যোগ
বাইবেলে ‘প্লেগ’ শিরোনামে মিসরে আল্লাহর তরফ থেকে দশ রকমের গজব নাযিল হওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং প্রত্যেক গজবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি গজবের আবার অলৌকিক বৈশিষ্ট্যও বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে কেবলমাত্র পাঁচটি গজবের কথা আছে, এগুলির অধিকাংশই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তবে ব্যাপক আকারের বন্যা, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাং এবং রক্ত।
বাইবেলে ব্যাঙ ও পঙ্গপালের দ্রুত বংশবিস্তারের বর্ণনা আছে। নদীর পানি রক্ত হয়ে সমস্ত দেশ প্লাবিত হয়ে যাওয়ার কথাও আছে। কুরআনে রক্তের উল্লেখ আছে মাত্র, আর কোন বিবরণ নেই। স্পষ্টতই রক্তের উল্লেখের ভিত্তিতে নানাবিধ কল্পকাহিনীর অবতারণা করা যেতে পারে। বাইবেলে অন্যান্য যে সকল গজবের কথা আছে তা হচ্ছে বিষাক্ত পতঙ্গ, মাছির ঝাক, বিষফোঁড়া, শিলাবৃষ্টি, অন্ধকার, প্রথম সন্তানের মৃত্যু এবং গবাদি পশুর মৃত্যু। প্লাবন শুরু হওয়ার মত এ সকল গজবও নানাভাবে শুরু হয়েছে এবং বাইবেলের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে।
মহাযাত্রার পথ
কুরআনে মহাযাত্রার পথ সম্পর্কে কোন ইঙ্গিতই নেই। পক্ষান্তরে বাইবেলে বিস্তারিত বিবরণ আছে। ফাদার দ্য ফক্স এবং পি মনটেট উভয়েই এ বিষয়ে পুনরায় আলোচনার পথ খুলে দিয়েছেন। সম্ভবত তানিস কানতির অঞ্চল থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল, কিন্তু অবশিষ্ট পথের যে বর্ণনা বাইবেলে আছে তাঁর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তাছাড়া মূসা ও তাঁর দলবলের পার হয়ে যাওয়ার জন্য পানি যে ঠিক কোন জায়গায় বিভক্ত হয়েছিল তাও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
পানির অলৌকিক বিভক্ত
কোন কোন ভাষ্যকার মনে করেন যে, অলৌকিকভাবে পানি বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সম্ভবত জোয়ার-ভাটার কারণে অথবা দূরবর্তী কোন অগ্নিগিরিতে অগ্লুৎপাতের কারণে হয়ে থাকতে পারে। ভাটার সময় ইহুদীরা পার হয়ে থাকতে পারে এবং পরবর্তী জোয়ারের সময় মিসরীয়রা ডুবে গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এ সবই নিছক অনুমান মাত্র।
ফেরাউনদের ইতিহাসে মহাযাত্রার স্থান
সময়ের হিসেবে মহাযাত্র যে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে অবস্থিত সে সম্পর্কে আরও সঠিক প্রমাণ নির্ণয় করা সম্ভব। দ্বিতীয় রামিসেসের উত্তরাধিকারী মারনেপতাহ-ই যে মহাযাত্রার আমলের ফেরাউন এ ধারণা বহুদিন যাবত পোষণ করা হয়ে আসছে। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকের বিখ্যাত মিসরবিদ মাসপেরো তাঁর”ডীজিটাল গাইড টু দি কায়রো মিউজিয়াম” (১৯০০) গ্রন্থে লিখেছেনঃ” আলেকজান্দ্রিয়ার প্রবাদ মতে মারনেপতাহ-ই মহাযাত্রার আমলের ফেরাউন ছিলেন এবং লোহিত সাগরে ডুবে মরেছিলেন।” মাসপেরো যে দলীলের ভিত্তিতে এ কথা বলেছেন তা আমি হাতে পাইনি। কিন্তু তাঁর মত একজন বিশিষ্ট এবং সুবিখ্যাত ভাষ্যকারের উক্তি সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হওয়ার দাবী রাখে।
পি মনটেট ছাড়া অপর কোন মিসরবিদ বা বাইবেলবিদ এ ধারণার পক্ষে বা বিপক্ষে তেমন কোন গবেষণা করেননি। গত কয়েক দশকের মধ্যে অবশ্য এ বিষয়ে অনেক অনুমান উদ্ভাবন করা হয়েছ কিন্তু তাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে গ্রন্থের বর্ণনার একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যের দিকে আদৌ নজর দেননি। এবং গ্রন্থের বর্ণনা বলতে শুধু বাইবেলের বর্ণনাই বুঝায় না। তদুপরি প্রত্যেকটি অনুমানেরই যে ইতিহাস ও পুরাকীর্তির তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন আছে উদ্ভাবকগণ তাও তেমন খেয়াল করে দেখেননি।
কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত অনুমান করেছেন (১৯৬০) যে দ্য মিসেলি। তিনি একেবারে দিন-তারিখ নির্ণয় করে বলেছেন যে, খৃষ্টপূর্ব ১৪৯৫ সালের ৯ই এপ্রিল মহাযাত্রা হয়েছিল। তিনি পঞ্জিকার ভিত্তিতে হিসেব করে ঐ তারিখ নির্ণয় করেছেন এবং দাবী করেছেন যে ঐ সময় দ্বিতীয় টুথমোসিস মিসরের ফেরাউন ছিলেন। সুতরাং তিনিই হচ্ছেন মহাযাত্রার আমলের ফেরাউন। এ দাবীর সমর্থনে তিনি বলেছেন যে, দ্বিতীয় টুথমোসিস মমিতে গায়ের চামড়ায় ক্ষতচিহ্ন দেখা যায় এবং ঐ ক্ষতচিহ্ন কুষ্ঠরোগের ক্ষত। কিভাবে এবং অন্য কোন কারণে ঐ ক্ষত হয়নি কেন তা অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেননি। বাইবেলে বর্ণিত দশ গজবের মধ্যে একটি হচ্ছে ফোঁড়া। এ ফোড়াকেই তিনি কুষ্ঠরোগজাত মনে করে ঐ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিশেষত বাইবেলে যে রামিসেস শহর নির্মাণের উল্লেখ আছে তা থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, একজন রামিসেস ফেরাউন হওয়ার আগে মহাযাত্রা হয়নি।
তাছাড়া দ্বিতীয় টুথমোসিসের চামড়ার দাগ দেখেই তাকে মহাযাত্রার ফেরাউন বলে নির্ণয় করা যায় না। আরণ তাঁর পুত্র তৃতীয় টুথমোসিস এবং পৌত্র দ্বিতীয় আমিনোফিসের গায়েও ঐরূপ দাগ ছিল এবং কায়রো যাদুঘরে রক্ষিত তাদের মমিতে ঐ দাগ এখনও পরিষ্কার দেখা যায়। ভাষ্যকারগণ মনে করেন যে বংশজাত কোন রোগের কারণেই ঐ দাগ হয়ে থাকবে। সুতরাং মিসেলির অনুমান আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
একইভাবে ডানিয়েল রপসের অনুমানও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি তাঁর”পিপল অব দি বাইবেল” নামক গ্রন্থে (প্রকাশক- ডেসক্লি অব দ্য ব্রাউয়ার, প্যারিস ১৯৭০) দ্বিতীয় আমিনোফিসকে মহাযাত্রার আমলের ফেরাউন বল ঘোষণা করেছেন। তাঁর পিতা (তৃতীয় টুথমোসিস) খুবই জাতীয়তাবাদী মনোভাব সম্পন্ন ছিলেন। এ অজুহাতের ভিত্তিতে তিনি দ্বিতীয় আমিনোফিসকে ইহুদীদের উপরে জুলুমকারী বলে ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন যে তাঁর বিমাতা বিখ্যাত রাণী হাতশেপসূত শিশু মূসার লালন পালন করেছেন।
ফাদার দ্য ফক্স দ্বিতীয় রামিসেসকে মহাযাত্রার ফেরাউন বলে নির্ণয় করেছেন এবং তাঁর যুক্তি অনেকাংশে সংগত বলে মনে হয়। তিনি তাঁর”দি এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি অব ইজরায়েল” নামক গ্রন্থে (প্রকাশক-জে গাবালডা এন্ড কোং, প্যারিস, ১৯৭১) যা বলেছেন তা বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে সকল বিষয়ে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও তাঁর দাখিল করা একটি প্রমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রামিসেস ও পিথম শহর দ্বিতীয় রামিসেসের আমলেই নির্মিত হয়েছিল এবং খোদ বাইবেলেই এ নির্মাণকার্যের সংবাদ আছে। সুতরাং দ্বিতীয় রামিসেসের সিংহাসনে আরোহণের আগে মহাযাত্রা হয়েছিল একথা আর বলা যায় না। এ শহর নির্মাণের ঘটনা ড্রিওটন ও ভ্যানডিয়ার বর্ণিত কালক্রম মুতাবিক খৃষ্টপূর্ব ১৩০১ সালে বৌটন বর্ণিত কালক্রম মুতাবিক খৃষ্টপূর্ব ১২৯০ সালে ঘটেছিল। উপরে বর্ণিত অনুমান দুটি আরও যে একটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয় তা হচ্ছে এই যে, বাইবেলের বর্ণনা মুতাবিক দ্বিতীয় রামিসেসই হচ্ছেন ইহুদীদের উপরে জুলুমকারীফেরাউন।
ফাদার দ্য ফক্স মনে করেন যে, দ্বিতীয় রামিসেসের রাজত্বকালের প্রথমভাগে অথবা মধ্যভাগে মহাযাত্রা হয়েছিল। এ সময় নির্ণয় সুনির্দিষ্ট নয়। মনে হয় মূসা ও তাঁর অনুসারীদের কেনানে স্থিতিলাভ এবং মারনেপতার ইহুদীদের সঙ্গে সন্ধি করতে কিছু সময় দেয়ার জন্যই তিনি ঐভাবে সময় নির্ধারণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, পিতা দ্বিতীয় রামিসেসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করে ফেরাউন মারনেপতাহ ইহুদীদের সঙ্গে সমঝোতা করে সীমান্তে শান্তি স্থাপন করেছিলেন বলে তাঁর রাজত্বের পঞ্চম বছরের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়। কিন্তু এ অনুমানের বিরুদ্ধে দুটি মজবুত যুক্তি খাড়া করা যায়ঃ
(ক) বাইবেলে দেখা যায় যে, মূসা যখন মাদায়েনে অবস্থান করছিলেন তখন মিসরের রাজার মৃত্যু হয়, (যাত্রাপুস্তক ২, ২৩) বাইবেলের অন্যত্র এ রাজাকেই ইহুদীদের জবর-মেহনতের দ্বারা রামিসেস ও পিথম শহর নির্মাণকারী বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এ রাজা ছিলেন দ্বিতীয় রামিসেস। সুতরাং মহাযাত্রার ঘটনাটি তাঁর উত্তরাধিকারীর রাজত্বকালে ঘটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফাদার দ্য ফক্স বাইবেলের যাত্রাপুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৩ শ্লোকের এ বর্ণনার উৎস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন বলে জানিয়েছেন।
(খ) আরও তাজ্জবের ব্যাপার এই যে, জেরুসালেমের বাইব্লিক্যাল স্কুলের ডিরেক্টর হওয়া সত্ত্বেও ফাদার দ্য ফক্স তাঁর মহাযাত্রা বিষয়ক অনুমানে বাইবেলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদের আদৌ কোন উল্লেখ করেননি। অথচ এ দুটি অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে যে, পলায়নরত ইহুদীদের তাড়া করার সময় মিসর রাজের মৃত্যু হয়। এ বিবরণ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মহাযাত্রার ঘটনাটি একজন রাজার রাজত্বকালের শেষভাগে ছাড়া অন্য কখনও ঘটতে পারে না। কিন্তু ফাদার দ্য ফক্স প্রথম বা মধ্যভাগে ঘটেছিল বলে অনুমান করেছেন। এ প্রসঙ্গে পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইহুদীদের তাড়া করতে গিয়েই যে ফেরাউন প্রাণ হারিয়েছিলেন সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। কারণ, খোদ বাইবেলেই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বর্ণনা আছে।
“তখন তিনি আপন রথ প্রস্তুত করাইলেন এবং আপন লোকদিগকে সংগে লইলেন (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৬) । (মিসর রাজ ফেরাউন)”ইসরায়েল সন্তাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন, তখন তাহারা বহির্গমন করিতেছিল।” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৮) । এবং”জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল, তাহাতে ফেরাউনের যে সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮-২৯) । এছাড়া গীতসংহিতাতেও (১৩৬, ১৫) ফেরাউনের মৃত্যুর উল্লেখ করে ইশ্বরের স্তব করার আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে”তিনি ফেরাউন ও তাহার বাহিনীকে সুফ সাগরে ঠেলিয়া দিলেন।”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মূসার জীবদ্দশায় দুজন ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। মূসা যখন মাদায়েনে ছিলেন তখন একজন ফেরাউন মারা যান, এবং অপর জন ফেরাউন মারা যান মহাযাত্রার সময় সাগরের পানিতে ডুবে। স্পষ্টতই এ দুজন পৃথক পৃথক ফেরাউন। এ অবস্থায় মূসার আমলে মাত্র একজন ফেরাউন থাকার কথা মেনে নেয়া যেতে পারে না। অথচ ফাদার দ্য ফক্স একজন ফেরাউনের কথাই (দ্বিতীয় রামিসেস) বলেছেন। কিন্তু যেহেতু একজন ফেরাউন থাকলে সংশ্লিষ্ট সকল প্রশ্নের সন্তোষজক জবাব পাওয়া যায় না সেহেতু ফাদার দ্য ফক্সের অনুমান সঠিক বলে গ্রহণ করা যায় না।
৩) জুলুমের ফেরাউন দ্বিতীয় রামিসেস এবং মহাযাত্রার ফেরাউন মারনেপতাহ। এ পার্থক্যটি যথেষ্ট স্পষ্ট। মাসপেরো যে আলেকজান্দ্রিয়ান কিংবদন্তির উল্লেখ করেছেন পি মনটেট খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে তা ব্যবহার করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, টলেমিদের স্বর্ণযূগে প্রাচীন ঐতিহাসিক দলীলাদি আলেকজান্দ্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হত, এবং রোমান বিজয়ের সময় তা ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ক্ষতি এখন সকলেই গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।
যাহোক ঐ একই বর্ণনা বহুকাল পরের ইসলামী কিংবদন্তি এবং খৃষ্টান কিংবদন্তিতেও পাওয়া গেছে। (লক্ষণীয় যে, ধর্মীয় উপদেশের জন্য ব্যবহৃত বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের রচিত ইতিহাসে এবং আরবী এইচ লেসটার রচিত ইতিহাসে মহাযাত্রার ঘটনাটি মারনেপতার রাজত্বকালে মিসরে ঘটেছিল বলে উল্লেখিত হয়েছে) । মনটেট তাঁর”ইপিজপ্ট এন্ড দি বাইবেল নামক গ্রন্থে (প্রকাশক-ডিলাসক্স এন্ড নিসল, নিউশাতেল, ১৯৫৯) ঐ একই বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তার পোষকতায় অন্যান্য যুক্তিও আছে, বিশেষত কুরআনের বর্ণনায় তাঁর সমর্থন আছে, যদিও বিখ্যাত পুরাতত্ববিদ মনটেট কুরআনের হাওয়ালা দেননি। কিন্তু এ সকল তথ্য বিবেচনার আগে আমরা প্রথমে বাইবেলের দিকে নজর দেব।
যাত্রাপুস্তকে যদিও সংশ্লিষ্ট ফেরাউনের নামের উল্লেখ নেই, তবে”রামিসেস” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাইবেলে হিব্রুদের জবর মেহনতে নির্মিত একটি শহরের নাম”রামিসেস” বলে বর্ণিত আছে। এখন অবশ্য আমরা জানি যে, ঐ শহরগুলি পূর্ব নীল উপত্যকার তানিস-কানতির অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দ্বিতীয় রামিসেস যে এলাকায় তাঁর উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী নির্মাণ করেন সেখানে আগেও কিছু দালানকোঠা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক দশকের ভূতাত্বিক খননকার্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, দ্বিতীয় রামিসেসই স্থানটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত করেন এবং এ কাজে তিনি হিব্রুদের জবর মেহনতই ব্যবহার করেন।
বর্তমান যুগে বাইবেল”রামিসেস” শব্দটি পড়ে কেউ আর বিস্মিত হন না। দেড়শ বছর আগে শামপোলিয়ন চিত্রলিপির পাঠোদ্ধারের উপায় আবিষ্কার করে এ শব্দটির ব্যবহার নির্ণয় করেন এবং তখন থেকেই এ শব্দটি সকলের নিকট সাধারণ ভাবে পরিচিত। আমরা শব্দটি উচ্চারণ করতে, পড়তে এবং তাঁর অর্থ উপলব্ধি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, চিত্রলিপির মর্মার্থ খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছ এবং বাইবেল ও কতিপয় গ্রীক ও ল্যাটিন পুস্তক ছাড়া অন্য কোথাও নামটি সংরক্ষিত নেই। এমন কি ঐ সকল পুস্তকেও নামটি কমবেশী বিকৃত আকারে দেখতে পাওয়া যায়। ট্যাসিটাস তাঁর”অ্যানালস” গ্রন্থে শব্দটি”রহামসিস” রূপে ব্যবহার করেছেন। একমাত্র বাইবেলেই শব্দটি সঠিক আকারে অর্থাৎ”রামিসেস” রূপে দেখতে পাওয়া যায়। ওল্ড টেস্টামেন্ট অর্থাৎ তৌরাতের পাঁচ জায়গায় শব্দটির উল্লেখ আছে। আদিপুস্তক ৪৭, ১১; যাত্রাপুস্তক ১, ১১ ও ১২, ৩৭ এবং গণনাপুস্তক ৩৩, ৩ ও ৩৩, ৫।
হিব্রু ভাষায় রামিসেস শব্দটি দুভাবে লিখিত দেখা যায়”রাইমস” এবং রাইয়ামস (ইংরাজী ‘ই’ অক্ষরটি হিব্রু ‘আইন’ অক্ষরের সমপর্যায়ে ব্যবহৃত হয়) । বাইবেলের গ্রীক সংস্করণে শব্দটি ‘রামিসে’ হিসেবে লিখিত হয়েছে এবং ল্যাটিন সংস্করণে লিখিত হয়েছে”রামিসেস” রূপে। ফরাসী ভাষার ক্লিমেনটাইন পাঠে (প্রথম সংস্করণ ১৬২১) শব্দটি একইভাবে অর্থাৎ ‘রামিসেস’ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। শামপোলিয়নের গবেষণার সময় ফরাসী ভাষার এ সংস্করণটিই চালু ছিল এবং তিনি তাঁর ‘সামারি অব দি হাইরোগ্রিফিক সিসটেম অব দি এনসিয়েন্ট ইজিপশিয়ানস’ নামক গ্রন্থে (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮২৮, ২৭৬ পৃষ্ঠা ) শব্দটির বাইবেলে ব্যবহৃত বানানের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাইবেলের হিব্রু, গ্রীক ও ল্যাটিন সংস্করণে রামিসেসের নাম অলৌকিকভাবে সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাইবেলের প্রাচীন সংস্করণে ভাষ্যকারগণ শব্দটির অর্থ আদৌ অনুধাবন করতে পারেন নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ১৬২১ সালের ফরাসী ভাষার ক্লিমেনটাইন বাইবেলে শব্দটির যে অর্থ দেয়া হয়েছে তা হাস্যকর। বলা হয়েছে রামিসেস শব্দের অর্থ ‘হিংস্র প্রাণীর বজ্র’।
উপরের আলোচনা থেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে সহজেই উপনীত হওয়া যায়ঃ
(ক) রামিসেস নামের কোন ফেরাউনের মিসরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে মহাযাত্রা হয়নি এবং হওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। উল্লেখযোগ্য যে, মিসরে রামিসেস নামে এগার জন রাজা ছিলেন।
(খ) যে ফেরাউন রামিসেস ও পিথম শহর নির্মাণ করেছিলেন তাঁর অর্থাৎ দিতীয় রামিসেসের রাজত্বকালে মূসার জন্ম হয়েছিল।
(গ) মূসার মাদায়েনে অবস্থান কালে দ্বিতীয় রামিসেসের মৃত্যু হয় এবং মূসার জীবনের পরবর্তী ঘটনাবলী দ্বিতীয় রামিসেসের উত্তরাধিকারী মারনেপতাহর রাজত্বকালে ঘটে।
অধিকন্তু বাইবেলে আরও এমন কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য আছে যার ভিত্তিতে ফেরাউনদের ইতিহাসের ঠিক কোন পর্যায়ে মহাযাত্রা হয়েছিল তা নির্ণয় করা সম্ভব হতে পারে। বাইবেলে আছে মূসা তাঁর আশি বছর বয়সে তাঁর ভাইদের মুক্তি দেয়ার জন্য ফেরাউনকে রাজী করাতে চেষ্টা করেন।” মূসার বয়স যখন আশি এবং হারুণের তিরাশি তখন তারা ফেরাউনের সঙ্গে কথা বলেন।” (মহাযাত্রা ৭, ৭) । বাইবেলে অন্যত্র (মহাযাত্রা ২, ২৩) বলা হয়েছে যে, মূসার জন্মকালে যে ফেরাউন সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন তিনি মূসার মাদায়েনে অবস্থানকালে মারা যান। লক্ষ্যণীয় যে, বাইবেলে পরবর্তী ঘটনাবলীর বর্ণনায় রাজার নামের কোন পরিবর্তন উল্লেখ করা হয়নি। এ দুটি বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, মূসার মিসরে অবস্থানকালে যে দুজন ফেরাউন ছিলেন তাদের রাজত্বকালের মোট মেয়াদ কমপক্ষে আশি বছর ছিল।
দ্বিতীয় রামিসেসের রাজত্বকাল যে সাতষট্টি বছর ছিল তা প্রায় সঠিকভাবেই জানা যায়। ড্রিয়োটোন ও ভ্যান্ডিয়ারের হিসাব মতে এ মেয়াদ খৃষ্টপূর্ব ১৩০১ থেকে ১২৩৫ সাল পর্যন্ত এবং রৌটোনের হিসাব মতে ১২৯০ থেকে ১২২৪ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দ্বিতীয় রামিসেসের উত্তরাধিকার মারনেপতাহর ক্ষেত্রে অবশ্য মিসরবিদগণ কোন সঠিক তারিখ দিতে সক্ষম নন। তবে তাঁর রাজত্বকাল যে কমপক্ষে দশ বছর ছিল সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই কারন ফাদার দ্য ফক্স উল্লেখ করেছেন যে, দশ বছরের প্রমাণ দলীল মতেই পাওয়া যায়। ড্রিয়োটোন ও ভ্যানডিয়ার দুটি সমাভবনার কথা বলেছেন- খৃষ্টপূর্ব ১২৩৪ থেকে ১২২৪ পর্যন্ত দশ বছর, অথবা খৃষ্টপূর্ব ১২২৪ থেকে ১২০৪ পর্যন্ত বিশ বছর। মারনেপতহার রাজত্ব কিভাবে শেষ হয়েছিল সে সম্পর্কে মিসরবিদগণ কোন সুনিরদিষ্ট ইশারা দিতে পারেন না, তবে এটুকু সম্ভবতঃবলা যায় যে, তার মৃত্যুর পর পঁচিশ বছর যাবত মিসরে গুরুতর আভ্যন্তরীন গোলযোগ ছিল।
যাহোক এ সকল রাজত্বকালের মেয়াদ সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় রামিসেস ও মারনেপতাহ ছাড়া বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অমন কোন দুজন ফেরাউনের সন্ধান পাওয়া যায় না যাদের রাজত্বকালের মোট মেয়াদ আশি বছর পূর্ণ হয়েছে অথবা তাঁর চেয়ে বেশী হয়েছে। মূসা যখন হিব্রুদের উদ্ধার করেন তখন তাঁর বয়স আশি বছর ছিল, বাইবেলে এ তথ্য একমাত্র দ্বিতীয় রামিসেস ও তাঁর উত্তরাধিকারী মারনেপতাহর রাজত্বকালের সমষ্টিগত মেয়াদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম সিথোস ও দ্বিতীয় রামিসেসের রাজত্বকালের মোট মেয়াদও প্রায় আশি বছর ছিল বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ মেয়াদটি আমাদের বিবেচনার প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু হিসেবে আসতে পারে না। কারণ, প্রথমত প্রথম সিথোসের রাজত্বকাল খুবই কম ছিল বিধ্য মূসার যৌবনকালে মাদায়েনে সুদীর্ঘ অবস্থানের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ন হতে পারে না এবং দ্বিতীয়ত মূসার জীবনকালের দুজন ফেরাউনের মধ্যে প্রথম জনের রাজত্বকালে মূসা ঐ দীর্ঘ দিন মাদায়েনে ছিলেন বিধায় ঐ প্রথমজন ফেরাউন প্রথম মিথোস হতে পারেন না। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে বরং এ সত্যই প্রতিপন্ন হয় যে, মূসা দ্বিতীয় রামিসেসের রাজত্বকালের প্রথম দিকে জন্মগ্রহণ করেন, তার মাদায়েনে অবস্থানকালেই দ্বিতীয় রামিসেস সাতষট্টি বছর রাজত্ব করার পর মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং তারপর দ্বিতীয় রামিসেসের পুত্র মারনেপতাহ সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি মিসরে ফিরে এসে এ নতুন ফেরাউনের কাছ থেকে হিব্রুদের উদ্ধারের ব্যাপারটি উত্থাপন করেন। মারনেপতাহ বিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে যদি ধরা হয় তাহলে বলা যায় যে তাঁর কাছে মূসার হিব্রুদের উদ্ধারের প্রসঙ্গটি উত্থাপনের ঘটনা তাঁর রাজত্বকালের দ্বিতীয়ার্ধে ঘটেছিল। রৌটন এ সম্ভাবনাকেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেছেন। আরণ তাহলে মূসা মারনেপতাহর রাজত্বকালের শেষভাগে মহাযাত্রা পরিচালনা করেন বলে ধরা যায়। এ অবস্থার বিপরীত কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না, কারণ বাইবেল ও কুরআন এ উভয় গ্রন্থ থেকেই আমরা জানতে পারছি যে, পলায়নপর হিব্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়েই ফেরাউন নিহত হয়েছেন।
মূসার শৈশব এবং ফেরাউনের প্রাসাদে তাঁর আশ্রয় লাভের যে বর্ণনা ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় তাঁর সাথে এ ঘটনাপ্রবাহ হুবহু মিলে যায়। দ্বিতীয় রামিসেস যে অতিশয় বৃদ্ধ বয়সে মারা যান তা সর্বজনবিদিত। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স নব্বই থেকে একশো বছরের মধ্যে ছিল। এ হিসেবে দেখা যায় যে তিনি তেইশ থেকে তেত্রিশ বছরের মধ্যবর্তী সময়কালে ফেরাউন হয়েছিলেন এবং সাতষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি ফেরাউন হওয়ার আগেই বিয়ে করে থাকতে পারেন। সুতরাং তাঁর পরিবারের কোন সদস্যের মূসাকে কুড়িয়ে পাওয়া (কুরআন মতে), অথবা ফেরাউনের স্ত্রী কর্তৃক নীল নদের তীরে মূসাকে কুড়িয়ে পাওয়ার পর শিশুটিকে রাজপ্রাসাদে রাখার জন্য স্বামীর অনুমতি প্রার্থনার ঘটনায় কোনই এবং এ ঘটনার বিপরীত কোন তথ্য বা বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না। বাইবেলে বলা হয়েছে যে ফেরাউনের কন্যা মূসাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ফেরাউন হওয়ার সময় দ্বিতীয় রামিসেসের যে বয়স ছিল তাতে সংশ্লিষ্ট সময়ে তাঁর একটি কিশোরী কন্যা থাকা বিচিত্র ছিল না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এ বিষয়ে কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনার মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
এ প্রস্তাবনা কুরআনের বর্ণনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ এবং বাইবেলের একটিমাত্র বর্ণনার বিরোধী। বর্ণনাটি আমরা আগেই দেখেছি প্রথম রাজাবলি সহিফার ৬, ১ শ্লোকে লিখিত আছে। (মিসর দেশ হইতে ইসরায়েল সন্তানদের বাহির হইয়া আসিবার পর চারিশত আশি বৎসরে ইসরায়েলের উপরে শলোমনের রাজত্বের চতুর্থ বৎসরে দ্বিতীয় মাসে শলোমন সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে গৃহ নির্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন) । তবে উল্লেখযোগ্য যে এ সহিফা তৌরাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ বর্ণনাটি ব্যাপকভাবে বিতর্কিত এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের এ অংশে যে ঐতিহাসিক তথ্য আছে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে ফাদার দ্য ফক্স সরাসরি বাতিল করে দিয়েছেন।
লক্ষ্যণীয় যে বর্ণনায় সোলায়মানের ইবাদাতগাহ নির্মাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে মহাযাত্রার তারিখ নির্ণয় করা হয়েছে। বর্ণনাটি যেহেতু বিতর্কিত এবং সন্দেহযুক্ত সেহেতু উপরে বর্ণিত মহাযাত্রার ঘটনা প্রবাহের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি হিসেবে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
শিলালিপির সমস্যা
ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবন করা মারনেপতাহর রাজত্বকালের সর্বশেষ কাজ বলে মহাযাত্রার যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, সমালোচকগণ তাঁর বিরুদ্ধে একটি আপত্তি খুজে পেয়েছেন বলে মনে করেন। তারা মারনেপতাহর রাজত্বকালের পঞ্চম বছরের একখানি শিলালিপির উপরে নির্ভর করে এ আপত্তি উত্থাপন করে থাকেন।
শিলালিপিখানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চিত্রলিপির মধ্যে একমাত্র এ দলীলেই”ইসরায়েল” শব্দটির উল্লেখ আছে এবং তাঁর সঙ্গে এমন একটি গুণবাচক বিশেষণ আছে যা থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় যে কোন”মানব গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়” -এর প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছে। শিলালিপিটি থিবিতে ফেরাউনের স্মৃতিমন্দির থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তাতে লেখা ঘটনাবলীর বর্ণনা মারনেপতাহর রাজত্বকালের প্রথমদিক থেকেই শুরু হয়েছে। মিসরের প্রতিবেশী দেশসমূহের বিরুদ্ধে ফেরাউন মারনেপতাহ যে বিজয় লাভ করেন তাঁর উল্লেখ লিপির শেষের দিকে একটি বিশেষ বিজয়ের কথা বলা হয়েছে-”ইসরায়েল ধ্বংস করেন এবং তাঁর কোন বীজ অবশিষ্ট নেই।” এ বর্ণনার ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে যে,”ইসরায়েল” শব্দটির ব্যবহার থেকে এ কথাই বুঝা যায় যে, ইহুদীরা আগেই অর্থাৎ মারনেপতাহর রাজত্বের পঞ্চম বছরের মধ্যেই কেনানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। সুতরাং মিসর থেকে তাদের মহাযাত্রা আগেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।
এ প্রস্তাবনা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। এ আপত্তি মেনে নিতে হলে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে ইহুদীরা আগে কখনই কেনানে বাস করত না এবং তারা সর্বদাই মিসরেই ছিল। সুতরাং এ আপত্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ফাদার দ্য ফক্স দ্বিতীয় রামিসেসকে মহাযাত্রাকালীন ফেরাউন বলে গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর”দি এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি অব ইসরায়েল” নামক গ্রন্থে ইহুদীদের কেনানে বসতি স্থাপন সম্পর্কে বলেছেনঃ”ইসরায়েলীদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সম্প্রদায়গুলির দক্ষিণে কাদেশ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না এবং এ বসতি মহাযাত্রার আগের আমলের।” সুতরাং তিনি এ সম্ভাবনা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মূসা ও তাঁর সনগিদের আগেও কিছু লোক মিসর ত্যাগ করেছিল। আপিরু বা হাবিরু নামে অভিহিত লোকেরা (যাদের কখনও কখনও ইসরাইলের বলে সনাক্ত করা হয়) দ্বিতীয় রামিসেস ও মহাযাত্রার অনেক আগে থেকেই সিরিয়া-ফিলিস্তিনে বাস করত এবং দ্বিতীয় আমিনোফিস যে ৩৬০০ জন বন্দীকে জবরমজুর হিসেবে মিসরে ফিরিয়ে এনেছিলেন আমাদের কাছে তাঁর দালিলিক প্রমাণ আছে। তাছাড়া প্রথম সিথোসের আমলে কেনানে এ ধরনের আরও লোক ছিল এবং তারা বেথশিয়ান অঞ্চলে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিল। পি মনটেট তাঁর”ইজিপ্ট এন্ড দি বাইবেল” নামক গ্রন্থে এ বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে যে মারনেপতাহ সীমান্তের এসব বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন এবং দেশের ভিতরে যারা ছিল তারা মূসার নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে পরে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এ অনুমান মারনেপতাহর রাজত্বের পঞ্চম বছরের শিলালিপির বর্ণনার সঙ্গে আদৌ অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। পরস্পর বিরোধীও নয়।
তদুপরি ইহুদী জাতির ইতিহাসে”ইসরায়েল” শব্দটি উল্লেখিত থাকার সঙ্গে মূসা ও তাঁর অনুসারীদের কেনানে বসতি স্থাপনের ধারণার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। ইসরায়েল শব্দটির উৎস নিম্নরূপঃ
আদিপুস্তক (৩২, ২৯) মতে ইসরায়েল হচ্ছে ইব্রাহীমের পৌত্র এবং ইসহাকের পুত্র ইয়াকুবের দ্বিতীয় নাম। ‘একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন অব দি বাইবেল’ – ওল্ড টেস্টামেন্ট (১৯৭৫) গ্রন্থের ভাষ্যকারগণ মনে করেন যে, শব্দটির অর্থ সম্ভবত ‘আল্লাহ তাঁর শক্তিতে প্রকাশিত হলেন। ‘এ নামটি যেহেতু একজন মানুষকে দেয়া হয়েছিল সেহেতু তাঁর স্মৃতিতে তাঁর বংশধরদের ঐ নামে অভিহিত হওয়া বিচিত্র নয়।
সুতরাং”ইসরায়েল” নামটি মূসার কয়েকশত বছর আগেই চালু ছিল। সেহেতু ফেরাউন মারনেপতাহর আমলের শিলালিপিতে থাকার কারণেই মারনেপতাহর রাজত্বের পঞ্চম বছরের আগেই মহাযাত্রা হয়েছিল বলে ধরে নেয়ারও কোন যুক্তি নেই।
শিলালিপিতে”ইসরায়েল”নামে বর্ণিত একদল লোকের কথা বলা হয়েছে মাত্র। তাতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত কোন সম্প্রদায়ের প্রতি কোন ইশারা থাকতে পারে না। কারণ শিলালিপিটি খৃষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীর আগে ইসরায়েল রাজ্য আদৌ গঠিতই হয়নি। সুতরাং শিলালিপিতে কোন স্বল্প সংখ্যক লোকের সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, জেরুসালেম বাইব্লিক্যাল স্কুলের প্রফেসর ফাদার বি কেরিয়ার তাঁর”বুক অব এক্সোডাস” এর তরজমার ভাষ্যে (প্রকাশক-এডিশনস দ্যু সার্ক, প্যারিস, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ১২) বলেছেনঃ”সিহালালিপির অন্যান্য নামের সঙ্গে”দেশ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু ইসরায়েল নামের সঙ্গে ‘সম্প্রদায়’ ব্যবহার করা হয়েছে।
এখন আমরা জানি যে, আট অথবা নয় শতাব্দী যাবত প্রস্তুতি কালের পর ‘ইসরায়েল’ ইতিহাসে প্রবেশ করেছে। ঐ সময়ে বহু আধা যাযাবর সম্প্রদায় বিশেষত আমোরাইট ও আরামিয়ান সম্প্রদায় সমগ্র এলাকার বসতি স্থাপন করে। একই সময় ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব ইসরায়েলসহ অনেক গোত্রপতির আবির্ভাব হয়। ইয়াকুবের অপর নাম”ইসরায়েল” নামে তাঁর গোত্র পরিচিতি লাভ করে এবং এ গোত্রই পরে, মারনেপতাহর রাজত্বকালের অনেক পরে একটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে বিকশিত হয়। কেননা ইসরায়েল রাজ্য খৃষ্টপূর্ব ৯৩১ বা ৯৩০ থেকে ৮২১ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল।
৪) মহাযাত্রায় ফেরাউনের মৃত্যু বিষয়ে ধর্মগ্রন্থের বিবরণঃ
মহাযাত্রার সময় ফেরাউনের মৃত্যুর ঘটনাটি কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উভয় গ্রন্থের মূল পাঠেই বিষয়টি লক্ষ্যণীয়ভাবে উপস্থিত আছে। বাইবেলে কেবলমাত্র পেন্টাটিউক বা তৌরাতের নয়, গীতসংহিতা অধ্যায়েও বিষয়টির উল্লেখ আছে এবং এ প্রসঙ্গটি পূর্বেও উলেখ করা হয়েছে।
আশ্চর্যের কথা এই যে, খৃষ্টান ভাষ্যকারগণ ঘটনাটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। ফাদার দ্য ফক্স বলেছেন যে, মিসর থেকে যে মহাযাত্রা হয়েছিল তা দ্বিতীয় রামিসেসের রাজত্বকালের প্রথমার্ধে বা মধ্যভাগে হয়েছিল। কিন্তু তিনি বোধহয় লক্ষ্য করেননি যে ঐ ফেরাউন মহাযাত্রার সময়ই মারা গিয়েছিলেন। অর্থাৎ এ ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয়ে যায় যে, মহাযাত্রা তাঁর রাজত্বের শেষভাগেই হয়েছিল। অথচ বাইবেলের তৌরাত ও গীতসংহিতায় প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে তাঁর বক্তব্য যে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয় এ বিষয়ে জেরুসালেম বাইব্লিক্যাল স্কুলের প্রধান ও এনসিয়েন্ট হিস্ট্রী অব ইসরায়েল গ্রন্থের লেখক আদৌ চিন্তিত নন।
পি মনটেট তাঁর ইজিপ্ট এন্ড দি বাইবেল গ্রন্থের বলেছেন যে, মহাযাত্রা মারনেপতাহর আমলে হয়েছিল। কিন্তু হিব্রুদের পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি।
খৃষ্টানদের এ অতিশয় আশ্চর্যজনক মনোভাব ইহুদীদের দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিরোধী। গীতসংহিতার ১৩৬, ১৫ স্তোত্রে আল্লাহকে শুকরিয়া জানানো হয়েছে, কেননা তিনি”ফেরাউন ও তাহার বাহিনীকে সুফ সাগরে নিমজ্জিত করিলেন।” ইহুদীদের প্রার্থনায় এ স্তোত্রটি হামেশা পাঠ করা হয়ে থাকে। খৃষ্টানগণ আরও জানেন যে, গীতসংহিতার এ বর্ণনার সঙ্গে যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮-২৯ স্তোত্রের সম্পূর্ণ মিল আছে-”জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল, তাহাতে ফেরাউনের যে সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না।” সুতরাং ফেরাউন ও তাঁর বাহিনী যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়েছিল সে সম্পর্কে তাদের মনে কোনই সন্দেহ থাকার কথা নয় এবং এসব কথা তাদের বাইবেলেই রয়েছে।
অথচ খৃষ্টান ভাষ্যকারগণ সকল সাক্ষ্য প্রমাণের বিপরীত উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ফেরাউনের মৃত্যুর ঘটনাটি উপেক্ষা করে থাকেন। তাদের মধ্যে অনেকে আবার আরও এক কদম এগিয়ে গিয়ে কুরআনে বর্ণিত ঘটনাটির উল্লেখ করে পাঠকদের আজগুবি ধারণায় প্ররোচিত করে থাকেন। জেরুসালেম বাইব্লিক্যাল স্কুলের অনুমোদিত ও প্রকাশিত বাইবেলের তরজমায় (ল্য এক্সোড-এক্সোডাস ১৯৬৮, ৭৩ পৃষ্ঠা, প্রকাশক-লেস এডিশনস ড্যু সার্ফ, প্যারিস) ফাদার কৌরয়্যার ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কিত ভাষ্যে বলেছেন-“কুরআনে (সূরা ১০, আয়াত ৯০-৯২) এ ঘটনাটির (ফেরাউনের মৃত্যু) উল্লেখ আছে এবং জনপ্রিয় প্রবাদ আছে যে, সেনাবাহিনী সহ নিমজ্জিত ফেরাউন (হোলি টেক্সটে যার কোন উল্লেখ নেই) সমুদ্রের তলদেশে বাস করেন এবং সেখানকার মানুষ অর্থাৎ সিলমাছদের রাজা হিসেবে রাজত্ব করেন।”
“হোলি টেক্সট” বা পবিত্র পাঠ বলতে ভাষ্যকার সাহেব স্পষ্টতই বাইবেলের কথা বলেছেন, এবং সেই গ্রন্থে সেনাবাহিনী সহ ফেরাউনের নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ নেই বলে একটি উদ্দেশ্যমূলক অসত্য বলেছেন। দ্বিতীয়, কুরআনের বর্ণনাটির উল্লেখ তিনি এমনভাবে করেছেন যাতে মনে হয় যে, ঐ বর্ণনা বাইবেলের সম্পূর্ণ বিরোধী। তৃতীয়, কুরআনের বর্ণনার উল্লেখ করার পরই তিনি তথাকথিত জনপ্রিয় প্রবাদের নামে একটি আজগুবি কাহিনীর অবতারণা এমনভাবে করেছেন যার ফলে অসতর্ক সাধারণ পাঠক এবং বিশেষত কুরআনের অনবহিত পাঠকের মনে এরূপ একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হবে যে, কুরআনের বর্ণনার সঙ্গে ঐ আজগুবি কাহিনীর সম্পর্ক আছে। অথচ ঐ ভাষ্যকার সাহেব যেদিকে ইশারা করেছেন কুরআনের আয়াতের বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাঁর আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। কুরআনের ১০ সূরার (ইউনুস) ৯০-৯২ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, ফেরাউন ও তাঁর বাহিনী যখন পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন তখন ইসরায়েল সন্তানগণ সাগর পার হয়ে যায় এবং ফেরাউন নিমজ্জিত হওয়ার সময় আর্তনাদ করে বলে-“আমি বিশ্বাস করিলাম যে, বনি ইসরায়েল যাহাতে বিশ্বাস করে তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নাই এবং আমি আত্মসমর্পনকারীদিগের অন্তর্ভুক্ত।” আল্লাহ জবাব দিলেন”এখন ! ইতিপূর্বে তো তুমি অমানু করিয়াছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদিগের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। আজ আমি তোমার দেহ চরাভূমিতে রক্ষা করিব যাহাতে তুমি তোমার পরবর্তীদিগের জন্য নিদর্শন হইয়া থাক।”
ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কে সূরায় এ বর্ণনাটুকুই আছে। এ সূরায় অথবা কুরআনের অন্যত্র কোথাও বাইবেলের ভাষ্যকার বর্ণিত ঐ আজগুবি কিচ্ছা নেই। কুরআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ফেরাউনের দেহ রক্ষা করা হবে এবং এ তথ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কুরআন যখন নাযিল হয় তখন মহাযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে (সঠিকভাবে বা বেঠিকভাবে) বর্তমানে বিবেচিত সকল ফেরাউনের লাশ লুকসর থেকে নীল নদের অপর পারে অবস্থিত থিবিসের গোরস্তানে কবর ছিল। কিন্তু তখন এ খবর কারো জানা ছিল না এবং অনেক দিন পরে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ঐ কবরগুলি আবিষ্কৃত হয়। কুরআনে যেমন বলা হয়েছে, মহাযাত্রাকালীন ফেরাউনের লাশ সত্যিই উদ্ধার করা হয়েছে এবং তাঁর নাম যাই হোক না কেন কায়রোর মিসরীয় যাদুঘরের রাজকীয় মমিঘরে এখন যে কেউ সেই লাশ দেখতে পারেন। সুতরাং ফাদার কৌরয়্যার কুরআনের সঙ্গে যে কিচ্ছা জুড়ে দিতে চেয়েছেন সত্য ঘটনা তাঁর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
(৫) ফেরাউন মারনেপতাহর মমিঃ
সকল সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, লোরেট ১৮৯৮ সালে রাজাদের উপত্যকায় (কিংস ভ্যালি) থিবিসে দ্বিতীয় রামিসেসের পুত্র ও মহাযাত্রাকালীন ফেরাউন মারনেপতাহর মমিভূত লাশ আবিষ্কার করেন এবং সেখান থেকে কায়রোয় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯০৭ সালের ৮ই জুলাই তারিখে এলিয়ট স্মিথ এ মমির আবরণ অপসারণ করেন এবং তিনি তাঁর”দি রয়্যাল ম্যমিজ” নামক গ্রন্থে (১৯১২) এ প্রক্রিয়া এবং লাশ পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। কয়েকটি জায়গায় কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া সত্ত্বেও ম্যমিটি তখন সন্তোষজনকভাবেই সংরক্ষিত ছিল এবং তখন থেকেই তা মাথা ও গলা খোলা এবং অবশিষ্ট দেহ কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় দর্শকদের দেখার জন্য কায়রো যাদুঘরে রাখা আছে। সম্ভবত ক্ষতি হওয়ার আশংকায় লাশের ঢাকা আর খুলতে দেয়া হয় না এবং সেই ১৯১২ সালে এলিয়ট স্মিথের তোলা ছবি ছাড়া পুরো লাশের আর কোন ছবি যাদুঘরে নেই।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে মিসরের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ মেহেরবাণী করে আমাকে লাশের ঢাকা অংশ খুলে পরীক্ষা করার এবং ছবি তোলার অনুমতি দেন। মমিটির বর্তমান অবস্থার সঙ্গে ষাট বছর আগের অবস্থার তুলনা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে অবস্থার অবনতি ঘটেছে এবং কিছু কিছু টুকরো এখন আর আদৌ নেই। লাশের মমিকরা অনেক টিস্যু কোথাও মানুষের হাতে এবং কোথাও সময়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে সংরক্ষণ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষতি খুবই স্বাভাবিক। আবিষ্কৃত হওয়ার আগে মমিটি তিন হাজার বছরেরও বেশী সময় যাবত থিবিসের গোরস্তানে কবরে ছিল। বর্তমানে মমিটি একটি সাধারণ কাঁচের আবরনে রাখা আছে। ফলে বাতাস সূক্ষ্ম কণা প্রভৃতি বাইরের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থেকে সুরক্ষিত নয়। তদুপরি তাপমাত্রার উঠানামা এবং বাতাসের আর্দ্রতার মওসুমী পরিবর্তনও তাঁর উপরে প্রতিনিয়ত প্রভাব ফেলছে। প্রায় তিন হাজার বছর যাবত মমিটি যে পরিবেশে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ছিল বর্তমা পরিবেশ তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার গায়ে জড়ানো আবরণের সেই প্রতিরোধ এখন আর নেই। কবরে থাকার সময় সম্ভবত সেই প্রাচীনকালে গুপ্তধন সন্ধানী তস্করেরা হয়ত কিছুটা ক্ষতি করে থাকতে পারে, কীটের আক্রমণও হয়ে থাকতে পারে; তবে অবস্থা দেখে মনে হয় বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেই তুলনায় মমিটি তখন অনেক অনুকূল পরিবেশে ছিল।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে আমার সফরকালে আমার সুপারিশক্রমে কর্তৃপক্ষ মমিটি বিশেষভাবে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেন। ডাঃ আল-মেলিজি ও ডাঃ রামসাইস মমির এক্সরে ছবি তোলেন এবং তাঁর ভিত্তিতে তাদের অভিমত লিপিবিদ্ধ করেন। ডাঃ মর্নিয়ালাবি পেট পরীক্ষা করেন এবং গলার কাছের একটি গতিপথে বুকের অভ্যন্তর ভাগ পরীক্ষা করে দেখেন। তার ফলে আমরা দেহের অভ্যন্তর ভাগের অবস্থা ভালোভাবে দেখতে এবং তাঁর ছবি তুলতে সক্ষম হই। এছাড়া প্রফেসর সিকালডি একটি সাধারণ চিকিৎসা ও আইন শাস্ত্রীয় পরীক্ষাও শুরু করেছেন। মমির দেহ থেকে আপনা-আপনি খসে পড়া আবরণখত অনুবীক্ষন যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষার পর সমগ্র প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত হবে। প্রফেসর মাইনট ও ডাঃ ডুরিগণ এ পরীক্ষা চালাবেন।
এ গ্রন্থ ছাপাখানায় পাঠানোর সময় (প্রথম ফরাসী সংস্করণ, নভেম্বর, ১৯৭৫) পরীক্ষার প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়নি। সুতরাং তাঁর ফলাফল এখানে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব না।
তবে ইতিমধ্যে এটুকু নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে যে, হাড়ের স্থানে স্থানে ক্ষতের চিহ্ন আছে এবং স্থানবিশেষে হাড়ের অংশবিশেষ নেই। এ অবস্থা ফেরাউনের মৃত্যুর আগে না পরে হয়েছে তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যু ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা মুতাবিক পানিতে ডুবে থাকতে পারে, অথবা ডুবে যাওয়ার পূর্বমুহুর্তে ভীতিপ্রসূত মারাত্মক মানসিক আঘাতজনিত কারনে হয়ে থাকতে পারে, অথবা উভয় প্রকারের সম্মিলিতকারণে হয়ে থাকতে পারে।
উপরে বর্ণিত মমির সংরক্ষণের অসুবিধা এবং বিশেষত হাড়ের ক্ষতির ব্যাপারটি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। ফলে অবিলম্বে ক্ষয় প্রতিরোধ এবং সংরক্ষণের উন্নততর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে মমিটি বোধ হয় বেশী দিন অক্ষত অবস্থায় রাখা যাবে না। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মহাযাত্রায় ফেরাউনের মৃত্যু ও তাঁর লাশ উদ্ধার যে আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে, এ মমিই তাঁর সাক্ষ্য ও প্রমাণ। সুতরাং সময়ের পরিক্রমায় এ সাক্ষ্য-প্রমাণ যাতে হারিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা বিশেষভাবেই প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক চিহ্ন-দ্রব্য সংরক্ষণ করা মানুষের স্বাভাবিক কর্তব্য। কিন্তু এ মমিটির ক্ষেত্রে সেই কর্তব্য অনেক বেশী বড় ও ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ এ মমি হচ্ছে এমন একজন মানুষের লাশের বাস্তব উপস্থিতি যিনি মূসাকে চিনতেন, তার হেদায়েত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তার পলায়নকালে তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন এবং সেই প্রক্রিয়ায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর কুরআনের বর্ণনা মুতাবিক তাঁর লাশ পরবর্তী মানুষের জন্য চিহ্ন হওয়ার নিমিত্ত আল্লাহর হুকুমে ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
মারনেপতাহর মমির মত মূসার কাহিনীর আর একজন চাক্ষুস সাক্ষী দ্বিতীয় রামিসেসের মমিও সম্প্রতি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রতিরোধ ও সংরক্ষণ ইয়বস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
[ইংরেজী অনুবাদকের টিকা-১৯৭৫ সালে কায়রোতে যে পরিক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় তাঁর ফলাফল হাতে পাওয়ার পর গ্রন্থকার ডাঃ মরিস বুকাইলি ১৯৭৬ সালের প্রথম ভাগে ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিনসহ কতিপয় ফরাসী জ্ঞানী সমিতির সভায় তা পড়ে শুনান। এ পরীক্ষায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিসর সরকার চিকিৎসার জন্য দ্বিতীয় রামিসেসের মমি ফ্রান্সে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই মুতাবিক মমিটি ১৯৭৬ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর প্যারিসে পৌছেছে।]
ধর্মগ্রন্থের বর্ণনার সত্যতার পোষকতায় যারা আধুনিক তথ্যের সন্ধান করেন তারা কায়রোর মিসরীয় যাদুঘরের রয়্যাল ম্যমিজ রুমে গেলেই ফেরাউনের লাশ সম্পর্কিত আল-কুরানের আয়াতের বাস্তব চিত্র দেখতে পাবেন।