কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান
ভূমিকা
কুরআন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক, কারন থেকে ফলের যুক্তির ধারায় বিস্ময়কর; বিশেষত যখন দেখা যায় যে, ঐ সম্পর্ক হচ্ছে মিলের, অমিলের নয়। আজক্লা অনেকেই মনে করেন যে, ধর্মীয় গ্রন্থের সঙ্গে বিজ্ঞানের ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণার মুকাবিলা একটি গোলকধাধা বিশেষ। অল্প কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া, বর্তমান যুগে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই বস্তুতন্ত্রের বেড়াজালে আটক হয়ে আছেন। ধর্মকে তারা কিংবদন্তি ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না এবং ধর্মীয় ব্যাপারে তারা হয় উদাসীন থাকেন, আর না হয় সরাসরি ঘৃণা পোষণ করেন। তাছাড়া পাশ্চাত্যে যখন ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা হয়, তখন লোকে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের কথাই উল্লেখ করে থাকে, ইসলামের কথা কেউ কখনও চিন্তাও করে না। আসলে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ইসলাম সম্পর্কে এমন ব্যাপক ভুল ধারণা প্রচারিত হয়েছে যে, প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা পাওয়া সেখানে সত্যিই কঠিন।
ইসলাম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে কোন তুলনামুলক আলোচনায় যাবার আগে ইসলামের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ, পাশ্চাত্যে এ ধর্মটি অতি অল্পই পরিচিত।
কখনও অজ্ঞানতার কারণে এবং কখনও হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্যে ইসলাম সম্পর্কে নানাবিধ ভুল উক্তি ও মন্তব্য করা হয়ে থাকে। এ জাতীয় উক্তির মধ্যে তথ্য বিষয়ক উক্তিগুলিই সবচেয়ে মারাত্মক; কারণ, ধারণার ভ্রান্তি হয়ত ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তথ্যের স্থলে কোন বানোয়াট তথ্য পেশ করা হলে তা ক্ষমার অযোগ্য হয়ে পড়ে। পাশ্চাত্যের অনেক জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তি তাদের রচনায় এমন সরাসরি মিথ্যাও স্থান দিয়েছেন যে, তা পড়ে রীতিমত বিক্ষুব্ধ হতে হয়। এরূপ একটি উদাহরণ ‘ইউনিভার্সালিস এনসাইক্লোপিডিয়া’ ষষ্ঠ খন্ড থেকে উধৃত করছি। ‘গসপেল’ শিরোনামের আলোচনায় লেখক বাইবেলের সঙ্গে কুরআনের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন-”কুরআনের ক্ষেত্রে যেমন করা হয়েছে, বাইবেলের ক্ষেত্রে ইভানজেলিস্টগণ তেমন কোন দাবী করেন নি যে, ইশ্বর অলৌকিকভাবে নবীর কাছে যে আত্মজীবনী বর্ণনা করেছেন, তাই তারা পৌছে দিচ্ছেন মাত্র।” কিন্তু কুরআন তো কোন আত্মজীবনী নয়। লেখক যদি কুরআনের কোন নিকৃষ্টতম তরজমাও নেড়েচেড়ে দেখতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন যে, কুরআন আসলে শিক্ষাদানের গ্রন্থ; পথ প্রদর্শনের গ্রন্থ। কিন্তু তিনি তা করেননি এবং না জেনে না শুনেই তিনি ঐ মিথ্যা উক্তি করেছেন। অথচ তিনি লিয়নের জেসুইট ফ্যাকালটি অব থিউলজির একজন জ্ঞানবান অধ্যাপক। এ ধরনের মিথ্যা উক্তির ফলেই কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিমধ্যে অবশ্য নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, বিভিন্ন ধর্ম এখন আর আগের মত অন্তর্মুখী নেই। তারা পরষ্পরের মধ্যে স্মঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। রোমান ক্যাথলিকরা যে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন, এ খবর শুনে সকলেই আশা করি আনন্দিত হবেন। তারা নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞানতা দূর করা এবং ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের জন্য চেষ্টা করছেন।
বিগত কয়েক বছরে যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে, এ গ্রন্থের ভূমিকায় আমি তা উল্লেখ করেছি, এবং ভ্যাটিক্যানের অফিস ফর নন-ক্রিশ্চিয়ান এফেয়ার্স প্রকাশিত ‘ওরিয়েন্টেশনস ফর এ ডায়ালগ বিটুইন ক্রিশ্চিয়ানস এন্ড মুসলিমস’ নামক একখানি পুস্তিকার কথাও বলেছি। ইসলাম সম্পর্কে গৃহীত নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিবরণ আছে বিধায় এ পুস্তিকা একখানি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দলীল। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত উক্ত পুস্তিকার তৃতীয় সংস্করণে”ইসলাম সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন এবং আমাদের বিদ্বেষ বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করে দেখার” আহবান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে-”যে নজরে আমাদের খৃষ্টান ভাইয়েরা দেখে থাকেন, প্রথম পদক্ষেপে তা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্বেষ ও নিন্দাবাদে বিকৃত যে প্রাচীন ছবি আমরা অতীতকাল থেকে মিরাসী সুত্রে পেয়েছি, তা অপসারন করতে হবে; এবং মুসলমানদের প্রতি অতীতে আমরা যে অবিচার করেছি, তা স্বীকার করে নিতে হবে। আরও স্বীকার করে নিতে হবে যে, খৃষ্টান শিক্ষায় শিক্ষিত পাশ্চাত্যই এ অবিচারের জন্য দায়ী।”
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অতীতে এমন এক সময় ছিল, যখন যে কোন আকারে বা প্রকারে ইসলামের বিরোধীতা বা শত্রুতা করা হলে এবং এমন কি তা চার্চের ঘোষিত ও পরিচিত শত্রুদের দ্বারা করা হলেও ক্যাথলিক চার্চের উচ্চতম পর্যায়ের নেতারা তাঁর প্রতি সানন্দে সমর্থন জানাতেন। উদাহরণ স্বরূপ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম ধর্মযাজক (পনাটিক) হিসাবে পরিচিত পোপ চতুর্দশ বেনেডিক্টের কথা বলা যেতে পারে। ভলটেয়ার তাঁর রচিত”মুহাম্মদ বা ধর্মান্ধতা” (মুহাম্মদ অর ফ্যানাটিসিজম, ফরাসী ভাষায় ম্যাহোমেট আওলে ফ্যানাটিসমে, ১৯৪১) নামক একখানি গ্রন্থ পোপের নামে উৎসর্গ করলে তিনি সেজন্য বিনা দ্বিধায় তাকে আশির্বাদ পাঠান অথচ গ্রন্থখানি ছিল অতিশয় নিকৃষ্টোমানের, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে পরিপূর্ণ একখানি বিয়োগান্ত নাটক এবং কলম ধরতে সক্ষম ও দুরভিসন্ধি দ্বারা প্রণোদিত যে কোন চতুর ব্যক্তিই যে কোন বিষয়ে এরূপ একখানি গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম। মঞ্চে নাটকটি তেমন সফল হয়নি, কিন্তু তথাপি খৃষ্টান দর্শকরা সানন্দে সমর্থন জানিয়েছে এবং একমাত্র সে কারণে শেষ পর্যন্ত ফরাসী বিয়োগান্ত নাটকের সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ভ্যাটিক্যানের ঐ পুস্তকটিতে মোট ১৫০ পৃষ্ঠার বিবরণ আছে এবন ইসলাম সম্পর্কে খৃষ্টানদের প্রাচীন মতবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা হয়েছে।
“আমাদের নিকৃষ্টতম বিদ্বেষ ও সংস্কার থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রয়াস’ শিরোনামে লেখকরা খৃষ্টানদের লক্ষ্য করে বলেছেন-” এ ক্ষেত্রেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সার্বিকভাবে পবিত্র করার জন্য সমর্পন করতে হবে। বিশেষত আমরা যে সকল ‘পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের’ কথা বলতে চাই, যা প্রায়শ এবং অতিশয় হালকাভাবে ইসলাম সম্পর্কে গ্রহন করা হয়ে থাকে। আমরা যাতে আমাদের অন্তরের অন্তস্থলেও এরূপ কোন কারন নিষ্ঠাবান মুসলমানরা আমাদের এ জাতীয় ধারণাকে বিভ্রান্তিকর বলেই মনে করে।”
এ জাতীয় ধারণার একটি নমুনা হচ্ছে এই যে, মুসলমানদের ‘গড’ বুঝানোর জন্য খৃষ্টানরা হামেশা ‘আল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, অর্থাৎ তারা যেন বলতে চান যে, মুসলমানরা যে গডে বিশ্বাস করেন, তিনি খৃষ্টান গড থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক সত্তা। আরবী ভাষায় আল্লাহ শব্দের অর্থ ডিভিনিটি, আসমানী সত্তা। একক ও অনন্য গড অর্থাৎ ইংরাজী ভাষার একমাত্র গড শব্দ দ্বারাই ঐ আরবী শব্দটির তাৎপর্য প্রকাশ করা যেতে পারে। মুসলমানরা যাকে আল্লাহ বলে থাকেন, তিনি মূসা ও যিশুর গড ছাড়া অপর কেউ নন।
ভ্যাটিক্যানে অখৃষ্টান বিষয়ক অফিস থেকে যে দলীল প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে এ মৌলিক বিষয়টির উপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে-”আল্লাহ আসলে গড নন, এরূপ ধারণা পোষণ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। অথচ পাশ্চাত্যের কোন কোন মহল তাই মনে করে থাকেন। খৃষ্টীয় পরিষদের দলীলসমুহে এ ভ্রান্ত ধারণা অপনোদন করে যথাস্থানে প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে। লুমেন জেনটিয়ামের (১৯৬২-৬৫ সালের দ্বিতীয় ভ্যটিক্যান কাউন্সিলে প্রণীত একটি দলীলের নাম) একটি অভিমত উধৃত করে গড- এর উপর মুসলমানদের বিশ্বাসের উৎকৃষ্টতম নজীর ও ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। ঐ অভিমতে বলা হয়েছে-”মুসলমানরা ইব্রাহীমের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং আমাদের সঙ্গে সেই একক করুণাময় গডের ইবাদত করেন, যিনি শেষ বিচারের দিনের একমাত্র বিচারক।”
সুতরাং বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় গড লেখার বদলে আল্লাহ লেখার বিরুদ্ধে মুসলমানরা যে কেন প্রতিবাদ করে থাকেন, তা সহজেই বোধগম্য। এ একই কারণে কুরআনের ফরাসী তরজমায় ‘অবশেষ’ আল্লাহ’ শব্দটির বদলে ডিউ (গড) শব্দ ব্যবহার করায় পন্ডিত মুসলমানরা ডি ম্যাসনের প্রসংসা করেছেন।
ভ্যাটিক্যানের ঐ দলীলে বলা হয়েছে-”গড বুঝানোর জন্য আরবী ভাষী খৃষ্টানদের একটি মাত্র শব্দ আছে, এবং তা হচ্ছে আল্লাহ।”
মুসলিম ও খৃষ্টানগণ এক ও একক গডের ইবাদত করে থাকেন।
ঐ দলীলে অতঃপর ইসলাম সম্পর্কিত অন্যান্য ভ্রান্ত মতবাদ বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।
ইসলামে অদৃষ্টবাদ আছে, এরূপ একটি ভ্রান্ত ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে। দলীলে এ ধারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে এবং কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, মানুষের নিজস্ব ব্যাক্তিগত দায়িত্ব আছে এবং তাকে তাঁর কাজের ভিত্তিতেই বিচার করা হবে। বল প্রয়োগের মারফত ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা ইসলামী নীতিতে বৈধ বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, দলীলে তারও বিরোধীতা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এ নীতিতে বিশ্বাস করাও ইসলাম বিরোধী। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের নিম্নবর্ণিত দুটি আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এ আয়াত দুটি সম্পর্কে পাশ্চাত্যে অনেক বিভ্রান্তি আছেঃ
“ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই” – সূরা-বাকারা, আয়াত ২৫৬।
” (আল্লাহ) ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি।” সূরা-হজ্জ, আয়াত-৭৮।
ইসলাম ভীতির ধর্ম বলে যে ধারণা প্রচার করা হয়ে থাকে, তার প্রতিবাদ করে দলীলে বলা হয়েছে যে, ইসলাম আসলে প্রেমের ধর্ম। আল্লাহ ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিবেশীকে ভালোবাসাই ইসলামের শিক্ষা। ইসলামে নৈতিকতা নেই বরং ধর্মান্ধতা আছে, ইহুদী ও খৃষ্টানদের এ ধারণা সম্পর্কে ভ্যাটিক্যান দলীলে বলা হয়েছে যে, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা -“খৃষ্টান ধর্ম যখন ইতিহাসে রাজনৈতিক গুরুত্ব লাভ করেছে, তখন যতখানি গোড়ামিপূর্ণ ছিল, ইসলাম কখনও তাঁর চেয়ে বেশী গোড়ামীপূর্ণ ছিল না। এ প্রসঙ্গে কুরআন থেকে উধৃতি দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, পাশ্চাত্যে”জিহাদ” শব্দটির ভুল তরজমা করা হয়ে থাকে -”আরবী ভাষায় কথাটি হচ্ছে আল-জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় প্রচেষ্টা চালানো। আর এ প্রচেষ্টা হচ্ছে ইসলাম প্রচারের জন্য, এবং ইসলামকে আক্রমনকারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য। এ জিহাদ বাইবেলের ‘খেরেম’ নয়; ধ্বংসের জন্য পরিচালিত নয়, বরং নতুন নতুন দেশে আল্লাহর ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতে জিহাদের সময় বলপ্রয়োগ ও রক্তপাত হয়েছে বটে, কিন্তু তা জিহাদের কারণে হয়নি, হয়েছে যুদ্ধের সাধারণ নিয়ম অনুসারে। তাছাড়া ক্রুসেডের সময় কেবল মুসলমানরাই জঘন্য হত্যা কান্ড চালায়নি।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আল-কুরআনের তরজমাকারীগণ, এমনকি এ ক্ষেত্রে যারা বিখ্যাত তারাও তাদের ধর্মনিরপেক্ষ অভ্যাস ও প্রবন্তা বর্জন না করে তরজমায় এমন অনেক জিনিষ বসিয়ে দিয়েছেন, যা মূল আরবী এবারতে নেই। মূল এবারত বদল না করেও অনেক সময় তাঁর এমন শিরোনাম দেয়া যেতে পারে, যার ফলে ঐ এবারতের সাধারণ অর্থই বদলে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আর ব্লাশেয়ারের বিখ্যাত তরজমার কতা বলা যেতে পারে (প্রকাশক মাইসোনেউব ও লারোজ, প্যারিস ১৯৬৬) । তিনি ১১৫ পৃষ্ঠায় এমন একটি শিরোনাম (ধর্মযুদ্ধের কর্তব্য) বসিয়ে দিয়েছেন, যা কুরআনে নেই। এ শিরোনামে এমন একটি অনুচ্ছেদ মাথায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে অস্ত্র ধারণের আহবান অবশ্যই আছে, কিন্তু শিরোনামের ভাষায় যে চরিত্র আরোপ করা হয়েছে, সে চরিত্র কোথাও নেই। সুতরাং যিনি মূল আরবী না পড়ে কেবলমাত্র এ তরজমা পড়বেন, তিনি যদি ধরে নেন যে, মুসলমানরা সর্বদাই ধর্মযুদ্ধ করতে বাধ্য, তাহলে তাকে বোধহয় তেমন দোষ দেয়া যাবে না।
ভ্যাটিক্যানের ঐ দলীলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অপনোদন করা হয়েছে। পাশ্চাত্যে সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, ইসলাম হচ্ছে এমন একটি ধর্ম যা মুসলমানদের সর্বদা মধ্যযুগের গন্ডিতে আবদ্ধ করে রাখে এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাদের অযোগ্য করে ফেলে। খৃষ্টান দেশসমূহের অনুরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে দলীলে বলা হয়েছে- ‘মুসলিম চিন্তাধারার ঐতিহ্যবাহী সম্প্রসারণের মধ্যে আমরা কিন্তু একটি প্রগতিশীল সমাজের বিবর্তন দেখতে পাই।”
আমি সুনিশ্চিত যে, ইসলামের প্রতি ভ্যাটিক্যানের এ সমর্থনে মুসলিম হোক, ইহুদী হোক, আর খৃষ্টান হোক, অনেক বিশ্বাসীই বিস্মিত হবেন। কারণ এ মনোভাব যে বিশ্বস্ততা ও খোলা মনের পরিচয় আছে, ভ্যাটিক্যানে অতীতে কখনও তা দেখা যায়নি। অতীতের মনোভাব বরাবরই বিরুদ্ধবাদী ও বিদ্বেষমূলক ছিল। তবে ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের খুব কম সংখ্যক লোকই অবহিত আছে।
অবশ্য যারা জানেন, তারা পরবর্তী পদক্ষেপে আদৌ বিস্মিত হননি। যেমনঃ ভ্যাটিক্যানের অফিস ফর নন ক্রিশ্চিয়ান ক্রিশ্চিয়ান এফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট সরকারীভাবে সউদী আরব সফরে গিয়ে বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তারপর সউদী আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল ভ্যাটিক্যান সফরে যান এবং খোদ পোপ ষষ্ঠ পল সরকারীভাবে তাদের সংবর্ধনা জানান। এ দুটি ঘটনাই ১৯৪৭ সালে ঘটে। এ পটভূমি মনে রাখলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সহজে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। স্ট্রাসবার্গের বিশপ হিজগ্রেস এলাশিংজার আলেমগণকে তাঁর ক্যাথাড্রেলে সংবর্ধনা জানান এবং সেখানেই তাদের নামায আদায় করতে অনুরোধ করেন। আলেমগণ এ অনুরোধ রক্ষা করেন এবং তাদের সম্মানে গির্জার প্রার্থনা বেদীখানি কিবলার দিকে কাবামুখী করে তাদের সামনে রেখে দেয়া হয়। এভাবে মুসলিম ও খৃষ্টান বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিগণ একটি সংলাপে রাজি হয়েছেন। কারণ তারা একই একক আল্লাহ ঈমান রাখেন এবং পরষ্পরের মতবিরোধের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করেন। এ অবস্থায় উভয় পক্ষের অহির অন্যান্য সকল বিষয়ে একটির সঙ্গে অপরটির তুলনা করে দেখাই স্বাভাবিক। এ তুলনার একটি প্রাসঙ্গিক কাজ হচ্ছে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য ও জ্ঞানের আলোকে উভয় পক্ষের গ্রন্থের অর্থাৎ কুরআন ও বাইবেলের বিবরণের সত্যতা যাচাই করে দেখা।
ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক দেশে দেশে যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু তৌহিদবাদী কোন ধর্মের কোন নীতিতেই কখনও বিজ্ঞানের বিরোধিতা করা হয়নি। তবে একথাও সত্য যে কোন কোন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানীদের অনেক সময় বিপাকে ফেলেছেন। খৃষ্টান জগতে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বহু শতাব্দী যাবত আসল অহীর খবর না নিয়ে শুধু গায়ের জোরেই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির বিরোধিতা করেছেন। বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে যে সকল কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, আমরা সে সম্পর্কেও অবহিত আছি। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং গবেষণা বন্ধ করে ক্ষমা প্রার্থনা না করলে যে আগুনে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করা হত এবং সেই ভয়ে অনেক বিজ্ঞানী যে পালিয়ে গোপন নির্বাসনে চলে যেতেন, এ খবর এখন আর কারও অজানা নেই। এ প্রসঙ্গে গ্যালিলিওর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পৃথিবীর আবর্তন সম্পর্কিত কপারনিকাসের আবিষ্কারকে সত্য বলে গ্রহণ করার অপরাধে চার্চ কর্তৃপক্ষ তাকে গুরুদন্ড প্রদান করেন। স্পষ্টতই তারা বাইবেলের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, কারণ বাইবেলের কোন শ্লোকই তারা সরাসরিভাবে গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেননি।
(বাংলা অনুবাদকের মন্তব্য-ভ্যাটিক্যানের রোমান ক্যাথলিক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ৩৫০ বছর পরে, গ্যালিলিওকে খালাস করে বিদায় দিয়ে বলেছেন-”যে বিচারকমন্ডলী গ্যালিলিওকে সাজা দেন, তারা ভুল করেছিলেন। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে, কপারনিকাসের এ অভিমত লিখিতভাবে এবং জোরেশোরে সমর্থন করার অপরাধে ইটালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও ১৬৩৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে রোমান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক দন্ডিত হন এবং পরবর্তী ৯ বছর তিনি গৃহবন্দীত্বের সাজা ভোগ করেন। ১৯৮০ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল ঐ বিচারের সাক্ষ্য প্রমাণ পুনরায় পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিধ, ও ধর্মবিদদেরসমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সম্প্রতি সরকারীভাবে ঐ খালাশের রায় প্রকাশিত হয়েছে[সাপ্তাহিক টাইম, ১২ মার্চ, ১৯৮৪]
বিজ্ঞানী সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের। হাদীসে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে-”ভাল আহরণের জন্য এমনকি চীন পর্যন্ত চলে যাও।” অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, জ্ঞানের অন্বেষণ করা প্রত্যেক নরনারীর অবশ্য কর্তব্য।
এ আলোচনায় একটু পরে আমরা আরও দেখতে পাব যে, খোদ কুরানেই বিজ্ঞান চর্চার আহবান জানানো হয়েছে। তাছাড়া কুরআনের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কে যে সকল মন্তব্য ও ব্যাখ্যামূলক বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, তা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রমানিত হয়েছে। ইহুদী খৃষ্টানদের অহির গ্রন্থে এরূপ কোন বিষয়বস্তু বা দৃষ্টান্ত নেই।
অবশ্য ইসলামের ইতিহাসে কোন কোন বিশ্বাসী বিজ্ঞান সম্পর্কে পৃথক অর্থাৎ বিরূপ ধারণাও পোষণ করেছেন। একথা সত্য যে কোন কোন আমলে শিক্ষা লাভ ও শিক্ষা দানের দায়িত্ব অবহেলা করা হয়েছে। একইভাবে একথাও সত্য যে, অন্যান্য জায়গার মত মুসলিম বিশ্বে কখনও কখনও বোইজ্ঞানিক অগ্রগতি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও মনে রাখা প্রয়োজন যে, খৃষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ইসলামের গৌরবময় যুগে খৃষ্টান দুনিয়ায় যখন বৈজ্ঞানিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল, তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে বহুবিধ গবেষণা ও আবিষ্কারেরকাজ চলছিল। সেখানে তখন সেই আমলের তমুদ্দুন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য সম্পদগুলিও রক্ষিত ছিল। কর্ডোভায় খলিফার পাঠাগারে ৪ লক্ষ্য গ্রন্থ ছিল। আবু রুশদ সেখানে অধ্যাপনা করতেন এবং সেখানে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্যের বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও ছিল। এ কারণে সমগ্র ইউরোপের শিক্ষার্তী ও পন্ডিতগণ তখন কর্ডোভা যেতেন ঠিক যেমন আজ শিক্ষা পূর্নাঙ্গ করার জন্য সকলে যুক্তরাষ্ট্রে যেয়ে থাকেন। আরব জাতি তখন তাদের বিজিত দেশ সমূহের সভ্যতা-সংস্কৃতির বাহক হিসাবে কাজ করত এবং তাদের এ বিদগ্ধ জনোচিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তাদের মারফতে আমরা অসংখ্য প্রাচীন পান্ডুলিপি হাতে পেয়েছি। তাছাড়া গণিতবিদ্যা (বীজগণিত আরবদেরই আবিষ্কার) জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা (দৃষ্টিবিদ্যা ও আলোকবিজ্ঞান) ভূতত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা (আবু আলী সিনা) প্রভৃতির জন্যও আমরা আরবদের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চা মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক চরিত্র ও মর্যাদা অর্জন করে। আজকেরতুলনায় তখনকার মানুষ ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় অনেক বেশী অভিষিক্ত ছিল; কিন্তু তা ইসলামী দুনিয়ায় তাদের একই সঙ্গে ঈমানদার ও বিজ্ঞানী হওয়ার পথে কোন বাধা সৃষ্টি করেনি। বিজ্ঞান তখন ধর্মের দোসর ছিল এবং সেই অবস্থার পরিবর্তন কখনই সংগত হয়নি।
খৃষ্টান দুনিয়ার জন্য মধ্যযুগ ছিল একটি আবদ্ধতা এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রতি অচল ভক্তির যুগ। তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা বেশ জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন যে, তখন বৈজ্ঞানিক গবেষণার গতি যে মন্থর হয়ে গিয়েছিল, তা কিন্তু ইহুদী-খৃষ্টান অহির কারণে হয়নি; হয়েছিল ঐ অহির সেবক বলেদাবীদার লোকদের দ্বারা। রেনেসার পর এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং বিজ্ঞানীগণ তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কারণে তাদের সাবেক শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে শুরু করেন। প্রতিশোধ গ্রহণ এখনও চলছে এবং বর্তমানে পাশ্চাত্যে তা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, বৈজ্ঞানিক মহলে এখন কেউ আল্লাহর কথা বললে তাকে প্রায় সন্দেহের চোখেই দেখা হয়। এ মনোভাব মুসলিম সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত সকল তরুণকেই বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানীগণ যেহেতু চরম মনোভাব পোষণ করে থাকেন, সেহেতু তাদের তরুণ অনুসারীগণ যে পৃথক কোন মনোভাব পোষণ করবেন, তেমন কিছু বোধহয় আশা করা যায় না। নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী বিগত কয়েক বছর যাবত সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, কতিপয় মৌলিক উপাদান থেকে ঘটনাক্রমে জীবন্ত পদার্থের বা জীবের জন্ম হতে পারে। এ বিষয়ে তিনি একখানি বইও লিখেছেন। তিনি বলেছেন যে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে ঐ মূল জীব থেকে সুগঠিত ও শৃংখলাবদ্ধ প্রাণী গঠিত হয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তা জটিল জীব মানুষে পরিণত হয়ে থাকে।
জীবন সৃষ্টির এ আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের নতুনত্ব চিন্তাশীল মানুষকে অতি অবশ্যই বিপরীত সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করতে পারে। জীবন সৃষ্টি ও সংরক্ষণের বিধি বিধান ও কলাকৌশল যতই অধ্যয়ন করা যায়, ততই তা জটিল বলে মনে হয় এবং জ্ঞানের পরিধি যতই বাড়ে, জ্ঞানী ততই প্রশংসামূখর হয়ে থাকেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, এ দীর্ঘ ও সুক্ষ্ম প্রতিক্রিয়ায় ঘটনাক্রমে কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি সুক্ষাতিসুক্ষ্ম তথ্য ও প্রক্রিয়া যতই আবিষ্কার করতে থাকেন একজন সৃষ্টিকর্তা থাকার অনুকূলে তাঁর যুক্তিও তত জোরদার হয়ে থাকে। কিন্তু এমন মানুষও আছেন যারা বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় অবনত মস্তক না হয়ে গর্বে অমান্যতায় উদ্ধত হয়ে থাকেন। আল্লাহর কথায় তারা নাক সিটকান; এ ধারণাকে বাধা মনে করে তারা অবজ্ঞাভরে ছুড়ে ফেলে দেন, ঠিক যেমন বিনোদন মুহুর্তের কোন বিঘ্নকে তারা তাচ্ছিল্যভরে উপেক্ষা করে থাকেন। পাশ্চাত্য জগতে যে বস্তুতান্ত্রিক সমাজের জয়জয়কার, এ হচ্ছে তাঁর প্রতিচ্ছবি।
আধুনিক বিজ্ঞানীদের অনেকেই আজ এ বিকৃত এ দূষিত চিন্তাধারার ধারক ও বাহক। তাদের মুকাবিলা ও সংশোধন করার জন্য কোন আধ্যাত্মিক শক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ইহুদী ধর্ম ও খৃষ্টান ধর্ম প্রায় প্রকাশ্যেই স্বীকার করে থাকে যে, পাশ্চাত্যে বর্তমানে যে বস্তুতান্ত্রিকতা ও নিরীশ্বরবাদের জোয়ার এসেছে, তা প্রতিহত করার ক্ষমতা তাদের নেই। এ দুটি ধর্মই ঐ জোয়ারের মুখে এখন সম্পূর্ণ অসহায় এবং তাদের প্রতিরোধের ক্ষমতা এক দশক থেকে আর এক দশকে আরও বেশী কমে যাচ্ছে। জোয়ার ক্রমে সর্বত্র সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এখন একজন বস্তুবাদী নিরীশ্বরবাদীর কাছে সনাতন খৃষ্টান ধর্মের রূপ হচ্ছে এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কায়েম রাখার উদ্দেশ্যেই বিগত দু হাজার বছরে এ পদ্ধতিটি গড়ে উঠেছে। ইহুদী-খৃষ্টধর্মের ভাষার সংগে তাঁর নিজের ভাষার কোন মিল আছে বলেও তিনি মনে করেন না। কারণ ঐ ভাষায় যে বর্ণনা আছে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের মুকাবিলায় তাতে এত বেশী অসম্ভাব্যতা, স্ববিরোধিতা ও সামঞ্জস্যহীনতা রয়েছে যে, তিনি তাকে আদৌ কোন আমল দেওয়ারই উপযুক্ত বলে মনে করেন না; অথচ অধিকাংশ ধর্মবিদ ঐ বর্ণনাকেই স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে সামগ্রিকভাবে মেনে নেয়ার কথা বলে থাকেন।
কোন বস্তুবাদী-নিরীশ্বরবাদীর কাছে ইসলামের কথা বলা হলে তিনি সবজান্তার হাসি হেসে থাকেন। অথচ ইসলাম সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা তিনি আদৌ পোষণ করেন না। যে কোন ধর্মাবলম্বী অধিকাংশ পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবির মত ইসলাম সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পোষণ করেন, তা অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
এ অবস্থার জন্য অবশ্য সংগত কারণও আছে। ক্যাথলিকদের উচ্চতর পর্যায়ে সম্প্রতি যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাঁর কথা বাদ দিলে পাশ্চাত্যে সাধারণভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে নিন্দাবাদই প্রচারিত হয়ে থাকে। সেখানে ইসলাম সম্পর্কে যারাই গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তারাই অবহিত আছেন যে, ইসলামের ইতিহাস, নীতিমালা ও লক্ষ্য কতখানি বিকৃতভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। তাছাড়া ইউরোপীয় ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে যে সকল বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, তা সাধারণ পাঠকের কাছে তেমন সহজবোধ্যও নয়।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বুঝা যাবে যে, কুরআনের বিষয়বস্তু সঠিকভাবে এবং বোধগম্য আকারে তাদের কাছে তুলে ধরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় কুরআনের কোন কোন আয়াত, বিশেষত বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত আয়াত এমন দুর্বলভাবে তরজমা এবং এমন আনাড়িভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, বিজ্ঞানীগণ দৃশ্যত সঙ্গতভাবেই তাঁর সমালোচনা করে থাকেন। অথচ কুরআন ঐ সমালোচনার আদৌ হকদার নয়। এ বিষয়টির প্রতি এখন থেকে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন। কারণ, যে তরজমার ভুল বা ব্যাখ্যার বিভ্রান্তি (একটির সঙ্গে অপরটির সম্পর্ক প্রায়শগভীর) দু-এক শতাব্দী আগে হয়ত কাউকে বিস্মিত করতে পারত না, এখন তা আধুনিক বিজ্ঞানীদের সরাসরি বৈরী করে তোলে। তরজমার দুর্বলতার কারণে বিষয়বস্তু যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণের অযোগ্য হয়ে পড়ে তাহলে কোন বৈজ্ঞানিকই তা নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখতে রাজি হবেন না। মানুষের জন্ম সম্পর্কিত আধ্যায়ে এ ধরনের ভুলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ তুলে ধরা হবে।
কিন্তু তরজমায় এ ধরনের ভুল থাকে কেন?একটি কারণ সম্ভবত এই যে, আধুনিক তরজমাকারীগণ বিচার-বিবেচনা না করেই প্রাচীন ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করে থাকেন। একটি আরবী শব্দের যেখানে একাধিক অর্থ আছে, প্রাচীন ভাষ্যকারগণ হয়ত তাঁর মধ্য থেকে একটি বাছাই করে নিয়েছেন এবং তাঁর ফলেই তাদের ব্যাখ্যা হয়ত অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু এজন্য তাদের খুব দোষও বোধহয় দেয়া যায় না। কারণ আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে যে শব্দের অর্থ এখন হয়ত খুবই সহজবোধ্য হয়েছে, প্রাচীন কালে তা তেমন ছিল না। সুতরাং তরজমা ও ব্যাখ্যা এখন সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অতীতে কখনও এ সংশোধন করা সম্ভব ছিল না। কারণ যে জ্ঞান ও তথ্য এখন আমরা হাতের কাছে পেয়েছি তখন তা আবিষ্কারই হয়নি। তরজমা ও ব্যাখ্যার এ প্রসং কিন্তু একমাত্র কুরআনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাইবেলের ক্ষেত্রে তাঁর কোনই প্রাসঙ্গিকতা নেই।
কুরআনের এ বৈজ্ঞানিক বিবেচনার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট আমাকে প্রথমে খুবই বিস্মিত করেছিল। আগে কখনও আমি চিন্তাই করতে পারিনি যে, প্রায় চৌদ্দ শতাব্দী আগে সংকলিত এ এবারতে এত বিবিধ বিষয়ের বিবরণ থাকতে পারে এবং তা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে অমন সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে। প্রথমে ইসলামে আমার আদৌ কখনও বিশ্বাস ছিল না। তবে আমি খোলা মন এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কুরআনের এবারত পরীক্ষা করতে শুরু করি। আমার উপরে যদি কোন প্রভাব ক্রিয়াশীল থেকে থাকে, তা ছিল আমার যৌবনে পাওয়া শিক্ষার প্রভাব। লোকে ‘মুসলিম’ বলত না, বলত ‘মুহামেডান’। অর্থাৎ বুঝানো হত যে, এ ধর্ম একজন মানুষের দ্বারা প্রবর্তিত হওয়ার কারণে গড-এর প্রসঙ্গে তাঁর আদৌ কোন মূল্য থাকতে পারে না। পাশ্চাত্যের অনেকের মত আমার নিজেরও তখন ইসলাম সম্পর্কে এ মিথ্যা ধারণা থেকে তাহকে পারে। এ মিথ্যা ধারণা পাশ্চাত্যে এখন এমন ব্যাপকপভাবে প্রসারিত যে, বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কাউকে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ভাবে কথা বলতে দেখলে আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই। সুতরাং আমি স্বীকার করছি যে, পাশ্চাত্যে প্রচলিত ধারণা থেকে পৃথক ধারণা পাওয়ার আগে পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম।
পাশ্চাত্যের ধারনা যে মিথ্যা, তা আমি উপলব্ধি করি কতিপয় ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। ঐ ধারণায় যে ভুল থাকতে পারে, এরূপ একটি আভাস প্রথমে আমি সউদী আরবে পাই।
মরহুম বাদশাহ ফয়সলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণের পরিমাণ খুবই বেশী এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি আমি গভিরভাবে শ্রদ্ধার স্নগে সালাম জানাই। ইসলাম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য শুনার যে বিরল সম্মান তিনি আমাকে দিয়েছিলেন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসঙ্গে কুরআন ব্যাখ্যার কতিপয় সমস্যা সম্পর্কে আমি যে তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেই স্মৃতি এখনও আমি সযত্নে লালন করে থাকি। তাঁর নিজের কাছ থেকে এবং তাঁর সহচরদের কাছ থেকে বহু মূল্যবান তথ্য সংগ্রহের বিরল সুযোগ আমি পেয়েছিলাম।
ইসলাম সম্পর্কে বাস্তব অবস্থা ও পাশ্চাত্যের ধারণার বিরাট ব্যবধান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর আমি আরবী ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করি। কারণ, আরবী আমার মাতৃভাষা নয়, অথচ যে ধর্মটি অমনভাবে ভুল বুঝা হয়ে থাকে তাঁর মূল গ্রন্থখানির ভাষা হচ্ছে আরবী। আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল এই যে, আমি মূল ভাষায় কুরআন পড়ব এবং বিভিন্ন ভাষ্যকার লিখিত ব্যাখ্যার আলোকে প্রত্যেকটি বাক্যের বিশ্লেষণ করব। আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল এই যে, কুরআনে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার যে বিবরণ আছে, তা আমি বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখব। কারণ ঐ বিবরণে এমন অনেক খুটিনাটি বিষয় আছে, যা আরবী ভাষায় পড়লে প্রথম পাঠেই নির্ভুল ও নিখুত বলে বুঝা যায় এবং আমার কাছে সেই প্রথমেই আধুনিক তহত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়। আমার তখন আরও মনে হয় যে, সেই মুহাম্মদের (সাঃ) আমলের কোন মানুষের পক্ষে তো এসব তথ্য জানতে পারা আদৌ সম্ভব ছিল না। পরে আমি কুরআনের বৈজ্ঞানিক তথ্য বিষয়ে মুসলিম লেখকদের লেখা কয়েকখানি বই পড়েছি এবং যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। কিন্তু পাশ্চাত্যে এ বিষয়ে কোন গবেষণা হয়েছে বলে আমি এখনও জানতে পারিনি।
কুরআনের এবারতের প্রথম পাঠকের কাছে জিনিসটি প্রথমে ধরা পড়ে, তা হচ্ছে এই যে, এ গ্রন্থে বহু বিষয় আলোচিত হয়েছে। সৃষ্টিতত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, পৃথিবী সম্পর্কে কতিপয় বিষয়ের ব্যাখ্যা, প্রাণিজগত, বৃক্ষজগত, মানব-প্রজনন প্রভৃতি। এ সকল বিষয়ে আমি বাইবেলে বহু ভুল তথ্য পেয়েছি, কিন্তু কুরআনে একটি ভুলও খুজে পাইনি। সুতরাং আমি থেমে গিয়েছি এবং প্রশ্ন করেছি-কুরআন যদু কোন মানুষেরই লেখা হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর পক্ষে সেই সপ্তম শতাব্দীতে এমন সব তথ্য লিপিবদ্ধ করা কিভাবে সম্ভব হল যা আমরা আজ আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে দেখত্যে পাচ্ছি?এবং কুরআনের যে এবারত এখন আমাদের হাতে আছে, তা যে ঠিক সেই আমলের, সে সম্পর্কে সন্দেহের আদৌ কোন অবকাশ নেই (পরে একটি অধ্যায়ে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাতকরব) । ‘তাহলে এ বিষয়ে মানুষের পক্ষে কি ব্যাখ্যা দেয়ায় সম্ভব হতে পারে?আমি মনে করি, এর কোন ব্যাখ্যা নেই, ব্যাখ্যা হতেও পারে না।
আমাদের এ বিংশ শতাব্দীতেও যে জ্ঞান কমপক্ষে হাজার বছরের আগাম বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, কোন কোন বিষয়ে সেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ফ্রান্সের রাজা দাগোবার্টের রাজত্বকালের (৬২৯-৬৩৯) সমসাময়িক আরব উপদ্বীপের একজন বাসিন্দার ছিল, মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনায় এর কোন্সঙ্গত কারণ থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
কুরআন নাযিল হয় হিজরী সাল শুরু হওয়ার (৬২২ ঈসায়ী) আগে-পিছে মোটামুটি বিশ বছর যাবত। একথা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ঐ সময়ের আগে পর্যন্ত কয়েক শতাব্দীযাবত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি হয়নি এবং কুরআন নাযিল হওয়া সমাপ্ত হওয়ার পরই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানসহ ইসলামী সভ্যতার তৎপরতার যুগ শুরু হয়। এ খবর যারা রাখেন না, তারা অনেক অসম্ভব ও হাস্যকর কথা বলে থাকেন। আমি নিজে এরূপ একটি কথা কয়েকবার শুনেছি। কথাটি এরূপ-কুরআনে বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির কোন আশ্চর্যজনক বিবরণ যদি থেকেই থাকে, তাহলে তাঁর কারণ হচ্ছে এই যে, আরব বিজ্ঞানীগণ খুবই পারদর্শী ও অগ্রগামী ছিলেন এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্রও ধারণা আছে তারাই বুঝতে পারবেন যে, ঐ মন্তব্য শুধু হাস্যকরই নয়, কল্পনা-বিলাসও বটে। কারণ, তারা জানেন যে, আরব বিশ্বে সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মধ্যযুগ শুরু হয়েছিল মুহাম্মদ (সঃ) পরে। তাছাড়া ঐ জাতীয় মন্তব্য আরও একটি কারণে অসঙ্গত ও ভিত্তিহীন। কেননা কুরআনের যে সকল বৈজ্ঞানিক তথ্যের ইশারা আছে বা নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট বিবরণ আছে, তা এ আধুনিক যুগের অনুসন্ধানের ফলেই সমর্থিত হয়েছে।
এ কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত কুরআনের ভাষ্যকারগণ, এমন কি ইসলামী সংস্কৃতির সেই গৌরবময় যুগের ভাষ্যকারগণও কোন কোন আয়াতের ব্যাখ্যায় অবশ্যম্ভাবীভাবে ভুল করেছেন। স্পষ্টতই প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা তখন তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। অনেকপরে এবং আমাদের যুগের প্রায় কাছাকাছি সময়েই ঐ আয়াতগুলির সঠিক তরজমা ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ কুরআনের আয়াত সঠিকভাবে বুঝতে পারার জন্য কেবলমাত্র ভাষাজ্ঞানই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কেও পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আসলে কুরআন বুঝতে হলে বিবিধ বিষয়ের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন এবং এদিক থেকে বরং বলা যেতে পারে যে, বিশ্বকোষের মত জ্ঞানভান্ডার হাতের কাছে রাখা দরকার। এ আলোচনায় অগ্রসর হয়ার সময় বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষার প্রসঙ্গে আমরা দেখতে পাব যে, কোন কোন আয়াতের মর্মার্থ উপলব্ধির জন্য বিবিধ প্রকারের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তথ্য অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।
কিন্তু বিশ্বজগতের নিয়ামক ও বিধায়ক নিয়ম-কানুন ব্যাখ্যা করা কুরআনের লক্ষ্য নয়। তাঁর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সম্পূর্ণত ধর্মীয়। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিবরণই মানুষকে সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে অনুপ্রানিত করে। এ বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পক্ষে দর্শনযোগ্য ঘটনা এবং বোধগম্য বিধানের প্রসঙ্গ এসেছে। কারণ, আল্লাহ মানুষ ও প্রকৃতি সম্বলিত বিশ্বজগতের একমাত্র নিয়ামক ও বিধায়ক। এ বক্তব্যের একটি অংশ সম্ভবত সহজেই বোধগম্য হতে পারে, কিন্তু অপর অংশটি উপলব্ধির জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন অপরিহার্য। এ কারণে আগের দিনে কোন কোন আয়াত থেকে মানুষের পক্ষে কেবলমাত্র দৃশ্যমান অর্থ গ্রহণ করাই সম্ভব ছিল এবং তাঁর ফলে তাকে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল, তা তখনও আবিষ্কার হয়নি বিধায় তা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।
বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুর জন্য যে সকল আয়াত পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন, তাঁর সংখ্যা অনেকের কাছে কম বলে হয়েছে। আমার আগে যারা এ দিকে নজর দিয়েছেন, তারা সম্ভবত সেরূপই মনে করেছেন। আমি নিজে অবশ্য ঐ সকল মুসলিম লেখকদের চেয়ে কিছু কম সংখ্যক আয়াত বেছে নিয়েছি। তবে আমি এমন কিছু আয়াত বাছাই করেছি, যেগুলিকে আগে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়নি। অন্তত আমার নিজের তাই মনে হয়েছে। পূর্ববর্তী লেখকদের নির্বাচিত কোন আয়াত আমি যদি ভুলক্রমে বাছাই না করে থাকি, তাহলে আশা করি তারা কিছু মনে করবেন না। কোন কোন গ্রন্থে আমি কুরআনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেখেছি বটে, কিন্তু আমার কাছে তা কেমন যেন নির্ভুল বলে মনে হয়নি। আমি খোলা মন ও পরিচ্ছন্ন বিবেক নিয়ে ঐ আয়াতগুলির আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি।
একইভাবে আমি কুরআনে এমন বিষয়ের প্রসঙ্গ তালাশ করেছি, যা মানুষের কাছে বোধগম্য বটে, কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা সমর্থিত নয়। আমার মনে হয় আমি এমন একটি প্রসঙ্গ কুরআনে পেয়েছি যেখানে জ্যোতির্মন্ডলে আমাদের এ পৃথিবীর মত আরও গ্রহের উপস্থিতির কথা আছে। অনেক বিজ্ঞানীই এরূপ সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেন বটে, কিন্তু সঠিকভাবে কিছু বলার মত কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। এখনও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে বটে, তথাপি বিষয়টির উল্লেখ করা আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করছি।
এ বইখানি যদি তিরিশ বছর আগে লেখা হত, তাহলে কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী করা আর একটি তথ্যের উল্লেখ করার প্রয়োজন হত। সেটি হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক-মানুষের মহাশূন্য বিজয় সম্পর্কে। তখন দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্রের প্রাথমিক পরীক্ষার পর মানুষ মোটামুটি অনুমান করতে পেরেছিল যে, পৃথিবী ত্থেকে সশরীরে গিয়ে মহাশূন্যে অনুসন্ধান চালানোর মত উপায়-উপকরণ একদিন হয়ত তাঁর হাতে আসবে। তখন তাঁর একথাও জানা ছিল যে, মানুষ যে একদিন মহাশূন্য জয় করবে, কুরআনের একটি আয়াতে এ ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে। সেই ভবিষ্যদ্বাণী এখন সত্য বলে প্রমাণীত হয়েছে।
ধর্মগ্রন্থ ও বিজ্ঞানের মধ্যকার বর্তমান মুকাবিলায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রতিষ্ঠিত সত্যের ক্ষেত্রে বাইবেল ও কুরআন এ উভয় গ্রন্থের বিবরণই পরীক্ষা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সত্যটি সম্পূর্ণ সুষ্ঠূ ও সঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং সন্দেহের আদৌ কোন অবকাশ থাকলে চলবে না। ধর্মগ্রন্থের মর্মার্থ উপলব্ধির জন্য বিজ্ঞানের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা যারা স্বীকার করেন না, তারা মনে করেন যে, ধর্মীয় বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য বিজ্ঞানের পক্ষে কোন সঙ্গত ও বৈধ ধারণা গঠন করা সম্ভব নয় এবং এ কথা বাইবেল ও কুরআন এ উভয় গ্রন্থের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি যে, বৈজ্ঞানিক সত্যের মুকাবিলায় বাইবেলের বিবরণ টিকে থাকতে পারছে না, অথচ কুরআনের বিবরণ হুবহু মিলে যাচ্ছে। তারা বলেন যে, বিজ্ঞান তো ক্রমে বদলে যাচ্ছে। আজ যা সত্য বলে গৃহীত হচ্ছে কিছুদিন পরে তা বাতিল হয়ে যেতে পারে। তা হয়ত ঠিক, এ বিষয়েও কথা আছে।
থিওরি বদলায়, কিন্তু সত্য বদলায় না। ধর্মগ্রন্থের মুকাবিলায় আমরা সত্যের কথা বলছি, থিওরির কথা নয়। থিওরি তো অনুমান মাত্র, কিন্তু সত্য তো পরীক্ষিত ও প্রমানিত সিদ্ধান্ত। যে ঘটনা বা দৃশ্য সহজে বোধগম্য নয়, তা বোধগম্য করাই থিওরির লক্ষ্য। সুতরাং ঐ ঘটনা বা দৃশ্য সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হওয়ার পরে আগের থিওরি সংশোধিত বা বাতিল হয়ে আর একটী নতুন থিওরি আসতে পারে। কিন্তু সত্য যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রমানিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন তাঁর আর পরিবর্তন ঘটে না। আর সংজ্ঞা নির্ণয় আগের চেয়ে সহজ হয়ে যায়। এখন এ সত্য প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এবং চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। এ সত্যের আর পরিবর্তন হবে না, তবে ভবিষ্যতে হয়ত ঐ কক্ষপথগুলি আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্ধারিত হতে পারে।
একজন মুসলিম পদার্থবিদ কুরআনের একটি আয়াতের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন যে, ঐ আয়াতে অবস্তুর (এন্টি-ম্যাটার) ধারণার ভবিষ্যদ্বাণী আছে। কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারিনি। কারণ থিওরি মাত্রই পরিবর্তনশীল এবং অবস্তু বিষয়ক থিওরিটি এখনও বিতর্কিত বিষয়। তবে কুরআনে যে আয়াতে পানি থেকে জীবন সৃষ্টির বর্ণনা আছে, তার প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ঐ বর্ণনা হয়ত আমরা কখনই হাতে কলমে প্রমাণ করতে পারবনা, কিন্তু তাঁর অনুকূলে অনেক যুক্তি আছে। মানব-ভ্রুণের মত দৃশ্যমান বিষয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য কুরআনে তাঁর ক্রমবিকাশের যে বিভিন্ন পর্যায় বর্ণিত আছে, তার সঙ্গে আধুনিক ভ্রুণবিদ্যায় প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখলে সম্পূর্ণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য ধরা পড়বে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে কুরআনের এ মুকাবিলা আরও দুপ্রকারের তুলনার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রথমে তুলনা করা হয়েছে বিজ্ঞানের সঙ্গে বাইবেলে প্রদত্ত তথ্যের মুকাবিলা করে এবং দ্বিতীয় তুলনা করা হয়েছে অহির গ্রন্থ কুরআনের তথ্যের সঙ্গে মুহম্মদের (সঃ) কাজও কথার বিবরণ হাদীসের তথ্যের মুকাবিলা করে।
এ আলোচনার শেষভাগে একটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে বাইবেল ও কুরআনের বর্ণনার মধ্যে তুলনা করে তাঁর ফলাফল দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ভিত্তিক পরীক্ষা ও সমালোচনায় বর্ণনা দুটির অবস্থা কি দাড়িয়েছে, তাও দেখানো হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলাযেতে পারে যে, বিশ্বসৃষ্টি এবং মহাপ্লাবনের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে বাইবেলের বর্ণনার অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে। একই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে কুরআনের বর্ণনার যে পরিপূর্ণ সঙ্গতি দেখতে পাওয়া গেছে, তাও তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং বর্তমান যুগে কোন গ্রন্থের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য এবং কোন গ্রন্থের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়, তা আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারব।
এ বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ পাশ্চাত্যে ইহুদী, খৃষ্টান ও নিরীশ্বরবাদীগণ কোন রকম সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই একযোগে বলে থাকেন যে, মুহাম্মদ বাইবেলের অনুকরণে নিজেই কুরআন লিখেছিলেন অথবা কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। তারা আরও বলে থাকেন যে, কুরআনে ধর্মীয় ইতিহাসের যে সকল কাহিনী আছে, তা বাইবেলের কাহিনীগুলিরই পুনরাবৃত্তি মাত্র। একথা বলা চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। যিশু তাঁর ধর্ম প্রচারের সময় ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে প্রেরণা নিয়ে তাঁর সমকালীন লোকদের প্রতারিত করেছিলেন বললে যেমন হয়, ঠিক সেই রকম নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক; যদিও আমরা আগেই দেখেছি যে, মথির গসপেল সম্পূর্ণতই ওল্ড টেস্টামেন্টের ধারাবাহিকতায় লিখিত হয়েছে। কিন্তু সেই কারণে যিশুর আল্লাহর নবী হওয়ার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার কথা কোন ধর্মবিদ কি কল্পনা করতে পারেন? অথচ পাশ্চাত্যে ঠিক এ ভাবেই মুহাম্মদের (সঃ) বিচার করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, ‘তিনি বাইবেল নকল করা ছাড়া আর কিছুই করেননি। ‘ এ মন্তব্যকে বড় জোর একটি হাতুড়ে রায় বলা যেতে পারে। কারণ এ মন্তব্য যারা করে থাকেন, তারা তলিয়ে দেখেন না যে, বাইবেল ও কুরআনেএকই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের বর্ণনা আছে; সুতরাং নকল করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তারা অবশ্য এ পার্থক্যের বিষয়ে আলোচনা করতে চান না এবং ধরে নিয়ে থাকেন যে, দু গ্রন্থে একই প্রকারের বর্ণনা আছে। ফলে বিজ্ঞানের সঙ্গে মুকাবিলার কোন প্রয়োজন নেই। বিশ্বসৃষ্টি ও মহাপ্লাবন বিষয়ে আলোচনার সময় এ বিষয়ে আমরা আরও আলোকপাত করব।
হাদীসের সঙ্গে মুহাম্মদের (সঃ) যে সম্পর্কে, গসপেলের সঙ্গে যিশুর সম্পর্কও ঠিক সেই প্রকারের। উভয় পয়গম্বরের কথা ও কাজের বিবরণ মাত্র। উভয় ক্ষেত্রেই লেখকগণ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। হাদীসের ক্ষেত্রে অবশ্য অনেক প্রত্যক্ষদর্শী লেখকও ছিলেন। তবে মুহাম্মদের (সঃ) জীবনকালের অনেক পরে যারা হাদীস সংকলন করেছেন, তারাও অতিশয় নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। হাদীস বা গসপেল অহির গ্রন্থ নয়। আল্লাহর কালাম নয়, পয়গম্বরের বাণী মাত্র। ব্যাপকভাবে পঠিত এ সকল গ্রন্থে এমন কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশেষত রোগের প্রতিকার হিসাবে ভ্রান্ত। ধর্মীয় কোন সমস্যার বিষয় আমরা বিবেচনা থেকে বাদ দিয়েছি। কারণ হাদীসের পটভূমিকায় ঐ সমস্যা নিয়ে আমরা গ্রন্থে আলোচনা করিনি। অনেক হাদীসের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতায় সন্দেহ আছে এবং মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ নিজেরাই সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থে কোন হাদীসের বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, কুরআনে এমন কোন বৈজ্ঞানিক বিবরণ নেই, যা বিশেষজ্ঞদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হাদীসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য, আমরা দেখতে পাব, বেশ চমকে ওঠার মত।
যারা মুহাম্মদকে (সঃ) কুরআনের লেখক বলে দাবী করে থাকেন, এ যুক্তির মুকাবিলায় তাদের কোন কথাই আর গ্রহণযোগ্য থাকতে পারে না। একজন নিরক্ষর মানুষ সাহিত্যের গুণগত মানের বিচারে সমগ্র আরব সাহিত্য জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হতে পারেন কিভাবে? আর সেই আমলে তিনি এমন সব বৈজ্ঞানিক সত্য কেমন করে ঘোষণা করলেন, যে সত্য তখন অপর কোন মানূষের পক্ষে উদ্ভাবন করা আদৌ সম্ভব ছিল না? এবং আদৌ কোন ভুল না করে?
এ গ্রন্থের বিভিন্ন ধারণা-প্রবাহ বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে। এবং তাঁর ফলে এ সিদ্ধান্ত সাব্যস্ত হয়েছে যে, সপ্তম শতাব্দীর একজন মানুষ কুরআনে বিভিন্ন বিষয়ে এমন সব বিবরণ দিয়েছেন যা তাঁর নিজের আমলের নয় এবং সেই বিবরণের সত্যতাও কয়েক শতাব্দী পরে জানা গেছে, এ অবস্থা কল্পনাও করা যেতে পারে না। এ কারণে অন্তত আমি মনে করি যে, কুরআনের কোন মানবিক ব্যাখ্যা হতে পারে না।
কুরআনের আসলত্ব, কিভাবে তা লেখা হয়
কুরআনের আসল হওয়া সম্পর্কে কোন মতবিরোধ না থাকায় বিভিন্ন অহির গ্রন্থের মধ্যে এ গ্রন্থের একটি বিশিষ্ট একক স্থান আছে। এ বৈশিষ্ট নিউ টেস্টামেন্টেও নেই, ওল্ড টেস্টামেন্টেও নেই। এ দুখানি গ্রন্থ যে কিভাবে রদবদল হতে হতে বর্তমান আকারে এসে দাড়িয়েছে, প্রথম দুটি অধ্যায়ে আমরা তাঁর বিবরণ দিয়েছি। কুরানের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি; কারণ কুরআন মুহাম্মদের (সঃ) আমলেই লিখে ফেলা হয়েছিল। কিভাবে লেখা হয়েছিল, অর্থাৎ প্রক্রিয়া কি ছিল, একটু পরেই তা আমরা বর্ণনা করব।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কুরানের সঙ্গে বাইবেলের যে পার্থক্য আছে, তা কোন মতেই মূলত এ দুটি গ্রন্থের নাযিল হওয়ার তারিখের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিছু লোক এ ধরনে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন বটে, কিন্তু ইহুদী-খৃষ্ট গ্রন্থ এবং কুরআন যখন লেখা হয়েছিল, তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতিও তারা বিবেচনা করেন না। তারা বলে থাকেন যে, পনের শত বছরের পুরোনো গ্রন্থের তুলনায় সপ্তম শতাব্দীর একখানি গ্রন্থের বিনা রদবদল আমাদের সময় পর্যন্ত চলে আসার সম্ভাবনাই বেশী। সে কথা ঠিক, কিন্তু কারণ হিসেবে এটা যথেষ্ট নয়। ইহুদী-খৃষ্ট গ্রন্থে যে রদবদল হয়েছে, তার অজুহাত হিসেবেই এ কথা বলা হয়ে থাকে; কিন্তু মানুষের দ্বারা কুরআনের এবারতের রদবদল হওয়ার যে আদৌ কোন আশংকা ছিল না সে সত্যের স্বীকৃতি এ কথায় নেই।
ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে যেহেতু বহু লেখক একই কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং কতিপয় গ্রন্থ যেহেতু খৃষ্টপূর্ব আমল থেকে বহুবার সংশোধিত হয়েছে, সেহেতু ভুল ও স্ববিরোধিতার ঠিক অতগুলির কারণ ঘটেছে। আর নিউ টেস্টামেন্ট অর্থাৎ গসপেলের ক্ষেত্রে কেউই দাবী করতে পারেন না যে, এ গ্রন্থে যিশুর বাণী বা তাঁর কাজের বিবরণ সঠিক ও বাস্তব সম্মতভাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। তাছাড়া আমরা আগেই দেখেছি যে, বিভিন্ন সময়ে এবারতের যে সকল পাঠ একটির পর একটি প্রস্তুত করা হয়েছে তাঁর কোন একটিও আসল ছিল না এবং ঐ সকল পাঠের লেখকগণের একজনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না।
এ প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কুরআন হচ্ছে লিখিত অহির গ্রন্থ, আর হাদীস হচ্ছে মুহাম্মদের (সঃ) এর কথা ও কাজের বিবরণের সংকলন। নবীর ইন্তেকালের পরই তাঁর কয়েকজন সঙ্গী ঐ বিবরণ লিখতে শুরু করেন। কিন্তু বিবরণ আরও পরেও লেখা হয়েছে। [অবশ্যি কিছু বিবরণ নবীর জীবদ্দশাই তিনি নিজে ও তাঁর সাহাবাগণও লিখেছেন। ] শ্রুতি বা স্মৃতির ক্ষেত্রে মানুষ মাত্রেরই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে এ জাতীয় সকল রচনা কঠোর সমালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গ্রহণ করা হয়েছে। তবে বাইবেলের বিবরণের মত বিভিন্ন হাদীসের আসল হওয়ার ব্যাপারেও কমবেশীহওয়ার অবকাশ আছে। তবুও উল্লেখযোগ্য যে, বাইবেলের কোন বিবরণই যিশুর আমলে লেখা হয়নি; অনেক পরে লেখা হয়েছে। হাদীসও মুহাম্মদের (সঃ) জীবিত কালে সংকলিত হয়নি; তবে তাঁর অব্যবহিত পরই সংকলনের কাজ শুরু হয়েছে।
কুরআনের ক্ষেত্রে অবশ্য পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। কোন অহি নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী ও তাঁর সঙ্গীগণ তা মুখস্ত করে ফেলতেন এবং তাঁর অনুসারী ও নিযুক্ত লেখকগণ তা লিখে ফেলতেন। সুতরাং কুরআনের শুরুই হয়েছে দুটি বৈশিষ্ট দিয়ে- মুখস্ত করা ও লিখে ফেলা এবং এ দুটিই হচ্ছে আসল হওয়ার প্রমাণ। বাইবেলের ক্ষেত্রে তেমন বৈশিষ্টও নেই, আসল হওয়ার প্রমাণও নেই। কুরআন মুখস্ত করা ও লিখে ফেলার ঐ প্রক্রিয়া মুহাম্মদের (সঃ) ইন্তেকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সেই আমলে যখন অনেকেই লেখাপড়া জানত না, অর্থাৎ লিখতে পারত না, কিন্তু সকলেই মুখস্ত করতে ও আবৃত্তি করতে পারত তখন একটি বিরল সুবিধা ছিল এই যে, অহি লিখিত আকারে সংকলনের সময় একাধিক মানুষের আবৃত্তির সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা সম্ভব ছিল।
কুরআনের অহি জিবরাইল ফেরেশতার মারফত মুহাম্মদের (সঃ) উপর নাযিল হয়েছিল। এ নাযিল হওয়া বিশ বছরেরও অধিক কাল যাবত চালু ছিল। প্রথম নাযিল হয়েছিল ৯৬ নম্বর সূরার (আল-আলাক) কয়েকটি আয়াত, তারপর তিন বছর যাবৎ আর কোন অহি নাযিল হয়নি। তিন বছর পর আবার অহি নাযিল হতে থাকে এবং ৬৩২ খৃষ্টাব্দে নবীর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছর যাবত চালু থাকে। এ বিশ বছরের প্রথম দশ বছর ছিল হিজরতের (৬২২ খৃষ্টান্দে মুহাম্মদের (সঃ) মক্কা থেকে মদীনা গমন) আগের এবং পরের দশ বছর ছিল তাঁর পরের।
প্রথম অহি ছিল নিম্নরূপ (সূরা ৯৬, আল-আলাক, আয়াত১-৫):
“পাঠ কর, তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন- সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষের রক্তপিন্ড হইতে।
পাঠ কর, তোমার প্রতিপালক মহা মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যাহা সে জানিত না।”
এ অহিতে মুহাম্মদ (সঃ) সম্পূর্ণরূপে অভিভুত হয়ে পড়েন। তিনি যে লিখতেও জানতেন না, পড়তেও জানতেন না, বিশেষত সেই পটভূমিকায় আমরা পরে এ অহির ব্যাখ্যা করব।
প্রফেসর হামিদুল্লাহ তাঁর কুরআনের ফরাসী তরজমার ভূমিকা উল্লেখ করেছেন যে, এ প্রথম অহির একটি বিষয় হচ্ছে”মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হিসাবে কলমের প্রশংসা” এবং”এ জন্যই নবী লিখিত আকারে কুরআন সংরক্ষণে সচেষ্ট ছিলেন।”
খোদ কুরআনের এবারত থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুহাম্মদের (সঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পূর্বেই সেই সময় পর্যন্ত নাযিল হওয়া অহি লিখে ফেলা হয়েছিল। এ ব্যাপারে কুরআনে যে সত্যিই আসল তা আমরা এখনই দেখতে পারব। কারণ প্রথম দিকের অহি লিখিত হয়ে যাওয়ার কথা পরবর্তী অহিতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা জানি যে মুহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ অহির এবারত মুখস্ত, অর্থাৎ স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে অভ্যস্ত ছিলেন। সুতরাং পরবর্তী অহিতে যখন পূর্ববর্তী অহি লিখিত হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তাঁর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া খুবই সহজ ছিল। যারাকুরআন লিখে রাখার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন, তাদের জিজ্ঞেস করলেই ঐ প্রমাণ পাওয়া যেত।
হিজরতের আগেই যে ঐ সময় পর্যন্ত নাযিল হওয়া অহি লিখে ফেলা হয়েছিল, ঐ সময়ের চারটি সূরাতে তাঁর উল্লেখ আছে।
-সূরা আবাসা (৮০: ১১-১৬):”এ প্রকার আচরণ অনুচিত; ইহা উপদেশ বাণী; যে ইচ্ছা করিবে সে ইহা স্মরণ রাখিবে, উহা আছে মহান, উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন পবিত্র গ্রন্থে, মহান, পূত চরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ।”
আল্লামা ইউসুফ আলী তাঁর ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত কুরআনের তরজমার ভাষ্যে বলেছেন যে, এ সূরাটি যখন নাযিল হয়, তখন বিয়াল্লিশ বা পয়তাল্লিশটি সূরা (মোট ১১৪ টি সূরার মধ্যে) লেখা হয়ে গিয়েছিল এবং মুসলমানগণ তা মক্কায় সংরক্ষণ করতেন।
-সূরা বুরুজ (৮৫: ২১-২২):”বস্তুতঃ ইহা সম্মানিত কুরান, সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।” -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬: ৭৭-৮০): নিশ্চয়ই ইহা সম্মানিত কুরান, যাহা আছে
সুরক্ষিত গ্রন্থে, যাহারা পূত-পবিত্র তাহার ব্যতীত অন্য কেউ তাহা স্পর্শ করিবে না। ইহা বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নিকট হইতে অবতীর্ণ।”
-সূরা ফুরকান (২৫:৫):”উহারা বলে, ‘এগুলি তো সেকালের উপকথা, যাহা সে লিখাইয়া লইয়াছে; এগুলি সকাল সন্ধ্যা তাঁর নিকট পাঠ করা হয়।”
এখানে নবীর দুশমনদের অভিযোগের উল্লেখ আছে। তারা তাকে ভন্ড বলে মনে করত। তারা এ গুওব ছড়াত যে, তার কাছে প্রাচীন উপকথা বর্ণনা করা হয়ে থাকে, এবং তিনি তা লিখিয়ে নেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, লিখিত দলিল যে প্রস্তুত করা হত, এ কথা মুহাম্মদের (সঃ) দুশমনেরাও উল্লেখ করেছে।
হিজরতের পরে নাযিল হওয়া একটি সূরায় আসমানী উপদেশমালা লিখিত পৃষ্ঠাসমূহের উল্লেখ সর্বশেষ বারের মত করা হয়েছে।
-সূরা বাইয়িনা (৯৮:২-৩):”আল্লাহর নিকট হইতে এক রসূল, যে আবৃত্তি করে গ্রন্থ যাহাতে আছে সরল বিধান।”
সুতরাং খোদ কুরানেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, নবীর আমলেই কুরআন লিখে ফেলা হয়েছিল। একথা সর্বজনবিদিত যে, তার অনুসারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কাতিব বা লেখক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে যায়েদ বিন সাবিতের নামই সর্বাধিক বিখ্যাত।
প্রফেসর হামিদুল্লাহ তাঁর কুরআনের ফরাসী তরজমার (১৯৭১) ভূমিকায় নবীর ইন্তেকাল
পর্যন্ত সময়ে কুরআনের এবারত লিখিত হওয়ার সময় যে অবস্থা বিদ্যমান ছিল, তার একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছে। তিনি বলেছেন,”সকল বিশেষজ্ঞই একমত হয়ে বলেছেন যে, যখনি কোন অহি নাযিল হত, তখনই নবী মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর লেখাপড়া জানা সঙ্গীদের মধ্য থেকে একজনকে ডেকে নিয়ে লিখিয়ে নিতেন এবং এ নতুন অহি পূর্বে নাযিল হওয়া অহির পরম্পরায় কোন জায়গায় বসাতে হবে তা বলে দিতেন। … লেখা হয়ে যাওয়ার পর লেখককে তিনি তা পড়ে শুনাতে বলতেন এবং লেখায় কোন ভুল হয়ে থাকলে তা সংশোধন করে দিতেন। …অপর একটি বিবরণে জানা যায় যে, প্রতি বছর রমযান মাসে নবী ঐ সময় পর্যন্ত নাযিল হওয়া সমুদয় অহি তেলাওয়াত করে জিবরাইল ফেরেশতাকে শুনাতেন…তাঁর ইন্তিকালের আগের রমযানে জিবরাইল তাকে দিয়ে সমগ্র কুরআন দুবার পড়িয়ে নিয়েছিলেন………একথা সর্বজন বিদিত যে, প্রতিদিন পাঁচ বারের নামাযে কুরআন পাঠ করা ছাড়াও সেই মুহাম্মদের (সঃ) আমল থেকেই মুসলমানগণ রমযান মাসে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে সমগ্র কুরআন পাঠ করতে অভ্যস্ত। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন যে, অহির এবারতের চূড়ান্ত সংকলনের সময় মুহাম্মদের (সঃ) কাতেব যায়েদ ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলেন। অন্যত্র অন্যান্য বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।”
প্রথমবার কুরআন বিভিন্ন জিনিসের উপর লেখা হয়। চামড়া, কাঠের তক্তি, উটের কাঁধের হাড়, পাথর প্রভৃত নানাবিধ জিনিস ব্যবহার করা হয়। স্নগে সঙ্গে মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর সঙ্গীদের কুরআন মুখস্ত করতে বলতেন এবং তারা সেই মত কাজ করতেন। । ফলে তখন অনেকেই সমগ্র কুরআন মুখস্ত করে হাফেজ নামে পরিচিত হন এবং বিভিন্ন দেশে কুরআনের বাণী প্রচার করতেন। এভাবে লিখিত আকারে ও মুখস্ত করে দুভাবে কউরান সংরক্ষণের ব্যাপারটি কালক্রমে খুবই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমানিত হয়েছে।
নবী মুহাম্মদের (সঃ) ইন্তেকালের (৬৩২খৃষ্টাব্দে) কিছুদিন পরই ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকর নবীর সাবেক প্রধান কাতেব যায়েদ ইবনে সাবিতকে এক জেলদ কুরআন নকল করে দিতে বলেন। উমরের (ভবিষ্যত দ্বিতীয় খলীফা) তত্ত্বাবধানে যায়েদ মদীনায় তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন লোকের কাছে থাকা বিভিন্ন জিনিসের উপরে লেখা কুরআনের এবারত একত্রিত করেন এবং হাফেজদের সঙ্গে পরামর্শ করে ও তাদের মুখস্ত থাকা বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে একখানি পূর্ণাঙ্গ কপি প্রস্তুত করেন। এভাবে একখানি নির্ভুল ও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য সংকলন প্রস্তুত হয়।
বিশেষজ্ঞদের সুত্রে জানা যায়, খলীফা উমর (আবু বকরের পর ৬৩৪ সালে খলীফা হন) পরে সমগ্র কুরআনের একটি এককখন্ড প্রস্তুত করে সংরক্ষণ করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি এ খন্ডটি তাঁর কন্যা ও নবীর বিধবা স্ত্রী হাফসাকে দিয়ে যান।
তৃতীয় খলীফা উসমান ৬৪৪ থেকে ৬৫৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। তিনি সংকলনটি আরও উন্নত ও সঙ্ঘত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন আবু বকরের আমলে প্রস্তুত করা ও তখন হাফসার হেফাজতে থাকা সংকলনটির ভিত্তিতে কাজ শুরু করেন। তারা হাফেজদের মুখস্ত থাকা বিবরণ শুনেন এবং তাদের জবানবন্দী গ্রহণ করেন। এভাবে কয়েকটি এবারতের আসল হওয়া সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষা ওঅনুসন্ধান চালান। এ ব্যাপারে কঠোরতম সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং সামান্যতম সন্দেহজনক ক্ষেত্রেও সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য না মিলে যাওয়া পর্যন্ত কোন এবারত আসল এবং নির্ভুল বলে গ্রহণ করা হয়নি। একথা সর্বজনবিদিত যে, কুরানের কতিপয় আয়াতে নির্দেশ দানের ক্ষেত্রে অপর কয়েকটি আয়াত সংশোধন করা হয়েছে। মুহাম্মদের (সঃ) নবুওতের কর্মধারা বিশ বছরের আধিক কাল যাবত বিস্তৃত ছিল, একথা মনে রাখলে এ অবস্থার একটি সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। নবী মুহাম্মদ (সঃ) রমযান মাসে সমগ্র কুরআন আবৃত্তি করার সময় যে ক্রমিকতা অনুসরণ করতেন, কমিশনও ঠিক সেই ক্রমিকতা অনুসরণ করে সূরাগুলি সেইভাবে সাজিয়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করেন।
প্রথমতিনজন খলীফা, বিশেষত উসমানের আমলে কুরআন সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল, সে সম্পর্কে অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব খুবই সহজ। নবীর ইন্তেকালের পরবর্তী প্রথম কয়েক দশকে দ্রুত প্রসার লাভ করে এবং এ প্রসার যে সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে তাদের মাতৃভাষা আরবী ছিলনা। সুতরাং অন্য ভাষায় তরজমা হওয়ার পূর্বে মূল ভাষার এবারত যাতে বিশুদ্ধ ও ইর্ভুল থাকে তাঁর নিশ্চয়তা বিধান করার প্রয়োজন ছিল। এটাই ছিল উসমান কমিশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
খলীফা উসমান ঐভাবে সংকলিত কুরআনের কপি ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রেরণ করেন এবং এ কারণেই প্রফেসর হামিদুল্লাহ বলেছেন, উসমানী সংকলনের ঐ কুরআন এখনও তাসখন্দ ও ইস্তাম্বুলের প্রাচীন সংগ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে যে সকল প্রাচীনতম কুরআনের সন্ধান পাওয়া যায়, নকল করার দু-একটি ছোটখাট ভুল ছাড়া তা সব একই প্রকারের। ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত কুরআনের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা প্রযোজ্য। (পায়রিসের বাইব্লিওথেক ন্যাশনাল পাঠাগারে প্রাচীন কুরআনের যে অংশ বিশেষ সংরক্ষিত আছে, তা খৃষ্টীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীর, অর্থাৎ হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর আমলের বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন) । ‘যা হোক আসল কথা এই যে, প্রাচীন কুরআনের যতগুলি কপির সন্ধান এযাবত পাওয়া গেছে, তার সবগুলিই একই প্রকারের। কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ত সামান্য বিভিন্নতা আছে, কিন্তু তাঁর এবারতের সাধারণ অর্থ আদৌ বদল হয়না। কোন প্রসঙ্গে যদি একাধিক প্রকারের ব্যাখ্যার সুযোগ আছে বলে দেখা যায়, তাহলে তাঁর কারণ সম্ভবত এ হতে পারে যে, কুরআনের রচনা পদ্ধতি বর্তমান কালের রচনা পদ্ধতির তুলনায় সহজ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, উচ্চারণের গতি নির্দেশক চিহ্ন (জের, জবর, পেশ প্রভৃত ) না থাকার ফলে কোন ক্রিয়াপদ সকর্মক হিসাবেও গ্রহণ করা যেতে পারে, আবার অকর্মক হিসাবেও গ্রহণ করা যেতে পারে; কোন লিঙ্গ পুংলিঙ্গ হিসাবেও গ্রহণ করা যেতে পারে, আবার স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবেও গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু বাক্যের প্রসঙ্গেই যেহেতু অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায় সেহেতু এ অসুবিধা আসলে কোণ অসুবিধাই নয়।
কুরআনের ১১৪ টি সূরা দৈর্ঘ্য অনুসারে বড় সূরার পরে ছোট সূরা সাজানো আছে; কিন্তু এ নিয়মের আবার ব্যতিক্রমও আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অহি নাযিল হওয়ার ক্রমিকতা বজায় থাকলেও সর্বত্র তা নেই। একই বিষয়ের অনেক বর্ণনা এবারতের বিভিন্ন স্থানে এসেছে; ফলে পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে মনে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, একই অনুচ্ছেদে এমন একটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ এসেছে, যা অপর একটি অনুচ্ছেদে অসম্পূর্ণ অবস্থায় বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে বর্ণিত অনেক বিষয়ের মত আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য গ্রন্থের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কোন প্রকার শ্রেণী বিভাগ করা নেই।